Wednesday 16 March 2016

আযান ও মুয়াযযিন (পর্ব-২)

unnamedىغ7আযান ও মুয়াযযিন (পর্ব-২)
লেখক: আব্দুর রাকীব মাদানী
সম্পাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
আযানের পদ্ধতি ও শব্দসমূহঃ
১ম পদ্ধতিঃ  এই পদ্ধতিটি আব্দুল্লাহ বিন যাঈদ (রাযিঃ) এর হাদীস দ্বারা প্রমাণিত এবং এটিকে বেলাল (রাযিঃ) এর আযানও বলা হয়। [কাশফুল্ লিসাম,২/১৬০] এই নিয়ম অনুযায়ী আযানের বাক্যসমূহের সংখ্যা ১৫ টি, ফজর ব্যতীত। প্রথমে তাকবীর ৪টি, আল্লাহর সাক্ষ্য ২টি, রিসালতের সাক্ষ্য ২টি, হায়আলা ৪টি, তাকবীর ২টি এবং শেষে তাওহীদের বাক্য ১টি।
আব্দুল্লাহ বিন যাইদ ইবনু আবদে রাব্বিহি হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাযে লোকদের একত্রিত করার উদ্দেশ্যে নাকূস বা ঘণ্টা বাজানোর আদেশ দিলেন, তখন এক রাত্রে আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, এক ব্যক্তি তার হাতে একটি  বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। আমি তাকে বললামঃ হে আল্লাহর বান্দা! তোমার ঘণ্টাটি বিক্রয় করবে কি? লোকটি বললঃ এ দ্বারা তুমি কী করবে? আমি বললামঃ এর দ্বারা আমি মানুষকে নামাযের আহ্বান করব। সে বললঃ আমি কি তোমাকে এর চাইতে উত্তম পন্থা শিখিয়ে দিব না? আমি বললামঃ হ্যাঁ, শিখিয়ে দাও। লোকটি তখন বললঃ তুমি এরূপ বলঃ
الله أكبر، الله أكبر، الله أكبر، الله أكبر، أشهد أن لا إله إلا الله،  أشهد أن لا إله إلا الله، أشهد أن محمداً رسولُ الله، أشهد أن محمداً رسولُ الله، حيَّ علىَ الصلاة، حيَّ علىَ الصلاة، حيَّ عَلىَ الفلاح، حيَّ عَلىَ الفلاح، الله أكبر، الله أكبر، لا إله إلا الله.
(উচ্চারণঃ আল্লাহু আক্ বার, আল্লাহু আক্ বার, আল্লাহু আক্ বার, আল্লাহু আক্ বার, আশহাদু আল্লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ্, আশহাদু আল্লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ্, আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার্ রাসূলুল্লাহ্, আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার্ রাসূলুল্লাহ্, হাইয়্যা আলাস্ স্বালাহ্, হাইয়্যা আলাস্ স্বালাহ্, হাইয়্যা আলাল্ ফালাহ্, হাইয়্যা আলাল্ ফালাহ্, আল্লাহু আক্ বার, আল্লাহু আক্ বার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লা-হ্।) [আবু দাউদ, স্বালাত অধ্যায়, অনুচ্ছেদঃ আযানের নিয়ম নং (৪৯৯) তিরমিযী, নং (১৮৯) এবং ইবনু মাজাহ, নং (৭০৬)]
দ্বিতীয় পদ্ধতিঃ এই পদ্ধতি অনুসারে আযানের শব্দসমূহের সংখ্যা ১৯। এই আযানকে ‘তারজী’ সহ আযান বলা হয়।
আযানে তারজী হল, সাধারণ আযান দেওয়ার মত প্রথমে জোর কণ্ঠে ৪বার আল্লাহু আকবার বলার পর ধীর কণ্ঠে  প্রথমে দুই বার আশহাদু আল্লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ এবং দুই বার আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ বলা। অতঃপর পুনরায় সেই বাক্যগুলি পূর্বের মত জোর কণ্ঠে  বলা। [রাওযাতুত্ ত্বালেবীন,১/৩১০] এই ভাবে প্রথম নিয়মের তুলনায় এই নিয়মে দুই শাহাদাতের ৪টি বাক্য বেশী হয়। ফলে সর্বমোট আযানের বাক্য সংখ্যা দাঁড়ায় ১৯ টি।

আবু মাহযূরা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে আযান শিক্ষা দেন এবং বলেনঃ
আল্লাহু আক্ বার, আল্লাহু আক্ বার,
আল্লাহু আক্ বার, আল্লাহু আক্ বার,
আশহাদু আল্লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ্,
আশহাদু আল্লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ্,
আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার্ রাসূলুল্লাহ্,
আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার্ রাসূলুল্লাহ্
অতঃপর বললেনঃ পুনরায় ফেরত আস এবং  কণ্ঠকে দীর্ঘ কর। তার পর বললেন, বলঃ
আশহাদু আল্লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ্,
আশহাদু আল্লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ্,
আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার্ রাসূলুল্লাহ্,
আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার্ রাসূলুল্লাহ্।
হাইয়্যা আলাস্ স্বালাহ্,
হাইয়্যা আলাস্ স্বালাহ্,
হাইয়্যা আলাল্ ফালাহ্,
হাইয়্যা আলাল্ ফালাহ্,
আল্লাহু আক্ বার,
আল্লাহু আক্ বার,
লা-ইলাহা ইল্লাল্লা-হ্।
যখন আযান দেয়া শেষ হল তখন তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে ডাকলেন এবং একটি থলে দিলেন যাতে কিছু রৌপ্যমুদ্রা ছিল। তখন আমি বললামঃ আল্লাহর রাসূল আমাকে মক্কায় আযান দেওয়ার আদেশ দিন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ যাও তোমাকে আদেশ দিলাম। [নাসাঈ, আযান নং ৬৩১ এবং ৬৩০/মুসলিম, স্বালাত অধ্যায়, আযানের পদ্ধতি অনুচ্ছেদ, নং ৩৭৯]
ইমাম নভবী বলেনঃ ‘হাদীসটি মালেক, শাফেঈ, আহমাদ ও জমহূরে উলামার পক্ষে স্পষ্ট দলীল যে, আযানে তারজী বৈধ ও প্রমাণিত। আর তা হচ্ছে, দুই শাহাদাতকে নিচু স্বরে বলার পর পুনরায় উঁচু কণ্ঠে  আবার বলা।
ইমাম আবু হানীফা ও কুফীরা বলেনঃ তারজী বৈধ নয়। কারণ আব্দুল্লাহ বিন যায়দ এর হাদীসে তারজী নেই। আর জমহূরের দলীল হল এই স্বহীহ হাদীসটি। তাতে বর্ণিত বেশী অংশ গৃহীত এবং এ কারণেও যে, আবু মাহযূরার হাদীস পরে বর্ণিত হাদীস আর আব্দুল্লাহ বিন যাইদের হাদীস পূর্বেকার হাদীস। এটা এই কারণে যে, আবূ মাহযূরার হাদীস হুনাইনের পরে ৮ম হিজরীর ঘটনা আর আব্দুল্লাহ বিন যাইদের হাদীস শুরু যুগের ঘটনা। [শারহু মুসলিম,৪/৮৪]
উল্লেখ্য যে, আযানের উক্ত সুন্নতী নিয়ম আমাদের সমাজে প্রচলিত নয়। তাই তা পুণরুজ্জীবিত করা একটি উত্তম আমল।
তৃতীয় পদ্ধতিঃ এই পদ্ধতি অনুযায়ী আযানের শব্দ সংখ্যা ১৭। এই নিয়মে তারজী রয়েছে এবং শুরুতে চার বার আল্লাহু আকবারের স্থানে দুই বার আল্লাহু আকবার রয়েছে। এই পদ্ধতি ইমাম মালেক গ্রহণ করেছেন। তাঁর দলীল হলঃ
আবু মাহযূরা থেকে বর্ণিত, তাকে আল্লার নবী এই আযান শিক্ষা দেন।
আল্লাহু আক্ বার,
আল্লাহু আক্ বার,
আশহাদু আল্লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ্,
আশহাদু আল্লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ্,
আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার্ রাসূলুল্লাহ্,
আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার্ রাসূলুল্লাহ্।
অতঃপর পুণরায় বললেনঃ
আশহাদু আল্লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ্,
আশহাদু আল্লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ্,
আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার্ রাসূলুল্লাহ্,
আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার্ রাসূলুল্লাহ্।
হাইয়্যা আলাস্ স্বালাহ্ (দুই বার)
হাইয়্যা আলাল্ ফালাহ্ (দুইবার) 
আল্লাহু আক্ বার, আল্লাহু আক্ বার,
লা-ইলাহা ইল্লাল্লা-হ্।
[স্বহীহ মুসলিম, স্বালাত অধ্যায়, আযানের পদ্ধতি অনুচ্ছেদ নং ৩৭৯]
দেখা যাচ্ছে, ইমাম মুসলিমের বর্ণনার শুরুতে আল্লাহু আকবার দুই বার বর্ণিত হয়েছে। আর এটাই ইমাম মালিক তার মতের পক্ষে দলীল হিসাবে গ্রহণ করেছেন।
শাইখ ইবনু উসাইমীন (রহঃ) বলেনঃ এ সকল পদ্ধতি যা সুন্নতে এসেছে, যদি কখনো এক পদ্ধতিতে এবং কখনো অন্য পদ্ধতিতে আযান দেওয়া হয়, তো এমন করা ভাল। এ ক্ষেত্রে  মূলনীতি হচ্ছেঃ ‘ইবাদত যা বিভিন্ন পদ্ধতিতে প্রমাণিত, লোকদের উচিৎ হবে তারা যেন সেই ইবাদতটি উক্ত সকল পদ্ধতিতে সম্পাদন করে’। এমন বিভিন্ন প্রমাণিত পদ্ধতিতে আমল করার কিছু লাভ ও রয়েছেঃ
  • ক-সুন্নতের সংরক্ষণ এবং লোকদের মাঝে তার বিভিন্ন প্রকারের প্রচার। যথা:
  • খ-আমলকারীর পক্ষে সহজ। কারণ সে সমস্ত নিয়মের কোনও একটি অন্যটি অপেক্ষা সহজতর।
  • গ-মনযোগী থাকা এবং ক্লান্ত বোধ না করা।
  • ঘ-শরীয়তের সকল নিয়মের প্রতি আমল করা। [শারহুল মুমতি ২/৫৬-৫৭]
ফজরের আযানে তাছবীব করাঃ (আস্ স্বলাতু খায়রুম মিনান্ নাউম বলা)
তাছবীব হল, ফজরের আযানে দুই হাইআলা বলার পর দুই বার ‘আসস্বালাতু খায়রুম মিনান নাউম’ বলা, যার অর্থঃ ঘুম হতে নামায উত্তম।
আবু মাহযূরা (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমি আল্লাহর রাসূলের উদ্দেশ্যে আযান দিতাম এবং ফজরের প্রথম আযানে বলতামঃ
হাইয়্যালাল ফালাহ,
আস স্বালাতু খায়রুম মিনান নাউম,
আস স্বালাতু খায়রুম মিনান নাউম,
আল্লাহু আকবার,
আল্লাহু আকবার,
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।
[নাসাঈ, আযান অধ্যায় নং ৬৪৬]
আবু দাউদের বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহর রাসূল আবু মাহযূরাকে বলেনঃ যখন সকালের নামায হবে তখন বলবেঃ
আস্ স্বালাতু খায়রুম মিনান নাউম,
আস্ স্বালাতু খায়রুম মিনান নাউম।
অনেকে তাছবীব আযান শেষে হবে বলে মত ব্যক্ত করেছেন, অনেকে তা ফজর ইশার নামাযেও বৈধ বলে মত দিয়েছেন, আর অনেকে সকল নামাযের আযানে তা বলা বৈধ বলেছেন। তবে উপরোক্ত হাদীস তাদের মতামত খণ্ডন করে এবং তা কেবল ফজরের সাথে নির্দিষ্ট করে।
প্রচণ্ড শীতের রাতে কিংবা বৃষ্টির সময় আযানঃ
উপরোক্ত সময়ে আযান দেয়ার সময় মুয়াযযিন বলবেঃ
(আস্ স্বালাতু ফির্ রাহাল্) কিংবা (স্বল্লু ফী রিহালিকুম)। অর্থাৎ নিজ বাসস্থানে নামায আদায় করুন।
ইবনে উমার বলেন, রাসূল স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুয়াযযিনকে আদেশ করতেন, যখন ঠাণ্ডা ও বৃষ্টির রাত হত-যেন সে বলেঃ আলা! স্বল্লু ফী রিহালিকুম। [বুখারী, আযান অধ্যায়, নং ৬৬৬]
উক্ত বাক্য আযান শেষে কিংবা দুই হাইআলা শেষে কিংবা দুই হাইআলার বদলে বলা যায়। [তাস্বহীহুদ্ দুআ, বাকর আবু যাঈদ পৃঃ ৩৭০,ফাতহুল বারী,৩/১৪৯]
সূর্য-চন্দ্র গ্রহণের সময় নামামাযের আহ্বান:
সূর্যগ্রহণের সময় লোকদের আযান ছাড়া শুধু এই বাক্য দ্বারা সংবাদ দিতে হবে যে, আস্ স্বলাতু জামেআতুন। অর্থাৎ জামাআতের সহিত স্বালাত অনুষ্ঠিত হবে। [বুখারী, কুসূফ অধ্যায়, নং ১০৪৫] যেহেতু উক্ত বাক্য কোনো আযানের অংশ নয় বরং তা বলার উদ্দেশ্য সংবাদ দেওয়া তাই তা নিজ ভাষাতেও দেওয়া বৈধ।
আযান হবে জোড়া শব্দে আর ইক্বামত হবে বেজোড় শব্দেঃ
আযানের বাক্য ও ইক্বামতের বাক্যগুলির মধ্যে একটি পার্থক্য হচ্ছে, আযানের শব্দগুলি হচ্ছে জোড় সংখ্যাবিশিষ্ট- লাইলাহা ইল্লাল্লাহ ছাড়া। আর ইক্বামতের বাক্যগুলি হচ্ছে বেজোড় সংখ্যা বিশিষ্ট- ক্বাদ কা-মাতিস্ স্বলাহ্ ব্যতীত।
আনাস (রাযিঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেনঃ “বেলালকে আদেশ করা হয়, যেন সে জোড় সংখ্যায় আযান দেয় এবং বেজোড় সংখ্যায় ইক্বামত দেয়- ক্বাদ কা-মাতিস্ স্বলাহ ব্যতীত”। [বুখারী আযান অধ্যায়, নং ৬০৫]
ইবনু হাজার বলেনঃ ‘জোড় সংখ্যায় আযান এবং বেজোড় সংখ্যায় ইক্বামতের কারণে বলা হয়েছে যে, আযান হচ্ছে অনুপস্থিতদের উদ্দেশ্যে আহ্বান। তাই তা যুগলভাবে বলা ভাল যেন তা তাদের নিকটে ভালভাবে পৌঁছে। পক্ষান্তরে ইক্বামত হচ্ছে উপস্থিত লোকদের উদ্দেশ্যে। এই কারণে আযান উঁচু স্থানে দেওয়া মুস্তাহাব; ইক্বামত নয়। আযানের কণ্ঠস্বর উঁচু হওয়া মুস্তাহাব; ইক্বামত নয় এবং আযান যেন ধীর গতিতে হয় আর ইক্বামত ত্বরিত গতিতে’। [ফাতহুল বারী,২/১১২]
উল্লেখ্য যে, ইক্বামত বেজোড় সংখ্যায় হবে, এটি অধিকাংশ উলামার অভিমত। সালাফদের যারা এই মত গ্রহণ করেছে তারা হলেনঃ সাঈদ বিন মুসাইয়্যেব, উরওয়া বিন যুবাইর, যুহরী, মালিক বিন আনাস ও হিজাযবাসী।  শাফেঈ ও তাঁর সাথীগণ, উমার বিন আব্দুল আযীয, মাকহূল, আউযায়ী এবং শামবাসী। হাসান বাস্বরী, মুহাম্মদ বিন সীরীন, আহমাদ বিন হাম্বাল এবং তাঁর অনুসারী ইরাকবাসীগণ। [তুহফাতুল আহওয়াযী,১/৪৯২-৪৯৩]
অবশ্য সুফইয়ান সাউরী, ইবনুল মুবারক এবং ইমাম আবু হানীফা জোড় সংখ্যায় ইক্বামত দেওয়ার পক্ষে মত ব্যক্ত করেছেন। কারণ সুনান গ্রন্থে আযানের মত জোড় সংখ্যায় ইক্বামত দেওয়ার হাদীস বিদ্যমান এবং হাদীসের মানদণ্ডে সেই হাদীসগুলিও গ্রহণীয়; যদিও সেগুলির মান সহীহাইনের (বুখারী ও মুসলিম এর) মত নয়। এই কারণে বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত বেজোড় ইক্বামতের দলীল সমূহ বেশী প্রাধান্য পাবে এবং সুনান গ্রন্থে বর্ণিত জোড় সংখ্যায় ইক্বামত দেওয়া বৈধ হবে। এ মত সাহেবে তুহফা সহ অনেকে ব্যক্ত করেছেন। [তুহফাতুল আহওয়াযী,১/৪৯৬-৪৯৮]
আযান শ্রবণকারীর জন্য যা সুন্নতঃ
১-আযানের উত্তর দেওয়াঃ অর্থাৎ মুয়াযযিন যা বলে আযান দেয়, আযান শ্রবণকারীও যেন পুণরায় সেই বাক্যগুলি বলবে আযানের এক একটি বাক্য শোনার পরে।
আবু সাঈদ খুদরী (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “যখন তোমরা আযান শুনবে তখন বলবে যেমন মুয়াযযিন বলে”। [বুখারী, আযান, নং ৬১১]
আযানের উত্তর দেয়ার উপরোক্ত সাধারণ নিয়ম থেকে দু জায়গা ব্যতিক্রম:
  • ক-দুই শাহাদাতের উত্তরঃ অর্থাৎ (আশ্ হাদু আল্লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ এবং আশ্ হাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ) এর উত্তরে যেমন মুআযযিনের ন্যায় হুবহু উক্ত বাক্য বলা যায় তেমনি তা বলার পূর্বে (ওয়া আনা আশ্ হাদু) যুক্ত করে উত্তর দেওয়াও প্রমাণিত। [ফাতহুলবারী,২/১২৩, নায়লুল আউত্বার ১-২/৪৭১] অর্থাৎ এমন বলাঃ (ওয়া আনা আশহাদু আল্লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ) (ওয়া আনা আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ)। অনুরূপ আশহাদু আল্লা-ইলাহা… এবং আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার…বলার পর “রাযীতু বিল্লাহি রাব্বান, ওয়া বিমুহাম্মাদিন রাসূলান, ওয়া বিল্ ইসলামে দীনান” বলাও প্রমাণিত। [তাস্বহীহুদ্দুআ, পৃঃ ৩৭০-৩৭১]
  • খ-দুই হাইআলার উত্তরঃ এই সময় মুআযযিনের মত উক্ত বাক্যদ্বয় বলে উত্তর দেওয়া বৈধ এবং “লা-হাউলা ওয়ালা কুওআতা” বলে উত্তর দেওয়াও প্রমাণিত। [বুখারী, আযান অধ্যায় নং ৬১৩] দ্বিতীয় উত্তরটি বেশী উত্তম। [তাস্বহীহুদ্দুআ/৩৭২]
২-নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি দুরূদ পাঠ করাঃ
আযান শেষে এবং আযানের দুআ পাঠের পূর্বে দুরূদ পাঠ প্রমাণিত সুন্নত। আব্দুল্লাহ বিন আমর হতে বর্ণিত, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন: “যখন মুয়াযযিনের আযান শুনবে, তখন তোমরা অনুরূপ বলবে। অতঃপর তোমরা আমার প্রতি দরূদ পাঠ করবে; কেননা যে আমার প্রতি একবার দরূদ পড়ে আল্লাহ তার উপর দশটি রহমত প্রেরণ করবেন”। [মুসলিম, স্বলাত অধ্যায়, নং ৮৪৭/আবু দাঊদ, স্বলাত অধ্যায় নং ৫২৩/তিরমিযী এবং নাসাঈ]
উত্তম দরূদ হল দরূদে ইবরাহীমী যা আমরা স্বলাতে পড়ে থাকি।
৩-অতঃপর নিম্নোক্ত দুআ পাঠ করাঃ
“আল্লাহুম্মা রাব্বা হা-যিহিদ্ দা’ওয়াতিত্ তা-ম্মাহ, ওয়াস্ স্বলাতিল ক্বায়িমাহ, আতি মুহাম্মাদানিল্ ওয়াসীলাতা ওয়াল্ ফযীলাহ, ওয়াব্ আসহু মাক্বামাম মাহমূদা, আল্লাযী ওয়াদ্ তাহ্”।
অর্থঃ “হে আল্লাহ! এই পরিপূর্ণ আহবান এবং এই প্রতিষ্ঠিত নামাযের তুমিই প্রভু। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দান কর সর্বোচ্চ সম্মানিত স্থান এবং সুমহান মর্যাদা। তাঁকে প্রতিষ্ঠিত কর প্রশংসিত স্থানে যার অঙ্গিকার তুমি তাঁকে দিয়েছো”। [বুখারী, আযান অধ্যায়ঃ নং ৬১৪]
আযানের দুআয় বর্ণিত কতিপয় শব্দের অর্থঃ
পরিপূর্ণ আহবানঃ অর্থাৎ তাওহীদের আহ্বান তাওহীদের আহ্বান পরিপূর্ণ বলার কারণ এই যে, তা অপরিবর্তনশীল তাতে রদ্দ-বদলের আশংকা নেই; বরং তা কেয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী।
অসীলাহঃ (সুমহান মর্যাদা) যার মাধ্যমে নৈকট্য অর্জন করা হয়। বলা হয়, ‘তাওয়াসসালতু’ (আমি অসীলা করলাম) অর্থাৎ নৈকট্য অর্জন করলাম।
অনুরূপভাবে জান্নাতের সবোর্চ্চ মর্যাদাপূর্ণ স্থানকে ওসীলা বলা হয় যার অধিকারী হবেন কেবল নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। (সহীহ মুসলিম)
ফযীলাহ (সর্বোচ্চ সম্মানিত স্থান) অর্থাৎ সমস্ত সৃষ্টির থেকে বেশী মর্যাদা। এটি উপরোক্ত অসীলাহ শব্দের ব্যাখ্যাও হতে পারে।
মাকামে মাহমূদ (প্রশংসিত স্থান) অর্থাৎ এমন স্থান যাতে অবস্থানকারী প্রশংসা করবেন। [নায়লুল আউত্বার,১-২/৪৭৩] কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা সমগ্র মানব কুলের  বিচার-ফয়সালার শাফায়াত করার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এই বিশেষ মর্যাদা দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন। যে কারণে তিনি মানবজাতির সর্ব মহলে প্রশংসিত হবেন।
আযানের দুআয় ইন্নাকা লা তুখলিফুল মীআদ বৃদ্ধি করাঃ
আযানের উপরোক্ত দুআ বিশুদ্ধ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে কিন্তু সুনান বায়হাক্বীতে উক্ত দুআ শেষে আরও একটি বাক্য অতিরিক্ত বর্ণিত হয়েছে, তা হলঃ ‘ইন্নাকা লা তুখলিফুল মীআদ’ অর্থাৎ নিশ্চয় তুমি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ কর না। এই বাক্যটিকে উসূলে হাদীসের পরিভাষায় ‘শায’ (অধিকতর শক্তিশালী বর্ণনাকারীর বিপরিত বর্ণনা-যা দূর্বল হিসেব পরিগণিত) বলা হয়েছে। অর্থাৎ শক্তিশালী বর্ণনাকারীর এমন বর্ণনা যা সে তার থেকে অধিকতর শক্তিশালী বর্ণনাকারীর বিপরীত করেছে। উক্ত হাদীসের সূত্রে শায বর্ণনাকারী রাভী হচ্ছেন মুহাম্মদ বিন আউফ আত্ ত্বায়ী। হাদীসটির দুটি সূত্র রয়েছে এবং এক ডজনেরও অধিক সৎ বর্ণনাকারী সেই বর্ধিত অংশ ছাড়াই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। [বিস্তারিত দেখুন, তাস্বহীহুদ্দুআ, বাকর আবু যাঈদ, পৃঃ ৩৮২-৩৮৩]
৪-আযানের জবাব শেষে নিজের জন্য দুআ করাঃ
ইবনে আমর থেকে বর্ণিত, একদা এক ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললঃ “মুয়াযযিনরা আমাদের চেয়ে বেশী ফযীলত পায়? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ তুমি বল যেমন মুয়াযযিনরা বলে। আর আযান শেষ দুয়া করা তোমার দুয়া কবুল করা হবে”। [আহমদ, আবু দাঊদ, ইবনু হিব্বান, সূত্র স্বহীহ স্বহীহুত তারগীব ও তারহীব]
ইমান নবভী বলেনঃ ‘জেনে রাখুন, যে ব্যক্তি আযাস শুনবে তাকে মুয়াযযিনের আযানের ন্যায় উত্তর দেওয়া মুস্তাহাব, সে পবিত্র অবস্থায় থাক কিংবা অপবিত্র অবস্থায় জুনুবী (বড় নাপাকী) অবস্থায় থাক কিংবা ঋতুবস্থায় থাক।
তবে যে সব ক্ষেত্রে উত্তর দেয়া সমিচিত নয় সেগুলোর মধ্যে, যদি কেউ শৌচকাজে রত থাকে কিংবা স্ত্রীর সাথে সহবাসরত থাকে। অনুরূপভাবে নামাযরত অবস্থায়ও আযানের উত্তর দেওয়া যাবে না। তবে সালাম ফিরানোর পর দিতে হবে’। [শারহু মুসলিম, ৪/৯২]
আযানের জবাব দেয়ার ফযীলতঃ
আব্দুল্লাহ বিন আমর হতে বর্ণিত তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বলতে শুনেছেন, তিনি বলেনঃ যখন তোমরা আযান শুনবে, তখন তোমরা তাই বলবে যা মুয়াযযিন বলে। তারপর আমার প্রতি দরূদ পাঠ করবে। কেননা যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরূদ পাঠ করবে, আল্লাহ তার উপর দশটি রহমত বর্ষণ করবেন। অতঃপর আমার জন্য অসীলার প্রার্থনা কর। অসীলা জান্নাতের সবোর্চ্চ মর্যাদাপূর্ণ স্থানের নাম আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে শুধু এক জনের জন্য সমিচীন। আর আমি আশা করি আমিই সেই ব্যক্তি। যে ব্যক্তি আমার জন্য অসীলার প্রার্থনা করবে, তার জন্য আমার শাফাআত আবশ্যক হয়ে যাবে। [মুসলিম, স্বলাত অধ্যায়, নং ৮৪৭, আবু দাঊদ, তিরমিযী এবং নাসাঈ]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, “যে ব্যক্তি একনিষ্ঠভাবে তা বলবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। [মুসলিম নং ৮৪৮]
(চলবে ইন শাআল্লাহ)
লেখক: আব্দুর রাকীব মাদানী, দাঈ, দাওয়াহ সেন্টার খাফজী (সউদী আরব)
সম্পাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল, দাঈ জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার।

No comments:

Post a Comment

Download AsPDF

Print Friendly and PDFPrint Friendly and PDFPrint Friendly and PDF
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...