Monday 21 July 2014

প্রসংগঃ “যাকাত”


যাকাত ইসলামের ৩য় রুকন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
“ইসলামের রুকন বা বুনিয়াদ পাচটি বিষয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত। আর তা হচ্ছে, আল্লাহকে এক বলে বিশ্বাস করা, সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, রামাযানের সাওম পালন করা এবং হজ্জ করা।”
[সহীহ মুসলিমঃ ১৮]
যাকাত আদায় করা ফরযঃ
“আপনি তাদের মালামাল থেকে যাকাত গ্রহণ করুন যাতে করে আপনি তাদেররকে পবিত্র করতে এবং তাদের সম্পদকে বরকতময় করতে পারেন এর মাধ্যমে। আর (যারা যাকাত দিবে) আপনি তাদের জন্য দোয়া করুন, নিঃসন্দেহে আপনার দোয়া তাদের জন্য সান্ত্বনা স্বরূপ। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছুই শুনেন ও জানেন।”
[সুরা আত-তাওবাহঃ ১০৩]
সুতরাং যাকাত দেওয়া ফরয আর এর বিনিময়ে বান্দার আত্মা পবিত্র হয় ও সম্পদ পবিত্র হয়ে তাতে আল্লাহর বরকত লাভ করা যায়।
যাকাত দেওয়ার ফযীলতঃ
“নিশ্চয়ই যারা ইমান আনে এবং সৎকাজ করে, সালাত কায়েম করে এবং যাকাত দান করে, তাদের জন্যে রয়েছে পুরষ্কার তাদের তাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে। তাদের কোন ভয় নেই এবং তাদের কোন দুঃখও থাকবেনা।”
[সুরা আল-বাক্বারাহঃ ২৭৭]
শয়তানকে পরাজিত করার একটা মাধ্যম হচ্ছে যাকাত আদায় করা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
“যখনই কোন ব্যক্তি যাকাত আদায় করে সে এর দ্বারা শয়তানের ৭০টি ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেওয়া দেয়।”
[ইবনে খুজাইমাহ, আহমাদঃ ৫/৩৫০, হাদীস সহীহ, সিলসিলাহ সহীহা’হঃ ১২৬৮]
যাকাত না দেওয়ার শাস্তিঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
“যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন, কিন্তু সে এর যাকাত আদায় করেনি, কিয়ামতের দিন তার সম্পদকে (বিষের তীব্রতার কারণে) টাকওয়ালা মাথা বিশিষ্ট বিষধর সাপের আকৃতি দান করে তার গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হবে। সাপটি তার মুখের দুই পাশে কমড়ে ধরে বলবে, আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার জমাকৃত মাল। তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিলাওয়াত করেনঃ
“আল্লাহ যাদেরকে সম্পদশালী করেছেন অথছ তারা সে সম্পদ নিয়ে কার্পণ্য করছে, তাদের ধারণা করা উচিত নয় যে, সেই সম্পদ তাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে, বরং উহা তাদের জন্য অকল্যাণকর হবে। অচিরে কিয়ামত দিবসে, যা নিয়ে কার্পণ্য করছে তা দিয়ে তাদের গলদেশ শৃংখলাবদ্ধ করা হবে।” (সুরা আলে ইমরানঃ ১৮০)
[সহীহ আল-বুখারীঃ ১৪০৩]
কোন সম্পদের ‘নিসাব’ কত?
আজকে শুধু স্বর্ণ, রূপা ও নগদ টাকার যাকাত আলোচনা করা হলো, ইন শা’ আল্লাহ পরবর্তীতে ফসলের যাকাত নিয়ে আলোচনা করা হবে।
স্বর্ণঃ
স্বর্ণের নিসাব হচ্ছে ২০ দিনার বা ৮৫ গ্রাম ওজনের স্বর্ণ, আমাদের দেশীয় হিসাব অনুযায়ী ৭.৫ ভরি স্বর্ণ।
[আবু দাউদঃ ১৫৭৩, শায়খ ইবনে উষাইমিন, আল-মুমতিঃ ৬/১০৩]
রূপাঃ
রূপার নিসাব হচ্ছে ১৪০ মিসকাল (দিরহাম) অর্থাৎ ৫৯৫ গ্রাম, আমাদের দেশীয় হিসাব অনুযায়ী ৫২.৫ ভরি রূপা।
[সহীহ বুখারীঃ ১৪৫৯, সহীহ মুসলিমঃ ৯৭৯, শায়খ ইবনে উষাইমিন]
ক্যাশ টাকাঃ
ক্যাশ টাকার নিসাব হচ্ছে রূপা অথবা স্বর্ণের নিসাবের সমান। বর্তমানে রূপা ও স্বর্ণের নিসাবের মূল্যের মাঝে অনেক বেশি পার্থক্য। এ ব্যপারে সৌদি আরবের স্থায়ী ফতোয়া বোর্ডের ফতোয়া হচ্ছেঃ নিসাব স্বর্ণ ও রূপার মাঝে যেটাকে ধরলে গরীবেরা বেশি উপকৃত হবে, সেটাকেই ধরা উচিত।
- আল-লাজনাহ আদ-দাইয়ি’মাহঃ ৯/২৪৬।
বর্তমানে ৭.৫ ভরি সোনা থেকে ৫২.৫ ভরি রূপার দাম অনেক কম। তাই ক্যাশ টাকার জন্য উত্তম হচ্ছে ৫২.৫ ভরি রূপার দামকেই ‘নিসাব’ হিসেবে ধরা।
ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২১ ক্যারেট প্রতি গ্রাম রূপার (সৌদি স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী) মূল্য ৪৬.৮৭ টাকা ধরে রূপার নিসাব এর মূল্য হচ্ছেঃ
৫৯৫ * ৪৬.৮৭ = ২৭,৮৮৭ টাকা।
সুতরাং, কারো কাছে সর্বনিম্ন ২৭,৮৮৭ পরিমান টাকা এক বছর ধরে জমা থাকলে ঐ টাকার উপরে যাকাত দেওয়া তার জন্য ফরয হবে।
বিঃদ্রঃ আপনারা স্থানীয় মার্কেটে খোজ নিয়ে দেখুন, আমাদের দেশে যেই ক্যারেটের রূপা ব্যবহার করা হয় তার দাম কত এবং সেই অনুযায়ী হিসাব করে নিবেন ইন শা’ আল্লাহ।
যাকাতের টাকা কিভাবে হিসাব করতে হবে?
কারো কাছে যদি ৭.৫ ভরি বা তার থেকে বেশি পরিমান স্বর্ণ অথবা ৫২.৫ ভরি বা তার থেকে বেশি পরিমান রূপা পূর্ণ এক চন্দ্র বছর জমা থাকে তাহলে তাকে সেটার মোট মূল্যের ৪০ ভাগের ১ ভাগ বা, শতকরা ২.৫ টাকা (প্রতি ১০০ টাকায় ২.৫ টাকা) হারে যাকাত দিতে হবে।
উদাহরণঃ যেমন ধরুন, কারো কাছে ১০ ভরি স্বর্ণ আছে। এটা নিসাবের পরিমানের থেকে বেশি, তাই তাকে যেইভাবে হিসাব করতে হবেঃ
১০ * প্রতি ভরি স্বর্ণের মূল্য * ০.০২৫ = যেই টাকা আসবে সেই পরিমান টাকা তাকে যাকাতের খাতগুলোতে ব্যয় করতে হবে।
অনুরূপভাবে রূপার বা ক্যাশ টাকার যাকাত হিসাব করতে হবে (মোট মূল্য * ০.০২৫ =...টাকা)
=> নিসাব পরিমান স্বর্ণ, রূপা, ক্যাশ টাকা পূর্ণ এক বছর না হওয়া পর্যন্ত যাকাত দেওয়া ফরয হবেনা। যেইদিন বছর পূর্ণ হবে সেইদিন যাকাত দেওয়া ফরয হবে। রমযান মাসে যাকাত দিতে হবে এমন কোন কথা নেই, যার উপর যেইদিন যাকাত ফরয হবে তখনই যাকাত দিতে হবে। উল্লেখ্য, বছর গণনা করতে হবে চাঁদের হিসাব অনুযায়ী, সৌর বৎসর নয়।
=> একই সম্পদ যদি জমানো থাকে তাহলে তার উপরে প্রতি বছরই যাকাত দিতে হবে। অর্থাৎ, কোন সম্পদের উপরে এক বছর যাকাত দিলে পরের বছরেও যদি সেই সম্পদ জমা থাকে, আর তার পরিমান নিসাবের সমান হয়, তাহলে পরের বছরেও ঐ একই সম্পদের উপর যাকাত দেওয়া ফরয হবে।
=> যাকাত পুরো সম্পদের উপরেই দিতে হয়। অনেকে মনে করে নিসাব পরিমানের উপরে যেটা হয় শুধুমাত্র সেই পরিমানের উপরে যাকাত দিতে হয় এটা ঠিকনা।
=> স্বর্ণ, রূপা বা নগদ টাকার যাকাত আদায় করতে হবে স্বর্ণ, রূপা বা নগদ টাকা দিয়ে। টাকা দিয়ে গরীবদেরকে ‘যাকাতের কাপড়’ বা অন্য কিছু কিনে বিরতণ করলে যাকাত আদায় হবেন। যাকাতে কাপড় দেওয়া এক প্রকার নিকৃষ্ট বেদাত।
=> স্বর্ণ, রূপা ও নগদ টাকার নিসাব আলাদা আলাদা হিসাব করা হবে, একসাথে করে যাকাত দিতে হবেনা। অর্থাৎ, কারো কাছে ৬ ভরি স্বর্ণ আর ৪৮ তোলা রুপা আছে, তাহলে তাকে দুইটার মূল্য যোগ করে একসাথে নিসাব হিসাব করে যাকাত দিতে হবেনা। কারণ, দুইটার নিসাব আলাদা, তাদের হিসাবও আলাদা হবে।
=> মেয়ে বা মা বোনদের যদি মালিক করে গয়না উপহার দেওয়া হয়, তাহলে তাদের প্রত্যেকের হিসাব আলাদা হবে। যেমন ধরুন, ৩ বোনের মিলে ৭.৫ ভরি বা তার বেশি ১০/১৫ ভরি স্বর্ণ হয়, কিন্তু এককভাবে কারোরই যদি ৭.৫ ভরি স্বর্ণ না হয়, তাহলে কাউকেই যাকাত দিতে হবেনা। তবে, কেউ যদি নিজের মেয়েদের স্থায়ী মালিক না করে গয়নাগুলো শুধু ব্যবহার করতে দেয়, তাহলে সবগুলো মিলিয়ে ৭.৫ ভরি বা তার বেশি হলে তার সম্পূর্ণটার উপরে তাকে যাকাত দিতে হবে।
=> স্ত্রীর গয়নার মালিক যদি সে হয়, তাহলে যাকাত ফরয হবে স্ত্রীর উপরে। স্ত্রীর গয়নার উপরে স্বামী যাকাত দিতে বাধ্য নন, তবে কেউ স্বেচ্ছায় নিজ স্ত্রীর যাকাত দিয়ে দিলে তার জন্য ভালো, কিন্তু স্ত্রী বাধ্য করতে পারবেনা। স্ত্রীর কোন উপার্জন নেই – এটা কোন অজুহাত হয়, স্ত্রীর নগদ টাকা না থাকলে আর স্বামী যদি যাকাত দিতে না চায়, তাহলে গয়না বিক্রি করেও হলে স্ত্রীকে যাকাত আদায় করতে হবে।
=> ৩-৪ বছর অবহেলা করে যাকাত না দিলে সেটা মারাত্মক অপরাধ ও কবীরা গুনাহ। অতি দ্রুত আল্লাহর কাছে খালেস তোওবা করে অতীতের যাকাতের টাকা হিসাব করে যাকাত আদায় করতে হবে।
=> ঋণগ্রস্থ ব্যক্তির যদি নিসাব পরিমান সম্পদ থাকে তাহলে তার উপর যাকাত ফরয হবে। তবে তার উচিত হচ্ছে আগে ঋণ পরিশোধ করা, এর পরে নিসাব পরিমান সম্পদ অবশিষ্ট থাকলে, তার উপর যাকাত আদায় করা। কিন্তু কেউ যদি ঋণ পরিশোধ না করে ও নিসাব পরিমান সম্পদ তার কাছে জমা থাকে, তাহলে তাকে যাকাত আদায় করতে হবে।
=> নিকটাত্মীয় যাদের জন্য ব্যয় করা কারো জন্য ফরয (যেমন স্ত্রী, ছেলে মেয়ে, বাবা-মা), বা কেউ মারা গেলে যারা উত্তরাধিকার হয় (যেমন ভাইয়ের কোন ছেলে না থাকলে) তাদেরকে যাকাত দেওয়া যায়না। তবে যাদের জন্য ব্যয় করা ফরয নয় এবং যারা তার উত্তরাধিকারও হবেনা, এমন আত্মীয়দেরকে যাকাত দেওয়া যায়।
=> মুজাহিদদের যাকাত প্রদান করা যায়। ইসলামী জ্ঞান শিক্ষা করা এক প্রকার জিহাদ। তাই দ্বীন শিক্ষায় নিয়োজিত ছাত্রদেরকে যাকাত দেওয়া যায়।
=> মসজিদে যাকাত দেওয়া যায় না।
=> নিজে ব্যবহার করার জন্য ব্যবহৃত গাড়ি ও বাড়িতে যাকাত দিতে হয়না। বাড়ি, গাড়ি ভাড়া দিয়ে রাখলেও তাঁর উপরে যাকাত দিতে হয়না। প্রাপ্ত ভাড়া জমা থাকলে বছর শেষে তার উপরে যাকাত দিতে হয়।

No comments:

Post a Comment

Download AsPDF

Print Friendly and PDFPrint Friendly and PDFPrint Friendly and PDF
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...