Friday 16 August 2019

যুলহাজ্ব মাসের প্রথম দশদিনে যা করণীয়


[সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সাবেক সদস্য, বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ, আশ-শাইখ, আল-‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) প্রণীত নিবন্ধের সরল বঙ্গানুবাদ]
·
যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। দয়া ও শান্তি অবতীর্ণ হোক সাইয়্যিদুল মুরসালীনের ওপর। অতঃপর:
নিশ্চয় এটি আল্লাহ’র পরম দয়া ও অনুগ্রহ যে, তিনি তাঁর সৎকর্মপরায়ণ বান্দাদের জন্য কিছু মৌসুস নির্ধারণ করেছেন, যেসব মৌসুমে তারা বেশি বেশি সৎ আমল করবে। যুলহাজ্ব মাসের প্রথম দশদিন এসব মৌসুমের মধ্যে অন্যতম।
·
ফজিলত:
যুলহাজ্ব মাসের প্রথম দশদিনের ফজিলতে কুরআন-সুন্নাহ’র অনেক দলিল বর্ণিত হয়েছে। যেমন:
১. মহান আল্লাহ বলেছেন, وَالْفَجْرِ. وَلَيَالٍ عَشْرٍ “শপথ ফজরের এবং দশ রজনীর।” [সূরাহ ফাজর: ১-২] ইবনু কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, المراد بها عشر ذي الحجة كما قالهه ابن عباس وابن الزبير ومجاهد وغيرهم “এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো যুলহাজ্ব মাসের প্রথম দশ দিন। যেমনটি বলেছেন ইবনু ‘আব্বাস, ইবনু যুবাইর, মুজাহিদ প্রমুখ।”
২. ইবনু ‘আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, مَا مِنْ أَيَّامٍ الْعَمَلُ الصَّالِحُ فِيهِنَّ أَحَبُّ إِلَى اللّهِ مِنْ هذِهِ الْأَيَّامِ الْعَشَرَةِ قَالُوا: يَا رَسُولَ اللّهِ وَلَا الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللّهِ؟ قَالَ: وَلَا الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللّهِ إِلَّا رَجُلٌ خَرَجَ بِنَفْسِه وَمَالِه فَلَمْ يَرْجِعْ مِنْ ذلِكَ بِشَيْءٍ “আল্লাহ তা‘আলার নিকট তাঁর দিনসমূহের মধ্যে এমন কোনো দিন নেই, যে দিনের আমল এ দশদিনের আমল অপেক্ষা অধিক প্রিয়।” সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহ’র রসূল! আল্লাহ’র রাস্তায় জিহাদও নয় কি?’ তিনি বললেন, “আল্লাহ’র রাস্তায় জিহাদও নয়। তবে সে ব্যতীত, যে নিজের জীবন ও সম্পদ নিয়ে বের হয়েছে, আর তা হতে কোনো কিছু নিয়েই ফিরেনি।” [সাহীহ বুখারী, হা/৯৬৯]
৩. মহান আল্লাহ বলেছেন, وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَّعْلُومَات “যেন তারা নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহ’র নাম স্মরণ করতে পারে।” [সূরাহ হাজ্ব: ২৮] ইবনু ‘আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) ও ইবনু কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, “নির্দিষ্ট দিনসমূহ মানে যুলহাজ্ব মাসের প্রথম দশদিন।”
৪. ইবনু ‘উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ما من أيّام أعظم عند الله سبحانه ولا أحب إليه العمل فيهن من هذه الأيام العشر، فأكثروا فيهن من التهليل والتكبير والتحميد “আল্লাহ তা‘আলার নিকট তাঁর দিনসমূহের মধ্যে এমন কোনো দিন নেই, যে দিনের মর্যাদা এবং আমল এ দশদিনের মর্যাদা ও আমল অপেক্ষা অধিক প্রিয়। সুতরাং তোমরা এই দিনগুলোতে বেশি বেশি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, ‘আল্লাহু আকবার’ এবং ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ বলো।” [ত্বাবারানী, মু‘জামুল কাবীর]
৫. তাবি‘ঈ সা‘ঈদ বিন জুবাইর (রাহিমাহুল্লাহ) যখন যুলহাজ্ব মাসের প্রথম দশকে উপনীত হতেন, তখন তিনি ইবাদতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাতেন। [দারিমী]

৬. হাফিয ইবনু হাজার বলেছেন, والذي يظهر أنّ السبب في امتياز عشر ذي الحجة، لمكان اجتماع أمهات العبادة فيه، وهي الصلاة والصيام والصدقة والحج، ولا يأتي ذلك في غيره “এ কথা স্পষ্ট যে, যুলহাজ্বের প্রথম দশদিনের বিশেষ গুরুত্বের কারণ হলো—ওই দিনগুলোতে প্রধান ইবাদতসমূহ একত্রিত হয়েছে, যেমন: নামাজ, রোজা, সদকা এবং হজ; যা অন্যান্য দিনে এইভাবে একত্রিত হয়নি।” [ফাতহুল বারী, ২/৪৬০]
·
এই দিনগুলোতে যা করণীয়:
১. নামাজ: সত্বর ফরজ নামাজ আদায় করা এবং বেশি বেশি নফল নামাজ আদায় করা মুস্তাহাব (পছন্দনীয় আমল)। কেননা নামাজ শ্রেষ্ঠ ইবাদতসমূহের অন্তর্ভুক্ত। সাওবান (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, عَلَيْكَ بِكَثْرَةِ السُّجُودِ لِلَّهِ فَإِنَّكَ لاَ تَسْجُدُ لِلَّهِ سَجْدَةً إِلاَّ رَفَعَكَ اللَّهُ بِهَا دَرَجَةً وَحَطَّ عَنْكَ بِهَا خَطِيئَةً ‏ “তুমি আল্লাহ’র জন্য অবশ্যই বেশি বেশি সিজদা করবে। কেননা তুমি যখনই আল্লাহ’র জন্য একটি সিজদা করবে, আল্লাহ তা‘আলা এর বিনিময়ে তোমার মর্যাদা একধাপ বৃদ্ধি করে দিবেন এবং তোমার একটি গুনাহ মাফ করে দিবেন।” [সাহীহ মুসলিম, হা/৪৮৮; সালাত অধ্যায় (৪); পরিচ্ছেদ- ৪৩] আর এই আমল সকল সময় করা যায়।
·
২. রোজা: যেহেতু রোজাও সৎ আমলের অন্তর্ভুক্ত। হুনাইদাহ ইবনু খালিদ (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর স্ত্রী থেকে এবং তিনি নাবী ﷺ এর কোনো এক স্ত্রীর সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَصُومُ تِسْعَ ذِي الْحِجَّةِ، وَيَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَثَلَاثَةَ أَيَّامٍ مِنْ كُلِّ شَهْرٍ، أَوَّلَ اثْنَيْنِ مِنَ الشَّهْرِ وَالْخَمِيسَ “রাসূলুল্লাহ ﷺ যুলহাজ্ব মাসের প্রথম নয়দিন, আশুরার দিন, প্রত্যেক মাসে তিনদিন এবং মাসের প্রথম সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখতেন।” [আবূ দাঊদ, হা/২৪৩৭; সনদ: সাহীহ (তাহক্বীক্ব: আলবানী)]
ইমাম নাওয়াউয়ী (রাহিমাহুল্লাহ) যুলহাজ্বের প্রথম দশকের রোজা সম্পর্কে বলেছেন, “এটি ভালো মানের মুস্তাহাব আমল (إنه مستحب إستحبابًا شديدا)।”
·
৩. তাকবীর, তাহলীল ও তাহমীদ: ইবনু ‘উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) বর্ণিত হাদীসে এসেছে, রাসূল ﷺ বলেছেন, “তোমরা এই দিনগুলোতে বেশি বেশি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, ‘আল্লাহু আকবার’ এবং ‘আল-হামদুলিল্লাহ’ বলো।”
ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, كان ابن عمر وأبو هريرة رضي الله عنهما يخرجان إلى السوق في أيّام العشر يكبران ويكبر النّاس بتكبيرهما “ইবনু ‘উমার ও আবূ হুরাইরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) যুলহাজ্বের প্রথম দশকে যখন বাজারে যেতেন, তখন ‘আল্লাহু আকবার’ বলে তাকবীর দিতেন। আর তাঁদের দুজনের তাকবীরের কারণে লোকেরাও তাকবীর দিত।”
তিনি আরও বলেছেন, وكان عمر يكبر في قبته بمنى فيسمعه أهل المسجد فيكبرون ويكبر أهلل الأسواق حتى ترتج منى تكبيراً “ইবনু ‘উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) মিনায় অবস্থিত তাঁর খিলানে তাকবীর দিতেন। আর সে তাকবীর মাসজিদের লোকেরাও শুনতে পেত, ফলে তারাও তাকবীর দিত এবং বাজারের লোকেরাও তাকবীর দিত। এমনকি তাঁদের তাকবীরের আওয়াজে মিনা প্রকম্পিত হতো।”
ইবনু ‘উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) এই দিনগুলোতে মিনায় তাকবীর দিতেন। তিনি এই দিনগুলোতে সালাতের পরে, শয়নে, তাবুতে, মজলিসে এবং হাঁটতে হাঁটতে তাকবীর দিতেন। আর উচ্চৈঃস্বরে তাকবীর দেওয়া মুস্তাহাব। যেহেতু ‘উমার, ইবনু ‘উমার এবং আবূ হুরাইরাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুম) এর এরকম আমল রয়েছে।
মুসলিম হিসেবে আমাদের কর্তব্য—এই সুন্নাহকে জিন্দা করা, যে সুন্নাহ বর্তমান যুগে অবহেলিত। এমনকি দুঃখজনক বিষয় হলো, ভালো ও সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তিবর্গও এ থেকে গাফেল থাকেন। অথচ ন্যায়নিষ্ঠ সালাফগণ এমন ছিলেন না।
·
তাকবীরের শব্দাবলি:
সাহাবী ও তাবি‘ঈদের থেকে অনেকগুলো শব্দে তাকবীর বর্ণিত হয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি নিম্নে উদ্ধৃত হলো:
ক. আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার কাবীরা।
খ. আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, ওয়াল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ।
গ. আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ।
·
৪. আরাফার রোজা:
আরাফার রোজা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। নাবী ﷺ আরাফার রোজা সম্পর্কে বলেছেন, أَحْتَسِبُ عَلَى اللَّهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ وَالسَّنَةَ الَّتِي بَعْدَهُ “আরাফার দিনের রোজা সম্পর্কে আমি আল্লাহ’র কাছে আশাবাদী যে, তিনি (এই আমলের কারণে) পূর্ববর্তী ও পরবর্তী বছরের (ছোটো) গুনাহসমূহ মোচন করে দিবেন।” [সাহীহ মুসলিম, হা/১১৬২; রোজা অধ্যায় (১৪); পরিচ্ছেদ- ৩৬]
কিন্তু যিনি আরাফায় হাজি হিসেবে অবস্থান করছেন, তার জন্য এই রোজা রাখা মুস্তাহাব নয়। কেননা নাবী ﷺ রোজা না রেখে আরাফায় অবস্থান করেছেন।
হে আল্লাহ, আমাদের নাবী মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবার পরিজন ও সকল সাহাবীর ওপর আপনি দয়া ও শান্তি বর্ষণ করুন।
·
তথ্যসূত্র:
https://tinyurl.com/yx8hglm5 (ইসলামওয়ে ডট নেটের আর্টিকেল)।
·
অনুবাদক: মুহাম্মাদ ‘আব্দুল্লাহ মৃধা

No comments:

Post a Comment

Download AsPDF

Print Friendly and PDFPrint Friendly and PDFPrint Friendly and PDF
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...