Tuesday 29 July 2014

ফিতরার পরিমাণ এবং ফিতরা আদায় করার সময়কাল



প্রশ্ন: আমরা মরক্কোর একটি সংস্থার সদস্য। বর্তমানে বার্সেলোনাতে বসবাস করছি। আমরা সদকাতুল ফিতর বা ফিতরা কিভাবে হিসাব করব?
উত্তর :
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, তিনি মুসলমানদের উপর সদকাতুল ফিতর (ফিতরা) ফরজ করেছেন। আর তা হল এক স্বা‘ খেজুর বা এক স্বা‘ যব। মানুষ ঈদের সালাতের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার আগে তা আদায় করার আদেশ দিয়েছেন। দুই সহীহ গ্রন্থে (অর্থাৎ বুখারী ও মুসলিমে) আবু সা‘ঈদ আলখুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে তিনি বলেছেন : “আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়ে সদকাতুল ফিতরহিসেবে এক স্বা খাদ্যদ্রব্য অথবা এক স্বা‘ খেজুর অথবা এক স্বা‘ যব অথবা এক স্বা‘কিসমিস প্রদান করতাম।”[বুখারী (১৪৩৭)]
একদল আলেম এই হাদীসে ব্যবহৃত ‘খাদ্যদ্রব্য’ শব্দটির ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, তা হল গম। আবার অনেকে এর ব্যাখ্যায় বলেছেন যে এর উদ্দেশ্য হল সে দেশের অধিবাসীগণ যা খায় তা গম, ভুট্টা, পার্ল মিলেট ( pearl millet) বা এছাড়া অন্য যাই হোক না কেন; এটাই সঠিক মত। কারণ ফিতরা হচ্ছে- দরিদ্রদের প্রতি ধনীদের সহানুভূতি। স্থানীয় খাদ্যদ্রব্য হিসেব বিবেচিত নয় এমন কিছু দিয়ে হকদারের প্রতি সহানুভুতি প্রকাশ করা কোন মুসলিমের উপর ওয়াজিব নয়। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, বর্তমানে চাউল সৌদি আরবের প্রধান খাদ্য, উত্তম ও মূল্যবান খাদ্য। চাউল যবের চেয়ে উত্তম; যে যব দিয়ে ফিতরা দেয়া জায়েয মর্মে হাদীসের ভাষ্যে সরাসরি উল্লেখ আছে। এর থেকে জানা গেল যে, চাউল দিয়ে সদকাতুল ফিতর আদায় করাতে কোন দোষ নেই।
ফিতরার ক্ষেত্রে ওয়াজিব হচ্ছে- এক স্বা‘ খাদ্য প্রদান করা। যে স্বা‘ বা পাত্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যবহার করেছেন সে স্বা অনুযায়ী। সাধারণমাপের দুই হাতের পরিপূর্ণ চার মুষ্ঠি এক স্বাকে পূর্ণ করে। যেমনটি আলক্বামূস ও অন্যান্য আরবী অভিধানে উল্লেখ করা হয়েছে। মেট্রিক পদ্ধতির ওজনে এর পরিমাণ প্রায় ৩ কিলোগ্রাম। যদি কোন মুসলিম চাউল বা দেশীয় কোন খাদ্যদ্রব্যের এক স্বা‘ দিয়ে ফিতরা আদায় করেন তবে তা জায়েয হবে; যদিওবা সে খাদ্যের কথা এই হাদিসে সরাসরি উল্লেখ না করা হয়ে থাকে? এটাই আলেমগণের দুইটি মতের মধ্যে বেশি শক্তিশালী। আর মেট্রিক পদ্ধতির ওজনের হিসাবে প্রায় ৩ কিলোগ্রাম দিলেও চলবে।
ছোট-বড়, নারী-পুরুষ, স্বাধীন-ক্রীতদাস সকল মুসলিমের পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব। কিন্তু গর্ভস্থিত সন্তানের পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব নয় মর্মে আলেমগণের ইজমা (ঐকমত্য) সংঘটিত হয়েছে। তবে তার পক্ষ থেকেও আদায় করা হলে সেটা মুস্তাহাব। কারণ উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে এ ধরনের আমল সাব্যস্ত আছে।
ফিতরার খাদ্য ঈদের নামাযের আগেই বন্টন করা ওয়াজিব। ঈদের নামাযের পর পর্যন্ত দেরি করা জায়েয নয়। বরঞ্চ ঈদের এক বা দুই দিন আগে আদায় করে দিলে কোন অসুবিধা নেই। এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে জানা গেল যে, আলেমদের বিশুদ্ধ মতানুযায়ী ফিতরা আদায় করার সময় শুরু হয় ২৮ শে রমজান। কারণ রমজান মাস ২৯ দিনও হতে পারে। আবার ৩০ দিনও হতে পারে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণ ফিতরা ঈদের একদিন বা দুই দিন আগে আদায় করতেন।
ফিতরা প্রদান করার খাত হচ্ছে- ফকির ও মিসকীন। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লাম অনর্থককাজওঅশ্লীলতাহতেপবিত্রকরণএবংমিসকীনদেরজন্য খাদ্যের উৎস হিসেবে রোযাপালনকারীর উপর ফিতরা ফরজকরেছেন। যেব্যক্তি ঈদের সালাতেরআগেতা আদায়করবে তাকবুলযোগ্যফিতরা হিসেবেগণ্যহবে।আরযে ব্যক্তিঈদের নামাযেরপরআদায়করবে সেটাসাধারণ সদকা হিসেবে গণ্যহবে।”[সুনানে আবু দাউদ (১৬০৯) এবং আলবানী এ হাদিসটিকে সহীহ আবু দাউদ গ্রন্থে ‘হাসান’ বলে আখ্যায়িত করেছেন]
অধিকাংশ আলেমের মতে খাদ্যের বদলে খাদ্যের মূল্য দিয়ে ফিতরা আদায় করলে তা আদায় হবে না। দলীলের দিক থেকে এই মতটি অধিক শুদ্ধ। বরং ওয়াজিব হলো খাদ্যদ্রব্য থেকে ফিতরা আদায় করা। যেভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ আদায় করেছেন। উম্মতের অধিকাংশ আলেম এ মতের পক্ষ অবলম্বন করেছেন। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি যাতে তিনি আমাদেরকে ও সকল মুসলমানকে তাঁর দ্বীনের ফিকাহ (প্রজ্ঞা) দান করেন, এর উপর অটল অবিচল থাকার তাওফিক দেন, আমাদের অন্তরসমূহ ও কাজকর্মকে পরিশুদ্ধ করে দেন। তিনি তো মহামহিম, পরম করুণাময়।” সমাপ্ত [মাজমু ফাতাওয়া ইবনে বায (বিন বাযের ফতোয়া সংকলন) (১৪/২০০)]
শাইখ বিন বায রাহিমাহুল্লাহ এর মতে কিলোগ্রামের হিসাবে ফিতরার পরিমাণ প্রায় ৩ কিলোগ্রাম। ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটির আলেমগণও একই পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন। (৯/৩৭১)
শাইখ ইবনে উছাইমীন রাহিমাহুল্লাহ চাউল দিয়ে ফিতরা দেয়ার পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন ২১০০ গ্রাম (অর্থাৎ ২.১কিলোগ্রাম) [ফাতাওয়ায যাকাত (যাকাত বিষয়ক ফতোয়া সংকলন), পৃঃ ২৭৪-২৭৬]
ওজন নির্ধারণের ক্ষেত্রে এই মতভেদের কারণ হল স্বা‘ হচ্ছে- পরিমাপের একক, ওজনের একক নয়।
কিন্তু আলেমগণ ওজন দ্বারা হিসাব নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছেন কারণ সেটা হিসাব রাখার ক্ষেত্রে বেশি সহজ ও সুক্ষ্ম। এ কথা সবাই জানে যে, একেক শস্যদানার ওজন একেক রকম। এর মধ্যে কোনটি হালকা, কোনটি ভারী এবং কোনটি মাঝারি ওজনের। বরঞ্চ একজাতীয় শস্যদানার ওজনও বিভিন্ন হয়ে থাকে। নতুন ফসলের ওজন পুরাতন ফসলের চেয়ে বেশি। তাই সতকর্তাবশতঃ কেউ যদি কিছুটা বেশি আদায় করে তবে সেটা বেশি নিরাপদ ও উত্তম।
‘আল-মুগনী’ গ্রন্থের খণ্ড- ৪, পৃষ্ঠা- ১৬৮ দেখুন। সেখানে ফসলের যাকাতের নিসাব উল্লেখ করতে গিয়ে ওজনের এই হার উল্লেখ করা হয়েছে।
আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।

No comments:

Post a Comment

Download AsPDF

Print Friendly and PDFPrint Friendly and PDFPrint Friendly and PDF
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...