Friday 5 June 2015

রাসূল যেভাবে রমজান যাপন করেছেন (১ম পর্ব)




পূর্ব কথা

তাকওয়া অর্জন সিয়াম সাধনার মুখ্য উদ্দেশ্য। আত্মার পরিশুদ্ধি, পার্থিবতায় সর্বাঙ্গ আরোপণ থেকে চেতনা ও মনোজগত বিমুক্তিকরণ, বস্তুকেন্দ্রিকতার রাহুগ্রাস থেকে নিজেকে স্বাধীন করে পরকালমুখীনতার সার্বক্ষণিক চর্চা ও লালন সুগম করে দেয় তাকওয়া অর্জনের পথ-পথান্তর। তবে, তার জন্য শর্ত হল, সিয়াম সাধনার প্রতিটি ক্ষণ যাপিত হতে হবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রোজা-যাপন ও সিয়াম-সাধনার উসওয়া-আদর্শ চেতনায়, অনুভূতিতে, আন্তর ও বহির আচরণে জাগ্রত রেখে, সার্বক্ষণিকভাবে।

রোজা যাপন অবস্থায় মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্বীয় প্রতিপালকের সান্নিধ্যে নিজের আবেগ-অনুভূতি-আচরণ উন্মীলিত করার আকার-প্রকৃতি, উম্মত বিষয়ে তাঁর পদক্ষেপ ও কর্মচাঞ্চল্যের ধরন-ধারণ, রোজা যাপনকালে পবিত্র স্ত্রীদের বিষয়ে নানাবিধ কর্মযজ্ঞ্তইত্যাদির পথ ধরে সিয়াম-সাধনার যে পূর্ণাঙ্গ নববী রূপ মূর্তিমান হয়েছে তার জন্য প্রাজ্ঞ লেখক ও বিদগ্ধ শরিয়তবিদ ফায়সাল বিন আলী আল বাদানিকে ধন্যবাদ জানিয়ে খাটো করতে চাই না। প্রখ্যাত গ্রন্থ : হজ পালন অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নান্দনিক আচরণ-এর আদলে রচিত গ্রন্থ 'যেভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান যাপন করেছেন' মাহে রমজান বিষয়ে একটি অভূতপূর্ব রচনা যা রোজা পালন অবস্থায় নববী জীবনের অজানা বহু অধ্যায় উন্মীলিত করেছে মনোজ্ঞ ভাষায়। তারুণ্যদীপ্ত শক্তিমান বঙ্গানুবাদক কাউসার বিন খালেদের ভাষান্তরে বইটি বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের হাতে তুলে দিতে পেরে আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি।

বিদগ্ধ গবেষক নোমান বিন আবুল বাশার, প্রাজ্ঞ আলেমে দ্বীন আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান অনুবাদকর্ম পরিমার্জনে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, আল্লাহ তাদেরকে জাযায়ে খায়ের দান করুন।

পবিত্র মাহে রমজান যাপন ও সিয়াম সাধনায় নববী আদর্শের অনুসরণ-অনুবর্তনের অনুভূতি জাগ্রত করণে বইটি যদি সামান্যতম ভূমিকাও পালন করে তবে আমাদের মেহনত সার্থক হয়েছে বলে মনে করব। আল্লাহ আমাদের শ্রম কবুল করুন। আমিন।
১৩/৯/২০০৭
মুহাম্মদ শামছুল হক সিদ্দিক
মহা-পরিচালক
আবহাস এডুকেশনাল এন্ড রিসার্চ সোসাইটি
বাড়ী নং -১৪, রোড নং -১৫, সেক্টর - ৪, উত্তরা,
ঢাকা, বাংলাদেশ।

সূচি

প্রথম পরিচ্ছেদ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রমজান-পূর্ব সময় যাপন
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রমজান-পূর্ব সময় যাপন 
অন্যান্য সময়ের তুলনায় শাবান মাসে অধিক-হারে রোজা রাখা 
নবী সা. কর্তৃক সাহাবিগণকে রমজান আগমনের সুসংবাদ প্রদান 
রমজানের বিধান বর্ণনা 
চাঁদ দেখার সাক্ষ্য কিংবা পূর্ণ শাবান অতিবাহিত ব্যতীত রোজা পালন আরম্ভ না করা 
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
রমজানে রবের সাথে রাসূলের আচরণ
রমজানে আল্লাহ তাআলার সাথে রাসূল সা.-এর আচরণ 
রাসূল যেভাবে রোজা পালন করতেন 
ইফতার কালে রাসূল সা.-এর দোয়া 
রোজা অবস্থায় মেসওয়াক 
রাতে অপবিত্র অবস্থায় রোজার নিয়ত করা 
তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে মাথায় পানি দেয়া 
কুলকুচা করা ও নাকে পানি দেয়া 
রাসূল সা.-এর সওমে ওসাল 
রমজানে সফর করা, রোজা রাখা কিংবা ভঙ্গ করা 
চাঁদ দেখা কিংবা ত্রিশ দিন পূর্ণ করার মাধ্যমে রোজা ভঙ্গ করণ 
রমজানে রাসূল সা.-এর এবাদতে রাত্রি জাগরণ 
রাসূলের রাত্রিকালীন সালাতের দৈর্ঘ্য 
এতেকাফে আল্লাহর একান্ত-সান্নিধ্য যাপন 
রমজানে রাসূল সা.-এর শেষ দশ দিন যাপন 
লাইলাতুল কদরের অনুসন্ধান ও তাতে রাত্রি-জাগরণ 
জিবরাইল আ:-এর সাথে রাসূলের কোরআন অনুশীলন 
রাসূলের বিনয় ও যুহুদ 
অধিক-হারে সদকা ও সৎ কাজে আত্মনিয়োগ 
রমজান মাসে রাসূলের জেহাদ 
রমজানের আমলে আহলে কিতাবিদের সাথে বৈপরিত্ব 
জীবন সায়া‎েহ্ন আমলের আধিক্য 
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
রমজানে প্রিয় সহধর্মিণীদের সাথে রাসূলের আচরণ
রমজানে প্রিয় সহধর্মিণীদের সাথে রাসূলের আচরণ 
শিক্ষাদান 
রাসূল সম্পর্কে তার সহধর্মিণীদের অবগতি 
কল্যাণ কর্মে উৎসাহ প্রদান 
রাসূলের সাথে এতেকাফ যাপনে অনুমতি প্রদান 
রাসূলের সাথে সম্মিলিত এবাদত পালন 
স্ত্রী-গণের সাথে রাসূলের বান্ধব সুলভ আচরণ ও সম্পর্ক 
এতেকাফগাহে রাসূলের সাথেতার স্ত্রী-গণের সাক্ষাৎ ও কথোপকথন 
রাসূলের উদ্দেশ্য তার স্ত্রীদের সেবার্ঘ্য 
রমজানে রাসূলের বিবাহ 
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
রমজানে উম্মতের সাথে রাসূলের আচরণ
রমজানে উম্মতের সাথে রাসূলের আচরণ 
সাহাবিদের তালিম দান 
সাহাবিদের উদ্দেশ্য রাসূলের ওয়াজ ও বয়ান 
সৎকর্মে সাহাবিদেরকে রাসূলের সর্বাত্মক নিয়োগ 
রমজানে রাসূলের বিভিন্ন সমস্যার শরয়ি সমাধান প্রদান 
রাসূলের ইমামতি 
সালাত শেষে রাসূলের আলোচনা ও খুতবা প্রদান 
রোজার আহকাম ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে রাসূলের নির্দেশনা 
লাইলাতুল কদর অনুসন্ধানে উৎসাহ প্রদান 
নিষিদ্ধ কর্মে বাঁধা দান 
না-ছোড়দের শিক্ষাদান 
ফিতরা আদায়ের আদেশ 
কোন কোন কাজে অন্যদের দায়িত্ব দেওয়া 
রমজানের পরও এবাদত অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে উৎসাহ প্রদান 
উপসংহার 


ভূমিকা

الحمد لله رب العالمين، والصلاة والسلام على سيد الأنبياء وإمام المرسلين، وعلى آله وصحبه أجمعين، وبعد:

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তার প্রেরিত নবি মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণের আদেশ প্রদান করেছেন, আবশ্যক করেছেন তার আনুগত্য। পবিত্র কোরানে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَا آَتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا.
রাসূল তোমাদের যা প্রদান করেছেন, তা গ্রহণ কর, যে বিষয়ে নিষেধ করেছেন, তা বর্জন কর।[১]

অপর স্থানে বলেছেন,
مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ وَمَنْ تَوَلَّى فَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيظًا.
যে ব্যক্তি রাসূলের অনুসরণ করবে, সে আল্লাহরই অনুসরণ করবে, আর যে পিছু হটব্তেআমি আপনাকে তাদের রক্ষাকারী হিসেবে প্রেরণ করিনি।[২]

রাসূলের অনুসরণ ও তার আনুগত্য-এতাআতকে আল্লাহ পাক তার প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন ও ঘোষণা স্বরূপ নিরূপণ করেছেন। কোরআনে এসেছে,
قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ.
আপনি বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস, তবে আমার অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন, তোমাদের পাপ ক্ষমা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।[৩]

রাসূল আমাদের জানিয়েছেন্তআল্লাহর প্রতি ভালোবাসা এবং ফলশ্রুতিতে তার প্রেরিত রাসূলের আদেশ-নিষেধের অনুবর্তন বান্দার যাবতীয় আমল কবুল হওয়া এবং জান্নাত লাভের জন্য শর্ত। হাদিসে এসেছে,
من عمل عملا ليس عليه أمرنا فهو رد.
কোন ব্যক্তি যদি এমন কাজ করে, যা আমাদের দ্বীন সমর্থিত নয়, তা পরিত্যাজ্য।[৪]

অপর স্থানে এসেছে,
كل أمتي يدخلون الجنة إلا من أبى, قالوا : يا رسول الله و من يأبى ؟ قال : من أطاعني دخل الجنة, و من عصاني فقد أبى.
আমার উম্মতের সকলে জান্নাতে প্রবেশ করব্তেঅস্বীকারকারী ব্যতীত। সকলে প্রশ্ন করল : হে আল্লাহর রাসূল ! অস্বীকারকারী কে ? রাসূল বললেন: যে ব্যক্তি আমার অনুসরণ করল, সে জান্নাতে প্রবেশ করল, আর যে আমার অবাধ্য হল, সে-ই অস্বীকার করল।[৫]

রাসূলের প্রতি এ আত্মিক সমর্পণ, তার সর্বৈব অনুসরণ-অনুবর্তন, নিরঙ্কুশ সম্মতি, পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ ব্যতীত কোনভাবেই সম্ভব নয়্তজীবনের সকল ক্ষেত্রে, সকল অনুষঙ্গে : প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে; বাধামুক্ত হয়ে, বিরোধিতা-প্রতিরোধহীনভাবে। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন,
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا.
আল্লাহর শপথ ! তাদের অভ্যন্তরীণ বিরোধপূর্ণ বিষয়ে আপনাকে বিধায়ক (ফায়সালাকারী) হিসেবে মান্য করা, এবং তৎপরবর্তী অবস্থায় তাদের মনে আপনার বিধানের প্রতি খেদ জন্মানো ও পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ ব্যতীত তাদের ইমান পূর্ণাঙ্গ হবে না।[৬]

রাসূলের প্রতি এই আত্মিক সমর্পণ, তার আদেশ-নিষেধের অনুবর্তনের মৌলিক চালক হবে তার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জ্ঞাপন, ও স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসাকে আশ্রয় করে। কারণ, হাদিসে এসেছে, রাসূল বলেছেন,
لا يؤمن أحدكم حتى أكون أحب إليه من والده و ولده والناس أجمعين.
পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও তাবৎ মানুষের তুলনায় আমি তোমাদের নিকট অধিক প্রিয় হওয়া ব্যতীত তোমাদের কারো ইমান পূর্ণাঙ্গ হবে না' 
হাদিসটির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে হাফেজ ইবনে রজব মন্তব্য করেন্তবিশুদ্ধ প্রেম ও ভালোবাসা প্রিয় বিষয়গুলো পছন্দ করা এবং অপ্রিয় বিষয়গুলোকে সর্বান্তঃকরণে ঘৃণা করার ক্ষেত্রে অনুসরণ-অনুবর্তন ও অবিকলতার দাবি করে।[৭] 
ইবনে হাজার বলেন্তমহব্বত ও ভালোবাসা হিসেবে এ স্থানে উদ্দেশ্য নিরঙ্কুশ ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ভালোবাসা। স্বভাবত ও প্রাকৃত যে ভালোবাস্তাতা উদ্দেশ্য নয়, ইমাম খাত্তাবি এ মতই পোষণ করতেন।[৮]

সে মহান ও সৌভাগ্য-মণ্ডিত স্তরে উন্নীত হওয়ার একমাত্র পথ ও পাথেয় হচ্ছে জীবনের সর্বক্ষেত্রে, যাবতীয় আনুষঙ্গিকতায় রাসূলের পূর্ণাঙ্গ জীবন-পদ্ধতি ও বিশুদ্ধ নীতিমালা সম্পর্কে জানা ও পালন করার অভ্যাস গড়ে তোলা। রাসূলের হেদায়েতের সাথে বান্দার ক্রমান্বয় নৈকট্য অর্জন ও তার সুন্নত অনুসারে দ্বীন-আমল সম্পাদন উঁচু ও সম্মানিত স্থান লাভের মজবুত সিঁড়ি, যা বেয়ে মানুষ তার মনুষ্য জীবনের পূর্ণতায় আরোহণ করে। তাই, এ মৌলনীতির ভিত্তিতে আল্লাহ তাআলা রাসূলকে মানুষের জন্য ইমাম ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছেন্তআল্লাহ তাআলা বলেন :
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآَخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا.
তোমাদের জন্য আল্লাহর প্রেরিত রাসূলের মাঝে রয়েছে উত্তম আদর্শ্তযে আল্লাহ ও পরকাল দিবসের কামনা করে, এবং আল্লাহকে অধিক-হারে স্মরণ করে।[৯]

ইসলামে রমজান মাস যেহেতু এবাদত ও এবাদতের অভ্যাস গড়ে তোলার একটি উত্তম ও কার্যকরী সময়, বান্দার জন্য আল্লাহ তাআলার নৈকট্য প্রাপ্তির সুবর্ণ সুযোগ্তমানুষ যা রাসূলের অনুসরণ ও ইত্তেবার মাধ্যমে হাসিল করতে পারে, তাই এ বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞানার্জনের জন্য রাসূলের নীতি ও পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞানলাভ অতীব প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। রাসূল তার জীবনে যে নয়টি রমজান পালন করেছেন, রমজান পালন ও তাতে এবাদত সংক্রান্ত যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয় বান্দাদের সামনে তুলে ধরেছেন ; আমাদের তাই কর্তব্য, এ বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ জ্ঞান লাভ করা, এবং সে অনুসারে আমলে ব্রতী হওয়া।

রাসূলের রমজান পালন ও তাতে এবাদত পালন সম্পর্কে জ্ঞাতব্য বিষয়গুলোকে আমরা চারটি পরিচ্ছেদে ভাগ করতে পারি। যথা :
 রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রমজান-পূর্ব সময় যাপন
 রমজানে রব তাআলার সাথে রাসূলের আচরণ
 রমজানের স্ত্রী ও সহধর্মিণীদের সাথে আচরণ
 রমজানে উম্মতের সাথে আচরণ

বইটি রচনার ক্ষেত্রে আমি যে বিষয়টির প্রতি অধিক মনোযোগ প্রদান করেছ্তিবলা যায়, নীতিমালা হিসেবে মান্য করেছি, তা এই যে, পুরো বইয়ে হাদিসের রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখের ক্ষেত্রে পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য হাদিস ব্যতীত অন্য কোন হাদিস স্থান দেইনি। যুগের সেরা ও সর্ব-মান্য হাদিসবেত্তার্দেতযেমন শায়েখ আলবানী, শায়েখ শুয়াইব্তকর্তৃক স্বীকৃত ও উল্লেখিত হওয়ার পরই কেবল আমি তাকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করেছি। তবে, এক্ষেত্রে, সচেতনভাবেই বাহুল্য বর্জন করেছি, কলেবর বৃদ্ধি ও টীকা-টিপ্পনিতে জর্জরিত না করে পাঠকের জন্য সহজ-পাঠ্য করাই ছিল আমার লক্ষ্য।

যারা আমাকে এ বিষয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন, তাদের সকলের প্রতি আমি সবিশেষ কৃতজ্ঞ। আল্লাহ তাআলার কাছে, সহযোগিতা, সৎপথ ও তওফিক কামনা করি, সার্বিকভাবে, আমার যাবতীয় কর্ম, এবং বিশেষভাবে এই কিতাব কবুলের জন্য তার কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা জানাই। নিশ্চয় তিনি দানশীল, দয়ার্দ্র, মহানুভব।
و صلي الله على محمد و على آله و صحبه أجمعين.
লেখক
২০/৬/১৪২৮ হিজরি, রিয়াদ।

প্রথম পরিচ্ছেদ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রমজান-পূর্ব সময় যাপন

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন পার্থিব বিষয়ে পরিপূর্ণ যুহুদ অবলম্বনকারী, আল্লাহ ও পরকাল দিবসে যা গচ্ছিত ও সংরক্ষিত সে ব্যাপারে খুবই আকাঙ্ক্ষী। রাসূল, তাই, অসন্ন এবাদতকাল উপলক্ষ্যে অত্যন্ত আনন্দিত হতেন এবং বিভিন্ন সময়ে রহমত-বরকত ও কল্যাণ বর্ষণ এবং অবতরণের উপলক্ষ্য ও অনুষঙ্গগুলোর কারণে ব্যাকুল হতেন। কোরআনে এসেছে,
قُلْ بِفَضْلِ اللَّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَلِكَ فَلْيَفْرَحُوا هُوَ خَيْرٌ مِمَّا يَجْمَعُونَ
আপনি বলুন, আল্লাহর ফজল ও করুণায় এ হয়েছে। এর মাধ্যমেই তারা যেন আনন্দিত হয়। তারা যা সঞ্চয় করে, সে তুলনায় তা উত্তম।[১০]

আয়াতটি প্রমাণ করে মানুষের পার্থিব অর্জিত ধন-সম্পদ বা সঞ্চিত ব্যবহার্য নয়; আনন্দের উপকরণ হল আল্লাহ কর্তৃক অবতীর্ণ কোরআন, ইসলামের ফরজ বিধি-বিধান, ও আনুষঙ্গিক সম্পূরক সমূহ্তযার অন্যতম সিয়াম।[১১]

আল্লামা ইমাম সাদি বলেন : ইহকালীন ও পরকালীন বিপুল নেয়ামত-রাজির সাথে পার্থিব জগতের অর্জনের কোন তুলনা নেই ; পার্থিব সঞ্চয়্ততা যতই অঢেল ও বিচিত্র হোক না কেন, একদিন অবশ্যই বিবর্ণ আকার ধারণ করবে, বিলুপ্ত হবে অচিরে। আল্লাহ তাআলা তাই, তার প্রদত্ত ফজিলত ও করুণাকে আনন্দের উপকরণ হিসেবে নির্ধারণ করেছেন-নির্দেশ দিয়েছেন তাকে স্ফূর্তির মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করতে।

কারণ, এর মাধ্যমেই আত্মার স্ফুরণ হয়, উদ্বেলিত হয় অপার এক উদ্যমে, কৃতজ্ঞতায় নতজানু হয় আল্লাহর দরবারে, সঞ্চারিত হয় তার মাঝে এক অমিত শক্তি, সূচিত হয় জ্ঞান ও ঈমান প্রাপ্তির পরম আকাঙ্ক্ষা। সন্দেহ নেই্তবান্দার এ মনোবৃত্তি প্রশংসনীয়। আনন্দ ও চিত্ত-স্ফূর্তির এ মাধ্যম খুবই গ্রহণযোগ্য।

পক্ষান্তরে, ইহকাল প্রবৃত্তি ও তার আস্বাদ জন্ম দেয় যে আনন্দের, কিংবা যে স্ফূর্তি ডাল-পালা মেলেছে অসিদ্ধ পথের বদান্যতায়, তা ঘৃণিত, বর্জনীয়। যেমন আল্লাহ তাআলা কারুন গোত্রের প্রসঙ্গে এরশাদ করেছেন,
لَا تَفْرَحْ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْفَرِحِينَ
তুমি আনন্দিত হয়ও না, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা (অনৈতিক উপায়ে) আনন্দিতদের পছন্দ করেন না।[১২]

অনুরূপ আল্লাহ তাআলা একই উক্তি করেছেন এমন ব্যক্তিদের সম্পর্কে, যারা আনন্দিত হয়েছে অগ্রহণযোগ্য অনৈতিক বিষয়ের প্রতি দৃকপাত র্কতেযা রাসূলদের আনীত বিষয়ের পূর্ণ পরিপন্থী।

কোরআনে এসেছে,
فَلَمَّا جَاءَتْهُمْ رُسُلُهُمْ بِالْبَيِّنَاتِ فَرِحُوا بِمَا عِنْدَهُمْ مِنَ الْعِلْمِ
রাসূলগণ যখন তাদের নিকট আগমন করলেন স্পষ্ট নিদর্শনা সহকারে, তারা আনন্দ অনুভব করল তাদের নিকট যে ইলম ছিল তা নিয়ে।[১৩] [১৪]

আল্লাহ তাআলার নৈকট্যলাভ ও কল্যাণ-কর্মের বিভিন্ন উপলক্ষের অনুবর্তন ও তাতে সর্বস্ব নিয়োগ বান্দাকে দ্রুত আল্লাহর নিকটবর্তী করতে সহায়তা করে, আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও রেজা লাভের মাধ্যমে বান্দা উন্নীত হয় উঁচু মর্যাদায়, এগিয়ে যায় দ্রুত সম্মুখ-পানে। নৈকট্য ও কল্যাণ-কর্মের মৌসুমগুলোর উত্তম অনুবর্তনের ফলে সবকিছুই হয় ফলদায়ক, আত্মায় ও দেহে, আন্তর ও বাহ্য সম্পর্কের যাবতীয় সজাগ অনুভূতি নিয়োগ করে আল্লাহর আনুগত্যে সে নিজেকে বিলীন করে দেয়।

নৈকট্য লাভের বিবিধ মাহেন্দ্রক্ষণ এবং রমজানের সদ্‌ব্যবহারের উত্তম প্রমাণ হল এ ব্যাপারে রাসূলের সর্বাত্মক প্রস্তুতি, মানসিক ও আত্মিকভাবে রমজানকে স্বাগত জানানোর জন্য ব্যাকুলতা ; যেন তা পূর্ণাঙ্গভাবে কল্যাণব্রতী হয়, উদ্যমী হয় আনুগত্যের চরম পরাকাষ্ঠা উত্তরণের, সময়গুলো কাজে লাগে পূর্ণাঙ্গভাবে।

এভাবে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যিনি উভয় জগতের নেতা, রমজান-পূর্ব সময় যাপন করতেন, সমাধা করতেন প্রস্তুতির নানা পর্ব। নিম্নে তার প্রস্তুতির উল্লেখযোগ্য কিছু উদাহরণ পেশ করা হল্ত

অন্যান্য সময়ের তুলনায় শাবান মাসে অধিক-হারে রোজা রাখা

রমজানে দীর্ঘদিন রোজা রাখার দৈহিক ও মানসিক প্রস্তুতির জন্য তিনি শাবান মাসে অধিক-হারে রোজা পালন করতেন।[১৫] আয়েশা রা: হতে বর্ণিত একটি হাদিস বিষয়টির প্রমাণ বহন করে। হাদিসে এসেছে, আয়েশা রা: বলেন,
كان رسول الله صلى الله عليه و سلم يصوم حتى نقول: لا يفطر، ويفطر حتى نقول: لا يصوم، فما رأيت رسول الله صلي الله عليه و سلم استكمل صيام شهر إلا رمضان، وما رأيته أكثر صياماً منه في شعبان
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো কখনো এমনভাবে রোজা পালন করতেন যে আমাদের মনে হত, তিনি রোজা ত্যাগ করবেন না। আর কখনো এত দীর্ঘ সময় রোজা ত্যাগ করতেন যে, আমাদের মনে হত তিনি আর রোজা পালন করবেন না। রমজান মাস ব্যতীত পূর্ণ কোন মাস তাকে আমি রোজা পালন করতে দেখিনি। এবং
শাবানের তুলনায় ভিন্ন কোন মাসে এত রোজা পালন করতেও দেখিনি।[১৬]

অন্য হাদিসে এসেছে,
ولم أره صائما من شهر قط أكثر من صيامه من شعبان، كان يصوم شعبان كله كان يصوم شعبان إلا قليلاً.
শাবানের তুলনায় অন্য কোন মাসে আমি তাকে এত অধিক-হারে রোজা পালন করতে দেখিনি। তিনি শাবানের প্রায় পুরোটাই রোজায় অতিবাহিত করতেন। কিছু অংশ ব্যতীত তিনি পুরো শাবান মাস রোজা রাখতেন।[১৭]

সুতরাং, উক্ত হাদিসের প্রতি লক্ষ্য রেখে, ধর্মপ্রাণ মুসলমান মাত্ররই কর্তব্য, শাবান মাসে অধিক-হারে রোজা পালন করা। বিদগ্ধ উলামাদের মতামত এই য্তেশাবানের রোজা হচ্ছে ফরজ সালাতের আগে ও পরে পালিত সুন্নতে মোয়াক্কাদার অনুরূপ এবং তা রমজান মাসের ভূমিকাতুল্য। অর্থাৎ, তা যেন রমজানের পূর্বে পালিত প্রস্তুতিমূলক এবাদত। এ কারণেই শাবান মাসে রোজা পালন সুন্নত করা হয়েছে। এবং সুন্নত করা হয়েছে শাওয়াল মাসের ছয় রোজা। ফরজ নামাজের পূর্বের ও পরের সুন্নতের অনুরূপ।[১৮]

সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বর্তমান পরিস্থিতির সানুপুঙ্খ বিচারক মাত্রই স্বীকার করতে বাধ্য হবেন্তনববী এই আদর্শ বিলুপ্ত হয়ে পড়েছে সমাজ হতে, গুটি কয় ব্যক্তি ব্যতীত এর উপস্থিতি কোনভাবেই নজরে পড়ে না আমাদের। নববী পদাঙ্ক অনুসরণ করে যারা আরোহণ করতে ব্যাকুল-আগ্রহী উচ্চ সম্মানের স্তরে, রাত্রি-দিন যে ব্যক্তি পরকালিন সাফল্য লাভের ধ্যানে মজ্জমান, নিজেকে এর জন্য গড়ে নিচ্ছে নিপুণভাবে, কোথায় সে মহা পুরুষগণ ! জীবনের সবগুলো বসন্তের অনুরূপ, হারিয়ে যাবে এক সময় বরকতময় কল্যাণ লাভের এ মাস্তরমজান মাস। আল্লাহ আমাদেরকে এর পুরো সার গ্রহণ করার তৌফিক দান করুন।

নবী সা. কর্তৃক সাহাবিগণকে রমজান আগমনের সুসংবাদ প্রদান

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাহাবিগণকে রমজানের পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য নানাভাবে উৎসাহিত-উদ্দীপিত করতেন, পরামর্শ প্রদান করতেন সর্বস্ব নিয়োগ করে তাতে কল্যাণ আহরণের জন্য আত্মনিয়োগের। এ বিষয়ে নানা হাদিস রয়েছ্তেযেমন :

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
إذا دخل شهر رمضان فتحت أبواب السماء و غلقت أبواب جهنم وسلسلت الشياطين.
যখন রমজান মাস আগত হয়, আকাশের দরজাগুলো উন্মুক্ত হয়, বন্ধ করে দেয়া হয় জাহান্নামের কপাটগুলো, এবং শয়তানদের আবদ্ধ করা হয় শৃঙ্খলে।[১৯]

অপর হাদিসে এসেছে,
إذا كان أول ليلة من شهر رمضان صفدت الشياطين ومردة الجن، وغلقت أبواب النار فلم يفتح منها باب، وفتحت أبواب الجنة فلم يغلق منها باب، وينادي منادٍ: يا باغي الخير أقبل، ويا باغي الشر أقصر!، ولله عتقاء من النار، وذلك كل ليلة.
রমজানের প্রথম রাত্রিতে শয়তান ও দুষ্ট জিনদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়, জাহান্নামের কপাটগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়্ততার একটি দরজাও খোলা হয় না। উন্মুক্ত করে দেয়া হয় জান্নাতের দরজাগুলো, বন্ধ করা হয় না তার একটিও। একজন আহ্বানকারী আহ্বান জানিয়ে বলেন : হে কল্যাণের প্রত্যাশী ! অগ্রসর হও। আর যে অকল্যাণের প্রত্যাশী, বিরত হও। আল্লাহ জাহান্নাম হতে অনেককে মুক্তি দিবেন, এবং তা প্রতি রাতেই।'[২০] 
ভিন্ন এক হাদিসে এসেছে,
أتاكم رمضان؛ شهر مبارك، فرض الله عز وجل عليكم صيامه، تفتح فيه أبواب السماء، وتغلق فيه أبواب الجحيم، وتُغَلُّ فيه مردة الشياطين، لله فيه ليلة خير من ألف شهر، من حرم خيرها فقد حرم.
রমজান্তবরকতময় মাস্ততোমাদের দুয়ারে উপস্থিত হয়েছে। পুরো মাস রোজা পালন আল্লাহ তোমাদের জন্য ফরজ করেছেন। এ মাসে আকাশের দরজা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়, বন্ধ করে দেয়া হয় জাহান্নামের দরজাগুলো। দুষ্ট শয়তানদের এ মাসে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে দেয়া হয়। এ মাসে আল্লাহ কর্তৃক একটি রাত প্রদত্ত হয়েছে, যা হাজার মাস হতে উত্তম। যে এর কল্যাণ হতে বঞ্চিত হল, সে বঞ্চিত হল (মহা কল্যাণ হতে)।[২১]

হাদিসে এসেছে,
إن في الجنة بابا يقال له: الريان، يدخل منه الصائمون يوم القيامة، لا يدخل منه أحد غيرهم، يقال: أين الصائمون؟، فيقومون لا يدخل منه أحد غيرهم، فإذا دخلوا أغلق فلن يدخل منه أحد
জান্নাতের একটি দরজা রয়েছে রইয়ান নামে। কেয়ামত দিবসে রোজাদারগণ উক্ত দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবিষ্ট হবেন ; তারা ব্যতীত কেউ তা দিয়ে প্রবেশ করার সুযোগ পাবে না। বলা হবে : রোজাদারগণ কোথায় ? তখন তারা দণ্ডায়মান হবেন, তারা ব্যতীত এ দরজা দিয়ে অপর কেউ প্রবেশ করবে না। তারা প্রবিষ্ট হওয়ার পর সে দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। অপর কেউ তাতে প্রবেশের সুযোগ পাবে না [২২]

সত্য পথের আহ্বানকারী যারা, যারা সর্বক্ষণে, সর্বক্ষেত্রে কল্যাণ ও ফজিলত পিয়াসি, তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হল : এ মহান সুন্নত চৌদিকে ছড়িয়ে দেয়া, মানুষের মাঝে এর কল্যাণ বিস্তারে আত্মনিয়োগ করা। তাদের দায়িত্ব হল, মানুষকে তারা রমজানের সুসংবাদ প্রদান করবে, তার ফজিলত ও বরকত সম্পর্কে অবগত করাবে, সময়ের সর্বোত্তম ও উপযোগী ব্যবহার, ও উপকার হাসিলের মাধ্যমে লাভবান হওয়ার পথ বাতলে দেবে। সুসংবাদ ও সৌভাগ্যের বাণী-মাধুর্যে বিধৌত করবে মানুষের মন-মানস। রমজান যাপনের মাধ্যমে উদ্বেল হবে একে-অপরে, আবদ্ধ হবে সম্প্রীতির বন্ধনে। যে কোন বিষয়ের তুলনায় এর জন্য অধিক প্রস্তুতি গ্রহণ করবে।

কি উপায়ে সর্বাত্মক কল্যাণ আহরণ হয়, এবং ভরিয়ে তোলা যায় আত্মাক্তেঅনুসন্ধান করবে এ বিষয়ে। পার্থিব ভোগ-বিলাস ও উত্তম পানাহারকে এমন পর্যায়ে নিয়ে আসবে না যে, মনে হয়, এগুলোই রমজানের একমাত্র উদ্দেশ্য। কারণ, এর মাধ্যমে রমজানের উদ্দেশ্য চূড়ান্তভাবে ব্যাহত হয়, বাধা প্রাপ্ত হয় কল্যাণ-ধারা। পরিতাপের বিষয় এই যে, অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই রমজান অতিবাহিত হয় তার অগোচর-সন্তর্পণে। আল্লাহ আমাদের হেদায়াত করুন, প্রদান করুন সঠিক পথের দিশা।

রমজানের বিধান বর্ণনা

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান মাসে সাহাবিদের নানা বিধান সম্পর্কে অবগত করাতেন, সঠিক দিক-নির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে ঋজু পথ আঁকড়ে ধরতে উৎসাহিত করতেন। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে উল্লেখিত অনেক হাদিস ও হাদিসাংশ এ বিষয়ের উত্তম প্রমাণ।

বর্তমান সময়ে, রাসূলের উক্ত কর্মপন্থা অনুসারে, আমাদের দায়িত্ব হল : যারা উম্মতের মহান আলেম ও বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব, সম্মানিত দায়ি, তারা সাধারণ মানুষকে রমজানের যাবতীয় হুকুম সম্পর্কে জ্ঞাত করাবেন, রমজান-পূর্ব ও মধ্যবর্তী সময়ে মানুষের মাঝে ব্যাপক দাওয়াতি কার্যক্রম অব্যাহত রাখবেন। প্রত্যেকে সাধ্য ও সামর্থ্যের সবটুকু ব্যয় করবেন, যে উপায়ে বিষয়টির বাস্তবায়ন সম্ভব, অবলম্বন করবেন সে সকল উপায়। কারণ, মানুষের মাঝে মূর্খতা ছড়িয়ে পড়েছে, দ্বীনের স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির প্রকট অভাব গোচরীভূত হচ্ছে সাধারণ মুসলমান্তকখনো কখনো বিশেষ শ্রেণির মাঝেও্তসমাজে।

সাধারণ মুসলমান্তনারী হোক কিংবা পুরুষ্তনির্বিশেষে, সকলের কর্তব্য : পবিত্র রমজানে পালিত যাবতীয় এবাদত ও জিকির-আজকার বিষয়ক বিধি-বিধান সম্পর্কে পূর্ণ অবগতি লাভ করা। সুতরাং, তারা রমজান বিষয়ক বই-পত্র অধ্যয়ন করবে, অডিও প্রোগ্রাম শ্রবণ করে স্বচ্ছ ধারণা লাভে প্রয়াস চালাবে। হাজির হবে ইলম ও জ্ঞানের মজলিস সমূহে।

কারণ, যে কোন বিষয়ের মৌলিক খুঁটি হচ্ছে সে সম্পর্কে পূর্ণ অবগতি লাভ করা, এবং পরবর্তীতে সে অনুসারে আমল করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক অনুমোদিত নয়্তএমন আমল পরিত্যাজ্য সর্বার্থে। গ্রহণযোগ্য কেবল সে আমলই, যার ভিত্তি অতি মজবুত, যার আচরিত কর্মপন্থা সঠিক ও নির্ভুল।

ইলম, আমল, ও দাওয়াতি ক্ষেত্রে যে রাসূলের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে, গ্রহণযোগ্য কেবল তার আমলই।

চাঁদ দেখার সাক্ষ্য কিংবা শাবান পূর্ণ হওয়া ব্যতীত রোজা আরম্ভ না করা

রমজান মাসের চাঁদ দেখেছে, এমন ব্যক্তির সাক্ষ্য, কিংবা পূর্ণ শাবান মাস অতিবাহিত হওয়া ব্যতীত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান পালনের সূচনা করতেন না। চাঁদ দেখা ইসলাম ধর্মের একটি বিশেষ নিদর্শন ও সময় অতিবাহনের প্রমাণ হিসেবে সাব্যস্ত ; যে কোন সময় ও স্থান হতেই যা চি‎িহ্নত করা সম্ভব। সাধারণ মানুষ প্রত্যক্ষ যে কোন বিষয়কে স্বীকৃতি প্রদানে কুণ্ঠা বোধ করে না, প্রকাশ্য মাধ্যমকে কবুল করে নেয় অতি সহজে, তাই ইসলাম একে প্রমাণ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে।

চাঁদ দেখা, অত:পর, সাক্ষ্য প্রদান বিষয়ক বিভিন্ন হাদিস রয়েছে। নিম্নে তা উল্লেখ করা হল :
عن ابن عمر -رضي الله عنهما- قال: تراءى الناس الهلال؛ فأخبرت رسول الله صلي الله عليه و سلم أني رأيـته، فصـامه وأمـر النـاس بصـيامه
ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত : তিনি বলেন, মানুষ সম্মিলিতভাবে চাঁদ দেখল, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সংবাদ প্রদান করলাম যে, আমি চাঁদ দেখেছি। রাসূল, তাই, রোজা রাখলেন, এবং সকলকে নির্দেশ দিলেন রোজা পালনের।[২৩]

ইবনে আব্বাস হতেও এ জাতীয় এক হাদিসের উল্লেখ পাওয়া যায়; তিনি বলেন :
جاء أعرابي إلى النبي صلي الله عليه و سلم فقال: إني رأيت الهلال -يعني رمضان-، فقال: أتشهد أن لا إله إلا الله؟. قال: نعم، قال: أتشهد أن محمداً رسول الله؟، قال: نعم. قال: يا بلال أذِّن في الناس فليصوموا غداً
এক গ্রাম্য সজ্জন রাসূলের দরবারে আগমন করে আরজ করল : আমি রমজানের চাঁদ দেখেছি। রাসূল বললেন : তুমি কি সাক্ষ্য প্রদান কর যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই ? লোকটি উত্তর দিল : হ্যা। রাসূল বললেন : তুমি কি সাক্ষ্য প্রদান কর যে, মোহাম্মদ আল্লাহর রাসূল ? উত্তর দিল : হ্যা। রাসূল অত:পর বেলাল রা.-এর প্রতি লক্ষ্য করে বললেন : হে বেলাল ! মানুষকে জানিয়ে দাও, তারা যেন আগামী কাল রোজা রাখে।[২৪]

হাদিসটি ইসলাম ধর্মের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরছে ; বিশেষত: যারা সাধারণ মানুষের সাথে কাজ করেন এমন দায়ি ও সংস্কারকদের জন্য বিষয়টি প্রণিধানযোগ্য। বৈশিষ্ট্যটি হচ্ছে : ন্যয়পরতার ক্ষেত্রে প্রশ্ন তোলে, কিংবা ইঙ্গিত করে জ্ঞানগত দৌর্বল্যের প্রতি, ব্যক্তি স্বার্থের দ্বারা কলুষিত করে- এমন অবস্থা ব্যতীত সাধারণ মানুষের প্রতি আস্থা রাখা, তাদের বক্তব্য গ্রহণ করা বিধি সম্মত। কারণ, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বীনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে- যাকে রুকনের মর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছে- সাধারণ এক গ্রাম্য ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন।

রমজান মাসের চাঁদ দৃষ্টিগোচর না হলে শাবান মাস পূর্ণ করা সংক্রান্ত হাদিস নিম্নরূপ : চাঁদ দেখার প্রতি নির্ভর করা এবং মাস গণনার ক্ষেত্রে হিসাবের প্রতি গুরুত্ব প্রদান না করার নির্দেশ করে রাসূল বলেন,
صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته، وانسكوا لها؛ فإن غم عليكم فأكملوا ثلاثين، فإن شهد شاهدان فصوموا وأفطروا
তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখ, চাঁদ দেখেই ভঙ্গ কর। চাঁদ দেখাকে অভ্যাসে পরিণত কর। যদি চাঁদ না দেখা যায়, তবে ত্রিশ দিন পূরণ কর। যদি দু' ব্যক্তি সাক্ষ্য প্রদান করে, তবে তোমরা রোজা রাখ, এবং রোজা ভঙ্গ কর।[২৫]

অপর হাদিসে এসেছে,
الشهر تسع وعشرون ليلة، فلا تصوموا حتى تروه، فإن غم عليكم فأكملوا العدة ثلاثين
মাস হল ২৯ রাত্রি। তবে, চাঁদ না দেখে তোমরা রোজা রেখ না। যদি চাঁদ না দেখা যায়, তবে ত্রিশ দিন পূর্ণ কর।[২৬]

শরিয়ত বিষয়টিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের পর এ সংক্রান্ত অতি সাবধানতার পদ্ধতি অবলম্বন নি:প্রয়োজন। তাই, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সন্দেহের দিনে রোজা পালন করে অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বনের ব্যাপারে নিষেধ করে এরশাদ করেছেন,
لا تصوموا قبل رمضان؛ صوموا للرؤية وأفطروا للرؤية، فإن حالت دونه غياية فأكملوا ثلاثين
তোমরা রমজান আগমনের পূর্বে রোজা পালন কর না, চাঁদ দেখে রোজা রাখ, এবং ভঙ্গ কর। যদি মেঘে ঢেকে যায়, তবে ত্রিশ পূর্ণ কর।[২৭] 
অপর স্থানে এসেছে,
لا تقدموا رمضان بصوم يوم ولا يومين، إلا رجل كان يصوم صوماً فليصمه.
রমজান-পূর্ব শেষ দিবসগুলোতে তোমরা একদিন, কিংবা দু দিন রোজা রেখ না, তবে এমন ব্যক্তির জন্য তা বৈধ, যে পূর্ব হতেই কোন রোজা রাখছিল।[২৮]

সন্দেহের দিন রোজা রাখ্তাযেমন অতিরিক্ত সতর্কতা বশত: কেউ কেউ করে থাক্তেনিষিদ্ধ।[২৯] কারণ, হাদিসে স্পষ্টভাবে চাঁদ দেখা কিংবা শাবান মাস পূর্ণ করার উপর বিষয়টিকে নির্ভরশীল রাখা হয়েছে। আম্মার ইবনে য়াসার, তাই, বলতেন : মানুষের কাছে সংশয়পূর্ণ দিবসে যে ব্যক্তি রোজা পালন করবে, সে নিশ্চয় আবুল কাসেম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবাধ্যতায় লিপ্ত হল।[৩০]

কিন্তু যে ব্যক্তি চাঁদ দেখতে সক্ষম হয়নি ; কিংবা যে অনুসন্ধান করেছ্তেসম্ভব হয়নি তার জন্য অপেক্ষা করা, এবং রোজা পালন করেছে এক ধরনের দোদুল্যমান নিয়ত নিয়্তেযেমন, যদি দিনটি রমজান ভুক্ত হিসেবে প্রমাণ হয়, তবে আমি রমজানেরই রোজা হিসেবে তা পালন করলাম, অন্যথায় নয় ; তবে তা তার জন্য্তঅগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মতানুসাের্তযথেষ্ট হবে। কারণ, নিয়ত ইলম বা জানার অনুবর্তী। যদি সে জেনে থাকে যে, আগামী কাল রোজা, তবে তাকে নির্দিষ্ট করে নিয়ত করতে হবে। যদি সে নিয়ত করে নফল রোজা রাখার, কিংবা নিয়তকে মুক্ত রাখে, তবে তার জন্য তা যথেষ্ট হবে না। কারণ, আল্লাহ তাকে ওয়াজিব আদায়ের ইচ্ছা করার নির্দেশ দিয়েছেন। ওয়াজিব হচ্ছে রমজান মাস, যার ওজুব সম্পর্কে সে জ্ঞাত হয়েছে। যদি সে ওয়াজিব পালন না করে, তবে দায় থেকে মুক্ত হবে না।

পক্ষান্তরে, যদি আগামী বেলার রোজা হওয়ার ব্যাপারে সে জ্ঞাত না হয়, তবে তার জন্য নির্দিষ্ট করে নিয়ত আবশ্যক নয়। না জানা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি নিয়তকে নির্দিষ্ট করার ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে মত দেয়, প্রকারান্তরে সে দুটি বিপরীত বিষয়কে একীভূত করে নিয়েছে।[৩১] আল্লাহই অধিক জ্ঞাত।

মাসের সূচনা ও সমাপ্তি নির্ধারণের বিষয়টিকে যদি সকলে চাঁদ দেখা কিংবা ত্রিশ পূর্ণ করার সাথে সংশ্লিষ্ট করে নেয়্তহাদিসের স্পষ্ট হেদায়েত আমাদের যে নির্দেশ প্রদান করেছে, তবে পঞ্জিকা অনুসারে সৌর বাৎসরিক হিসাব গণনাকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত নতুন ফেরকা ও তার ফেতনার ভয়াবহতার মুখোমুখি হতে হবে না। শরিয়ত, সন্দেহাতীতভাবে, তার ভিত হল : সাব্যস্ত ও প্রশ্নাতীত শরয়ি বর্ণনার অনুসরণ, ও তা মান্য করা। শরয়ি নস বিষয়টিকে সংশ্লিষ্ট করেছে চাঁদ দেখার সাথে, পঞ্জিকার সাথে নয়। যখন চাঁদ দেখা যাবে, যদিও তা দৃষ্ট হয় নির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণ-কেন্দ্র হতে, তবে, সে অনুসারে আমল করা আবশ্যক হিসেবে গণ্য হবে। কারণ, বিষয়টি তখন রাসূলের ব্যাপক উক্ত্তি'তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখ, কিংবা ভঙ্গ কর'-র আওতাভুক্ত হবে। যদি না দেখা যায়, তবে ত্রিশ পূর্ণ করা ওয়াজিব।

চাঁদ দেখার জন্য দূর্বীণ ব্যবহার নিষিদ্ধ নয় ; তবে, ব্যবহার আবশ্যকও নয়। কারণ, হাদিসের বাহ্য বর্ণনা দ্বারা আমরা অবগত হই যে, স্বাভাবিক দৃষ্টির উপর ভরসা করাই যথেষ্ট।[৩২] সম্মিলিতভাবে, চাঁদ দেখা উচিৎ। আল্লাহই অধিক জ্ঞাত।

পক্ষান্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উক্তি,
الصوم يوم تصومون، والفطر يوم تفطرون، والأضحى يوم تضحون.
যেদিন তোমরা সকলে রোজা পালন করবে, সেদিন রোজা ; যেদিন সকলে ঈদুল ফিতর পালন করবে, সেদিন ঈদুল ফিতর। আর যেদিন সকলে কোরবানি পালন করবে, সেদিন ঈদুল আযহা।[৩৩]

হাদিসটির ব্যাখ্যা এই যে, রোজা রাখা, ভঙ্গ করা, ঈদ উদযাপনের ক্ষেত্রে সকলের অনুবর্তী হওয়া এবং অধিকাংশ মানুষের মতামত গ্রহণ করাই কাম্য। এ সকল বিষয়্তপ্রাধান্যপ্রাপ্ত মতানুসাের্তব্যক্তি বিশেষের প্রভাব দ্বারা নির্ধারিত হবে না। জামাত-চ্যুত হওয়াও, এ ক্ষেত্রে, বৈধ নয়। বিষয়গুলো, বরং, ইমাম ও সকল মানুষের মতের অনুবর্তী করা হবে। ব্যক্তি বিশেষ ভিন্ন মতের অধিকারী হলেও, সকলের অনুবর্তী হওয়াই তার জন্য ওয়াজিব।[৩৪]

দায়িগণ যদি এ পদ্ধতি অনুসরণ করেন, নববী হেদায়েতের এ নীতিমালাকে নির্ধারণ করে নেন নিজেদের পালনীয় একমাত্রিক বিধান হিসেবে, তবে নানামুখী বিভক্ত দলগুলোর মাঝে সমতা বিধান করার কার্যকরী প্রচেষ্টা চালাতে সক্ষম হবেন, সফল হবেন পারস্পরিক দূরত্ব ও বিরোধ নিরসনে। এর জন্য যে কার্যকরী নীতিমালা অনুসরণ করা যেতে পারে, তাহল : গ্রহণযোগ্য কোন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, চাঁদ দেখার দায়িত্ব যার নেতৃত্বে পালিত হবে। তার নেতৃত্বে শরিয়ত সিদ্ধ পদ্ধতিতে যখন চাঁদ দেখা যাবে, সকলে রোজা রাখবে, কিংবা ঈদ পালন করবে। যদি শরিয়ত সিদ্ধ পদ্ধতিতে চাঁদ দেখা না যায়, তবে ত্রিশ দিন পূর্ণ করবে।[৩৫] যে ভূমিতে অবস্থান করছে, সেখান থেকে যদি চাঁদ দেখার বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব না হয়, তবে অধিক নিকটবর্তী মুসলিম দেশের অনুসারে আমল করব্তেসুতরাং, তাদের সময় অনুসারে রোজা পালন করবে। কারণ, এটিই তাদের জন্য সহজতর। আল্লাহ বান্দার উপর অসাধ্য কিছু চাপিয়ে দেন না।

মনে কর, মুসলমানদের সর্ববৃহৎ সামাজিক সংস্থা কিংবা কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এমন সিদ্ধান্ত প্রদান করল, মাস সূচনা-সমাপ্তির ক্ষেত্রে যা খুবই দুর্বল্ত যেমন সৌরবাৎসরিক পঞ্জিকা মতে রোজা রাখা বা ভঙ্গ করার আদেশ জারি করল, তবে এ ক্ষেত্রে বাহ্যত: তাদের অনুসরণ করাই শ্রেয়। যারা নেতৃত্ব প্রদান করছে, কিংবা সাধারণ মুসলমান জনসাধারণ ব্যাপকভাবে যে মতের অনুসরণ করছে, তা মেনে নেয়াই কাম্য। কারণ, প্রকাশ্য আচরণীয় মতবিরোধ এড়িয়ে যাওয়া খুবই জরুরি। হাদিসে এসেছ্তেالصوم يوم تصومون ্তঅর্থাৎ, যেদিন সকলে রোজা পালন করবে, সেদিনই রোজা। এ হাদিসের উপর ভিত্তি করে উক্ত সিদ্ধান্ত প্রদান করা যেতে পারে। তাছাড়া, শরিয়ত ও মানবিক যুক্তির ভিত্তিতে বলা যায়, ইসলামের এ জাতীয় অমৌলিক মাসআলার ব্যাপারে বিরোধ এড়িয়ে ঐক্যের ভিত দৃঢ় করার মাঝে কল্যাণ নিহিত।

মাসের সূচনা ও সমাপ্তির ব্যাপারে সংখ্যালঘু কিছু মুসলিম সমাজের মাঝে এ জাতীয় বিরোধ এমন একটি বিষয়, যা কোনভাবেই এড়ানো সম্ভব নয়। কারণ, বিষয়টি কিছুটা জটিল, অমীমাংসিত ; কোথাও কোথাও অমুসলিম দেশে মুসলমানগণ মত প্রকাশ ও প্রচারের ক্ষেত্রে নানাভাবে দুর্বলতায় আক্রান্ত হওয়ার ফলে সুষ্ঠু সুরাহা বাধা প্রাপ্ত হয় চূড়ান্তরূপে। সুতরাং, ঐক্য-মত্যের প্রতিষ্ঠার কোন বিকল্প নেই। যা তোমার কাছে মনে হচ্ছে গ্রহণযোগ্য ও পালনীয়, ফেতনা ও মুসলমানদের মাঝে অনৈক্য দূর করার জন্য কখনো যদি তা ত্যাগ করতে হয়, তুমি নির্দ্বিধায় তা কর।

তবে, মুসলিমদের কোন উপদল যদি এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে, তাহলে দুটি উপায়ে সমাধান প্রদান করা যেতে পারে :

প্রথমত: বিষয়টি ইজতিহাদ প্রসূত এবং নতুন বৈধ যে কোন সিদ্ধান্ত অনুসারে ব্যত্যয় আরোপের অনুকূল্তসকলকে এ ব্যাপারে অবগত করানো, এবং জানানো যে, মাসআলাটি খুবই মতবিরোধপূর্ণ, নানাভাবে তাতে মতবিরোধ আরোপ করা যায়। মতবিরোধের সুযোগ রয়েছ্তেএর সূত্রে ধরে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও শত্রুতা সৃষ্টি এবং সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বিনষ্টের কোন মানে হয় না। শরিয়তের অনুসরণ ও অনুবর্তনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে উম্মতের ঐক্য ; সুতরাং সুন্নত আঁকড়ে ধরার নিমিত্তে পারস্পরিক বিভেদ তৈরির কি অর্থ থাকতে পারে ?!

দ্বিতীয়ত: সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যারা সংখ্যালঘু, নিজেদের মতামত তারা গোপন করবে, এড়িয়ে যাবে সকলকে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যারা সংখ্যাগুরু, আক্ষরিক অর্থে যাদের হাতে নেতৃত্ব, অনর্থক নিজেদের সিদ্ধান্ত পেশ করে তাদের সাথে বিরোধে লিপ্ত হবে না।

দু:খজনক হল, আমরা প্রায়শ: লক্ষ্য করি, অধিকাংশ বিরোধ উদ্ভূত দলীয় মতবিরোধ, সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাবের কারণে, যারা নির্দিষ্ট একটি এলাকার পক্ষ-বলয়ের হওয়ার ফলে সে এলাকার অনুবর্তী হয়, তৎপর হয় নিজেদের মতকে সকলের তুলনায় শ্রেয়তর হিসেবে প্রমাণ ও বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে এবং জড়িয়ে পড়ে ভ্রাতৃঘাতী বিরোধে। এভাবে, অনৈতিক উপায়ে তারা নিজেদের মতকে কোন প্রকার প্রামাণ্য ভিত্তির পরোয়া না করে পরিয়ে দেয় শরিয়তের টুপি, উঁচিয়ে ধরে সকলের মাথার উপর ! আল্লাহর কাছে আমাদের সকাতর প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদের দ্বীনের মর্ম উপলব্ধির তওফিক দান করেন, তওফিক দান করেন মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিপূর্ণ অনুসরণের। মুসলমানদের ঐক্য-সম্প্রীতি-সৌহার্দ্যের জন্য নিরলস কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করেন।

আল্লাহর কাছে যা গচ্ছিত ও রক্ষিত আর পরকাল দিবসে অপেক্ষা করছে যে মহান নেয়ামত্ততার প্রত্যাশী হে মোমিন ! ভেবে দেখ একবার নিজের অবস্থা, বিবেচনা কর তোমার করণীয়। রমজানের মহান সুযোগ, সন্দেহ নেই, উম্মতের জন্য গনিমত স্বরূপ, বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে যা মানুষের এবাদতের সচেতন অনুভূতিকে জাগরূক রাখে ; বল দান করে স্মৃতিকে, উদ্যমী করে তার একান্ত পৃথিবী। এবাদতে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করতে সাহস জোগায়। অপরদিকে, ইতিবাচক এ বিষয়গুলোর পাশাপাশি, নেতিবাচক নানা অপ-চিন্তা, কর্ম ও পাপ হতে মুক্ত রাখে চিন্তা-চেতনা ও ভাবনাকে। চিত্তবৃত্তি, প্রবৃত্তিপুজা, অনর্থক চাঞ্চল্য্তমুক্ত রাখে ইত্যাদি হতে। তাই, রমজান মাসে, আমরা দেখতে পাই, মুসলমানদের এবাদতগাহগুলো লোকে লোকারণ্য্তআত্মায়, মননে, কর্মে ও সফেদ চিত্তবৃত্তিতে যারা পরিপূর্ণ মোমিন, পরিশুদ্ধ জাকের, আত্মশুদ্ধির পরাকাষ্ঠা অতিক্রমকারী আল্লাহ-প্রেমিক। সুতরাং, হে মুসলিম ভাই ! রমজানকে পূর্ণ প্রস্তুতি সহ স্বাগত জানাতে প্রস্তুতি নাও, সুবর্ণ সময়গুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য নিজেকে গড়ে তুল। সময়গুলো কাজে লাগাবার সর্বোত্তম উপায় হচ্ছ্তেএ সময় আত্মিক, মানসিক ও দেহগত যাবতীয় পাপ হতে কায়মনোবাক্যে তওবা করা, পবিত্র করা নিজেকে গোনাহের তাবৎ অনুষঙ্গ হতে। এবাদত হুকুম-আহকাম বিষয়ে গভীর উপলব্ধি ও জ্ঞান লাভে সচেষ্ট হওয়া। নির্দিষ্ট কর্মপন্থা ও সূচী তৈরি করে সে অনুসারে সময় ও কর্ম বিন্যাস করে সর্বাত্মক ফায়দা হাসিলে উদ্যোগী হওয়া।

হে আল্লাহ, আমাদের কল্যাণ ব্রতী হওয়ার তওফিক দান করুন, আপনার আনুগত্যে উৎসাহী ও আপনার ক্রোধের উদ্রেককারী যাবতীয় বিষয় পরিহারে আমাদের সহায়তা করুন। আমিন।


দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
রমজানে রবের সাথে রাসূলের আচরণ

রমজানে রবের সাথে রাসূল সা.-এর আচরণ

হেদায়েতের নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন তাবৎ সৃষ্টিকুলের মাঝে রব তাআলা সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত, তার হকের প্রতি সর্বাধিক লক্ষ্য প্রদানকারী। আল্লাহ তাআলার উবুদিয়াত ও দাসত্ব, যাবতীয় ক্ষেত্রে তার প্রতি নতজানু হওয়া, মানবিক পূর্ণতার রূপায়ণে ক্রমান্বয় স্তর অতিক্রম- ইত্যাদি ক্ষেত্রে তিনি স্তর-ক্রম পেরিয়ে এক সময় উপনীত হয়েছেন পূর্ণতর মনজিলে, উচ্চতর অধিষ্ঠানে। সম্মান ও মর্যাদার এমন এক উচ্চতা ছুঁয়েছেন, সৃষ্টিকুলের কেউ যেখানে পৌঁছোতে সক্ষম হয়নি। তার পূর্বাপর যাবতীয় পাপ ও গোনাহ আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন।

উচ্চতার এমন স্তরে সমাসীন হওয়া সত্ত্বেও, রাসূল দীর্ঘ সময় এবাদতে রাত্রি যাপন করতেন, এমনকি, তার পবিত্র পদ-যুগল স্ফীত হয়ে যেত, ফেটে যেত অসহ্য ব্যথায়। আবু বকর তনয়া আয়েশা সিদ্দীকা অবাক হয়ে তাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে উত্তরে তিনি বলেন:
أفلا أحب أن أكون عبداً شكوراً؟!
আমি কি কৃতজ্ঞ বান্দা হতে পছন্দ করব না ?[৩৬]

রাসূল কাঁদতেন ভীত-নতজানু হয়ে, আল্লাহকে ডাকতেন বিপদগ্রস্তের অবিকল। সাহাবি আব্দুল্লাহ বিন শাখীর মন্তব্য করেন :
رأيت رسول الله صلى الله عليه و سلم يصلي، وفي صدره أزيز كأزيز الرحى من البكاء صلى الله عليه و سلم.
কান্নার ফলে বুকে চাকার মৃদু ধ্বনি নিয়ে আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সালাত আদায় করতে দেখেছি।[৩৭]

আয়েশা রা., উম্মুল মোমিনীন ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয়তমা সহধর্মিণী, এক আশ্চর্য বিষয়ের বর্ণনা দিয়ে বলেন :
لما كان ليلة من الليالي قال: يا عائشة ذريني أتعبد لربي، قالت: والله إني لأحب قربك، وأحب ما سرَّك، قالت: فقام فتطهر ثم قام يصلي، قالت: فلم يزل يبكي حتى بلَّ حجره، قالت: ثم بكى فلم يزل يبكي حتى بلَّ لحيته، قالت: ثم بكى فلم يزل يبكي حتى بلَّ الأرض، فجاء بلال يؤذنه بالصلاة؛ فلما رآه يبكي قال: يا رسول الله، لِمَ تبكي وقد غفر الله لك ما تقدم من ذنبك وما تأخر؟! قال: أفلا أكون عبداً شكوراً، لقد نزلت عليّ الليلة آية، ويل لمن قرأها ولم يتفكر فيها: إن في خلق السماوات و الأرض... الآية كلها
এক রাতে রাসূল আমাকে বললেন : আয়েশা ! এখন আমি রবের এবাদতে মগ্ন হব। আয়েশা বললেন : আল্লাহর শপথ ! আমি নিশ্চয় আপনার নৈকট্য-সান্নিধ্য পছন্দ করি। কিন্তু, সাথে-সাথে পছন্দ করি এমন বিষয়, যা আপনাকে আনন্দ প্রদান করে। আয়েশা বলেন : অত:পর রাসূল উঠে গিয়ে পবিত্র হলেন এবং সালাতে দণ্ডায়মান হলেন। আয়েশা বলেন : অত:পর তিনি এত ক্রন্দন করলেন যে, তার বক্ষ ভিজে গেল। অথবা- তিনি এতটা ক্রন্দন করলেন যে, তার দাঁড়ি সিক্ত হল। কিংবা- তিনি এতটা ক্রন্দন করলেন যে, তার সম্মুখস্থ জমি ভিজে গেল। অত:পর সময় ঘনালে বেলাল রা. সালাতের আজান দিতে আগমন করলেন, তাকে ক্রন্দনরত দেখে বেলাল বললেন : হে আল্লাহর রাসূল ! কাঁদছেন কেন, আল্লাহ তো আপনার পূর্বাপর সকল পাপ ক্ষমা করে দিয়েছেন ? উত্তরে তিনি এরশাদ করেন : আমি কি কৃতজ্ঞ বান্দা হব না ? আজ রাতে আমার নিকট একটি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। পাঠ করেও যে ব্যক্তি এ আয়াতে মনোনিবেশ করবে না, তার ভাগ্যে ধ্বংস আছে- 'নিশ্চয় আকাশমণ্ডলী ও ভূমি মাঝে...এ আয়াত পুরোটি।'[৩৮]

ভেবে দেখুন ! এ এমন ব্যক্তির পক্ষ হতে আল্লাহর নির্দেশের পূর্ণাঙ্গ রূপায়ণ, যিনি ছিলেন আদম সন্তানদের নেতা। আল্লাহ প্রদত্ত সংবাদের ভিত্তিতেই তিনি অবগত ছিলেন যে, জান্নাতের অতি উঁচু স্তরে হবে তার অবস্থান। এ সত্ত্বেও, তিনি এবাদত ও আল্লাহর আনুগত্য জ্ঞাপনের ক্ষেত্রে নিজেকে এমন উজাড় করে দিতে কুণ্ঠিত হতেন না বিন্দুমাত্র। লীন করে দিতেন আল্লাহর দরবারে ; আল্লাহ-ভীতি, ভয় ও আশায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠতেন- আত্মা, মনন ও চেতনায়।

পক্ষান্তরে, নববী এ আদর্শের আলোকে আমরা যখন নিজেদের বিবেচনা করি, বিশ্লেষণ করি প্রতিটি কর্ম ও আচরণ, গ্রাস করে সীমাহীন আতঙ্ক- এবাদত ও আনুগত্যের ব্যাপারে কেউ হয়তো অলস ও উদ্যমহীন, হামেশা পাপে নিমজ্জিত কেউ, আল্লাহ প্রেমের ঘাটতি সত্ত্বেও বিন্দুমাত্র বিচলিত নয় ; তুমি বরং দেখতে পাবে যে, অলসতা ও বিবেক-শূন্যতা যেন জগদ্দল পাথরের মত তাদের চেতনায় জমে বসেছে। দেখতে পাবে, এত কিছুর পরও, নিজেকে ভাবছে সে আল্লাহর যাবতীয় পাকড়াও হতে মুক্ত, বিপদ হতে শত-হস্ত দূর ! যেন কোন ভয়হীন একাধিপত্য ভোগ করছে সে। নববী আদর্শের উক্ত দৃষ্টান্তকে সামনে রেখে আমরা উভয়ের মাঝের যোজন যোজন পার্থক্য সহজে অনুভব করতে পারি। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন, ক্ষমা করুন তিনি, টেনে তুলুন এ বিপদ হতে।

রমজান মাসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে আচরণ ও কর্ম নিয়ে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হতেন, তা সকলের জন্য জীবন্ত এক উদাহরণ ; তিনি তার এবাদত ও বিনয়-লীন আনুগত্য আল্লাহর কাছে উপস্থাপন করতেন। নানাভাবে শোভিত-মহিমান্বিত করতেন তার এ সময়গুলোকে।

রাসূল যেভাবে রোজা পালন করতেন

এবাদতের বিবিধ উপকরণ দ্বারা রাসূল সা. রোজার দিবসগুলোকে শোভিত করতেন- অত্যন্ত আগ্রহ ও ব্যাকুলতার সাথে তিনি সেহরি ও ইফতার গ্রহণ করতেন। রোজা ভাঙার সময় হলে দ্রুত ইফতার করে নিতেন, পক্ষান্তরে সেহরি করতেন অনেক দেরিতে, সুবহে সাদিকের কিছু পূর্বে সেহরি সমাপ্ত করতেন। ইফতার করতেন ভেজা বা শুকনো খেজুর, অথবা পানি দিয়ে। ভেজা খেজুর দিয়ে সেহরি করাকে পছন্দ করতেন তিনি। জাঁকজমকহীন স্বাভাবিক সেহরি ও ইফতার গ্রহণ করতেন সর্বদা।

রমজানে রাসূলের এ আচরণ বিষয়ে বিভিন্ন হাদিসে উল্লেখ পাওয়া যায়- আনাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন :
كان النبي صلي الله عليه و سلم يفطر قبل أن يصلي على رطبات، فإن لم تكن رطبات فتميرات، فإن لم تكن تميرات حسا حسوات من ماء
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত আদায়ের পূর্বে কয়েকটি ভেজা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন, যদি ভেজা খেজুর না থাকত, তবে সাধারণ শুকনো খেজুরই গ্রহণ করতেন। যদি তাও না থাকত, তবে কয়েক ঢোক পানিই হত তার ইফতার।[৩৯]

আবু আতিয়া হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : আমি এবং মাসরুক আয়েশা রা.-এর নিকট উপস্থিত হলাম। মাসরুক তাকে উদ্দেশ্য করে বলল : মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দু' সাহাবি উপস্থিত হয়েছে, যাদের কেউ কল্যাণে পশ্চাৎবর্তী হতে আগ্রহী নয় ; তাদের একজন মাগরিব ও ইফতার উভয়টিকেই বিলম্ব করে, অপরজন দ্রুত করে মাগরিব ও ইফতার। আয়েশা বললেন : কে মাগরিব ও ইফতার দ্রুত করে ? বললেন : আব্দুল্লাহ। আয়েশা উত্তর দিলেন : রাসূল সা. এভাবেই রোজা পালন করতেন।[৪০]

আব্দুল্লাহ বিন আবি আউফা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন :
كنا مع رسول الله صلى الله عليه و سلم في سفر في شهر رمضان، فلما غابت الشمس قال: يا فلان انزل فاجدح لنا! قال: يا رسول الله إن عليك نهاراً!، قال: انزل فاجدح لنا!، قال: فنزل فجدح، فأتاه به فشرب النبي صلى الله عليه و سلم ثم قال بيده: إذا غابت الشمس من ها هنا وجاء الليل من ها هنا فقد أفطر الصائم
একবার, রমজান মাসে আমরা রাসূলের সাথে সফরে ছিলাম। সূর্য অস্তমিত হলে তিনি বললেন, হে অমুক ! নেমে এসে আমাদের জন্য ছাতু ও পানি মিশ্রিত ইফতার পরিবেশন কর। লোকটি বলল : হে আল্লাহর রাসূল ! এখনও তো দিবসের কিছু বাকি আছে। রাসূল পুনরায় বললেন : নেমে এসে আমাদের জন্য ছাতু ও পানি মিশ্রিত ইফতার পরিবেশন কর। বর্ণনাকারী বলেন : সে নেমে এসে ছাতু ও পানির ইফতার প্রস্তুত করে রাসূলের সামনে উপস্থিত করলে তিনি তা গ্রহণ করলেন। অত:পর তিনি হাতের ইশারা দিয়ে বললেন : সূর্য যখন এখান থেকে এখানে অস্ত যাবে এবং রাত্রি আগত হবে এতটুকু অবধি, তখন রোজাদার রোজা ভাঙবে।[৪১]

জনৈক সাহাবির সূত্র ধরে আব্দুল্লাহ বিন হারেস বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: আমি রাসূলের নিকট হাজির হলাম, তিনি সেহরি খাচ্ছিলেন। রাসূল বললেন : নিশ্চয় তা বরকত স্বরূপ, আল্লাহ পাক বিশেষভাবে তা তোমাদেরকে দান করেছেন, সুতরাং তোমরা তা ত্যাগ কর না।[৪২]

যায়েদ বিন সাবেত হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : আমারা রাসূলের সাথে সেহরি খেলাম, অত:পর তিনি সালাতে দণ্ডায়মান হলেন। আমি বললাম : সেহরি ও আজানের মধ্যবর্তী সময়ের স্থায়িত্ব কতটা ? তিনি বললেন : পঞ্চাশ আয়াত তেলাওয়াত পরিমাণ দৈর্ঘ্য।[৪৩] বিলম্বে সেহরি গ্রহণ রোজার জন্য সহজ, রোজাদারের জন্য প্রশান্তিকর ; এবং বিলম্বে সেহরি গ্রহণের কারণে ফজরের সালাত ছুটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে না।

আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : মোমিনের উত্তম সেহরি শুকনো খেজুর।[৪৪]

আনাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন :
قال رسول الله صلي الله عليه و سلم -وذلك عند السحور-: يا أنس إني أريد الصيام، أطعمني شيئاً، فأتيته بتمر وإناء فيه ماء، وذلك بعد ما أذن بلال
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেহরিকালিন আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন- হে আনাস, আমি রোজা রাখতে আগ্রহী। আমাকে কিছু আহার করাও। আমি তার সামনে শুকনো খেজুর এ একটি পাত্রে পানি উপস্থিত করলাম। বেলালের (প্রথম) আজানের পর তিনি সেহরি গ্রহণ করেছিলেন।[৪৫]

উপরোক্ত হাদিসগুলো সামনে রেখে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, রাসূল ইফতার করতেন দ্রুত- আনাস রা.-এর স্পষ্ট হাদিস এ বিষয়ের উৎকৃষ্ট প্রমাণ, তিনি বলেন : আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে, এমনকি এক ঢোক পানি দিয়ে হলেও, ইফতার করা ব্যতীত মাগরিবের সালাত আদায় করতে দেখিনি।[৪৬]

আব্দুল্লাহ বিন উমর রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূল বলেছেন,
تسحروا ولو بجرعة من ماء
এক ঢোক পানি দ্বারা হলেও, তোমরা সেহরি গ্রহণ কর।[৪৭]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উবুদিয়ত ও দাসত্বের সর্বোচ্চ পরাকাষ্ঠা পেরুনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, সাধ্যানুসারে যাবতীয় উপকরণ ব্যবহার করে কর্মের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জন করতে প্রয়াসী হয়েছেন।

কীভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান যাপন করেছেন, সানুপুঙ্খ দৃষ্টিতে আমরা যদি তা বিবেচনা করি, তবে দেখতে পাব, রোজাদারদের যারা সেহরি গ্রহণ করেন না, বা করলেও, সম্পন্ন করেন অনেক দ্রুত- মধ্যরাতে, তারা অবশ্যই সুন্নতের সঠিক পথ-বিচ্যুত। দ্রুত সেহরি গ্রহণের কারণে নফ্‌সকে অযথা ভোগানো হয়। মূলত: রাসূল আমাদের জন্য হেদায়েতের যে আদর্শ রেখে গিয়েছেন, তার পুণ্যবান সহচরগণ সমুন্নত করেছেন যে আদর্শ ও কর্মনীতির মৌল-পন্থা, তার অনুসরণ ও অনুবর্তনেই সাফল্য ও কল্যাণ। আমর বিন মায়মুন রা. বলেন : মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবিগণ ছিলেন সকলের চেয়ে সর্বাধিক দ্রুত ইফতারকারী, এবং বিলম্বে সেহরি গ্রহণকারী।[৪৮]

বর্তমান সময়ে ইফতার ও সেহরিকে কেন্দ্র আমরা যে জাঁকজমক ও আচার-অনুষ্ঠান দেখতে পাই, রাসূল কোনভাবেই এর বৈধতা প্রদান করেননি। অতিরিক্ত ভোজন ও বিলাসী আহারের ফলে নফ্‌স অলসতায় আক্রান্ত হয়, এবাদতের ক্ষেত্রে তার মাঝে সীমাহীন শৈথিল্য ছড়িয়ে পড়ে। সে তাই, বঞ্চিত হয় এ মহান মৌসুমের প্রকৃত ফললাভে। দু:খজনক বিষয় এই যে, কোথাও কোথাও দেখা যায়, মানুষ হারাম ও অবৈধ খাদ্য দিয়ে ইফতার ও সেহরি গ্রহণ করছে, সেহরি ও ইফতারের পিছনে ব্যায় করছে অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদ। মানুষ কতটা নির্বিকার হয়ে পড়েছে, এগুলো তার জ্বলন্ত প্রমাণ। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন।

মানুষ সতত ধোঁকায় আক্রান্ত নিজেকে নিয়ে ; নিজেকে সে বঞ্চিত করছে এমন সৌভাগ্য ও অবশ্যম্ভাবী ফলশ্রুতি থেকে, যা হতে পারত তার নাজাতের উপকরণ, পরকালিন দরজা বুলন্দীর কারণ। যেদিন কাজে আসবে না পাহাড়সম সম্পদ, একপাল সন্তান-সন্ততি, আল্লাহ যাকে বিশুদ্ধ অন্তরে শোভিত করেছেন, কেবল তার ললাটেই শোভা পাবে মুক্তির সৌভাগ্য। ইহকালিন নশ্বর কিছু বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে মানুষ ত্যাগ করছে-হেলায় হারাচ্ছে পরকালিন অবিনশ্বর প্রাপ্তিকে, এবং রমজান মাসে রাসূল নির্দেশিত কর্মপন্থা ও আহার-ভোজনের নীতিমালা অনুসরণ না করে- আল্লাহর সাথে এবাদতের ক্ষেত্রে দূরত্ব সৃষ্টি, পাপাচার-অনাচারে আক্রান্ত হওয়া ছাড়াও- আক্রান্ত হয় নানারকম দৈহিক অসুস্থতা, স্বাস্থ্যহানিতে, যার জের টানতে হয় দীর্ঘ সময়।

আত্মার প্রবঞ্চনা ও মোহ হতে যে সতর্ক সতত, নিজেকে তার রক্ষা করাই কাম্য। সময় বয়ে যাচ্ছে নিরবধি, সুযোগ হাতছাড়া হচ্ছে ক্রমাগত, যে কর্ম পরকালে কাজে আসবে, বয়ে আনবে মহান ফলাফল, তা ক্রমে নি:শেষ তলানিতে এসে ঠেকছে। রাসূলের পুণ্যময় আচরণ ও জীবনাচারের যে আলো আমাদের স্পর্শ করেছে, তা নিয়েই যে ব্যক্তি বেঁচে থাকতে প্রয়াসী, রাসূলের পূর্ণাঙ্গ অনুবর্তনই যার ইহকালীন একমাত্র অবলম্বন, পার্থিব আস্বাদকে ছুঁড়ে মারা তার দায়িত্ব; আলস্য পরিহার করে ধর্মের মৌলিক এবাদতে নিজেকে নিয়োগ করা, সৌভাগ্যের অনুষঙ্গের মাধ্যমে আত্মায় ও মননে শোভিত হওয়া, এবং অধিক-হারে কল্যাণ-কর্মে ব্রতী হওয়া তার একমাত্রিক কর্তব্য।

ইফতার কালে রাসূল সা.-এর দোয়া

ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন :
كان رسول الله صلي الله عليه و سلم إذا أفطر قال: ذَهَبَ الظَمَأُ، وَابْتَلَّتِ العُرُوْقُ، وَثَبَتَ الأَجْرُ إِنْ شَاءَ اللهُ.
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ইফতার করতেন, (ইফতার সেরে) বলতেন্তপিপাসা নিবারিত হয়েছে, নিষিক্ত হয়েছে নালিগুলো আর আল্লাহ চাহে তো পুরস্কারও নির্ধারিত হয়েছে।[৪৯] [৫০]

পক্ষান্তরে, আমাদের বর্তমান সমাজে দেখতে পাই, ইফতার কালে আহার-ভোজন অনুষ্ঠানের ফলে অধিকাংশ রোজাদারই দোয়ার বিষয়টি বিস্মৃত হন, ভুলে যান রোজা শেষে আল্লাহর দরবারে নতজানু হয়ে প্রার্থনা জানাতে। বিশেষত, নানা আয়োজনে অন্তপুরে ব্যস্ত থাকেন যে নারীরা, তাদের কথা বলাই বাহুল্য। এভাবে, রোজাদারগণ দোয়া কবুলের মহত্তম সময়গুলো হেলায় হারান।

রোজা অবস্থায় মেসওয়াক

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোজা রেখেও মেসওয়াক করতেন। আমের বিন রাবিয়া হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অসংখ্যবার রোজাবস্থায় মেসওয়াক করতে দেখেছি।[৫১]

মেসওয়াকের প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। হাদিসে এসেছে,
السواك مطهرة للفم مرضاة للرب.
অর্থাৎ, মেসওয়াক মুখের জন্য পবিত্রকারী, এবং রবের সন্তুষ্টি আনয়নকারী।[৫২]

অপর হাদিসে এসেছে,
لقد أمرت بالسواك حتى ظننت أنه سينزل به علي قرآن أو وحي.
মেসওয়াকের ব্যাপারে আমাকে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে, এমনকি, একসময় আমার মনে হয়েছিল যে, এ ব্যাপারে আমার উপর কোরআন কিংবা ওহি নাজিল হবে।[৫৩]

স্পষ্ট যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরো দিবস জুড়েই মেসওয়াক করতেন। দিবসের সূচনা বা সমাপ্তির মাঝে কোন প্রকার পার্থক্য করতেন না। হাদিসে এসেছে,
لولا أن أشق على أمتي لأمرتهم بالسواك مع كل وضوء
আমার উম্মতের উপর যদি বিষয়টি কঠিন না হত, তবে প্রতি ওজুর সময় তাদের জন্য মেসওয়াক আবশ্যক করে দিতাম।[৫৪]

অপর হাদিসে এসেছে,
لولا أن أشق على المؤمنين لأمرتهم بالسواك عند كل صلاة
মোমিনদের জন্য যদি কষ্টকর না হত, তবে প্রতি নামাজের কালে আমি তাদের জন্য মেসওয়াক আবশ্যক করে দিতাম।[৫৫]

ইবনে আব্দুল বার বলেন : এ হাদিস প্রমাণ করে, যে কোন সময় মেসওয়াক বৈধ। হাদিস দুটিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম 'প্রতি ওজুকালে' এবং 'প্রতি নামাজ কালে' বাক্যাংশ দুটি ব্যবহার করেছেন। নামাজ নির্দিষ্ট একটি সময়েই নয়, ওয়াজিব হয় দ্বিপ্রহর, বিকেল ও রাতের নানা সময়ে।[৫৬]

ইমাম বোখারির উক্ত্তিরোজাদারকে এ হুকুমের আওতা-বহির্ভূত করা হয়নি।[৫৭]

ইবনে খুযাইমা বলেন : হাদিসটিতে প্রমাণ হয় স্বাভাবিক অবস্থায় ব্যক্তির জন্য যেভাবে প্রতি নামাজের সময় মেসওয়াক করা ফজিলতের বিষয়, তেমনিভাবে ফজিলতের বিষয় রোজাদারের জন্যও।[৫৮] সুন্নতের অনুসারীগণের অবশ্য কর্তব্য বিষয়টির প্রতি যত্নশীল হওয়া। কারণ, এর প্রতিদান অঢেল, উপকারিতা অগণিত।

রাসূলের অন্য হাদিসে বর্ণিত একটি উক্তি এ ক্ষেত্রে কোন জটিলতা তৈরি করবে না, উক্তিটি হচ্ছে,
لخلوف فم الصائم أطيب عند الله من ريح المسك.
মেশকের সুঘ্রাণের চেয়েও আল্লাহর নিকট রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ অধিক প্রিয়।[৫৯] 
কারণ, হাদিসটির অর্থ হচ্ছে, রোজাদারের মুখের এ গন্ধ, যাকে তোমরা দুর্গন্ধ বলে অবহিত কর, আল্লাহ তাআলার নিকট মেশকের চেয়েই উত্তম, ভালো ও প্রিয়্তযাকে তোমরা সুগন্ধি বল। কারণ, এ গন্ধ সৃষ্টি হয়েছে তার এবাদত পালন ও আল্লাহ তাআলার হুকুমের অনুবর্তী হওয়ার ফলে। মুখের গন্ধ মৌলিকভাবে প্রিয় ও ভালো নয়, এবং তা দূর করার ব্যাপারে বান্দার উপর কোন নিষেধাজ্ঞাও নেই।

ভেজা ও শুকনো মেসওয়াকের মাঝে রাসূল পার্থক্য করেছেন, এমন কোন প্রমাণ আমরা পাই না। তাই, সালাফের অধিকাংশই এ দুয়ের মাঝে পার্থক্য করতেন না। ইবনে সীরীনের নিকট আগমনকারী জনৈক ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন : ...এতে কোন অসুবিধা নেই, এ কেবল খেজুরের ডাল, এর স্বাদ রয়েছে। যেমন স্বাদ রয়েছে পানির, অথচ তা দিয়ে তুমি কুলি কর।[৬০] ইবনে উলয়া বলেন : রোজাদার কিংবা পানাহারকার্তীউভয়ের জন্যই মেসওয়াক করা সুন্নত। শুকনো কিংবা ভেজা মেসওয়াক্তদুটোই এ ক্ষেত্রে বরাবর।[৬১]

রাতে অপবিত্র অবস্থায় রোজার নিয়ত করা

রাসূল কখনো কখনো রাতে অপবিত্র অবস্থাতেই রোজার নিয়ত করে নিতেন। বিষয়টির প্রমাণ রাসূলের সহধর্মিণী উম্মুল মোমিনীন আয়েশা রা. বর্ণিত হাদিস,
كان النبي صلى الله عليه و سلم يدركه الفجر في رمضان وهو جنب من غير حلم، فيغتسل ويصوم.
রমজান মাসে স্বপ্নদোষ ব্যতীতই অপবিত্র অবস্থায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুবহে অতিক্রম করতেন। অত:পর তিনি গোসল করে রোজা রাখতেন।[৬২]

রাসূলের অপর স্ত্রী উম্মুল মোমিনীন উম্মে সালামা রা. বর্ণনা করেন:
كان يدركه الفجر وهو جنب من أهله ثم يغتسل ويصوم.
সহবাসের ফলে না-পাকি অবস্থায় রাসূল সুবহে সাদিক অতিক্রম করতেন, অত:পর গোসল করে রোজা রাখতেন।[৬৩]

একই হুকুম-ভুক্ত হায়েজ ও নেফাসগ্রস্ত নারীরা। ফজর হওয়ার পূর্বেই যদি তারা পবিত্র হয়ে যায়, তবে গোসল না করেই নিয়ত করে নিবে।

তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে মাথায় পানি দেয়া

অসহনীয় তাপমাত্রা দেখা দিলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাথায় পানি ঢালতেন। আবু বকর বিন আব্দুর রহমান হতে বর্ণিত, রাসূলের কয়েকজন সাহাবির উদ্ধৃতি উল্লেখ করে তিনি বলেন : আরজে (স্থান বিশেষ) অত্যধিক পিপাসা বা তাপমাত্রার ফলে রাসূলকে দেখেছি যে, তিনি মাথায় পানি ঢালছেন।[৬৪]

দৈহিক প্রশান্তি ও স্বস্তি এবং উদ্যম লাভের জন্য এমন করা দূষণীয় নয়। এর ফলে রোজাদারের এবাদত বৃদ্ধি পাবে। কারণ, বান্দা স্বতঃস্ফূর্ত ও সানন্দচিত্তে বিনয়-বিগলিত হয়ে রবের দরবারে উপস্থিত হবে, পালন করবে তার আদেশ-নিষেধ্তরোজার প্রধান উদ্দেশ্য এটিই। দৈহিক কষ্টভোগ, নির্যাতন কিংবা কঠোরতা আরোপ রোজা রাখার উদ্দেশ্য হতে পারে না কখনো।

পূর্ণ গোসল, কাপড় ভেজানো, পানিতে ডুব দেয়্তাসবই মাথায় পানি ঢালার হুকুম-ভুক্ত, যেমন উল্লেখ করেছেন ইমাম বোখারি তার সহি গ্রন্থে। কয়েকজন সাহাবি ও তাবেইনের উদ্ধৃতি সহ্তযারা ছিলেন অনুবর্তনের ক্ষেত্রে রাসূলের আদর্শ অনুসার্তীতিনি গোসল বিষয়ক পরিচ্ছেদে উল্লেখ করেন যে, ইবনে উমর রা. একটি কাপড় পানিতে ভিজিয়ে শরীরে জড়িয়ে নিলেন। তিনি ছিলেন রোজাদার। শা'বী রোজা রেখেই গোসলের জন্য হাম্মামে প্রবেশ করেন। হাসান বলেন : কুলকুচা কিংবা শীতলতা গ্রহণ রোজাদারের জন্য দূষণীয় নয়। ইবনে মাসঊদ বলেন : তোমাদের যে রোজা রাখবে, সে যেন তৈলযুক্ত, বিন্যস্ত কেশবিন্যাস নিয়ে সকাল যাপন করে। আনাস বলেন : আমার একটি টব রয়েছে, রোজা রেখেই আমি তাতে প্রবেশ করি।[৬৫] এগুলোর উপর ভিত্তি করে বর্তমানে এ-সি রুমে সময় কাটানো একই হুকুম ভুক্ত ধরা হবে।

এ ক্ষেত্রে মৌলিক ও সাধারণ নীতিমালা হল, ব্যক্তির জন্য এবাদত পালন যা সহজ করে দেয়, স্বতঃস্ফূর্ত-উদ্যমী ও প্রশান্ত মন নিয়ে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হতে যা সহায়ক, তা করা রোজাদারের জন্য বৈধ। যে পরিশ্রম ও কষ্টভোগের ফলে এবাদত হতে বিচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, বিধায়কের পক্ষ হতে তাকে কখনো উদ্দিষ্ট করা হয়নি, তাকে বরং, ত্যাগ ও এড়িয়ে যাওয়াই কাম্য। তবে, যে কষ্টভোগের ফলে এবাদত হতে বিচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তাকে মেনে নেওয়া উত্তম। কারণ, তা এবাদতের বিনিময় বৃদ্ধি করে, যেমন অধিক শীতেও ওজু করা, হজের জন্য সফর, অত্যধিক শীত বা গরম সত্ত্বেও জামাতে সালাত আদায়ের জন্য গমন।

এই প্রসঙ্গে ইবনে তাইমিয়া বলেন : এ স্থলে যা জ্ঞাতব্য, তা এই যে, অযৌক্তিকভাবে আত্মাকে কষ্টদান কিংবা কঠোরতা আরোপ আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ভালোবাসা লাভের উপায় হতে পারে না। অধিকাংশ মূর্খ যেমন ভেবে থাকে যে, আমল যত কঠিন, পুরস্কারও তত বিপুল। তাদের ধারণা, কষ্টের মাত্রা অনুসারে প্রতিফল নির্ধারিত হয়। প্রতিফল, বরং, নিরূপিত হয় আমলের উপকারিতা, কল্যাণ ও পরিণতি হিসেবে। বান্দা যতটা আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্যে নিজেকে লীন করবে, তার আমল সে অনুসারে গ্রহণযোগ্য হবে। এ দু প্রকার আমলের মাঝে যা হবে সুন্দর, সুষম, এবং যে আমলকারী হবে অধিক অনুগত, তব্তেসন্দেহ নেই, তার আমলই আল্লাহ পাক কবুল করবেন। সংখ্যাধিক্যের বিচারে আমলের মাঝে প্রবৃদ্ধি আসে না, বরং, তা সমৃদ্ধ হয় আমলকালীন অন্তরের অবস্থা অনুসারে।[৬৬]

শরিয়তের পরিধি খুবই বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ। তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, সার্বিক বিবেচনায় তা খুবই সহজ ও সরল এবং অনায়াস সাধ্য। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের জন্য স্থাপন করেছেন হেদায়েতের যে আলোকবর্তিকা, আত্মাকে কষ্টদান ও এ জাতীয় বিষয় তার স্পষ্ট বিরোধী।

কুলকুচা করা ও নাকে পানি দেয়া

রোজা অবস্থাতেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুলকুচা করতেন, পানি দিতেন নাকে। তবে নাকে পানি দেওয়ার ব্যাপারে খুবই সাবধানতা অবলম্বন করতেন। লাকিত বিন সাবরা রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদিস বিষয়টিকে প্রমাণ করে ; তিনি বলেন :
... فقلت: يا رسول الله أخبرني عن الوضوء!، قال: أسبغ الوضوء، وخلل بين الأصابع، وبالغ في الاستنشاق إلا أن تكون صائماً.
...আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল ! আমাকে ওজু বিষয়ে শিক্ষা দিন ! তিনি বললেন, তুমি ওজু করবে পূর্ণাঙ্গরূপে, খেলাল করবে আঙুলগুলো। যদি রোজাদার না হও, তবে নাকে পানি দেওয়ার ক্ষেত্রে গভীরে পৌঁছে দেবে।[৬৭]

মধ্যপন্থা অবলম্বনের এ এক অনুপম দৃষ্টান্ত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিচ্ছন্নতা ও সিয়ামের নীতিমালা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে উম্মতের জন্য অতুলনীয় সমন্বয় সাধন করেছেন। কোন একদিকে অতিরঞ্জনের ন্যূনতম সুযোগ রাখেননি।

রাসূল সা.-এর সওমে ওসাল ২

রাসূল কখনো কখনো রাত-দিন পূর্ণ সময় অনাহারে কাটাতেন এবং রোজা পালন করতেন। পুরো সময় যেন আল্লাহর এবাদতে পালিত হয়্তসওমে ওসাল পালনের মাধ্যমে এটাই ছিল তার উদ্দেশ্য।[৬৮] প্রমাণ হিসেবে কয়েকটি হাদিস এ স্থানে উল্লেখ্য : আনাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন :
لا تواصلوا, قالوا: إنك تواصل؟!، قال: لست كأحد منكم؛ إني أُطعم وأُسقى -أو إني أبيت أُطعم وأُسقى-
তোমরা সওমে ওসাল (রাত-দিন একত্রে রোজা) পালন কর না। সাহাবিগণ বললে, আপনি তো তা পালন করেন ?! তিনি উত্তরে বললেন : আমি তো তোমাদের কারো মত নই। আমাকে (আল্লাহর পক্ষ হতে, আত্মিক ভাবে) পানাহার করানো হয়, আমি রাত যাপন করি পানাহার করানো অবস্থায়।[৬৯]

আবু হুরায়রা কর্তৃক বর্ণিত : তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোজা ওসাল করতে বারণ করেছেন। মুসলমানদের একজন তাকে প্রশ্ন করলেন : হে আল্লাহর রাসূল ! আপনি তো তা করেন ? উত্তরে রাসূল বললেন : তোমাদের কেউ কি আমার অনুরূপ ? আমি রাতযাপন কালে আল্লাহ আমাকে পানাহার করান। যখন তারা ওসাল করতে নাছোড় হল, তখন রাসূল তাদের সাথে একদিন সওমে ওসাল করলেন, অত:পর আরেকদিন করলেন। এরপর চাঁদ উঠল। অত:পর রাসূল বললেন : যদি চাঁদ উঠতে আরো বিলম্ব হত, তবে আমি আরো বৃদ্ধি করতাম। সওমে ওসালের ব্যাপারে তারা নাছোড় হলে রাসূল তাদের তিরস্কার করে এমন বলেছিলেন।[৭০]

উল্লেখিত হাদিসগুলোর পর্যালোচনায় প্রমাণ হয়, সওমে ওসাল একমাত্র রাসূলের জন্য বিশিষ্ট ; অন্য কারো জন্য তা পালন বৈধ নয়। তবে, কেউ যদি একান্তভাবে তা পালন করতে চায়, তাহলে সেহরি অবধি বিলম্বিত করার বৈধতা রয়েছে। এক হাদিসে এসেছে, রাসূল বলেন :
لا تواصلوا، فأيكم إذا أراد أن يواصل فليواصل حتى السحر.
তোমরা সওমে ওসাল কর না, কেউ যদি ওসাল করতে আগ্রহী হয়, তবে সে যেন সেহরি অবধি করে।[৭১]

সেহরি অবধি ওসাল করার ক্ষেত্রে কেবল বৈধতা প্রদান করা হয়েছে, উৎসাহ কিংবা সম্মতি দেওয়া হয়নি। বিভিন্ন হাদিসে, কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্রুত ইফতার করার জন্য উৎসাহ দিয়েছেন। সাহল বিন সাআদ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূল বলেছেন :
لا يزال الناس بخير ما عجلوا الفطر.
মানুষ যতক্ষণ দ্রুত (সময় হওয়া মাত্রই) ইফতার করবে, ততক্ষণ ভালো থাকবে।[৭২]

রাসূলের উক্তি إني أبيت يطعمني ربي ويسقين সম্পর্কে আলেমদের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে। কেউ বলেন : আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূলের উক্ত খাদ্য ও পানীয় ছিল ইন্দ্রিয়গত, অনুভবীয়। অর্থাৎ, আধ্যাত্মিকভাবে নয়, তাকে সরাসরি খাদ্যই প্রদান করা হত। এ ব্যাপারে তাদের যুক্তি, হাদিসের বাহ্যিক শব্দ-প্রয়োগ এ অর্থই বহন করছে, সুতরাং, তা থেকে সরে এসে ভিন্ন কোন অর্থ নেওয়ার মানে নেই।

অপর কেউ বলেন : এ আহার কোনভাবেই ইন্দ্রিয়গত বা অনুভবীয় ছিল না। বরং, আল্লাহ তাকে আপন জ্ঞানভান্ডার হতে তাকে যে মহান তত্ত্ব দান করতেন, মোনাজাতের মাধ্যমে অপার আস্বাদ, ভালোবাসা, এবং আল্লাহ তাআলার পরম নৈকট্যের যে ভূষণে তাকে শোভিত করতেন, এ তারই প্রতি ইঙ্গিতসূচক। যদি তাকে আমরা ইন্দ্রিয়গত ও অনুভবীয় পানাহার হিসেবেই সাব্যস্ত করি, তবে তাতে রাসূলের অক্ষমতাই কেবল প্রকাশ পাবে, সওমে ওসাল পালনকারী বলা হবে না। শেষোক্ত মতকেই অধিক যুক্তিযুক্ত মনে হয়।

এতে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, আল্লাহ তাআলার আনুগত্য ও এবাদতে নিজেকে লীন করে দেওয়া, প্রবৃত্তীয় যাবতীয় লালসা ও আকাঙ্ক্ষা হতে মুক্ত থেকে আল্লাহকে ধ্যান-জ্ঞান বানিয়ে যাপন করা বান্দার জন্য নির্মাণ করে এক অপার্থিব রক্ষাব্যুহ, যা ভেদ করে শয়তানি শত্রু তাকে আক্রান্ত করতে পারে না কোনভাবে, এর ফলে প্রবৃত্তিজাত দৌর্বল্যগুলো মানুষ অতি সহজে কাটিয়ে উঠতে পারে। মানুষ যতটা পরিমাণে দৈহিক প্রয়োজন ও চাহিদাগুলো এড়াতে পারবে, দমন করতে পারবে প্রবৃত্তির আকাঙ্ক্ষা, সাফল্যের পালক ততটাই বৃদ্ধি পাবে তার হিসেবের খাতায়, ইচ্ছা ও প্রতিজ্ঞায় বলীয়ান হয়ে উঠবে। রোজা তার জন্য, তখন, হবে রক্ষাকবচ্তযাবতীয় পাপ ও গোনাহ হতে।

রাসূল সওমে ওসাল পালন করতেন, যা ছিল তার জন্য মোস্তাহাব আমলের তুলনায় ঊর্ধ্বের। এ পালন প্রমাণ করে, তার মানসিকতা ছিল অধিক কল্যাণব্রতিতায় নিরত, নফ্‌সকে প্রবৃত্তির বন্ধ্যাত্ব হতে মুক্ত রাখবার জন্য আত্মমগ্ন। তার আত্মা সন্তোষ প্রকাশ করত প্রয়োজনীয় পার্থিব আস্বাদ পেয়ে এবং মুক্ত থাকত যাবতীয় গাফলত ও উদাসীনতা হতে। তিনি পার্থিব যাবতীয় কর্ম সম্পাদন করে স্রষ্টার জন্য সর্বোত্তম সময়টুকু বের করে আনতেন, মগ্ন হতেন তাতে তার এবাদতে। তার এ মানসিকতার সর্বোত্তম প্রকাশ ছিল রমজান মাসে, যে মাস রহমত-বরকতের মাস, এবাদত ও যুহুদ পালনের মহত্তম মৌসুম।

সওমে ওসাল ইঙ্গিত করে, আল্লাহ তাআলা কখনো কখনো বান্দার জন্য এমন কর্মের আদেশ প্রদান করেন, বাহ্যিক দৃষ্টিতে যাকে মনে হবে অনুপযোগী, মানুষের স্বাভাবিক স্বভাব ও প্রকৃতির প্রতিকুল্তখোলা চোখে যার যৌক্তিকতা আমাদের কাছে ধরা দেয় না।

রাসূলের, স্বয়ং ওসাল করা সত্ত্বেও, সাহাবিদের ওসাল হতে বিরত থাকার আদেশ প্রদান প্রমাণ করে, উম্মতের ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুবই দয়ার্দ্র চিত্তের, ও সহনশীল। নিষেধ ব্যতীত সাহাবিগণ তার কর্মের পূর্ণ অনুবর্তনে ছিলেন ব্রতী, তার অনুসরণে আত্মনিয়োগকারী।[৭৩]

রমজানে সফর করা, রোজা রাখা কিংবা ভঙ্গ করা

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানে সফর করতেন ; সফরে তিনি কখনো কখনো রোজা পালন করতেন, কখনো ত্যাগ করতেন, এবং পানাহার করতেন, অন্যদেরও আদেশ দিতেন রোজা ভঙ্গের। এ ব্যাপারে নানা হাদিস পাওয়া যায়্তইবনে আব্বাস হতে তাউস বর্ণনা করেন : রাসূল রমজানে রোজা পালনরত অবস্থায় সফরে বের হলেন, পথে উসফান নামক এলাকায় পৌঁছে পানিপাত্র আনার নির্দেশ দিলেন। লোকদের দেখানোর জন্য তিনি প্রকাশ্যেই পানি পান করলেন। মক্কায় পৌঁছা অবধি তিনি পানাহার করতে থাকলেন। ইবনে আব্বাস বলতেন : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানে সফররত অবস্থায় রোজা পালন করেছেন এবং ভঙ্গ করেছেন। সুতরাং, যার ইচ্ছা রোজা রাখবে, যার ইচ্ছা ভঙ্গ করবে।[৭৪]

রমজানে সফররত অবস্থায় রাসূলের রোজা রাখা এবং ভঙ্গ করার বিষয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, যদি কষ্টের সম্ভাবনা না থাকে, রোজা ভাঙ্গার মত কিছু না ঘটে, তবে রোজা রাখাই উত্তম। কারণ, রাসূল এমনই করেছেন। আবু দারদার হাদিসে এসেছ্তেতিনি বলেন: প্রচণ্ড তাপে আমরা রাসূলের সাথে রমজানে সফরে বের হলাম, এমনকি আমাদের কেউ কেউ অধিক তাপের ফলে মাথায় হাত দিচ্ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা ব্যতীত আমাদের মাঝে কেউ রোজাদার ছিলেন না।[৭৫] হাদিসটি প্রমাণ করে, সম্ভব হলে রোজা পালনই উত্তম। এর মাধ্যমে বান্দা দ্রুত দায়-মুক্ত হবে, রোজা পালন করতে পারবে সঠিক সময়ে, সকলের সাথে একই সময়ে রোজা রাখার ফলে বিষয়টি তার জন্য সহজ হবে।

তবে, রোজা ভাঙ্গার মত যদি কোন কারণ থাকে, তবে রোজা না রাখাই উত্তম। এক হাদিসে রাসূল এরশাদ করেন :
إن الله يحب أن تؤتى رخصه كما يكره أن تؤتى معصيته.
আল্লাহ পছন্দ করেন তার প্রদত্ত রুখসত যাপন করা, যেমন অপছন্দ করেন তার পাপে লিপ্ত হওয়া।[৭৬]

কখনো কখনো, বরং, এ অবস্থায় রোজা রাখা মাকরূহ। কারণ, মক্কা অভিযান কালীন রমজান মাসে রাসূল রোজা পালন করেননি। ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রোজা পালনরত অবস্থায় রাসূল কুদাইদ ও উসফান নামক স্থানের মধ্যবর্তী প্রস্রবনে অবতীর্ণ হয়ে রোজা ভেঙে ফেললেন, মাস শেষ হওয়া অবধি তিনি এভাবেই পানাহার করে চললেন।[৭৭]

আনাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : আমরা রাসূলের সাথে ছিলাম, আমাদের মাঝে অধিক ছায়া গ্রহণকারী ছিল সে ব্যক্তি, যে তার কাপড় দিয়ে ছায়া নিচ্ছিল। যারা রোজাদার ছিল তারা কিছুই করল না, আর যারা পানাহার করেছিল, তারা বাহন হাঁকাল, কাজে আত্মনিয়োগ করল, এবং প্রচুর পরিশ্রম করল। রাসূল বললেন : পানাহারকারীগণ আজ সওয়াব নিয়ে গেছে।[৭৮]

যদি রোজা পালন খুবই কঠিন হয়ে পড়ে, এবং পানাহার আবশ্যক হয়, তবে পানাহার বাধ্যতামূলক। কারণ, রাসূল এমন কঠিন অবস্থায় রোজা পালনকারীকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন :
أولئك العصاة، أولئك العصاة.
এরা পাপী, এরা পাপী।[৭৯]

এক ব্যক্তি, যে এমন কঠিন দু:সাধ্য সময়ে রোজা রেখেছিল, তাকে ঘিরে ছিল একদল লোক, এবং ছায়া দিচ্ছিল ; দেখে রাসূল বললেন :
ليس من البر الصيام في السفر.
(এভাবে) সফরে রোজা পালন কোন পুণ্যের কাজ নয়।[৮০]

আবু সাঈদ খুদরি হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রোজা পালনরত অবস্থায় আমরা রাসূলের সাথে মক্কায় সফরে বের হলাম। এক স্থানে যাত্রা বিরতিকালে রাসূল বললেন : তোমরা শত্রুব্যুহের কাছাকাছি পৌঁছে গেছ, পানাহার তোমাদেরকে শারীরিকভাবে সবল করে তুলবে। সুতরাং, আমাদের রুখসত প্রদান করা হয়েছিল। আমাদের কেউ রোজা রেখেছিল, পানাহার করেছিল কেউ কেউ। অত:পর ভিন্ন এক স্থানে উপনীত হলে রাসূল আমাদের উদ্দেশ্য করে বললেন : তোমরা ভোরে শত্রুর মুখোমুখি হবে, পানাহার হবে তোমাদের জন্য বলদায়ক, সুতরাং, তোমরা পানাহার কর। পানাহার ছিল বাধ্যতামূলক। তাই আমরা সকলে পানাহার করলাম। তিনি বলেন : এরপর আমরা অনেকবার রমজানের সফরে রাসূলের সাথে রোজা রেখেছি।[৮১] ইবনে কায়্যিম বলেন : পানাহারের জন্য বাসস্থান অতিক্রম করতে হবে রাসূল এমন বলেননি, এ ব্যাপারে রাসূল থেকে সহি কিছুই পাওয়া যায় না।[৮২]

আমাদের মতে, এ মত ব্যক্তিগতভাবে আনাস রা.-এর। সফরের সূচনা ব্যতীত কেউ রুখসত পালন করতে পারবে না। কারণ, রাসূলের অসংখ্য সফরের কোথাও আমরা এর দৃষ্টান্ত পাই না। এবং কোরআনে এসেছে,
فَمَن كَانَ مِنكُم مَّرِيضاً أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ [البقرة: ১৮৪]
তোমাদের মাঝে যে অসুস্থ হবে, কিংবা সফরে থাকবে, ভিন্ন সময় রোজা রেখে নিবে।[৮৩] 
যে সফরের সূচনা করেনি, সে সফরকারী হতে পারে না। অধিকাংশ আলেমের মতামত্তসফরের সূচনা ব্যতীত পানাহার করা যাবে না।

সফরে রোজা পালনের উত্তম-অনুত্তম বিচারে শাস্ত্রজ্ঞ ও তত্ত্ববিদদের যাবতীয় বর্ণনা ও মতামতকে সামনে রেখেই আমরা বলতে পারি : সফরে রোজা পালন কিংবা ভঙ্গ কর্তাউভয়টিই রাসূলের আচরিত পথ। সফরের রোজা কিংবা পানাহারের বিষয়টি অযৌক্তিকভাবে যারা খারিজ করে দেন, তাদেরকে এ বিষয়ের প্রতি সবিশেষ যত্নবান হতে হব্তেসন্দেহ নেই।

চাঁদ দেখা কিংবা ত্রিশ দিন পূর্ণ করার মাধ্যমে রোজা ভঙ্গকরণ

চাঁদ দেখার নিশ্চয়তা কিংবা পূর্ণ ত্রিশ দিন অতিক্রম ব্যতীত রাসূল রোজা ভঙ্গ করতেন না। হাদিসে এসেছে,
صوموا لرؤيته، وأفطروا لرؤيته، وانسكوا لها؛ فإن غمَّ عليكم فأكملوا ثلاثين؛ فإن شهد شاهدان فصوموا وأفطروا.
তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখ, এবং তা দেখেই রোজা ভঙ্গ কর, এবং একে অভ্যাসে পরিণত কর। যদি তা মেঘে ঢেকে যায়, তবে ত্রিশ দিন পূর্ণ কর। দু ব্যক্তি যদি সাক্ষ্য প্রদান করে, তবে, সাক্ষ্য অনুসারে, রোজা রাখ, অথবা ভঙ্গ কর।[৮৪] মাসের সূচনা-সমাপ্তির উভয়টিই্তসৌর বাৎসরিক হিসেব নয়্তপ্রত্যক্ষণের উপর ভিত্তি করে নির্ধারণ কাম্য।

এ ক্ষেত্রে উদ্ভূত যে কোন বিরোধ এড়ানো মুসলমানদের অবশ্য কর্তব্য্তসন্দেহ নেই ; এমনকি সম্মিলিতভাবে সকলে যদি গৌণ মতকে মেনে নেয় কিংবা সৌর বাৎসরিক হিসেবের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত প্রদান করে। যে মতবিরোধের ফলে ফরজ-ওয়াজিবের মত মৌলিক বিষয় লঙ্ঘিত হবে, মানুষ ব্যাপক ফেতনা ও ভ্রাতৃঘাতী পাপে আক্রান্ত হবে, ছড়াবে ঘৃণা ও বিদ্বেষের বিষ, তা এড়িয়ে, এ ধরনের সম্মিলিত গৌণ মতামত মেনে নেওয়াই উত্তম।

এভাবে, পারস্পরিক মতদ্বৈধতায় লিপ্ত হওয়া, সর্বৈবে, পাপ আজাবের উদ্রেককারী। সর্ব-মান্য বিজ্ঞ আলেম-সমাজের নেতৃত্ব, ও কিংবা কেন্দ্রীয় গ্রহণযোগ্য দিকনির্দেশনা ব্যতীত এ মতবিরোধ প্রকট রূপ ধারণ করে মুসলিম সংখ্যালঘু এলাকাগুলোয়। চাঁদ দেখা যাক কিংবা সৌর বাৎসরিক হিসাব মানা হোক, অসহনীয়ভাবে তারা বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে সহিষ্ণু ও ভ্রাতৃসুলভ আচরণ প্রদর্শন কাম্য।

উপরোক্ত বিষয়গুলো রাসূলের সে মহান আচরণীয় আদর্শের প্রতিফলন, যা তিনি উম্মতের নিকট পেশ করেছেন, এ আচরণ ও অভ্যাসের মাঝ দিয়েই তিনি আল্লাহর দরবারে রমজান মাসে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন, রোজার সুন্নত, মোস্তাহাব ও আদব পালন করেছেন রহমতের আকুতি ও ব্যাকুলতা নিয়ে। নফল ও সুন্নতের ব্যাপারে রাসূল যতটা যত্নবান ছিলেন, তার তুলনায় অনেক বেশি ছিলেন ফরজ ও ওয়াজিব আদায়ের ব্যাপারে, এবং হারাম ও পাপকে এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে। এক হাদিসে কুদসীতে রাসূল এরশাদ করেন:
وما تقرب إلي عبدي بشيء أحب إليَّ مما افترضت عليه.
বান্দার উপর আমি যা ফরজ করেছি, আমার নিকটবর্তীকারীর মাঝে তাই আমার সর্বাধিক প্রিয়।[৮৫]

অপর এক হাদিসে রাসূল এরশাদ করেন :
من لم يدع قول الزور والعمل به والجهل فليس لله حاجة أن يدع طعامه وشرابه.
মিথ্যা কথন, সে অনুসারে আমল ও মূর্খতা প্রসূত আচরণ যে ব্যক্তি ত্যাগ না করবে, তার পানাহার পরিত্যাগে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই (অর্থাৎ, আল্লাহ তাকে সওয়াব প্রদান করবেন না)।[৮৬]

এ বিষয়টিই নাজাত আকাঙ্ক্ষী যে কোন মুসলমানকে নিজেকে জানবার, উপলব্ধি করবার এবং নিজ অবস্থানকে শনাক্ত করবার মুখোমুখি এনে দাঁড় করায় ; সম্পর্ক, যোগাযোগ, আচরণীয় ও নৈতিক্তযাবতীয় ক্ষেত্রে নিজেকে সুন্দর-শোভাময় ও সৌকর্যমন্ডিত করে তুলতে উৎসাহ জোগায়। সে হয়ে উঠে রাসূলের অধিক নিকটবর্তী ও অনুবর্তী।

উপরোক্ত বিষয়গুলোর উপলব্ধির পর আমরা বুঝতে পারব কতটা ঠুনকো বিষয় নিয়ে নব্য, আধুনিক সচেতন সমাজ নিজেদের কল্যাণব্রতী প্রমাণ করতে চাচ্ছে। যারা সুন্নত ও মোস্তাহাবকে কেন্দ্র করে ফরজ ও বিরোধপূর্ণ বিষয়গুলোকে হীনতর মনে করছে। লাভ অর্জনের পূর্বে মূলধন সংরক্ষণ অধিক গুরুত্বপূর্ণ্তসচেতন ব্যক্তি মাত্রই এ আপ্ত বাক্য সম্পর্কে জ্ঞাত। সুন্নত ও মোস্তাহাব পালন করার নিমিত্তে যদি ফরজ ও ওয়াজিব ত্যাগ করতে হয়, তবে তা হবে খুবই পরিতাপের ও পরিণতির বিচারে ভয়াবহ। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন।

রমজানে রাসূল সা.-এর এবাদতে রাত্রি জাগরণ

রাত্রি জাগরণ সালিহীন ও এবাদতগুজারদের নিদর্শন ও পরিচয় ; যারা দাওয়াত ও সংস্কারের মহান দায়িত্বে সতত নিয়োজিত ও মগ্ন, তাদের মহান আদর্শ। এ ক্ষেত্রে তারা অনুসরণ-অনুবর্তন করেন সে মহান ব্যক্তিত্ব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের, রাত্রি জাগরণ ছিল যার পুরো বছরের এবাদত- ওজর ব্যতীত তিনি কখনো রাত্রি জাগরণ ত্যাগ করতেন না, সুতরাং রমজানে কী পরিমাণ রাত্রি জাগরণ করতেন, তা বলাই বাহুল্য।

রাসূলের রাত্রি জাগরণ, তাহাজ্জুদ ও সালাত আদায়ের বৈশিষ্ট্য ও রূপ বর্ণনা করে বিভিন্ন হাদিস বর্ণিত হয়েছে। হাদিসে এসেছে- রাসূল রাতে এগারো কিংবা তেরো রাকাতের অধিক সালাত আদায় করতেন না। 
উম্মুল মোমিনীন আয়েশা রা. বর্ণিত হাদিসে এসেছে- 
রাসূল রমজান কিংবা অন্য সময়ে এগারো রাকাতের অধিক সালাত আদায় করতেন না।[৮৭] 
অন্য এক হাদিসে আয়েশা রা. বর্ণনা করেন : 
রাসূল রাতে তেরো রাকাত সালাত আদায় করতেন। অত:পর ভোরের আজান শ্রুত হলে সংক্ষেপে দু রাকাত সালাত আদায় করতেন।[৮৮]

তার রাত্রি জাগরণের পদ্ধতি ছিল নানা প্রকার, যেভাবেই করা হোক না কেন, এবাদতগুজার বান্দার জন্য তা হবে কল্যাণকর। তবে, সুন্নত অনুসারে, উত্তম হচ্ছে জোড় হিসেবে দুই দুই রাকাত করে অধিক-হারে আদায় করা।

রাকাতের সংখ্যা ও পদ্ধতি বিষয়ে যত বর্ণনা রয়েছে, তাতে আমরা দেখতে পাই, বিনয়-বিনম্রতার সাথে দীর্ঘ তেলাওয়াত, রাত্রি-জাগরণে ধ্যান-নিমজ্জন, অন্তরের সাক্ষ্য ও উপস্থিতি সহ জিকির ও দোয়া, প্রতিটি কর্মের সুষম সম্পাদন অধিক সংখ্যক রাকাতের তুলনায় উত্তম ও শ্রেয়। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংখ্যা ও পদ্ধতি নির্দিষ্টকরণ ব্যতীতই হাদিসে এরশাদ করেছেন,
صلاة الليل مثنى مثنى.
রাতের সালাত দুই দুই সংখ্যায়।[৮৯]

তাত্ত্বিক ও অনুসন্ধিৎসু পাঠক মাত্রই স্বীকার করবেন, তারাবীহ নামাজের রাকাত-সংখ্যা বিষয়ে রয়েছে নানা মতবিরোধ ও এখতেলাফ।[৯০] 
রাসূলের সুন্নাহর পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধানের পর আমরা স্বীকার করতে বাধ্য হব- এ ব্যাপারে তিনি নির্দিষ্ট কোন সীমা এঁকে দেননি। কেবল রাত্রি-জাগরণের ব্যাপারে সকলকে উৎসাহিত করেছেন। এ ব্যাপারে রাসূলের নীরবতা অবলম্বন বিষয়টির ব্যাপক সম্ভাব্যতার প্রমাণ করে- সুতরাং, ব্যক্তির পক্ষে একাগ্রতা-বিনম্র চিত্ততা ও প্রশান্তির সাথে যতটা সম্ভব সালাত আদায় বৈধ, যদিও সংখ্যা ও পদ্ধতিগত দিক থেকে রাসূলকে অনুসরণ করা শ্রেয়।[৯১]

রাসূল কখনো পূর্ণ রাত্রি সালাতে জাগরণ করতেন না। কোরআন তেলাওয়াত ইত্যাদির মাধ্যমে কিছু সময় কাটাতেন। আয়েশা রা. বর্ণিত হাদিসে এসেছে,
ولا أعلم نبي الله صلى الله عليه و سلم قرأ القـرآن كـله في ليـلة، ولا قام ليلة حتى أصـبح، ولا صام شهراً كاملاً غير رمضان.
রমজান ব্যতীত কোন রাত্রিতে আমি রাসূলকে পূর্ণ কোরআন তেলাওয়াত করতে, কিংবা ভোর অবধি সালাতে কাটিয়ে দিতে অথবা পূর্ণ মাস রোজা পালন করে কাটিয়ে দিতে দেখিনি।[৯২]

ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত : জিবরাইল আ. রমজানের প্রতি রাতে ভোর অবধি রাসূলের সাথে কাটাতেন। রাসূল তাকে কোরআন শোনাতেন।[৯৩]- রাসূল যদি সে রাতগুলোতে পূর্ণ সময় ব্যয়ে কিয়ামুল লাইল করে কাটিয়ে দিতেন, তবে জিবরাইল আ.-এর সাথে কোরআন অনুশীলনে সময় পেতেন না।

এবাদতের এ পদ্ধতি শরীরের জন্য অনুকূল, মন এতে অংশ নেয় স্বত:স্ফূর্তভাবে। এর ফলে ব্যক্তির জন্য পরিবারের হক আদায় সম্ভব হয় ; এবাদতে অব্যহততা আনা যায়, সহনীয়ভাবে, ক্রমশ: দ্বীনের মাঝে প্রবেশ সহজ হয়। নফ্‌স হঠাৎ বিতৃষ্ণ হয়ে উঠে না। অধিক কিন্তু বিচ্ছিন্ন এবাদতের তুলনায় পরিমাণে স্বল্প ও অব্যাহত এবাদত কল্যাণকর ও আল্লাহর নিকট প্রিয়।

অধিকাংশ সময় রাসূল- উম্মতের জন্য ফরজ করে দেয়া হবে এ আশঙ্কায়- রাতে একাকী সালাত আদায় করতেন। আনাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন :
كان رسول الله صلى الله عليه و سلم يصلي في رمضان، فجئت فقمت إلى جنبه، وجاء رجل آخر فقام أيضاً، حتى كنا رهطاً، فلما حسَّ النبي صلى الله عليه و سلم أنَّا خلْفه جعل يَتَجوَّز في الصلاة، ثم دخل رحله فصلى صلاة لا يصليها عندنا، قال: قلنا له حين أصبحنا: أفطنت لنا الليلة؟، قال: فقال: نعم، ذاك الذي حملني على الذي صنعت.
রাসূল রমজানে (রাতে) সালাত আদায় করতেন। একদিন আমি এসে তার পাশে দাঁড়ালাম, অত:পর এক ব্যক্তি এসে দাঁড়াল- এভাবে কিছুক্ষণের মাঝে আমরা একটি দলে পরিণত হলাম। রাসূল যখন বুঝতে পারলেন যে, আমরা তার পিছনে দাঁড়ানো, তখন সংক্ষেপে সালাত আদায় করতে লাগলেন। অত:পর তিনি তার গৃহে প্রবেশ করে একাকী সালাত আদায় করলেন। প্রত্যুষে আমরা তাকে বললাম : আপনি রাতে আমাদের সাথে কৈৗশল করেছেন ? তিনি বললেন, হ্যা। আমি তোমরা জড়ো হওয়ার ফলেই আমাকে কৌশল করতে হয়েছে।[৯৪]

আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন :
أن رسول الله صلي الله عليه و سلم خرج من جوف الليل فصلى في المسجد فصلى رجال بصلاته؛ فأصبح الناس يتحدثون بذلك، فاجتمع أكثر منهم، فخرج رسول الله صلي الله عليه و سلم في الليلة الثانية فصلوا بصلاته؛ فأصبح الناس يذكرون ذلك، فكثر أهل المسجد من الليلة الثالثة، فخرج فصلوا بصلاته، فلما كانت الليلة الرابعة عجز المسجد عن أهله، فلم يخرج إليهم رسول الله صلي الله عليه و سلم، فطفق رجال منهم يقولون: الصلاة، فلم يخرج إليهم رسول الله صلي الله عليه و سلم حتى خرج لصلاة الفجر، فلما قضى الفجر أقبل على الناس، ثم تشهد فقال: أما بعد: فإنه لم يَخْفَ علي شأنكم الليلة، ولكني خشيت أن تفرض عليكم صلاة الليل فتعجزوا عنها.
এক রাতে রাসূল গৃহ হতে বেরিয়ে মসজিদে সালাত আদায় করলেন। কয়েক ব্যক্তি তার সাথে সালাত আদায় করল। পরদিন সকলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় প্রবৃত্ত হল, ফলে পূর্বের তুলনায় অধিক লোক সমাগম হল। দ্বিতীয় রাত্রিতেও রাসূল আগমন করলে লোকেরা তার সাথে সালাত আদায় করল, সকলে এ নিয়ে আলোচনায় অংশ নিল। তৃতীয় রাত্রিতে পূর্বেরও অধিক লোকসমাগম হল। রাসূল বের হলে সকলে তার সাথে সালাত আদায় করল। চতুর্থ রাত্রিতে এত মুসল্লি হল যে, মসজিদ তাদের ধারণ করতে অক্ষম হয়ে পড়ল। কয়েক ব্যক্তি ডেকে বলল : সালাত ! কিন্তু, রাসূল ফজরে সালাতের পূর্বে বেরুলেন না। ফজরের সালাত আদায়ের পর তিনি সকলের দিকে ফিরে তাশাহুদ পাঠ করে বললেন : গত রাতের ঘটনা আমার অবিদিত নয়। কিন্তু, আমি আশঙ্কা করেছি যে, তোমাদের উপর রাতের সালাত ফরজ করা হবে, তোমরা তা আদায়ে অপরাগ হয়ে পড়বে।[৯৫]

আবু যর হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : আমরা রাসূলের সাথে রোজা পালন করেছি, যখন মাসের মাত্র সাতদিন বাকি ছিল, তখন তিনি আমাদের নিয়ে রাতের এক তৃতীয়াংশ সালাত আদায় করলেন। ষষ্ঠ দিনে তিনি আমাদের সাথে সালাত আদায় করেননি। পঞ্চম রাতে অর্ধ রাত্রি আমাদের নিয়ে সালাত আদায় করলেন। আমরা তাকে উদ্দেশ্য করে আরজ করলাম : হে আল্লাহর রাসূল ! আপনি বাকি সময়টুকুও যদি আমাদের নিয়ে নফল সালাতে কাটাতেন ! তিনি বললেন : যে ব্যক্তি ইমাম সালাত সমাপ্তি করা অবধি তার সাথে সালাত আদায় করবে, তার জন্য পূর্ণ রাত্রি সালাত আদায়ের সওয়াব লিখে দেয়া হবে। অত:পর তিনি শেষ তিন রাত বাকি থাকা পর্যন্ত আর আমাদের নিয়ে সালাত আদায় করলেন না। তৃতীয় রাত্রিতে আমাদের নিয়ে সালাত আদায় করলেন। স্ত্রী ও পরিবার-পরিজনদের ডেকে নিলেন। এতটা সময় তিনি আমাদের সাথে রাত্রি জাগরণ করেছিলেন যে সেহরির সময় অতিক্রান্তের ভয় হচ্ছিল।[৯৬]

রাসূল- তার প্রতি আমার পিতা-মাতা উৎসর্গিত হোক- উম্মতের কল্যাণ, শিক্ষা ও এবাদতে সহায়তা দানে ছিলেন বদ্ধপরিকর, অত্যন্ত আগ্রহী। কতটা সময় তিনি উম্মতকে সাথে নিয়ে রাত্রি জাগরণ-সালাত আদায় করেছেন- বলাই বাহুল্য।

আগ্রহের সাথে সাথে তিনি এ আশঙ্কাও পোষণ করতেন যে, তার উম্মতের উপর রাত্রি-জাগরণ ও সালাত আদায় ফরজ করা হতে পারে; ফলে কিছু লোক এ ব্যাপারে অক্ষমতায় আক্রান্ত হবে, গোনাহর ভাগীদার হবে ফরজ ত্যাগের ফলে। সাহাবিদের সীমাহীন আকাঙ্ক্ষার কারণে তিনি তাদের সাথে রাতে সালাত আদায় করতেন, অন্যথায়, পরবর্তী দুর্বল মুসলমানদের প্রতি লক্ষ্য রেখেই তিনি এ ব্যাপারে তাদের বারণ করেছিলেন।

আল্লাহ তার প্রিয় রাসূলের মহত্ত্ব, দয়ার্দ্রতা এবং আবেগের যথার্থ চিত্র তুলে ধরেছেন ; কোরআনে এসেছে,
لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ.
অবশ্যই তোমাদের মাঝে, তোমাদের থেকেই একজন রাসূল আগমন করেছেন, যা তোমাদেরকে বিপন্ন করে, তা তার জন্য কষ্টদায়ক, সে তোমাদের মঙ্গলকামী, মোমিনদের জন্য দয়ার্দ্র, ও করুণাময়।[৯৭]

যারা দায়ি, সংস্কার কর্মে নিয়োজিত, তাদের জন্য বিষয়টি গাইড ও আদর্শ স্বরূপ। মানুষের হেদায়েত ও দাওয়াতের ক্ষেত্রে যথাসাধ্য শ্রম ব্যয় করে নিজেকে তারা উজাড় করে দেবে, উম্মতের জন্য অন্তরে লালন করবে সহানুভূতি, করুণা ও হৃদ্যতা। তাদের অস্বীকৃতি ও বিকারকে এড়িয়ে দ্বীনকে তুলে ধরবে সরল নীতিমালা হিসেবে।

উল্লেখিত হাদিসগুলোর মাধ্যমে আমরা তারাবীহ নামাজের ফজিলত বিষয়ে অবগতি লাভ করি, প্রথমে তা ছিল রাসূল কর্তৃক অনুমোদিত-প্রবর্তিত মসজিদে আদায়কৃত সুন্নত ; পরবর্তীতে ফরজ করে দেয়ার আশঙ্কায় রাসূল তা পরিত্যাগ করেন। উমর ফারুক রা.-এর খেলাফতকালে- রাসূলের তিরোধানের ফলে ফরজ হওয়ার সম্ভাবনা যখন লুপ্ত- তিনি দেখতে পেলেন, লোকেরা বিচ্ছিন্নভাবে মসজিদে তারাবীহ-র সালাত আদায় করছে, সকলকে লক্ষ্য করে তিনি বললেন :
إني أرى لو جمعت هؤلاء على قارئ واحد لكان أمثل، ثم عزم فجمعهم على أُبيٍّ بن كعب رضي الله عنه.
আমার মনে হয়, সকলে যদি এক ইমামের পিছনে তা আদায় করত, তবে তা হত সুন্দর-উত্তম। অত:পর তিনি গুরুত্বের সাথে সকলকে উবাই বিন কাব-এর ইমামতিতে একত্রিত করলেন।[৯৮]

উমরের এ আদেশ সাহাবিদের সকলে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিয়েছিলেন- এমনকি, একদা রমজানের প্রথম রাত্রিতে আলী রা. মসজিদে এসে দেখতে পেলেন, তাতে আলো জ্বলছে, সকলে সমস্বরে কোরআন তেলাওয়াত করছে, তখন তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে উমর রা.-কে লক্ষ্য করে বললেন : হে উমর বিন খাত্তাব ! আল্লাহ আপনার কবরকে আলোয় আলোকিত করুন, যেভাবে আপনি মসজিদকে কোরআনের আলোয় আলোকিত করেছেন।[৯৯]

সুতরাং, যে ব্যক্তি তা পালন করতে আগ্রহী, এবং এ ব্যাপারে রাসূল ও তার সাহাবাগণের অনুবর্তী, তার দায়িত্ব যত্নের সাথে তা পালন করা। হাদিসে আছে- একবার রাসূল যখন কয়েকজনকে নিয়ে রাত্রি যাপন করছিলেন, অর্ধ রাত্রি অতিক্রান্তের পর জনৈক সাহাবি তাকে বলল : আপনি যদি বাকি রাতটুকু আমাদের নিয়ে নফল আদায় করতেন ! তখন রাসূল বললেন : ইমামের সাথে যে ব্যক্তি রাতে সালাত আদায় করল, এবং ইমাম সমাপ্ত করা অবধি সে প্রস্থান করল না, তাকে পূর্ণ রাত্রি এবাদতে যাপনের সওয়াব প্রদান করা হবে।[১০০] রাসূলের এ উক্তি প্রমাণ করে, ইমামের সাথে রমজানের রাত্রি এবাদতে যাপন খুবই ফজিলতপূর্ণ একটি কর্ম।

তারাবীহ সালাতের রাকাতের সংখ্যার ক্ষেত্রে ব্যক্তি বিশেষের সীমা-রোপ, এবং ইমামের সালাত সমাপ্তির পূর্বেই প্রস্থান- হাদিসটি প্রমাণ করে- বৈধ হলেও, উত্তম ও প্রশংসনীয় হতে পারে না কোনভাবে। যারা এভাবে বিষয়টির ইজতিহাদ করেছেন, আমি মনে করি, তাদের ইজতিহাদ প্রশংসনীয়, কিন্তু পূর্ণ এক রাত্রির সওয়াব বিনষ্টকারী, বিধায় কর্মের বিচারে প্রশংসনীয় নয়।

রাসূলের রাত্রিকালীন সালাতের দৈর্ঘ্য

রমজানে রাত্রিকালীন সালাতের ক্ষেত্রে রাসূল সালাতকে অনেক দীর্ঘ করতেন। উম্মুল মোমিনীন আয়েশা রা.-কে রমজানে রাসূলের সালাত বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন :
ما كان يزيد في رمضان ولا في غيره على إحدى عشرة ركعة: يصلي أربعاً فلا تسل عن حسنهن وطولهن، ثم يصلي أربعاً فلا تسل عن حسنهن وطولهن، ثم يصلي ثلاثاً. فقلت: يا رسول الله، أتنام قبل أن توتر؟، قال: يا عائشة، إن عينيَّ تنامان ولا ينام قلبي.
রমজান কিংবা অন্য সময়ে তিনি (রাতে) এগারো রাকাতের অধিক সালাত আদায় করতেন না। তিনি প্রথমে চার রাকাত আদায় করতেন, তার সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্য হত অতুলনীয় ; অত:পর চার রাকাত আদায় করতেন, তার সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্যও হত অতুলনীয়। এর পর তিন রাকাত আদায় করতেন। আমি বললাম : হে আল্লাহর রাসূল ! আপনি বিতির আদায়ের পূর্বেই ঘুমাবেন ? তিনি বললেন, হে আয়েশা ! আমার দু-চোখ ঘুমায়, কিন্তু অন্তর ঘুমায় না।[১০১]

নোমান বিন বশির বর্ণনা করেন, আমরা রমজানের তেইশতম রাত্রির প্রথম এক তৃতীয়াংশ রাসূলের সাথে যাপন করলাম। পঁচিশতম রাত্রিতে অর্ধরাত্রি আমরা তার সাথে কাটালাম। সাতাশতম রাত্রিতে এতটা সময় যাপন করলাম যে, আমাদের আশঙ্কা হল, সেহরি গ্রহণ করতে পারব না।[১০২]

রাসূলের সাহাবিগণ দীর্ঘ সময় রাত্রি যাপনের ক্ষেত্রে ছিলেন তার উত্তম অনুসারী। সায়েব বিন য়াযিদ হতে বর্ণিত, 
তিনি বলেন : উমর বিন খাত্তাব উবাই বিন কাব ও তামিম দারিকে নির্দেশ দিলেন সকলকে নিয়ে এগারো রাকাত সালাত আদায় করতে। তিনি বলেন : ইমাম এতটা সময় তেলাওয়াত করতেন যে, আমরা দীর্ঘ সময় দণ্ডায়মান থাকার ফলে লাঠিতে ভর দিতাম। ফজর নিকটবর্তী হওয়ার পূর্বে আমরা প্রস্থান করতাম না।[১০৩] 
তার থেকে আরো বর্ণিত আছে : দীর্ঘ সময় দণ্ডায়মানের ফলে উসমান বিন আফ্‌ফান এর কালে লোকেরা লাঠিতে ভর দিত।[১০৪]

যারা সংক্ষেপ তেলাওয়াতের মাধ্যমে তারাবীহ সালাতকে সংক্ষিপ্ত করেন, হাদিসগুলো তাদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট প্রমাণ। এতটাই দ্রুততার সাথে তারা সালাত আদায় করেন যে, শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করা হয় না, সালাতের রুকন ও ওয়াজিবগুলো পালন করা হয় না পূর্ণাঙ্গরূপে। মোস্তাহাব ও ধৈর্য-প্রশান্তির বিষয়ের উল্লেখ বাহুল্য বৈ নয়।

অপরদিকে, কেবল সংখ্যার ক্ষেত্রেই যারা রাসূলকে অনুসরণ করেন, পদ্ধতির ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ করেন না, তাদের অশুদ্ধতাও চি‎িহ্নত। রাসূল দীর্ঘ সময় সালাত আদায় করতেন, বিনয়-বিনম্রতার চূড়ান্ত করে নিজেকে আল্লাহর দরবারে পেশ করতেন। নামাজরত রাসূল ছিলেন প্রশান্তি ও ধৈর্যের এক জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত। আমরা আল্লাহ পাকের দরবারে কল্যাণের দিশা ও সঠিক পথ-প্রাপ্তির তৌফিক কামনা করি।

তবে ইমামের দায়িত্ব তার জামাতের সাথে বৈধ সীমারেখা পর্যন্ত সমঝোতা করে সালাত পরিচালনা করা। দীর্ঘ সময় যদি তাদের নিয়ে সালাত আদায় সম্ভব না হয়, তবে যতটা সম্ভব সহনীয় পর্যায়ে র্দীর্ঘায়িত করবে। রাসূল বলেছেন :
إذا قام أحدكم للناس فليخفف، فإن منهم الضعيف والسقيم والكبير، وإذا صلى أحدكم لنفسه فليطول ما شاء.
যখন তোমাদের কেউ ইমামতি করবে, সে যেন সংক্ষেপ করে, কারণ, তাদের কেউ দুর্বল, অসুস্থ কিংবা বৃদ্ধ। তবে, যখন একাকী পড়বে, ইচ্ছা অনুসারে সালাত দীর্ঘ করবে।[১০৫]

এতেকাফে আল্লাহর একান্ত-সান্নিধ্য যাপন

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানে এতেকাফ পালন করতেন, একান্ত কিছু সময় যাপন করতেন আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্যে। রাসূলের এতেকাফকালীন সময় বিচার করলে এ ব্যাপারে তার আচরণ, সুন্নত ও অবস্থা স্পষ্টরূপে আমাদের নিকট প্রতিভাত হবে।

প্রতি বছর রাসূল মদিনায় এতেকাফ পালন করতেন। আয়েশা রা. বর্ণনা করেন: রাসূল প্রতি রমজানে এতেকাফ পালন করতেন।[১০৬]

রাসূল মাসের প্রতি দশে এতেকাফ করেছেন, অত:পর লাইলাতুল কদর শেষ দশ দিনে জেনে তাতে স্থির হয়েছেন। এ ব্যাপারে বিভিন্ন হাদিস রয়েছে,

রাসূল বলেন :
إني اعتكفت العشر الأُوَل ألتمس هذه الليلة، ثم اعتكفت العشر الأوسط، ثم أُتيت فقيل لي: إنها في العشر الأواخر؛ فمن أحب منكم أن يعتكف فليعتكف؛ فاعتكف الناس معه.
আমি কদরের রাত্রির সন্ধানে প্রথম দশ দিন এতেকাফ করলাম। এরপর এতেকাফ করলাম মধ্যবর্তী দশদিনে। অত:পর ওহি প্রেরণ করে আমাকে জানান হল যে তা শেষ দশ দিনে। সুতরাং তোমাদের যে এতেকাফ পছন্দ করবে, সে যেন এতেকাফ করে। ফলে, মানুষ তার সাথে এতেকাফ যাপন করল।[১০৭]

আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যু-পূর্ব পর্যন্ত রমজানের শেষ দশ দিনে এতেকাফ পালন করেছেন।[১০৮]

এতেকাফকালীন রাসূল মসজিদে সকলের থেকে আলাদা করে একটি তাঁবু-সদৃশ টানিয়ে দেওয়ার আদেশ দিতেন। সকল হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে তাতে তিনি আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্য যাপন করতেন। অন্তরের যাবতীয় একাগ্রতা ও মনোযোগ, আল্লাহর জিকির, বিনয়-বিনম্রতার সাথে নিজেকে তার দরবারে সমর্পণ যেন হয় অন্তরের একমাত্র চিন্তা ও ধ্যান্তএ উদ্দেশ্যেই রাসূল নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে একান্ত সময় যাপন করতেন।

আবু সাইদ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূল এক তুর্কি তাঁবুতে এতেকাফে বসলেন, যার প্রবেশমুখে ছিল একটি চাটাইয়ের টুকরো। তিনি বলেন : রাসূল সে চাটাইটি হাতে ধরে একপাশে সরিয়ে রাখলেন এবং মুখমণ্ডল বের করে মানুষের সাথে কথোপকথনে নিয়োজিত হলেন।[১০৯]

নাফে বিন উমর হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষ দশ দিনে এতেকাফ করতেন। নাফে বলেন: আব্দুল্লাহ রা. মসজিদের যে অংশে রাসূল এতেকাফ করতেন, তা আমাকে দেখিয়েছেন।[১১০]

ইবনে কায়্যিম বলেন : এসব আয়োজন এতেকাফের উদ্দেশ্য ও রুহ লাভের জন্য। মূর্খরা যেমন করে জনবহুলভাবে, জাঁকজমকের সাথে এতেকাফ করে, তা সিদ্ধ নয় কোনভাবে।[১১১]

বিশ তারিখের দিবসের সূর্যাস্তের পর একুশ তারিখের রাতের সূচনাতে রাসূল তার এতেকাফগাহে প্রবেশ করতেন, এবং তা হতে বের হতেন ঈদের চাঁদ দেখা যাওয়ার পর। মধ্যবর্তী এই সময়টি শেষ দশদিন, যাতে এতেকাফের বিধান দেয়া হয়েছে। আবু সাইদ খুদরি হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের মধ্যবর্তী দশ দিনে সম্মিলিতভাবে এতেকাফ পালন করতেন। বিশতম রাত্রি বিগত হয়ে একুশতম দিবস উদিত হলে তিনি গৃহে প্রত্যাবর্তন করতেন, এবং যারা তার সাথে এতেকাফ যাপন করত, তারাও ফিরে আসত, সম্মিলিতভাবে যাপিত রাত্রিগুলোর যে রাতে তিনি প্রত্যাবর্তন করতেন, একবার সে রাত্রি যাপন করলেন সকলকে নিয়ে, সকলের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন, তাদের নির্দেশ দিলেন আল্লাহ তাআলার আদেশ বিষয়ে। অত:পর বললেন : আমি ইতিপূর্বে এই দশে সম্মিলিতভাবে এতেকাফ পালন করতাম। এখন আমাকে জানানো হয়েছে যে, শেষ দশ রাত্রিতে সম্মিলিতভাবে যাপন করা কাম্য, সুতরাং যে আমার সাথে এতেকাফ করবে, সে যেন এতেকাফস্থলে অবস্থান করে। আমাকে এ (লাইলাতুল কদর) দেখানো হয়েছিল, অত:পর আমি তা বিস্মৃত হয়েছি। তোমরা তা শেষ দশ দিনে অনুসন্ধান কর, এবং অনুসন্ধান কর প্রতি বেজোড়ে। আমি দেখতে পেয়েছি যে, আমি পানি ও কাদায় সেজদা দিচ্ছি। একুশের রাতে আকাশ ঝেপে বৃষ্টি এল, এবং রাসূলের জায়নামাজে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানি পড়ল।[১১২] হাদিসটি প্রমাণ করে, একুশের রাত্রি হতেই এতেকাফের সূচনা, এবং এতেকাফ দিবসগুলোর শেষ দিবসের সূর্যাস্তের পরই কেবল এতেকাফকারী আপন গৃহে প্রত্যাবর্তন করবে।

এস্থলে উল্লেখ্য যে, আয়েশা রা. কর্তৃক বর্ণিত এক হাদিসে আমরা দেখতে পাই, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজর বাদে এতেকাফস্থালে প্রবেশ করতেন। তার বর্ণিত হাদিসে এসেছে,
كان رسول الله صلي الله عليه و سلم إذا أراد أن يعتكف صلى الفجر ثم دخل معتكفه.
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এতেকাফের ইচ্ছা পোষণ করতেন, তখন ফজর আদায় করে এতেকাফগাহে প্রবেশ করতেন।[১১৩] 
এতে উভয় বর্ণনার মাঝে সংঘর্ষ হবে না। কারণ, বোখারির ভিন্ন এক রেওয়ায়েতে একই হাদিস কিছু শাব্দিক তারতম্য সহ বর্ণিত হয়েছে, এবং তাতে আছে, دخل مكانه الذي اعتكف فيه অর্থাৎ, তিনি প্রবেশ করলেন এমন স্থানে যাতে তিনি ইতিপূর্বে এতেকাফ করেছেন।[১১৪] পূর্বের রাত্তেএকুশের রাত্তেএখানে এতেকাফ করে রাসূল কোন কারণে হয়ত বেরিয়েছিলেন, এবং ফজর বাদ তাতে আবার প্রবেশ করেছেন। ইবনে উসাইমিন বলেন : এ বর্ণনাটি প্রমাণ করে যে, রাসূল তাতে প্রবেশের পূর্বে অবস্থান করেছেন। কারণ, হাদিসে বর্ণিত اعتكف অতীতকালীন ক্রিয়া, যার মানে হল তিনি ইতিপূর্বে তাতে এতেকাফ করেছেন। এ জাতীয় ক্ষেত্রগুলোতে শব্দকে তার মৌলিক অর্থে রাখাই কাম্য।

উক্ত বর্ণনার আলোকে, এতেকাফে আগ্রহী ব্যক্তি বিশ তারিখ দিবসের সূর্যাস্তের পর এতেকাফের স্থানে প্রবেশ করবে এবং ত্রিশ পূর্ণ হওয়া কিংবা দুজন সাক্ষীর সাক্ষ্যের মাধ্যমে মাস শেষ হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর উক্ত এতেকাফগাহ হতে প্রস্থান করবে। এখানেই এতেকাফের কালের সমাপ্তি। এতেকাফের কাল রমজানেই সীমাবদ্ধ, অন্য কোন মাসে নয়।

তবে, সালফে সালিহীনের কেউ কেউ ঈদের জামাতে বের হওয়া অবধি মসজিদে অবস্থান করেছেন।[১১৫]

এতেকাফরত অবস্থাতেও রাসূল পাক-পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার প্রতি গুরুত্বারোপ করতেন, যেমন বর্ণিত হয়েছে উরওয়ার হাদিসে। তিনি বলেন : আয়েশা রা. আমাকে বলেছেন্তহায়েজা অবস্থায় তিনি রাসূলের কেশবিন্যাস করে দিতেন। রাসূল তখন মসজিদে অবস্থান করতেন, গৃহে অবস্থানরতা আয়েশার নিকট তিনি মস্তক এগিয়ে দিতেন, এবং তিনি হায়েজা অবস্থাতেই তার কেশ বিন্যাস করে দিতেন।[১১৬]

ইবনে হাজার বলেন : হাদিসটি প্রমাণ করে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সুগন্ধি ব্যবহার, গোসল, ক্ষৌরকর্ম, কেশ বিন্যাস বৈধ। অধিকাংশ আলেমের মত এই যে, এতেকাফকালীন কেবল সেসব বিষয় মাকরূহ, যা মাকরূহ সচরাচর মসজিদে।[১১৭]

এতেকাফকালীন রাসূল কোন অসুস্থ ব্যক্তির দর্শনে যেতেন না, অংশ নিতেন না কোন জানাজায়, বর্জন করতেন স্ত্রী সংস্পর্শ বা সহবাস। আয়েশা রা. বলেন : এতেকাফকারীর সুন্নত হচ্ছে অসুস্থের দর্শনে গমন না করা, জানাজায় অংশ না নেয়া, নারী সংসর্গ ও সহবাস বর্জন করা এবং অত্যবশ্যকীয় কোন প্রয়োজন ব্যতীত এতেকাফ হতে বের না হওয়া।[১১৮]

এতেকাফরত অবস্থায় রাসূলের স্ত্রী-গণ তার সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং কথোপকথন করতেন তার সাথে। সাফিয়া রা. বলেন : রাসূল এতেকাফরত অবস্থায় আমি তার সাথে সাক্ষাতের জন্য এলাম, তার সাথে আলাপ করে অত:পর চলে এলাম...।[১১৯] অপর রেওয়ায়েতে আছ্তেএকদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে অবস্থানকালীন তার স্ত্রী-গণ তার পাশে ছিলেন, তারা ছিলেন আনন্দিত....।[১২০]

হাদিসগুলো প্রমাণ করে, এতেকাফরত অবস্থাতেও রাসূল স্ত্রী-গণের সংবাদ নিয়েছেন। এতেকাফের ফলে যে মূর্খরা তাদের পরিবার-পরিজনের কথা ভুলে যায়, তারা এ থেকে শিক্ষা নিতে পারে। আমার বোধগম্য নয় যে, আল্লাহ তাআলার স্পষ্ট বর্ণনা সত্ত্বেও তারা কীভাবে এ আচরণ করতে দু:সাহস দেখায়। আল্লাহ বলেন :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ لاَ تَخُونُواْ اللّهَ وَالرَّسُولَ وَتَخُونُواْ أَمَانَاتِكُمْ وَأَنتُمْ تَعْلَمُونَ. [الأنفال: ২৭]
হে মোমিনগণ ! জেনে শুনে আল্লাহ ও তার রাসূলের বিশ্বাস ভঙ্গ করবে না, তোমাদের পরস্পরের আমানতের খেয়ানতও করবে না।[১২১]

্তএবং হাদিসে এসেছ্তেরাসূল বলেছেন :
كفى بالمرء إثماً أن يضيع من يقوت.
মানুষের জন্য পাপ হিসেবে এতটুকুই যথেষ্ট যে, যার ভোরণ-পোষণ তার দায়িত্ব তাকে বিনষ্ট করে দেয়।[১২২]

পরিবারের সাথে এ জাতীয় আচরণ, সন্দেহ নেই, হারাম। এর পাপ এতেকাফের সওয়াব অপেক্ষা বড়। কারণ, এর ফলে ওয়াজিবকে পরিত্যাগ করে মোস্তাহাবের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়। উমরা, এতেকাফ ও এ জাতীয় অন্যান্য আমলের ক্ষেত্রে একই হুকুম।

ওয়াজিব ছুঁড়ে ফেলে মোস্তাহাব আমল নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকার ফলে যখন এমন সিদ্ধান্ত প্রদান করা হয়েছে, তখন সহজে অনুমেয় যে, পার্থিব ক্ষুদ্র উপার্জনের সন্ধানে যে ভুলে যায় পরিবার-পরিজনের কথা, আল্লাহ তাকে কী পরিমাণ শাস্তি দিবেন, পরকালে তার কী পরিণতি হবে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যবশ্যকীয় কোন কারণ ব্যতীত এতেকাফগাহ হতে বের হতেন না। আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূল এতেকাফরত অবস্থায় কোন কারণ ব্যতীত গৃহে প্রবেশ করতেন না।[১২৩] সাফিয়া রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতেকাফরত অবস্থায় এক রাতে আমি তার সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে গমন করলাম। আমি তার সাথে আলোচনা সেরে উঠে চলে এলাম। আমাকে পৌঁছে দেয়ার জন্য তিনি এলেন। সাফিয়ার আবাস ছিল উসামা বিন যায়েদের বাড়িতে।[১২৪]

প্রবল কোন কারণ বশত: কখনো কখনো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার পবিত্র দেহের কিছু অংশ এতেকাফগাহ হতে বের করতেন। আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : এতেকাফরত অবস্থায় রাসূল মসজিদ হতে তার মস্তক বের করতেন, আর আমি হায়েজা অবস্থাতেই তা ধৌত করে দিতাম।[১২৫]

রাসূল একবার তার স্ত্রী-গণকে উত্তম পথ প্রদর্শন, মনোরঞ্জন ও আনন্দ প্রদানের জন্য রমজানের এতেকাফ ত্যাগ করেছেন্ততবে, একই বছরের শাওয়াল মাসের প্রথম দশ দিনে উক্ত এতেকাফের কাজা আদায় করে নিয়েছেন।

উম্মুল মোমিনীন আয়েশা রা. বর্ণনা করেন : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এতেকাফে মনস্থ হলেন, ফজরের সালাত আদায় করে এতেকাফগাহে প্রবেশ করলেন। রাসূল তাঁবু টানানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন, কারণ, তিনি রমজানের শেষ দশ দিন এতেকাফ করার মনস্থ করেছিলেন। জয়নবকেও নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, সেটিও টানানো হয়েছিল, তিনি ছাড়া অন্যান্যদেরকেও নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, ফলে তাদেরগুলো টানানো হয়েছিল। ফজরের সালাত শেষে রাসূল অনেকগুলো তাঁবু দেখতে পেলেন। তিনি বললেন : তোমরা কি এর মাধ্যমে পুণ্য অর্জনের ইচ্ছা করছ ? রাসূল অত:পর নির্দেশ দিলে তার তাঁবু গুটিয়ে নেয়া হল, এবং তিনি রমজানে এতেকাফ পরিত্যাগ করলেন এবং শাওয়ালের প্রথম দশদিন এতেকাফের কাজা আদায় করলেন।[১২৬]

রাসূল, এভাবে, দুটি ভাল কাজ একই সাথে সমাধা করেছেন্তএক দিকে এতেকাফ পালন করেছেন, অপরদিকে স্ত্রী-গণের মানসিকতার প্রতি সহানুভূতিপ্রবণ দৃষ্টি রেখেছেন, তাদের শিক্ষা দিয়েছেন যে, অযাচিত কোন কারণ বশত: এবাদত বন্দেগির মাঝে বিঘ্ন সৃষ্টি সর্বার্থে অনুচিত।[১২৭]

কোন কারণ বশত যদি এতেকাফ ছুটে যেত, তবে রাসূল পরবর্তীতে তা কাজা করে নিতেন্তপূর্বের হাদিসে যেমন উল্লেখ হয়েছে যে, স্ত্রী-গণের হকের প্রতি লক্ষ্য রেখে তিনি এতেকাফ বর্জন করেছিলেন, পরবর্তীতে, শাওয়ালের প্রথম দশ দিনে তা কাজা করে নিয়েছেন। একবার সফরে থাকার কারণে এতেকাফ পালন সম্ভব না হলে রাসূল পরবর্তী বছরে বিশ দিন এতেকাফ করে তা কাজা করে নিয়েছিলেন। আনাস বিন মালেক হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষ দশদিনে এতেকাফ পালন করতেন। এক বছর তিনি এতেকাফ পালনে সক্ষম হলেন না, তাই, পরবর্তী বছরে তিনি বিশ দিন এতেকাফ করে নিয়েছিলেন।[১২৮]

উবাই বিন কাব হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূল রমজানের শেষ দশ দিনে এতেকাফ পালন করতেন, একবার সফর জনিত কারণে তিনি এতেকাফ করলেন না, পরবর্তী বছরে, তাই, দশ দিন এতেকাফ করে নিলেন।[১২৯]

এতেকাফের কারণে রাসূল সফর বাদ দেননি, সফর সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রয়োজন ও কল্যাণ হতেও পিছপা হননি, এবং ভুলে যাননি এতেকাফের কথা, পরবর্তী বছরে তাই, তাৎক্ষণিক এতেকাফ সহ কাজা এতেকাফও আদায় করে নিয়েছিলেন। বর্তমান আলেম সমাজ, সংস্কারক ও দায়িদের আমরা দেখতে পাই যে, সাময়িক যৌক্তিক কোন কারণ বশত: হয়তো তারা নির্দিষ্ট কোন এবাদত মওকুফ করতে বাধ্য হন, অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কর্মের সাথে সমন্বয় সাধন করে তা পালন করতে পারেন না বিধায় তাকে ত্যাগ করেন। কিন্তু, রাসূলের প্রদর্শিত হেদায়েত অনুসারে পরবর্তীতে তা পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন না।

এতেকাফ পরিত্যাগের প্রবণতা বর্তমানে খুবই ব্যাপক হারে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইমাম যুহরি বলেন : অবাক ব্যাপার ! মুসলমানগণ এতেকাফ পরিত্যাগ করছে হর-হামেশা, অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় আগমন পরবর্তীতে মৃত্যু অবধি এতেকাফ পরিত্যাগ করেননি।[১৩০]

উম্মতের মহান দায়িত্ব সত্ত্বেও, রাসূলের এতেকাফ, মসজিদে স্থাপিত তাঁবুতে একাকিত্ব যাপন, মাওলার এবাদত ও জিকিরে আত্মা ও মনন সমর্পণ ইঙ্গিত র্কতেযে কোন কালের দায়ি, সংস্কারক ও আলেম মাত্ররই কর্তব্য ও দায়িত্ব নিজের জন্য একাকী-নির্বিঘ্ন কিছু সময় নির্ধারণ করা, যাতে আত্মিক অনুসন্ধান ও নফ্‌সের মোহাসাবায় নিরত হবে।

এ ব্যাপারে উদাসীনতা, গাফিলতি ও ভ্রূক্ষেপ-হীনতা নফ্‌সের ক্লেদাক্ততা ও অসুস্থতা কেবল বৃদ্ধিই করে ; এক সময় বাসা বাধে মানুষের অনুভূতি ও চিন্তার গোপনতম এলাকায়, কুড়ে কুড়ে নষ্ট করে দেয় ঈমান ও বিশ্বাসের বিনির্মাণগুলো। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন। আল্লাহ পাকের সাহায্য-সহযোগিতা প্রার্থনা পরিত্যাগ লাঞ্ছনা ও ধ্বংসের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়, বান্দা সহজে হারিয়ে ফেলে নিজেকে পাপের অতল নিমজ্জনে। আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা, আকুতি জানান, ও নিজেকে তার দরবারে বিলীন করবার উত্তম পন্থা হল : আত্মার পরিমার্জন ও উন্নতিকল্পে একাকিত্ব যাপন্ততার অপূর্ণতাগুলো ঢেকে দেয়া, হিম্মত ও প্রতিজ্ঞার সঞ্চার, আল্লাহ ও আখেরাতের পথে নিজেকে মহীয়ান করে গড়ে তোল্তাসন্দেহ নেই, এ উদ্দেশ্য রূপায়ণে এতেকাফই হচ্ছে বান্দার জন্য সর্বোত্তম উপায়।

আধুনিকতা ও সংস্কৃতির ছায়ায় গড়ে উঠছে আমাদের যে নতুন প্রজন্ম, তাদের প্রতি ন্যুনতম লক্ষ করলেই দেখতে পাবেন্তমহত্ত্ব ও কল্যাণের সর্ব-ব্যাপকতা সত্ত্বেও, তারা এ সুন্নতকে পরিত্যাগ করছেন অনায়াসে, তাই, আত্মার পরিমার্জন ও পরিচ্ছন্নতা অর্জন তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না কোনভাবে। যদিও কোন কোন শ্রেণির মাঝে এই সুন্নত বিস্তার লাভ করছে ধীরে ধীরে, কিন্তু এখনও তাদের ও তাদের কর্মের মাঝে রাসূলের প্রদর্শিত হেদায়েত বিরোধী কর্মকাণ্ডের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, কিংবা এতেকাফের উদ্দেশ্য ও আদব ক্ষুণ্ন হয় নানাভাবে। নিম্নে তার কিছু উল্লেখ করা হল :্ত

এতেকাফের মৌলিক উদ্দেশ্য বিরোধী ও একাগ্রতা বিনষ্টকারী যে বিষয়টি সর্বপ্রথম লক্ষণীয়, তাহল, মোবাইল ব্যবহার। আল্লাহর তরে অন্তরের নিবিষ্টতা, পার্থিব যাবতীয় সম্পর্ক ও যোগাযোগ হতে কিছু সময়ের জন্য বিচ্ছিন্নতা, জিকির ও ধ্যানে অবগাহন্তইত্যাদি চূড়ান্তভাবে লঙ্ঘিত হয় মোবাইল ব্যবহারের ফলে।[১৩১]

তবে, মুসলমানদের জন্য অতি প্রয়োজনীয় কোন কর্মে শর্তহীনভাবে কি মোবাইল ব্যবহার নিষিদ্ধ ? এ ব্যাপারে দ্বিমত রয়েছে। মূলত: যদি এতেকাফের শরয়ি উদ্দেশ্য ও বাস্তবতা ক্ষুণ্ন না হয়, লঙ্ঘিত না হয় তার মৌলিক উদ্দেশ্য, তবে শর্তহীনভাবে মোবাইল ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হবে না। এ বিষয়ে আল্লামা ইবনে উসাইমিন বলেন : এতেকাফরত অবস্থায় মোবাইল যদি মসজিদে থাকে, তবে মুসলমানদের ধর্মীয় প্রয়োজনে মোবাইল ব্যবহার বৈধ। কারণ, এর ফলে তাকে মসজিদ থেকে বের হতে হচ্ছে না। তবে, যদি মসজিদের বাইরে হয়, তাহলে ব্যবহার করবে না। কেউ যদি মুসলমানদের প্রয়োজনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে, তবে সে এতেকাফ পালন করবে না। কারণ, মুসলমানদের প্রয়োজন পূরণ করা এতেকাফের তুলনায় গুরুত্বপূর্ণ। মুসলমানদের কল্যাণ সর্বব্যাপী ও প্রবৃদ্ধিশীল, এতেকাফের পরিসর সংক্ষিপ্ত। তবে সংক্ষিপ্ত ও প্রবৃদ্ধি-বিলগ্ন বিষয়ও যদি হয় ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব হুকুম, তবে তা পালন করাই হবে আবশ্যকীয়।[১৩২]

কেউ কেউ পিতা-মাতার আদেশ উপেক্ষা করে এতেকাফ পালন করে। এতেকাফ সুন্নত, পিতা-মাতার আদেশ মান্য করা ওয়াজিব। সুন্নতের তুলনায় ওয়াজিব পালন অগ্রগাম্তীসন্দেহ নেই। আল্লাহ তাআলা হাদিসে কুদসিতে এরশাদ করেন :
وما تقرب إليَّ بشيء أحب إليَّ مما افترضته عليه.
আমার আরোপিত ফরজই বান্দাকে আমার নিকটবর্তীকারী আমলের মাঝে সর্বাধিক প্রিয়।[১৩৩]

সুতরাং, ফরজ পালনই বান্দার জন্য অধিক যুক্তিযুক্ত ও অগ্রগণ্য। আল্লামা ইবনে উসাইমিন এ বিষয়ে যে বিস্তারিত বর্ণনা প্রদান করেছেন, এখানে তার উল্লেখ খুবই সময়োচিত বলে আমি মনে করি। তিনি বলেন :

তোমার পিতা যদি তোমাকে এতেকাফে বাধা প্রদান করে এবং এতেকাফ ত্যাগ করার মত যৌক্তিক কারণ উল্লেখ করে, তবে তুমি এতেকাফ পালন কর না। কারণ, হয়তো এ ব্যাপারে তিনি তোমার মুখাপেক্ষী। এতেকাফ ত্যাগ করার মত প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের মানদণ্ডও তার কাছে, তোমার কাছে নয়। তুমি যে মানদণ্ড মান্য কর, এতেকাফের প্রতি আসক্ত হওয়ার ফলে হয়তো তা সঠিক ও ন্যায্য নয়। তবে, পিতা যদি প্রয়োজনীয় বিষয়টির উল্লেখ করে কল্যাণের ব্যাখ্যা না করেন, তবে, এক্ষেত্রে তার আদেশ কায়মনোবাক্যে মান্য করা তোমার জন্য আবশ্যক নয়। কারণ, এমন বিষয়ে তাকে তোমার মান্য করার প্রয়োজন নেই, যা কল্যাণ শূন্য।[১৩৪]

কেউ কেউ অসময়ে নিদ্রা, অনর্থক আলাপ-আলোচনা ও গল্প-গুজবে সময় নষ্ট করে, যা কোনভাবেই কাম্য নয়। এগুলো এড়িয়ে যাওয়া এতেকাফকারীর জন্য অবশ্য কর্তব্য।

হাদিসে দিবস ও রাতের যে সকল সময়-নির্দিষ্ট অনির্দিষ্ট সুন্নত উল্লেখ করা হয়েছ্তেযেমন : ফরজ সালাতের পূর্বে ও পরে পালিত সুন্নত, দ্বিপ্রহরের সুন্নত, ওজুর সুন্নত, জিকির-আজকার ও কোরআন পাঠ, এতেকাফকারীদের সাথে দ্বীনি আলোচনায় অংশগ্রহণ, সালাতে প্রথম কাতারের সংরক্ষণ, সালাত শেষে নির্দিষ্ট জিকির পাঠ্তইত্যাদির ক্ষেত্রে কেউ কেউ অনীহ আচরণ করে থাকে। এ এবাদত ও জিকির-আজকারের মাধ্যমে এতেকাফকারীর সময়গুলো হিরণ্ময় হয়ে উঠে, বিশুদ্ধ হয় তার আত্মা, পূরণ হয় এতেকাফের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।

নিজ এলাকা ও দেশের বাইরে সফররত অবস্থায় যারা এতেকাফ পালন করেন,্তযেমন হারামাইন্তসফরের কারণ প্রদর্শন করে নফল সালাত ত্যাগ করেন, এ কোনভাবেই ঠিক নয়। কারণ, সফরে থাকা সত্ত্বেও রাসূল নফল সালাত হতে বিরত থাকতেন না। রাসূল বরং, জোহর, মাগরিব ও এশার সুন্নত ত্যাগ করতেন, অন্যান্য নফল এবাদতগুলো যথাযথভাবেই পালন করতেন।[১৩৫]

রমজানে রাসূল সা.-এর শেষ দশ দিন যাপন

রমজানের শেষ দশ দিনে, এতেকাফকালীন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন এবাদত-বন্দেগিতে কাটাতেন, পরিশ্রম করতেন কঠোরভাবে।

হাদিসে এসেছে, উম্মুল মোমিনীন আয়েশা রা. বলেন : 
রমজানে লোকেরা মসজিদে সালাত আদায় করত...(উক্ত হাদিসের একাংশে আছে, রাসূল সকলকে সম্বোধন করে এরশাদ করেন-) হে লোক সকল ! আল-হামদুলিল্লাহ ! আজ রাত আমি গাফলতিতে যাপন করিনি। এবং তোমাদের অবস্থানও আমার অবিদিত নয়।[১৩৬]

ভিন্ন এক হাদিসে আয়েশা বলেন : 
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য সময়ের তুলনায় রমজানের শেষ দশ দিনে অধিক-হারে পরিশ্রম করতেন।[১৩৭]

অপর বর্ণনায় তিনি বলেন : 
শেষ দশ দিনে প্রবেশ করে রাসূল রাত্রি জাগরণ করতেন, পরিবারের সকলকে জাগিয়ে দিতেন এবং পূর্ণভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন, পরিশ্রম করতেন।[১৩৮]

'শেষ দশ দিনে প্রবেশ করে তিনি রাত্রি জাগরণ করতেন'- হাদিসের এ অংশ দ্বারা প্রমাণ হয়, প্রথম বিশ দিন রাসূল পূর্ণ রাত্রি জাগরণ করতেন না, বরং, কিছু সময় এবাদত করতেন, ঘুমিয়ে কাটাতেন কিছু সময়। শেষ দশ দিনে তিনি, এমনকি, বিছানাতেও গমন করতেন না। রাতের পুরোটাই এবাদতে ব্যয় করতেন।[১৩৯]

হাদিসগুলো প্রমাণ করে : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দশ দিন এবাদতে হতেন কঠোর পরিশ্রমী, আল্লাহর দরবারে নিজেকে পেশ করতেন নতজানু ও বিনয়াবনত রূপে। সালাত, সিয়াম, সদকা, কোরআন পাঠ, জিকির, দোয়া, তাওয়াক্কুল, আশা ও ভীতি, মোহাসাবা, তওবা, অন্তরের একাগ্র উপস্থিতি- ইত্যাদি এবাদতের মৌলিক বিষয়গুলো তিনি পূর্ণভাবে রূপায়ণ ও সম্মিলন করতেন এ কয় দিনে।

রাসূলের সেই হেদায়েত অনুসারে আমাদের অবস্থা বিচার করলে সহজে আমাদের অবস্থা ও চিত্র ফুটে উঠে- যা খুবই হতাশাকর, দুর্গতি আক্রান্ত ও অশুভ পরিণতিময়।

লাইলাতুল কদরের অনুসন্ধান ও তাতে রাত্রি-জাগরণ

লাইলাতুল কদর আল্লাহ তাআলা বান্দাদের কাছ থেকে গোপন রেখেছেন, যাতে তার অনুসন্ধিৎসু ও গাফেলদের মাঝে সরল পার্থক্য করা যায়। রাসূল কদরের রাত্রির অনুসন্ধানে রাত্রি-জাগরণ করতেন, ব্যস্ত সময় যাপন করতেন। আবু সাইদ খুদরি হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন :
إني اعتكفت العشر الأول ألتمس هذه الليلة، ثم اعتكفت العشر الأوسط، ثم أُتيت فقيل لي: إنها في العشر الأواخر؛ فمن أحب منكم أن يعتكف فليعتكف؛ فاعتكف الناس معه.
এ রাতের অনুসন্ধানে প্রথম দশ দিন আমি এতেকাফে যাপন করলাম, পরবর্তীতে যাপন করলাম মধ্যবর্তী দশ দিন। অত:পর ওহির মাধ্যমে আমাকে অবগত করানো হল যে, সে রাত আছে শেষ দশ দিনে। সুতরাং, তোমাদের যে এতেকাফে আগ্রহী সে যেন এতেকাফ করে। তাই, লোকেরা তার সাথে এতেকাফ পালন করল।[১৪০]

রমজান বিষয়ক রাসূলের আদর্শ, হেদায়েত, ও যাপন পদ্ধতি গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে এ বিষয়টি ফুলে উঠে যে, রাসূল অত্যন্ত আগ্রহ, প্রেরণার মাধ্যমে কদরের রাত অনুসন্ধান করতেন, জাগরণ করতেন পূর্ণ রাত্রি। অন্য যে কোন রাতের তুলনায় অধিক ফজিলতময় হওয়ার ফলেই কেবল রাসূল তাকে এতটা গুরুত্ব প্রদান করেছেন। কদর হচ্ছে শান্তি ও বরকতের রাত, মর্ত্যলোকে নেমে আসে এ রাতে আকাশের ফেরেশতাগণ, তা হাজার রাতের তুলনায় উত্তম ও সৌভাগ্য-মণ্ডিত। ইমান ও ইহতিসাব সহকারে যে এ রাত যাপন করবে, তার পূর্ব জীবনের সকল গোনাহ আল্লাহ ক্ষমা করে দিবেন।

এ মোবারক রাত্রিতে এবাদতকারীদের জন্য বিশেষভাবে যা কর্তব্য ও পালনীয়, তাহল, মাগরিব ও এশার সালাত জামাতের সাথে মসজিদে আদায় করা। কারণ, মোস্তাহাব আমলের জন্য ওয়াজিব আমল পরিত্যাগ বৈধ নয় ; ফরজ আমলের তুলনায় ভিন্ন কোন এবাদত বান্দাকে এতটা নিকটবর্তী করতে পারে না। 
ইমাম যাহ্‌হাক বলেন : রমজানে যে ব্যক্তি মাগরিব ও এশার সালাত নিয়মিত আদায় করে যাবে, সে অবশ্য লাইলাতুল কদরের সওয়াবের অংশীদার হবে।[১৪১] বান্দার জন্য আল্লাহর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান দান হচ্ছে দ্বীন বিষয়ে স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি, আপন ইচ্ছা ও খেয়ালে নয়, আল্লাহর ইচ্ছা অনুসারে তার নৈকট্য অর্জন ও রাসূলের অনুসরণ।

লাইলাতুল কদরের অনুসন্ধান-এবাদতের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়ে একই শ্রেণিভুক্ত। কারণ, রাসূল এ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে তার পরিবার-পরিজনকে সাথে নিয়েছেন। উমর রা. হতে প্রমাণিত : 
রাত্রি যাপনের জন্য যখন সকলে মিলিত হল, তিনি পুরুষদের দায়িত্ব দিলেন উবাই বিন কাব-কে, সুলাইমান বিন আবি হাসামাকে দিলেন নারীদের দায়িত্ব।[১৪২] 
আফজা হতে বর্ণিত, 
আলী রা. সকলকে রমজানে রাত্রি জাগরণের আদেশ দিতেন। পুরুষ ও নারীদের জন্য তিনি পৃথক-পৃথক ইমাম নির্ধারণ করতেন। তিনি বলেন : আমাকে আদেশ করলে আমি মেয়েদের ইমামতি করলাম।[১৪৩]

সুতরাং, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের কর্তব্য কদরের রাত্রি অনুসন্ধান করা এবং রাত জেগে এবাদত-বন্দেগি করা। লাইলাতুল কদর- সন্দেহ নেই, বান্দাদের জন্য আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে এক বড় নেয়ামত, যাতে এবাদত হাজার গুণে বৃদ্ধি পায়, রহমত বর্ষিত হয় সকলের উপর। আল্লাহ আমাদের সকলকে এ রাতের যথোপযুক্ত সম্মান দানের মাধ্যমে কল্যাণ ও সৌভাগ্য হাসিলের তৌফিক দান করুন। আমিন।

জিবরাইল আ:-এর সাথে রাসূলের কোরআন অনুশীলন

কোরআনের প্রতি গুরুত্বারোপ আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের কুঞ্জিকা। অপরের সাথে কোরআন বিষয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা কোরআনের গভীর জ্ঞান, মর্ম উপলব্ধির সহজ মাধ্যম। পারস্পরিক কোরআন বিষয়ক আলোচনা সততা ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে একে অপরকে সহযোগিতা সদৃশ। রমজানে কোরআন শিক্ষায় রাসূলের সহপাঠী হওয়ার জন্য জিবরাইল আ: আল্লাহ কর্তৃক নিয়োজিত ছিলেন। এ বিষয়ে হাদিসে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়্ত

ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, জিবরাইল আ: রমজানের প্রতি রাতে রাসূলের সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং ফজর অবধি তার সাথে অবস্থান করতেন। রাসূল তাকে কোরআন শোনাতেন।[১৪৪] আরো এসেছে, রাসূল তার প্রিয়তমা কন্যা ফাতেমাকে গোপনে জানালেন যে, জিবরাইল প্রতি বছর আমাকে একবার কোরআন শোনাতেন এবং শুনতেন, এ বছর তিনি দু বার আমাকে শুনিয়েছেন-শুনেছেন। একে আমি আমার সময় সমাগত হওয়ার ইঙ্গিত বলে মনে করি।[১৪৫]

ইবনে হাজার বলেন : জিবরাইল প্রতি বছর রাসূলের সাথে সাক্ষাৎ করে এক রমজান হতে অন্য রমজান অবধি যা নাজিল হয়েছে, তা শোনাতেন এবং শুনতেন। যে বছর রাসূলের অন্তর্ধান হয়, সে বছর তিনি দু বার শোনান ও শোনেন।[১৪৬]

হাদিসগুলো একে অপরের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের নিদর্শন। রমজানে উত্তম সাহচর্য নির্ধারণ এ কারণেই আবশ্যক ; উত্তম সাহচর্যের ফলে সময়ের সর্বোত্তম সুফল লাভ হব্তেসন্দেহ নেই। কুসংসর্গের ফলে এ বরকতময় মাসেও অনেকের সময় পাপের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে, এমন দৃষ্টান্ত আমাদের নিকট বিরল নয়। এক্ষেত্রে, সুতরাং, বান্দার জন্য অধিক তাকওয়া অবলম্বন জরুরি। মানুষ যাকে বন্ধু ও আপনজন হিসেবে গ্রহণ করে, অভ্যাস-আচরণ ও ধর্মাচারে প্রবলভাবে তার দ্বারা প্রভাবিত হয়, এ কারণে বন্ধু নির্বাচনে অত্যন্ত সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।

কোরআন শিক্ষা, দিবসের তুলনায় রাতে কোরআন তেলাওয়াতের অধিক ফজিলত[১৪৭], রমজানে কোরআন তেলাওয়াত বেশি পুণ্যময় ও কল্যাণকর হওয়া, উত্তম সাহচর্যের ফলে আত্মিক উত্তম ফলশ্রুতি লাভ্তইত্যাদি বিষয়ে উক্ত হাদিস একটি প্রামাণ্য দলিল।

ইবনে হাজার বলেন : তেলাওয়াত দ্বারা উদ্দেশ্য আত্মিক উপস্থিতি ও উপলব্ধি।[১৪৮]

ইবনে বাত্তাল বলেন : রাসূলের এ কোরআন শিক্ষা ও অনুশীলনের একমাত্র কারণ ছিল পরকালের আকাঙ্ক্ষা ও ব্যাকুল ভাবনার জাগরণ এবং পার্থিব বিষয়ে অনীহার সৃষ্টি করা।[১৪৯]

অত্যন্ত আনন্দ ও সুখের বিষয়, বর্তমান সময়ে রমজানে একবার বা দু বার কোরআন খতমের ব্যাপক আগ্রহ মানুষের মাঝে দেখা যায়। সন্দেহ নেই, এ হবে মানুষের জন্য ব্যাপক কল্যাণবাহী। তবে, তারাবীহে যে তেলাওয়াত করা হয়, তেলাওয়াত ও সুর মাধুর্যের নানা কৌশলের প্রতি লক্ষ্য রাখার ফলে মর্ম উপলব্ধি ও গভীর চিন্তার প্রয়োগ হয় না। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন,
كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِّيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُوْلُوا الْأَلْبَابِ [ص: ২৯].
এ এমন এক কিতাব্তবরকতময়্তযা আপনার নিকট অবতীর্ণ করেছি, যাতে তারা এর আয়াতগুলোয় গভীর চিন্তা করে এবং জ্ঞানীগণ উপদেশ গ্রহণ করে।[১৫০]

সন্দেহ নেই, এ সম্মানিত সময়ের সবটুকু কল্যাণ নিংড়ে নেয়া সকলের কর্তব্য। সালফে সালিহীন হতে প্রমাণিত, এ সময়ে তারা সালাত ও অন্যান্য উপলক্ষে দীর্ঘক্ষণ কোরআন তেলাওয়াত করতেন্তএমনকি, ইমাম যুহরি বলেন : রমজান হচ্ছে কোরআন তেলাওয়াত ও আহার বিতরণের মাস ;[১৫১] রমজান মাস আরম্ভ হলে ইমাম মালেক হাদিস অধ্যয়ন ও আহলে ইলমের সাথে ইলমি আলোচনা ও সভা-সমাবেশ পরিত্যাগ করে কোরআন তেলাওয়াতে নিমগ্ন হতেন।[১৫২]

তাদের অধিকাংশই, বরং, স্বল্প সময় ব্যয়ে কোরআন খতম করতেন্তদশ, সাত বা কেউ কেউ মাত্র তিন দিনে।[১৫৩] উম্মতের মহান ইমামদের যারা বছরের পুরোটা সময় সতত নিরত থাকতেন কোরআনের আয়াতগুলো বুঝা ও মর্ম উপলব্ধিতে, তাদের প্রতি লক্ষ্য করে বলা যায়, এটি খুবই সম্ভব ; কিন্তু যারা কেবল রমজান মাসেই কোরআন তেলাওয়াতের কথা স্মরণ করে, তাদের পক্ষে এ কখনোই সম্ভব হতে পারে না। রাসূল এক হাদিসে বলেছেন,
لا يفقه من قرأ القرآن في أقل من ثلاث.
তিন দিনের কমে (পূর্ণ) কোরআন কেউ পাঠ করলে তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে না।[১৫৪]

কোরআনের উদ্ধৃতিগুলোর সত্যায়ন ও আহকামের পূর্ণ আনুগত্যের ভিত্তিতেই কোরআন তেলাওয়াত কাম্য। আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ বলেন:
إن القرآن شافع مشفع وماحل مصدق، فمن جعله أمامه قاده إلى الجنة، ومن جعله خلفه ساقه إلى النار.
কোরআন নিশ্চয় সুপারিশকারী, তার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে, সে আল্লাহর কাছে হবে সত্যায়িত-গৃহিত আবেদনকারী, যে কোরআনকে স্থাপন করবে সম্মুখে, কোরআন তাকে জান্নাতের দিশা দেবে, আর যে স্থাপন করবে পশ্চাতে, কোরআন তাকে টেনে নিয়ে যাবে জাহান্নামে।[১৫৫]

কোরআন শিক্ষার ক্ষেত্রে এটিই ছিল রাসূলের সুমহান পদ্ধতি। আবু আব্দুর রহমান সালামি বলেন : কোরআনের মহান পাঠকগণ্তযেমন উসমান বিন আফ্‌ফান, আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ ও অন্যান্যগণ, আমাদের জানিয়েছেন, রাসূলের নিকট হতে তারা দশটি আয়াত লাভ করার পর তার মর্ম-কর্ম বিষয়ে সঠিক জ্ঞান লাভ ব্যতীত এগিয়ে যেতেন না। তারা বলেছেন : আমরা একই সাথে কোরআন, তার ইলম ও আমলের জ্ঞান অর্জন করেছি। আল্লামা সুয়ূতী বলেন : এ কারণেই তারা একটি সূরা মুখস্থ করার জন্য সময় নিতেন।[১৫৬]

কোরআন তেলাওয়াতকারীর, সুতরাং, কর্তব্য হল : তার কর্ম ও কথনে সঠিক ও সৎ পথের অনুসারী হওয়া। ইবনে মাসঊদ রা. বলেন:
ينبغي لحامل القرآن أن يُعرف بليله إذ الناس نائمون، و بنهاره إذ الناس يفطرون، وبحزنه إذ الناس يفرحون، و ببكائه إذ الناس يختالون.
কোরআনের বাহকের উচিত রাতে কোরআনে মগ্ন হওয়্তাযখন মানুষ নিদ্রায় মগ্ন হয় ; এবং দিন্তেযখন মানুষ পানাহারে লিপ্ত হয়, এবং দু:খ্তেযখন মানুষ আনন্দে উদ্বেল হয় ; এবং কান্নার সময়্তযখন মানুষ অহংকারে স্ফীত হয়।[১৫৭]

আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. বলেন : কোরআন বিষয়ে সমালোচক ও মূর্খদের সংসর্গ যাপন কোরআনের বাহকের জন্য উচিত নয়। বরং, সে হবে ক্ষমাশীল, ঔদার্যময়।[১৫৮]

হাসান বলেন :
إنكم اتخذتم قراءة القرآن مراحل، وجعلتم الليل جَمَلا فأنتم تركبونه فتقطعون به مراحله، وإن من كان قبلكم رأوه رسائل من ربهم، فكانوا يتدبرونها بالليل وينفذونها بالنهار.
তোমরা কোরআন শিক্ষাকে বিভিন্ন পর্বে ভাগ করে নিয়েছ। রাতে তোমরা কোরআন শিক্ষায় অতিবাহিত কর। আর তোমাদের পূর্বসূরীগণ কোরআনকে মনে করতেন প্রতিপালকের পক্ষ হতে প্রেরিত বার্তা স্বরূপ। রাতে তারা এর শিক্ষায় মগ্ন হতেন, দিনে প্রয়োগ করতেন।[১৫৯]

যাদেরকে আল্লাহ কোরআন শিক্ষায় ভূষিত করেছেন, দান করেছেন এ মহান নেয়ামত, তারাই যখন ছিলেন এমন ব্যাকুল ও কোরআন শিক্ষার অতিশয় আগ্রহে মগ্ন, সুতরাং, আমরা কেন, কি কারণে পিছিয়ে যাব ? কোরআনে উক্ত মহান ব্যক্তিদের উল্লেখ করে এরশাদ করা হয়েছে,
إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآَنَهُ فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآَنَهُ.
এটা সংরক্ষণ ও পাঠ করার দায়িত্ব আমার। যখন আমি তা পাঠ করি, তখন তুমি সে পাঠের অনুসরণ কর। অত:পর তা ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব আমারই।[১৬০] 
কোরআনের এ আয়াত ও বর্ণনাগুলো নিশ্চয় আমাদের নতুন উদ্যমে কোরআন পাঠে আত্মনিয়োগ করার পথে আগ্রহী করে তুলবে ! কোরআনের মর্ম ও উপলব্ধি, জ্ঞান ও হেদায়েত আমাদের আত্মাকে করবে আরো প্রসারিত-প্রশস্ত, পার্থিব ব্যাপারে আরো বেশি সতর্ক ও কল্যাণকামী।

কোরআন শিক্ষা ও অধ্যয়নের ক্ষেত্রে সকলের সাথে সহপাঠ, সম্মিলিত অনুশীলন না একাকী তেলাওয়াত উত্তম ?্তএ ব্যাপারে নানা মত থাকলেও, প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি পাঠক ও তেলাওয়াতকারীর মানসিকতা ও ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। সকলের সাথে সমবেত হয়ে সহপাঠ বা অনুশীলন যদি তেলাওয়াতকারীর নিকট উত্তম ও অধিক একাগ্রতা-বিনয় উদ্রেককারী মনে হয়, তবে তাই উত্তম, অন্যথায়, তার মানসিকতা অনুসারে একাকী-নির্জনতা বেছে নিবে, মগ্ন হবে ঐকান্তিক নীরবতায়।[১৬১]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহানুভবতা, সকলের সাথে সমান এহসানপ্রবণ আচরণ, বিনয়, যুহুদ, অপরকে প্রাধান্য প্রদান্তইত্যাদি ক্ষেত্রে কোরআনের সহপাঠ কীভাবে ক্রিয়া করত, আগামীতে আমরা তা আলোচনা করব।

কোরআনের প্রতি সর্বস্ব নিবেদন ও আকুতি দাওয়াত ইলাল্লাহর জন্য খুবই সহায়ক, আনুগত্য ও এবাদতে বিপুলতা আনয়নকারী এবং সৎকাজের উদগাতা। এ ক্ষেত্রে অধিক অগ্রগামী ব্যক্তি এ সকল সৎকর্মের মাধ্যমে নিজেকে ভূষিত করতে সক্ষম হবে সন্দেহ নেই।

বর্তমান মুসলিম সমাজের দূরাবস্থার সচেতন যে কোন সমাজ-পাঠকই স্বীকার করতে বাধ্য হবেন : উম্মতের অধিকাংশ দূরবস্থার সূচনা কোরআনের বর্জনের সূত্র ধরে। কোরআনকে হেলা করেছে বলেই জাতি ও উম্মত হিসেবে মুসলিম উম্মাহ আজ সবার চোখে, যাবতীয় সক্রিয় ক্ষেত্রে হেলার পাত্র। কোরআনের সামাজিক পাঠ দুর্বল হয়ে যাওয়ার ফলে দুর্বল হয়ে পড়ছে ক্রমশ তাদের অস্তিত্বের ভীত, সামাজিক-সাংস্কৃতিক বলয়। কোরআনের পূর্ণ অনুসরণ-অনুবর্তন ব্যতীত এই 'তীহ' হতে আমাদের মুক্তি নেই, অনবরত তাতেই আমাদের ঘুরপাক খেতে হবে দীর্ঘ লাঞ্ছিত-কাল ধরে। কোরআন তেলাওয়াত, গবেষণা, সর্বাত্মক আমল ও কোরআনের শাসন প্রণয়ন্তইত্যাদি হবে আমাদের এ পথ উত্তরণের স্তর ও পর্ব। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুন।

রাসূলের বিনয় ও যুহুদ

যার অন্তর লীন হয়েছে, বিনম্র হয়েছে মহান সত্ত্বার সামনে, সন্ধান পেয়েছে প্রকৃত মাবুদের, অনুভব করেছে আত্মিক দৌর্বল্যের, বিনয়-যুহুদ তার পরিচয় ও নিদর্শন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম্তরবের পরিচয় লাভ ও তার তরে লীন হওয়ার ক্ষেত্রে যিনি ছিলেন সর্বোত্তম আদর্শ্তএমন পরিচয় ও নিদর্শনই ধারণ করেছিলেন নিজের জন্য। শরিয়ত, শরিয়ত প্রদত্তার মহত্ত্ব, তার সাথে সম্পর্কের প্রবৃদ্ধি, পার্থিবে অনাসক্তি ও পরকালে প্রবল আসক্ত্তিইত্যাদির জন্য অন্তরের বিনয় ও নিবেদনের মাধ্যমে এ মারেফাত ও আল্লাহ ভীতির জন্ম নেয়। অভ্যাস ও আচরণের নানা ক্ষেত্রে রাসূল যুহুদ অবলম্বন করতেন, আচরণে অবলম্বন করতেন বিনয়ের সর্বোচ্চ পরাকাষ্ঠা।

রাসূল এক চাটাইতে পূর্ণ রাত্রি কাটিয়ে দিতেন। আয়েশা রা. বর্ণনা করেন :
كان الناس يصلون في المسجد في رمضان أوزاعاً، فأمرني رسول الله صلي الله عليه و سلم فضربتُ له حصيراً فصلى عليه.
রমজানে লোকেরা মসজিদে দলে দলে সালাত আদায় করত ; রাসূল আমাকে নির্দেশ দিলে আমি তার জন্য একটি চাটাই বিছিয়ে দিলাম, তিনি তাতে সালাত আদায় করলেন।[১৬২]

রাসূল রমজানে এতেকাফ পালন করতেন একটি তুর্কি তাঁবু টানিয়ে, যার প্রবেশমুখে ঝুলান থাকত একটি চাটাই। আবু সাইদ খুদরি বর্ণিত হাদিসে এসেছ্তেরাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতেকাফ পালন করলেন একটি তুর্কি তাঁবুতে, যার প্রবেশমুখে ছিল একটি চাটাই। তিনি বলেন : রাসূল স্বহস্তে উক্ত চাটাই ধরে একপাশে সরিয়ে দিলেন, অত:পর মুখ বের করে মানুষের সাথে কথা বললেন।[১৬৩]

শুকনো খেজুর পাতায় নির্মিত তাঁবুতে রাসূল এতেকাফ পালন করতেন। ইবনে উমর রা. বলেন : রাসূল রমজানের শেষ দশ দিন এতেকাফ পালন করলেন, তার জন্য শুকনো খেজুর পাতা দিয়ে গৃহ-সদৃশ বানান হল।[১৬৪] মসজিদের ছাদ দিয়ে তার জায়নামাজে পানি গড়িয়ে পড়ত, তিনি মাটি আর কাদাতেই সেজদা করতেন। আবু সাইদ খুদরি রা. বর্ণিত হাদিসে আছ্তে...সে রাতে আকাশ-ঝেপে বৃষ্টি হল, একুশ তারিখের রাতের ঘটনা, রাসূলের জায়নামাজে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। রাসূলের উপর আমার দৃষ্টি পড়ল। আমি দেখলাম, সকাল হয়ে এসেছে, পানি আর কাদায় তার মুখমণ্ডল মাখামাখি হয়ে আছে।[১৬৫]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুবই সাদামাটাভাবে ইফতার ও সেহরি গ্রহণ করতেন। তার খাদেম আনাস বিন মালেক বর্ণনা করেন : রাসূল সালাত আদায়ের পূর্বে কয়েকটি ভেজা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন, ভেজা খেজুর না হলে শুকনো খেজুর গ্রহণ করতেন। শুকনো খেজুরও না থাকলে কয়েক ঢোক পানি দিয়ে ইফতার করতেন।[১৬৬] অপর এক হাদিসে তিনি বলেন : একদা সেহরিকালে রাসূল আমাকে লক্ষ্য করে বলেন,
يا أنس إني أريد الصيام؛ أطعمني شيئاً!، فأتيته بتمر وإناء فيه ماء، وذلك بعد ما أذن بلال.
হে আনাস আমি রোজা রাখতে আগ্রহী, আমাকে কিছু আহার করাও। আমি তার জন্য খেজুর ও এক পাত্রে পানি এনে হাজির করলাম। এ ছিল বেলালের (প্রথম) আজানের পরে।[১৬৭]

তিনি ছিলেন খুবই স্বল্পাহারী। যামারা বিন আব্দুল্লাহ বিন আনিস তার পিতা হতে বর্ণনা করেন : আমি বনি সালামার এক মজলিসে বসা ছিলাম্তআমি ছিলাম তাদের মাঝে সর্বকনিষ্ঠ্ততারা বলাবলি করল, লাইলাতুল কদর সম্পর্কে আমাদের পক্ষ হতে রাসূলকে কে প্রশ্ন করবে? এটি ছিল একুশে রমজানের সকালের ঘটনা। আমি বেরিয়ে মাগরিবের সালাতে রাসূলের নিকট উপস্থিত হলাম। অত:পর তার গৃহের দরজায় দণ্ডায়মান হলে তিনি পাশ দিয়ে গমন করলেন। বললেন, প্রবেশ কর। প্রবেশ করলে আমাকে তার রাতের খাবার প্রদান করা হল। তিনি দেখতে পেলেন খাদ্য স্বল্পতার কারণে আমি খাদ্যগ্রহণ হতে বিরত থাকছি।[১৬৮]

এ থেকে প্রমাণ হয় রাসূলের হেদায়েত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ জুড়ে রয়েছে বিনয় ও যুহুদ। বিনয় ও যুহুদের অর্থ হল : পরকালে কল্যাণ সাধন করে না, এমন যাবতীয় কিছু পরিহার করা, উদারতা, লোক-দেখানো জাঁকজমক না করা, পার্থিব বিষয় যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়া, কখনো কখনো কঠোরতা অবলম্বন, জরাজীর্ণ বেশ ধারণ্তইত্যাদি ; যেন আত্মা প্রবৃত্তির দাসত্বে আকণ্ঠ নিমজ্জিত না হয়ে পড়ে। এবাদতের মৌলিকত্ব হল আত্মার বিনয়, আগ্রহ ও ব্যাকুলতার সাথে শরিয়তের প্রতি সর্বস্ব নিয়োগ। পার্থিবের সাথে প্রগাঢ় সম্পর্ক, তার জাঁকজমক নিয়ে সর্বদা মেতে থাকা এ পথের সবচেয়ে বড় বাধা। এর মাধ্যমে প্রমাণিত যুহুদ ও বিনয়ের সর্বনিম্ন স্তর অর্জন যে কোন মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য। এ ব্যাপারে মৌলনীতি হচ্ছে : বান্দা হারাম প্রবৃত্তির পরওয়া করবে না বিন্দুমাত্র, বৈধ হোক কিংবা অবৈধ্তওয়াজিব আদায়ের ক্ষেত্রে যে বিষয় বাধা, তাকে এড়িয়ে যাবে দৃঢ়তার সাথে।

তবে, এর উদ্দেশ্য এই নয় যে, প্রবৃত্তির যে কোন আস্বাদকে মানুষ সর্বদা এড়িয়ে যাবে ; প্রকারান্তরে যা পর্যবসিত হয় পার্থিব বৈরাগ্যে, আল্লাহ তাআলা ইসলামকে এ জাতীয় অসামাজিক বৈরাগ্য থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত রেখেছেন। আমরা বরং, সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূল ও তার পুণ্যবান সাহাবাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করব, বিচার-বিশ্লেষ ব্যতীত কোন বিষয়কে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাব না, কিংবা গ্রহণ করব না অমূলকভাবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের হেদায়েত দান করুন, প্রদর্শন করুন সঠিক ও ঋজু পথ।

এই সূত্র ধরে বলা যায়, মৌলিকভাবে সম্পদ অর্জন অবাঞ্ছিত নিন্দনীয় বিষয় নয়, তবে সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে বান্দাকে আল্লাহর তরে অন্তরকে করে তুলতে হবে বিনয়ী, একমুখী ; অন্তরের প্রশান্তি ও সন্তোষ সম্পদে নয়, পেতে হবে আল্লাহর সাথে সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে, পরকালীন চিন্তাই হবে তার সার্বক্ষণিক চিন্তা ও ধ্যান, সাফল্যের মাপকাঠি। যুহুদের প্রকৃত স্বরূপ এর মাঝেই নিহিত। সম্পদ চিন্তা ও মোহে আকণ্ঠ নিমজ্জন, সম্পদের অর্জন ও প্রবৃদ্ধির লালস্তাযুহুদের সাথে এগুলোর ন্যুনতম সম্পর্ক নেই ; টাকা ও অর্থের দাসত্বের অনুরূপ এগুলো হচ্ছে পার্থিবের দাসত্বের প্রতিফল।

অধিক-হারে সদকা ও সৎকাজে আত্মনিয়োগ

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানে অধিক সৎকাজ করতেন, সদকা করতেন বিপুল পরিমাণে। কোরআন পাঠ ও তার আলোকে জীবন যাপনের অলৌকিক ফলশ্রুতি হচ্ছে এ পুণ্য চরিত্রের স্ফুরণ। ইবনে আব্বাস এক হাদিসে বলেন : রাসূল ছিলেন মানুষের মাঝে সর্বাধিক দানশীল। রমজানে তিনি সর্বাধিক দানশীল হতেন, যখন জিবরাইলের সাথে তার সাক্ষাৎ হত। রমজানে জিবরাইল তার সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং তার সাথে কোরআন পাঠ করতেন। জিবরাইল আ:-এর সাথে সাক্ষাৎকালীন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতেন মুক্ত বায়ুর তুলনায় অধিক কল্যাণময় দানশীল।[১৬৯]

অন্যান্য মাসের তুলনায় রমজানে তার দানের আধিক্যের কারণ, কোরআন পাঠ তার আত্মার প্রাচুর্য বৃদ্ধির প্রত্যয়ের নবায়ন করত। আত্মিক এ প্রাচুর্যই হত তার দানশীলতার কারণ।[১৭০]

রাসূলের দানশীলতা ছিল সর্বব্যাপী, দানের যাবতীয় প্রকারের সম্মিলন হত তাতে। দ্বীনের বিজয়, মানুষের হেদায়েতের জন্য তিনি আল্লাহর রাস্তায় সমভাবে ব্যয় করতেন ইলম, নফ্‌স ও সহায়-সম্পদ। অজ্ঞদের শিক্ষাদান, তাদের সর্বাত্মক প্রয়োজন পূরণ করতেন ও অন্নদান করতেন ক্ষুধার্তদের।[১৭১]

'কল্যাণের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন মুক্ত বায়ুর তুলনায় অধিক দানশীল'্তইবনে আব্বাসের এ উক্তি থেকে প্রমাণিত হয়, রমজানে রাসূল দান ও এহসানে ছিলেন সকলের তুলনায় অগ্রবর্তী ব্যক্তিত্ব ; মুক্ত বায়ুর দান যেমন পৌঁছে যায় সম্মিলিতভাবে সকলের কাছে, রাসূলের দানে বিধৌত হতেন তেমনি সকলে, নির্বিশেষে। ইবনে মুনায়্যির উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেন : দরিদ্র, প্রয়োজনগ্রস্ত ও ধন্তীসকলের কাছে পৌঁছে যেত রাসূলের দানের কল্যাণ, মুক্ত শীতল প্রবাহিত বায়ুর পর আসে বৃষ্টির যে ঝাপটা, রাসূলের দান হত তার চেয়েও কল্যাণকর ও সর্বব্যাপী।[১৭২]

রাসূলের পুণ্যময় অভ্যাস ও চরিত্রে, আচরণ-নিষ্ঠায় এ ছিল কোরআনের প্রভাব, যুহুদের ফলশ্রুতি, রহমানের সাথে সার্বক্ষণিক সুসম্পর্কের সুখকর অবশ্যম্ভবি পরিণতি।

এ মাসে, তাই, মুসলিম মাত্ররই আকাঙ্ক্ষা ও আগ্রহের বিষয় হওয়া উচিত অধিক-হারে ব্যয়-দান ; ইমাম শাফেয়ী বলেন : রাসূলকে অনুসরণ করে ব্যক্তি এ মাসে অধিক হারে দান করবে, এ খুবই পছন্দনীয় বিষয়। কারণ, অধিকাংশ মানুষ এ সময় সালাত ও রোজা পালনে ব্যস্ত থাকার ফলে উপার্জনে ঘাটতি দেখা দেয়, ফলে এ দান তাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে।[১৭৩]

দানশীলতা ছিল রাসূলের জীবনের সর্বাধিক মহিমান্বিত প্রকাশ্য অভ্যাস, এ গুণ ছিল তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী, মুহূর্তের জন্য একে তিনি ত্যাগ করেননি। তিনি কখনো কিছু কুক্ষিগত করেননি কিছু, প্রার্থনা করার পর কাউকে না করেননি কখনো। তার এ আচরণের সর্বোচ্চ প্রকাশ দেখা যেত রমজানের পবিত্র মৌসুমে।

হাদিস থেকে প্রমাণ হয়, লজ্জার আবরণ খসে যাওয়ার পূর্বেই প্রয়োজনগ্রস্ত ব্যক্তির কাছে পৌঁছে যেত তার দানের কল্যাণ্তযেমন মুক্ত বসন্ত বায়ু পৌঁছে যায় ঘরে ঘরে, খরতাপদগ্ধ জমিতে জমিতে। সম্পদের নেয়ামতে আল্লাহ যাকে ভূষিত করেছেন, কিংবা ধনীদের প্রতিনিধি যে ব্যক্ত্তিসংস্থা অথবা ব্যক্তি, এ ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ তাকওয়া অনুসারে আমল করা তাদের কর্তব্য।

রমজান মাসে রাসূলের জেহাদ

রমজান হত রাসূলের জন্য পরীক্ষা, ব্যয় ও আত্মদানের মাস। এ মাসে তিনি বিভিন্ন জেহাদ ও সম্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতেন। রমজানে একই সাথে তিনি সশরীরে অংশ নিয়েছেন যুদ্ধে, এবং বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য প্রেরণ করেছেন সেনাদল বা সারিয়া।[১৭৪]

আবু সাইদ খুদরি হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রমজানের ষোলো তারিখে আমরা রাসূলের সাথে যুদ্ধে অংশ নিয়েছি। আমাদের কেউ কেউ রোজা রেখেছে, কেউ ভেঙ্গেছে। ভিন্ন শব্দে এসেছ্তেআমরা রাসূলের সাথে রমজানে যুদ্ধে অংশ নিতাম, আমাদের কেউ রোজা রাখত, কেউ রাখত না। রোজাদার আহারকারীর উপর ক্ষোভ পোষণ করত না, এবং আহারকারীও রোজাদারের উপর ক্ষোভ পোষণ করত না।[১৭৫]

উমর বিন খাত্তাব রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : আমরা রাসূলের সাথে রমজান মাসে দুটি যুদ্ধে অংশ নিয়েছ্তিবদর ও মক্কা বিজয়। এ উভয় যুদ্ধে আমরা পানাহার করেছি।[১৭৬]

এমনকি গাযওয়ায়ে তাবুক্তেযে যুদ্ধে আরব উপদ্বীপের দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে ইসলামের সালতানাত সুদৃঢ় হয়েছে, নবম হিজরিতে যে যুদ্ধে রাসূল মদিনা হতে বের হয়ে প্রত্যাবর্তন করেছেন রমজানে,্ত সেটিও সংগঠিত হয় রমজান মাসে।[১৭৭]

স্বশরীরে অংশ না নিয়ে রাসূল এ মাসে বিভিন্ন যুদ্ধ দল নানাস্থানে জেহাদের অংশগ্রহণের জন্য প্রেরণ করেছেন। শাম হতে প্রত্যাবর্তনকারী কোরাইশি কাফেলার মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রেরণ করেন হামজা বিন আব্দুল মোত্তালেব উপদলকে, এ ছিল প্রথম হিজরির রমজান মাসের ঘটনা।[১৭৮] হিজরি দ্বিতীয় বর্ষের রমজান মাসে, বদর যুদ্ধের পর তিনি প্রেরণ করেন আমর বিন আদির উপদল, এদের উদ্দেশ্য ছিল আসামা বিনতে মারওয়ানকে খুন করা, যে তা রচিত কবিতা দিয়ে নিন্দা করে বেড়াত ইসলামের, প্ররোচনা দিত মুসলমানদের নানাভাবে।[১৭৯] সপ্তম হিজরিতে রমজান মাসে প্রেরণ করেন আব্দুল্লাহ বিন আবি আতিক এর যুদ্ধ উপদল, যাদের প্রেরণ করা হয়েছিল খন্দকের যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গোত্র-উপদলকে ঐক্যবদ্ধ-সংগঠিতকারী আবু রাফে বিন সালাম বিন আবিল হুকাইককে হত্যা করতে।[১৮০]

ফাতহে মক্কার যুদ্ধে রাসূলের অবস্থানের ব্যাপারে কোরাইশের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য হিজরি চতুর্থ বর্ষে রমজানে আবু কাতাদা বিন রবয়ির উপদল প্রেরণ করা হয়। একই বর্ষে রমজানে যথাক্রমে উজ্জা, সুয়া ও মানাত ধ্বংস করার জন্য প্রেরণ করা হয় খালিদ বিন ওয়ালিদ ও আমর বিন আস এবং সাদ বিন যায়েদ আশহালির উপদল তিনটিকে।

অন্যান্য এবাদত অব্যাহত রেখেও রাসূল ও তার সাহাবিগণের এ ধরনের সম্মুখ সমরে অংশ গ্রহণ প্রমাণ করে রোজা পালন ব্যক্তির মাঝে এক ইতিবাচক প্রেরণা ও শক্তি জোগায়, যা একই সাথে শারীরিক ও আন্তর স্বতঃস্ফূর্ততার জন্ম দিয়ে ব্যক্তিকে করে তোলে চূড়ান্ত কল্যাণকামী।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও পুণ্যবান সাহাবাদের এ আদর্শ প্রমাণ করে জেহাদ ও এবাদত এবং আল্লাহর তাআলার মহব্বত ও তার মহত্ত্ব, আদেশ-নিষেধের মাঝে সুদৃঢ় সম্পর্ক্তএগুলোই হচ্ছে সত্যবাদী মুজাহিদদের অবশ্য অর্জনীয় গুণ। দ্বীনের পথে মুজাহিদদের গুণ বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ مَن يَرْتَدَّ مِنكُمْ عَن دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ يُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللّهِ وَلاَ يَخَافُونَ لَوْمَةَ لآئِمٍ ذَلِكَ فَضْلُ اللّهِ يُؤْتِيهِ مَن يَشَاءُ وَاللّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ. [المائدة: ৫৪]
হে ইমানদারগণ ! তোমাদের মাঝে কেউ যদি তার দ্বীন হতে ফিরে যায়, তবে অচিরে আল্লাহ তাআলা এমন এক জাতি পাঠাবেন, যাদের তিনি পছন্দ করেন, তারাও তাকে পছন্দ করে। যারা মোমিনদের ব্যাপারে হবে বিনম্র, কিন্তু কাফেরদের উপর হবে কঠোর। তারা আল্লাহর পথে জিহাদে অংশ নিবে, নিন্দুকের নিন্দার ভয় করবে না, এ আল্লাহর ফজিলত, যাকে ইচ্ছা তিনি তা দান করেন।
আর আল্লাহ প্রশস্ত, সর্বজ্ঞ।[১৮১]

একই সাথে, পার্থিব প্রবৃত্তির আস্বাদে যারা বিভোর, ভুলে আছে যারা তাআত ও আনুগত্যের যাবতীয় অনুসঙ্গ, তাদের প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন :
قُلْ إِن كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَآؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُم مِّنَ اللّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُواْ حَتَّى يَأْتِيَ اللّهُ بِأَمْرِهِ وَاللّهُ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ [التوبة: ২৪].
আপনি বলুন, তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ, তার রাসূল, এবং আল্লাহর পথে জেহাদ অপেক্ষা অধিক প্রিয় হয় তোমাদের পিতা, সন্তান-সন্ততি, তোমাদের ভ্রাতা, পত্নী, তোমাদের স্ব-গোষ্ঠী, অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, যার মন্দাকালের আশঙ্কা কর, এবং তোমাদের বাসস্থান, যা তোমরা পছন্দ কর, তাহলে অপেক্ষা কর আল্লাহর বিধান আসা অবধি। আল্লাহ ফাসেক কওমকে হেদায়েত করেন না।[১৮২]

রমজানের আমলে আহলে কিতাবিদের সাথে বৈপরিত্ব

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের আমলের ক্ষেত্রে আহলে কিতাবিদের সাথে বৈপরিত্য রেখেছেন। এক হাদিসে এসেছে, রাসূল বলেন :
لا يزال الدين ظاهراً ما عجَّل الناس الفطر؛ لأن اليهود والنصارى يؤخرون.
দ্বীন বিজয়ী হবে, যে যাবৎ মানুষ দ্রুত ইফতার করবে। কারণ, ইহুদি-নাসারা তা বিলম্বে করে।[১৮৩]

অপর এক হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন :
لا يزال الناس بخير ما عَجَّلُوا الفطرْ. عَجِّلُوا الفطر! فإن اليهود يؤخرون.
যে অবধি মানুষ দ্রুত ইফতার করবে (অর্থাৎ সময় হওয়া মাত্রই), ভাল থাকবে। তোমরা দ্রুত ইফতার কর, কারণ, ইহুদিরা তা বিলম্বে করে।[১৮৪]

তিনি আরো এরশাদ করেন :
فصل ما بين صيامنا وصيام أهل الكتاب أكلة السحر.
আমাদের ও আহলে কিতাবিদের রোজার মাঝে পার্থক্য হল সেহরি গ্রহণ।[১৮৫]

ইসলাম ধর্মের রয়েছে বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা। তার বৈশিষ্ট্যগুলো পৌত্তলিক ও বিকৃতকারী আহলে কিতাবিদের থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। রোজা ইত্যাদি ক্ষেত্রে, তাই, রাসূল ছিলেন পার্থক্য বজায় রাখার নিদর্শন ও নির্দেশক।

উম্মত আজ সাংস্কৃতিক, চেতনাগত এক ব্যাপক দৌর্বল্যে আক্রান্ত, সর্বক্ষেত্রে অন্যের পদাঙ্ক অনুসরণই হয়ে উঠেছে তার একমাত্র ভবিতব্য। কাফের ও পৌত্তলিকদের সাথে বৈসাদৃশ্য গ্রহণ, সন্দেহ নেই, তার জন্য ছিল সর্বাধিক প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। ধর্ম ও ধর্ম-চেতনার যা তাদের জন্য বৈশিষ্ট্যের মর্যাদা প্রাপ্ত, তাতে নিজেদের স্বকীয়তা প্রমাণ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। চিন্তা ও চেতনার মৌলনীতির যা স্তম্ভের স্বীকৃতি প্রাপ্ত, মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক স্বাজাত্যবোধের পরিচায়ক, তাই কেবল তাদের হারানো দিনের পুনরূপায়নের চাবিকাঠি হতে পারে, ফিরিয়ে আনতে পারে কাঙ্ক্ষিত বিজয়, আর স্বভূমি উদ্ধারের সুবাতাস।

জীবন সায়াহ্নে আমলের আধিক্য

জীবনের শেষ সময়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানে অধিক আমল করতেন। হাদিসে পাওয়া যায়, রাসূল এ সময়ে এতেকাফে দ্বিগুণ সময় ব্যয় করতেন। আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন :
كان النبي صلي الله عليه و سلم يعتكف في كل رمضان عشرة أيام، فلما كان العام الذي قبض فيه اعتكف عشرين يوماً.
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি রমজানে দশ দিন এতেকাফে যাপন করতেন, যে বছর তার ঊর্ধ্বারোহন হয়, সে বছর তিনি বিশ দিন এতেকাফে যাপন করেন।[১৮৬]

শেষ সময়ে তিনি দু বার জিবরাইল আ:-এর সাথে কোরআন সহপাঠ ও অনুশীলনে অংশ নেন। রাসূলের প্রিয়তমা কন্যা ফাতেমা রা. বর্ণিত হাদিসে এসেছে, তিনি বলেন : আমাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোপনে জানালেন যে, জিবরাইল প্রতি বছর আমাকে একবার কোরআন শোনাতেন-শুনতেন, এবার তিনি তা দু বার করেছেন, একে আমি আমার সময় ঘনিয়ে আসার ইঙ্গিত মনে করছি।[১৮৭]

আবু হুরায়রা বর্ণিত হাদিসে উভয়টির উল্লেখ পাওয়া যায় এভাব্তেতিনি বলেন:
كان يعرض على النبي صلي الله عليه و سلم القرآن كل عام مرة، فعرض عليه مرتين في العام الذي قبض فيه، وكان يعتكف كل عام عشراً فاعتكف عشرين في العام الذي قبض فيه.
রাসূলকে প্রতি বছর একবার কোরআন পাঠ করে শোনান হত, যে বছর তার ঊর্ধারোহন হয়, সে বছর তাকে দু বার শোনান হয়। প্রতি বছর তিনি দশ দিন এতেকাফ করতেন, যে বছর তার তিরোধান হয়, সে বছর তিনি বিশ দিন এতেকাফ পালন করেন।[১৮৮]

আল্লাহ তাআলার শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে যে জ্ঞাত হয়েছে, পেয়েছে আপন আত্মার পরিচয়, তার দারিদ্র্য, লাঞ্ছনা, সর্বক্ষেত্রে খালেকের মুখাপেক্ষিতা, উপলব্ধি করতে পেরেছে পার্থিবের ক্ষণস্থায়িত্ব, একে গ্রহণ করেছে পরীক্ষার স্থল হিসেবে এবং পরকালকে ভেবেছে চিরকালীন আবাস, ফলে রাসূলের অনুবর্তন ও কল্যাণ কর্মে সর্বাত্মক আত্মনিয়োগ হয়েছে তার ফলশ্রুতি, উপযোগিতা বিচারে সে গ্রহণ করেছে সময়ের সর্বাধিক কল্যাণকর সিদ্ধান্ত। বিশেষত: জীবনের দীর্ঘ বসন্ত যার অতিক্রান্ত হয়েছে ইতিমধ্যে, পৌঁছে গেছে পরকালগাহের সন্নিকটে, তার জন্য এ কর্ম পন্থা খুবই সময়োচিত্তসন্দেহ নেই।

এই হচ্ছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আলোকিত-প্রকাশ্য জীবনের ক্ষুদ্র অথচ অনুসরণীয় কয়েকটি নিদর্শন, বরকতময় মহত্তম সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য রাসূল যাকে গ্রহণ করেছেন কর্মপদ্ধতি হিসেবে। এ হচ্ছে আল্লাহর সুদৃঢ় ঋজু পথ আঁকড়ে ধরবার আলোকবর্তিকা, এ পথ বিচ্যুত ব্যক্তি মাত্রই বিভ্রান্ত, অতলান্ত অন্ধকার গহ্বরে নিপতিত। রাসূল প্রদর্শিত সুন্নতের পথে ফিরে আসা ব্যতীত সে ক্রমাগত ঘুরপাক খাবে পথের বাকচক্রে। হে আল্লাহ ! আমাদেরকে তৌফিক দান করুন আপনার আনুগত্য করার, রক্ষা করুন আপনার অবাধ্যতা হতে, দৃঢ়-অবিচল রাখুন দ্বীনের উপর ; রাসূলের সর্বাত্মক অনুসরণের সৌভাগ্যে ভূষিত করুন। আমিন।

সংকলন : ফায়সাল বিন আলী আল বা'দানী
فيصل بن علي البعداني
অনুবাদক : কাউসার বিন খালেদ
ترجمة: كوثر بن خالد
সম্পাদনা : মুহাম্মদ শামসুল হক সিদ্দিক
নুমান বিন আবুল বাশার
مراجعة: محمد شمس الحق صديق
نعمان بن أبو البشر
সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব

No comments:

Post a Comment

Download AsPDF

Print Friendly and PDFPrint Friendly and PDFPrint Friendly and PDF
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...