Tuesday 29 March 2016

আযান এবং মুয়াযযিন (পর্ব-৩)


unnamedىغ7আযান এবং মুয়াযযিন (পর্ব-৩)
লেখক: আব্দুর রাক্বীব মাদানী
সম্পাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
মুয়াযযিনের বেতন-ভাতাঃ
বিষয়টির কয়েকটি অবস্থা হতে পারে এবং অবস্থার প্রেক্ষিতে বিধানও ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। নিম্নে বিস্তারিত উল্লেখ করা হলঃ
১- যদি মুয়াযযিন কেবল পার্থিব লাভের উদ্দেশ্যেই আযান দেয়, তাহলে এমন করা হারাম ও বড় গুনাহ। মনে রাখা উচিৎ, আযান দেওয়া ইবাদত। আর ইবাদত কবুলের প্রথম শর্তই হচ্ছে, ইখলাস। অর্থাৎ যে কোন ইবাদত তা যেন কেবল আল্লাহর উদ্দেশ্যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হয়। অর্থ পাবার উদ্দেশ্যে কিংবা পদ লাভের উদ্দেশ্যে কিংবা নিজের সুন্দর কণ্ঠের মাধ্যমে লোকের প্রশংসা পাওয়ার উদ্দেশ্য থাকলে, তাতে আর ইখলাস থাকে না। যার ফলে ইবাদতটি কবুল হয় না এবং তা ছোট শিরকে পরিণত হয় । কারণ ইবাদত, যা কেবল আল্লাহর জন্যই খাঁটি ভাবে হওয়া কাম্য, তাতে সে পার্থিব উদ্দেশ্যকে অংশী করেছে।
তাই আক্বীদার পণ্ডিতগণ বলেনঃ মূল ইবাদতের মাধ্যমে কেবল দুনিয়া অর্জনের উদ্দেশ্য করা, যেমন হজ্জ করা পয়সার জন্য, জিহাদ করা গনিমতের সম্পদ পাওয়ার জন্য, অনুরূপ আযান দেওয়া কেবল বেতনের জন্য, যাতে আল্লাহর কোন সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য থাকে না। এই প্রকারের আমল বাতিল এবং ছোট শিরক। [দেখুন,তাসহীলুল আক্বীদা,ড.জিবরীন,পৃঃ৩৭৬]
আল্লাহ বলেনঃ “যারা এ দুনিয়ার জীবন আর তার শোভা সৌন্দর্য কামনা করে, তাদেরকে এখানে তাদের কর্মের পুরোপুরি ফল আমি দিয়ে দেই, আর তাতে তাদের প্রতি কোন ঘাটতি করা হয় না। কিন্তু আখেরাতে তাদের জন্য আগুন ছাড়া কিছুই নাই। এখানে যা কিছু তারা করেছে তা নিষ্ফল হয়ে গেছে,আর তাদের যাবতীয় কাজ-কর্ম ব্যর্থ হয়ে গেছে।) [হূদ,১৫-১৬]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “অবশ্যই আমল সমূহ নির্ভর করে নিয়তের উপরে এবং প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পায়, যার সে নিয়ত করে থাকে।”। [বুখারী,নং১, মুসলিম,নং১৯০৭]
তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উসমান বিন আবুল আস (রাযিঃ) কে বলেনঃ “তুমি তাদের (তোমার গোত্রের) ইমাম, তাদের দুর্বলদের খেয়াল রাখবে এবং এমন এক মুয়াযযিন নির্ধারণ করবে যে তার আযানের বিনিময় নিবে না”। [আবু দাঊদ, স্বালাত অধ্যায়, নং (৫৩১), মুসনাদ আহমদ, নং (১৬৩৭৮]
উপরোক্ত প্রমাণের আলোকে একথা সুস্পষ্ট যে, আযানের উদ্দেশ্য যদি শুধু বেতন হয় কিংবা শুধু অন্য কোন পার্থিব লাভ হয়, তাহলে সেই মুয়াযযিনের আযান বাতিল ও হারাম। তাই আমাদের ঐসকল মুয়াযযিনদের চিন্তা করা প্রয়োজন যারা বেতন ছাড়া আযান দেন না বা বেতনের চুক্তি করেই আযান দেন; নচেৎ দেন না।
২- মূলত: মুয়াযযিন যদি সওয়াবের আশায় আযান দেয় অতঃপর সরকার তাকে বায়তুল মাল থেকে ভাতা প্রদান করে, কিংবা কোন সংস্থা তাকে ভাতা দেয় কিংবা কোন ব্যক্তি তাকে এ কারণে সাহায্য দেয়, তাহলে তা গ্রহণে কোন অসুবিধা নেই বরং তা জায়েজ। [ইসলামের শুরু যুগে যাকে বায়তুল মাল বলা হত, বর্তমান যুগে তা অর্থ মন্ত্রণালয় বলা যেতে পারে।]
ফিকাহ বিশ্বকোষে বর্ণিত হয়েছে,‘এমন কাজে বায়তুল মাল থেকে অনুদান নেওয়া বৈধ, যার মাধ্যমে সকল মুসলিম উপকৃত হয়,যেমন বিচার বিভাগ, ফাতওয়া বিভাগ, আযান, ইমামত, কুরআন শিক্ষা এবং হাদীস ফিকাহ এর মত উপকারী বিদ্যার শিক্ষা প্রদান ইত্যাদি। কারণ এ গুলো সাধারণ জনকল্যাণের অন্তর্ভুক্ত’। [মাওসূআ ফিকহিয়্যাহ,২২/২০২]
পূর্বসূরি উলামাগণ বায়তুল মালের অনুদানকে ‘বিনিময়’ (ইওয়ায) কিংবা ‘মজুরী’ (উজরাহ) বলেন নি বরং তাঁরা এটাকে ‘রায্ক’ অর্থাৎ জীবিকা, ভাতা বা দান বলেছেন।
ইবনে তায়মিয়্যাহ (রহঃ) বলেনঃ ‘আর যা বায়তুল মাল থেকে নেওয়া হয়,তা বিনিময় ও মজুরি নয়;বরং তা আনুগত্যের কাজে সহযোগিতার উদ্দেশ্যে অনুদান। আর সৎ কাজে অনুদান গ্রহণ কাজটিকে নৈকট্য থেকে বের করে দেয় না আর না ইখলাসে ব্যাঘাত ঘটায়;ব্যাঘাত ঘটলে (জিহাদকারী) গনিমতের হকদার হত না’। [প্রাগুক্ত,২২/২০২]
৩- বায়তুল মাল বা সরকারি ব্যবস্থাপনার অবর্তমানে যদি কোন সংস্থা বা মসজিদ কমিটি মুয়াযযিনকে মাসিক সাহায্য বা ভাতা দেয়,তাহলে তা বায়তুল মালেরই স্থলাভিষিক্ত হিসাবে গণ্য হবে।
৪- মুয়াযযিন যদি অর্থশালী ব্যক্তি হয়, তাহলে তার জন্য আযানের বেতন-ভাতা না নেওয়াই উত্তম। কিন্তু মুয়াযযিন যদি অভাবী হয় এবং আযানের দায়িত্ব পালনের কারণে নিজস্ব প্রয়োজন ও তার সংসারের প্রয়োজনীয় অর্থ যোগান দিতে অক্ষম হয়, তাহলে তার জন্য এতখানি মাসিক ভাতা বা সাহায্য নেওয়া বৈধ, যার মাধ্যমে তার ও তার সাংসারিক অভাব পূরণ হবে। আল্লাহ তাআ’লা ইয়াতীমের অভিভাবকদের আদেশ করেনঃ
“আর যে অভাব মুক্ত সে যেন বিরত থাকে আর যে অভাবগ্রস্ত সে যেন ন্যায়সঙ্গত ভাবে ভোগ করে।” [আন্ নিসা/৬]
তাই কিছু ইসলামী পণ্ডিত অভাবী ইমাম ও মুয়াযযিনের সাহায্য নেওয়াকে এই আদেশের উপর কেয়াস করতঃ বৈধ বলেছেন। তাছাড়া অভাবীর অভাব দূরীকরণ ইসলামের একটি সুন্দর মৌলিক বিধান।
৫- কোন অমুসলিম সরকার যদি ইমাম-মুয়াযযিনের ভাতার ব্যবস্থা করে এবং এর বিনিময়ে সরকার যদি তাদের উপর কোন অবৈধ কাজের শর্তারোপ না করে, তাহলে সাধারণতঃ সেই ভাতা গ্রহণ বৈধ হবে। কারণ লেনদেনের মূলনীতি হচ্ছে, বৈধতা। [ওয়াল্লাহু আ’লাম]
 সফরে আযান ও ইক্বামত দেওয়ার বিধানঃ
প্রায় সমস্ত ফুকাহা এ বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, সফরাবস্থায় আযান দেওয়া মুস্তাহাব; সফরকারীর সংখ্যা একধিক হোক কিংবা একা হোক।
মালিক বিন হুআইরিস (রাযিঃ) বলেনঃ সফরের ইচ্ছাকারী দুই ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট আসলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের বললেনঃ “যখন তোমরা (সফরে) বের হবে, তখন আযান দিবে অতঃপর ইক্বামত দিবে এবং তোমাদের মধ্যে অধিক বয়স্ক ব্যক্তি ইমামতি করবে”। [বুখারী, আযান অধ্যায়, নং ৬৩০]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ তোমার প্রতিপালক সেই ছাগলের রাখালকে পছন্দ করেন যে কোনো পাহাড়ের দূর চূড়ায় অবস্থান করে। নামাযের জন্য আযান দেয় ও নামায আদায় করে। তখন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “আমার এই বান্দার দিকে তাকাও, সে নামাযের জন্য আযান দিল, ইক্বামত দিল এবং আমাকে ভয় করল। আমি তাকে ক্ষমা করলাম এবং তাকে জান্নাত দিলাম”। [আবু দাঊদ, নং ১২০৩/আহমাদ নং (১৬৮০১) আরনাঊত সহীহ বলেছেন]
মাঠে বা নির্জন স্থানে একা নামাযীর আযান দেওয়ার বিধানঃ
কাজে-কর্মে মানুষ যদি এমন স্থানে অবস্থান করে যেখানে সে ব্যতীত কেউ নেই এবং নিকটে মসজিদও নেই, তাহলে এমন সময়ও তাকে আযান দেওয়া মুস্তাহাব।
আবু সাঈদ খুদরী (রাযিঃ) আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাহমানকে বলেনঃ আমি দেখছি তুমি ছাগল ও মরুভূমি পছন্দ কর, যখন তুমি তোমার ছাগলের পালের সাথে থাকবে কিংবা নির্জন স্থানে থাকবে, তখন নামাযের আযান দিবে এবং উঁচু আওয়াজে দিবে। কারণ জিন কিংবা ইনসান কিংবা অন্য কিছু আযানের শব্দ যতদূর যায় ততদূর পর্যন্ত যারা শুনে, তারা তার জন্য কিয়ামত দিবসে সাক্ষী দিবে”। সাহাবী আবু সাঈদ বলেনঃ আমি এটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে শুনেছি। [বুখারী, আযান অধ্যায় নং ৬০৯]
ক্বাযা নামাযের উদ্দেশ্যে আযান ও ইক্বামতঃ
সংখ্যা গরিষ্ঠ উলামার মতে ক্বাযা নামাযের জন্য আযান ও ইক্বামত বৈধ। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সাহাবাগণ একদা এক সফরে ঘুমিয়ে পড়লে ফজরের সময় শেষ হয়ে যায় অতঃপর সূর্য উঠার পর তাঁরা সকলে ফজরের নামায আদায় করেন। তাতে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেলালকে আদেশ করেন। সে আযান দেয়, ইক্বামত দেয় অতঃপর নামায আদায় করেন। [আবু দাঊদ, স্বালাত অধ্যায়, নং ৪৩৫, মুসলিম, নং ৩১০] অনুরূপ খন্দকের যুদ্ধে একাধিক নামায ক্বাযা হয়ে যাওয়ার পর রাত হয়ে গেলে আল্লাহর রাসূল বেলাল (রাযিঃ) কে আদেশ দেন, সে আযান দেয় অতঃপর ইক্বামত দেয় তারপর যোহরের স্বালাত আদায় করেন। অতঃপর ইক্বামত দেন এবং আসরের নামায আদায় করেন। এই ভাবে মাগরিব ও ইশার নামাযও আদায় করেন। [তিরমিযী, ত্বাহারাহ নং ১৭৯, নাসাঈ, আযান অধ্যায় নং ৬৬১ এবং মুসনাদ আহমাদ]
উক্ত প্রমাণাদিতে দেখা যাচ্ছে, নামায ক্বাযা হলে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আযান ও ইক্বামত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন কিন্তু একাধিক নামাযের ক্বাযা আদায়ের সময় শুধু প্রথম ওয়াক্তের জন্য আযান দেওয়া হয়েছে আর বাকি নামাযের জন্য শুধু ইক্বামত। অবশ্য কিছু বর্ণনায় প্রত্যেক নামাযের জন্য ভিন্ন আযান ও ইক্বামতের কথাও এসেছে। এসব বর্ণনার আলোকে ক্বাযা নামাযের জন্য আযান ও ইক্বামত বৈধ।
লক্ষণীয় যে, এখানে ইমাম ও মুক্তাদী সকলের একই ধরণের নামায ক্বাযা হয়েছে তাই সকলের উপর ক্বাযা জরুরি হয়েছে এবং তা একত্রে একসাথে জামাআত সহকারে আদায় করা সম্ভব এবং তা অন্যদের বিভ্রান্তির কারণও নয়।  কিন্তু যদি বিষয়টি এমন হয় যে, কোনো মসজিদের ইমাম ও অধিকাংশ মুক্তাদী সঠিক সময়ে নামায আদায় করেছেন। অতঃপর কিছু এমন লোক বা বিশেষ কোনো এক ব্যক্তি মসজিদে আসল যাদের বা যার উপর নামায ক্বাযা রয়েছে, তাহলে তারা কি সেই মসজিদে আযান দিয়ে ক্বাযা নামায আদায় করবে? যেই মসজিদে জামাআত সহ নামায হয়ে গেছে সেই মসজিদেই পুণরায় ক্বাযা নামাযের জন্য আযান দেওয়ার কোনো দলীল পাওয়া যায় না; তাই এমন করা উচিৎ হবে না। কিন্তু সেই মসজিদের ইমামের অনুমতি নিয়ে যদি তারা আপসের মধ্যে আযান দেয় আর সেই আযানের কারণে জনপদের লোক বিভ্রান্তিতে না পড়ে তাহলে তাতে আপত্তি হতে পারে না।
ফজরের ফরয স্বালাতের পূর্বে আযানঃ (তাহাজ্জুদ বা সাহরীর আযান)
ফজরের সময় শুরু হওয়ার পূর্বে রাতে একটি আযান দেওয়া প্রমাণিত সুন্নত, যা এখনও হারামাইনে প্রচলিত। অতঃপর ফজর হলে ফজরের আযান দিতে হবে। ফজরের পূর্বের আযানটির উদ্দেশ্য হচ্ছে, তাহাজ্জুদ আদায়কারী যেন কিছুটা বিরাম নিয়ে ফজরের জন্য চাঙ্গা হয়, রোযাদার রোযা রাখার উদ্দেশ্যে যেন সাহরী খেয়ে নেয় এবং কারো উপর গোসল ফরয থাকলে তা সেরে নেয়। [ফাতহুলবারী,২/১৩৮]
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ নবী (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “বেলালের আযান যেন তোমাদের কাউকে সাহরী খাওয়া থেকে বিরত না রাখে; কারণ সে রাতে আযান দেয়, যেন তাহাজ্জুদ আদায়কারী ফেরৎ আসে এবং ঘুমন্ত লোকেরা সতর্ক হয়”। [বুখারী নং ৬২১]
তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরোও বলেনঃ বিলাল রাতে আযান দেয়, তাই তোমরা খাও ও পান কর যতক্ষণ ইবনু উম্মি মাকতূম আযান না দেয়। বর্ণনাকারী বলেনঃ সে অন্ধ ব্যক্তি ছিল। আর সে ততক্ষণে আযান দিত না যতক্ষণে তাকে বলা না হত যে, সকাল হয়ে গেছে সাকাল হয়ে গেছে”। [বুখারী, আযন অধ্যায়, নং ৬১৭]
জমহূর উলামার নিকট উক্ত আযান বৈধ কিন্তু সাউরী, আবু হানীফা এবং মুহাম্মদ এর বিপরীত মত ব্যক্ত করেন। অতঃপর উলামাগণ মতভেদ করেন যে, সেই আযানই কি ফজরের জন্য যথেষ্ট না ফজরের জন্য ভিন্ন আযান দিতে হবে? উপরোক্ত দলীল প্রমাণ করে যে, প্রথম আযান যথেষ্ট নয় বরং পরে ফজর হওয়ার পর ফজরের আযান দিতে হবে, যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে অন্ধ সাহাবী ইবনু উম্মি মাকতুম দিতেন।
উল্লেখ্য যে, ফজরের পূর্বের আযান মুস্তাহাব আযান জরুরি নয়। তা দিতে গিয়ে যদি জনপদের লোকেরা বিভ্রান্তিতে পড়ে এবং এটা ফজরের আযান না ফজরের পূর্বের আযান তা নিয়ে গোলমালে থাকে তাহলে এমন সময় সেই আযান দেওয়া উত্তম হবে না। হ্যাঁ, তবে যদি দুই আযানের ভিন্ন ভিন্ন মুয়াযযিন নির্ধারণ করা হয় যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে ছিল এবং লোকেরা তাদের আওয়াজ পার্থক্য করতে পারে, তাহলে আযান দেওয়া মুস্তাহাব হবে।
এক মসজিদে একাধিক মুয়াযযিন নিয়োগ করাঃ
প্রয়োজনে এক মসজিদে দুই জন মুয়াযযিন নিয়োগ করা বৈধ। যেমন রাসূল (সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর যুগে তাঁর মসজিদে বিলাল ও ইবনু উম্মি মাকতূম (রাযিঃ) ছিল। [বুখারী, আযন অধ্যায়, নং ৬১৭] অতঃপর প্রয়োজন ও সুবিধার্থে দুইয়ের অধিক মুয়াযযিন নিয়োগ করা বৈধ হবে; কারণ উসমান (রাযিঃ) এর চারজন মুয়াযযিন ছিল। [তালখীসুল হাবীর,১/৫২২,আল্ মাজমূ, ৩/১৩০]
অন্ধ ব্যক্তির আযানঃ
অন্ধ ব্যক্তির আযান নিঃসন্দেহে বৈধ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “বিলাল রাতে আযান দেয়, তাই তোমরা খাও ও পান কর যতক্ষণ ইবনু উম্মি মাকতূম আযান না দেয়। বর্ণনাকারী বলেনঃ সে অন্ধ ব্যক্তি ছিল। আর সে ততক্ষণ আযান দিত না যতক্ষণ তাকে বলা না হত যে, সকাল হয়ে গেছে সাকাল হয়ে গেছে”। [বুখারী, আযান অধ্যায়, নং ৬১৭] আর যেহেতু আযানের উদ্দেশ্য নামাযের সংবাদ দেওয়া, তাই সেই উদ্দেশ্য যেমন দৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তির আওয়াজ দ্বারা আদায় হয় তেমন অন্ধ ব্যক্তির শব্দ দ্বারাও সম্পন্ন হয়।
তবে অধিকাংশ ফুকাহা মনে করেন, অন্ধ মুয়াযযিনের সাথে যেন এমন ব্যক্তি থাকে যে তাকে সময় সম্পর্কে অবগত করবে; কারণ সে নিজে নিজে সময়ের শুরু ও শেষ জানতে অক্ষম। [মুগনী,২/৬৯/কাশফুল্লিসাম,২/১৮৩] তবে এ যুগে উক্ত কারণেরও তেমন গুরুত্ব নেই কারণ; বর্তমানে অন্ধ ব্যক্তি বিশেষ যন্ত্রপাতির মাধ্যমে নিজে নিজে সময় সম্পর্কে জানতে সক্ষম।
ইক্বামতের কতিপয় বিধানঃ
ইতিপূর্বে আলোচনায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে আযানের সাথে সাথে ইক্বামতেরও কিছু আলোচনা হয়েছে। এখানে সে সবের সাথে আরও কিছু যোগ করা হলঃ
ইক্বামতের শব্দ সংখ্যাঃ
অধিক সহীহ সূত্রে বর্ণিত ইক্বামতের শব্দ সংখ্যা এগারোটি। সবকটিই বেজোড় দুটি ছাড়া। একটি হল শুরুতে দুটি তাকবীর এবং শেষে ‘ক্বাদকামাতিস স্বলাহ’ জোড়। এবিষয়ে সুনান আবু দাউদে হাদীস বিদ্যমান।
আযান ও ইক্বামতের মাঝের সময়সীমাঃ
আযানের পর এবং নামায শুরু করার পূর্বে ইমাম কতক্ষণ বিরতি দিবেন বা অপেক্ষা করবেন, তার কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা সহীহ হাদীস দ্বারা বর্ণিত নয়। তবে বিভিন্ন হাদীসের আলোকে কিছুক্ষণ বিরতি দেওয়া প্রমাণিত। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘‘প্রত্যেক দুই আযানের মাঝে নামায রয়েছে’’। [বুখারী,নং ৫৮৮] অর্থাৎ আযান ও ইকামতের মাঝে নফল নামায আছে। এমনকি তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাগরিবের ফরয নামাযের পূর্বেও নামায পড়ার আদেশ দেন। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ‘‘তোমরা মাগরিবের পূর্বে নামায পড়, তোমরা মাগরিবের পূর্বে নামায পড়, তৃতীয়বারে বলেনঃ যার ইচ্ছা”। [বুখারী নং ১১৮৩]
তাছাড়া আযানের উদ্দেশ্যই হল, লোকদের সংবাদ দেওয়া যে নামাযের সময় হয়ে গেছে, যাতে করে তারা অযু করে নামাযের প্রস্তুতি নিয়ে মসজিদে উপস্থিত হয়। তাই আযানের পর সময় না দিলে এই মূল উদ্দেশ্যই বিনষ্ট হয়।
ইশার নামায সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, যদি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে লোকদের অধিকহারে উপস্থিতি দেখতেন, তাহলে তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটু আগেই নামায শুরু করতেন আর যদি সংখ্যা কম দেখতেন তো একটু বিলম্ব করতেন। [বুখারী, নং ৫৬৫]
উপরোক্ত তথ্যানুসারে এটা স্পষ্ট যে, আযান ও ইকামতের মাঝে কিছুক্ষণ সময় অপেক্ষা করা প্রমাণিত ও মুস্তাহাব। তবে নির্দিষ্টরূপে এর সময়সীমা কতখানি হবে তা বর্ণিত নয়। তাই বিভিন্ন নামাযের পূর্বে সুন্নতে রাতেবার দিকে লক্ষ্য রেখে, নামাযীদের দূর ও নিকটে অবস্থানের দিকে লক্ষ্য রেখে এবং আরো অন্যান্য বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রেখে ইমাম সময়সীমা নির্ধারণ করতে পারেন।
যে আযান দিবে তাকেই কি ইক্বামত দিতে হবে?
আযান দাতাই কেবল ইক্বামত দেওয়ার অধিকার রাখে অন্য কেউ দিতে পারে না, এমন মনে করা সঠিক নয়। “কারণ যে আযান দিয়েছে সেই ইক্বামত দিবে” বা “সেই ইক্বামত দেয়ার হকদার যে আযান দিবে” মর্মে যেই হাদীস প্রসিদ্ধ তা নিতান্ত দুর্বল। [নায়লুল আউত্বার,১-২/৪৭৬] তবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুয়াযযিন বিলাল (রাযিঃ) এর আযান ও ইক্বামতের নিয়মে এটা প্রমাণিত যে, সাধারণতঃ সেই ইক্বামত দিত। তাই বলা যেতে পারে যে, মুয়াযযিন ইক্বামত দিবে এই নিয়ম সাব্যস্ত কিন্তু তা জরুরী ভিত্তিক নয়।
(ক্বাদ ক্বামাতিস্ স্বলাহ) বলার সময় (আক্বামাহাল্লাহু ওয়া আদামাহা) বলাঃ
ইক্বামত দাতার (ক্বাদ ক্বামাতিস্ স্বলাহ) বলার সময় শ্রবণকারীদের (আক্বামাহাল্লাহু ওয়া আদামাহা) বলা মর্মে যে দলীল এসেছে তা নিতান্ত দুর্বল, আমল অযোগ্য তাই তা বলা যাবে না। [ফাতাওয়াল্ লাজনা আদ্দায়িমাহ,৬/৮৯, তাস্বহীহুদ্দুআ/৩৯৫]
ইক্বামতের জবাব দেওয়াঃ
আযান শুনে যেভাবে আযানের জবাব দিতে হয়, সেভাবে ইক্বামতের সময়ও কি ইক্বামতের জবাব দিতে হবে? অনেকে মনে করেন, যেহেতু শরীয়ার ভাষায় ইক্বামতেকেও আযান বলা হয়েছে, যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “প্রত্যেক দুই আযানের মাঝে নামায রয়েছে।” [বুখারী] তাই ইক্বামতও একটি আযান এবং তা দ্বিতীয় আযান। একারণে যেমন আযানের জবাব দেওয়া সুন্নাত তেমন ইক্বামতের জবাব দেওয়াও সুন্নাত। [ফাতাওয়াল লাজনা, ৬/৮৯-৯০]
কিন্তু আযান ও ইক্বামত উভয়কে আযান বলা হলেও যেভাবে আযানের উত্তর দেওয়া সুস্পষ্ট দলীল দ্বারা প্রমাণিত তেমন ইক্বামতের উত্তর দেওয়ার কোনো স্পষ্ট সঠিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। ইক্বামতকে আযানের অনুরূপ মনে করে যদি আমরা ইক্বামতের জবাব দেওয়া ভাল মনে করি, তাহলে প্রশ্ন আসে যে, যেমন আযানের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি দরূদ পাঠ করা এবং আযানের দুআ পাঠ করা প্রমাণিত, তেমন কি ইক্বামতের পরেও প্রমাণিত? এর স্বপক্ষে কোনো‌ স্পষ্ট দলীল পাওয়া যায় না।
ফরয নামাযের ইক্বামত দেওয়া হলেও কি সুন্নত পড়া যায়?
এ সম্বন্ধে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে স্পষ্টই বর্ণিত হয়েছে, তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “যখন (ফরয) স্বলাতের ইক্বামত দেওয়া হবে, তখন ফরয নামায ব্যতীত আর অন্য কোনো নামায নেই”। [মুসলিম, অধ্যায়ঃ স্বলাতুল মুসাফেরীন, নং ৭১০]
ইমান নবভী বলেনঃ ফরয নামাযের ইক্বামতের পর নফল শুরু করা সম্বন্ধে এই দলীলটি একটি স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা; চায় তা সুন্নতে রাতেবা (সুন্নতে মুআক্কাদা) হোক যেমন ফজর, যোহর, আসরের সুন্নাত বা অন্য স্বলাতের সুন্নাত। আর এটাই শাফেঈ এবং জমহূর উলামার মত। [শারহু মুসলিম,৩/২২৬]
যারা মনে করে, ফজরের সুন্নত পড়তে  হবে যদিও ইমামের সাথে এক রাকাআত পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে বা নামাযের কোনো অংশ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাদের এই মতও প্রত্যাখ্যাত কারণ ফজরের ইক্বামতের পর জনৈক সাহাবী সুন্নত পড়তে থাকলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার এই কাজকে অপছন্দ মনে করেন। ইবনে বুহাইনা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ফজরের ইক্বামত দেওয়া হয় এমতাবস্থায় আল্লাহর রাসূল এক ব্যক্তিকে নামায পড়তে দেখেন। ঐসময় মুয়াযযিন ইক্বামত দিচ্ছিল। তখন তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম বললেনঃ তুমি কি সকালের নামায চার রাকাআত আদায় করছো? [সহীহ মুসলিম, স্বলাতুল মুসাফেরীন, নং ৭১১]
অনেকে মনে করেন, নফল ইবাদত শুরু করলে তা পূরণ না করেই মাঝখানে নষ্ট করে দেওয়া নিষেধ ও গুনাহ। কিন্তু তাঁদের এই মত এ কারণে প্রত্যাখ্যাত যে, একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নফল রোযা রাখার পর তা পূরণ না করেই ভঙ্গ করেছেন। আয়েশা (রাযিঃ) বলেনঃ একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার নিকট প্রবেশ করলেন এবং বললেনঃ তোমাদের কাছে কি কিছু আছে? আমরা বললাম নেই। তখন তিনি বললেনঃ তাহলে আমি রোযায় থাকলাম। অতঃপর অন্য এক দিন আসলে আমরা বললামঃ আমাদের ‘হায়স’ খাদ্য হাদিয়া দেওয়া হয়েছে। তখন তিনি বললেনঃ আমাকে দেখাও দেখি আমি তো আজ রোযাবস্থায় সকাল করেছি। অতঃপর তিনি তা ভক্ষণ করলেন। [মুসলিম, সিয়াম অধ্যায়, নং ১১৫৪]
অন্যদিকে শরীয়ায় এই নীতি স্পষ্ট যে, সুন্নতের চেয়ে ফরয অবশ্যই বেশী গুরুত্বপূর্ণ। তাই ফরয ছেড়ে সুন্নত আদায় যেমন বিবেক বিরোধী তেমন দলীল বিরোধীও।
লেখক: আব্দুর রাক্বীব মাদানী
দাঈ, দাওয়াহ সেন্টার খাফজী, সউদী আরব।
সম্পাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার

No comments:

Post a Comment

Download AsPDF

Print Friendly and PDFPrint Friendly and PDFPrint Friendly and PDF
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...