Tuesday 25 February 2020

একটি বিভ্রান্তি ও তার অপনোদন


ইমাম ইসহাক (রহ।) কে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল সালাতে কয়টা ফরজ? জবাবে তিনি বলেছিলেন: ‘সালাতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবই অপরিহার্য। যেটা আমরা বলি সালাতে তাকবির থেকে সালাম পর্যন্ত সবই অপরিহার্য।’ তারপর তিনি বলেছেন –‘কোন ব্যক্তির জন্য বৈধ নয় যে সে বলবে সালাতের ৭টি কিংবা ৮টি ফরজ, অনুরুপ সুন্নাতও!’ অতপর তিনি বলেছেন –‘কোন ব্যক্তি যদি সালাতে ফরজ সুন্নাত ভাগ করে তবে জেনে রাখ এটা একটা বিদ’আত এবং সে ব্যক্তি বিদ’আতি।’ ক্ষমাসায়েলে ইমাম আহম্মদ ও ইসহাক -১৯১ পৃষ্টাঁ
অনুরূপ উক্ত ভাগাভাগিকে ইমাম ইমাম মালেক (রাহিমাহুল্লাহ) 'যিনদীক' (নাস্তিক)দের কথা বলেছেন। (সিয়ারু আ'লামিন নুবালা' ৮/১১৪)
ইমাম শাফেয়ী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, 'নামাযের প্রত্যেকের কর্ম আমাদের নিকট ফরয।' (মানাক্বিবুশ শাফেয়ী)
আর এখান থেকেই অনেকে ধারণা করেন, যাঁরা নামাযের কর্মাবলীকে ফরয-সুন্নত ভাগাভাগি ক'রে উল্লেখ করেছেন, তাঁরা কাফের বা বিদআতী। অনেকে ধারণা করেন, নামাযে রফয়ে-য়্যাদাইন ইত্যাদি (সুন্নতী আমল) না করলে নামায বাতিল!
জ্ঞানীরা প্রশ্ন করেন, তাহলে নামাযে ভুল হলে কোন ভুলের জন্য নামায বাতিল হয়ে যায়, কোন ভুলের জন্য সহু সিজদা করলে নামায শুদ্ধ হয়ে যায়, আবার কোন কোন ভুলের জন্য সহু সিজদাও দিতে হয় না এবং নামায শুদ্ধ হয়ে যাও। এ কথাও তো ইমাম ও উলামাগণ উল্লেখ করেছেন। তাহলে এর মানে কী?
ইমাম ইসহাক বিন রাহওয়াইহ (রাহিমাহুল্লাহ)ও স্পষ্ট বলেছেন, 'নামাযে যা কিছু (কথা ও কর্ম) আছে, সবই ওয়াজেব। অবশ্য তার কিছু বর্জন করলে নামায ফিরিয়ে পড়তে হয় এবং কিছু বর্জন না করলে নামায ফিরিয়ে পড়তে হয় না। (নামায শুদ্ধ হয়ে যায়।)'
তাহলে কেন তাঁরা এমন ঢালাও কথা বলে গেলেন?
এর উত্তরে ইবনে রজব হাম্বলী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, 'আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত, যেহেতু (নামাযের কোন অংশকে) 'সুন্নত' বললে এই পরিভাষা অনেক সময় তার প্রতি শৈথিল্য, অবজ্ঞা বা বর্জনের দিকে ঠেলে দেয়। আর সেটা হবে শরীয়তের উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। যাতে আছে এমন বহু পদ্ধতিতে উৎসাহ প্রদান ও অনুপ্রেরণা দান, যার ফলে কর্ম করতে ও তার সওয়াব অর্জন করতে নামাযী উদ্বুদ্ধ হয়। আর 'ওয়াজেব' (বা ফরয) শব্দ প্রয়োগ করলে সেই কর্ম করতে এবং তাতে আগ্রহী হতে বেশি উদ্বুদ্ধ হওয়া যায়। (যদিও প্রকৃতপ্রস্তাবে সে কর্ম ওয়াজেব নয়।)
শরীয়তের পরিভাষায় এমন কর্মের ব্যাপারে 'ওয়াজেব' শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে, যা বর্জন করলে গোনাহ হয় না এবং অধিকাংশের মতে তার বর্জনকর্তা শাস্তিযোগ্য নয়। যেমন জুমআর গোসল এবং অনেক অথবা অধিকাংশ উলামার নিকট অর্ধ রাতের গোসল (উদ্দেশ্য অজানা)। এই গোসল ওয়াজেব বলার উদ্দেশ্য, তা করার উপর উৎসাহ ও তাকীদ প্রদান করা।' (জামেউল উলূমি ওয়াল-হিকাম ১/২৭৯)
এ মর্মে শায়খ মুহাম্মাদ বিন উষাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, 'কোন মানুষের জন্য সঙ্গত নয়, যখন সে রসূল ﷺ-এর নির্দেশ শুনবে, তখন জিজ্ঞাসা করবে, তা ওয়াজিব না মুস্তাহাব? যেহেতু তিনি বলেছেন,
(( فَإِذَا أَمَرْتُكُمْ بِشَيءٍ فَأتُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ ، وَإِذَا نَهَيْتُكُمْ عَن شَيْءٍ فَدَعُوهُ ))।

“---সুতরাং আমি যখন তোমাদেরকে কোন কিছু করার আদেশ দেব, তখন তোমরা তা সাধ্যমত পালন করবে। আর যা করতে নিষেধ করব, তা থেকে বিরত থাকবে।” (মুসলিম ৩৩২১নং)
তফসীল জিজ্ঞাসা করা (আপনার জন্য সঙ্গত নয়)। যেহেতু আপনি আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্ল ও তাঁর রসূল ﷺ-এর হুকুম তামীলকারী বান্দা (আজ্ঞাবহ দাস)।
তবে হ্যাঁ, বান্দা যখন সমস্যা ও বিরুদ্ধাচরণে পতিত হবে, তখন সে তার ব্যাপারে তফসীল জিজ্ঞাসা করতে পারবে। যেহেতু নির্দেশ যদি ওয়াজেব হয়, তাহলে তার জন্য তওবা ওয়াজেব। আর তা যদি ওয়াজেব না হয়, তাহলে তওবা ওয়াজেব নয়।' (শারহুল আরবাঈন আন-নাওয়াবিয়্যাহ ১৩৮পৃঃ)
মহান আল্লাহ বলেছেন,
ৎآمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنزِلَ إِلَيْهِ مِن رَّبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ آمَنَ بِاللّهِ وَمَلآئِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لاَ نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِّن رُّسُلِهِ وَقَالُواْ سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُঃ (২৮৫) سورة البقرة
“রসূল তার প্রতি তার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে, তাতে সে বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং মু'মিনগণও; সকলে আল্লাহতে, তাঁর ফিরিশ্তাগণে, তাঁর কিতাবসমূহে এবং তাঁর রসূলগণে বিশ্বাস স্থাপন করেছে। (তারা বলে,) আমরা তাঁর রসূলগণের মধ্যে কোন পার্থক্য করি না। আর তারা বলে, আমরা শুনলাম ও মান্য করলাম! হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা তোমার ক্ষমা চাই, আর তোমারই দিকে (আমাদের) প্রত্যাবর্তন হবে।” (বাক্বারাহঃ ২৮৫)
শায়খ মুহাম্মাদ বিন উষাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) উক্ত আয়াতের তফসীরে বলেছেন, 'রসূল ও মু'মিনগণ “আমরা শুনলাম ও মান্য করলাম” বলেন, মহান আল্লাহর এই খবর দেওয়ার হিকমত হল, যাতে তাঁরা আমাদের আদর্শ হন এবং আমরাও বলি, “আমরা শুনলাম ও মান্য করলাম”। আর তা হল আদেশ ও নিষেধের ক্ষেত্রে।
মানুষ যখন এই কর্মনীতি ও রীতি মেনে জীবনের পথ চলবে, তখন সে অনেক সমস্যা থেকে নিরাপত্তা এবং অনেক সন্দেহ থেকে মুক্তি লাভ করবে। আর সে হবে প্রকৃত (আল্লাহর) বান্দা (আজ্ঞাবহ দাস)।
আমি এই উপলক্ষ্যে একটি এমন বিষয়ে সতর্কও করতে চাই, যা কিছু মানুষ ক'রে থাকে। যখন কোন নির্দেশ আসে, তখন তুমি দেখবে, কিছু লোক প্রশ্ন করে, “এটা মুস্তাহাব, নাকি ওয়াজেব?”
ভাইজান! এমন কথা বলো না। বরং বলো, “আমরা শুনলাম ও মান্য করলাম”। অতঃপর তা যদি ওয়াজেব হয়, তাহলে আল্লাহ তোমাকে ওয়াজেবের সওয়াব দান করবেন। অন্যথা যদি মুস্তাহাব হয়, তাহলে তিনি তোমাকে মুস্তাহাবের সওয়াব দান করবেন। পক্ষান্তরে ওয়াজেব না মুস্তাহাব তার অনুভূতি না রেখে তোমার সে নির্দেশ মেনে নেওয়া এবং তা পালন করা হল সবচেয়ে উচ্চ পর্যায়ের (আনুগত্য)।
অনুরূপভাবে কোন নিষেধ এলে প্রশ্ন করে, “এটা কি মাকরূহ, নাকি হারাম?” প্রশ্ন করো না ভাইজান! বর্জন কর। যখন তোমাকে নিষেধ করা হল, তখন বর্জন কর।
এই জন্য, আমার জানা নেই যে, সাহাবা (রায্বিয়াল্লাহু আনহা)-কে যখন কোন আদেশ করা হতো, তখন তাঁরা বলতেন, “হে আল্লাহর রসূল! এটা মুস্তাহাব না ওয়াজেব?” এবং কোন কিছু নিষেধ করা হলে, তাঁরা বলতেন, “এটা মাকরূহ, নাকি হারাম?” আমার জানা নেই এটা।
তবে হ্যাঁ, যখন মনে হতো যে, সে আদেশ পরামর্শ, পথনির্দেশ, আবেদন (বা সুপারিশ) হতে পারে, তখন তাঁরা জিজ্ঞাসা ক'রে নিতেন; যেমন বারীরার ঘটনায় আছে, বারীরার স্বামী ক্রীতদাস ছিল। মুগীস নামে তাকে ডাকা হত। আমি যেন এখনও তাকে দেখছি সে বারীরার পিছে কেঁদে কেঁদে ঘুরছে, আর তার দাড়ি বেয়ে অশ্রু ঝরছে। তখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ হে ‘আব্বাস! বারীরার প্রতি মুগীসের ভালবাসা এবং মুগীসের প্রতি বারীরার অনাসক্তি দেখে তুমি কি আশ্চর্যান্বিত হও না? এরপর নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ (বারীরা) তুমি যদি তার কাছে আবার ফিরে যেতে! সে বললঃ হে আল্লাহ্‌র রসূল! আপনি কি আমাকে হুকুম দিচ্ছেন? তিনি বললেনঃ আমি কেবল সুপারিশ করছি। সে বললঃ তাকে দিয়ে আমার কোন প্রয়োজন নেই। (বুখারী ৫২৮৩নং)
কিন্তু তাঁরা কখনোও এই বলে জিজ্ঞাসা করতেন না যে, হে আল্লাহর রসূল! আপনার এ আদেশ ওয়াজেব, নাকি মুস্তাহাব?
বলা বাহুল্য, মহান আল্লাহর জন্য পরিপূর্ণ আনুগত্য ও বিনয়াবনত আচরণ এই যে, তুমি কোন কাজ করতে আদিষ্ট হলে বলবে, “হ্যাঁ (করছি)।” পক্ষান্তরে যদি মানুষ কোন বিষয়ে অন্যথাচরণ বা বিরুদ্ধাচরণে পতিত হয়, তাহলে সেই সময় সে জিজ্ঞাসা করবে, সে নির্দেশ কি ওয়াজেব ছিল, তাহলে সে তওবা করবে। অথবা মুস্তাহাব ছিল, তাহলে তাতে প্রশস্ততা আছে বুঝবে। নচেৎ এমন সমস্যায় পড়ার আগে ভাইজান! তুমি মু'মিন। তুমি বিনয়াবনত। তুমি দাস। তুমি যদি তোমার ছেলেকে কোন আদেশ কর, আর সে যদি তোমাকে প্রশ্ন করে, “আব্বা! এটা কি জরুরী?” তাহলে তুমি তাকে বেআদব ভাববে। তাহলে সৃষ্টিকর্তার আদেশ-নির্দেশের ক্ষেত্রে কেমন হবে?' (আহকামুল কুরআন ২/৩৭০)
সুতরাং মোটের উপর কথা এই যে, 'নামাযের সকল কর্মই ফরয' অথবা 'ফরয-সুন্নতে ভাগ করা বিদআত' কথার উদ্দেশ্য হল, নামাযের সকল কর্মকে গুরুত্ব সহকারে আদায় করা এবং তাতে কোন প্রকার অবজ্ঞা বা শৈথিল্য না করা। বাক্যের বাহ্যিক অর্থ উদ্দিষ্ট নয়।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে বোঝার তওফীক দিন। আমীন।
সংগ্রহেঃ আব্দুল হামীদ আল-ফাইযী আল-মাদানী

No comments:

Post a Comment

Download AsPDF

Print Friendly and PDFPrint Friendly and PDFPrint Friendly and PDF
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...