Friday 16 August 2019

কুরবানিদাতার জন্য যুলহাজ্ব মাসের প্রথম দশ দিন নখ-চুল না কাটা ওয়াজিব


·
পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। সকল প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি।
মাসআলাহটি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণে এবং এ সম্পর্কে সঠিক বিধান আমাদের অনেকেরই অজানা থাকার কারণে এ নিয়ে শরিয়তের বিধান লোকদেরকে জানানো কর্তব্য মনে করছি। আর যারা জানেন, তাদের জন্যও একটা রিমাইন্ডার হয়ে যাবে। যাইহোক, বেশি কথা না বাড়িয়ে সরাসরি আলোচনায় চলে যাই। মূলত এ ব্যাপারে যুগশ্রেষ্ঠ ‘আলিমগণের বক্তব্য সরল বাংলায় উপস্থাপন করব। আর আজকের লেখায় অভিনব একটি পদ্ধতি ফলো করব। আশা করি, এই পদ্ধতি অধিক ফলপ্রসূ হবে, ইনশাআল্লাহ। ওয়া মা তাওফীক্বী ইল্লা বিল্লাহ, ‘আলাইহি তাওয়াক্কালতু ওয়া ইলাইহি উনীব।
·
যদি যুলহাজ্ব মাস সাব্যস্ত হয়, তাহলে যে ব্যক্তি কুরবানি দেওয়ার ইচ্ছা বা সংকল্প করেছে, তার জন্য ওয়াজিব হলো—কুরবানির পশু জবেহ না করা পর্যন্ত তার শরীরের কোনো লোম, চুল, নখ ও চামড়া না কাটা। উম্মুল মু’মিনীন উম্মু সালামাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) কর্তৃক বর্ণিত, নাবী ﷺ বলেছেন, إِذَا رَأَيْتُمْ هِلاَلَ ذِي الْحِجَّةِ وَأَرَادَ أَحَدُكُمْ أَنْ يُضَحِّيَ فَلْيُمْسِكْ عَنْ شَعْرِهِ وَأَظْفَارِه “যখন তোমরা যুলহাজ্ব মাসের নতুন চাঁদ (হিলাল) দেখবে এবং তোমাদের মধ্যে কেউ কুরবানি করার ইচ্ছা করবে, তখন সে যেন (কুরবানি না করা পর্যন্ত) তার চুল ও নখ (কাটা) থেকে বিরত থাকে।” [সাহীহ মুসলিম, হা/১৯৭৭; ‘কুরবানি’ অধ্যায় (৩৬); পরিচ্ছেদ- ৭]
উম্মু সালামাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে, নাবী ﷺ বলেছেন, إِذَا دَخَلَتِ الْعَشْرُ وَأَرَادَ أَحَدُكُمْ أَنْ يُضَحِّيَ فَلاَ يَمَسَّ مِنْ شَعَرِهِ وَبَشَرِهِ شَيْئًا “যখন (যুলহাজ্ব মাসের) প্রথম দশদিন উপস্থিত হয়, আর তোমাদের কেউ কুরবানি করার ইচ্ছা করে, তবে সে যেন তার চুল ও চামড়ার কিছুই স্পর্শ না করে (কর্তন না করে)।” [সাহীহ মুসলিম, হা/১৯৭৭; হাদীস দুটি একই নম্বরের আওতায় বর্ণিত হয়েছে শাইখ ফুআদ ‘আব্দুল বাক্বীর তারক্বীম (নাম্বারিং) অনুযায়ী]
·
মাসায়েল:
এই আলোচনা থেকে যে মাসআলাহগুলো জানা যাবে, তা পয়েন্ট আকারে এখানেই উল্লেখ করছি। রেফারেন্স হিসেবে নিচে ‘আলিমগণের ফাতাওয়া উল্লেখ করব, ইনশাআল্লাহ। যাতে করে পাঠক মহোদয় মাসআলাহগুলো সহজেই আয়ত্ব করতে পারেন। মাসআলাহগুলো নিম্নরূপ—
এক. যুলহাজ্বের নতুন চাঁদ (হিলাল) উঠেছে বলে প্রমাণ হলে অথবা যুল-ক্বা‘আদাহর ৩০ দিন পূর্ণ হলেই চুল-নখ কাটার নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে।
দুই. বিশুদ্ধ মতানুসারে হাদীসে উদ্ধৃত নিষেধাজ্ঞা মৌলিক অর্থে হারাম বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। এর দ্বারা মাকরূহ উদ্দেশ্য নয়। কেননা এই নিষিদ্ধতার বিপরীতে কোনো দলিল বিদ্যমান নেই।
তিন. এমন ব্যক্তি যে নতুন চাঁদ দেখার পরও কুরবানি করার ইরাদাহ (ইচ্ছা/সংকল্প) করেনি। কিন্তু পরবর্তীতে যুলহাজ্ব মাসের প্রথম দশদিনের মধ্যে তার কুরবানি করার ইচ্ছা হলো। সেক্ষেত্রে সে যদি ইতঃপূর্বে চুল-নখ কেটেও থাকে, তবে এরপর থেকে আর তা কাটবে না। নিয়্যাতের আগে যা কেটে ফেলেছে, তাতে সে গুনাহগার হবে না।
চার. কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে চুল-নখ কাটে, তবে তার জন্য জরুরি হচ্ছে, সে আল্লাহ’র নিকটে ইস্তিগফার (ক্ষমাপ্রার্থনা) করবে এবং তাওবাহ করবে। আর তার জন্য কোনো কাফফারাহ নেই। সে স্বাভাবিকভাবেই কুরবানি করবে।
পাঁচ. চুল কাটা বা তোলা নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে মাথা ধোয়া বা চুল পরিপাটি করা অবৈধ নয়।
ছয়. অনিচ্ছাকৃত এসবের কিছু কেটে ফেললে বা ভুল করে কেটে ফেললে সে গুনাহগার হবে না। কারণ ইসলামের সাধারণ মূলনীতি হলো—আল্লাহ এই উম্মাহর অনিচ্ছাকৃত ভুল বা বিস্মৃতিজনিত ভুলের গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন।
সাত. কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কাটলে তার কুরবানি কবুল হবে না—মর্মের প্রচলিত ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। কুরবানি কবুল হওয়ার সাথে এসবের কোনো কিছু কর্তনের কোনোরূপ সম্পর্ক নেই। তবে কর্তনকারী ব্যক্তি অবশ্যই পাপী হবে।
আট. যে ব্যক্তির চুল, নখ, চামড়া থেকে কিছু কেটে ফেলার প্রয়োজন দেখা দেয়, ফলে সে তা কেটে ফেলে, সে ব্যক্তির কোনো দোষ নেই। কারণ শরিয়তের সাধারণ মূলনীতি হলো—জরুরি অবস্থা নিষিদ্ধ কর্মাবলিকে বৈধ করে দেয়।
নয়. যে ব্যক্তি নিজের ও পরিবারের পক্ষ থেকে অথবা স্বেচ্ছায় অন্য কারও পক্ষ থেকে কুরবানি করার সংকল্প করেছে, সেই কেবলমাত্র এ বিধানের আওতায় পড়বে। পক্ষান্তরে পরিবারের যাদের পক্ষ থেকে কুরবানি করা হবে, তারা এই বিধানের আওতায় পড়বে না। অর্থাৎ, তাদের জন্য চুল-নখ কাটা হারাম নয়।
দশ. একইভাবে ওয়াকীল তথা প্রতিনিধি (যে অন্যের স্থলাভিষিক্ত হয়ে কুরবানি করে দেয়) বা ওয়াসী (যাকে কুরবানি করতে অসিয়ত করা হয়েছে)-ও এই নিষেধের অন্তর্ভুক্ত নয়। যেহেতু কুরবানি তাদের নিজস্ব নয়, সেহেতু তারা চুল-নখ প্রভৃতি কাটতে পারবে।
·

‘আলিমগণের বক্তব্য:
·
১ম বক্তব্য:
বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ সৌদি ফাতাওয়া বোর্ডের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন—
“যে ব্যক্তি কুরবানি দেওয়ার ইচ্ছা করেছে, তার জন্য যুলহাজ্ব মাসে উপনীত হওয়ার পর কুরবানি না করা পর্যন্ত স্বীয় শরীরের কোনো লোম, চুল, নখ ও চামড়া কাটা জায়েজ নয়। কেননা নাবী ﷺ বলেছেন, “যখন যুলহাজ্ব মাস উপস্থিত হয়, আর তোমাদের কেউ কুরবানি করার ইচ্ছা করে, তখন কুরবানি না করা পর্যন্ত সে যেন তার নখ, চুল ও চামড়ার কিছুই কর্তন না করে।” ইমাম মুসলিম (রাহিমাহুল্লাহ) উম্মু সালামাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) থেকে হাদীসটি তাঁর “আস-সাহীহ” গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।” [ইমাম ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ), মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ; খণ্ড: ১৮; পৃষ্ঠা: ৩৮-৩৯; দারুল ক্বাসিম, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২১ হিজরী/২০০১ খ্রিষ্টাব্দ (১ম প্রকাশ)]
·
২য় বক্তব্য:
বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] এ ব্যাপারে আলোচনা করতে গিয়ে উম্মু সালামাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) বর্ণিত হাদীসটি উল্লেখ করার পর বলেছেন—
“এই হাদীসে, যে ব্যক্তি কুরবানি দেওয়ার ইচ্ছা করেছে, তার জন্য যুলহাজ্ব মাসে উপনীত হওয়ার পর কুরবানি না করা পর্যন্ত স্বীয় শরীরের লোম, চুল, নখ ও চামড়া কাটার নিষিদ্ধতা বর্ণিত হয়েছে। আর যদি যুলহাজ্ব মাসের প্রথম দশদিন উপস্থিত হয়, অথচ এখনও সে কুরবানি করার নিয়াত করেনি। তারপর সে এই দশকের মধ্যবর্তী কোনো সময়ে কুরবানি দেওয়ার ইচ্ছা করেছে, তাহলে ইরাদাহ (ইচ্ছা/সংকল্প) করার সময় থেকে সে নখ-চুল কাটা থেকে বিরত থাকবে। আর সংকল্প করার আগে সে যদি কিছু কেটে থাকে, তবে তা তার কোনো ক্ষতি করবে না।
হাদীসে বর্ণিত এই নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে ‘আলিমগণ এই মর্মে ইখতিলাফ করেছেন যে, এর দ্বারা মাকরূহ (অপছন্দীয়) হওয়া উদ্দেশ্য না কি হারাম (নিষিদ্ধ) হওয়া উদ্দেশ্য। তবে সর্বাধিক বিশুদ্ধ কথা হলো—এর দ্বারা হারাম হওয়া উদ্দেশ্য। কেননা হারাম সাব্যস্ত হওয়াই নাহী বা নিষেধের মৌলিক অবস্থা। আর এমন কোনো দলিলও নেই, যা এই বিধানকে পরিবর্তন করে দেয়। কেউ যদি অন্যায়ভাবে নখ, চুল বা চামড়া কেটে ফেলে, তবে তার জন্য কোনো কাফফারাহ নেই। কেননা কাফফারাহ দেওয়ার কোনো দলিল পাওয়া যায় না।...
সতর্কবার্তা: কতিপয় সাধারণ মানুষ ধারণা করে থাকে, যে ব্যক্তি কুরবানি দেওয়ার ইচ্ছা করার পর এই দশদিনের মধ্যে তার নখ, চুল, চর্ম থেকে কোনো কিছু কাটে, তার কুরবানি কবুল করা হবে না। এটি একটি সুস্পষ্ট ভুল। কুরবানি কবুল হওয়ার সাথে উল্লিখিত বিষয়গুলোর কিছু কাটার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু যে ব্যক্তি কোনো ওজর ছাড়াই তা কর্তন করবে, সে রাসূল ﷺ কর্তৃক নখ-চুল কাটা থেকে বিরত থাকার আদেশের বিরুদ্ধাচারণ করল এবং নাবী ﷺ কর্তৃক নখ-চুল কাটার নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পতিত হলো। এই ব্যক্তির জন্য আবশ্যক হলো—আল্লাহ’র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা, তাওবাহ করা এবং এই কাজের পুনরাবৃত্তি না করা। আর চুল-নখ কর্তন করার বিষয়টি তার কুরবানি কবুল হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হবে না।
পক্ষান্তরে যে ব্যক্তির চুল, নখ, চামড়া থেকে কিছু কেটে ফেলার প্রয়োজন দেখা দেয়, ফলে সে তা কেটে ফেলে, তবে এতে তার কোনো দোষ নেই। যেমন: কারও মাথায় জখম হলো, ফলে মাথার চুল কাটার প্রয়োজন দেখা দিল। অথবা তার নখ ফেটে গেল, যা তাকে কষ্ট দিচ্ছে, তখন যে অংশের দ্বারা সে কষ্ট পাচ্ছে তা কেটে ফেলল। অথবা তার চামড়ার উপরিভাগ ছিলে গিয়ে ঝুলে আছে—যা তাকে কষ্ট দিচ্ছে, তখন সে তা কেটে ফেলল। এসবের কোনো কারণেই তার ওপর দোষ বর্তাবে না।
দ্বিতীয় সতর্কবার্তা: হাদীসের সুস্পষ্ট বুঝ এবং ‘আলিমদের কথা এটাই প্রমাণ করে যে, কুরবানিদাতাকে যে তার নখ, চুল, চামড়া কাটতে নিষেধ করা হয়েছে, তা নিজের পক্ষ থেকে করা কুরবানি অথবা স্বেচ্ছায় অন্যের পক্ষ থেকে করা কুরবানি—উভয় নিয়াতকেই শামিল করে। যদিও আমাদের কতিপয় সঙ্গীবর্গ বলেন, স্বেচ্ছায় অন্যের পক্ষ থেকে কুরবানিকারী এই নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে আমরা যে মত উল্লেখ করেছি, সেটাই অধিকতর উপযোগী ও সতর্কতামূলক মত। পক্ষান্তরে প্রতিনিধি (যে অন্যের স্থলাভিষিক্ত হয়ে কুরবানি করে দেয়) বা ওয়াসী (যাকে কুরবানি করতে অসিয়ত করা হয়েছে) হওয়ার কারণে যে অন্যের পক্ষ থেকে কুরবানী দেয়, সে এই নিষেধের অন্তর্ভুক্ত হবে না—এতে কোনো সন্দেহ নেই।
হাদীসের সুস্পষ্ট বুঝ এবং অধিকাংশ ‘আলিমদের কথা এটাও প্রমাণ করে যে, যার তরফ থেকে কুরবানী দেওয়া হয়, সেও এই নিষেধের অন্তর্ভুক্ত হবে না। সুতরাং তার জন্য নখ, চুল বা চামড়া কাটা জায়েজ। এই মতটিকে আরও শক্তিশালী করে এই বিষয়টি যে, নাবী ﷺ স্বীয় পরিবারের পক্ষ থেকে কুরবানি দিয়েছেন। অথচ তাঁর থেকে এটা বর্ণিত হয়নি যে, তিনি কখনো এ থেকে তাঁর পরিবারকে নিষেধ করেছেন।” [ইমাম ইবনু ‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ), আহকামুল উদ্বহিয়্যাতি ওয়ায যাকাত; পৃষ্ঠা: ৫৩-৫৪; (সন-তারিখ বিহীন)]
·
৩য় বক্তব্য:
ইমাম ইবনু ‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) অন্যত্র বলেছেন—
“নাবী ﷺ থেকে প্রমাণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, “যখন (যুলহাজ্ব মাসের) প্রথম দশদিন উপস্থিত হয়, আর তোমাদের কেউ কুরবানি করার ইচ্ছা করে, তবে সে যেন তার চুল ও নখের কিছুই কর্তন না করে।” অন্য বর্ণনায় তিনি বলেছেন, “তার চামড়া থেকেও যেন কিছু কর্তন না করে।” এটা নাহী তথা নিষেধ। আর নিষেধের মৌলিক অবস্থা হলো—তার দ্বারা হারাম সাব্যস্ত হবে। যতক্ষণ না এ দলিল প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে যে, এটা হারাম নয় (ততক্ষণ পর্যন্ত তা হারামই থাকবে)।
এই দলিলের ভিত্তিতেই বলা যায়—যে ব্যক্তি কুরবানি দেওয়ার ইচ্ছা করেছে, তার জন্য যুলহাজ্ব মাস উপস্থিত হওয়ার পর কুরবানি না করা পর্যন্ত স্বীয় শরীরের কোনো লোম, চুল, নখ ও চামড়া কর্তন করা জায়েজ নয়। এই হাদীসে কুরবানিদাতাকে সম্বোধন করা হয়েছে, যার তরফ থেকে কুরবানি করা হবে—তাকে সম্বোধন করা হয়নি। এটাই প্রমাণ করে, পরিবারের সকল সদস্যের জন্য চুল-নখ কর্তন করা হারাম নয়। কেননা পরিবারের সদস্যদের তরফ থেকে কুরবানি করা হয়, তারা নিজেরাই কুরবানিদাতা নয়।” [ইমাম ইবনু ‘উসাইমীন (রহিমাহুল্লাহ), মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়ার রাসাইল; খণ্ড: ২৫; পৃষ্ঠা: ১৪১-১৪২; দারুস সুরাইয়্যা, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২৯ হিজরী/২০০৮ খ্রিষ্টাব্দ (১ম প্রকাশ)]
·
৪র্থ বক্তব্য:
ইমাম ইবনু ‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, “যুলহাজ্ব মাসের প্রথম দশদিন চুল-নখ কাটার নিষেধাজ্ঞা কতক্ষণ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে?” উত্তরে তিনি বলেছেন, “কুরবানি করা পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে। যখন কুরবানি করে ফেলবে, তখনই এই নিষেধাজ্ঞা অপসৃত হয়ে যাবে।” [প্রাগুক্ত; খণ্ড: ২৫; পৃষ্ঠা: ১৫২]
·
৫ম বক্তব্য:
সৌদি ফাতওয়া বোর্ড এবং সৌদি ‘আরবের সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য, যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহু) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.] বলেছেন—
“যে ব্যক্তি কুরবানি দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছে তার জন্য কুরবানি না করা পর্যন্ত যুলহাজ্ব মাসের প্রথম দশদিনের মধ্যে পূর্ণরূপে চুল-নখ কেটে ফেলা জায়েজ নয়, আবার চুল-নখের কিয়দংশ কেটে ফেলাও জায়েজ নয়। কারণ নাবী ﷺ এ থেকে নিষেধ করেছেন। যেমনটি আসমা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা)’র হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। পক্ষান্তরে চুল পরিপাটি করা, যা করলে চুল পড়ে যায় না—তাতে কোনো সমস্যা নেই।” [ইমাম সালিহ আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ), আল মুনতাক্বা মিনাল ফাতাওয়া; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ১২৫; গৃহীত: ফাতাওয়া আহকামিল উদ্বহিয়্যাহ, পৃষ্ঠা: ৯; দারুল ইখলাসি ওয়াস সাওয়াব, আলজেরিয়া কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪৩৪ হিজরী/২০১৩ খ্রিষ্টাব্দ (২য় প্রকাশ)]
·
৬ষ্ঠ বক্তব্য:
সৌদি ‘আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটি (আল-লাজনাতুদ দা’ইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) প্রদত্ত ফাতওয়া—
প্রশ্ন: “হাদীস: ‘যে ব্যক্তি কুরবানি করতে চায় কিংবা যার পক্ষ থেকে কুরবানি করা হবে, সে যুলহাজ্জ মাসের শুরু থেকে তার চুল, চামড়া ও নখের কোনো কিছু কাটবে না; যতক্ষণ না কুরবানি শেষ হয়।’ এ নিষেধাজ্ঞা কি পরিবারের ছোটোবড়ো সকল সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করবে, না কি ছোটোদের পরিবর্তে শুধু বড়োদেরকে অন্তর্ভুক্ত করবে?”
উত্তর: “প্রশ্নকারী যে ভাষায় উল্লেখ করেছেন সে ভাষায় আমরা কোনো হাদীস জানি না। বরং যে ভাষায় হাদিসটি নাবী ﷺ থেকে সাব্যস্ত হয়েছে বলে আমরা জানি সেটা হচ্ছে—“তোমরা যখন যুলহাজ্ব মাসের নতুন চাঁদ (হিলাল) দেখ এবং তোমাদের কেউ কুরবানি করার সংকল্প করে, তখন সে যেন তার চুল ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকে।” সুনানে আবূ দাউদ, সাহীহ মুসলিম ও সুনানে নাসাঈ’র ভাষা হচ্ছে—“কেউ যদি জবেহ করার জন্য কোনো পশু প্রস্তুত রাখে এবং সে যুলহাজ্ব মাসে প্রবেশ করে, তবে সে যেন তার চুল, নখ না কাটে; যতক্ষণ না সে কুরবানি সম্পন্ন করে।” এ হাদীসে যুলহাজ্ব মাস প্রবেশ করার পর যে ব্যক্তি কুরবানি করতে ইচ্ছুক তার জন্য চুল ও নখ কাটা থেকে নিষেধাজ্ঞার প্রমাণ রয়েছে। আর প্রথম বর্ণনাটিতে বর্জন করার নির্দেশ রয়েছে। নির্দেশের মূল অবস্থা হচ্ছে তার দ্বারা ওয়াজিব সাব্যস্ত হবে। এ হাদীছের মূল অবস্থাকে রহিত করতে পারে এমন কোনো বিপরীত দলিল আমাদের জানা নেই। দ্বিতীয় বর্ণনাতে রয়েছে, কর্তন করার নিষেধাজ্ঞা। নিষেধাজ্ঞারও মূল বিধান হচ্ছে তার দ্বারা হারাম সাব্যস্ত হবে। অর্থাৎ, কর্তন করার নিষেধাজ্ঞা। এ নিষেধাজ্ঞাকে শিথিল করতে পারে, এমন কোনো বিপরীত দলিলও আমাদের জানা নেই।
আর এর মাধ্যমে সাব্যস্ত হলো যে, এ হাদীসটি শুধু ওই ব্যক্তির জন্য খাস, যিনি নিজে কুরবানি করতে ইচ্ছুক। আসল বিধানের উপর ভিত্তি করে বলা যায়, যে ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানি করা হবে (যেমন, কুরবানিদাতার স্ত্রী-পুত্র), তিনি বড়ো হন কিংবা ছোটো হন, তার ক্ষেত্রে চুল কাটা, চামড়া তোলা কিংবা নখ কাটতে কোনো বাধা নেই। যেহেতু আসল বিধান হচ্ছে—এগুলো জায়েজ। এই আসল বিধানের বিপরীত কোনো দলিল আমাদের জানা নেই। আর আল্লাহই তাওফীক্বদাতা।
হে আল্লাহ, আমাদের নাবী মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবার পরিজন ও সাহাবীগণের ওপর আপনি দয়া ও শান্তি বর্ষণ করুন।”
ফাতওয়া প্রদান করেছেন—
চেয়ারম্যান: ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ)।
ডেপুটি চেয়ারম্যান: ‘আব্দুর রাযযাক্ব ‘আফীফী (রাহিমাহুল্লাহ)।
মেম্বার: ‘আব্দুল্লাহ বিন গুদাইয়্যান (রাহিমাহুল্লাহ)।
মেম্বার: ‘আব্দুল্লাহ বিন মানী‘ (রাহিমাহুল্লাহ)। [ফাতাওয়া লাজনাহ দাইমাহ, খণ্ড: ১১; পৃষ্ঠা: ৪২৭; ফাতওয়া নং: ১৪০৭; প্রশ্ন নং: ৩; গৃহীত: alifta.net]
·
আলোচ্য বিধানের হিকমাহ:
চুল-নখ-চামড়া প্রভৃতি কাটা যাবে না—এই বিধানের পিছনে হিকমাহ বা যুক্তি কী? ইমাম শাওকানী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, “এ নিষেধাজ্ঞার পিছনে হিকমাহ বা যুক্তি হলো কুরবানিদাতার শরীরের সম্পূর্ণ অংশ অটুট থাকা; যাতে করে সম্পূর্ণ শরীর জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি পায়। কারও কারও মতে, ইহরামকারীর সাথে সাদৃশ্যস্বরূপ এই বিধান। এ দুটি হিকমাহ তথা যুক্তি ইমাম নাওয়াউয়ী (রহিমাহুল্লাহ) উল্লেখ করেছেন। ইমাম শাফি‘ঈর ছাত্রদের থেকে বর্ণিত আছে যে, দ্বিতীয় হিকমাহটি ভুল। কারণ ইহরামকারী আরও যেসব জিনিস বর্জন করে থাকে, কুরবানিদাতা তো সেগুলো বর্জন করে না। যেমন: নারী, সুগন্ধি, সাধারণ পোশাক ইত্যাদি।” [ইমাম শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ), নাইলুল আওত্বার; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ১৩৩]
ইমাম ইবনু ‘উসাইমীন (রহিমাহুল্লাহ) কে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি চমৎকার একটি উত্তর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “কতিপয় ‘আলিম বলেছেন, এক্ষেত্রে হিকমাহ হলো, কুরবানিদাতার সম্পূর্ণ শরীর অটুট থাকা; যাতে করে তার সমগ্র শরীর জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করে। তবে প্রকৃত হিকমাহ বা যুক্তি তো সেটাই, যা কখনো বাতিল হবে না। আর তা হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ পালন করা। হিকমাহ হিসেবে এটাই যথেষ্ট।” [ইমাম ইবনু ‘উসাইমীন (রহিমাহুল্লাহ), মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়ার রাসাইল; খণ্ড: ২৫; পৃষ্ঠা: ১৪৩; দারুস সুরাইয়্যা, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২৯ হিজরী/২০০৮ খ্রিষ্টাব্দ (১ম প্রকাশ)]
·
পরিশেষে, আল্লাহ’র কাছে প্রার্থনা করছি, তিনি যেন আমাদেরকে যথাযথভাবে ‘আলিমদের সঠিক বুঝ অনুযায়ী তাঁর শরিয়ত পালন করার তাওফীক্ব দান করেন এবং সদাসর্বদা তাঁর দ্বীনের উপর অটল রাখেন। হে আল্লাহ, আমাদের কবুল করে নিন। আমীন, ইয়া রাব্বাল ‘আলামীন।
·
অনুবাদক: মুহাম্মাদ ‘আব্দুল্লাহ মৃধা

No comments:

Post a Comment

Download AsPDF

Print Friendly and PDFPrint Friendly and PDFPrint Friendly and PDF
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...