Sunday 19 March 2017

নামায কিভাবে পড়তে হয়? (পর্ব-৩)

প্রশ্নঃ নামায কিভাবে পড়তে হয়? (পর্ব-৩)
উত্তরঃ বিসমিল্লাহ। ওয়ালহা’মদুলিল্লাহ।
ওয়াস-সালাতু ওয়াস-সালামু আ’লা রাসুলিল্লাহ। আম্মা বা’দ। আজকে এই সিরিজের শেষ পর্ব।
.
.

.
সিজদা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু মাস’আলাঃ
১. আমরা সিজদা করার সময় অনেক সময় খেয়াল করিনা, তাই নাক মাটিতে না রেখেই সিজদা করি।
সিজদার সময় নাক মাটিতে লাগিয়ে রাখতে হবে।
“রাসুলুল্লাহ (সাঃ) নাক ও কপাল মাটিতে মজবুতভাবে ঠেকিয়ে রাখতেন।”
আবু দাউদ, তিরমিযী, হাদীস সহীহ।
“ঐ বান্দার নামায সহীহভাবে আদায় হয়না যে কপালের মতো করে নাক মাটিতে ঠেকায় না।”
দারা কুতনী, তাবারানী ৩/১৪০/১।
২. অনেকে বিশেষ করে নারীরা সিজদার সময় মাটিতে দুই হাত বিছিয়ে দেয়। এই কাজটা হারাম।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “তুমি যখন সিজদা করবে তখন তোমার হাতে তালুদ্বয় (যমীনে) রাখবে আর দুই কনুই উঁচু করে রাখবে।”
সহীহ মুসলিম।
অন্য হাদীসে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “তোমাদের কেউ যেন দুই হাতকে কুকুরের মতো বিছিয়ে না দেয়।”
বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযী।
৩. সিজদার সময় দুই পা এক সাথে করে রাখতে হবে।
আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সিজদাতে দুই পায়ের গোড়ালি জোড়া লাগানো অবস্থায় দেখেছি।
ইবনে খুজাইমা, সহীহ।
এই সময় পায়ের আংগুলগুলো একটু ভাজ করে কিবলার দিকে রাখতে হবে।
বায়হাকী।
বিঃদ্রঃ এইসবগুলো নিয়ম নারী ও পুরষের জন্য। এর বিপরীতে কিছু জাল হাদীস আছে। সহীহ হাদীস বাদ দিয়ে জাল হাদীসের উপরে আমল করা বেদাত।
সিজদার তাসবীহ পড়বেন “সুবহা-না রব্বিয়াল আ‘লা” অন্তত ৩ বার, বা আরো বেশি পড়া ভালো। এছাড়া আরো দুয়াও পড়তে পারেন “সুবহা-নাকাল্লা-হুম্মা রব্বানা ওয়া বিহামদিকা আল্লা-হুম্মাগফিরলী”
.
এছাড়া সিজদাতে মুনাজাতের মতো দুনিয়া আখেরাতের জন্য দুয়া করতে পারেন, ফরয নফল যেকোন নামাযে।
সিজদাতে দুয়া করা নিয়ে বিস্তারিত জানতে আমাদের এই পোস্ট দেখুনঃ
http://ansarus-sunnah.blogspot.com/20…/…/blog-post_5589.html
.
সিজদায় তাসবীহ, দুয়া পড়া শেষ হলে “আল্লাহু আকবার” বলে সিজদা থেকে উঠে বসবেন। এইসময় পিঠ সোজা করতে হবে, পিঠ বাকা রেখে দ্রুত দ্বিতীয় সিজদায় চলে যাওয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ, এইরকম করলে নামায কবুল হবেনা। দুই সিজদার মাঝখানে এই সময় দুয়া আছে এইগুলো করবেন। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষতো দূরের কথা, এমনকি বেশিরভাগ ইমামই দুই সিজদার মাঝখানে দুয়া না করে দ্বিতীয় সিজদায় চলে যায় – এটা স্পষ্ট সুন্নতবিরোধী একটা কাজ। জানা থাকা ভালো, রুকু ও সিজদাতে তাসবীহ পড়তে হবে এমন হাদীস থেকে দুই সেজদার মাঝখানে দুয়া করতে হবে এই মর্মে হাদীস আরো বেশি আছে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বেশিরভাগ মানুষ এই সুন্নতকে বাদ দিয়েছে। এমন সহীহ হাদীস আছেযে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) দুই সেজদার মাঝখানে এতো বেশি সমইয় ধরে দুয়া করতেন যে সাহাবীরা সন্দেহে পড়ে যেতেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ২য় সিজদা করতে ভুলে গেলেন কিনা?
.
দুই সিজদার মাঝখানে বসা অবস্থায়ঃ
এখানে নিজের পছন্দমতো যেকোনো দুয়া করা যায়না, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেই দুয়াগুলো করেছেন শুধুমাত্র সেই দুয়াগুলোই করা যাবে। আর এইখানে দুয়া আরবীতেই করতে হবে। দুই সিজদার মাঝখানে এই দুয়াগুলো করার সময় তাশাহুদের মতো আংগুন দিয়ে ইশারা করা সুন্নত। যেই দুয়া করতে হবেঃ ছোট্ট এই দুয়াটা কি মুখস্থ করা যায়না?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফরয, সুন্নত, নফল যে কোনো সালাতের দুই সিজদার মাঝখানে বসা অবস্থায় এই দুআটি করতেনঃ
رَبِّ اغْفِرْ لِي، رَبِّ اغْفِرْ لِي
উচ্চারণঃ রাব্বিগ ফিরলি, রাব্বিগ ফিরলি।
অর্থঃ হে আমার রব আমাকে ক্ষমা করা, হে আমার রব আমাকে ক্ষমা কর।
আবু দাউদ ১/৩১, ইবনে মাজাহ, দুয়াটা সহীহ।
.
এই ছোট্ট দুয়াটা পড়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ মিস করা ঠিকনা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দিনে ৭০ থেকে ১০০ বার তোওবা করতেন। আপনি যদি সালাতের দুই সিজদার মাঝখানে এই দুয়াটা পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলেন তাহলে দিনে যত রাকাত করে সালাত পড়বেন, তত বারই আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া হবে। আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার একটা উপায় হচ্ছে বেশি বেশি করে নিয়মিত তোওবা ও ইস্তিগফার করা (ক্ষমা করা)।
.
এছাড়া দুই সিজদার মাঝখানে আরেকটা ছোট্ট সুন্দর দুয়াঃ
اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي، وَارْحَمْنِي، وَاهْدِنِي، وَاجْبُرْنِي، وَعَافِنِي، وَارْزُقْنِي، وَارْفَعْنِي
উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মাগফিরলী, ওয়ারহা’মনী, ওয়াহদিনী, ওয়াজবুরনী, ওয়াআ’ফিনি, ওয়ারযুক্বনী, ওয়ারফা‘নী।
অর্থঃ হে আল্লাহ! আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, আমার প্রতি দয়া করুন, আমাকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন, আমার সমস্ত ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করে দিন, আমাকে নিরাপত্তা দান করুন, আমাকে রিযিক দান করুন এবং আমার মর্যাদা বৃদ্ধি করুন”।
হাদীসটি ইমাম নাসাঈ ব্যতীত সুনান গ্রন্থগারগণ সবাই সংকলন করেছেন। আবূ দাউদঃ ৮৫০, তিরমিযীঃ ২৮৪, ২৮৫, ইবন মাজাহঃ ৮৯৮। শায়খ আলবানির মতে হাদীস সহীহ।
বিঃদ্রঃ এই দুয়াটা কম-বেশি বিভিন্ন ভাবে বর্ণনা আছে, সবগুলো সহীহ – তবে এখানে যেটা দেওয়া আছে এটা সবচাইতে বড় যেখানে সবগুলো দুয়া একসাথে আছে। এটা করলে সবগুলো দুয়াই করা হলো।
.
এবার আল্লাহু আকবার বলে ২য় সিজদা করবেন, আগের মতো তাসবীহ পড়বেন। ইচ্ছা হলে নিজস্ব দুয়া করতে পারবেন। আপনার ইচ্ছা হলে যেকোন এক বা একাধিক সিজদাতে, বা সবগুলো সিজদাতেই যত ইচ্ছা দুয়া করতে পারবেন, কোন সমস্যা নেই।
.
২য় রাকাতের জন্য সিজদা থেকে উঠাঃ
১ম ও ৩য় রাকাতে দুইটা সিজদা থেকে ২য় ও ৪র্থ রাকাতের জন্য উঠার আগে সরাসরি না দাঁড়িয়ে, আগে বসে এর পরে দুই হাতের উপর ভর করে দাঁড়ানো সুন্নত। একে প্রশান্তির বৈঠক বলা হয়। এসময় কোন দুয়া পড়তে হয়না। আর উঠার জন্য আলাদা তাকবীর বলতে হয়না। হয় আপনি সিজদা থেকে উঠার সময় তাকবীর বলে বসবেন এর পরে দাঁড়াবেণ, নয়তো তাকবীর না বলে উঠে বসবেন এর পরে তাকবীর বলে দাঁড়াবেন।
প্রশান্তির বৈঠকের দলীল –
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “যখন দ্বিতীয় সেজদা থেকে মাথা উঠাবে, তখন বসবে ও যমীনের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াবে।” সহীহ বুখারিঃ ৮২৪।
.
২য় রাকাতঃ
২য় রাকাতের শুরুতে সানা পড়তে হবেনা। বিসমিল্লাহ-হির রাহমানির পড়ে সুরা ফাতেহা পড়বেন। ইচ্ছা হলে বিসমিল্লাহর পূর্বে আউযুবিল্লাহ...দুয়া পড়বেন। এর পরে কিরাত পড়বেন, সুরার প্রথম থেকে পড়লে বিসমিল্লাহ…পড়বেন মাঝখান থেকে পড়লে পড়তে হবেনা। সুরা ফাতেহা ও কেরাত শেষ করে ১ম রাকাতের মতো রুকু ও সিজদা করবেন।
.
১ম বৈঠকঃ
যদি ৩ অথবা ৪ রাকাত নামায হয় তাহলে ১ম বৈঠকে শুধু তাশাহুদ (আত্তাহিয়্যাতু…) পড়লেই হবে। কেউ যদি ইচ্ছা করে তাহলে ১ম তাশাহুদে দুরুদ পড়া জায়েজ আছে, এটা সহীহ হাদীস দিয়ে প্রমানিত কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর বেশিরভাগ সময় আমল ছিলো ১ম বৈঠকে শুধু তাশাহুদ পড়া। কিন্তু যারা বলে ১ম তাশাহুদে ইচ্ছা করে দুরুদ পড়লে নামায নষ্ট হয়ে যাবে, বা অনিচ্ছাকৃতভাবে পড়লে সাহু সিজদা দিতে হবে এটা একেবারেই ভুল কথা।
বৈঠকের সময় তর্জনী দিয়ে আকাশের দিকে ইশারা করা বা নাড়াচাড়া করা সুন্নত। অনেকে মনে করে আশ-হাদু আল-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলার সময় শুধু একবার তুলতে হবে, এটা ভুল। আর যারা বলে অন্য সময় তুললে শিরিক হয়ে এটা আরো বড় রকমের ভুল, এইসমস্ত কথার কোনো ভিত্তি নেই। সুন্নত হচ্ছে, তাশাহুদ, দুরুদ ও দুয়া মাসুরার সময় যখন দুয়া করা হবে তখন একবার করে ইশারা করতে হবে, সালাম ফিরানোও একটা দুয়া, সুতরাং ডানে বামে সালাম ফেরানোর সময় আরো দুইবার করতে হবে।
.
আঙ্গুল নাড়ানোর বিস্তারিত নিয়ম দেখুন এই পোস্টে –
http://ansarus-sunnah.blogspot.com/20…/…/blog-post_4651.html
.
৩/৪ রাকাত হলে তাশাহুদ পড়ে “আল্লাহু আকবার” বলে ২হাতের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে যাবেন। ২ রাকাত পড়ে দাঁড়িয়ে ৩য় রাকাত শুরু করার আগে আরো একবার “রাউফুল ইয়াদাইন” করা সুন্নত, “রাউফুল ইয়াদাইন” এর জন্য আবার আল্লাহু আকবার বলার দরকার নেই। তারপর বিসমিল্লাহ…সুরা ফাতেহা…পড়বেন। ফরয নামায হলে ৩ ও ৪ রাকাতে কোনো সুরা না পড়লেও হবে শুধু সুরা ফাতেহা। তবে আপনি যদি চান তাহলে সুরা/কেরাত পড়তে পারেন – অতিরিক্ত সওয়াব পাবেন। সুন্নত, নফল নামাযে ৩ ও ৪ রাকাতে সুরা ফাতেহা পড়ে কেরাত পড়বেন।
.
শেষ বৈঠক এর নিয়মঃ
শেষ বৈঠকে অর্থাৎ ২ রাকাত নামাযের ১ম বৈঠক ও ৩/৪ রাকাত নামাযের ২য় বৈঠকে প্রথমে তাশাহুদ, এর পরে দুরুদ পড়বেন। এর পরে “দুয়া মাসুরা” অর্থাৎ হাদীসে বর্ণিত বিভিন্ন দুয়া আছে সেইগুলো পড়বেন। তাশাহুদ ও দুরুদ পড়া ওয়াজিব এবং দুয়া মাসুরা ও অন্য দুয়া পড়া সুন্নত। যত ইচ্ছা দুয়া পড়তে পারবেন, নিজের বা অন্য মুসলিমের জন্য প্রয়োজ়নীয় যেকোন দুয়া করতে পারবেন, দুনিয়া বা আখেরাতের যেকোন কল্যানের। কুরানের দুয়াগুলোও পড়তে পারবেন। দুয়া পড়ে “আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ” বলে ডানে ও বামে সালাম ফেরাবেন। সালাম ফেরানোর বিশেষ কোনো নিয়ম নাই, চেষ্টা করবেন যথাসম্ভব ডানে ও বামে মুখে ফেরাতে। একবার ডানে মুখ নিয়ে পরে মাঝখানে এনে পর বাম দিকে ফেরানো, মাথা উপর নিচ করা এইগুলোর কোনো সহীহ হাদীস নেই।
উল্লেখ্য, ১ম বৈঠকে আমাদের দেশে পুরুষেরা যেইভাবে বসে সেইভাবে বসা নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য সুন্নত। আর ৩/৪ রাকাত নামাযে ২য় বৈঠকে আমাদের দেশের নারীরা যেইভাবে বসে এইভাবে বসা নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য সুন্নত – বসার এই স্টাইলকে “তাওয়্যারুক” করা বলা হয়। নারী ও পুরুষের আলাদা বসার নিয়ম সহীহ হাদীস দিয়ে প্রমানিত না।
তাওয়্যারুক নিয়ে বিস্তারিত দেখুন –
http://ansarus-sunnah.blogspot.com/2014/04/blog-post_24.html
.
আলহা’মদুলিল্লাহ!
তাসলীম বা সালাম ফেরানোর মাধ্যমেই শেষ হলো নামায পড়ার পদ্ধতি নিয়ে আমাদের এই সিরিজ। ইন শা’ আল্লাহ পরবর্তীতে জামাতে নামায পড়া ও আপনাদের প্রশ্নের উত্তরগুলো দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। বারাকাল্লাহ ফীকুম। এই লেখাগুলোতে যদি ভালো ও উপকারী কিছু থাকে সেটা আল্লাহর পক্ষ থেক দয়া। আর যদি খারাপ কিছু থেকে থাকে শুধুই শয়তানের পক্ষ থেকে বা আমাদের নিজেদের পক্ষ থেকে।
ওয়া সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লামা আ’লা নাবিয়্যিনা মুহা’ম্মাদ।
সুবহা’নাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহা’মদিকা আশ-হাদু আল্লা ইলাহা ইল্লা আনতা, আস্তাগফিরুকা ওয়া আতুবু ইলাইকা।

সংগ্রহঃ তোমরা তোমাদের পালনকর্তার অভিমূখী হও এবং তাঁর আজ্ঞাবহ হও

No comments:

Post a Comment

Download AsPDF

Print Friendly and PDFPrint Friendly and PDFPrint Friendly and PDF
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...