Friday 16 August 2019

সালাফী ‘আক্বীদাহর কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি


·
পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর:
মুক্তিপ্রাপ্ত ও সাহায্যপ্রাপ্ত দলটির নাম হলো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত। এই দলটিই হলো আহলুল হাদীস, আহলুল আসার, সালাফিয়্যাহ এবং গুরাবা। বৈশিষ্ট্যগত নাম আলাদা হলেও মূল দলটি এক ও অভিন্ন। জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতে হলে এই দলের আদর্শ ও কর্মপন্থা গ্রহণ না করে উপায় নেই। কারণ নাবী ﷺ এই দলটির ব্যাপারেই জাহান্নাম থেকে মুক্তির সুসংবাদ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ এই দলটির অনুসরণ করতে আদেশ দিয়েছেন এবং যারা এর অনুসরণে প্রবৃত্ত হয় না, তাদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারিস্বরূপ বলেছেন, “যে ব্যক্তি সত্য পথ প্রকাশিত হওয়ার পরেও রাসূলের বিরোধিতা করে এবং মু’মিনদের পথ বাদ দিয়ে ভিন্ন পথ অনুসরণ করে, আমি তাকে সে পথেই ফিরাব যে পথে সে ফিরে যায়, আর তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাব; কতই না মন্দ সে আবাস!” [সূরাহ নিসা: ১১৫]
যারাই এ দলের বিরোধিতা করবে, তারাই বিদ‘আতী হিসেবে পরিগণিত হবে। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন,“আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের মাযহাব একটি সুপরিচিত প্রাচীনতম মাযহাব (আদর্শ)। আল্লাহ তা‘আলা আবূ হানীফাহ, মালিক, শাফি‘ঈ ও আহমাদকে সৃষ্টি করার পূর্ব থেকেই এই মাযহাবের অস্তিত্ব ছিল। নিশ্চয় এটি সাহাবীদের মাযহাব, যাঁরা এই মাযহাব স্বয়ং তাঁদের নাবী’র কাছ থেকে গ্রহণ করেছেন। যে ব্যক্তি এই মাযহাবের বিরোধিতা করবে, সে আহলুস সুন্নাহ’র নিকট বিদ‘আতী হিসেবে পরিগণিত হবে।” [ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ), মিনহাজুস সুন্নাতিন নাবাউয়িয়্যাহ; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৬০১; প্রকাশনার নামবিহীন; সন: ১৪০৬ হি./১৯৮৬ খ্রি. (১ম প্রকাশ)]
·
যখন একজন ব্যক্তি আহলুস সুন্নাহ’র মূলনীতিসমূহের কোনো একটি মূলনীতির বিরোধিতা করে, তখন সে আহলুস সুন্নাহ’র গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যায়, অর্থাৎ বিদ‘আতী ব্যক্তিতে পরিণত হয়। এ ব্যাপারে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের শ্রেষ্ঠ ইমাম শাইখুল ইসলাম হাফিয আহমাদ বিন হাম্বাল (রাহিমাহুল্লাহ)’র [মৃত: ২৪১ হি.] একটি উক্তি উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হচ্ছি। তিনি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, “আবশ্যকীয় সুন্নাহ’র (মানহাজের) মধ্য থেকে যে ব্যক্তি একটি বৈশিষ্ট্য পরিত্যাগ করবে, তা গ্রহণ করবে না এবং তার প্রতি ঈমানও আনবে না, তবে সে সুন্নাহপন্থিদের তথা আহলুস সুন্নাহ’র অন্তর্ভুক্ত নয়।” [ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ), উসূলুস সুন্নাহ; পৃষ্ঠা: ৩; প্রকাশনার নাম ও তারিখবিহীন; ইমাম আল-লালাকাঈ (রাহিমাহুল্লাহ), শারহু উসূলি ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আহ; আসার নং: ৩১৭; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১৪৮; দারুল বাসীরাহ, আলেকজান্দ্রিয়া কর্তৃক প্রকাশিত; সনতারিখ বিহীন]
সম্মানিত পাঠক, মুক্তিপ্রাপ্ত দলের মূলনীতিগুলো কী—তা আমরা অনেকেই জানিনা। অজ্ঞতার কারণে ব্যক্তি ভুলের মধ্যে পতিত হয়। সুতরাং আমাদের জন্য এটি জানা অতীব জরুরি যে, মুক্তিপ্রাপ্ত দলের মূলনীতি কী কী, যাতে করে আমরা তা যথাযথভাবে গ্রহণ, সংরক্ষণ ও অনুসরণ করতে পারি। সৌদি ফাতাওয়া বোর্ড এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ সামাহাতুল ওয়ালিদ আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.] তাঁর “মিন উসূলি ‘আক্বীদাতি আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত” নামক পুস্তিকায় মুক্তিপ্রাপ্ত দল আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের ‘আক্বীদাহগত নয়টি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি নিয়ে নাতিদীর্ঘ আলোচনা করেছেন। আমরা বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে উক্ত পুস্তিকায় উল্লিখিত নয়টি মূলনীতি অনুবাদ করে ঈষৎ সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিতরূপে বাঙালি মুসলিম পাঠকবর্গের সামনে পেশ করছি। ওয়া বিল্লাহিত তাওফীক্ব।
·
১ম মূলনীতি: আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাবর্গ, কিতাবসমূহ ও রাসূলগণের প্রতি ঈমান আনয়ন করা এবং শেষ দিবসের প্রতি ও ভাগ্যের ভালো-মন্দের প্রতি ঈমান আনয়ন করা। বুখারী-মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, জিবরীল (‘আলাইহিস সালাম) নাবী ﷺ কে জিজ্ঞেস করলেন, “আমাকে ঈমান সম্পর্কে সংবাদ দিন।” তিনি ﷺ বললেন, “ঈমান এই যে, তুমি আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাবর্গ, কিতাবসমূহ, রসূলগণের প্রতি ও শেষ দিবসের প্রতি এবং ভাগ্যের ভালো-মন্দের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে।” [সাহীহ বুখারী, হা/৫০; সাহীহ মুসলিম, হা/৮]
·
২য় মূলনীতি: ঈমান হচ্ছে কথা, কাজ ও বিশ্বাসের নাম; এটা আনুগত্যের মাধ্যমে বৃদ্ধি পায়, আর পাপাচারিতার মাধ্যমে হ্রাস পায়। বিশ্বাস ব্যতিরেকে ঈমান শুধু কথা ও কাজের নাম নয়। কেননা এটা মুনাফিক্বদের ঈমান। আর কথা ও কাজ ব্যতিরেকে ঈমান শুধু (সত্য বলে) জানার নাম নয়। কেননা এটা কাফিরদের ঈমান। মহান আল্লাহ বলেছেন, “তারা (কাফিররা) অন্যায় ও ঔদ্ধত্যভরে নিদর্শনগুলোকে প্রত্যাখ্যান করল, যদিও তাদের অন্তর এগুলোকে সত্য বলে বিশ্বাস করেছিল।” [সূরাহ নামল: ১৪]
ঈমান শুধু বিশ্বাসের নাম নয়, অথবা আমল ব্যতিরেকে শুধু কথা ও বিশ্বাসের নাম নয়। কেননা এটা মুরজিয়াদের ঈমান। আল্লাহ তা‘আলা অনেক জায়গায় আমলকে ঈমান বলেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন, “মু’মিন তো তারাই, আল্লাহ’র কথা আলোচিত হলেই যাদের অন্তর কেঁপে ওঠে, আর তাদের কাছে যখন তাঁর আয়াত পঠিত হয়, তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে, আর তারা তাদের প্রতিপালকের উপর নির্ভর করে। তারা সালাত প্রতিষ্ঠা করে, আর আমি তাদেরকে যে জীবিকা দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে। এসব লোকেরাই হলো প্রকৃত মু’মিন।” [সূরাহ আনফাল: ২-৪]
মহান আল্লাহ আর‌ও বলেছেন, “আর আল্লাহ তোমাদের ঈমান বিনষ্ট করবেন না।” [সূরাহ বাক্বারাহ: ১৪৩]অর্থাৎ, বাইতুল মাক্বদিসের দিকে ফিরে আদায় করা তোমাদের সালাতকে বিনষ্ট করবেন না। আল্লাহ অত্র আয়াতে সালাতকে ‘ঈমান’ বলে অভিহিত করলেন।
·

৩য় মূলনীতি: ইসলাম বিনাশী কর্মাবলির কোনটা না করা পর্যন্ত তারা কোনো মুসলিমকে কাফির ফাতওয়া দেয় না। পক্ষান্তরে বড়ো শির্কের চেয়ে নিম্নপর্যায়ের কাবীরাহ গুনাহ, যে গুনাহ সংঘটনকারী কাফির হওয়ার ব্যাপারে কোনো দলিল নেই—যেমন সুদ খাওয়া, ব্যভিচার করা—সেই গুনাহ সংঘটনকারী ব্যক্তিকে তারা কাফির ফাতওয়া দেয় না, তবে তারা তাকে ত্রুটিপূর্ণ ঈমানের অধিকারী ফাসিক্ব বলে থাকে। সে যদি এই পাপ থেকে তাওবাহ না করে, তবে সে আল্লাহ’র ইচ্ছাধীন থাকবে। আল্লাহ চাইলে তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন, আবার চাইলে তাকে শাস্তিও দিতে পারেন; কিন্তু সে জাহান্নামে চিরস্থায়ী হবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাথে শরিক করা ক্ষমা করবেন না। তবে এর চেয়ে নিম্নপর্যায়ের অন্য সব (গুনাহ) যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন।” [সূরাহ নিসা: ৪৮]
এক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের মতাদর্শ মধ্যপন্থি, খারিজী ও মুরজিয়াদের দুই আদর্শের মধ্যভাগে অবস্থানকারী মতাদর্শ। যেই খারিজীরা কাবীরাহ গুনাহগারকে কাফির ফাতওয়া দেয়, যদিও সেই গুনাহ বড়ো কুফরের চেয়ে নিম্নপর্যায়ের হয়। আর যেই মুরজিয়ারা কাবীরাহ গুনাহগারকে পরিপূর্ণ ঈমানের অধিকারী মু’মিন বলে। তারা (মুরজিয়ারা) আরও বলে, পাপাচারিতা ঈমানের কোনো ক্ষতি করে না, যেমনভাবে সৎকর্মপরায়ণতা কুফরের কোনো উপকার করে না।
·
৪র্থ মূলনীতি: মুসলিম শাসকবর্গের আনুগত্য করা ওয়াজিব, যতক্ষণ না তারা পাপকাজের আদেশ করে। তারা যখন পাপকাজের আদেশ করবে, তখন এক্ষেত্রে (ওই পাপকাজের ক্ষেত্রে) তাদের আনুগত্য করা না-জায়েজ। তথাপি অন্যান্য ক্ষেত্রে সৎকাজে তাদের আনুগত্য অবশিষ্ট থাকবে। যেহেতু মহান আল্লাহ বলেছেন, “হে মু’মিনগণ, তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহ’র, আনুগত্য করো রাসূলের, এবং তোমাদের মধ্যকার কর্তৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের।” [সূরাহ নিসা: ৫৯]আর নাবী ﷺ বলেছেন,“আমি তোমাদেরকে আল্লাহভীতির এবং শ্রবণ ও আনুগত্যের উপদেশ দিচ্ছি, যদিও সে (শাসক) একজন হাবশী গোলাম হয়।” [আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৭; তিরমিযী, হা/২৬৭৬; ইবনু মাজাহ, হা/৪২; সনদ: সাহীহ]
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত মুসলিম শাসকের অবাধ্যতাকে স্বয়ং রাসূল ﷺ এর অবাধ্যতা বলে গণ্য করে। যেহেতু রাসূল ﷺ বলেছেন,“যে ব্যক্তি শাসকের আনুগত্য করল, সে ব্যক্তি আমারই আনুগত্য করল। আর যে ব্যক্তি শাসকের অবাধ্যতা করল, সে ব্যক্তি আমারই অবাধ্যতা করল।” [সাহীহ বুখারী, হা/২৯৫৭; সাহীহ মুসলিম, হা/১৮৩৫]
তারা (আহলুস সুন্নাহ) মুসলিম শাসকদের পিছনে সালাত আদায় করা, তাদের সাথে জিহাদ করা, তাদের জন্য কল্যাণ ও দৃঢ়তার দু‘আ করা এবং তাদেরকে (শার‘ঈ পদ্ধতিতে) নসিহত করা বিধেয় মনে করে।
·
৫ম মূলনীতি: মুসলিম শাসকবর্গ বড়ো কুফুরীর চেয়ে নিম্নপর্যায়ের কোনো পাপকাজে লিপ্ত হলে, তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা হারাম। যেহেতু নাবী ﷺ পাপকাজ ব্যতীত সবক্ষেত্রে তাদের আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছেন, যতক্ষণ না তাদের দ্বারা সুস্পষ্ট বড়ো কুফরি সংঘটিত হয়। বিদ‘আতী মু‘তাযিলী ও খারিজীদের বিপরীতে, যারা শাসকবর্গ কর্তৃক কোনো কাবীরাহ গুনাহ সংঘটিত হলে, তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ওয়াজিব মনে করে, যদিও তা বড়ো কুফরি না হয়। আর তারা এই কাজকে (বিদ্রোহকে) সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের অন্তর্ভুক্ত গণ্য করে। যদিও বাস্তবতা হলো, মু‘তাযিলী ও খারিজীদের উক্ত কর্মই সবচেয়ে বড়ো অসৎকাজ। যেহেতু এর ফলে উদ্ভূত হয় অসংখ্য ভয়ানক ও ক্ষতিকর বিষয়। যেমন: বিশৃঙ্খলা, বিপর্যয়, ঐক্যের বিনাশ এবং মুসলিম জনপদের ওপর শত্রুদের কর্তৃত্ব।
ইমাম আবূ জা‘ফার আত্ব-ত্বহাউয়ী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৩২১ হি.] শাসকদের আনুগত্যের ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের ‘আক্বীদাহ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন,“আমরা আমাদের নেতৃবৃন্দ ও শাসকবর্গের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা বৈধ মনে করি না, যদিও তারা জুলুম করে। আমরা তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক দিই না, আর তাদের আনুগত্য থেকে আমাদের হাত ছিনিয়ে নিই না। আমরা তাদের আনুগত্যকে ফরজ মনে করি এবং তা আল্লাহ’র আনুগত্যের অন্তর্ভুক্ত মনে করি, যতক্ষণ না তারা পাপকাজের নির্দেশ দেয়। আর আমরা তাদের জন্য কল্যাণ ও মার্জনার দু‘আ করি।” [ইমাম ইবনু আবিল ‘ইয আল-হানাফী (রাহিমাহুল্লাহ), শারহুল ‘আক্বীদাতিত্ব ত্বাহাউয়িয়্যাহ (তাহক্বীক্ব: আহমাদ শাকির); পৃষ্ঠা: ৩৭১; বাদশাহ ফাহাদ লাইব্রেরি, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪১৮ হিজরী।]
·
৬ষ্ঠ মূলনীতি: আল্লাহ’র রাসূল ﷺ এর সাহাবীবর্গের ব্যাপারে (অসৎ চিন্তা ও কথা থেকে) নিজেদের অন্তর এবং জিহ্বাকে নিরাপদে রাখা। যেমনভাবে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে (আহলুস সুন্নাহকে) স্বীয় বাণীতে এই গুণে গুণান্বিত করেছেন এবং তাদের প্রশংসা করেছেন, যখন তিনি মুহাজির ও আনসার সাহাবীদের কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেছেন,“(এ সম্পদ তাদের জন্যও) যারা অগ্রবর্তীদের পরে (ইসলামের ছায়াতলে) এসেছে। তারা বলে—‘হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদেরকে আর আমাদের ভাইদেরকে ক্ষমা করো, যারা ঈমানের ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রবর্তী হয়েছে, আর যারা ঈমান এনেছে তাদের ব্যাপারে আমাদের অন্তরে কোনো হিংসা-বিদ্বেষ রেখো না। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি বড়োই করুণাময়, অতি দয়ালু’।” [সূরাহ হাশর: ১০]
আর যেহেতু নাবী ﷺ বলেছেন,“তোমরা আমার সাহাবীদের গালি দিও না। সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ! তোমাদের কেউ যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ সোনাও দান-খয়রাত করে, তবে তা তাদের কারও এক মুদ বা অর্ধ-মুদ দান-খয়রাত করার সমান মর্যাদাসম্পন্নও হবে না।” [সাহীহ মুসলিম, হা/২৫৪০; ইবনু মাজাহ, হা/১৬১]
বিদ‘আতী রাফিদ্বী (শিয়া) এবং খারিজীদের বিপরীতে, যারা সাহাবীদের গালি দেয় এবং তাঁদের মর্যাদা অস্বীকার করে। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত এই মত পোষণ করে যে, আল্লাহ’র রাসূল ﷺ এর পর খালীফাহ হলেন আবূ বকর, তারপর ‘উমার, তারপর ‘উসমান, আর তারপর ‘আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুম আজমা‘ঈন)। যে ব্যক্তি তাঁদের কারও খিলাফাতের নিন্দা করে, সে নিজের পরিবারের গাধার চেয়েও পথভ্রষ্ট। যেহেতু সে সুস্পষ্ট দলিল এবং তার মতাদর্শের বিরুদ্ধে সংঘটিত এই ইজমা‘র বিরোধিতা করেছে যে, তাঁরা এই পর্যায়ক্রম অনুযায়ীই খিলাফাতের হকদার।
·
৭ম মূলনীতি: আল্লাহ’র রাসূল ﷺ এর পরিবার পরিজনকে ভালোবাসা এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করা। যেহেতু রাসূলুল্লাহ ﷺ অসিয়ত করে বলেছেন,“আমি আমার পরিবার পরিজনের বিষয়ে তোমাদেরকে আল্লাহ’র কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি।” [সাহীহ মুসলিম, হা/২৪০৮; ‘সাহাবীগণের মর্যাদা’ অধ্যায় (৪৫); পরিচ্ছেদ- ৪]
তাঁর পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন তাঁর সহধর্মিনীগণ, যাঁরা হলেন উম্মাহাতুল মু’মিনীন তথা মু’মিনদের মাতা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুন ওয়া আরদ্বাহুন)। আল্লাহ তা‘আলা ‘হে নবীপত্নীগণ’ বলে সম্বোধন করে তাঁদেরকে নসিহত করেছেন এবং মহা প্রতিদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এরপর তিনি বলেছেন, “হে নাবী’র পরিবার, আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পবিত্র ও নিষ্কলংক করতে।” [সূরাহ আহযাব: ৩৩]
প্রকৃতপক্ষে আহলে বাইত (নাবী পরিবার) বলতে নাবী ﷺ এর আত্মীয়দেরকে বোঝায়। কিন্তু এখানে আহলে বাইত (নাবী পরিবার) বলতে নির্দিষ্টভাবে কেবল সৎ লোকেরাই উদ্দেশ্য। পক্ষান্তরে তাঁর অসৎ আত্মীয়দের এক্ষেত্রে কোনো অধিকার নেই, যেমন আবূ লাহাব এবং অনুরূপ ব্যক্তিবর্গ। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, “আবূ লাহাবের হাত দুটো ধ্বংস হোক, আর ধ্বংস হোক সে নিজে।” [সূরাহ মাসাদ/লাহাব: ১]
দ্বীনের ক্ষেত্রে সৎকর্ম না করলে স্রেফ রাসূল ﷺ এর আত্মীয় হওয়া এবং তাঁর দিকে নিজেকে সম্পৃক্ত করা প্রভৃতির কিছুই আল্লাহ’র কাছে ব্যক্তির জন্য উপকারে আসবে না। তিনি ﷺ বলেছেন, “হে কুরাইশ সম্প্রদায়, তোমরা নিজেদের কিনে নাও। আমি আল্লাহ’র নিকট তোমাদের কোনো উপকারে আসব না। হে বানী ‘আব্দে মানাফ, আল্লাহ’র নিকট আমি তোমাদের কোনো উপকারে আসব না। হে ‘আব্বাস বিন আব্দুল মুত্বত্বালিব, আমি আল্লাহ’র নিকট তোমার কোনোই উপকারে আসব না। হে আল্লাহ’র রাসূলের ফুফু সাফিয়্যাহ, আমি আল্লাহ’র নিকট তোমার কোনোই উপকার করতে পারব না। হে মুহাম্মদের কন্যা ফাত্বিমাহ, আমার ধনসম্পদ থেকে যা ইচ্ছা চাও, কিন্তু আল্লাহ’র নিকট আমি তোমার কোনোই উপকারে আসব না।” [সাহীহ বুখারী, হা/৪৭৭১]
আমাদের ওপর রাসূল ﷺ এর সৎ আত্মীয়দের রয়েছে শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার। কিন্তু আমাদের জন্য জায়েজ নয় তাঁদের ব্যাপারে অতিরঞ্জন করা, জায়েজ নয় কোনো ‘ইবাদতের মাধ্যমে তাঁদের নৈকট্য অর্জন করা। জায়েজ নয় এমন বিশ্বাস পোষণ করা যে, আল্লাহ ছাড়া তাঁরাও উপকার ও ক্ষতি করতে পারেন। কেননা আল্লাহ তা‘আলা নাবী ﷺ কে বলেছেন, “বলো, ‘আমি তোমাদের কোনো ক্ষতি বা কল্যাণ করার ক্ষমতা রাখি না’।” [সূরাহ জিন: ২১]
তিনি আরও বলেছেন, “বলো, আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তা ছাড়া নিজের ভালো বা মন্দ করার কোনো ক্ষমতা আমার নেই। আমি যদি অদৃশ্যের খবর জানতাম, তাহলে নিজের জন্য অনেক বেশি ফায়দা হাসিল করে নিতাম, আর কোনো প্রকার অকল্যাণই আমাকে স্পর্শ করত না।” [সূরাহ আ‘রাফ: ১৮৮]স্বয়ং রাসূল ﷺ এর অবস্থাই যদি এমন হয়, তাহলে অন্যদের অবস্থা কীরূপ হতে পারে!?
·
৮ম মূলনীতি: (আল্লাহ’র) অলীদের কারামাতকে সত্যায়ন করা। আল্লাহ তা‘আলা অলীদের কতিপয়ের হাতে তাঁদের সম্মানার্থে যে অলৌকিক বিষয়ের প্রকাশ ঘটান, তাই হলো কারামাত। যেমনভাবে কিতাব ও সুন্নাহ তা প্রমাণ করে।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] অলীদের কারামাতের ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের ‘আক্বীদাহ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন,“আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে—(আল্লাহ’র) অলীদের কারামাতকে সত্যায়ন করা। আল্লাহ তা‘আলা তাঁদের (অলীদের) কতিপয়ের হাতে যে অলৌকিক বিষয়ের প্রকাশ ঘটান, তাই হলো কারামাত; আর তা আল্লাহ’র পক্ষ থেকে তাঁদের মাধ্যমে বিভিন্ন জ্ঞান, কাশফ, ক্ষমতা ও প্রভাব দ্বারা প্রকাশিত হয়। যেমন পূর্ববর্তী জাতিগুলোর মধ্যে যেসব কারামাত সংঘটিত হয়েছে, তার একটি সূরাহ কাহাফে বর্ণিত হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে এই উম্মাতের প্রথম যুগে সাহাবী, তাবি‘ঈ এবং পরবর্তীতে আগমনকারী উম্মাতের সকল যুগের মধ্যে প্রকাশিত কারামাত (যা বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে)। কেয়ামত পর্যন্ত এই উম্মাতের মধ্যে কারামাত অবশিষ্ট থাকবে।”[ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ), আল-‘আক্বীদাতুল ওয়াসিত্বিয়্যাহ; পৃষ্ঠা: ১২৩; আদ্বওয়াউস সালাফ, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি. (২য় প্রকাশ)]
কারামাত সংঘটিত হওয়াকে অস্বীকার করেছে মু‘তাযিলাহ ও জাহমিয়্যাহ সম্প্রদায়। অথচ এটা সুস্পষ্ট বাস্তবতাকে অস্বীকার করার নামান্তর।
কিন্তু আমাদের জন্য এটা জানা জরুরি যে, বর্তমানে আমাদের সময়ে কিছু মানুষ কারামাতের ক্ষেত্রে পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং এক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করেছে। এমনকি এর মধ্যে এমন কিছু বিষয় প্রবিষ্ট করেছে, যা তার অন্তর্ভুক্ত নয়। যেমন: ভেলকি এবং জাদুকর, শয়তান ও মিথ্যুক দাজ্জালদের কর্মকাণ্ড।
কারামাত এবং ভেলকির মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট। কারামাত আল্লাহ’র সৎ বান্দাদের হাতে সংঘটিত হয়। আর ভেলকি জাদুকর, কাফির ও নাস্তিকদের হাতে সংঘটিত হয়, মানুষকে পথভ্রষ্ট করার জন্য এবং ভয় দেখিয়ে তাদের ধনসম্পদ আত্মসাৎ করার জন্য। কারামাত সংঘটিত হয় (শরিয়তের) অনুসরণের কারণে, আর ভেলকি সংঘটিত হয় কুফর ও পাপাচারিতার কারণে।
·
৯ম মূলনীতি: দলিল প্রদানের ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে—আল্লাহ’র কিতাব এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সুন্নাহ’য় যা এসেছে প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে তার অনুসরণ করা। ব্যাপকভাবে মুহাজির ও আনসারদের সকল সাহাবী যে মতাদর্শের ওপর ছিলেন তা অনুসরণ করা, আর বিশেষভাবে সুপথপ্রাপ্ত খালীফাহদের অনুসরণ করা। যেহেতু নাবী ﷺ এ ব্যাপারে অসিয়ত করে বলেছেন, “তোমরা অবশ্যই আমার সুন্নাত এবং আমার হেদায়াতপ্রাপ্ত খালীফাহগণের সুন্নাত অনুসরণ করবে।” [আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৭; সনদ: সাহীহ]
তারা আল্লাহ’র কথা এবং রাসূলের কথার ওপর কোনো মানুষের কথাকে প্রাধান্য দেয় না। একারণে তাদেরকে আহলুল কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ বলা হয়। আল্লাহ’র কিতাব এবং রাসূলের সুন্নাহকে ধারণ করার পর তারা উম্মাতের ‘আলিমগণের ইজমা‘কে (মতৈক্য) ধারণ করে। তারা প্রথম উৎস দুটি তথা কিতাব ও সুন্নাহ’র পর এই তৃতীয় উৎসের (ইজমা‘) ওপর নির্ভর করে।
আর মানুষের মধ্যে যে বিষয়ে ইখতিলাফ (মতভেদ) সৃষ্টি হয়, সে বিষয়কে তারা কিতাব ও সুন্নাহ’র কাছে সোপর্দ করে। যেহেতু মহান আল্লাহ বলেছেন,“যদি কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটে, তাহলে সেই বিষয়কে আল্লাহ এবং রাসূলের (নির্দেশের) দিকে ফিরিয়ে দাও, যদি তোমরা আল্লাহ এবং আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান এনে থাক; এটাই সবচেয়ে উত্তম পন্থা এবং সুন্দরতম মর্মকথা।” [সূরাহ নিসা: ৫৯]
তারা আল্লাহ’র রাসূল ﷺ ছাড়া আর কারও নিকট (অনুসরণের) রশি বাঁধে না। তারা কোনো ব্যক্তির রায়ের ব্যাপারে পক্ষপাতিত্ব করে না, যতক্ষণ না সে কথা কিতাব ও সুন্নাহ’র সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। তারা এই বিশ্বাস পোষণ করে যে, মুজতাহিদ ভুল করে, আবার সঠিকও করে। তারা কেবলমাত্র তাকেই ইজতিহাদের অনুমোদন দেয়, যার মধ্যে—‘আলিমদের মতে—ইজতিহাদের সুবিদিত শর্তসমূহ একত্রিত হয়েছে।
গ্রহণযোগ্য ইজতিহাদী মাসআলাহসমূহের ক্ষেত্রে তাদের (মধ্যে) কোনো বিরোধ নেই। ইজতিহাদী মাসআলাহগুলোতে তাদের মধ্যকার ইখতিলাফ (মতভেদ) নিজেদের মধ্যে শত্রুতা ও পারস্পরিক সম্পর্কচ্ছেদ আনয়ন করে না, যেমনটা গোঁড়া ও বিদ‘আতীরা করে থাকে। বরং তারা একে অপরকে ভালোবাসে, একে অপরের সাথে মিত্রতা পোষণ করে। তারা একে অপরের পিছনে সালাত আদায় করে। যদিও তাদের মধ্যে কিছু শাখাগত মাসআলাহ’য় মতদ্বৈধতা রয়েছে। বিদ‘আতীদের বিপরীতে, যারা তাদের বিরোধীদের সাথে শত্রুতা পোষণ করে এবং তাদেরকে পথভ্রষ্ট বা কাফির আখ্যা দেয়।
·
তথ্যসূত্র:
ইমাম সালিহ আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ), মিন উসূলি ‘আক্বীদাতি আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত; পৃষ্ঠা: ১৭-৪১; আল-মীরাসুন নাবাউয়ী, আলজিয়ার্স কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪৩৩ হি./২০১২ খ্রি. (২য় প্রকাশ)।
·
অনুবাদক: মুহাম্মাদ ‘আব্দুল্লাহ মৃধা

No comments:

Post a Comment

Download AsPDF

Print Friendly and PDFPrint Friendly and PDFPrint Friendly and PDF
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...