Friday 16 August 2019

মিউজিক হারাম হওয়ার মাসআলাহ কি ইখতিলাফী? [১ম পর্ব]


প্রাবন্ধিক: ফাদ্বীলাতুশ শাইখ ‘আব্দুল ক্বাদির বিন মুহাম্মাদ আল-জুনাইদ (হাফিযাহুল্লাহ)
·
অনুবাদকের কথা:
·
পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর:
রাসূল ﷺ যে স্বচ্ছ, নির্মল ও পরিচ্ছন্ন দ্বীন নিয়ে এসেছেন, সে দ্বীনকে আঁকড়ে ধরার মধ্যে রয়েছে মানবজাতির চূড়ান্ত সাফল্য। রাসূলের ﷺ আনীত দ্বীন—ইসলাম থেকে বিচ্যুত হওয়া মানে গোমরাহি, পথভ্রষ্টতা ও বিপথগামিতায় পতিত হওয়া। যুগে যুগে একদল সত্যপন্থি মানুষ পরিচ্ছন্ন দ্বীনের উপযুক্ত পরিচর্যা করে সফল ও কৃতকার্য হয়েছেন। আর সকল যুগেই এসব সফল মানুষের বিপরীতে একদল বাতিলপন্থি ছিল, যারা রাসূলের ﷺ দ্বীনকে বিকৃত করে এবং দ্বীনের মধ্যে নবআবিষ্কার করে ভ্রষ্ট ও বিপথগামী হয়েছে।
বর্তমান যুগেও একদল লোক রয়েছে, যারা ইসলামী দা‘ওয়াতের মোড়কে দ্বীনকে বিকৃত করছে। এদের মধ্যে অন্যতম একটি গ্রুপ হলো মডার্নিস্ট বা আধুনিকতাবাদী মুসলিমদের গ্রুপ। এরা অমুসলিমদের নিকট ইসলামকে ওয়েস্টার্নাইজ করে পেশ করে। এদের ইসলাম এমন এক মোডিফায়েড ইসলাম, যে ইসলাম প্র্যাকটিস করার জন্য আগের যুগের কথিত ‘কট্টর নিয়মনীতি’ পালন করতে হয় না।
·
অর্থাৎ, খুব সহজতর ইসলাম, যা পালন করতে অমুসলিমদের খুব একটা কষ্ট করতে হয় না, বড়ো বড়ো হারাম কাজ পরিত্যাগ করতে হয় না এবং ইসলামপূর্ব জীবনের কথিত স্বকীয়তা বর্জন করতে হয় না। আমি এসব বানিয়ে বলছি না। তাদের কিছু বক্তব্য পেশ করলে, আপনারা নিজেরাই বুঝতে পারবেন যে, এরা কোন ইসলাম প্রচার করছে—নাবাউয়ী ইসলাম না কি নিজেদের উদ্ভাবিত সহজতর ইসলাম।
তো এই আধুনিকতাবাদী মুসলিমরা বিভিন্ন হারাম কাজকে হালাল সাব্যস্ত করে থাকে। যেমন: নারী-পুরুষের সমঅধিকার, ফ্রি-মিক্সিং, নারী শাসন, নাটক-সিনেমা, গানবাজনা প্রভৃতি। যেসব লোকের মাধ্যমে মুসলিম সমাজে এই মডার্নিস্ট ইসলাম ছড়িয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো—রাশীদ রিদ্বা, জামালুদ্দীন আফগানী, মুহাম্মাদ ‘আবদুহ, ইউসুফ আল-ক্বারদ্বাউয়ী, হাসান আত-তুরাবী, মুহাম্মাদ আল-গাযালী, সালিহ আল-মুগামিসী প্রমুখ।
এখন আমরা মডার্নিস্টদের মিউজিক-বৈধকরণ প্রসঙ্গে আলোচনা করব। পাঠকদেরকে স্রেফ এতটুকু বলব যে, দেখুন, এদের দৌরাত্ম্য ও বিপথগামিতা কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে।
·
মিশরীয় ইখওয়ানীদের পত্রিকা ‘আল-ইখওয়ানুল মুসলিমূন’ ম্যাগাজিনের ১১ তম সংখ্যায় (২৯শে যুল ক্বা‘আদাহ, ১৩৭৩ হিজরী) গান ও মিউজিক প্রসঙ্গে ফাতওয়া প্রদান করা হয়েছে। ফাতাওয়া প্রদানকারী মুফতী মুহাম্মাদ আবূ যাহরাহ (মৃত: ১৩৯৪ হি./১৯৭৪ খ্রি.) বলেছেন,

بالنسبة للغناء إذا لم يكن فيه ما يثير الغريزة الجنسية فإننا لا نجد موجبًا لتحريمه، وإن العرب كانوا يرجزون ويغنون ويضربون بالدف،... مثل ذلك الموسيقي... وعلى أي حال، فمن المتفق عليه أنه ما دام لا يثير الغزيرة الجنسية، ولا يشتغل عن ذكر الله وعن الصلاة، فليس فيه ما يمس الدين.
“যেসব গানে যৌনপ্রবৃত্তি জাগ্রত করার মতো উপাদান নেই, আমরা সেসব গানকে হারাম সাব্যস্ত করার (যথার্থ) কারণ দেখি না। আরবরা ছন্দময় কবিতা আবৃত্তি করত, গান গাইত এবং দফ (একমুখী ঢোল) বাজাত। মিউজিকও এর অনুরূপ।... আর সর্বাবস্থায় সর্ববাদিসম্মত মত হলো, যেসব গান যৌনপ্রবৃত্তিকে উসকে দেয় না এবং আল্লাহ’র জিকির ও সালাত থেকে বিরত করে না, সেসব গানে দ্বীন-বিরোধী কিছু নেই।” [গৃহীত: ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ), তাহরীমু আলাতিত্ব ত্বার্ব; পৃষ্ঠা: ৫-৬; মাকতাবাতুদ দালীল কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪১৮ হি./১৯৯৮ খ্রি. (২য় প্রকাশ)]
·
এবার দেখুন, আবূ যাহরাহ’র ছাত্রদের অবস্থা। যেমন গুরু, তেমন শিষ্য। বরং মনে হয়, শিষ্য যেন আরেক কাঠি সরেস। আবূ যাহরাহ’র ছাত্র এবং ইখওয়ানী ও মডার্নিস্টদের শীর্ষস্থানীয় গুরু ড. ইউসুফ আল-ক্বারদ্বাউয়ী (জন্ম: ১৯২৬ খ্রি.) প্রণীত “আল-হালাল ওয়াল হারাম ফিল ইসলাম (ইসলামে হালাল-হারামের বিধান)” গ্রন্থটি ইখওয়ানী ও মডার্নিস্টদের অতি পছন্দের একটি বই। এই বইয়ে অনেক বড়ো বড়ো হারামকে ‘কিছুই না’ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে কি না! যাইহোক, এই বইয়ে গান ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপারে একটি পরিচ্ছেদ রচনা করা হয়েছে। পরিচ্ছেদের শুরুতেই ড. ক্বারদ্বাউয়ী সাহেব বলেছেন,
ومن اللهو الذي تستريح إليه النفوس وتطرب له القلوب وتنعم به الآذان الغناء، وقد أباحه الإسلام ما لم يشتغل على فحش أو خنا أو تحريض على إثم، ولا بأس أن تصحبه الموسيقى غير المثيرة وأستحبه في المناسبات السارة إشاعة للسرور وترويحا للنفوس، وذلك كأيام العيد والعرس وقدوم الغائب، وفي وقت الوليمة والعقيقة، وعند ولادة المولود.
উক্তিটির রেফারেন্স: আল-হালাল ওয়াল হারাম ফিল ইসলাম, পৃষ্ঠা: ২১৮; গৃহীত: ইমাম সালিহ আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ), আল-ই‘লাম বি নাক্বদি কিতাব আল-হালাল ওয়াল হারাম ফিল ইসলাম; পৃষ্ঠা: ৫৪; ২য় প্রকাশ (প্রকাশনার নামবিহীন)।
·
প্রিয় পাঠক, ড. ক্বারদ্বাউয়ী’র বইটি যেহেতু আশির দশকেই বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়েছে, আর অনুবাদও করেছেন বাংলা ভাষায় ‘লিখন জগতের দিকপাল’ খ্যাত বর্ষীয়ান লেখক মাওলানা আবদুর রহীম সাহেব (মৃত: ১৯৮৭ খ্রি.), তাই আমি নিজে উক্ত মন্তব্য অনুবাদ না করে ইখওয়ানীদের নিকট আস্থাশীল প্রকাশনা ও অনুবাদকের অনুবাদ তুলে দিচ্ছি।
মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম সাহেব অনুবাদ করেছেন, “যে কাজে সাধারণতঃ মানুষের মন আকৃষ্ট হয় ও অন্তর পরিতৃপ্তি ও প্রশান্তি লাভ করে এবং কর্ণ কুহরে মধু বর্ষিত হয়, তা হচ্ছে গান বা সঙ্গীত। ইসলামের দৃষ্টিকোণ হচ্ছে, নির্লজ্জতা, কুৎসিত-অশ্লীল ভাষা কিংবা পাপ কাজে উৎসাহ উত্তেজনা দানের সংমিশ্রণ না থাকলে তা মুবাহ্। উপরন্তু যৌন আবেগ উত্তেজনাকর বাদ্য শংমিশ্রণ (যদৃষ্ট – সংকলক: আব্দুল্লাহ মৃধা) না হলে সেই সাথে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারেও কোন দোষ নেই। আনন্দ উৎসব ক্ষেত্রে খুশী ও সন্তোষ প্রকাশের জন্যে এ সব জিনিস শুধু জায়েযই নয়, পছন্দনীয়ও বটে। যেমন ঈদ, বিয়ে, হারিয়ে যাওয়া আত্মীয়ের ফিরে আসা এবং ওয়ালীমা’র আকীকার অনুষ্ঠান ও সন্তান জন্ম হওয়াকালে এ সব ব্যবহার করা যেতে পারে দ্বিধাহীন চিত্তে।” (যদ্দৃষ্ট – সংকলক) [ইসলামে হালাল-হারামের বিধান, পৃষ্ঠা: ৪০৬-৪০৭; খায়রুন প্রকাশনী (দোকান নং- ২০৯, ৪৫ বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০) কর্তৃক প্রকাশিত]
মাওলানা আবদুর রহীম সাহেব—আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করুন এবং তাঁর ভুলত্রুটি মার্জনা করুন—মূল লেখক ড. ক্বারদ্বাউয়ী’র ব্যাপারে সুধারণা পোষণ করে লেখকের পক্ষ থেকে ওজর পেশ করেছেন এবং বলতে চেয়েছেন যে, বর্তমান সমাজে প্রচলিত গানে লেখক কর্তৃক আরোপিত শর্তসমূহ পাওয়া যায় না। কিন্তু তিনি লেখকের বাদ্যযন্ত্র তথা মিউজিক বিষয়ক বক্তব্যের খণ্ডনে কিছুই বলেননি। [প্রাগুক্ত; পৃষ্ঠা: ৪১১; অনুবাদকের টীকা দ্রষ্টব্য]
·
প্রিয় পাঠক, ড. ক্বারদ্বাউয়ী মিউজিক হালাল করার জন্য ‘ইসলামে হালাল-হারামের বিধান’ বইটির একটিমাত্র পরিচ্ছেদকে যথেষ্ট মনে করেননি। আর তাইতো তিনি এ ব্যাপারে “ফিক্বহুল গিনা ওয়াল মূসীক্বা” শিরোনামে একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন। আসুন, দেখি, স্বতন্ত্র গ্রন্থে তিনি মডার্নিস্ট হিসেবে কতটুকু আত্মপ্রকাশ করেছেন।
ইখওয়ানী ও মডার্নিস্টদের বর্তমান টপ গুরু ড. ইউসুফ আল-ক্বারদ্বাউয়ী বলেছেন,
يجب على الفقيه الذي يبحث في القضية أن يراعي هذه الآفاق كلها، ولا يركز نظره على جانب واحد، وفئة واحدة، ناسيًا أن إفريقيا كلها لا تستغني عن الغناء وتوابعه، وأن أوروبا كلها، بل الغرب كله يعتبرون الموسيقي –وخصوصا بعض أنواع منها– وسيلة للسمو بالروح والوجدان.
“একজন ফাক্বীহ, যিনি কোনো একটি বিষয়ে গবেষণা করছেন, তাঁর জন্য সকল দিক পর্যবেক্ষণ করা আবশ্যক। তিনি স্বীয় দৃষ্টিকে কোনো একটি দিকের প্রতি বা কোনো একটি সম্প্রদায়ের প্রতি সীমাবদ্ধ রাখবেন না। এ কথা বিস্মৃত হয়ে যে, পুরো আফ্রিকার অধিবাসী গান ও তৎসংশ্লিষ্ট বিষয়াদির মুখাপেক্ষী, আর পুরো ইউরোপ, বরং পুরো ওয়েস্টার্ন সোসাইটি মিউজিককে—বিশেষত কয়েক প্রকার মিউজিককে—আত্মিক প্রশান্তি লাভের মাধ্যম মনে করে।” [ড. ক্বারদ্বাউয়ী, ফিক্বহুল গিনা ওয়াল মূসীক্বা ফী দ্বাওইল কুরআনি ওয়াস সুন্নাহ; পৃষ্ঠা: ৭; মাকতাবাতু ওয়াহবাহ, কায়রো কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দ (৩য় প্রকাশ)]
·
ড. ইউসুফ আল-ক্বারদ্বাউয়ী আরও বলেছেন,
نحن اليوم نريد أن نعرض الإسلام على العالم، وأن تبلغ دعوته إلى الأمم كافة. ومنها أمم وشعوب تري الغناء والميسيقى والرقص والطرب جزءًا لا يتجزأ من حياتها، لا تعيش بدونه، ولا تهنأ لها حياة إذا حرمت منه. فكيف ترغبهم في الإسلام ونحن نحرم عليهم الغناء والميسيقى، ونتوعدهم بالرصاص المذاب يصب في آذانهم يوم القيامة، وبغيره من ألوان العذاب المهين، في حين أنهم يعتبرون الموسيقى غذاء الروح.
“বর্তমান সময়ে আমরা ইসলামকে পুরো বিশ্বের নিকট উপস্থাপন করতে চাচ্ছি। আমরা চাচ্ছি, ইসলামের দা‘ওয়াত সকল জাতির নিকট পৌঁছে যাক। এদের মধ্যে এমন কিছু জাতি ও সম্প্রদায় আছে, যারা গানবাজনা, বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্যকলাকে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করে, যা ব্যতিরেকে বেঁচে থাকা যায় না, যা থেকে বঞ্চিত হলে জীবন সুখীময় হয় না। তুমি তাদেরকে কীভাবে ইসলামের দিকে উদ্বুদ্ধ করবে, এ অবস্থায় যে, আমরা তাদের ওপর গান ও মিউজিককে হারাম করছি, তাদেরকে এ ভয় দেখাচ্ছি যে, কেয়ামতের দিন তাদের কর্ণরন্ধ্রে গলিত সীসা ঢালা হবে, এবং ভয় দেখাচ্ছি, আরও বিভিন্ন ধরনের লাঞ্ছনাকর শাস্তির? আর আমরা এসব করছি এমন সময়, যখন তারা মিউজিককে আত্মার খোরাক মনে করছে।” [প্রাগুক্ত; পৃষ্ঠা: ১৪৮]
ড. ক্বারদ্বাউয়ী’র এই কৌশলী বক্তব্যে স্থূল বুদ্ধির লোকজন খুব সহজেই ধরাশায়ী হবে, আর এমন লোকের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। আমার একজন শিক্ষক বলতেন, “পাবলিককে কোনো কাজের ব্যাপারে কনভিন্স করার জন্য কুশলী ব্যক্তি মোটা দাগের কথা (সূক্ষ্ম নয় এমন কথা) বলে থাকে। কারণ পাবলিক সূক্ষ্ম চিন্তার ধার দিয়েও যাবে না। তারা ওই মোটা দাগের কথাই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করবে।” এই কথার বাস্তবতা আছে। তাই সচেতন পাঠকদের বলব, একটু সূক্ষ্মভাবে ড. ক্বারদ্বাউয়ী’র কথা চিন্তা করুন।
·
ইসলাম আমাদেরকে এ শিক্ষা দেয়নি যে, কম্প্রোমাইজ করে হলেও—হালালকে হারাম বা হারামকে হালাল করে হলেও—ইসলামকে বিশ্ব দরবারে পেশ করতে হবে। আল্লাহ কুরআনে বারবার এটা স্পষ্ট করেছেন যে, হকপন্থি মানুষের সংখ্যা সর্বযুগে কমই থাকবে। এমনকি এজন্য তিনি অধিকাংশ লোকের অনুসরণ করতে নিষেধও করেছেন। তিনি বলেছেন, وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ ۚ إِنْ يَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلَّا يَخْرُصُونَ “আর যদি তুমি ভূপৃষ্ঠের অধিকাংশ মানুষের আনুগত্য করো, তবে তারা তোমাকে আল্লাহ’র পথ থেকে বিচ্যুত করবে। তারা শুধু ধারণারই অনুসরণ করে এবং তারা শুধু অনুমানই করে।” [সূরাহ আন‘আম: ১১৬]
ক্বারদ্বাউয়ী সাহেব শরিয়তের বিধান সাব্যস্ত করার জন্য কাফির, মুশরিক, ইহুদি, খ্রিষ্টান ও নাস্তিকদের লাইফ স্টাইলের দিকে নজর দিতে বলছেন। কেন? এজন্য নজর দিতে বলছেন, যেন তাদের চিত্তাকর্ষক লাইফ স্টাইলের কোনো বিষয়কে হারাম সাব্যস্ত করার দরুন তাদের কষ্ট ভোগ করতে না হয়! এই ফালতু কথা তিনি কোথায় পেলেন? আহলুস সুন্নাহ’র কোনো একজন ফাক্বীহ কি এ কথা বলেছেন?!
অথচ মহান আল্লাহ স্পষ্টতই বলেছেন, ثُمَّ جَعَلْنَاكَ عَلَىٰ شَرِيعَةٍ مِنَ الْأَمْرِ فَاتَّبِعْهَا وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ. إِنَّهُمْ لَنْ يُغْنُوا عَنْكَ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا ۚ وَإِنَّ الظَّالِمِينَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ ۖ وَاللَّهُ وَلِيُّ الْمُتَّقِين “তারপর আমি তোমাকে দ্বীনের এক বিশেষ বিধানের ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছি। সুতরাং তুমি তার অনুসরণ করো এবং অজ্ঞদের প্রবৃত্তির অনুসরণ কোরো না। তারা আল্লাহ’র মোকাবেলায় তোমার কোনো কাজে আসবে না। নিশ্চয় জালেমরা হলো একে অপরের বন্ধু, আর আল্লাহ মুত্তাক্বীদের বন্ধু।” [সূরাহ জাসিয়াহ: ১৭-১৮]
·
পাশ্চাত্যপ্রেমী মডার্নিস্টদের মনে রাখা উচিত, মহান আল্লাহ কাফিরদের লাইফ স্টাইল পর্যবেক্ষণ করা এবং তাদের জন্য—স্বীয় দ্বীনের ক্ষেত্রে—কম্প্রোমাইজ করার চিন্তাধারাকে চরমভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَبِّكُمْ ۖ فَمَنْ شَاءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاءَ فَلْيَكْفُرْ “আর বল, ‘সত্য তোমাদের রবের পক্ষ থেকে। সুতরাং যে চায় সে ঈমান আনুক, আর যে চায় করে সে কুফরি করুক’।” [সূরাহ কাহাফ: ২৯]
অথচ ড. ক্বারদ্বাউয়ী কাফির-মুশরিকদের জন্য কম্প্রোমাইজ করতে করতে এ পর্যায়ে পৌঁছেছেন যে, তিনি কাফিরদেরকে আল্লাহ’র ভয় দেখানো থেকে কঠিনভাবে বারণ করছেন। তিনি চাচ্ছেন, যেন কাফিরদেরকে আল্লাহ’র ভয় দেখানো না হয়! তাঁর বক্তব্য সুস্পষ্ট। কিন্তু যখনই আমরা তাঁর ভুল ধরতে যাব, বা তাঁর বিরুদ্ধে বলতে যাব, তখনই বলা হবে, “তিনি এর দ্বারা ইসলামকে বিকৃত করতে চাননি, হারামকে হালাল করতে চাননি।” আল্লাহুল মুস্তা‘আন।
·
সুপ্রিয় পাঠক, মুফতী আবূ যাহরাহ’র কথা মনে আছে নিশ্চয়ই? হ্যাঁ, এই মুফতী সাহেবের আরেক ছাত্র, ইখওয়ানীদের এক ফিগারহেড, মুহাম্মাদ আল-গাযালী (মৃত: ১৪১৬ হি./১৯৯৬ খ্রি.) ড. ক্বারদ্বাউয়ী’র শেষোক্ত বক্তব্যের মতোই মন্তব্য পেশ করেছেন। বর্তমান মডার্নিস্টদের মহামান্য গুরু মুহাম্মাদ আল-গাযালী মিউজিককে হারাম সাব্যস্তকারী হাদীসগুলোর ওপর সর্বশক্তি দিয়ে সাঁড়াশি হামলা চালিয়েছেন। তারপর তিনি খোঁড়া যুক্তি পেশ করে বলেছেন,
إني أطلب من الأروبيين وغيرهم ترك التجسيد والتعديد لإصلاح عقائدهم فهل أضع عائقًا أمام هذا الإصلاح الخطير بدعوتهم إلى ترك الغناء والموسيقى؟
“আমি ইউরোপের অধিবাসী ও অন্যান্য (অমুসলিম) ব্যক্তিবর্গের ‘আক্বীদাহ পরিশুদ্ধ করার জন্য তাদের নিকট থেকে এই প্রত্যাশা করছি যে, তারা দৈহিক মূর্তি নির্মাণ এবং মৃতের জন্য বিলাপ পরিত্যাগ করবে। এখন তাদেরকে গান ও মিউজিক বর্জনের দা‘ওয়াত দিয়ে আমি কি এই গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারকাজের সম্মুখে কোনো প্রতিবন্ধকতা পেশ করতে পারি?” [মুহাম্মাদ আল-গাযালী, আস-সুন্নাতুন নাবাউয়িয়্যাহ বাইনা আহলিল ফিক্বহি ওয়া আহলিল হাদীস; পৃষ্ঠা: ৯২-৯৩; দারুশ শুরূক্ব কর্তৃক প্রকাশিত (৬ষ্ঠ প্রকাশ)]
এ কথা বলার পূর্বে মুহাম্মাদ আল-গাযালী বলেছেন,
أظن الأحاديث التي وردت في ليلة النصف أقوي من الأحاديث التي وردت في تحريم الغناء.
“আমি মনে করি, মধ্য শা‘বানের ব্যাপারে যেসব হাদীস বর্ণিত হয়েছে, সেগুলো গান হারাম হওয়ার ব্যাপারে বর্ণিত হাদীসের চেয়ে বেশি শক্তিশালী।” [প্রাগুক্ত; পৃষ্ঠা: ৮১] অর্থাৎ, গানকে হারাম সাব্যস্তকারী হাদীসগুলো তাঁর নিকট অগ্রহণযোগ্য, বাতিল।
·
মডার্নিস্টরা মিউজিককে হালাল সাব্যস্ত করার জন্য আরও যেসব মুফতী সাহেবের বক্তব্য রেফারেন্স হিসেবে পেশ করে থাকে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন ‘আলী আত্ব-ত্বানত্বাউয়ী (মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.), যাঁর বইপুস্তক বাংলাদেশের আহলেহাদীস দা‘ঈরা পর্যন্ত অনুবাদ করে থাকেন, যা বাঙালি সালাফীদের জন্য খুবই দুঃখজনক একটি ব্যাপার। উল্লেখ্য যে, সালাফিয়্যাহ’র ইমাম, বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও মুজাদ্দিদ, ‘আল্লামাহ আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন, “জনাব ‘আলী আত্ব-ত্বানত্বাউয়ী সিরিয়ায় সালাফী দা‘ওয়াতের শত্রু ছিলেন। একারণে যে, উক্ত দা‘ওয়াত কুরআন-সুন্নাহ অনুসরণ করার দিকে মানুষকে আহ্বান করে।” [দ্র.: https://ar.alnahj.net/audio/1103.]
তো ‘আলী ত্বানত্বাউয়ী সাহেব মিউজিক হালাল করার জন্য বিভিন্ন ফিক্বহী মূলনীতি পেশ করার পর বলেছেন,
فليس الغناء والموسيقى مما استقبحه الشرع لذاته، لكن يطرأ عليهما التحريم في حالات، ... فما لم يكن فيه شيء من ذلك، كأن يغني المرء أو يعزف لنفسه في وقت فراغه، أو تغني المرأة لزوجها أو للنساء، أو أن يغني الرجل للرجال بالشروط التي سبق ذكرها، أو يسمع الغناء من الراد بهذه الشروط، فهو على الإباحة الأصلية.
“গান ও মিউজক সত্ত্বাগতভাবে শরিয়ত কর্তৃক নিন্দিত বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে এ দুটি বিষয় হারাম হয়ে যায়।... যে গান বা মিউজিকে উল্লিখিত বিষয়ের কোনো কিছু পাওয়া যায় না। যেমন: কোনো পুরুষ অবসর সময়ে নিজে নিজে গান গায়, অথবা বাদ্যযন্ত্র বাজায়, কিংবা কোনো মহিলা তাঁর স্বামী বা অন্য মহিলাদের নিকট গান গায়, অথবা কোনো পুরুষ অন্য পুরুষদের নিকট গান গায়, উল্লিখিত শর্ত পূরণ করে, অথবা এসব শর্ত পূরণ করে রেডিয়ো থেকে গান শোনে, তাহলে এর বিধান হলো—এটি মৌলিকভাবে বৈধ।” [ফাতাওয়া ‘আলী আত্ব-ত্বানত্বাউয়ী, পৃষ্ঠা: ১০৮-১০৯; দারুল মানারাহ, জেদ্দা কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪০৫ হি./১৯৮৫ খ্রি. (১ম প্রকাশ)]
·
অনুরূপভাবে আরেকজন প্রথিতযশা দা‘ঈ—যাঁর বক্তব্যকে মডার্নিস্টরা মিউজিক হালালের রেফারেন্স হিসেবে পেশ করে—হলেন মাসজিদে কুবার ইমাম এবং অসংখ্য বিদ‘আতী কথার কথক জনাব সালিহ আল-মুগামিসী (জন্ম: ১৩৮৩ হি./১৯৬৩ খ্রি.)। সালিহ আল-মুগামিসী সাহেব তাঁর একাধিক প্রোগ্রামে সফট মিউজিককে হালাল বলে উল্লেখ করেছেন এবং নিঃশর্তভাবে ‘সকল মিউজিক হারাম’ বলার বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেছেন,
أنا لا أرى أن الميسيقى على إطلاقها حرام، لا بد أن يفرق في استخدامها، الموسيقى على إطلاقها حرام—فيه نظر.
“আমি এ মত পোষণ করি না যে, নিঃশর্তভাবে সকল মিউজিক হারাম। মিউজিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই পার্থক্য করতে হবে। নিঃশর্তভাবে সকল মিউজিক হারাম—কথাটির মধ্যে চিন্তাভাবনার অবকাশ আছে।” [দ্র.: https://m.youtube.com/watch?v=1L9a5A55t0E.]
·
সম্ভবত নিজেদের ইখওয়ানী গুরুদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই বাংলাদেশের জামাতী বক্তা জনাব মিজানুর রহমান আজহারী সাহেব—যিনি কি না ইখওয়ানী ও অজ্ঞ তরুণদের আদর্শ এবং অসংখ্য বিদ‘আতী কথা বলার মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টিকারী মৌলবি—তাঁর একটি ভিডিয়ো ক্লিপে মিউজিকের ব্যাপারে বলেছেন, “মিউজিকের ব্যাপারে ইখতিলাফ আছে। তবে উত্তম হচ্ছে সব ধরনের মিউজককে বর্জন করা।... তবে স্কলাররা যেটার ক্ষেত্রে ফ্লেক্সিবিলিটি দিয়েছেন, সেটা হচ্ছে মাইল্ড মিউজিক। যেখানে কণ্ঠের বিষয়টাই প্রাধান্য পাবে, আর কণ্ঠের পিছনে হালকা কী-বোর্ডের টিউন থাকতে পারে, হালকা-সামান্য রেদম থাকতে পারে। মাইল্ড মিউজিকের ব্যাপারে অনেক স্কলাররা এটাকে পারমিসেবল বলেছেন।” (যদ্দৃষ্ট – সংকলক) [দ্র.: https://youtu.be/zgMtznqW7MA.]
সুপ্রিয় পাঠক, কিছু লোক ‘মিউজিকের ব্যাপারে ইখতিলাফ আছে’—বলে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করতে চান এবং মিউজিকের ব্যাপারটিকে সামান্য বা ক্ষুদ্র হিসেবে প্রদর্শন করতে চান। কিন্তু আসল কথা হলো, মিউজিক হারাম হওয়ার ব্যাপারে পূর্ববর্তী ‘উলামায়ে সুন্নাহ ঐক্যমত পোষণ করেছেন। এখনো তো অনুবাদকের ভূমিকাই পড়ছেন। ব্যাপক তথ্যসমৃদ্ধ মূল প্রবন্ধ পড়লে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত জ্ঞান লাভ করতে পারবেন, ইনশাআল্লাহ।
·
যাইহোক, বিপথগামী দা‘ঈদের বক্তব্য অনেক জানা হলো। আসুন, আহলুস সুন্নাহ’র একজন মহান ইমামের মুখে গানবাজনার ব্যাপারে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো কিছু কথা শুনি। যুগের সেরা মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] বলেছেন,
ومعلوم عند الخاصة والعامة أن فتنة سماع الغناء والمعازف أعظم من فتنة النوح بكثير، والذي شاهدناه نحن وغيرنا وعرفناه بالتجارب: أنه ما ظهرت المعازف وآلات اللهو في قوم وفشت فيهم واشتغلوا بها إلا سلط الله عليهم العدو ويبلوا بالقحط والجدب وولاة السوء، والعاقل يتأمل أحوال العالم وينظر، والله المستعان.
“সকল বিশিষ্ট ও সাধারণ ব্যক্তির নিকট একটি সুবিদিত বিষয় হলো, গান ও বাদ্যযন্ত্র শ্রবণের ফিতনা নূহের ফিতনার চেয়েও বড়ো। আমরা এবং আমরা ছাড়াও অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ—প্রত্যক্ষ করেছি এবং অভিজ্ঞতার আলোকে জেনেছি, যে সম্প্রদায়ের মধ্যেই বাদ্যযন্ত্র প্রকাশিত হয়, তাদের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে, আর সম্প্রদায়ের লোকেরাও তা নিয়ে মত্ত হয়, সে সম্প্রদায়ের ওপরই আল্লাহ শত্রুদের আধিপত্য দিয়ে দেন, এবং তাদেরকে দুর্ভিক্ষ, অনাবৃষ্টি ও মন্দ শাসকদের মাধ্যমে বিপদগ্রস্ত করেন। বস্তুত জ্ঞানী ব্যক্তি জগতের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে এবং তা নিয়ে চিন্তা ও গবেষণা করে। আল্লাহুল মুস্তা‘আন।” [মাদারিজুস সালিকীন, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৫০০; তাহক্বীক্ব: মুহাম্মাদ হামিদ আল-ফাক্বী; দারুল কিতাবিল ‘আরাবী, বৈরুত কর্তৃক প্রকাশিত; প্রকাশকাল: ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দ; গৃহীত: শাইখ ‘আব্দুল্লাহ বিন রামাদ্বান মূসা, আর-রাদ্দু ‘আলাল ক্বারদ্বাউয়ী ওয়াল জুদাঈ‘; পৃষ্ঠা: ১১; আল-আসারিয়্যাতু লিত তুরাস, ইরাক কর্তৃক প্রকাশিত; প্রকাশকাল: ১৪২৮ হি./২০০৭ খ্রি. (১ম প্রকাশ)]
·
সুপ্রিয় পাঠক, উপরিউক্ত আলোচনা পড়ে নিশ্চয় উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, এ বিষয়ে আলোচনা করা কতটা জরুরি। আমরা বিষয়টি উপলব্ধি করে এ ব্যাপারে একটি সংক্ষিপ্ত, তথ্যসমৃদ্ধ ও সারগর্ভ আরবি প্রবন্ধ অনুবাদ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যে প্রবন্ধের অনুবাদ এখন আপনার হাতে রয়েছে। এই প্রামাণ্য প্রবন্ধটি লিখেছেন সৌদি আরবের প্রখ্যাত দা‘ঈ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ ‘আব্দুল ক্বাদির বিন মুহাম্মাদ আল-জুনাইদ (হাফিযাহুল্লাহ)। আরবি প্রবন্ধটির নাম—তাযকীরুল খা’ইফীনাল গায়ূরিয়্যিঈন বি আন্নাল মূসীক্বা মুহাররামাতুম বি ইজমা‘ই আ’ইম্মাতিদ দীন।
উক্ত প্রবন্ধে শাইখ জুনাইদ (হাফিযাহুল্লাহ) তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপে আলোচনা করেছেন। প্রথমত, শাইখ (হাফিযাহুল্লাহ) মিউজিক হারাম হওয়ার ব্যাপারে ‘উলামাদের তাহক্বীক্ব-সহ তিনটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন এবং হাদীসগুলো থেকে দলিল গ্রহণের পদ্ধতি উল্লেখ করেছেন। দ্বিতীয়ত, মিউজিক হারাম হওয়ার ব্যাপারে পূর্ববর্তী ‘আলিমগণের যে ইজমা‘ (মতৈক্য) সংঘটিত হয়েছে, সে ব্যাপারে ২৫ জন ডাকসাইটে ফাক্বীহ ও মুহাদ্দিসের অবস্থান চমৎকারভাবে সংকলন করেছেন। তৃতীয়ত, যারা মিউজিককে হালাল ফতোয়া দেয়, কিংবা যারা বলে, “মিউজিকের ব্যাপারে ‘উলামাদের মধ্যে ইখতিলাফ রয়েছে”, তাদের উক্ত কথা ও কর্মের ভয়াবহ ক্ষতি ও অনিষ্টতা প্রসঙ্গে সারগর্ভ আলোচনা করেছেন।
তাহলে আর দেরি কেন? চলুন, পড়ে ফেলি তথ্যবহুল নিবন্ধটি, সমৃদ্ধ করি আমাদের জ্ঞান-ভাণ্ডার, আর শাণিত করি আমাদের অবিচল বিশ্বাসকে। ওয়া বিল্লাহিত তাওফীক্ব।
·
মূল প্রবন্ধের অনুবাদ:
·
যাবতীয় প্রশংসা মহান আল্লাহ’র জন্য, যিনি হারাম থেকে হালালকে আলাদা করে বর্ণনা দিয়েছেন, বাতিল থেকে হককে পৃথক করেছেন এবং সুস্পষ্ট শার‘ঈ দলিলের মাধ্যমে প্রত্যেক জ্ঞানবান ব্যক্তির ওপর হুজ্জাহ (দলিল/প্রমাণ) প্রতিষ্ঠা করেছেন। দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক তাঁর ওপর এবং তাঁর স্ত্রীবর্গ, সন্তানাদি, অবশিষ্ট পরিবার পরিজন ও সঙ্গীবর্গের ওপর, যাঁকে মহান আল্লাহ প্রেরণ করেছেন বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ, অজ্ঞদের জন্য পথপ্রদর্শকস্বরূপ এবং পথভ্রষ্টদের জন্য হেদায়াতস্বরূপ। এরপর যিনি রিসালাত পৌঁছিয়ে দিয়েছেন, দলিল স্পষ্ট করেছেন এবং অজ্ঞতা দূর করেছেন। ফলে যিনি ওজর পেশকারীর জন্য কোনো ওজর এবং দলিল পেশকারীর জন্য কোনো দলিল অবশিষ্ট রাখেননি।
অতঃপর, হে সম্মাননীয় ব্যক্তিবর্গ! আল্লাহ আপনাদেরকে মৃত্যু অবধি তাঁর সঠিক দ্বীন আঁকড়ে ধরার সামর্থ্য দিয়ে সুসজ্জিত করুন। নিঃসন্দেহে আমরা এমন যুগে বাস করছি, যে যুগে ফিতনা হু হু করে বেড়ে চলেছে, অনিষ্ট বিস্তৃতি লাভ করছে এবং মন্দকর্ম বৃদ্ধি পেয়েছে। যেসব অনিষ্ট ও মন্দকর্ম উৎক্ষেপণ করছে একদিক থেকে বিদ‘আত ও ভ্রষ্টতার দা‘ঈবর্গ, এবং অপর দিক থেকে অন্যায় ও আমোদপ্রমোদের দা‘ঈবর্গ। তারা বিপুল পরিমাণ লোককে প্রভাবিত করেছে। হারাম কাজ করা এবং ভুল কাজ সংঘটন করাকে তারা সহজভাবে নিচ্ছে। ফলে তাদের দেশে, মজলিসে ও বৈঠকে হারাম কর্মাবলি ছড়িয়ে পড়েছে।
·
জেনে রাখুন! নিশ্চয়ই তারা যেসব ভয়ংকর অন্যায় ও ফিতনা জনসাধারণের মধ্যে উৎক্ষেপণ করেছে, যেসব ভয়াবহ মন্দকর্ম জনসাধারণের জন্য সহজসাধ্য করেছে, যেসব ভয়ানক অপরাধ তাদের মজলিস ও সমাজে বৃদ্ধি করেছে এবং যেসব বাতিল ও হারাম কথার বিস্তার ঘটিয়েছে, সেসবের মধ্যে অন্যতম হলো—
প্রথমত, এই ফতোয়া দেওয়া যে, মিউজিক শোনা এবং বাদ্যযন্ত্র বাজানো হালাল, শার‘ঈ দৃষ্টিকোণ থেকে এতে কোনো সমস্যা নেই।
দ্বিতীয়ত, মিউজিকের বিধান বর্ণনা করতে গিয়ে ভাগ করা। অর্থাৎ, হট্টগোলপূর্ণ ও কামোদ্দীপক মিউজিক হারাম, আর প্রশান্ত ও সামরিক মিউজিক হালাল।
তৃতীয়ত, মিউজিক শোনা এবং বাদ্যযন্ত্র বাজানোর ব্যাপারে ফতোয়া জিজ্ঞেস করা হলে, এভাবে উত্তর দেওয়া যে, এর বিধানের ব্যাপারে ‘আলিমগণ (রাহিমাহুল্লাহ) মতদ্বৈধতা করেছেন, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ এটাকে হালাল বলেছেন, আবার কেউ কেউ হারাম বলেছেন।
·
অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, কিছু স্যাটেলাইট চ্যানেল, বিভিন্ন রেডিয়ো স্টেশন ও পত্রপত্রিকায় এই কথা জনসাধারণের কর্ণকুহরে এবং জনগণের চোখের সামনে পেশ করেছেন এমন কতিপয় ব্যক্তি, যাঁরা নিজেদেরকে দিকনির্দেশনা প্রদান, উপদেশদান ও ফতোয়া প্রদানের ক্ষেত্রে প্রধান বানিয়ে নিয়েছেন, অথবা তাঁদেরকে প্রধান বানানো হয়েছে। কিংবা এসব কথা তাঁরা বলেছেন, যাঁরা দারস প্রদান, খুতবা পাঠ ও ইমামতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সাথে জড়িত। আর তাঁরা এই কথা তাঁদের বিভিন্ন প্রবন্ধ, বইপুস্তক, প্রোগ্রাম, সাক্ষাৎকার এবং (সোশ্যাল মিডিয়ায়) টুইটের মধ্যে বলেছেন।
এই সম্প্রদায় যদি তাদের প্রদত্ত ফতোয়ার ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তা ও পর্যবেক্ষণ অব্যাহত রাখে, তাহলে অবশ্যই তারা জানতে পারবে যে, এসব ফতোয়া দেওয়ার মাধ্যমে তারা নিজেদের ওপর মহাঅনিষ্ট ও ভয়াবহ অপকারিতা জমা করেছে, এসব অনিষ্টকে তারা আরও বড়ো বিপর্যয়ের দিকে পরিচালিত করেছে এবং অসংখ্য ধ্বংসকারী বিষয় আনয়ন করেছে।
এসব অনিষ্ট, বিপর্যয় ও বিপদের অন্তর্ভুক্ত হলো: তারা নিজেদেরকে সে সমস্ত কাজ হালাল করার সাথে জড়িয়ে ফেলেছে, যে সমস্ত কাজ মহান আল্লাহ স্বীয় বান্দাদের ওপর হারাম করেছেন। যেমন তারা জনসাধারণের জন্য মিউজিক শোনা এবং বাদ্যযন্ত্র বাজানো হালাল করেছে। অথচ মিউজিক বাজানো ও তা শোনা সরাসরি নাবাউয়ী সুন্নাহ’র দলিল এবং শরিয়তের জ্ঞান রাখেন এমন ‘আলিমদের ইজমা‘র (মতৈক্য) মাধ্যমে হারাম সাব্যস্ত হয়েছে, এ ব্যাপারে ‘আলিমদের মধ্যে কোনো মতানৈক্য নেই।
·
এ ব্যাপারে নাবাউয়ী সুন্নাহ’য় বর্ণিত কিছু হাদীস নিম্নে উল্লিখিত হলো:
১ম হাদীস:
আবূ ‘আমির কিংবা আবূ মালিক আশ’আরী (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি নাবী ﷺ কে বলতে শুনেছেন, لَيَكُونَنَّ مِنْ أُمَّتِي أَقْوَامٌ يَسْتَحِلُّونَ الحِرَ، وَالحَرِيرَ، وَالخَمْرَ، وَالمَعَازِفَ “আমার উম্মাতের মধ্যে অবশ্যই এমন কতগুলো দলের সৃষ্টি হবে, যারা ব্যভিচার, রেশমী কাপড়, মদ ও মা‘আযিফকে (বাদ্যযন্ত্র) হালাল বলে বিশ্বাস করবে।” [সাহীহ বুখারী, হা/৫৫৯০]
মা‘আযিফ হলো বাদ্যযন্ত্র, যা দিয়ে গান বাজানো হয়। যেমন: বীণা, বাঁশি, তবলা, তাম্বুরা, ক্লাইনেট, মন্দিরা প্রভৃতি।
এমনকি ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, المعازف هي آلات اللهو كلها، لا خلاف بين أهل اللغة في ذلك “সকল প্রকার বাদ্যযন্ত্রই মা‘আযিফ। এ ব্যাপারে ভাষাবিদদের মধ্যে কোনো মতপার্থক্য নেই।” [ইগাসাতুল লাহফান মিন মাসা’ইদিশ শাইত্বান; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২৯১]
এই হাদীস প্রমাণ করছে যে, বাদ্যযন্ত্র বাজানো এবং তা শ্রবণ করা হারাম। এই হারাম সাব্যস্তকরণ তিনটি দিক থেকে গ্রহণ করা হয়েছে:
এক. নাবী ﷺ হাদীসটিতে বলেছেন, ‘...হালাল বলে বিশ্বাস করবে (َيَسْتَحِلُّوْن)’। আর ইস্তিহলাল (الاستحلال) তথা হালাল বলে বিশ্বাস করা হয় কেবল সে বিষয়কেই, যে বিষয়টি হারাম।
দুই. নাবী ﷺ বাদ্যযন্ত্রের ইস্তিহলালকে মিলিত করেছেন মদ, ব্যভিচার ও রেশমী কাপড়ের ইস্তিহলালের সাথে। আর এ বিষয়গুলো যে হারাম, তা শরিয়তে ব্যাপক প্রসিদ্ধ এবং মুসলিমদের নিকট সুবিদিত।
তিন. এই বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে তাদের প্রতি নিন্দা ও কদর্যতার ভঙ্গিতে, যারা এই ইস্তিহলালের মধ্যে পতিত হয়েছে।
এটি বিশুদ্ধ হাদীস। বিভিন্ন যুগ, অঞ্চল ও মাযহাবের অসংখ্য ‘আলিম এই হাদীসকে বিশুদ্ধ বলেছেন। যাঁরা এই হাদীসকে বিশুদ্ধ বলেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন—বুখারী, ইসমা‘ঈলী, বুরক্বানী, ইবনু হিব্বান, ইবনুস সালাহ, ইবনু তাইমিয়্যাহ, ইবনুল ক্বাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ, ইবনু কাসীর, ইবনু রজব আল-হাম্বালী, ইবনু জামা‘আহ, ইবনু বাদরান আদ-দাশতী আল-হানাফী, ইবনুল মুলক্বিন, যাইনুদ্দীন আল-‘ইরাক্বী, বাদরুদ্দীন আল-‘আইনী, নূরুদ্দীন আল-হাইসামী, ইবনু হাজার আল-‘আসক্বালানী, ইবনু হাজার আল-হাইতামী, আস-সাখাউয়ী, আস-সুয়ূত্বী, ইবনুল ওয়াযীর, ইবনুল আমীর আস-সান‘আনী, আহমাদ শাকির, মুহাম্মাদ আল-আমীন আশ-শানক্বীত্বী, আলবানী, ইবনু বায, ‘উসাইমীন, মুক্ববিল আল-ওয়াদি‘ঈ, মুহাম্মাদ ‘আলী আদাম আল-ইতয়ূবী।
·
২য় হাদীস:
‘আব্দুল্লাহ বিন ‘আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, إِنَّ اللهَ حَرَّمَ عَلَيْكُمُ الْخَمْرَ، وَالْمَيْسِرَ، وَالْكُوبَةَ “নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ওপর হারাম করেছেন মদ, জুয়া এবং কূবাহ (তবলা)।” [মুসনাদে আহমাদ, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২৭৮, ২৮৯ ও ৩৫০; আবূ দাঊদ, হা/৩৬৯৬; হাদীসের শব্দগুচ্ছ আহমাদের]
অসংখ্য ‘আলিম এই হাদীসকে সাহীহ তথা বিশুদ্ধ বলেছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইবনু হিব্বান, বাদরুদ্দীন আল-‘আইনী, ইবনুল মুলক্বিন, ইবনু হাজার আল-হাইতামী, আহমাদ শাকির এবং আলবানী।
কূবাহ হলো তবলা বা ঢোল। যেমনটি বলেছেন ইবনুল আ‘রাবী, ইবনু দুরাইদ, আল-জাওহারী, ইবনু ফারিস, ইবনু সাইয়্যিদাহ প্রমুখ ভাষাবিদ (রাহিমাহুমুল্লাহ)। অনুরূপভাবে ব্যাখ্যা করেছেন হাদীসটির বর্ণনাকারী ‘আলী বিন বাযীমাহ (রাহিমাহুল্লাহ) এবং একদল ইমাম।
এই হাদীস থেকে দলিল গ্রহণ করার দিক:
হাদীসটিতে একটি বাদ্যযন্ত্র হারাম করা হয়েছে, যা সবচেয়ে কম সুর আনয়নকারী বাদ্যযন্ত্রগুলোর একটি। তাহলে যেসব বাদ্যযন্ত্র বেশি সুর আনয়ন করে, সেগুলোর বিধান কী হতে পারে?
·
৩য় হাদীস:
‘আমির বিন সা‘দ আল-বাজালী (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, دَخَلْتُ عَلَى أَبِي مَسْعُودٍ وَأُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ وَثَابِتِ بْنِ زَيْدٍ وَجَوَارٍ يَضْرِبْنَ بِدُفٍّ لَهُنَّ وَتُغَنِّينَ، فَقُلْتُ: أَتُقِرُّونَ بِذَا وَأَنْتُمْ أَصْحَابُ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ قَالَ: إِنَّهُ قَدْ رُخِّصَ لَنَا فِي الْعُرْسِ “আমি আবূ মাস‘ঊদ, উবাই বিন কা‘ব এবং সাবিত বিন যাইদের নিকট প্রবেশ করলাম, এমতাবস্থায় সেখানে কয়েকজন বালিকা দফ বাজাচ্ছিল এবং গান গাইছিল। আমি বললাম, আপনারা এটা সমর্থন করছেন, অথচ আপনারা কি না মুহাম্মাদ ﷺ এর সাহাবী?! তিনি বললেন, বিবাহের ক্ষেত্রে আমাদেরকে এ কাজের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।” [নাসাঈ, হা/৩৩৮৫; হাকিম, খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ১৮৩-১৮৪; ত্বাবারানী’র মু‘জামুল কাবীর, হা/৬৯০; খণ্ড: ১৭; পৃষ্ঠা: ২৪৭; বাইহাক্বী, খণ্ড: ৭; পৃষ্ঠা: ২৮৯; হাদীসের শব্দগুচ্ছ ত্বাবারানী’র]
হাদীসটিকে সাহীহ বলেছেন হাকিম, যাহাবী ও আলবানী। আর হাদীসটিকে হাসান বলেছেন মুহাম্মাদ ‘আলী আদাম আল-ইসয়ূবী। দারাকুত্বনী হাদীসটিকে ‘আল-ইলযামাত’ এর মধ্যে উল্লেখ করেছেন।
এই হাদীস থেকে দলিল গ্রহণের দিক:
বিবাহের ক্ষেত্রে মহিলাদের জন্য দফ বাজানোর অনুমতি প্রমাণ করছে যে, বিবাহ ব্যতিরেকে সার্বজনিক জনসাধারণের জন্য দফ বাজানো নিষিদ্ধ। আর দফ হলো সবচেয়ে কম সুর আনয়নকারী বাদ্যযন্ত্রগুলোর একটি। তাহলে যেসব বাদ্যযন্ত্র বেশি সুর আনয়ন করে, সেগুলোর বিধান কী হতে পারে?
[আগামী পর্বে সমাপ্য, ইনশাআল্লাহ]
·
অনুবাদক: মুহাম্মাদ ‘আব্দুল্লাহ মৃধা

No comments:

Post a Comment

Download AsPDF

Print Friendly and PDFPrint Friendly and PDFPrint Friendly and PDF
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...