Tuesday 14 April 2020

মাওলানা আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ : ত্রুটিবিচ্যুতি ও পর্যালোচনা [৩য় পর্ব]


▌২য় অধ্যায়: আল্লাহর শরীর সাব্যস্তকরণের জঘন্য বিদ‘আতী বক্তব্য
·
সূরাহ মুজাদালাহর ৭ নং আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে উস্তায আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ সাহেব বলেছেন, “সংখ্যায় তিন-এর কম হৌক অথবা পাঁচ-এর বেশী হৌক সব অবস্থাতেই আল্লাহ তাদের সাথে থাকেন। আর আল্লাহ মানুষের সাথে থাকেন এর অর্থ আল্লাহ সর্ববিষয়ে অবহিত। সবকিছু তিনি শুনেন ও সবকিছু তিনি দেখেন, তিনি সর্বশক্তিমান। তিনি তাঁর মর্যাদা অনুযায়ী সপ্তম আকাশের উপর অবস্থিত। অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় আবুল আলা মওদুদী আল্লাহ্‌র অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ কোন শরীর সম্পন্ন সত্তা নন। তিনি কারো সাথী হয়ে কোথাও লুকিয়ে থাকেন না’ (তাফহীমুল কুরআন, অত্র আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)।” (যদ্দৃষ্ট – সংকলক) [আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ, তাওযীহুল কুরআন : ২৮তম পারা; পৃষ্ঠা: ৩৪; নিবরাস প্রকাশনী (সপুরা, রাজশাহী) কর্তৃক প্রকাশিত; প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ]
·
❏ বক্তব্যের পর্যালোচনা:
সম্মাননীয় পাঠক, উস্তায আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ সাহেব এখানে জামাতীদের আদর্শিক গুরু মওদুদী সাহেবের বিরোধিতা করতে গিয়ে আল্লাহর শরীর সাব্যস্ত করেছেন। উস্তায আব্দুর রাযযাক সাহেবের কথাটি আবার প্রণিধান করুন। তিনি বলেছেন, “অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় আবুল আলা মওদুদী আল্লাহ্‌র অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ কোন শরীর সম্পন্ন সত্তা নন। তিনি কারো সাথী হয়ে কোথাও লুকিয়ে থাকেন না’।” উস্তায আব্দুর রাযযাকের এই কথা থেকে বোঝা যায়, কেউ আল্লাহর শরীর সাব্যস্ত না করলে সে আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকারকারী বিবেচিত হবে। পক্ষান্তরে আল্লাহর শরীর সাব্যস্ত করলে সে আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকারকারী বিবেচিত হবে না। আল-‘ইয়াযু বিল্লাহ। এ থেকে স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয় যে, উস্তায আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ সাহেব আল্লাহর শরীর সাব্যস্তকরণের ‘আক্বীদাহ পোষণ করেন। লা হাওলা ওয়ালা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ।

কেউ বলতে পারেন, তবে কি মওদুদী সাহেব এক্ষেত্রে সঠিক বলেছেন? আমরা বলি, না। তাঁর বক্তব্যও সঠিক নয়। তিনি আল্লাহকে শরীর থেকে মুক্ত ঘোষণা করেছেন, যা আহলুস সুন্নাহর মূলনীতির খেলাপ। কারণ আল্লাহর নাম ও গুণাবলির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত কিছু মূলনীতি অনুসরণ করে থাকে।
সেসব মূলনীতির অন্যতম হলো—আল্লাহর নাম ও গুণাবলি তাওক্বীফিয়্যাহ তথা বিলকুল কুরআন-হাদীসের দলিলনির্ভর, এতে বিবেকের কোনো স্থান নেই। অর্থাৎ, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ যেসব নাম ও গুণ বর্ণনা করেছে, আমরা কেবল সেসবই সাব্যস্ত করব, কোনোরূপ কমবেশি করব না। যে ব্যক্তি এক্ষেত্রে কমবেশি করে, সে আল্লাহর নাম ও গুণাবলির ক্ষেত্রে বক্রপথ অবলম্বনকারী বিদ‘আতী। এটাই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের বক্তব্য, এবং এটাই তাদের মূলনীতি।
·
❏ আল্লাহর নাম ও গুণাবলিতে কমবেশি করার নিষিদ্ধতা:
সালাফিয়্যাহর দিকে নিজেকে সম্পৃক্তকারী দা‘ঈ উস্তায আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ সাহেব আহলুস সুন্নাহর উক্ত মূলনীতি লঙ্ঘন করে আল্লাহর জন্য ‘শরীর’ সাব্যস্ত করেছেন, যা মূলত মুজাসসিমাহ বা দেহবাদী সম্প্রদায়ের ‘আক্বীদাহ। আমরা মনে করি, আল্লাহর নাম ও গুণাবলির ব্যাপারে গভীর জ্ঞান অর্জন না করেই এসব বিষয়ে বক্তব্য দেওয়া এবং ‘উলামায়ে সুন্নাহর বক্তব্যের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে নিজেই কুরআন-হাদীস পড়ে নিজের মতো ব্যাখ্যা করার নিন্দার্হ প্রবণতা থেকেই এরকম ভয়াবহ বক্তব্য এসেছে, তাঁর নিকট থেকে।
আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের ﷺ সুন্নাহয় আল্লাহর ‘শরীর’ আছে নাকি নেই—তা বর্ণিত হয়নি। তাই আমাদেরকে এ বিষয়ে নিরবতা অবলম্বন করতে হবে। আমরা বলব না, আল্লাহর শরীর আছে। আবার এও বলব না যে, আল্লাহর শরীর নেই। আল্লাহর ওপর খবরদারি করে আল্লাহর জন্য ‘শরীর’ সাব্যস্ত করা হলো কঠিন বিদ‘আত এবং ভয়াবহ কাবীরাহ গুনাহ। মহান আল্লাহ বলেছেন, “আর সে বিষয়ের পেছনে ছুটো না (কোরো না, বলো না, সাক্ষ্য দিয়ো না), যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই। কান, চোখ, আর অন্তর—এগুলোর প্রত্যেকের বিষয়ে অবশ্যই তোমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।” [সূরাহ ইসরা: ৩৬]
·
মহান আল্লাহ আরও বলেছেন, قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالْإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَنْ تُشْرِكُوا بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا وَأَنْ تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ “বল, ‘আমার রব তো হারাম করেছেন অশ্লীল কাজ—যা প্রকাশ পায় এবং যা গোপন থাকে, আর পাপ ও অন্যায়ভাবে সীমালঙ্ঘন এবং আল্লাহর সাথে তোমাদের শরিক করা, যে ব্যাপারে আল্লাহ কোনো প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি এবং আল্লাহর ব্যাপারে এমন কিছু বলা যা তোমরা জান না’।” [সূরাহ আ‘রাফ: ৩৩]
সম্মাননীয় পাঠক, হাত (ইয়াদ), চোখ (‘আইন), পা (ক্বাদাম), আরোহণ (ইস্তিওয়া) প্রভৃতি আল্লাহর সিফাত তথা গুণ। কিন্তু এসব গুণ থেকে আল্লাহর ‘শরীর’ সাব্যস্ত করা যায় না। এরকম কাজ সালাফদের কেউ করেননি। তাই আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ সাহেব আল্লাহর শরীর সাব্যস্ত করে বড়ো ধরনের ভুল করছেন এবং জঘন্য বিদ‘আতে পতিত হয়েছেন। এখন আল্লাহর নাম ও গুণাবলি তাওক্বীফী (পুরোপুরি কুরআন-সুন্নাহর দলিলনির্ভর) হওয়ার ব্যাপারে আহলুস সুন্নাহর মহান ইমামদের বক্তব্য পেশ করেছি।
·
১. প্রখ্যাত তাবি‘ঈ ইমাম ক্বাসিম বিন মুহাম্মাদ বিন আবূ বকর আস-সিদ্দীক্ব (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১০৬ হি.] বলেছেন, تكلموا فيما سمعتم الله ذكر في كتابه، وكفوا عما كف الله عنه “আল্লাহ স্বীয় কিতাবে উল্লেখ করেছেন মর্মে তোমরা যা শুনেছ, সে ব্যাপারে তোমরা কথা বল। আর আল্লাহ যা বলা থেকে বিরত থেকেছেন, তোমরাও তা থেকে বিরত থাক।” [ইমাম ইসমা‘ঈল আল-হারাউয়ী (রাহিমাহুল্লাহ), যাম্মুল কালামি ওয়া আহলিহী, খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৬৭]
২. ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন মুসলিম আল-কিনানী আল-মাক্কী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ২৪০ হি.] বলেছেন, وعلى الخلق جميعا أن يثبتوا ما أثبت الله، وأن ينفوا ما نفى الله، ويمسكوا عما أمسك الله “সকল মানুষের ওপর কর্তব্য হলো—তারা আল্লাহ কর্তৃক সাব্যস্তকৃত বিষয়কে সাব্যস্ত করবে, আল্লাহ কর্তৃক নাকচকৃত বিষয়কে নাকচ করবে এবং আল্লাহ যা থেকে বিরত থেকেছেন, তারাও তা থেকে বিরত থাকবে।” [আল-হাইদাতু ওয়াল ই‘তিযার ফির রাদ্দি ‘আলা মান ক্বালা বি খালক্বিল কুরআন, পৃষ্ঠা: ৪৬]
·
৩. ইমামু আহলিস সুন্নাহ হাফিয আহমাদ বিন হাম্বাল (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ২৪১ হি.] আল্লাহর সিফাত সংক্রান্ত হাদীসসমূহের ব্যাপারে বলেছেন,
نؤمن بها، ونصدق بها بلا كيف، ولا معنى، ولا نرد شيئا منها، ونعلم أن ما جاء به الرسول حق، ولا نرد على رسول الله ﷺ ولا نصف الله بأكثر مما وصف به نفسه بلا حد ولا غاية، ﴿لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ ۖ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ﴾ [الشورى : ١١] ، ونقول كما قال، ونصفه بما وصف به نفسه، ولا نتعدى ذلك، ولا يبلغه وصف الواصفين، نؤمن بالقرآن كله محكمه ومتشابه، ولا نزيل عنه صفة من صفاته لشناعة شنعت، ولا نتعدى القرآن والحديث، ولا نعلم كيف كنه ذلك إلا بتصديق الرسول ﷺ وتثبيت القرآن.
“আমরা এগুলোর প্রতি ইমান রাখি, কোনো ধরন (কাইফিয়্যাহ) ও অপব্যাখ্যা (তা’উয়ীল) ছাড়াই এগুলোকে সত্যায়ন করি। আমরা এগুলোর কোনো কিছুকেই প্রত্যাখ্যান করি না। আর আমরা জানি যে, রাসূল ﷺ যা আনয়ন করেছেন তা সুনিশ্চিত হক। আমরা রাসূল ﷺ এর ওপর খবরদারি করি না। আল্লাহ নিজেকে যেসব গুণে গুণান্বিত করেছেন, তার চেয়ে বাড়িয়ে (বাড়তি গুণ দিয়ে) আমরা তাঁকে গুণান্বিত করি না; (আর তাঁর গুণাবলি বর্ণনা করতে গিয়ে) আমরা সেসবের সীমা ও ধরন বর্ণনা করি না। “বস্তুত তাঁর সদৃশ কিছুই নেই; তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।” (সূরাহ শূরা: ১১) তিনি যেমন বলেছেন, আমরা তেমনই বলে থাকি।
তিনি যে গুণে নিজেকে গুণান্বিত করেছেন, আমরা সে গুণেই তাঁকে গুণান্বিত করি। আমরা এরচেয়ে অগ্রগমন (বাড়তি) করি না। আর তাঁর কাছে গুণ বর্ণনাকারীদের গুণ পৌঁছে না (অর্থাৎ, সৃষ্টিকুলের কেউ আল্লাহর গুণ নিজে থেকে বর্ণনা করতে সক্ষম নয়)। আমরা সমুদয় কুরআনের প্রতি ইমান রাখি, কুরআনের দ্ব্যর্থহীন (মুহকাম) ও দ্ব্যর্থবোধক (মুতাশাবিহ) বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস পোষণ করি। কারও নিন্দা বা সমালোচনার ভয়ে আমরা তাঁর গুণাবলির মধ্য থেকে কোনো একটি গুণকেও বিলোপ করি না। আমরা (এ ব্যাপারে) কুরআন-হাদীসের ওপর অগ্রগমন করি না (অর্থাৎ, আমরা মনে করি, আল্লাহর সমুদয় গুণাবলি সরাসরি কুরআন-হাদীসের দলিলনির্ভর)। কুরআনের প্রমাণীকরণ ও রাসূল ﷺ এর সত্যায়ন ব্যতিরেকে আমরা এগুলোর ধরন-প্রকৃতি সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।” [ইমাম ইবনু কুদামাহ আল-মাক্বদিসী (রাহিমাহুল্লাহ), লুম‘আতুল ই‘তিক্বাদ (ইমাম ফাওযানের ভাষ্য-সহ); পৃষ্ঠা: ৪৭-৫৪]
৪. ইমাম বারবাহারী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৩২৯ হি.] বলেছেন, واعلم –رحمك الله–: أن الكلام في الرب تعالى محدث، وهي بدعة وضلالة، ولا يتكلم في الرب، إلا بما وصف به نفسه في القرآن، وما بين رسول الله ﷺ لأصحابه. وهو –جل ثناؤه– واحد : لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ ۖ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ “আল্লাহ তোমার ওপর রহম করুন। জেনে রেখ, মহান রবের ব্যাপারে (বাড়তি) কথা বলা নবউদ্ভাবিত কর্ম হিসেবে বিবেচিত। এটা বিদ‘আত ও ভ্রষ্টতা। আল্লাহ কুরআনে নিজেকে যে গুণে গুণান্বিত করেছেন এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ স্বীয় সাহাবীদের কাছে আল্লাহর যে গুণ বর্ণনা করেছেন, তা ব্যতীত অন্য কোনো গুণের কথা উল্লেখ করে মহান রবের শানে কথা বলা যাবে না। কেননা তিনি এক, তাঁর সদৃশ কিছুই নেই, তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।” [ইমাম বারবাহারী (রাহিমাহুল্লাহ), শারহুস সুন্নাহ; পৃষ্ঠা: ৬৩]
আল্লাহর নাম ও গুণাবলি তাওক্বীফিয়্যাহ তথা বিলকুল কুরআন-হাদীসের দলিলনির্ভর—মর্মে শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ, ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম, ইমাম ইবনু বায ও ইমাম ‘উসাইমীন-সহ আরও অনেকে সুস্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন। বিস্তারিত দ্রষ্টব্য: মাজমূ‘উ ফাতাওয়া লি ইবনি তাইমিয়্যাহ, খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ২৬; বাদায়ে‘উল ফাওয়াইদ, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১৭০; ফাতাওয়া লাজনাহ দাইমাহ, খণ্ড: ১০; পৃষ্ঠা: ৫১০; শারহুল ক্বাওয়া‘ইদিল মুসলা, পৃষ্ঠা: ৫৯-৬১, ১৪২-১৪৩।
·
❏ আল্লাহর শরীর সাব্যস্তকরণের ব্যাপারে ‘উলামায়ে সুন্নাহর বক্তব্য:
১. ইমাম ক্বাদ্বী আবূ ইয়া‘লা আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৪৫৮ হি.] বলেছেন, فإن قيل: فصفوه بالجسم لا كالأجسام؟ قيل: لا نصفه بذلك؛ لأن الشرع لم يرد بذلك، وهذا كما وصفته أنت بأن له نفسا وحياة، ولا نصفه بأنه جسم “যদি বলা হয়, তাহলে তোমরা আল্লাহর ব্যাপারে বল, তিনি শরীরসম্পন্ন সত্তা, তবে (তাঁর শরীর) অন্যদের শরীরের মতো নয়? সেক্ষেত্রে বলতে হবে, আমরা এর (শরীর শব্দের) মাধ্যমে তাঁর গুণ বর্ণনা করি না। কেননা শরিয়তে তা বর্ণিত হয়নি। এটা তেমনই, যেমনভাবে তুমি তাঁর গুণ বর্ণনা করো যে, তাঁর নাফস ও হায়াত আছে। আমরা তাঁকে শরীরসম্পন্ন বলি না।” [ইমাম আবূ ইয়া‘লা (রাহিমাহুল্লাহ), ইবত্বালুত তা’উয়ীলাত লি আখবারিস সিফাত (তাহক্বীক্ব: মুহাম্মাদ বিন হামাদ আল-হামূদ আন-নাজদী); খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৮৩]
২. শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] আল্লাহর শানে ‘জিসম’ বা ‘শরীর’ শব্দের ব্যবহার প্রসঙ্গে বলেছেন,
فإن ذكر لفظ (الجسم) في أسماء الله وصفاتِه بدعة، لم ينطق بها كتاب ولا سنة، ولا قالَها أحد من سلفِ الأمة وأئمتها، لم يقل أحد منهم: إن الله جسم، ولا إن الله ليس بجسم، ولا إن الله جوهر، ولا إن الله ليس بجوهر. ولفظ (الجسم) لفظٌ مجمل، فمعناه في اللغة هو البدن، ومن قال: إنّ الله مثل بدن الإنسان فهو مفترٍ على الله، ومن قال: إنّ الله يُماثِله شيء من المخلوقات فهو مفترٍ على الله. ومن قال: إن الله ليس بجسمٍ، وأراد بذلك أنه لا يُماثِله شيء من المخلوقات، فالمعنى صحيح وإن كان اللفظ بدعة. وأما من قال: إنَّ الله ليس بجسم، وأراد بذلك أنه لا يُرى في الآخرة، وأنه لم يتكلم بالقرآن العربي، بل القرآن العربي مخلوقٌ أو تصنيفُ جبريل ونحو ذلك، فهذا مفترٍ على الله فيما نفاه عنه.
“নিশ্চয় আল্লাহর নাম ও গুণাবলির ক্ষেত্রে ‘জিসম’ তথা ‘শরীর’ বা ‘দেহ’ শব্দ উল্লেখ করা বিদ‘আত। কেননা কিতাব ও সুন্নাহ এ বিষয়ে কোনো কথা বলেনি; আর না বলেছেন এই উম্মতের সালাফ ও ইমামদের কেউ। তাঁদের কেউ বলেননি, ‘আল্লাহর শরীর আছে’, আর না বলেছেন, ‘আল্লাহর শরীর নেই।’ কেউ বলেননি, ‘আল্লাহ হলেন বস্তু (জাওহার)’, আর না বলেছেন, ‘আল্লাহ বস্তু নন।’
‘জিসম’ বা ‘শরীর’ একটি সংক্ষিপ্ত শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ দেহ। যে ব্যক্তি বলে, আল্লাহ হলেন মানুষের শরীরের মতো, সে আল্লাহর ওপর মিথ্যারোপ করে। আর যে ব্যক্তি বলে, আল্লাহ শরীরসম্পন্ন নন। আর সে উক্ত কথার দ্বারা এই উদ্দেশ্য করে যে, সৃষ্টিকুলের কোনো কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তাহলে তার কথার অর্থ বিশুদ্ধ বিবেচিত হবে, যদিও উক্ত শব্দ (অর্থাৎ, ‘শরীর’ শব্দটি) বিদ‘আত। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি বলে, আল্লাহ শরীরসম্পন্ন নন। আর সে উক্ত কথার দ্বারা এই উদ্দেশ্য করে যে, আল্লাহকে পরকালে দেখা যাবে না, তিনি (নিজে) আরবি কুরআন বলেননি, বরং আরবি কুরআন হলো মাখলুক (সৃষ্ট) অথবা জিবরীলের রচনা, তাহলে আল্লাহ নিজের থেকে যেসব বিষয়কে নাকচ করেছেন, সেসব বিষয়ে সেই ব্যক্তি আল্লাহর ওপর মিথ্যারোপকারী বলে গণ্য হবে।” [ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ), জামি‘উল মাসাইল, খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ২০৬-২০৭; দারু ‘আলামিল ফাওয়ায়েদ, মক্কা কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২২ হিজরি (১ম প্রকাশ)]
·
৩. ভারতবর্ষের স্বনামধন্য মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ, বহুগ্রন্থ প্রণেতা, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম নওয়াব সিদ্দীক্ব হাসান খান ভূপালী আল-ক্বিন্নাউজী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৩০৭ হি./১৮৯০ খ্রি.] বলেছেন, فإن ذكر لفظ الجسم في أسماء الله وصفاته بدعة، لم ينطق بها كتاب ولا سنة، ولا قالها أحد من سلف الأمة وأئمتها، ولم يقل أحد منهم إن الله جسم، ولا إن الله ليس بجسم “নিশ্চয় আল্লাহর নাম ও গুণাবলির ক্ষেত্রে ‘জিসম’ বা ‘শরীর’ শব্দ উল্লেখ করা বিদ‘আত। উক্ত শব্দ না আছে কিতাবে, আর না আছে সুন্নাহয়। আর এই উম্মতের সালাফ ও ইমামগণের মধ্য থেকে কেউ উক্ত শব্দ (আল্লাহর শানে) বলেননি। তাঁদের কেউ বলেননি, আল্লাহ শরীরসম্পন্ন সত্তা, আবার কেউ বলেননি, আল্লাহ শরীরসম্পন্ন নন।” এরপর ইমাম সিদ্দীক্ব উপরোদ্ধৃত শাইখুল ইসলামের কথাগুলোই সামান্য শব্দের ভিন্নতায় উল্লেখ করেছেন। [ইমাম সিদ্দীক্ব হাসান খান (রাহিমাহুল্লাহ), ক্বাত্বফুস সামার ফী বায়ানি ‘আক্বীদাতি আহলিল আসার, পৃষ্ঠা: ৮৮-৮৯; তাহক্বীক্ব: ড. ‘আসিম বিন ‘আব্দুল্লাহ আল-ক্বারউয়ূতী]
৪. সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি, ইমাম ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] ‘জিসম’ বা ‘শরীর’ শব্দের ব্যাপারে ‘সাফওয়াতুত তাফাসীর’ গ্রন্থের রচয়িতা মুহাম্মাদ ‘আলী সাবূনীকে (জন্ম: ১৯৩০ খ্রি.) রদ (খণ্ডন) করতে গিয়ে বলেছেন,
ثم ذكر الصابوني-هداه الله-تنزيه الله سبحانه عن الجسم والحدقة والصماخ واللسان والحنجرة، وهذا ليس بمذهب أهل السنة بل هو من أقوال أهل الكلام المذموم وتكلفهم، فإن أهل السنة لا ينفون عن الله إلا ما نفاه عن نفسه، أو نفاه رسولهﷺ، ولا يثبتون له إلا ما أثبته لنفسه أو أثبته له رسولهﷺ، ولم يرد في النصوص نفي هذه الأمور ولا إثباتها، فالواجب الكف عنها وعدم التعرض لها، لا بنفي ولا إثبات، ويغني عن ذلك قول أهل السنة في إثبات صفات الله وأسمائه أنه لا يشابه فيها خلقه، وأنه سبحانه لا ند له ولا كفو له.
“অতঃপর সাবূনী হাদাহুল্লাহ (আল্লাহ তাকে হেদায়েত দিন) ‘শরীর, নয়নতারা, কর্ণকুহর, জিহ্বা ও বাগ্‌যন্ত্র থেকে মহান আল্লাহ মুক্ত’—বলে উল্লেখ করেছে। এটা আহলুস সুন্নাহর মতাদর্শ নয়। বরং এটা নিন্দনীয় কালামশাস্ত্র চর্চাকারীদের মতবাদ এবং তাদের বাড়াবাড়ি বক্তব্য। আল্লাহ নিজেকে যে বিষয় থেকে মুক্ত ঘোষণা করেছেন, অথবা তাঁর রাসূল ﷺ তাঁকে যা থেকে মুক্ত ঘোষণা করেছেন, তা ব্যতীত অন্য কিছুকে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত আল্লাহ থেকে মুক্ত ঘোষণা করে না। আর আল্লাহ নিজের জন্য যা সাব্যস্ত করেছেন অথবা তাঁর রাসূল ﷺ তাঁর জন্য যা সাব্যস্ত করেছেন, তা ব্যতীত অন্য কিছুকে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আত আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করে না।
কুরআন-সুন্নাহর সুস্পষ্ট দলিলসমূহে এসকল বিষয়ের বিদ্যমানতা-অবিদ্যমানতা সম্পর্কে কিছুই বর্ণিত হয়নি (অর্থাৎ, এ সমস্ত বিষয় আল্লাহর আছে কি নেই—তা বর্ণিত হয়নি)। তাই এসব বিষয় থেকে বিরত থাকা এবং সাব্যস্ত বা নাকচ করার মাধ্যমে এসব নিয়ে পর্যালোচনা না করা আবশ্যক (ওয়াজিব)। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর নাম ও গুণাবলি সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহর এই বক্তব্যই ওই সকল কাজ থেকে অমুখাপেক্ষী করে যে, তিনি (আল্লাহ) কোনো কিছুর ক্ষেত্রেই তাঁর সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নন, বরং তিনি মহাপবিত্র, তাঁর কোনো সমকক্ষ ও শরিক নেই।” [ইমাম ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ), মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৬১; দারুল ক্বাসিম, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; প্রকাশকাল: ১৪২০ হিজরি]
·
৫. বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন, مسألة الجسمية لم ترد لا في القرآن ولا في السنَّة إثباتاً ولا نفياً، ولكن نقول بالنسبة للفظ : لا ننفي ولا نثبت، لا نقول : جسم وغير جسم “জিসমিয়্যাহ তথা শরীরবাদ বা দেহবাদের মাসআলাহ কুরআন-সুন্নাহয় বর্ণিত হয়নি। না বলা হয়েছে, ‘এর অস্তিত্ব আছে’, আর না বলা হয়েছে, ‘এর অস্তিত্ব নেই।’ তাই আমরা এই শব্দের ব্যাপারে বলি, ‘আমরা (এটাকে) সাব্যস্ত করি না, আবার নাকচও করি না।’ আমরা বলি না, ‘আল্লাহর শরীর আছে।’ আবার এও বলি না যে, ‘আল্লাহর শরীর নেই’।” [ইমাম ইবনু ‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ), শারহুল ‘আক্বীদাতিস সাফফারীনিয়্যাহ; পৃষ্ঠা: ১৮; মাদারুল ওয়াত্বান, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২৬ হিজরি (১ম প্রকাশ)]
৬. সৌদি ফতোয়া বোর্ড ও সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সাবেক সদস্য, আল-ফাক্বীহুল মুহাদ্দিস, ‘আল্লামাহ বাকার বিন ‘আব্দুল্লাহ আবূ যাইদ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২৯ হি.] বলেছেন,
الجسم : لم يرد في الوحي إطلاقه على الله سبحانه وتعالى، لا نفيا ولا إثباتا، فهو بدعة، وقد عني شيخا الإسلام ابن تيمية وابن القيم رحمهما الله تعالى بهذا في مباحث مبسوطة لكشف عوار المبتدعة. وأول من قال إن الله جسم هشام بن الحكم الرافضي
“কুরআন-হাদীসে মহান আল্লাহর শানে ‘জিসম’ বা ‘শরীর’ শব্দের ব্যবহার বর্ণিত হয়নি। না নাকচরণের দিক থেকে বর্ণিত হয়েছে, আর না সাব্যস্তকরণের দিক থেকে বর্ণিত হয়েছে। তাই এ শব্দ আল্লাহর শানে প্রয়োগ করা বিদ‘আত। এ শব্দ নিয়ে দুই শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ ও ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুমাল্লাহ) বিদ‘আতীদের ভ্রান্তি উন্মোচন করতে গিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। ‘মহান আল্লাহ শরীরসম্পন্ন সত্তা’—এ কথা সর্বপ্রথম বলেছিল হিশাম বিন হাকাম নামক রাফিদ্বী শিয়া।” [‘আল্লামাহ বাকার আবূ যাইদ (হাফিযাহুল্লাহ), মু‘জামুল মানাহী আল-লাফযিয়্যাহ, পৃষ্ঠা: ২১৭; দারুল ‘আসিমাহ, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪১৭ হি./১৯৯৬ খ্রি. (৩য় প্রকাশ)]
শ্রদ্ধেয় পাঠকবর্গ, ব্যাপারটি ভেবে দেখুন, সর্বপ্রথম কে এই ভ্রান্ত ‘আক্বীদাহ প্রচার করেছে। রাফিদ্বী শিয়া! আর আজকে কে এই ভ্রান্ত মতবাদ প্রচার করছে?! এরপরেও যদি কোনো ‘আহলেহাদীস’ দাবিদার এই কথার কথককে ডিফেন্ড করতে আসে, তাহলে সে হয় বেহেড মাতাল, আর নাহয় শাইখপূজার ভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত। আল্লাহর কাছে এ থেকে পরিত্রাণ চাইছি।
·
৭. মাসজিদুল হারামের সম্মানিত মুদার্রিস, বর্তমান যুগের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ, উসূলবিদ ও নাহূবিদ, সুনানে নাসাঈর স্বনামধন্য ভাষ্যকার (৪২ খণ্ডে), আশ-শাইখ, আল-‘আল্লামাহ মুহাম্মাদ বিন ‘আলী বিন আদাম আল-ইতয়ূবী (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৬৫ হি.] বলেছেন, لم يرد نص في إطلاق الجسم، والجوهر على الله تعالى، لا إثباتا، ولا نفيا، فالأولى عدم الخوض في ذلك حتى يثبت لدينا نص نعتمد عليه “সাব্যস্তকরণ ও নাকচকরণ—কোনো দিক থেকেই মহান আল্লাহর শানে ‘শরীর’ ও ‘বস্তু’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে মর্মে (কুরআন-সুন্নাহয়) কোনো দলিল বর্ণিত হয়নি। তাই এ ব্যাপারে অহেতুক আলোচনায় প্রবৃত্ত না হওয়াই বাঞ্ছনীয়, যতক্ষণ না আমাদের কাছে সুস্পষ্ট দলিল প্রমাণিত হচ্ছে, যে দলিলের ওপর আমরা নির্ভর করতে পারি।” [ইমাম মুহাম্মাদ ইতয়ূবী (হাফিযাহুল্লাহ), যাখীরাতুল ‘উক্ববা ফী শারহিল মুজতাবা (সুনানে নাসাঈর ভাষ্য); খণ্ড: ১৪; পৃষ্ঠা: ২৭৭; দারু আলি বুরূম, মক্কা কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২৪ হি./২০০৩ খ্রি. (১ম প্রকাশ)]
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হলো যে, উস্তায আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ সাহেব আল্লাহর শরীর সাব্যস্ত করে জঘন্য বিদ‘আতে পতিত হয়েছেন এবং তিনি উক্ত বিদ‘আত জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করেছেন। অনতিবিলম্বে এ থেকে তওবা করা এবং জাতির উদ্দেশ্যে ভুল স্বীকার করে বক্তব্য দেওয়া তাঁর জন্য আবশ্যক। যাতে করে সাধারণ জনগণ এই বিদ‘আত থেকে বেঁচে থাকতে পারে। আল্লাহ তাঁকে সত্য গ্রহণ করার তৌফিক দিন, আর আমাদেরও সুপথে চলার সুমতি দিন।
·
সুপথপ্রাপ্তির অভিলাষী
এক গুনাহগার বান্দা—
Md Abdullah Mridha.

No comments:

Post a Comment

Download AsPDF

Print Friendly and PDFPrint Friendly and PDFPrint Friendly and PDF
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...