শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু।

আযান
সংজ্ঞা : ‘আযান’ অর্থ, ঘোষণা ধ্বনি (الإعلام)। পারিভাষিক অর্থ, শরী‘আত নির্ধারিত আরবী বাক্য সমূহের মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ে উচ্চকণ্ঠে ছালাতে আহবান করাকে ‘আযান’ বলা হয়। ১ম হিজরী সনে আযানের প্রচলন হয়।[1]
সূচনা : ওমর ফারূক (রাঃ) সহ একদল ছাহাবী একই রাতে আযানের একই স্বপ্ন দেখেন ও পরদিন সকালে ‘অহি’ দ্বারা প্রত্যাদিষ্ট হ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তা সত্যায়ন করেন এবং বেলাল (রাঃ)-কে সেই মর্মে ‘আযান’ দিতে বলেন।[2]
ছাহাবী আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ (রাঃ) সর্বপ্রথম পূর্বরাতে স্বপ্নে দেখা আযানের কালেমা সমূহ সকালে এসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে বর্ণনা করেন। পরে বেলালের কণ্ঠে একই আযান ধ্বনি শুনে হযরত ওমর (রাঃ) বাড়ী থেকে বেরিয়ে চাদর ঘেঁষতে ঘেঁষতে ছুটে এসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলেন, ‘যিনি আপনাকে ‘সত্য’ সহকারে প্রেরণ করেছেন, তাঁর কসম করে বলছি আমিও অনুরূপ স্বপ্ন দেখেছি’। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)‘ফালিল্লা-হিল হাম্দ’ বলে আল্লাহর প্রশংসা করেন’।[3] একটি বর্ণনা মতে ঐ রাতে ১১ জন ছাহাবী একই আযানের স্বপ্ন দেখেন’। [4] উল্লেখ্য যে, ওমর ফারূক (রাঃ) ২০ দিন পূর্বে উক্ত স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ আগেই বলেছে দেখে লজ্জায় তিনি নিজের কথা প্রকাশ করেননি।[5]
আযানের ফযীলত ( فضل الأذان) :
(১) আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
لاَ يَسْمَعُ مَدَى صَوْتِ الْمُؤَذِّنِ جِنٌّ وَّلاَ إِنْسٌ وَّ لاَ شَيْئٌ إِلاَّ شَهِدَ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ رواه البخاريُّ-
‘মুওয়ায্যিনের আযানের ধ্বনি জিন ও ইনসান সহ যত প্রাণী শুনবে, ক্বিয়ামতের দিন সকলে তার জন্য সাক্ষ্য প্রদান করবে’। [6]
(২) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন যে, ‘ক্বিয়ামতের দিন মুওয়ায্যিনের গর্দান সবচেয়ে উঁচু হবে’।[7]
(৩) মুওয়ায্যিনের আযান ধ্বনির শেষ সীমা পর্যন্ত সজীব ও নির্জীব সকল বস্ত্ত তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে ও সাক্ষ্য প্রদান করে। ঐ আযান শুনে যে ব্যক্তি ছালাতে যোগ দিবে, সে ২৫ ছালাতের সমপরিমাণ নেকী পাবে। মুওয়ায্যিনও উক্ত মুছল্লীর সমপরিমাণ নেকী পাবে এবং তার দুই আযানের মধ্যবর্তী সকল (ছগীরা) গুনাহ মাফ করা হবে’।[8]
(৪) ‘আযান ও এক্বামতের ধ্বনি শুনলে শয়তান ছুটে পালিয়ে যায় ও পরে ফিরে আসে’।[9]
(৫) যে ব্যক্তি বার বছর যাবৎ আযান দিল, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে গেল। তার প্রতি আযানের জন্য ৬০ নেকী ও এক্বামতের জন্য ৩০ নেকী লেখা হয়’। [10]
(৬) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ইমাম হ’ল (মুছল্লীদের ছালাতের) যামিন ও মুওয়ায্যিন হ’ল (তাদের ছালাতের) আমানতদার। অতঃপর তিনি তাদের জন্য দো‘আ করে বলেন, হে আল্লাহ! তুমি ইমামদের সুপথ প্রদর্শন কর ও মুওয়ায্যিনদের ক্ষমা কর।[11]
আযানের অন্যান্য পরিত্যাজ্য বিষয় :
(১) আযানের আগে ও পরে উচ্চৈঃস্বরে যিকর : জুম‘আর দিনে এবং অন্যান্য ছালাতে বিশেষ করে ফজরের আযানের আগে ও পরে বিভিন্ন মসজিদে মাইকে বলা হয় (ক) ‘বিসমিল্লা-হ, আছ্ছালাতু ওয়াসসালা-মু ‘আলায়কা ইয়া রাসূলাল্লা-হ … ইয়া হাবীবাল্লাহ, … ইয়া রহমাতাল লিল ‘আ-লামীন। এভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে সালাম দেওয়ার পরে সরাসরি আল্লাহকেই সালাম দিয়ে বলা হয়, আছ্ছালাতু ওয়াসসালামু ‘আলায়কা ইয়া রববাল ‘আ-লামীন’। এটা বিদ‘আত তো বটেই, বরং চরম মূর্খতা। কেননা আল্লাহ নিজেই ‘সালাম’। তাকে কে সালাম দিবে? তাছাড়া হাদীছে আল্লাহকে সালাম দিতে নিষেধ করা হয়েছে। [12] (খ) আযানের পরে পুনরায় ‘আছছালা-তু রাহেমাকুমুল্লা-হ’ বলে বারবার উঁচু স্বরে আহবান করা (ইরওয়া ১/২৫৫)। এতদ্ব্যতীত (গ) হামদ, না‘ত, তাসবীহ, দরূদ, কুরআন তেলাওয়াত, ওয়ায, গযল ইত্যাদি শোনানো। অথচ কেবলমাত্র ‘আযান’ ব্যতীত এসময় বাকী সবকিছুই বর্জনীয়। এমনকি আযানের পরে পুনরায় ‘আছছালাত, আছছালাত’ বলে ডাকাও হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) প্রমুখ ছাহাবীগণ ‘বিদ‘আত’ বলেছেন।[13] তবে ব্যক্তিগতভাবে যদি কেউ কাউকে ছালাতের জন্য ডাকেন বা জাগিয়ে দেন, তাতে তিনি অবশ্যই নেকী পাবেন। [14]
(২) ‘তাকাল্লুফ’ করা : যেমন- আযানের দো‘আটি ‘বাংলাদেশ বেতারের’ কথক এমন ভঙ্গিতে পড়েন, যাতে প্রার্থনার আকুতি থাকেনা। যা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। কারণ নিজস্ব স্বাভাবিক সুরের বাইরে যাবতীয় তাকাল্লুফ বা ভান করা ইসলামে দারুণভাবে অপসন্দনীয়।[15]
(৩) গানের সুরে আযান দেওয়া : গানের সুরে আযান দিলে একদা আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) জনৈক মুওয়ায্যিনকে ভীষণভাবে ধমক দিয়ে বলেছিলেন إِنِّيْ لَأُبْغِضُكَ فِي اللهِ ‘আমি তোমার সাথে অবশ্যই বিদ্বেষ করব আল্লাহর জন্য’।[16]
(৪) আঙ্গুলে চুমু দিয়ে চোখ রগড়ানো : আযান ও এক্বামতের সময় ‘মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ’ শুনে বিশেষ দো‘আ সহ আঙ্গুলে চুমু দিয়ে চোখ রগড়ানো, আযান শেষে দুই হাত তুলে আযানের দো‘আ পড়া কিংবা উচ্চৈঃস্বরে তা পাঠ করা ও মুখে হাত মোছা ইত্যাদির কোন শারঈ ভিত্তি নেই।[17]
(৫) বিপদে আযান দেওয়া : বালা-মুছীবতের সময় বিশেষভাবে আযান দেওয়ারও কোন দলীল নেই। কেননা আযান কেবল ফরয ছালাতের জন্যই হয়ে থাকে, অন্য কিছুর জন্য নয়।
(৬) এতদ্ব্যতীত শেষরাতে ফজরের আযানের আগে বা পরে মসজিদে মাইকে উচ্চৈঃস্বরে কুরআন তেলাওয়াত করা, ওয়ায করা ও এভাবে মানুষের ঘুম নষ্ট করা ও রোগীদের কষ্ট দেওয়া এবং তাহাজ্জুদে বিঘ্ন সৃষ্টি করা কঠিন গোনাহের কাজ।[18]
আযানের অন্যান্য মাসায়েল (مسائل أخري في الأذان) :
(১) মুওয়াযযিন ক্বিবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে আযান দিবে। দুই কানে আংগুল প্রবেশ করাবে, যাতে আযানে জোর হয়। ‘হাইয়া ‘আলাছ ছালা-হ ও ফালা-হ’ বলার সময় যথাক্রমে ডাইনে ও বামে মুখ ঘুরাবে, দেহ নয়।[19]অসুস্থ হ’লে বসেও আযান দেওয়া যাবে। [20]
(২) যে ব্যক্তি আযান হওয়ার পর (কোন যরূরী প্রয়োজন ছাড়াই) মসজিদ থেকে বের হয়ে গেল, সে ব্যক্তি আবুল ক্বাসেম [মুহাম্মাদ (ছাঃ)]-এর অবাধ্যতা করল। [21]
(৩) যিনি আযান দিবেন, তিনিই এক্বামত দিবেন। অন্যেও দিতে পারেন। অবশ্য মসজিদে নির্দিষ্ট মুওয়াযযিন থাকলে তার অনুমতি নিয়ে অন্যের আযান ও এক্বামত দেওয়া উচিত। তবে সময় চলে যাওয়ার উপক্রম হ’লে যে কেউ আযান দিতে পারেন।[22]
(৪) আযানের উদ্দেশ্য হবে স্রেফ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। এজন্য কোন মজুরী চাওয়া যাবে না। তবে বিনা চাওয়ায় ‘সম্মানী’ গ্রহণ করা যাবে। কেননা নিয়মিত ইমাম ও মুওয়াযযিনের সম্মানজনক জীবিকার দায়িত্ব গ্রহণ করা সমাজ ও সরকারের উপরে অপরিহার্য কর্তব্য।[23]
(৫) আযান ওযূ অবস্থায় দেওয়া উচিত। তবে বে-ওযূ অবস্থায় দেওয়াও জায়েয আছে। আযানের জওয়াব বা অনুরূপ যেকোন তাসবীহ, তাহলীল ও দো‘আ সমূহ এমনকি নাপাক অবস্থায়ও পাঠ করা জায়েয আছে।[24]
(৬) এক্বামতের পরে দীর্ঘ বিরতি হ’লেও পুনরায় এক্বামত দিতে হবে না।[25]
(৭) আযান ও জামা‘আত শেষে কেউ মসজিদে এলে কেবল এক্বামত দিয়েই জামা‘আত ও ছালাত আদায় করবে।;[26]
(৮) ক্বাযা ছালাত জামা‘আত সহকারে আদায়ের জন্য আযান আবশ্যিক নয়। কেবল এক্বামতই যথেষ্ট হবে। [27]
No comments:
Post a Comment