Friday 16 August 2019

শাইখ বাদী‘উদ্দীন আস-সিন্ধী (রাহিমাহুল্লাহ)’র সংক্ষিপ্ত জীবনী


·
জন্ম ও পরিচয়:
তিনি হলেন আল-মুহাদ্দিসুল ফাক্বীহ আল-‘আলিমুল জালীল আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ ইমাম আবূ মুহাম্মাদ বাদী‘উদ্দীন শাহ বিন সাইয়্যিদ ইহসানুল্লাহ শাহ বিন রুশদুল্লাহ শাহ আর-রাশিদী আল-হুসাইনী আস-সিন্ধী আল-বাকিস্তানী।
তিনি পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের এক গ্রামে ১৩৪২ হিজরী মোতাবেক ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।
·
‘ইলম অর্জন ও কর্মজীবন:
শাইখ বাদী‘উদ্দীনের পিতা সপরিবারে গ্রাম ছেড়ে সিন্ধু প্রদেশেরই অন্য জায়গায় চলে যান এবং সেখানে ‘দরগাহ শরীফ’ নামে একটি গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সেখানে একটি মাদরাসাও প্রতিষ্ঠা করেন, যে মাদরাসায় ভর্তি হয়েছিলেন শাইখ বাদী‘উদ্দীন। শাইখ উক্ত মাদরাসাতেই বেশ কয়েকজন শাইখের নিকট আরবি ভাষা ও শরিয়তের মৌলিক জ্ঞান অর্জন করেন।
আল্লাহ শাইখকে অসাধারণ স্মৃতিশক্তি দিয়ে এক বিশেষ অনুগ্রহ করেছিলেন। ফলে শাইখ চার মাসেরও কম সময়ে কুরআনুল কারীম মুখস্থ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ২৩ বছর। আর আশ্চর্যের বিষয় হলো এই যে, তিনি তাঁর এক সফরে উটের পিঠে বসে সূরাহ নূর মুখস্থ করেছিলেন।
তিনি ‘ইলমে হাদীস ও ‘ইলমে ফিক্বহ অর্জনের জন্য পূর্ববর্তী ‘উলামাদের মতো শাইখদের দারসে বসে ‘ইলম আহরণ করেন। তিনি অনেক শাইখের নিকট থেকে ইজাযাহ (অনুমোদন) অর্জন করেছিলেন।
এরপর তিনি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের পড়ানো শুরু করেন। তাঁর দেশের অনেক শিক্ষার্থী তাঁর নিকট থেকে ‘ইলম গ্রহণ করে। এরপর তিনি ১৩৯৫ হিজরী মোতাবেক ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা মুকাররমায় চলে যান।
তিনি মাসজিদুল হারামে চার বছর দারস প্রদান করেন। তিনি সেখানে ছাত্রদেরকে কুতুবে সিত্তাহ (বিখ্যাত ৬ টি হাদীসগ্রন্থ) এবং ইবনু হাযমের ‘মুহাল্লা’ পড়াতেন।
শেষজীবনে তিনি কুয়েতে গিয়েছিলেন এবং সেখানেও তাঁর নিকট থেকে অসংখ্য ছাত্র ‘ইলম গ্রহণ করেছিল। তিনি সেখানে সাহীহ বুখারীর ‘তাওহীদ’ অধ্যায় ও ‘সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা’ অধ্যায়, ইবনু কাসীরের “বা‘ইসুল হাসীস” এবং উসূলে ফিক্বহের ‘আল-ওয়ারাক্বাত’ গ্রন্থ পড়িয়েছিলেন। তাঁর নিকট থেকে ‘ইলমী ইজাযাহ গ্রহণ করেছিল পাকিস্তান, ভারত, সিরিয়া, ইরাক, আরব উপদ্বীপ ও মরোক্কোর অসংখ্য শিক্ষার্থী।
তিনি একটি বড়ো লাইব্রেরির পরিচর্যা করতেন। যে লাইব্রেরিতে অসংখ্য উৎস ও দুর্লভ গ্রন্থের সমাহার ছিল। তাঁর কাছে ইমাম ত্বাবারানী’র ‘মুসনাদুশ শামিয়্যিঈন’ কিতাবের অনুলিপি ছিল। যা তিনি মদিনার এক লাইব্রেরি থেকে অনুলিপি করেছিলেন। পরবর্তীতে বইটির আসল কপি হারিয়ে গেলে তাঁর অনুলিপি করা পাণ্ডুলিপিই ছিল পুরো বিশ্বের একমাত্র পাণ্ডুলিপি। শাইখ হামদী ‘আব্দুল মাজীদ আস-সালাফী উক্ত পাণ্ডুলিপির ওপর নির্ভর করেই এই বই তাহক্বীক্ব-সহ প্রকাশ করেন।
·

শিক্ষকবৃন্দ:
শাইখ বাদী‘উদ্দীন অনেক শাইখের নিকট থেকে ‘ইলম গ্রহণ করেছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন—
(১) শাইখ হাফিয আমীন আল-কুশী (রাহিমাহুল্লাহ)
(২) শাইখ বাহাউদ্দীন খান জালালাবাদী (রাহিমাহুল্লাহ)
(৩) শাইখ মুহাম্মাদ শাফী‘উল মানকাউয়ী আস-সাকরানদী (রাহিমাহুল্লাহ)
(৪) শাইখ ‘আব্দুল কারীম নাওয়াব শামী (রাহিমাহুল্লাহ)
(৫) শাইখ মুহিব্বুদ্দীন শাহ আর-রাশিদী (রাহিমাহুল্লাহ)। ইনি হলেন শাইখ বাদী‘উদ্দীনের জ্যৈষ্ঠ ভ্রাতা। শাইখ রাবী‘ (হাফিযাহুল্লাহ) তাঁর ব্যাপারে বলেছেন, “তিনি একজন মুহাদ্দিস ‘আল্লামাহ ছিলেন।” [তাযকীরুন নাবিহীন, পৃষ্ঠা: ২৯২]
(৬) শাইখ কুতুবুদ্দীন হালিয়াজাউয়ী (রাহিমাহুল্লাহ)
(৭) শাইখ মুহাম্মাদ আস-সিন্ধী আল-হালাঈ, সুম্মা আল-মাদানী, সুম্মা আল-কারাতাশাউয়ী (রাহিমাহুল্লাহ)
(৮) শাইখ মুহাম্মাদ নূর ‘ঈসা খলীলী (রাহিমাহুল্লাহ)
·
ইজাযাহ নেওয়ার দিক থেকে তাঁর আরও অনেক শাইখ আছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন—
(১) ভারতবর্ষের অপ্রতিদ্বন্দ্বী মুহাদ্দিস, ইমাম আবুল ওয়াফা সানাউল্লাহ অমৃতসরী (রাহিমাহুল্লাহ)
(২) মুহাদ্দিস ‘আব্দুল হাক্ব বিন ‘আব্দুল ওয়াহিদ আল-হাশিমী (রাহিমাহুল্লাহ)
(৩) শাইখ মুহাম্মাদ খালীল বিন মুহাম্মাদ সালীম (রাহিমাহুল্লাহ)
·
ছাত্রবৃন্দ:
তাঁর ছাত্রসংখ্যা অনেক। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন—
(১) ইমাম মুক্ববিল বিন হাদী আল-ওয়াদি‘ঈ (রাহিমাহুল্লাহ)
(২) ইমাম রাবী‘ বিন হাদী আল-মাদখালী (হাফিযাহুল্লাহ)
(৩) ‘আল্লামাহ ড. ‘আব্দুল্লাহ বিন ‘আব্দুর রহীম আল-বুখারী (হাফিযাহুল্লাহ)
·
শাইখের লিখন:
শাইখ লেখালেখির ক্ষেত্রে সেরাদের একজন ছিলেন। তাঁর আশিটিরও বেশি লিখিত গ্রন্থ আছে, যার অধিকাংশই অপ্রকাশিত। তাঁর কিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের নাম নিম্নরূপ—
(১) আল-ইজাবাতু ‘আনিল ইসাবাহ ফী তারতীবি আহাদীসিল বাইহাক্বী ‘আলা মাসানীদিস সাহাবাহ
(২) মুক্বাদ্দামাতুত তাফসীর
(৩) আল-ফাতাওয়া আল-বাদী‘ইয়্যাহ
(৪) জুযউম মানযূম ফী আসমাইল মুদাল্লিসীন
(৫) আস-সারীহুল মুমাহহাদ ফী ওয়াসলি তা‘লীক্বাতি মুওয়াত্বত্বাইল ইমাম মুহাম্মাদ
(৬) তারাজুমু শুয়ূখিল ইমাম আল-বাইহাক্বী
(৭) মুসনাদুস সুনানিল কুবরা লিল বাইহাক্বী
(৮) আত-তাবউয়ীব লি আহাদীসি তারীখিল খত্বীব
(৯) গাইয়াতুল মারাম ফী তাখরীজি জুযইল ক্বিরাআতি খালফাল ইমাম
(১০) আল-ক্বাওলুল লাত্বীফ ফিল ইহতিজাজি বিল হাদীসিদ্ব দ্বা‘ঈফ
(১১) রাফ‘উল ইরতিয়াব ‘আন হুকমিল আসহাব
(১২) তুহফাতুল আহবাব ফী তাখরীজি আহাদীসি ক্বাওলিত তিরমিযী—‘ওয়া ফিল বাব’
·
তাঁর ব্যাপারে সুযোগ্য ‘আলিমগণের প্রশংসা:
·
বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, আল-ফাক্বীহুল মুজতাহিদ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] তাঁর দেখা শ্রেষ্ঠ পাঁচজন ‘আলিমের তালিকায় শাইখ বাদী‘উদ্দীনের নাম উল্লেখ করেছেন। ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ)’র ব্যাপারে বলা হয়েছে যে, “আল্লামাহ আলবানী (ড. তাক্বিউদ্দীন) আল-হিলালীকে সেই পাঁচজন ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত গণ্য করতেন, ‘ইলম ও তাহক্বীক্বের ব্যাপারে যাঁদের মতো কাউকে তিনি কখনো দেখেননি। তাঁরা হলেন—(১) ইবনু বায, (২) তাক্বিউদ্দীন হিলালী, (৩) ‘আব্দুর রহমান মুবারকপুরী, (৪) বাদী‘উদ্দীন আস-সিন্ধী, (৫) আশ-শানক্বীত্বী। আল্লাহ তাঁদের সকলের ওপর রহমত বর্ষণ করুন।” [সাবীলুর রাশাদ ফী হাদয়ি খাইরিল ‘ইবাদ, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৬]
·
বর্তমান যুগের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, ইমাম রাবী‘ বিন হাদী ‘উমাইর আল-মাদখালী (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫১ হি./১৯৩২ খ্রি.] শাইখ বাদী‘উদ্দীনের ব্যাপারে বলেছেন, “তিনি হলেন আশ-শাইখ, আল-‘আল্লামাহ, আল-মুহাদ্দিস, আল-ফাক্বীহ, আল-ফাহহামাহ (তীক্ষ্ণবুদ্ধি), মুফীদুত ত্বালাবাহ (ছাত্রদের ফায়দা প্রদানকারী), ‘আলিউর রুতবাহ (উঁচু পর্যায়ের মানুষ)।” [ইমাম রাবী‘ (হাফিযাহুল্লাহ), তাযকীরুন নাবিহীন; পৃষ্ঠা: ২৯২]
·
ইমাম রাবী‘ আল-মাদখালী (হাফিযাহুল্লাহ) আরও বলেছেন, “আমি শাইখ বাদী‘ (রাহিমাহুল্লাহ) কে চিনেছি তাঁর প্রখর মেধা, প্রচণ্ড মুখস্থশক্তি এবং কিতাব ও সুন্নাহ থেকে দলিল উপস্থিত করার ক্ষমতার মাধ্যমে। মক্কা, মদিনা ও মাসজিদুল হারামে আমি অনেকবার তাঁর সাহচর্য লাভ করেছি এবং তাঁর সাথে অসংখ্য মাসআলাহ নিয়ে আলোচনা করেছি। আমি তাঁর কাছে সুবুলুস সালাম (বুলুগুল মারামের ভাষ্যগ্রন্থ) এবং সাহীহ মুসলিমের কিয়দংশ পড়েছি। তিনি আমাকে তাঁর কাছে পড়া ও শোনা যাবতীয় বিষয়ের ব্যাপারে আমভাবে ইজাযাহ (অনুমোদন) প্রদান করেছেন।” [প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা: ২৯৪]
·
মাদীনাহ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদীস বিভাগের অধ্যাপক, ‘আল্লামাহ ড. ‘আব্দুল্লাহ বিন ‘আব্দুর রহীম আল-বুখারী (হাফিযাহুল্লাহ) বলেছেন, “আল্লাহ আমাদের শাইখ, আল-‘আল্লামাহ, আল-মুহাদ্দিস, আস-সালাফী, বাদী‘উদ্দীন শাহ আর-রাশিদী আস-সিন্ধী’র ওপর রহম করুন। নিশ্চয় আমাদের শাইখ সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা, সুন্নাহকে ডিফেন্ড করা এবং বিভিন্ন গোঁড়া মুক্বাল্লিদ বা সুন্নাহবিরোধীকে রদ করার ব্যাপারে সুপ্রসিদ্ধ।” [দ্র.: https://tinyurl.com/y43kmle5.]
·
মৃত্যু:
শাইখ দীর্ঘদিন অসুস্থতার কারণে শয্যাশায়ী থাকার পর ১৪১৬ হিজরী মোতাবেক ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে পরলোকগমন করেন। আল্লাহ এই ক্ষণজন্মা মনীষীকে স্বীয় রহমত দিয়ে ঢেকে দিন এবং সর্বোচ্চ জান্নাতে তাঁর বাসস্থান নির্ধারণ করুন। আমীন, ইয়া রাব্বাল ‘আলামীন।
·
তথ্যসূত্র:
(১) ইমাম রাবী‘ আল-মাদখালী (হাফিযাহুল্লাহ), তাযকীরুন নাবিহীন বি সিয়ারি আসলাফিহিম হুফফাযিল হাদীসিস সাবিক্বীনা ওয়াল লাহিক্বীন; পৃষ্ঠা: ২৯২-২৯৪; শাইখের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট (rabee.net) থেকে সংগৃহীত সফট কপি।
(২) “তারজামাতুশ শাইখ বাদী‘উদ্দীন আস-সিন্ধী রাহিমাহুল্লাহ”– শীর্ষক আর্টিকেল। লিংক: www.ahlalhdeeth.com/vb/showthread.php?t=256918
·
বি.দ্র.: আমাদের নিবন্ধটি তথ্যসূত্রে উল্লিখিত সূত্রদ্বয় থেকে সংগৃহীত, সংক্ষেপিত এবং ঈষৎ পরিমার্জিত।
·
অনুবাদক: মুহাম্মাদ ‘আব্দুল্লাহ মৃধা

No comments:

Post a Comment

Download AsPDF

Print Friendly and PDFPrint Friendly and PDFPrint Friendly and PDF
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...