Thursday 30 June 2016

রমযান মাসের ৩০ আসর



শায়খ মুহাম্মদ ইবন সালেহ ইবন উসাইমীন রহ.
অনুবাদ: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া ও আলী হাসান তৈয়ব
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
ভূমিকা
নিশ্চয়ই সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য; আমরা তাঁর প্রশংসা করি, তাঁর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি, তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি, তাঁর কাছেই তাওবা করি; আর আমরা আমাদের নফসের জন্য ক্ষতিকর এমন সকল খারাপি এবং আমাদের সকল প্রকার মন্দ আমল থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই। সুতরাং আল্লাহ যাকে পথ প্রদর্শন করেন, তাকে পথভ্রষ্ট করার কেউ নেই; আর যাকে তিনি পথহারা করেন, তাকে পথ প্রদর্শনকারীও কেউ নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো হক্ক ইলাহ নেই, তাঁর কোন শরীক নেই এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। আল্লাহ তার ওপর, তার পরিবার-পরিজন, সকল সাহাবী এবং কিয়ামত পর্যন্ত যারা সুন্দরভাবে তাদের অনুসরণ করবে তাদের সবার উপর সালাত ও যথাযথ সালাম পেশ করুন।
অতঃপর:
এ হচ্ছে ‘মুবারক রমযান মাসের কিছু আসর’; যাতে সিয়াম, কিয়াম, যাকাত ইত্যাদি ও এ উত্তম মাসের উপযোগী কিছু বিধান স্থান পেয়েছে।
* আমি এটাকে দৈনিক অথবা রাত্রিকালিন আসররূপে সাজিয়েছি।
* এর অধিকাংশ খুতবা বা আসরের ভূমিকা আমি ‘কুররাতুল ‘উয়ূনিল মুবসিরাহ বি তালখীসে কিতাবিত তাবসিরাহ’ গ্রন্থ থেকে যতটুকু যথা সম্ভব পরিপাটি করে চয়ন করেছি।
* আর আমি এখানে যত বেশি সম্ভব হুকুম-আহকাম, বিধি-বিধান, ও আদাব নিয়ে নিয়ে এসেছি; কারণ মানুষের এটাই বেশি প্রয়োজন।
* আর আমি এটাকে ‘মাজালিসু শাহরি রামাদান’ বা ‘রমযান মাসের আসরসমূহ’ নামকরণ করেছি।
মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদের এ আমলটুকু একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে বানান এবং এর দ্বারা উপকৃত করেন। নিশ্চয় তিনি অত্যাধিক দাতা ও সম্মানিত।
প্রথম আসরঃরমযান মাসের ফযীলত
সকল প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য, যিনি আসমান, যমীন ও তার মধ্যকার সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন। রাতের অন্ধকারে ক্ষুদ্র পীপিলিকার বেয়ে উঠাও যার দৃষ্টি বহির্ভূত নয় এবং আসমান ও যমীনের বিন্দু-বিসর্গও যার জ্ঞানের বাইরে নয়। “যা আছে আসমানসমূহ, যমীন ও এ দু’য়ের মধ্যবর্তী স্থানে এবং যা আছে মাটির নিচে সব তাঁরই। আর যদি তুমি উচ্চস্বরে কথা বল তবে তিনি গোপন ও অতি গোপন বিষয় জানেন। আল্লাহ তিনি ছাড়া সত্য কোনো মা‘বুদ নাই; সুন্দর নামসমূহ তাঁরই।” [সূরা ত্বা-হা: ৬-৮] তিনি আদম ‘আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তাকে পরীক্ষার মাধ্যমে মনোনীত করে সঠিক পথ প্রদর্শন করেছেন। তিনি নুহ ‘আলাইহিস সালামকে নবী বানিয়ে পাঠিয়েছেন। অতঃপর তিনি আল্লাহর নির্দেশে নৌকা তৈরি করেছেন এবং সেটাকে চালিয়েছেন। স্বীয় অন্তরঙ্গ বন্ধু ইব্রাহিম ‘আলাইহিস সালামকে আগুন থেকে নাজাত দিয়েছেন এবং সেটার উষ্ণতাকে সুশীতল ও আরামদায়ক করেছেন। মুসা ‘আলাইহিস সালামকে নয়টি নিদর্শন দান করেছেন; কিন্তু ফেরআউন সেটা দ্বারা নসীহত নিতে পারেনি, তার অবস্থান থেকেও সরে আসে নি। ঈসা ‘আলাইহিস সালামকে এমন নিদর্শন দান করেছেন যা সৃষ্টিকুলকে বিস্মিত করে দিয়েছে। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর এমন একটি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, যাতে রয়েছে সুস্পষ্ট প্রমাণ এবং হেদায়েত।
কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি তাঁর অফুরন্ত অসংখ্য ও অনবরত প্রাপ্ত নেয়ামতের। অসংখ্য দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক উম্মুল কুরা (মক্কায়) প্রেরিত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর। অবারিত শান্তি বর্ষিত হোক তাঁর ওপর, হেরা গুহায় তার নিশ্চিত পরম সঙ্গী আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, সত্যের ইঙ্গিত প্রাপ্ত মতের অধিকারী এবং আল্লাহর আলোতে যিনি দেখতে পেতেন সে উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, তাঁর দু কন্যার স্বামী যিনি ছিলেন সত্যভাষী সে উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, তাঁর চাচাত ভাই আলী রাদিয়াল্লাহ আনহু, যিনি ছিলেন জ্ঞানের সাগর, বনের বাঘ, তাদের সবার উপর এবং অপরাপর সম্মানিত আহলে বাইত রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম, সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম যাদের শ্রেষ্ঠত্ব জগতে ছড়িয়ে পড়েছে এবং মুসলিম উম্মাহর সকল সদস্যের ওপর সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক।

প্রিয় ভাই সকল! আমাদের সামনে সম্মানিত রমযান সমাগত যা ইবাদতের মহৎ মওসুম। যে মাসে আল্লাহ তা‘আলা নেক আমলের সাওয়াব সীমাহীন বৃদ্ধি করে দেন এবং দান করেন অফুরন্ত কল্যাণ। উন্মুক্ত করেন নেক কাজে উৎসাহী ব্যক্তির জন্য কল্যাণের সকল দ্বার। এ মাস কুরআন নাযিলের মাস। কল্যাণ ও বরকতের মাস। পুরস্কার ও দানের মাস।
﴿ شَهۡرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِيٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلۡقُرۡءَانُ هُدٗى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَٰتٖ مِّنَ ٱلۡهُدَىٰ وَٱلۡفُرۡقَانِۚ ﴾ [البقرة: ١٨٥]
‘রমযান মাস, যাতে নাযিল হয়েছে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন, যা বিশ্ব মানবের জন্য হেদায়েত, সুস্পষ্ট পথ নির্দেশ এবং হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৫}
এ মাস রহমত, মাগফিরাত এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাস। যার প্রথমে রয়েছে রহমত, মাঝে রয়েছে মাগফিরাত এবং শেষে জাহান্নাম হতে মুক্তি।
এ মাসের মর্যাদা ও ফযীলতের ব্যাপারে এসেছে অনেক হাদীস সমূহ যেমন এসেছে অনেক বাণী:
* সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
إِذَا جَاءَ رَمَضَانُ فُتِّحَتْ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ، وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ النَّارِ، وَصُفِّدَتِ الشَّيَاطِينُ
‘যখন রমযান মাস আগমন করে, তখন জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখা হয়’।
এ মাসে জান্নাতের দ্বারসমূহ খুলে দেয়া হয় অধিকহারে নেক আমল করার জন্য এবং আমলকারীদের উৎসাহ প্রদানের জন্য। আর জাহান্নামের দ্বারসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় ঈমানদারদের গুনাহ কম অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে। শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়, যাতে সে অন্যান্য মাসের মত এ মুবারক মাসে মানুষকে পথ ভ্রষ্টতার দিকে নিয়ে যেতে না পারে।
* ইমাম আহমদ রহ. আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
أُعْطِيَتْ أُمَّتِي خَمْسَ خِصَالٍ فِي رَمَضَانَ، لَمْ تُعْطَهَا أُمَّةٌ قَبْلَهُمْ: خُلُوفُ فَمِ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللَّهِ مِنْ رِيحِ الْمِسْكِ، وَتَسْتَغْفِرُ لَهُمُ الْمَلَائِكَةُ حَتَّى يُفْطِرُوا، وَيُزَيِّنُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ كُلَّ يَوْمٍ جَنَّتَهُ، ثُمَّ يَقُولُ: يُوشِكُ عِبَادِي الصَّالِحُونَ أَنْ يُلْقُوا عَنْهُمُ الْمَئُونَةَ وَالْأَذَى وَيَصِيرُوا إِلَيْكِ، وَيُصَفَّدُ فِيهِ مَرَدَةُ الشَّيَاطِينِ، فَلَا يَخْلُصُوا فِيهِ إِلَى مَا كَانُوا يَخْلُصُونَ إِلَيْهِ فِي غَيْرِهِ، وَيُغْفَرُ لَهُمْ فِي آخِرِ لَيْلَةٍ ” قِيلَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، أَهِيَ لَيْلَةُ الْقَدْرِ؟ قَالَ: لَا، وَلَكِنَّ الْعَامِلَ إِنَّمَا يُوَفَّى أَجْرَهُ إِذَا قَضَى عَمَلَهُ
‘আমার উম্মতকে রমযানে পাঁচটি বৈশিষ্ট্য দেয়া হয়েছে, যা পূর্ববর্তী কোনো উম্মতকে দেয়া হয়নি: ১। সিয়াম পালনকারীর মুখের না খাওয়াজনিত গন্ধ আল্লাহর কাছে মিসকের সুঘ্রাণ থেকেও উত্তম। ২। ইফতারের পূর্ব পর্যন্ত ফেরেশতাগণ সিয়াম পালনকারীর জন্য মাগফিরাতের দো‘আ করতে থাকে। ৩। আল্লাহ তা‘আলা প্রতিদিন তাঁর জান্নাতকে সুসজ্জিত করে বলেন, আমার নেককার বান্দাগণ কষ্ট স্বীকার করে অতিশীঘ্রই তোমাদের কাছে আসছে। ৪। দুষ্ট প্রকৃতির শয়তানদেরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়, ফলে তারা অন্য মাসের ন্যায় এ মাসে মানুষকে গোমরাহীর পথে নিতে সক্ষম হয় না। ৫। রমযানের শেষ রজনীতে সিয়াম পালনকারীদের ক্ষমা করে দেয়া হয়। বলা হলো- হে আল্লাহর রাসূল, এ ক্ষমা কি কদরের রাতে করা হয়? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, বরং কোনো শ্রমিককে তার পারিশ্রমিক তখনই দেয়া হয়, যখন সে কাজ শেষ করে’।
আমার দীনী ভাইয়েরা! এ মূল্যবান পাঁচটি বৈশিষ্ট্য আল্লাহ তা‘আলা অন্য সকল উম্মতের মধ্য থেকে কেবল আপনাদের দান করেছেন এবং এর মাধ্যমে আপনাদের ওপর নেয়ামাত পূর্ণ করে বিশেষ ইহসান করেছেন। এভাবে আল্লাহর কতই না নেয়ামত ও অনুগ্রহ আপনাদের ওপর ছায়া হয়ে আছে; কারণ,
﴿ كُنتُمۡ خَيۡرَ أُمَّةٍ أُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ تَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَتَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَتُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِۗ ﴾ [ال عمران: ١١٠]
‘তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত। মানুষের কল্যাণের জন্যই তোমাদের বের করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে। আর আল্লাহর প্রতি দৃঢ় ঈমান রাখবে’। {সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১১০}
[হাদীসে বর্ণিত পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের বিশ্লেষণ]
প্রথম বৈশিষ্ট্য:
خُلُوفُ فَمِ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللَّهِ مِنْ رِيحِ الْمِسْكِ
‘সিয়াম পালনকারীর মুখের না খাওয়াজনিত গন্ধ মহান আল্লাহর কাছে মিসকের চেয়েও অধিক উত্তম ঘ্রাণসম্পন্ন’।
আরবী خُلُوفُ শব্দটি প্রথম হরফে পেশ ও যবর যুক্ত হয়ে অর্থ দেয়, পাকস্থলি খাবারশূন্য হলে মুখের ঘ্রাণের পরিবর্তন এবং এক প্রকার ভিন্ন গন্ধ সৃষ্টি হওয়া। এ দুর্গন্ধ মানুষের কাছে অপ্রিয় হলেও আল্লাহ তা‘আলার কাছে মিসক থেকেও অধিক সুঘ্রাণসম্পন্ন। কেননা এ দুর্গন্ধ আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতের কারণে সৃষ্টি হয়েছে। আর প্রত্যেক অপ্রিয় জিনিস যা আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর ইবাদতের কারণে সৃষ্টি হয় তা আল্লাহর কাছে প্রিয় এবং এর জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে কল্যাণকর শ্রেষ্ঠ ও উত্তম প্রতিদান প্রদান করা হয়।
যেমন দেখুন শহীদদের প্রতি, যিনি আল্লাহর কালেমাকে সমুন্নত রাখার উদ্দেশ্যে শাহাদাত বরণ করেন। কিয়ামতের দিন তিনি এমন অবস্থায় উঠবেন যে, তার শরীরের ক্ষতস্থান থেকে রক্ত টপটপ করে পড়তে থাকবে যার রং হবে রক্তের কিন্তু ঘ্রাণ হবে মিসকের ঘ্রাণের ন্যায় ।
অনুরূপভাবে হাজীদের ব্যাপারে এসেছে, আল্লাহ তা‘আলা আরাফাতের ময়দানের অবস্থানরতদের ব্যাপারে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করে বলেন,
انْظُرُوا إِلَى عِبَادِي هَؤُلَاءِ جَاءُونِي شُعْثًا غُبْرًا
‘তোমরা আমার বান্দাদের প্রতি লক্ষ্য করো, এরা আমার কাছে এলোমেলো চুল, ধুলিমাখা অবস্থায় হাজির হয়েছে’। হাদীসটি ইমাম আহমাদ ও ইবন হিব্বান তার সহীহ গ্রন্থে সংকলন করেছেন।
এক্ষেত্রে এলোমেলো চুল আল্লাহর কাছে প্রিয় হওয়ার কারণ, তা আল্লাহর আনুগত্যে ‌ইহরামের নিষিদ্ধ বস্তুসমূহ পরিত্যাগ ও বিলাসিতা বর্জনের মাধ্যমে সৃষ্ট হয়েছে।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য:
وَتَسْتَغْفِرُ لَهُمُ الْمَلَائِكَةُ حَتَّى يُفْطِرُوا
‘সিয়ামপালনকারীর জন্য ইফতারের পূর্ব পর্যন্ত ফেরেশতাগণ মাগফিরাত কামনা করতে থাকেন।’
ফেরেশতাগণ আল্লাহর সম্মানিত বান্দা।
﴿ لَّا يَعۡصُونَ ٱللَّهَ مَآ أَمَرَهُمۡ وَيَفۡعَلُونَ مَا يُؤۡمَرُونَ ٦ ﴾ [التحريم: ٦]
‘তারা আল্লাহর কোনো নির্দেশ অমান্য করে না। বরং তাঁর সকল নির্দেশ পালন করে।’ {সূরা আত-তাহরীম, আয়াত: ৬}
যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সিয়াম পালনকারীদের জন্য দো‘আ করার অনুমতি দিয়েছেন। এজন্য তাদের দো‘আ আল্লাহর কাছে কবুল হওয়াই অধিক যুক্তিযুক্ত। এটা উম্মতে মুহাম্মদীর বৈশিষ্ট্য যে, আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদেরকেও এ উম্মতের সিয়াম পালনকারীদের জন্য জন্য দো‘আ করার অনুমতি দিয়েছেন। যা তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি, তাদের স্মরণ সমাদৃত হওয়া এবং তাদের সিয়াম অধিক ফযীলতপূর্ণ হওয়ার প্রমাণ বহন করে।
আর ইস্তেগফার হচ্ছে, মাগফিরাত কামনা করা। দুনিয়া ও আখেরাতে গুনাহকে গোপন রাখা এবং এড়িয়ে যাওয়া উদ্দেশ্য। এটাই প্রধান আকাঙ্ক্ষা ও সর্বোচ্চ প্রাপ্তির বিষয়। কারণ, প্রত্যেক আদম সন্তান গুনাহগার, নিজের উপর সীমালঙ্ঘনকারী, মহান আল্লাহর ক্ষমার বেশি মুখাপেক্ষী।
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য:
وَيُزَيِّنُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ كُلَّ يَوْمٍ جَنَّتَهُ، ثُمَّ يَقُولُ: يُوشِكُ عِبَادِي الصَّالِحُونَ أَنْ يُلْقُوا عَنْهُمُ الْمَئُونَةَ وَالْأَذَى وَيَصِيرُوا إِلَيْكِ
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা প্রতিদিন (মাহে রমযানে) জান্নাতকে সুসজ্জিত করেন এবং তাকে লক্ষ্য করে বলেন, অতি শীঘ্রই আমার নেককার বান্দাগণ দুনিয়ার ক্লেশ-যাতনা সহ্য করে তোমার কাছে আসছে।’
আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যহ জান্নাতকে সুসজ্জিত করেন তার নেককার বান্দাদের প্রস্তুতি ও তাতে প্রবেশে উৎসাহ এবং প্রেরণা দেওয়ার জন্য।
হাদীসে বর্ণিত الْمَئُونَةَ وَالْأَذَى এর অর্থ হচ্ছে: দুনিয়ার দুঃখ-কষ্ট। অতএব, দুনিয়ার ক্লেশ-যাতনা সহ্য করা এবং সদা সর্বদা নেক আমলের প্রস্তুতি গ্রহণ ও তাতে লিপ্ত থাকার মধ্যেই রয়েছে মুমিনের ইহকালীন ও পরকালীণ সফলতা। এর মাধ্যমেই শান্তির আবাসস্থল জান্নাতের পথ সুগম করা উচিত।
চতুর্থ বৈশিষ্ট্য:
وَيُصَفَّدُ فِيهِ مَرَدَةُ الشَّيَاطِينِ
‘বিতাড়িত শয়তানদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়।’
এর ফলে এরা আল্লাহর নেককার বান্দাদের অন্য মাসের মত গোমরাহ করার এবং সৎ কাজ থেকে বিরত রাখার সুযোগ পায় না। এটা আল্লাহ তা‘আলার তরফ থেকে মেহেরবানী যে, তিনি বান্দাদের থেকে তাদের চির শত্রু শয়তানকে বন্দি করে রেখেছেন যে শত্রুবাহিনী মানুষদেরকে জাহান্নামে নিয়ে যেতে চায়।
এ কারণে আপনি দেখবেন, নেককার বান্দাগণ অন্যান্য মাসের তুলনায় এ মাসে নেক কাজের প্রতি অধিক উৎসাহী হয় এবং গুনাহের কাজ থেকে অনেক দূরে থাকে।
পঞ্চম বৈশিষ্ট্য:
وَيُغْفَرُ لَهُمْ فِي آخِرِ لَيْلَةٍ
‘আল্লাহ তা‘আলা মাহে রমযানের শেষ রাতে উম্মতে মুহাম্মদীকে ক্ষমা করে দেন।’
যখন তারা সিয়াম (রোযা) ও কিয়াম (তারাবীর সালাতের) মাধ্যমে এ মুবারক মাসের হক আদায় করে। তখন আল্লাহ তাদের বিশেষভাবে ক্ষমা করেন।
আর সিয়াম পালন যথাযথভাবে করা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নিঃসন্দেহে একটি মেহেরবানী। তিনি তাদের আমল শেষে তাদের পরিপূর্ণ প্রতিদান দিয়ে তাদের প্রতি দয়া ও মেহেরবানী করেন। কারণ একজন কাজের লোককে কাজের শেষেই তার পাওনা পুরা করে দিতে হয়।
মহান আল্লাহ তা‘আলা মাহে রমযানের এ প্রতিদানের মাধ্যমে তাঁর বান্দাদের ওপর তিন দিক থেকে করুণা ও মেহেরবানী করেছেন।
প্রথমত: আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের জন্য এ মাহে রমযানে নেক আমল করার এমন ব্যবস্থা করেছেন যা তাদের মর্যাদা বুলন্দ করাসহ তাদের গোনাহ মাফের কারণ হবে।
যদি তিনি তাদের জন্য এ ব্যবস্থা না করতেন তাহলে তারা নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করতো না। সুতরাং রাসূলগণের কাছে ওহী প্রেরণ ছাড়া কোনো ইবাদতই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না।
এ জন্যই যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করার ব্যবস্থা করেন। তাদের ওপর আল্লাহ তা‘আলা অসন্তুষ্ট হন এবং তাদের কাজকে শিরকের অন্তর্ভুক্ত করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ أَمۡ لَهُمۡ شُرَكَٰٓؤُاْ شَرَعُواْ لَهُم مِّنَ ٱلدِّينِ مَا لَمۡ يَأۡذَنۢ بِهِ ٱللَّهُۚ ﴾ [الشورى: ٢١]
‘না-কি তাদের জন্য কোন শরীক বা অংশীদার ব্যক্তিবর্গ আছে যারা তাদের জন্য কোন দ্বীন বা জীবনাদর্শ চালু করেছে যা আল্লাহ মোটেই অনুমতি দেননি’। {সূরা আশ-শুরা, আয়াত: ২১}
দ্বিতীয়ত: আল্লাহ তাঁর বান্দাদের এ মাহে রমযানে নেক আমল করার তাওফীক দান করেন। অথচ অধিকাংশ মানুষই এ নেক আমলকে পরিত্যাগ করে থাকে। যদি আল্লাহর সাহায্য ও মেহেরবানী তাদের প্রতি না থাকতো তবে তারা নেক আমলের সম্মান দিতে পারতো না।
সুতরাং এটি সম্পূর্ণই আল্লাহর দান এবং তিনিই পারেন কাউকে নেয়ামতের খোঁটা দিতে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ يَمُنُّونَ عَلَيۡكَ أَنۡ أَسۡلَمُواْۖ قُل لَّا تَمُنُّواْ عَلَيَّ إِسۡلَٰمَكُمۖ بَلِ ٱللَّهُ يَمُنُّ عَلَيۡكُمۡ أَنۡ هَدَىٰكُمۡ لِلۡإِيمَٰنِ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ١٧ ﴾ [الحجرات: ١٧]
‘তারা আপনার প্রতি (ওহে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইসলাম গ্রহণের ইহসান বা অনুগ্রহ প্রকাশ করছে। আপনি বলে দিন, তোমরা ইসলাম গ্রহণ করে আমার প্রতি অনুগ্রহ প্রকাশ করো না। বরং আল্লাহ তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। তিনি মেহেরবানী করে তোমাদের ঈমানের পথে পরিচালিত করেছেন। যদি তোমরা তোমাদের দাবীতে সত্যবাদী হও’। {সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১৭}
তৃতীয়ত: আল্লাহ তা‘আলা এ মাহে রমযানে অনেক প্রতিদান দিয়ে মেহেরবানী করেছেন। প্রতিটি নেক আমল দশগুণ হতে সাতশত বা তার চেয়েও অধিক গুণে বর্ধিত হবে। সুতরাং নেক আমল করে অনেক সাওয়াব অর্জন করা এটা আল্লাহ তা‘আলারই করুণা ও মেহেরবানী আর যাবতীয় প্রশংসা সকল সৃষ্টির রব আল্লাহর জন্যই।
আমার ভাইয়েরা! মাহে রমযান একটি বিরাট নিয়ামত। এ নিয়ামত তার জন্য যার কাছে এ মাস পৌঁছার পর সে যথাযথভাবে এ মাসের হক পালন করে। গোনাহ থেকে বেঁচে থেকে নেক আমল ও আনুগত্যের মাধ্যমে তার রবের দিকে ধাবিত হয়, গাফলতি ছেড়ে আল্লাহর যিকিরে মত্ত হয় এবং তাঁর থেকে দূরত্ব ছেড়ে তাঁর নৈকট্য অর্জন করে তাঁর দিকে এগিয়ে যায়। কবির ভাষায়:
يا ذا الذي ما كفاه الذين في رجب حتى عصى ربه في شهر شعبان
لقد اظلك شهر الصوم بعدهمـــا فلا تصـيره أيضا شهر عصيان
واتل القرآن وسبح فيه مجتهــــدا فإنــــــه شهر تسبيح وقرآن
كم كنت تعرف ممن صام في سلف من بين اهل وجيران وأخـــوان
افناهم الموت واستبقاك بعد بعد همو حيا فما اقرب القاصى من الداني
‘হে অমুক ব্যক্তি! যার গুনাহ রজব মাসে যথেষ্ট পরিমাণ হয়েছে। এমনকি শাবান মাসেও সে তার রবের প্রতি নাফরমানী করেছে।
রজব ও শাবান মাসের পর তোমার কাছে সুশীতল ছায়া বিস্তার করে মাহে রমযান হাযির হয়েছে। তাকে তুমি পাপের মাস বানিয়ে নিও না।
কুরআন তিলাওয়াত করো, গভীর মনোনিবেশ নিয়ে তাসবীহ পাঠ করো। কারণ এটা কুরআন তিলাওয়াত ও তাসবীহ পাঠের মাস।
তোমার আত্মীয়-স্বজন, পরিবার-পরিজন, ভাই-বোন, পাড়া-প্রতিবেশী যাদের অনেককেই তুমি চিনতে জানতে, তারা সিয়াম পালনের মধ্য দিয়ে নিজেদের জীবন অতিবাহিত করেছে।
মৃত্যু তাদেরকে পৃথিবী থেকে বিদায় করে দিয়েছে। তোমাকেও মরতে হবে। অবশ্য তুমি এখনো পৃথিবীতে জীবতাবস্থায় আছ।
তবে শুনে রাখো! আমল করতে হবে। কারণ, কি করে আমল থেকে দূরে থাকা ব্যক্তি আমলকারী আল্লাহর নৈকট্যশীল বান্দাহর নিকটে বা সমপর্যায়ে আসতে পারে?
হে আল্লাহ! আপনি আমাদের জাগ্রত করুন উদাসীনতার নিদ্রা থেকে, তাওফীক দিন প্রস্থানের আগেই তাকওয়ায় সুসজ্জিত হতে এবং অবসর সময়গুলো কাজে লাগাতে। আর হে শ্রেষ্ঠ করুণাময়, আপনি আপনার দয়ায় ক্ষমা করুন আমাদেরকে, আমাদের পিতামাতা ও সকল মুসলিমকে।
আর আল্লাহ সালাত ও সালাম পেশ করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদ ও তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাথীদের উপর।
দ্বিতীয় আসরঃসিয়ামের ফযীলতের বর্ণনা
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি সূক্ষ্মদ্রষ্টা, দয়ালু ও দয়াপ্রদর্শনের মালিক, অমুখাপেক্ষী, শক্তিশালী ক্ষমতাধর, সহিষ্ণু, সম্মানিত, করুণাময় ও অতিশয় দয়ার্দ্র, তিনিই প্রথম; তাঁর আগে কেউ নেই, তিনিই সর্বশেষ; তাঁর পরে কেউ নেই। তিনি যাহের-সর্বোপরে; তার ওপর কিছু নেই, তিনি বাতেন-সর্বনিকটে; তাঁর চেয়ে নিকটে কিছু নেই। যা হবে এবং হয়েছে সবই তাঁর জ্ঞান ভাণ্ডারের আয়ত্বাধীন। সম্মানিত করেন আবার অপমানিতও করেন, তিনি বিত্তশালী বানান এবং তিনিই বিত্তহীন করেন। যা ইচ্ছা তা করেন তাঁর প্রজ্ঞা অনুযায়ী; প্রতিদিন তিনি কোনো না কোনো গুরুত্বপূর্ণ কর্ম করেন। যমীনকে তার বিভিন্ন প্রান্তে পাহাড় দিয়ে পেরেক মেরে দিয়েছেন। ভারী মেঘমালাকে পানি নিয়ে পাঠিয়েছেন যার মাধ্যমে যমীনকে জীবিত করেন। যমীনের বুকে বসবাসকারী প্রত্যেকের জন্য মৃত্যুর ক্ষণ নির্ধারণ করেছেন যাতে করে যারা অপরাধী তাদেরকে অপরাধের শাস্তি দেওয়া আর যারা ইহসান তথা সঠিক কাজ করেছে তাদের কাজের সঠিক প্রতিদান প্রদান করা যায়।
আমি তাঁর যাবতীয় পূর্ণ-সুন্দর গুণাগুণের উপর তার প্রশংসা করছি। তার পরিপূর্ণ নে‘আমতের উপর তার শুকরিয়া আদায় করছি। আর শুকরিয়ার মাধ্যমেই দান ও দয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত কোনো হক ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই, তিনি রাজাধিরাজ, যথাযথ বিচারকারী। আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল, যাকে মানুষ ও জিন সবার জন্য প্রেরণ করা হয়েছে।
আল্লাহ তাঁর উপর, তার পরিবার-পরিজন, সাহাবী ও যাবতকাল ব্যাপী তার অনুসারীদের উপর দরুদ পাঠ করুন এবং তাদের প্রতি যথাযথ সালাম প্রেরণ করুন।
দ্বীনী ভাইগণ! নিশ্চয়ই সিয়াম হচ্ছে অন্যতম উত্তম ইবাদত ও মহান পুণ্যকর্ম। বিভিন্ন আয়াত ও হাদীসে এর ফযীলত বর্ণিত আছে। আর এ ব্যাপারে মানুষের মাঝে বেশ কিছু হাদীস বর্ণিত আছে।
সিয়াম পালনের অন্যতম ফযীলত:
১। সিয়াম ফরয করা হয়েছে:
আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক উম্মতের ওপর তা লিখে দিয়েছেন এবং তাদের উপর তা ফরয করেছেন।
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُتِبَ عَلَيۡكُمُ ٱلصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ١٨٣ ﴾ [البقرة: ١٨٣]
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেমনি ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতদের ওপর, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পারো।” {সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৩}
আর যদি এ সিয়াম সাধনা এমন একটি মহান ইবাদত না হতো যার দ্বারা আল্লাহর ইবাদত করা ব্যতীত সৃষ্টিকুল অমুখাপেক্ষী হতে পারে না, আর তার উপর ব্যাপক সওয়াবের বিষয়টি নির্ভর না করত তবে আল্লাহ সকল উম্মতের ওপর তা ফরয করতেন না।
২। সিয়াম সাধনা মানুষের পাপ মোচনের একটি উন্নত মাধ্যম:
* বুখারী ও মুসলিম এসেছে, আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
مَنْ صَامَ رَمَضَانَ، إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
“যে ব্যক্তি ঈমান ও সাওয়াবের আশায় সিয়াম পালন করবে, তার পূর্ববর্তী পাপরাশী ক্ষমা করে দেয়া হবে”।
অর্থাৎ আল্লাহর ওপর ঈমান ও সিয়াম ফরয হওয়াকে সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে সিয়ামের প্রতিদান প্রাপ্তির আশায় এ বিধান পালন করলেই কেবল উপরোক্ত ফযীলত পাওয়া যাবে। সিয়াম ফরয হওয়াতে বিরক্ত হওয়া এবং সিয়ামের পুরস্কারের ব্যাপারে কোনোরূপ সন্দেহ পোষণ করা যাবে না। এভাবে সিয়াম পালন করলেই আল্লাহ তা‘আলা অতীতের পাপসমূহ মার্জনা করে দেবেন।
* অনুরূপ সহীহ মুসলিমে এসেছে, আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
الصَّلَوَاتُ الْخَمْسُ، وَالْجُمْعَةُ إِلَى الْجُمْعَةِ، وَرَمَضَانُ إِلَى رَمَضَانَ، مُكَفِّرَاتٌ مَا بَيْنَهُنَّ إِذَا اجْتَنَبَ الْكَبَائِرَ
“পাঁচ ওয়াক্তের সালাত, এক জুমআ হতে অন্য জুমআর সালাত এবং এক রমযান হতে অন্য রমযানের সিয়াম মধ্যবর্তী সময়ের সকল অপরাধের কাফফারাস্বরূপ, যদি কবীরা গুনাহ হতে বিরত থাকে”।
৩। সিয়াম পালনকারীর প্রতিদান কোনো সংখ্যা দ্বারা সীমিত করা হয় নি, বরং সিয়াম পালনকারীকে তার সীমাহীন প্রতিদান দেয়া হবে:
* বুখারী ও মুসলিমে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
قَالَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ: كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ لَهُ إِلَّا الصِّوْمَ، فَإِنَّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ، وَالصِّيَامُ جُنَّةٌ، فَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ، فَلَا يَرْفُثْ يَوْمَئِذٍ وَلَا يَصْخَبْ، فَإِنْ سَابَّهُ أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَهُ، فَلْيَقُلْ: إِنِّي امْرُؤٌ صَائِمٌ، وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ، لَخُلُوفُ فَمِ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللهِ، يَوْمَ الْقِيَامَةِ، مِنْ رِيحِ الْمِسْكِ، لِلصَّائِمِ فَرْحَتَانِ يَفْرَحُهُمَا: إِذَا أَفْطَرَ فَرِحَ بِفِطْرِهِ، وَإِذَا لَقِيَ رَبَّهُ فَرِحَ بِصَوْمِهِ
“আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, সিয়াম ছাড়া আদম সন্তানের প্রত্যেক আমল তার নিজের জন্য, কারণ তা কেবল আমার জন্য, আমিই এর প্রতিদান দেব। সিয়াম ঢাল স্বরূপ। যদি তোমাদের কেউ সিয়াম পালন করে, তাহলে সে যেন অশ্লীল কথা না বলে, যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়, তবে সে যেন বলে, আমি সিয়াম পালনকারী। ওই সত্তার শপথ! যার হাতে আমি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন, নিশ্চয়ই সিয়াম পালনকারীর মুখের না-খাওয়াজনিত গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশক আম্বরের চেয়েও অধিক প্রিয়। রোযাদারের জন্য দু’টি আনন্দ রয়েছে-একটি যখন সে ইফতার করে, অন্যটি যখন সে তাঁর রব আল্লাহর দিদার লাভ করবে তখন আনন্দ প্রকাশ করবে।”
* মুসলিম শরীফের অন্য বর্ণনায় রয়েছে:
كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ يُضَاعَفُ الْحَسَنَةُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا إِلَى سَبْعمِائَة ضِعْفٍ قَالَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ إِلَّا الصَّوْمَ فَإِنَّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ يَدَعُ شَهْوَتَهُ وَطَعَامَهُ مِنْ أَجلِي
“প্রত্যেক আদম সন্তানকে তার নেক আমল দশগুণ হতে সাতশত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে দেয়া হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: তা অবশ্য সিয়ামের প্রতিদান ছাড়া; কারণ সিয়াম আমার জন্য আর আমিই তার প্রতিদান দেব। কেননা আমার কারণে সিয়াম পালনকারী তার যৌনকার্য ও আহার বর্জন করে থাকে।”
এ তাৎপর্যপূর্ণ হাদীসটি বিভিন্ন দিক থেকে সাওমের ফযীলতের ওপর প্রমাণ বহন করছে:
প্রথম দিক: আল্লাহ তা‘আলা সকল ইবাদতের মধ্য থেকে সাওমকে নিজের জন্য খাস করেছেন। কারণ সাওম আল্লাহর কাছে একটি মর্যাদাপূর্ণ ইবাদত। সাওমকে আল্লাহ ভালবাসেন। সাওমের মাধ্যমে মহান আল্লাহর প্রতি ইখলাস প্রকাশ পায়। কারণ এটা বান্দা ও তার রবের মাঝে এমন এক গোপন ভেদ যা আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ জানতে পারে না। কেননা সিয়াম পালনকারী ইচ্ছা করলে মানবশূন্য জায়গা বা এলাকায় আল্লাহ কর্তৃক হারামকৃত বস্তু আহার করতে পারেন কিন্তু তিনি তা করেন না। কারণ তিনি জানেন তার একজন রব রয়েছেন, যিনি নির্জনেও তার অবস্থা জানেন। আর তিনিই তার উপর এটা হারাম করেছেন। তাই তিনি সাওমের সাওয়াব লাভের আশায় এবং আল্লাহর শাস্তি থেকে বাঁচার ভয়ে আহার বিহার পরিত্যাগ করেন।
এজন্যই আল্লাহ সিয়াম পালনকারী বান্দার এই ইখলাসের যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করে সাওমকে সকল ইবাদত থেকে নিজের জন্য বিশিষ্ট করে নিয়েছেন। তাই তো তিনি বলেছেন,
يَدَعُ شَهْوَتَهُ وَطَعَامَهُ مِنْ أَجْلِي
“আমার বান্দা আমার কারণে যৌনকাজ ও আহার পরিত্যাগ করে থাকে।”
আর এ বিশিষ্টকরণের উপকারিতা দৃশ্যমান হবে কিয়ামত দিবসে। যেমনটি সুফিয়ান ইবন ‘উয়াইনাহ রহ. বলেন:
إذا كان يوم القيامة يحاسب الله عبده ويؤدي ما عليه من المظالم من سائر عمله حتى إذا لم يبق إلا الصومُ يتحمل الله عنه ما بقي من المظالم ويدخله الجنة بالصوم.
‘যখন কিয়ামত দিবসে আল্লাহ তার বান্দার হিসাব নেবেন এবং বান্দার সব আমল থেকে তার পক্ষ থেকে অন্যের উপর করা জুলুমের বিনিময় মিটিয়ে দিবেন। অবশেষে যখন সিয়াম ছাড়া তার অন্য কোনো আমল থাকবে না তখন আল্লাহ তাঁর পক্ষ হতে সব জুলুমের বিষয়টি নিজের দায়িত্বে নিয়ে বান্দাকে শুধু সিয়ামের কারণে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।’
দ্বিতীয় দিক: সাওম সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: وأنا أجزي به ‘সাওমের প্রতিদান আমি নিজে দেব।’ সাওমের প্রতিদানকে আল্লাহ তাঁর স্বীয় সত্তার প্রতি সম্পর্কযুক্ত করলেন। কারণ অন্যান্য নেক আমলের প্রতিদান দ্বিগুণ করে দেয়া হবে। প্রতিটি নেক ‘আমল তার দশগুণ থেকে সাতশ গুণ ও তার চেয়েও অধিকহারে দেয়া হবে। আর সাওমের ছাওয়াবের কোনো সংখ্যা গণনা না করে আল্লাহ তা‘আলা আপন সত্তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করেছেন। আর আল্লাহই হলেন সবচেয়ে বড় ও মহান ইজ্জতের অধিকারী ও সর্বশ্রেষ্ঠ দানশীল। দান দানশীল অনুপাতেই হয়ে থাকে। তাই সাওমের সাওয়াব এমন বিরাট যার কোনো হিসেব নেই।
আর সাওম হলো: আল্লাহর আনুগত্যে ধৈর্য অবলম্বন, আল্লাহ কর্তৃক হারাম বস্তুসমূহ হতে বাঁচার ক্ষেত্রে ধৈর্য অবলম্বন এবং দেহ ও মনের দুর্বলতা এবং ক্ষুধা ও তৃষ্ণার মতো আল্লাহর নির্ধারিত বিধান পালনে ধৈর্য ধারণ করার নামান্তর।
* সুতরাং সাওমের মধ্যে ধৈর্য্যের প্রকারত্রয়ের সবই একত্র হয়েছে। আর আল্লাহ তা‘আলা সবর সম্পর্কে বলেছেন:
﴿ إِنَّمَا يُوَفَّى ٱلصَّٰبِرُونَ أَجۡرَهُم بِغَيۡرِ حِسَابٖ﴾ [الزمر: ١٠]
‘নিঃসন্দেহে ধৈর্যশীলদেরকে তাদের প্রতিদান হিসেব ছাড়া পূর্ণ করে দেয়া হয়।’ {সূরা আয-যুমার, আয়াত: ১০}
তৃতীয় দিক: সাওম ঢাল স্বরূপ। অর্থাৎ তা সিয়াম পালনকারীকে অনর্থক কথাবার্তা ও অশ্লীল সংলাপ হতে রক্ষা করে। এ জন্যই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
إِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلاَ يَرْفُثْ وَلاَ يَصْخَبْ
‘তোমাদের কেউ সাওম দিবসে থাকলে সে যেন অশ্লীল ভাষায় কথা না বলে এবং চিৎকার করে বাক্য বিনিময় না করে।’
* আর সিয়াম তাকে জাহান্নামের অগ্নি থেকেও রক্ষা করবে। যেমন ইমাম আহমদ রহ. জাবির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে হাসান সনদে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إِنَّمَا الصِّيَامُ جُنَّةٌ، يَسْتَجِنُّ بِهَا الْعَبْدُ مِنَ النَّارِ
‘সিয়াম ঢাল স্বরূপ যার দ্বারা সিয়াম পালনকারী নিজেকে জাহান্নাম হতে বাঁচাতে পারে।’
চতুর্থ দিক: সিয়াম পালনকারীর মুখের না খাওয়া জনিত গন্ধ আল্লাহর কাছে মেসকের সুগন্ধি হতেও প্রিয়। কারণ এ গন্ধ রোযার কারণে হয় তাই তা আল্লাহর কাছে সুগন্ধি ও প্রিয় বলে বিবেচিত হয়। এটা আল্লাহর কাছে সিয়ামের মর্যাদা ও মাহাত্ম্যের প্রমাণ। আল্লাহর আনুগত্যের মধ্য দিয়ে সিয়াম পালিত হয় বলেই রোযাদারের মুখের গন্ধ মানুষের কাছে অপছন্দনীয় হলেও আল্লাহর কাছে তা সুপ্রিয় ও পছন্দনীয় হয়।
পঞ্চম দিক: সিয়াম পালনকারীর জন্য দু’টি আনন্দ রয়েছে। একটি আনন্দ ইফতারের সময়, অন্যটি আল্লাহর দীদার লাভের সময়।
ইফতারের সময় আনন্দ: ‘সিয়াম পালনকারী সর্বোত্তম নেক আমলের অন্যতম ইবাদত সাওম সম্পন্ন করার কারণে আল্লাহ তার প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন এ জন্য আনন্দ প্রকাশ করে।
কারণ বহু মানুষ এমন রয়েছে যারা এ অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে; কেননা তারা সাওম পালন করে নি। বরং পানাহার ও স্ত্রী সহবাস যা আল্লাহ তার জন্য অন্য অবস্থায় হালাল করেছেন কিন্তু সাওম অবস্থায় হারাম করেছেন, তা দিয়ে (অবৈধ) আনন্দ-উদযাপনে লিপ্ত।
আল্লাহর দিদার লাভের সময় আনন্দ: ‘যখন একজন সাওম পালনকারী তার অতি দরকারী মুহূর্তে আল্লাহর কাছ থেকে পরিপূর্ণ প্রতিদান পাবে তখন সাওমের কারণে আনন্দ প্রকাশ করবে। যখন বলা হবে:
أَيْنَ الصَّائِمُونَ لَيَدْخُلُوا الجنة مِنْ بَاب الريان الذي لاَ يَدْخُلُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ.
‘সাওম পালনকারীরা কোথায়? তারা রাইয়ান নামক দরজা দিয়ে যেন জান্নাতে প্রবেশ করে, ওই দরজা দিয়ে সাওম পালনকারীরা ছাড়া আর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না।
উপরোক্ত হাদীসে সাওম পালনকারীর জন্য একটি দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে যে, কেউ যদি তাকে গালমন্দ করে কিংবা তার সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে চায় সে তার অনুরূপ ভূমিকা নেবে না। যাতে না গাল-মন্দ ও সংঘর্ষ বেড়ে যায়, আবার নীরবতা অবলম্বন করে নিজেকে দুর্বল হিসেবেও প্রকাশ করবে না। বরং বলবে ‘আমি তো রোযাদার।’ যাতে ইঙ্গিত করা হয় যে, প্রতিশোধ গ্রহণে অক্ষমতার জন্য নয়, বরং সাওমের সম্মানার্থে ঐ ব্যক্তির অনুরূপ আচরণে সে লিপ্ত হবে না। আর এভাবে ঝগড়া-বিবাদ ও সংঘাত বন্ধ হয়ে যাবে।
﴿ٱدۡفَعۡ بِٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُ فَإِذَا ٱلَّذِي بَيۡنَكَ وَبَيۡنَهُۥ عَدَٰوَةٞ كَأَنَّهُۥ وَلِيٌّ حَمِيمٞ ٣٤ وَمَا يُلَقَّىٰهَآ إِلَّا ٱلَّذِينَ صَبَرُواْ وَمَا يُلَقَّىٰهَآ إِلَّا ذُو حَظٍّ عَظِيمٖ ٣٥ ﴾ [فصلت: ٣٤، ٣٥]
‘তুমি উত্তম পন্থায় প্রত্যুত্তর করো। ফলে তোমার সাথে এবং যার সাথে তোমার শত্রুতা রয়েছে সে যেন অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে যায়। ধৈর্যশীল ব্যতিরেকে কেউ তা করতে সক্ষম হয় না এবং ভাগ্যবান ব্যক্তি ছাড়া কেউ তা লাভ করতে পারবে না।’ {সূরা ফুসসিলাত, আয়াত: ৩৪-৩৫}
৪. সিয়াম পালনকারীর জন্য কিয়ামতের দিন সিয়াম সুপারিশ করবে:
আবদুল্লাহ ইবন ‘আমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
الصِّيَامُ وَالْقُرْآنُ يَشْفَعَانِ لِلْعَبْدِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، يَقُولُ الصِّيَامُ: أَيْ رَبِّ، مَنَعْتُهُ الطَّعَامَ وَالشَّهَوَاتِ بِالنَّهَارِ، فَشَفِّعْنِي فِيهِ، وَيَقُولُ الْقُرْآنُ: مَنَعْتُهُ النَّوْمَ بِاللَّيْلِ، فَشَفِّعْنِي فِيهِ ، قَالَ: فَيُشَفَّعَانِ
‘সিয়াম ও কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। সিয়াম বলবে, হে আল্লাহ! আমি তাকে পানাহার ও যৌনাচার হতে বিরত রেখেছি। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। কুরআন বলবে, হে আল্লাহ! আমি রাতের ঘুম থেকে তাকে বিরত রেখেছি, সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। উভয়ের সুপারিশ কবুল করা হবে।’
প্রিয় ভাইয়েরা! সিয়ামের উল্লেখিত ফযীলত ওই সকল ব্যক্তির জন্য, যারা গুরুত্বসহ এবং আদবের সঙ্গে সিয়াম পালন করে। নিজেদের সিয়ামকে নিখুঁত রাখতে এবং তার বিধিবিধান পালনে চেষ্টা করুন আর আপনারা নিজেদের সাওমে ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য আল্লাহর কাছে তাওবা করুন।
হে আল্লাহ! আপনি আমাদের সিয়াম সংরক্ষণ করুন, সিয়ামকে সুপারিশকারী হিসাবে গ্রহণ করুন এবং আমাদের, আমাদের পিতা-মাতা ও মুসলিম উম্মাহকে ক্ষমা করুন।
আর আল্লাহ সালাত ও সালাম প্রদান করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবার ও সাহাবীগণের ওপর।
তৃতীয় আসরঃসিয়ামের বিধান
সকল প্রশংসা ওই আল্লাহর জন্য যিনি দান করলে আটকানোর কেউ নেই এবং যিনি নিয়ে নিলে দান করার মতো কেউ নেই, শ্রমদাতাদের জন্য তাঁর আনুগত্য শ্রেষ্ঠ কামাই, তাকওয়া অর্জনকারীদের জন্য তাঁর তাকওয়া সর্বোচ্চ বংশপদবী। তিনি নিজ বন্ধুদের অন্তরসমূহকে ঈমানের জন্য প্রস্তুত ও তাতে তা লিপিবদ্ধ করে দিয়েছেন, তাদের জন্য তাঁর আনুগত্যের পথে যাবতীয় ক্লান্তিকে সহজ করে দিয়েছেন; ফলে তাঁর সেবার পথে তারা ন্যূনতম শ্রান্তিবোধ করে না। হতভাগারা যখন বক্রপথ অনুসরণ করেছে তখন তিনি তাদের জন্য দুর্ভাগ্য নির্ধারণ করেছেন, ফলে তারা নিপতিত হয়েছে নিশ্চিত ধ্বংসের চোরাবালিতে। তারা তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তার সাথে কুফরী করেছে ফলে তিনি তাদের দকরেছেন লেলিহান আগুনে। আমি প্রশংসা করি তাঁর, তিনি যা আমাদের দান করেছেন এবং অনুগ্রহ করেছেন তার জন্য।
আমি সাক্ষ্য প্রদান করি যে একমাত্র তিনি ব্যতীত কোনো সত্য ইলাহ নেই; তাঁর কোনো অংশীদার নেই, বাহিনীসমূহকে পরাজিত করেছেন এবং বিজয়ী হয়েছেন। আমি আরও সাক্ষ্য প্রদান করি যে মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসূল, যাকে আল্লাহ মনোনীত করেছেন এবং নির্বাচিত করেছেন।
দরূদ বর্ষিত হোক তাঁর ওপর, তাঁর সঙ্গী আবূ বকর সিদ্দীকের ওপর যিনি মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন, উমরের ওপর যাকে দেখে শয়তান ভেগে যায় এবং পলায়ন করে, উসমানের ওপর যিনি দুই নূরের অধিকারী (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একেরপর এক দুই মেয়ের জামাতা) শ্রেষ্ঠ আল্লাহভীরু ও উৎকৃষ্ট বংশীয় ব্যক্তি, আলীর ওপর যিনি তাঁর জামাই এবং বংশগত দিক থেকে চাচাতো ভাই এবং তাঁর অবশিষ্ট সব সাহাবীর ওপর যারা দীনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গর্ব ও অর্জন কামাই করেছেন আর সকল তাবেঈ-অনুসারীর ওপর যারা তাঁদের সর্বোত্তম অনুসরণ করে পূর্ব-পশ্চিমকে আলোকিত করেছেন। অনুরূপ যথাযথ সালামও বর্ষণ করুন।
আমার ভাইয়েরা! নিশ্চয় রমযানের সিয়াম ইসলামের অন্যতম রুকন ও গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُتِبَ عَلَيۡكُمُ ٱلصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ١٨٣ أَيَّامٗا مَّعۡدُودَٰتٖۚ فَمَن كَانَ مِنكُم مَّرِيضًا أَوۡ عَلَىٰ سَفَرٖ فَعِدَّةٞ مِّنۡ أَيَّامٍ أُخَرَۚ وَعَلَى ٱلَّذِينَ يُطِيقُونَهُۥ فِدۡيَةٞ طَعَامُ مِسۡكِينٖۖ فَمَن تَطَوَّعَ خَيۡرٗا فَهُوَ خَيۡرٞ لَّهُۥۚ وَأَن تَصُومُواْ خَيۡرٞ لَّكُمۡ إِن كُنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ١٨٤ شَهۡرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِيٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلۡقُرۡءَانُ هُدٗى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَٰتٖ مِّنَ ٱلۡهُدَىٰ وَٱلۡفُرۡقَانِۚ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ ٱلشَّهۡرَ فَلۡيَصُمۡهُۖ وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوۡ عَلَىٰ سَفَرٖ فَعِدَّةٞ مِّنۡ أَيَّامٍ أُخَرَۗ يُرِيدُ ٱللَّهُ بِكُمُ ٱلۡيُسۡرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ ٱلۡعُسۡرَ وَلِتُكۡمِلُواْ ٱلۡعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُواْ ٱللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَىٰكُمۡ وَلَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُونَ ١٨٥ ﴾ [البقرة: ١٨٣، ١٨٥]
‘হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। নির্দিষ্ট কয়েক দিন। তবে তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ হবে, কিংবা সফরে থাকবে, তাহলে অন্যান্য দিনে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আর যাদের জন্য তা কষ্টকর হবে, তাদের কর্তব্য ফিদয়া- একজন দরিদ্রকে খাবার প্রদান করা। অতএব যে স্বেচ্ছায় অতিরিক্ত সৎকাজ করবে, তা তার জন্য কল্যাণকর হবে। আর সিয়াম পালন তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা জান। রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে। আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তবে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আল্লাহ তোমাদের সহজ চান এবং কঠিন চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন, তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা শোকর কর।’ {সূরা আল-বাক্বারা, আয়াত: ১৮৩-১৮৫}
* হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
بُنِيَ الْإِسْلَامُ عَلَى خَمْسٍ، شَهَادَةِ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ، وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، وَإِقَامِ الصَّلَاةِ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ، وَحَجِّ الْبَيْتِ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ
‘ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি, এ সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া সত্যিকারের কোনো মা‘বুদ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, সালাত প্রতিষ্ঠা করা, যাকাত প্রদান করা, বাইতুল্লাহর হজ করা এবং রমযানের সিয়াম পালন করা।’ বুখারী ও মুসলিম।
মুসলিমে ‘রমযানের রোযা রাখা’ এরপর ‘বাইতুল্লায় হজ করা’ এভাবে এসেছে।
রমযানের সিয়ামের ব্যাপারে সকল মুসলিম ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, এটা ফরয। এটা ইসলামে স্পষ্টত অকাট্য ইজমা।
সুতরাং যে ব্যক্তি সিয়াম ফরয হওয়াকে অস্বীকার করবে সে কাফের হয়ে যাবে। তখন তাকে তাওবা করতে বলা হবে। যদি তাওবা করে, সিয়ামের ফরযিয়্যাত স্বীকার করে তবে ভালো কথা অন্যথায় কাফির ও মুরতাদ হওয়ার কারণে তাকে হত্যা করা হবে। তাকে মৃত্যুর পর গোসল দেয়া হবে না এবং কাফন পরানো হবে না, তার নামাযে জানাযা পড়া হবে না এবং তার জন্য রহমতের দো‘আ করা হবে না। তাকে মুসলিমদের করবস্থানে দাফন করা হবে না। কেবল দূরবর্তী কোনো স্থানে তার জন্য কবর খনন করা হবে এবং দাফন করা হবে, যাতে মানুষ তার গলিত লাশের দুর্গন্ধে কষ্ট না পায় এবং তাকে দেখে তার পরিবার পরিজনও যেন দুঃখ না পায়।
রমযানের সিয়াম দ্বিতীয় হিজরীতে ফরয হয়েছে। ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নয় বছর রমযানের সিয়াম পালন করেছেন।
সিয়াম ফরয হয়েছে দুটি পর্যায়ে:
প্রথম পর্যায়: প্রথমে সিয়াম পালন কিংবা খাদ্য গ্রহণ উভয়ের অনুমতি ছিল। তবে সিয়াম পালন উত্তম ছিল।
দ্বিতীয় পর্যায়: পরে সিয়াম পালন বাধ্যতামূলক করা হয়।
* বুখারী ও মুসলিমের হাদীসে এসেছে, সালমা ইবনে আকওয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: যখন এ আয়াত নাযিল হল:
﴿ وَعَلَى ٱلَّذِينَ يُطِيقُونَهُۥ فِدۡيَةٞ طَعَامُ مِسۡكِينٖۖ ﴾ [البقرة: ١٨٤]
‘আর যাদের জন্য তা কষ্টকর হবে, তাদের কর্তব্য ফিদয়া- একজন দরিদ্রকে খাবার প্রদান করা।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৪} তখন যার ইচ্ছা সে সিয়াম ভঙ্গ করে ফিদয়া প্রদান করত। কিন্তু যখন পরবর্তী আয়াত নাযিল হল, তখন তা রহিত হয়ে গেল ।
অর্থাৎ নিম্নের আয়াতের মাধ্যমে পূর্ববর্তী আয়াতের হুকুম রহিত হয়ে গেল। আয়াতটি এই:
﴿فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ ٱلشَّهۡرَ فَلۡيَصُمۡهُۖ وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوۡ عَلَىٰ سَفَرٖ فَعِدَّةٞ مِّنۡ أَيَّامٍ أُخَرَۗ﴾ [البقرة: ١٨٥]
‘সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে। আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তবে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করে নেবে।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৫} এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা সিয়াম পালনকে বাধ্যতামূলক করে অবকাশ রহিত করে দেন।
আর সিয়াম ততক্ষণ ফরয হবে না, যতক্ষণ রমযান মাস প্রমাণিত না হয়। তাই মাস শুরু হওয়ার আগেই সাওম শুরু করা যাবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
لاَ يَتَقَدَّمَنَّ أَحَدُكُمْ رَمَضَانَ بِصَوْمِ يَوْمٍ أَوْ يَوْمَيْنِ، إِلَّا أَنْ يَكُونَ رَجُلٌ كَانَ يَصُومُ صَوْمَهُ، فَلْيَصُمْ ذَلِكَ اليَوْمَ
‘তোমাদের কেউ যেন রমযানের আগের এক বা দুই দিন সিয়াম পালন না করে, তবে পূর্ব থেকে কারো সিয়াম পালনের অভ্যাস থাকলে, সে ওই সিয়াম পালন করতে পারবে।’
দু’টি বিষয়ের কোনো একটি ঘটলে রমযানের আগমন বুঝা যাবে:
প্রথম বিষয়: নতুন চাঁদ দেখা গেলে।
-যেমন আল্লাহর বাণী:
﴿ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ ٱلشَّهۡرَ فَلۡيَصُمۡهُۖ ﴾ [البقرة: ١٨٥]
‘সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৫}
হাদীসে রয়েছে, আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
إِذَا رَأَيْتُمُ الْهِلَالَ فَصُومُوا
‘যখন তোমরা রমযানের চাঁদ দেখবে, তখন সিয়াম পালন করবে।’
তবে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য চাঁদ দেখা শর্ত নয়; বরং একজন নির্ভরযোগ্য পুরুষ সাক্ষ্য দিলে সকলের ওপর সিয়াম পালন জরুরী হবে।
চাঁদ দেখার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হওয়ার শর্ত হলো:
সাক্ষ্যদাতা ব্যক্তি প্রাপ্ত বয়স্ক, বুদ্ধিমান, মুসলিম, দৃষ্টি শক্তি সম্পন্ন এবং তার আমানতদারীতার কারণে বিশ্বস্ত হতে হবে তথা তার সংবাদের গ্রহণযোগ্যতা থাকতে হবে।
– অতএব, নাবালেগের চাঁদ দেখার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ সে বিশ্বস্ত নয়।
– আর পাগলের সাক্ষ্যও নাবালেগের মত গ্রহণযোগ্য নয়।
– কাফিরের সাক্ষ্য দ্বারাও মাহে রমযান সাব্যস্ত ও প্রমাণিত হবে না।
– কারণ আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন:
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: جَاءَ أَعْرَابِيٌّ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: إِنِّي رَأَيْتُ الْهِلَالَ، قَالَ الْحَسَنُ فِي حَدِيثِهِ يَعْنِي رَمَضَانَ، فَقَالَ: أَتَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، قَالَ: نَعَمْ، قَالَ: أَتَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ؟ ، قَالَ: نَعَمْ، قَالَ: يَا بِلَالُ، أَذِّنْ فِي النَّاسِ فَلْيَصُومُوا غَدًا
‘ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, একজন বেদুঈন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মুখে এসে বলল, নিশ্চয়ই আমি (রমযানের) চাঁদ দেখেছি। এ কথা শুনে তিনি বললেন, তুমি কি এ সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই? সে উত্তরে বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তুমি কি এ সাক্ষ্য দাও যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল? সে বলল, হ্যাঁ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে বেলাল! তুমি ঘোষণা দিয়ে দাও, লোকেরা যেন আগামীকাল সিয়াম পালন করে।’
– আর যে ব্যক্তি মিথ্যাবাদী হিসেবে প্রসিদ্ধ কিংবা অধিক তাড়াহুড়া করে এমন কিংবা দৃষ্টিশক্তি এমন দুর্বল ও ক্ষীণ যে তার দ্বারা চাঁদ দেখা অসম্ভব, এ ধরনের ব্যক্তির সংবাদ গ্রহণযোগ্য হবে না। তাদের দ্বারা মাহে রমযানের চাঁদ দেখার সাক্ষ্য গ্রহণ করা যাবে না। কারণ তাদের সত্যতার ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে অথবা মিথ্যার দিকটাই অধিক প্রাধান্য পাওয়া স্বাভাবিক।
বিশ্বস্ত একজনের সাক্ষ্য দ্বারাই রমযান মাস প্রবেশ করা সাব্যস্ত ও প্রমাণিত হবে। যেমন আবদুল্লাহ ইবন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
تَرَاءَى النَّاسُ الْهِلَالَ، فَأَخْبَرْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنِّي رَأَيْتُهُ فَصَامَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَأَمَرَ النَّاسَ بِصِيَامِهِ
“লোকেরা চাঁদ দেখল, পরক্ষণে আমি রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চাঁদ দেখার সংবাদ দিলে তিনি সিয়াম পালন করলেন এবং লোকদের সিয়াম পালনের নির্দেশ দিলেন।’
আর যে ব্যক্তি নিশ্চিতভাবে চাঁদ দেখে, তার উচিৎ প্রশাসনকে অবহিত করা।
এমনিভাবে যে শাওয়াল ও জিলহজের চাঁদ দেখবে, তারও উচিৎ প্রশাসনকে অবহিত করা। কারণ এর সাথে সাওম, ফিতর ও হজ এর ফরয আদায় হওয়া নির্ভরশীল। আর “যা না হলে ফরয আদায় করা সম্ভব হয় না তাও ফরয হিসেবে বিবেচিত”।
কোনো ব্যক্তি যদি একা এত দূরে চাঁদ দেখে যে, দূরত্বের কারণে তার পক্ষে প্রশাসনের কাছে সংবাদ পৌঁছানো সম্ভ্রম না হয়। তাহলে সে নিজে সিয়াম পালন করবে এবং প্রশাসনের কাছে সংবাদ পৌঁছানোর সাধ্যমত চেষ্টা করবে।
যখন প্রশাসনের পক্ষ থেকে রেডিও বা এ জাতীয় কিছুর মাধ্যমে চাঁদ দেখার ঘোষণা প্রদান করা হয়, রামযান মাস আগমনের জন্য বা রমযান মাস শেষ হওয়ার ব্যাপারে সেটা অনুযায়ী আমল করা আবশ্যক। কারণ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ঘোষণা আসা শরীয়তের প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হবে যার উপর আমল করা ফরয।
এ জন্যই যখন রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে রমযান মাস প্রবেশ করার বিষয়টি সাব্যস্ত হলো তখন তিনি বেলাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে মাস সাব্যস্ত হওয়ার বিষয়টি ঘোষণা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন; যাতে তারা সাওম পালন করে। আর তিনি সে ঘোষণাকে তাদের জন্য সাওম পালনের বাধ্যকারী বিধান হিসেবে গণ্য করলেন।
* তাই শরয়ী পদ্ধতি অনুযায়ী চাঁদ দেখা প্রমাণিত হলে সেটাই ধর্তব্য হবে, চন্দ্রের বিবিধ উদয়াস্থলের বিষয়টি ধর্তব্য হবে না, কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাওম রাখার বিধানটি চাঁদ দেখার সাথে সংশ্লিষ্ট করেছেন, চাঁদের বিবিধ উদয়াস্থলের সাথে সম্পৃক্ত করেন নি। তিনি বলেন:
إِذَا رَأَيْتُمُوهُ فَصُومُوا، وَإِذَا رَأَيْتُمُوهُ فَأَفْطِرُوا
‘যখন তোমরা (রামযানের) চাঁদ দেখ, তখন সিয়াম পালন কর এবং যখন (শাওয়ালের) চাঁদ দেখ, তখন সিয়াম ভঙ্গ কর।’
* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন:
وَإِنْ شَهِدَ شَاهِدَانِ مُسْلِمَانِ، فَصُومُوا وَأَفْطِرُوا
‘যদি দু‘জন মুসলিম (চাঁদ দেখে) সাক্ষ্য দেয়, তখন সিয়াম পালন কর এবং ভঙ্গ কর।’
দ্বিতীয় বিষয়: রমযান তথা নতুন মাস সাব্যস্ত হওয়ার জন্য দ্বিতীয় পদ্ধতি হচ্ছে, আগের মাসকে ৩০ দিন পূর্ণ করা।
কেননা চান্দ্র মাস কখনো ত্রিশদিনের বেশি বা ২৯ দিনের কম হতে পারে না। আরবী মাস কখনো কখনো ধারাবাহিকভাবে দু’মাস, তিনমাস অথবা চারমাস পর্যন্ত ত্রিশ দিনের হয়ে থাকে। আবার কখনো দু’মাস, তিনমাস অথবা চারমাস পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ঊনত্রিশ দিনের হয়ে থাকে। কিন্তু সাধারণত এক মাস, দু মাস পূর্ণ ত্রিশ দিন হলেও তৃতীয় মাস কম অর্থাৎ ঊনত্রিশ দিনের হয়ে থাকে।
সুতরাং কোনো মাসের ত্রিশদিন পূর্ণ হলে, শরীয়তের হুকুম অনুযায়ী পরবর্তী মাসটি এসে গেছে বলে গণ্য হবে। যদিও চাঁদ দেখা না যায়।
* কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি বলেন:
صُومُوا لِرُؤْيَتِهِ وَأَفْطِرُوا لِرُؤْيَتِهِ، فَإِنْ غُمِّيَ عَلَيْكُمُ الشَّهْرُ فَعُدُّوا ثَلَاثِينَ
‘তোমরা চাঁদ দেখে সিয়াম পালন করা এবং চাঁদ দেখে সিয়াম ভঙ্গ কর। আকাশ যদি মেঘাচ্ছন্ন থাকে, তখন ওই মাস ত্রিশ দিন হিসাবে গণনা কর।’
* ইমাম বুখারীর শব্দ হচ্ছে,
فَإِنْ غُبِّيَ عَلَيْكُمْ فَأَكْمِلُوا عِدَّةَ شَعْبَانَ ثَلاَثِينَ
‘চাঁদ যদি অজ্ঞাত থাকে, তাহলে শাবান মাসটি ত্রিশদিন পূর্ণ কর।’
* সহীহ ইবনে খুযাইমা গ্রন্থে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَتَحَفَّظُ مِنْ شَعْبَانَ مَا لَا يَتَحَفَّظُ مِنْ غَيْرِهِ، ثُمَّ يَصُومُ لِرُؤْيَةِ رَمَضَانَ، فَإِنْ غُمَّ عَلَيْهِ عَدَّ ثَلَاثِينَ يَوْمًا ثُمَّ صَامَ
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাবান মাসকে যত বেশি হিসাব করতেন, অন্য মাসকে তত বেশি হিসাব করতেন না। এরপর তিনি চাঁদ দেখে রমযানের সিয়াম পালন করতেন। আর আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে শাবান মাসকে ত্রিশ দিন হিসাব করে সিয়াম পালন করতেন।’
এসব হাদীস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, নতুন চাঁদ দেখার পূর্বে সিয়াম পালন শুরু করা যাবে না, অতঃপর যদি চাঁদ দেখা না যায় তবে শাবান মাসকে ত্রিশ দিন পূর্ণ করতে হবে। অবশ্য শাবানের সে ত্রিশতম দিনটিতে কোনোভাবেই সাওম রাখা যাবে না, চাই রাতে আকাশ পরিষ্কার থাকুক বা মেঘাচ্ছন্ন। কারণ:
* আম্মার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
مَنْ صَامَ اليَوْمَ الَّذِي يَشُكُّ فِيهِ النَّاسُ فَقَدْ عَصَى أَبَا القَاسِمِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
‘যে ব্যক্তি সন্দেহের দিন সিয়াম পালন করল, সে আবূল কাসেম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাফরমানী করল।’
হে আল্লাহ! আমাদেরকে হেদায়াত অনুসরণের তাওফীক দান করুন এবং ধ্বংস ও দুর্ভাগ্যের উপকরণ-উপায়াদি থেকে দূরে রাখুন। আমাদের এ রমযান মাসকে আমাদের জন্য কল্যাণ ও বরকতময় করুন। আর এ মাসে আমাদের আপনার আনুগত্য করার তাওফীক দিন এবং আপনার অবাধ্যতার পথ থেকে দূরে রাখুন। হে রাহমানুর রাহীম! অনুগ্রহ করে আমাদের, আমাদের মাতা-পিতা ও সকল মুসলিমকে ক্ষমা করুন।
হে আল্লাহ! সালাত ও সালাম বর্ষণ করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদের ওপর, তাঁর পরিবারবর্গ, সাহাবায়ে কেরাম ও কিয়ামত পর্যন্ত আগত তাঁদের সুন্দরভাবে অনুসরণকারীদের ওপর।
চতুর্থ আসরঃরমযানে কিয়ামুল লাইলের বিধান
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি নিজ দয়ায় সামনে অগ্রসরমান পাগুলোকে সাহায্য করেন, আপন করুণায় ধ্বংসপ্রায় জীবনগুলোকে উদ্ধার করেন এবং যাকে তিনি ইচ্ছা করেন তাকে সহজতর পথ জান্নাতের রাস্তাকে সহজ করে দেন, ফলে তাকে আখিরাতের প্রতি আগ্রহী করে তোলেন। আমি তাঁর স্তুতি গাই তাবৎ সুস্বাদ ও বিস্বাদ বিষয়ের জন্য।
আমি সাক্ষ্য প্রদান করি যে একমাত্র তিনি ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই; তাঁর কোনো অংশীদার নেই, তিনি সম্মান ও প্রতিপত্তির অধিকারী; প্রতিটি অন্তরই (তাঁর সামনে) লাঞ্ছিত ও দুর্দশাগ্রস্ত। আর আমি আরও সাক্ষ্য দেই যে মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসূল, তিনি প্রকাশ্যে ও গোপনে আপন রবের নির্দেশ বাস্তবায়ন করেছেন।
আল্লাহ সালাত ও সালাম বর্ষিত করুন তাঁর ওপর, তাঁর সাথী আবূ বকরের ওপর যাকে ভ্রান্তগোষ্ঠী তাতিয়ে দিয়েছিল, উমরের ওপর যার আত্মা নিজেই নিয়ন্ত্রণ করত নিজেকে, উসমানের ওপর অঢেল অর্থ খরচকারী, আলীর ওপর যিনি ঘন সেনাবাহিনীর সাথে লড়াইয়েও প্রকৃত বীর কাকে বলে চিনিয়ে দিতেন এবং অবশিষ্ট সব সাহাবীর ওপর আর তাদের সুন্দর অনুসারীদের উপর, সামনে ধাবমান পায়ের পদধ্বনি চলমান থাকা পর্যন্ত।
আমার ভাইয়েরা, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের জন্য বিভিন্ন ধরনের ইবাদত প্রবর্তন করেছেন, তারা যাতে বিভিন্ন ইবাদত করে সে অনুযায়ী নেকী অর্জন করতে পারে। যাতে করে এক প্রকারের ইবাদতে বিরক্তি বোধ করে অন্য আমল ছেড়ে হতভাগ্য না হয়। এসব ইবাদতের মধ্যে কিছু রয়েছে ফরয যাতে কোনো প্রকার কমতি বা ত্রুটি করা যাবে না। আবার কিছু রয়েছে নফল যা ফরযে পরিপূর্ণতা ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সহায়ক।
* এসব ইবাদতের মধ্যে অন্যতম হলো সালাত। আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদের ওপর দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। যা কার্যত পাঁচ হলেও মীযানের পাল্লায় পঞ্চাশ। আল্লাহ তা‘আলা নফল সালাতকে ফরয সালাতের ক্ষতিপূরণ এবং তার নৈকট্য লাভের মাধ্যম স্থির করেছেন।
এসব নফল সালাতের অন্যতম হচ্ছে:
কিছু সুন্নাত সালাত, যা ফরয সালাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যেমন, ফজরের ফরয সালাতের পূর্বে দু’রাকাত, যোহরের ফরযের পূর্বে চার রাকাত ও পরে দু’রাকাত। মাগরিবের ফরযের পর দু’রাকাত ও এশার ফরযের পর দু’রাকাত।
আর এসব (ফরয ছাড়া অন্যসব) নফল সালাতের অন্যতম হলো সালাতুল লাইল (রাতের সালাত বা তাহাজ্জুদ)
* যা আদায়কারীদের প্রশংসা করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَٱلَّذِينَ يَبِيتُونَ لِرَبِّهِمۡ سُجَّدٗا وَقِيَٰمٗا ٦٤ ﴾ [الفرقان: ٦৪]
‘আর যারা তাদের রবের জন্য সিজদারত ও দণ্ডায়মান হয়ে রাত্রি যাপন করে।’ {সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ৬৩}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেছেন:
﴿ تَتَجَافَىٰ جُنُوبُهُمۡ عَنِ ٱلۡمَضَاجِعِ يَدۡعُونَ رَبَّهُمۡ خَوۡفٗا وَطَمَعٗا وَمِمَّا رَزَقۡنَٰهُمۡ يُنفِقُونَ ١٦ فَلَا تَعۡلَمُ نَفۡسٞ مَّآ أُخۡفِيَ لَهُم مِّن قُرَّةِ أَعۡيُنٖ جَزَآءَۢ بِمَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٧ ﴾ [السجدة: ١٦، ١٧]
‘তাদের পার্শ্বদেশ বিছানা থেকে আলাদা হয়। তারা ভয় ও আশা নিয়ে তাদের রবকে ডাকে। আর আমি তাদেরকে যে রিযক দান করেছি, তা থেকে তারা ব্যয় করে। অতঃপর কোনো ব্যক্তি জানে না তাদের জন্য চোখ জুড়ানো কী জিনিস লুকিয়ে রাখা হয়েছে, তারা যা করত, তার বিনিময়স্বরূপ।’ {সূরা আস-সাজদাহ, আয়াত: ১৬-১৭}
* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
وَأَفْضَلُ الصَّلَاةِ، بَعْدَ الْفَرِيضَةِ، صَلَاةُ اللَّيْلِ
‘ফরয সালাতের পর অধিক ফযীলতপূর্ণ হল রাতের সালাত।’
* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যত্র বলেন:
يَا أَيُّهَا النَّاسُ، أَفْشُوا السَّلَامَ، وَأَطْعِمُوا الطَّعَامَ، وَصِلُوا الْأَرْحَامَ، وَصَلُّوا وَالنَّاسُ نِيَامٌ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ بِسَلَامٍ
‘হে লোক সকল! সালামের প্রসার ঘটাও, গরীব-দুঃখীদের খাদ্য দান কর, আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখ, রাতে যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে, তখন সালাত আদায় কত, তাহলে নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’
সালাতুল বিতর; যা সালাতুল লাইল তা রাত্রির সালাতের একটি অংশ। যার সর্বনিম্ন পরিমাণ এক রাকাত। আর সর্বোচ্চ এগারো রাকাত।
অতএব কেবল এক রাকাত বিতরও পড়া যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
مَنْ أَحَبَّ أَنْ يُوتِرَ بِوَاحِدَةٍ فَلْيَفْعَلْ
‘যে বিতর সালাত এক রাকাত আদায় করতে যায়, সে যেন এক রাকাত আদায় করে।’
বিতর সালাত তিন রাকাতও পড়া যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
وَمَنْ أَحَبَّ أَنْ يُوتِرَ بِثَلَاثٍ فَلْيَفْعَلْ
‘যে তিন রাকাত বিতর পড়তে চায় সে যেন তিন রাকাত পড়ে।’
তবে কেউ যদি এক সালামে বিতর সালাত শেষ করতে চায়, তাও পারবে। কারণ;
* ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বর্ণনা করেছেন:
أنَّ عُمر بنَ الخطاب رضي الله عنه أوتر بِثَلَاثَ رَكَعَاتٍ , لَمْ يُسَلِّمْ إِلَّا فِي آخِرِهِنَّ
‘উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তিন রাকাত বিতর পড়েছেন ও সর্বশেষে সালাম ফিরিয়েছেন।’
অবশ্য কেউ যদি দু’রাকাত পড়ে সালাম ফিরিয়ে তৃতীয় রাকাত পড়তে চায়, তবে তাও পারবে। কেননা;
* বুখারী নাফে‘ থেকে বর্ণনা করেন:
أَنَّ عَبْدَ اللهِ بْنَ عُمَرَ كَانَ يُسَلِّمُ بَيْنَ الرَّكْعَةِ وَالرَّكْعَتَيْنِ فِي الْوِتْرِ حَتَّى يَأْمُرَ بِبَعْضِ حَاجَتِهِ.
‘আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা তিন রাকাত বিতর সালাতের দু’রাকাত আদায়ের পর সালাম ফিরিয়েছেন। এমনকি তিনি প্রয়োজনে কোনো নির্দেশও দিতেন।’
তেমনি পাঁচ রাকাত বিতর সালাতও আদায় করা যায়, তবে এসব রাকাত একত্রে আদায় করবে, সর্বশেষ বৈঠকেই শুধু বসতে হবে এবং সালাম ফিরানো যাবে।
* কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
فَمَنْ أَحَبَّ أَنْ يُوتِرَ بِخَمْسٍ فَلْيَفْعَلْ
‘যে বিতর পাঁচ রাকাত আদায় করতে চায়, সে যেন পাঁচ রাকাত আদায় করে।’
* অনুরূপভাবে ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُصَلِّي مِنَ اللَّيْلِ ثَلَاثَ عَشْرَةَ رَكْعَةً، يُوتِرُ مِنْ ذَلِكَ بِخَمْسٍ، لَا يَجْلِسُ فِي شَيْءٍ إِلَّا فِي آخِرِهَا
‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে তেরো রাকাত সালাত আদায় করতেন; তন্মধ্য হতে পাঁচ রাকাত বিতর আদায় করতেন, যার শেষেই শুধু তিনি বৈঠক করতেন।’
তেমনি পাঁচ রাকাতের ন্যায় একত্রে সাত রাকাত বিতরও আদায় করা যাবে।
* যেমন উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন,
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُوتِرُ بِسَبْعٍ وَبِخَمْسٍ لَا يَفْصِلُ بَيْنَهُنَّ بِسَلَامٍ وَلَا بِكَلَامٍ
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনও সাত রাকাত আবার কখনও পাঁচ রাকাত বিতর সালাত আদায় করতেন। তাতে সালাম-কালামের মাধ্যমে বিরতি দিতেন না।’
তেমনি নয় রাকাত বিতরও একত্রে আদায় করা যাবে; তন্মধ্যে অষ্টম রাকাতে বসবে, সেখানে তাশাহহুদ ও দো‘আ পড়বে কিন্তু সালাম না ফিরিয়েই নবম রাকাতের জন্য দাঁড়াবে, তারপর নবম রাকাত পড়ার পর বসে তাশাহহুদ ও দো‘আ করে সালাম ফিরাবে।
* যেমন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার হাদীসে রয়েছে:
وَكان يُصَلِّي تِسْعَ رَكَعَاتٍ لَا يَجْلِسُ فِيهَا إِلَّا فِي الثَّامِنَةِ، فَيَذْكُرُ اللهَ وَيَحْمَدُهُ وَيَدْعُوهُ، ثُمَّ يَنْهَضُ وَلَا يُسَلِّمُ، ثُمَّ يَقُومُ فَيُصَلِّي التَّاسِعَةَ، ثُمَّ يَقْعُدُ فَيَذْكُرُ اللهَ وَيَحْمَدُهُ وَيَدْعُوهُ، ثُمَّ يُسَلِّمُ تَسْلِيمًا يُسْمِعُنَا
‘তিনি নয় রাকাত সালাত আদায় করতেন, অষ্টম রাকাতে বসতেন এবং আল্লাহর যিকির, প্রশংসা ও দো‘আ করতেন তথা তাশাহহুদ পড়তেন। অতঃপর উঠতেন এবং সালাম না ফিরিয়েই দাঁড়িয়ে যেতেন। এরপর নবম রাকাত আদায় করতেন, এরপর বসতেন এবং আল্লাহর যিকির, প্রশংসা ও দো‘আ তথা তাশাহহুদ পড়ে আমাদের শুনিয়ে সালাম ফেরাতেন।’
অনুরূপভাবে এগার রাকাত সালাতও আদায় করা যাবে। এমতাবস্থায় ইচ্ছা করলে প্রতি দু’রাকাতে সালাম ফিরানো যাবে আর সবশেষে এক রাকাতের মাধ্যমে বিতর আদায় করা যাবে।
* যেমন ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত হাদীসে রয়েছে, তিনি বলেন:
كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُصَلِّي، مَا بَيْنَ أَنْ يَفْرُغَ مِنْ صَلَاةِ الْعِشَاءِ إِلَى الْفَجْرِ، إِحْدَى عَشْرَةَ رَكْعَةً، يُسَلِّمُ فِي كُلِّ اثْنَتَيْنِ، وَيُوتِرُ بِوَاحِدَةٍ
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইশা ও ফজরের সালাতের মধ্যবর্তী সময়ে এগার রাকাত সালাত আদায় করতেন, যার প্রতি দু’রাকাতে সালাম ফিরাতেন। তিনি সর্বশেষে এক রাকাতের মাধ্যমে বিতর আদায় করতেন।’
অথবা ইচ্ছা করলে প্রথমে চার রাকাত, তারপর চার রাকাত আদায় করতেন এবং শেষে তিন রাকাত সালাত আদায় করতেন। কারণ:
* ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كان النبي صلى الله عليه وسلم يُصَلِّي أَرْبَعَ رَكَعَاتٍ، فَلاَ تَسْأَلْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُولِهِنَّ، ثُمَّ يُصَلِّي أَرْبَعًا، فَلاَ تَسْأَلْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُولِهِنَّ، ثُمَّ يُصَلِّي ثَلاَثًا
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম চার রাকাত সালাত আদায় করতেন, তা কত সুন্দর ও দীর্ঘ করতেন, তা কত সুন্দর ও দীর্ঘ ছিল, সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করো না। তারপর পুনরায় চার রাকাত সালাত আদায় করতেন, তা কত সুন্দর ও দীর্ঘ করতেন, তা কত সুন্দর ও দীর্ঘ ছিল, সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করো না। অতঃপর তিনি তিন রাকাত সালাত আদায় করতেন।’
* হাম্বলী ও শাফেয়ী ফকীহগণ বলেন, এক তাশাহহুদে এগার রাকাত বিতর অথবা দু’ তাশাহহুদে বিতর আদায় করা জায়েয, যার শেষ তাশাহহুদের পূর্বের রাকাতেও একটি তাশাহহুদ হবে।
তবে রমযানে সালাতুল লাইলের স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা রয়েছে। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
‘যে ব্যক্তি রমযানে ঈমানের সঙ্গে ও ছাওয়াবের আশায় রাত জেগে সালাত আদায় করবে, তার পূর্বের সকল (সগীরা) গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।
এখানে ‘ঈমানের সঙ্গে’ অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি ঈমান রেখে এবং তার পক্ষ হতে যে সাওয়াব রাখা হয়েছে তাতে বিশ্বাস রেখে।
আর ‘ছাওয়াবের আশায়’ অর্থাৎ কেবল নেকীর আশায় করা হবে, লোক দেখানো, সুনাম অর্জন, সম্পদ বা সম্মান লাভের আশায় না হওয়া।
বস্তুত ‘কিয়ামে রমযান’ এটি রমযানের রাত্রিতে সালাতে দাঁড়ানোকে বুঝায়; চাই সেটা প্রথম রাতে হোক বা শেষ রাতে। সুতরাং বুঝা গেল যে,
তারাবীর সালাতও ক্বিয়ামে রমযানের অন্তর্ভুক্ত। তাই উচিত হলো, তারাবীর সালাতকে গুরুত্ব দেয়া এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাওয়াব ও প্রতিদানের আশা ও আগ্রহ প্রকাশ করা। এ সালাতুত্ তারাবীহ তো হাতেগোনা কয়েকটি রাত্রি মাত্র। সুযোগ চলে যাওয়ার পূর্বেই বুদ্ধিমান ঈমানদার ব্যক্তি এ সুযোগ গ্রহণ করবে।
তারাবীহ শব্দের অর্থ বিশ্রাম করা। তারাবীহকে এজন্য তারাবীহ বলা হয়; কারণ লোকেরা এ সালাত বহু দীর্ঘায়িত করে আদায় করত। তাই যখনই চার রাকাত সালাত শেষ করত তখনই তারা একটু আরাম বা বিশ্রাম করে নিত।
সর্বপ্রথম আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে (নববীতে) তারাবীহর সালাত সুন্নত হিসেবে চালু করেন। তারপর উম্মতের ওপর ফরয হয়ে যাবার আশংকায় তিনি এ সালাত ছেড়ে দেন।
* বুখারী ও মুসলিমে রয়েছে:
عَنْ عَائِشَةَ أُمِّ المُؤْمِنِينَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا: أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ صَلَّى ذَاتَ لَيْلَةٍ فِي المَسْجِدِ، فَصَلَّى بِصَلاَتِهِ نَاسٌ، ثُمَّ صَلَّى مِنَ القَابِلَةِ، فَكَثُرَ النَّاسُ، ثُمَّ اجْتَمَعُوا مِنَ اللَّيْلَةِ الثَّالِثَةِ أَوِ الرَّابِعَةِ، فَلَمْ يَخْرُجْ إِلَيْهِمْ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَلَمَّا أَصْبَحَ قَالَ: قَدْ رَأَيْتُ الَّذِي صَنَعْتُمْ وَلَمْ يَمْنَعْنِي مِنَ الخُرُوجِ إِلَيْكُمْ إِلَّا أَنِّي خَشِيتُ أَنْ تُفْرَضَ عَلَيْكُمْ وَذَلِكَ فِي رَمَضَانَ
‘আম্মুল মু’মিনীন ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো এক রাতে মসজিদে সালাত আদায় করলেন, লোকজনও তার সঙ্গে সালাত আদায় করল। পরবর্তী রাতেও তিনি সালাত আদায় করলেন, তাতে লোকজন আরো বৃদ্ধি পেল। তৃতীয় কিংবা চতুর্থ রাতে অনেক লোকের সমাগম হল। কিন্তু সে রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপস্থিত হলেন না। সকালে তিনি বললেন, তোমরা যা করেছ, তা আমি দেখেছি। কিন্তু তোমাদের ওপর এ সালাত ফরয হয়ে যাওয়ার ভয়ে আমি উপস্থিত হইনি। ‘বর্ণনাকারী বলেন, ঘটনাটি রমযান মাসে ঘটেছিল।’
হাদীসে আরো বর্ণিত আছে:
عَنْ أَبِي ذَرٍّ قَالَ: صُمْنَا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَلَمْ يُصَلِّ بِنَا، حَتَّى بَقِيَ سَبْعٌ مِنَ الشَّهْرِ، فَقَامَ بِنَا حَتَّى ذَهَبَ ثُلُثُ اللَّيْلِ، ثُمَّ لَمْ يَقُمْ بِنَا فِي السَّادِسَةِ، وَقَامَ بِنَا فِي الخَامِسَةِ، حَتَّى ذَهَبَ شَطْرُ اللَّيْلِ، فَقُلْنَا لَهُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، لَوْ نَفَّلْتَنَا بَقِيَّةَ لَيْلَتِنَا هَذِهِ؟ فَقَالَ: إِنَّهُ مَنْ قَامَ مَعَ الإِمَامِ حَتَّى يَنْصَرِفَ كُتِبَ لَهُ قِيَامُ لَيْلَةٍ
‘আবূ যর গিফারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সিয়াম পালন করছিলাম। (এর মধ্যে) রমযানের সাতদিন বাকি থাকার পূর্ব পর্যন্ত (প্রথম ২৩ দিন) তিনি আমাদের নিয়ে সালাত আদায় করেন নি। বাকি সাতদিনের প্রথম রাতের এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত তিনি আমাদের নিয়ে সালাত আদায় করলেন। তারপর ষষ্ঠ রাতে আমাদের নিয়ে সালাত আদায় করলেন না। পঞ্চম রাতের অর্ধাংশ পর্যন্ত পুনরায় আমাদের নিয়ে সালাত আদায় করলেন। আমরা বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাকি রাতে যদি আমাদের নিয়ে নফল সালাত আদায় করতেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন, নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি ইমামের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত সালাত আদায় করবে, তার আমলনামায় সারারাত সালাত আদায়ের সাওয়াব লেখা হবে।’
বিতর সালাতসহ তারাবীর সংখ্যা কত হয় তা নিয়ে সালফে সালিহীনের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
কেউ বলেন ৪১ রাকাত, কেউ ৩৯ রাকাত, কেউ ২৯, কেউ ২৩, আবার কেউ ১৩, এবং কেউ বলেন ১১ রাকাত। এসব মতামতের মধ্যে ১১ অথবা ১৩ রাকাতের মতামত অগ্রগণ্য।
* কারণ, ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তাকে প্রশ্ন করা হল, রমযানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সালাত কেমন (কত রাকাত) ছিল? তিনি বললেন,
مَا كَانَ يَزِيدُ فِي رَمَضَانَ وَلاَ فِي غَيْرِهِ عَلَى إِحْدَى عَشْرَةَ رَكْعَةً
‘রমযান এবং রমযানের বাইরে ১১ রাকাতের বেশি ছিল না।’
* অনুরূপ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كَانَتْ صَلاَةُ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ثَلاَثَ عَشْرَةَ رَكْعَةً يَعْنِي من اللَّيْلِ
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সালাত ১৩ রাকাত ছিল।’ অর্থাৎ রাতে ।
* অনুরূপ মুওয়াত্তায় সায়েব ইবন ইয়াযীদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَمَرَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ أُبَيَّ بْنَ كَعْبٍ وَتَمِيمًا الدَّارِيَّ أَنْ يَقُومَا لِلنَّاسِ بِإِحْدَى عَشْرَةَ رَكْعَةً
‘উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু উবাই ইবন কা‘আব ও তামীমুদ্দারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে লোকদের ১১ রাকাত সালাত পড়াতে নির্দেশ দিয়েছেন।’
সালাফে সালেহীন তথা নেককার পূর্বসুরীরা তারাবীহ খুব লম্বা কেরাতে আদায় করতেন।
* যেমন সায়েব ইবন ইয়াযিদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:
كَانَ الْقَارِئُ يَقْرَأُ بِالْمِئِينَ، حَتَّى كُنَّا نَعْتَمِدُ عَلَى الْعِصِيِّ مِنْ طُولِ الْقِيَامِ.
‘ক্বারীগণ শত শত আয়াত পড়তেন। এমনকি আমরা দীর্ঘ রাকাতের কারণে লাঠির ওপর ভর দিয়ে সালাত আদায় করতাম।’
কিন্তু আজকের দিনের মানুষ এর বিপরীত করে। তারা অনেক দ্রুতগতিতে তারাবীহ সালাত আদায় করে; যার ফলে শান্তি ও ধীর-স্থিরতার সাথে সালাত আদায় করা যায় না। অথচ ধীর-স্থিরতা ও শান্তির সাথে সালাত আদায় করা সালাতের রোকনসমূহের একটি; যা ব্যতীত সালাত বিশুদ্ধ হয় না।
তারা এ গুরুত্বপূর্ণ রোকনটিকে নষ্ট করে এবং তারা তাদের পিছনের দুর্বল, অসুস্থ ও বৃদ্ধ বয়সী মুসল্লিদের কষ্ট দেয়। এতে নিজেদের উপর যুলুম করে এবং অন্যদের উপরও যুলুম করে থাকে।
উলামায়ে কেরাম রাহেমাহুমুল্লাহ বলেন, মুকতাদীগণ নামাযের সুন্নত আদায় করতে পারে না এমন দ্রুতগতিতে ইমামের সালাত পড়ানো মাকরূহ। তাহলে ওয়াজিব তরক করতে বাধ্য হয় এমন দ্রুততা অবলম্বন করলে কিরূপ হবে!? আমরা আল্লাহর কাছে এরূপ কাজ থেকে আশ্রয় চাই।
পুরুষদের জন্য তারাবীহর সালাতের জামাত উপেক্ষা করা উচিৎ নয়। যতক্ষণ ইমাম তারাবীহ ও বিতর শেষ না করেন, ততক্ষণ পর্যন্ত প্রস্থান করবে না; যাতে সারারাত দাঁড়িয়ে সালাত আদায়ের সাওয়াব পাওয়া যায়।
যদি মহিলাদের দ্বারা বা মহিলাদের জন্য ফেৎনার আশংকা না থাকে, তাহলে মসজিদে তারাবীহর জামাতে মহিলাদের উপস্থিত হওয়া জায়েয।
* কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
لاَ تَمْنَعُوا إِمَاءَ اللَّهِ مَسَاجِدَ اللَّهِ
‘তোমরা আল্লাহর বান্দীদের (নারীদের) মসজিদে আসতে বাধা দিও না।’
* তাছাড়া এটা সালাফে সালিহীনের আমলও বটে। তবে শর্ত হলো: পর্দার সঙ্গে আসতে হবে। খোলামেলা, সুগদ্ধি ব্যবহার করে, উচ্চ আওয়াজ করে এবং সৌন্দর্য প্রদর্শন করে আসা বৈধ নয়। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿ وَلَا يُبۡدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنۡهَاۖ ﴾ [النور: ٣١]
‘আর যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য তারা প্রকাশ করবে না।’ {সূরা আন-নূর, আয়াত: ৩১}
অর্থাৎ বোরকা, লম্বা চাদর বা এ জাতীয় পোশাক ব্যবহারের পরও যা স্বাভাবিকভাবে প্রকাশ পায়, তাতে কোনো ক্ষতি নেই। কারণ তা লুকানো বা আবৃত করা সম্ভবও নয়।
তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদের ঈদের সালাতে অনুমতি দিলে উম্মে আতিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বললেন,
يَا رَسُولَ اللهِ إِحْدَانَا لَا يَكُونُ لَهَا جِلْبَابٌ، قَالَ: لِتُلْبِسْهَا أُخْتُهَا مِنْ جِلْبَابِهَا
‘হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের কারও কারও তো বোরকা নেই। (তাহলে সে কী করবে?) তিনি বললেন, ‘তার কোনো বোন তাকে নিজ বোরকাসমূহ থেকে একটি বোরকা পরাবে।’
নারীদের জন্য সুন্নত হলো: তারা পুরুষদের পেছনে কাতার বাঁধবে এবং তাদের থেকে দূরত্ব অবলম্বন করবে। সর্বশেষ কাতারগুলোয় দাঁড়াবে। কারণ তাদের বেলায় উত্তম কাতারের বিবেচনা পুরুষদের উল্টো।
* কারণ, আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
خَيْرُ صُفُوفِ الرِّجَالِ أَوَّلُهَا، وَشَرُّهَا آخِرُهَا، وَخَيْرُ صُفُوفِ النِّسَاءِ آخِرُهَا، وَشَرُّهَا أَوَّلُهَا
‘পুরুষদের জন্য উত্তম হল প্রথম কাতার এবং মন্দ হল পেছনের কাতার। আর নারীদের জন্য উত্তম হল পেছনের কাতার এবং মন্দ হল প্রথম কাতার।’
নারীগণ ইমামের সালাম ফিরানোর পরপরই ঘরে ফিরে যাবে। ওযর ছাড়া বিলম্ব করবে না।
* কারণ, উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন:
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا سَلَّمَ قَامَ النِّسَاءُ حِينَ يَقْضِي تَسْلِيمَهُ، وَيَمْكُثُ هُوَ فِي مَقَامِهِ يَسِيرًا قَبْلَ أَنْ يَقُومَ، قَالَ: نَرَى – وَاللَّهُ أَعْلَمُ – أَنَّ ذَلِكَ كَانَ لِكَيْ يَنْصَرِفَ النِّسَاءُ، قَبْلَ أَنْ يُدْرِكَهُنَّ أَحَدٌ مِنَ الرِّجَالِ
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সালাম ফিরাতেন, তখন সালাম শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে নারীগণ দাঁড়িয়ে যেতেন। তিনি দাঁড়ানোর পূর্বে সামান্য কিছুক্ষণ বসে থাকতেন। বর্ণনাকারী ইবন শিহাব যুহরী বলেন, আমার মনে হয় (আল্লাহই ভালো জানেন) সেটা এজন্য করতেন, যাতে নারীরা পুরুষদের বের হওয়ার পূর্বে ফিরে যেতে পারে।’
হে আল্লাহ! ঐ সকল (পূর্ববর্তী) লোকদের যেভাবে আমল করার তাওফীক দিয়েছেন তেমনিভাবে আমাদেরও আমল করার তাওফীক দিন। হে দয়াময় প্রভু! আমাদের পিতা-মাতা এবং সকল মুসলিমকে ক্ষমা করুন। দরূদ ও সালাম বর্ষণ করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদ ও তাঁর বংশধর ও সকল সাহাবীর ওপর।
পঞ্চম আসরঃকুরআন তিলাওয়াতের ফযীলত
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি তাঁর দরজার দিকে আহ্বান করেন, যাকে চান তিনি সঠিক পথের দিশা দেন, নিজের কিতাব নাযিলের মধ্য দিয়ে যিনি নেয়ামতধন্য করেন, যে কিতাব ‘মুহকাম’ ও ‘মুতাশাবিহ’ সংবলিত, ফলে যাদের অন্তরে রয়েছে সত্যবিমুখ প্রবণতা তারা মুতাশাবিহ্ আয়াতগুলোর পেছনে লেগে থাকে। আর যারা জ্ঞানে পরিপক্ক, তারা বলে, আমরা এগুলোর প্রতি ঈমান আনলাম। আমি তাঁর প্রশংসা করি এ জন্য যে তিনি আমাকে সুপথের সন্ধান দিয়েছেন এবং এর উপায়-উপকরণ সহজলভ্য করেছেন।
আর সাক্ষ্য দিচ্ছি যে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই, এমন সাক্ষ্য দিচ্ছি যা দ্বারা আমি তাঁর শাস্তি থেকে নাজাত প্রত্যাশা করি, আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসূল, যিনি পৃথিবীতে আগমন ও পৃথিবী থেকে গমনকালে কার্যক্ষেত্রে ছিলেন সবচে পূর্ণাঙ্গ মানুষ।
দরূদ বর্ষিত হোক তাঁর ওপর, গারে হেরায় তার পরম সঙ্গী শ্রেষ্ঠ সাহাবী আবূ বকরের ওপর, উমরের ওপর যার মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর দীনকে সম্মানিত করেছেন এবং দুনিয়াকে তার দ্বারা অবিচল রেখেছেন, উসমানের ওপর যিনি নিজ বাসায় ও নিজ মিহরাবে শহীদ হয়েছেন, আলীর ওপর যিনি ইলমী বিষয়ের জটিলতা নিরসন ও অপ্রকাশ্য গূঢ় বিষয় উন্মোচনকারী, আর নবীর পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীর ওপর যারা তাঁর প্রিয়জন ছিলেন। আর তাঁর উপর যথাযথ সালাম প্রদান করুন।
আমার ভাইয়েরা!
* আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ يَتۡلُونَ كِتَٰبَ ٱللَّهِ وَأَقَامُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَأَنفَقُواْ مِمَّا رَزَقۡنَٰهُمۡ سِرّٗا وَعَلَانِيَةٗ يَرۡجُونَ تِجَٰرَةٗ لَّن تَبُورَ ٢٩ لِيُوَفِّيَهُمۡ أُجُورَهُمۡ وَيَزِيدَهُم مِّن فَضۡلِهِۦٓۚ إِنَّهُۥ غَفُورٞ شَكُورٞ ٣٠ ﴾ [فاطر: ٢٩، ٣٠]
‘যারা আল্লাহর কিতাব পাঠ করে, সালাত কায়েম করে, আমার দেয়া রিযিক থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারাই আশা করতে পারে এমন ব্যবসার, যা কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হবেনা, কারণ আল্লাহ তাদের কর্মের পূর্ণ প্রতিদান দেবেন এবং নিজ অনুগ্রহে আরো অধিক দান করবেন। তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ {সূরা আল-ফাতির, আয়াত: ২৯-৩০}
আল্লাহর কিতাবের তিলাওয়াত দু’প্রকার। যথা-
১। প্রথম প্রকার: হুকমী তিলাওয়াত। এটা হলো আল্লাহর কথাকে বিশ্বাস করা, তাঁর নির্দেশ মেনে নিয়ে তাঁর নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ থেকে বর্জন করে কিতাব তথা আল কুরআনের সকল হুকুম-আহকাম বাস্তবায়ন করা। এ বিষয়ে অন্য আসরে বিস্তারিত আলোচনা আসবে ইনশাআল্লাহ।
২। দ্বিতীয় প্রকার: শাব্দিক তিলাওয়াত। এটা হলো আল কুরআন পাঠ করা। এর ফযীলতের ব্যাপারে কুরআন ও সুন্নাহ হতে অনেক দলীল প্রমাণ রয়েছে। ফযীলত হয়তো পুরা কুরআনের ব্যাপারে আবার হয়তো নির্দিষ্ট কোনো সূরার ব্যাপারে রয়েছে আবার কখনো হয়তো নির্দিষ্ট কোনো আয়াতের ব্যাপারে রয়েছে।
* যেমন বুখারী ও মুসলিমে উসমান ইবন আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ القُرْآنَ وَعَلَّمَهُ
“তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ওই ব্যক্তি যিনি কুরআন মাজীদ শিক্ষা করেন এবং অন্যকে শিক্ষা দেন।”
* বুখারী ও মুসলিমে আরো বর্ণিত হয়েছে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
الْمَاهِرُ بِالْقُرْآنِ مَعَ السَّفَرَةِ الْكِرَامِ الْبَرَرَةِ وَالَّذِى يَقْرَأُ الْقُرْآنَ وَيَتَتَعْتَعُ فِيهِ وَهُوَ عَلَيْهِ شَاقٌّ لَهُ أَجْرَانِ.
“আল-কুরআনে দক্ষ ও পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ সম্মানিত পুণ্যবান ফেরেশতাদের সঙ্গে থাকবেন। যে ব্যক্তি কুরআন আটকে আটকে তিলাওয়াত করে এবং তা তার জন্য কষ্টকর হয়, তার জন্য দু’টি প্রতিদান রয়েছে।”
দুটি প্রতিদানের প্রথমটি হলো: তিলাওয়াতের, দ্বিতীয়টি হলো: পাঠকারীর কষ্টের।
* অনুরূপভাবে বুখারী ও মুসলিমে আবু মূসা আল-আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
مَثَلُ المُؤْمِنِ الَّذِي يَقْرَأُ القُرْآنَ كَمَثَلِ الأُتْرُجَّةِ، رِيحُهَا طَيِّبٌ وَطَعْمُهَا طَيِّبٌ، وَمَثَلُ المُؤْمِنِ الَّذِي لاَ يَقْرَأُ القُرْآنَ كَمَثَلِ التَّمْرَةِ، لاَ رِيحَ لَهَا وَطَعْمُهَا حُلْوٌ،
“যে মুমিন কুরআন তিলাওয়াত করে তার দৃষ্টান্ত কমলালেবুর মত, যা সুস্বাদু ও সুঘ্রাণযুক্ত। আর যে মুমিন কুরআন তিলাওয়াত করে না, তার দৃষ্টান্ত খেজুরের ন্যায় যার কোনো ঘ্রাণ নেই কিন্তু তার স্বাদ মিষ্টি।”
* তাছাড়া সহীহ মুসলিমে আবূ উমামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
اقْرَءُوا الْقُرْآنَ فَإِنَّهُ يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ شَفِيعًا لِأَصْحَابِهِ .
“তোমরা কুরআন তিলাওয়াত কর। কেননা কুরআন কিয়ামতের দিন তিলাওয়াতকারীর জন্য সুপারিশ করবে।”
* অনুরূপভাবে সহীহ মুসলিমে উকবা ইবন ‘আমের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
أَفَلَا يَغْدُو أَحَدُكُمْ إِلَى الْمَسْجِدِ فَيَعْلَمُ، أَوْ يَقْرَأُ آيَتَيْنِ مِنْ كِتَابِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ، خَيْرٌ لَهُ مِنْ نَاقَتَيْنِ، وَثَلَاثٌ خَيْرٌ لَهُ مِنْ ثَلَاثٍ، وَأَرْبَعٌ خَيْرٌ لَهُ مِنْ أَرْبَعٍ، وَمِنْ أَعْدَادِهِنَّ مِنَ الْإِبِلِ
“তোমাদের কেউ কি এরূপ করতে পার না যে, সকালে মসজিদে গিয়ে মহান আল্লাহ্‌র কিতাব থেকে দুটো আয়াত জানবে অথবা পড়বে; এটা তার জন্য দু’টো উষ্ট্রীর তুলনায় উত্তম। আর তিনটি আয়াত তিনটি উষ্ট্রী থেকে উত্তম, চারটি আয়াত চারটি উষ্ট্রী থেকে উত্তম। আর (শুধু উষ্ট্রীই নয়, বরং একইসাথে) সমসংখ্যক উট লাভ করা থেকেও তা উত্তম হবে।”
* তদ্রূপ সহীহ মুসলিমে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদীসে রয়েছে, তিনি বলেন, নিশ্চয় নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
مَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِي بَيْتٍ مِنْ بُيُوتِ اللَّهِ تَعَالَى، يَتْلُونَ كِتَابَ اللَّهِ وَيَتَدَارَسُونَهُ بَيْنَهُمْ، إِلَّا نَزَلَتْ عَلَيْهِمُ السَّكِينَةُ، وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ، وَحَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ، وَذَكَرَهُمُ اللَّهُ فِيمَنْ عِنْدَهُ
“যখন আল্লাহর কোনো ঘরে (মসজিদে) লোকজন একত্রিত হয়ে কুরআন তিলাওয়াত করে এবং নিজেদের মাঝে তা অধ্যয়ণ করে, তখন তাদের ওপর প্রশান্তি অবতীর্ণ হয়, আল্লাহর রহমত তাদেরকে আবৃত করে রাখে, ফেরেশতাগণ তাদের বেষ্টন করে রাখেন এবং আল্লাহ তাঁর কাছে অবস্থিত ফেরেশতাদের কাছে তাদের আলোচনা করেন।”
* তাছাড়া আরো এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
تَعَاهَدُوا هَذَا الْقُرْآنَ، فَوَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَهُوَ أَشَدُّ تَفَلُّتًا مِنَ الْإِبِلِ فِي عُقُلِهَا
“তোমরা কুরআনের যথাযথ যতœ নাও, তা হিফাযত ও সংরক্ষণ কর। ওই সত্তার শপথ! যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন, অবশ্যই উট তার রশি থেকে যেমন দ্রুত পালিয়ে যায় তার চেয়েও আরো তীব্র বেগে এ কুরআন চলে যায়। (অর্থাৎ কুরআনের প্রতি যতœবান না হলে কুরআন স্মৃতি থেকে দ্রুত চলে যাবে।)”
* রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন:
لَا يَقُلْ أَحَدُكُمْ نَسِيتُ آيَةَ كَيْتَ وَكَيْتَ، بَلْ هُوَ نُسِّيَ
“তোমাদের কেউ যেন না বলে আমি অমুক অমুক আয়াত ভুলে গেছি। বরং তাকে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে।’
হাদীসে نسيت ‘আমি ভুলে গেছি’ এ কথা বলবে না এজন্য যে, এতে করে কুরআন মুখস্থ করার পর গুরুত্বহীনতার কারণে ভুলে গেছে বুঝা যায়। তাই এভাবে বলা যাবে না।
* অনুরূপ আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ، وَالحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا، لَا أَقُولُ الم حَرْفٌ، وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلَامٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ
“যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ (অক্ষর) পাঠ করবে, তাকে একটি নেকী প্রদান করা হবে। আর প্রতিটি নেকী দশগুণ বৃদ্ধি করা হবে। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ। বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ, মীম একটি হরফ।”
* আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে আরো বর্ণিত আছে, তিনি বলেন:
إِنَّ هَذَا الْقُرْآنَ مَأْدُبَةُ اللَّهِ فَاقْبَلُوا مِنْ مَأْدُبَتِهِ مَا اسْتَطَعْتُمْ إِنَّ هَذَا الْقُرْآنَ حَبْلُ اللَّهِ، وَالنُّورُ الْمُبِينُ، وَالشِّفَاءُ النَّافِعُ عِصْمَةٌ لِمَنْ تَمَسَّكَ بِهِ، وَنَجَاةٌ لِمَنْ تَبِعَهُ، لَا يَزِيغُ فَيُسْتَعْتَبَ، وَلَا يَعْوَجُّ فَيُقَوَّمُ، وَلَا تَنْقَضِي عَجَائِبُهُ، وَلَا يَخْلَقُ مِنْ كَثْرَةِ الرَّدِّ، اتْلُوهُ فَإِنَّ اللَّهَ يَأْجُرُكُمْ عَلَى تِلَاوَتِهِ كُلَّ حَرْفٍ عَشْرَ حَسَنَاتٍ، أَمَا إِنِّي لَا أَقُولُ الم حَرْفٌ، وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلَامٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ .
‘নিশ্চয়ই এ কুরআন আল্লাহর দস্তরখান। তোমরা যথাসম্ভব তার দস্তরখান থেকে গ্রহণ কর। এ মহাগ্রন্থ আল-কুরআন আল্লাহর মজবুত রশি, সুদীপ্ত জ্যোতি, উত্তম নিরাময়কারী, যে তা আঁকড়ে ধরবে তার জন্য কুরআন ত্রাতা, যে অনুসরণ করে তা তার জন্য নাজাত ও মুক্তির মাধ্যম। সে সত্য থেকে এমনভাবে বিচ্যুত হবে না যে তাকে ভর্ৎসনা করা হবে। সে বক্র পথে এমনভাবে যাবে না যে তাকে সোজা করতে হবে। কুরআনের বিস্ময়ের শেষ নেই। অধিক পুনরাবৃত্তির কারণে তা পুরাতন হয় না (অর্থাৎ কুরআনের আয়াতের পুনরাবৃত্তি হলেও তাতে নতুনত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। কারণ তার আবেদন চিরন্তন।) তোমরা কুরআন তিলাওয়াত করো, কারণ আল্লাহ তোমাদেরকে তিলাওয়াতকৃত প্রতিটি হরফের বিনিময়ে দশটি করে নেকী দেবেন। জেনে রাখ, আমি বলি না আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ, বরং আলিফ একটি, লাম একটি, এবং মীম একটি হরফ।”
আমার ভাইয়েরা! এই হলো আল-কুরআন পাঠের ফযীলত। অল্প আমলে অধিক সাওয়াব, তবে তা শুধু সে লোকের জন্যই যে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর পক্ষ থেকে সাওয়াব কামনা করে। সুতরাং প্রতারিত ও প্রবঞ্চিত সেই ব্যক্তি যে কুরআনের ব্যাপারে শৈথিল্য প্রদর্শন করে। আর সে লোকই তো ক্ষতিগ্রস্ত যে লাভ এমনভাবে হাতছাড়া হয়ে গেছে যে সে সেটাকে আর কাটিয়ে উঠতে পারে নি। এই যে ফযীলতসমূহের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে তার গোটা কুরআনকেই শামিল করে।
আর কুরআনের সুনির্দিষ্ট সূরার ফযীলতের ব্যাপারেও অনেক হাদীস বর্ণিত রয়েছে।
সেসবের মধ্যে সূরা ফাতেহা অন্যতম:
* সহীহ বুখারীতে আবু সাঈদ ইবনুল মু‘আল্লা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন:
لَأُعَلِّمَنَّكَ سُورَةً هِيَ أَعْظَمُ سُورَةٍ فِي الْقُرْآنِ قَالَ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ هِيَ السَّبْعُ الْمَثَانِي وَالْقُرْآنُ الْعَظِيمُ الَّذِي أُوتِيتُهُ.
‘অবশ্যই আমি তোমাকে কুরআনের বড় সূরাটি শেখাবো। সেটা হলো সূরা আল-ফাতেহা ‘‘আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন’’ এটাই ‘সাব‘উল মাসানী’ (বা বারবার পঠিত ৭টি আয়াত) এবং মহা কুরআন যা আমাকে দেওয়া হয়েছে।”
* সূরা ফাতিহার এ ফযীলতের কারণেই সালাতের মধ্যে এ সূরা পাঠ করা সালাতের রুকন হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছে; যা ছাড়া সালাত শুদ্ধ হয় না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
لَا صَلَاةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ.
‘সূরা ফাতিহা যে ব্যক্তি পড়ল না তার সালাতই পূর্ণ হবে না।’
* আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
مَنْ صَلَّى صَلَاةً لَمْ يَقْرَأْ فِيهَا بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ فَهِي خِدَاجٌ يقولها ثَلَاثًا. فَقِيلَ لِأَبِي هُرَيْرَةَ إِنَّا نَكُونُ وَرَاءَ الْإِمَامِ، فَقَالَ اقْرَأْ بِهَا فِي نَفْسِكَ…
“যে ব্যক্তি এমন কোনো সালাত পড়ল যাতে সে সূরা ফাতিহা পাঠ করে নি সেটা অসম্পূর্ণ।” কথাটি তিনি তিনবার বলেছেন। তখন আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে জিজ্ঞাসা করা হলো, আমরা ইমামের পেছনে থাকলে কী করবো? তিনি বললেন: তখন তা মনে মনে পাঠ করবে।’
অনুরূপ সুনির্দিষ্ট সূরার মধ্যে সূরা বাকারা ও সূরা আলে ইমরান অন্যতম।
* নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
اقْرَءُوا الزَّهْرَاوَيْنِ الْبَقَرَةَ وَسُورَةَ آلِ عِمْرَانَ فَإِنَّهُمَا تَأْتِيَانِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ كَأَنَّهُمَا غَمَامَتَانِ أَوْ كَأَنَّهُمَا غَيَايَتَانِ أَوْ كَأَنَّهُمَا فِرْقَانِ مِنْ طَيْرٍ صَوَافَّ تُحَاجَّانِ عَنْ أَصْحَابِهِمَا اقْرَءُوا سُورَةَ الْبَقَرَةِ فَإِنَّ أَخْذَهَا بَرَكَةٌ وَتَرْكَهَا حَسْرَةٌ وَلَا تَسْتَطِيعُهَا الْبَطَلَةُ
“তোমরা যাহরাওয়াইন তথা পুষ্পদ্বয় পাঠ করো, তা হলো সূরা বাকারা ও সূরা আলে ইমরান। কারণ এ দুটো সূরা কিয়ামতের দিন দু’টি মেঘমালার ন্যায় অথবা দু’দল পাখির ঝাঁকের মতো সারিবদ্ধভাবে উড়বে এমতাবস্থায় যে, তারা তাদের পাঠকদের পক্ষ নিয়ে বাক-বিতণ্ডা করবে। (জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর জন্য অথবা জাহান্নামের ফিরিশতা যাবানিয়াদের সাথে)। তোমরা সূরা বাকারা পাঠ করো। কারণ তা গ্রহণ (করা বা মুখস্থ) করায় রয়েছে বরকত আর তা পরিত্যাগ করায় রয়েছে পরিতাপ। আর কোনো ‘বাতালা’ অর্থাৎ জাদুকর এটা অর্জন করতে পারে না।’
* আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
إِنَّ البَيْتَ الَّذِي تُقْرَأُ فِيهِ البَقَرَةُ لَا يَدْخُلُهُ الشَّيْطَانُ
‘যে ঘরে সূরা বাকারা পাঠ করা হয় সেখানে শয়তান প্রবেশ করে না।’
আর শয়তান এজন্য ঘরে প্রবেশ করে না; কারণ তাতে আয়াতুল কুরসী রয়েছে।
* আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত আছে যে,
أَنَّ من قرأها في ليلة لم يزل عليه من الله حافظ ولا يقربه شيطان حتى يصبح
“যে ব্যক্তি এ আয়াতুল কুরসী রাত্রি বেলায় পাঠ করল, আল্লাহর পক্ষ থেকে তার জন্য একজন সংরক্ষণকারী সার্বক্ষণিকভাবে থাকবে এবং শয়তান সকাল হওয়া পর্যন্ত তার কাছে আসতে পারবে না।”
* অনুরূপভাবে ‘আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত,
أن جبرئيل قال وهو عِنْدَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ هَذَا بَابٌ قد فتح من السماء ما فتح قط، قال: فَنَزَلَ مِنْهُ مَلَكٌ فأتى النبي صلى الله عليه وسلم أَبْشِرْ بِنُورَيْنِ أُوتِيتَهُمَا لَمْ يُؤْتَهُمَا نَبِيٌّ قَبْلَكَ فَاتِحَةُ الْكِتَابِ وَخَوَاتِيمُ سُورَةِ الْبَقَرَةِ لَنْ تَقْرَأَ بِحَرْفٍ مِنْهُمَا إِلَّا أُعْطِيتَهُ
“জিব্রাঈল আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে থাকা অবস্থায় বললেন, এই দেখুন এটা একটা দরজা আকাশ থেকে খোলা হয়েছে- ইতোপূর্বে কখনো তা খোলা হয়নি। রাবী বললেন, এরপর ওই দরজা থেকে একজন ফেরেশতা নাযিল হয়ে আল্লাহর নবীর সম্মুখে হাযির হয়ে বললেন: আপনি দু’টো নূরের সুসংবাদ গ্রহণ করুন যা আপনার পূর্বে কোনো নবীকে দেয়া হয়নি, সেটা হলো (১) সূরা ফাতিহা। (২) সূরা বাকারার শেষ আয়াতগুলো, আপনি এ দুটো তিলাওয়াত করে যে কোনো হরফ দ্বারা যা চাইবেন তা আপনাকে দেয়া হবে।”
যে সমস্ত সূরা বিশেষ ফযীলতের জন্য সুনির্দিষ্ট সূরা ইখলাস (কুল হুয়াল্লাহু আহাদ) তাদের অন্যতম।
* সহীহ বুখারীতে আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সূরার ব্যাপারে বলেছেন:
وَالَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ إنها تَعْدِلُ ثُلُثَ الْقُرْآنِ.
‘সেই সত্তার কসম করে বলছি যার হাতে আমার জীবন নিহিত, নিশ্চয়ই এ সূরা ইখলাস কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান।’
অবশ্য ফযীলতের ক্ষেত্রে এটা কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান এ কথাটির অর্থ এই নয় যে তা পুরো কুরআনের বিকল্প। এজন্য যদি কেউ এ সূরা সালাতে তিনবার পড়ে তা তার জন্য সূরা ফাতেহার বিকল্প হিসেবে গ্রহণীয় হবে না। বস্তুত কোনো কিছু ফযীলতের ক্ষেত্রে অন্য কিছুর সমপর্যায়ের হলেই এটা আবশ্যক নয় যে তা অপরটার বিকল্প হবে। যেমন সহীহ বুখারী ও মুসলিমে এসেছে, আবূ আইয়ুব আল আনছারী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
من قال لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ عَشَرَ مَرَّات كَانَ كَمَنْ أعتق أربعة أنفسٍ من ولد إسماعيل.
“যে ব্যক্তি বলল,
لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ.
‘একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই, সকল রাজত্ব তাঁর, তাঁর জন্য সকল প্রশংসা।’ এ দো‘আ বা যিকরটি ১০ বার পড়ে, সে যেন ইসমাইল ‘আলাইহিস সালামের সন্তানদের মধ্যে চারজন গোলামকে আযাদ করে দিল।”
তাবরানীর বর্ণনায় বলা হয়েছে,
كُنَّ لَهُ كَعِدْلِ عَشَرِ رِقَابٍ مِنْ وَلَدِ إِسْمَاعِيلَ عَلَيْهِ السَّلَامُ
‘তা তার জন্য ইসমাঈল ‘আলাইহিস সালামের বংশধরদের মধ্য হতে চারজনকে আযাদ করার সমতুল্য হবে।’
এ দো‘আর এ ফযীলত সত্ত্বেও যদি কারো উপর ৪ জন গোলাম আযাদ করার কাফফারা ধার্য হয় তখন সে এ যিকরটি করলে গোলাম আযাদের জন্য যথেষ্ট হবে না; যদিও ফযীলত বা সওয়াবের দিক থেকে মান সমান হয়।
ফযীলত সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট সূরার মধ্যে সূরা মুয়াওয়াযাতাইন তথা (কুল ‘আউযু বিরাব্বিল ফালাক) ও (কুল ‘আউযু বিরাব্বিন নাস) উল্লেখযোগ্য।
* ‘উকবা ইবন আমের রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
أَلَمْ تَرَ آيَاتٍ أُنْزِلَتْ اللَّيْلَةَ لَمْ يُرَ مِثْلُهُنَّ قَطُّ قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ وَقُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ
“তুমি কি দেখনি? আজ রাত্রিতে নাযিল হওয়া সেই আয়াতসমূহ! এরূপ আয়াত আর লক্ষ্য করা যায় না। সেগুলো হলো সূরা ফালাক ও সূরা নাস। তথা কুল ‘আউযু বিরাব্বিল ফালাক ও কুল ‘আউযু বিরাব্বিন নাস।”
* নাসাঈতে এসেছে,
أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَمَرَ عقبة أن يقرأ بهماثم قال النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَا سَأَلَ سَائِلٌ بِمِثْلِهِمَا وَلَااسْتَعَاذَ مُسْتَعِيذٌ بِمِثْلِهِمَا.
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘উকবা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নির্দেশ দিলেন এ সূরা ফালাক ও সূরা নাস পাঠ করার জন্য।” তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “কোনো প্রার্থনাকারী এ দুটো সূরায় বর্ণিত প্রার্থনার মত প্রার্থনা করে না। আর কোন আশ্রয়কারীও এ সূরায় বর্ণিত বিষয়ের মত আশ্রয় চায় না।”
সুতরাং হে আমার ভ্রাতৃবৃন্দ! বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াতে রত থাকুন। বিশেষ করে এ মাসে যাতে কুরআন নাযিল হয়েছে। কারণ এ মাসে অধিক কুরআন তেলাওয়াতের বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
-জিব্রাঈল (আলাইহিস সালাম) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের কাছে প্রত্যেক বছর রমযান মাসে একবার পুরো কুরআন পেশ করতেন, পুনরাবৃত্তি করতেন। অবশেষে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর বছর তিনি সেটা দু’বার পেশ করেন; যাতে তা রাসূলের হৃদয়ে স্থায়ী ও স্থির হয়ে যায় এবং পাশাপাশি বিষয়টি জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এমনটি করেছেন।
অনুরূপভাবে সালাফে সালেহীন তথা আমাদের নেককার পূর্বসুরীগণ রমযান মাসে সালাতে ও সালাতের বাইরে কুরআন বেশি বেশি তিলাওয়াত করতেন।
* ইমাম যুহরী (রহ.) রমযান মাস আগমন করলে বলতেন, এটা তো শুধু কুরআন তিলাওয়াত ও মানুষকে খাবার খাওয়ানোর মাস।
* এ মাহে রমযান আগমন করলে ইমাম মালেক (রহ.) হাদীস পাঠ, ইলমী মজলিস পরিত্যাগ করতেন এবং মুসহাফ থেকে কুরআন তেলাওয়াতের প্রতি মনোনিবেশ করতেন।
* কাতাদা (রহ.) সর্বদা প্রতি সপ্তাহে একবার কুরআন খতম করতেন। আর রমযানে প্রতি তিন দিনে একবার খতম করতেন এবং রমযানের শেষ দশ দিন প্রতিদিন এক খতম করে পড়তেন।
* ইব্রাহীম নাখ‘য়ী (রহ.) রমযানে প্রতি তিন রাত্রিতে কুরআন খতম করতেন এবং শেষ দশ রাত্রিতে প্রতি দুই রাত্রিতে খতম করতেন।
* আসওয়াদ (রহ.) প্রতি মাসেই দুই রাত্রিতে পুরা কুরআন পাঠ করতেন।
ভ্রাতৃবৃন্দ! আপনাদের প্রতি আল্লাহ রহম করুন। অতএব আপনারা এসব পুণ্যবান মনীষীদের অনুসরণ করুন, তাঁদের পথে অনুগামী হয়ে পূতঃহৃদয় পুণ্যবান ফেরেশতাদের সঙ্গী হোন। আর রাত ও দিনের সময়গুলো এমন কিছুতে কাজে লাগান যা আপনাদেরকে প্রতাপশালী ক্ষমাশীল রবের নৈকট্যশীল করবে; কেননা বয়স দ্রুতই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছে, এ যেন দিনের এক মুহূর্তকাল মাত্র!
হে আল্লাহ, আপনি আমাদের সেভাবে কুরআন তিলাওয়াতের তাওফীক দিন যেভাবে করলে আপনি খুশি হবেন এবং এর মাধ্যমে আপনি আমাদের শান্তির পথ দেখান, এর দ্বারা আমাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোয় বের করে আনুন, আর একে আমাদের বিপক্ষে নয় আমাদের পক্ষে প্রমাণ বানিয়ে দিন হে সৃষ্টিকুলের পালনকর্তা।
হে আল্লাহ আপনার আপন করুণায় এ কুরআনের মাধ্যমে জান্নাতে আমাদের উঁচু স্তর প্রদান করুন এবং জাহান্নামের স্তরসমূহ থেকে নাজাত দিন। আর আমাদের যাবতীয় গুনাহের ক্ষতিপূরণ করে দিন। আমাদেরকে এবং পিতা-মাতা ও সকল মুসলিমকে ক্ষমা করুন হে পরম করুনাময়! আর সালাত ও সালাম বর্ষণ করুন আমাদের নবী মুহাম্মদ, তাঁর পরিবার ও সকল সাহাবীর ওপর।
ষষ্ঠ আসরঃসিয়ামের বিধানের দিক থেকে মানুষের প্রকারভেদ
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, তিনি নিজ প্রজ্ঞা অনুযায়ী যা সৃষ্টি ও নির্মাণ করেছেন তা করেছেন সুনিপুণ। পথ ও পদ্ধতি হিসেবে প্রবর্তন করেছেন শরীয়তকে, যাতে রয়েছে দয়া ও প্রজ্ঞার সমন্বয়। আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন আনুগত্য করার, তাঁর নিজের প্রয়োজনে নয় বরং আমাদেরই প্রয়োজনে। ক্ষমা করেন তাকে যে তার রবের কাছে ফিরে আসে এবং তাঁর কাছে যায় আর বিপুল পরিমান দান করেন তাকে যে সৎকর্মশীল হয়।
﴿وَٱلَّذِينَ جَٰهَدُواْ فِينَا لَنَهۡدِيَنَّهُمۡ سُبُلَنَاۚ ﴾ [العنكبوت: ٦٩]
“আর যারা আমাদের পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, আমরা তাদেরকে অবশ্যই আমাদের পথে পরিচালিত করব।’ {সূরা আল-‘আনকাবূত, আয়াত: ৬৯} আমি তাঁর নে‘আমতসমূহের ওপর তাঁর স্তুতি গাই ও প্রশংসা করি।
আর আমি সাক্ষ্য প্রদান করি যে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই, তাঁর কোনো অংশীদার নেই, এমন সাক্ষ্য যা দ্বারা আমি দারুন নাঈম তথা নে‘আমত ও আনন্দপূর্ণ বাড়ী জান্নাত লাভ ধন্য হতে পারি। আমি আরও সাক্ষ্য দেই যে মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসূল, যাকে তিনি সব আসমান ছাড়িয়ে উপরে নিজের কাছে নিয়েছিলেন ফলে তিনি তাঁর নৈকট্য লাভ করেছিলেন।
আল্লাহ সালাত পেশ করুন তাঁর ওপর, তাঁর সাথী আবূ বকরের ওপর যিনি ইবাদতের কষ্টের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকেছেন সন্তুষ্টচিত্তে, যাকে আল্লাহ তার বাণী,
﴿إِذۡ يَقُولُ لِصَٰحِبِهِۦ لَا تَحۡزَنۡ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَنَاۖ﴾ [التوبة: ٤٠]
“যখন তিনি তার সাথীকে বলছিলেন, পেরেশান হয়ো না, নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের সাথে রয়েছেন”। [সূরা আত-তাওবাহ: ৪০] দ্বারা সম্মানিত করেছেন। অনুরূপভাবে উমরের ওপর, যিনি ইসলামের বিজয়গৌরব ছিনিয়ে এনেছেন ফলে তা আর দুর্বল অসহায় থাকেনি, উসমানের ওপর যিনি তাকদীরে সন্তুষ্ট থেকেছেন অথচ তার দুয়ারে মৃত্যু হাতছানি দিয়েছে। তদ্রূপ আলীর ওপর, যিনি বংশগত দিক থেকে রাসূলের নিকটজন এবং যিনি লক্ষ্যে পৌঁছেছেন। তাছাড়া রাসূলের সকল পরিবার-পরিজন এবং বিশ্বস্ত ও সম্মানিত সাহাবীর ওপর। আর আল্লাহ তাদের উপর যথাযথ সালামও বর্ষণ করুন।
ভাইয়েরা আমার, তৃতীয় আসরে উল্লেখিত হয়েছে যে,
সাওমের ফরয হওয়া প্রথমত দুটি পর্যায়ে বিভক্ত ছিল। এরপর সাওমের বিধান স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
কিন্তু এ সিয়াম পালনের ক্ষেত্রে মানুষের দশটি প্রকার রয়েছে:
প্রথম প্রকার: ঐ সব মানুষ যারা মুসলিম, বালেগ বা প্রাপ্ত বয়স্ক, সুস্থ জ্ঞানসম্পন্ন, মুকীম, সামর্থ্যবান ও বাধামুক্ত।
এ প্রকার মানুষদের উপর রমযানের সাওম যথাসময়ে আদায় করা ওয়াজিব। কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমার দলীলসমূহ এর উপর প্রমাণবহ।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿شَهۡرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِيٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلۡقُرۡءَانُ هُدٗى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَٰتٖ مِّنَ ٱلۡهُدَىٰ وَٱلۡفُرۡقَانِۚ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ ٱلشَّهۡرَ فَلۡيَصُمۡهُۖ ﴾ [البقرة: ١٨٥]
‘রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৫}
* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
إِذَا رَأَيْتُمُ الْهِلَالَ فَصُومُوا ‘
যখন তোমরা রমযানের চাঁদ দেখবে, তখন সিয়াম পালন করবে।’
* আর পৃথিবীর সব মুসলিম রমযানের সিয়াম ফরয হওয়ার ব্যাপারে ইজমা বা ঐকমত্য পোষণ করেছেন।
কাফিরের ওপর সিয়াম ফরয নয় এবং কাফিরের সিয়াম বিশুদ্ধও হবে না। কারণ সে ইবাদত করার যোগ্য নয়। তাই যদি সে মাহে রমযানের মাঝখানে মুসলিম হয়, তাহলে বিগত দিনগুলোর সিয়াম কাযা করা তার উপর আবশ্যক নয়।
* কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿ قُل لِّلَّذِينَ كَفَرُوٓاْ إِن يَنتَهُواْ يُغۡفَرۡ لَهُم مَّا قَدۡ سَلَفَ﴾ [الانفال: ٣٨]
‘যারা কুফরী করেছে তুমি তাদেরকে বল, যদি তারা বিরত হয় তাহলে অতীতে যা হয়েছে তাদেরকে তা ক্ষমা করা হবে।’ {সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৩৮}
তবে যদি কাফির রমযানের কোনো দিনের মধ্যভাগে মুসলিম হয়, তাহলে এই দিনের বাকী সময় সিয়াম পালন করা তার জন্য আবশ্যক। কারণ বিরত থাকার সময় পাওয়ার পর থেকে বিরত থাকার বিধান মানতে সে বাধ্য।
দ্বিতীয় প্রকার: নাবালেগ শিশু।
তার ওপর সিয়াম ফরয হবে না; যতক্ষণ না সে বালেগ হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
رُفِعَ الْقَلَمُ عَنْ ثَلَاثٍ: عَنِ النَّائِمِ حَتَّى يَسْتَيْقِظَ، وَعَنِ الصَّغِيرِ حَتَّى يَكْبُرَ، وَعَنِ الْمَجْنُونِ حَتَّى يَعْقِلَ أَوْ يُفِيقَ
“তিন ব্যক্তির জন্য কলমের লিখন বন্ধ রাখা হয়েছে। (শর‘ঈ বিধানের বাধ্য-বাধকতার আওতামুক্ত রাখা হয়েছে) (১) ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষণ না জাগ্রত হবে, (২) নাবালেগ যতক্ষণ না সে বালেগ হবে এবং (৩) পাগল যতক্ষণ না তার জ্ঞান ফিরে আসবে।”
কিন্তু সালাফে সালেহীনের অনুকরণ ও অনুসরণে অভিভাবগণ নিজ নিজ নাবালেগ সন্তানকে সিয়ামের চর্চা করাবে, যাতে বালেগ হওয়ার পর ইবাদত সহজ হয়।
কারণ, সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম তাদের ছোট ছোট নাবালেগ সন্তানদের রোযা রাখাতেন এবং মসজিদে নিয়ে যেতেন এবং তাদের জন্য তুলা, পশম ইত্যাদির খেলনা বানিয়ে দিতেন। খাবার না পেয়ে কাঁদলে তারা ওই ছোট সন্তানদের খেলনা দিতেন, ওরা খেলনা পেয়ে খেলত এবং খাবারের কথা ভুলে যেত ।
আজকের দিনে অনেক অভিভাবককে এ বিষয়ে গাফেল ও উদাসীন দেখা যায়। তারা নাবালেগ শিশু-সন্তানদের সিয়াম পালনের নির্দেশ দেন না। বরং আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও তাদের প্রতি অনুচিত মায়া দেখিয়ে সিয়াম পালনে নিষেধ করেন।
অথচ বাস্তবতা হলো, ইসলামের মৌলিক নিদর্শনাবলী ও তার মূল্যবান শিক্ষার ওপর প্রশিক্ষণ দেয়াই সন্তানের প্রতি প্রকৃত ভালোবাসার দাবী। সুতরাং যে অভিভাবক নাবালেগ শিশুসন্তানদের সিয়াম পালন থেকে নিষেধ করেন অথবা এ ব্যাপারে শৈথিল্য প্রদর্শন করেন, তিনি তাদের জন্য যালেম হিসেবে বিবেচিত হবেন এবং নিজের উপরও। হ্যাঁ! যদি তারা সাওম পালন শুরু করে দেওয়ার পর তিনি দেখতে পান যে সিয়াম পালনে তাদের ক্ষতি হয়ে যাবে তখন তাদেরকে তা থেকে নিষেধ করায় কোনো অসুবিধা নেই।
উল্লেখ্য, তিনটি বিষয়ের যে কোনো একটির মাধ্যমে পুরুষ সন্তানের বালেগ তথা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া প্রমাণিত হবে:
এক: স্বপ্নদোষ বা অন্য কোনোভাবে বীর্যপাত হওয়া।
* কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿وَإِذَا بَلَغَ ٱلۡأَطۡفَٰلُ مِنكُمُ ٱلۡحُلُمَ فَلۡيَسۡتَ‍ٔۡذِنُواْ كَمَا ٱسۡتَ‍ٔۡذَنَ ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِهِمۡۚ﴾ [النور: ٥٩]
‘আর তোমাদের সন্তান-সন্ততি যখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়, তখন তারাও যেন অনুমতি প্রার্থনা করে যেমনিভাবে তাদের অগ্রজরা অনুমতি প্রার্থনা করত।’ {সূরা আন-নূর, আয়াত: ৫৯}
* অনুরূপ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
غُسْلُ يَوْمِ الجُمُعَةِ وَاجِبٌ عَلَى كُلِّ مُحْتَلِمٍ
‘প্রতিটি বালেগের জন্য জুম‘আর দিন গোসল করা ওয়াজিব।’
দুই: নাভীর নিচের পশম গজানো। এ ব্যাপারে আতিয়া আল-কুরাযী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
عُرِضْنَا عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَوْمَ قُرَيْظَةَ، فَكَانَ مَنْ أَنْبَتَ قُتِلَ، وَمَنْ لَمْ يُنْبِتْ خَلَّى سَبِيلَهُ
‘যুদ্ধের দিন আমাদের বন্দি করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে উপস্থিত করা হয়েছিল। অতঃপর যাদের নাভীর নিচে পশম গজিয়েছিল, তাদের হত্যা করা হয়েছিল। যাদের পশম গজায়নি তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছিল।’
তিন: ১৫ বছর বয়সে উপনীত হওয়া।
* এ ব্যপারে আব্দুল্লাহ ইবন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন,
عُرِضْتُ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ أُحُدٍ، وَأَنَا ابْنُ أَرْبَعَ عَشْرَةَ سَنَةً، فَلَمْ يُجِزْنِي
‘‘আমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে উহুদ যুদ্ধের দিন যুদ্ধের জন্য পেশ করা হলো। আমার বয়স তখন ১৪ বছর ছিল। তিনি তখন আমাকে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দেন নি (আমি নাবালেগ বলে আমাকে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দেন নি)’।’
ইমাম বায়হাকী ও ইবনে হিব্বান সহীহ গ্রন্থে বিশুদ্ধ সনদে বর্ধিত আকারে বর্ণনা করেন: আব্দুল্লাহ ইবন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
وَلَمْ يَرَنِي بَلَغْتُ ثُمَّ عُرِضتُ عَلَيْهِ يَوْمَ الْخَنْدَقِ وَأَنَا ابْنُ خَمْسَ عَشْرَةَ فَأَجَازَنِي
‘তিনি মনে করেন নি যে আমি বালেগ তথা প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছি। অতঃপর খন্দকের যুদ্ধের সময় আমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে যুদ্ধের জন্য পেশ করা হলো, তখন আমার বয়স ১৫ বছর। সে সময় তিনি আমাকে যু্দ্েধর অনুমতি দিলেন।’
তাছাড়া বাইহাকী ও ইবন হিব্বান এর সহীহ গ্রন্থে সহীহ সনদে আরও এসেছে, ورآني بلغتُ “আর তিনি মনে করলেন যে, আমি বালেগ হয়েছি।”
قَالَ نَافِعٌ: فَقَدِمْتُ عَلَى عُمَرَ بْنِ عَبْدِ العَزِيزِ وَهُوَ خَلِيفَةٌ، فَحَدَّثْتُهُ هَذَا الحَدِيثَ فَقَالَ: إِنَّ هَذَا لَحَدٌّ بَيْنَ الصَّغِيرِ وَالكَبِيرِ، وَكَتَبَ إِلَى عُمَّالِهِ أَنْ يَفْرِضُوا (يعني من العطاء) لِمَنْ بَلَغَ خَمْسَ عَشْرَةَ
‘নাফে‘ (রহ.) বলেন, তারপর আমি উমর ইবনে আব্দুল আযীয (খলীফাতুল মুসলিমীন)-এর কাছে গমন করে এ হাদীসটি বর্ণনা করলে তিনি বললেন, “এটিই হলো ছোট ও বড়র মধ্যে সীমারেখা।” তারপর তিনি কর্মচারীদের উদ্দেশে লিখলেন, “যারাই ১৫ বছর বয়সে উপনীত হবে তাদের জন্যই রাজকোষ থেকে ভাতা নির্ধারণ করা হবে।’
* আর মেয়েরা বালেগা (প্রাপ্ত বয়স্কা) হবে পুরুষদের বালেগ হওয়ার মতই তবে তাদের উপরোক্ত তিনটির সাথে চতুর্থ একটি আলমতও রয়েছে। আর সে চতুর্থটি হলো: হায়েয বা ঋতুবতী হওয়া।
সুতরাং যখন মেয়েদের হায়েয হয়, তখন তার ওপর শরীয়তের যাবতীয় নির্দেশ পালন করা আবশ্যক। যদিও বয়স ১০ বছর না হয়।
আর যদি কেউ রমযান মাসে দিনের বেলায় বালেগ-বালেগা হয়, তাহলে যদি সে দিন সাওম পালনরত অবস্থায় বালেগ-বালেগা হয় তাহলে সে তার সাওম পূর্ণ করবে। আর যদি সে দিন সাওম ভঙ্গকারী হিসেবে থাকে তবে দিনের বাকি সময় পানাহার থেকে বিরত থাকবে; কারণ সিয়াম পালন যাদের ওপর ওয়াজিব এক্ষনে সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে তাকে এ দিনের সাওম কাযা করতে হবে না; কারণ সাওমের জন্য পানাহার ইত্যাদি থেকে বিরত থাকার সময় (সুবহে সাদিকের সময়) যাদের উপর পানাহার ইত্যাদি থেকে বিরত থাকতে হয় সে তখন তাদের অন্তর্ভ্ক্তু ছিল না।
তৃতীয় প্রকার: পাগল তথা সুস্থজ্ঞানশূন্য ব্যক্তি
সুতরাং পাগল, অচেতন ও মাতালের ওপর সিয়াম ফরয নয়। যেমন পূর্বোক্ত হাদীস থেকে জানা গেল: রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
رُفِعَ الْقَلَمُ عَنْ ثَلَاثٍ: عَنِ النَّائِمِ حَتَّى يَسْتَيْقِظَ، وَعَنِ الصَّغِيرِ حَتَّى يَكْبُرَ، وَعَنِ الْمَجْنُونِ حَتَّى يَعْقِلَ أَوْ يُفِيقَ
‘তিন ব্যক্তির জন্য কলমের লিখন বন্ধ রাখা হয়েছে। (শর‘ঈ বিধানের বাধ্য-বাধকতার আওতামুক্ত রাখা হয়েছে) (১) ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষণ না জাগ্রত হবে, (২) নাবালেগ যতক্ষণ না সে বালেগ হবে এবং (৩) পাগল যতক্ষণ না তার জ্ঞান ফিরে আসবে।’
পাগল যদি সিয়াম পালন করে তাহলে তা সহীহ হবে না। কারণ পাগলের কাছে এমন বিবেক নেই যা দ্বারা সে ইবাদত বুঝবে ও তার নিয়ত বুঝবে। আর নিয়ত ছাড়া ইবাদত বিশুদ্ধ হয় না। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى
‘সকল আমল বা কাজে ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেক মানুষের জন্য তা-ই রয়েছে যা সে নিয়ত করল।’
যদি কখনও পাগলামী করে আবার কখনো সুস্থ হয়, তাহলে পাগলামী অবস্থা বাদে সুস্থ অবস্থায় সিয়াম পালন করা আবশ্যক। যদি দিনের মধ্য ভাগে পাগল হয়ে যায়, তাহলে তার সিয়াম বাতিল হবে না। যেমনিভাবে কেউ অসুস্থ বা অন্য কোনো কারণে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো তার সিয়াম ভঙ্গ বা বতিল হয় না। কারণ সে সিয়ামের নিয়ত করেছে সুস্থ ও জ্ঞান থাকা অবস্থায়। বাতিল বলার সপক্ষে কোনো দলীল নেই; বিশেষ করে যখন এটা জানা যাবে যে, তার পাগলামী সুনির্দিষ্ট কিছু সময় সংঘটিত হয়ে থাকে। সুতরাং তার সিয়াম বাতিল হবে না।
তাই যেদিন পাগলামী করেছে ওই দিনের সিয়াম কাযা করাও আবশ্যক নয়।
আর যদি পাগল রমযান মাসে দিনের বেলায় সুস্থ হয়, তাহলে সেদিনের বাকি অংশ তার জন্য সিয়াম পালন আবশ্যক; কারণ সে তখন যাদের উপর সিয়াম পালন করা ফরয তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে তার ওপর এ সাওমটি কাযা করা আবশ্যক নয়। যেমনটি শিশু বালেগ হলে এবং কাফের মুসলিম হলে কাযা আবশ্যক হয় না।
চতুর্থ প্রকার: স্মৃতি হারানো ও ভালো-মন্দের তারতম্য বোধশূন্য বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি।
এ ধরণের ব্যক্তিদের ‌ওপর সিয়াম পালন কিংবা মিসকীন খাওয়ানো কোনোটাই আবশ্যক নয়। কারণ ভালো-মন্দ নির্ণয় করার জ্ঞান না থাকার কারণে তিনি শরয়ী মুকাল্লাফ (বাধ্য-বাধকতা) অবস্থায় থাকেন না। এ ধরনের লোককে ভালো-মন্দ পার্থক্য করতে পারে না এমন শিশু হিসেবে গণ্য করা হবে।
যদি তাঁর কখনো পার্থক্য করার জ্ঞান থাকে আবার কখনো পার্থক্য করার জ্ঞান থাকে না এমন অবস্থা হয়, তাহলে পার্থক্য করার জ্ঞান থাকা অবস্থায় সাওম ফরয হবে। জ্ঞানশূন্য অবস্থায় ফরয হবে না। আর সালাত সিয়ামের মতোই। জ্ঞানহীন অবস্থায় সালাত পড়া আবশ্যক নয়, জ্ঞান থাকা অবস্থায় সালাত পড়া অবশ্যক।
পঞ্চম প্রকার: সাওম পালনে এমন ধারাবাহিক অক্ষম ব্যক্তি যার অক্ষমতা দূর হওয়ার সম্ভাবনা নেই:
যেমন অতিশয় বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি বা এমন রোগী যার রোগ আরোগ্য হওয়া আশা করা যায় না। এর উদাহরণ হচ্ছে, ক্যানসার বা অনুরূপ রোগ। অতএব এমন ব্যক্তির জন্য সিয়াম পালন ফরয নয়। কারণ সে এতে অক্ষম।
* আর আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :
﴿ فَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ مَا ٱسۡتَطَعۡتُمۡ ﴾ [التغابن: ١٦]
‘যতটুকু পার তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করো।’ {সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত: ১৬}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেছেন:
﴿ لَا يُكَلِّفُ ٱللَّهُ نَفۡسًا إِلَّا وُسۡعَهَاۚ ﴾ [البقرة: ٢٨٦]
‘আল্লাহ সাধ্যের বাইরে কাউকে দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না।’ {সূরা আল-বাকারাহ্‌, আয়াত: ২৮৬}
তবে ওই অক্ষম ব্যক্তির জন্য প্রতি সাওমের বদলে রোজ একজন মিসকীনকে খাওয়ানো আবশ্যক। কারণ আল্লাহ তা‘আলা সাওম ফরয হবার প্রাথমিক সময়ে খাবার খাওয়ানোকে সাওম পালনের সমান বলে গণ্য করেছিলেন, যখন এতদোভয়ের যে কোনো একটি করার অনুমতি ছিল। সুতরাং সাওম পালনে অক্ষম ব্যক্তির জন্য প্রত্যেক সাওমের বদল হিসেবে খাবার খাওয়ানো সুনির্ধারিত হয়ে গেল; কারণ খাবার খাওয়ানো সাওম পালনের বিকল্প।
আর খাবার খাওয়ানোর ব্যাপারে দু’টির যে কোনোটি গ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে,
প্রত্যেক মিসকীনকে আলাদাভাবে খাদ্য ভাগ করে দেয়া যায়। প্রত্যেকের জন্য এক মুদ্দ উন্নত গম, যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সা‘ এর চারভাগের একভাগ। আর এক মুদ্দ এর পরিমান হচ্ছে, “আধা কিলো ও ১০ গ্রাম” ভারী ভালো গম।
আবার খাবারের আয়োজন চূড়ান্ত করে সব মিসকীনকে দাওয়াত দিয়ে নির্ধারিত দিনের হিসেব অনুযায়ী খাওয়ানো যেতে পারে।
ইমাম বুখারী বলেন:
وَأَمَّا الشَّيْخُ الْكَبِيرُ إِذَا لَمْ يُطِقْ الصِّيَامَ فَقَدْ أَطْعَمَ أَنَسٌ بَعْدَ مَا كَبِرَ عَامًا أَوْ عَامَيْنِ كُلَّ يَوْمٍ مِسْكِينًا خُبْزًا وَلَحْمًا وَأَفْطَرَ
‘বয়স্ক বৃদ্ধ লোক যখন সিয়াম পালনে অক্ষম হবেন, তখন তিনি আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর পদাংক অনুসরণ করবেন। আনাস বয়স্ক হবার পর এক বছর কিংবা দু’বছর প্রত্যেক দিন একজন মিসকীনকে রুটি ও গোশত খাওয়াতেন এবং সাওম ভাঙ্গতেন। ’
ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বৃদ্ধ পুরুষ, বৃদ্ধা নারীর ব্যাপারে বলেছেন, তারা যদি সাওম পালনে অক্ষম হন, তাহলে প্রতি সাওমের স্থলে একজন মিসকীনকে খাওয়াবে।’
আমার ভাইয়েরা! শরীয়ত মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে হিকমত ও রহমতস্বরূপ। আল্লাহ এর দ্বারা বান্দাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। কারণ এ শরীয়তের মূল ভিত্তিই হচ্ছে সহজতা ও প্রজ্ঞা এবং সুচারুরূপ ও প্রজ্ঞার উপর। আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক ব্যক্তির অবস্থানুযায়ী সিয়াম ফরয করেছেন, যাতে প্রত্যেকেই নিজ নিজ কার্য আঞ্জাম দিতে পারে এবং এর দ্বারা তার অন্তরে লাভ করে প্রশান্তি এবং মনে আসে তৃপ্তি। যাতে প্রত্যেকেই রব হিসেবে আল্লাহ, দীন হিসেবে ইসলাম ও নবী হিসেবে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর সন্তুষ্ট হতে পারে।
সুতরাং হে মুমিনগণ, আপনারা আল্লাহর প্রশংসা ও শুকরিয়া আদায় করুন, এ মূল্যবান দীনের ওপর আর আপনাদের হেদায়েতের মাধ্যমে যে অফুরন্ত নেয়ামত আপনাদের দিয়েছেন তার ওপর। কারণ পৃথিবীতে বহু মানুষ পথভ্রষ্ট ও পথহারা হয়ে গেছে। আর আল্লাহর নিকট আপনারা প্রার্থনা করুন যাতে তিনি আপনাদেরকে আমৃত্যু দীনের ওপর অটল ও অবিচল রাখেন।
হে আল্লাহ! আমরা আপনার কাছে প্রার্থনা করছি; কারণ আপনিই আল্লাহ, আপনি ব্যতীত কোনো সত্য ইলাহ নেই, আপনি একক অদ্বিতীয়, অমুখাপেক্ষী, যার কোনো সন্তান নেই, যিনি কারও সন্তান নন এবং কেউ তাঁর সমকক্ষ নন, হে মহিমান্বিত, সম্মানিত ও অনুগ্রহপ্রদর্শনকারী, হে আসমান ও জমিনের সৃষ্টিকর্তা! হে চিরঞ্জীব, হে অবিনশ্বর! আমরা আপনার কাছে চাই যেন আপনি আমাদেরকে সেটার তাওফীক দিন যা আপনি আপনি পছন্দ করে এবং যাতে আপনি সন্তুষ্ট এবং আমাদের অন্তর্ভুক্ত করুন তাদের মধ্যে যারা আপনাকে রব হিসেবে, ইসলামকে দীন ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবী হিসেবে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছেন। আপনার কাছে আরও প্রার্থনা করি, আপনি আমাদের আমৃত্যু এর ওপর স্থির ও অবিচল রাখুন। আর আপনি আমাদের জীবনের সমুদয় পাপরাশি ক্ষমা করুন এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য করুণা বর্ষণ করুন। নিশ্চয় আপনি মহান দাতা।
আর সালাত ও সালাম বর্ষণ করুন আমাদের নবী মুহাম্মদ, তাঁর পরিবার, সাহাবীগণ ও কিয়ামত পর্যন্ত আগত সব অনুসারীর ওপর।
সপ্তম আসরঃসিয়ামের বিধানের দিক থেকে মানুষের প্রকারভেদের অবশিষ্ট আলোচনা
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি সকল সমকক্ষের উর্ধ্বে, সব ধরনের ত্রুটি ও বৈপরিত্ব থেকে মুক্ত, স্ত্রী ও সন্তানদের থেকে পবিত্র, দৃঢ় সপ্তক (সাত আসমান) উত্তোলনকারী, খুঁটিবিহীন ওপরে স্থাপনকারী, ভূমণ্ডলকে সমতলকারী, মজবুত পেরেকসমূহ (পর্বতমালা) দ্বারা সুস্থিরকারী, মনের গোপনীয়তা ও অন্তরের ভেদ সম্পর্কে অবগত, সঠিক-ভ্রান্ত পথিক যা হয়েছে ও হবে তার নির্ধারণকারী, তাঁর স্নেহসমুদ্রে বান্দাদের বাহনগুলো চলাচল করে এবং তাঁর ভালোবাসার ময়দানে সংসারবিরাগী বান্দাদের ঘোড়াগুলো বিচরণ করে। তিনিই তালাশকারীদের তালাশস্থল এবং পথিকদের গন্তব্যস্থল। বহনকারীরা তাঁর জন্যই বহন করে এবং প্রচেষ্টাকারীরা তাঁর জন্যই চেষ্টা করে। অন্ধকারে কালো পিঁপড়ের পদবিক্ষেপও তিনি দেখেন। গোপন চেতনা থেকে নফসে যে কুমন্ত্রণার জন্ম তিনি তারও খবর রাখেন। প্রার্থনাকারীদের প্রতি তিনি বদান্যতা দেখান এবং তাদের পাথেয় আরও বাড়িয়ে দেন। আর লক্ষ্য পানে নিষ্ঠকর্মীদের তিনি অধিক দান করেন। আমি তাঁর স্তুতি গাই সকল সংখ্যা ছাড়িয়ে এবং তাঁর নেয়ামতের উপর শুকরিয়া জানাই, আর যখনই তার শোকর আদায় করা হয় তখনই তা যায় বেড়ে।
আর আমি সাক্ষ্য প্রদান করি যে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই, তাঁর কোনো অংশীদার নেই, তিনিই মালিক ও বান্দাদের প্রতি দয়ালু, আমি আরও সাক্ষ্য দেই যে মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসূল, যিনি সব দেশের সব মানুষের জন্য প্রেরিত হয়েছেন।
আল্লাহ সালাত পাঠ করুন তাঁর ওপর, তাঁর সাথী আবূ বকরের ওপর যিনি নিজের জান, মাল যথেষ্ট পরিমাণ ব্যয় করেছেন, উমরের ওপর যিনি ইসলামের বিজয় কৃতিত্ব দেখিয়েছেন এবং চমৎকার নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছেন, উসমানের ওপর যিনি কঠোর সময়ে সৈন্যবাহিনীকে রসদ সরবরাহ করেছেন, কিয়ামতের দিন তার কতই না গৌরব হবে! অনুরূপভাবে আলীর ওপর যিনি বীরত্ব ও নির্ভীকতায় সুবিদিত, আল্লাহ আরও সালাত পেশ করুন নবীর সকল পরিবার-পরিজন, সঙ্গী-সাথী ও কিয়ামত পর্যন্ত অনাগত সব সুন্দর অনুসারীর ওপর। আর আল্লাহ তাদের উপর যথাযথ সালামও পেশ করুন।
প্রিয় ভাইয়েরা! সিয়াম পালনের হুকুম আহকামের ব্যাপারে মানুষের পাঁচটি শ্রেণীর আলোচনা পূর্বে পেশ করেছি। এ আসরে এসব প্রকারের মধ্য থেকে আরেকটি দলের আলোচনা করবো:
ষষ্ঠ প্রকার: মুসাফির ব্যক্তি যিনি সাওম ভাঙ্গার কৌশল হিসেবে সফরের সংকল্প করেন নি।
যদি মুসাফির সাওম ভাঙ্গার কৌশল হিসেবে সংকল্প সফর শুরু করে তাহলে সাওম ভাঙ্গা তার জন্য হারাম হবে। তখন সাওম পালনই তার জন্য ফরয হয়ে যাবে।
পক্ষান্তরে সে যদি সফরকে কৌশল হিসেবে গ্রহণ না করে তবে সে সাওম পালন বা সাওম ভঙ্গ করার এখতিয়ার পাবে। তার সফরের সময়সীমা দীর্ঘ হোক কিংবা সংক্ষিপ্ত। হোক তার সফর কোনো উদ্দেশ্যে আকস্মিক কিংবা ধারাবাহিক। যেমন পাইলট বা ভাড়া গাড়ির ড্রাইভার। কারণ,
* আল্লাহর বাণীতে সফরের কথা ব্যাপকার্থেই এসেছে:
﴿وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوۡ عَلَىٰ سَفَرٖ فَعِدَّةٞ مِّنۡ أَيَّامٍ أُخَرَۗ يُرِيدُ ٱللَّهُ بِكُمُ ٱلۡيُسۡرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ ٱلۡعُسۡرَ ﴾ [البقرة: ١٨٥]
‘আর তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি অসুস্থ বা মুসাফির, সে তার সিয়াম অন্য সময় আদায় করে নেবে। তোমাদের পক্ষে যা সহজ আল্লাহ তাই চান এবং তোমাদের জন্য যা কষ্টকর তা তিনি চান না।’ {সূরা আল-বাকারাহ্‌, আয়াত: ১৮৫}
* বুখারী ও মুসলিমে আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন:
كُنَّا نُسَافِرُ مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَلَمْ يَعِبِ الصَّائِمُ عَلَى المُفْطِرِ، وَلاَ المُفْطِرُ عَلَى الصَّائِمِ
“আমরা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সফর করতাম, তখন সিয়াম পালনকারী ভঙ্গকারীকে দোষ দিত না এবং সিয়াম ভঙ্গকারীও পালনকারীকে দোষারোপ করত না।’
* সহীহ মুসলিমে বর্ণিত ‘আবূ সা‘ঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
يَرَوْنَ أَنَّ مَنْ وَجَدَ قُوَّةً فَصَامَ، فَإِنَّ ذَلِكَ حَسَنٌ وَيَرَوْنَ أَنَّ مَنْ وَجَدَ ضَعْفًا، فَأَفْطَرَ فَإِنَّ ذَلِكَ حَسَنٌ
“তারা (সাহাবীগণ) মনে করতেন, যে নিজের মধ্যে শক্তি অনুভব করে ও সিয়াম পালন করে সেটা তার জন্য উত্তম। পক্ষান্তরে যে নিজের মধ্যে দুর্বলতা অনুভব করে ও সাওম ভঙ্গ করে সেটা তার জন্য উত্তম।’
* সুনানে আবূ দাউদে হামযা ইবন আমর আল-আসলামী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন:
يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنِّي صَاحِبُ ظَهْرٍ أُعَالِجُهُ أُسَافِرُ عَلَيْهِ وَأَكْرِيهِ وَإِنَّهُ رُبَّمَا صَادَفَنِي هَذَا الشَّهْرُ يَعْنِي رَمَضَانَ وَأَنَا أَجِدُ الْقُوَّةَ وَأَنَا شَابٌّ وَأَجِدُبِأَنْ أَصُومَ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَهْوَنَ عَلَيَّ مِنْ أَنْ أُؤَخِّرَهُ فَيَكُونُ دَيْنًا أَفَأَصُومُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَعْظَمُ لِأَجْرِي أَوْ أُفْطِرُ قَالَ أَيُّ ذَلِكَ شِئْتَ يَا حَمْزَةُ
“হে আল্লাহর রাসূল! আমি মালামাল বহনকারী পশুর মালিক, আমি তা সফরের জন্য পরিচর্যা করে থাকি এবং তা ভাড়া দেই। কখনো এ মাস রমযানও আমাকে সফরের মধ্যে পেয়ে বসে। আর আমি যুবক মানুষ, সাওম পালনের শক্তিও আছে। হে আল্লাহর রাসূল সাওম পালন আমার জন্য পরে পিছিয়ে রাখার চেয়ে অধিকতর সহজ। পরে সাওম পালন করলে এটা আমার কাছে ঋণের বোঝার মতো হয়ে যায়। তাহলে কি আমি বড় ধরনের সাওয়াবের আশায় সাওম পালন করবো নাকি ভেঙ্গে ফেলবো? তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে হামযা! যেটা ইচ্ছা তোমার সেটাই করতে পারো।” অর্থাৎ ইচ্ছা করলে সাওম পালন করতে পারো আবার ভাঙ্গতেও পার।
অতএব গাড়ির ড্রাইভার যিনি ভাড়ায় গাড়ী চালান এবং তাকে তা সর্বক্ষণই করতে হয়, রমযান মাসে সফর অবস্থায় তীব্র গরমের কারণে যদি তাঁর সাওম পালন করা কঠিন হয়ে পড়ে, তাহলে তিনি যখন আবহাওয়া ঠান্ডা হবে এবং তার জন্য সাওম পালন করা সহজ হবে এমন সময়ে সে সাওম (কাযা হিসেবে) পালন করতে পারবেন।
তবে মুসাফিরের জন্য সর্বোত্তম হলো সাওম পালন বা ভাঙ্গার মধ্যে যেটা তুলনামূলক সহজ হয় তাই করা।
যদি দু’টোই সমান হয় তাহলে সাওম পালনই শ্রেয়। কারণ এটা তাড়াতাড়ি জিম্মামুক্ত হতে সহায়ক এবং অন্যদের সঙ্গে হবার কারণে উৎসাহব্যঞ্জকও বটে। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমলও এমন।
* যেমন সহীহ মুসলিমে আবূ দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-
خَرَجْنَا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي شَهْرِ رَمَضَانَ فِي حَرٍّ شَدِيدٍ حَتَّى إِنْ كَانَ أَحَدُنَا لَيَضَعُ يَدَهُ عَلَى رَأْسِهِ مِنْ شِدَّةِ الْحَرِّ وَمَا فِينَا صَائِمٌ إِلَّا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَعَبْدُ اللَّهِ بْنُ رَوَاحَةَ
‘আমরা রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে রমযান মাসে প্রচণ্ড গরমের দিনে বের হলাম। এমনকি আমাদের কেউ কেউ প্রচণ্ড গরমের কারণে তার হাত মাথার ওপর রাখে। আমাদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আব্দুল্লাহ ইবন রাওয়াহা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ছাড়া আর কেউ রোযাদার ছিল না।’
আবার কখনও কখনও রাসূল সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যখন এ খবর পৌঁছল যে, সাওম হেতু সাহাবীগণের কষ্ট হচ্ছে, তখন তিনি তাঁর সাহাবীদের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য করে সাওম ভেঙ্গে ফেললেন।
* যেমন জাবের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে:
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَرَجَ إِلَى مَكَّةَ عَامَ الفَتْحِ، فَصَامَ حَتَّى بَلَغَ كُرَاعَ الغَمِيمِ، وَصَامَ النَّاسُ مَعَهُ، فَقِيلَ لَهُ: إِنَّ النَّاسَ قَدْ شَقَّ عَلَيْهِمُ الصِّيَامُ، وَإِنَّ النَّاسَ يَنْظُرُونَ فِيمَا فَعَلْتَ، فَدَعَا بِقَدَحٍ مِنْ مَاءٍ بَعْدَ العَصْرِ، فَشَرِبَ، وَالنَّاسُ يَنْظُرُونَ إِلَيْهِ
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের বছর মক্কার উদ্দেশে বের হলেন। এরপর তিনি সাওম পালন শুরু করে কুরায়ে গামীম (নামক স্থানে) পৌঁছলেন। তাঁর সঙ্গে লোকজনও সাওম রাখলেন। অতঃপর তাঁর উদ্দেশে বলা হলো, লোকজনের সাওম রাখতে কষ্ট হচ্ছে। আপনি কী করছেন তারা তা লক্ষ্য করছে। তখন তিনি বাদ আসর পানির পেয়ালা আনতে বললেন। এরপর সবাইকে দেখিয়ে তিনি পানি পান করলেন।’
* আর আবূ সা‘ঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণিত হাদীসে এসেছে,
أَنَّ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَتَى عَلَى نَهَرٍ مِنْ السَّمَاءِ وَالنَّاسُ صِيَامٌ فِي يَوْمٍ صَائِفٍ مُشَاةً وَنَبِيُّ اللَّهِ عَلَى بَغْلَةٍ لَهُ فَقَالَ اشْرَبُوا أَيُّهَا النَّاسُ قَالَ فَأَبَوْا قَالَ إِنِّي لَسْتُ مِثْلَكُمْ إِنِّي أَيْسَرُكُمْ إِنِّي رَاكِبٌ فَأَبَوْا قَالَ فَثَنَى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَخِذَهُ فَنَزَلَ فَشَرِبَ وَشَرِبَ النَّاسُ وَمَا كَانَ يُرِيدُ أَنْ يَشْرَبَ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَرواه أحمد
‘নবী সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বৃষ্টির পানিসৃষ্ট এক নালার সম্মুখে গমন করলেন। তখন লোকজন গরমের দিনে পায়ে হেঁটে সাওম পালন করছিল। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বসা ছিলেন তাঁর একটি খচ্চরের পিঠে। এমতাবস্থায় তিনি বললেন, হে লোক সকল! তোমরা পানি পান করো। তারা পান করতে ইতস্তত করতে লাগলেন। তখন তিনি বললেন, দেখ আমি তোমাদের মত নই। আমি তোমাদের চেয়ে বেশ আরামে আছি। আমি তো আরোহী (আর তোমরা পদব্রজে)। তারপরও তাদের ইতস্ততভাব কাটলো না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন নিজ উরু মোবারক সরিয়ে খচ্চরের পিঠ থেকে নেমে পড়লেন। এরপর (সবার সামনে) পানি পান করলেন। আর (তাঁর দেখাদেখি) লোকজনও পানি পান করলো। আসলে তিনি পানি পান করতে চাইছিলেন না।’
আর যখন মুসাফির ব্যক্তির জন্য সাওম পালন কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়, তখন সে সাওম ভেঙ্গে ফেলবে; সফরে সাওম পালন করবে না। যেমন,
* পূর্বোল্লিখিত জাবের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর হাদীসে উল্লেখ রয়েছে:
أَنَّ النبي صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لما افطر حين شق الصوم على الناس قيل له: أن بعض الناس قد صام، فَقَالَ أُولَئِكَ الْعُصَاةُ أُولَئِكَ الْعُصَاةُ رواه مسلم
‘নবী সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরে যখন লোকজনের রোযা রাখা কষ্টকর হলো তখন নিজে সাওম ভেঙ্গে ফেললেন। তাঁকে বলা হলো, কোনো কোনো লোক সাওম রেখেছে। তিনি বললেন, ওরাই অবাধ্য, ওরাই পাপী।’
* সহীহ বুখারী ও মুসলিমে জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে আরও বর্ণিত হয়েছে:
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي سَفَرٍ فَرَأَى زِحَامًا وَرَجُلًا قَدْ ظُلِّلَ عَلَيْهِ فَقَالَ مَا هَذَا فَقَالُوا صَائِمٌ فَقَالَ لَيْسَ مِنْ الْبِرِّ الصَّوْمُ فِي السَّفَرِ
‘নবী সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সফরে ছিলেন, তিনি একস্থানে মানুষের জটলা দেখলেন, সেখানে তারা এক লোককে ছায়া দিচ্ছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী হচ্ছে এখানে? তারা বললো, সাওম পালনকারী। উত্তরে তিনি বললেন, সফর অবস্থায় সাওম পালনে কোনো পুণ্য নেই।’
যদি সিয়াম পালনকারী দিনের মধ্যভাগে সফর করে এবং সিয়াম পূর্ণ করা তার জন্য কষ্টকর হয়, তাহলে নিজ শহর থেকে বের হবার পর তার জন্য সিয়াম ভঙ্গ করা জায়েয। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিয়াম পালন করেছেন এবং লোকেরাও তার সঙ্গে সিয়াম পালন করেছেন। অবশেষে ‘কুরা‘উল গামীম’ নামক স্থানে পৌঁছার পর তাঁর কাছে সংবাদ পৌঁছল যে, লোকদের জন্য সিয়াম পালন খুব কষ্টকর হচ্ছে। তখন তিনি সাওম ভঙ্গ করলেন এবং তাঁর দেখাদেখি অন্যরাও সিয়াম ভঙ্গ করল।’
আর কুরা‘উল গামীম হলো হাররা বা কালো পাথরগুলোর পার্শ্বস্থিত একটি কালো পাহাড়; যা মাররূয-যাহরান ও ‘উসফান নামক স্থানের মধ্যভাগে অবস্থিত ‘গামীম’ নামক উপত্যকা পর্যন্ত প্রসারিত।
আর যদি মুসাফির রমযান মাসে স্বীয় শহরে দিনের বেলায় সিয়াম পরিত্যাগ অবস্থায় আগমন করে, ওই দিন তার জন্য বাকী সময়ের সিয়াম রাখা সহীহ হবে না। কেননা সে দিনের প্রথম ভাগে সিয়াম ভঙ্গকারী ছিল। আর ফরয সিয়াম সুবহে সাদিক উদয় হওয়ার সময় থেকেই কেবল সহীহ হয়।
তবে দিনের অবশিষ্টাংশ কি তার জন্য পানাহার থেকে বিরত থাকা জরুরী?
এ ব্যাপারে উলামায়ে কেরাম একাধিক মত প্রকাশ করেছেন:
* কেউ বলেছেন, তার জন্য সময়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে দিনের অবশিষ্টাংশ পানাহার থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব। আর তাকে এর কাযাও করতে হবে ওই দিনের সাওম শুদ্ধ না হবার কারণে। এটাই ইমাম আহমাদ রহ.-এর মাযহাবের প্রসিদ্ধ মত।
* আবার কোনো কোনো আলেম বলেছেন, দিনের বাকি অংশের সাওম পালন আবশ্যক নয়; কারণ যেহেতু তাকে সাওম কাযা করতে হবে। তাই বাকি দিন সাওম পালনে কোনো ফায়দা নেই। আর রমযান মাসের মর্যাদা রক্ষার বিষয়টি তো দিনের প্রারম্ভে প্রকাশ্য বা গোপনে তার বৈধভাবে রোযা ভাঙ্গার দ্বারাই শেষ হয়ে গেছে।
* আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন:
من أكل أول النهار فليأكل آخره
‘যে রমযানের দিনের প্রথম ভাগে খেল সে যেন শেষ ভাগেও খায়।’
অর্থাৎ শরয়ী ওযরের কারণে যার জন্য দিনের প্রথম ভাগে ভক্ষণ করা বৈধ হলো, তার জন্য দিনের শেষভাগে ভক্ষণ করাও বৈধ। এটা ইমাম মালেক রহ. শাফেয়ী রহ.-এর মাযহাব এবং ইমাম আহমদ রহ.-এরও একটি রেওয়ায়েত।
তবে তার রোযা ভাঙ্গার গোপনীয়তা রক্ষার জন্য পানাহারের কথা প্রকাশ করবে না। কারণ তার সম্পর্কে এতে ধারণা খারাপ হবে কিংবা তার অনুসরণ করা হবে।
সপ্তম প্রকার: এমন রোগী যার রোগমুক্তির আশা করা যায়।
এর তিনটি অবস্থা:
প্রথমত: যদি এমন হয় যে, সাওম তার জন্য কষ্টকর নয় আবার তার ক্ষতিও করবে না, তাহলে তার জন্য সাওম ফরয হবে। কারণ তার কোনো শর‘ঈ ওযর নেই যা সাওম ভাঙ্গাকে বৈধ করবে।
দ্বিতীয়ত: যদি এমন হয় যে, সাওম তার জন্য কষ্টকর, তবে তার ক্ষতি করবে না। এমতাবস্থায় সে সাওম ভঙ্গ করবে।
* যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوۡ عَلَىٰ سَفَرٖ فَعِدَّةٞ مِّنۡ أَيَّامٍ أُخَرَۗ ﴾ [البقرة: ١٨٥]
‘যে ব্যক্তি অসুস্থ কিংবা সফর অবস্থায় থাকবে যে অন্যসময় গণনা করে সাওম পূর্ণ করে নেবে।’ {সূরা আল-বাকারাহ্‌, আয়াত: ১৮৫}
এমতাবস্থায় তার জন্য কষ্টকর হলে সাওম পালন মাকরূহ হবে। কারণ সে আল্লাহর দেওয়া সুযোগ থেকে বের হয়ে নিজেকে শাস্তি দিল।
* হাদীসে এসেছে:
إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ أَنْ تُؤْتَى رُخَصُهُ، كَمَا يَكْرَهُ أَنْ تُؤْتَى مَعْصِيَتُهُ
‘নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর দেওয়া সুযোগ গ্রহণকে ভালোবাসেন যেমনিভাবে তার নাফরমানী করাকে অপছন্দ করেন।’
তৃতীয়ত: যদি এমন হয় যে, সাওম তার ক্ষতি করবে। তাহলে তার জন্য সাওম ভাঙ্গা ওয়াজিব এবং সাওম পালন বৈধ নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَلَا تَقۡتُلُوٓاْ أَنفُسَكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ بِكُمۡ رَحِيمٗا ٢٩ ﴾ [النساء: ٢٩]
‘তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি অত্যন্ত মেহেরবান।’ [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ২৯}
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
﴿ وَلَا تُلۡقُواْ بِأَيۡدِيكُمۡ إِلَى ٱلتَّهۡلُكَةِ ﴾ [البقرة: ١٩٥]
‘তোমরা তোমাদের নিজেদের হাতকে ধ্বংসের দিকে নিক্ষেপ করো না।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৯৫}
* অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
إِنَّ لِنَفْسِكَ عَلَيْكَ حَقًّا
‘নিশ্চয় তোমার নিজের ওপর নিজের কিছু হক রয়েছে।’
আর আত্মার হক হলো, আল্লাহ ছাড় দেয়া সত্ত্বেও সাওম পালন করে নিজ আত্মার ক্ষতি না করা।
* কেননা আরেক হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
لاَضَرَرَ وَلاَ ضِرَارَ
‘নিজের ও অন্যের ক্ষতি করা যাবে না।’
ইমাম নাওয়াওয়ী বলেন, হাদীসটির বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে যেগুলো পরস্পরকে শক্তিশালী করেছে।
রমযান মাসে সাওম পালনকালে যদি তার অসুস্থতা দেখা দেয় আর সাওম পূর্ণ করা তার জন্য কষ্টকর হয়, তাহলে তার জন্য বৈধ কারণ থাকায় তার সাওম ভঙ্গ করা জায়েয।
পক্ষান্তরে রোযা ভঙ্গকারী অসুস্থ ব্যক্তি যদি রমযানে দিনের বেলা সুস্থ হয় তাহলে সেদিনের সাওম তার জন্য সহীহ হবে না। কারণ দিনের শুরুতেই সে সাওম ভঙ্গ করেছে। আর সাওম পালন সুবহে সাদিকের সময় থেকে করা ব্যতীত সহীহ হয় না।
কিন্তু ঐ দিনের বাকী অংশ কি তার সাওম পালন করতে হবে?
এ সম্পর্কে উলামায়ে কেরামের মতবিরোধ রয়েছে, যা ইতোপূর্বে মুসাফির কর্তৃক সফর অবস্থায় নিজে দেশে সাওম ভঙ্গ করা অবস্থায় ফেরা সম্পর্কিত আলোচনায় গত হয়েছে।
যদি চিকিৎসা দ্বারা সাব্যস্ত হয় যে, সাওম রোগ বৃদ্ধি করবে, তাহলে রোগ থেকে বাঁচার জন্য শারীরিক সুস্থতার দিকে লক্ষ্য রেখে সাওম ভাঙ্গা জায়েয।
যদি এ ঝুঁকি দূর হয়ে যাওয়ার আশা করা যায় তাহলে দূর হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। তারপর যেসব সাওম ভেঙ্গেছে তা কাযা করে নেবে। আর যদি তার রোগমুক্তির আশা করা না যায়, তাহলে তার হুকুম হবে পঞ্চম প্রকারের হুকুম; সাওম ভাঙ্গবে এবং প্রত্যেক দিনের পরিবর্তে একজন করে মিসকীন খাওয়াবে।
হে আল্লাহ! আমাদের এমন আমল করার তাওফীক দিন যা আপনাকে সন্তুষ্ট করে। আর আমাদেরকে আপনার অসন্তুষ্টি ও নাফরমানির কারণ থেকে দূরে রাখুন। আর আপনার বিশেষ অনুগ্রহে আমাদেরকে, আমাদের পিতা-মাতাকে এবং সকল মুসলিমকে ক্ষমা করে দিন। আর সালাত ও সালাম বর্ষণ করুন আমাদের নবী মুহাম্মদ, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীর ওপর।
অষ্টম আসরঃসিয়াম পালন এবং এর কাযার বিধানের দিক থেকে মানুষের প্রকারভেদের অবশিষ্ট আলোচনা
যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি অনন্য, মহান, প্রবল, ক্ষমতাবান, শক্তিশালী, মহাপ্রতাপশালী; কল্পনা ও দৃষ্টিশক্তির মাধ্যমে আয়ত্ব করার উর্ধ্বে; প্রত্যেক সৃষ্টিকে তিনি মুখাপেক্ষিতার বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত করেছেন; আপন শক্তিমত্তা প্রকাশ করেছেন দিবারাত্রির আবর্তনের মধ্য দিয়ে; দুরারোগ্য রোগীর ক্রন্দন শোনেন, যে নিজ অসুবিধার অনুযোগ-অভিযোগ করে; গুহাভ্যন্তরে আঁধার রাতে কৃষ্ণকায় পিঁপড়ের পদচিহ্ন তিনি দেখেন; অন্তরের অব্যক্ত এবং মনের লুকানো বিষয়ও তিনি জানেন; তাঁর গুণাবলিও তাঁর সত্তার মতোই (যেমনিভাবে তাঁর সত্তার প্রকৃত ধরণ কেউ জানে না তেমনিভাবে তাঁর গুণাগুণের প্রকৃত রূপ কেউ জানে না), যারা তার সাদৃশ্য নির্ধারণ করে (মুশাব্বিহা) তারা কাফের; কুরআন ও সুন্নায় তিনি নিজেকে যেসব গুণে গুণান্বিত করেছেন আমরা তা স্বীকার করি:
﴿أَفَمَنۡ أَسَّسَ بُنۡيَٰنَهُۥ عَلَىٰ تَقۡوَىٰ مِنَ ٱللَّهِ وَرِضۡوَٰنٍ خَيۡرٌ أَم مَّنۡ أَسَّسَ بُنۡيَٰنَهُۥ عَلَىٰ شَفَا جُرُفٍ هَارٖ ﴾ [التوبة: ١٠٩]
‘যে তার গৃহের ভিত্তি আল্লাহর তাকওয়া ও সন্তুষ্টির উপর প্রতিষ্ঠা করল সে কি উত্তম নাকি ঐ ব্যক্তি যে তার গৃহের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছে এক গর্তের পতনোন্মুখ কিনারায়?’ {সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ১০৯} আমি পবিত্র ও মহান সে সত্তার প্রশংসা করি, আনন্দ ও বেদনা সর্বাবস্থায়।
আর আমি সাক্ষ্য প্রদান করি যে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই, তাঁর কোনো অংশীদার নেই, সৃষ্টি ও পরিচালনায় তিনি এক-অদ্বিতীয়:
﴿ وَرَبُّكَ يَخۡلُقُ مَا يَشَآءُ وَيَخۡتَارُۗ ﴾ [القصص: ٦٨]
‘আর আপনার রব যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং মনোনীত করেন।’ {সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৬৮} আমি আরও সাক্ষ্য দেই যে মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসূল, যিনি শ্রেষ্ঠতম পুণ্যাত্মা নবী।
আল্লাহ সালাত তথা উত্তম প্রশংসা বর্ষণ করুন তাঁর ওপর, তাঁর হেরা গুহার সাথী আবূ বকরের ওপর, কাফেরদের মূলোৎপানকারী উমরের ওপর, স্বগৃহদ্বারে শহীদ উসমানের ওপর, শেষ রাতে সালাত আদায়কারী আলীর ওপর এবং তার সকল পরিবারবর্গ, সকল সাহাবী মুহাজির ও আনসারীগণের ওপর। আর আল্লাহ তাদের উপর যথাযথ সালাম পেশ করুন।
আমার ভাইয়েরা! ইতোপূর্বে সিয়াম পালনের ক্ষেত্রে সাত প্রকার মানুষের কথা আলোচনা করেছি। আর এই হলো অবশিষ্ট প্রকারের মানুষের আলোচনা।
অষ্টম প্রকার: ঋতুবতী মহিলা।
সুতরাং ঋতুবতী মহিলার জন্য সিয়াম পালন করা হারাম; তার দ্বারা সিয়াম পালন সহীহ হবে না।
* কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
مَا رَأَيْتُ مِنْ نَاقِصَاتِ عَقْلٍ وَدِينٍ أَذْهَبَ لِلُبِّ الرَّجُلِ الحَازِمِ مِنْ إِحْدَاكُنَّ، قُلْنَ: وَمَا نُقْصَانُ دِينِنَا وَعَقْلِنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: أَلَيْسَ شَهَادَةُ المَرْأَةِ مِثْلَ نِصْفِ شَهَادَةِ الرَّجُلِقُلْنَ: بَلَى، قَالَ: فَذَلِكِ مِنْ نُقْصَانِ عَقْلِهَا، أَلَيْسَ إِذَا حَاضَتْ لَمْ تُصَلِّ وَلَمْ تَصُمْقُلْنَ: بَلَى، قَالَ: فَذَلِكِ مِنْ نُقْصَانِ دِينِهَا
‘তোমাদের মতো দীন ও জ্ঞানগত অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও আর কাউকে বিচক্ষণ লোকের বুদ্ধি হরণে এমন পারঙ্গম দেখিনি। তারা প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের দীন ও জ্ঞানগত অসম্পূর্ণতা কী? তিনি বললেন, নারীর সাক্ষ্য কি পুরুষের সাক্ষ্যের অর্ধেক নয়? তারা বলল, নিশ্চয়। তিনি বললেন, এটাই হলো তোমাদের জ্ঞানগত কমতি। আর ঋতু অবস্থায় তার সালাত ও সিয়াম পালন করতে হয় না, এমন নয় কি? তারা বলল হ্যাঁ, তিনি বললেন, এটাই হলো দীনী কমতি।’
হায়েয হলো: প্রকৃতিগত রক্তক্ষরণ নির্দিষ্ট কয়েক দিনের জন্য যা নারীদের নিয়মিত হয়ে থাকে।
সিয়াম পালনকারী নারীর যদি সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পূর্বেও ঋতুস্রাব দেখা দেয়, তাহলে তার ওই দিনের সিয়াম বাতিল হয়ে যাবে। তবে তা কাযা করতে হবে। তবে নফল সিয়াম হলে এর কাযা করাও নফল হবে।
আর যদি কোনো নারী রমযানের দিনের মধ্যভাগে ঋতুস্রাব থেকে পবিত্র হয়, তবে দিনের শুরুতে সিয়াম পালনের প্রতিবন্ধকতা থাকার কারণে ওই দিনের বাকী অংশেও সিয়াম পালন সহীহ হবে না।
প্রশ্ন হলো, দিনের অবশিষ্টাংশ সে পানাহার থেকে বিরত থাকবে কি না?
এ ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। মুসাফিরের সিয়াম সম্পর্কিত মাসআলায় এ বিষয়টি আলোচিত হয়েছে।
আর যদি রমযানের রাতে সুবহে সাদিক উদয়ের সামান্য পূর্বেও কোনো নারী ঋতুস্রাব থেকে পবিত্র হয়, তবে তার ওপর সিয়াম পালন আবশ্যক। কেননা সে সিয়াম পালনে সক্ষমদের অন্তর্ভুক্ত, সিয়াম পালনে তার তো এখন কোনো বাধা নেই। তাই তার ওপর সিয়াম পালন ওয়াজিব। যদি সে সুবহে সাদিকের পর গোসল করে তবুও সিয়াম শুদ্ধ হবে। যেমন অপবিত্র ব্যক্তি সুবহে সাদিক উদয় হওয়ার পর গোসল করলেও তার সিয়াম শুদ্ধ হবে।
* কারণ, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
إِنْ كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيُصْبِحُ جُنُبًا مِنْ جِمَاعٍ، غَيْرِ احْتِلَامٍ فِي رَمَضَانَ، ثُمَّ يَصُومُ
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বপ্নদোষ ছাড়া সহবাসজনিত নাপাক অবস্থায় সুবহে সাদিকের পর পবিত্রতা অর্জন করতেন এবং রমযানের সিয়াম পালন করতেন।’
আর নিফাসওয়ালী মহিলাদের বিধান পূর্বোক্ত হায়েযওয়ালী মহিলাদের বিধানের মতোই।
হায়েয ও নিফাস অবস্থায় নারীর যে কয়দিন সিয়াম বাদ পড়বে, সে দিনগুলোর কাযা তার ওপর ওয়াজিব।
* কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿ فَعِدَّةٞ مِّنۡ أَيَّامٍ أُخَرَۚ ﴾ [البقرة: ١٨٤]
‘তবে অন্য দিনে এগুলো গণনা (কাযা) করে নেবে।’ {সূরা আল-বাকারাহ্‌, আয়াত: ১৮৪}
* অনুরূপ আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল:
مَا بَالُ الْحَائِضِ تَقْضِي الصَّوْمَ، وَلَا تَقْضِي الصَّلَاةَ. فَقَالَتْ: أَحَرُورِيَّةٌ أَنْتِ؟ قُلْتُ: لَسْتُ بِحَرُورِيَّةٍ، وَلَكِنِّي أَسْأَلُ. قَالَتْ: كَانَ يُصِيبُنَا ذَلِكَ، فَنُؤْمَرُ بِقَضَاءِ الصَّوْمِ، وَلَا نُؤْمَرُ بِقَضَاءِ الصَّلَاةِ
‘ঋতুবতীর কী হলো যে, সে সিয়াম কাযা করে অথচ সালাত কাযা করে না? উত্তরে তিনি বললেন, তুমি কি হারূরী? (অর্থাৎ খারেজি সম্প্রদায়ভুক্ত?) সে বলল, আমি হারূরী নই, বরং জানার জন্য জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বললেন, আমাদেরও এ অবস্থা হয়েছিল। তখন আমরা সিয়াম কাযা করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি। সালাতের জন্য নয়।’
নবম প্রকার: যে দুবতী কিংবা গর্ভবতী নারী সাওম পালনের কারণে নিজের বা সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন
এমতাবস্থায় তিনি সিয়াম পালন করবেন না; সাওম ভঙ্গ করবেন।
* কারণ, আনাস ইবন মালেক আল-কা‘বী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ وَضَعَ عَنِ الْمُسَافِرِ شَطْرَ الصَّلَاةِ، وَعَنِ الْمُسَافِرِ وَالْحَامِلِ وَالْمُرْضِعِ الصَّوْمَ، أَوِ الصِّيَامَ
‘আল্লাহ তা‘আলা মুসাফিরদের সালাত অর্ধেক করেছেন। আর গর্ভবতী, স্তন্যদানকারিনী ও মুসাফির থেকে সিয়াম শিথিল করেছেন।’
যে কদিন তারা সিয়াম ত্যাগ করেছেন শুধুমাত্র ওই সিয়ামগুলো কাযা করা আবশ্যক। যখন তাদের জন্য কাযা করা সহজ হয় এবং শঙ্কা দূর হয়ে যায় তখনই তা কাযা করবে। যেমন অসুস্থ ব্যক্তি যখন সুস্থ হবে তখনই কেবল তার কাযা করবে।
দশম প্রকার: অন্যের অত্যাবশ্যক প্রয়োজন পূরণের নিমিত্তে যার সাওম ভাঙ্গা প্রয়োজন।
যেমন: কোনো নিরপরাধ মানুষকে ডুবে যাওয়া কিংবা আগুনে পোড়া অথবা ধসে পড়া ইত্যাদি থেকে বাঁচানো।
অতএব যদি খাবার ও পানীয় পান না করে তাকে বাঁচানো সম্ভব না হয় তাহলে তার জন্য সাওম ভাঙ্গা জায়েয হবে। বরং তখন সাওম ভাঙ্গা ওয়াজিব হবে। কারণ নিরপরাধ মানুষকে ধ্বংস থেকে বাঁচানো ওয়াজিব। আর “যা ব্যতিরেকে ওয়াজিব সম্পন্ন করা যায় না, তাও ওয়াজিব।” তবে পরবর্তীতে ভাঙ্গা সাওমগুলো কাযা করা তার উপর আবশ্যক।
আর তার উদাহরণ ঐ ব্যক্তির ন্যায়, যে আল্লাহর পথে জিহাদে শত্রু নিধনের লক্ষ্যে শক্তি অর্জনের জন্য সিয়াম ভঙ্গ করে। সে সিয়াম ভঙ্গ করবে এবং পরে তার কাযা করবে। চাই সে জিহাদের সফরে হোক কিংবা নিজ শহরে, শত্রু যদি সামনে এসে যায়, সর্বাবস্থায় সাওম ভঙ্গ করে শক্তি সঞ্চয় করার বৈধতার মধ্যে কোনো হেরফের নেই। কেননা এ সময় সিয়াম ভঙ্গ করা মুসলিমদের থেকে প্রতিরোধ ও মহান আল্লাহর কালেমা উঁচু করার জন্য।
* সহীহ মুসলিমে আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,
سَافَرْنَا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى مَكَّةَ وَنَحْنُ صِيَامٌ قَالَ فَنَزَلْنَا مَنْزِلًا فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّكُمْ قَدْ دَنَوْتُمْ مِنْ عَدُوِّكُمْ وَالْفِطْرُ أَقْوَى لَكُمْ فَكَانَتْ رُخْصَةً فَمِنَّا مَنْ صَامَ وَمِنَّا مَنْ أَفْطَرَ ثُمَّ نَزَلْنَا مَنْزِلًا آخَرَ فَقَالَ إِنَّكُمْ مُصَبِّحُو عَدُوِّكُمْ وَالْفِطْرُ أَقْوَى لَكُمْ فَأَفْطِرُوا وَكَانَتْ عَزْمَةً فَأَفْطَرْنَا
‘আমরা রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে মক্কায় সফরে বের হলাম, তখন আমরা সাওম পালনকারী ছিলাম। এরপর আমরা একটি স্থানে অবতরণ করলাম। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা তোমাদের শত্রু পক্ষের নিকটবর্তী হয়ে গেছ। আর সাওম ভেঙ্গে ফেলে তোমাদের জন্য শক্তি সঞ্চয়ে সহায়ক হবে। ফলে সাওম ভাঙ্গা বৈধ ছিল। এরপর আমাদের মধ্যে কেউ কেউ সাওম রাখলো আর কেউ কেউ ভেঙ্গে ফেলল। তারপর আমরা আরেকটি স্থানে নামলাম তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা খুব শীঘ্রই শত্রুপক্ষের মোকাবেলা করবে। আর সাওম ভেঙ্গে ফেলা শক্তি সঞ্চয়ের জন্য অধিক সহায়ক হবে। সুতরাং তোমরা সবাই সাওম ভেঙ্গে ফেল। আর এটা বাধ্যকারী নির্দেশ ছিল, তাই আমরা সবাই সাওম ভেঙ্গে ফেলেছিলাম।’
এ হাদীস থেকে বোঝা যায়, সফর ছাড়াও যুদ্ধের জন্য শক্তি সঞ্চয় করা একটি কারণ; যার নিমিত্তে সিয়াম ভঙ্গ করা জায়েয। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য শক্তি সঞ্চয় করাকে সিয়াম ভেঙ্গে ফেলার জন্য স্বতন্ত্র একটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সফর স্বতন্ত্র আরেকটি কারণ। এ জন্য তিনি প্রথম স্থানে সিয়াম ভঙ্গের নির্দেশ দেন নি।
উল্লেখিত কারণসমূহে যাদের সিয়াম ভঙ্গ করা বৈধ, তাদের সিয়াম ভঙ্গের বিষয়টি প্রকাশ করায় কোনো বাধা নেই। যদি তার স্পষ্ট কারণ থাকে। যেমন অসুস্থ বা বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি যিনি সিয়ামে অক্ষম।
পক্ষান্তরে যদি সিয়াম ভঙ্গের কারণ অপ্রকাশ্য বা অস্পষ্ট হয়, যেমন ঋতুবতী মহিলা এবং ওই ব্যক্তি যে কোনো বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে রক্ষা করতে গিয়ে সিয়াম ভঙ্গ করেছে- সে আড়ালে পানাহার করবে। যাতে তার প্রতি কোনো অপবাদ না আসে কিংবা কোনো অবুঝ ধোঁকায় পড়ে এ ধারণা না করে যে কোনো কারণ ছাড়াই সিয়াম ভঙ্গ করা বৈধ।
আর উপরোক্ত প্রকারসমূহের মধ্য থেকে যার সাওম কাযা করা আবশ্যক, সে যে কদিন সাওম ভাঙ্গবে হিসেব করে তার সাওম কাযা করে নেবে।
* কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :
﴿ فَعِدَّةٞ مِّنۡ أَيَّامٍ أُخَرَۚ ﴾ [البقرة: ١٨٤]
‘তাহলে অন্যান্য দিনে সংখ্যা পূরণ করে নেবে।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৪}
* হ্যাঁ, যে ব্যক্তি পুরো মাসই সাওম ভাঙ্গে তার জন্য পুরো মাসের সবকটা সাওমই রাখতে হবে। যদি ৩০ দিনে মাস হয় তাহলে ৩০টা সাওম রাখবে এবং ২৯ দিনে মাস হলে ২৯টা সাওম রাখবে।
আর উত্তম হলো, উযর শেষ হওয়ামাত্র দ্রুততম সময়ে তার সাওমগুলো কাযা করে নেওয়া। কেননা এতে দ্রুত কল্যাণের দিকে যাওয়া যায় ও যিম্মাদারী থেকে তাড়াতাড়ি মুক্ত হওয়া যায়।
তবে ছুটে যাওয়া সিয়াম জরুরী উযরসাপেক্ষে পরবর্তী রমযান পর্যন্ত বিলম্ব করাও বৈধ। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿فَعِدَّةٞ مِّنۡ أَيَّامٍ أُخَرَۗ يُرِيدُ ٱللَّهُ بِكُمُ ٱلۡيُسۡرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ ٱلۡعُسۡرَ ﴾ [البقرة: ١٨٥]
‘তবে সে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আল্লাহ তোমাদের সহজ চান এবং কঠিন চান না।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৫}
সিয়াম কাযার ক্ষেত্রে বিলম্বের বৈধতাই হলো চরম সহজীকরণ। তাই যদি কারও ওপর রমযানের ১০ দিনের সিয়ামের কাযা ফরয হয় তাহলে পরবর্তী রমযান আসার ১০ দিন পূর্ব পর্যন্ত বিলম্ব করা তার জন্য জায়েয।
তবে কোনো উযর ছাড়াই দ্বিতীয় রমযান পর্যন্ত বিলম্ব বৈধ নয়।
* কারণ, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন:
كَانَ يَكُونُ عَلَيَّ الصَّوْمُ مِنْ رَمَضَانَ، فَمَا أَسْتَطِيعُ أَنْ أَقْضِيَهُ إِلَّا فِي شَعْبَانَ
‘আমার ওপর রমযানের সিয়াম কাযা হয়ে যেতো; কিন্তু আমি শাবান মাস আসার আগ পর্যন্ত কাযা করতে সক্ষম হতাম না।’
* তাছাড়া দ্বিতীয় রমযান পর্যন্ত বিলম্ব করলে তার দায়িত্বে অনেক সাওম জমা হয়ে যাবে। ফলে কখনো সে তা পালনে অপারগ কিংবা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারে। আর সাওম যেহেতু এমন ইবাদত যা বারবার আসে তাই প্রথমটিকে বিলম্ব করে দ্বিতীয়টির সময় পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয়া জায়েয নয়, যেমন সালাত।
আর যদি কারও ওযর মৃত্যু পর্যন্ত বহাল থাকে এবং সে সিয়াম কাযা করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তার ওপর কিছুই আবশ্যক হবে না। কেননা আল্লাহ তা‘আলা অন্য সময়ে কাযা করাকে আবশ্যক করেছেন যা তার পক্ষে সম্ভব হয় নি। তাই তার থেকে সিয়াম ওই ব্যক্তির মত রহিত হয়ে যাবে যে রমযান মাস আগমনের পূর্বেই মারা গেছে ফলে তার ওপর সিয়াম আবশ্যক হয় নি।
তবে সে যদি কাযা করতে সক্ষম হয় কিন্তু অলসতা হেতু কাযা না করে মারা যায়, তাহলে যে সকল সিয়ামের কাযা করা মৃত ব্যক্তির সুযোগ ছিল তার উত্তরাধিকারীগণ সে সকল সিয়ামের কাযা করবে।
* কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
مَنْ مَاتَ وَعَلَيْهِ صِيَامٌ صَامَ عَنْهُ وَلِيُّهُ
‘যে ব্যক্তি সিয়াম আদায় না করে মারা যাবে তার অলী তথা উত্তরাধিকারীগণ তার পক্ষ থেকে সিয়াম আদায় করে নেবে।’
অলী হলো, তার ওয়ারিশগণ অথবা নিকটবর্তী আত্মীয়বর্গ। আর তাই দিন অনুপাতে (তার অলী বা আত্মীয়বর্গের মধ্য থেকে) একদল লোক একই দিন তার পক্ষ থেকে সিয়াম আদায় করে, তবে তাও বৈধ হবে।
* ইমাম বুখারী রহ. বলেন,
قَالَ الْحَسَنُ إِنْ صَامَ عَنْهُ ثَلَاثُونَ رَجُلًا يَوْمًا وَاحِدًا جَازَ
‘হাসান বছরী রহ. বলেছেন, যদি তার পক্ষে থেকে ৩০ জন লোক একদিনেই সিয়াম পালন করে তাহলে তা জায়েয হবে।’
যদি তার কোন অলী বা অভিভাবক না থাকে কিংবা অভিভাবক থাকে কিন্তু তারা তার পক্ষ থেকে সাওম রাখতে চায় না, তাহলে ওই ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে কাযা করা সম্ভব ছিল এমন দিনগুলোর সংখ্যা হিসেব করে প্রত্যেক দিনের জন্য একজন মিসকীনকে খাওয়াতে হবে। প্রত্যেক মিসকীনকে এক মুদ ভালো গম দেবে, যার ওজন বর্তমানে ‘আধা কিলো ও ১০ গ্রাম।’
প্রিয় ভাইয়েরা! এই হলো সিয়ামের বিধানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ। আল্লাহ তা‘আলা স্থান ও অবস্থানুযায়ী প্রত্যেক প্রকারের মানুষের সাওমের বিধান কী হবে তা বলে দিয়েছেন। অতএব এ শরীয়তে আপনাদের প্রতিপালকের হিকমত ও প্রজ্ঞা-রহস্য জেনে নিন। আল্লাহ তাঁর শরীয়তকে সহজ করার মাধ্যমে যে নেয়ামত দিয়েছেন তার শুকরিয়া আদায় করুন এবং তাঁর কাছে আমরণ এ দীনের ওপর অটল থাকার তাওফীক প্রার্থনা করুন।
হে আল্লাহ! আমাদের যাবতীয় পাপ, যা আমাদের ও আপনার যিকরের মাঝে অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল তা মোচন করুন, আর আপনার আনুগত্য ও শুকরিয়ায় আমাদের ঘাটতি মার্জনা করুন, আপনার পথে অবিরাম অবিচল রাখুন এবং আমাদের সে নূর দান করুন যা দিয়ে আমরা আপনার পথ খুঁজে পাব।
হে আল্লাহ! আপনার মুনাজাতের স্বাদ আমাদের আস্বাদন করান আর আমাদের পরিচালিত করুন আপনাকে সন্তুষ্টকারীদের পথে। হে আল্লাহ! নিজেদের অধঃগমন থেকে আমাদের রক্ষা করুন, নিজেদের অলসতা থেকে জাগিয়ে দিন, আমাদের কল্যাণের পথের সন্ধান দিন এবং আপন কৃপায় আমাদের পথচলাকে সুন্দর করুন।
হে আল্লাহ! আমাদের শামিল করুন আপনি মুত্তাকীদের কাতারে আর অন্তর্ভুক্ত করুন আপনার নেককার বান্দাদের দলে।
আর আল্লাহ দরূদ ও সালাম বর্ষণ করুন আমাদের নবী মুহাম্মদ, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীর ওপর। আমীন।
নবম আসরঃসিয়াম পালনের হিকমত বা তাৎপর্যসমূহ
যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি রাত ও দিনের বিবর্তন ঘটান, মাস ও বছরের আবর্তন ঘটান; যিনি বাদশা, মহাপবিত্র, ত্রুটিমুক্ত; বড়ত্ব, স্থায়ীত্ব ও অমরত্বে অনন্য; যাবতীয় ত্রুটি-বিচ্যুতি ও মানবিক তুলনা থেকে পবিত্র; শিরার ভেতরস্থ ও অস্থির অভ্যন্তরস্থ জিনিসও দেখেন; ক্ষীণস্বর ও সূক্ষ্ম বিষয়াদিও শোনেন; অধিক দাতা দয়ালু ইলাহ্‌, ক্ষমতাবান ও কঠিন প্রতিশোধ গ্রহণকারী রব; তিনি সকল বিষয় নির্ধারণ করেন অতঃপর তাকে সর্বোত্তম নিয়মে পরিচালনা করেন; তিনি শরীয়তের বিধানাবলি প্রবর্তন করেছেন অতঃপর তাকে সুপ্রষ্ঠিত ও নিখুঁত করেছেন; তাঁর ক্ষমতায় বাতাস প্রবাহিত হয় এবং মেঘমালা পরিভ্রমণ করে; তারই দয়া ও প্রজ্ঞানুসারে দিন ও রাতের আবর্তন ঘটে। আমি গুণকীর্তন করি তাঁর মহান গুণাবলির ও চমৎকার নেয়ামতরাজির ওপর, আর শুকরিয়া আদায় করি অধিক নেয়ামত প্রার্থনাকারী ও তা লাভ করার ইচ্ছাপোষণকারী ব্যক্তির শুকরিয়া।
আর আমি সাক্ষ্য প্রদান করি যে একমাত্র আল্লাহ্‌ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই; তাঁকে জ্ঞান বা কল্পনায় বেষ্টন করা সম্ভব নয়। আমি আরও সাক্ষ্য দেই যে মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসূল, যিনি শ্রেষ্ঠতম মানব।
আল্লাহ সালাত ও সালাম বর্ষণ করুন তাঁর ওপর, তাঁর সাথী আবূ বকরের ওপর যিনি ইসলাম গ্রহণে ছিলেন অগ্রগামী, উমরের ওপর যাকে দেখে শয়তান পলায়ন করত, উসমানের ওপর যিনি কঠিন যুদ্ধে (তাবুকের যুদ্ধে) রসদ সরবরাহ করেছেন, আলীর ওপর যিনি বিশাল সাগর ও দুর্বার সিংহের মতো এবং তাঁর সকল পরিবারসদস্য, সাহাবী ও অনাগতকালের সুন্দর আনুসারীদের ওপর।
আল্লাহর বান্দাগণ! জেনে রাখুন নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহ যা সৃজন করেছেন আর যে বিধান প্রবর্তন করেছেন সব কিছুতেই তাঁর পরিপূর্ণ হুকুম ও হিকমত বিদ্যমান। তিনি সৃজন ও বিধান প্রবর্তনে প্রজ্ঞাময়। তিনি তার বান্দাদের খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করেন নি, তিনি তাদের অনর্থক ছেড়ে দেন নি এবং শরীয়তকে বেহুদা প্রবর্তন করেন নি। বরং আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে বিরাট কর্মযজ্ঞ আঞ্জাম দেবার নিমিত্তে সৃষ্টি করেছেন। তাদেরকে বড় ধরনের কিছু করার জন্য প্রস্তুত করেছেন। তাদের জন্য সুস্পষ্টভাবে সরল-সঠিক পথ বাৎলে দিয়েছেন। আর তাদের জন্য শরীয়ত প্রবর্তন করেছেন, যার মাধ্যমে তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তাদের ইবাদত পূর্ণতা লাভ করে। বান্দাদের জন্য প্রবর্তিত এমন কোনো ইবাদত নেই যার পেছনে পরিপূর্ণ হিকমত নেই। যারা এ হিকমত জানার প্রচেষ্টা করেছে তারা তা জেনেছে আর যারা অজ্ঞ থাকার ইচ্ছা করেছে তারা অজ্ঞ থেকেছে। আমাদের কোনো ইবাদতের হিকমত না জানা তার হিকমত না থাকার প্রমাণ নয়। বরং তা আল্লাহর হিকমতজ্ঞান সম্পর্কে আমাদের ব্যর্থতা ও অক্ষমতার দলীল। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা বলেছেন:
﴿ وَمَآ أُوتِيتُم مِّنَ ٱلۡعِلۡمِ إِلَّا قَلِيلٗا ٨٥ ﴾ [الاسراء: ٨٥]
‘তোমাদেরকে ইলমের সামান্য কিছু দেয়া হয়েছে।’ {সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত: ৮৫}
আল্লাহ তা‘আলা ইবাদতসমূহ প্রবর্তন করেছেন আর লেনদেন ব্যবস্থাপনা চালু করেছেন তাঁর বান্দাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার অভিপ্রায়ে। যাতে পরিষ্কার হয়ে যায় কে আসল রবের দাসত্ব করে আর কে প্রবৃত্তির।
অতএব যে ব্যক্তি এই শরীয়ত ও বিধিবিধানকে প্রশস্ত বক্ষে ও প্রশান্ত মনে গ্রহণ করেছে সেই তো আসল প্রভুর গোলাম। সে তাঁর শরীয়তে সন্তুষ্ট আর নিজ রবের আনুগত্যকে সে প্রাধান্য দেয় আপন প্রবৃত্তির ওপর।
আর যে নিজ আগ্রহ ও অভিরুচির বাইরে কোনো ইবাদত গ্রহণ করে না এবং আল্লাহ প্রদত্ত বিধান বা রীতিনীতির অনুসরণ করে না, সে হলো প্রবৃত্তির গোলাম। সে আল্লাহর শরীয়তে অসন্তুষ্ট এবং তার রবের আনুগত্যবিমুখ। সে তার প্রবৃত্তির আনুগত হয়েছে তাকে বানায়নি অনুগত। সে চায় আল্লাহর শরীয়ত তার রুচির অনুকূল হবে, অথচ তার জ্ঞান কতই না অপূর্ণ এবং তার প্রজ্ঞা কতই না স্বল্প। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :
﴿وَلَوِ ٱتَّبَعَ ٱلۡحَقُّ أَهۡوَآءَهُمۡ لَفَسَدَتِ ٱلسَّمَٰوَٰتُ وَٱلۡأَرۡضُ وَمَن فِيهِنَّۚ بَلۡ أَتَيۡنَٰهُم بِذِكۡرِهِمۡ فَهُمۡ عَن ذِكۡرِهِم مُّعۡرِضُونَ ٧١﴾ [المؤمنون: ٧١]
‘আর যদি হক তাদের প্রবৃত্তিকে অনুসরণ করতো তাহলে অবশ্যই বিশাল আকাশ ও যমীন ও এর মধ্যবর্তী সবকিছুই বিশৃঙ্খল হয়ে যেত। বরং আমরা তাদের কাছে তাদের উপদেশ নিয়ে এসেছি, কিন্তু তারা উপদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।’ {সূরা আল-মু’মিনূন, আয়াত: ৭১}
আর আল্লাহর হিকমত হলো, তিনি ইবাদতকে বিভিন্ন ধরনের বানিয়েছেন যাতে ইবাদত (মনেপ্রাণে) গ্রহণ ও এর প্রতি সন্তোষ হওয়া স্পষ্ট হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَلِيُمَحِّصَ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ﴾ [ال عمران: ١٤١]
‘যাতে তিনি ঈমানদারকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যাচাই-বাছাই করতে পারেন।’ {সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৪১}
কেননা মানুষের মধ্যে কেউ কেউ এমন রয়েছেন যিনি এ প্রকার ইবাদতের প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন এবং তা পালন করেন অথচ অন্য প্রকার ইবাদতের প্রতি অসন্তুষ্ট থাকেন এবং তাতে উদাসীনতা দেখান। তাই আল্লাহ তা‘আলা ইবাদতের মধ্যে নানা বৈচিত্র্য রেখেছেন:
– কোনো কোনো ইবাদতকে সম্পৃক্ত করেছেন দেহের সঙ্গে, যেমন সালাত।
– কোনো কোনো ইবাদতের সম্পর্ক নফসের প্রিয় সম্পদ ব্যয়ের সঙ্গে, যেমন যাকাত।
– কোনো কোনো ইবাদতে শরীর ও সম্পদ উভয়ই সম্পৃক্ত, যেমন হজ ও জিহাদ।
– কোনো কোনো ইবাদত সম্পৃক্ত লোভনীয় ও প্রিয়বস্তু থেকে নফসকে বিরত রাখার সঙ্গে, যেমন সিয়াম।
সুতরাং আল্লাহর বান্দা যখন বিচিত্র ইবাদত কোনো ধরনের অসন্তুষ্টি ও সীমালংঘন ছাড়াই পরিপূর্ণভাবে পালন করে, এতে করে সে তার রবের আনুগত্যে, তাঁর নির্দেশ পালনার্থে এবং তাঁর শরীয়তে সন্তুষ্ট হয়ে কষ্ট সহ্য করে, আমল করে, প্রিয় বস্তু ব্যয় করে এবং তার প্রবৃত্তি যা কামনা করে তা থেকে বিরত থাকে। এটা বান্দার পক্ষ থেকে তার রবের প্রতি পরিপূর্ণ দাসত্ব, পূর্ণ আনুগত্য ও ভালোবাসা ও সম্মান করার প্রমাণ বহন করে। এর মাধ্যমে সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর দাসত্বের গুণ পুরোপুরি প্রতিফলিত হয়।
উল্লেখিত বিষয়গুলো স্পষ্ট হবার পর জানবার বিষয় হলো, সাওমেরও অনেক হিকমত ও তাৎপর্য রয়েছে যা একে ইসলামের একটি রুকন ও ফরয হওয়া দাবী করে।
সিয়াম ফরয হওয়ার হিকমত ও তাৎপর্য:
সিয়াম পালনের রয়েছে অসংখ্য উপকারিতা ও হিকমত। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আলোচনা করা হলো।
প্রথম হিকমত: ঈমানে নিষ্ঠা ও দাসত্বের পূর্ণতা লাভ
সিয়াম আল্লাহ তা‘আলার অন্যতম ইবাদত। বান্দা পানাহার, স্ত্রী সহবাস ইত্যাদি লোভনীয় ও প্রিয় বস্তু ত্যাগের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার নিকটবর্তী হয়। এর দ্বারা তার ঈমানের সততা, দাসত্বের পূর্ণতা, আল্লাহ তা‘আলাকে হৃদয় উজাড় করে ভালোবাসা ও তাঁর কাছে যা কিছু আছে এগুলোর ব্যাপারে তাঁর ওপর অত্যাধিক নির্ভরতা প্রকাশ পায়। কেননা মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো বস্তু ত্যাগ করেনা, যতক্ষণ তার কাছে এর চেয়েও বড় বস্তু না থাকে। যখন মুমিন এটা জানল যে, আকর্ষণ থাকা সত্ত্বেও লোভনীয় কামবৃত্তি ত্যাগ করে সিয়াম পালন করার মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি নিহিত, তখন সে তার প্রবৃত্তির ওপর আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দেয়। ফলে অধিক আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও সে তা ত্যাগ করে। কেননা আল্লাহ তা‘আলার জন্য তা ছেড়ে দেয়ার মাঝে সে আত্মপ্রশান্তি ও স্বাদ অনুভব করে। এজন্যই এমন অনেক মুমিন রয়েছে যদি তাদেরকে বিনা ওজরে রমযানের একটি সিয়াম ভাঙ্গার জন্য প্রহার করা হয় বা বন্দি করা হয়, তবুও সে সিয়াম ত্যাগ করবে না। এটাই হলো সিয়ামের বড় হিকমত।
দ্বিতীয় হিকমত: তাকওয়া অর্জন
সিয়াম পালনের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করা যায় এটা সিয়ামের অন্যতম হিকমত। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُتِبَ عَلَيۡكُمُ ٱلصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ١٨٣ ﴾ [البقرة: ١٨٣]
‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেমনি ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতদের ওপর, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পারো।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৩}
কারণ, সিয়াম পালনকারীকে ভালো কাজ করা ও মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
* যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالعَمَلَ بِهِ والجهلَ، فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ فِي أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ
‘যে সিয়াম অবস্থায় মিথ্যা বলা ও তদনুযায়ী আমল করা এবং মূর্খতা ত্যাগ করতে পারলো না, তার পানাহার ত্যাগে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’
যখন কোনো ব্যক্তি সিয়াম অবস্থায় কোনো পাপাচারের ইচ্ছা করে তৎক্ষণাৎ সে যেন স্মরণ করে যে, সে সিয়াম পালনকারী। তাহলে তার জন্য পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা সহজ হবে।
* এজন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিয়ামরত ব্যক্তিকে এ কথা বলতে নির্দেশ দিয়েছেন যে, যদি কেউ তাকে গালি দেয় বা তার সঙ্গে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হয় তাহলে সে বলে “আমি সিয়াম পালনকারী ব্যক্তি।” এটা সাওম পালনকারীকে সাবধান করার জন্য যে, তাকে গালি-গালাজ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আর তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য যে, সে সাওম পালনরত অবস্থায় আছে সুতরাং তাকে কটূক্তি ও গালাগালির জবাব প্রদান থেকে বিরত থাকতে হবে।
তৃতীয় হিকমত: আল্লাহর স্মরণ ও তার সৃষ্টিতে চিন্তার জন্য একান্ত হওয়া।
এটাও সিয়ামের হিকমত যে, সিয়াম পালনকারীর হৃদয় আল্লাহ তা‘আলার স্মরণ ও ধ্যানে মগ্ন থাকে। কেননা প্রবৃত্তির দাসত্ব ও অধিক ভোজন উদাসীনতাকে অবধারিত করে। আর ক্ষেত্রবিশেষ অন্তরকে কঠোর করে ও চোখকে সত্য দর্শনে অন্ধ বানিয়ে দেয়।
* এ কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম পানাহার কমানোর কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন:
مَا مَلَأَ ابْنُ آدَمَ وِعَاءً شَرًّا مِنْ بَطْنٍ، حَسْبُ ابْنِ آدَمَ أُكُلَاتٌ يُقِمْنَ صُلْبَهُ، فَإِنْ كَانَ لَا مَحَالَةَ، فَثُلُثُ طَعَامٍ، وَثُلُثُ شَرَابٍ، وَثُلُثٌ لِنَفْسِهِ
‘আদম সন্তান পেটের চেয়ে নিকৃষ্ট কোনো পাত্র পূর্ণ করে না। অথচ আদম সন্তানের জন্য মেরুদণ্ড সোজা থাকে এমন কয়েক লোকমা খাদ্যই যথেষ্ট। অগত্যা যদি খেতেই হয়, তাহলে পেটের এক তৃতীয়াংশ খাদ্যের জন্য, অপর তৃতীয়াংশ পানীয়ের জন্য এবং বাকী তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য রাখবে।’
* সহীহ মুসলিমে এসেছে, হানযালাহ্‌ আল-উসাইদী রাদিয়াল্লাহু আনহু, তিনি ছিলেন ওহী লিখকদের একজন, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একদিন বললেন, হানযালাহ মুনাফেকী করেছে। তখন আল্লাহর রাসূল বললেন:
وَمَا ذَاكَ؟قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ نَكُونُ عِنْدَكَ تُذَكِّرُنَا بِالنَّارِ وَالْجَنَّة حَتَّى كَأَنَّا رَأْيُ عَيْنٍ، فَإِذَا خَرَجْنَا مِنْ عِنْدِكَ عَافَسْنَا الْأَزْوَاجَ وَالْأَوْلَادَ وَالضَّيْعَاتِ فنَسِينَا كَثِيرًا… الحديث
অর্থাৎ হে হানযালা! সেটা কী রকম? তিনি উত্তরে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা যখন আপনার নিকট থাকি আপনি আমাদেরকে জান্নাত ও জাহান্নামের স্মরণ করিয়ে দেন যেন আমরা তা স্বচক্ষে দেখি। অতঃপর যখন আপনার নিকট থেকে বের হয়ে চলে যাই তখন স্ত্রী-সন্তানাদি ও জমি-জমা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি; তখন অনেক কিছু-ই (আখেরাতের কথা) ভুলে যাই।’
এ হাদীসে রয়েছে, “হে হানযালা! এক ঘণ্টা, এক ঘণ্টা ও এক ঘণ্টা।” তিন বার বললেন।”
* আবূ সুলাইমান আদ-দারানী রহ. বলেন-
أن النفس إذا جاعت وعطشت صفا القلب ورق وإذا شبعت عمي القلب
“যখন নফস ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত থাকে তখন অন্তর স্বচ্ছ এবং কোমল থাকে। আর যখন খাবারে পরিপূর্ণ ও পরিতৃপ্ত থাকে তখন অন্তর অন্ধ থাকে।”
চতুর্থ হিকমত: ধনী ব্যক্তি কর্তৃক নেয়ামত উপলব্ধি
সিয়ামের অন্যতম একটি হিকমত হলো, এর মাধ্যমে ধনী ব্যক্তি তার প্রতি আল্লাহর দেয়া ধন সম্পদের মর্যাদা বুঝতে পারে। যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা তাকে খাদ্য, পানীয় ও স্ত্রীর মত নেয়ামত প্রদান করেছেন, যা থেকে সৃষ্টি জগতের অনেকেই বঞ্চিত রয়েছে। ফলে সে এসব নেয়ামতের জন্য আল্লাহর প্রশংসা করে, সুখ স্বাচ্ছন্দের জন্য শুকরিয়া আদায় করে এবং এর মাধ্যমে সে তার ওই সকল ভাইদের কথা স্মরণ করে যারা ক্ষুধার্ত ও অসহায় অবস্থায় রাত যাপন করে। ফলে সে তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে, যদ্বারা তারা নিজেদের লজ্জা নিবারণ করবে ও ক্ষুধা মিটাবে।
* এজন্যই “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানব সমাজের বড় দানশীল। তিনি আরও বেশি দানশীল হয়ে যেতেন যখন রমযান আসত আর জিব্রাইল ‘আলাইহিস সালাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন ও তাঁর সাথে কুরআন পাঠ করতেন।”
পঞ্চম হিকমত: আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণ লাভ
সিয়ামের অন্যতম হিকমত হলো এর মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণের অনুশীলন, তার ওপর কর্তৃত্ব অর্জন এবং তা দমনের মাধ্যম; যাতে করে নফসের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাসহ তাকে কল্যাণ ও সৌভাগ্যের পথে পরিচালিত করতে পারে। এটা নিশ্চিত যে, নফস মন্দ কাজেরই পথ নির্দেশ করে। তবে আল্লাহ যাকে দয়া করেন সে ব্যতিত। সুতরাং মানুষ যখন আত্মাকে লাগামমুক্ত করে দেয়, তখন তাকে ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করে। পক্ষান্তরে যখন সে তার ওপর কর্তৃত্ববান হয় ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, তখন সুউচ্চ স্থানে ও অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌছতে সক্ষম হয়।
ষষ্ঠ হিকমত: কুপ্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ ও অহংকার থেকে মুক্তি
সিয়ামের অন্যতম হিকমত হচ্ছে, কুপ্রবৃত্তিকে নিষ্ক্রিয় ও অহংকার থেকে মুক্ত করা; যাতে সে সত্যের প্রতি বিনয়ী ও সৃষ্টির প্রতি কোমল হয়। কেননা পরিতৃপ্ত হওয়া, আনন্দ উল্লাস করা ও নারীর সঙ্গে অধিক মেলামেশা করা, এর প্রত্যেকটিই মানুষদেরকে মন্দ, গর্ব, অহংকার, সৃষ্টির উপর দাম্ভিকতা ও হক গ্রহণ না করার দিকে ধাবিত করে। কেননা নফস যখন মনে করে যে তার এগুলো প্রয়োজন তখন সে এগুলো অর্জনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অতঃপর সে যখন সেটা অর্জনে সমর্থ হয় তখন সে মনে করে যে সে কাঙ্ক্ষিত বস্তু পেয়ে গেছে, ফলে সে গর্হিত আনন্দ পায় ও তা নিয়ে অহংকার করে, যা পরবর্তীতে তার ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রকৃতপক্ষে এ অবস্থা থেকে সে-ই নিরাপদ থাকতে পারে, আল্লাহ যাকে রক্ষা করেন।
সপ্তম হিকমত: রক্ত চলাচলের পথ সংকুচিত হওয়া
সিয়ামের আরও হিকমত হলো, ক্ষুধা তৃষ্ণার কারণে মানুষের রক্ত চলাচলের পথ সংকুচিত হয়ে পড়ে। ফলে দেহের অভ্যন্তরে শয়তানের চলাচলের পথ সংকীর্ণ হয়ে যায়।
* কেননা “শয়তান আদম সন্তানের রক্তের সঙ্গে শিরা উপশিরা দিয়ে চলাচল করে।” যেমনটি বুখারী ও মুসলিমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে,
إِنَّ الشَّيْطَانَ يَجْرِي مِنَ الإِنْسَانِ مَجْرَى الدَّمِ
‘নিশ্চয় শয়তান মানুষের শিরায় শিরায় বিচরণ করে।’
মূলত সিয়ামের মাধ্যমে মানুষ শয়তানের প্ররোচনা থেকে নিরাপদ থাকে এবং ক্রোধ ও কামপ্রবৃত্তির উন্মত্ততা হ্রাস পায়। এ জন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুবকদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন:
يا مَعْشَرَ الشَّبَاب! مَنِ اسْتَطَاعَ البَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ، فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ، وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ، وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ، فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاءٌ
‘হে যুবক সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যে, ব্যক্তি বিবাহ করতে সক্ষম, সে যেন বিবাহ করে। কেননা বিবাহ দৃষ্টি অবনত রাখে ও লজ্জাস্থান হেফাজত করে। আর যে বিবাহ করতে সক্ষম নয়, সে যেন সিয়াম পালন করে। কেননা সিয়াম তাকে কামভাব থেকে বিরত রাখবে।’
অষ্টম হিকমত: বহুবিধ স্বাস্থ্যগত উপকার
সিয়ামের আরও একটি হিকমত হলো এর দ্বারা বহুবিধ স্বাস্থ্যগত উপকার হয়, যা সুনির্দিষ্ট সময়ের জন্য আহার নিয়ন্ত্রণ ও পরিপাকতন্ত্রের বিশ্রাম দানের মাধ্যমে অর্জিত হয় এবং শরীরের অন্যান্য বাড়তি ক্ষতিকর বস্তু ও জলীয় পদার্থ হ্রাস করে।
আহ সিয়াম সাধনার মাঝে আল্লাহ তা‘আলার কত মহান ও চমৎকার হিকমত বিদ্যমান! আর তাঁর বিধি-বিধান সৃষ্টিকূলের জন্য কতই না উপযোগী, উপকারী এবং বাস্তবসম্মত।
হে আল্লাহ! আপনি আমাদের দীনের গভীর প্রজ্ঞা ও শরীয়তের রহস্যাবলির জ্ঞান দান করুন। দ্বীন- দুনিয়ার যাবতীয় কাজ বিশুদ্ধ করে দিন। হে দয়াময়! স্বীয় অনুগ্রহে আমাদেরকে, আমাদের পিতা-মাতাকে ও সকল মুসলিমকে ক্ষমা করুন।
আর আল্লাহ সালাত ও সালাম পেশ করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীর ওপর।
দশম আসরঃসিয়াম পালনের ফরয আদবসমূহ
যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি সৃষ্টি তথা মানুষকে পূর্ণতর শিষ্টাচারের দিয়েছেন দিক-নির্দেশনা, তাদের জন্য নিজ দয়া ও দানের সর্বপ্রকার ভাণ্ডার করেছেন উন্মুক্ত, মুমিনদের দৃষ্টিকে করেছেন আলোকিত ফলে তারা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে গূঢ় বাস্তবতা এবং তালাশ করেছে সাওয়াব, তাঁর আনুগত্য উপেক্ষাকারীদের দৃষ্টিকে করে দিয়েছেন অন্ধ ফলে তাদের ও তাঁর নূরের মাঝে পড়ে গেছে পর্দা। তিনি নিজ হিকমত ও ইনসাফ অনুযায়ী তাদের দিয়েছেন হেদায়াত, আর অন্যদের করেছেন পথভ্রষ্ট। নিশ্চয় এতে রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য উপদেশ।
আর আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই, রাজত্ব তাঁরই, তিনি প্রবল-পরাক্রমশালী ও মহাদাতা। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসূল, যিনি উৎকৃষ্টতম ইবাদত ও পূর্ণতর শিষ্টাচার নিয়ে প্রেরিত হয়েছিলেন।
আল্লাহ সালাত বর্ষণ করুন তাঁর ওপর, তাঁর সকল পরিবার-পরিজন ও সাহাবীর ওপর এবং কিয়ামত পর্যন্ত তাদের উত্তমরূপে অনুসরণকারীদের ওপর। আর তিনি যথার্থ সালামও পেশ করুন।
আমার ভাইয়েরা! জেনে রাখুন, সিয়ামের অনেক আদব বা পালনীয় বিষয় রয়েছে যা ছাড়া সিয়াম পূর্ণতা পায় না এবং যা যথাযথভাবে সম্পন্ন না করা হলে সিয়ামের উৎকর্ষ সাধন হয় না।
আর তা দুই প্রকার:
১- প্রথম প্রকার: ফরয করণীয়সমূহ, যা প্রতিটি সাওম পালনকারীকেই অবশ্যই খেয়াল রাখতে হয় এবং সেগুলোর প্রতি যথাযথ যতœবান থাকতেই হয়।
২- দ্বিতীয় প্রকার: মুস্তাহাব করণীয়সমূহ, আর তা এমন কিছু মুস্তাহাব আদব; সাওম পালনকারীকে সেগুলোর প্রতি যতœশীল হওয়া ও লক্ষ্য রাখা উচিত।
ওয়াজিব আদবসমূহের মধ্যে রয়েছে: আল্লাহ তা‘আলা সিয়াম পালনকারীর ওপর যেসব মৌখিক ও কায়িক ইবাদত আবশ্যক করেছেন তা বাস্তবায়ন করা।
এসব ইবাদতের মধ্যে ঈমানের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ফরয সালাত। সালাত ইসলামের অন্যতম রুকন। সালাতের শর্ত, রুকন ও ওয়াজিবসমূহ আদায় করে নিয়মিত সালাত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তার যতœ নেয়া এবং সময়মত জামাতের সঙ্গে মসজিদে গিয়ে আদায় করা। কেননা এটা তাকওয়ার অন্তর্ভুক্ত, যা অর্জনের জন্য সিয়ামের বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে এবং উম্মতের জন্য ফরয করা হয়েছে। আর সালাত পরিত্যাগ করা তাকওয়ার পরিপন্থী এবং শাস্তির আবশ্যককারী।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿۞فَخَلَفَ مِنۢ بَعۡدِهِمۡ خَلۡفٌ أَضَاعُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَٱتَّبَعُواْ ٱلشَّهَوَٰتِۖ فَسَوۡفَ يَلۡقَوۡنَ غَيًّا ٥٩ إِلَّا مَن تَابَ وَءَامَنَ وَعَمِلَ صَٰلِحٗا فَأُوْلَٰٓئِكَ يَدۡخُلُونَ ٱلۡجَنَّةَ وَلَا يُظۡلَمُونَ شَيۡ‍ٔٗا ٦٠ ﴾ [مريم: ٥٩، ٦٠]
‘তাদের পরে আসল এমন এক অসৎ বংশধর যারা সালাত বিনষ্ট করল এবং কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করল। সুতরাং শীঘ্রই তারা জাহান্নামের শাস্তি প্রাপ্ত হবে। তবে তারা নয় যারা তাওবা করেছে, ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে; তারাই জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি কোন যুলম করা হবে না।’ {সূরা মারইয়াম, আয়াত: ৫৯-৬০}
 সাওম পালনকারীদের মধ্যে কেউ কেউ তার উপর জামায়াতে সালাত আদায় ওয়াজিব হওয়া সত্ত্বেও তাতে অবহেলা করে। অথচ আল্লাহ তাঁর কিতাবে জামাতে সালাতের নির্দেশ প্রদান করেছেন।
* তিনি বলেছেন:
﴿وَإِذَا كُنتَ فِيهِمۡ فَأَقَمۡتَ لَهُمُ ٱلصَّلَوٰةَ فَلۡتَقُمۡ طَآئِفَةٞ مِّنۡهُم مَّعَكَ وَلۡيَأۡخُذُوٓاْ أَسۡلِحَتَهُمۡۖ فَإِذَا سَجَدُواْ فَلۡيَكُونُواْ مِن وَرَآئِكُمۡ وَلۡتَأۡتِ طَآئِفَةٌ أُخۡرَىٰ لَمۡ يُصَلُّواْ فَلۡيُصَلُّواْ مَعَكَ وَلۡيَأۡخُذُواْ حِذۡرَهُمۡ وَأَسۡلِحَتَهُمۡۗ ﴾ [النساء: ١٠٢]
‘(হে রাসূল) যখন আপনি তাদের মাঝে (যুদ্ধক্ষেত্রে) থাকেন তারপর তাদের নিয়ে সালাত কায়েম করেন তাহলে তাদের একটি দল যেন আপনার সঙ্গে দাঁড়ায় এবং তারা যেন তাদের যুদ্ধের অস্ত্রাদি সঙ্গে রাখে। আর যখন তারা সিজদা করে -তাদের সালাতের প্রথম রাকাত সম্পন্ন করে- তখন যেন পিছনে চলে যায় এবং যেন আবার ২য় দলটি আগমন করে যারা সালাত আদায় করে নি। অতঃপর তারা যেন আপনার সঙ্গে সালাত আদায় করে এবং তাদের সতর্কতা অবলম্বন করে এবং যুদ্ধের অস্ত্রাদি সঙ্গে রাখে।’ {সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১০৬}
দেখুন, যুদ্ধ চলাকালে এবং ভীতিকর মুহূর্তেও ‌আল্লাহ জামাতের সঙ্গে সালাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন! তাহলে নিরাপদ ও শান্ত অবস্থায় এর গুরুত্ব কত বেশি!
* জামা‘আতে সালাত আদায় করা সম্পর্কে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু বর্ণিত হাদীসে এসেছে, তিনি বলেন,
أن رَجُلاً أَعْمَى قَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ لَيْسَ لِي قَائِدٌ يَقُودُنِي إِلَى الْمَسْجِدِ فَرَخَّصَ لَهُ فَلَمَّا وَلَّى دَعَاهُ وقَالَ هَلْ تَسْمَعُ النِّدَاءَ بِالصَّلَاةِ قَالَ نَعَمْ قَالَ فَأَجِبْ
‘একজন অন্ধলোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মুখে এসে নিবেদন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার মসজিদে নিয়ে আসার মত কোনো লোক নেই। এ কথা শুনে তিনি তাকে জামা‘আতে না আসার অনুমতি প্রদান করলেন। অতঃপর লোকটি যখন পিছন ফিরে চলে যাচ্ছিল তখন তিনি তাকে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন, তুমি কি আজান শুনতে পাও? তিনি উত্তরে বললেন, হ্যাঁ। রাসূল সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাহলে তোমাকে আযানের ডাকে সাড়া দিতে হবে অর্থাৎ জামায়াতে আসতে হবে।’
এ হাদীসে দেখা যাচ্ছে যে, নবী সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকটিকে জামাত পরিত্যাগ করার অনুমতি দেন নি, যদিও লোকটি ছিল অন্ধ আর তার কোনো পরিচালক ছিল না।
আর জামাত ত্যাগকারী শুধু ওয়াজিবই বাদ দেন না, বহুগুণ সাওয়াবসহ অনেক কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হন। কারণ জামাতে সালাতের সওয়াব বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।
* যেমন সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
صَلَاةَ الْجَمَاعَةِ تَفْضُلُ عَلي صَلَاةَ الْفَذِّ بِسَبْعٍ وَعِشْرِينَ دَرَجَةً
‘জামাতে সালাত আদায় করা একাকী সালাতের চেয়ে সাতাশ গুণ বেশি মর্যাদা রাখে।’
আর সে নানা সামাজিক কল্যাণ থেকেও বঞ্চিত হয়, যা মুসলিমগণ একসঙ্গে হবার মাধ্যমে অর্জন করে থাকেন। যেমন সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি স্থাপন, অজ্ঞকে শিক্ষা দেয়া এবং অভাবীকে সহযোগিতা করা ইত্যাদি।
তেমনি সালাতের জামাত ত্যাগের কারণে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হয় এবং মুনাফিকদের সঙ্গেও সাদৃশ্য সৃষ্টি হয়। যেমন,
* সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
أَثْقَلَ صَلَوَاتِ عَلَى الْمُنَافِقِينَ صَلَاةُ الْعِشَاءِ وَصَلَاةُ الْفَجْرِ وَلَوْ يَعْلَمُونَ مَا فِيهِمَا لَأَتَوْهُمَا وَلَوْ حَبْوًا وَلَقَدْ هَمَمْتُ أَنْ آمُرَ بِالصَّلَاةِ فَتُقَامَ ثُمَّ آمُرَ رَجُلًا فَيُصَلِّيَ بِالنَّاسِ ثُمَّ أَنْطَلِقَ مَعِي بِرِجَالٍ مَعَهُمْ حُزَمٌ مِنْ حَطَبٍ إِلَى قَوْمٍ لَا يَشْهَدُونَ الصَّلَاةَ فَأُحَرِّقَ عَلَيْهِمْ بُيُوتَهُمْ بِالنَّارِ
‘মুনাফিকদের জন্য সবচেয়ে কঠিন সালাত হলো ফজর ও এশার সালাত। তারা যদি জানতো এ দু’ সালাতের মধ্যে কী ফযীলত রয়েছে তাহলে অবশ্যই হামাগুড়ি দিয়ে উপস্থিত হতো। আর আমার মনে চায় যে, আমি সালাতের জন্য নির্দেশ দেই। তারপর সালাতের ইকামত দেয়া হবে। অতঃপর আমি একজন লোককে নির্দেশ দেই সে যেন লোকদের নিয়ে সালাত আদায় করে। আর আমি লাকড়ি হাতে কিছু লোক নিয়ে ওইসব লোকের কাছে যাবো যারা সালাতের জামাতে হাযির হয় না। এরপর আমি তাদের বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেই।’
* সহীহ মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন:
مَنْ سَرَّهُ أَنْ يَلْقَى اللَّهَ غَدًا مُسْلِمًا فَلْيُحَافِظْ عَلَى هَؤُلَاءِ الصَّلَوَاتِ حَيْثُ يُنَادَى بِهِنَّ فَإِنَّ اللَّهَ شَرَعَ لِنَبِيِّكُمْ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سُنَنَ الْهُدَى وَإِنَّهُنَّ مِنْ سُنَنِ الْهُدَى، قَالَ وَلَقَدْ رَأَيْتُنَا وَمَا يَتَخَلَّفُ عَنْهَا إِلَّا مُنَافِقٌ مَعْلُومُ النِّفَاقِ وَلَقَدْ كَانَ الرَّجُلُ يُؤْتَى بِهِ يُهَادَى بَيْنَ الرَّجُلَيْنِ حَتَّى يُقَامَ فِي الصَّفِّ
‘যে ব্যক্তি এটা পছন্দ করে যে, আগামীকাল তথা মৃত্যুর পর আল্লাহর সঙ্গে মুসলিম হিসেবে সাক্ষাত করবে তার উচিত সে যেন এ সালাতসমূহের ব্যাপারে যতœবান হয়; যখনই এগুলোর জন্য ডাকা হয়। কারণ, আল্লাহ তোমাদের নবীর জন্য হেদায়াতের রীতিনীতি প্রবর্তন করেছেন। আর এ সালাতগুলো সে হেদায়াতের নীতিসমূহের মধ্যে অন্যতম।’ বর্ণনাকারী বলেন, ‘আমরা আমাদেরকে দেখেছি এরকম যে, স্পষ্ট কপটতা আছে এমন মুনাফিক ছাড়া কেউ সালাতের জামাত থেকে পিছপা হতো না। এমনকি তখনকার সময় কোনো কোনো মানুষকে দু’জনের কাঁধে ভর করে জামাতে উপস্থিত করা হতো এবং তাকে কাতারে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হতো।’
 কোনো কোনো সাওম পালনকারী আছে যারা আরও সীমালঙ্ঘন করে থাকে, তারা সময়মত সালাত আদায় না করে ঘুমিয়ে থাকে। এটা সবচে নিন্দিত কাজ এবং সালাত বিনষ্টের সবচে ঘৃণিত রূপ।
এমনকি বহু আলেম বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি শরয়ী কোনো ওযর ব্যতিরেকে সালাতকে তার সময় থেকে বিলম্ব করবে তার সালাত ১০০ বার পড়লেও গ্রহণযোগ্য হবে না।’
* কেননা নবী সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ
‘যে ব্যক্তি এমন আমল করল যে আমল আমাদের আমল নয় (যে আমলের সঙ্গে আমাদের আমলের কোনো মিল নেই), সেটা বাতিল বলে গণ্য হবে।’
আর সময়মত সালাত আদায় না করে দেরী করে আদায় করা নবী সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল নয়। সুতরাং যে ব্যক্তি এমনটি করবে তা প্রত্যাখ্যাত হবে, গ্রহণযোগ্য হবে না।
সিয়ামের অন্যতম ওয়াজিব আদব হচ্ছে: আল্লাহ যে সকল কথা ও কাজ হারাম করেছেন সাওম পালনকারী তা থেকে বেঁচে থাকবে। যেমন:
মিথ্যা থেকে বেঁচে থাকবে:
আর মিথ্যা হলো বাস্তবতার বিপরীত কথা বলা। সবচেয়ে নিকৃষ্টতম মিথ্যা হলো আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে মিথ্যা বলা যেমন, কোনো হালালকে হারাম ও হারামকে হালাল বলার বিষয়টিকে আল্লাহর দিকে সম্পর্কযুক্ত করে বলা।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿وَلَا تَقُولُواْ لِمَا تَصِفُ أَلۡسِنَتُكُمُ ٱلۡكَذِبَ هَٰذَا حَلَٰلٞ وَهَٰذَا حَرَامٞ لِّتَفۡتَرُواْ عَلَى ٱللَّهِ ٱلۡكَذِبَۚ إِنَّ ٱلَّذِينَ يَفۡتَرُونَ عَلَى ٱللَّهِ ٱلۡكَذِبَ لَا يُفۡلِحُونَ ١١٦ مَتَٰعٞ قَلِيلٞ وَلَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمٞ ١١٧ ﴾ [النحل: ١١٦، ١١٧]
‘আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে তোমাদের জিহ্বা যেন এ কথা না বলে এটা হালাল এবং এটা হারাম। যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করবে তারা সফলকাম হবে না। তাদের সুখ সম্ভোগ ক্ষণিকের জন্য। তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি।’ {সূরা আন-নাহল, আয়াত: ১১৬-১১৭}
* সহীহ বুখারী ও মুসলিমসহ অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে আবূ হুরাইরা ও অন্যান্য রাবী থেকে বর্ণিত আছে, নবী সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنْ النَّارِ
“যে ব্যক্তি আমার ওপর ইচ্ছা করে মিথ্যা বললো সে যেন তার স্থানকে জাহান্নামে নির্ধারণ করে নিল।”
* তাছাড়া নবী সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিথ্যা থেকে সতর্ক করে বলেছেন:
وَإِيَّاكُمْ وَالْكَذِبَ، فَإِنَّ الْكَذِبَ يَهْدِي إِلَى الْفُجُورِ، وَإِنَّ الْفُجُورَ يَهْدِي إِلَى النَّارِ، وَمَا يَزَالُ الرَّجُلُ يَكْذِبُ وَيَتَحَرَّى الْكَذِبَ حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ كَذَّابًا
‘তোমরা মিথ্যা পরিহার কর। কেননা মিথ্যা পাপাচারের দিকে নিয়ে যায়, আর পাপাচার জাহান্নামের দিকে ধাবিত করে। কোনো লোক সর্বদা মিথ্যা কথা বলতে থাকলে ও এতে প্রচেষ্টা চালাতে থাকলে তার নাম আল্লাহ তা‘আলার কাছে মিথ্যাবাদী হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়।’
গীবত থেকে বেঁচে থাকবে:
গীবত হচ্ছে, কোনো মুসলিম ভাইয়ের অগোচরে তার ব্যাপারে এমন আলোচনা করা, যা সে অপছন্দ করে। চাই এটা তার শারীরিক ত্রুটি-বিচ্যুতিই হোক না কেন। যেমন কাউকে নিন্দা ও দোষারোপ করার উদ্দেশ্যে ল্যাংড়া, ট্যারা বা অন্ধ বলা। তেমনি কারো চারিত্রিক ত্রুটি তুলে ধরা যা সে অপছন্দ করে, যেমন বোকা, নির্বোধ, ফাসেক ইত্যাদি। বাস্তবে ওই লোকের মধ্যে এ সকল দোষ-ত্রুটি বিদ্যমান থাকুক বা না থাকুক।
* কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গীবত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন:
ذِكْرُكَ أَخَاكَ بِمَا يَكْرَهُقِيلَ أَفَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ فِي أَخِي مَا أَقُولُ؟ قَالَ: إِنْ كَانَ فِيهِ مَا تَقُولُ، فَقَدِ اغْتَبْتَهُ، وَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِيهِ فَقَدْ بَهَتَّهُ
‘এটা হলো তোমার ভাই সম্পর্কে এমন আলোচনা করা যা সে অপছন্দ করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো, আমি যা বলি তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে তাহলে এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাব দিলেন, তুমি যা বলো তা যদি তার মধ্যে থাকে তাহলে তুমি গীবত করলে, আর যদি না থাকে তাহলে তুমি তাকে অপবাদ দিলে।’
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমে গীবত করতে নিষেধ করেছেন ও একে নিকৃষ্ট বস্তু তথা আপন মৃত ভাইয়ের গোস্ত খাওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَلَا يَغۡتَب بَّعۡضُكُم بَعۡضًاۚ أَيُحِبُّ أَحَدُكُمۡ أَن يَأۡكُلَ لَحۡمَ أَخِيهِ مَيۡتٗا فَكَرِهۡتُمُوهُۚ ﴾ [الحجرات: ١٢]
‘আর তোমরা কারো গীবত করো না, তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা এটাকে ঘৃণাই কর।’ {সূরা আল-হুজুরাত: ১২}
* অনুরূপভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানিয়েছেন যে,
أَنَّهُ مَرَّ بِقَوْمٍ لَهُمْ أَظْفَارٌ مِنْ نُحَاسٍ يَخْمُشُونَ وُجُوهَهُمْ وَصُدُورَهُمْ فَقُلْتُ مَنْ هَؤُلَاءِ يَا جِبْرِيلُ قَالَ هَؤُلَاءِ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ لُحُومَ النَّاسِ وَيَقَعُونَ فِي أَعْرَاضِهِمْ
‘তিনি মেরাজের রাত্রে কোনো এক সম্প্রদায়ের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন যাদের পিতলের নখ রয়েছে তারা এগুলো দিয়ে তাদের মুখমণ্ডল ও বক্ষে আঘাত করছে। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে জিব্রাইল এরা কারা? জিব্রাঈল উত্তরে বললেন, এরা ওই সমস্ত লোক যারা পৃথিবীতে মানুষের গোশত খেতো এবং মানুষের সম্মানহানি ঘটাতো।’
নামীমা বা চুগলখোরী থেকে বেঁচে থাকবে:
নামীমা বা চুগলখোরী হচ্ছে, পারস্পরিক সম্পর্ক বিনষ্টের উদ্দেশ্যে কোনো ব্যক্তি অপর ব্যক্তির ব্যাপারে কোনো কথা বললে অপর ব্যক্তির কাছে তা ফেরি করে বেড়ানো। এটি অন্যতম কবিরা গুনাহ।
* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে বলেন:
لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ نَمَّامٌ
‘চুগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’
* সহীহ বুখারী ও মুসলিমে ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
مَرَّ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِقَبْرَيْنِ فَقَالَ إِنَّهُمَا لَيُعَذَّبَانِ وَمَا يُعَذَّبَانِ فِي كَبِيرٍ أَمَّا أَحَدُهُمَا فَكَانَ لَا يَسْتَنزه مِنْ الْبَوْلِ وَأَمَّا الْآخَرُ فَكَانَ يَمْشِي بِالنَّمِيمَةِ
‘নবী সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা দুটি কবরের পাশে দিয়ে অতিক্রম করলেন। তারপর বললেন, দুটো কবরবাসীকে আযাব দেয়া হচ্ছে। অবশ্য বিরাট কোনো কঠিন কাজের জন্য তাদের শাস্তি হচ্ছে না। (অর্থাৎ যা থেকে বেঁচে থাকা কোনো কঠিন বিষয় ছিল না) তাদের একজন প্রস্রাব করে পবিত্রতা অর্জন করতো না। অপরজন মানুষের মধ্যে চুগলখোরি করে বেড়াত।’
বস্তুত: নামীমা বা চুগলখোরি ব্যক্তি, সমাজ ও মুসলিমদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করা এবং তাদের মধ্যে শত্রুতার আগুন লাগিয়ে দেওয়া।
﴿ وَلَا تُطِعۡ كُلَّ حَلَّافٖ مَّهِينٍ ١٠ هَمَّازٖ مَّشَّآءِۢ بِنَمِيمٖ ١١ ﴾ [القلم: ١٠، ١١]
‘আর তুমি আনুগত্য করো না প্রত্যেক এমন ব্যক্তির যে অধিক কসমকারী, লাঞ্ছিত। পিছনে নিন্দাকারী ও যে চুগলখোরী করে বেড়ায়।’ {সূরা আল-কালাম, আয়াত: ১০-১১}
সুতরাং যে আপনার কাছে অপরের নিন্দা ও চুগলখোরি করে সে আপনার ব্যাপারেও চুগলখোরি করে বেড়ায়। সুতরাং তার থেকে সতর্ক থাকুন।
সকল প্রকার প্রতারণা ও ধোঁকা প্রদান থেকে বেঁচে থাকতে হবে:
সিয়ামপালনকারী ক্রয়-বিক্রয়, ভাড়া, শিল্প, বন্ধক ও অন্যান্য যাবতীয় লেনদেনের মধ্যে প্রতারণা থেকে বিরত থাকবে। অনুরূপভাবে সব ধরনের উপদেশ ও পরামর্শের ক্ষেত্রেও প্রতারণা পরিহার করবে। কেননা ‘প্রতারণা একটি মারাত্মক কবীরা গুনাহ।
* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
مَنْ غَشَّنَا فَلَيْسَ مِنَّا .
‘যে আমাদেরকে ধোঁকা দেয় সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’
অন্য বর্ণনায় এসেছে,
مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنِّى .
‘যে প্রতারণা করে সে আমার অন্তর্ভুক্ত নয়।’
হাদীসে উল্লেখিত ‘আল-গিশ’ শব্দের অর্থ ধোঁকা দেয়া, খেয়ানত, আমানত বিনষ্ট করা, মানুষের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলা। আর প্রতারণার মাধ্যমে যা অর্জিত হয় তা নিকৃষ্ট, হারাম ও ঘৃণ্য। প্রতারণা দ্বারা প্রতারক ও আল্লাহর মাঝে কেবলমাত্র দূরত্বই বৃদ্ধি পায়।
সব ধরনের বাদ্যযন্ত্র থেকে বেঁচে থাকা:
সকল প্রকার বাদ্যযন্ত্র থেকে দূরে থাকা উচিত। যেমন- বীণা, একতারা, বেহালা, হারমোনিয়াম, গিটার, পিয়ানো, ঢোল-তবলা ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র। কেননা এসব হারাম। এগুলোর হারাম ও গুনাহ আরও বৃদ্ধি পায় যখন এর সাথে মিলিত হয় উত্তেজনামূলক গান ও মিষ্টি আওয়াজ।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿ وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَشۡتَرِي لَهۡوَ ٱلۡحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِ بِغَيۡرِ عِلۡمٖ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًاۚ أُوْلَٰٓئِكَ لَهُمۡ عَذَابٞ مُّهِينٞ ٦ ﴾ [لقمان: ٦]
‘মানুষের মধ্যে কেউ কেউ অজ্ঞতাবশতঃ আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য গান বাদ্যের উপকরণ ক্রয়-বিক্রয় করে এবং আল্লাহ প্রদর্শিত পথ নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রূপ করে। তাদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর কঠোর শাস্তি।’ {সূরা লুকমান, আয়াত: ৬}
* আবদুল্লাহ ইবন মাস‘উদ রাদিয়াল্লাহুকে এ আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন,
والله الذي لا إله غيرهُ هو الغناء
‘যিনি ব্যতীত আর কোনো ইলাহ নেই সেই আল্লাহর শপথ করে বলছি, এটা হচ্ছে গান’ ।
* অনুরূপভাবে ইবন আব্বাস, ইবন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুম থেকেও এ তাফসীর সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়া ‘আল্লামা ইবন কাসীর এ তাফসীরটি জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু, ইকরিমা, সা‘ঈদ ইবন জুবাইর ও মুজাহিদ রাহেমাহুল্লাহ থেকেও উল্লেখ করেছেন ।
* হাসান বসরী রহ. বলেন, ‘এ আয়াতটি গান ও বাদ্যের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে।’
* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাদ্যযন্ত্র থেকে সতর্ক করেছেন। তিনি এসবকে যেনা-ব্যভিচারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন:
لَيَكُونَنَّ مِنْ أُمَّتِى أَقْوَامٌ يَسْتَحِلُّونَ الْحِرَ وَالْحَرِيرَ وَالْخَمْرَ وَالْمَعَازِفَ .
‘আমার উম্মতে এমন একদল লোক হবে যারা যেনা-ব্যভিচার, রেশম, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল মনে করবে।’
হাদীসে বর্ণিত ‘الْحِرَ’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে, লজ্জাস্থান, যার দ্বারা যেনা-ব্যভিচার বুঝানো হয়েছে। আর ‘يَسْتَحِلُّونَ’ এর অর্থ হচ্ছে এমনভাবে ভ্রূক্ষেপহীনভাবে করা যেমন হালাল মনে কেউ কোনো কাজ করে থাকে।
বর্তমান সময়ে এমন মানুষ রয়েছে যারা এসব বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে থাকে অথবা সেগুলো এমনভাবে শ্রবণ করে থাকে যেন এগুলো হালাল জিনিস।
এটা এমন এক ষড়যন্ত্র যা দ্বারা ইসলামের শত্রুরা মুসলিমদেরকে ষড়যন্ত্রের জালে আবদ্ধ করতে সফলতা লাভ করেছে। এতে করে তারা মুসলিমদেরকে আল্লাহ তা‘আলার যিকর-স্মরণ, তাদের দ্বীন ও দুনিয়ার গুরুত্বপূর্ণ কাজ থেকে বিরত রাখছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, মুসলিমদের অনেকেই কুরআন ও হাদীসের পাঠ, ধর্মবেত্তাগণের শরীয়ত ও হিকমত সমৃদ্ধ বয়ানের চেয়েও এগুলোর প্রতি বেশী এসব গান ও বাদ্যযন্ত্রে আসক্ত হয়ে পড়ছে।
হে মুসলিমগণ! আপনারা সিয়াম বিনষ্টকারী ও তাতে ত্রুটি সৃষ্টিকারী বিষয় থেকে সতর্কতা অবলম্বন করুন এবং মিথ্যা বলা ও তদানুযায়ী কাজ ত্যাগ করে সিয়ামের হক আদায় করুন।
* নবী সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ والجهلَ فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ فِي أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ
‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও মিথ্যার মাধ্যমে আমল করা ও মূর্খতা পরিত্যাগ করতে পারেনি, তার পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’
জাবের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:
إِذَا صُمتَ فَلْيَصُمْ سَمْعُكَ وبصرك ولسانك عن الكذب والمحارم ودع عنك أذى الجار، وليكن عليك وقار وسكينة ولايكن يوم صومك ويوم فطرك سواء
‘যখন তুমি সাওম রাখবে তোমার কর্ণ, চক্ষু, জিহ্বাও যেন মিথ্যা কথা ও সব হারাম বর্জনের মাধ্যমে সাওম পালন করে। তুমি প্রতিবেশিকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকো। অবশ্যই তুমি আত্মসম্মান ও প্রশান্তভাব বজায় রাখবে। আর তোমার সাওমের দিন ও সাওমবিহীন দিন যেন সমান না হয়।’
হে আল্লাহ! আপনি আমাদের জন্য আমাদের দীন রক্ষা করুন, আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলিকে আপনাকে অসন্তুষ্টকারী বিষয়াদি থেকে বিরত রাখুন, আমাদেরকে এবং আমাদের বাবা-মা ও সকল মুসলিমকে আপনার দয়ায় ক্ষমা করুন হে জগতের শ্রেষ্ঠ করুণাময়। আর সালাত ও সালাম বর্ষণ করুন আমাদের নবী মুহাম্মদ, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীর ওপর।
একাদশ আসরঃসিয়ামের মুস্তাহাব আদবসমূহ
সকল প্রশংসা সে আল্লাহর জন্য, যিনি প্রত্যাশাকারীকে প্রত্যাশার ওপরে পৌঁছান এবং প্রার্থনাকারীকে প্রার্থনার বেশি দেন। আমি তাঁর গুণকীর্তন করি হেদায়াত দান ও তা অর্জনের জন্য। আর আমি প্রমাণ ও মূলনীতিসহ জেনে তাঁর তাওহীদের স্বীকৃতি দেই।
সালাত ও সালাম বর্ষণ হতে থাক যতদিন পুব-পশ্চিম ও উত্তর-দক্ষিণে বাতাসের প্রবাহ অব্যাহত থাকবে তাঁর বান্দা ও রাসূল আমাদের নবী মুহাম্মদের ওপর; তাঁর সাথী আবূ বকরের ওপর যিনি সফর ও স্থায়ী সর্বাবস্থায় ছিলেন তাঁর পাশে; উমরের ওপর যিনি এমন নির্ভীকতার সঙ্গে ইসলামের সাহায্য করেছেন যে কোনো খানাখন্দ বা পতনকে ভয় পাননি; উসমানের ওপর যিনি ছিলেন বিপদে অনঢ় ধৈর্যশীল; আলী ইবন আবী তালিবের ওপর যিনি আপন বীরত্ব দিয়ে শত্রুদের সন্ত্রস্ত করেছেন হামলার আগেই এবং তাঁর সকল পরিবার-পরিজন ও সাহাবীর ওপর যারা দীনের মূল ও শাখাগত বিষয়াদিতে প্রতিযোগিতায় অন্যদের হাত থেকে বিজয়টোপর ছিনিয়ে নিয়েছেন।
প্রিয় ভাইয়েরা আমার! এ আসরটি সিয়ামের আদবের দ্বিতীয় প্রকার তথা মুস্তাহাব আদব প্রসঙ্গে। সিয়ামের মুস্তাহাব আদবসমূহের মধ্যে রয়েছে:
সাহরী খাওয়া:
সাহরী বলা হয়, রাতের শেষাংশের খাওয়াকে। একে সাহরী বলার কারণ হচ্ছে এ খাবারটি ‘সাহর’ তথা রাতের শেষাংশে অনুষ্ঠিত হয়।
* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
تَسَحَّرُوا فَإِنَّ فِي السَّحُورِ بَرَكَةً
‘তোমরা সাহরী খাও, কেননা সাহরীতে বরকত নিহিত রয়েছে।’
* সহীহ মুসলিমে ‘আমর ইবন ‘আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
فَصْلُ مَا بَيْنَ صِيَامِنَا وَصِيَامِ أَهْلِ الْكِتَابِ، أَكْلَةُ السَّحَرِ
‘আমাদের ও আহলে কিতাবদের সিয়ামের মধ্যে পার্থক্য হলো সাহরী খাওয়া।’
* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম খেজুর দিয়ে সাহরী গ্রহণের প্রশংসা করে বলেছেন:
نِعْمَ سَحُورُ الْمُؤْمِنِ التَّمْرُ
‘মুমিনদের খেজুর দিয়ে সাহরী গ্রহণ কতই না উত্তম।’
* রাসূল সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন:
السَّحُورُ أَكْلُهُ بَرَكَةٌ فَلَا تَدَعُوهُ وَلَوْ أَنْ يَجْرَعَ أَحَدُكُمْ جُرْعَةً مِنْ مَاءٍ فَإِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى الْمُتَسَحِّرِينَ
‘সাহরী খাওয়া বরকতপূর্ণ। সুতরাং সাহরী পরিত্যাগ করো না, যদিও এক ঢোক পানি পান করে হয়। কারণ আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ সাহরী ভক্ষণকারীর ওপর সালাত পেশ করেন।’
* সাহরী ভক্ষণকারী ব্যক্তির উচিত, সাহরী খাওয়ার ব্যাপারে নিয়ত করে যে, নবী সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ পালন এবং তাঁর নির্দেশের অনুসরণে তা গ্রহণ করছে; যাতে তার সাহরী হয় ইবাদত। তাছাড়া আরও নিয়ত করবে যে, সাহরী খাওয়ার মাধ্যমে সে সাওম পালনে সামর্থ্য হবে; যাতে করে এর দ্বারা সাওয়াব অর্জিত হয়।
* সুন্নাত হচ্ছে সুবহে সাদিক উদয়ের আগ পর্যন্ত বিলম্ব করে সাহরী খাওয়া। কেননা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনই করতেন।
* কাতাদা রহ. আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন,
أَنَّ نَبِيَّ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَزَيْدَ بْنَ ثَابِتٍ: تَسَحَّرَا فَلَمَّا فَرَغَا مِنْ سَحُورِهِمَا، قَامَ نَبِيُّ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى الصَّلاَةِ، فَصَلَّى، قُلْنَا لِأَنَسٍ: كَمْ كَانَ بَيْنَ فَرَاغِهِمَا مِنْ سَحُورِهِمَا وَدُخُولِهِمَا فِي الصَّلاَةِ؟ قَالَ: قَدْرُ مَا يَقْرَأُ الرَّجُلُ خَمْسِينَ آيَةً
‘আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও যায়েদ ইবন সাবেত সাহরী গ্রহণ করলেন। যখন সাহরী গ্রহণ করা শেষ করার পর আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘সালাতের দিকে’ (চল)। তারপর তিনি সালাত আদায় করলেন। আমরা আনাসকে বললাম, তাঁদের সাহরী শেষ করা ও সালাতে প্রবেশ করার মধ্যে কত সময় ছিল? তিনি বললেন, ‘একজন লোক পঞ্চাশ আয়াত পড়ার মত সময়’।
* ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, বেলাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাত থাকতেই আযান দিতেন; তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
كُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يُؤَذِّنَ ابْنُ أُمِّ مَكْتُومٍ، فَإِنَّهُ لاَ يُؤَذِّنُ حَتَّى يَطْلُعَ الفَجْرُ
‘আব্দুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম আযান না দেয়া পর্যন্ত তোমরা পানাহার কর। কেননা সে সুবহে সাদিক উদয়ের পরই আযান দেয়।’
* বিলম্ব করে সাহরী খাওয়া সিয়াম পালনকারীর জন্য অধিক উপকারী ও ফজরের সালাত আদায় করার পূর্বে ঘুমিয়ে যাওয়া থেকে অধিক নিরাপদ। সাহরী খাওয়া ও সাওমের নিয়ত করার পরও দৃঢ়ভাবে সুবহে সাদিকের সময় প্রবেশ করা পর্যন্ত সাওম পালনকারীর জন্য পানাহার করার অধিকার রয়েছে।
* কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَكُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكُمُ ٱلۡخَيۡطُ ٱلۡأَبۡيَضُ مِنَ ٱلۡخَيۡطِ ٱلۡأَسۡوَدِ مِنَ ٱلۡفَجۡرِ﴾ [البقرة: ١٨٧]
“আর তোমরা পানাহার কর যতক্ষণ রাতের কালোরেখা থেকে ঊষার সাদা রেখা স্পষ্টরূপে তোমাদের নিকট প্রকাশ না হয়”। [সূরা আল-বাকারাহ: ১৮৭]
* আর সুবহে সাদিক উদিত হওয়ার বিষয়টি নির্ধারিত হবে: সরাসরি আকাশের প্রান্তদেশ প্রত্যক্ষ করার মাধ্যমে অথবা নির্ভরযোগ্য সংবাদের মাধ্যমে যেমন আযান ইত্যাদি দ্বারা। অতঃপর যখন সুবহে সাদিক উদিত হবে তখনই (পানাহার ইত্যাদি থেকে) বিরত থাকবে, আর মনে মনে নিয়ত করবে, তবে কোনোভাবেই মুখে নিয়ত উচ্চারণ করা যাবে না; কারণ নিয়ত উচ্চারণ করা বিদ‘আত।
সিয়ামের মুস্তাহাব আদবের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, তাড়াতাড়ি ইফতার করা:
প্রত্যক্ষ করার মাধ্যমে সূর্যাস্ত সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া অথবা আযান বা অনুরূপ নির্ভরযোগ্য সংবাদের মাধ্যমে সূর্যাস্তের বিষয়ে প্রবল ধারণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইফতার করা।
* সাহ্‌ল ইবন সা‘দ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
لاَ يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجَّلُوا الفِطْرَ
‘মানুষ যতক্ষণ তাড়াতাড়ি ইফতার করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কল্যাণের মধ্যে থাকবে।’
* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীসে কুদসীতে বর্ণনা করেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
إِنَّ أَحَبَّ عِبَادِي إِلَيَّ أَعْجَلُهُمْ فِطْرًا.
‘তারা আমার সর্বাধিক প্রিয় বান্দা, যারা তাড়াতাড়ি ইফতার করে।’
* আর সুন্নাত হচ্ছে, কাঁচা খেজুর দ্বারা ইফতার করা। কাঁচা খেজুর না পাওয়া গেলে শুকনো খেজুর দ্বারা ইফতার করবে। আর যদি তাও না পাওয়া যায় তাহলে পানি দ্বারা ইফতার করবে। কারণ, আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন –
كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُفْطِرُ قَبْلَ أَنْ يُصَلِّيَ عَلَى رُطَبَاتٍ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ رُطَبَاتٌ تمرَاتٌ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تُمرَاتٌ حَسَا حَسَوَاتٍ مِنْ مَاءٍ
“নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাগরিব নামায আদায়ের পূর্বে কিছু কাঁচা খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। যদি কাঁচা খেজুর না থাকতো তাহলে শুকনো খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। যদি শুকনো খেজুর না থাকতো তাহলে কয়েক ঢোক পানি দ্বারা ইফতার করতেন।”
যদি কোনো কাঁচা খেজুর, শুকনো খেজুর ও পানি না পাওয়া যায় তাহলে হালাল খাদ্য ও পানীয় যা সহজে মিলে তা দ্বারা-ই ইফতার করবে। যদি কোনো কিছুই না পাওয়া যায় তাহলে অন্তরে ইফতারের নিয়ত করবে।
তবে তার আঙ্গুল চুষবে না এবং মুখে লালা জমা করে গিলে ফেলবে না। যেমনটি কোনো কোনো সাধারণ লোকেরা করে থাকে!!
* ইফতারের সময় পছন্দনীয় দো‘আ করা উচিত:
* কেননা সুনান ইবন মাজায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন:
إنَّ لِلصَّائِمِ عِنْدَ فِطْرِهِ دَعْوَةٌ مَا تُرَدُّ
‘নিশ্চয়ই ইফতারের সময় সিয়াম পালনকারীর একটি দো‘আ রয়েছে যা ফেরত দেওয়া হয় না।’
* অনুরূপ আবু দাউদ মু‘আয ইবন যাহরা থেকে মুরসাল সনদে বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইফতার করার সময় এই দো‘আ পড়তেন:
اللَّهُمَّ لَكَ صُمْتُ، وَعَلَى رِزْقِكَ أَفْطَرْتُ
‘হে আল্লাহ! আমি আপনারই জন্য সিয়াম পালন করলাম ও আপনার দেয়া রিযিক দিয়ে ইফতার করলাম।’
* আবু দাউদ অনুরূপভাবে ‘আব্দুল্লাহ ইবন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইফতার করার সময় বলতেন:
ذَهَبَ الظَّمَأُ وَابْتَلَّتِ الْعُرُوقُ، وَثَبَتَ الْأَجْرُ إِنْ شَاءَ اللَّهُ
‘পিপাসা দূর হলো, শিরা-উপশিরা সতেজ হলো এবং আল্লাহর ইচ্ছায় প্রতিদান প্রতিষ্ঠিত হলো।’
সিয়ামের মুস্তাহাব আদবের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, বেশি করে কুরআন তিলাওয়াত করা, যিকির করা, দো‘আ করা, সালাত আদায় করা ও দান-সাদকা করা।
* হাদীসে এসেছে,
ذَاكِرُ اللَّهِ فِي رَمَضَانَ مَغْفُورٌ لَهُ
“রমযানে যে আল্লাহর যিকির করবে, সে ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে।”
* অনুরূপভাবে সহীহ ইবনে খুযাইমা ও ইবনে হিব্বান গ্রন্থে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
ثَلَاثَةٌ لَا تُرَدُّ دَعْوَتُهُمْ: الصَّائِمُ حَتَّى يُفْطِرَ، وَالإِمَامُ العَادِلُ، وَدَعْوَةُ المَظْلُومِ يَرْفَعُهَا اللَّهُ فَوْقَ الغَمَامِ وَيَفْتَحُ لَهَا أَبْوَابَ السَّمَاءِ وَيَقُولُ الرَّبُّ: وَعِزَّتِي وَجَلَالِي لَأَنْصُرَنَّكِ وَلَوْ بَعْدَ حِينٍ
“তিন ব্যক্তির দো‘আ ফেরত দেওয়া হয় না। (১) রোযাদার ব্যক্তি ইফতার করা পর্যন্ত, (২) ন্যায়পরায়ণ ইমাম বা রাষ্ট্রপতি, (৩) মযলুম ব্যক্তির দো‘আ। তার দো‘আ আল্লাহ আকাশে মেঘমালার উপরে তুলে নেন এবং এর জন্য আকাশের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয় এবং মহান রব বলেন, আমার ইয্‌যত ও মাহাত্ম্যের কসম করে বলছি, অবশ্যই আমি তোমাকে সাহায্য করবো, কিছু সময় পর হলেও।”
* তাছাড়া বুখারী ও মুসলিমে ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَجْوَدَ النَّاسِ، وَكَانَ أَجْوَدُ مَا يَكُونُ فِي رَمَضَانَ حِينَ يَلْقَاهُ جِبْرِيلُ، وَكَانَ يَلْقَاهُ فِي كُلِّ لَيْلَةٍ مِنْ رَمَضَانَ فَيُدَارِسُهُ القُرْآنَ، فَلَرَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَجْوَدُ بِالخَيْرِ مِنَ الرِّيحِ المُرْسَلَةِ
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের মধ্যে বেশি দানশীল ছিলেন। আর রমযান মাসে তিনি আরো বেশি দানশীল হয়ে যেতেন; যখন জিব্রাইল (‘আলাইহিস সালাম) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করতেন। জিব্রাইল রমযানের প্রতি রাতে তার সাথে সাক্ষাত করে পরস্পরে কুরআন পড়তেন, তখন তিনি প্রবাহিত বায়ুর চেয়েও অধিক হারে দান করতেন।’
* আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের দান ছিল সার্বিক ও সবধরণের। যেমন আল্লাহর দ্বীনকে সমুন্নত করা ও আল্লাহর বান্দাদের পথপ্রদর্শনের জন্য জ্ঞান, জান ও মাল ব্যয় করা। অনুরূপভাবে আল্লাহর বান্দাদের কাছে সব রকমের কল্যাণ পৌঁছে দেওয়ার জন্য যত পথ ও পদ্ধতি রয়েছে সবই তিনি অবলম্বন করতেন, যেমন মূর্খদের জ্ঞানদান, তাদের অভাব-অভিযোগ পূরণ, তাদের মধ্যকার ক্ষুধার্তদের আহার প্রদান। আর তাঁর দান রমযানে বহুগুণ বেড়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে, সময়ের মর্যাদা সম্পর্কে সচেতনতা, সওয়াবের পরিমানে বর্ধিত হওয়া। তাছাড়া ইবাদতকারীদের ইবাদতে সহযোগিতা করাও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। এভাবে তিনি সাওম ও খাবার খাওয়ানো এ দু’টি কাজকে একসাথে করতেন, এ দুটো কাজই জান্নাতে প্রবেশের অন্যতম মাধ্যম।
* অনুরূপভাবে সহীহ মুসলিমে আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার সাহাবীদের লক্ষ্য করে বললেনঃ
مَنْ أَصْبَحَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ صَائِمًا؟قَالَ أَبُو بَكْرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ: أَنَا، قَالَ: فَمَنْ تَبِعَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ جَنَازَةً؟قَالَ أَبُو بَكْرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ: أَنَا، قَالَ: فَمَنْ أَطْعَمَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ مِسْكِينًا؟قَالَ أَبُو بَكْرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ: أَنَا، قَالَ: فَمَنْ عَادَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ مَرِيضًا؟قَالَ أَبُو بَكْرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ: أَنَا، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَا اجْتَمَعْنَ فِي امْرِئٍ، إِلَّا دَخَلَ الْجَنَّةَ
“তোমাদের মধ্যে কে আজ সাওম অবস্থায় প্রত্যুষে উপনীত হয়েছ? আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, আমি। রাসূল বললেন, তোমাদের মধ্যে কে আজ জানাযার সালাতে শরীক হয়ে জানাযার পিছু নিয়েছো? আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু উত্তরে বললেন, আমি। রাসূল বললেন, তোমাদের মধ্যে কে আজ একজন মিসকীনকে খাইয়েছ? আবু বকর বললেন, আমি। রাসূল বললেন, তোমাদের মধ্যে কে আজ একজন রোগীর সেবা করেছ? আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমি। তখন রাসূলুল্লাহ্ ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বললেন, “যে ব্যক্তির মধ্যে এসব গুণ গুলো মিলিত হয়েছে সে অবশ্য-ই জান্নাতে যাবে।”
সিয়ামের মুস্তাহাব আদবের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামতের কথা অন্তরে সদা জাগরুক রাখা।
সিয়ামের মুস্তাহাব আদবসমূহের অন্যতম হলো, সিয়াম পালনকারী সিয়াম পালনের মাধ্যমে আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের কথা সর্বদা স্মরণ করবে; যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা তাকে সিয়াম পালনের তাওফীক দিয়েছেন, তার জন্য সহজ করে দিয়েছেন, ফলে সে এ দিনের সিয়াম পূর্ণ করতে পেরেছে, এ মাসের সিয়াম পুরোপুরিভাবে আদয় করতে পেরেছে। কারণ, এমন অনেক লোক রয়েছে যারা সিয়াম পালনের নে‘আমত থেকে মাহরূম হয়েছে, তাদের কেউ কেউ প্রাপ্ত বয়স্ক হবার পূর্বে মারা গেছে, আবার কেউ ছিল সিয়াম পালনে অক্ষম, আবার তাদের কেউ পথভ্রষ্টতা ও দ্বীন বিমুখিতার ফলে সিয়াম পালন করতে পারেনি।
তাই সিয়াম পালনকারীর উচিত হলো এ নেয়ামতের জন্য আল্লাহর প্রশংসা করা; যা গোনাহের ক্ষমা, মন্দ-পাপাচার থেকে মুক্তি, স্থায়ী নে‘আমতপূর্ণ দারুন না‘ঈম জান্নাতে মহান সম্মানিত রবের পাশে থাকার মত সুউচ্চ মর্যাদা লাভের মাধ্যম।
ভাইয়েরা আমার! সিয়ামের আদবগুলো রক্ষা করুন। আর (আল্লাহর) গযব (ক্রোধ) ও শাস্তির কারণগুলো থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখুন। সালাফে সালেহীন তথা সৎকর্মশীল পূর্বসুরীদের গুণে গুণান্বিত হোন, কেননা পূর্ববর্তীরা যেভাবে আল্লাহর আনুগত্য করে এবং পাপাচার থেকে বিরত থেকে সংশোধিত হয়েছিলেন, শেষ যামানার উম্মতদেরও সে একই পদ্ধতিতে সংশোধিত হতে হবে।
* ইবন রজব রহ. বলেন, সিয়াম পালনকারীরা দুস্তরে বিভক্ত:
প্রথম স্তর: ওই সকল লোক, যারা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য স্বীয় পানাহার ও কামপ্রবৃত্তি ত্যাগ করে এবং জান্নাতে তার বিনিময় আশা করে। তিনি তো আল্লাহ তা‘আলার সঙ্গে ব্যবসা করেছেন ও লেন-দেন করেছেন। আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদের প্রতিদান কখনও নষ্ট করেন না, যে তাঁর সাথে লেনদেন করবে সে কখনও আশাহত হবে না বরং সবচেয়ে বড় ধরনের লাভে ধন্য হবে।
* একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক লোককে উদ্দেশ করে বললেন:
إِنَّكَ لَنْ تَدَعَ شَيْئًا اتِّقَاءً لِلَّهِ، إِلَّا آتَاكَ اللَّهُ خَيْرًا مِنْهُ
‘নিশ্চয় তুমি যা কিছুই আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বনের কারণে পরিত্যাগ করবে, তার চেয়েও উত্তম বস্তু তিনি তোমাকে প্রদান করবেন।’
এ ধরনের সিয়াম পালনকারীর চাহিদা মত আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতে তাকে শ্রেষ্ঠতম খাদ্য-পানীয় ও স্ত্রী দান করবেন।
* আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন:
﴿كُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ هَنِيٓ‍َٔۢا بِمَآ أَسۡلَفۡتُمۡ فِي ٱلۡأَيَّامِ ٱلۡخَالِيَةِ ٢٤ ﴾ [الحاقة: ٢٤]
‘(বলা হবে) ‘বিগত দিনসমূহে তোমরা যা অগ্রে প্রেরণ করেছ তার বিনিময়ে তোমরা তৃপ্তি সহকারে খাও ও পান কর।’ {সূরা আল-হাক্কাহ্‌, আয়াত: ২৪}
* মুজাহিদ রহ. সহ আরো অনেকে বলেন, এ আয়াত সিয়াম পালনকারীদের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে।
* আব্দুর রহমান ইবন সামুরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণিত হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বপ্নে দেখেছেন:
وَرَأَيْتُ رَجُلًا مِنْ أُمَّتِي يَلْهَثُ عَطَشًا كُلَّمَا دَنَا مِن حَوْضٍ مُنِعَ وطُرِدَ، فَجَاءَهُ صِيَامُ رَمَضَانَ فَسَقَاهُ وَأَرْوَاهُ
‘আর আমি আমার উম্মতের এক লোককে দেখতে পেলাম সে পিপাসায় জিহ্বা বের করে হাঁপাচ্ছে। যখন সে পানি পানের জন্য হাউজের কাছে যায়, তখন তাকে সেখানে বাধা দেয়া হয় এবং সে ওখান থেকে বিতাড়িত হয়। অতঃপর তার কাছে রমযানের সিয়াম এসে উপস্থিত হলো এবং তাকে পানি পান করিয়ে তৃপ্ত করালো।’
হে আমার জাতি! এ রমযানে আল্লাহ তা‘আলার সঙ্গে (কুরআন তিলাওয়াত ও নফল সালাতের মাধ্যমে) কথা বলার কি কেউ নেই?
তাঁর অনুগত বান্দাদের জন্য জান্নাতে সংরক্ষিত নেয়ামতরাজির প্রতি আগ্রহী কি কেউ নেই?
কবির ভাষায় বলতে হয়:
مَنْ يُرِدْ مُلْكَ الْجِنَانِ فلْيَدعْ عنه التواني
ولْيَقْم في ظُلمةِ اللي لِ إلى نورِ القُرآنِ
ولْيَصِلْ صوماًبصومٍ إن هذا العَيشَ فَانِ
إنَّما العيشُ جِوارُ الله في دارِ الأمانِ
যে হতে চায় জান্নাতের মালিক সে যেন ছাড়ে অবহেলা
সে যেন দাঁড়ায় রাতের আঁধারে কুরআনের আলো নিয়ে
সে যেন পর্যায়ক্রমে পালন করে সিয়াম নিশ্চয় এ জীবন নশ্বর
প্রকৃত জীবন হলো আল্লাহর প্রতিবেশীত্বে জান্নাতের বাড়ীতে।
সিয়াম পালনকারীদের দ্বিতীয় স্তর: এমন কিছু লোক রয়েছে, যারা আল্লাহ ব্যতীত পার্থিব সব কিছু ছেড়ে বিরত থাকার সাওম পালন করে। তারা মস্তিষ্ককে মন্দ চিন্তা থেকে এবং উদরকে পূর্ণ খাবার মুক্ত রাখে। মৃত্যু ও মৃত্যুর পর পঁচে-গলে যাবার কথা স্মরণ করে এবং আখিরাতের উদ্দেশে দুনিয়ার সৌন্দর্য ত্যাগ করে। এমন লোকের জন্যই তো তার রবের সাথে সাক্ষাত ও তাঁর দর্শন লাভ হবে প্রকৃত ‘ঈদুল ফিতর’।
কবি বলেন,
‘বিশেষ (প্রকৃত) সিয়াম পালনকারীদের সিয়াম হলো, জিহ্বাকে মিথ্যা বলা ও অপবাদ দেয়া থেকে বিরত রাখা।
আল্লাহর সাধক ও সান্নিধ্যে ধন্য ব্যক্তিদের সিয়াম হলো, অন্তরকে অন্য কারো অনুপ্রবেশ ও তাঁর পর্দা থেকে হেফাযত করা।
আল্লাহর পরিচয় প্রাপ্তগণকে পার্থিব জগতের সুরম্য অট্টালিকা স্বীয় রবের দর্শনের বিপরীতে প্রশান্তি দিতে পারে না। তাঁর দর্শন ছাড়া কোনো ঝর্ণাধারা তাদের পরিতৃপ্ত করতে পারে না। তাদের চিন্তা-চেতনা চাওয়া-পাওয়া এগুলো থেকে অনেক মহৎ।
যে ব্যক্তি আল্লাহর আদেশ পালনার্থে আজ দুনিয়াতে প্রবৃত্তির চাহিদা থেকে বিরত রাখার সাওম পালন করবে, আগামীকাল জান্নাতে সে ঐসব চাহিদা লাভ করবে, আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অপর সব কিছু থেকে নিজেকে বিরত রাখার সাওম পালন করবে, তার ঈদ বা খুশী তো সেদিন হবে যে দিন সে আল্লাহর সাক্ষাত লাভ করবে।
﴿مَن كَانَ يَرۡجُواْ لِقَآءَ ٱللَّهِ فَإِنَّ أَجَلَ ٱللَّهِ لَأٓتٖۚ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡعَلِيمُ ٥ ﴾ [العنكبوت: ٥]
‘যে আল্লাহর সাক্ষাৎ কামনা করে (সে জেনে রাখুক) নিশ্চয় আল্লাহর নির্ধারিত কাল আসবে। আর তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী।’ {সূরা আল-‘আনকাবূত, আয়াত: ৫}
তাই হে তাওবাকারীগণ! আজ প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে সিয়াম পালন করুন, তাহলে প্রতিপালকের সাক্ষাতের দিন ঈদুল ফিতরের আনন্দ উপভোগ করতে পারবেন।
হে আল্লাহ! আপনার প্রতি নিষ্ঠা সৃষ্টি করে আমাদের অন্তরলোককে সৌন্দর্যমণ্ডিত করুন এবং আমাদের আমলগুলোকে আপনার রাসূলের আনুগত্য আর তাঁর আদব অনুকরণের মাধ্যমে সুষমামণ্ডিত করুন।
হে আল্লাহ! আমাদের আলস্যের নিদ্রা থেকে জাগিয়ে দিন, অধঃপতন থেকে রক্ষা করুন এবং আমাদের অপরাধ ও পাপরাশি ক্ষমা করুন। হে শ্রেষ্ঠ দয়াময়! আপনার দয়ায় আমাদেরকে, আমাদের পিতামাতা ও জীবিত-মৃত সকল মুসলিমকে ক্ষমা করে দিন। আর সালাত ও সালাম বর্ষণ করুন আমাদের নবী মুহাম্মদ, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীর ওপর।
দ্বাদশ আসরঃকুরআন তিলাওয়াতের দ্বিতীয় প্রকার
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি অজস্র দানকারী তার জন্য যে তাঁর আনুগত্য করে এবং তাঁর কাছে প্রত্যাশা করে; যিনি কঠোর শাস্তি প্রদানকারী যে তার যিকর থেকে থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং তাঁর অবাধ্যাচরণ করে। নিজ দয়ায় তিনি যাকে চান নির্বাচিত করে কাছে টেনে নেন এবং নৈকট্য দান করেন আবার নিজ ইনসাফের ভিত্তিতেই তিনি যাকে চান দূরে ঠেলে দেন ফলে তাকে সেদিকেই ফিরিয়ে দেন যেদিকে সে ফিরতে চায়। তিনি নাযিল করেছেন কুরআন সৃষ্টিকুলের জন্য রহমতস্বরূপ এবং পথিকদের জন্য আলোকবর্তিকা হিসেবে, সুতরাং যে একে আঁকড়ে ধরবে সে তার লক্ষ্যে পৌঁছবে, আর যে এর সীমারেখা অতিক্রম করে এবং অধিকার বিনষ্ট করে, সে তার দুনিয়া ও আখিরাত সবই হারায়।
আমি তাঁর প্রশংসা করি তিনি যত অনুগ্রহ ও দান করেছেন তার ওপর। তাঁর শুকরিয়া আদায় করি দীনী ও দুনিয়াবী সব নেয়ামতের ওপর। আর শুকরিয়াকারী কত অধিক লাভের যোগ্য হয় ও কত অধিকপ্রাপ্ত হয়!
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এক আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই; তিনি তাঁর গুণাবলিতে পরিপূর্ণ, সমকক্ষতা ও সাদৃশ্যতা থেকে বহু উর্ধ্বে। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসূল, যাকে তিনি সকল সৃষ্টির মধ্য নির্বাচিত ও মনোনীত করেছেন।
আল্লাহ সালাত পেশ করুন তাঁর ওপর, তাঁর পরিবার-পরিনজন, সাহাবী ও অনাগত সকল সুন্দর অনুসারীর ওপর- যতদিন প্রভাত ফুটে বের হবে এবং তার কিরণ আলোকিত করবে। আর যথাযথ সালামও তাদের প্রতি বর্ষণ করুন।
আমার ভাইয়েরা!
পঞ্চম আসরে আলোচিত হয়েছে যে, কুরআন তিলাওয়াত দুই প্রকার:
প্রথমত: কুরআনের শাব্দিক পঠন, যার আলোচনা ইতোপূর্বে করা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত: হুকমী বা প্রায়োগিক পঠন অর্থাৎ কুরআনের বিধানকে তেলাওয়াত করা। আর তার অর্থ হচ্ছে, কুরআনপ্রদত্ত যাবতীয় সংবাদকে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করা, সকল আদিষ্ট বিষয় পালন ও নিষিদ্ধ বিষয় পরিত্যাগ করার মাধ্যমে তার বিধানাবলিকে মেনে নেওয়া।
বস্তুত এ প্রকারই হচ্ছে কুরআন নাযিলের বৃহত্তম লক্ষ্য। যেমন,
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿كِتَٰبٌ أَنزَلۡنَٰهُ إِلَيۡكَ مُبَٰرَكٞ لِّيَدَّبَّرُوٓاْ ءَايَٰتِهِۦ وَلِيَتَذَكَّرَ أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَٰبِ ٢٩ ﴾ [ص: ٢٩]
‘আমরা আপনার প্রতি নাযিল করেছি এক বরকতময় কিতাব, যাতে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং যাতে বুদ্ধিমানগণ উপদেশ গ্রহণ করে।’ {সূরা সোয়াদ, আয়াত: ২৯}
এ জন্য সালাফে সালেহীন রহ. কুরআন তিলাওয়াতের এ পদ্ধতির উপর চলে কুরআন শিক্ষা করেছেন, এর উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছেন এবং মজবুত আক্বীদা-বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে এর যাবতীয় বিধানাবলিকে ইতিবাচক ধারায় বাস্তবায়িত করেছেন। আবূ আব্দুর রহমান আসসুলামী রহ. বলেন:
حدَّثَنا الذين كانوا يُقرِؤوننا القرآن، عثمان بنُ عفانَ وعبدُالله بنُ مسعودٍ، وغيرهما، أنَّهم كانَوا إذا تعلَّمُوا منَ النبيِّ صلى الله عليه وسلّم عَشرَ آياتٍ لم يتجاوزوها حتى يتعلَّموها وما فِيها من الْعلْم والْعَمَل، قالوا: فَتعلَّمنَا القرآنَ والعلمَ والعملَ جميعاً.
‘উসমান ইবন আফ্ফান, আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ প্রমুখ যারা আমাদেরকে কুরআন শিক্ষা দিতেন তারা বলেছেন, তারা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে দশটি আয়াত শিখতেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তা ভালোভাবে না শিখতেন ও তাতে যে সকল জ্ঞান ও আমল করার কথা রয়েছে তা বাস্তবায়ণ না করতেন ততক্ষণ পর্যন্ত সামনে অগ্রসর হতেন না। তারা বলেন, আমরা এভাবেই কুরআন, জ্ঞান ও আমল সবই শিখেছি।”
আর এটাই হলো কুরআন তিলাওয়াতের ওই প্রকার যার ওপর সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য নির্ভর করে।’
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَإِمَّا يَأۡتِيَنَّكُم مِّنِّي هُدٗى فَمَنِ ٱتَّبَعَ هُدَايَ فَلَا يَضِلُّ وَلَا يَشۡقَىٰ ١٢٣ وَمَنۡ أَعۡرَضَ عَن ذِكۡرِي فَإِنَّ لَهُۥ مَعِيشَةٗ ضَنكٗا وَنَحۡشُرُهُۥ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ أَعۡمَىٰ ١٢٤ قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرۡتَنِيٓ أَعۡمَىٰ وَقَدۡ كُنتُ بَصِيرٗا ١٢٥ قَالَ كَذَٰلِكَ أَتَتۡكَ ءَايَٰتُنَا فَنَسِيتَهَاۖ وَكَذَٰلِكَ ٱلۡيَوۡمَ تُنسَىٰ ١٢٦ وَكَذَٰلِكَ نَجۡزِي مَنۡ أَسۡرَفَ وَلَمۡ يُؤۡمِنۢ بِاَرَيَٰتِ رَبِّهِۦۚ وَلَعَذَابُ ٱلۡأٓخِرَةِ أَشَدُّ وَأَبۡقَىٰٓ ١٢٧ ﴾ [طه: ١٢٣، ١٢٧]
‘অতঃপর যখন তোমাদের কাছে আমার পক্ষ থেকে হিদায়াত আসবে, তখন যে আমার হিদায়াতের অনুসরণ করবে সে বিপথগামী হবে না এবং দুর্ভাগাও হবে না। আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জন্য হবে নিশ্চয় এক সংকুচিত জীবন এবং আমি তাকে কিয়ামত দিবসে উঠাবো অন্ধ অবস্থায়। সে বলবে, ‘হে আমার রব, কেন আপনি আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন? অথচ আমি তো ছিলাম দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন? তিনি বলবেন, ‘এমনিভাবেই তোমার নিকট আমার নিদর্শনাবলি এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবেই আজ তোমাকে ভুলে যাওয়া হল। আর এভাবেই আমি প্রতিফল দান করি তাকে, যে বাড়াবাড়ি করে এবং তার রবের নিদর্শনাবলিতে ঈমান আনে না। আর আখিরাতের আযাব তো অবশ্যই কঠোরতর ও অধিকতর স্থায়ী।’ {সূরা ত্ব-হা, আয়াত: ১২৩-১২৭}
এ আয়াতসমূহে আল্লাহ তা‘আলা যা যা বর্ণনা করেছেন তা হলো:
– রাসূলগণের নিকট পাঠানো হেদায়াত অনুসরণকারীদের প্রতিদান। আর সে মহান হেদায়াত হলো, আল-কুরআন। সঙ্গে সঙ্গে হেদায়াত বিমুখদের শাস্তির কথাও বর্ণনা করেছেন। হেদায়াত অনুসারীদের বড় প্রাপ্তি হল তারা পথভ্রষ্ট হবে না ও দুর্ভাগা হবে না। তাদের থেকে ভ্রষ্টতা ও দুর্ভাগ্য দূর করার অর্থ হচ্ছে তাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতের সৌভাগ্য ও পূর্ণ হেদায়াত সাব্যস্ত করা।
– পক্ষান্তরে অহংকারবশত কুরআন নির্দেশিত আমল বিমুখদের শাস্তি হল, দুনিয়া ও আখেরাতে তারা দুর্ভাগা ও হতভাগা হওয়া। তাদের জীবন হবে খুবই সংকীর্ণ।
সে দুনিয়াতে: দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা তথা সমস্যা সঙ্কুল অবস্থায় থাকবে। তার কোনো বিশুদ্ধ আকীদা নেই, নেই কোনো সৎ আমল।
﴿أُوْلَٰٓئِكَ كَٱلۡأَنۡعَٰمِ بَلۡ هُمۡ أَضَلُّۚ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡغَٰفِلُونَ﴾ [الاعراف: ١٧٩]
‘তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত; বরং তারা অধিক পথভ্রষ্ট। তারাই হচ্ছে গাফেল।’ {সূরা আল-‘আরাফ, আয়াত: ১৭৯}
আর সে কবরে: থাকবে সংকীর্ণ অবস্থায়। তার কবর হবে সংকুচিত। এমনকি তার এক পাঁজরের হাড় অন্য পাঁজরে মিলে যাবে। আর সে হাশরের দিন হবে অন্ধ, ফলে কিছুই দেখতে পাবে না।
﴿وَنَحۡشُرُهُمۡ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ عَلَىٰ وُجُوهِهِمۡ عُمۡيٗا وَبُكۡمٗا وَصُمّٗاۖ مَّأۡوَىٰهُمۡ جَهَنَّمُۖ كُلَّمَا خَبَتۡ زِدۡنَٰهُمۡ سَعِيرٗا ٩٧ ﴾ [الاسراء: ٩٧]
‘আর আমি কিয়ামতের দিনে তাদেরকে একত্র করব উপুড় করে, অন্ধ, মূক ও বধির অবস্থায়। তাদের আশ্রয়স্থল জাহান্নাম; যখনই তা নিস্তেজ হবে তখনই আমি তাদের জন্য আগুন বাড়িয়ে দেব।’ {সূরা বানী ইসরাঈল, আয়াত: ৯৭}
তারা যেহেতু দুনিয়াতে সত্যের ব্যাপারে অন্ধ, সত্য শ্রবণ থেকে বধির ও সত্য বলা থেকে বিরত ছিল, আর তারা বলত:
﴿قُلُوبُنَا فِيٓ أَكِنَّةٖ مِّمَّا تَدۡعُونَآ إِلَيۡهِ وَفِيٓ ءَاذَانِنَا وَقۡرٞ وَمِنۢ بَيۡنِنَا وَبَيۡنِكَ حِجَابٞ﴾ [فصلت: ٥]
‘আপনি আমাদেরকে যার প্রতি আহ্বান করছেন সে বিষয়ে আমাদের অন্তরসমূহ আচ্ছাদিত, আমাদের কানের মধ্যে রয়েছে বধিরতা আর আপনার ও আমাদের মধ্যে রয়েছে অন্তরায়।’ {সূরা ফুসসিলাত, আয়াত: ৫} সেহেতু আল্লাহ তা‘আলা আখিরাতে তাদেরকে সেরূপ প্রতিদানই দেবেন যেরূপ তারা দুনিয়াতে করেছিল। আর আল্লাহ তাদেরকে ওইভাবে ধ্বংস করবেন, যেভাবে তারা আল্লাহর শরীয়তকে ধ্বংস করেছে।
﴿قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرۡتَنِيٓ أَعۡمَىٰ وَقَدۡ كُنتُ بَصِيرٗا ١٢٥ قَالَ كَذَٰلِكَ أَتَتۡكَ ءَايَٰتُنَا فَنَسِيتَهَاۖ وَكَذَٰلِكَ ٱلۡيَوۡمَ تُنسَىٰ ١٢٦ ﴾ [طه: ١٢٥، ١٢٦]
‘সে বলবে, ‘হে আমার রব, কেন আপনি আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন? অথচ আমি তো ছিলাম দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন? তিনি বলবেন, ‘এমনিভাবেই তোমার নিকট আমার নিদর্শনাবলী এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবেই আজ তোমাকে ভুলে যাওয়া হল।’ {সূরা ত্ব হা, আয়াত: ১২৫-১২৬}
﴿ جَزَآءٗ وِفَاقًا ٢٦ ﴾ [النبا: ٢٦]
‘উপযুক্ত প্রতিফলস্বরূপ।’ {সূরা আন-নাবা’, আয়াত: ২৬}
﴿وَمَن جَآءَ بِٱلسَّيِّئَةِ فَلَا يُجۡزَى ٱلَّذِينَ عَمِلُواْ ٱلسَّيِّ‍َٔاتِ إِلَّا مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ﴾ [القصص: ٨٤]
‘আর কেউ পাপ নিয়ে আসলে তবে যারা মন্দকর্ম করেছে তাদের শুধু তারই প্রতিদান দেওয়া হবে যা তারা করেছে।’ {সূরা আল-ক্বাসাস, আয়াত: ৮৪}
* সহীহ বুখারীতে সামুরা ইবন জুনদুব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনো সালাত আদায় করতেন (অন্য বর্ণনায় এসেছে, যখন ফজরের সালাত আদায় করতেন) তখন তিনি আমাদের দিকে মুখ করে বসতেন এবং জিজ্ঞাসা করতেন,
مَنْ رَأَى مِنْكُمُ اللَّيْلَةَ رُؤْيَا؟قَالَ: فَإِنْ رَأَى أَحَدٌ قَصَّهَا، فَيَقُولُ: مَا شَاءَ اللَّهُفَسَأَلَنَا يَوْمًا فَقَالَ: هَلْ رَأَى أَحَدٌ مِنْكُمْ رُؤْيَا؟قُلْنَا: لاَ، قَالَ: لَكِنِّي رَأَيْتُ اللَّيْلَةَ رَجُلَيْنِ أَتَيَانِي (فساق الحديث وفيه) فَانْطَلَقْنَا حَتَّى أَتَيْنَا عَلَى رَجُلٍ مُضْطَجِعٍ، وَإِذَا آخَرُ قَائِمٌ عَلَيْهِ بِصَخْرَةٍ، وَإِذَا هُوَ يَهْوِي بِالصَّخْرَةِ لِرَأْسِهِ فَيَثْلَغُ رَأْسَهُ، فَيَتَدَهْدَهُ الحَجَرُ هَا هُنَا، فَيَتْبَعُ الحَجَرَ فَيَأْخُذُهُ، فَلاَ يَرْجِعُ إِلَيْهِ حَتَّى يَصِحَّ رَأْسُهُ كَمَا كَانَ، ثُمَّ يَعُودُ عَلَيْهِ فَيَفْعَلُ بِهِ مِثْلَ مَا فَعَلَ المَرَّةَ الأُولَىقَالَ: ” قُلْتُ لَهُمَا: سُبْحَانَ اللَّهِ مَا هَذَا؟ ” قَالَ: ” قَالاَ لِي: انْطَلِقِ انْطَلِقْ ” (فذكر الحديث وفيه) أَمَّا الرَّجُلُ الأَوَّلُ الَّذِي أَتَيْتَ عَلَيْهِ يُثْلَغُ رَأْسُهُ بِالحَجَرِ، فَإِنَّهُ الرَّجُلُ يَأْخُذُ القُرْآنَ فَيَرْفُضُهُ وَيَنَامُ عَنِ الصَّلاَةِ المَكْتُوبَةِ،….
‘তোমাদের কেউ কি আজ রাতে কোনো স্বপ্ন দেখেছ? বর্ণনাকারী বলেন, যদি কেউ দেখত তাহলে বর্ণনা করত। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, মাশাআল্লাহ। এরূপ তিনি একদিন আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কি আজ রাতে কোনো স্বপ্ন দেখেছ? আমরা বললাম না। তখন তিনি বললেন, আজ রাতে আমি স্বপ্ন দেখলাম, দু’জন লোক আমার নিকট এল (তারপর তিনি দুই ব্যক্তির বিবরণ দিলেন অতঃপর হাদীসে এসেছে), আমরা চলতে চলতে একজন শায়িত ব্যক্তির কাছে পৌঁছলাম, সেখানে এক ব্যক্তিকে পাথর হাতে তার শিয়রে দাঁড়ানো দেখতে পেলাম। যখন সে ওই পাথরটি শায়িত ব্যক্তির মাথায় নিক্ষেপ করে, তখন পাথরটি তার মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দূরে ছিটকে যায়। পুনরায় পাথরটি নিয়ে আসার পূর্বেই তার মাথাটি আবার পূর্বের ন্যায় হয়ে যায়। অতঃপর সে তার নিকট ফিরে এসে পূর্বের ন্যায় একই আচরণ করে। আমি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কী? তারা দু’জন বলল, সামনে অগ্রসর হোন। (তিনি হাদীসটি বর্ণনা করলেন, তাতে রয়েছে) যে লোকটির নিকট আমি এসেছিলাম এং যার মাথা পাথর দিয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হচ্ছিল, সে কুরআন শিক্ষা করেছে, অথচ সে অনুযায়ী আমল করে নি। আর সে ফরয সালাত আদায় না করে ঘুমিয়ে যেতো।’
* অনুরূপভাবে ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজের ভাষণে জনতার উদ্দেশে বলেন:
قَدْ يَئِسَ الشَّيْطَانُ بِأَنْ يُعْبَدَ بِأَرْضِكُمْ وَلَكِنَّهُ رَضِيَ أَنْ يُطَاعَ فِيمَا سِوَى ذَلِكَ مِمَّا تُحَاقِرُونَ مِنْ أَعْمَالِكُمْ ، فَاحْذَرُوا يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي قَدْ تَرَكْتُ فِيكُمْ مَا إِنِ اعْتَصَمْتُمْ بِهِ فَلَنْ تَضِلُّوا أَبَدًا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ
‘নিশ্চয় শয়তান তোমাদের ভূখণ্ডে (মক্কা-মদীনায়) তার ইবাদত করার ব্যাপারে নিরাশ হয়েছে। তবে সে এটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকবে যে তোমরা তুচ্ছ মনে করে তার ইবাদত ছাড়াও এমন কিছু কাজ করবে যাতে তার অনুসরণ হয়ে যাবে। সুতরাং শয়তানের ব্যাপারে তোমরা সাবধান হও। হে মানুষ সকল! আমি তোমাদের মাঝে এমন বস্তু রেখে যাচ্ছি, যদি তা আঁকড়ে ধর, তাহলে তোমরা কখনও পথভ্রষ্ট হবে না। তা হলো: আল্লাহর কিতাব এব তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ।”
* ‘আমর ইবন শু‘আইব তার বাবা থেকে, তার বাবা তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
يُمَثَّلُ الْقُرْآنُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ رَجُلًا، فَيُؤْتَى بِالرَّجُلِ قَدْ حَمَلَهُ فَخَالَفَ أَمْرَهُ، فَيَتَمَثَّلُ خَصْمًا لَهُ فَيَقُولُ: يَا رَبِّ حَمَّلْتَهُ إِيَّايَ فَشَرُّ حَامِلٍ تَعَدَّى حُدُودِي، وَضَيَّعَ فَرَائِضِي، وَرَكِبَ مَعْصِيَتِي، وَتَرَكَ طَاعَتِي، فَمَا يَزَالُ يَقْذِفُ عَلَيْهِ بِالْحُجَجِ حَتَّى يُقَالَ: فَشَأْنُكَ بِهِ فَيَأْخُذُ بِيَدِهِ، فَمَا يُرْسِلُهُ حَتَّى يَكُبَّهُ عَلَى مَنْخِرِهِ فِي النَّارِ
‘কিয়ামতের দিন কুরআনকে এক ব্যক্তির আকার দেয়া হবে। অতঃপর একজন লোকের সামনে তাকে উপস্থিত করা হবে। সে কুরআন বহণ করেছিল ও তার নির্দেশ লঙ্ঘন করেছিল। তখন কুরআনকে তার বিরুদ্ধে বাদী হিসেবে দাঁড় করানো হবে। তখন কুরআন বলবে, হে আমার প্রভু! আপনি তাকে আমার বহনকারী বনিয়েছিলেন, অথচ সে কতইনা নিকৃষ্ট বহনকারী ছিল। সে আমার সীমালঙ্ঘন করেছে, আমার ফরযসমূহ নষ্ট করেছে ও আমার নাফরমানি করেছে এবং আনুগত্য পরিত্যাগ করেছে। কুরআন অনবরত তার রিরুদ্ধে প্রমাণ পেশ করে তাকে লাঞ্ছিত করতেই থাকবে। পরিশেষে তাকে বলা হবে, তোমার ব্যাপারে কুরআনের এ অভিযোগ। তখন কুরআন তাকে আপন হাতে ধরে নিয়ে অধঃমুখী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে।’
* সহীহ মুসলিমে আবূ মালেক আশআরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
َالْقُرْآنُ حُجَّةٌ لَكَ أَوْ عَلَيْكَ .
‘কুরআন তোমার পক্ষে অথবা বিপক্ষে দলীল হবে।’
* অনুরূপ ‘আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহ আনহু বলেন,
الْقُرْآنُ شَافِعٌ مُشَفَّعٌ، فَمَنْ جَعَلَهُ أمَامَهُ قَادَهُ إِلَى الْجَنَّةِ، وَمَنْ جَعَلَهُ خَلْفَ ظَهْرِهِ قَادَهُ إِلَى النَّارِ
‘কুরআন এমন সুপারিশকারী যার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। যে ব্যক্তি কুরআনকে সম্মুখে রাখবে, কুরআন তাকে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাবে। আর যে কুরআনকে পেছনে রাখবে, কুরআন তাকে তাড়িয়ে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাবে।’
সুতরাং হে ব্যক্তি! কুরআন যার বিপক্ষে বাদী হিসাবে দাঁড়াবে, কিভাবে তুমি তোমার পক্ষে তার সুপারিশের আশা কর? ওই লোকের জন্য আফসোস! যার সুপারিশকারী বিচার দিবসে তার বিপক্ষে বাদী হয়ে যাবে।
আল্লাহর বান্দাগণ! এটা আল্লাহর কিতাব, যা আপনাদের সামনে তিলাওয়াত করে শোনানো হচ্ছে। এটা ওই কুরআন, যদি তা কোনো পাহাড়ের উপর নাযিল হত তাহলে দেখতেন তা ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। তদ্যপি কোনো কান শুনছে না, কোনো চোখ কাঁদছে না, কোনো অন্তর ভীত হচ্ছে না। কুরআনের নির্দেশকেও তো পালন করা হচ্ছে না যে সেটার বিনিময়ে তার সুপারিশের আশা করা যাবে। হৃদয়সমূহ তাকওয়াশূন্য জনমানবহীন মরুভূমিতুল্য, যাতে পাপের কালিমা স্তুপাকারে জড়িয়ে আছে। ফলে সে না পায় দেখতে আর না শুনতে।
আমাদের সামনে কত আয়াত পড়া হচ্ছে, অথচ আমাদের হৃদয় পাথরের মত কিংবা এর চেয়েও বেশি কঠিন। আর আমাদের সামনে কত রমযান মাস এসে চলে গেছে, অথচ আমাদের অবস্থা হতভাগ্যদের মতই রয়েই গেছে। না কোনো যুবক অশোভন কামনা থেকে বিরত হচ্ছে। না কোনো বৃদ্ধ মন্দ কাজ পরিহার করে নেককারদের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। ওই সম্প্রদায়ের তুলনায় আমরা কোথায় আছি, যারা আল্লাহর পথে আহ্বানকারীর ডাক শোনা মাত্রই সাড়া দিত? আর যখন তাদের সামনে কুরআনের আয়াত পাঠ করা হতো, তাদের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠত? তারাই ওই লোক যাদের ওপর আল্লাহ তা‘আলা অনুগ্রহ করেছেন, তারা আল্লাহর হক চিনতে পেরেছে। ফলে তারা স্বচ্ছতা অবলম্বন করতে সক্ষম হয়েছে।
* আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলতেন:
يَنْبَغِي لِقَارِئِ الْقُرْآنِ أَنْ يُعْرَفَ بِلَيْلِهِ إِذَا النَّاسُ نَائِمُونَ، وَبِنَهَارِهِ إِذَا النَّاسُ مُفْطِرُونَ، وَبِبُكَائِهِ إِذَا النَّاسُ يَضْحَكُونَ، وَبِوَرَعِهِ إِذَا النَّاسُ يَخْلِطُونَ، وَبِصَمْتِهِ إِذَا النَّاسُ يَخُوضُونَ، وَبِخُشُوعِهِ إِذَا النَّاسُ يَخْتَالُونَ وبحزنه إذا الناسُ يفرحون
‘কুরআন তিলাওয়াতকারীর উচিৎ তাকে যেন চেনা যায় তার রাতে (সালাতে) যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে। তার দিনে (সাওমে) যখন মানুষ খাওয়া-দাওয়া করে। তার ক্রন্দনে, যখন মানুষ হাসে। তার তাকওয়ায়, যখন মানুষ ভালো-মন্দ মিশিয়ে ফেলে। তার নীরবতায়, যখন মানুষ খারাপ কিছু কিংবা পরনিন্দায় লিপ্ত থাকে। তার বিনয় ও নম্রতায়, যখন মানুষ অহংকার করে। তার চিন্তা ও পেরেশানীতে, যখন মানুষ হইহুল্লোড় করে।
কবির ভাষায়:
১। হে আত্মা! নেককার লোকজন সফলকাম হয়েছে তাকওয়ার মাধ্যমে। তারা সত্য দেখেছে অথচ আমার হৃদয় অন্ধ।
২। তাদের সৌন্দর্য কতই না বেশি যে, রাত তাদের ঢেকে ফেলেছে অথচ তরকারাজির আলোর ওপর তাদের আলো প্রধান্য পেয়েছে।
৩। তারা রাতে মধুর সুরে যিকির করেছে। মূলত তাদের জীবন যিকিরের মাধ্যমে ধন্য হয়েছে।
৪। যিকিরের জন্য তাদের অন্তর সর্বদাই প্রস্তুত হয়ে আছে। তাদের চোখের পানি যেন সুসজ্জিত মনি-মুক্তা।
৫। স্বীয় আলোয় তাদের রাতের শেষাংশ আলোকিত হয়েছে, আর ক্ষমা লাভই হলো উত্তম সৌভাগ্য।
৬। তারা অনর্থক কাজ থেকে নিজেদের সিয়ামকে মুক্ত রেখেছে এবং বিনয়ী হয়ে রাতে যিকিরে মগ্ন থেকেছে।
৭। ধিক হে আত্মা! পা ফসকে যাবার পূর্বে তুমি কি তা লাভের জন্য জাগ্রত হবে না?
৮। কামনা বাসনায় কেটেছে অতীত, তাই সময় থাকতে দ্বীন আঁকড়ে ধর ও সুযোগ গ্রহণ কর।
প্রিয় ভাইসকল! সময় শেষ হওয়ার পূর্বেই কুরআনকে হেফয করুন এবং নাফরমানী ও সীমালঙ্ঘন থেকে তার বিধানসমূহের সীমারেখা হেফাযত করুন। জেনে রাখুন, কুরআন আপনাদের পক্ষে বা বিপক্ষে আল্লাহর দরবারে সাক্ষ্য দেবে। কুরআন অবতীর্ণের শুকরিয়া এটা নয় যে, তার প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করব। আল্লাহর বিধানসমূহের সম্মান এটা নয় যে, এগুলোকে উপহাস করব।
﴿وَيَوۡمَ يَعَضُّ ٱلظَّالِمُ عَلَىٰ يَدَيۡهِ يَقُولُ يَٰلَيۡتَنِي ٱتَّخَذۡتُ مَعَ ٱلرَّسُولِ سَبِيلٗا ٢٧ يَٰوَيۡلَتَىٰ لَيۡتَنِي لَمۡ أَتَّخِذۡ فُلَانًا خَلِيلٗا ٢٨ لَّقَدۡ أَضَلَّنِي عَنِ ٱلذِّكۡرِ بَعۡدَ إِذۡ جَآءَنِيۗ وَكَانَ ٱلشَّيۡطَٰنُ لِلۡإِنسَٰنِ خَذُولٗا ٢٩ وَقَالَ ٱلرَّسُولُ يَٰرَبِّ إِنَّ قَوۡمِي ٱتَّخَذُواْ هَٰذَا ٱلۡقُرۡءَانَ مَهۡجُورٗا ٣٠ وَكَذَٰلِكَ جَعَلۡنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوّٗا مِّنَ ٱلۡمُجۡرِمِينَۗ وَكَفَىٰ بِرَبِّكَ هَادِيٗا وَنَصِيرٗا ٣١ ﴾ [الفرقان: ٢৭، ৩১]
‘আর সেদিন যালিম নিজের হাত দুটো কামড়িয়ে বলবে, ‘হায়, আমি যদি রাসূলের সাথে কোনো পথ অবলম্বন করতাম! ‘হায় আমার দুর্ভোগ, আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম। অবশ্যই সে তো আমাকে উপদেশবাণী (কুরআন) থেকে বিভ্রান্ত করেছিল, আমার কাছে তা আসার পর। আর শয়তান তো মানুষের জন্য চরম প্রতারক। আর রাসূল বলবে, ‘হে আমার রব, নিশ্চয় আমার কওম এ কুরআনকে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছে। আর এভাবেই আমি প্রত্যেক নবীর জন্য অপরাধীদের মধ্য থেকে শত্রু বানিয়েছি। আর পথপ্রদর্শক ও সাহায্যকারী হিসেবে তোমার রবই যথেষ্ট।’ {সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ২৭-৩১}
হে আল্লাহ! আমাদের যথাযথভাবে কুরআন তিলাওয়াতের সুযোগ দিন। আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন, যারা এর মাধ্যমে সফলতা ও সৌভাগ্য অর্জন করেছে।
হে আল্লাহ! আমাদের তৌফিক দিন কুরআনের অর্থ ও শব্দ বুঝে তা প্রতিষ্ঠাকারী হওয়ার, তার সীমারেখার হেফাযতকারী ও তার যথাযথ সম্মানের খেয়ালকারী হওয়ার।
হে আল্লাহ আমাদের কুরআনের গভীর জ্ঞানী করুন, যারা হবে কুরআনের সুস্পষ্ট ও অস্পষ্ট আয়াতসমূহে বিশ্বাসী, তার সংবাদ সত্যায়নকারী এবং হুকুমসমূহ বাস্তবায়নকারী। হে রহমতের আঁধার, আপন রহমতে আমাদের, আমাদের পিতা-মাতা ও সকল মুসলিমকে ক্ষমা করে দিন।
আর সালাত ও সালাম বর্ষণ করুন, আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবারবর্গ ও সাহাবীগণের ওপর।

ত্রয়োদশ আসরঃকুরআন তিলাওয়াতের আদব
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যার কুদরতের সামনে প্রতিটি বান্দা বিনীত হয়; যার মাহাত্ম্যের কাছে প্রতিটি রুকু-সিজদাকারী বিগলিত হয়; যার মুনাজাতের স্বাদ গ্রহণের জন্য তাহাজ্জুদগুযার জেগে থাকে এবং বিনিদ্র রজনী যাপন করে; যার নেকীর প্রত্যাশায় মুজাহিদ নিজের জীবন ব্যয় করে এবং প্রচেষ্টা চালায়। পবিত্র সত্তা তিনি, যিনি এমন কথা বলেন যা সৃষ্টিকুলের কথার সঙ্গে তুলনা থেকে উর্ধ্বে ও বহুদূরে; তাঁর কথার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তাঁর নবীর ওপর অবতীর্ণকৃত কিতাব, যা আমরা দিনরাত পড়ি ও বারবার আওড়াই। বারবার পড়ায় তা পুরনো হয় না, বিরক্তি আসে না আর যাকে কখনও অগ্রহণযোগ্য বলে উড়িয়েও দেওয়া যায় না। আমি তাঁর প্রশংসা করি এমন ব্যক্তির ন্যায় যে তাঁর দুয়ারে অবস্থানের প্রত্যাশা করে কোনোরূপ বিতাড়নের শংকা ছাড়াই।
আর আমি সাক্ষ্য দেই যে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই- ওই ব্যক্তির সাক্ষ্য যে আল্লাহর প্রতি নিষ্ঠ এবং তাঁর অনুগত বান্দা। আমি আরও সাক্ষ্য দেই যে মুহাম্মদ আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল, যিনি ইবাদতের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং পাথেয় সংগ্রহ করেছেন।
আল্লাহ সালাত বর্ষণ করুন তাঁর ওপর; তাঁর সঙ্গী আবূ বকর সিদ্দীকের ওপর, যার শত্রুদের অন্তর অনিঃশেষ ক্ষতে পূর্ণ হয়েছে; ‘উমরের ওপর, যিনি অবিরাম ইসলামের শক্তি বৃদ্ধি করেছেন; উসমানের ওপর, যিনি নিঃশঙ্ক চিত্তে শাহাদাতের পেয়ালায় চুমুক দিয়েছেন; আলীর ওপর, যিনি আপন তলোয়ার দিয়ে বিরামহীন কাফেরদের ক্ষেত নিমূল করেছেন। আর রাসূলের সকল পরিবার-পরিজন ও সাহাবীর ওপর, অনন্তকালব্যাপী বিরামহীন। আর তিনি তাদের উপর যথাযথ সালামও পেশ করুন।
আমার ভাইয়েরা! এই যে কুরআন, যা আপনাদের কাছে আছে, আপনারা তিলাওয়াত করছেন, শুনছেন, মুখস্থ করছেন এবং লিপিবদ্ধ করছেন, তা আপনাদের রব ও সৃষ্টিকুলের রব ও পূর্ববর্তী-পরবর্তীদের মা‘বুদের বাণী; এটা তাঁর সুদৃঢ় রশি, তাঁর সরল পথনির্দেশ, বরকতময় উপদেশবাণী ও সুস্পষ্ট নূর। মহান আল্লাহর সম্মান ও মাহাত্মের সাথে যেভাবে মানায় সেভাবে আল্লাহু তা‘আলা এ কুরআন দ্বারা বাস্তবিকই কথা বলেছেন। তিনি কুরআনকে নৈকট্যশীল সম্মানিত ফেরেশতাদের একজন জিব্রাইল আমীনের নিকট প্রেরণ করেছেন। তিনি এরপর এ কুরআন নিয়ে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওসাল্লামের হৃদয়ে নাযিল করেছেন। যাতে তিনি সুষ্পষ্ট আরবী ভাষায় মানুষকে সতর্ককারীদের অন্তর্ভ্ক্তু হতে পারেন। আল্লাহ তা‘আলা বড় বড় বিশেষণে কুরআনকে বিশেষায়িত করেছেন যাতে আপনারা কুরআনের যথাযথ মর্যাদা ও সম্মান করতে পারেন। যেমন,
* আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿شَهۡرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِيٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلۡقُرۡءَانُ هُدٗى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَٰتٖ مِّنَ ٱلۡهُدَىٰ وَٱلۡفُرۡقَانِۚ ﴾ [البقرة: ١٨٥]
‘রমযান মাস যাতে নাযিল হয়েছে আল-কুরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়াত ও সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা এবং হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৫}
﴿ ذَٰلِكَ نَتۡلُوهُ عَلَيۡكَ مِنَ ٱلۡأٓيَٰتِ وَٱلذِّكۡرِ ٱلۡحَكِيمِ ٥٨ ﴾ [ال عمران: ٥٨]
* ‘এটি আমরা আপনার উপর তিলাওয়াত করছি, আয়াতসমূহ ও প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ থেকে।’ {সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৫৮}
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ قَدۡ جَآءَكُم بُرۡهَٰنٞ مِّن رَّبِّكُمۡ وَأَنزَلۡنَآ إِلَيۡكُمۡ نُورٗا مُّبِينٗا ١٧٤﴾ [النساء: ١٧٤]
* ‘হে মানুষ! অবশ্যই তোমাদের নিকট তোমাদের রবের পক্ষ থেকে দলীল এসেছে আর আমরা তোমাদের নিকট সুস্পষ্ট নূর নাযিল করেছি।’ {সূরা আন-নিসা, আয়াত: ‌১৭৪}
﴿قَدۡ جَآءَكُم مِّنَ ٱللَّهِ نُورٞ وَكِتَٰبٞ مُّبِينٞ ١٥ يَهۡدِي بِهِ ٱللَّهُ مَنِ ٱتَّبَعَ رِضۡوَٰنَهُۥ سُبُلَ ٱلسَّلَٰمِ ﴾ [المائ‍دة: ١٥، ١٦]
* ‘অবশ্যই আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট নূর ও সুস্পষ্ট গ্রন্থ এসেছে। এর মাধ্যমে আল্লাহ হেদায়াত দান করবেন তথা শান্তির পথ জান্নাতের দিকে পথনির্দেশ করবেন- তাকে যে আল্লাহর সন্তুষ্টির অনুসরণ করে।’ {সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ১৫-১৬}
﴿وَمَا كَانَ هَٰذَا ٱلۡقُرۡءَانُ أَن يُفۡتَرَىٰ مِن دُونِ ٱللَّهِ وَلَٰكِن تَصۡدِيقَ ٱلَّذِي بَيۡنَ يَدَيۡهِ وَتَفۡصِيلَ ٱلۡكِتَٰبِ لَا رَيۡبَ فِيهِ مِن رَّبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٣٧ ﴾ [يونس: ٣٧]
* আর এ কুরআন আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো রচনা হওয়া সম্ভব নয়। বরং এর আগে যা নাযিল হয়েছে এটা তার সত্যায়ন এবং আল কিতাবের বিশদ ব্যাখ্যা। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এটা সৃষ্টিকুলের রবের পক্ষ থেকে।’ {সূরা ইউনুস, আয়াত: ৩৭}
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ قَدۡ جَآءَتۡكُم مَّوۡعِظَةٞ مِّن رَّبِّكُمۡ وَشِفَآءٞ لِّمَا فِي ٱلصُّدُورِ وَهُدٗى وَرَحۡمَةٞ لِّلۡمُؤۡمِنِينَ ٥٧ ﴾ [يونس: ٥٧]
* ‘হে মানবকুল! তোমাদের নিকট উপদেশ বাণী এসেছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে এবং অন্তরের রোগের নিরাময় ও হেদায়াত ও রহমত মুমিনদের জন্য।’ {সূরা ইউনুস, আয়াত: ৫৭}
﴿الٓرۚ كِتَٰبٌ أُحۡكِمَتۡ ءَايَٰتُهُۥ ثُمَّ فُصِّلَتۡ مِن لَّدُنۡ حَكِيمٍ خَبِيرٍ ١﴾ [هود: ١]
* ‘আলিফ লাম রা, এটা এমন কিতাব, যার আয়াতসমূহ সুদৃঢ় ও সুপ্রতিষ্টিত, প্রাজ্ঞ ও সর্বজ্ঞের পক্ষ থেকে।’ {সূরা হূদ, আয়াত: ১}
﴿إِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا ٱلذِّكۡرَ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَٰفِظُونَ ٩ ﴾ [الحجر: ٩]
* ‘নিশ্চয় আমি উপদেশবাণী তথা কুরআন নাযিল করেছি এবং নিঃসন্দেহে এর হেফাজতের দায়িত্বভার আমি নিজেই নিয়ে নিলাম।’ {সূরা আল-হিজর, আয়াত: ৯}
﴿ وَلَقَدۡ ءَاتَيۡنَٰكَ سَبۡعٗا مِّنَ ٱلۡمَثَانِي وَٱلۡقُرۡءَانَ ٱلۡعَظِيمَ ٨٧ لَا تَمُدَّنَّ عَيۡنَيۡكَ إِلَىٰ مَا مَتَّعۡنَا بِهِۦٓ أَزۡوَٰجٗا مِّنۡهُمۡ وَلَا تَحۡزَنۡ عَلَيۡهِمۡ وَٱخۡفِضۡ جَنَاحَكَ لِلۡمُؤۡمِنِينَ ٨٨﴾ [الحجر: ٨٧، ٨٨]
* ‘আমি আপনাকে সাতটি বার বার পঠিতব্য আয়াত এবং মহান কুরআন দান করেছি। আপনি চক্ষু তুলে ঐ বস্তুর দিকে দেখবেন না, যা আমি তাদের মধ্যে কয়েক প্রকার লোককে ভোগ করার জন্য দিয়েছি। তাদের জন্য পেরেশান হবেন না। আর ঈমানদারদের জন্যে স্বীয় বাহু নত করুন।’ {সূরা আল-হিজর, আয়াত: ৮৭-৮৮}
﴿وَنَزَّلۡنَا عَلَيۡكَ ٱلۡكِتَٰبَ تِبۡيَٰنٗا لِّكُلِّ شَيۡءٖ وَهُدٗى وَرَحۡمَةٗ وَبُشۡرَىٰ لِلۡمُسۡلِمِينَ ٨٩﴾ [النحل: ٨٩]
* ‘আমরা আপনার নিকট কিতাবটি নাযিল করেছি। এটি এমন যে তা সবকিছুর সুস্পষ্ট বর্ণনা, আর এটা হেদায়াত, রহমত ও মুসলিমদের জন্য সুসংবাদস্বরূপ।’ {সূরা আন-নাহল, আয়াত:৮৯}
﴿إِنَّ هَٰذَا ٱلۡقُرۡءَانَ يَهۡدِي لِلَّتِي هِيَ أَقۡوَمُ وَيُبَشِّرُ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ ٱلَّذِينَ يَعۡمَلُونَ ٱلصَّٰلِحَٰتِ أَنَّ لَهُمۡ أَجۡرٗا كَبِيرٗا ٩ وَأَنَّ ٱلَّذِينَ لَا يُؤۡمِنُونَ بِٱلۡأٓخِرَةِ أَعۡتَدۡنَا لَهُمۡ عَذَابًا أَلِيمٗا ١٠ ﴾ [الاسراء: ٩، ١٠]
* ‘নিশ্চয় এ কুরআন যেটা যথার্থ ও সঠিক সে দিকেই পথনির্দেশ করে এবং ঈমানদারদের সুসংবাদ প্রদান করে, যারা নেক কাজ করে। নিঃসন্দেহে তাদের জন্য মহা প্রতিদান রয়েছে।’ {সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৯-১০}
﴿ وَنُنَزِّلُ مِنَ ٱلۡقُرۡءَانِ مَا هُوَ شِفَآءٞ وَرَحۡمَةٞ لِّلۡمُؤۡمِنِينَ وَلَا يَزِيدُ ٱلظَّٰلِمِينَ إِلَّا خَسَارٗا ٨٢ ﴾ [الاسراء: ٨٢]
* আর আমরা নাযিল করি এমন কুরআন যা রোগের নিরাময় এবং মু’মিনদের জন্য রহমতস্বরূপ। আর এটা জালিমদেরকে ক্ষতি ছাড়া অন্য কিছুই বৃদ্ধি করে না।’ {সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৮২}
﴿ قُل لَّئِنِ ٱجۡتَمَعَتِ ٱلۡإِنسُ وَٱلۡجِنُّ عَلَىٰٓ أَن يَأۡتُواْ بِمِثۡلِ هَٰذَا ٱلۡقُرۡءَانِ لَا يَأۡتُونَ بِمِثۡلِهِۦ وَلَوۡ كَانَ بَعۡضُهُمۡ لِبَعۡضٖ ظَهِيرٗا ٨٨ ﴾ [الاسراء: ٨٨]
* আপনি বলে দিন! যদি মানব ও জ্বিন জাতি সবাই মিলে একত্রিত হয় যে, তারা এ কুরআন অনুরূপ কিছু আনয়ন করবে- তারা এ কুরআনের অনুরূপ কিছুই আনয়ন করতে পারবে না যদিও তারা একে অপরের সাহায্যকারী হোক।’ {সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৮৮}
﴿مَآ أَنزَلۡنَا عَلَيۡكَ ٱلۡقُرۡءَانَ لِتَشۡقَىٰٓ ٢ إِلَّا تَذۡكِرَةٗ لِّمَن يَخۡشَىٰ ٣ تَنزِيلٗا مِّمَّنۡ خَلَقَ ٱلۡأَرۡضَ وَٱلسَّمَٰوَٰتِ ٱلۡعُلَى ٤ ﴾ [طه: ٢، ٤]
* ‘আমরা আপনার ওপর কুরআনকে এ জন্য নাযিল করিনি যে, আপনি দুঃখ-কষ্ট করবেন। অবশ্য এটা উপদেশবাণী স্বরূপ যে আল্লাহকে ভয় করে তার জন্য এটা নাযিল হয়েছে। সুউচ্চ আকাশ ও যমীনকে যিনি সৃষ্টি করেছেন এমন সত্তার পক্ষ থেকে।’ {সূরা ত-হা, আয়াত: ২-৪}
﴿ تَبَارَكَ ٱلَّذِي نَزَّلَ ٱلۡفُرۡقَانَ عَلَىٰ عَبۡدِهِۦ لِيَكُونَ لِلۡعَٰلَمِينَ نَذِيرًا ١ ﴾ [الفرقان: ١]
* ‘বরকতময় সেই সত্তা যিনি হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য বিধানকারী কুরআন তাঁর বান্দাহর প্রতি নাযিল করেছেন; যাতে তিনি বা তা সৃষ্টিকুলের জন্য সতর্ককারী হয়।’ {সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ১}
﴿ وَإِنَّهُۥ لَتَنزِيلُ رَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ١٩٢ نَزَلَ بِهِ ٱلرُّوحُ ٱلۡأَمِينُ ١٩٣ عَلَىٰ قَلۡبِكَ لِتَكُونَ مِنَ ٱلۡمُنذِرِينَ ١٩٤ بِلِسَانٍ عَرَبِيّٖ مُّبِينٖ ١٩٥ وَإِنَّهُۥ لَفِي زُبُرِ ٱلۡأَوَّلِينَ ١٩٦ أَوَ لَمۡ يَكُن لَّهُمۡ ءَايَةً أَن يَعۡلَمَهُۥ عُلَمَٰٓؤُاْ بَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ ١٩٧ ﴾ [الشعراء: ١٩٢، ١٩٧]
* ‘নিশ্চয়ই এ কুরআন তো সৃষ্টিকুলের রবের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। বিশ্বস্ত ফেরেস্তা (জিব্রাঈল) একে নিয়ে অবতরণ করেছে, আপনার অন্তরে যাতে আপনি ভীতি প্রদর্শন কারীদের অন্যতম হোন, সুষ্পষ্ট আরবী ভাষায়। নিশ্চয়-ই এর উল্লেখ আছে পূর্ববর্তী কিতাব সমূহে। তাদের জন্যে এটা কি নিদর্শন নয় যে, বনী-ইসরাইলের আলেমগণ এটা অবগত আছেন।’ {সূরা আশ-শু‘আরা, আয়াত: ১৯২-১৯৭}
﴿وَمَا تَنَزَّلَتۡ بِهِ ٱلشَّيَٰطِينُ ٢١٠ وَمَا يَنۢبَغِي لَهُمۡ وَمَا يَسۡتَطِيعُونَ ٢١١ ﴾ [الشعراء: ٢١٠، ٢١١]
* ‘আর শয়তানরা এ কুরআন নিয়ে অবতরণ করে না। আর তাদের জন্য উচিতও নয় এবং তারা পারবেও না।’ {সূরা আশ-শু‘আরা, আয়াত: ১০-১১}
﴿ بَلۡ هُوَ ءَايَٰتُۢ بَيِّنَٰتٞ فِي صُدُورِ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡعِلۡمَۚ﴾ [العنكبوت: ٤٩]
* ‘বরং এ কুরআন কতিপয় নিদর্শন ও যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে এদের হৃদয়ে কতিপয় সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা।’ {সূরা আল-‘আনকাবূত, আয়াত: ৪৭}
﴿إِنۡ هُوَ إِلَّا ذِكۡرٞ وَقُرۡءَانٞ مُّبِينٞ ٦٩ لِّيُنذِرَ مَن كَانَ حَيّٗا وَيَحِقَّ ٱلۡقَوۡلُ عَلَى ٱلۡكَٰفِرِينَ ٧٠ ﴾ [يس: ٦٩، ٧٠]
* ‘এটা তো কেবল এক উপদেশবাণী ও প্রকাশ্য কুরআন। যাতে তিনি সতর্ক করতে পারেন জীবিতকে এবং যাতে কাফেরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়।’ {সূরা ইয়াসীন, আয়াত: ৬৯-৭০}
﴿كِتَٰبٌ أَنزَلۡنَٰهُ إِلَيۡكَ مُبَٰرَكٞ لِّيَدَّبَّرُوٓاْ ءَايَٰتِهِۦ وَلِيَتَذَكَّرَ أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَٰبِ ٢٩ ﴾ [ص: ٢٩]
* ‘আমরা আপনার নিকট অবতীর্ণ করেছি এক বরকতপূর্ণ কিতাব; যাতে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে চিন্তা গবেষণা করতে পারে, আর জ্ঞানীরা যেন উপদেশ গ্রহণ করতে পারে।’ {সূরা ছোয়াদ, আয়াত: ২৯}
﴿ قُلۡ هُوَ نَبَؤٌاْ عَظِيمٌ ٦٧ ﴾ [ص: ٦٧]
* ‘আপনি বলে দিন! এটা তথা এ কুরআন এক মহা সংবাদ।’ {সূরা ছোয়াদ, আয়াত: ২৭}
﴿ٱللَّهُ نَزَّلَ أَحۡسَنَ ٱلۡحَدِيثِ كِتَٰبٗا مُّتَشَٰبِهٗا مَّثَانِيَ تَقۡشَعِرُّ مِنۡهُ جُلُودُ ٱلَّذِينَ يَخۡشَوۡنَ رَبَّهُمۡ ثُمَّ تَلِينُ جُلُودُهُمۡ وَقُلُوبُهُمۡ إِلَىٰ ذِكۡرِ ٱللَّهِۚ ذَٰلِكَ هُدَى ٱللَّهِ يَهۡدِي بِهِۦ مَن يَشَآءُۚ﴾ [الزمر: ٢٣]
* ‘আল্লাহ উত্তম বাণী তথা কুরআন নাযিল করেছেন। যা সামঞ্জস্যপূর্ণ বারবার পঠিত গ্রন্থ। এতে তাদের লোম কাঁটা দিয়ে উঠে চামড়ার ওপর, যারা তাদের রবকে ভয় করে, এরপর এদের চামড়া ও অন্তর আল্লাহর স্মরণে বিনম্র হয়। এটাই আল্লাহর পথ নির্দেশ, এর মাধ্যমে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথ প্রদর্শন করেন।’ {সূরা আয-যুমার, আয়াত: ২৩}
﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ بِٱلذِّكۡرِ لَمَّا جَآءَهُمۡۖ وَإِنَّهُۥ لَكِتَٰبٌ عَزِيزٞ ٤١ لَّا يَأۡتِيهِ ٱلۡبَٰطِلُ مِنۢ بَيۡنِ يَدَيۡهِ وَلَا مِنۡ خَلۡفِهِۦۖ تَنزِيلٞ مِّنۡ حَكِيمٍ حَمِيدٖ ٤٢ ﴾ [فصلت: ٤١، ٤٢]
* ‘নিশ্চয়ই কুরআন তাদের নিকট আগমন করার পর যারা তা অস্বীকার করে। (তাদেরকে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে)। এটা অবশ্যই মহিমাময় গ্রন্থ।’ বাতিল তার সামনে বা পিছনে দিয়ে আসতে পারে না, এটা তো প্রজ্ঞাপূর্ণ প্রশংসিতের পক্ষ থেকে নাযিলকৃত।’ {সূরা ফুসসিলাত, আয়াত: ৪১-৪২}
﴿وَكَذَٰلِكَ أَوۡحَيۡنَآ إِلَيۡكَ رُوحٗا مِّنۡ أَمۡرِنَاۚ مَا كُنتَ تَدۡرِي مَا ٱلۡكِتَٰبُ وَلَا ٱلۡإِيمَٰنُ وَلَٰكِن جَعَلۡنَٰهُ نُورٗا نَّهۡدِي بِهِۦ مَن نَّشَآءُ مِنۡ عِبَادِنَاۚ ﴾ [الشورى: ٥٢]
“এমনিভাবে আমরা আপনার নিকট রুহ প্রেরণ করেছি আমাদের আদেশক্রমে। আপনি জানতেন না কিতাব কি এবং ঈমান কী? কিন্তু আমরা একে করেছি নূর। যার দ্বারা আমরা আমার বান্দাদের মধ্যে থেকে যাকে ইচ্ছা পথ প্রদর্শন করি।’ {সূরা আশ-শুরা, আয়াত: ৫২}
﴿ وَإِنَّهُۥ فِيٓ أُمِّ ٱلۡكِتَٰبِ لَدَيۡنَا لَعَلِيٌّ حَكِيمٌ ٤ ﴾ [الزخرف: ٤]
* ‘নিশ্চয় এ কুরআন আমাদের নিকটে সমুন্নত অটল অক্ষুণ্ন রয়েছে লওহে মাহফুযে।’ {সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ৪}
﴿هَٰذَا بَصَٰٓئِرُ لِلنَّاسِ وَهُدٗى وَرَحۡمَةٞ لِّقَوۡمٖ يُوقِنُونَ﴾ [الجاثية: ٢٠]
* ‘এটা মানুষের জন্য সুস্পষ্ট দলীল, জ্ঞানবর্তিকা, হেদায়াত ও রহমত দৃঢ়বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্যে।’ {সূরা আল-জাসিয়াহ্‌, আয়াত: ২০}
﴿وَٱلۡقُرۡءَانِ ٱلۡمَجِيدِ ﴾ [ق: ١]
* ‘ক্বফ, মর্যাদাপূর্ণ কুরআনের কসম।’ {সূরা ক্বফ, আয়াত: ১}
﴿فَلَآ أُقۡسِمُ بِمَوَٰقِعِ ٱلنُّجُومِ ٧٥ وَإِنَّهُۥ لَقَسَمٞ لَّوۡ تَعۡلَمُونَ عَظِيمٌ ٧٦ إِنَّهُۥ لَقُرۡءَانٞ كَرِيمٞ ٧٧ فِي كِتَٰبٖ مَّكۡنُونٖ ٧٨ لَّا يَمَسُّهُۥٓ إِلَّا ٱلۡمُطَهَّرُونَ ٧٩ تَنزِيلٞ مِّن رَّبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٨٠ ﴾ [الواقعة: ٧٥، ٨٠]
* ‘অতএব আমি তারকারাজির অস্তাচলের শপথ করছি। নিশ্চয় এটা মহা শপথ যদি তোমরা জানতে। নিশ্চয় এটা সম্মানিত কুরআন, যা আছে এক সংরক্ষিত গ্রন্থে তথা লওহে মাহফুযে। যারা পাক-পবিত্র তারা ছাড়া অন্য কেউ একে স্পর্শ করবে না। এটা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ।’ {সূরা আল-ওয়াকি‘আ, আয়াত: ৭৫-৮০}
﴿لَوۡ أَنزَلۡنَا هَٰذَا ٱلۡقُرۡءَانَ عَلَىٰ جَبَلٖ لَّرَأَيۡتَهُۥ خَٰشِعٗا مُّتَصَدِّعٗا مِّنۡ خَشۡيَةِ ٱللَّهِۚ وَتِلۡكَ ٱلۡأَمۡثَٰلُ نَضۡرِبُهَا لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمۡ يَتَفَكَّرُونَ ٢١ ﴾ [الحشر: ٢١]
* ‘যদি আমরা নাযিল করতাম এ কুরআনকে পাহাড়ের ওপর তাহলে অবশ্যই আপনি দেখতে পেতেন পাহাড় বিনীত হয়ে আল্লাহর ভয়ে বিদীর্ণ হয়ে গেছে। আমরা এসব দৃষ্টান্ত মানুষের জন্য উপস্থাপন করি; যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করতে পারে।’ {সূরা আল-হাশর, আয়াত: ২১}
আল্লাহ তা‘আলা জ্বিন জাতির কথার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন:
﴿ إِنَّا سَمِعۡنَا قُرۡءَانًا عَجَبٗا ١ يَهۡدِيٓ إِلَى ٱلرُّشۡدِ فَ‍َٔامَنَّا بِهِۦۖ ﴾ [الجن: ١، ٢]
* ‘নিশ্চয় আমরা বিস্ময়কর এক কুরআন শুনেছি যা হেদায়াতের পথে পরিচালিত করে। সুতরাং আমরা এর প্রতি ঈমান আনলাম।’ {সূরা আল-জিন, আয়াত: ১-২}
﴿ بَلۡ هُوَ قُرۡءَانٞ مَّجِيدٞ ٢١ فِي لَوۡحٖ مَّحۡفُوظِۢ ٢٢ ﴾ [البروج: ٢١، ٢٢]
* ‘বরং এটা সম্মানিত কুরআন। যা লওহে মাহফুয বা সংরক্ষিত ফলকে রয়েছে।’ {সূরা আল-বুরূজ, আয়াত: ২১-২২}
এ সমস্ত মহান গুণাবলি যা কুরআনের ব্যাপারে উল্লেখ করলাম, আর যেসব গুণাবলি উল্লেখ করিনি, সবই এ কুরআনের মাহাত্ম্য, কুরআনকে সম্মান করার আবশ্যকতা, আদবের সঙ্গে কুরআন তিলাওয়াত করা এবং তা তিলাওয়াতের সময় উপহাস, ঠাট্টা-বিদ্রূপ থেকে বিরত থাকার ওপর স্পষ্ট দলীল বহন করে।
কুরআন কিছু তিলাওয়াতের আদব:
নিয়্যাত খালেস করা:
আর কুরআন তেলাওয়াতের আদব হলো আল্লাহ তা‘আলার জন্য নিয়্যাতকে খালিস করা। কারণ কুরআন তিলাওয়াত একটি মহৎ ইবাদত। এর ফযীলত ইতোপূর্বে আলোচিত হয়েছে।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ فَٱعۡبُدِ ٱللَّهَ مُخۡلِصٗا لَّهُ ٱلدِّينَ ٢ ﴾ [الزمر: ٢]
‘সুতরাং আপনি একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করুন।’ {সূরা আয-যুমার, আয়াত: ২}
* আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
﴿ وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ حُنَفَآءَ ﴾ [البينة: ٥]
‘তাদেরকে একমাত্র নির্দেশ দেয়া হয়েছে এজন্য যে, তারা আল্লাহর ইবাদত করবে খাঁটি মনে ইখলাসের সঙ্গে।’ {সূরা আল-বায়্যিনা, আয়াত: ৫}
* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
اقْرَءُوا الْقُرْآنَ، وَابْتَغُوا بِهِ وجهَ اللَّهَ، مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَ قَوْمٌ يُقِيمُونَهُ إِقَامَةَ الْقِدْحِ، يَتَعَجَّلُونَهُ، وَلَا يَتَأَجَّلُونَهُ
‘তোমরা কুরআন তিলাওয়াত কর এবং এ তিলাওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা কর। এ আমল কর ওই সম্প্রদায়ের আগমনের পূর্বে, যারা কুরআন তীরের মত সোজা করে পড়বে, কুরআন দ্রুত পড়বে তথা এর দ্বারা দুনিয়ার প্রতিদান তালাশ করবে। তারা কুরআন ধীরস্থিরভাবে তিলাওয়াত করবে না।’
উপস্থিত-মন নিয়ে তিলাওয়াত করা:
যা পড়বে তা নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করবে এবং এর অর্থ অনুধাবনের চেষ্টা করবে এবং সে সময় তার অন্তরটা বিনয়ী হবে এবং সে নিজের অন্তরকে এমনভাবে হাযির করবে যেন এ কুরআনে আল্লাহ তার সঙ্গে সংলাপ করছেন। কারণ কুরআন তো মহান আল্লাহর বাণী।
পবিত্র অবস্থায় তিলাওয়াত করা:
এটা আল্লাহর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অংশ। অপবিত্র ব্যক্তি, অর্থ যার ওপর গোসল ফরয, এমন ব্যক্তি গোসল না করা পর্যন্ত কুরআন পাঠ করবে না। সম্ভব হলে পানি দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করবে। যদি পানি না পাওয়া যায় কিংবা রোগের কারণে পানি ব্যবহার করতে অক্ষম হয় তাহলে তায়াম্মুম করে পবিত্রতা অর্জন করবে। অবশ্য অযু বা গোসল ফরয এমন ব্যক্তি আল্লাহর যিকির করতে পারবে এবং কুরআনে আছে এমন দো‘আ পাঠ করতে পারবে তবে কুরআন পাঠের নিয়্যত করবে না। যেমন বলবে:
﴿ لَّآ إِلَٰهَ إِلَّآ أَنتَ سُبۡحَٰنَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ ٱلظَّٰلِمِينَ ٨٧ ﴾ [الانبياء: ٨٧]
‘আল্লাহ আপনি ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই। আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। নিশ্চয় আমি জালিমদের অন্তর্ভুক্ত।’ {সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: } কিংবা পড়বে:
﴿رَبَّنَا لَا تُزِغۡ قُلُوبَنَا بَعۡدَ إِذۡ هَدَيۡتَنَا وَهَبۡ لَنَا مِن لَّدُنكَ رَحۡمَةًۚ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡوَهَّابُ ٨ ﴾ [ال عمران: ٨]
‘হে আমাদের রব! আপনি আমাদেরকে হেদায়াত দান করার পর আমাদের অন্তরসমূহকে বক্র করে দিবেন না। আর আপনি আমাদেরকে আপনার পক্ষ থেকে দান করুন রহমত।’ {সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৮}
নোংরা জায়গা কিংবা মনোযোগ কাড়বে না এমন জনসমাগমস্থানে কুরআন তিলাওয়াত না করা:
নোংরা কিংবা এমন স্থান যেখানে তিলাওয়াত শোনার মত পর্যাপ্ত একাগ্রতার অভাব সেখানে কুরআন তিলাওয়াত কুরআনকে অপমান করার শামিল। টয়লেটে কিংবা পেশাব-পায়খানার জন্য বরাদ্দকৃত স্থানে কুরআন তিলাওয়াত করা জায়েয নেই। কারণ এসব স্থানে কুরআন তিলাওয়াত করা কুরআনুল কারীমের মর্যাদার সঙ্গে মানানসই নয়।
তিলাওয়াতের তিলাওয়াতের শুরুতে তা‘আউউয পড়া:
কুরআন তিলাওয়াতের আরেকটি আদব হলো, তিলাওয়াতের শুরুতে তা‘আউউয তথা (আউযুবিল্লাহি মিনাশ-শায়ত্বানির রজীম) পড়া। কেননা আল্লাহ বলেছেন :
﴿ فَإِذَا قَرَأۡتَ ٱلۡقُرۡءَانَ فَٱسۡتَعِذۡ بِٱللَّهِ مِنَ ٱلشَّيۡطَٰنِ ٱلرَّجِيمِ ٩٨ ﴾ [النحل: ٩٨]
‘যখন আপনি কুরআন পাঠ করবেন তখন বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাইবেন।’ {সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৯৮}
যাতে করে শয়তান কুরআন তিলাওয়াত থেকে কিংবা তিলাওয়াত পরিপূর্ণ করা থেকে বাঁধা না দিতে পারে। আর সূরার মাঝখান থেকে তিলাওয়াত শুরু করলে বিসমিল্লাহ পড়বে না। সূরার শুরু থেকে পাঠ করলে বিসমিল্লাহ বলবে। অবশ্য সূরা তাওবার শুরুতে বিসমিল্লাহ পড়বে না। কারণ এ সূরার সূচনায় বিসমিল্লাহ নেই।
কারণ কুরআন লিপিবদ্ধ করার সময় সাহাবীগণের এ বিষয়টি নিয়ে সন্দেহের উদ্রেক হয়েছিল। সূরা তাওবা কি সম্পূর্ণ আলাদা সূরা নাকি এটা সূরা আনফালের অংশ। তখন তারা উভয় সূরার মাঝে বিসমিল্লাহ লিখা বাদ দিয়েছেন।
কণ্ঠ সুন্দর করা এবং সুর দিয়ে তিলাওয়াত করা:
* কারণ, সহীহ বুখারী ও মুসলিমে এসেছে, আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
مَا أَذِنَ اللهُ لشيءٍ كما أذن لِنَبِيٍّ حَسَنِ الصَّوْتِ يَتَغَنَّى بِالْقُرْآنِ يَجْهَرُ بِهِ
‘আল্লাহ তা‘আলা কোনো কিছুর প্রতি এরকমভাবে শ্রবণ করেন না যেভাবে তিনি সুন্দর স্বরবিশিষ্ট নবীর পড়াকে শ্রবণ করেন। যিনি তাকে প্রদত্ত কুরআন তথা কিতাবকে উচ্চসুরে সুর দিয়ে পড়েন।’
* অনুরূপ সহীহ বুখারী ও মুসলিমে জুবাইর ইবন মুত‘য়িম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন:
سَمِعْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقْرَأُ فِي الْمَغْرِبِ بِالطُّورِ فَمَا سَمِعْتُ أَحَدًا أَحْسَنَ أو قراءة منه
‘আমি মাগরিব সালাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সূরা তুর পড়তে শুনেছি। এত সুন্দর কণ্ঠ ও কিরাত আমি আর কারো থেকে শুনি নি।’
অবশ্য যদি পাঠকের আশপাশে এমন কেউ থাকে যে উচ্চ স্বরে কিরাত পাঠ করলে কষ্ট পায়, যেমন ঘুমন্ত ব্যক্তি এবং সালাত আদায়রত ব্যক্তি ইত্যাদি, তাহলে এমন উচ্চ আওয়াজে পড়বে না যা তার জন্য বিরক্তিকর কিংবা কষ্টদায়ক দেয়। কারণ,
* আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকজনের নিকট বের হলেন তখন তারা উচ্চ কিরাতে সালাত আদায় করছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন:
إِنَّ الْمُصَلِّيَ يُنَاجِي رَبَّهُ تَبَارَكَ فَلْيَنْظُرْ بِمَا يُنَاجِيهِ وَلَا يَجْهَرْ بَعْضُكُمْ عَلَى بَعْضٍ فِيْ القرآن
‘সালাত আদায়কারী তার রবের নিকট কাকুতি মিনতি করে প্রার্থনা করে সে যেন লক্ষ্য করে তার প্রার্থনা সে কিভাবে করবে। আর কুরআন পাঠের সময় তোমাদের একজন অপরের ওপর যেন উচ্চ না করে।’ ইবন আবদিল বার বলেন, হাদীসটি সহীহ।
তারতীল বা ধীরস্থিরভাবে সুন্দররূপে তিলাওয়াত করা:
* আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :
﴿ وَرَتِّلِ ٱلۡقُرۡءَانَ تَرۡتِيلًا ٤ ﴾ [المزمل: ٤]
‘আর আপনি কুরআনকে তারতীলের সঙ্গে তথা ধীরস্থিরভাবে থেমে থেমে সুন্দররূপে তিলাওয়াত করুন।’ {সূরা আল-মুযযাম্মিল, আয়াত: ৪}
কুরআন তিলাওয়াত করবে ধীরস্থিরভাবে, দ্রুত নয়; কারণ ধীরস্থিরভাবে তিলাওয়াত, শব্দ ও অক্ষর সঠিকভাবে উচ্চারণ এবং কুরআনের অর্থ অনুধাবনে অধিক সহায়ক।
* সহীহ বুখারীতে এসেছে:
عن أنس بن مالك رضي الله عنه أنه سُئِلَ أَنَسٌ عَنْ قِرَاءَةِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ كَانَتْ مَدًّا ثُمَّ قَرَأَ بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ يَمُدُّ بِبِسْمِ اللَّهِ وَيَمُدُّ بِالرَّحْمَنِ وَيَمُدُّ بِالرَّحِيمِ
‘আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহুকে আল্লাহর নবী ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কেরাতের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তখন তিনি বললেনঃ তার কেরাত ছিল দীর্ঘ আকারের। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম টেনে টেনে পড়তেন। এরপর তিনি পড়লেন بسم الله الرحمن الرحيم তিনি بسم الله বিসমিল্লাহকে দীর্ঘ করলেন। الرحمن আর রাহমানকে দীর্ঘ করলেন। الرحيم আর রাহীমকে দীর্ঘ করলেন।’
* তেমনি উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কিরাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন:
كان يقطع قراءته آية آية-بسم الله الرحمن الرحيم-الحمد لله رب العالمين-الرحمن الرحيم-مالك يوم الدين
‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি একটি আয়াত করে আলাদা আলাদা ভাবে পড়তেন। তিনি পড়তেন- بسم الله الرحمن الرحيم তার পর (الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ) তারপর (الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ) ও তারপর (مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ) এভাবে আলাদা ভাবে পড়তেন।’
* ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
لاَ تَنْثُرُوهُ نَثْرَ الدَّقْل وَلاَ تَهُذُّوهُ كَهَذِّ الشِّعْرِ ، قِفُوا عِنْدَ عَجَائِبِهِ ، وَحَرِّكُوا بِهِ الْقُلُوبَ ، وَلاَ يَكُونُ هَمُّ أَحَدِكُمْ آخِرَ السُّورَةِ.
‘তোমরা একে (কুরআন) নষ্ট খেজুরের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ো না কিংবা কবিতার মতো গতিময় ছন্দেও পড়ো না। বরং এর যেখানে বিস্ময়ের কথা আছে সেখানে থামো এবং তা দিয়ে হৃদয়কে আন্দোলিত করো। আর সূরার সমাপ্তিতে পৌঁছা যেন তোমাদের কারো লক্ষ্য না হয়।’
অবশ্য এমন দ্রুত পাঠে কোনো সমস্যা নেই যেখানে কোনো অক্ষর বিলুপ্ত করলে বা ছুটে গেলে শাব্দিক কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি হয় না কিংবা যেখানে ইদগাম করা বিশুদ্ধ নয় সেখানে ইদগাম করলে শাব্দিক কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি হয় না এবং অর্থেরও কোনো পরিবর্তন হয় না। আর যদি এতে শাব্দিক ত্রুটি বিচ্যুতি হয় তাহলে হারাম হবে কারণ এটা কুরআনকে পরিবর্তন করার শামিল।
তিলাওয়াতে সিজদায় গিয়ে সিজদা করা:
কুরআন তিলাওয়াতকারী যখন অযু অবস্থায় থাকেন তখন দিন কিংবা রাত্রি যে কোনো সময় সিজদার আয়াত তিলাওয়াত করলে সিজদা আদায় করতে হবে।
সিজদা আদায়ের নিয়ম হলো: সিজদার জন্য প্রথমে আল্লাহু আকবার বলে সিজদায় যাবে এবং সিজদায় গিয়ে বলবে: سبحان ربى الأعلى এবং দো‘আ করবে। অতঃপর সিজদা থেকে তাকবীর ও সালাম ছাড়াই মাথা উঠাবে। কারণ তেলাওয়াতে সিজদা থেকে উঠার সময় তাকবীর ও সালাম দেওয়ার কোনো বর্ণনা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে পাওয়া যায় না। তবে যদি তিলাওয়াতে সিজদাটি সালাতের মধ্যে হয় তখন সিজদা দেওয়ার সময় এবং সিজদা থেকে মাথা উঠানোর সময়ও তাকবীর দিবে। কেননা,
* আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত যে:
أَنَّهُ كَانَ يُكَبِّرُ كُلَّمَا خَفَضَ وَرَفَعَ وَيُحَدِّثُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَفْعَلُ ذَلِكَ
তিনি যখনই মাথা অবনত করতেন এবং উত্তোলন করতেন তখনই তাকবীর বলতেন; আর তিনি (আবু হুরায়রা রা.) বলতেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটিই করতেন।’
* অনুরূপ আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন:
رأيت النبي صلى الله عليه وسلم يكبر في كل رفع وخفض وقيام وقعود
‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মাথা উঠানো, মাথা অবনত করা, দাঁড়ানো ও বসা এ প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহু আকবার বলতে শুনেছি।’
আর এটা সালাতের সিজদা ও সালাতে তিলাওয়াতে সিজদা উভয়কেই শামিল করে।
এ হলো কুরআন তিলাওয়াতের কতিপয় আদব। সুতরাং আপনারা এসব আদবের প্রতি যথাযথ লক্ষ্য রেখে তিলাওয়াত করবেন এবং আল্লাহর মেহেরবানী ও করুণা অন্বেষণ করবেন।
হে আল্লাহ! আমাদেরকে আপনি আপনার সম্মানিত বস্তুগুলোর সম্মান করার, আপনার দানগুলো আহরণ করে সফলতা লাভের, আপনার জান্নাতসমূহের ওয়ারিস হওয়ার তাওফীক দিন। আর হে পরম করুণাময়! আপনি আমাদেরকে, আমাদের পিতা-মাতা ও সকল মুসলিমকে স্বীয় রহমতে ক্ষমা করুন।
আর আমাদের নবী মুহাম্মদ, তাঁর পরিবার-পরিজন এবং সাহাবীদের প্রতি সালাত ও সালাম পেশ করুন।
চতুর্দশ আসরঃসিয়াম ভঙ্গের কারণসমূহ
সকল প্রশংসা সে আল্লাহর জন্য যিনি প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সকল বিষয়ের যথাযথ জ্ঞান রাখেন। যিনি বান্দার গোপন, প্রকাশ্য ও ধারণা সম্পর্কেও জ্ঞাত। যিনি তাঁর সৃষ্টিকে তৈরী ও তার শৈল্পিক বিন্যাসে একক। যিনি প্রতিটি সৃষ্টির যাবতীয় নড়া-চড়া ও স্থিরতা সবই নিয়ন্ত্রণ করেন। প্রতিটি বস্তু সৃষ্টি করেছেন সুন্দরভাবে, কর্ণ বিদীর্ণ করেছেন এবং চোখের মণি নির্ধারণ করেছেন। গাছে তার শাখা ও ডালে কত পাতা আছে তা তিনিই গুণে রেখেছেন। যমীনকে বিস্তৃত করেছেন এবং সেটাকে ছাড়িয়ে দিয়েছেন, আকাশকে প্রশস্ত করেছেন এবং সেটাকে উপরে উঠিয়েছেন। তারকাসমূহের তাদের কক্ষপথে পরিচালিত করেছেন এবং অন্ধকার রাতে ও তমসায় সেগুলোকে উদিত করেছেন। বৃষ্টিকে নাযিল করেছেন মুষল ও হাল্কাভাবে, আর এর মাধ্যমে তিনি বীজকে শুকিয়ে যাওয়া থেকে যথার্থভাবে উদ্ধার করেছেন। “এ হচ্ছে আল্লাহর সৃষ্টি সুতরাং তোমার দেখাও তিনি ব্যতীত অন্যরা কি সৃষ্টি করেছে?” [সূরা লুকমান: ১১] আমি তাঁর প্রশংসা করছি তাঁর দান ও দাক্ষিণ্যের উপর।
আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত কোনো হক ইলাহ নেই, যাঁর ইবাদতে কোনো শরীক নেই, তাঁর ক্ষমতাতেও কোনো শরীক নেই। আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল, যাঁকে তাঁর পক্ষ থেকে দলীল-প্রমাণাদি দিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করা হয়েছে।
আল্লাহ তার উপর সালাত পেশ করুন, অনুরূপ আবু বকরের ওপর যিনি সর্বাবস্থায় তার সাথী ছিলেন, উমরের উপর যিনি খসরু পারভেযকে তার সুরম্য অট্টালিকায় অস্বস্তিতে ফেলেছিলেন, উসমানের ওপর যিনি কুরআন নিয়ে বিনিদ্র রজনী যাপন করেছিলেন, আলীর ওপর যিনি খাইবারের দরজা উপড়ে ফেলেছিলেন এবং সেখানকার দূর্গসমূহকে স্থানচ্যুত করেছিলেন। আর তার পরিবার-পরিজন, সঙ্গী-সাথীগণ যাদের প্রত্যেক ব্যক্তি তার নড়া-চড়া ও স্থিরতার মধ্যে তার রবের আনুগত্যে যথাযথ শ্রম ব্যয় করেছেন। আর আল্লাহ তাদের উপর যথার্থ সালাম পেশ করুন।
ভাই সকল:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَٱلۡـَٰٔنَ بَٰشِرُوهُنَّ وَٱبۡتَغُواْ مَا كَتَبَ ٱللَّهُ لَكُمۡۚ وَكُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكُمُ ٱلۡخَيۡطُ ٱلۡأَبۡيَضُ مِنَ ٱلۡخَيۡطِ ٱلۡأَسۡوَدِ مِنَ ٱلۡفَجۡرِۖ ثُمَّ أَتِمُّواْ ٱلصِّيَامَ إِلَى ٱلَّيۡلِۚ﴾ [البقرة: ١٨٧]
‘আর এখন তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে সহবাস করতে পারো এবং আল্লাহ যা কিছু তোমাদের জন্য লিপিবদ্ধ করেছেন বা দান করেছেন তা আহরণ কর। আর ভক্ষণ করো, পান করো যতক্ষণ না রাতের কাল রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিস্কার দেখা যায়। অতঃপর তোমরা রাত পর্যন্ত সাওমকে পূর্ণ কর।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৭}
এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা সিয়াম ভঙ্গের মৌলিক নীতিমালা উল্লেখ করেছেন। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীসে তা পরিপূর্ণভাবে উল্লেখ করেছেন।
সিয়াম ভঙ্গের কারণসমূহ ৭ প্রকার:
প্রথম কারণ: স্ত্রী সহবাস
সহবাস বলতে বুঝায়, পুরুষের লিঙ্গ মহিলার জননেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করানো। এটা সিয়াম সাওম ভঙ্গের বড় কারণ এবং সিয়াম অবস্থায় সবচেয়ে বড় গোনাহের কাজ। সুতরাং যে সিয়াম অবস্থায় স্ত্রী সহবাস করল তার সিয়াম নষ্ট হয়ে যাবে। চাই তা ফরয হোক কিংবা নফল।
তাই সিয়াম পালনকারী যদি রমযানের সিয়াম পালন অবস্থায় স্ত্রী সহবাস করে, তাহলে তার জন্য সিয়ামের কাযাসহ ‘কঠোর কাফফারা’ আদায় করা আবশ্যক। এই কাফফারা হলো: একজন মুসলিম কৃতদাস-দাসীকে আযাদ করা। যদি সে কৃতদাস-দাসী না পায় তাহলে শরয়ী ওযর ছাড়া একাধারে দুই মাস সিয়াম পালন করা। শরয়ী ওযর হলো: দুই ঈদের দিন, আইয়্যামে তাশরীক কিংবা শারিরীক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ওজর। যেমন- রোগাক্রান্ত হওয়া কিংবা সিয়াম ভাঙ্গার নিয়ত ছাড়া সফর করা।
এর মধ্যে যদি সে কোনো ওযর ছাড়া একদিনও সিয়াম ভঙ্গ করে, তাহলে পুনরায় তাকে শুরু থেকে সিয়াম পালন করতে হবে। যাতে একাধারে দু’মাস সিয়াম পালন করা হয়। যদি দু’মাস একাধারে সিয়াম পালনে সক্ষম না হয় তাহলে ৬০জন মিসকিনকে খানা খাওয়াতে হবে। প্রতি মিসকীনকে ‘আধা কিলো ও ১০ গ্রাম’ ভাল মানের গম দিতে হবে।
* সহীহ মুসলিমে এসেছে:
إن رجلا وقع بامرأته في رمضان فاستفتي النبي صلى الله عليه وسلم عن ذلك فقال: هل تجد رقبة؟ قال لا، قال: هل تستطيع صيام شهرين، (يعني متتابعين كما في الروايات الأخرى) قال: لا، قال: فأطعم ستين مسكيناوهو في الصحيحين مطولا
‘জনৈক লোক রমযানে তার স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এ ব্যাপারে ফতওয়া জানতে চাইল? তখন তিনি বললেন: তুমি কি কৃতদাস আযাদ করতে পারবে। সে উত্তরে বললো জ্বি-না। তখন তিনি বললেন: তুমি কি একাধারে দু’মাস সাওম রাখতে পারবে। (একাধারে নিরবচ্ছিন্নভাবে সাওম রাখা অন্য রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে) সে বলল: জ্বি-না। তখন আল্লাহর রাসূল বললেন: তাহলে তুমি ৬০ জন মিসকীনকে খাওয়াও।’ হাদীসটি বুখারী ও মুসলিমে দীর্ঘাকারে এসেছে।
দ্বিতীয় কারণ: ইচ্ছাকৃত বীর্যপাত ঘটানো
চাই তা চুম্বন, স্পর্শ বা হস্তমৈথুন অথবা কামভাবসহ এমন কিছু করার মাধ্যমে হোক যা বীর্যপাত ঘটায়, এমন হলে সিয়াম ভেঙ্গে যাবে। কারণ এগুলো এমনসব কাজ যেগুলো পরিত্যাগ করা ব্যতীত সাওম সংঘটিত হতে পারে না। যেমন,
* হাদীসে কুদসীতে রয়েছে:
يَدَعُ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ وَشَهْوَتَهُ مِنْ أَجْلِي
‘(আল্লাহ তা‘আলা বলেন) সিয়াম পালনকারী আমার কারণে তার পানাহার ও কামভাব থেকে বিরত থাকে।’
আর চুম্বন বা স্পর্শ করাতে যদি বীর্যপাত না হয় তাহলে সিয়াম ভঙ্গ হবে না। কারণ,
* সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে এসেছে, তিনি বলেন,
أن النبي صلى الله عليه وسلم كان يقبل وهو صائم ويباشر وهو صائم ولكنه كان أملككم لأرِبِهِ.
‘নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাওম অবস্থায় স্ত্রী চুম্বন করতেন এবং সাওম অবস্থায় তিনি স্ত্রীদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন। কিন্তু তিনি তাঁর কামভাব তোমাদের চেয়ে অধিক নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম ছিলেন।’
* অনুরূপ সহীহ মুসলিমে এসেছে:
أنَّ عُمَرَ بْنِ أَبِي سَلَمَةَ سَأَلَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَيُقَبِّلُ الصَّائِمُ فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سَلْ هَذِهِ لِأُمِّ سَلَمَةَ فَأَخْبَرَتْهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَصْنَعُ ذَلِكَ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَدْ غَفَرَ اللَّهُ لَكَ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَمَا وَاللَّهِ إِنِّي لَأَتْقَاكُمْ لِلَّهِ وَأَخْشَاكُمْ لَهُ.
‘উমর ইবন আবূ সালমা রাসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন। সাওম পালনকারী কি চুম্বন করতে পারবে? তখন আল্লাহর নবী বললেন, একে জিজ্ঞাসা কর অর্থাৎ উম্মে সালমাকে (যিনি রাসূলের সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্ত্রী ছিলেন) অতঃপর উম্মে সালমা বলে দিলেন, আল্লাহর রাসূল এমনটি করতেন। তখন তিনি আরয করলেন ইয়া রাসুলাল্লাহ! আল্লাহ কি আপনার পূর্বাপর সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেন নি? নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, শুনে রাখ আল্লাহর কসম করে বলছি, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের চেয়ে অধিক তাকওয়ার অধিকারী এবং আমি আল্লাহকে অধিক ভয় করি।’
অবশ্য যদি সাওম পালনকারী চুম্বন বা অন্য কিছুর মাধ্যম বীর্যপাতের আশঙ্কা বোধ করে কিংবা তাদের এ চুম্বন সহবাস পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেবে এবং সে তার কাম উত্তেজনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। তখন তার ওপর চুম্বন ও অন্য আচরণগুলো হারাম হবে। এটা হচ্ছে অন্যায়ে পথ রুদ্ধ করা এবং সাওম ভঙ্গ থেকে সাওমকে হেফাজত করার জন্য। এ জন্যই আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাওম পালনকারী অযুকারীকে নাকের মধ্যে ভালোভাবে পানি টানার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছিলেন। কারণ, সাওম পালনকারী ভালোভাবে নাকে পানি দিলে পেটের ভেতরে পানি চলে যাবার আশঙ্কা আছে তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরূপ করতে নিষেধ করেছেন; যাতে সাওম ফাসেদ না হয়ে যায়।
তবে কোনো স্বপ্নদোষের মাধ্যমে কিংবা কোনো চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই যদি বীর্যপাত হয় তাহলে সাওম ভঙ্গ হবে না। কারণ স্বপ্নদোষ সাওম পালনকারীর ইচ্ছায় হয়নি। আর চিন্তা-ভাবনার বিষয়টি ক্ষমারযোগ্য। কারণ,
* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
إِنَّ اللَّهَ تَجَاوَزَ عَنْ أُمَّتِي مَا حَدَّثَتْ بِهِ أَنْفُسَهَا مَا لَمْ تَعْمَلْ أَوْ تَتَكَلَّمْ
‘নিশ্চয় আল্লাহ আমার উম্মতকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, যা আমার উম্মত মনে মনে কল্পনা করে যাবৎ তা বাস্তবায়ন করে কিংবা আলাপ করে।”
তৃতীয় কারণ: পানাহার করা
পানাহার করা বলতে, যে কোনো প্রকার খাদ্য বা পানীয় দ্রব্য মুখ বা নাক দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করানোকে বুঝায়। কারণ,
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَكُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكُمُ ٱلۡخَيۡطُ ٱلۡأَبۡيَضُ مِنَ ٱلۡخَيۡطِ ٱلۡأَسۡوَدِ مِنَ ٱلۡفَجۡرِۖ ثُمَّ أَتِمُّواْ ٱلصِّيَامَ إِلَى ٱلَّيۡلِۚ ﴾ [البقرة: ١٨٧]
‘তোমরা পানাহার কর, যতক্ষণ না রাতের কালো রেখা থেকে ভোরের সাদা রেখা তোমাদের কাছে স্পষ্ট হয়। অতঃপর সিয়ামকে রাত পর্যন্ত পূর্ণ কর।’ {সূরা আল-বাকারা: ১৮৭}
আর নাক দিয়ে কিছু প্রবেশ করানো পানাহারের মতোই। কারণ,
* লাকীত ইবনে সুবরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর হাদীসে এসেছে:
وَبَالِغْ فِي الِاسْتِنْشَاقِ إِلَّا أَنْ تَكُونَ صَائِمًا
‘(রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ) তুমি অযুর সময় নাকে ভালোভাবে পানি পৌঁছিয়ে দাও অবশ্য সাওম পালনকারী হলে এমন করবে না।’
আর নাকে গন্ধের ঘ্রাণ নিলে সাওম ভাঙ্গবে না। কারণ ঘ্রাণের এমন কোনো দৃশ্যমান শরীর নেই যা পেটের ভেতরে প্রবেশ করবে।
চতুর্থ কারণ: পানাহারের অনুরূপ বস্তু গ্রহণ করা
এটা দু’ ধরনের হয়ে থাকে।
এক: সিয়াম অবস্থায় রক্তপাত কিংবা অন্য কোনো কারণে রক্তে প্রয়োজন হলে যদি রক্ত দেয়া হয়, তাহলে সিয়াম ভেঙ্গে যাবে। কেননা পানাহারের পুষ্টির চূড়ান্ত পর্যায় হলো রক্ত। রক্ত গ্রহণের মাধ্যমে সে-ই পুষ্টি অর্জিত হয়।
দুই: যেসব ইনজেকশন খাদ্য ও পানীয়ের বিকল্প, তা প্রয়োগ করা হলেও সিয়াম ভেঙ্গে যাবে। যদিও তা বাস্তবে খাদ্য ও পানীয় নয়, কিন্তু খাদ্য-পানীয়ের বিকল্প। সুতরাং তা খাদ্য ও পানীয়ের বিধান রাখবে।
আর যে ইনজেকশন খাদ্যের পরিপূরক নয়: তা দ্বারা সিয়াম ভঙ্গ হবে না। যদিও ইনজেকশন মাংসপেশী কিংবা রগে নেয়া হয়। এমনকি কণ্ঠনালীতেও যদি এর প্রভাব যায় তাহলেও সিয়াম ভঙ্গ হবে না। কেননা তা খাদ্যও নয় পানীয়ও নয়; তাছাড়া তা খাদ্য বা পানীয়ের অর্থেও পড়ে না। সুতরাং এর দ্বারা খাদ্য বা পানীয়ের বিধান প্রযোজ্য হবে না।
আর খাদ্য বা পানীয় ছাড়া কণ্ঠনালীতে অন্য কোনো স্বাদের প্রভাব ধর্তব্য নয়।
* এজন্য আমাদের ফকীহগণ বলেন: ‘যদি সাওম পালনকারীর পায়ে কোনো তিক্ত জিনিস ঘর্ষণের ফলে সে এর স্বাদ কণ্ঠনালীতে পায় তাহলে সাওম ভাঙ্গবে না।’
* শায়খুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া রহ. তাঁর ‘হাকীকতুস সিয়াম’ রিসালায় বলেছেন: ‘কুরআন ও সুন্নাহর দলীল-প্রমাণাদিতে এমন কিছু আসে নি যার ভিত্তিতে দাবি করা যায় যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিকট তা-ই সাওম ভঙ্গকারী যা মগজে পৌঁছে কিংবা শরীরে পৌঁছে কিংবা কোনো গহ্বর দিয়ে প্রবেশ করে অথবা মুখগহ্বরে প্রবেশ করে, কিংবা এধরনের অন্যান্য যেসব বিষয়কে এ-মতামতের প্রবক্তাগণ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিকটে এ হুকুমের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। (অর্থাৎ এগুলোর কোনোটিই সাওম ভঙ্গের মূল কারণ হিসেবে প্রমাণিত হয় নি।)
তিনি আরও বলেন: ‘যখন এটা প্রমাণিত হলো না যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এসব বৈশিষ্ট্য বা কারণকে সাওম ভঙ্গ হওয়ার কারণ বলে নির্ধারণ করেছেন, তখন কেউ যদি বলে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এগুলোকে সাওম ভঙ্গের কারণ নির্ধারণ করেছেন, তবে তা হবে আল্লাহর উপর না জেনে কথা বলা।’
পঞ্চম কারণ: সিঙ্গার মাধ্যমে রক্ত বের করা
কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
أَفْطَرَ الحَاجِمُ وَالمَحْجُومُ
‘সিঙ্গা যে লাগায় ও যে সিঙ্গা গ্রহণ করে- উভয়ের সিয়াম ভঙ্গ হবে।’
ইমাম বুখারী রহ. বলেন. ‘এ অধ্যায়ে এর চেয়ে অধিক বিশুদ্ধ হাদীস আর নেই।’
আর এটাই ইমাম আহমদ ও অধিকাংশ ফকীহের মাযহাব।
সিঙ্গা দ্বারা রক্ত বের করার অর্থে আরো রয়েছে শিরা কেটে রক্ত বের করা ও এ জাতীয় কর্মকাণ্ড; যা দিয়ে রক্ত প্রদান করলে শরীরে শিঙ্গা দেওয়ার মত প্রভাব পড়ে।
সুতরাং ফরয সিয়াম পালনকারীর জন্য কাউকে রক্তদান করা বৈধ নয়; তবে যদি এমন কোনো অত্যাবশ্যক অবস্থায় পতিত হয়; যা ফরয সিয়ামপালনকারীর রক্তদান দ্বারাই কেবল সমাধান হতে পারে, আর রক্ত দেওয়ার কারণে সাওমপালনকারীরও ক্ষতি না হয় তখন অত্যাবশ্যকতার কারণে রক্ত প্রদান করা জায়েয হবে এবং সে ওই দিনের সাওম ভঙ্গ করবে ও পরবর্তীতে তা কাযা করে নিবে।
অবশ্য নাক দিয়ে রক্ত পড়া, কফের সঙ্গে রক্ত বের হওয়া, অর্শ রোগের কারণে রক্ত বের হওয়া, দাঁত উঠানোজনিত কারণে রক্ত বের হওয়া, ক্ষতস্থান ফেটে রক্ত বের হওয়া কিংবা সুঁই দিয়ে খোচা দিয়ে রক্ত বের করা ও এ জাতীয় কাজে সাওম ভঙ্গ হয় না। কারণ; এগুলো শিঙ্গাও নয়, তার মতও নয়; কেননা এগুলো শরীরে শিঙ্গার মত প্রভাব ফেলে না।
ষষ্ঠ কারণ: ইচ্ছাকৃত মুখ ভরে বমি করা
বমি হচ্ছে, পাকস্থলীতে খাবার বা পানীয় যা কিছু রয়েছে তা মুখ দিয়ে বের করে দেওয়া। বমি দ্বারা সাওম নষ্ট হয়, কারণ;
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
مَنْ ذَرَعَهُ القَيْءُ، فَلَيْسَ عَلَيْهِ قَضَاءٌ، وَمَنْ اسْتَقَاءَ عَمْدًا فَلْيَقْضِ
‘যে ব্যক্তির অনিচ্ছাকৃত বমি হলো, তার ওপর কোনো কাযা নেই। তবে যে ইচ্ছাকৃত বমি করল, সে যেন কাযা করে নেয়।’
ইচ্ছাকৃত বমি করলে সিয়াম ভঙ্গ হয়ে যাবে। চাই পেট চেপে বমি করুক, কিংবা কণ্ঠনালীতে কিছু প্রবেশ করিয়ে বমি করুক কিংবা এমন বস্তুর ঘ্রাণ নিল, যাতে বমি আসে, অথবা এমন বস্তুর দিকে ইচ্ছে করে নজর দিল যার কারণে বমি হয়। এসব কারণে সিয়াম ভেঙ্গে যাবে।
আর যদি কোনো কারণ ছাড়া বমি হয়, তাহলে সাওমের কোনো ক্ষতি নেই।
আর যদি পাকস্থলী বমি করতে চায় তাহলে সেটাকে চেপে রাখাও সাওমপালনকারীর জন্য আবশ্যক নয়; কেননা এটা তার ক্ষতি করবে, বরং সেটাকে তার অবস্থায় ছেড়ে দিবে, অর্থাৎ সে বমি করতে চেষ্টা করবে না, বমি বন্ধ করতেও চেষ্টা করবে না।
সপ্তম কারণ: হায়েয তথা ঋতু বা নেফাস তথা সন্তান প্রসবের রক্ত বের হওয়া।
* কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
أَلَيْسَ إِذَا حَاضَتْ لَمْ تُصَلِّ وَلَمْ تَصُمْ
‘নারীর যখন হায়েয হয়, তখন সালাত আদায় করে না এবং সিয়ামও পালন করে না, তা নয় কি?’
যখন কোনো মহিলার হায়েয হয় কিংবা নেফাসের রক্ত দেখে তখন তার সাওম ভেঙ্গে যাবে। চাই সে দিনের শুরুতে দেখুক কিংবা শেষভাগে দেখুক। এমনকি যদিও তা সূর্য ডোবার এক ক্ষনিক আগেও হয়।
আর যদি সে অনুভব করে যে রক্ত বের হওয়া শুরু হচ্ছে, কিন্তু সূর্য ডোবার পরই শুধু সেটা বের হয়, তবে তাতে তার সাওম শুদ্ধ হয়ে যাবে।
সাওম পালনকারীর উপর হারাম হবে, উপরোক্ত সাওম ভঙ্গের কারণসমূহের যে কোনো একটি করা, যদি সাওমটি হয় ফরয সাওম, যেমন রমযানের সাওম। অথবা যদি সেটা হয় ওয়াজিব সাওম যেমন, কাফফারার সাওম ও মান্নতের সাওম। অবশ্য যদি সাওম ভাঙ্গার শরয়ী ওযর থাকে তাহলে সেটা ভিন্ন কথা। কারণ যে ব্যক্তি ওয়াজিব শুরু করে তার জন্য সহীহ কোনো ওযর ছাড়া এটা পরিপূর্ণ করাটা আবশ্যক। তারপর যদি কেউ কোনো ওযর ছাড়া রমযানের দিনের বেলায় এ হারামসমূহের কোনো একটা করে বসে তাহলে তার ওপর বাকী দিন পানাহার থেকে বিরত থাকা এবং কাযা করা ওয়াজিব। অবশ্য অন্যান্য ওয়াজিব সাওমের ক্ষেত্রে শুধু কাযা করতে হবে, পানাহার থেকে বিরত থাকতে হবে না।
আর যদি নফল সাওম হয়, তাহলে কোনো ওযর ছাড়াই সাওম ভাঙ্গা জায়েয। কিন্তু সাওম পুরা করাই উত্তম।
প্রিয় ভাইসব! তোমরা আল্লাহর আনুগত্যের ব্যাপারে যতœবান হও। পাপাচার ও হারাম থেকে বিরত থাক। আসমান ও যমীনের সৃষ্টিকর্তার দিকে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা কর, তাঁর দানের বিশেষ সময়গুলোকে যথাযথভাবে কাজে লাগাও; তিনি তো অফুরন্ত দানশীল। আর জেনে রেখো! তোমরা তোমাদের মাওলার আনুগত্যে যে সময় কাটিয়েছ দুনিয়া থেকে তা-ই শুধু তোমাদের প্রাপ্তি। সুতরাং সময় চলে যাওয়ার পূর্বে সময়কে গনীমত মনে করে তার যথাযথ সদ্ব্যবহার করো। ক্ষতি আপতিত হওয়ার আগেই লাভকে বেছে নাও।
হে আল্লাহ! আপনি আমাদের সময়গুলোকে কাজে লাগাবার তাওফীক দিন, আর আমাদেরকে নেক কর্মসমূহে ব্যস্ত রাখুন।
হে আল্লাহ! আমাদের উপর দয়া ও অনুগ্রহ দান করুন আর আমাদের সঙ্গে ক্ষমা ও মার্জনার আচরণ করুন।
হে আল্লাহ! আমাদের জন্য নেক কাজ তথা জান্নাতের রাস্তাসমূহকে সহজ করে দিন আর কঠিন কাজ তথা জাহান্নামের আমল থেকে আমাদেরকে দূরে রাখুন এবং আমাদেরকে আখেরাত ও দুনিয়াতে ক্ষমা নসীব করুন।
হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে আমাদের নবীর শাফা‘আত নসীব করুন এবং আমাদেরকে তাঁর হাউজে উপনীত করুন আর তা থেকে পান করিয়ে এমনভাবে পরিতৃপ্ত করুন যে আর কখনো পিপাসা না লাগে হে সৃষ্টিকুলের রব।
হে আল্লাহ আপনি সালাত, সালাম ও বরকত নাযিল করুন আপনার বান্দা ও নবী মুহাম্মাদের ওপর এবং তার পরিবার-পরিজন ও সকল সঙ্গী-সাথীর ওপর।
পঞ্চদশ আসরঃসিয়াম ভঙ্গের শর্তাবলি এবং যে কাজে সিয়াম ভাঙে না আর সাওম পালনকারীর জন্য যা করা জায়েয
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি প্রজ্ঞাময় স্রষ্টা, মহীয়ান সহিষ্ণু সত্যবাদী, দয়ালু সম্মানিত রিযিকদাতা, সাত রাস্তা তথা আসমানকে কোনো প্রকার খুঁটি ও লগ্নি ছাড়াই উপরে উঠিয়েছেন, যমীনকে সুঊচ্চ পাহাড় দ্বারা সুস্থিরভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাঁর সৃষ্টির কাছে দলীল-প্রমাণাদি ও মৌলিক তত্ত্বের মাধ্যমে পরিচিত হয়েছেন, সকল সৃষ্টিকুলের রিযিকের দায়িত্ব নিজেই গ্রহণ করেছেন, মানুষকে সৃষ্টি করেছেন সবেগে স্খলিত পানি থেকে, তাকে শরীয়ত দিয়ে বেঁধে দিয়েছেন যাতে সে সম্পর্ক ঠিক রাখে, যেগুলো তাঁর মনঃপুত হয় না এমন ভুল-ভ্রান্তি তার থেকে মার্জনা করেছেন। আমি তার প্রশংসা করি যতক্ষণ নির্বাক চুপ থাকে আর যতক্ষণ কোনো কথক কথা বলে।
আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই, এটা নিষ্ঠাবানের সাক্ষ্য কোনো মুনাফিকের সাক্ষ্য নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল যার দাওয়াত উপর-নীচ সকল স্থানকে ব্যাপকভাবে অন্তর্ভুক্ত করে। আল্লাহ তাঁর উপর সালাত পেশ করুন, অনুরূপ তাঁর সাথী আবু বকরের উপর, যিনি উপযুক্ত বিচক্ষণতার সাথে মুরতাদদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন, আর ‘উমারের ওপর, যিনি কাফেরদের মাথাব্যাথার কারণ হয়েছিলেন এবং বন্ধ দরজা খুলেছিলেন, আর ‘উসমানের উপর, যার সম্মানকে পাষণ্ড-সীমালঙ্ঘনকারী ব্যতীত কেউ নষ্ট করেনি, অনুরূপভাবে ‘আলীর ওপর, যিনি তাঁর বীরত্বের কারণে সংকীর্ণ পথেও হাটতে সক্ষম ছিলেন। তদ্রূপ রাসূলের সকল পরিবার-পরিজন, সকল সাহাবী যাদের প্রত্যেকেই অন্যদের উপর পেয়েছিলেন শ্রেষ্ঠত্ব। আর আল্লাহ তাদের যথাযথ সালামও প্রদান করুন।
আমার ভাইয়েরা! পূর্বে আমরা সিয়াম ভঙ্গের কারণসমূহ নিয়ে আলোচনা করেছি। হায়েয ও নেফাস ছাড়া সিয়াম ভঙ্গের অন্যান্য কারণসমূহ যেমন, সহবাস করা, সরাসরি বীর্যপাত ঘটানো, খাদ্য কিংবা এ জাতীয় কিছু খাওয়া বা ব্যবহার করা এবং শিঙ্গা লাগানো ও বমি করা এ সব কিছু দ্বারা কেবল তখনই সাওম ভঙ্গ হবে যখন তা জেনে শুনে, স্মরণ করে ও স্বপ্রণোদিত হয়ে করে।
সুতরাং বোঝা গেল যে, সাওম ভঙ্গ হওয়ার জন্য তিনটি শর্ত রয়েছে:
প্রথম শর্ত: সিয়াম ভঙ্গের কারণ সম্পর্কে জ্ঞান থাকা
তাই যদি না জেনে উপরোক্ত বিষয়ের কোনো একটিতে লিপ্ত হয়, তাহলে সিয়াম ভঙ্গ হবে না। কারণ,
* আল্লাহ তা‘আলা সূরা আল-বাকরায় বলেন:
﴿ رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذۡنَآ إِن نَّسِينَآ أَوۡ أَخۡطَأۡنَاۚ ﴾ [البقرة: ٢٨٦]
‘হে আমাদের রব! আপনি আমাদের পাকড়াও করবেন না, যদি আমরা ভুলে যাই কিংবা কোনো ভুল করে বসি।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৮৬} তখন আল্লাহ তা‘আলা বললেন, “অবশ্যই আমি তা কবুল করেছি”।
* অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَلَيۡسَ عَلَيۡكُمۡ جُنَاحٞ فِيمَآ أَخۡطَأۡتُم بِهِۦ وَلَٰكِن مَّا تَعَمَّدَتۡ قُلُوبُكُمۡۚ وَكَانَ ٱللَّهُ غَفُورٗا رَّحِيمًا ٥ ﴾ [الاحزاب: ٥]
‘আর তোমরা ভুলে যা কর, তাতে কোনো অপরাধ নেই। অবশ্য ইচ্ছাপূর্বক তোমাদের হৃদয় যা করছে তার ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, অতিশয় দয়ালু।’ {সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৫}
না জানার কারণে সাওম না ভাঙ্গার বিষয়টি ব্যাপক, হতে পারে সে শরীয়তের হুকুম সম্পর্কে অজ্ঞ। যেমন, সে ধারণা করে যে এ জিনিসটা সাওম ভাঙ্গবে না, ফলে তা করে বসে। অথবা কাজ করা অবস্থায় বা সময়ে সেটি তার অজানা ছিল। যেমন, সে ধারণা করে যে, ফজর বা সুবহে সাদিক এখনও উদিত হয়নি, ফলে সে খাওয়া-পিনা চালিয়ে যায় অথচ ফজর উদিত হয়ে গেছে। কিংবা সূর্য অস্তমিত হয়ে গেছে মনে করে খেয়ে ফেলল অথচ সূর্য তখনও অস্ত যায় নি। এসব কারণে সাওম ভঙ্গ হবে না। কারণ,
* সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আদী ইবনে হাতেম রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,
لما نزلت هذه الآية ﴿حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْأَسْوَدِ﴾ عمدت إلى عقالين أحدهما أسود والآخر أبيض فجعلتهما تحت وسادتي وجعلت أنظر إليهما فلما تبين لي الأبيض من الأسود أمسكت فلما أصبحتُ غدوتُ إلى رسول الله صلى الله عليهِ وسلم فأخبرتُهُ بالذي صنعتُ، فقال النبي صلى الله عليه وسلم: إن وسادك إذن لعريض إن كان الخيط الأبيض والأسود تحت وسادك، إنما ذلك بياض النهار وسواد الليل.
“যখন নাযিল হলো এই আয়াতটি,
﴿حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْأَسْوَدِ﴾ [البقرة: ১৮৭]
“যতক্ষণ না স্পষ্টভাবে দেখা যায় কালো রেখা থেকে শুভ্র রেখা” তখন আমি দু’টি সুতা নিলাম, একটা কালো অপরটি সাদা। উভয়টাকে আমার বালিশের নীচে রাখলাম এবং উভয়ের দিকে তাকাতাম। অতঃপর যখন আমার নিকট কালো সূতা থেকে শুভ্র সুতাটা পরিস্কার ভাবে দেখা গেল তখন আমি পানাহার থেকে বিরত থাকলাম। অতঃপর যখন সকাল হলো তখন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট গিয়ে যা করলাম সে ঘটনা জানালাম। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাহলে তোমার বালিশ তো বেশ বড় ও প্রশস্ত, যদি তোমার বালিশের নীচে থাকে শ্রভ্র ও কালো সুতা। এটা তো দিনের শুভ্রতা ও রাতের কৃষ্ণতা।”
এ হাদীসে দেখা যাচ্ছে যে, ‘আদী রাদিয়াল্লাহু আনহু সুবহে সাদিক উদিত হওয়ার পরও খেয়েছেন। দুটো রেখা পরিস্কার দেখা না যাওয়া পর্যন্ত তিনি পানাহার পরিত্যাগ করেন নি। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সাওমটি কাযা করার নির্দেশও দেননি; কারণ তিনি এর হুকুম সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন।
* অনুরূপ সহীহ বুখারীতে আসমা বিনতে আবি বকর রাদিয়াল্লাহু আনহা এর হাদীসে এসেছে। তিনি বলেন,
أفطرنا في عهد النبي صلى الله عليه وسلم يوم غيم ثم طلعت الشمس.
“আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে ইফতার করেছিলাম এক মেঘলা দিনে তারপর সূর্য দেখা গিয়েছিল।”
এখানে তিনি উল্লেখ করেননি যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে সাওমটি কাযা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন; কারণ তাদের সময় অজানা ছিল। আর কাযার নির্দেশ যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিয়েই থাকতেন তবে তা অবশ্যই বর্ণিত হতো; কেননা এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা বর্ণনার ক্ষেত্রে মানুষের হিম্মতের অভাব হতো না।
বরং শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ তার ‘হাকিকাতুস সিয়াম’ নামক রেসালায় বলেন,
إنه نقلَ هِشَامُ بنُ عُرْوَةَ أحدُ رواة الحَدِيثِ عن أبيه عروة: أنهم لم يؤمروا بالقضاء.
এ হাদীস বর্ণনাকারীদের অন্যমত হিশাম ইবনে ‘উরওয়াহ তার পিতা ‘উরওয়াহ থেকে বর্ণনা করেন, “তাদেরকে কাযা করার নির্দেশ দেওয়া হয় নি।”
কিন্তু যখনই জানতে পারবে যে, দিন এখনও বাকী রয়েছে এবং সূর্য অস্ত যায়নি, তখন থেকে (দিনের অবশিষ্টাংশ) সূর্য অস্তমিত হওয়া পর্যন্ত পানাহার ইত্যাদি থেকে বিরত থাকবে।
উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ সুবহে সাদিক উদিত হওয়ার পর ভক্ষণ করে এ মনে করে যে সুবহে সাদিক এখনো উদিত হয় নি। অতঃপর তার নিকট স্পষ্ট হলো যে, সুবহে সাদিক উদিত হয়ে গেছে, তাহলে তার রোযা সহীহ হবে, তার উপর কাযা আবশ্যক হবে না। কারণ সে সময়ের ব্যাপারে অজ্ঞ ছিল। আর আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য পানাহার ও সহবাসকে সুবহে সাদিক স্পষ্ট হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত হালাল করেছেন। আর অনুমতি দেয়া বৈধ জিনিসের কাযা করার নির্দেশ দেয়া হয় না।
দ্বিতীয় শর্ত: সিয়ামের কথা স্মরণ থাকা
সুতরাং যদি সিয়াম পালনকারী নিজ সিয়ামের কথা ভুলে সাওম ভঙ্গকারী কোনো কাজ করে ফেলে তাহলে তার সিয়াম শুদ্ধ হবে, তাকে আর সেটা কাযা করতে হবে না। যেমনটি সূরা বাকারার আয়াতে গত হয়েছে।
* তাছাড়া আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
مَنْ نَسِيَ وَهُوَ صَائِمٌ، فَأَكَلَ أَوْ شَرِبَ، فَلْيُتِمَّ صَوْمَهُ، فَإِنَّمَا أَطْعَمَهُ اللهُ وَسَقَاهُ
‘যে সিয়াম পালনকারী ভুলে পানাহার করল, সে যেন তার সিয়াম পূর্ণ করে; কেননা আল্লাহই তাকে পানাহার করিয়েছেন।’
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক সাওম পরিপূর্ণ করার নির্দেশ প্রদান সে সাওম সহীহ হওয়ার স্পষ্ট দলীল। আর ভুলে যাওয়া ব্যক্তির খাওয়ানো ও পান করানোর সম্পর্ক আল্লাহর দিকে করা প্রমাণ করে যে এর উপর কোনো পাকড়াও বা জবাবদিহিতা নেই।
কিন্তু যখনই স্মরণ হবে কিংবা কেউ স্মরণ করিয়ে দেবে তখনই: সেটা থেকে বিরত থাকবে এবং মুখে কিছু থাক
লে তাও নিক্ষেপ করবে; কারণ এখন তার ওযর দূরীভূত হয়েছে।
আর যখন কেউ দেখবে যে, সাওম পালনকারী ব্যক্তি খাচ্ছে কিংবা পান করছে, তখন তার উচিত হবে সাওম পালনকারীকে সতর্ক করে দেওয়া। কারণ,
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَتَعَاوَنُواْ عَلَى ٱلۡبِرِّ وَٱلتَّقۡوَىٰۖ ﴾ [المائ‍دة: ٢]
“তোমরা সদাচারণ ও তাকওয়ার কাজে পরস্পর সহযোগিতা কর।” [সূরা আল-মায়েদাহ: ২]
তৃতীয় শর্ত: স্বতঃস্ফূর্তভাবে সিয়াম ভঙ্গ করা
অর্থাৎ সিয়াম ভঙ্গকারী নিজের পছন্দ ও ইচ্ছা অনুযায়ী যদি সিয়াম ভঙ্গকারী কিছু করে তবেই কেবল তার সিয়াম নষ্ট হবে। অন্যথায় যদি সিয়াম পালনকারীকে জোর-জবরদস্তি করে সিয়াম ভঙ্গ করানো হয় তবে তার সিয়াম বিশুদ্ধ হবে, তার আর সেটা কাযা করা লাগবে না। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা কুফুরীর হুকুমকে সে ব্যক্তি থেকে উঠিয়ে নিয়েছেন যাকে কুফুরী করতে জোর করে বাধ্য করা হয়েছে, যখন তার অন্তর ঈমানের ওপর অটল থাকে।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿مَن كَفَرَ بِٱللَّهِ مِنۢ بَعۡدِ إِيمَٰنِهِۦٓ إِلَّا مَنۡ أُكۡرِهَ وَقَلۡبُهُۥ مُطۡمَئِنُّۢ بِٱلۡإِيمَٰنِ وَلَٰكِن مَّن شَرَحَ بِٱلۡكُفۡرِ صَدۡرٗا فَعَلَيۡهِمۡ غَضَبٞ مِّنَ ٱللَّهِ وَلَهُمۡ عَذَابٌ عَظِيمٞ ١٠٦ ﴾ [النحل: ١٠٦]
“কেউ তার ঈমান আনার পর আল্লাহ্‌র সাথে কুফরী করলে এবং কুফরীর জন্য হৃদয় উন্মুক্ত রাখলে তার উপর আপতিত হবে আল্লাহ্‌র গযব এবং তার জন্য রয়েছে মহাশাস্তি ; তবে তার জন্য নয়, যাকে কুফরীর জন্য বাধ্য করা হয় কিন্তু তার চিত্ত ঈমানে অবিচলিত।” {সূরা আন-নাহল, আয়াত: ১০৬}
সুতরাং যদি আল্লাহ তা‘আলা জোর-জবরদস্তি ও বাধ্য করার কারণে কুফরির হুকুমও তুলে দিয়েছেন তাহলে কুফরির চেয়ে ছোট অপরাধ তো উঠে যাবেই।
* অনুরূপভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إِنَّ اللَّهَ قَدْ تَجَاوَزَ عَنْ أُمَّتِي الْخَطَأَ ، وَالنِّسْيَانَ ، وَمَا اسْتُكْرِهُوا عَلَيْهِ.
‘নিশ্চয় আল্লাহ আমার উম্মতের ভুল, বিস্মৃতি এবং বাধ্য হয়ে করা বিষয় ক্ষমা করেছেন।’
আর যদি কোনো লোক তার স্ত্রীকে সহবাস করতে বাধ্য করে অথচ সে সাওম পালনকারিনী, তাহলে মহিলার সাওম শুদ্ধ হবে। তাকে সেটার কোনো কাযা করতে হবে না। যদিও লোকটির জন্য বৈধ নয় স্ত্রীকে সাওম অবস্থায় সহবাসে বাধ্য করা। হ্যাঁ, যদি কোনো মহিলা তার স্বামীর উপস্থিতিতে তার অনুমতি ব্যতীত নফল সাওম পালন করে সেটা ভিন্ন কথা।
যদি কোনো ধুলা-বালি উড়ে গিয়ে সাওম পালনকারীর পেটের ভিতরে চলে যায় কিংবা অনিচ্ছাকৃতভাবে পেটের মধ্যে কোনো কিছু ঢুকে কিংবা কুলি বা নাকে পানি দেওয়ার ফলে অনিচ্ছাকৃতভাবে পেটের ভেতর কিছু পানি প্রবেশ করে, তবে তার সাওম বিশুদ্ধ হবে। তার উপর কাযা করতে হবে না।
আর চোখে সুরমা ও ঔষধ ব্যবহার করলে সাওম ভঙ্গ হবে না। যদিও এর স্বাদ সে কণ্ঠনালীতে পায়। কারণ এটা খাদ্য ও পানীয় নয় এবং সমপর্যায়েরও নয়।
কানের মধ্যে ফোটা ফোটা করে ঔষধ দিলেও সাওম ভাঙ্গবে না। আর কোনো ক্ষত স্থানে ঔষধ দিলেও সাওম ভঙ্গ হয় না। যদিও সে ঔষধের স্বাদ কন্ঠনালীতে পায়। কারণ এটা খাদ্য নয় পানীয় নয়- এবং উভয়ের সমপর্যায়েরও নয়।
* শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া তার ‘‘হাকীকাতুস সিয়াম’’ গ্রন্থে বলেন, আমরা জানি, কুরআন ও সুন্নায় এমন কিছু নেই যা প্রমাণ করে যে এ বস্তুগুলো দ্বারা সাওম ভঙ্গ হবে, তাই আমরা জানলাম যে, এগুলো সাওম ভঙ্গকারী নয়।’
* তিনি আরো বলেন, সিয়াম মুসলিমদের দ্বীনে এমন একটি বিষয় যা সাধারণ মানুষ ও বিশেষ মানুষ সকলেরই জানা দরকার। যদি এসব বিষয় আল্লাহ ও তার রাসূল সিয়াম অবস্থায় হারাম করে থাকতেন এবং এর দ্বারা সাওম নষ্ট হতো, তবে অবশ্যই এটা বর্ণনা করা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর আবশ্যক হতো। আর যদি তিনি এটা উল্লেখ করতেন তাহলে সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমও তা জেনে যেতেন এবং তারা তা গোটা উম্মতকে পৌঁছিয়ে দিতেন যেমনি ভাবে তারা পুরা শরীয়তকে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং যখন কোনো আলেম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে না কোনো সহীহ, দ্ব‘য়ীফ, মুসনাদ, কিংবা মুরসাল কোনো প্রকার হাদীসই বর্ণনা করেন নি, তখন জানা গেলো যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এগুলোর কোনো কিছুই উল্লেখ করেন নি। আর সুরমার ব্যাপারে বর্ণিত হাদীস অর্থাৎ ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরামদায়ক সুরমা ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং বলেছেন,
ليتقه الصائم
“রোযাদার যেন এর ব্যবহার থেকে বিরত থাকে।” এটা দুর্বল হাদীস। ইমাম আবু দাউদ তার সুনান গ্রন্থে এটাকে সংকলন করেছেন। তিনি ব্যতীত অন্য কেউ এটা বর্ণনা করেন নি। ইমাম আবূ দাউদ বলেন, আমাকে ইয়াহইয়াহ ইবনে মা‘ঈন বলেন, এ হাদীসটি মুনকার।’
* শাইখুল ইসলাম আরো বলেন, ‘যে সব হুকুম-আহকাম জাতির জন্য জানা জরুরী, অবশ্যই নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি অসাল্লামকে তা সাধারণভাবে বর্ণনা করতে হতো। আর অবশ্যই উম্মতরা এটা বর্ণনা করতো। অতঃপর যখন এটা এটা পাওয়া গেল না, তখন বুঝা গেল যে, এটা তাঁর দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত বিষয় নয়।’ শাইখের বক্তব্য এখানেই শেষ। শাইখের এ বক্তব্য অত্যন্ত সুদৃঢ় যা সুস্পষ্ট দলীল ও প্রতিষ্ঠিত নিয়ম-নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত।
আর খাবারের স্বাদ গ্রহণ করলে যখন না গিলা হয় তখন তাতে সাওম ভঙ্গ হবে না। আর কোন সুঘ্রাণ ও ধুপের ঘ্রাণেও সাওম ভঙ্গ হবে না। কিন্তু ধুপের ধোঁয়া নাকে গ্রহণ করবে না। কারণ তার অনেক অংশবিশেষ আছে যা ঊর্ধে উঠে থাকে; হয়তো বা তার কিছু পাকস্থলীতে পৌঁছে যাবে। অনুরূপভাবে কুলি করা ও নাকে পানি দেওয়াতেও সাওম ভঙ্গ হয় না; কিন্তু তাতে অতিরঞ্জিত করবে না। কারণ কখনো কিছু পানি পেটের ভিতরে ঢুকে যেতে পারে।
* যেমন হাদীসে এসেছে, লাকীত ইবন সুবরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
أسبغ الوضوء وخلل بين الأصابع وبالغ في الاستنشاق إلا أن تكون صائما
“উত্তম রূপে অজু করো এবং আঙ্গুলের মাঝে খিলাল করো আর ভালো ভাবে নাকে পানি দাও- অবশ্য সাওম পালনকারী হলে নয়।”
সাওম পালনকারী মেসওয়াক করলে সাওম ভঙ্গ হবে না। বরং সাওম ভঙ্গকারীদের মত সাওম পালনকারীর জন্যও দিনের প্রথম ও শেষ ভাগে মেসওয়াক করা সুন্নাত। কারণ,
* নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
لولا أن أشق على أمتي لأمرتهم بالسواك عند كل صلاة
“যদি আমার উম্মতের ওপর কষ্টকর না হতো, তাহলে অবশ্যই প্রত্যেক সালাতের সময় মেসওয়াক করার নির্দেশ দিতাম।”
এটা সাওম পালনকারী ও সাওম ভঙ্গকারী সকলের জন্য সব সময় প্রযোজ্য হুকুম।
* অনুরূপভাবে ‘আমের ইবন রাবী‘আহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
رأيت النبي صلى الله عليه وسلم ما لا أحصى يتسوك وهو صائم
“নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাওম অবস্থায় অগণিত বার মেসওয়াক করতে দেখেছি”।
সাওম পালনকারীর জন্য পেস্ট বা দাতের মাজন দিয়ে দাঁত পরিস্কার করা উচিত নয়। কারণ এর শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে, ফলে আশংকা করা হয় যে, মুখের লালার সাথে খাদ্যনালীর ভিতরে এর কোনো কিছু ঢুকে যাবে। মিসওয়াক ব্যবহার সেটার বিকল্প হতে পারে এবং সে অবস্থা থেকে বেঁচে থাকা যায়।
আর সাওম পালনকারীর এমন কিছু করা জায়েয যা তাকে প্রচণ্ড গরম ও পিপাসা থেকে কিছুটা হালকা করবে। যেমন, পানি দ্বারা ঠাণ্ডা হওয়া বা অনুরূপ কিছু। কারণ,
* ইমাম মালেক ও ইমাম আবূ দাউদ কোনো এক সাহাবী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন,
رأيت النبي صلى الله عليه وسلم بالعرج (اسم موضع) يصب الماء على رأسه وهو صائم من العطش، أو من الحر
“আমি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ‘আরজ’ নামক স্থানে সাওম পালনরত অবস্থায় পিপাসা কিংবা গরমের কারণে তার পবিত্র মাথা মোবারকে পানি ঢালতে দেখেছি।”
* ‘আব্দুল্লাহ ইবনে ‘উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু একটি কাপড় ভিজিয়ে নিজের উপর সাওম পালনরত অবস্থায় রেখেছেন।
* আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু এর একটি খোদাই করা পাথর ছিল এটা কূপের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল। তিনি যখন সাওম পালনরত অবস্থায় গরম অনুভব করতেন, তখন তাতে অবতরণ করতেন। আল্লাহ ভালো জানেন, মনে হচ্ছে যেন এটা পানিতে পরিপূর্ণ থাকত।
* হাসান বলেন, সাওম পালনকারীর জন্য কুলি করা ও ঠান্ডা হওয়ায় কোনো অসুবিধা নেই।
এ বর্ণনাগুলো ইমাম বুখারী তা‘লীক হিসেবে সহীহ বুখারীতে উল্লেখ করেছেন।
প্রিয় ভ্রাতৃবৃন্দ! আল্লাহর দীন ভালোভাবে জানুন, যাতে জেনে-শুনে আল্লাহর ইবাদত করতে পারেন। কারণ যারা জানে এবং যারা জানে না তারা সমান হতে পারে না। আর
مَنْ يُرِدِ اللَّهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِي الدِّينِ
‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে দীনের গভীর জ্ঞান দান করেন।’
হে আল্লাহ! আমাদেরকে দীন বুঝা এবং সেটার উপর আমলের তাওফীক দিন। আর আমাদেরকে দীনের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত রাখুন। আমাদেরকে মুমিন হিসেবে মৃত্যু দিন এবং নেক বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আর হে দয়ালুদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ দয়ালু আপনার একান্ত দয়ায় আমাদেরকে ও আমাদের মা-বাবা এবং সকল মুসলিমকে ক্ষমা করুন।
আর আল্লাহ সালাত ও সালাম পেশ করুন আমাদের নবী মুহাম্মদ, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীর ওপর।
ষোড়শ আসরঃযাকাত
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি পদস্খলন মিটিয়ে দেন ও উপেক্ষা করেন, ক্ষমা করেন আবোল-তাবোল কথা ও ছাড় দেন। যে কেউ তাঁর কাছে আশ্রয় চায় সে সফল হয়, যে কেউ তার সাথে লেন-দেন করে সেই লাভবান হয়, তিনি আকাশকে বিনা খুঁটি উপরে উঠিয়েছেন সুতরাং তুমি চিন্তা কর এবং খাঁটি ও স্বচ্ছ হও। তিনি নাযিল করেছেন বৃষ্টি ফলে ফসলাদিকে দেখা যায় পানিতে সাতরাতে। প্রাচুর্যও প্রদান করেন আবার দারিদ্র্যতাও দেন, কখনও কখনও দারিদ্র্যতা হয় বান্দার জন্য উপযোগী। এমন বহু প্রাচুর্যশীল রয়েছে, যার প্রাচুর্য তাকে গর্ব অহংকারের খুব নিকৃষ্টতম পর্যায়ে নিপতিত করেছে। এ তো ‘কারূন’ অনেক কিছুরই সে মালিক হয়েছিল, কিন্তু সে সামান্যের ব্যাপারে ছাড় দিতে রাযী ছিল না, তাকে সাবধান করা হয়েছিল কিন্তু সে জাগ্রত হয় নি, তাকে তিরস্কার করা হয়েছিল কিন্তু তিরস্কার তার কাজে আসে নি, বিশেষ করে যখন তার জাতির লোকেরা তাকে বলেছিল, ‘তুমি বেশি খুশি হয়ো না। আমি তাঁর প্রশংসা করি যতক্ষণ পর্যন্ত দিন গড়িয়ে বিকেল হবে, আর রাত পেরিয়ে হবে সকাল।
আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো সত্য ইলাহ নেই, তিনি অমুখাপেক্ষী, দানবীর, প্রশস্ত দান করার মাধ্যমে দয়া করেছেন এবং নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল, যিনি আল্লাহর জন্য তাঁর জান ও মাল ব্যয় করেছেন, সত্যকে করেছেন স্পষ্ট ও প্রকাশিত।
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর উপর সালাত পেশ করুন, আর তার সাথী আবু বকরের উপর, যিনি সফরে ও অবস্থানস্থল সর্বদা তার সাথে ছিলেন, কখনও তাকে পরিত্যাগ করেন নি। অনুরূপ উমারের উপর, যিনি দিনের সম্মান ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধিতে ছিলেন সদা সচেষ্ট। আর উসমানের উপর, যিনি আল্লাহর রাস্তায় বহু খরচ করেছেন এবং সংশোধন করেছেন। তদ্রূপ আলীর উপর, যিনি ছিলেন রাসূলের চাচাতো ভাই, তার ব্যাপারে যারা বাড়াবাড়ি কিংবা সম্মানহানি থেকে তাদের থেকে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ মুক্ত; অনুরূপভাবে বাকী সাহাবীগণের উপর এবং যারা সুন্দরভাবে তাদেরকে অনুসরণ করেছেন তাদেরও উপর। আর আল্লাহ তাদের উপর যথাযথ সালামও পেশ করুন।
প্রিয় ভাইয়েরা!
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ حُنَفَآءَ وَيُقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤۡتُواْ ٱلزَّكَوٰةَۚ وَذَٰلِكَ دِينُ ٱلۡقَيِّمَةِ ٥ ﴾ [البينة: ٥]
‘তাদের এ মর্মে আদেশ করা হয়েছে যে, তারা নিবিষ্ট মনে একান্তভাবে শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে, সালাত প্রতিষ্ঠা করবে এবং যাকাত প্রদান করব। আর এটাই হলো সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীন।’ {সূরা আল-বায়্যিনাহ, আয়াত: ৫}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُواْ ٱلزَّكَوٰةَ وَأَقۡرِضُواْ ٱللَّهَ قَرۡضًا حَسَنٗاۚ وَمَا تُقَدِّمُواْ لِأَنفُسِكُم مِّنۡ خَيۡرٖ تَجِدُوهُ عِندَ ٱللَّهِ هُوَ خَيۡرٗا وَأَعۡظَمَ أَجۡرٗاۚ وَٱسۡتَغۡفِرُواْ ٱللَّهَۖ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٞ رَّحِيمُۢ ٢٠ ﴾ [المزمل: ٢٠]
‘আর সালাত কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও। আর তোমরা নিজদের জন্য মঙ্গলজনক যা কিছু অগ্রে পাঠাবে তোমরা তা আল্লাহর কাছে পাবে প্রতিদান হিসেবে উৎকৃষ্টতর ও মহত্তর রূপে। আর তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। নিশ্চয় আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ {সূরা আল-মুযযাম্মিল, আয়াত: ২০}
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَمَآ ءَاتَيۡتُم مِّن رِّبٗا لِّيَرۡبُوَاْ فِيٓ أَمۡوَٰلِ ٱلنَّاسِ فَلَا يَرۡبُواْ عِندَ ٱللَّهِۖ وَمَآ ءَاتَيۡتُم مِّن زَكَوٰةٖ تُرِيدُونَ وَجۡهَ ٱللَّهِ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُضۡعِفُونَ ٣٩ ﴾ [الروم: ٣٩]
‘আর তোমরা যে সূদ দিয়ে থাক, মানুষের সম্পদে বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য তা মূলত আল্লাহর কাছে বৃদ্ধি পায় না। আর তোমরা যে যাকাত দিয়ে থাক আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে (তাই বৃদ্ধি পায়) এবং তারাই বহুগুণ সম্পদ প্রাপ্ত।’ {সূরা আর-রূম, আয়াত: ৩৯}
এ ছাড়াও যাকাত ফরয হওয়ার বিধান সম্পর্কে অনেক আয়াত রয়েছে।
হাদীসের আলোকে যাকাতের বিধান:
* ‘আব্দুল্লাহ ইবন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন:
بُنِيَ الْإِسْلَامُ عَلَى خَمْسَةٍ، عَلَى أَنْ يُوَحَّدَ اللهُ، وَإِقَامِ الصَّلَاةِ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ، وَصِيَامِ رَمَضَانَ، وَالْحَجِّ، فَقَالَ رَجُلٌ: الْحَجُّ، وَصِيَامُ رَمَضَانَ، قَالَ: لَا، صِيَامُ رَمَضَانَ، وَالْحَجُّ
‘ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি, যথা- এ কথার সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সত্যিকারের মাবুদ নেই। সালাত আদায় করা, যাকাত প্রদান করা, রমযানের সিয়াম পালন করা ও হজ আদায় করা। এ কথা শুনে একব্যক্তি বললেন, হজ তারপর কি রমযানের সিয়াম? তিনি বললেন, না বরং প্রথমে রমযানের সিয়াম তারপর হজ। এ ধারাবাহিকতায় আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি।’
* অন্য বর্ণনায় রয়েছে: (ইসলামের ভিত্তি হলো) এ সাক্ষ্য প্রদান করা যে ‘এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই, মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর রাসূল’। তারপর পূর্বোক্ত হাদীসের অনুরূপ।
সুতরাং বোঝা গেল, যাকাত ইসলামের একটি রুকন ও মৌলিক ভিত্তিগুলোর একটি।
আর কুরআনের বহু জায়গায় সালাতের পাশাপাশি যাকাতের বিষয়টি আলোচিত হয়েছে।
ইজমা:
সকল মুসলিম অকাট্যভাবে একমত যে, যাকাত একটি ফরয বিধান। সুতরাং যাকাত ফরয জেনেও যদি কোনো ব্যক্তি তা অস্বীকার করে, তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে।
আর যে যাকাত প্রদানে কৃপণতা করবে বা পরিমানের চেয়ে কম দেবে, সে লাঞ্ছনা ও কঠিন শাস্তির উপযুক্ত হবে।
চার ধরনের সম্পদে যাকাত ফরয:
প্রথম প্রকার: ভূমি থেকে উৎপাদিত শস্য ও ফল-ফলাদী
* কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَنفِقُواْ مِن طَيِّبَٰتِ مَا كَسَبۡتُمۡ وَمِمَّآ أَخۡرَجۡنَا لَكُم مِّنَ ٱلۡأَرۡضِۖ ﴾ [البقرة: ٢٦٧]
‘হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের বৈধ উপার্জন এবং আমরা তোমাদের জন্য ভুমি থেকে যে শস্য উৎপন্ন করি তা থেকে আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যয় কর।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৬৭}
* অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَءَاتُواْ حَقَّهُۥ يَوۡمَ حَصَادِهِۦۖ ﴾ [الانعام: ١٤١]
‘আর তোমরা ফসল কাটার সময় তার হক (যাকাত) আদায় কর।’ {সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১৪১}
আর সম্পদের সবচেয়ে বড় হক হচ্ছে যাকাত।
* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
فِيمَا سَقَتِ السَّمَاءُ وَالعُيُونُ أَوْ كَانَ عَثَرِيًّا العُشْرُ، وَمَا سُقِيَ بِالنَّضْحِ نِصْفُ العُشْرِ
‘আসমান ও ঝর্ণার পানিতে কিংবা স্বেচ্ছা উৎপাদিত ফসলের মধ্যে এক দশমাংশ আর যা সেচের মাধ্যমে আবাদ হয় তার মধ্যে বিশভাগের এক ভাগ যাকাত প্রদেয়।’
ফসলের ওপর যাকাত ফরয হওয়ার নির্ধারিত পরিমাণ হলো পাঁচ ওসক। কারণ,
* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
لَيْسَ فِي حَبٍّ وَلَا ثَمَرٍ صَدَقَةٌ، حَتَّى يَبْلُغَ خَمْسَةَ أَوْسقٍ
‘শস্য বা ফলমুলের ওপর যাকাত ফরয হবে না। যতক্ষণ তা পাঁচ ওসক পরিমাণ না হয়।’
আর ওসকের পরিমাণ হলো; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যবহৃত সা‘ এর ৬০ সা‘ সমপরিমাণ। তাহলে নিসাব হলো, তিনশ সা‘, আর এক সা‘র পরিমাণ হলো ২০৪০ গ্রাম (দুই কেজি চল্লিশ গ্রাম)। সুতরাং নিসাবের পরিমাণ দাঁড়ালো ৬১২ কেজি। তাই এর কমে যাকাত ফরয নয়। ওই নিসাবে বিনাশ্রমে প্রাপ্ত ফসলের যাকাতের পরিমাণ হলো এক দশমাংশ আর শ্রম ব্যয়ে প্রাপ্ত ফসলের এক বিশমাংশ।
ফলমূল, শাক-সবজি, তরমুজ ও জাতীয় ফসলের ওপর যাকাত ফরয নয়।
* কেননা ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন, ‘শাক-সবজিতে যাকাত নেই’।
* তেমনি আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন, ‘আপেল বা এ জাতীয় ফলের ওপর যাকাত ফরয নয়।
* তাছাড়া যেহেতু এগুলো (নিত্যপ্রয়োজনীয়) খাবার জাতীয় শস্য বা ফল নয়, তাই এর ওপর যাকাত নেই। তবে যদি এসব টাকার বিনিময়ে বিক্রি করা হয় তাহলে মূল্যের ওপর নিসাব পূর্ণ হয়ে এক বছর অতিক্রান্ত হবার পর যাকাত ফরয হবে।
দ্বিতীয় প্রকার: যে সকল প্রাণীর ওপর যাকাত ফরয হয়
তাহলো: উট, গরু, ছাগল, ভেড়া ও মহিষ। যদি এ সকল প্রাণী ‘সায়েমা’ হয় তথা মাঠে চরে চষে খায় এবং এগুলোকে বংশ বৃদ্ধির জন্য পালন করা হয় এবং তা নিসাব পরিমাণ হয়, তাহলে এদের যাকাত দিতে হবে। উটের নিসাব ন্যূনতম ৫টি, গরুর ৩০টি, আর ছাগলের ৪০টি।
‘সায়েমা’ ওই সকল প্রাণীকে বলে, যেগুলো সারা বছর বা বছরের অধিকাংশ সময় চারণভূমিতে ঘাস খেয়ে বেড়ায়। যদি এসব প্রাণী সায়েমা না হয়, তবে এর ওপর যাকাত ফরয নয়। কিন্তু যদি এগুলো দ্বারা টাকা-পয়সা কামাই করার উদ্দেশ্য থাকে; যেমন বেচা-কেনা, স্থানান্তর ইত্যাদির মাধ্যমে টাকা-পয়সা আয় করা, তাহলে তা ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে বিবেচিত হবে; আর তখন সেগুলো সায়েমা কিংবা মা‘লুফাহ (যাকে ঘাস কেটে খাওয়ানো হয়) যা-ই হোক না কেন তাতে ব্যবসায়িক পণ্যের যাকাত আসবে; যদি তা স্বয়ং নিসাব পরিমাণ হয় অথবা এসবের মূল্য অন্য ব্যবসায়িক সম্পদের সঙ্গে যুক্ত করলে নিসাব পরিমাণ হয়।
তৃতীয় প্রকার: স্বর্ণ-রৌপ্যের ওপর (নিসাব পরিমাণ হলে) সর্বাবস্থায় যাকাত ফরয। কারণ,
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَٱلَّذِينَ يَكۡنِزُونَ ٱلذَّهَبَ وَٱلۡفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ فَبَشِّرۡهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٖ ٣٤ يَوۡمَ يُحۡمَىٰ عَلَيۡهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكۡوَىٰ بِهَا جِبَاهُهُمۡ وَجُنُوبُهُمۡ وَظُهُورُهُمۡۖ هَٰذَا مَا كَنَزۡتُمۡ لِأَنفُسِكُمۡ فَذُوقُواْ مَا كُنتُمۡ تَكۡنِزُونَ ٣٥﴾ [التوبة: ٣٤، ٣٥]
‘আর যারা সোনা ও রূপা জমা করে রাখে অথচ তা আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যয় করে না (যাকাত দেয় না)। আপনি তাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ প্রদান করুন। কিয়ামত দিবসে ওই সোনারূপাকে জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করে তা দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ ও পৃষ্ঠে ছেকা দেয়া হবে এবং বলা হবে এ হলো তোমাদের সে সকল ধন-সম্পদ যা তোমরা নিজেদের জন্য সঞ্চয় করে রাখতে। সুতরাং আজ জমা করে রাখার স্বাদ গ্রহণ কর।’ {সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ৩৪-৩৫}
আয়াতে ‘জমা করে রাখা’ বলতে আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় না করা বুঝানো হয়েছে। আর আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করার সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে, যাকাতে ব্যয় করা।
* তাছাড়া সহীহ মুসলিমে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
مَا مِنْ صَاحِبِ ذَهَبٍ وَلَا فِضَّةٍ، لَا يُؤَدِّي مِنْهَا حَقَّهَا، إِلَّا إِذَا كَانَ يَوْمُ الْقِيَامَةِ، صُفِّحَتْ لَهُ صَفَائِحُ مِنْ نَارٍ، فَأُحْمِيَ عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ، فَيُكْوَى بِهَا جَنْبُهُ وَجَبِينُهُ وَظَهْرُهُ، كُلَّمَا بَرَدَتْ أُعِيدَتْ لَهُ، فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ خَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ، حَتَّى يُقْضَى بَيْنَ الْعِبَادِ
‘যে সকল সোনা-রূপার মালিকগণ তাদের সম্পদ থেকে নির্ধারিত হক (যাকাত) আদায় না করে, কিয়ামত দিবসে তার জন্য কতগুলো আগুনের পাত প্রস্তুত করে তা জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করে তা দ্বারা ওই লোকদের ললাট ও পিঠে চেপে ধরা হবে। তাপ কমে গেলে উত্তপ্ত করে পুনরায় চেপে ধরা হবে। পঞ্চাশ বছর দীর্ঘ সময় বান্দাদের হিসাব-নিকাশ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এভাবে শাস্তি চলতেই থাকবে।’
* ‘সোনা-রূপার হক’ আদায় না করার অর্থ, যাকাত আদায় না করা। যা অন্য বর্ণনায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। যেখানে এসেছে,
ما من صاحب كنز لا يؤدي زكاته
‘যে সকল সোনা-রূপার মালিকগণ তাদের সম্পদের যাকাত আদায় না করে….’।
সোনা-রূপার যাবতীয় প্রকারে যাকাত ফরয হবে। চাই তা হোক টাকা পয়সা, চাকা বা টুকরা, পরিধেয় অলংকার বা ধার দেওয়ার মত অলংকার অথবা অন্য প্রকার সোনা-রূপা এসব কিছুর ওপর যাকাত ফরয। কারণ সোনা-রূপার উপর যাকাত ফরয করে বর্ণিত সকল আয়াত বা হাদীস ব্যাপকভাবে এর উপর প্রমাণবহ।
* ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘আমর ইবন ‘আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَنَّ امْرَأَةً أَتَتْ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- وَمَعَهَا ابْنَةٌ لَهَا وَفِى يَدِ ابْنَتِهَا مَسَكَتَانِ غَلِيظَتَانِ مِنْ ذَهَبٍ فَقَالَ لَهَا أَتُعْطِينَ زَكَاةَ هَذَا . قَالَتْ لاَ. قَالَ أَيَسُرُّكِ أَنْ يُسَوِّرَكِ اللَّهُ بِهِمَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ سِوَارَيْنِ مِنْ نَارٍ . قَالَ فَخَلَعَتْهُمَا فَأَلْقَتْهُمَا إِلَى النَّبِىِّ -صلى الله عليه وسلم- وَقَالَتْ هُمَا لِلَّهِ عَزَّ وَجَلَّ وَلِرَسُولِهِ.
‘একদা একজন মহিলা তার মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মুখে এলেন। ওই মেয়ের হাতে স্বর্ণের দুটি ভারি ও মোটা বালা ছিলো। তা দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি কি এসবের যাকাত দাও? মেয়েটি বলল, না। তিনি বললেন, তুমি কি এটা পছন্দ কর যে কিয়ামতের দিন আল্লাহ এসবের দ্বারা দুটি আগুনের চুড়ি বানিয়ে তোমার হাতে পরিয়ে দেবেন? মেয়েটি এ কথা শুনে বালা দুটি খুলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দিয়ে বলল, এসব আল্লাহর রাস্তায় দান করলাম।’
* অন্য এক হাদীসে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
دَخَلَ عَلَىَّ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- فَرَأَى فِى يَدِى فَتَخَاتٍ مِنْ وَرِقٍ فَقَالَ مَا هَذَا يَا عَائِشَةُ . فَقُلْتُ صَنَعْتُهُنَّ أَتَزَيَّنُ لَكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ. قَالَ أَتُؤَدِّينَ زَكَاتَهُنَّ . قُلْتُ لاَ أَوْ مَا شَاءَ اللَّهُ. قَالَ هُوَ حَسْبُكِ مِنَ النَّارِ .
‘একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে এলেন, তখন আমার হাতে কয়েকটি বড় বড় রূপার আংটি ছিল। তিনি বললেন, এসব কী? আমি বললাম, আপনার সামনে সৌন্দর্য প্রকাশ করার জন্য এগুলো তৈরি করেছি। তিনি বললেন, তুমি কি এসবের যাকাত প্রদান করো? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, তোমার জাহান্নামে যাওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট।’
হাদীসটি আবু দাউদ সংকলন করেছেন। অনুরূপ বাইহাকী ও হাকেম, আর তিনি সেটাকে সহীহ বলেছেন এবং আরও বলেছেন যে, এটি বুখারী ও মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী।
ইবন হাজার ‘আত-তালখীস’ গ্রন্থে বলেন, এটি বুখারী শর্ত অনুযায়ী।
ইবন দাকীকিল ‘ঈদ বলেন, এটি মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী।
সোনার নিসাব পূর্ণ না হলে তার ওপর যাকাত ফরয হবে না। আর সে নিসাব হলো, ২০ দিনার। কারণ,
* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোনার ব্যাপারে বলেছেন,
وَلَيْسَ عَلَيْكَ شَىْءٌ حَتَّى يَكُونَ لَكَ عِشْرُونَ دِينَارًا
‘(স্বর্ণের যাকাত হিসেবে) তোমার ওপর কিছুই ওয়াজিব হবে না যাবৎ তোমার কাছে বিশ দিনার পরিমাণ স্বর্ণ না হবে।’
* দিনার বলতে ইসলামী দিনার উদ্দেশ্য যার ওজন এক মিছকাল। মিছকাল সমান সোয়া চার গ্রাম। সে হিসাবে সোনার নিসাব হলো ৮৫ গ্রাম। যা সা‘উদী মাপে এগার জুনাইহ ও এক জুনাইহ এর তিন সপ্তমাংশ।
রূপার নিসাব পূর্ণ না হলে তাতে যাকাত ফরয নয়। আর তার নেসাব হলো: পাঁচ ওকিয়্যা। কারণ,
* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
لَيْسَ فِيمَا دُونَ خَمْسِ أَوَاقٍ صَدَقَةٌ
‘পাঁচ ওকিয়্যার কম রূপার ওপর যাকাত নেই।’
এক ওকিয়্যা সমান ৪০ ইসলামী দিরহাম।
সে মতে রূপার হিসাব হলো: ২০০ দিরহাম।
আর এক দিরহাম হলো, এক মিসকালের সাত দশমাংশ। এর মোট ওজন ১৪০ মিসকাল, যার বর্তমান প্রচলিত ওজন হলো: ৫৯৫ গ্রাম। যা আরবী ৫৬ রৌপ্য রিয়াল মুদ্রা।
রৌপ্য ও স্বর্ণের যাকাতের পরিমাণ হচ্ছে, চার দশমাংশ বা ৪০ ভাগের এক ভাগ।
কাগজের তৈরি নোট (টাকা) এর ওপরও যাকাত ফরয; কারণ নোটগুলো রূপার বদলেই চলমান। সুতরাং এসব রূপার স্থলাভিষিক্ত হবে এবং এর মূল্যমান রূপার নিসাবের সমপরিমাণ হলে তাতে যাকাত ফরয হবে।
সোনা-রূপা ও কাগজের নোট ইত্যাদি ওপর সর্বাবস্থায় যাকাত ফরয। চাই তা হাতে মজুদ থাকুক বা অন্য কারো যিম্মাদারীতে থাকুক।
এ থেকে বুঝা যায়, সব ধরনের ঋণ, চাই তা কর্জ হোক বা বিক্রয়কৃত বস্তুর মূল্য হোক কিংবা ভাড়া বা এ ধরনের যা-ই হোক না কেন, তার ওপর যাকাত ফরয। তারপর যদি সে ঋণ এমন লোকের কাছে থাকে যে সচ্ছল এবং সহজে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তখন সে প্রতি বছর অন্যান্য সম্পদের সঙ্গে সঙ্গে এসবের যাকাত দিবে, অথবা সে ঋণ আদায় করা পর্যন্ত দেরী করে যত বছর যাকাত দেয় নি তত বছরের যাকাত হিসেব করে আদায় করবে।
আর যদি দরিদ্র বা ঋণ আদায়ে টালবাহানাকারী লোককে ঋণ দেয়া থাকে, যার কাছ থেকে সেটা আদায় করা কঠিন হয়ে পড়ে তাহলে ঋণ আদায় হওয়ার পর শুধু ওই ঋণ উসুল করা বছরের যাকাত প্রদান করবে; পূর্ববর্তী বছরগুলোর যাকাত দিতে হবে না।
সোনা-রূপা ছাড়া অন্য সকল খনিজ পদার্থ যদিও তা আরও মূল্যবান হয়, তাতে যাকাত ফরয নয়। তবে তা যদি ব্যবসার পণ্য হয়ে থাকে; তাহলে নিসাব পূর্ণ হলে অবশ্যই ব্যবসায়ী পণ্য হিসেবে যাকাত দিতে হবে।
চতুর্থ প্রকার: ব্যবসায়ী পণ্য
ব্যবসায়ী পণ্য বলতে বুঝায়: এমন যাবতীয় বস্তু যা দ্বারা মুনাফা অর্জন কিংবা ব্যবসার উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে রাখা হয়েছে। যেমন, জমি, জীব-জন্তু, খাবার, পানীয় ও গাড়ী ইত্যাদি সব ধরনের সম্পদ।
সুতরাং বছরান্তে সেগুলোর মূল্য নির্ধারণ করে তার চার দশমাংশ বা ৪০ ভাগের এক ভাগ যাকাত দিতে হবে। চাই সেটার মূল্যমান ক্রয়মূল্যের সমপরিমান হোক, অথবা কম হোক অথবা বেশি হোক।
মুদি দোকানদার, মেশিনারি দোকানদার বা খুচরা যন্ত্রাংশ বিক্রেতা ও এ জাতীয় ব্যবসায়ীদের কর্তব্য হলো, ছোট বড় সকল অংশের মূল্য নির্ধারণ করে নেবে, যাতে কোনো কিছু বাদ না পড়ে। পরিমাণ নির্ণয়ে যদি জটিলতা দেখা দেয়, তাহলে সতর্কতামূলক বেশি দাম ধরে যাকাত আদায় করবে, যাতে সে সম্পূর্ণভাবে দায়িত্বমুক্ত হতে পারে।
মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তু যথা খাবার, পানীয়, বিছানা, আসবাবপত্র, থাকার ঘর, বাহন, গাড়ী, পোশাকের (ব্যবহার্য সোনা-রূপা ছাড়া) ওপর যাকাত নেই। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
لَيْسَ عَلَى الْمُسْلِمِ فِى عَبْدِهِ وَلاَ فَرَسِهِ صَدَقَةٌ .
‘মুসলিমের দাস-দাসী, ঘোড়ার ওপর যাকাত নেই।’
অনুরূপভাবে ভাড়া দেওয়ার জন্য প্রস্তুতকৃত পণ্য যেমন জমি-জমা, গাড়ী ইত্যাদির ওপর যাকাত আসবে না। তবে সেসব থেকে প্রাপ্ত অর্থের ওপর বছর পূর্তির পর সেটা দ্বারা স্বয়ং নিসাব পূর্ণ হোক বা এ জাতীয় অন্য সম্পদের সাথে মিশে নিসাব পূর্ণ হোক তাতে যাকাত দেয়া ফরয হবে।
প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা! তোমরা তোমাদের সম্পদের যাকাত যথাযথভাবে আদায় কর, আর এতে তোমাদের মন যেন খুশী থাকে। বস্তুত এটা লাভজনক, জরিমানামূলক নয়। মুনাফাস্বরূপ, ক্ষতিস্বরূপ নয়। তোমরা তোমাদের সকল যাকাতযোগ্য সম্পদ ভালোকরে হিসেব কর। আর আল্লাহর কাছে যা তোমরা ব্যয় কর তা কবুল করার জন্য এবং যা তোমাদের কাছে অবশিষ্ট রেখেছ তাতে বরকত দেওয়ার জন্য প্রার্থনা কর।
আর সকল প্রশংসা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর জন্য।
আল্লাহ সালাত ও সালাম পেশ করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তার পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীর উপর।
২য় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন 
উৎসঃ quranalo.wordpress.com

No comments:

Post a Comment

Download AsPDF

Print Friendly and PDFPrint Friendly and PDFPrint Friendly and PDF
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...