Sunday 28 September 2014

কিভাবে কুরআন পড়তেন সাহাবাগন (রাদি-আল্লাহু আনহুম)?


রহমান রহীম আল্লাহ্‌ তায়ালার নামে-

অনুবাদক : আলী হাসান তৈয়ব
250

সাহাবা রাদিআল্লাহু আনহুম ও  তাঁদের পরবর্তী মনীষীগণ কুরআনের একটি সূরা শিক্ষায় দীর্ঘ কয়েক বছর পর্যন্ত বসতেন। ইবন উমর রাদিআল্লাহু আনহু সূরা বাকারা শিক্ষা করেন আট বছরে। বলা হয়ে থাকে : তিনি সূরা বাকারা শেখায় বারো বছর সময় ব্যয় করেন। যেমন বলেছেন আবূ আবদুর রহমান সুলামী, তাবেয়ীদের মধ্যে যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের থেকে যেমন উসমান, উবাই বিন কা‘‌ব প্রমুখের কাছে কুরআন শিখেছেন তাঁরা বলেন,

‘আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে দশ আয়াত শিখে আর সামনে এগুতাম না, যাবত আমরা তাতে কী এলেম রয়েছে, কী আমল রয়েছে তা শিখতাম। ফলে আমরা কুরআন শিখেছি, এলেম শিখেছি এবং আমল শিখেছি।’
এমনই করতেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীরা। ইবন মাসঊদ রাদিআল্লাহু আনহু বলেন,
كُنَّا إذَا تَعَلَّمْنَا مِنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَشْرَ آيَاتٍ لَمْ نُجَاوِزْهَا حَتَّى نَتَعَلَّمَ مَا فِيهَا مِنْ الْعِلْمِ وَالْعَمَلِ ” قَالُوا : ” فَتَعَلَّمْنَا الْقُرْآنَ وَالْعِلْمَ وَالْعَمَلَ جَمِيعًا
‘আমরা যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে দশ আয়াত শিখতাম, সেখান থেকে সামনে বাড়তাম না যাবৎ না এর মধ্যে যত বিধান আছে, মর্ম ও আমল আছে তা না শেখা হত।’ তাঁরা বলেন, ‘তাইতো আমরা কুরআন শিখেছি এবং ইলম ও আমল উভয়ই শিখেছি।’ [বাইহাকী, শুআবুল ঈমান : ১৪০১]

মালেক রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ইবন উমর রাদিআল্লাহু আনহু বারো বছরে সূরা বাকারা শিখেন। যখন তিনি সূরা বাকারা খতম করেন, একটি উট জবাই করেন। আর এ সময় শুধু তিনি সূরাটি মুখস্ত করায় বা শাব্দিকভাবে আত্মস্থ করায় ব্যয় করেন নি। বরং ধারণা করা যায় তাঁরা তো পরবর্তীদের চেয়ে দ্রুতই মুখস্ত করতে পারতেন। কিন্তু তারা এ আসমানী মহা বাণীতে তাঁদের জন্য কী বার্তা রয়েছে, কী মর্ম ও বিধান রয়েছে তা অনুধাবনে এ সময় ব্যয় করতেন। এ জন্যই তাঁদের রাদিআল্লাহু আনহুম কথা কম হত কিন্তু তা বরকতে বেশি হত। কারণ তা তত্ত্ব, মর্ম, চিন্তা ও বিদগ্ধতার নির্যাস হত। পক্ষান্তরে পরবর্তীদের কথা পরিমাণে বেশি হত কিন্তু বরকতে হত কম।
সাহাবা রাদিআল্লাহু আনহুমদের অনেকে একটি আয়াত পড়তে পড়তে সারা রাত কাটিয়ে দিতেন। এমনটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কেও বর্ণিত হয়েছে, যেমন বর্ণনা করেছেন আবূ যর রাদিআল্লাহু আনহু। তিনি বলেন,

قَامَ النَّبِيُّ صَلَّى الله عَليْهِ وسَلَّمَ بِآيَةٍ حَتَّى أَصْبَحَ يُرَدِّدُهَا وَالآيَةُ : {إِنْ تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ وَإِنْ تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ}.
‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি আয়াত নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। এমনকি তা বারবার আবৃত্তি করতে করতে সকাল করে ফেললেন। আর সে আয়াতটি ছিল আল্লাহর বাণী :
﴿إِن تُعَذِّبۡهُمۡ فَإِنَّهُمۡ عِبَادُكَۖ وَإِن تَغۡفِرۡ لَهُمۡ فَإِنَّكَ أَنتَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ١١٨﴾ [المائدة :118]
‘যদি তুমি তাদের আযাব দাও তবে তারা তো তোমারই বান্দা। আর যদি তাদের ক্ষমা করে দাও তবে তো তুমিই প্রতাপশালী প্রজ্ঞাময়।’ {সূরা আল-মায়িদা, আয়াত : ১১৮} রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ আয়াত পড়তে পড়তে পুরো একটি রাতই অতিবাহিত করে দেন। [নাসায়ী : ১৩৫০]

একদল সাহাবী রাদিআল্লাহু আনহুম থেকেও এমনটি বর্ণিত হয়েছে। যেমন তামীম দারী রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে,
তিনি নিচের আয়াতটি পড়তে থাকেন :
﴿أَمۡ حَسِبَ ٱلَّذِينَ ٱجۡتَرَحُواْ ٱلسَّيِّ‍َٔاتِ أَن نَّجۡعَلَهُمۡ كَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ﴾ [الجاثية :21]
‘যারা দুষ্কর্ম করেছে তারা কি মনে করে যে, আমি তাদেরকে এ সব লোকের সমান গণ্য করব, যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে?’ {সূরা আল-জাছিয়া, আয়াত : ২১} তিনি এ আয়াত আওড়াতে আওড়াতে সকাল হয়ে যায়।

আসমা রাদিআল্লাহু আনহা থেকেও এমন ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তিনি পড়ছিলেন :
﴿فَمَنَّ ٱللَّهُ عَلَيۡنَا وَوَقَىٰنَا عَذَابَ ٱلسَّمُومِ ٢٧﴾ [الطور :27]
‘অতঃপর আল্লাহ আমাদের প্রতি দয়া করেছেন এবং আগুনের আযাব থেকে আমাদেরকে রক্ষা করেছেন।’ {সূরা আত-তূর, আয়াত : ২৭}

তিনি রাদিআল্লাহু আনহা এ আয়াতে এসে থেমে যান। এখানে এসে তিনি বারবার আওড়াতে থাকেন আর দু‌‘আ করতে থাকেন। এ ঘটনার বর্ণনাকারী বলেন, আমার কাছে বিষয়টি অনেক দীর্ঘ মনে হলো। আমি তখন বাজারে গেলাম। সেখানে আমার যাবতীয় প্রয়োজন সারলাম। তারপর তাঁর কাছে ফিরে এলাম। তিনি তখনো আয়াতটি আবৃত্তি করে যাচ্ছেন আর দুআ করে যাচ্ছেন। তাঁরা এমন করেছিলেন আয়াতে চিন্তা করার জন্য। হরফ আদায় করে বেশি বেশি নেকী প্রাপ্তির ইচ্ছায় তাঁরা এমন করেন নি। তা ছিল বরং আয়াতে নিহিত অর্থ ও মর্ম এবং তাতে লুকিত কল্যাণ আহরণের নিমিত্তে। বর্ণিত হয়েছে ইবন মাসঊদ রাদিআল্লাহু আনহু আল্লাহর এ বাণীটি আওড়াতে থাকেন :
﴿وَقُل رَّبِّ زِدۡنِي عِلۡمٗا ١١٤﴾ [طه :114]
‘হে আমার রব, আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন।’ {সূরা ত্ব-হা, আয়াত : ১১৪} সাঈদ বিন জুবাইর রাহিমাহুল্লাহ এ আয়াতটি বারবার পড়তেন :
﴿وَٱتَّقُواْ يَوۡمٗا تُرۡجَعُونَ فِيهِ إِلَى ٱللَّهِۖ﴾ [البقرة :281]
‘আর তোমরা সে দিনের ভয় কর, যে দিন তোমাদেরকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নেয়া হবে।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ২৮১}
এভাবে একদল সাহাবী ও তাবেয়ী থেকে এমন বর্ণিত হয়েছে। আর আয়াতে এমন পুনরাবৃত্তি ফরয সালাতে অনুমোদিত নয়। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা করেন নি। তাঁর থেকে এমনটি প্রমাণিতও নয়। তিনি এমন করেছেন কেবল নফল সালাতগুলোয়। যেমনটি জানা যায় ইমাম নাসায়ী ও প্রমূখ বর্ণিত আবূ যর রাদিআল্লাহু আনহুর আছর থেকে। একই আয়াত বারবার পড়ার এই ঘটনাগুলোই প্রমাণ করে সাহাবায়ে কিরাম রাদিআল্লাহু আনহুম কুরআন নিয়ে চিন্তা করতেন। কারণ বারবার এসব আয়াতের পঠন ও পুনরাবৃত্তি ছিল মূলত এর মর্ম ও তাৎপর্য নিয়ে চিন্তার খাতিরে।

No comments:

Post a Comment

Download AsPDF

Print Friendly and PDFPrint Friendly and PDFPrint Friendly and PDF
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...