Sunday 9 July 2017

কেয়ামতের দিন হিসাব-নিকাশের পর যা যা হবেঃ



(১) জাহান্নামীরা জাহান্নামে যাবে,
(২) জান্নাতীরা আল্লাহ তাআ’লাকে দেখতে পারবে,
(৩) জান্নাতীরা পুলসিরাত পার হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে,
(৪) নবী-রাসুল ও নেককার জান্নাতী ব্যক্তিরা ঈমানদার, কিন্তু পাপের কারনে জাহান্নামে গেছে, এমন লোকদের জন্য সুপারিশ করবেন,
(৫) অন্তরে অণু পরিমান ঈমান আছে, তাদেরকেও শাস্তি দেওয়ার পরে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে,
(৬) আল্লাহ্‌ তাঁর দয়া ও অনুগ্রহে কিছু লোকদেরকে হাতের অঞ্জলি দিয়ে জাহান্নাম থেকে বের করে আনবেন. . .
এরপরেও যারা জাহান্নামে বাকি থাকবে, তাদের মধ্য থেকে আর কেউ কোনদিন জাহান্নাম থেকে বের হতে পারবেনা। তারা হচ্ছে যারা কাফের, বেঈমান, মুশরেক ও মুনাফেক অবস্থায় মৃত্যবরণ করেছিলো এমন লোকেরা। আল্লাহ্‌ আমাদেরকে জাহান্নাম থেকে বাঁচান, আমিন। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমঃ (৩৫১)-এ বর্ণিত পুরো ঘটনাটা বর্ণনা করা হলো।
.
আবু সাঈদ আল-খুদরী রাদিয়াল্লাহু আ’নহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগে কয়েকজন সাহাবী তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, হে আল্লাহর রাসুল! কিয়ামতের দিন আমরা কি আমাদের প্রতিপালককে দেখতে পাব? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ হ্যা। তিনি আরো বললেন, দুপুরবেলা মেঘমুক্ত আকাশে সূর্য দেখতে তোমাদের কোন কষ্ট হয় কি? সাহাবীদের সবাই বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! না, তা কষ্ট হয় না। নবীজী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ঠিক তেমনি কিয়ামতের দিন তোমাদের প্রতিপালককে দেখতে তোমাদের জন্যে কোনই বাঁধা থাকবে না। সেদিন এক ঘোষনাকারী ঘোষণা দিবে, “তোমরা যে যার উপাসনা করতে, সে আজ তার মাবূদের অনুসরণ করুক।” তখন আল্লাহ ব্যতীত যারা অন্য দেব-দেবী ও বেদীর উপাসনা করত, তাদের কেউ অবশিষ্ট থাকবে না; সকলেই জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। নেককার লোক কিংবা পাপী, যারা আল্লাহ তাআ’লার ইবাদত করত, তারাই কেবল বাকী থাকবে এবং আহলে কিতাবীদের মধ্যে যারা দেব-দেবী ও বেদীর উপাসক ছিল না, তারাও বাকি থাকবে। এরপর ইয়াহুদীদেরকে ডেকে জিজ্ঞেস করা হবে! তোমরা কার ইবাদত করতে? তারা বলবে, আমরা আল্লাহর পুত্র উযায়ের-এর উপাসনা করতাম। তাদেরকে বলা হবে, তোমরা মিথ্যা বলছ। (কারণ), আল্লাহ কোন স্ত্রী বা সন্তান গ্রহণ করেননি। তোমরা কি চাও? তারা বলবে, হে আল্লাহ! আমাদের খুবই পানির পিপাসা পেয়েছে। আমাদের তৃষ্ণা নিবারণ করুন। তাদের এই দুয়া শুনে তাদেরকে ইঙ্গিত করে মরীচিকাময় জাহান্নামের দিকে জমায়েত করা হবে। সেই জাহান্নামের (আগুনের) এক অংশ অপর অংশকে খেয়ে ফেলতে থাকবে। ইয়াহুদীরা সেই (মরীচিকাময় জাহান্নামের মাঝে পানির আশায়) ঝাঁপিয়ে পড়বে। এরপর খৃষ্টানদেরকে ডাকা হবে আর বলা হবে, তোমরা কার ইবাদত করতে? তারা বলবে, আমরা আল্লাহর পুত্র (ঈসা) মসীহ-এর উপাসনা করতাম। তাদেরকে বলা হবে, তোমরা মিথ্যা বলছ। (কারণ), আল্লাহ কোন স্ত্রী বা সন্তান গ্রহণ করেন নি। তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হরে, এখন তোমরা কি চাও? তারা বলবে, হে আমাদের রব! আমাদের দারুন তৃষ্ণা পেয়েছে, আমাদের তৃষ্ণা নিবারণ করুন। তখন তাদেরকেও পানির ঘাটে যাবার ইঙ্গিত করে জাহান্নামের দিকে জমায়েত করা হবে। তাদের কাছে একে মরীচিকার মত (পানির নদী বা ঝর্ণার মতো) মনে হবে। সেই জাহান্নামের (আগুনের) এক অংশ অপর অংশকে খেয়ে ফেলতে থাকবে। খ্রীস্টানরা তখন জাহান্নামে ঝাপিয়ে পড়তে থাকবে। শেষে ঈমানদার হোক কিংবা গুনাহগার, এক আল্লাহর উপাসনাকারী ব্যতীত আর কেউ (হাশরের ময়দানে) অবশিষ্ট থাকবে না। তখন আল্লাহ তাদের কাছে আসবেন। বলবেন, সবাই তাদের নিজ নিজ উপাস্যের অনুসরণ করে চলে গেছে, আর তোমরা কার জন্যে অপেক্ষা করছ? তারা বলবে, হে আমাদের প্রভু! যেখানে আমরা বেশি মুখাপেক্ষী ছিলাম, সেই দুনিয়াতে আমরা অপরাপর মানুষ থেকে আলাদা থেকেছি এবং তাদের সঙ্গী হইনি। তখন আল্লাহ বলবেন, আমিই তো তোমাদের প্রভু। মুমিনরা (আল্লাহকে চিনতে না পেরে) বলবে, “আমরা তোমরা কাছ থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি, আল্লাহর সঙ্গে আমরা কোন কিছুকে শরীক করি না।” মুমিনরা এই কথা দুই বা তিনবার বলবে। এমন কি কেউ কেউ অবাধ্যতা প্রদর্শনেও অবতীর্ণ হয়ে যাবে। (অর্থাৎ তারা আল্লাহকে মোটেই চিনতে পারবেনা)। তখন আল্লাহ মুমিনদেরকে বলবেন, আচ্ছা, তোমাদের কাছে এমন কোন নিদর্শন আছে যার দ্বারা তোমরা আল্লাহকে চিনতে পার? তারা বলবে, অবশ্যই আছে। এরপর আল্লাহ তাঁর “পায়ের গোছা” প্রদর্শন করবেন, তখন পৃথিবীতে যারা স্বেচ্ছায় আল্লাহর উদ্দেশ্যে সেজদা করত (অর্থাৎ শুধুমাত্র আল্লাহকে রাজি-খুশী করার জন্যে সালাত আদায় করতো), তাদেরকে আল্লাহ তাআ’লা সিজদা করার অনুমতি দিবেন। আর যারা লোক দেখানো বা মানুষের ভয়ে আল্লাহকে সিজদা করত (অর্থাৎ যারা ছিলো মুনাফিক কিংবা রিয়ার উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করতো), সে মুহূর্তে তাদের মেরুদন্ড শক্ত ও অনমনীয় করে দেওয়া হবে। যখনই তারা সিজদা করতে ইচ্ছা করবে, তখনই তারা চিৎ হয়ে পড়ে যাবে। তারপর তারা মাথা তুলবে। ইতিমধ্যে তারা আল্লাহকে প্রথমে যে সুরতে দেখেছিল, তা পরিবর্তিত হয়ে যাবে এবং তিনি তাঁর সুরতে আবির্তূত হবেন। অতঃপর আল্লাহ বলবেন, আমিই তোমাদের রব! ঈমানদারেরা বলবে হ্যা, আপনিই আমাদের প্রতিপালক। তারপর জাহান্নামের উপর ‘জিসর’ (পুলসিরাত) স্থাপন করা হবে। জিসর বা পুলসিরাত হচ্ছে চুল অপেক্ষা অধিক সূক্ষ্ম ও তরবারি অপেক্ষা অধিক ধারালো। অতঃপর শাফায়া’তেরও অমুমতি দেওয়া হবে। মানুষ বলতে থাকবে, হে আল্লাহ! আমাদের নিরাপত্তা দিন, আমাদের নিরাপত্তা দিন। জিজ্ঞেস করা হল, হে আল্লাহর রাসুল জিসর (পুলসিরাত) কি? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (পুলসিরাত) হচ্ছে এমন একটি স্থান, যেখানে মানুষের পা পিছলে যাবে। সেখানে আছে নানা প্রকারের লৌহ শলাকা ও কাঁটা, দেখতে নজদের ‘নাদান’ নামক কাঁটাদার বৃক্ষের মত। মুমিনগণের কেউ এই পথ চোখের পলকের গতিতে, কেউবা বিদ্যুতের গতিতে, কেউ বায়ুর গতিতে, কেউ ঘোড়ার গতিতে দ্রুত, কেউ উটের গতিতে আস্তে আস্তে অতিক্রম করবে। পুলসিরাত থেকে কেউ অক্ষত অবস্থায় মুক্তি পাবে, আবার কেউবা ক্ষতবিক্ষত হয়ে মুক্তি পাবে। আর পুলসিরাতে অনেক ইমানদারেরা (তাদের পাপের কারনে) কাঁটাবিদ্ধ অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। অবশেষে মুমিনগণ জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভ করবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সে সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, ঐ দিন মুমিনগণ তাঁদের ঐসব ভাইয়ের স্বার্থে আল্লাহর সাথে বিতর্কে লিপ্ত হবে, যারা জাহান্নামে রয়ে গেছে। তোমরা পার্থিব অধিকারের ক্ষেত্রেও এমন বিতর্কে লিপ্ত হও না। তারা বলবে, হে রব! এরাতো আমাদের সাথেই সালাত আদায় করত, সাওম পালন করতো, হজ্জ করতো। তখন আল্লাহ তাদেরকে নির্দেশ দিবেন, যাও তোমরা তোমাদের পরিচিত লোকদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করে আন। উল্লেখ্য, এরা জাহান্নামে পতিত হলেও তাদের চেহারা বা মুখমন্ডল আযাব থেকে রক্ষিত থাকবে। (তাই তাদেরকে চিনতে কোন অসুবিধা হবে না।) মুমিনগণ জাহান্নাম থেকে এক বিরাট দলকে উদ্ধার করে নিয়ে আসবে। এদের অবস্থা এমন হবে যে, কারোর পায়ের অর্ধ গোড়ালি পর্যন্ত, আবার কারো হাঁটু পর্যন্ত দেহ আগুনে পুড়ে কয়লার মতো হয়ে যাবে। উদ্ধার শেষ করে মুমিনগণ বলবে, হে আমাদের রব! যাদের সম্পর্কে আপনি নির্দেশ প্রদান করেছিলেন, তাদের মাঝে আর কেউ অবশিষ্ট নেই। আল্লাহ বলবেন, তোমরা আবার যাও, যার অন্তরে ‘এক দীনার’ (তৎকালীন যুগে প্রচলিত এক স্বর্ণমুদ্রার) সমান ঈমান অবশিষ্ট পাবে, তোমরা তাকেও জাহান্নাম থেকে বের করে আন। তখন তারা আরও একদলকে উদ্ধার করে এনে বলবে, হে আমাদের রব! অনুমতি প্রাপ্তদের কাউকেও রেখে আসিনি। আল্লাহ বলবেন, তোমরা আবার যাও, যার অন্তরে অর্ধ দীনার পরিমাণও ঈমান অবশিষ্ট পাবে, তোমরা তাকেও বের করে নিয়ে আস। তখন আবার এক বিরাট দলকে উদ্ধার করে এনে তারা বলবে হে রব! যাদের আপনি উদ্ধার করতে বলেছিলেন, তাদের কাউকে ছেড়ে আসিনি। আল্লাহ বলবেন, আবার যাও, যার অন্তরে যাররা (অণু বা অত্যন্ত ক্ষুদ্র) পরিমাণও ঈমান বিদ্যমান, তাকেও তোমরা জাহান্নাম থেকে বের করে আন। তখন আবারও এক বিরাট দলকে উদ্ধার করে এনে তারা বলবে, হে আমাদের রব! যাদের কথা বলেছিলেন, তাদের কাউকেই রেখে আসিনি। সাহাবী আবু সাঈদ আল-খুদরী রাদিয়াল্লাহু আ’নহু বলেন, তোমরা যদি এই হাদীসের ব্যাপারে আমাকে সত্যবাদী বলে মনে না কর, তাহলে এর সমর্থনে নিম্নোক্ত আয়াতটিও তিলাওয়াত করতে পারঃ “আল্লাহ কারো প্রতি অণু পরিমাণও জুলুম করেন না এবং, অণু পরিমাণ নেক কাজ হলেও আল্লাহ তা দ্বিগুন করে করে দেন এবং তাঁর কাছ থেকে মহা-পুরস্কার দান করেন।” [সুরা নিসা; ৪০] এরপর আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করবেন, ফেরেশতারা সুপারিশ করলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গণও সুপারিশ করলেন এবং মুমিনরাও সুপারিশ করেছে, কেবল “আরহামুর রাহিমীন” পরম দয়াময় আল্লাহই বাকী রয়ে গেছেন। এরপর তিনি জাহান্নাম থেকে একু অঞ্জলি লোকদেরকে তুলে আনবেন, ফলে এমন একদল লোক মুক্তি পাবে, যারা কখনো কোন নেক আমল করেনি, এবং আগুনে জ্বলে সম্পূর্ণ অঙ্গার হয়ে গেছে। পরে তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ মুখের ‘নাহরুল হায়াতে’ (জীবন নদীতে) ফেলা হবে। এর ফলে তারা এমনভাবে সতেজ হয়ে উঠবে, যেমন শস্য অস্কুর স্রোতবাহিত পানির দ্বারা সজীব হয়ে ওঠে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা কি কোন বৃক্ষ কিংবা পাথরের আড়ালে কোন শস্য দানা অস্কুরিত হতে দেখনি? যেগুলো সূর্য কিরণের মাঝে থাকে সেগুলো হলদে ও সবুজ রুপ ধারণ করে আর যেগুলো ছায়ামুক্ত স্হানে থাকে, সেগুলো সাদা হয়ে যায়। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! মনে হয় আপনি যেন গ্রামাঞ্চলে পশু চড়িয়েছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এরপর তারা নহর থেকে মুক্তার মত ঝকঝকে অবস্হায় উঠে আসবে এবং তাদের ঘাড়ে মোহরাঙ্কিত থাকবে, যা দেখে জান্নাতীরা তাদেরকে চিনতে পারবেন। এরা হলো ‘উতাকাউল্লাহ’ অর্থাৎ, আল্লাহর পক্ষ থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত লোকেরা। আল্লাহ তাআ’লা নেক আমল ছাড়াই তাদেরকে জান্নাতে দাখিল করবেন। এরপর আল্লাহ তাদেরকে লক্ষ করে বলবেন, যাও, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ কর। আর যা কিছু দেখছ সবকিছু তোমাদেরই। তারা বলবে, হে আমাদের রব! আপনি আমাদেরকে এতই দিয়েছেন যা সৃষ্ট-জগতের কাউকে দেননি। আল্লাহ বলবেন, তোমাদের জন্য আমার কাছে এর চেয়েও উত্তম বস্তু আছে। তারা বলবে, কি সে উত্তম বস্তু? আল্লাহ বলবেনঃ সে হল ‘আমার সন্তুষ্টি’। আজকের পর থেকে আমি আর কখনো তোমাদের উপর অন্তুষ্ট হবো না।
[সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিমঃ ৩৫১]

Courtesy page তোমরা তোমাদের পালনকর্তার অভিমূখী হও এবং তাঁর আজ্ঞাবহ হও

No comments:

Post a Comment

Download AsPDF

Print Friendly and PDFPrint Friendly and PDFPrint Friendly and PDF
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...