Wednesday 15 January 2020

যার জন্য তাক্বলীদ বৈধ, আর যার জন্য বৈধ নয়


·
মক্কাস্থ উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক এবং মাসজিদুল হারামের সম্মানিত মুদার্রিস, বর্তমান যুগের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, আশ-শাইখ, আল-‘আল্লামাহ, ড. ওয়াসিউল্লাহ বিন মুহাম্মাদ ‘আব্বাস (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৬৭ হি./১৯৪৮ খ্রি.] বলেছেন—
❝আমরা এ ব্যাপারে বলি, মহান আল্লাহ কিতাব ও সুন্নাহর মাধ্যমে তাঁর দ্বীনকে পরিপূর্ণ করেছেন। যাঁরা তাঁর দ্বীনের প্রতি ইমান আনয়ন করেছেন, তাঁদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাহাবীবর্গ ছিলেন প্রথম সারির অগ্রণী। যাঁরা ইসলাম ও ইমানকে সাদরে বরণ করে নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে সাহাবীগণই ছিলেন সবচেয়ে পরিপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ। তাঁরা ইমামুল আইম্মাহ ﷺ ব্যতীত অন্য কারও তাক্বলীদ (অনুসরণ) করতেন না।
তারপরে তাবি‘ঈ ও তাঁদের পরবর্তীগণকে কিতাব, সুন্নাহ ও সাহাবীবর্গের আসার (বর্ণনা) থেকে যে ফতোয়া দেওয়া হতো, তাঁরা কেবল তারই অনুসরণ করতেন। তখন উম্মতের মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির তাক্বলীদ করা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে কোনো প্রশ্নই ছিল না।
তাক্বলীদের ইতিহাস থেকে এটা সুবিদিত হয়েছে যে, উক্ত কথা (নির্দিষ্ট ব্যক্তির তাক্বলীদ করা ওয়াজিব মর্মের বক্তব্য) সোনালী (তিন) যুগ সমাপ্ত হওয়ার পরে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বিভিন্ন দলিলের ভিত্তিতে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, ‘ইলমের ক্ষেত্রে মানুষ নিম্নোক্ত কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত। যথা:
১. বড়ো ‘উলামা, যাঁরা উম্মতের মধ্যে মুজতাহিদ হিসেবে পরিচিত। তাঁদেরকে ‘উলামা ও তালিবুল ‘ইলমরা চিনতে পারেন।

২. মধ্যম পর্যায়ের ‘উলামা, যাঁরা ‘ইলমের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত তাফসীর, হাদীস ও ‘আক্বীদাহ বিষয়ে ‘ইলম অর্জন করেছেন। তাঁরা দলিলসমূহের শুদ্ধাশুদ্ধি নির্ণয় করতে পারেন। “বস্তুত প্রত্যেক জ্ঞানীর ওপরেই রয়েছেন মহাজ্ঞানী।” [১]
৩. সাধারণ জনগণ, যাঁরা দলিল জানেন না এবং তাঁদের ওপর বিস্তারিত ‘ইলম অর্জন করা আবশ্যকও নয়। যেমনটি আমি ইত্তিবা‘ অধ্যায়ে আলোচনা করেছি।
প্রথমোক্ত শ্রেণির জন্য কারও তাক্বলীদ করা জায়েজ নয়। তবে যদি কোনো মাসআলাহর হুকুম জানতে তিনি অপারগ হন, তাহলে সে কথা স্বতন্ত্র। তখন ‘উলামাদের মধ্যে যাঁদের সিন্ধান্তে তাঁর অন্তর প্রশান্ত হয়, তাঁদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তাঁর তাক্বলীদ করা তাঁর জন্য বৈধ হবে।
দ্বিতীয়োক্ত শ্রেণির জন্যও প্রথমোক্ত শ্রেণির মতো কারও তাক্বলীদ করা জায়েজ নয়। তার জন্য দলিল জানা এবং দলিলের আলোকে ‘উলামাদের ফতোয়া বোঝা আবশ্যক। পক্ষান্তরে সে যদি অপরাগ হয়, দলিল জানতে না পারে, তাহলে তাকে তাক্বলীদ করতে হবে।
আর তৃতীয়োক্ত শ্রেণি, যাঁরা হলেন সাধারণ মানুষ, যাঁদের নিকটে দলিলের জ্ঞান নেই। তাঁরা উল্লিখিত দুই শ্রেণির যেসব ‘উলামা জ্ঞান ও সততার ব্যাপারে পরিচিত—নির্দিষ্ট কারও রায় বা মতের মধ্যে সীমাবদ্ধ না হয়ে—তাঁদের মধ্যে যে কোনো ‘আলিমকে প্রশ্ন করবেন এবং তাঁর তাক্বলীদ করবেন।
ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) ‘উলামাদের বক্তব্য উদ্ধৃত করে এবং তাঁর সঠিক সিন্ধান্ত ব্যক্ত করে বলেছেন,
والذي عليه جماهير الأمة أن الاجتهاد في الجملة، والتقليد جائز في الجملة، لا يوجبون الاجتهاد على كل أحد ويحرمون التقليد، ولا يوجبون التقليد على كل أحد ويحرمون الاجتهاد، وأن الاجتهاد جائز للقادر على الاجتهاد، والتقليد جائز للعاجز عن الاجتهاد، فأما القادر على الاجتهاد، فهل يجوز له التقليد؟ هذا فيه خلاف، والصحيح أنه يجوز حيث عجز الاجتهاد: إما لتكافؤ الأدلة، وإما لضيق الوقت عن الاجتهاد، وإما لعدم ظهور دليل له، فإنه حيث عجز سقط عنه وجوب ما عجز عنه وانتقل إلى بدله وهو التقليد، كما لو عجز عن الطهارة بالماء.
“উম্মতের অধিকাংশ বিদ্বানের মতানুযায়ী, সাধারণভাবে ইজতিহাদ করা বৈধ এবং সাধারণভাবে তাক্বলীদ করাও বৈধ। তাঁরা সবার জন্য ইজতিহাদকে ওয়াজিব বলে তাক্বলীদকে বিলকুল হারাম বলেন না, আবার সবার জন্য তাক্বলীদকে ওয়াজিব বলে ইজতিহাদকে বিলকুল হারাম বলেন না। বরং ইজতিহাদ করতে যিনি সক্ষম, তাঁর জন্য ইজতিহাদ করা বৈধ। অনুরূপভাবে যিনি ইজতিহাদ করতে অপারগ, তাঁর জন্য তাক্বলীদ করা বৈধ। পক্ষান্তরে যিনি ইজতিহাদ করতে সক্ষম, তাঁর জন্য কি তাক্বলীদ করা বৈধ? এ ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে। তবে সঠিক কথা হলো—দুই দিকের দলিল সমমানের হওয়ায়, অথবা ইজতিহাদ করার সময় না থাকায়, কিংবা মুজতাহিদের কাছে দলিল স্পষ্ট না হওয়ার কারণে তিনি ইজতিহাদ করতে অপারগ হলে, তাঁর জন্য তাক্বলীদ করা বৈধ। কেননা তিনি যখন কোনো বিষয় সম্পাদন করতে অপারগ হয়েছেন, তখন তিনি যা করতে অপারগ হয়েছেন তা সম্পাদন করার আবশ্যকতা তার থেকে বিলীন হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে তিনি ইজতিহাদের পরিবর্তে তাক্বলীদের দিকে স্থানান্তরিত হবেন। যেমনভাবে কেউ পানি দিয়ে পবিত্রতা অর্জন করতে অপারগ হলে সে তায়াম্মুম করে পবিত্রতা অর্জন করে।” [২]
বাস্তবিক অর্থে এ ধরনের তাক্বলীদকে ইত্তিবা‘ (দলিলের অনুসরণ) বলা হয়। কেননা তাক্বলীদকারী মুক্বাল্লিদ এক্ষেত্রে দলিলের অনুসরণ করে থাকে। যেহেতু মহান আল্লাহ বলেছেন, فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ “তোমরা যদি না জান, তাহলে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস করো।” [৩]
আর এই দলিল তার জন্য জ্ঞানী ব্যক্তির কথা গ্রহণ করা ওয়াজিব সাব্যস্ত করেছে। কিন্তু এভাবে প্রশ্ন করা এবং সেই প্রশ্নের জবাব অনুযায়ী আমল করাকে যদি তাক্বলীদ বলা হয়, তাহলে তাতে কোনো সমস্যা নেই। যদিও ইমাম ইবনু খুওয়াইয মানদাদ আল-মালিকী (রাহিমাহুল্লাহ) উক্ত প্রকারকে ইত্তিবা‘ বলেছেন, তাক্বলীদ নয়।
তিনি বলেছেন, ﻛُﻞُّ ﻣَﻦْ ﺍﺗَّﺒَﻌْﺖ ﻗَﻮْﻟَﻪُ ﻣِﻦْ ﻏَﻴْﺮِ ﺃَﻥْ ﻳَﺠِﺐَ ﻋَﻠَﻴْﻚ ﻗَﺒُﻮﻟُﻪُ ﺑِﺪَﻟِﻴﻞٍ ﻳُﻮﺟِﺐُ ﺫَﻟِﻚَ ﻓَﺄَﻧْﺖَ ﻣُﻘَﻠِّﺪُﻩُ، ﻭَﺍﻟﺘَّﻘْﻠِﻴﺪُ ﻓِﻲ ﺩِﻳﻦِ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﻏَﻴْﺮُ ﺻَﺤِﻴﺢٍ، ﻭَﻛُﻞُّ ﻣَﻦْ ﺃَﻭْﺟَﺐَ ﺍﻟﺪَّﻟِﻴﻞَ ﻋَﻠَﻴْﻚ ﺍﺗِّﺒَﺎﻉُ ﻗَﻮْﻟِﻪِ ﻓَﺄَﻧْﺖَ ﻣُﺘَّﺒِﻌُﻪُ، ﻭَﺍﻟِﺎﺗِّﺒَﺎﻉُ ﻓِﻲ ﺍﻟﺪِّﻳﻦِ ﻣُﺴَﻮَّﻍٌ، ﻭَﺍﻟﺘَّﻘْﻠِﻴﺪُ ﻣَﻤْﻨُﻮﻉٌ “তুমি যদি এমন কোনো দলিল ছাড়াই কারও কথা গ্রহণ করে নাও, যে দলিল তার কথা গ্রহণ করাকে ওয়াজিব করে না, তুমি যদি সেই ব্যক্তির অনুসরণ করো, তাহলে তুমি তার তাক্বলীদ করলে। আর আল্লাহর বিধান পালনের ক্ষেত্রে তাক্বলীদ বৈধ নয়। পক্ষান্তরে তুমি যদি এমন কোনো দলিলের ভিত্তিতে তাঁর কথা মেনে চল, যে দলিল তার কথা গ্রহণ করাকে ওয়াজিব করে, (তুমি তাঁর অনুসরণ করলে) তুমি হবে তাঁর ইত্তিবা‘কারী। আর দ্বীন পালনের ক্ষেত্রে ইত্তিবা‘ সিদ্ধ, কিন্তু তাক্বলীদ নিষিদ্ধ।” [৪]
শেষোক্ত শ্রেণির ব্যক্তিবর্গের জন্য তাদের তাক্বলীদ করা না-জায়েজ, যাদের ব্যাপারে তারা জানে—এরা এমন উপযুক্ত নয় যে, এদের কথা গ্রহণ করা যায়। অনুরূপভাবে দলিল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এবং অন্য মতের মধ্যে হক আছে তা জানার পর কারও (না-হক) ফতোয়ার তাক্বলীদ করা কারও জন্য জায়েজ নয়। এক্ষেত্রে দলিলের বিরোধিতা করার কারণে উক্ত মুক্বাল্লিদ (তাক্বলীদকারী) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ﷺ নাফরমান হিসেবে পরিগণিত হবে। [৫]
যে মুক্বাল্লিদ তার পূর্বসূরিদের তাক্বলীদ করে, অথচ তার পূর্বসূরিদের কর্মের বিপরীতে দলিল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, মহান আল্লাহ সেই মুক্বাল্লিদের কঠিন নিন্দা করেছেন।
ইমাম ইবনু ‘আব্দিল বার্র (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, মহান আল্লাহ তাঁর কিতাবে একাধিক জায়গায় তাক্বলীদের নিন্দা করেছেন। তিনি বলেছেন, اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ “আল্লাহর পরিবর্তে তারা তাদের তাদের ধর্মীয় নেতা ও পুরোহিতদেরকে রব হিসেবে বরণ করে নিয়েছিল।” [৬]
হুযাইফাহ ও অন্যদের (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুম) থেকে বর্ণিত হয়েছে, নাবী ﷺ বলেছেন, “তারা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ইবাদত করেনি। বরং তারা অনেক বিষয়কে হালাল ও হারাম হিসেবে উপস্থাপন করত, আর তারা (এসব ক্ষেত্রে) তাদের অনুসরণ করত।”
ইবনু ‘আব্দিল বার্র বিশুদ্ধ সনদে ‘আদী বিন হাতিম (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কাছে গেলাম, এমতাবস্থায় আমার গলায় ঝুলছিল একটি ক্রুশ। তিনি আমাকে বললেন, ‘আদী, তোমার গলা থেকে এই মূর্তিকে ছুঁড়ে ফেল! আমি তা ছুঁড়ে ফেলে তাঁর কাছে গমন করলাম, তখন তিনি ﷺ পাঠ করছিলেন, اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ “তারা (ইহুদি ও খ্রিষ্টান জাতির লোকেরা) আল্লাহর পরিবর্তে তাদের ধর্মীয় নেতা ও পুরোহিতদেরকে রব হিসেবে বরণ করে নিয়েছিল।” (সূরাহ তাওবাহ: ৩১) তখন আমি নাবীজিকে বললাম, ‘আমরা তো তাদের ইবাদত করি না (তাদেরকে রব হিসেবে গ্রহণ করি না)।’ তিন বললেন, ‘আচ্ছা আল্লাহর হালাল ঘোষিত জিনিসকে তারা হারাম বললে, তোমরা কি তা হারাম হিসেবে গ্রহণ করো না? আবার আল্লাহর হারাম ঘোষিত জিনিসকে তারা হালাল বললে, তোমরা কি তা হালাল হিসেবে গ্রহণ করো না? তখন আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি তখন বললেন, ‘এটাই তাদের ইবাদত।’ [৭]
ইবনু ‘আব্দিল বার্র (রাহিমাহুল্লাহ) বাপদাদা ও আকাবিরদের তাক্বলীদকারীদের ব্যাপারে আয়াত উল্লেখ করেছেন। তারপর তিনি বলেছেন, “পূর্বসূরি ও নেতাদের তাক্বলীদের নিন্দা করে কুরআনে এরকম অনেক আয়াত বর্ণিত হয়েছে।”
তারপর তিনি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘উলামাগণ এসব তাক্বলীদকে বাতিল করার ক্ষেত্রে এসব আয়াত দিয়ে দলিল দিয়েছেন। আয়াতে উল্লিখিত মুক্বাল্লিদরা কাফির হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা এসব আয়াত দিয়ে দলিল দিয়েছেন। কেননা কারও মু’মিন হওয়া এবং অপরজনের কাফির হওয়ার দিক থেকে তুলনা করা হয়নি। বরং মুক্বাল্লিদ যে দলিল ছাড়া তাক্বলীদ করে, এই দিক থেকে উভয় তাক্বলীদের তুলনা করা হয়েছে। যেমন যদি কোনো ব্যক্তি তাক্বলীদ করে কুফরি করে, আবার কোনো ব্যক্তি তাক্বলীদ করে গুনাহ করে, অথবা কোনো ব্যক্তি দুনিয়াবি ক্ষেত্রে তাক্বলীদ করে ভুলে পতিত হয়, তাহলে তারা সবাই বিনা দলিলে (অন্যের) অনুসরণ করার কারণে নিন্দিত হবে। কেননা এগুলোর সবই তাক্বলীদ, যেগুলোর একটি অপরটির সাথে সামঞ্জস্য রাখে, যদিও এর পাপের ক্ষেত্রে কমবেশি হয়ে থাকে।
মহান আল্লাহ বলেছেন, وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُضِلَّ قَوْمًا بَعْدَ إِذْ هَدَاهُمْ حَتَّىٰ يُبَيِّنَ لَهُمْ مَا يَتَّقُونَ “আর আল্লাহ এরূপ নন যে, কোনো জাতিকে সুপথপ্রাপ্ত করার পর পথভ্রষ্ট করেন, যে পর্যন্ত না তাদেরকে সেই সব বিষয় পরিষ্কারভাবে বলে দেন, যে বিষয়ে তারা তাকওয়া অবলম্বন করবে।” [৮]
ইতঃপূর্বে উল্লিখিত আয়াতসমূহের দ্বারা দলিল গ্রহণ করা সুসাব্যস্ত হয়েছে। আর সেসব দলিলেও রয়েছে তাক্বলীদ বাতিল হওয়ার প্রমাণ। আমাদের উল্লিখিত দলিলসমূহের মাধ্যমে যখন তাক্বলীদ বাতিল প্রমাণিত হলো, তখন (শরিয়তের) মূল উৎসের সামনে নত হয়ে যাওয়া আবশ্যক হয়ে গেল, আর তা হলো কিতাব, সুন্নাহ এবং এতদুভয়ের স্থলাভিষিক্ত বিষয়, যা কুরআন-সুন্নাহর সমন্বিত দলিল থেকে প্রমাণিত।
এরপর ইবনু ‘আব্দিল বার্র (রাহিমাহুল্লাহ) ‘আলিমের ভুল ও পদস্খলনের ব্যাপারে কিছু মারফূ‘ ও অন্যান্য হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, “যেহেতু বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত হলো যে, ‘আলিমের ভুল ও পদস্খলন ঘটে, সেহেতু কারও জন্য এমন কথা বলে ফতোয়া দেওয়া জায়েজ নয়, যে কথার দলিল জানা যায় না।” তারপর তিনি তাক্বলীদের নিন্দার ব্যাপারে ‘উলামাদের বক্তব্য উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন, “এগুলোর সবই তাক্বলীদকে নাকচ করে এবং তাকে বাতিল বলে প্রমাণ করে; আর তা তার জন্য, যে বোধসম্পন্ন এবং সত্যকে মেনে হয়েছে হেদায়েতপ্রাপ্ত।”
তারপর তিনি বলেছেন, “এসব কথা তাদের জন্য, যারা আওয়াম (সাধারণ জনগণ) নয়। পক্ষান্তরে সাধারণ জনগণকে অবশ্যই (বিভিন্ন) দুর্যোগকালীন বিষয়ে ‘উলামাদের তাক্বলীদ করতে হবে। কেননা এসব ক্ষেত্রে দলিলমাফিক অবস্থান সুস্পষ্ট হয় না, এবং (দলিল) না বোঝার কারণে উক্ত অবস্থানে পৌঁছাও যায় না। কেননা ‘ইলমের অনেক স্তর রয়েছে, যার সর্বনিম্ন স্তর অর্জন না করে তার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছা যায় না। এটাই সাধারণ জনগণ এবং দলিল অন্বেষণকারীর মধ্যে পার্থক্য। আর আল্লাহই সর্বাধিক অবগত।”
‘উলামাদের মধ্যে এ ব্যাপারে কোনো মতদ্বৈধতা নেই যে, সাধারণ জনগণের জন্য ‘উলামাদের তাক্বলীদ করা আবশ্যক। তাদের উদ্দেশেই মহান আল্লাহ বলেছেন, فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ “তোমরা যদি না জান, তাহলে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস করো।” [৯]
তাঁরা এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন যে, অন্ধ ব্যক্তি যখন সঠিক রাস্তা নির্ণয় করতে অসামর্থ্য হবে, তখন তাকে অবশ্যই বিশ্বস্ত এবং দিক নির্ণয়ে সক্ষম এমন কারও তাক্বলীদ করতে হবে। একইভাবে যে ব্যক্তির ‘ইলম নেই, দ্বীনের ব্যাপারে জ্ঞান নেই, তাকে অবশ্যই কোনো (নির্ভরযোগ্য) ‘আলিমের তাক্বলীদ করতে হবে। অনুরূপভাবে এ ব্যাপারেও কোনো মতদ্বন্দ্ব নেই যে, সাধারণ জনগণের জন্য ফতোয়া প্রদান করা না-জায়েজ; আর তা না-জায়েজ—আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন—শরিয়তের মর্মার্থের ব্যাপারে তাদের অজ্ঞতার কারণে। যেই মর্মার্থ জানার কারণে বৈধ হয় (কারও জন্য) হালাল-হারামের বিষয়ে ফতোয়া দেওয়া এবং শার‘ঈ ‘ইলমের ব্যাপারে মন্তব্য করা। [১০]❞
·
পাদটীকা:
▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂
[১]. সূরাহ ইউসুফ: ৭৬।
[২]. ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ, খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ২০৪; অনুরূপ কথা দ্রষ্টব্য: খণ্ড: ১৯; পৃষ্ঠা: ২৬৩; খণ্ড: ২৮; পৃষ্ঠা: ৩৮৮।
[৩]. সূরাহ নাহল: ৪৩; সূরাহ আম্বিয়া: ৭।
[৪]. জামি‘উ বায়ানিল ‘ইলম, খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৯৯৩।
[৫]. ই‘লামুল মুওয়াক্বক্বি‘ঈন, খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৪৪৭; মাজমূ‘উ ফাতাওয়া লি শাইখিল ইসলাম, খণ্ড: ২০; পৃষ্ঠা: ১৫-১৬।
[৬]. সূরাহ তাওবাহ: ৩১।
[৭]. তিরমিযী, হা/৩০৯৫; সুনানে বাইহাক্বী, খণ্ড: ১০; পৃষ্ঠা: ১১৬; ইমাম খত্বীব বাগদাদী, আল-ফাক্বীহ ওয়াল মুতাফাক্বক্বিহ; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৬৬; সনদ: সাহীহ।
[৮]. সূরাহ তাওবাহ: ১১৫।
[৯]. সূরাহ নাহল: ৪৩; সূরাহ আম্বিয়া: ৭।
[১০]. জামি‘উ বায়ানিল ‘ইলমি ওয়া ফাদ্বলিহী, খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৯৭৫-৯৮৯; অনুরূপ আলোচনা দ্রষ্টব্য: আল-ফাক্বীহ ওয়াল মুতাফাক্বক্বিহ, খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৬৮; ই‘লামুল মুওয়াক্বক্বি‘ঈন, খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৪৪৭।
·
তথ্যসূত্র:
‘আল্লামাহ ওয়াসিউল্লাহ ‘আব্বাস (হাফিযাহুল্লাহ), আত-তাক্বলীদ ওয়া হুকমুহু ফী দ্বাওইল কিতাবি ওয়াস সুন্নাতি ওয়াল আসারিস সালাফিয়্যাহ; পৃষ্ঠা: ৩৮-৪৩; দারুল ইস্তিক্বামাহ, কায়রো কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪৩১ হি./২০১০ খ্রি. (১ম প্রকাশ)।
·
অনুবাদক: মুহাম্মাদ ‘আব্দুল্লাহ মৃধা

No comments:

Post a Comment

Download AsPDF

Print Friendly and PDFPrint Friendly and PDFPrint Friendly and PDF
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...