Wednesday 13 March 2019

কষ্টিপাথরে ব্রাদারহুড, ইখুয়ানুল মুসলিমীনের (জামাতী ইসলামী) ব্যাপারে সালাফী আলেমদের ফতোয়া। পর্ব-০২

 ‘আল্লামাহ মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহেল কাফী আল-কুরাইশী (রাহিমাহুল্লাহ)
·Image may contain: text
শাইখ পরিচিতি:
‘আল্লামাহ মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহেল কাফী আল-কুরাইশী (রাহিমাহুল্লাহ) সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) একজন প্রখ্যাত সালাফী দা‘ঈ ও বিদ্বান ছিলেন। তাঁর জন্ম পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার টুবগ্রামে ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি পিতার নিকট ফারসি ও আরবির প্রারম্ভিক শিক্ষালাভ করেন। তারপর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আব্দুল্লাহেল বাকীর কাছে পারিবারিক মাদরাসায় আরবি ও ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়নের পর তিনি কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় অ্যাংলো-পারসিয়ান বিভাগ হতে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সেন্ট জেভিয়ারস কলেজে বি.এ. ক্লাসে অধ্যয়নকালে খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাবে উপমহাদেশ শোষণকারী সাম্রাজ্যবাদী ধবল দস্যুদের প্রবর্তিত শিক্ষা বর্জন করে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মাওলানা আকরাম খাঁর উর্দু দৈনিক ‘যামানা’র সম্পাদনা বিভাগে যোগদান করেন এবং খণ্ডকালীন সম্পাদকেরও দায়িত্ব পালন করেন।
১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি “জাম‘ইয়াতু ‘উলামা-ই বাঙ্গালা” প্রতিষ্ঠানের সহ-সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯২৪ সালের ডিসেম্বরে তিনি নিজ সম্পাদনায় সাপ্তাহিক ‘সত্যাগ্রহী’ প্রকাশ করেন। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে হোসেন সোহরাওয়ার্দীর সহকারীরূপে তিনি ইনডিপেন্ডেন্ট মুসলিম পার্টির সংগঠন কার্যে আত্মনিয়োগ করেন। একই সাথে তিনি সারা বাংলায় জালসা ও ধর্মসভাগুলোতে জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতার মাধ্যমে ক্বুরআন-সুন্নাহ’র বাণী প্রচার এবং শির্ক ও বিদ‘আতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যান।
১৯৪৬ সালে রংপুরের হারাগাছ বন্দরে তিনি নিখিল বঙ্গ ও আসাম-আহলে হাদীস কনফারেন্সে গঠিত “নিখিল বঙ্গ ও আসাম জমঈয়তে আহলে হাদীস” এর সভাপতি নির্বাচিত হন। জমঈয়তের দফতর স্থাপিত হয় কলকাতার মিসরীগঞ্জে। ১৯৪৮ সালে দফতর পাবনা শহরে স্থানান্তরিত হলে সংগঠনের নাম হয় “পূর্ব পাকিস্তান জমঈয়তে আহলে হাদীস”। তাঁরই প্রচেষ্টায় ১৯৪৯ সালে “আল হাদীস প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিশিং হাউজ” নামে জমঈয়তের নিজস্ব একটি মুদ্রণালয় ও প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয় এবং একই সালে জমঈয়তের মুখপাত্ররূপে তাঁর সুুযোগ্য সম্পাদনায় মাসিক ‘তর্জুমানুল হাদীস’ আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৫৬ সালের শেষের দিকে জমঈয়তের দফতর ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। ১৯৫৭ সালের ৭ই অক্টোবর তাঁর সম্পাদনায় সাপ্তাহিক ‘আরাফাত’ আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৫৮ সালে তাঁরই উদ্যোগে ঢাকাস্থ নাজিরাবাজারে ‘মাদরাসাতুল হাদীস’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
ইসলামী বিষয়ে বিভিন্ন ভাষায় তাঁর রচিত (প্রকাশিত-অপ্রকাশিত) অর্ধ শতাধিক গ্রন্থ রয়েছে। তাঁর জীবনব্যাপী ইসলামী সাহিত্য সাধনা ও গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬০ সালে বাংলা একাডেমি তাঁকে সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করে। তিনি ১৯৬০ সালের ৪ঠা জুন পরলোকগমন করেন। আল্লাহ এই নির্ভীক সিপাহসালারকে উত্তম প্রতিদান দান করুন এবং তাঁকে সর্বোচ্চ জান্নাতে দাখিল করুন। আমীন। সংগৃহীত: ‘আল্লামাহ মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহেল কাফী আল-কুরাইশী (রাহিমাহুল্লাহ), ফিরকাবন্দী বনাম অনুসরণীয় ইমামগণের নীতি; পৃষ্ঠা: ৬; তৃতীয় সংস্করণ (জুন, ২০০৬ খ্রি.)।
·
‘আল্লামাহ কুরাইশীর বক্তব্য:
বাংলাদেশে আহলেহাদীস আন্দোলনের অগ্রবর্তী সেনানায়ক প্রথিতযশা সাহিত্যিক সাবেক পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) জমঈয়তে আহলে হাদীসের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আশ-শাইখ আল-‘আল্লামাহ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহেল কাফী আল-কুরায়শী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৯৬০ খ্রি.] প্রণীত একটি ঐতিহাসিক পুস্তিকার নাম—‘একটি পত্রের জওয়াব’। এই পুস্তিকায় ‘আল্লামাহ কুরাইশী পাক-ভারত উপমহাদেশে মুসলিম ব্রাদারহুডেরই নব্যরূপ জামায়াতে ইসলামীর মতাদর্শ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
১৯৫৭ সালে গাইবান্ধার জনৈক আহলেহাদীস মৌলবি সাহেব ‘আল্লামাহ কুরায়শীকে জামায়াতে ইসলামীতে যোগদানের উপদেশ খয়রাত করে একটি পত্র লিখেছিলেন। যার জবাবস্বরূপ ‘আল্লামাহ কুরায়শী তাঁর সম্পাদিত মাসিক তর্জুমানুল হাদীসে দুটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন।
তর্জুমানের ৭ম বর্ষ ৩য় সংখ্যার (ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৭) ১৪৩-১৪৮ পৃষ্ঠায় এবং ৬ষ্ঠ বর্ষ ১ম সংখ্যার (শ্রাবণ, ১৩৬২) ৪১-৪৫ পৃষ্ঠায় প্রবন্ধ দুটি প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তীতে ‘যুবসংঘ প্রকাশনী’ (রাণীবাজার, রাজশাহী) ১৯৯৩ সালের মার্চে প্রবন্ধ দুটি পুস্তক আকারে প্রকাশ করে। আমি ‘যুবসংঘ প্রকাশনী’ কর্তৃক প্রকাশিত পুস্তিকাটি থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ অবিকৃতরূপে হুবহু পেশ করার প্রয়াস পাব, ইনশাআল্লাহ।
আশ-শাইখ আল-‘আল্লামাহ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহেল কাফী আল-কুরায়শী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন—
১. পত্রলেখক বলিতে চাহিয়াছেন, এইরূপ অন্ধকার পরিবেশে তিনি অকস্মাৎ আলোকের সন্ধান পাইলেন। পাক পাঞ্জাবের সামরিক আদালত মওলানা মওদুদীকে ফাঁসীর হুকুম দেওয়ায় দেশব্যাপী যে আন্দোলন সৃষ্টি হইয়াছিল এবং পূর্ব পাকিস্তান জমঈয়তে আহলেহাদীছের মুখপাত্র “তর্জুমানের পৃষ্ঠায় সম্পাদকের জোরাল মুক্তি দাবী” দর্শন করিয়া এবং তর্জুমান সম্পাদকের কাঁদ কাঁদ সুরে “মওদুদীকে বর্তমান যুগের মুজাদদিদ বলা চলে” শ্রবণ করিয়া এবং পাঞ্জাবের কারাগারে অন্যান্য বর্ষীয়ান উলামার লাঞ্ছনার বিবরণ অবগত হইয়া তিনি মওদুদী ছাহেবের আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হইয়া পড়িলেন।
আমার বক্তব্য এই যে, কোন ব্যক্তি ফাঁসীর আসামী হইলে এবং তজ্জন্য দেশে তোলপাড় ঘটিলেই তাঁহার প্রবর্তিত দলে প্রবেশ করিতে হইবে এবং নিজের জামাআতকে পরিত্যাগ করিতে হইবে এরূপ কথা আলেম দূরে থাক, সাধারণ বুদ্ধি বিবেচনা সম্পন্ন লোকও উচ্চারণ করিতে পারে না। (পৃ. ৭-৮)
২. মওলানা মওদুদীকে আমি মুজাদদিদ বলিয়াছি এরূপ কথা আমি স্মরণ করিতে অসমর্থ। আর কেহ মুজাদদিদ হইতে পারে; এরূপ সম্ভাবনা এমনকি নিশ্চয়তা প্রদান করিলেই যে তাঁহাকে ইমামতের একচ্ছত্র সিংহাসন প্রদান করিতে হইবে, ইহাও মূর্খতাব্যঞ্জক উক্তি। (পৃ. ৮)

৩. পত্রলেখকের উক্তিতে প্রমাণিত হয় যে, মুছলমানদের বা আহলেহাদীছের বর্তমান সংকটপূর্ণ অবস্থায় কর্তব্য কী, (এ নিয়ে) তিনি তাঁহার দিশা হারাইয়াছিলেন, মওদুদী ছাহেবের পুস্তকগুলি তাঁহাকে চক্ষুদান করিয়াছে। উত্তম কথা! কিন্তু কোরআন হাদীছ যখন তাঁহাকে পথের সন্ধান দিতে পারে নাই, তখন মওদুদী ছাহেবের পুস্তক তাঁহাকে যে সঠিক পথেরই সন্ধান দিয়াছে, এ বিষয়ে তিনি কৃতনিশ্চয় হইলেন কেমন করিয়া? বিশেষতঃ আহলেহাদীছদের কর্তব্য কী, তাহাই বা মওদুদী ছাহেব জানিলেন কিরূপে? তিনি আহলেহাদীছ আন্দোলনকে যদি সঠিক ও সত্য জানিতেন তাহা হইলে তিনি স্বয়ং আহলেহাদীছ দলের অন্তর্ভুক্ত হইয়া তাহাদের আন্দোলনকে জোরদার করিতে চেষ্টিত হইতেন না কি? এই আন্দোলনে তাঁহার আস্থা নাই বলিয়াই কি তিনি একটি স্বতন্ত্র আন্দোলন শুরু করেন নাই? যে ব্যক্তি আহলেহাদীছ মতবাদকে বিশ্বাস করেন না, তাঁহার নেতৃত্ব কোন ঈমানদার ও হায়া সম্পন্ন আহলেহাদীছের পক্ষে স্বীকার করা ও তাঁহার আন্দোলনে যোগ দেওয়া কি সম্ভবপর? (পৃ. ৯-১০)
৪. ‘দ্বীনের প্রতিষ্ঠা’ ও ‘বিভেদের পরিহার’, সম্পর্কে পত্র লেখক তাঁহার দলের ‘মটো’ স্বরূপ ছুরত আশ্ শূরার যে আয়াত [সূরাহ শূরা’র ১৩ নং আয়াত – সংকলক] উদ্ধৃত করিয়াছেন, আমি মনে করি, হয় তিনি ইহার অর্থ অবগত নন, অথবা তাঁহার দলপরস্তীর নূতন দীক্ষা তাঁহার চক্ষু অন্ধ করিয়া দিয়াছে।
حبك الشيء يعمى ويصمّ
কোন বস্তুর অতিরিক্ত অনুরাগ যে মানুষকে অন্ধ ও বধির করিয়া ফেলে, ইহাই তাহার জ্বলন্ত প্রমাণ। আমি মওলবী ছাহেবকে হুশিয়ার করিয়া দিতে চাই যে, দুনিয়ার পিঠে কেবল তিনি ও তাঁহার জামাত ইকামতে দ্বীনের ঠিকা গ্রহণ করিয়াছে, যতশীঘ্র সম্ভব, এই অলীক ধারণা তাঁহার স্বীয় মস্তক হইতে বিদূরিত করা উচিত, আর তাঁহার চিন্তা করা উচিত তিনি এবং তাঁহার জামাতই মুছলিম সংহতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করিতেছে, না যাহারা স্ব স্ব সীমানার ভিতর থাকিয়া সাধ্যপক্ষে দ্বীনের সেবা করিয়া যাইতেছে, তাহারাই বিভেদ সৃষ্টিকারী? (পৃ. ১০-১১)
৫. তাঁহার জানিয়া রাখা উচিত যে, শিরক ও কুফরের বিরুদ্ধে পাক-ভারত উপমহাদেশে আহলে হাদীছগণ যে জদ্দ ও জিহাদ চালাইয়া আসিয়াছেন, আর আজও তাঁহাদের আপামর জনসাধারণ কুফর ও শিরক হইতে যতটা দূরে সরিয়া আছেন, তাহার দৃষ্টান্ত বিরল। তওহীদের শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য আহলেহাদীছগণ মওলানা মওদুদী ও তদীয় জামাতের আদৌ মুখাপেক্ষী নয়। প্রকাশ্যে শিরক ও কুফরের বিরুদ্ধে এই দলের আমীর আজ পর্যন্ত কী সংগ্রাম করিয়াছেন, পাক ভারতের আহলে হাদীছগণ তা অবগত নন। (পৃ. ১১)
৬. আমি মনে করি, এই দুষ্ট মনোভাবের জন্যই ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্গত মধ্য প্রদেশের মওলানা আব্দুল মাজেদ দরইয়াবাদী প্রমুখ বিদ্বানগণ মওদুদী আন্দোলনকে ‘খারেজী আন্দোলন’ বলিয়া অভিহিত করিয়া থাকেন। (প্রাগুক্ত)
৭. জামাতে ইছলামীতে সকল দলের মিলিত হইবার সুযোগ রহিয়াছে, এ কথা সম্পূর্ণ অলীক। মওদুদী ছাহেব ইছলামের যে ব্যাখ্যা দিয়া থাকেন, তাহাতে দীক্ষিত না হওয়া পর্যন্ত এবং তাঁহাকে একচ্ছত্র নেতা স্বীকার না করা পর্যন্ত জামাতে ইছলামীর দ্বার সকল মুছলমানের জন্য রূদ্ধ। (পৃ. ১২)
৮. আহলেহাদীছগণ বুখারীর সমুদয় মর্ফূ ও মুছনদ হাদীছকে অকাট্য বলিয়া বিশ্বাস করেন, তাঁহারা প্রমাণিত খবরে আহাদকে অবশ্য প্রতিপালনীয় মনে করেন। ফকীহদের আসন মোহাদ্দেছীন অপেক্ষা উন্নত মনে করেন না। কোন হাদীছ প্রমাণিত বলিয়া সাব্যস্ত হইলে কোন নির্দিষ্ট ইমাম উহা অনুসরণ করার অনুমতি না দিলেও উক্ত হাদীছের অনুসরণ ওয়াজিব জানেন। এই বিষয়গুলি মৌলিক না ফরূআত? জামাতে ইছলামীর নেতা উল্লিখিত বিষয়গুলির একটিও মানেন না। এমন কি জানিয়া শুনিয়া হাদীছ প্রত্যাখ্যানকারীকে অনেক ক্ষেত্রে তিনি নিরপরাধ বলিয়াছেন। (প্রাগুক্ত)
৯. অন্ধভক্তির পরিবর্তে মওদুদী ছাহেবের মাসিক তর্জুমানুল কোরআন এবং ইমাম বুখারী সম্পর্কে লিখিত তাঁহার সাম্প্রতিক প্রবন্ধগুলি, যাহা তাঁহার নিজস্ব মাসিক ও দলীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক উর্দু কাগজগুলিতে প্রকাশিত হইয়াছে, পাঠ করিতে পারিলে আমার উক্তির সত্যতা সহজেই হৃদয়ংগম হইবে। প্রয়োজন হইলে আমিও আমার উক্তির যথার্থতা প্রতিপন্ন করিতে রাযী আছি।
তাঁহার (মওদূদীর) প্রাথমিক লেখাগুলি পাঠ করিয়াই তীক্ষ্ণ ধ্বীশক্তি সম্পন্ন মরহুম আল্লামা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী স্বীয় প্রতিভাবলে যাহা ভবিষ্যদ্বানী করিয়াছিলেন, আহলেহাদীছগণ তাহাও পাঠ করিয়া দেখিতে পারেন। পাঞ্জাব গোজরানওয়ালার মাওলানা মোহাম্মদ ইছমায়ীল ছলফী, যিনি হারাগাছ আহলেহাদীছ কনফারেন্সেও উপস্থিত ছিলেন, “হাদীছ সম্পর্কে জামাতে ইছলামীর দৃষ্টিভঙ্গি (জামা‘আতে ইসলামী কা নাযরিয়াতে হাদীছ)” নামেও একটি মূল্যবান পুস্তিকা রচনা করিয়াছেন। (পৃ. ১২-১৩)
১০. ফলকথা মওলানা আবুল আলা মওদুদী আর যাহাই হউন, আহলেহাদীছ নন এবং আহলেহাদীছদের সাথে তাঁহার যে মতভেদ, তাহা খুঁটিনাটি নয়, অছুলেদ্বীনের মতভেদ। (পৃ. ১৩)
১১. যতদিন পর্যন্ত তাঁহার [মওদূদী সাহেবের – সংকলক] মস্তকে দলীয় পার্লামেন্টারী কার্যক্রমের অভিসন্ধি প্রবেশ করে নাই, ততদিন পর্যন্ত তাঁহার সাহিত্য সাধারণভাবে মনোজ্ঞই ছিল, কিন্তু দলপরস্তি ও ফ্যাসিষ্টিক স্বৈরভাব সৃষ্টি হওয়ার পর হইতে তাঁহার লেখনী তার পূর্বকার শক্তি হারাইয়া ফেলিয়াছে। (পৃ. ১৩-১৪)
১২. পত্রলেখক আমাকে জামাতে ইছলামীতে দীক্ষা গ্রহণ করার জন্য যে আমন্ত্রণ জানাইয়াছিলেন, তজ্জন্য অশেষ ধন্যবাদ! আমার পক্ষে এবং কোন আহলেহাদীছের পক্ষে এ আমন্ত্রণ স্বীকার করার উপায় নাই কেন, তাহার জওয়াব দিতে গিয়া তর্জুমানের কয়েক পৃষ্ঠাই নিঃশেষিত হইল।... অতএব কোন আহলেহাদীছের পক্ষে ইহার [কোন আহলেহাদীছ সংগঠনের – সংকলক] ত্রুটি বিচ্যুতির জন্য আহলেহাদীছ জামাআত পরিত্যাগ করা এবং অন্য জামাতে ভর্তি হওয়া অবৈধ ও অন্যায়। (পৃ. ১৪)
১৩. ইছলামের মহাসাগর তীর্থেই সকল ভেদ ও বৈষম্যকে জলাঞ্জলী দিয়া মুছলমানগণ একাত্মা হইয়াছেন, আর এই জন্যই কোন দলই ইছলামে একচেটিয়া অধিকারী দাবী করার স্পর্ধা কোন কালেই প্রকাশ করে নাই। কিন্তু এই তথাকথিত ইছলামী জামাআতের স্পর্ধা যে, যে মানুষটিকে কেন্দ্র করিয়া তাঁহাদের এই ফির্কা গজাইয়া উঠিয়াছে, কেবল সেইটিই হইতেছে “ইছলামী জামাআত”। এরূপ অভিমানের নযীর ইছলামের ধর্মীয় আন্দোলনের ইতিহাস হইতে খুঁজিয়া বাহির করা দুঃসাধ্য। (পৃ. ১৯)
১৪. আমরা দেখিতে পাইতেছি যে, মওলানা ছৈয়েদ আবুল আলা মওদুদী নামক ব্যক্তি এবং তাঁহার নিকট দীক্ষিত কতিপয় বিদ্বান ও অবিদ্বানের অভিমত ও উক্তিগুলিই ইছলামী জামাআতের সিন্ধান্ত নামে কথিত হইয়াছে। তাঁহাদের আমীরে আলার “তাজদীদে দ্বীন” শীর্ষক নিবন্ধে পূর্বেও প্রদর্শিত হইয়াছিল যে, ইছলামের প্রাথমিক যুগ হইতে আজ পর্যন্ত সমগ্র ইছলামের উন্নয়ন ও প্রতিষ্ঠাদানের আন্দোলন কোন ইমাম, মুজতাহিদ, ফকীহ, মুহাদ্দিছ, ওলী, সাধক, রাষ্ট্রপতি ও মুজাদ্দিদ কেহই সৃষ্টি করিতে পারেন নাই। ইছলামের তেরশত বৎসরের ইতিহাসে সামগ্রিকভাবে ইছলামকে বুঝিবার ও বুঝাইবার উপযোগী যোগ্যতা ও ত্যাগের মহিমা একমাত্র তথাকথিত ইছলামী জামাআতের নেতারাই অর্জন করিয়াছেন।
এই ফির্কার ইমামে আযম তাঁহার দীর্ঘ কারাবাস হইতে মুক্ত হইয়া সম্প্রতি শেখুপুরায় যে বক্তৃতা প্রদান করিয়াছেন, তাহাতেও তাঁহার সেই পুরাতন দাম্ভিকতার প্রতিধ্বনি সমানভাবেই বিঘোষিত হইয়াছে। তিনি বলিতে চাহিয়াছেন, ধর্মের ও জাতির সেবার কার্য তাঁহার দলটি ব্যতীত অন্য কোন সংঘ, পার্টি বা সমাজ কিছুমাত্র সমাধা করেন নাই। (পৃ. ১৯-২০)
১৫. তাঁহার এই দাম্ভিকতার অনস্বীকার্য প্রমাণস্বরূপ তিনি বুঝাইতে চাহিয়াছেন যে, একমাত্র তাঁহারাই সরকারী কোপে পতিত হইয়াছেন। লাঞ্ছনা ও কারাবাসকে প্রোপাগান্ডার বিষয়বস্তুরূপে প্রয়োগ করা ইছলামী আদর্শের সহিত কতদূর সুসমঞ্জস এবং এই বিবৃতির সত্যতাই বা কতটুকু, তাহার আলোচনা না করিলেও কার্য ও কারণের মধ্যে যে গভীর যোগাযোগের সন্ধান মওলানা ছৈয়েদ আবুল আলা প্রাপ্ত হইয়াছেন, ন্যায় শাস্ত্রের ছাত্রগণ তাহা উপলব্ধি করিয়া যে চমৎকৃত হইবেন, তাহাতে সন্দেহের অবকাশ নাই। (পৃ. ২০)
১৬. ইছলামী জামাআতের লেখক এবং নেতৃবৃন্দের অহমিকতা এই খানেই সমাপ্ত হয় নাই। মওলানা ছৈয়েদ আবুল আলা মওদুদী বারংবার বিনা কারণে এই ধৃষ্ট উক্তিও ঘোষণা করিয়া বেড়াইতেছেন যে, ইছলাম জগতে কোরআনের পরবর্তী সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ ও মাননীয় গ্রন্থ ছহীহ বুখারী প্রমাদবিহীন পুস্তক নয়। এযাবত তিনি বুখারীর কোন সংশোধিত সংস্করণ প্রকাশ করেন নাই, অথবা উক্ত গ্রন্থে তিনি যেসকল প্রমাদের সন্ধান লাভ করিয়াছেন, উল্লেখ সহকারে সেগুলির প্রমাণ প্রদর্শন করিতেও সক্ষম হন নাই।
সর্বোপরি বর্তমান সময়ে যখন কোরআন ও ছুন্নতের প্রামাণিকতা ও বিশ্বস্ততা সম্পর্কে হাদীছ বৈরীগণ নানারূপ সন্দেহ ও দ্বিধার জাল বুনিতে চেষ্টা করিতেছে, ঠিক সেই অবাঞ্ছিত মুহূর্তে মওলানা মওদূদী ছাহেবের ছহীহ বুখারীর বিরুদ্ধে বিষোদগারের হেতুবাদ কী? (পৃ. ২০-২১)
১৭. ইছলামী জামাআতের হঠকারিতা, সংকীর্ণতা এবং হাদীছ বিরোধী মনোবৃত্তির ফলে পাঞ্জাবের অনেক আলিম, যাহারা উহার প্রতি সহানুভূতিশীল এমনকি উহার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, শুধু আহলেহাদীছ থাকার অপরাধেই উক্ত দল বর্জন করিতে বাধ্য হইয়াছেন। ইছলামী জামাআতের নেতা এবং তাঁহার অন্ধ ভক্তের দল মুসলিম জনসাধারণ এবং তাঁহাদের নেতৃবর্গকে যেরূপ নির্মম, নিষ্ঠুর ও অভদ্রোচিত ভাবে অহরহই আক্রমণ করিয়া থাকেন, তাহার ফলে বিদ্বানগণের অন্তঃকরণ উক্ত জামাআতের বিরুদ্ধে বিষাক্ত হইয়া উঠিয়াছে। (পৃ. ২১-২২)
১৮. সম্প্রতি এই দলটি তাঁহাদের বহু বিশ্রুত নীতি নৈতিকতার মাথা খাইয়া বিগত বন্যা প্লাবিত অঞ্চলে তাঁহাদের বিতরিত সাহায্যের বিনিময়ে অজ্ঞ জনসাধারণকে তাঁহাদের দলে ভিড়াইবার চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করিয়াছেন। (পৃ. ২২)
·
আমি (সংকলক) বলছি, কতিপয় লোক নিজেদেরকে জমঈয়তের দিকে সম্পৃক্ত করা সত্ত্বেও মুসলিম ব্রাদারহুড ও জামায়াতে ইসলামীর বিদ‘আতী মানহাজ সমর্থন করেন, অথবা তাদের কার্যক্রমের প্রশংসা করেন, অথবা খোদ জামায়াতে ইসলামীর সাথে তাদের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন। তাঁরা ধারণা করেন যে, একজন ব্যক্তি একই সাথে আহলেহাদীস এবং জামায়াতী তথা ইখওয়ানী দুটোই হতে পারে। অথচ এটি তাদের অলীক ধারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। মহান আল্লাহ’র কাছে এ ধরনের কথিত আহলেহাদীসদের থেকে পানাহ চাই। বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলেহাদীসের প্রতিষ্ঠাতা ‘আল্লামাহ ‘আব্দুল্লাহেল কাফী আল-কুরাইশী’র উপরিউক্ত বক্তব্য কথিত আহলেহাদীস-জামায়াতী ব্যক্তিবর্গের ওপর বজ্রনিনাদস্বরূপ, যারা কি না আহলেহাদীসদের মানহাজ সম্পর্কে না জেনেই তার দিকে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করেছে কিংবা জেনেশুনে হঠকারিতা করে চলেছে। শাইখ কুরাইশী (রাহিমাহুল্লাহ)’র বক্তব্য সামনে রেখে বলতে চাই, যারা জেনেশুনে ব্রাদারহুড বা জামায়াতের মানহাজ সমর্থন করে, তারা আহলেহাদীস নয়। কারণ আহলেহাদীস এবং জামায়াতী কখনো এক হতে পারে না; যেহেতু উভয় দলের মানহাজের মধ্যে আকাশপাতাল ব্যবধান রয়েছে।
·
▌৩য় অধ্যায়: ‘আল্লামাহ ‘আলীমুদ্দীন নদিয়াভী (রাহিমাহুল্লাহ)
·
শাইখ পরিচিতি:
‘আল্লামাহ আবূ মুহাম্মাদ ‘আলীমুদ্দীন নদিয়াভী (রাহিমাহুল্লাহ) বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত সালাফী দা‘ঈ ও বিদ্বান ছিলেন। তিনি ছিলেন অসাধারণ প্রতিভাধর মুহাদ্দিস এবং রিজালবিদ। ‘ইলমুর রিজাল তথা রাবীদের জীবনীশাস্ত্র সম্পর্কে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্যের কারণে তাঁকে ‘চলন্ত রিজাল ডিকশনারি’ বলা অত্যুক্তি হবে না। তিনি ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি উত্তর প্রদেশের জ্ঞানকেন্দ্র সাহারানপুরে এবং দিল্লির মাদরাসা রাহমানিয়ায় পড়েছেন। তিনি ১৯৬৪ সালে প্রথমবারের মতো পূর্ব পাকিস্তানের রাজশাহীতে আগমন করেন। আর ১৯৬৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান জমঈয়তে আহলে হাদীসের সেক্রেটারি জেনারেলের আমন্ত্রণে তিনি ঢাকায় আগমন করেন এবং মাদরাসাতুল হাদীসে দারস দিতে শুরু করেন। তিনি তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীসের সহ-সভাপতি ছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর লেখা গ্রন্থের সংখ্যা ত্রিশেরও বেশি।
সৌদি আরবের ‘আলিমদের কাছেও তিনি স্বীয় ‘ইলম ও ফিক্বহের কারণে সুপরিচিত ছিলেন। এমনকি জারাহ ও তা‘দীলের ঝাণ্ডাবাহী মুজাহিদ মাদীনাহ’র মুহাদ্দিস ইমাম রাবী‘ আল-মাদখালী (হাফিযাহুল্লাহ) তাঁর নিকট থেকে হাদীস বর্ণনার ইজাযাহ (অনুমতি/সনদ) গ্রহণ করেছেন। [শাইখ খালিদ বিন দ্বাহউয়ী আয-যাফীরী (হাফিযাহুল্লাহ), আস-সানাউল বাদী‘ মিনাল ‘উলামা-ই ‘আলাশ শাইখ রাবী‘; পৃষ্ঠা: ৫; ২য় প্রকাশ (ছাপা ও সন বিহীন)]
এই মহান জ্ঞানসাধক ২০০১ সালের ১২ই জুন দিবাগত রাতে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমান। আল্লাহ তাঁকে উত্তম প্রতিদান দান করুন এবং জান্নাতুল ফিরদাউসে দাখিল করে তাঁকে সম্মানিত করুন। আমীন। সংগৃহীত: ‘আল্লামাহ ‘আলীমুদ্দীন নদিয়াভী (রাহিমাহুল্লাহ), ধর্ম ও রাজনীতি; পৃষ্ঠা: ৮৯-১০৪; সন: ডিসেম্বর, ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দ (৩য় সংস্করণ)।
·
১ম বক্তব্য:
বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীসের সাবেক সহ-সভাপতি প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও রিজালবিদ আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ আবূ মুহাম্মাদ ‘আলীমুদ্দীন নদিয়াভী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ২০০১ খ্রি.] তাঁর লেখা ‘ধর্ম ও রাজনীতি’ গ্রন্থের ‘আহলুস সুন্নাহ ও রাজনীতি’ অধ্যায়ে মুসলিম ব্রাদারহুডের উপমহাদেশীয় সংস্করণ জামায়াতে ইসলামীকে শী‘আ ফিরক্বাহ’র একটি বিদ‘আতী উপদল যাইদিয়াহ’র সাথে তুলনা করেছেন এবং তাদের ইসলামী রাজনীতির হকিকত বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, “যারা ইসলামের নামে রাজনীতি করা, কিতাব ও সুন্নাহ মোতাবিক শাসন পদ্ধতি চালু করার কথা প্রকাশ করেন, তারাও সহীহায়েনের হাদীস মোতাবিক ‘আমল করতে আগ্রহী নন এবং তাদের মাযহাবের বিপরীত সহীহায়েনের বহু হাদীসকে তারা মানসূখ বলে অথবা হাদীসগুলোর ভিন্নার্থ করে। এদের হাতে কোনদিন শাসন ক্ষমতা এলে, এরাও শীয়া যায়দিয়াদের ন্যায় সহীহ বুখারী ও মুসলিমের হাদীস মুতাবিক ‘আমল অর্থাৎ আহলুল হাদীস তরীকায় ‘আমল করায় বাধা দিবে এ আশঙ্কা মুক্ত নই।” (যদ্দৃষ্ট – সংকলক) [‘আল্লামাহ ‘আলীমুদ্দীন নদিয়াভী (রাহিমাহুল্লাহ), ধর্ম ও রাজনীতি; পৃষ্ঠা: ২৫; লেখক (রাহিমাহুল্লাহ)’র ছেলে আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ কর্তৃক প্রকাশিত এবং আল্লামা ‘আলীমুদ্দীন একাডেমী, মেহেরপুর কর্তৃক পরিবেশিত; সন: ডিসেম্বর, ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দ (৩য় সংস্করণ)]
·
২য় বক্তব্য:
শাইখ (রাহিমাহুল্লাহ) পরবর্তী অধ্যায়ে এই বিদ‘আতী দল সম্পর্কে আরও বলেছেন, “এরা কিতাব ও সুন্নাহ বনাম ফিকাহর রাজ্য কায়িম করা তথা-ইমাম আবূ হানীফার মাযহাব ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা কায়িম করতে তৎপর আর তাকেই তারা ইকামাতে দীন বলে জানে, যেমন খোমেনী তার শাসনকে ইসলামী শাসন বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। এরা এক সময়ে খোমেনীকে মুজাদ্দিদে মিল্লাত, ইমামে যমান ইত্যাদি বলে তাঁর পত্রের ফটো ছেপে ঘটা করে দলের নেতাগণ জৌলুস প্রদর্শন করেছিলেন।” (যদ্দৃষ্ট – সংকলক) [প্রাগুক্ত; পৃষ্ঠা: ২৭-২৮]
·
সংকলনে: মুহাম্মাদ ‘আব্দুল্লাহ মৃধা

No comments:

Post a Comment

Download AsPDF

Print Friendly and PDFPrint Friendly and PDFPrint Friendly and PDF
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...