Wednesday 5 November 2014

কবর যিয়ারতের বৈধতা ও অবৈধতা প্রসঙ্গে



রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
« إِنِّي كنت نَهَيْتُكُمْ عَنْ زِيَارَةِ الْقُبُورِ فَزُورُوهَا » . (أخرجه مسلم) .
“আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করা থেকে নিষেধ করেছিলাম, সুতরাং তোমরা তা যিয়ারত কর।”[51] 
এই হাদিসটি ‘মাসাবীহ’ (المصابيح) গ্রন্থের বিশুদ্ধ হাদিসসমূহের অন্তর্ভুক্ত, যা বুরাইদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেছেন; তাতে ইসলামের প্রথম দিকে কবর যিয়ারত করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা থাকার বিষয়টির সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে, কারণ এ কবরগুলোই ছিল মূর্তিপূজার উৎপত্তিস্থল বা সূচনা; আর এই কঠিন ব্যাধির সূচনা হয়েছিল নবী নূহ আ. এর জাতির মধ্যে; যেমন আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবে বলেছেন:
﴿ قَالَ نُوحٞ رَّبِّ إِنَّهُمۡ عَصَوۡنِي وَٱتَّبَعُواْ مَن لَّمۡ يَزِدۡهُ مَالُهُۥ وَوَلَدُهُۥٓ إِلَّا خَسَارٗا ٢١ وَمَكَرُواْ مَكۡرٗا كُبَّارٗا ٢٢ وَقَالُواْ لَا تَذَرُنَّ ءَالِهَتَكُمۡ وَلَا تَذَرُنَّ وَدّٗا وَلَا سُوَاعٗا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسۡرٗا ٢٣ ﴾ [نوح: ٢١،  ٢٣]                   
“নূহ্ বলেছিলেন, ‘হে আমার রব! আমার সম্প্রদায় তো আমাকে অমান্য করেছে এবং অনুসরণ করেছে এমন লোকের, যার ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তার ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করেনি; আর তারা ভয়ানক ষড়যন্ত্র করেছে এবং বলেছে, ‘তোমরা কখনো পরিত্যাগ করো না তোমাদের উপাস্যদেরকে; পরিত্যাগ করো না ওয়াদ্, সুওয়া‘আ, ইয়াগূছ, ইয়া‘ঊক ও নাসরকে।”[52] 
আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রা. ও অন্যান্য সালাফে সালেহীন তথা সত্যনিষ্ঠ আলেমগণ বলেন: “আয়াতে উল্লেখিত ঐসব ব্যক্তিবর্গ ছিলেন নবী নূহ আ. -এর জাতির মধ্যকার সৎ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত; যখন তাঁরা মারা গেলেন, তখন জনগণ তাঁদের সমাধিস্থলে অবস্থান করতে লাগল, অতঃপর তারা তাঁদের প্রতিমূর্তি বানাল, অতঃপর তাদের এই অবস্থার উপর দিয়ে দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হল, অতঃপর তারা তাঁদের উপাসনা করা শুরু করল।”[53]

কবর যিয়ারতের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা, অতঃপর অনুমতি প্রদান

সুতরাং যেহেতু সাব্যস্ত হলো যে, মূর্তিপূজার উৎপত্তি হয়েছিল কবর থেকে, সেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শির্কের পথ বন্ধ করার জন্য তাঁর সাহাবীদেরকে ইসলামের প্রথম দিকে কবর যিয়ারত করা থেকে নিষেধ করেছিলেন, কারণ তাঁরা ছিলেন নওমুসলিম বা কুফরী যুগের কাছাকাছি সময়ের মানুষ; তারপর যখন তাঁদের হৃদয়ে তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদের শিক্ষা বদ্ধমূল হয়ে যায়, তখন তিনি তাঁদেরকে পুনরায় কবর যিয়ারতের অনুমতি প্রদান করেন এবং তাঁদেরকে কবর যিয়ারতের পদ্ধতি শিক্ষা দেন, কখনও তাঁর কর্মের মাধ্যমে, আবার কখনও তাঁর কথার মাধ্যমে; আর এই বিষয়টি অনকেগুলো হাদিসের মধ্যে রয়েছে। তন্মধ্যে কিছু সংখ্যক হাদিস এসেছে অনুমতি প্রদান প্রসঙ্গে, আর কিছু সংখ্যক হাদিস এসেছে (কবর যিয়ারত) পদ্ধতি শিক্ষা দান প্রসঙ্গে; আর তার অভ্যন্তরে স্থান পেয়েছে ফায়দা বা উপকারিতার বর্ণনা।
কবর যিয়ারতের অনুমতি প্রদান প্রসঙ্গে যেসব হাদিস এসেছে তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে,
১- আবূ সুফিয়ান রা. থেকে বর্ণিত; নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
« إِنِّي كنت نَهَيْتُكُمْ عَنْ زِيَارَةِ الْقُبُورِ فَزُورُوهَا فَإِنَّ فِيهَا عِبْرَةً » (أخرجـــه الطبراني) .
“আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করা থেকে নিষেধ করেছিলাম, সুতরাং তোমরা তা যিয়ারত কর; কারণ, তাতে শিক্ষা বা উপদেশ রয়েছে।”[54]
২- অনুরূপভাবে আলী ইবন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
« إِنِّي كنت نَهَيْتُكُمْ عَنْ زِيَارَةِ الْقُبُورِ فَزُورُوهَا فَإِنَّها تذكركم بالآخرة » (أخرجه أحمد) .
“আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করা থেকে নিষেধ করেছিলাম, সুতরাং তোমরা তা যিয়ারত কর; কারণ, তা তোমাদেরকে আখিরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে।”[55]
৩- আর এই প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ ইবন মাস‘উদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকেও বর্ণিত আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
« إِنِّي كنت نَهَيْتُكُمْ عَنْ زِيَارَةِ الْقُبُورِ فَزُورُوهَا فَإِنَّها تزهد في الدنيا» (أخرجه ابن ماجه) .
“আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করা থেকে নিষেধ করেছিলাম, সুতরাং তোমরা তা যিয়ারত কর; কারণ, তা দুনিয়ার মোহ ত্যাগে অনুপ্রাণিত করবে।”[56]
৪- অনুরূপভাবে এ প্রসঙ্গে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকেও বর্ণিত আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
« زُورُوا الْقُبُور فَإِنَّها تذكركم الموت » . (أخرجه ابن ماجه) .
“তোমরা কবর যিয়ারত কর; কেননা তা মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।”[57]
৫- তদ্রূপ এ প্রসঙ্গে বুরাইদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকেও বর্ণিত আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
« كنت نهيتكم عن زيارة القبور فمن أراد أن يزور فليزر ولا تقولوا هجرا » . (أخرجه النسائي) .
“আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করা থেকে নিষেধ করেছিলাম, সুতরাং যে ব্যক্তি (বর্তমানে) কবর যিয়ারত করতে চায়, সে যেন যিয়ারত করে এবং তোমরা বাজে-অশ্লিল কথা বলবে না।”[58]

কবরস্থানে প্রবেশের দো‘আ

আর যেসব হাদিস কবর যিয়ারতের নিয়ম শিক্ষা দান প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে, তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে,
১- বুরাইদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন:
« كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يُعَلِّمُهُمْ إِذَا خَرَجُوا إِلَى الْمَقَابِرِ أن يَقُولُوا السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ يا أَهْلَ الدِّيَارِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُسْلِمِينَ وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللَّهُ بكم لاَحِقُونَ أنتم لنا سلف ونحن لكم تبع نسْأَلُ اللَّهَ لَنَا وَلَكُمُ الْعَافِيَةَ. » . (أخرجه مسلم و  النسائي و ابن ماجه و أحمد) .
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে শিক্ষা দিতেন, তারা যখন সমাধিস্থলের দিকে বের হবে, তখন তারা যেন বলে:
«السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ يا أَهْلَ الدِّيَارِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُسْلِمِينَ وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللَّهُ بكم لاَحِقُونَ أنتم لنا سلف ونحن لكم تبع نسْأَلُ اللَّهَ لَنَا وَلَكُمُ الْعَافِيَةَ»
(তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হউক হে কবরবাসী মুমিন ও মুসলিমগণ! আল্লাহর ইচ্ছায় অবশ্যই আমরাও তোমাদের সাথে মিলিত হব; তোমরা আমাদের অগ্রগামী, আর আমরা তোমাদের অনুগামী; আমরা আল্লাহর নিকট আমাদের ও তোমাদের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি)।”[59]
২- অনুরূপভাবে উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকেও বর্ণিত আছে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্নের ভাষায় বলেন:
« كَيْفَ أَقُولُ لَهُمْ يَا رَسُولَ اللَّهِ في زيارة القبور؟ قَالَ: « قُولِى السَّلاَمُ عَلَى أَهْلِ الدِّيَارِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُسْلِمِينَ وَيَرْحَمُ اللَّهُ الْمُسْتَقْدِمِينَ مِنَّا و منكم وَالْمُسْتَأْخِرِينَ وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللَّهُ بِكُمْ لَلاَحِقُونَ» . (أخرجه مسلم و  النسائي).
“হে আল্লাহর রাসূল! কবর যিয়ারতের ক্ষেত্রে আমি তাদের উদ্দেশ্য কী বলব? জবাবে তিনি বললেন: তুমি বল:
 « السَّلاَمُ عَلَى أَهْلِ الدِّيَارِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُسْلِمِينَ وَيَرْحَمُ اللَّهُ الْمُسْتَقْدِمِينَ مِنَّا و منكم وَالْمُسْتَأْخِرِينَ وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللَّهُ بِكُمْ لَلاَحِقُونَ»
(কবরবাসী মুমিন ও মুসলিমগণের প্রতি সালাম; আল্লাহ আমাদের ও তোমাদের মধ্য থেকে অগ্রগামী ও পশ্চাতগামী সকলের প্রতি দয়া করুন; আমরাও আল্লাহর ইচ্ছায় অবশ্যই তোমাদের সাথে মিলিত হব)।”[60]
৩- তদ্রুপ আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকেও বর্ণিত আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরস্থানের উদ্দেশ্যে বের হলেন, অতঃপর তিনি বললেন:
«السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ دَارَ قَوْمٍ مُؤْمِنِينَ وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللَّهُ بِكُمْ لاَحِقُونَ وَدِدْتُ أَنَّا قَدْ رَأَيْنَا إِخْوَانَنَا ». (أخرجه مسلم) .
“তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হউক; এটা মুমিনদের ঘর; ইনশা আল্লাহ আমরাও এসে তোমাদের সাথে মিলব; আমার বড় ইচ্ছা হয়, আমরা আমাদের ভাইদেরকে দেখি।”[61]
৪- আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকেও বর্ণিত আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার কবরসমূহের পাশ দিয়ে পথ অতিক্রম করেন, অতঃপর তিনি কবরবাসীর নিকট গিয়ে দাঁড়ালেন এবং বললেন:
« السلام عليكم يا أهل القبور ! يغفر الله لنا ولكم أنتم سلفنا ونحن بالأثر». (أخرجه الترمذي) .
“হে কবরবাসী! তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হউক; আল্লাহ আমাদেরকে ও তোমাদেরকে ক্ষমা করুন; তোমরা আমাদের অগ্রগামী, আর আমরাও তোমাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করছি।”[62]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসব হাদিসে কবর যিয়ারতের উপকারিতা বর্ণনা করেছেন; আর তা হল কবর যিয়ারতকারী ব্যক্তি কর্তৃক নিজের প্রতি ও কবরবাসীদের প্রতি ইহসান করা; আর তার নিজের প্রতি ইহসান মানে হল, মৃত্যু ও আখিরাতের কথা স্মরণ করা, দুনিয়া বিমূখ হওয়া এবং উপদেশ ও শিক্ষা গ্রহণ করা; আর কবরবাসীদের প্রতি তার ইহসান করার মানে হল, তাদের প্রতি সালাম দেওয়া, তাদের জন্য রহমত ও ক্ষমার আবেদন করা এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা। 
সকল আলেম বলেন: যিয়ারতের এই বিষয়টি পূরুষ ব্যক্তিদের বেলায় প্রযোজ্য।

নারীগণ কর্তৃক কবর যিয়ারত করার বিধান

আর নারীদের জন্য সমাধিস্থলের উদ্দেশ্যে বের হওয়া বৈধ নয়; কেননা আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বললেন:
« لعن رسول الله صلى الله عليه و سلم زوارات القبور ». (أخرجه ابن ماجه) .
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর যিয়ারতকারিনী নারীদের প্রতি লানত করেছেন।”[63] 
আর ‘নিসাবুল ইহতিসাব’ (نصاب الاحتساب) নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, নারী কর্তৃক সমাধিস্থলের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার বৈধতা সম্পর্কে বিচারককে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন: এ ধরনের কাজের বৈধতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করো না, বরং সে কী পরিমাণ লা‘নতের (অভিশাপের) উপযুক্ত হবে, সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা কর; কারণ, সে যখন সমাধিস্থলের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার নিয়ত করে, তখন সে আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর ফেরেশতাদের লা‘নতের উপযুক্ত হয়ে যায়; আর যখন বের হবে, তখন শয়তান তার সাথে শামিল হয়; আর যখন সমাধিস্থলে উপস্থিত হয়, তখন মৃত ব্যক্তির আত্মা তাকে অভিশাপ দেয়; আর যখন সে প্রত্যাবর্তন করে, তখন সে আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর ফেরেশতাদের লা‘নতের মধ্যে থাকে যতক্ষণ না সে তার গৃহের মধ্যে ফিরে আসে।
কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে,
« أيما امرأة خرجت إلى مقبرة يلعنها ملائكة السموات السبع و الأرضين السبع و أيما امرأة دعت للميت بخيىر و لم تخرج من بيتها يعطيها الله ثواب حجة و عمرة ».                                       
“যে কোন নারী সমাধিস্থলের উদ্দেশ্যে বের হয়, তাকে সাত আসমান ও সাত যমীনের ফিরিশতাগণ লা‘নত করতে থাকে; আর যে নারী মৃত ব্যক্তির জন্য কল্যাণের দো‘আ করে এমতাবস্থায় যে, সে তার ঘর থেকে বের হয় না, তাকে আল্লাহ তা‘আলা হাজ্জ ও ওমরার সাওয়াব দান করবেন।”[64]
আর সালমান ও আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত আছে: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন একদিন মসজিদ থেকে বের হলেন, অতঃপর তিনি তাঁর বাড়ির দরজায় দাঁড়ালেন, অতঃপর তাঁর কন্যা ফাতিমা রা. আসলেন, তারপর তিনি তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন:
« من أين جئت ؟ فقالت: خرجت إلى منزل فلانة التي ماتت . فقال: هل ذهبت إلى قبرها ؟ فقالت: معاذ الله أن أفعل شيئا بعدما سمعت منك ما سمعت . فقال: لو ذهبت إلى قبرها لم ترحي رائحة الجنة » .                    
“তুমি কোথা থেকে এসেছ? জবাবে তিনি বলেন: আমি অমুকের বাসায় গিয়েছি, যে মারা গিয়েছে; অতঃপর তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন: তুমি কি তার সমাধিস্থল পর্যন্ত গিয়েছ? জবাবে তিনি বলেন: আমি আপনার নিকট থেকে যা শুনার, তা শুনার পরেও এমন কিছু করা থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই (না‘উযুবিল্লাহ); তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: তুমি যদি তার সমাধিস্থল পর্যন্ত যেতে, তাহলে জান্নাতের ঘ্রাণও পেতে না।”[65]

কবরবাসীদের অবস্থা থেকে শিক্ষা গ্রহণ

সুতরাং এর উপর ভিত্তি করে বলা যায়, পুরুষ ব্যক্তিদের মধ্য থেকে প্রত্যেক এমন ব্যক্তি, যে কবর যিয়ারত করার ইচ্ছা পোষণ করবে, তার যিয়ারতের অংশটুকু যাতে চতুষ্পদ যন্তুর প্রদক্ষিণের মত না হয়, বরং সে যখন কবরের নিকট আসবে, তখন তার জন্য উচিত কাজ হল কবরবাসীদের উপর সালাম পেশ করা এবং তাদেরকে উপস্থিত ব্যক্তিদের মত করে সম্বোধন করা; আর তাদের জন্য রহমত ও ক্ষমা প্রার্থনা করা, যেমনটি পূর্বে উল্লেখিত হাদিসসমূহের মধ্যে বর্ণিত হয়েছে। অতঃপর যিয়ারতকারী ব্যক্তি যারা মাটির নীচে চলে গেছে এবং পরিবার-পরিজন ও প্রিয় ব্যক্তিদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে তাদের অবস্থা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে; আর মৃত ব্যক্তি যখন কবরে প্রবেশ করেছে, তখন প্রশ্নের মাধ্যমে পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছে: সে কি সঠিকভাবে সেগুলোর জবাব দিতে পেরেছে এবং তার কবর কি জান্নাতের বাগানসমূহের মধ্য থেকে একটি বাগানে পরিণত হয়েছে? নাকি সে জবাব দানে ভুল করেছে? আর তার কবর পরিণত হয়েছে জাহান্নামের গর্তসমূহের মধ্য থেকে কোন একটি গর্তে পরিণত হয়েছে!! অতঃপর সে নিজেকে নিয়ে ভাবতে শুরু করবে যে, সে যেন মারা গেছে, কবরে প্রবেশ করেছে এবং তার নিকট থেকে দূরে সরে গেছে তার সম্পদ, পরিবার-পরিজন, সন্তান-সন্ততি ও তার পরিচিত লোকজন; আর সে একাই অবশিষ্ট রয়ে গেছে; এখন সে প্রশ্নের সম্মুখীন হবে, সুতরাং সে কী জবাব দেবে? তার অবস্থা কী হবে? আর সে কবরস্থানে যতক্ষণ অবস্থান করে, ততক্ষণ এ ধরনের শিক্ষা নিয়ে ব্যস্ত থাকবে এবং এই ধরনের ভয়ঙ্কর বিষয়সমূহ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তার মাওলার (আল্লাহ তা‘আলা’র) সাথে সম্পর্ক রাখবে এবং তাঁর নিকট আশ্রয় গ্রহণ করবে।

কবরের নিকট কুরআন পাঠ করার বিধান

কবরস্থানে কুরআন পাঠ করাকে আলেমদের এক অংশ বৈধ বলেছেন; তবে অধিকাংশ আলেম তা করতে নিষেধ করেছেন। তারা বলেন: যিয়ারতকারীর জন্য আবশ্যক হলো শিক্ষা গ্রহণ নিয়ে ব্যস্ত থাকা; আর কুরআন পাঠ করার দ্বারা পাঠক পঠিত অংশের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে গবেষণা ও চিন্তাভাবনা করার প্রয়োজন অনুভব করে; আর শিক্ষা গ্রহণ ও চিন্তাভাবনা একই সময়ে একই মনে একত্রিত হতে পারে না।

কবরস্থানে কুরআন পাঠ বিষয়ে একটি সংশয় ও তার উত্তর

যদি কেউ বলে যে, আমি এক সময় শিক্ষা গ্রহণ করব আর অন্য সময় কুরআন পাঠ করব; আর যখন কুরআন পাঠ করা হবে, তখন রহমত নাযিল হয়, সুতরাং আশা করা যায় যে, ঐ রহমত থেকে কবরবাসীদের সাথে কিছু রহমত সম্পৃক্ত হবে, যা তাদেরকে উপকৃত করবে।’ তাহলে এর কয়েকটি জবাব হতে পারে:
প্রথমত: কুরআন পাঠ করা যদিও ইবাদত, কিন্তু যিয়ারতকারীর জন্য মৃত্যু, ফেরেশতাদ্বয়ের প্রশ্ন ও অন্যান্য বিষয়ে চিন্তাভাবনা ও শিক্ষা গ্রহণ নিয়ে ব্যস্ত থাকাও এক প্রকারের ইবাদত, যা পূর্বে আলোচনা হয়েছে; আর সময়টি শুধু এই ইবাদতের জন্যই উপযুক্ত ক্ষেত্র, সুতরাং সে এক ইবাদত থেকে অন্য ইবাদতে যাবে না, বিশেষ করে (নিজের জন্য ইবাদত বাদ দিয়ে) অন্যের (উপকারের) জন্য নয়।
দ্বিতীয়ত: সে যদি তার ঘরের মধ্যে কুরআন পাঠ করে এবং তার সাওয়াব তাদের প্রতি হাদিয়া হিসেবে প্রেরণ করে এইভাবে যে, সে তিলাওয়াত থেকে অবসর নেয়ার পর তার ভাষায় বলবে: হে আল্লাহ! আমার তিলাওয়াতের সাওয়াব কবরবাসীদের জন্য কবুল করে নাও, তাহলে তা তাদের নিকট পৌঁছে যাবে[66]। নিশ্চয়ই এটি দো‘আ যা তাদের নিকট সাওয়াবকে পৌঁছিয়ে দেবে; আর দো‘আ সর্বসম্মতিক্রমে পৌঁছে যায়; সুতরাং তাদের কবরের পাশে গিয়ে কুরআন পাঠের প্রয়োজন নেই।
তৃতীয়ত: তাদের কবরের নিকট তার কুরআন পাঠ করাটা তাদের কারও কারও আযাবের (শাস্তির) কারণ হতে পারে, কেননা যখনই এমন আয়াত অতিক্রম করবে, যা সে আমল করেনি, তখনই তাকে বলা হবে: তুমি কি তা পাঠ করনি?! তুমি কি তা শ্রবণ করনি, তাহলে কিভাবে তার বিপরীত কাজ করলে এবং তার উপর আমল করলে না? ফলে তার (আয়তের) প্রতি তার বিরুদ্ধাচরণের কারণে তাকে শাস্তি দেওয়া হবে।
চতুর্থত: তার (কুরআন পাঠের) সমর্থনে কোনো সুন্নাহ বা হাদিস বর্ণিত হয়নি; আর তা নিষিদ্ধ হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট। সুতরাং ব্যাপারটি যখন এ রকম, তখন যিয়ারতকারীদের জন্য উপযুক্ত কাজ হল, সুন্নাহ’র অনুসরণ করা এবং তাদের জন্য শরী‘আত যা অনুমোদন দিয়েছে, সেখানেই থেমে যাওয়া ও তার সীমা লঙ্ঘন না করা; যাতে তারা তাদের নিজেদের প্রতি এবং কবরবাসীদের প্রতি ইহসানকারী হতে পারে; কারণ-

কবর যিয়ারত দুই প্রকার: শরী‘আতসম্মত ও বিদ‘আত

কবর যিয়ারত দু’ প্রকার: শরী‘য়তসম্মত যিয়ারত এবং বিদ‘আত পন্থায় যিয়ারত। তন্মধ্যে শরী‘আত পন্থায় যিয়ারত হল, যে যিয়ারতের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুমতি প্রদান করেছেন; আর তার উদ্দেশ্য হল দু’টি: তন্মধ্যে একটি যিয়ারতকারীর সাথে সম্পর্কিত, আর তা হল, উপদেশ ও শিক্ষা গ্রহণ করা। আর দ্বিতীয়টি কবরবাসীদের সাথে সম্পর্কিত, আর তা হল, যিয়ারতকারী কর্তৃক তাদের প্রতি সালাম পেশ করা এবং তাদের জন্য দো‘আ করা।
আর বিদ‘আত পন্থায় যিয়ারত হল, কবরের নিকট সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে কবর যিয়ারত করা; আর তাকে প্রদক্ষিণ করা, চুম্বন করা, স্পর্শ করা, কবরের মাটি গাল ঘষা, তার মাটি গ্রহণ করা, কবরবাসীকে ডাকা, তাদের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করা; তাদের নিকট সাহায্য-সহযোগিতা, রিযিক, ক্ষমা, সন্তান, ঋণ পরিশোধ কামনা করা, দুঃখ-কষ্ট লাঘব আশা করা, দুশ্চিন্তামুক্ত হওয়ার আশা করা ইত্যাদি বিবিধ প্রয়োজন পূরণের জন্য সাহায্য চাওয়া, যা মূর্তিপূজারীরা তাদের মূর্তিদের নিকট চেয়ে থাকে। বস্তুত বিদ‘আতী, শির্কী এ যিয়ারতের ধারণা মূর্তিপূজারীদের নিকট থেকেই গ্রহণ করা হয়েছে; মুসলিম আলেমদের সর্বসম্মত মতে এসবের কোনো কিছুই শরী‘য়ত সম্মত নয়; কেননা জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলার রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবা, তাবে‘য়ীন ও দীনের সকল ইমামগণের মধ্য থেকে কেউ এ ধরনের কাজ করেননি।

শির্কের উপলক্ষসমূহ থেকে সাহাবীগণের বেঁচে থাকা

বরং সাহাবীগণ এর চেয়ে আরও অনেক তুচ্ছ বিষয়েরও জোর প্রতিবাদ করেছেন; যেমন, মা‘রুর ইবন সুয়াইদ থেকে বর্ণিত, ওমর রা. একদিন মক্কার রাস্তার মধ্যে ফজরের সালাত আদায় করেছেন, অতঃপর দেখলেন জনগণ কোনো এক জায়গায় যাচ্ছে; অতঃপর তিনি বললেন: এসব লোক কোথায় যাচ্ছে? তখন তাকে বলা হল: তারা এমন এক মসজিদে যাচ্ছে, যাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত আদায় করেছেন, সুতরাং তারও তাতে সালাত আদায় করবে; অতঃপর তিনি বললেন: তোমাদের পূর্ববর্তীগণ শুধু এ ধরনের আচরণের কারণেই ধ্বংস হয়েছে, তারা তাদের নবীদের নিদর্শনসমূহের অনুসরণ ও অনুকরণ করত এবং সেগুলোকে মন্দির ও গির্জার মত উপাসনালয় বলে গ্রহণ করত; এসব মসজিদের মধ্যে যাকে সালাতের সময় পেয়ে যাবে, সে যেন তাতে সালাত আদায় করে নেয়; আর যাকে ঐসব মসজিদের মধ্যে সালাতের সময় পায়নি, সে যেন স্বাভাবিক অবস্থা অব্যাহত রাখে এবং ঐসব স্থানে সালাত আদায়ের ইচ্ছা করে সেখানে না যায়।[67]
অনুরূপভাবে যখন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর নিকট সংবাদ পৌঁছল যে, লোকজন ঐ গাছটিকে (বরকত হিসেবে) গ্রহণ করছে, যার নীচে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীগণ থেকে বাই‘আত (শপথ) গ্রহণ করেছেন, তখন তিনি ঐ গাছের নিকট লোক পাঠালেন, অতঃপর তা কেটে ফেলা হয়।[68] যে গাছটির নীচে সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বাই‘আত গ্রহণ করেছিলেন এবং যার আলোচনা করে আল্লাহ তা‘আলা আল-কুরআনে বলেন:
﴿ لَّقَدۡ رَضِيَ ٱللَّهُ عَنِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ إِذۡ يُبَايِعُونَكَ تَحۡتَ ٱلشَّجَرَةِ ... ﴾ [الفتح: ١٨]
“(অবশ্যই আল্লাহ মুমিনগণের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন, যখন তারা গাছের নীচে আপনার কাছে বাই‘আত গ্রহণ করেছিল, ...।)”[69] 
যখন ওমর রা. উক্ত গাছটির সাথে এ আচরণ করেছিলেন, তখন অন্যান্য কিছু (যেখানে এ ধরনের অবৈধ যিয়ারত সংঘটিত হয়) তার বিধান কেমন হতে পারে?!
আর সালফে সালেহীন তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদকে নির্ভেজাল করেছেন এবং তার সীমানা সংরক্ষণ করেছেন, তাই ওয়ালিদ ইবন আবদিল মালেকের যামানা পর্যন্ত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হুজরাকে মসজিদ থেকে পৃথক রাখা হয়, তখন সাহাবী ও তাবে‘য়ীগণের মধ্য থেকে একজনও তাতে প্রবেশ করত না, না সালাত আদায় করার জন্য, না দো‘আর জন্য, না ইবাদত জাতীয় অন্য কিছুর জন্য, বরং তারা এসব কিছু মসজিদের ভিতরেই করতেন।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবরের নিকট সহাবীগণের সালাম ও দো‘আর ধরন

তাঁদের কেউ যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর সালাম পেশ করতেন এবং দো‘আ করার ইচ্ছা পোষণ করতেন, তখন তিনি কিবলামুখী হতেন এবং তাঁর পিঠকে কবরের দেওয়ালের দিকে করতেন, অতঃপর তিনি দো‘আ করতেন; আর এটা এমন পদ্ধতি, যার ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে কোন বিতর্ক নেই।
তাদের মাঝে মতবিরোধ তো কেবল রাসূলের উপর সালাম পেশ করার সময়ের অবস্থা নিয়ে। ইমাম আবূ হানিফা র. বলেন: সালাম দেওয়ার সময়ও কিবলামুখী হবে, কবরমুখী হবে না; আর অন্যরা বলেন: দো‘আর সময় কবরমুখী হবে না, বরং তারা বলেন: সে দো‘আর সময় কিবলামুখী হবে, কবরমুখী হবে না; যাতে করে কবরের নিকট কোনো দো‘আ না হয়; কারণ, দো‘আ হচ্ছে ইবাদত, যা মারফু‘ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত; নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
« إن الدعاء هو العبادة  » . (أخرجه أحمد وأبو داود والترمذي و ابن ماجه) .
“নিশ্চয় দো‘আ হচ্ছে ইবাদত।”[70]
আর সালাফে সালেহীন তথা সাহাবী ও তাবে‘য়ীগণ ইবাদতকে নির্ভেজালভাবে আল্লাহ তা‘আলার জন্য নির্ধারণ করেছেন এবং তারা ইবাদতের মধ্য থেকে কোন কিছুই কবরের নিকটে করেননি; তবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ব্যাপারে অনুমতি দিয়েছেন, সেই বিষয়টি ভিন্ন; যেমন, কবরবাসীর উপর সালাম প্রেরণ, আল্লাহ তা‘আলার নিকট তাদের জন্য রহমত, ক্ষমা ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করা; আর এর কারণ হল, মৃত ব্যক্তির আমল করার পথ বন্ধ হয়ে গেছে; আর সে এখন ঐ ব্যক্তির মুখাপেক্ষী যে তার জন্য দো‘আ করবে এবং তার পক্ষে সুপারিশ করবে। আর এ জন্যই শরী‘আত তার সালাতে জানাযায় তার জন্য দো‘আ করাকে ওয়াজিব বা মুস্তাহাব করে দিয়েছে; অথচ জীবিত ব্যক্তির জন্য তেমনটি করেনি; কারণ, আমরা যখন জানাযার উদ্দেশ্যে দাঁড়াই, তখন আমরা তার জন্য দো‘আ করি এবং তার উদ্দেশ্যে সুপারিশ করি।

মৃত ব্যক্তির জন্য দাফনের পরে দো‘আ করা

সুতরাং দাফনের পরে আমরা আরও উত্তমভাবেই তার জন্য দো‘আ ও সুপারিশ করব; কারণ, দাফনের পর সে তার কবরের মধ্যে কঠিনভাবে দো‘আর প্রয়োজন অনুভব করবে; কেননা সে তখন প্রশ্ন ও অন্যান্য বিষয়ের মুখোমুখী হবে, যা উসমান ইবন ‘আফফান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন:
كَانَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم إِذَا فَرَغَ مِنْ دَفْنِ الْمَيِّتِ وَقَفَ عَلَيْهِ فَقَالَ : «اسْتَغْفِرُوا لأَخِيكُمْ وَسَلُوا لَهُ التَّثْبِيتَ فَإِنَّهُ الآنَ يُسْأَلُ ».  (أخرجه أبو داود).                                                          
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মৃত ব্যক্তির দাফনকাজ সম্পন্ন করে অবসর হতেন, তখন তিনি তার কবরের পাশে অবস্থান করতেন, অতঃপর বলতেন: ‘তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তার জন্য দৃঢ়তা ও স্থিরতা কামনা কর; কেননা এখন সে জিজ্ঞাসিত হবে।”[71]
সুফিয়ান সাওরী র. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: যখন মৃত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করা হবে: তোমার রব কে? তখন শয়তান তাকে কোনো এক আকৃতি ধারণ করে দেখায় এবং নিজের দিকে ইঙ্গিত করে বলে, নিশ্চয় আমি তোমার রব।”
ইমাম তিরমিযী র. বলেন: এটা বড় ফিতনা বা পরীক্ষা; এ জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত ব্যক্তিকে দৃঢ়ও ও অটল থাকার জন্য দো‘আ করে বলতেন: “হে আল্লাহ! প্রশ্ন করার সময় তার কথাকে অটল রাখ এবং তার আত্মার জন্য আকাশের দরজাসমূহ খুলে দাও”। আর মৃত ব্যক্তিকে যখন কবরে রাখা হয়, তখন তারা এ কথা বলতে পছন্দ করতেন: “হে আল্লাহ! তুমি তাকে বিতাড়িত শয়তান থেকে রক্ষা কর।”
এটা হল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত; কবরবাসীদের ব্যাপারে বিশটিরও অধিক সুন্নাত রয়েছে, আর এগুলো খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত এবং সকল সাহাবী ও তাবে‘য়ী’র তরিকা বা পদ্ধতি। কিন্তু তারপর বিদ‘আতীরা ও পথভ্রষ্টরা তাদেরকে যে কথা বলা হয়েছিল, তা পরিবর্তন করে ফেলেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে যিয়ারতকে শরী‘আতের অন্তর্ভুক্ত করেছেন মৃত ব্যক্তি ও যিয়ারতকারী ব্যক্তির প্রতি ইহসান হিসেবে, তারা সেটাকে বদলে দিয়েছে মৃত ব্যক্তির মাধ্যমে কোনো কিছু চাওয়া ও তার মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করা দ্বারা। আর এটা ফিতনা ছাড়া অন্য কিছু নয়, যে ব্যাপারে আবদুল্লাহ ইবন মাস‘উদ রা. বলেন: “তোমাদের তখন কি অবস্থা হবে? যখন তোমরা এমন ফিতনার শিকার হবে, যাতে বড়রা অতিশয় বৃদ্ধ হবে এবং ছোটরা তাতে বেড়ে উঠবে, আর এ ফিতনা জনগণের উপর এমনভাব চেপে বসবে যে, তারা সে ফিতনায় পরিবর্তিত হওয়ার পরে সেটাকে সুন্নাহ হিসেবে গ্রহণ করবে। আর তারা বলবে, সুন্নাহ পরিবর্তিত হয়ে গেছে।”[72]
ইবনুল কায়্যিম তার ‘ইগাসাতুল লাহফান’ (إغاثة اللهفان) নামক গ্রন্থে বলেন: এটা প্রমাণ করে যে, যখন সুন্নাহ বিরোধী নীতির উপর কাজ চলতে থাকে, তখন তা বিবেচনাযোগ্য থাকে না এবং তার প্রতি দৃষ্টিও দেওয়া যায় না। অথচ সুন্নাহ পরিপন্থী কাজ দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসছে; সুতরাং সে ক্ষেত্রে জরুরি হল শরী‘য়তের মধ্যে নবপ্রবর্তিত (বিদ‘আতপূর্ণ) বিষয়গুলো থেকে কঠিনভাবে বেঁচে থাকা, যদিও অধিকাংশ লোক এ ব্যাপারে একমত হোক না কেন, সুতরাং সাহাবীগণের পরবর্তী সময়ে নবপ্রবর্তিত কোনো বিষয়ে তাদের একমত হওয়ার ব্যাপারটি যেন কোনোভাবেই তোমাকে প্রতারিত না করে, বরং তোমার জন্য উচিত হবে তাদের অবস্থা ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তথ্য অনুসন্ধানে আগ্রহী হয়ে উঠা; কারণ, সবচেয়ে বিজ্ঞ ও আল্লাহর নিকটতম মানুষ সেই, তাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশি সাহাবীগণের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ এবং তাঁদের নিয়মপদ্ধতি সম্পর্কে অধিক জ্ঞানী। কারণ, তাঁদের নিকট থেকে দীন গ্রহণ করা হয়েছে, আর শরী‘য়ত প্রবর্তকের নিকট থেকে শর‘য়ী বিধিবিধান বর্ণনার ক্ষেত্রে তাঁরাই হলেন আসল বা মূল শক্তি; সুতরাং তোমার জন্য আবশ্যক হল, তোমার যুগের লোকজনের সাথে তোমার বিরোধপূর্ণ কোনো বিষয়ের প্রতি মনোযোগ না দেওয়া, যে বিষয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগের মানুষের সাথে তোমার মতের সামঞ্জস্য বিদ্যমান আছে; কারণ, হাদিসের মধ্যে এসেছে:
« إذا اختلف الناس فعليكم بالسواد الأعظم » .
“যখন মানুষ মতবিরোধ করবে, তখন তোমাদের কর্তব্য হল সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক তথা সাহাবায়ে কিরামের মতকে গ্রহণ করা।”[73]
আবূ শামাহ নামে পরিচিত আবদুর রহমান ইবন ইসমাঈল বলেন, “যখন কোনো বিষয় আল-জামা‘আতকে মেনে চলার অপরিহার্যতা দেওয়া হয়, তখন তার দ্বারা উদ্দেশ্য হয় সত্য ও তার অনুসরণের আবশ্যকতা; যদিও সত্য অবলম্বনকারীগণ সংখ্যায় কম হউক এবং তার বিরোধীরা সংখ্যায় বেশি হউক! তবে হক্ব তো তা-ই যার উপর প্রথম জামা‘আত বা দল প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, আরা তাঁরা হলেন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ। তাঁদের পরবর্তীতে বাতিলের সংখ্যাধিক্যের বিষয়টি গ্রহণযোগ্য বা বিবেচিত হবে না।”
ফুদাইল ইবন ‘আইয়াদ বলেন, যার অর্থ হচ্ছে: “তুমি হিদায়েতের পথে অবস্থান কর, সুন্নাহ’র অনুসারীদের সংখ্যার স্বল্পতা তোমার ক্ষতি করবে না; আর ভ্রষ্টপথ পরিহার কর, ধ্বংসশীলদের সংখ্যাধিক্য দ্বারা প্রতারিত হবে না।”
ইবনু মাস‘উদ রা. বলেন: “তোমরা এমন যামানায় অবস্থান করছ, যাতে তোমাদের মধ্যকার উত্তম ব্যক্তি হচ্ছে সে ব্যক্তি, যে বিবিধ কাজের ক্ষেত্রে দ্রুতগতি সম্পন্ন; অথচ তোমাদের পরে অচিরেই এমন এক সময় আসবে, যাতে তাদের মধ্যকার উত্তম ব্যক্তি হবে সে-ই, পর্বতপ্রমাণ সন্দেহ-সংশয়ের কারণে কাজের ক্ষেত্রে থমকে দাঁড়াবে।”
ইমাম গাযালী র. বলেন: তিনি (ইবন মাসউদ রা.) সত্য বলেছেন; কারণ, এ যামানায় যে ব্যক্তি (হকের ব্যাপারে) দৃঢ়তা অবলম্বন করবে না, বরং অধিকাংশ ব্যক্তির মতের সাথে তাল মিলিয়ে চলবে এবং তারা যাতে নিমগ্ন থাকবে সেও তাতে মগ্ন থাকবে, তাহলে সে ধ্বংস হবে, যেমনিভাবে তারা ধ্বংস হয়েছে। কারণ, দীনের মূল, খুঁটি ও ভিত্তি অধিক ইবাদত, তিলাওয়াত ও খেয়ে না খেয়ে চেষ্টাসাধানা করার নাম নয়; বরং দীন হল তার উপর আপতিত বিদ‘আত ও নবপ্রবর্তিত শর‘য়ী বিধানের মত যাবতীয় দুর্যোগ ও ব্যাধি থেকে তাকে সংরক্ষণ করা। যেমনিভাবে এসব কারণে ইতঃপূর্বে পরিবর্তন ও বিকৃতি ঘটেছে নবী-রাসূলদের দীনসমূহে।
এর উপর ভিত্তি করে মুমিনের উচিত হবে, কোনো বিষয়ে তার শক্তিশালী সুদৃঢ় সংকল্প ও এর দ্বারা অধিক ইবাদত করা দ্বারা এ ধোঁকা না খাওয়া যে, সে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত আছে। কারণ, সে ব্যাপারে তার দৃঢ়তা এবং তাকে করাত দিয়ে ছিড়ে ফেললেও তার থেকে তার ফিরে না আসা এটা প্রমাণ করে না যে, সে তার দীনের ব্যাপারে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত; কেননা সে ব্যাপারে তার দৃঢ়তা ও শক্ত অবস্থান সেটি সত্য হওয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং তা হচ্ছে তার এমন এক জাতির মাঝে বেড়ে উঠার কারণে, যারা এটাকে দীন হিসেবে গ্রহণ করেছে।
বস্তুত কোনো বিষয়ে দৃঢ় সংকল্প ও শক্ত অবস্থান গ্রহণের ক্ষেত্রে জন্ম ও মেলামেশার একটা বড় প্রভাব রয়েছে, চাই তা সত্য হউক অথবা বাতিল হউক। তুমি কি দেখতে পাচ্ছ না যে, এই ধরনের দৃঢ়তা ও একগুয়েমী সকল গণ্ড মূর্খ ব্যক্তির মধ্যেই পাওয়া যায়, যেমন ইয়াহূদী, খ্রিষ্টান ও তাদের মত ব্যক্তিদের মধ্যে।
আর যখন এটা (বিদ‘আত নিন্দনীয় হওয়ার বিষয়টি) সুসাব্যস্ত হলো, তখন বর্তমান কালের প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির উপর অপরিহার্য হলো, কোনো প্রকার বিদ‘আতের দিকে ঝুঁকে পড়া ও তা দ্বারা ধোঁকাগ্রস্ত হওয়া থেকে নিজেকে হেফাযত করা এবং তার দীনকে প্রতিষ্ঠিত অভ্যাস বা প্রথা থেকে রক্ষা করা, যাতে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে এবং যার উপর সে বেড়ে উঠেছে। কারণ, তা হচ্ছে প্রাণহারী বিষ; খুব কম লোকই এই ধরনের মহামারী থেকে বাঁচতে পারে এবং খুব কম লোকের কাছেই সেগুলোর সত্য বিষয়টি ফুটে উঠে।
তুমি কি লক্ষ্য কর না যে, কুরাইশগণ তাদের প্রাণের সাথে মিশে যাওয়া স্বভাব-চরিত্র তথা প্রথার কারণেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে হিদায়াত ও দলিল-প্রমাণ নিয়ে এসেছেন, তারা তা অস্বীকার করেছিল, আর এটাই ছিল তাদের কুফরী ও সীমালংঘন করার অন্যতম কারণ। এমনকি তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে যা যা বলেছে তার কারণ তো শুধু এই যে, তারা যেসব প্রথার উপর বেড়ে উঠেছে এবং যেটার উপর তারা বড় হয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনীত হিদায়াত তার বিপরীতে ছিল। আর এজন্যই আবদুল্লাহ ইবন মাস‘উদ রা. বলতেন:   
«إياكم و ما يحدث من البدع فإن الدين لا يذهب بمرة من القلوب, بل الشيطان يحدث لكم بدعا حتى يذهب الإيمان من قلوبكم » .                                                                                
“তোমরা নবউদ্ভাবিত বিদ‘আত থেকে বেঁচে থাক; কারণ, নিশ্চয় হৃদয় থেকে দ্বীন একবারে ছিনিয়ে নেওয়া হয় না, বরং শয়তান তোমাদের জন্য বহু ধরনের বিদ‘আতের উদ্ভাবন করবে, এমনকি শেষ পর্যন্ত তোমাদের অন্তর থেকে ঈমান চলে যাবে”।
আমরা আল্লাহ তা‘আলার কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে সত্যকে সত্য হিসেবে দেখিয়ে দেন এবং আমাদেরকে তার অনুসরণ করার তাওফীক দান করেন; আবার তিনি যেন আমাদেরকে বাতিলকে বাতিল হিসেবে দেখিয়ে দেন এবং আমাদেরকে তা পরিহার করে চলা নসীব করেন।
সংকলন: শাইখ আহমদ আর-রুমী আল-হানাফী রহ. 
অনুবাদক: মোঃ আমিনুল ইসলাম 
সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
সূত্র: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব
 

No comments:

Post a Comment

Download AsPDF

Print Friendly and PDFPrint Friendly and PDFPrint Friendly and PDF
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...