প্রশ্ন: আমরা জানি যে, আল্লাহ্ তা‘আলা প্রত্যেক বস্তু "كن" শব্দ দ্বারা সৃষ্টি
করেছেন, কিন্তু আদমের ক্ষেত্রে এরূপ করা হয়নি কেন, কেন তাকে ঠনঠনে মাটি দ্বারা
সৃষ্টি করা হয়েছে? বিষয়টি আমার বোধগম্য নয়, আশা করছি বুঝিয়ে বলবেন।
উত্তর: আল-হামদুলিল্লাহ।
প্রথমত: কুরআনুল কারিম থেকে জানা যায় যে, আদম আলাইহিস
সালামকে মাটি দ্বারা, অথবা ঠনঠনে মাটি দ্বারা, অথবা কাদামাটি দ্বারা সৃষ্টি করা
হয়েছে। এসব তার সৃষ্টির বিভিন্ন ধাপ, প্রয়োজন অনুসারে ধাপগুলো কুরআনুল কারিমের বিভিন্ন
স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে।
আদম
আলাইহিস সালামের সৃষ্টির সূচনা মাটি দ্বারা, অতঃপর তার সাথে পানি মিশানোর ফলে কাদামাটিতে
রূপান্তরিত হয়। অতঃপর কাদামাটি কালো বর্ণ ধারণ করে, অতঃপর আগুনের স্পর্শ ব্যতীত
শুকিয়ে তা ঠনঠনে হয়। صلصال বলা হয় আগুন ব্যতীত শুকনো মাটিকে। অতঃপর
আল্লাহ তাতে রূহ সঞ্চার করেন, ফলে তা মানুষের আকৃতি লাভ করে। এভাবেই আদম আলাইহিস
সালামের সৃষ্টি হয়।
শায়খ
মুহাম্মদ আমিন শানকিতি রহ. বলেন: “এটি জানার পর স্মরণ রাখ যে, আল্লাহ তা‘আলা যে মাটি থেকে আদমকে সৃষ্টি করেছেন,
তার বিভিন্ন ধাপ তিনি কুরআনুল কারিমে উল্লেখ করেছেন, যেমন নিম্নের বাণীসমূহে মাটির কথা বলেছেন:
﴿ إِنَّ مَثَلَ عِيسَىٰ عِندَ
ٱللَّهِ كَمَثَلِ ءَادَمَۖ خَلَقَهُۥ مِن تُرَابٖ ٥٩ ﴾ [ال عمران: ٥٩]
“নিশ্চয় আল্লাহর
নিকট ঈসার দৃষ্টান্ত আদমের মত, তিনি তাকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি
করেছেন”।[1]
অন্যত্র বলেন:
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِن
كُنتُمۡ فِي رَيۡبٖ مِّنَ ٱلۡبَعۡثِ فَإِنَّا خَلَقۡنَٰكُم مِّن تُرَابٖ٥ ﴾ [الحج : ٥]
“হে
মানুষ, যদি তোমরা পুনরুত্থানের ব্যাপারে সন্দেহে থাক, তবে নিশ্চয়ই জেনে রেখো, আমি
তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি”।[2]
অন্যত্র বলেন:
﴿ هُوَ ٱلَّذِي خَلَقَكُم مِّن تُرَابٖ ثُمَّ مِن نُّطۡفَةٖ ٦٧ ﴾ [غافر: ٦٧]
“তিনিই
তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, তারপর শুক্রবিন্দু থেকে”।[3]
অতঃপর বলেছেন, এ মাটি পানি মিশিয়ে আঠালো বানানো হয়েছে, যা হাতের সাথে লেগে যায়, যেমন তিনি বলেন:
﴿ إِنَّا خَلَقۡنَٰهُم مِّن طِينٖ لَّازِبِۢ ١١ ﴾ [الصافات : ١١]
“নিশ্চয়
আমি তাদেরকে সৃষ্টি করেছি আঠালো মাটি থেকে”।[4]
অন্যত্র বলেন:
﴿ وَلَقَدۡ خَلَقۡنَا ٱلۡإِنسَٰنَ مِن سُلَٰلَةٖ مِّن طِينٖ ١٢ ﴾ [المؤمنون : ١٢]
“আর অবশ্যই
আমি মানুষকে মাটির নির্যাস থেকে সৃষ্টি করেছি”।[5]
অন্যত্র বলেন:
﴿وَبَدَأَ خَلۡقَ ٱلۡإِنسَٰنِ مِن طِينٖ ٧ ﴾ [السجدة : ٧]
“এবং
কাদা মাটি থেকে মানুষ সৃষ্টির সূচনা করেছেন”।[6]
অতঃপর বলেছেন যে, এ কাদামাটি কালচে
রঙ ধারণ করেছে, যেমন তিনি বলেন:
﴿ حَمَإٖ مَّسۡنُونٖ ٢٦ ﴾ [الحجر: ٢٦]
“কালচে
কাদামাটি”।[7]
অপর আয়াতে তিনি বলেন যে, এ কাদামাটি শুকিয়ে
ঠনঠনে মাটিতে পরিণত করা হয়, অর্থাৎ শুকানোর ফলে তার থেকে ঠনঠনে
আওয়াজ শুনা যেত, যেমন তিনি ইরশাদ করেন:
﴿ وَلَقَدۡ خَلَقۡنَا ٱلۡإِنسَٰنَ مِن صَلۡصَٰلٖ ٢٦ ﴾ [الحجر: ٢٦]
“আর
অবশ্যই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি শুকনো ঠনঠনে মাটি থেকে”।[8]
অপর আয়াতে তিনি বলেন:
﴿ خَلَقَ ٱلۡإِنسَٰنَ مِن صَلۡصَٰلٖ كَٱلۡفَخَّارِ ١٤ ﴾ [الرحمن: ١٤]
“তিনি
মানুষকে সৃষ্টি করেছেন শুষ্ক ঠনঠনে মাটি থেকে, যা পোড়া মাটির ন্যায়”।[9]
প্রকৃত ইলম একমাত্র আল্লাহর নিকট”।[10]
দ্বিতীয়ত: জানা প্রয়োজন যে, আল্লাহ তা‘আলা হিকমত ব্যতীত কোনো কিছু নির্ধারণ করেন
না, সৃষ্টি করেন না ও কোনো বিধান রচনা করেন না। তিনি হিকমতপূর্ণ,
হিকমত তার এক বিশেষ বিশেষণ, কিন্তু তার সকল
কর্মের হিকমতের জ্ঞান বান্দাদেরকে দান করেন না।
শরীয়ত
এমন অনেক কিছু নিয়ে এসেছে যাতে বিবেক হতবাক হয়ে যায়; কিন্তু বিবেক সেটাকে অসম্ভব
বলে না। শরীয়ত অনেক বিধানের হিকমত বলেনি। আলেমগণ তার হিকমত অনুসন্ধান করে কখনো নাগাল
পেয়েছে, কখনো অপারগতা প্রকাশ করেছে, তবে তারা সকল বিষয় আল্লাহর সোপর্দ করেছে, তারা
স্বীকার করেছে তার সৃষ্টি ও বিধান হিকমতপূর্ণ। দাসত্বের দাবি হিসেবে তারা আল্লাহর
আদেশগুলো বাস্তবায়ন করেছে এবং তার নিষেধগুলো পরিহার করেছে।
মুসলিম
বিশ্বাস করে যে, মখলুক যত বড়ই হোক, আল্লাহ যখন তার সৃষ্টি ও অস্তিত্ব দানের ইচ্ছা
করেন, শুধু তিনি বলেন:"كن"
তাই হয়ে যায়। ইরশাদ হচ্ছে:
﴿ أَوَ لَيۡسَ ٱلَّذِي خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَ بِقَٰدِرٍ عَلَىٰٓ أَن
يَخۡلُقَ مِثۡلَهُمۚ بَلَىٰ وَهُوَ ٱلۡخَلَّٰقُ ٱلۡعَلِيمُ ٨١ إِنَّمَآ أَمۡرُهُۥٓ
إِذَآ أَرَادَ شَيًۡٔا أَن يَقُولَ لَهُۥ كُن فَيَكُونُ ٨٢ ﴾ [يس: ٨١، ٨٢]
“যিনি
আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন, তিনি কি তাদের অনুরূপ সৃষ্টি করতে সক্ষম নয়?
হ্যাঁ, তিনিই মহাস্রষ্টা, সর্বজ্ঞানী। তার ব্যাপার শুধু এই যে, কোনো কিছুকে তিনি
যদি ‘হও’ বলতে চান, তখনই তা হয়ে যায়”।[11]
আসমান,
জমিন ও মানুষ সৃষ্টি প্রসঙ্গে এ দু’টি আয়াতে চিন্তা করুন। কোনো মখলুক আল্লাহকে
অক্ষম করতে পারেনি, যখন তিনি সৃষ্টি করতে চেয়েছেন শুধু "كن" বলেছেন, তাই হয়ে গেছে। অতএব যখন তিনি বলছেন যে,
আসমান, জমিন ও তার মধ্যবর্তী যাবতীয় কিছু তিনি ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, তখন অবশ্যই তাতে
হিকমত আছে। অনুরূপ আমাদের পিতা আদমকে তিনি বিভিন্ন ধাপে সৃষ্টি করেছেন, চাইলে
অবশ্যই"كن"
দ্বারা
সৃষ্টি করতে সক্ষম ছিলেন, কিন্তু তা করেননি, তাতে অবশ্যই হিকমত রয়েছে। কয়েকটি
হিকমত যেমন:
১.
আল্লাহ তা‘আলা মহান কুদরত প্রকাশ করার জন্য
আদমকে মাটি ও কাদামাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। এটা কি কম আশ্চর্য যে, তিনি ঘৃণিত অবস্থা
থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ মখলুক সৃষ্টি করেছেন, যাতে জীবনও রয়েছে![12]
২. মখলুকের প্রকৃতি অনুসারে তার উপাদান
বেছে নেওয়া হয়েছে, যেমন আল্লাহ তা‘আলা মালায়েকা তথা
ফেরেশতাদের সৃষ্টি করেছেন নুর থেকে, শয়তান সৃষ্টি করেছেন আগুন
থেকে, আর আদম সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে। মালায়েকাদের সৃষ্টি
যেহেতু ইবাদত, তাসবীহ ও আনুগত্যের জন্য তাই তাদের সৃষ্টি নুর
দ্বারাই যথাযথ হয়েছে। শয়তানের সৃষ্টি যেহেতু প্রবঞ্চনা, ষড়যন্ত্র
ও ফেতনার জন্য, তাই তাদের সৃষ্টি আগুন থেকে যথাযথ হয়েছে। মানুষ
যেহেতু জমিন আবাদকারী, আর জমিনে নরম, কঠিন, ভাল ও মন্দ সকল প্রকার মাটি রয়েছে,
তাই তাদের সৃষ্টির উপাদানও এমন হওয়াই চাই, যাতে এসব বিশেষণ বিদ্যমান। দেখুন আগুনে বিভিন্নতা নেই, নুরে বিভিন্নতা নেই, কিন্তু
মাটিতে বিভিন্নতা রয়েছে, যা মূলত মানুষের প্রকৃতির বহিঃপ্রকাশ। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিম্নের বাণীতে
তারই বর্ণনা দিয়েছেন:
«إِنَّ اللَّهَ تَعَالَى خَلَقَ آدَمَ مِنْ قَبْضَةٍ
قَبَضَهَا مِنْ جَمِيعِ الْأَرْضِ، فَجَاءَ بَنُو آدَمَ عَلَى قَدْرِ الْأَرْضِ،
فَجَاءَ مِنْهُمُ الْأَحْمَرُ وَالْأَبْيَضُ وَالْأَسْوَدُ، وَبَيْنَ ذَلِكَ،
وَالسَّهْلُ وَالْحَزْنُ وَالْخَبِيثُ وَالطَّيِّبُ»
“নিশ্চয়
আল্লাহ আদমকে সৃষ্টি করেছেন এক মুষ্টি থেকে, যা তিনি সমগ্র জমিন থেকে গ্রহণ
করেছেন, ফলে বনু আদম জমিনের প্রকৃতি মোতাবেক সৃষ্টি হয়েছে। তাদের কেউ লাল, কেউ
সাদা, কেউ কালো এবং কেউ মাঝামাঝি বর্ণের। কেউ নরম, কেউ কঠোর, কেউ খারাপ ও কেউ ভালো
এবং কেউ মাঝামাঝি পর্যায়ের।”[13]
মুবারকপুরি
রহ. বলেন: “শায়খ তীবী বলেছেন: প্রথম চারটি গুণ যেহেতু মানুষ ও জমিনের মাঝে স্পষ্ট,
তাই তার প্রকৃত অর্থ এখানে উদ্দেশ্য। দ্বিতীয় চারটি গুণের ক্ষেত্রে ব্যাখ্যার
প্রয়োজন, কারণ তা অভ্যন্তরীণ বিশেষণ প্রসঙ্গে। সাহাল অর্থ
বিনয় ও বিনয়াবনতা, হাযান অর্থ কঠোর ও
বদমেজাজ, তাইয়্যেব অর্থ উর্বর জমি, অর্থাৎ মুমিন, যার পূর্ণ অস্তিত্বই কল্যাণ।
খবিস অর্থ লবণাক্ত জমি, অর্থাৎ কাফির, যার পূর্ণ অস্তিত্বই অকল্যাণ”।[14]
৩. সবচেয়ে
বড় হিকমত: আল্লাহ তা‘আলা নিজ বরকতময়
হাত দ্বারা আদমকে সৃষ্টি করে অন্যান্য সকল মখলুক থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছেন।
আল্লাহ যদি আদমকে একবাক্যে অস্তিত্বহীন থেকে অস্তিত্ব দান করতেন এরূপ হত না। দেখুন
মালায়েকা ও জিন একবাক্যে সৃষ্ট, তাদের ব্যাপারে বলা হয় না যে, আল্লাহ তাদেরকে নিজ
হাতে সৃষ্টি করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে:
﴿ قَالَ يَٰٓإِبۡلِيسُ مَا مَنَعَكَ أَن تَسۡجُدَ لِمَا خَلَقۡتُ بِيَدَيَّۖ
أَسۡتَكۡبَرۡتَ أَمۡ كُنتَ مِنَ ٱلۡعَالِينَ ٧٥ ﴾ [ص : ٧٥]
“আল্লাহ
বললেন, হে ইবলিস, আমার দু’হাতে আমি যাকে সৃষ্টি করেছি তার প্রতি সিজদাবনত হতে কিসে
তোমাকে বাঁধা দিল? তুমি কি অহংকার করলে, না তুমি অধিকতর উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন”?[15]
কিয়ামতের
দিন মানুষেরা যখন তাদের পিতা আদমের নিকট সুপারিশের জন্য আসবে, যেন আল্লাহ তাদের বিচারকার্য আরম্ভ করেন,
তখন তারা বলবে:
«يَا آدَمُ أَنْتَ أَبُو الْبَشَرِ خَلَقَكَ اللَّهُ
بِيَدِهِ وَنَفَخَ فِيكَ مِنْ رُوحِهِ وَأَمَرَ الْمَلَائِكَةَ فَسَجَدُوا لَكَ
وَأَسْكَنَكَ الْجَنَّةَ أَلَا تَشْفَعُ لَنَا إِلَى رَبِّكَ أَلَا تَرَى مَا
نَحْنُ فِيهِ وَمَا بَلَغَنَا»
“হে আদম,
আপনি মানব জাতির পিতা, আপনাকে আল্লাহ নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন এবং তার পক্ষ থেকে
আপনার মাঝে রূহ সঞ্চার করেছেন। তিনি মালায়েকাদের নির্দেশ করেছেন, ফলে তারা আপনাকে
সেজদা করেছে, তিনি আপনাকে জান্নাতে আবাস্থল দিয়েছেন, আপনি কি আমাদের জন্য আপনার
রবের নিকট সুপারিশ করবেন না, আপনি কি দেখছেন না আমরা কিসে আছি এবং আমাদের কিসে
স্পর্শ করেছে।”[16]
শায়খুল ইসলাম
ইব্ন তাইমিয়া রহ. বলেন: “আদম আলাইহিস সালামের এসব বৈশিষ্ট্য উল্লেখ
করা প্রমাণ করে, সকল মখলুকের উপর তার মর্যাদা ঊর্ধ্বে।”[17]
এ কারণে ঈসা আলাইহিস সালাম অপেক্ষা আদম আলাইহিস সালামের সৃষ্টি অধিক
আশ্চর্যজনক।
তিনি আরো
বলেন: “আদম ও হাওয়ার সৃষ্টি ঈসা থেকেও আশ্চর্যজনক,
কারণ হাওয়াকে সৃষ্টি করা হয়েছে আদমের পাঁজর থেকে, যা মারয়ামের পেটে ঈসার সৃষ্টি অপেক্ষা আশ্চর্যজনক। আর আদমের সৃষ্টি হাওয়া
ও ঈসা থেকে আশ্চর্যজনক, কারণ আদমই হাওয়ার উপাদান।”[18]
আল্লাহর সকল কর্ম হিকমতে পরিপূর্ণ। আল্লাহ ভালো জানেন।
No comments:
Post a Comment