সংকলন ও প্রকাশনায় : কুরআনের আলো টিম
সপ্তম হিজরি, ৬২৯ খ্রিস্টাব্দ। মক্কার
কাফেরদের কুরাইশ দের সাথে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হুদায়বিয়ার সন্ধি
স্বাক্ষরিত হয়েছে। যে ইসলামের নাম শুনলে জ্বলে উঠত কুরাইশদের গা, আজ সেই
কুরাইশগণ স্পষ্টত: স্বীকৃতি দিল ইসলামকে একটি শক্তিশালী ধর্ম হিসাবে।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নদীর মোহনায় এসে তাঁর সাধনার স্রোতধারায় শুনতে পেলেন
মহাসাগরের কল্লোল। তাই তিনি মনস্থ করলেন বিশ্বের শক্তিশালী রাজা-বাদশাহদের
নিকট ইসলামের সুমহান বার্তা পৌঁছাতে। তৎকালীন বিশ্বের বুকে রোম ও পারস্য
ছিল সবচেয়ে ক্ষমতাধর শক্তিশালী সাম্রাজ্য। রোমান সাম্রাজ্যের শাসনকর্তা
ছিলেন সম্রাট হিরাক্লিয়াস। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রখ্যাত ছাহাবী দেহিয়া কালবী
(রা:)-কে ইসলামের দাওয়াত পত্র তাঁর কাছে প্রেরণ করেন। সম্রাট
হিরাক্লিয়াস ঐ সময় জেরুজালেমে অবস্থান করছিলেন। এদিকে কুরাইশ নেতা আবূ
সুফিয়ান (তখনও তিনি মুসলমান হননি) ব্যবসা উপলক্ষে সিরিয়াতে অবস্থান
করছিলেন। আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত, তাকে আবূ সুফিয়ান বিন
হারব সংবাদ দিয়েছেন যে, একদা রোম সম্রাট হিরাকিলয়াস তাঁকে একদল কুরাইশ সহ
ডেকে পাঠালেন। তখন তাঁরা ব্যবসা উপলক্ষে সিরিয়াতে অবস্থান করছিলেন। এ সময়
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আবূ সুফিয়ান ও কুরাইশদের সাথে হুদায়বিয়ার সন্ধি-সূত্রে
আবদ্ধ ছিলেন। সম্রাট হিরাকিলয়াস তাঁর অমাত্যবর্গ পরিবৃত অবস্থায় ঈলিয়া বা
জেরুজালেমে অবস্থানকালে তাঁরা সম্রাটের দরবারে আগমন
করলেন। সম্রাট
হিরাকিলয়াস তাঁদেরকে স্বীয় মজলিসে ডেকে নিলেন। তখন তাঁর চতুষপার্শ্বে
ছিলেন রোমান প্রধানগণ। অতঃপর তিনি কুরাইশগণকে এবং তাঁর দোভাষীকে আহবান
জানিয়ে বললেন, যে লোকটি তোমাদের মধ্যে নবী বলে দাবী করছেন বংশগতভাবে
তোমাদের মধ্যে কে তাঁর অধিক নিকটবর্তী? আবূ সুফিয়ান বললেন, তখন আমি বললাম,
‘বংশগতভাবে আমিই তাঁর নিকটতম ব্যক্তি। সম্রাট হিরাকিলয়াস নির্দেশ দিলেন
যে, তাকে আমার নিকটবর্তী করো এবং তাঁর সঙ্গী- সাথীগণকেও ডেকে এনে
তাঁর পেছনে উপস্থিত কর। অতঃপর সম্রাট তার দোভাষীকে বললেন, তুমি তাদেরকে বল,
আমি এই লোকটিকে তাঁর [(রাসূল (সাঃ)] সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করব। যদি সে
আমার সাথে কোন মিথ্যা কথা বলে, তবে তোমরা যেন তাকে মিথ্যাবাদী বলে প্রমাণ
করো। আবূ সুফিয়ান বলেন, ‘আল্লাহ্র কসম! লোকেরা আমার উপর মিথ্যা আরোপ
করবে বলে যদি আমার লজ্জার ভয় না হত, তাহলে তখন আমি অবশ্যই রাসূলুল্লাহ
(সাঃ) সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলতাম। সম্রাট সর্বপ্রথম আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
যিনি নবী বলে দাবী করছেন তাঁর বংশ কেমন?
আবূ সুফিয়ান: তিনি আমাদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত বংশগত।
সম্রাট: তাঁর পূর্বে তোমাদের মধ্য হতে কোন ব্যক্তি কখনও এমন কথা বলেছে কি?
আবূ সুফিয়ান: না।
সম্রাট: তাঁর পিতৃপুরুষগণের মধ্যে কেউ বাদশাহ ছিলেন কি?
আবূ সুফিয়ান: না।
সম্রাট: প্রভাবশালী লোকেরা তাঁর অনুসরণ করছে, না দুর্বল লোকেরা?
আবূ সুফিয়ান: দরিদ্র ও দুর্বল শ্রেণীর লোকগুলো।
সম্রাট: তাদের সংখ্যা কি দিন দিন বাড়ছে, না কমছে?
আবূ সুফিয়ান: না, বরং বাড়ছে।
সম্রাট: তাদের মধ্যে কেউ কি সেই দ্বীনে প্রবেশ করার পর তার দ্বীনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে তা ত্যাগ করে থাকে?
আবূ সুফিয়ান: না।
সম্রাট: সে নবুঅত লাভের পূর্বে কি তোমরা তাঁকে মিথ্যাবাদী বলে অপবাদ দিতে?
আবূ সুফিয়ান: না।
সম্রাট: তিনি কখনো কোন অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছেন কি?
আবূ সুফিয়ান: না। তবে আমরা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তার সাথে এক সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছি, জানি না এ সময়ের মধ্যে তিনি কি করবেন?
আবূ সুফিয়ান (পরবর্তীতে) বলেন, এই কথাটি ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে অন্য কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
সম্রাট: তোমরা কি তাঁর সাথে কোন যুদ্ধ করেছ?
আবূ সুফিয়ান: হ্যাঁ।
সম্রাট: যুদ্ধের ফলাফল কি?
আবূ
সুফিয়ান: তাঁর ও আমাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত যুদ্ধের ফলাফল হল বালতিতে পালাক্রমে
পানি তোলার ন্যায়। অর্থাৎ কোনটায় তিনি জয় লাভ করেন এবং কোনটায় আমরা।
সম্রাট: তিনি তোমাদেরকে কি নির্দেশ দিয়ে থাকেন?
আবূ
সুফিয়ান: তিনি বলেন, তোমরা একমাত্র আল্লাহ্র ইবাদত কর। তার সাথে কোন
কিছুকে শরীক কোর না। আর তোমরা তোমাদের বাপ-দাদারা যা বলে বেড়াত, তা
পরিত্যাগ কর। তিনি আমাদেরকে ছালাত প্রতিষ্ঠা করতে, সর্বদা সত্য কথা বলতে,
অশ্লীল ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে দূরে থাকতে এবং আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখতে
বলেন।
সম্রাট
হিরাক্লিয়াস দোভাষীকে বললেন, তুমি তাকে বল, আমি তোমাকে তাঁর বংশ সম্পর্কে
জিজ্ঞেস করেছি। তুমি উত্তরে বলেছ, তিনি তোমাদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত বংশজাত।
প্রকৃতপক্ষে নবী-রাসূলগণ তাঁদের কওমের সম্ভ্রান্ত পরিবারে প্রেরিত হয়ে
থাকেন। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, তোমাদের মধ্যে কেউ কি এ কথা (নবী হওয়ার
কথা) বলেছেন? তুমি উত্তরে বলেছ, না। আমি বলতে চাই- যদি তাঁর পূর্বে কেউ এ
কথা বলত, তবে অবশ্যই আমি বলতে পারতাম, তিনি এমন এক ব্যক্তি, যিনি পূর্বের
কথার পুনরাবৃত্ত করেছেন। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, তাঁর পিতৃপুরুষগণের
মধ্যে কোন বাদশাহ ছিলেন কি? তুমি উত্তরে বলেছ, না। আমি বলতে চাই- যদি তাঁর
পিতৃপুরুষগণের মধ্যে কোন বাদশাহ থাকতে, তাহলে আমি বলতাম, তিনি এমন এক
ব্যক্তি, যিনি পিতৃরাজ্য পুনরুদ্ধার করতে ইচ্ছুক। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস
করেছি, তোমরা তাঁর নবুঅত লাভের পূর্বে তার প্রতি কোন মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিলে
কি? তুমি উত্তরে বলেছ, না। কাজেই আমি বুঝতেছি, তিনি এমন ব্যক্তি নন, যিনি
মানুষের ব্যাপারে মিথ্যারোপ করবেন এবং আল্লাহ্র উপর মিথ্যারোপ করবেন।আমি
তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি যে, প্রভাবশালী লোকেরা তাঁর অনুসরণ করছে, না
নিরীহ-দুর্বল লোকগুলো? তুমি উত্তরে বলেছ, নিরীহ-দুর্বল লোকেরাই তাঁর অনুসরণ
করছে।আসলে নিরীহ-দুর্বল লোকেরাই নবী-রাসূ্ল গণের অনুসারী হয়ে থাকে।
আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, তারা সংখ্যায় বৃদ্ধি প্রাপ্ত হচ্ছে, না হ্রাস
পাচ্ছে? তুমি উত্তরে বলেছ, বৃদ্ধি হচেছ।ঈমানের ব্যাপারটি পূর্ণতা লাভের সময়
পর্যন্ত এরূপই হয়ে থাকে।আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, কেউ তার দ্বীনে প্রবেশ
করে বীতশ্রদ্ধ হয়ে আবার সে দ্বীন পরিত্যাগ করেছে কি? তুমি উত্তরে বলেছ,
না। আসলে ঈমানের দীপ্তি ও সজীবতা অন্তরের সাথে মিশে গেলে এরূপই হয়ে থাকে।
আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, তিনি কোন প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন কি? তুমি
উত্তরে বলেছ, না। নবী-রাসূ্ল গণ এরূপই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না। আমি
তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, তিনি তোমাদেরকে কি নির্দেশ প্রদান করেন? তুমি উত্তরে
বলেছ, তিনি তোমাদেরকে একমাত্র আল্লাহ্র ইবাদত করার ও তাঁর সাথে কোন
কিছুকে শরীক না করার নির্দেশ প্রদান করেন। তিনি তোমাদেরকে মূর্তিপূজা করতে
নিষেধ করেন এবং তোমাদেরকে ছালাত প্রতিষ্ঠা করার, সত্য কথা বলার ও
পূত-পবিত্র থাকার নির্দেশ প্রদান করেন। তুমি যা বলেছ তা যদি সত্য হয়, তবে
তিনি অত্যন্ত অল্পকালের মধ্যেই আমার এ পদদ্বয়ের নিম্নবর্তী স্থানের
(সিরিয়ার) মালিক হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করবেন। আমি নিশ্চিত জানতাম, তার
আবির্ভাব হবে; কিন্তু তিনি যে তোমাদের মধ্য হতে হবেন, একথা ভাবতে পারিনি।
আমি যদি যথাযথভাবে তাঁর নিকট পৌছাতে পারব বলে জানতে পারতাম, তাহলে আমি তাঁর
সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে সম্ভাব্য সর্ব প্রকার কষ্ট স্বীকার করতাম। আর
আমি যদি তাঁর নিকট থাকতাম, তাহলে অবশ্যই আমি তাঁর পা ধুয়ে দিতাম। অতঃপর
সম্রাট হিরাক্লিয়াস রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পত্রখানা আনতে বললেন, যে পত্রখানা
দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ছাহাবী দেহিয়া কালবী (রা:)-কে বছরার শাসনকর্তার
নিকট পাঠিয়েছিলেন। বছরার অধিপতি হারেছ পত্রখানা সম্রাট হিরাকিলয়াসকে প্রদান
করলে তিনি তা পাঠ করলেন। পত্রটি ছিল নিন্ম রূপ-
‘পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহ্র নামে
শুরু করছি। আল্লাহ্র বান্দা ও তদীয় রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ হতে রোম সম্রাট
হিরাকিলয়াসের প্রতি। যারা সঠিক পথের অনুসারী, তাঁদের উপর শান্তি বর্ষিত
হৌক। অতঃপর, আমি আপনাকে ইসলামের দাওয়াত প্রদান করছি। ইসলাম গ্রহণ করুন,
নিরাপদে থাকতে পারবেন। আল্লাহ্ আপনাকে দ্বিগুণ পুরস্কারে ভূষিত করবেন। আর
যদি মুখ ফিরিয়ে নেন, তাহলে সকল প্রজার পাপ আপনার উপর বর্তাবে।
‘হে আহলে কিতাব! ‘তোমরা একটি কথার দিকে চলে আস, যে কথাটি আমাদের ও তোমাদের
মধ্যে অভিন্ন, আমরা যেন আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত না করি, তাঁর
সাথে অন্য কোন কিছুকে শরীক না করি এবং আমাদের কেউ যেন আল্লাহ্ ছাড়া অপর
কাউকে প্রভু হিসাবে গ্রহণ না করি। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তাদের বলে
দাও, তোমরা সাক্ষী থাক যে, আমরা মুসলিম’ (আলে ইমরান ৬৪) ।
আবূ সুফিয়ান বলেন, যখন সম্রাট হিরাক্লিয়াস
তাঁর বক্তব্য ও পত্রখানা পাঠ শেষ করলেন, তখন তাঁর সম্মুখে শোরগোল ও চীৎকার
চরম আকার ধারণ করল এবং আমাদেরকে বের করে দেয়া হল। তখন আমি আমার
সঙ্গী-সাথীদেরকে বললাম, আবূ কাবশার (মুহাম্মাদ) ছেলের বিষয় তো
শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, বনু আছফার (রোম)-এর বাদশাহও তাকে ভয় পাচ্ছে। তখন থেকে
আমি বিশ্বাস করতাম যে, তিনি শীঘ্রই জয়ী হবেন। অবশেষে মহান আল্লাহ্ আমাকে
ইসলাম গ্রহণের তাওফীক্ব দিলেন (ছহীহ বুখারী হা/৭, ‘অহির সূচনা’অধ্যায়,
অনুচেছদ-৬, মুসলিম হা/১৭৭৩, মিশকাত হা/৫৮৬১)।
শিক্ষা:
১. গরীব-অসহায়রাই দ্বীনী কাজে অগ্রগামী থাকে।
২. আল্লাহ্ রাববুল আলামীন প্রত্যেক মানুষকে সত্য-মিথ্যা ও ভাল-মন্দ বুঝার অনুধাবন শক্তি দিয়েছেন।
৩. ক্ষমতা লিপ্সা ও স্বার্থ হানির ভয়ে মানুষ হক গ্রহণ থেকে বিরত থাকে।
No comments:
Post a Comment