Wednesday 15 January 2020

বর্তমান নারীদের ব্যাপারে ইমাম আলবানীর গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়ন ও উপদেশ


·
বিগত শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] প্রদত্ত ফতোয়া—
.
প্রশ্নকারী: “হে আমাদের শাইখ, আমরা শুনেছি যে কতিপয় নারী যারা কিছু ইউনিভার্সিটি, স্কুল, এবং কলেজে (অধ্যয়নরত) রয়েছে এবং কিছু নারী বক্তৃতা প্রদান করে, দারস দেয়, এমনকি কুরআন তিলাওয়াত করে, বিশেষ করে সকালবেলার বেতারে (রেডিয়ো বা টিভিতে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানে)। এই নারীদের স্বামীরা কখনো তাদের উপভোগ করতে পারে না। কারণ তারা মুতারাজ্জিলাত (পুরুষসুলভ)। প্রশ্নের এই প্রসঙ্গে আপনার কাছ থেকে আমরা স্পষ্টকরণ আশা করছি।”
.
আল-আলবানী: “এই বিষয়ের সাথে জড়িত মৌলিক কারণ হলো ত্রুটিপূর্ণ তারবিয়্যাহ (প্রতিপালন)। ত্রুটিপূর্ণ তারবিয়্যাহর কারণ হলো সামাজিক অবক্ষয় এবং পাঠ্যক্রমের অবক্ষয়, যার ওপর পুরুষ ও নারী অথবা তরুণ ও তরুণীদের শিক্ষাচর্চা ভিত্তিশীল হয়। এর কারণ—আমি প্রায় নিশ্চিত যে, স্কুলগুলোর ছাত্রীরা নাবী ﷺ এর এমন কথা শোনেনি, “পুরুষসুলভ নারীদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ।” [১] একইভাবে অন্য হাদীসটি, যেটি আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) এই বলে বর্ণনা করেছেন, لَعَنَ رَسُولُ اللهِ ﷺ المُتَشَبِّهِينَ مِنَ الرِّجَالِ بِالنِّسَاءِ، وَالمُتَشَبِّهَاتِ مِنَ النِّسَاءِ بِالرِّجَالِ “আল্লাহর রাসূল ﷺ নারীদের সাদৃশ্যতা অবলম্বনকারী পুরুষদের এবং পুরুষদের সাদৃশ্যতা অবলম্বনকারী নারীদের অভিসম্পাত করেছেন।” [২]
.
আমি বিশ্বাস করি, ছাত্রীদের—যারা হাইস্কুল বা এর চেয়ে উচ্চস্তরের প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে গ্র্যাজুয়েট করে—কর্ণদ্বয় দিয়ে এ ধরনের হাদীস অতিক্রম করেনি। আর যদি এ দুটি হাদীসের কোনোটি তাদের কর্ণদ্বয় অতিক্রম করেও থাকে, তাহলে তা এক কান দিয়ে প্রবেশ করে আরেক কান দিয়ে বের হয়ে গিয়েছে। কারণ যে ধরনের পাঠ্যক্রম তাদের শেখানো হয় বা তাদের যে ধরনের শিক্ষাদান করা হয়, তার ভিত্তিতে শিক্ষককে এসব বিষয় পড়ানোর অনুমোদন দেওয়া হয় না; এমনকি যদি সে দ্বীনদারও হয়ে থাকে।

.
শরিয়তের ব্যাপারে এটা জ্ঞাত যে—এবং এর (শরিয়তের) ব্যাপারে যারা জ্ঞানী তাদের মতানুযায়ী—একজন পুরুষের ব্যাপারে মৌলিক বিধান হলো, সে তার পরিবার ও বাচ্চাদের স্বার্থে বাড়ির বাইরে যাবে (কাজ করতে)। অন্যদিকে, একজন মহিলার ব্যাপারে মৌলিক বিধান হলো—সে তার বাড়িতে আশ্রিত থাকবে এবং সে বাড়ির বাইরে যাবে না, যেটি হলো আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলার কথা অনুযায়ী আমল। মহান আল্লাহ বলেছেন, وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَىٰ “তোমরা তোমাদের গৃহের অভ্যন্তরে অবস্থান করো, আর প্রাক-জাহিলী যুগের মতো নিজেদের (সৌন্দর্য) প্রদর্শন করে বেড়িও না।” [৩]
.
সুতরাং, একজন নারী যখন সকালে বাইরে যাওয়ার মাধ্যমে এবং সন্ধ্যায় বাড়িতে ফেরার মাধ্যমে পুরুষের অনুরূপ হতে গেল, তখন সে পুরুষের মতো হয়ে গেল; সে তা জানুক আর না জানুক, সে তা উপলব্ধি করুক বা না করুক। এই কারণে, এই পরবর্তী সময়ে আমরা এমন তরুণী কুমারী মেয়েদের আর দেখি না, যারা তাদের দৃষ্টি একজন পুরুষের ওপর পতিত হতে দেওয়ার ব্যাপারে লজ্জাশীলা, আর তার ভদ্রতার তীব্রতার কারণে, সে হাঁটার সময় তার দৃষ্টি জমিনের ওপর রাখে, স্বীয় পদচিহ্ন দেখার জন্য। আমরা এমন তরুণীদের আর দেখি না। অথচ জাহিলী যুগেও এমন তরুণীদের সহজেই পাওয়া যেত; প্রাচীন, সমুজ্জ্বল ও বিশুদ্ধ ইসলামের যুগের কথা না-ই বা উল্লেখ করলাম।
.
এর সূত্র ধরেই সাহীহ হাদিসে নাবী ﷺ এর বিবরণস্বরূপ উল্লিখিত হয়েছে যে, كانَ النبيُّ َﷺ أشَدَّ حَيَاءً مِنَ العَذْرَاءِ في خِدْرِهَا “তিনি ﷺ গৃহ অভ্যন্তরীণ কুমারী মেয়ের চেয়েও লজ্জাশীল ছিলেন।” [৪]
.
এই কুমারী মেয়ে, লজ্জার দিক দিয়ে যার সাথে মানবকূলের সর্দারের ﷺ তুলনা করা হয়েছে, তার (মতো কারও) ব্যাপারে বর্তমান সময়ে আমরা আর শুনি না। এর কারণ হলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষদের সাদৃশ্যতা অবলম্বন করে। কোনো সন্দেহ নেই যে, এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। এই কারণগুলোর অন্যতম হলো অনেক ইসলামী দেশে কাফির সরকারগুলোর শাসন। যার কারণে তাদের (কাফিরদের) স্বভাব, ঐতিহ্য, রুচি, এবং তাদের আদব-আখলাক, যা কিনা ফিতরতের বিরোধী, তা সেসব দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। সুতরাং মানব প্রজন্মগুলো সেগুলো গ্রহণ করে নিয়েছে এবং পুরুষ ও নারী প্রফেসররা—যারা তরুণ-তরুণীদের পথপ্রদর্শনের দাবি করে—সেগুলো গ্রহণ করেছে।
.
এ সকল লোকেরা তরুণ ও তরুণীদের আসন্ন প্রজন্মগুলোর মধ্যে এমন কিছু ছড়িয়েছে যাকে তারা বলে নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতা। সুতরাং এটি হলো নারীদের মধ্যে অতি অল্প ভদ্রতার কারণগুলোর একটি, যা তাদের অনেককে পুরুষসুলভ বানিয়ে ফেলেছে। যার মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই তা হলো—নারীর পুরুষসুলভ হওয়াটা তার স্বামীর সামনে তাকে ধৃষ্টতাপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী করে। হয়তো সে তার সাথে আওয়াজ উঁচু করবে, অথবা তার স্বামীর বা তার নিজের কতক আত্মীয়ের সামনে তাকে (স্বামীকে) অপমানিত করবে, তার স্বামীর ওপর নিজের (কল্পিত) শ্রেষ্ঠত্বের কারণে।
.
এই বিষয়টি কীরূপ হয়, যদি নারীদের ব্যাপারে পুরুষদেরকে দেওয়া রাসূল ﷺ এর বিদায়ী নসিহতের সাথে এটাকে তুলনা করা হয়? এটি (নারীদের ব্যাপারে পুরুষদেরকে দেওয়া রাসূল ﷺ এর উপদেশ) তাঁর ﷺ কথায় এমন যুক্তি দ্বারা প্রতিপাদিত হয়েছে, যা বর্তমানে আমরা যেই তারবিয়্যাহ দেখতে পাই তার সম্পূর্ণ বিপরীত। এটি হলো তাঁর ﷺ কথা, اسْتَوصُوا بالنِّساءِ خَيْراً، فَإِنَّمَا هُنَّ عَوَانٍ عِنْدَكُمْ “তোমরা নারীদের ব্যাপারে আমার এই উপদেশ গ্রহণ করো যে, তোমরা তাদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করবে। কেননা তারা তো তোমাদের হাতে বন্দি।” [৫]
.
এখানে উল্লেখ্য বিষয়টি হলো—রাসূল যখন এই হাদিসে নারীদের প্রতি উত্তম আচরণের আদেশ দিয়েছেন, তখন তিনি তাঁর কথার পক্ষে যুক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন যে, “কেননা তারা তো তোমাদের হাতে বন্দি।”
.
অর্থাৎ, তারা হলো দাসীর মতো। দাসী তার মালিকের সাথে কিছু করতে পারেনা। অনুরূপভাবে, একজন মুসলিম নারী যে নিজেকে সঠিক ইসলামী আদবের সাথে সজ্জিত করে, তার স্বামীর সামনে সে হলো একজন দাসীর মতো। এর কারণে, তিনি ﷺ ভয় করেছিলেন যে পুরুষরা নারীদের ব্যাপারে অতিরঞ্জন করবে এবং তাদের ওপর (অন্যায়ভাবে) কর্তৃত্ব খাটাবে, জবরদস্তি করবে, এবং তাদের ওপর জুলুম করবে। এজন্য তিনি নারীদের সাথে উত্তম আচরণের আদেশ করেছেন এবং এর পেছনে তিনি কারণ উল্লেখ করেছেন। সেটি হলো, “কেননা তারা তো তোমাদের হাতে বন্দি।”
.
বর্তমানে নারীরা এমন হয়ে গিয়েছে যে তাদের (সাথে উত্তম আচরণ করার) ব্যাপারে পুরুষদের আর নসিহতের প্রয়োজন নেই। বরং, বিষয়টি পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে এবং এমন হয়েছে যে, পুরুষদের সাথে উত্তম আচরণ করার ব্যাপারে নারীদের নসিহতের প্রয়োজন। কারণ তাদের নিজেদের চাকরি ও স্বাধীনতার ক্ষেত্রে তারা মুক্ত। প্রায়ই তাদের কতককে আমরা বলতে শুনি, “আমার এবং আমার স্বামীর মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। সে একজন বৈবাহিক সঙ্গী, আমিও একজন বৈবাহিক সঙ্গী। সে একজন জীবনসঙ্গী, আমিও একজন জীবনসঙ্গী।”
.
অতএব, দ্বীনের সাথে জুড়ে থাকে এমন মুসলিম নারীদের ওপর জরুরি হলো, তারা যদি এমন সমাজের সাথে মেলামেশায় জড়িয়ে পড়ে, এসব কলুষতার যে কোনো কিছু থেকে তারা নিজেদেরকে প্রভাবমুক্ত রাখার চেষ্টা করবে। এটি হলো একটি নসিহত, এবং নসিহত মুমিনকে উপকৃত করে। আসসালামু ‘আলাইকুম।”
.
প্রশ্নকারী: “আল্লাহ আপনাকে উত্তম বিনিময় দান করুন, ইয়া শাইখ। ওয়া ‘আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।”
·
পাদটীকা:
▂▂▂▂▂▂▂▂▂▂
[১]. সাহীহুল জামি‘, হা/৫০৯৬; মিশকাতুল মাসাবীহ, হা/৪৪৭০; সনদ: সাহীহ (তাহক্বীক্ব: আলবানী)।
[২]. সাহীহ বুখারী, হা/৫৮৮৫।
[৩]. সূরাহ আহযাব: ৩৩।
[৪]. সাহীহ বুখারী, হা/৩৫৬২।
[৫]. তিরমিযী, হা/১১৬৩; ইবনু মাজাহ, হা/১৮৫১; সনদ: হাসান (তাহক্বীক্ব: আলবানী); শব্দগুচ্ছ তিরমিযীর।
·
তথ্যসূত্র:
·
অনুবাদক: রিফাত রাহমান সিয়াম
সম্পাদক: মুহাম্মাদ 'আব্দুল্লাহ মৃধা

No comments:

Post a Comment

Download AsPDF

Print Friendly and PDFPrint Friendly and PDFPrint Friendly and PDF
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...