Sunday 12 April 2020

মাওলানা আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ : ত্রুটিবিচ্যুতি ও পর্যালোচনা [১ম পর্ব]


·
▌ভূমিকা ও তৎসংশ্লিষ্ট আলোচনা
পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহর জন্য। যিনি বলেছেন, “হক এসেছে, আর বাতিল অপসৃত হয়েছে; বাতিল তো অপসৃত হওয়ারই ছিল।” [সূরাহ বানী ইসরাঈল: ৮১]
শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর প্রতি। যিনি বলেছেন, “তুমি হক (সত্য) বল, যদিও তা তিক্ত হয়।” [সাহীহুত তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২২৩৩; সনদ: সাহীহ লি গাইরিহী] অন্যত্র বলেছেন, “তুমি হক বল, যদিও তা তোমার নিজের বিরুদ্ধে যায়।” [সিলসিলাহ সাহীহাহ, হা/১৯১১; সাহীহুল জামি‘, হা/৩৭৬৯; সনদ: সাহীহ]
·
❏ পূর্বাভাস:
ইয়া মা‘শারাল কুররা, ইয়া মিলহাল বালাদ, মাঁই ইউসলিহুল মিলহা ইযাল মিলহু ফাসাদ। ওগো ক্বারীদের দল, ওগো নগর-রাষ্ট্রের নিমক, তোমাদেরই যদি হয় এ হাল, তবে কে দিবে নগরস্থদের সবক? কথাগুলো বলেছিলেন ইমাম সুফইয়ান সাওরী। চরণ দুটোর মর্মার্থের আরও প্রকট কাব্যিক রূপায়ন চোখে পড়েছিল ফাইযী সাহেবের বইয়ে। সেখানে কথাগুলো এসেছে এভাবে, ‘রক্ষক যদি ভক্ষক হয়, কে করিবে রক্ষা, ধার্মিক যদি চুরি করে, কে দিবে তারে শিক্ষা?’
ইমাম সুফইয়ানের শেষের চরণটি গভীরভাবে ভাবতে গিয়ে চমকে ওঠলাম। ‘ইসলাহ’ আর ‘ফাসাদ’ শব্দ দুটো আমায় নিয়ে গেল ওই হাদীসে, যেখানে আহলেহাদীসদের বৈশিষ্ট্যের কথা বিবৃত হয়েছে। নবিকুল শিরোমণি রাসূলে মুবাশশির ﷺ বলেছেন, ইসলামের আগমন হয়েছে অল্পসংখ্যক মানুষ নিয়ে। অচিরেই ইসলাম অনুরূপ সংখ্যা নিয়ে প্রত্যাগমন করবে, যেমন শুরুতে আগমন করেছিল। সুতরাং শুভ সংবাদ ওই অল্পসংখ্যক লোকদের জন্য। তাদের পরিচয় জানতে চাওয়া হলে নাবীজী বললেন, ‘আল্লাযীনা ইউসলিহূনা ইযা ফাসাদান নাস, ওরা সেই সব লোক যারা মানুষ ভ্রষ্টপথে ধাবিত হলে তাদেরকে সংস্কার করে সঠিক পথে ধরে রাখার চেষ্টা করে।’ [মুসনাদে আহমাদ, হা/১৬৬৯০; সনদ: সাহীহ]
আহলেহাদীসদের এক অনুপম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা জনসাধারণকে সঠিক পথের দিকে আহ্বান করে। তারা ‘আক্বীদাহ, মানহাজ ও আমল-আখলাকে ধারণ করে তাদের পূর্বসূরি ইমামদের নীতি, ন্যায়নিষ্ঠ সালাফদের আদর্শ। আর আহলেহাদীস জনগণের নেতৃত্ব দেয় তাদের হকপন্থি দা‘ঈবৃন্দ। বহু যুগ পূর্ব থেকে এমনটিই হয়ে আসছে, আর এমনটিই হওয়া উচিত। এই পরম্পরার মাঝে অনেক নেতৃস্থানীয় মহাত্মাদের পদস্খলন ঘটে। কিন্তু আহলেহাদীসরা সেই পদস্খলনের অনুগমন করে না। কারণ তারা হকের অনুসারী, ব্যক্তিপূজারী নয়।
মুশকিল দেখা দেয় তখন, যখন নেতৃস্থানীয় কেউ স্বীয় ভ্রমপ্রমাদের ওপর অটল থাকেন। ভুল থেকে ফিরে আসতে চান না। বরং স্বীয় প্রমাদকে আরও প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরেন। আর একদল অবুঝ কিংবা অবুঝ হওয়ার ভণিতাকারী ব্যক্তি সেই ভুলকে এড়িয়ে যেতে, অথবা সেটাকে সঠিক প্রমাণ করতে তৎপর হয়ে ওঠে। ইমাম সুফইয়ানের কথাগুলো সেসব দা‘ঈর জন্যই যথার্থ হয়, যারা মানুষের সংস্কার করবে কী, তারা নিজেদের সংস্কার করতেই আগ্রহী নয়। আল্লাহ মাফ করুন।
আহলেহাদীস সমাজের সংস্কারমূলক দা‘ঈদের একজন হচ্ছেন উস্তায আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ। জনসাধারণের মধ্যে তাঁর দা‘ওয়াতের ভালো প্রভাব আছে। এটা অবশ্যই ভালো দিক। কিন্তু তাঁর কিছু বিপজ্জনক বিভ্রান্তিও আছে, যেসব বিভ্রান্তির সংশোধন অতীব জরুরি। সত্যিকারার্থে আমি আগে মনে করতাম, তাঁর ভুলগুলো দুয়েকটি খুঁটিনাটি মাসআলাহ সংক্রান্ত। আমি সেগুলো এড়িয়ে যেতাম। পরে জানলাম, তাঁর কিছু মৌলিক ‘আক্বীদাহগত ভুলও আছে। আমি ভাবলাম, তিনি হয়তো এসব ভুল থেকে ফিরে আসবেন। কারণ বিষয়গুলো নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল।
এমনকি আমি তাঁর নাম না নিয়ে একটি মৌলিক ‘আক্বীদাহগত ভ্রান্তির খণ্ডনও করেছিলাম। পরবর্তীতে ‘উসমানী আজানের ইস্যু আসল। এই ইস্যুতে তাঁর কয়েক দফার বক্তব্য দেখে আমার মনে হলো, তিনি ভুল থেকে ফিরে আসতে চাইছেন না। হঠাৎই মনে পড়ল, ‘আক্বীদাহগত ভ্রান্তি নিয়ে সমালোচনার অনেকদিন হয়ে হয়ে গেল। কিন্তু তাঁকে তো ফিরে আসতে দেখলাম না! আমি এখানে এসে হোঁচট খেলাম, আমার চিন্তা বাধাগ্রস্ত হলো। উপলব্ধি করলাম, তাঁর ব্যাপারে এতদিন ধরে অবলম্বিত নীরবতা ভঙ্গ করার সময় এসেছে।

আমি তাঁদের মন্তব্যগুলো দেখেছি, যাঁরা চান না আমি এ বিষয়ে কলম ধরি, কিংবা ধরলেও যেন নাম না ধরে সমালোচনা করি। আশ্চর্য, তাঁদের অনেকেই এক সময় চাইতেন, আমি খারিজী ‘আক্বীদাহর বিরুদ্ধে লিখি, ইখওয়ানী মানহাজের বিরুদ্ধে লিখি! অথচ মহান আল্লাহর নাম ও গুণাবলি বিষয়ক তাশবীহ ও তাজসীমের মতো ভয়াবহ ‘আক্বীদাহর বিরুদ্ধে লেখা হোক, তারা তা চাইছেন না। তবে সবাই যে ওই দলে যোগ দেননি, সেটাই স্বস্তির কথা।
বলতে বলতে অনেক কথাই বলা হলো। এখন আমরা বক্ষ্যমাণ সমালোচনাধর্মী প্রবন্ধের প্রারম্ভে এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কয়েকটি পয়েন্টে কথা বলব। যাতে করে পাঠক বুঝতে পারেন, এই প্রবন্ধ কতটুকু গুরুত্ববহ ও প্রয়োজনীয়। ওয়া বিল্লাহিত তাওফীক্ব।
·
❏ একনজরে উস্তায আব্দুর রাযযাকের বিভ্রান্তি:
সুপ্রিয় পাঠক, আমরা উস্তায আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফের ভ্রান্তিগুলোর বিস্তারিত পর্যালোচনা করব, ইনশাআল্লাহ। আমরা স্রেফ তাঁর ‘আক্বীদাহগত ও শরিয়তের মূলনীতিগত ভুলের এবং ফিক্বহের কিছু ‘শায’ বা ‘অপ্রচলিত’ মতের খণ্ডন করতে চাইছি। বিশদ পর্যালোচনাভিত্তিক লেখা সময় নিয়ে ধীরে ধীরে প্রকাশ করার ইচ্ছা আছে। এখানে আমরা একনজরে উস্তায আব্দুর রাযযাক সাহেবের ভুলগুলো তুলে ধরছি।
১. তিনি আল্লাহ তা‘আলার সিফাতকে মাখলুকের সিফাতের সাথে সাদৃশ্য দিয়েছেন।
২. তিনি মহান আল্লাহর ‘শরীর’ বা ‘দেহ’ সাব্যস্ত করেছেন।
৩. তিনি আল্লাহর ‘অঙ্গপ্রত্যঙ্গ’ সাব্যস্ত করেছেন।
৪. তিনি দাবি করেছেন, আল্লাহ পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করার সময় আরশ ত্যাগ করেন।
৫. তিনি ভুল ইস্তিদলালের (দলিলগ্রহণের) মাধ্যমে আল্লাহর ‘কান’ সাব্যস্ত করেছেন।
৬. তিনি আল্লাহর নামসমূহকে নির্দিষ্ট সংখ্যায় সীমাবদ্ধ করেছেন এবং আল্লাহর কর্মগত সিফাত থেকে তাঁর নাম তৈরি করেছেন।
৭. তিনি কাবীরাহ গুনাহ (ছোটো শির্ক) করার কারণে দেওবন্দের মাওলানাকে তাকফীর করেছেন।
৮. তিনি গাইরুল্লাহর মাধ্যমে বরকত হাসিল করাকে নিঃশর্তভাবে ‘বড়ো শির্ক’ সাব্যস্ত করেছেন।
৯. তিনি বাসায় পুতুল ব্যবহারকারীদের ‘মুশরিক’ আখ্যা দিয়েছেন।
১০. গাইরুল্লাহর নামে কসমকারীকে তিনি নিঃশর্তভাবে ‘মুশরিক’ বলেছেন।
১১. কুরআনের ওপর হাত রেখে শপথ করাকে তিনি নিঃশর্তভাবে শির্ক বলেছেন।
১২. কুরআনের আয়াত দিয়ে তৈরিকৃত তাবিজ ব্যবহারকারীকে তিনি ‘মুশরিক’ বলেছেন।
১৩. তিনি সকল দিবস পালন করাকে নিঃশর্তভাবে শির্ক বলেছেন।
১৪. তিনি নিঃশর্তভাবে বলেছেন, অষ্টধাতুর আংটি ব্যবহার করলে ইমান কেটে যায়।
১৫. এমনকি পতাকায় স্যালুট করলেও নিঃশর্তভাবে ইমান কেটে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
১৬. তিনি ব্যক্ত করেছেন, সময় হওয়ার এক মিনিট আগেই ইফতার করা যাবে।
১৭. তিনি এক লক্ষবার দু‘আ ইউনুস পাঠকারীকে ‘কাফির’ বলেছেন।
১৮. তিনি মনে করেন, ইজমা‘ বলতে কিছুই নাই।
১৯. শৌচকার্যে ঢিলা ও পানি একসঙ্গে ব্যবহার করাকে তিনি বিদ‘আত আখ্যা দিয়েছেন।
২০. তাবলীগ জামাতের লোকদেরকে হত্যা করার কথা হাদীসে বোঝানো হয়েছে, এই মর্মে জনৈক মাওলানার রেফারেন্স টেনে তিনি বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন।
উপরোল্লিখিত একটি ভুলও ছোটোখাটো নয়, বরং এগুলো মৌলিক বিভ্রান্তি। আল্লাহ উস্তায আব্দুর রাযযাক সাহেবকে ক্ষমা করুন। এসব ভুল তিনি আজকে করছেন না। আমাদের অনুসন্ধান মোতাবেক, কোনো কোনো ভুল ২০০৬ সাল থেকে চলছে, আবার কোনো ভুল আজ থেকে পাঁচ বা ততোধিক বছর আগের লেকচারে পাওয়া গেছে, কোনো ভুল আবার দুই-তিন বছর আগের লেকচারে পাওয়া গেছে। এসব ভুলের প্রকাশ্য সমালোচনা হওয়া জরুরি। আর তিনি যদি সবগুলো ভুল থেকে ফিরে আসেন, আমি আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলছি, তাঁর ফিরে আসার কথা আমি প্রচার করব। ভুলের সমালোচনার সাথে তাঁর ফিরে আসার কথা সংযুক্ত করে দিব। ইনশাআল্লাহ।
·
❏ শরিয়তবিরোধীর খণ্ডন করা আহলুস সুন্নাহর মূলনীতি:
এটি খুবই জরুরি একটি আলোচনা। দ্বীনের ব্যাপারে ভুলে পতিত ব্যক্তি ও শরিয়তবিরোধীর রদ (রিফিউট) করা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের একটি অন্যতম মূলনীতি। সালাফদের যুগ থেকেই শরিয়তবিরোধীকে রদ করার এই শার‘ঈ নীতি চলে আসছে। শরিয়তবিরোধীর রদকারীদের ব্যাপারে নাবী ﷺ প্রশংসামূলক কথা বলেছেন।
ইবরাহীম বিন ‘আব্দুর রাহমান আল-‘উযরী কর্তৃক বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “প্রত্যেক আগত দলের মধ্যে সৎকর্মপরায়ণ ও নির্ভরযোগ্য মানুষ (কিতাব ও সুন্নাহর) এই ‘ইলম গ্রহণ করবে। আর তারাই কিতাব ও সুন্নাহর ‘ইলমের ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘনকারী ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক কৃত রদবদল, বাতিলপন্থিদের মিথ্যাচার এবং জাহিল ব্যক্তিদের ভুল ব্যাখ্যা খণ্ডন করবে।” [বাইহাক্বী, সুনানুল কুবরা, হা/২১৪৩৯; ইবনু বাত্বত্বাহ, ইবানাতুল কুবরা, হা/৩৪; মিশকাত, হা/২৪৮; সনদ: সাহীহ (তাহক্বীক্ব: আলবানী)]
সালাফগণের কর্মে আমরা এই মহান নীতির প্রতিফলন দেখতে পাই। সাহীহ মুসলিমের একটি হাদীসে এসেছে, কা‘ব বিন উজরাহ কর্তৃক বর্ণিত। তিনি বলেন, তিনি মাসজিদে প্রবেশ করলেন, আর তখন ‘আব্দুর রাহমান ইবনুল হাকাম বসা অবস্থায় খুতবা দিচ্ছিলেন। কা‘ব (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) বললেন, “তোমরা এই খবিসের দিকে লক্ষ করো, সে বসে বসে খুতবা দিচ্ছে। অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘এবং যখন তারা দেখল ব্যবসা ও কৌতুকের বিষয়, তখন তারা (খুতবা চলাকালীন সময়ে) তোমাকে দাঁড়ানো অবস্থায় রেখে সেদিকে ছুটে গেল।’ (সূরাহ জুমু‘আহ: ১১)” [সাহীহ মুসলিম, হা/৮৬৪; জুমু‘আহ অধ্যায়; পরিচ্ছেদ- ১১]
ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) কে প্রশ্ন করা হয়েছে, “শরিয়তবিরোধীকে রদ করা এবং (দ্বীনের ব্যাপারে) ভুলকারীদের ভুল বর্ণনা করা কি সুন্নাহর মূলনীতিসমূহের অন্তর্ভুক্ত?” তিনি (হাফিযাহুল্লাহ) উত্তরে বলেছেন, “হ্যাঁ, শরিয়তবিরোধীকে রদ করা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের ত্বরীক্বাহর অন্তর্ভুক্ত।” [দ্র.: https://m.youtube(ডট)com/watch?v=kRVQsNqCYzM (অডিয়ো ক্লিপ)]
এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, শরিয়তবিরোধীর রদ করা আহলুস সুন্নাহর একটি অন্যতম মূলনীতি। পরন্তু শরিয়তবিরোধীকে রদ করার মাধ্যমে সুন্নাহকে ডিফেন্ড করা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার শামিল। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন, “বিদ‘আতীদের রদকারী একজন মুজাহিদ। এমনকি ইয়াহইয়া বিন ইয়াহইয়া বলেছেন, ‘সুন্নাহকে ডিফেন্ড করা সর্বোত্তম জিহাদ’।” [নাক্বদুল মানত্বিক্ব, পৃষ্ঠা: ১২; গৃহীত: ইজমা‘উল ‘উলামা ‘আলাল হাজরি ওয়াত তাহযীরি মিন আহলিল বিদা‘; পৃষ্ঠা: ১০৪]
·
❏ শরিয়তবিরোধীর ব্যাপারে চুপ থাকা নিষিদ্ধ:
সুপ্রিয় পাঠক, জেনেশুনে শরিয়তবিরোধীর ব্যাপারে চুপ থাকা যাবে না। কারণ এটা মানুষের দ্বীন সংক্রান্ত বিষয়। সাধারণ মানুষের কাছে হক পৌঁছে দেওয়া আবশ্যক, যাতে করে ভুলকারীর দ্বারা তারা ধোঁকাগ্রস্ত না হয়। আর শরিয়তের ক্ষেত্রে ভুলকারীকে খণ্ডন করার নীতি সালাফদের যুগ থেকে চলে আসছে। সালাফগণ ও উম্মতের ইমামগণ ব্যক্তির দিকে তাকাননি, বরং দ্বীনের দিকে তাকিয়েছেন।
১. ইমাম আবূ মুহাম্মাদ হাসান বিন ‘আলী বিন খালফ আল-বারবাহারী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৩২৯ হি.] বলেছেন, “জেনে রেখো, সঠিক পথ থেকে বের হয়ে যাওয়া দুই ধরনের হয়ে থাকে। হয় ব্যক্তি পথ ভুল করেছে, অথচ সে স্রেফ কল্যাণের অভিলাষীই ছিল। এক্ষেত্রে তাঁর ভুলের অনুসরণ করা যাবে না। নতুবা সে (জেনেশুনে ভুলের অনুসরণকারী) ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। আর না হয় ব্যক্তি সত্য গ্রহণে হঠকারিতা করেছে এবং তার পূর্ববর্তী মুত্তাক্বী ব্যক্তিদের বিরোধিতা করেছে। এই ব্যক্তি নিজে ভ্রষ্ট এবং অপরকে ভ্রষ্টকারী। সে এই উম্মতের অবাধ্য শয়তান। যে ব্যক্তি তার প্রকৃত অবস্থা জানে, তার উচিত ওর থেকে মানুষকে সতর্ক করা এবং ওর ঘটনা মানুষের কাছে বর্ণনা করা। যাতে করে কেউ ওর বিদ‘আতে পতিত হয়ে ধ্বংস না হয়।” [ইমাম বারবাহারী (রাহিমাহুল্লাহ), শারহুস সুন্নাহ, পৃষ্ঠা: ৬৯-৭০; মাকতাবাতুল গুরাবাইল আসারিয়্যাহ, মাদীনাহ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪১৪ হি./১৯৯৩ খ্রি. (১ম প্রকাশ)]
২. বিগত শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন, “মুসলিমদের ‘আলিমদের উপর প্রকৃত বিষয় বর্ণনা করা, প্রত্যেক দল বা সংগঠনের সাথে (শার‘ঈ) বিতর্ক সম্পন্ন করা এবং সবাইকে ওই পথের উপর চলতে নসিহত করা ওয়াজিব, যে পথ স্বয়ং আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য চিত্রায়িত করেছেন, আর যে পথের দিকে আমাদের নাবী মুহাম্মাদ ﷺ আমাদেরকে আহ্বান করেছেন। যে ব্যক্তি এই পথের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করে, কিংবা ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে বা কেবল আল্লাহ জানেন এমন কোনো (গুপ্ত) উদ্দেশ্যের কারণে নিজের জিদ ও হঠকারিতায় অটল থাকে, তাহলে যারা প্রকৃত বিষয়টি জানে তাদের জন্য ওই ব্যক্তির সমালোচনা করা এবং তার থেকে সতর্ক করা ওয়াজিব। যাতে করে মানুষ এই ব্যক্তিদের পথ বর্জন করে, আর যে ব্যক্তি প্রকৃত বিষয় জানে না সে তাদের দলে প্রবেশ না করে। নতুবা তারা ওই অজ্ঞ ব্যক্তিকে পথভ্রষ্ট করবে এবং সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করে ফেলবে। যেই সঠিক পথ অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেছেন, “আর এটি তো আমার সরল পথ। সুতরাং তোমরা তার অনুসরণ করো এবং অন্যান্য পথ অনুসরণ কোরো না, তাহলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। এগুলো তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা তাক্বওয়া অবলম্বন করো।” (সূরাহ আন‘আম: ১৫৩)” [ইমাম ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ), মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ২০৩; দারুল ক্বাসিম, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২০ হিজরী (১ম প্রকাশ)]
৩. ইমাম ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) আরও বলেছেন, “পাপাচারী, মূর্খ ও বিদ‘আতীর বিরুদ্ধে কথা বলা বর্জন করা এবং নীরব থাকা ‘আলিমদের জন্য বৈধ নয়। কেননা এটি একটি মারাত্মক গলত। এটি অকল্যাণ ও বিদ‘আত প্রসারিত হওয়ার অন্যতম কারণ। এটি কল্যাণ কমে যাওয়া, কল্যাণ দূরীভূত হওয়া এবং সুন্নাহ অপসৃত হওয়ারও অন্যতম কারণ। সুতরাং ‘আলিমদের জন্য হক বলা, এর দিকে লোকদের আহ্বান করা, বাতিলকে রদ করা এবং এ থেকে লোকদেরকে সতর্ক করা ওয়াজিব। তবে অবশ্যই তা হতে হবে শার‘ঈ ‘ইলম ও জাগ্রত জ্ঞান সহকারে।” [প্রাগুক্ত; খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ৫৩]
৪. এমনকি যারা দ্বীনের ব্যাপারে ভুলকারীর ব্যাপারে চুপ থাকে, তারা ইহুদি-খ্রিষ্টানের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বনকারী। এ মর্মে ইমাম ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, “হকপন্থিরা যদি হক বর্ণনা করা থেকে চুপ থাকে, তাহলে ভুলকারীরা তাদের ভুলে অটল থাকবে এবং অন্যরা সেই ভুলের ক্ষেত্রে তাদের অনুসরণ করবে। আর নীরবতা অবলম্বনকারীরা শরিয়ত গোপনের পাপ বহন করবে, যে ব্যাপারে আল্লাহ তাদের হুঁশিয়ার করেছেন। তিনি বলেছেন, “আমি যেসব উজ্জ্বল নিদর্শন ও পথনির্দেশ অবতীর্ণ করেছি, সেগুলিকে সর্বসাধারণের নিকট প্রকাশ করার পরও যারা সেসব বিষয়কে গোপন করে, আল্লাহ তাদেরকে অভিসম্পাত করেন এবং অভিসম্পাতকারীরাও তাদেরকে অভিসম্পাত করে থাকে। তবে তারা ছাড়া, যারা তাওবাহ করেছে, শুধরে নিয়েছে এবং স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে। অতএব আমি তাদের তাওবাহ কবুল করব। বস্তুত আমি তাওবাহ কবুলকারী, পরম দয়ালু।” (সূরাহ বাক্বারাহ: ১৫৯-১৬০)
আল্লাহ আহলে কিতাব তথা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ‘আলিমদের নিকট থেকে এই অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, তারা তা মানুষের কাছে বর্ণনা করবে, গোপন করবে না। কিন্তু তারা সে অঙ্গীকার তাদের পিছনে ছুঁড়ে ফেলার কারণে আল্লাহ তাদের ভর্ৎসনা করেছেন এবং আমাদেরকে তাদের অনুসরণ করা থেকে সতর্ক করেছেন।
কিতাব ও সুন্নাহর বিরোধীদের ভুল বর্ণনা করা থেকে আহলুস সুন্নাহ যদি চুপ থাকে, তাহলে তারা এর মাধ্যমে ইহুদি-খ্রিষ্টানের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করে, যে ইহুদি-খ্রিষ্টানরা অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্ট।” [প্রাগুক্ত; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৭২-৭৩]
৫. ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) বলেছেন, “যে মুসলিমের কাছে ‘ইলম আছে, তার জন্য বিদ‘আত ও শরিয়তবিরোধিতার ব্যাপারে চুপ থাকা এবং মানুষের কাছে তা বর্ণনা না করা জায়েজ নয়। কেননা সে যদি চুপ থাকে, তাহলে মানুষ তা দলিল হিসেবে গ্রহণ করবে এবং বলবে, “এটা যদি হারাম বা নিষিদ্ধই হতো, তাহলে অমুক ‘আলিম তা দেখা সত্ত্বেও চুপ করে থাকতেন না”।” [দ্র.: www.sahab(ডট)net/forums/index.php?app=forums&module=forums&controller=topic&id=122996 (টেক্সট-সহ অডিয়ো ক্লিপ)]
উপরোদ্ধৃত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হলো যে, উস্তায আব্দুর রাযযাক সাহেবের মৌলিক বিভ্রান্তিগুলোর ব্যাপারে চুপ থাকা যাবে না। বরং সেসব বিভ্রান্তির ব্যবচ্ছেদ করতে হবে, মুসলিম জনসাধারণের কল্যাণের জন্য এবং আল্লাহর দ্বীনকে সমুন্নত করার জন্য।
·
❏ নাম ধরে সমালোচনা করার বৈধতা:
আজকে উস্তায আব্দুর রাযযাক সাহেবের বিভ্রান্তির সমালোচনা করতে গিয়ে এসব টপিকে লিখতে হচ্ছে, যা আমি কখনো কল্পনাও করিনি। এসব সংশয় ইখওয়ানী-জামাতীরা পেশ করত, যখন আমরা তাদের বিরুদ্ধে সমালোচনা করতাম। আজকে আহলেহাদীস ভাইদেরকেও যে এসব সংশয়ের জবাবের পাঠ দিতে হবে, তা আমার কল্পনারও বাইরে ছিল। এটা হচ্ছে তা‘আসসুব (গোঁড়ামি) নামক নিকৃষ্ট ব্যাধির প্রতিফল। কথায় আছে, “হুব্বুকাশ শাই ইউ‘মী ওয়া ইউসিম, কোনো কিছুর প্রতি বিশেষ প্রীতি ব্যক্তিকে অন্ধ ও বধির করে দেয়।”
সে যাকগে, বাস্তবতা হলো, শরিয়তবিরোধীর নাম ধরে সমালোচনা করা জায়েজ, বরং ক্ষেত্রবিশেষে ওয়াজিব। এ মর্মে ইমামদের থেকে কয়েকটি বর্ণনা উল্লেখ করছি।
১. প্রখ্যাত তাবি‘ তাবি‘ঈ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৮১ হি.] বললেন, “মু‘আল্লা বিন হিলাল যখনই হাদীস বর্ণনা করে, তখনই মিথ্যা বলে।” তখন তাঁকে একজন সূফী বলল, “হে আবূ আব্দুর রহমান! আপনি গিবত করছেন?” তখন তিনি বললেন, “চুপ করো তুমি! যদি আমরা এভাবে সুস্পষ্ট বর্ণনা না করি, তবে লোকেরা কীভাবে বাতিল থেকে হককে (আলাদা করে) চিনতে পারবে?” [ইমাম সুয়ূত্বী, তাদরীবুর রাবী; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৩৬৯; গৃহীত: শাইখ হারিসী (হাফিযাহুল্লাহ), লাম্মুদ দুর্রিল মানসূর; পৃষ্ঠা: ১৮৪]
২. ইমাম মুসলিম (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ২৬১ হি.] সাহীহ মুসলিমের ভূমিকায় বলেছেন, “পরিচ্ছেদ: হাদীসের সনদ বর্ণনা করা দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত, নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী ছাড়া রিওয়াইয়াত (বর্ণনা) গ্রহণ করা উচিত নয়; বর্ণনাকারীদের দোষত্রুটি তুলে ধরা শুধু জায়েজ নয়, বরং ওয়াজিব! এটি হারাম গিবতেরও অন্তর্ভুক্ত নয়; বরং এটি ক্ষতিকারক বিষয়াদি দূর করে মর্যাদাপূর্ণ শরিয়তের বিধানসমূহকে নিখুঁত ও ত্রুটিমুক্ত করার অন্তর্ভুক্ত!” [সাহীহ মুসলিম, ‘ভূমিকা’, পরিচ্ছেদ- ৫]
৩. ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন, “কোনো ব্যক্তি যদি মন্দ দা‘ঈর গিবত করে এবং নির্দিষ্টভাবে তার নাম ধরে সমালোচনা করে, যাতে মানুষ তার থেকে সতর্ক হয়, তাহলে এতে কোনো সমস্যা নেই। বরং কখনো কখনো এটা তার ওপর ওয়াজিব হয়ে যায়। কারণ এর মাধ্যমে মুসলিমদের ওপর আপতিত বিপজ্জনক বিষয়কে দূরীভূত করা হয়। যেহেতু তারা তার প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়।” [নূরুন ‘আলাদ দার্ব, ১৫৮ নং অডিয়ো ক্লিপ; গৃহীত: সাহাব (sahab) ডট নেট]
৪. ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.] কে ‘উলামা ও তুল্লাবুল ‘ইলম কর্তৃক শরিয়তবিরোধীদের নাম ধরে সমালোচনা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “এক্ষেত্রে মূলনীতি হলো মানুষকে ভুল ও বিপথগামিতা থেকে সতর্ক করা। আর প্রয়োজন দেখা দিলে ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে সতর্ক করতে হবে। কেননা ব্যক্তির দ্বারা মানুষ ধোঁকাগ্রস্ত হয়। বিশেষত যেসব লোকের চিন্তা ও দর্শনে ভ্রষ্টতা রয়েছে, আর (মানুষের মধ্যে) তাদের প্রসিদ্ধি আছে, মানুষ তাদের সম্পর্কে ভালো ধারণা করে, তাহলে সেসব লোকের নাম উল্লেখ করা এবং তাদের থেকে সতর্ক করায় কোনো সমস্যা নেই। ‘আলিমগণ জারাহ (কাউকে মন্দ বলা) ও তা‘দীল (কাউকে ভালো বলা) শাস্ত্রে আলোচনা করেছেন, হাদীস বর্ণনাকারীদের নাম উল্লেখ করেছেন এবং তাদের ব্যাপারে যা বলা হয় তা বলেছেন, অর্থাৎ মন্দ গুণের কথা আলোচনা করেছেন। তাঁরা তা ব্যক্তিগত কারণে বলেননি, বরং উম্মাহ’র নসিহতের জন্য বলেছেন।” [দ্র.: https://m.youtube(ডট)com/watch?v=_DPtrywcDIc (অডিয়ো ক্লিপ)]
এখন কেউ এই সংশয় উত্থাপন করতে পারে যে, বিদ‘আতীদের সমালোচনা করা বিধিসম্মত, কিন্তু আহলুস সুন্নাহর কারও নাম ধরে সমালোচনা করা যাবে না। যেহেতু উস্তায আব্দুর রাযযাক সাহেব মূলত আহলেহাদীস, সেহেতু তার নাম ধরে ভুল ধরা যাবে না। তাহলে এর জবাবে আমি ইমাম রাবী‘ আল-মাদখালী (হাফিযাহুল্লাহ)’র একটি বক্তব্য উল্লেখ করাই যথেষ্ট মনে করছি।
ইমাম রাবী‘ আল-মাদখালী (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫১ হি./১৯৩২ খ্রি.] বলেছেন, “সাহাবীগণ (দ্বীনের জন্য) একে অপরের সমালোচনা করেছেন, একে অপরকে রদ করেছেন। এমনকি মহিলা সাহাবীও সমালোচনা করেছেন। ‘আইশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) সমালোচনা করেছেন, ভুল শুধরিয়ে দিয়েছেন। তিনি সাহাবীদের যে ভুলগুলো শুধরিয়ে দিয়েছেন এবং তাঁদের যে সমালোচনা করেছেন, এ ব্যাপারে গ্রন্থ প্রণীত হয়েছে। গ্রন্থটি যিনি লিখেছেন, তোমরা তাঁকে চেনো। তিনি হলেন (শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ বাদরুদ্দীন) আয-যারাকশী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৯৪ হি.]।
‘উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু)’র সমালোচনা করা হয়েছে। তাঁর সমালোচনা করেছেন সাহাবী ‘ইমরান ইবনু হুসাইন, ‘আলী ইবনু ত্বালিব এবং অন্যান্য সাহাবাবর্গ। ‘উমার (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু)-ও সমালোচনা করেছেন। প্রত্যেকের কথাই গ্রহণযোগ্য হতে পারে, আবার প্রত্যাখ্যাতও হতে পারে। যেমনটি ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন।
ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর শাইখদের সমালোচনা করেছেন, ‘আলিমদের সমালোচনা করেছেন। তিনি জারাহ করেছেন, ভুল শুধরিয়ে দিয়েছেন, (দুর্বল বর্ণনাকারীকে) দ্ব‘ঈফ তথা দুর্বল বলেছেন। এরপর আরও ইমাম এসেছেন, যাঁরা এর ওপরই অব্যাহত ছিলেন এবং এ ব্যাপারে প্রচুর গ্রন্থ লিখে গেছেন।
সমালোচনা হয়ে থাকে লোকদেরকে পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, নির্মল ও বাছাই করার জন্য। কখনো এটা লোকদের যাচাইবাছাই করার জন্য হয়ে থাকে। আবার কখনো তাদের ভুলভ্রান্তি বর্ণনা করার জন্য হয়ে থাকে। ইসলামই এই বিষয়গুলো নিয়ে এসেছে। (মুসলিমের) জানমাল ও মানমর্যাদা হারাম, যেমনটি আমরাও বলে থাকি। কিন্তু যখন কোনো ব্যক্তি মানুষ-হত্যাকারী হয়, বিবাহিত ব্যভিচারী হয় এবং ধর্মত্যাগী দলছুট হয়, তখন (তার) রক্ত (জীবন/জান) হালাল হয়ে যায়। উল্লিখিত বিষয়গুলো মুসলিমের রক্ত হালাল করে দেয়।
একারণে যে ব্যক্তি ভুল করে এবং পথভ্রষ্ট হয়, সে তার ইজ্জতকে (মানমর্যাদা) নষ্ট করে। ফলে তার ভ্রান্তি প্রকাশ করা হবে, কিন্তু (তা হতে হবে) একটি শর্তসাপেক্ষে। আর তা হলো—বক্তব্য হতে হবে নসিহতস্বরূপ, হতে হবে আল্লাহর জন্য। উপদেশদাতার উদ্দেশ্য হবে হককে প্রকাশ করা এবং উম্মাহকে ভ্রান্তি ও পথভ্রষ্টতায় পতিত হওয়া থেকে সতর্ক করা। অবশ্যই এই শর্তগুলো থাকতে হবে।” [ইমাম রাবী‘ (হাফিযাহুল্লাহ), আন-নাক্বদু মানহাজুন শার‘ঈ; পৃষ্ঠা: ৮; মাজমূ‘উশ শাইখ রাবী‘, খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৫০১; দারুল ইমাম আহমাদ, মিশর কর্তৃক প্রকাশিত (সনতারিখ বিহীন)]
·
❏ ভুলের খণ্ডন করা এবং ভুল থেকে ফিরে আসার অনুপম দৃষ্টান্ত:
এখানে আমরা একটি শিক্ষামূলক সত্য ঘটনা উল্লেখ করছি। এই ঘটনায় আহলুস সুন্নাহর মধ্যেও সমালোচনা হওয়ার দৃষ্টান্ত এবং ভুল থেকে ফিরে আসার অবিস্মরণীয় উপমা উল্লিখিত হয়েছে।
একবার ইমাম হামূদ আত-তুওয়াইজিরী কোনো এক ইস্যুতে ইমাম ‘উসাইমীনকে রদ করে বই লিখেন। সেই বই আবার সম্পাদনা করে দেন ইমাম ‘উসাইমীনের ওস্তাদ ইমাম ইবনু বায। পরবর্তীতে ইমাম ‘উসাইমীন ওজর পেশ করেন, ভুল অবস্থান থেকে ফিরে আসেন, এমনকি তিনি যে ফিরে এসেছেন তা ইমাম হামূদের কাছে চিঠি লিখে জানান। তিনি রিকুয়েস্ট করেন, ইমাম হামূদ যেন ওই বইয়ের পরবর্তী সংস্করণে ইমাম ‘উসাইমীনের ফিরে আসার বয়ানটি সংযুক্ত করে দেন। ফলে ইমাম হামূদ পরের সংস্করণে তা যুক্ত করে দেন। এই ঘটনা নিয়ে সালাফী ‘উলামা ও তালাবারা প্রচুর লেখালেখি করেছেন। এই ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়েই ইমাম রাবী‘ (হাফিযাহুল্লাহ) হামূদ, ‘উসাইমীন ও ইবনু বাযকে একত্রে ‘আল-আইম্মাতুস সালাসাহ’ তথা ‘তিন ইমাম’ বলেছেন।
প্রকৃতপ্রস্তাবে কারও ‘আহলেহাদীস’ হওয়া মানেই এই না যে, তার ভয়াবহ ভ্রান্তিকেও এড়িয়ে যেতে হবে। বরং আহলেহাদীসদের নীতি হচ্ছে, হক বলতে হবে এবং বিভ্রান্তির সংশোধন করতে হবে। আর তা করতে গিয়ে কথা কার বিরুদ্ধে গেল, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করা যাবে না। মাওলানা আকরাম খাঁর মতো পোড় খাওয়া ডাকসাইটে আহলেহাদীস নেতাকেও আমরা ছাড় দিইনি। বাংলার আহলেহাদীসদের গর্ব আল্লামা ‘আলীমুদ্দীন নদীয়াভী (রাহিমাহুল্লাহ) বিরচিত গ্রন্থ ‘ইসলামে বিভিন্ন দল ও উহার উৎস’ পড়ে দেখুন। তিনি আকরাম খাঁর ভ্রান্ত ‘আক্বীদাহর তীব্র সমালোচনা করেছেন। এই নীতি যদি আহলেহাদীসদের মধ্যে বহমান না থাকে, তাহলে ‘আহলেহাদীস’ কেবল একটি নামসর্বস্ব লকবেই পরিণত হবে। আল্লাহ আমাদের সুমতি দিন।
·
❏ রদ করার পূর্বে ব্যক্তিগতভাবে জানানো শর্ত:
কোনো শরিয়তবিরোধীর ভুলত্রুটির খণ্ডন করতে চাওয়া হলেই একদল ভাই আপত্তি পেশ করে বলেন, রদ করার আগে তাঁকে ব্যাক্তিগতভাবে জানানো জরুরি, পার্সোনালি নসিহত না করে প্রকাশ্য সমালোচনা করা যাবে না ইত্যাদি। বর্তমানেও কিছু ভাই উস্তায আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফের ক্ষেত্রে এ ধরনের ভুয়ো শর্ত প্রচার করছেন এবং রদকারী ব্যক্তিকে উক্ত শর্ত দিয়ে নসিহত করছেন।
এ ব্যাপারে সত্য কথা এই যে, রদ করার পূর্বে ব্যক্তিগতভাবে জানানোকে স্বয়ং আল্লাহর রাসূল ﷺ জরুরি মনে করেননি এবং সালাফগণও জরুরি মনে করেননি। এ প্রসঙ্গে আমরা ‘রদ করার পূর্বে কি ব্যক্তিগতভাবে জানানো শর্ত’—শিরোনামে বিশদ আলোচনা করেছি। [দ্র.: https://tinyurl(ডট)com/v7dumf8] তারপরও এখানে দুটো ফতোয়া উল্লেখ করছি।
·
১. বিগত শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, আল-মুজাদ্দিদ, আল-ফাক্বীহ, আন-নাক্বিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] প্রদত্ত ফতোয়া—
প্রশ্ন: “এ থেকে কতিপয় লোকের এরকম বক্তব্য বা শর্তারোপ উদ্ভূত হয়েছে যে, কারও রদ (রিফিউটেশন) প্রকাশ করার আগে অবশ্যই রদের একটি কপি যাকে রদ করা হচ্ছে তার কাছে পাঠাতে হবে, তিনি না দেখা পর্যন্ত রদ প্রকাশ করা যাবে না। তারা বলছে, এটাই সালাফদের মানহাজ।”
উত্তর: “এটা শর্ত নয়। কিন্তু যদি সম্ভব হয়, আর এই কর্মপন্থার মাধ্যমে এটাই আশা করা হয় যে, জনসাধারণের মাঝে বিষয়টি না ছড়িয়ে সমঝোতা হোক, তাহলে নিঃসন্দেহে এটা ভালো কাজ। পক্ষান্তরে এটাকে আগে শর্ত বানানো, তারপর এটাকে সার্বজনিক শর্ত বানানো, এগুলো কোনোভাবেই প্রজ্ঞাপূর্ণ কাজ নয়। তোমরা সকলেই জান, মানুষ স্বর্ণ-রৌপ্যের খনিস্বরূপ (যারা ভালো, তারা সবক্ষেত্রেই ভালো)। তুমি যার ব্যাপারে জেনেছ, সে আমাদের সাথে আমাদের মানহাজ ও আদর্শের ওপরেই আছে, আর সে নসিহত গ্রহণও করে, তাহলে তুমি তার ভুল না ছড়িয়ে তাকে চিঠি লিখ। কমপক্ষে তুমি তোমার দৃষ্টিকোণ থেকে এক্ষেত্রে ঠিক আছ। কিন্তু এটা শর্ত নয়। এমনকি এটা যদি শর্তও হতো, তথাপি তা পূরণ করা সম্ভবপর হতো না। তুমি কোথা থেকে তার ঠিকানা জোগাড় করবে? তারপর কীভাবেই বা চিঠি আদানপ্রদান করবে? এরপর তার তরফ থেকে চিঠির জবাব আসবে, নাকি আসবে না? এগুলো পুরোপুরি ধারণানির্ভর ব্যাপার। এই শর্ত বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন। এজন্য এই বিষয়কে শর্ত ধরে নেওয়া যাবে না।” [সিলসিলাতুল হুদা ওয়ান নূর, ৬৩৮ নং অডিয়ো ক্লিপ; গৃহীত: আজুর্রি (ajurry) ডট কম]
·
২. বর্তমান যুগের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, ‘আল্লামাতুল ফাক্বীহ, ইমাম রাবী‘ বিন হাদী বিন ‘উমাইর আল-মাদখালী (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫১ হি./১৯৩২ খ্রি.] প্রদত্ত ফতোয়া—
প্রশ্ন: “শাইখানা, কিছু কথা ছড়ানো হচ্ছে, আর তা সালাফীদের জন্য বিপথগামিতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদল লোক দাবি করছে, কারও থেকে সতর্ক করার আগে তাকে ব্যক্তিগত নসিহত করা ওয়াজিব। শাইখানা, এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?”
উত্তর: “আমি আগেও এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছি। আমরা এ ধরনের লোকদের নিয়ে বিপদগ্রস্ত হয়েছি। তুমি দেখবে, সে ব্যাপকভাবে অন্যদের ব্যাপারে নাম ধরে নানারকম বাতিল কথা, মিথ্যাচার ও রটনা প্রচার করছে। যখন তাকে নসিহত করা হবে, সমালোচনা করা হবে, তখনই সে বলে, তারা আগে আমাকে সতর্ক করল না কেন? তারা আগে আমাকে নসিহত করল না কেন? তারা আগে আমাকে জানাল না কেন? এগুলো হলো বিভ্রান্তিকর আপত্তি। আমরা তাদের কাছ থেকে আশা করব, তারা আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করুক, হকের দিকে ফিরে আসুক, আদব ও বিনয়ের সাথে। আর তারা এসব আপত্তি বর্জন করুক।
আচ্ছা, এ ভুল করেছে, তোমার সাথে কথা বলেনি, তোমাকে নসিহত করেনি। কিন্তু তুমি আগে হকের দিকে ফিরে আস, তারপর তাকে দোষারোপ করো। কিন্তু জনসাধারণের মধ্যে তোমার অনুসরণ করা হচ্ছে, আর তুমি তোমার বাতিল মতবাদ ও ত্রুটিবিচ্যুতির মধ্যেই অবস্থান করছ, আর বলছ, তারা এটা করল না, তারা এটা করল! এগুলো অর্থহীন প্রলাপ। মুমিনদের কর্তব্য হলো, তারা আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করবে এবং প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সব নসিহতই গ্রহণ করবে।
তুমি বইয়ের মধ্যে, আর লেকচারের মধ্যে তোমার ভুল প্রচার করছ! তুমি যদি তোমার ভুল গোপনে রাখ, আর ভুলগুলো অন্ধকারের মধ্যে চর্চা করো, তাহলে সেটা তোমার আর আল্লাহর মধ্যকার ব্যাপার। আর এই লোক যদি তোমার ভুল আবিষ্কার করে ফলে, সে তোমাকে নসিহত করবে। এটা তোমার আর তার ব্যাপার। কিন্তু তুমি জগৎ জুড়ে তোমার (ভুল) কথা ও কাজ প্রচার করছ। এখন কোনো মুসলিম এসে তোমাকে খণ্ডন করল। এতে কোনো শর্তের ব্যাপার নেই। এসব আপত্তি বর্জন করো। যেসব আপত্তি মূলত বাতিলপন্থিদের, যারা বাতিল ও হঠকারিতায় অটল থেকে লাঞ্ছিত হয়েছে।” [“১৪০০ হিজরিতে শাইখ রাবী‘র সাক্ষাৎকার”– শীর্ষক অডিয়ো ক্লিপ থেকে গৃহীত; দ্র.: www.rabee(ডট)net/ar/questions.php?cat=29&id=605]
মুসলিম জনসাধারণের কল্যাণের জন্য স্বয়ং উস্তায আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ সাহেব খারিজীগুরু ওসামা বিন লাদেন, জামাতীদের লিডার আবুল আলা মওদূদী, মুফতি কাজী ইবরাহীম-সহ আরও অনেকের সমালোচনা করেছেন। আমরাও উম্মতের কল্যাণের জন্য আব্দুর রাযযাক সাহেবের শরিয়তগত ভুলত্রুটির সমালোচনা করতে চাই। আমরা এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি বৈ অন্য কিছুর আশা করি না। আমরা যাবতীয় তা‘আসসুব ও গোঁড়ামি থেকে শত ক্রোশ দূরে থাকতে চাই। আল্লাহ আমাদেরকে কবুল করুন।
·
❏ দা‘ঈদের প্রতি গোঁড়ামি রাখার ভয়াবহতা:
অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, শরিয়তবিরোধী ব্যক্তি ও মতবাদের প্রতি গোঁড়ামি রাখার ভয়াবহ ব্যাধি পূর্ববর্তী উম্মতের মধ্যে যেমন ছিল, আরবের মুশরিকদের মধ্যে যেমন ছিল, ঠিক তেমনি যুগে যুগে উক্ত রোগ এই উম্মতের হঠকারী মুসলিমদের মধ্যেও ছিল। আজ অবধি এর ভয়াল থাবা উম্মতের মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর কারণে অসংখ্য লোক ভ্রষ্টতায় পর্যবসিত হয়েছে, অসংখ্য হকপন্থি লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়েছে।
পছন্দের দা‘ঈ বা শাইখের ভুল প্রমাণিত হয়ে যাওয়ার পরেও তা মানতে না চাওয়া, সেই ভুলকে ডিফেন্ড করা চরম গোঁড়ামি। অথচ হক আমার সাথেই থাক, কিংবা আমার বিরোধীর সাথে, আমি হকের সামনে থেমে যেতে এবং তা মেনে নিতে বাধ্য। ইমাম শাফি‘ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ২০৪ হি.] বলেছেন, “আমি যখন কোনো (‘ইলমী) বিতর্কে প্রবেশ করি, তখন হক আমার সাথে থাক চাই আমার প্রতিপক্ষের সাথে থাক, আমি তা গ্রহণ করতে কোনো পরোয়া করি না।” [শাইখ রাবী‘ বিরচিত ‘আত-তা‘আসসুবুয যামীম ওয়া আসারুহু’ পুস্তিকা থেকে সংগৃহীত; গৃহীত: মাজমূ‘উশ শাইখ রাবী‘, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৪৩৩]
মিশরের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, ‘আল্লামাহ হাসান বিন ‘আব্দুল ওয়াহহাব আল-বান্না (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৯২৫ খ্রি.] বলেছেন, “নিশ্চয় কোনো শাইখের প্রতি গোঁড়ামি পোষণ করা এবং তাকে কেন্দ্র করে দলবাজি করা সুফিবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যেই সুফিবাদ হলো রাফিদ্বী শিয়া মতবাদের পোষ্য মতাদর্শ। এই গোঁড়ামি (অভিনবভাবে) শাইখকে তদীয় ভক্ত বা মুরিদের আচরণ, মনন ও বিশ্বাসের নিয়ন্ত্রক বানিয়ে দেয়। কিন্তু আহলুস সুন্নাহর একটি স্বতন্ত্র আদর্শ আছে। ‘(আমাদের আদর্শ হচ্ছে) আল্লাহর দ্বীন; আল্লাহর দ্বীনের চাইতে উত্তম দ্বীন আর কার হতে পারে? আমরা তো কেবল তাঁরই ইবাদত করি।’ (সূরাহ বাক্বারাহ: ১৩৮) আহলুস সুন্নাহর ব্যক্তিবর্গ যেসব শাইখের কাছে ‘ইলম অর্জন করেছে, তাদেরকে সম্মান করে, তাদের সাথে তালিবুল ‘ইলমের আদব বজায় রাখে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, তারা অন্যায়ভাবে তাদের প্রতি গোঁড়ামি করবে।” [আত-তা‘আসসুব লিশ শুয়ূখ, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৩৭]
যারা নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা সংগঠনের প্রতি গোঁড়ামি রাখে, তাদের মধ্যে সুফি ও শিয়াদের বৈশিষ্ট্য আছে। শাইখদের প্রতি সুফিদের অন্ধভক্তি ও গোঁড়ামির স্বরূপ তুলে ধরে ইমাম সালিহ আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) বলেছেন, “সুফিরা আবেদ বা ইবাদতগুজার লোককে ‘শাইখ’ আখ্যা দেয়। এর মানে তাদের তরিকার শাইখ, যেই তরিকার লোকেরা সেই শাইখের কাছ থেকে নিজেদের দ্বীন গ্রহণ করেছে। যে ব্যক্তি উক্ত শাইখের নিকট থেকে স্বীয় দ্বীন গ্রহণ করে, তারা তাকে ‘মুরিদ’ বলে। সে তার শাইখের কাছে গোসলদাতার সামনে মৃতদেহের মতো হয়ে থাকে। কোনো বিষয়ে তার কোনো আপত্তি করার কিছু নেই।... (ওদের কথা অনুযায়ী) শাইখের কাছে তোমাকে বাই‘আত নিতে হবে, এবং নিজেকে তার কাছে সঁপে দিতে হবে। তুমি কোনো আপত্তি ও বিরোধিতা করতে পারবে না, অন্যথায় তুমি আর তার মুরিদ থাকবে না।” [তাফসীরু কালিমাতিত তাওহীদ, পৃষ্ঠা: ১৭; গৃহীত: ইবত্বালুল গুলুউয়িশ শানী‘ ফিশ শাইখ রাবী‘, পৃষ্ঠা: ১৫]
ওই সত্তার কসম, যিনি বীজ থেকে অঙ্কুরোদগম করেন, কোনো হায়াসম্পন্ন আহলেহাদীস নিজের দ্বীনের ব্যাপারে কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সংগঠন ও ভূখণ্ডের প্রতি অন্ধভক্তি ও গোঁড়ামি রাখতে পারে না। যার ফলে সে অন্যায়ভাবে হককে পাশ কাটিয়ে বাতিলকে আঁকড়ে থাকে। সুফি ও শিয়া খবিসদের মতো গোঁড়ামিকে আঁকড়ে ধরার পরিণতি ভালো হয় না। যুগে যুগে আল্লাহ গোঁড়া মুতা‘আসসিবদের দুনিয়াতেই শাস্তি দিয়েছেন। আর পরকালেও তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ আজাব।
অধিকন্তু হক স্পষ্ট হওয়ার পরেও যদি কেউ বিদ‘আত ও কুফরকে ডিফেন্ড করে, সে ব্যক্তি আর আহলুস সুন্নাহয় থাকে না। সুন্নাহর মূলনীতির বিরোধিতা করার কারণে সে আহলুস সুন্নাহ থেকে বের হয়ে যায়। এটা আম সিদ্ধান্ত, যা আহলুস সুন্নাহর মহান ইমামগণ দিয়েছেন। পক্ষান্তরে আহলুস সুন্নাহর নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে বিদ‘আতী ফতোয়া দেওয়ার ব্যাপারটি সতন্ত্র এবং ‘উলামা ও যোগ্য তলাবাদের জন্য নির্দিষ্ট। আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন।
দীর্ঘ ভূমিকার শেষ পর্যায়ে এসে নাবী ﷺ এর নসিহতটি আমিও ব্যক্ত করি, “সাবধান, জনগণের ভয় যেন কোনো ব্যক্তিকে সজ্ঞানে হক বলা থেকে বিরত না রাখে।” [ইবনু মাজাহ, হা/৪০০৭; সনদ: সাহীহ (তাহক্বীক্ব: আলবানী)]
সাইয়্যিদুনা ‘আব্দুল্লাহ বিন মাস‘ঊদ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেছেন, “তোমাদের কেউ যেন নিজের দ্বীনের ব্যাপারে কোনো ব্যক্তির অন্ধ অনুকরণ না করে। ফলে ওই ব্যক্তি ইমান আনলে সেও ইমান আনে, ওই ব্যক্তি কুফরি করলে সেও কুফরি করে। তোমাদেরকে যদি অনুসরণ করতেই হয়, তাহলে মৃত ব্যক্তির অনুসরণ করো। কেননা জীবিত ব্যক্তি কখনোই ফেতনা থেকে মুক্ত নয়।” [মু‘জামুল কাবীর, খণ্ড: ৯; পৃষ্ঠা: ১৫২; হিলইয়াতুল আউলিয়া, খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১৩৪; শারহু উসূলি ই‘তিক্বাদ, পৃষ্ঠা: ১৩০; সনদ: সাহীহ (তাহক্বীক্ব: খালিদ ‘উসমান)]
আর যা না বললেই নয়, আমি মানুষ হিসেবে ভুলের ঊর্ধ্বে নই। আমি লেখার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্ক থাকার চেষ্টা করেছি। তথাপি যদি কোনো ভুল থাকে, তবে তা আমার ও শয়তানের পক্ষ থেকে। আর এতে যা সত্য ও সঠিক রয়েছে, তা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। পরন্তু কোনো সুহৃদ পাঠকের যদি ভুল দৃষ্টিগোচর হয়, তাহলে আমাদেরকে জানালে কৃতজ্ঞ থাকব এবং ভুল শুধরিয়ে নিব, ইনশাআল্লাহ। ‘আমি তো যথাসাধ্য শোধরাতে চাই। কিন্তু আল্লাহর তৌফিকেই কাজ হয়ে থাকে। তাই আমি তাঁরই ওপর ভরসা করি এবং তাঁরই দিকে ফিরে যাই।’ (সূরাহ হূদ: ৮৮)
পরিশেষে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি, ইয়া আল্লাহ, আপনি আমাদের এই লেখায় বরকত দিন। আমার সাথে সাথে সালাফী ভাইদেরকে গোঁড়ামি ও অন্ধভক্তির ব্যাধি থেকে হেফাজত করুন। ইয়া আরহামার রাহিমীন, আপনি আমাদের রদকে অন্ধবিদ্বেষ ও প্রদর্শনেচ্ছার কলুষতা থেকে মুক্ত রাখুন। ইয়া মালিকাল আমলাক, আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাকে মীযানের সওয়াবের পাল্লার জন্য কবুল করে নিন। যেসব ভাই আমাকে তথ্য ও উৎসাহ দিয়ে সাহায্য করেছেন এবং আমার জন্য দোয়া করেছেন, তাঁদেরকেও উত্তম পারিতোষিক দিন। আমীন, ইয়া রাব্বাল ‘আলামীন।
·
সুপথপ্রাপ্তির অভিলাষী
এক গুনাহগার বান্দা—
Md Abdullah Mridha.
·
রচনাকাল—
সকাল ৭ টা ৫১ মিনিট।
সোমবার।
১২ই শাবান, ১৪৪১ হিজরি।
২৩শে চৈত্র, ১৪২৬ বঙ্গাব্দ।
৬ই এপ্রিল, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ।

No comments:

Post a Comment

Download AsPDF

Print Friendly and PDFPrint Friendly and PDFPrint Friendly and PDF
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...