Wednesday 20 August 2014

নির্ধারিত সময়ে সালাত আদায়ের গুরুত্ব



রহমান রহীম আল্লাহ্‌ তায়ালার নামে-

Salat on time
মূল : হুসাইন আল-আওয়াঈশাহ্‌ | ভাষান্তর : মোছতানছের বিল্লাহ্‌ | সম্পাদনা : আব্‌দ আল-আহাদ
আল্লাহ্‌ তা‘আলা বলেছেন :
“নিশ্চয়ই সালাত মু’মিনদের জন্য উল্লিখিত সময়ে ফরয।” [সূরা আন-নিসা : ১০৩]
এ সম্পর্কে ইমাম আল-বুখারী (রহ.) বলেন :

“উল্লিখিত সময় হলো নির্ধারিত (সময়)। তিনি সালাতের জন্য সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন।”
আবু আম্‌র আশ-শাইবানী থেকে বর্ণিত : এই ঘরের মালিক (আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদের ঘরের দিকে ইশারা করে) বলেছেন : আমি রাসূলকে (সা) জিজ্ঞাসা করেছিলাম : কোন ‘আমলটি আল্লাহ্‌র নিকট সর্বাধিক প্রিয়?’ তিনি (সা) উত্তরে বলেছিলেন : “যথা সময়ে সালাত (আদায় করা)।” তারপর তিনি জানতে চাইলেন : তারপর কী?’ তিনি (সা) বলেন : “বাবা-মায়ের সাথে ন্যায়নিষ্ঠ আচরণ করা।” তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তারপর কী?’ তিনি (সা) বললেন : “আল্লাহ্‌র রাস্তায় জিহাদ করা।” এসব বলার পর তিনি (আব্দুল্লাহ) বলেন : আমি আরও জানতে চাইলে তিনি (সা) আমাকে আরও বলতেন। [বুখারী, খণ্ড : ৮, অধ্যায় : ৭৩, হাদীস : ১]
এই হাদীসে রাসূল (সা) সুস্পষ্ট করেছেন যে, নির্ধারিত সময়কে সালাত আদায় করা আল্লাহ্‌র কাছে সর্বাধিক প্রিয় ‘আমল। এই ‘আমলটিকে তিনি (সা) বাবা-মায়ের সাথে সদ্ব্যবহার করা এবং আল্লাহ্‌র রাস্তায় জিহাদ করার ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন। এর প্রমাণ হলো হাদীসে ‘তারপর কী?’ ক্রমবাচক পদবাচ্যের ব্যবহার। এই শব্দগুচ্ছটি গুরুত্বের ক্রম বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয় এবং আরবি ভাষাভাষীদের কাছে বিষয়টি সুপরিচিত।
আল-হাফিয ইবনু হাজার তার ‘আল-ফাত্‌হ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন : “ইবনু বাযীযা বলেছেন : এক্ষেত্রে যা লক্ষণীয় তা হলো, সকল দৈহিক প্রচেষ্টা মধ্য থেকে জিহাদকে সর্বাগ্রে স্থান দেওয়া, কারণ এতে আত্মত্যাগের বিষয়টি জড়িত। তবে ধৈর্য ধারনের বিষয়টি এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। কারণ ফরজ সালাতগুলোকে রক্ষা করা, সেগুলোকে সঠিক সময়ে আদায় করা এবং নিজের মা-বাবার সাথে উত্তম আচরণ করার বিষয়টি ধৈর্যের সাথে সংশ্লিষ্ট যা একটি সার্বক্ষণিক বিষয়। সত্যবাদীরা (সদীকূন) ব্যতীতঅন্যকেউ আল্লাহ্‌র আদেশ পালনের ক্ষেত্রে সার্বক্ষণিকভাবে ধৈর্যশীল থাকতে পারে না। আর আল্লাহ্‌ সকল বিষয়ে সর্বজ্ঞ।”

বিষয়টি সুস্পষ্ট করার জন্য আমি এখানে একটি দৃষ্টান্ত পেশ করতে চাই :

ধরুন, এক ব্যবসায়ী তার ব্যবসা-বাণিজ্য এবং লেনদেন নিয়ে সারাদিন মশগুল থাকেন। শয়তানের প্ররোচনায় এই লোক প্রায়ই জামা‘আতে সালাতের তাকবীরাতুল ইহ্‌রাম (সালাতের প্রথম তাকবীর) অথবা সালাতের অংশবিশেষ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এমতাবস্থায় আপনি সেই লোকের কাছে আল্লাহ্‌র রাস্তায় জিহাদের মর্যাদা এবং সাহাবাদের বীরত্বগাঁথা সম্পর্কিত কুরআন এবং হাদীসের দলীল নিয়ে হাজির হলেন। তার মনে জান্নাত লাভের আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করে দিলেন। ফলে পৃথিবীর প্রতি তার বিতৃষ্ণা জন্ম নিল। আপনার সতর্কবাণী শোনার পর সেইলোক পৃথিবী নিয়ে ভাবলেন এবং পৃথিবী তার কাছে তুচ্ছ ও নগণ্য মনে হলো। তিনি পরকাল নিয়ে ভাবলেন যা তার কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদার মনে হলো। তাই তিনি সেই জান্নাতের পথে ছুটে এলেন  যার বিশালত্ব পৃথিবী ও আকাশসমূহের বিশালত্ব। দেরি না করে তিনি তার ইচ্ছাপত্র লিখে ফেললেন, সবার দেনাপাওনা মিটিয়ে দিলেন, পরিবার পরিজনের কাছে বিদায় নিলেন এবং আল্লাহ্‌র রাস্তায় জিহাদের জন্য ময়দানে গেলেন। সেখানে নিহত হলেন এবং আল্লাহ্‌র রাস্তায় শহীদ হয়ে গেলেন।
ওই লোককে আল্লাহ্‌র রাস্তায় জিহাদ করার জন্য না ডেকে, তাকে যদি তার সালাত হেফাজতের জন্য এবং তার মধ্যে অনুপ্রেরণা সৃষ্টির জন্য কুরআন-হাদীসের দলীল পেশ করতেন, এমন কোনো গল্প বলতেন যা তার মনে ভয় সৃষ্টি করত এবং তার মনকে প্রভাবিত করত, তাহলে সে ক্ষেত্রে কী ঘটত বলে আপনার মনে হয়?
হয়তো তাতে কাজ হতো; তিনি হয়তো সালাতের প্রতি তার অবহেলার কারণে অনুতপ্ত হতেন এবং তাওবা করতেন। হয়তো নিজের সালাত হেফাজতের ব্যপারে এবং সঠিক সময়ে সালাত আদায়ের ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প করতেন। হয়তো কিছুদিনের জন্য সেই সংকল্পের বাস্তবায়ন করতেন। কিন্তু তারপর আবার শয়তান আসবে এবং তাকে কুমন্ত্রণা দেবে; আবার তার ব্যবসা-বাণিজ্য ও লেনদেনের ব্যস্ততা বাড়বে; সভা-সমাবেশ, মানুষের সাথে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা ইত্যাদির চাপ সমান তালে বাড়তে থাকবে। ফলে শয়তান যা চায়, আবারও তা-ই ঘটবে। আবার তার সালাতে বিচ্যুতি আসবে। শয়তান থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য আবার তিনি নিজের আত্মার বিরুদ্ধে জিহাদ করবেন। আবার শয়তান দ্বারা প্ররোচিত হবেন এবং পূর্বের ন্যায় শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদে লিপ্ত হবেন; প্রতিদিন পাঁচবার করে এই জিহাদ অনুষ্ঠিত হবে। এভাবে জীবনের প্রতিটি দিন… আর জীবন তো কেবল কয়েকটি দিনের সমষ্টি ছাড়া আর কিছু নয়।
এই দৃষ্টান্তটি নাফ্‌সের (কুপ্রবৃত্তির) বিরুদ্ধে জিহাদ। আবার পূর্বের দৃষ্টান্তটিও নাফ্‌সের বিরুদ্ধে জিহাদ। তবে প্রথমটির সাথে দ্বিতীয়টির অবস্থানগত পার্থক্য রয়েছে। দ্বিতয়টি হচ্ছে তিল তিল করে জীবনের শেষদিন অবধি জিহাদ করে যাওয়া; আর প্রথমটি হয়তো কয়েকঘণ্টা, কয়েকদিন বা কয়েকমাস কিংবা কয়েক বছরের জন্য। তবে দুটির যেটিই হোক, আমার মতে উভটিতেই কল্যাণ রয়েছে।
আল্লাহ্‌র কাছে দো‘আ করি তিনি যেন আমাকে সালাত ও এর খুশূ‘ (বিনম্রতা) হেফাজতকারীদের অন্তর্ভুক্ত করেন, পাশাপাশি তাঁর প্রতিটি নির্দেশ পালনে সক্ষম করেন এবং আমাকে শহীদদের অন্তর্ভুক্ত করেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাবান।
মিস‘আব ইবনু সা‘আদ বলেন : আমি আমার বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম : ও বাবা! “যারা তাদের সালাতের ব্যাপারে উদাসীন।” (১০৭ : ৫) — এই আয়াত সম্পর্কে আপনার ব্যাখ্যা কী? আমাদের মধ্যে কারা উদাসীন? আমাদের মধ্যে কে (সালাতের মধ্যে) তার আত্মার সাথে কথা বলে না? তিনি বললেন : এর দ্বারা তেমনটি বোঝানো হয়নি। এর দ্বারা সালাতের (নির্ধারিত) সময়কে বোঝানো হয়েছে। মানুষ অযথা সময় নষ্ট করে যতক্ষণ না সালাতের সময় অতিক্রান্ত হয়ে যায়। [আবূ ইয়া‘লা থেকে হাসান সূত্রে বর্ণিত। আরও দেখনু : সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হাদীস : ৫৭৫]
মূসা ইবনু ইসমা‘ঈল বলেন : আনাস থেকে গাইলান থেকে মাহ্‌দি বর্ণনা করেন যে : “একবার আনাস (রা) অনুপাত এবং আক্ষেপ করে বললেন, নবীর (সা) সময়ে যে সমস্ত (‘আমল) দেখেছিলাম এখন তার একটিও দেখতে পাই না। এক ব্যক্তি বললেন, সালাত এখন বাকি আছে। আনাস (রা) বললেন, দেখো না! কীভাবে সালাতকে বিনষ্ট করেছ?” [আল-বুখারী, খণ্ড : ১, অধ্যায় : ৭ “ওয়াক্ত মতো সালাত আদায় না করা সালাতকে বিনষ্ট করা”, হাদীস : ৩২৫]
এখানে তিনি মূলত সালাতের নির্ধারিত সময় পার করে দিয়ে অসময়ে সালাত আদায়ের বিষয়ে কথা বলছেন।
আব্দুল ‘আযীযের ভাই, উসমান ইবনু আবি রাউওয়াদ বলেন : আমি যুহরীকে বলতে শুনেছি : একবার দামেস্কে আনাস ইবনু মালিকের কাছে গিয়ে দেখলাম তিনি কাঁদছেন। তাই জিজ্ঞাসা করলাম : আপনি কাঁদছেন কেন? তিনি কিছুক্ষন থেমে বললেন : হায়! যা কিছু দেখেছিলাম এখন তার কিছুই দেখছি না। এমনকি এই সালাতকেও নষ্ট করা হচ্ছে। [আল-বুখারী, খণ্ড : ১, অধ্যায় : ৭ “ওয়াক্তমতো সালাত আদায় না করা সালাতকে বিনষ্ট করা”, হাদীস : ৩২৬]
‘ফাতহুল বারী -তে ইবনু হাজার (রহ.) বলেছেন : আল-মুহাল্লিব বলেছেন : ‘নষ্ট করা হচ্ছে’ এর অর্থ হলো উত্তম এবং নির্দেশিত সময় থেকে বিলম্ব করা। এর অর্থ এই নয় যে, তারা ওয়াক্ত শেষ হওয়ার পর সালাত আদায় করতেন।’ ইবনু হাজার এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন এবং বলেছেন, এর অর্থ হলো মূলত ওয়াক্ত শেষ হয়ে যাওয়ার পর সালাত আদায় করা।
আমার মতে, কবি সত্য কথায় বলেছেন :
আমি বলি দুটোই তিতা, দুটোর মধ্যে যেটা সামান্য মিষ্টি সেটাও মূলত তিতাই।”
আনাস (রা) এই ব্যাপারে কান্নাকাটি করতেন আর আমরা কী করছি? আমাদের ক্ষেত্রে কী করা বাঞ্ছনীয়? সালাতের প্রতি অবহেলার জন্য এবং আল্লাহ্‌র অন্যান্য বিধিবিধানের বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য আমাদের কি চোখের জলে নদী হয়ে যাওয়া উচিত নয়?
উবাদাহ ইনবু সামিত (রা) বলেন : আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমি আল্লাহ্‌র রাসূলকে (সা) বলতে শুনেছি : “আল্লাহ্‌ (আয্‌যা ওয়া জাল্লা) পাঁচ ওয়াক্ত সালাতকে বাধ্যতামূলক করেছেন। যে ব্যাক্তি তার অযুকে সুন্দর করে, নির্ধারিত সময়ে সালাত আদায় করে এবং খুশূ‘ সহকারে রুকূ‘ ও সেজ্‌দা সম্পন্ন করে, তার সাথে আল্লাহ্‌র অঙ্গীকার হলো তিনি তাকে ক্ষমা করে দেবেন। আর যে ব্যাক্তি তা করলো না, আল্লাহ্‌র সাথে তার তেমন কোনো অঙ্গীকার নেই। আল্লাহ্‌ চাইলে তাকে ক্ষমাও করতে পারেন, আবার চাইলে তিনি তাকে শাস্তিও দিতে পারেন। [মালিক, আবূ দাঊদ এবং আন নাসা‘ঈ কর্তৃক সংকলিত। ইবনু হিব্বান এটিকে সহীহ বলে মত দিয়েছেন। সহীহুত তারগীব ওয়াত-তাহ্‌রীব (হাদীস : ৩৯৬) গ্রন্থেও রয়েছে]
কা‘ব ইবনু উজ্‌রা (রা) বলেন : আল্লাহ্‌র রাসূল (সা) আমাদের কাছে এলেন এবং আমরা ছিলাম ৭ জনের একটি দল। আমাদের চারজন ছিল মুক্তিপ্রাপ্ত গোলাম আর বাকিরা আগে কখনো গোলাম ছিল না। আমরা মসজিদের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে ছিলাম এবং তিনি (সা) বললেন : “তোমরা বসে আছো কেন?” আমরা বললাম : আমরা সালাতের জন্য অপেক্ষা করছি। তিনি (কা‘ব) বললেন : তখন তিনি (সা) কিছুক্ষন চুপ করে থাকলেন এবং আমাদের দিকে ফিরে বললেন : “তোমাদের রব কী বলেছেন তা কি তোমরা জানো?” আমরা বললাম : “না।” তিনি (সা) বললেন : “নিশ্চয়ই তোমাদের রব বলেছেন : যে সঠিক সময়ে সালাত আদায় করে, ধারাবাহিকভাবে সালাতের হেফাজত করে এবং এর সত্যিকার গুরুত্বকে নগণ্য ভেবে একে বিনষ্ট না করে, তার সাথে আমার অঙ্গীকার হলো আমি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবো। আর যে ব্যক্তি সঠিক সময়ে সালাত আদায় করে না, ধারাবাহিকভাবে সালাতের হেফাজত করে না এবং এর সত্যিকার গুরুত্বকে নগণ্য ভেবে একে বিনষ্ট করে, তার সাথে আমার কোনো অঙ্গীকার নেই। আমি চাইলে তাকে ক্ষমা করে দেবো আর চাইলে তাকে শাস্তি দিবো।” [আত-তাবারানী কর্তৃক আল-কাবীর গ্রন্থে এবং আহ্‌মাদ কর্তৃক আল-আওসাত গ্রন্থে বর্ণিত। সহীহুত তারগীব ওয়াত-তাহ্‌রীব (হাদীস : ৩৯৭) গ্রন্থেও রয়েছে।]
আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রা) বলেন : একদিন নবী (সা) তাঁর সাহাবীদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বললেন : “তোমরা কি জানো, তোমাদের রব (সুবহানাহু ওয়া ত‘আলা), কী বলেছেন?” আমরা বললাম : আল্লাহ্‌ এবং তাঁর রাসূল (সা) ভালো জানেন। আল্লাহ্‌র রাসূল (সা) একথা তিনবার বলেন। অতঃপর বললেন : “আমার ক্ষমতা ও মহত্ত্বের কসম! যথা সময়ে সালাত আদায়কারী প্রত্যেককে আমি জান্নাতে প্রবেশ করাবো। আর যে নির্ধারিত সময়ের বাইরে অন্য কোনো সময় সালাত আদায় করবে, আমি তার  প্রতি দয়াও করতে পারি আবার তাকে শাস্তিও দিতে পারি।” [আত-তাবারানী কর্তৃক আল-কাবীর গ্রন্থে বর্ণিত। সহীহুত তারগীব ওয়াত-তাহ্‌রীব (হাদীস : ৩৯৮) গ্রন্থেও রয়েছে।] 

No comments:

Post a Comment

Download AsPDF

Print Friendly and PDFPrint Friendly and PDFPrint Friendly and PDF
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...