Friday 6 September 2019

নোমান আলি খান কর্তৃক সাহাবিদের উপর অপবাদ ও তার জবাব!


(পর্ব-০২)
নোমান আলী খান নিয়ে আমাদের পেজে যে দুইটি পোস্ট প্রকাশিত হয়েছিল, সেই ব্যাপারে বেশ বিতর্ক হয়েছে, অনেকেই ভিন্ন মত পোষণ করেছেন,কেউবা কমেন্ট বক্সে গালি ছুড়েছেন!
যাহোক, মানুষ ভিন্ন মত পোষণ করতেই পারে। তবে ভিন্নমত পোষণ করলে দলিল সহকারে করা উচিত। সাহাবী-সাহাবিয়াতরা দীর্ঘদিন ধরে একসাথে কো-ওয়ার্ক করেছেন, বিজনেস পার্টনারশিপ করেছেন, একে-অপরকে প্রস্তাব দেওয়ার সময় খুব ক্যাজুয়ালি, “hey, I like you” জাতীয় কথাবার্তা বলেছেন, কিংবা বিয়ের আগে বেশ ভালো সময় নিয়ে “রেসপেক্টফুল কোর্টশিপ” করে মন দেওয়া-নেওয়া করেছেন! এরকম কোনো প্রমাণ কেউ দেয় নি।
একজনকে দেখলাম লম্বা একটা নোট লিখেছেন তাদের কথিত উস্তায কে ডিফেন্ড করতে যিনি লিখেছেন তিনি একাধিক দলিল দিয়ে দুটো বিষয় খুব স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছেন!
১. সাহাবিরা সাহাবিয়াতদের বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন।
২. বিয়ের আগে তারা প্রসপেকটিভ স্পাউস এর চেহারা দেখেছেন।
সমস্যা হচ্ছে, বিতর্ক এই বিষয়ে না। একজন সাহাবী, সাহাবিয়াতকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন, বিয়ের আগে চেহারা ভালো করে দেখে নিয়েছেন, বিতর্ক এটা নিয়ে না। অবশ্যই একজন মুসলিম পুরুষ একজন মুসলিম নারীকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারেন, তার চেহারা দেখে নিতে পারেন, এমনকি তার সাথে কথাও বলতে পারেন। আমি জানিনা তিনি এই দলিলগুলো দিয়ে আসলে কী প্রমাণ করতে চেয়েছেন। বিতর্ক হলো সাহাবিরা সাহাবিয়াতদের সাথে ক্যাজুয়ালি মেলামেশা করেছেন, দীর্ঘ পরিচয় ছিলো, তারপর তারা খুব ক্যাজুয়ালি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন (যেটা জাহিলরা করে থাকে) -- এই কথাগুলো নিয়ে, চেহারা দেখা বা বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার বিষয়ে না।
বিয়ের আগে প্রস্পেকটিভ স্পাউসদের মধ্যে কেমন ইন্টারএ্যাকশন হবে সেটা ইসলামে বেশ স্ট্রিক্ট। যেমন- মাহরামের উপস্থিতিতে কথাবার্তা বলা।
ভাই ও বোনেরা, নিজেদের সাথে সৎ হোন। “নিজেদের মধ্যে চেনাজানা” হওয়া বলতে আমরা যেটা বুঝি, সেটার সুযোগ ইসলামে কি লাগামছাড়া ভাবে আছে? নিজেদের মধ্যে “চেনাজানা” হতে মানুষ আজকাল বছরের পর বছর লাগিয়ে দেয়। মাহরামের সামনে বসে দুই-চার বৈঠকে আর যাই হোক, “চেনাজানা” হয় না। হ্যাঁ, অবশ্যই ইসলাম আপনাকে অনুমতি দেয় আপনি প্রস্পপেক্টিভ স্পাউসের সাথে কথা বলবেন, কিন্তু প্রচলিত সেন্সে “চেনাজানা” হওয়া যেটা বুঝায়, সেটার কাছেধারেও আমরা এমন কোনো কাহিনী সাহাবীদের মধ্যে পাই না। সে যুগটা ছিলো এমন যে “মেয়েদের নীরবতাকেই সম্মতি হিসেবে দেখা হতো।” এই যুগ বদলেছে, তার মানে এই নয় যে ইসলামের নীতিগুলোও বদলে যাবে।
আর অনেকেই বলছেন প্যারেন্টাল গাইডেন্সের কথা। আমরা যখন একটা কথা বলি, তখন আসলে কথাগুলো প্রচলিত সেন্সকে মাথায় রেখেই বলি। আমাদের এই সময়ে যখন ফ্রি-মিক্সিং এর বিষয়টাকে মানুষ খুব স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে, তখন বিয়ের কথা উঠলে প্যারেন্টাল গাইডেন্সটা কেমন হয়? “তোমরা বসে গল্প করো, আমি চা বানিয়ে দিচ্ছি।” এই যদি প্যারেন্টাল গাইডেন্সের স্ট্যান্ডার্ড, আর তারপর যদি বলা হয় “কোর্টশিপ” রেসপেক্টফুল হলে কোনো সমস্যা নাই, তাহলে ফিতনার দরজা কি খুলে যায় না?

আমাদের প্যারেন্টসরা কয়জন ইসলামী নিয়মনীতিগুলো কঠোরভাবে মেনে চলেন যে প্যারেন্টাল গাইডেন্স এর হাতে বিষয়টা তুলে দিয়ে এত সিরিয়াস একটা বিষয়কে হালকা বানিয়ে ফেলা যায়? নোমান আলী খান নিজেই এই লেকচারে অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে নাসিহা দিয়েছে, কেন? কারণ অভিভাবকদের বুঝে সমস্যা আছে, অথচ পরবর্তীতে তিনি নিজেই বিষয়টাকে “প্যারেন্টাল গাইডেন্সের” হাতে ছেড়ে দিলেন, এই পরিস্থিতিতে ইসলামের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করলেন না, পুরো বিষয়টাকে জোকস করে হালকা করে ফেললেন। অথচ প্রশ্নকর্তা খুব স্পষ্টভাবে বিয়ের প্রস্তাবের সময় ইসলামের নীতিমালাগুলোই জানতে চেয়েছিল।
দলিল দেখাতে না পারলেও, অনেকে এমন দাবি করেছেন যে “হেই, আই লাইক ইউ” টাইপ কথা বলা নাকি ওয়েস্টার্ন কালচার, ওয়েস্টার্ন অডিয়েন্সের কথা মাথায় রেখেই উনি এভাবে বলেছেন, এটাতে তারা কোনো সমস্যা পান নি।
দীর্ঘদিন যাবৎ লন্ডনে থাকা এক দ্বীনী বোন বলেছেন- এই লন্ডনের কালচারেও যদি কেউ কাউকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার জন্য “হেই, আই লাইক ইউ” বলে, সেটা আর যা-ই হোক, কোনোভাবেই মার্জিত আচরণ না। কথাটা শুনতে হয়ত “cool” লাগতে পারে, কিন্তু এটা কোনোভাবেই Dignified আর Respectful attitude হিসেবে এখানেও গণ্য হয় না। আর একজন সাহাবী আরেকজন সাহাবিয়াতকে এরকম অসভ্যের মতো প্রপোজ করেছেন এটা চিন্তাই করা যায় না। কারো কাছে যদি এই টাইপ কথাবার্তা খুব “নরমাল” মনে হয়, তাহলে বুঝতে হবে যে, পশ্চিমা নির্লজ্জতার কালচারে সে এতটাই প্রভাবিত হয়ে পড়েছে যে, মার্জিত আচরণ আর শিষ্টাচার কী জিনিস সেটাই সে জানেনা। যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই, এটাই বিদেশী কালচার, তবু শরীয়াহর নিয়ম উরফ বা প্রথার ওপর প্রাধান্য পাবে। অনেকের কথা শুনে মনে হচ্ছে, আমরা যারা বিষয়টার প্রতিবাদ করছি, তারা যেন ইংলিশ ভাষাও ঠিকমতো বুঝি না বা ওয়েস্টার্ন কালচার সম্পর্কে ধারণা নেই।
এই লেকচারে নোমান আলী খান একটা ভয়াবহ আপত্তিকর কথা বলেছেন, যেটা অনেকেরই চোখ এড়িয়ে গেছে। সে বলেছে, “তোমার মেয়েরা যদি ঘরে বসে থাকে, তাহলে কে তাকে পছন্দ করবে?”
এভাবে চিন্তা করে বাংলাদেশের ট্রেডিশনাল কিছু মহিলা। মেয়েকে বিয়ের বাজারে তোলার জন্য তারা মার্কেটে, বিয়েবাড়িতে যাবার আগে ভালো করে একটু সাজিয়ে-গুজিয়ে নেয়, যেন সুপাত্রের “চোখে পড়ে যায়”। সুবহানআল্লাহ, ইসলাম এই কথা কবে বললো, কোথায় বললো, কার মুখ দিয়ে বললো যে মেয়েদের ঘরের বাইরে নিয়ে যেতে হবে যেন পাত্ররা তাদের বিয়ের জন্য পছন্দ করে? মেয়েদের ঘরের বাইরে কাজ করার যে ফেনোমেনা, এটা খুব পুরোনো নয়। তার আগে কি বিয়ে হতো না? আমাদের ট্রেডিশনাল ফ্যামিলিগুলো মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে অনেক অযাচিত বাড়াবাড়ি করে সেটা সত্যি, কিন্তু তার মানে কি এটা, যে বাইরে ছুটে পুরুষদের সামনে ঘুরঘুর করতে হবে?
এই কথার ইমপ্লিকেশন আপনারা কি ভেবে দেখেছেন? মেয়েদেরকে কো-এডুকেশন স্কুলে যেতে হবে, পুরুষ সহকর্মীদের সাথে কো-ওয়ার্ক করতে হবে? এসব না করলে তার বিয়ে হবে না? আগে জানতাম, প্রয়োজন ছাড়া মেয়েদের ঘরের বাইরে কাজ না করাই উত্তম, এখন দেখছি বিয়ের বাজারে নিজেকে ওঠানোর জন্য কো-ওয়ার্কিং শুরু করতে হবে! সুবহান আল্লাহ, যখন প্রয়োজন ছিল কো-ওয়ার্কের ফিতনা থেকে বোনদের সতর্ক করা, যখন দরকার ছিল বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রীর “চেনাজানার” নামে যতো প্রেম-প্রীতি হয়, ফিতনা হয়, সেসবের ব্যাপারে বেশি বেশি সতর্ক করা, সেসব না করে নোমান আলী খান এটা কীসের লাইসেন্স দিলেন? ঘরের বাইরে কাজ করো, সহকর্মীদের সাথে পরিচিত হও, কথা বলো, সময় নিয়ে কোর্টশিপ করো -- এটাই কি ইসলাম শিক্ষা দেয় নারীদের?
নোমান আলী খানের ভালো ভালো কাজকে আমরা অস্বীকার করছি না। কেনই বা করব, যখন আমি নিজে তার লেকচার দিয়ে উপকৃত হয়েছি। আমার জীবনের ইসলামের সূচনা যাদের হাত দিয়ে আল্লাহ করেছেন তাদের মধ্যে এই নৌমান আলী খান একজন। কিন্তু আমার ভালোবাসা, আমার আলটিমেট লয়ালটি দ্বীনের প্রতি, ব্যক্তি নৌমান আলী খানের প্রতি নয়। কোনো মুসলিমই কোনো ব্যক্তিকে দ্বীনের ঊর্ধ্বে স্থান দিতে পারে না।
আমরা নবী ও সাহাবিদের ব্যাপারে খুব সাবধানে কথা বলি। মূসা আলাইহিস সালামের স্ত্রী মূসাকে পছন্দ করেছিলেন -- এরকম কোনো উক্তি আজ পর্যন্ত কোনো মুফাসসির করেছেন বলে আমার জানা নেই। যদি পছন্দ করেও থাকেন, আমি নিশ্চিত, শুধুমাত্র সম্মান আর মর্যাদার কথা মাথায় রেখে কোনো মুফাসসির এই ধরণের একটা অনুমান করা থেকে বিরত থেকেছেন। আর সেখানে নোমান আলী খান কুরআনের আয়াত থেকে এই ব্যাখ্যা পেলেন কোথায়? তবুও যদি ভদ্রতা আর সৌজন্যবোধ বজায় রেখে কথাটা বলতেন, তাহলে একটা কথা ছিলো। একজন নবীর স্ত্রীর ব্যাপারে এত ক্যাজুয়ালি কথা বলা কি আল্লাহর রাসূল আমাদের শিখিয়েছেন? He’s kinda a nice guy -- এটা কোন ধরণের সম্মান? কী প্রয়োজনই বা ছিলো তাঁর ব্যাপারে এই টোনে কথা বলার? হাততালি আর হাসির রোল ছাড়া কী মিলেছে? ওয়েস্টের মুসলিমরা কি এতোই বুদ্ধিহীন যে নবী আর সাহাবাদের ব্যাপারে কথা বলার সময়ও ফানিভাবে কথা বলতে হবে? অভিনয় করে করে দেখাতে হবে?
সময়ের সাথে সাথে আমরা নোমান আলী খানকে একটু একটু করে বদলে যেতে দেখেছি। তার একটা লেকচারের দুটো লাইন শুনে বা একাংশ শুনেই আমরা তার সমালোচনা করি নি। ফ্রি মিক্সিং একটামাত্র ইস্যু না। এরকম আরো অনেক কিছুই আছে। যখন কোনো দ্বীনের দায়ীর কাছ থেকে এই ধরণের ভুল বার বার হতে থাকে, আর ভুলের মাত্রা বাড়তেই থাকে, সেটা তার অজ্ঞানতার কারণে হোক, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক, সেই বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করাটা গীবতের পর্যায় পড়ে না, বরং দায়িত্ব-কর্তব্য হয়ে যায়। যারা ইসলামের এলিমেন্টারি লেভেলটা শেষ করেছেন, তারা খুব ভালো করেই জানেন কখন গীবত করা হালাল হয়। দুঃখজনক ভাবে, অনেককেই দেখা যায়, অপছন্দের ব্যক্তির বিরুদ্ধে দেদারসে কথা বলে যাচ্ছে, আর পছন্দের ব্যক্তির বিরুদ্ধে কথা শুনলেই শোরগোল তুলতে থাকে “গীবত, গীবত করে!”
অন্যের অনুপস্থিতিতে তার দোষ বা ভুল বর্ণনা করা কখন প্রয়োজনীয় বা অনুমোদিত হয়ে যায়, সেটা জানতে চাইলে সোজা চলে যান ইমাম নববীর (রাহিমাহুল্লাহ) বিখ্যাত বই রিয়াদুস স্বলেহীনে। সেখানে ক্যাটাগরি উল্লেখ করে বিষয়টা আলোচনা করেছেন।
হাদীস শাস্ত্রের একটা বড় অংশই হচ্ছে বর্ণনাকারীদের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা নিয়ে। সেখানে একজন দাঈ প্রকাশ্যে ভুল করলে, তার সমালোচনা করা যাবে না, এটা হতে পারে না। এই সমালোচনা ব্যক্তি-আক্রমণ নয়, বরং এটা দ্বীনের জন্য জরুরি। নোমান আলী খানের ব্যাপারে একাধিক আলেম ও শাইখ সমালোচনা করেছেন, সতর্ক করে দিয়েছেন। এমনকি নোমান আলী খানকে অনেকে ব্যক্তিগত ভাবে নাসীহা দিয়েছেন।
শেষ কথা,
বিয়ের আগে ফ্রি-মিক্সিং, চ্যাটিং ইত্যাদি এই ইস্যুগুলো নিয়ে আলিমগণের বিস্তারিত আলোচনা আছে, এবং তারা স্পষ্ট করেছেন যে বিয়ের আগে নারী ও পুরুষের মেলামেশায় নির্ধারিত সীমা আছে। যেই কাহিনীর কথা (মুসা আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম এর বিয়ে) এই লোক বা তার মতো অন্যান্যরা বলছে আলিমরা সেটা সম্পর্কে অনবহিত ছিলেন, এমন না।”
আমরা কেন নোমান আলী খানের সমালোচনা করছি, সে বিষয়ে যদি কেউ আন্তরিকভাবে জানতে চান, তাদের জন্য দুটো ভিডিও লিংক দেবো (কমেন্ট দ্রষ্টব্য)। আশা করি এটার জন্য সময় খরচ করার মানসিকতা তাদের আছে। ভিডিওটা শাইখ আবু মুসসাব ওয়াজদি আল আক্কারির। তিনি নিজেই একসময় নোমান আলী খানের লেকচার শোনার জন্য মানুষকে উৎসাহ দিতেন। পরবর্তীতে তিনি তার ভুলগুলো দেখে তাকে ব্যক্তিগত ভাবে পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ফোনে কথা বলেছেন। কিন্তু এরপরেও কোনো সমাধান না হওয়ায় উম্মাহকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যে কিছু কথা সরাসরি বলা জরুরি মনে করেছেন।
সবশেষে এটাই বলব, জীবিত মানুষ মাত্রই ভুল করতে পারে, কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। আর নোমান আলী খানের মত এত পরিচিত একজন দায়ী, যার লক্ষ লক্ষ অডিয়েন্স, সে যদি ইসলামের বেসিক বিষয়গুলো নিয়ে বার বার ভুল করতে থাকে, তাহলে সাবধান হতে হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহর দ্বীনের চাইতে দামী আর কিছুই নেই।
#সুন্নাহর_পথযাত্রী

No comments:

Post a Comment

Download AsPDF

Print Friendly and PDFPrint Friendly and PDFPrint Friendly and PDF
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...