Saturday 14 January 2017

বই ডাউনলোড: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বহুবিবাহ সম্পর্কে ইসলাম বিদ্বেষীদের অভিযোগের দাঁত ভাঙ্গা জবাব



rasul-sm-ar-bohu-bibaho-cover
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বহুবিবাহ
সম্পর্কে ইসলাম বিদ্বেষীদের অভিযোগের দাঁত ভাঙ্গা জবাব
মূল: শাইখ মুহাম্মদ আলী সাবুনী
অনুবাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
(লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়)
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব
ক্রমসূচীপত্রপৃষ্ঠা
১.সংক্ষিপ্ত লেখক পরিচিতি
২.অনুবাদকের কথা
৩.ভূমিকা১২
৪.প্রদীপ্ত সূর্য১২
৫.রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বহু বিবাহ সম্পর্কে ইসলাম বিদ্বেষীদের অভিযোগ এবং সেগুলোর জবাব১৭
৬.ইসলাম বিদ্বেষীদের জবাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ দুটি পয়েন্ট২০
৭.১ম পয়েন্ট২১
৮.২য় পয়েন্ট২১
৯.বহু বিবাহের তাৎপর্য সমূহ২৪
১০.১মত: শিক্ষা মূলক তাৎপর্য২৫
১১.২য়ত: শরঈ তাৎপর্য৩১
১২.৩য়ত: সামাজিক তাৎপর্য৩৭
১৩.আয়েশা রা. এর সাথে বিবাহ৩৮
১৪.হাফসা রা. সাথে বিবাহ৪০
১৫.৪র্থত: রাজনৈতিক তাৎপর্য৪২
১৬.জুওয়ায়রিয়া রা. এর সাথে বিবাহ৪২
১৭.সুফিয়া বিনতে হুয়াই রা. এর সাথে বিবাহ৪৫
১৮.উম্মে হাবীবা রা. এর সাথে বিবাহ৪৮
১৯.রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর  সহধর্মিণীগণ সম্পর্কে আলোচনা৫১
২০.রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পবিত্র স্ত্রীদের নাম৫৩
২১.খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ রা.৫৪
২২.সাওদা বিনতে যামআ রা.৫৯
২৩.আয়েশা বিনতে আবু বকর রা.৬০
২৪.হাফসা বিনতে ওমর রা.৬৪
২৫.যয়নব বিনতে খুযাইমা রা.৬৭
২৬.যয়নব বিনতে জাহাশ রা.৬৯
২৭.যায়েদ র. এর সাথে যয়নব রা. এর বিবাহ বিচ্ছেদ প্রসঙ্গে একটি বানোয়াট হাদীস৭০
২৮.যায়েদ র. এর সাথে যয়নব রা. এর বিবাহ বিচ্ছেদের প্রকৃত কারণ৭৩
২৯.উম্মে সালামা রা.৭৭
৩০.উম্মে হাবীবা রামলা বিনতে আবী সুফিয়ান রা.৮১
৩১.জুওয়াইরিয়া বিনতে হারেস রা.৮১
৩২.সুফিয়া বিনতে হুয়াই বিন আখতাব রা.৮১
৩৩.মাইমুনা বিনতে হারেস হেলালিয়া রা.৮২
৩৪.মোটকথা৮৪
সংক্ষিপ্ত লেখক পরিচিতি
 শাইখ মুহাম্মদ আলী সাবুনী। তাফসীর জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। বিখ্যাত সাফওয়াতুত তাফাসীর গ্রন্থের লেখক। তিনি ১৯৩০ সনে সিরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। মিসরের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করে পরবর্তীতে মক্কা মুকাররমা শারিয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ কলেজে দীর্ঘ ৩০ বছর অধ্যাপনা করেন। তারপর মক্কার উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে গবেষক হিসেবে নিয়োগ দান করা হয়। রাবেতা আলম আল ইসলামীতে কুরআনিক সাইন্স বিভাগের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন।
পবিত্র মসজিদে হারামে তার প্রাত্যাহিক দাসর হত। বিশেষ করে বিভিন্ন মওসুমে মসজিদে হারামে তিনি ফতোয়া প্রদান করতেন। জেদ্দার একটি মসজিদে তিনি তাফসীর বিষয়ে দীর্ঘ ৮ বছর নিয়মিত দরস দিয়েছেন। টেলিভিশনে প্রচারের জন্য তিনি তাফসীর বিষয়ে প্রায় ৬০০টি অনুষ্ঠান রেকর্ড করেছেন। এ জন্য সময় লেগেছে প্রায় দু বছর।
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে তার রচিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৩৩টি। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হল, তাফসীর বিষয়ক গ্রন্থ সাফওয়াতুত তাফাসীর।
বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা, বিশেষ করে তাফসীরের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান এবং ইসলামের খেদমতের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০৭ সালে আরব আমিরাত সরকারের পক্ষ থেকে তাকে ‘বছরের সেরা ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে এডওয়ার্ড প্রদান করা হয়।[1]
একটি সতর্কতা:
উল্লেখ্য যে, তাফসীর সহ ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে মুহাম্মদ আলী সাবুনীর অগাধ পাণ্ডিত্য থাকলেও আকীদা ও মানহাজগত ভাবে তার মাঝে বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হয়। এ ব্যাপারে আল্লামা বিন বায রহ. সহ অন্যান্য আলেমগণ তার প্রতিবাদ করেছেন। আকীদাগত ভ্রান্তির কারণে সউদী আরবে তার সফওয়াতুত তাফাসীর গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে যতদিন তা সংশোধন না করা হয়। তাই এ বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
আল্লাহ শাইখকে ক্ষমা করুন এবং সালফে-সালেহীনের আকীদা ও মানহাজ অনুযায়ী ইসলামের আরও বেশী খেদমত করার তাওফীক দান করুন । আমীন।

অনুবাদকের কথা
الحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله وبعد:
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর প্রেরিত দূত ও শেষ নবী। তিনি সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ঠ মহামানব এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-অঞ্চল-ভাষা নির্বিশেষে এক মহান অনুসরণীয়  আদর্শ ব্যক্তিত্ব। যে কোন মানুষ নিরপেক্ষ মন নিয়ে তাঁর পবিত্র ও সৌরভময় জীবনালেখ্য পাঠ করলে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে মনে কোন দ্বিধা থাকবে না।
কিন্তু বাস্তবতা হল, চিরকালই শ্রেষ্ঠ মানুষদের পেছনে এক শ্রেণীর হিংসুক ও চক্রান্তকারী লেগে থাকে। এরা তাঁদের সম্মান, মর্যাদা, খ্যাতি ও নেতৃত্বকে মেনে নিতে পারে না।
ইসলামের ইতিহাস সচেতন মনুষমাত্রই অবগত আছে যে, যুগে যুগে একশ্রেণীর হিংসুক নাস্তিক, মুনাফিক, ইহুদী ও খৃষ্টান চক্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য অসংখ্য জঘন্য পন্থা অবলম্বন করেছে। ওরা তাঁর গোলাপের মত নিষ্পাপ ও নির্মল চরিত্রকে কলুষিত করার হীন উদ্দেশ্যে তাঁর প্রতি নানা অমূলক অভিযোগের তীর ছুড়ে দিয়েছে। সেগুলোর মধ্যে একটি হল, তাঁর ‘একাধিক বিবাহ’কে কেন্দ্র করে। এ ব্যাপারে তারা বিভিন্ন খারাপ শব্দ প্রয়োগে তাঁর চরিত্রহনন করার পাশাপাশি তাঁর ব্যক্তিত্বকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, অনেক মুসলিমও এ সব অহেতুক সংশয় ও অভিযোগের জবাব না জানার কারণে সংশয়ের ঘূর্ণিপাকে পড়ে পথভ্রষ্ট হয়ে যায়।
আল হামদুলিল্লাহ যুগে যুগে দ্বীনের অতন্দ্র প্রহরী, ইসলামের কলম সৈনিক-যারা প্রিয় রাসূলকে নিজেদের জীবনের চেয়ে বেশী ভালবাসে-তারা চুপ করে বসে থাকে নি। বরং ঐ সব হিংসুক মিথ্যা অপবাদ আরোপকারীদের দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিয়েছেন।
সে ধারাবাহিকতায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ‘বহুবিবাহ’ সম্পর্কে আধুনিক যুগের ইসলাম বিদ্বেষী চক্রের এসব সংশয় ও অভিযোগের যথার্থ ও দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছেন আরব বিশ্বের স্বনামধন্য আলেমে দ্বীন ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক, বিখ্যাত তাফসীর বিশারদ শাইখ মুহাম্মদ আলী সাবুনী একটি মূল্যবান ছোট্ট বইয়ের মাধ্যমে। বইটির নাম:
شبهات و أباطيل حول تعدد زوجات الرسول صلى الله عليه وسلم
বইটির বাংলা অনুবাদের নাম দেয়া হল: ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বহুবিবাহ সম্পর্কে ইসলাম বিদ্বেষীদের অভিযোগের দাঁত ভাঙ্গা জবাব।’
এটি শাইখের লিখিত কোন বই নয় বরং তা  ১৩৯০ হিজরীর  যিলহজ্জ মোতাবেক ১৯৭১ খৃষ্টাব্দে মক্কা মুকাররমায় রাবেতা আলম আল ইসলামীর উদ্যোগে আয়োজিত হাজী সম্মেলনে প্রদত্ত তার  একটি বক্তৃতা সংকলন।
শাইখ মুহাম্মদ আলী সাবুনী উক্ত আলোচনায় অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিরুদ্ধে আরোপিত অভিযোগগুলো পেশ করে সেগুলোর খণ্ডন করেছেন। তারপর কখন কিভাবে কোন প্রেক্ষাপটে তিনি এ সব বিবাহ করেছিলেন, সেগুলোর উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য ফুটিয়ে তুলেছেন। পরিশেষ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এগারো জন জীবন সঙ্গিনীর প্রত্যেকের আলাদাভাবে মর্যাদা ও বিবাহের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন যা পাঠক ভিন্ন এক আমেজে দেখতে পাবেন ইনশাআল্লাহ।
উল্লেখ্য যে, বইটিতে পাঠকদের সুবিধার্থে বিভিন্ন স্থানে কিছু শিরোনাম সংযোজন করেছি যা মূল বইয়ে নেই।
সম্মানিত পাঠক মহোদয়ের নিকট অনুরোধ রইল, কোথাও কোন অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হলে অনুগ্রহ পূর্বক অনুবাদককে জানিয়ে বাধিত করবেন যেন তা সংশোধন করে নেয়া যায়।
পরিশেষ, মহান আল্লাহ যেন বইটিকে কেবল তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য কবুল করে নেন। প্রিয় নবীর ভালবাসায় সিক্ত এই কর্মটি যেন মূল লেখক, অনুবাদক ও সুধী পাঠকের জন্য পরকালের মুক্তির পাথেয় হয় সেই দুয়া করে শেষ করছি।
هَذَا وَصَلَّى اللهُ عَلَى نَبِيِّنَا مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِهِ وَصَحْبِهِ وَسَلَّم
বিনীত অনুবাদক:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব
তারিখ: ৮/১১/২০১৬ইং
+966571709362

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
ভূমিকা:
الْحَمْدُ لِلهِ وَالصَّلاَةُ وَالسَّلاَمُ عَلىَ رَسُوْلِ اللهِ أَمَّا بَعْدُ
আমি আপনাদেরকে আল্লাহর পক্ষ হতে বরকতময় পবিত্র ইসলামী অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি এবং প্রার্থনা করছি, তিনি যেন তাঁর সন্তুষ্টি ও ভালবাসার উপর ভিত্তি করে আমাদের হৃদয়গুলোকে একত্রিত করে দেন। আমাদেরকে সঠিক কাজ করার ও বলার ক্ষমতা দানের পাশাপাশি তাতে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা দান করেন। আরও দান করেন পূর্ণ ঈমান ও সুদৃঢ় বিশ্বাস। নিশ্চয় তিনি সব কিছু শ্রবণ করেন এবং বান্দাদের আহবানে সাড়া দেন।
প্রদীপ্ত সূর্য:
সম্মানিত ভ্রাতৃ মহোদয়,আপনারা কি দ্বিপ্রহরের উজ্জ্বল দীপ্তিমান সূর্য দেখেছেন যার সামনে কোন কিছুই বাঁধা সৃষ্টি করতে পারে না, যাকে মেঘমালা কিংবা কুয়াশা এসে ঢেকে রাখতে পারে না?
কেউ যদি ঐ সূর্যের আলো নিভিয়ে ফেলার বা দৃষ্টির আড়াল করার উদ্দেশ্যে মুখ দিয়ে ফুঁ দেয়া শুরু করে কিংবা গায়ের জামা খুলে সে দিকে মেলে করে ধরে তবে কি সূর্যের আলো নিভে যাবে বা চোখের আড়ালে চলে যাবে? না, কখনই না।
ঠিক তেমনই আমাদের এই সূর্য যার আলোচনা আমরা একটু পরে করব।
আপনাদেরকে ঐ আকাশের সূর্যের কথা বলছি না;বলছি মাটির সূর্যের কথা! আমরা এমন সূর্যের কথা আলোচনা করছি না যা প্রচণ্ড উত্তাপে সব কিছু ঝলসে করে দেয় বরং আলোচনা করছি এমন সূর্যের কথা যা তার ঝলমল আলোয় চতুর্দিক উদ্ভাসিত করে তোলে। এবার চিনতে পেরেছেন কে এই সূর্য?
হ্যাঁ,তা হল নবুওয়তের সূর্য। রিসালাতের সূর্য। অনাবিল হেদায়েত,অফুরন্ত জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সূর্য। এটি হল,উজ্জ্বল ঝকঝকে আলো,প্রজ্বলিত প্রদীপ যার মাধ্যমে মহীয়ান আল্লাহ মানব জীবনের দুর্ভাগ্যের কালিমাকে মুছে দিয়ে মানুষকে বের করে আনেন অন্ধকার হতে আলোর পথে।
সেই সূর্য প্রিয়নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ব্যক্তি সত্তা।
মহান আল্লাহ যথার্থই বলেছেন:
يُرِيدُونَ لِيُطْفِئُوا نُورَ اللَّـهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَاللَّـهُ مُتِمُّ نُورِهِ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ –هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَىٰ وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ
“তারা মুখের ফুঁ দিয়ে আল্লাহর আলো নিভিয়ে দিতে চায়। অথচ আল্লাহ তাঁর আলোকে পূর্ণরূপে বিকশিত করবেন যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে। তিনি তার রাসূলকে হেদায়াত এবং সঠিক দ্বীন সহকারে প্রেরণ করেছেন যেনঅন্যান্য সকল ধর্ম ও মতাদর্শের উপর তাকে বিজয়ী করতে পারেন-যদিও মুশরিকরা তাতে নাখোশ।” (সূরা আস সফ: ৮-৯)
আমরা এখন এ মাটির সূর্য নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি যার ব্যাপারে মহাগ্রন্থ আল কুরআনে অপূর্ব প্রাঞ্জল ভাষায় বলা হয়েছে,
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا وَدَاعِيًا إِلَى اللَّـهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجًا مُّنِيرًا
“(হে নবী) আমি তোমাকে প্রেরণ করেছি সাক্ষী,সুসংবাদদাতা,সতর্ককারী আল্লাহর অনুমতিক্রমে তার প্রতি আহ্বানকারী এবং উজ্জ্বল প্রদীপ স্বরূপ।” (সূরা আহযাব: ৪৪ ও ৪৫)
এখানে ‘উজ্জ্বল প্রদীপ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল নবুওয়তের সূর্য যা তার উজ্জ্বল দীপ্তি এবং কিরণ দ্বারা বিশ্বচরাচরকে আলোর বন্যায় প্লাবিত করে দেয়। চক্ষুষ্মান লোকেরা তা দেখতে পায় কিন্তু অন্ধরা দেখতে পায় না।
কবি বলেন:
মর্যাদার নীল আকাশে সূর্য মোদের দীপ্তিমান।
অন্ধ যদি দেখতে না পায় কিরণ কি তার হয়রে ম্লান?
ইসলামের দুশমনরা রিসালাতের ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তার মানহানির অপচেষ্টায় রত রয়েছে যাতে মুমিনগণ দ্বীনের ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে তার রিসালাতের প্রতি ঈমান থেকে দূরে সরে যায়।
অবশ্য নবী-রসূলগণের উপর এ ধরণের মিথ্যা,বানোয়াট, বিভ্রান্তি মূলক অভিযোগ শুনতে পাওয়ায় হতবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ সৃষ্টি জগতে এটাই আল্লাহর রীতি। আল্লাহর রীতির কোন পরিবর্তন হয় না।
আল্লাহ তাআলা সত্য কথাই বলেছেন:
وَكَذَٰلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا مِّنَ الْمُجْرِمِينَ ۗ وَكَفَىٰ بِرَبِّكَ هَادِيًا وَنَصِيرًا
“এভাবেই প্রত্যেক নবীর জন্যে আমি অপরাধীদের মধ্য থেকে শত্রু সৃষ্টি করেছি। আপনার জন্যে আপনার পালনকর্তা পথপ্রদর্শক ও সাহায্যকারী রূপে যথেষ্ট।” (আল ফুরকান: ৩১)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বহু বিবাহ সম্পর্কে ইসলাম বিদ্বেষীদের অভিযোগ এবং সেগুলোর জবাব:
মুমিনদের মা প্রিয় নবীর পবিত্র সহধর্মিনীদের আলোচনা এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে বিবাহ করার পেছনে কী রহস্য ও তাৎপর্য লুকায়িত রয়েছে সে সম্পর্কে আলোকপাত করার পূর্বে পশ্চাত্যের গোঁড়া হিংসুক ক্রুসেডাররা যে সকল সংশয় উস্কে দিচ্ছে সেগুলোর জবাব দিতে চাই।
এরা মুসলিমদের ঈমান-আকীদা নষ্ট করার জন্য এবং বাস্তবতাকে ধামাচাপা দিয়ে সর্বকালের সেরা ব্যক্তিত্ব প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মানহানির হীন উদ্দেশ্যে এ সংশয়গুলো ব্যাপকভাবে প্রচার করে যাচ্ছে। যথা:
১) ওরা বলছে, মুহাম্মদ ছিলেন একজন কামুক লোক। তিনি ছিলেন কাম ও কু প্রবৃত্তি পুজারী। একজন স্ত্রী তার জন্য যথেষ্ট ছিল না। এমন কি চারজনও নয়। অথচ তিনি কি না তার অনুসারীদের উপর সর্বোচ্চ চারজন স্ত্রী গ্রহণ আবশ্যক করেছেন আর তিনি নিজে কু প্রবৃত্তি এবং লালসার বশবর্তী হয়ে দশ বা ততোধিক স্ত্রী গ্রহণ করেছেন! (নাউযুবিল্লাহ)
২) তারা আরও বলছে, ঈসা এবং মুহাম্মাদ এর মাঝে বিশাল পার্থক্য রয়েছে! ঈসা জীবন যাপন করেছেন প্রবৃত্তির কামনা-বাসনাকে দমন করে-আত্মসংযমী হয়ে (অবিহবাহিত অবস্থায়)। পক্ষান্তরে মুহাম্মদ ছুটে বেড়িয়েছেন কু প্রবৃত্তি এবং লালসার পেছনে!! (নাউযুবিল্লাহ)
كَبُرَتْ كَلِمَةً تَخْرُجُ مِنْ أَفْوَاهِهِمْ ۚ إِن يَقُولُونَ إِلَّا كَذِبًا
“এ এক সাংঘাতিক কথা যা তাদের মুখ থেকে নির্গত হয়। তারা যা বলে তা তো সবই মিথ্যা।।” (সূরা কাহাফ: ৫)
জবাব:
সত্যিই এ সব লোক মারাত্মক মিথ্যাচারী এবং হিংসুটে! মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কামুক পুরুষ ছিলেন না; তিনি ছিলেন একজন মানুষ-আল্লাহর দূত। অন্যান্য মানুষ যেভাবে বিবাহ করেন তিনিও করেছেন। যেন তিনি সঠিক পথ অবলম্বনের ক্ষেত্রে হতে পারেন মানবতার অনুসরণীয়-অনুকরণীয়।
তিনি ঈশ্বর নন,ঈশ্বরের পুত্রও নন যেমনটি খৃষ্টানরা তাদের নবী ঈসা আলাইহিস সালাম এর ব্যাপারে বিশ্বাস করে থাকে! বরং তিনি অন্যান্য মানুষের মতই একজন মানুষ। পার্থক্য এই যে, আল্লাহ তাঁকে ওহী এবং রিসালাতের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন। আল্লাহ বলেন:
قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يُوحَىٰ إِلَيَّ
“(হে নবী আপনি বলে দিন যে) আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ-আল্লাহ আমার কাছে ওহী আগমন করে।” (সূরা কাহাফ: ১১০)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্যান্য নবীদের থেকে ভিন্নতর ছিলেন না যে তিনি তাদের নীতি লঙ্ঘন করবেন কিংবা তাদের অনুসৃত পথের বাইরে যাবেন।
তার পূর্বের রাসূলদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন:
لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلًا مِّن قَبْلِكَ وَجَعَلْنَا لَهُمْ أَزْوَاجًا وَذُرِّيَّةً
“আমি তো তোমার পূর্বে অনেক রসূল প্রেরণ করেছিলাম এবং তাদেরকে স্ত্রী এবং সন্তান-সন্ততি দিয়েছিলাম।” (সূরা রা’দ: ৩৮)
সুতরাং কিসের ভিত্তিতে এরা খাতামুল আম্বিয়া মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর এ ধরণের অপবাদের ঝড় তুলছে?!
অবশ্য কবি বলেছেন:
রোগ যদি হয় চোখের মাঝে রবির কিরণ মিথ্যা নয়।
মুখের ভিতর রোগ থাকিলে পানির সাধও লুপ্ত হয়।
আর আল্লাহ তাআলা যথার্থই বলেছেন:
فَإِنَّهَا لَا تَعْمَى الْأَبْصَارُ وَلَـٰكِن تَعْمَى الْقُلُوبُ الَّتِي فِي الصُّدُورِ
“বস্তুত: চোখ তো আদৌ অন্ধ নয়,কিন্তু অন্ধ হচ্ছে হৃদয় যা রয়েছে বুকের ভেতরে।” (সূরা হজ্জ: ৪৬)

ইসলাম বিদ্বেষীদের জবাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ দুটি পয়েন্ট:
এ মর্মে দুটি পয়েন্ট উল্লেখ করব যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ব্যাপারে সংশয়গুলো নিরসন করবে আর সে সব পাপিষ্ঠ মিথ্যুকদের মুখে পাথর ছুড়ে মারবে যারা প্রাণ প্রিয় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মান-মর্যাদা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। (আমি যখন এই বইয়ের শেষ দিকে উম্মাহাতুল মুমেনীন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সহধর্মিনী ও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বহু বিবাহ সম্পর্কে আলোচনা করবে তখন উক্ত পয়েন্ট দুটি আমাদের সামনে রাখা আবশ্যক)
১ম পয়েন্ট:
বার্ধক্যে উপনীত হওয়ার পূর্বে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একাধিক বিবাহ করেন নি। অর্থাৎ তাঁর জীবনের ৫০ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর তিনি একাধিক বিবাহ করেছেন।
২য় পয়েন্ট:
আয়েশা রা. ছাড়া তার সকল সহধর্মিণী ছিলেন বিবাহিতা বা বিধবা। তাদের মধ্যে একমাত্র আয়েশা রা. কে তিনি কুমারী অবস্থায় বিবাহ করেছিলেন।
এ দুটি পয়েন্টের মাধ্যমেই আমরা সুস্পষ্ট ভাবে জানতে পারছি যে, হিংসুক ও উম্মাদ খৃষ্টানরা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি যে অপবাদ আরোপ করে থাকে তা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত,অর্থহীন এবং অমূলক।
লালসা চরিতার্থ, প্রবৃত্তির তাড়না এবং শুধু নারী ভোগের বাসনায় যদি তিনি বিবাহ করতেন তাহলে তিনি যৌবন বয়সে বিবাহ করতেন; বার্ধক্য বয়সে নয়। কুমারী ও তরুণীদের বিবাহ করতেন;বিধবা নারীদের নয়।
অথচ প্রখ্যাত সাহাবী জাবের রা. যখন তার কাছে আসলেন তখন তার মুখমণ্ডলে সুগন্ধি ব্যবহারের চিহ্ন দেখে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন: বিবাহ করেছ নাকি?
জাবের রা.: জি, হ্যাঁ।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: কুমারী না বিবাহিতা?
জাবের রা.: বিবাহিতা।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: “কুমারী বিবাহ করলে না কেন?! যদি করতে তাহলে তোমরা একে অন্যের সাথে খেলা-ধুলা ও হাস্যরস মূলক কথাবার্তা বলতে পারতে!” (সহীহ বুখারী, কিতাবুন নিকাহ)
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জাবের রা. কে কুমারী নারী বিবাহ করার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।
এতে প্রমাণিত হল, নারী সম্ভোগ এবং প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণের পন্থা তাঁর জানা ছিল।
সুতরাং তার উদ্দেশ্য যদি থাকত শুধু নারী সম্ভোগ এবং প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ তাহলে কি তিনি কুমারীদের ছেড়ে বিধবা নারীদের বিবাহ করতেন? না কি যৌবন পার করে এসে বার্ধক্যে এসে বিবাহ করতেন?
সাহাবীগণ রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্য তাদের দেহ-প্রাণ বিসর্জন দিতেও দ্বিধা করতেন না। সুতরাং তিনি চাইলে কি কেউ তাদের নব যৌবনা সুন্দরী কন্যাদেরকে তার সাথে বিবাহ দিতে পিছিয়ে থাকতেন?!
অতএব কেন তিনি জীবনের প্রথম লগ্নে যৌবনের সবুজ বসন্তে বিবাহ করলেন না? কেনই বা তরুণীদেরকে বিবাহ করলেন না? বিবাহ করলেন তালাক প্রাপ্তা ও বিধবা নারীদের?!
নি:সন্দেহে এ বিষয়টি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর আরোপিত সকল মিথ্যা অভিযোগ, সংশয় ও সন্দেহ বিদূরিত করে দেয় এবং দাঁত ভাঙ্গা জবাব দেয় ঐ সকল পাপিষ্ঠ মিথ্যাচারীদের যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পবিত্রতাকে মলিন করতে চায়-কলঙ্কিত করতে চায় তাঁর নিষ্কলঙ্ক সত্তাকে।
সুতরাং রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিবাহ কুপ্রবৃত্তি বা লালসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে ছিল না বরং এর পেছনে ছিল অতি উন্নত ও মহৎ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য। ছিল বিচক্ষণতার পরিচয় যা তাঁর চরম দুশমনরাও স্বীকার করতে বাধ্য হবে যদি তারা অন্ধ গোঁড়ামি ত্যাগ করে বিবেক দিয়ে বিচার করে। এরা যুক্তি ও বিবেক দ্বারা চিন্তা করলে দয়ার মূর্ত প্রতীক রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এ সব বিবাহের মাঝে খুঁজে পাবে এক ‘উন্নততর আদর্শ’। যিনি মানুষের কল্যাণ, দ্বীনের দাওয়াত ও ইসলামের স্বার্থে নিজের আরাম-আয়েশ অকাতরে বিলিয়ে দিতেন।

বহু বিবাহের তাৎপর্য সমূহ:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর একাধিক বিবাহ করার পেছনে পরিতৃপ্ত হওয়ার মত অনেক তাৎপর্য সন্নিহিত রয়েছে সেগুলো আমরা কয়েকটি পয়েন্টে উল্লেখ করতে পারি। যথা:
  • ১মত: শিক্ষা মূলক তাৎপর্য
  • ২য়ত: শরঈ তাৎপর্য
  • ৩য়ত: সামাজিক তাৎপর্য
  • ৪র্থত: রাজনৈতিক তাৎপর্য
প্রথমত: আমরা উল্লেখিত চারটি তাৎপর্য সংক্ষিপ্তভাবে বিশ্লেষণ করব। অতঃপর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সহধর্মিনীদের জীবনীর উপর আলোকপাত করত: তাদের প্রত্যককে বিবাহ করার পেছনে কী কারণ নিহিত ছিল তা আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করার প্রয়াস পাব (ইনশাআল্লাহ)।
আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করে এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করছি।

১মত: শিক্ষা মূলক তাৎপর্য
রাসূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর একাধিক বিবাহের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল নারী জগতের জন্য কতিপয় শিক্ষক তৈরি করা, যারা তাদেরকে শরীয়তের বিভিন্ন বিধিবিধান শিক্ষা দিবেন। কারণ নারীরা সমাজের অর্ধেক। ইসলামী শরীয়তে পুরুষের উপর যেমন অনেক দায়িত্ব অপরিহার্য করা হয়েছে তেমনি করা হয়েছে নারীদের উপরও।
এমন অনেক নারী ছিল যারা প্রিয় সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট শরীয়তের বিভিন্ন হুকুম-আহকাম-বিশেষ করে নারী সম্পর্কীয় বিষয়াদি (যেমন ঋতুস্রাব,বাচ্চা প্রসব জনিত রক্তপাত,অপবিত্রতা,দাম্পত্য জীবন ইত্যাদি ) বিধিবিধান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে দারুন লজ্জাবোধ করতেন। এ সব মাসআলা-মাসায়েল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট জিজ্ঞেস করতে এসে তারা লজ্জায় চুপসে যেত।
অন্যদিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও ছিলেন লাজুক প্রকৃতির। যেমনটি বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন পর্দার অন্তরালের কুমারী বালিকার চেয়েও বেশী লাজুক।” (সহীহুল বুখারী, মানাকিব অধ্যায়)
ফলে মহিলাদের নিকট থেকে উত্থাপিত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর তিনি খোলাখুলি ভাবে দিতে পারতেন না বরং কখনও কখনও পরোক্ষভাবে উত্তর দিতেন। এ কারণে অনেক সময় তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উদ্দেশ্য বুঝে উঠতে পারত না।
আয়েশা রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন: এক আনসারী মহিলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে ঋতুস্রাবের গোসল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে কীভাবে গোসল করবে তা শিক্ষা দিতে গিয়ে বলেন:
“এক খণ্ড সুগন্ধযুক্ত কাপড় নিয়ে তা দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করবে।”
সে বলল, এটা দ্বারা কিভাবে পবিত্রতা অর্জন করব?
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: “এটা দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করবে।”
 সে আবার বলল, হে আল্লাহর রাসূল,আমি এটা দ্বারা কীভাবে পবিত্রতা অর্জন করব?
তিনি বললেন: “সুবহানআল্লাহ! এটার মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করবে।”
আয়েশা রা. বলেন: অতঃপর আমি তার হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে বললাম, এই এই স্থানে কাপড় খণ্ডটি রাখবে এবং রক্তের চিহ্ন মুছে ফেলবে। অতঃপর তিনি স্থানটা স্পষ্ট ভাবে তাকে বুঝিয়ে দিলেন। (সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ঋতুস্রাব)
এ ধরণের বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে বিবরণ দিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত লজ্জাবোধ করতেন।
অনুরূপভাবে খুব কম মহিলাই লজ্জা কাটিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে খোলাখুলি প্রশ্ন করতে পারত।
বুখারী মুসলিমে বর্ণিত উম্মে সালামা রা. বর্ণিত হাদীসটিকে আমরা উদাহরণ হিসেবে নিতে পারি। তিনি (উম্মে সালামা রা.) বলেন: একদা উম্মে সুলাইম (তালহার রা. এর স্ত্রী) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এসে বললেন: হে আল্লাহর রাসূল, আল্লাহ তো সত্য কথার ব্যাপারে লজ্জা বোধ করেন না। তো কোন মহিলার যদি স্বপ্নদোষ হয় তবে কি তাকে গোসল করতে হবে?
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: “হ্যাঁ, যদি সে পানি দেখতে পায়।”
এ কথা শুনে মহিলারা হেসে উঠলেন।
উম্মে সালামা রা. বলেন: হায় আফসোস! মহিলাদের কি স্বপ্নদোষ হয় না কি?
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: তা নাহলে কিভাবে সন্তান মায়ের মত হয়?
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উদ্দেশ্য হল,গর্ভস্থ সন্তান সৃষ্টি হয় পুরুষ ও নারীর বীর্য থেকে। আর এ কারণেই সন্তানদের আকৃতি মায়ের মত হয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলাও ঠিক এরূপই বলেছেন:
إنَّا خَلَقْنَا الْإِنسَانَ مِن نُّطْفَةٍ أَمْشَاجٍ نَّبْتَلِيهِ فَجَعَلْنَاهُ سَمِيعًا بَصِيرًا
“আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মিশ্র শুক্র বিন্দু থেকে এভাবে যে, তাকে পরীক্ষা করব। অতঃপর তাকে করে দিয়েছি শ্রবণ ও দৃষ্টি শক্তি সম্পন্ন।” (সূরা দাহর/ইনসান:২)
ইবনে কাসীর রহ. এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন: أَمْشَاج শব্দের অর্থ: মিশ্রণ। একটি বস্তু আরেকটির সাথে মিশ্রিত থাকলে তাকে المشجঅথবা المشيج বলা হয়।
ইবনে আব্বাস রা. বলেন: “আয়াতের উদ্দেশ্য হল, পুরুষ ও নারীর বীর্য যখন একত্রিত হয় এবং উভয়টির মিশ্রণ ঘটে।”
পরবর্তীতে এ ধরণের বিভভভকক  ভিন্ন জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর  সহধর্মিণীগণ ।
আয়েশা রা. বলতেন,
رحم الله نساء الأنصار لم يمنعهن الحياء أن يسألن عن أمر دينهن
“আল্লাহ আনসারী মহিলাদের প্রতি রহম করুন! লজ্জা তাদেরকে দ্বীনের বিষয়ে জ্ঞানার্জনে বাধা দেয় না।” (সহীহ বুখারী, পবিত্রতা অধ্যায়)
কোন কোন মহিলা রাত আঁধারে দ্বীনের বিভিন্ন বিষয় যেমন, প্রসূতি,অপবিত্রতা ইত্যাদি হুকুম-আহকাম জানার জন্য আয়েশা রা. এর নিকট আসতেন। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পবিত্র  সহধর্মিণীগণ ছিলেন মহিলা বিষয়ক চমৎকার শিক্ষক ও দিক নির্দেশনা দান কারিণী।
এভাবেই তাঁদের নিকট থেকে মুসলিম নারীগণ দ্বীনী বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেছেন।
আর এ কথাও সত:সিদ্ধ যে,সুন্নাহ কেবল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণীকেই বলা হয় না বরং তাঁর কথা,কাজ এবং সম্মতির সমষ্টির নাম হল সুন্নাহ। এ সবগুলোই শরীয়তের অন্তর্ভুক্ত এবং উম্মতের জন্য অপরিহার্য পালনীয়।
সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সহধর্মিণীগণ ব্যতিরেকে তাঁর গৃহ অভ্যন্তরের কার্যক্রম ও নানা তথ্যাদি সম্পর্কে আমাদেরকে কে  অবহিত করতো?
তাঁর পবিত্র জীবন সঙ্গিনীদের মধ্য হতে অনেকেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পক্ষ থেকে মুসলিম জাতির নিকট হেদায়েতের বাণী পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষক এবং মুহাদ্দিসের ভূমিকা পালন করেছেন। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাদের অনেকেই স্মৃতিশক্তি, মেধা ও প্রতিভায় খ্যাতি লাভ করেছেন।

২য়ত: শরঈ তাৎপর্য
এখন আমরা শরঈ তাৎপর্য সম্পর্কে আলোচনা করব যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বহু বিবাহের অন্যতম তাৎপর্যের অংশ। এ বিষয়টি খুব সহজেই উপলব্ধি করা সম্ভব।
এ সব বিবাহের পেছনে অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল, তৎকালীন আরব সমাজের কিছু নিন্দনীয় রীতি-নীতির বিলোপ সাধন করা।
উদাহরণ স্বরূপ, পালক পুত্রকে ঔরসজাত পূত্রের মত মনে করা। এটি ইসলামপূর্ব যুগ থেকে আরবরা তাদের বাপ-দাদা থেকে প্রাপ্ত ধর্মীয় কুসংস্কার হিসেবে মেনে আসছিলো।
তারা নিজের ঔরসজাত সন্তান নয় এমন কাউকে পালকপুত্র বানিয়ে সম্পদের উত্তরাধিকার,বিবাহ, তালাক ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে প্রকৃত ঔরসজাত পুত্রের মনে করত। নিতান্ত অন্ধ অনুসরণের বশবর্তী হয়ে তারা এ কুপ্রথা পালন করে আসত। জাহেলী যুগে একজন আরেকজনের সন্তানকে নিজের সন্তান হিসেবে ধরে নিয়ে বলত, “তুমি আমার ছেলে। আমি তোমার উত্তরাধিকার হব আর তুমি আমার উত্তরাধিকার হবে।”
ইসলাম তাদের এই অন্যায়ের স্বীকৃতি দিতে পারে না আবার বিষয়টিকে অন্ধকারের মধ্যেও ঘুরপাক খেতে দিতে চায় না। তাই আল্লাহর পক্ষ থেকে ইলহামের ভিত্তিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরবদের রীতি অনুযায়ী পোষ্যপুত্র গ্রহণ করলেন। এটা নবুওয়তের পূর্বের ঘটন। সেই পোষ্যপুত্রের নাম যায়েদ বিন হারেসা।
যায়েদ বিন হারেসাকে পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণের পেছনে একটি চমকপ্রদ ঘটনা রয়েছে যা মুফাসসিরগণ এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সীরাত লেখকগণ আলোচনা করেছেন। পুস্তকের কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় এখানে তা উল্লেখ করা হল না।
যাহোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যায়েদ বিন হারেসাকে পালক পুত্র বানানোর পর থেকে মানুষ তাকে ‘মুহাম্মদের ছেলে’ বলে ডাকতে লাগলো।
প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন ওমর রা. হতে সহীহ বুখারী ও মুসলিম একটি হাদীস উল্লিখিত হয়েছে। সেটি হল:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর গোলাম যায়েদ বিন হারেসাকে যায়েদ বিন মুহাম্মদ বা মুহাম্মদের পুত্র যায়েদ বলে ডাকতাম। একপর্যায়ে কুরআনের আয়াত নাজিল হল,
ادْعُوهُمْ لِآبَائِهِمْ هُوَ أَقْسَطُ عِندَ اللَّـهِ
“তোমারা তাদেরকে তাদের পিতৃ পরিচয়ে ডাক। এটাই আল্লাহর কাছে ন্যায় সঙ্গত।” (সূরা আহযাব: ৫)
এই আয়াত নাজিলের পরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যায়েদ রা. কে লক্ষ্য করে বললেন: “তুমি যায়েদ বিন হারেসা বিন শুরাহবিল।”
অতঃপর তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ফুফাতো বোন যয়নব বিনতে জাহাশ রা. এর সাথে বিয়ে দিলেন। বিয়ের পর তারা অল্প কিছু দিন ঘর-সংসার করলেন কিন্তু দাম্পত্য জীবন বেশী দিন টিকল না। উভয়ের মাঝে সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠল। যয়নব রা. যায়েদ রা. কে কঠোর ভাষায় কথা বলতেন এবং নিজেকে তার চেয়ে সম্ভ্রান্ত ভাবতেন। কারণ যায়েদ ছিলেন কৃতদাস যাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেছেন। পক্ষান্তরে তিনি (যয়নব রা.) ছিলেন সম্ভ্রান্ত বংশীয় নারী।
ফলে যায়েদ রা. তাকে তালাক প্রদান করলে মহান আল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নির্দেশ দিলেন যয়নবকে বিবাহ করার জন্য। উদ্দেশ্য হল, ‘পোষ্যপুত্রের স্ত্রীকে বিবাহ করা যাবে না’ মর্মে জাহেলী যুগের কুপ্রথাকে ভেঙ্গে ইসলামে এর বৈধতার ভিত্তি স্থাপন করা।
কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক শ্রেণীর লম্পট ও মুনাফিকদের ব্যাপারে আশঙ্কা করতেন যে,তারা এ ব্যাপারে সমালোচনার ঝড় তুলবে। তারা বলে বেড়াবে যে, মুহাম্মদ তার পুত্রবধূকে বিবাহ করেছে! তিনি এমন সংশয় এবং আশঙ্কার দোলায় দোল খাচ্ছিলেন এমন সময় আল্লাহ রব্বুল আলামীন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে লক্ষ্য করে কঠোর ভাষায় তিরস্কার করলেন এই বলে:
وَتَخْشَى النَّاسَ وَاللَّـهُ أَحَقُّ أَن تَخْشَاهُ ۖ فَلَمَّا قَضَىٰ زَيْدٌ مِّنْهَا وَطَرًا زَوَّجْنَاكَهَا لِكَيْ لَا يَكُونَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ حَرَجٌ فِي أَزْوَاجِ أَدْعِيَائِهِمْ إِذَا قَضَوْا مِنْهُنَّ وَطَرًا ۚ وَكَانَ أَمْرُ اللَّـهِ مَفْعُولًا
“আর আপনি লোক নিন্দার ভয় করছিলেন অথচ আল্লাহকেই অধিক ভয় করা উচিৎ। অতঃপর যায়েদ যখন যয়নবের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করল তখন আমি তাকে আপনার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করলাম যাতে মুমিনদের পোষ্যপুত্ররা তাদের স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলে সে সব স্ত্রীকে বিবাহ করার ব্যাপারে মুমিনদের কোন অসুবিধা না থাকে। আল্লাহর নির্দেশ কার্যে পরিণত হয়েই থাকে।” (সূরা আহযাব: ৩৭)
এ ভাবেই পোষ্যপুত্রের বিধানটির সমাপ্ত ঘটল এবং অজ্ঞতার যুগের এই কুপ্রথাটি বাতিল হল যা ছিল অন্ধভাবে পালিত তাদের একটি ধর্মীয় রীতি।
অত:পর নতুন এই শরীয়তের বিধানটিকে শক্তিশালী করার নিমিত্তে নাযিল হল এই আয়াতটি:
ماَ كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِّن رِّجَالِكُمْ وَلَـٰكِن رَّسُولَ اللَّـهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ ۗ وَكَانَ اللَّـهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا
“মুহাম্মদ তোমাদের কোন পুরুষ (প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ) এর পিতা নন;বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং সর্বশেষ পয়গম্বর। আল্লাহ সবকিছুই পরিজ্ঞাত।” (সূরা আহযাব: ৪০)
মোটকথা, এ বিবাহটি ছিল মহান আল্লাহ তাআলার নির্দেশ ক্রমে। এর পেছনে কোন পার্থিব লোভ-লালসা বা প্রবৃত্তির তাড়না ছিল না যেমনটি আল্লাহর দুশমন মিথ্যুকেরা অভিযোগ করে থাকে। বরং এ বিবাহ ছিল এক মহৎ উদ্দেশ্যে। আর সেটি হল একটি জাহেলী কুপ্রথার বিলুপ্তি সাধন।
আল্লাহ তাআলা এ বিবাহের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন:
زَوَّجْنَاكَهَا لِكَيْ لَا يَكُونَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ حَرَجٌ فِي أَزْوَاجِ أَدْعِيَائِهِمْ إِذَا قَضَوْا مِنْهُنَّ وَطَرًا ۚ وَكَانَ أَمْرُ اللَّـهِ مَفْعُولًا
“যাতে মুমিনদের পোষ্যপুত্ররা তাদের স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলে সে সব স্ত্রীকে বিবাহ করার ব্যাপারে মুমিনদের কোন অসুবিধা না থাকে। আল্লাহর নির্দেশ কার্যে পরিণত হয়েই থাকে।” (সূরা আহযাব: ৩৭)
ইমাম বুখারী রা. তার সনদ সহকারে বর্ণনা করেছেন, যয়নব রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অন্যান্য পত্নীদের উপর গর্ব করে বলতেন,
زَوَّجَكُنَّ أَهَالِيكُنَّ وَزَوَّجَنِي اللَّهُ مِنْ فَوْقِ سَبْعِ سَمَوَاتٍ
“তোমাদের বিবাহ দিয়েছে তোমাদের পরিবারবর্গ কিন্তু আমার বিবাহ দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা সাত আসমানের উপর থেকে।” (সহীহ বুখারী, কিতাবুত তাওহীদ)
এভাবেই ইসলামী শরীয়তের একটি বিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে মহাপ্রকৌশলী মহাজ্ঞানী আল্লাহর নির্দেশে এ বিবাহ সংঘটিত হয়েছিল।
সুতরাং পবিত্রতা ঘোষণা করছি সেই মহান সত্তার যার কৌশল অতি নিপুণ যা মানবিক জ্ঞান-বুদ্ধি দ্বারা অনুধাবন করা সম্ভব নয়। আল্লাহ যথার্থই বলেছেন:
 وَمَا أُوتِيتُم مِّنَ الْعِلْمِ إِلَّا قَلِيلًا
“তোমাদেরকে খুব কম জ্ঞান দান করা হয়েছে।” (সূরা ইসরা: ৮৫)

৩য়ত: সামাজিক তাৎপর্য
তৃতীয় তাৎপর্যটি হল সামাজিক তাৎপর্য। বিষয়টি সুস্পষ্ট হয় আল্লাহর রাসূলের ১ম মন্ত্রী সিদ্দীকে আকবর আবু বকর রা. এর কন্যা, অতঃপর ২য় মন্ত্রী উমর ফারুক রা. এর কন্যার সাথে তার পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার মধ্য দিয়ে। সেই সাথে কুরাইশদের সাথে আল্লাহর রাসুলের বৈবাহিক ও বংশীয় সম্পর্ক গড়ে তোলার মধ্য দিয়েও বিষয়টি পরিষ্কার হয়। কেননা, তিনি কুরাইশ গোত্রের বেশ কয়েকজন নারীকে বিবাহ করেছিলেন।  ফলে এ বৈবাহিক ও বংশীয় সম্পর্কের মাধ্যমে বিভিন্ন গোত্র-উপগোত্রের মাঝে গড়ে উঠেছিল এক নিবিড় সখ্যতা ও বন্ধন। শুধু তাই নয় এতে করে তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শনের পাশাপাশি  তার দাওয়াতের দিকে ধাবিত হয়েছিলেন।
নিম্নে এ বিষয়ে দুটি উদারহণ পেশ করা হল:
এক. আয়েশা রা. এর সাথে বিবাহ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আয়েশা রা. এর সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন। যিনি ছিলেন তার প্রিয়তম সাহাবী এবং সম্মানিত বন্ধু আবু বকর সিদ্দীক রা. এর কন্যা। ‌আবু বকর রা. সর্ব প্রথম ইসলাম গ্রহন করে আল্লাহর দ্বীনের সাহায্যার্থে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতিরক্ষায় নিজের দেহ-প্রাণ, অর্থ-সম্পদ সব কিছু উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন আর ইসলামের পথে শিকার করেছিলে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা।
যেমন সুনান তিরমিযীতে বর্ণিত হয়েছে,আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকর রা. এর মর্যাদাকে সমুন্নত করতে গিয়ে বলেছেন:
مَا لأَحَدٍ عِنْدَنَا يَدٌ إِلا كَافَأْنَاهُ مَا خَلا أَبَا بَكْرٍ فَإِنَّ لَهُ عِنْدَنَا يَدًا يُكَافِئُهُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مَا نَفَعَنِي مَالٌ قَطُّ مَا نَفَعَنَي مَالُ أَبِي بَكْرٍ
“আমাদের প্রতি যেই সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে আমরা তাকে তার প্রতিদান দিয়ে দিয়েছি কেবল আবু বকর ব্যতিরেকে। কেননা তিনি আমাদের প্রতি এমনভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন যার প্রতিদান মহান আল্লাহ  তাকে কিয়ামতের দিন প্রদান করবেন। আবু বকরের সম্পদ আমার যত উপকার করেছে অন্য কারও সম্পদ ততটা করে নি।” (সুনান তিরমিযী, মিশকাত/কিতাবুল মানাকিব। আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত)
তিনিআরও বলেছেন:
“আমি যার কাছেই ইসলাম পেশ করেছি আবু বকর ছাড়া সকলেই কিছুটা ইতস্তত: করেছে। তিনি এতটুকুও ইতস্তত: করেন নি। আমি যদি কাউকে খলিল বা অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতাম তাহলে আবু বকরকেই করতাম। জেনে রাখো, তোমাদের সাথী (আল্লাহর রাসূল) আল্লাহর খলিল বা অন্তরঙ্গ বন্ধু। (তিরমিযী)
সুতরাং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকর রা. এর মেয়ে (আয়েশা রা.) কে বিবাহ করে তার চক্ষু শীতল করবেন। তাদের মাঝে বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয়তা সৃষ্টি হবে এবং পারস্পারিক বন্ধুত্ব ও ভালবাসা আরও দৃঢ়তর হবে-এর চেয়ে দুনিয়াতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পক্ষ থেকে আবু বকর রা. এর প্রতি বড় প্রতিদান আর কী হতে পারে?
দুই. হাফসা রা. সাথে বিবাহ
অনুরূপভাবে,আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওমর রা. এর প্রাণপ্রিয় কন্যা হাফসা রা. এর সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন। এ বিবাহ ছিল ওমর রা. এর জন্য তার ইসলাম গ্রহন,সততা,নিষ্ঠা এবং দ্বীনের রাস্তায় নিজেকে বিলেয়ে দেয়ার বিনিময়ে এক পরম পাওয়া।
ওমর রা. ইসলামের এক মহান বীর। তার দ্বারা আল্লাহ তাআলা ইসলাম এবং মুসলিমদের সম্মান দান করেছিলেন। উচ্চকিত করেছিলেন দ্বীনের আলোক স্তম্ভ। ইসলামের পক্ষে তার সীমাহীন অবদানের জন্য বৈবাহিক দিক দিয়ে সম্পর্ক গড়ে তুলে আল্লাহর রাসূল তাঁকে দিলেন শ্রেষ্ঠতম প্রতিদান।
এই আত্মীয়তার মাধ্যমে আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওমর রা. ও আবু বকর রা. এর মাঝে মর্যাদার সমতা বিধান করলেন। আল্লাহর রাসূলের সাথে তাদের কন্যাদ্বয়ের বিবাহ উভয়ের জন্য পরম সম্মানের বিষয় এবং অতুলনীয় প্রতিদান। পার্থিব জীবনে প্রতিদান হিসেবে এর চেয়ে বড় সম্মান দেয়া সম্ভব নয়। কী অপূর্ব কৌশল! বিশ্বস্ত ও নিষ্ঠাবান্দের জন্য কী মহৎ প্রতিদান!
অনুরূপভাবে উসমান এবং আলী রা. তাদের কন্যাদ্বয়কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে বিবাহ প্রদান করে সম্মানের সমান অংশিদার হয়েছিলেন।
উল্লেখিত চারজন ছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাহাবীদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যাক্তি। তাঁর তিরধানের পর এই চারজনই ছিলেন মুসলিম মিল্লাতের প্রচার-প্রসার এবং ইসলামের শাশ্বত আহবানকে ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে খলীফা বা প্রতিনিধি। কী অসাধারণ তাঁর কৌশল!কী অনুপম তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি!

৪র্থত: রাজনৈতিক তাৎপর্য
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কতিপয় স্ত্রীকে বিবাহ করেছেন তাঁর পক্ষে গোত্র-সম্প্রদায়গুলোকে সংঘবদ্ধ করতে এবং তাদের অন্তরগুলোকে এক সূত্রে গেঁথে দেয়ার উদ্দেশ্যে।
এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে,কোন মানুষ যখন কোন গোত্রে বিবাহ করে তখন তার মাঝে এবং সেই গোত্রের মাঝে একটা প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি হয় আর তখন স্বভাবতই তারা পরস্পরের সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসে।
এপর্যায়ে আমরা কতিপয় উদাহরণ পেশ করব যার মাধ্যমে রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এই সব বিবাহের পেছনে কী তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য ছিল তা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠবে (ইনশাআল্লাহ)।
এক. জুওয়ায়রিয়া রা. এর সাথে বিবাহ
রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বনী মুস্তালেক এর সরদার হারেসের কন্যা জুওয়ায়রিয়া রা. কে বিবাহ করলেন। তিনি তার সম্প্রদায়ের সাথে মুসলিমদের হাতে যুদ্ধবন্দি হয়ে এসেছিলেন। যুদ্ধবন্দি হওয়ার পর তিনি নিজের মুক্তিপণ আদায়ের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এসে অর্থ সাহায্য চাইলেন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রস্তাব পেশ করলেন যে, তিনি তার পক্ষ হতে মুক্তিপণ প্রদান করবেন; বিনিময়ে তাকে বিবাহ করবেন।
তিনি এ প্রস্তাব কবুল করলে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বিবাহ করে নিলেন।
অতঃপর মুসলিমগণ বললেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শশুর গোষ্ঠি আমাদের হাতে বন্দি থাকবে তা কী করে হয়?! ব্যাস, তারা তাদের অধীনস্থ সকল বন্দিকে মুক্তি দিয়ে দিলেন।
বনী মুস্তালেক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবীদের এই উদারতা,মহত্ম এবং মানবতাবোধ অবলোকন করে সকলেই ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করল।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে তার বিবাহ ছিল তার জ্ঞাতি-গোষ্ঠী এবং সম্প্রদায়ের জন্য বরকত স্বরূপ। কারণ তা ছিল,তাদের ইসলাম গ্রহণ এবং মুক্তিপ্রাপ্তির মাধ্যম। জুওয়াইরিয়া রা. তার সম্প্রদায়ের জন্য সত্যই এক বরকতময় নারী।
ইমাম বুখারী আয়েশা রা. হতে একটা হাদীস বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: বনী মুস্তালেক গোত্রের মহিলাদেরকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুদ্ধবন্দি হিসেবে পেলেন। অতঃপর তম্মধ্যে হতে এক পঞ্চমাংশ বের করার পর বাকি সাহাবীগণের মাঝে বণ্টন করে দিলেন। অশ্বারোহী যোদ্ধাদেরকে দিলেন দুটি অংশ আর পদাতিক যোদ্ধাদেরকে একটি অংশ।
যাহোক এই বণ্টন প্রক্রিয়ায় জুওয়রিয়া বিনতুল হারিস পড়ল সাবেত বিন কায়স রা. এর অংশে।
জুওয়রিয়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এসে আরজ করলেন: হে আল্লাহর রাসূল, আমি আমাদের গোত্র প্রধান হারিসের কন্যা। আপনি তো জানেন আমি কী বিপদে পড়েছি! সাবিত আমাকে ৯ উকিয়া স্বর্ণ প্রদানের শর্তে মুক্তি দেয়ার কথা বলেছে। সুতরাং আপনি আমাকে মুক্তি করার ব্যাপারে সাহায্য করুন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: এটাই চাও না কি এ থেকে উত্তম কিছু?
তিনি বললেন: কী সেটা?
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: আমি তোমার চুক্তিবদ্ধ বা শর্তকৃত অর্থ পরিশোধ করে দিব এবং তোমাকে বিয়ে করব।
তিনি বললেন: ঠিক আছে,হে আল্লাহর রাসূল।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: তাই করলাম।
এ সংবাদ জনগণের নিকট পৌঁছলে তারা বলল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শশুর বংশের লোকেরা আমাদের কৃতদাস হয়ে থাকবে এটা কী করে হয়? ফলে তারা তাদের অধীনস্থ সকল বন্দিকে মুক্ত করে দিল। তাদের সংখ্যা ছিল ১০০ ঘর।
দুই. সুফিয়া বিনতে হুয়াই রা. এর সাথে বিবাহ
অনুরূপভাবে রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুফিয়া বিনতে হুয়াই বিন আখতাব রা. কে বিবাহ করেছিলেন। খায়বার যুদ্ধে তার স্বামী নিহত হওয়ার পর তিনি যুদ্ধবন্দি হয়ে বণ্টনের মাধ্যমে জনৈক মুসলিমের ভাগে পড়ল। তখন সাহাবীদের মধ্যে বিচক্ষণ লোকেরা বললেন: সুফিয়া বনী কুরাইযার নেত্রী। তিনি আল্লাহর রাসূল ছাড়া অন্য কারও জন্য উপযুক্ত নন।
অতঃপর তারা বিষয়টি রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট পেশ করলেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে ডেকে দুটি বিষয়ের যে কোনও একটি গ্রহণের এখতিয়ার দিলেন:
ক. তাকে মুক্ত করা হলে তিনি রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন।
খ. অথবা তাঁকে মুক্ত করা হলে তিনি নিজ পরিবার-পরিজনের সাথে গিয়ে মিলিত হবেন।
অবশেষে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তাকে মুক্তি দেয়া হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন। কারণ তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিশাল মর্যাদা, সম্মান এবং অনুপম সুন্দর আচার-আচরণ সচক্ষে দেখেছিলেন।
এরপর তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন। তার ইসলাম গ্রহণের কারণে আরও কিছু মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেন।
বর্ণিত আছে, সুফিয়া রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর গৃহে আসার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: “তোমার পিতা চরমপন্থি ইহুদী। আল্লাহ তাকে ধ্বংস করার পূর্ব পর্যন্ত আমার সাথে মারাত্মক দুশমনি করেছে।
তিনি বললেন: হে আল্লাহর রাসূল,আল্লাহ কি তাঁর কিতাবে বলেন নি?
وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَىٰ
“একজন আরেক জনের দোষের বোঝা বহন করবে না।” (সূরা ফাতির: ১৮)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন: তোমার ইচ্ছা, তুমি যদি ইসলামকে পছন্দ কর তবে আমি তোমাকে আমার স্ত্রী হিসেবে রাখব আর যদি ইহুদীবাদ পছন্দ কর তবে আমি তোমাকে মুক্ত করে দিব। তখন তুমি নিজ সম্প্রদায়ের সাথে মিলিত হতে পারবে।
তিনি বললেন: হে আল্লাহর রাসূল,আমি ইসলামকে ভালবেসেছি। আমাকে আপনার ঘরে আহ্বানের পূর্বেই আমি আপনাকে সত্যবাদী বলে স্বীকার করে নিয়েছি। ইহুদী ধর্মের প্রতি আমার মোটেও আগ্রহ নেই। আমার পিতা এবং ভায়েরও আগ্রহ নেই। আপনি আমাকে ইসলাম এবং কুফুরীর মধ্যে স্বাধীনতা দিয়েছেন। কিন্তু মুক্তি পেয়ে নিজ গোত্রের নিকট ফিরে যাওয়ার চেয়ে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই আমার নিকট অধিক পছন্দনীয়।
অতঃপর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে স্ত্রী হিসেবে রেখে দিলেন।
তিন. উম্মে হাবীবা রা. এর সাথে বিবাহ 
অনুরূপভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মে হাবীবা রামলা বিনতে আবী সুফিয়ানকে বিবাহ করেছিলেন।
আবু সুফিয়ান সে সময় ছিল শিরকের ঝাণ্ডা বাহী এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ঘোরতর দুশমন।
এদিকে মক্কায় তার মেয়ে ইসলাম গ্রহণ করে স্বামীর সাথে দ্বীন হেফাজতের স্বার্থে হাবশা (ইথিওপিয়া)এ হিজরত করেছেন। সেখানে তার স্বামী মৃত্যু বরণ করায় তিনি নি:সঙ্গ জীবন কাটাতে লাগলেন। সেখানে না ছিল তার কোন সাহায্যকারী না ছিল কোন ঘনিষ্ঠজন।
রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার এ দুরবস্থার কথা জানতে পেরে হাবশা (ইথিওপিয়া) এর সম্রাট নাজাশির নিকট বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দূত পাঠালেন। দূত এ সংবাদ নাজাশির নিকট পৌঁছিয়ে দিলে নাজাশি যে কী পরিমাণ আনন্দিত হলেন তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। কারণ যদি তিনি নিজের পিতা বা পরিবারের নিকট ফিরে যান তাহলে তারা তাকে কুফুরী এবং ধর্মান্তরিত করতে বাধ্য করবে এবং কঠিন শাস্তি দিবে।
অতঃপর নাজাশি অনেক মূল্যবান উপহার সামগ্রী সহ চারশত দিনার মোহর হিসেবে তাঁকে দিয়ে পাঠালেন। মদীনায় ফিরে এলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করলেন।
এ সংবাদ আবু সুফিয়ান এর কানে পৌঁছলে তিনি এ বিবাহে সম্মতি দিয়ে বললেন: “তিনি এমন সুপুরুষ যাকে ফিরিয়ে দেয়া যায় না।” তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যাপারে গর্ববোধ করলেন এবং তার কন্যার বিবাহের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সমকক্ষতাকে অস্বীকার করলেন না।
পরবর্তীতে মহান আল্লাহ তাকে হেদায়েতের অমিয় সুধা পান করিয়েছেন।
এখান থেকে আবু সুফিয়ানের কন্যাকে বিবাহ করার পেছনে কী সুগভীর তাৎপর্য নিহিত ছিল তা প্রতিভাত হয়ে গেল। এই বিবাহ বন্ধন সাহাবীগণের উপর তার নির্যাতনকে হ্রাস করেছিল। যদিও আবু সুফিয়ান তখনও বনী উমাইয়ার মধ্যে রাসূলুল্লাহর প্রতি সবচেয় বড় বিদ্বেষ পরায়ণ এবং ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য মারাত্মক শত্রু ছিল।
কিন্তু আবু সুফিয়ানের কন্যার সাথে আল্লাহর রাসূলের বিবাহ তার এবং তার গোত্রীয় লোকদের হৃদয়কে আকৃষ্ট করার একটা অন্যতম কারণ হয়েছিল।
অন্যদিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মে হাবীবা রা.কে নিজের সহধর্মিণী হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন তার ঈমানের প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে। কারণ তিনি দ্বীন রক্ষার খাতিরে নিজের গৃহত্যাগ করে ছিলেন।
কী চমৎকার তাঁর কৌশল!

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর  সহধর্মিণীগণ সম্পর্কে আলোচনা
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বহু বিবাহের তাৎপর্য সম্পর্কে আলোচনা করার পর এখন আমরা আলোচনা করব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পূত-পবিত্র সহধর্মিণীদের সম্পর্কে।
আল্লাহ তাদেরকে তার প্রিয় বন্ধু মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্য চয়ন করেছেন। সায়্যেদুল মুরসালীন-সকল রাসূলের শ্রেষ্ঠ রাসূলের সাথে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে তাদেরকে প্রদান করেছেন বিশাল মর্যাদা। নারী জাতির মধ্যে থেকে বাছায় করে তাদেরকে সমগ্র মুসলিম জাতির জননী’র মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সম্মানার্থে তাঁর তিরোধানের পর তাঁর স্ত্রীদেরকে বিবাহ করা ইমানদারদের জন্য হারাম ঘোষণা করেছেন।
আল্লাহ তাআলা স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন,
النَّبِيُّ أَوْلَىٰ بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنفُسِهِمْ ۖ وَأَزْوَاجُهُ أُمَّهَاتُهُمْ
“নবী (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা অধিক ঘনিষ্ঠ এবং তাঁর স্ত্রীগণ তাদের মা।” (সূরা আহযাব: ৬)
তিনি আরও বলেন:
وَمَا كَانَ لَكُمْ أَن تُؤْذُوا رَسُولَ اللَّـهِ وَلَا أَن تَنكِحُوا أَزْوَاجَهُ مِن بَعْدِهِ أَبَدًا ۚ إِنَّ ذَٰلِكُمْ كَانَ عِندَ اللَّـهِ عَظِيمًا
“আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেয়া এবং তার ওফাতের পর তার পত্নীগণকে বিবাহ করা তোমাদের জন্য বৈধ নয়। আল্লাহর নিকট এটা গুরুতর অপরাধ।” (সূরা আহযাব: ৫৩)
আল্লামা করতুবী রহ. তার ‘আল জামে লি আহকামিল কুরআন’ শীর্ষক বিশ্বখ্যাত তাফসীরে বলেছেন:
“মহান আল্লাহ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সহধর্মিণীদেরকে মুমিনদের মা আখ্যা দিয়ে তাদেরকে সম্মানিত করেছেন। অর্থাৎ সম্মান ও শ্রদ্ধা  জ্ঞাপন আবশ্যক হওয়া এবং তাদেরকে বিবাহ করা হারাম হাওয়ার দিক দিয়ে তারা আমাদের মা। এটি মূলত: আল্লাহর রাসূল এবং তার জীবনসঙ্গিনীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পবিত্র স্ত্রীদের নাম:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সকল সৌভাগ্যবান নারীকে বিবাহ করেছিলেন তাদের সংখ্যা এগারো। যথাক্রমে:
  • ১. খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ রা.
  • ২. সাওদা বিনতে যামআ রা.
  • ৩. আয়েশা বিনতে আবু বকর রা.
  • ৪. হাফসা বিনতে উমর রা.
  • ৫. যায়নব বিনতে জাহাশ রা.
  • ৬. উম্মে সালামা রা.
  • ৭. উম্মে হাবীবা (রমলা বিনতে আবু সুফিয়ানরা.
  • ৮. মায়মুনা বিনতে হারেস আল হেলালিয়া রা.
  • ৯. ওয়াইরিয়া বিনত হারেস রা.
  • ১০. সুফিয়া বিনতে হুয়াই বিন আখতাব রা.
  • ১১- মাইমুনা বিনতে হারেস হেলালিয়া রা.

১-খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ রা.
খাদীজা রা. হলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রথম স্ত্রী। নবুওয়ত লাভের পূর্বে ২৫ বছর বয়সে তিনি তাকে বিবাহ করেন। তখন খাদিজা ছিলেন ৪০ বছর বয়স্ক বিধবা মহিলা।
প্রথমত: তিনি আবু হালা নামক এক ব্যক্তির স্ত্রী ছিলেন। সে মারা গেলে আতিক বিন আয়েয তাকে বিবাহ করেন। আতিক মৃত্যু বরণ করার পর তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হোন। (আল ইসাবাহ)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে পছন্দ করেন তার বিচার-বুদ্ধি, বিচক্ষণতা ও প্রখর বুদ্ধিমত্তার কারণে। এ বিবাহ ছিল দারুণ বিচক্ষণতার পরিচায়ক। এখানে মূলত: দুটি বিবেকের সমন্বয় ঘটেছে। ফলে তাদের দু জনের মাঝে বয়স কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে নি। কারণ এতে কেবল কামনা-বাসনা চরিতার্থ করা উদ্দেশ্য ছিল না বরং ছিল এক মহৎ উদ্দেশ্য।
আল্লাহ তাআলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে রিসালাতের দায়িত্ব পালন এবং দাওয়াতের ক্ষেত্রে কষ্ট শিকারে জন্যই প্রস্তুত করেছিলেন। এই দাওয়াতি কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে এবং রিসালাতের মর্মবাণীকে প্রসারের জন্য মহিমাময় আল্লাহ এই বিচক্ষণ, বুদ্ধিমতী,পূত-পবিত্র,সতীসাধ্বী নারীকে সহজেই তাকে মিলিয়ে দিয়েছিলেন।
মহিলাদের মধ্যে তিনি সর্ব প্রথম ঈমান এনেছিলেন। তার প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও সঠিক বিশ্লেষণ ক্ষমতা প্রতীয়মান হয় যখন হেরা গুহায় অবস্থানের সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট জিবরাঈল আ. আগমন করলেন এবং ভয়ে ভীত হয়ে প্রকম্পিত হৃদয়ে তিনি খাদিজার নিকট এসে বলতে লাগলেন, زملوني زملوني
 “আমাকে কম্বল জড়িয়ে দাও, আমাকে কম্বল জড়িয়ে দাও।”
 অবশেষে তার ভয় কেটে গেলে খাদিজা রা. নিকট ঘটনার বিবরণ দিয়ে বললেন: “আমার তো জীবনের ভয় ধরে গেছে।”
তিনি বললেন: “আপনি আশ্বস্ত হোন। আল্লাহর কসম,আল্লাহ আপনাকে কখনোই লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয় স্বজনের সাথে ভালো ব্যবহার করেন,সত্য কথা বলেন, আমানতের হিফাজত করেন,অসহায় লোকদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন,নিজে উপার্জন করে অভাবীদেরকে দান করেন। আতিথ্য রক্ষা করেন এবং ভালো কাজে সহযোগিতা করেন।”(বুখারী ও মুসলিম)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার যৌবনের পুষ্পিত কালটি খাদিজার সাথে কাটিয়েছেন। তিনি থাকা কালীন অন্য কোন বিবাহ করেন নি। তার মত আর কাউকে ভালবাসেন নি।
আয়েশা রা. যদিও খাদীজা রা. কে কখনও দেখেন নি বা তার সাথে থাকেন নি তবুও তার প্রতি ঈর্ষা করতেন। এমন কি একবার খাদিজা রা. এর ব্যাপারে আলোচনা করতে নিয়ে তিনি একবার ধৃষ্টতাপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,
“অতীতে তো আপনার এক বৃদ্ধা ছিল। আল্লাহ কি তার চেয়েও উত্তম আপনাকে দান করেন নি?” নিজেকে উদ্দেশ্য করে তিনি একথা বলেছিলেন।
একথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রেগে গিয়ে বললেন: “না, আল্লাহর কসম, আল্লাহ তার চেয়ে উত্তম কাউকে দেন নি। সকল মানুষ যখন আমাকে অস্বীকার করেছিল তখন তিনি আমাকে বিশ্বাস করেছিলেন। সকল মানুষ যখন আমাকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিয়েছিল তখন তিনি আমাকে সত্যবাদী বলে মেনে নিয়েছিলেন। সকল মানুষ যখন আমাকে বঞ্চিত করে ছিল তখন তিনি আমাকে তার অর্থ-সম্পদ দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। আল্লাহ তার মাধ্যমে আমাকে সন্তান-সন্ততি দান করেছেন; অন্য কোন স্ত্রীর মাধ্যমে দেন নি।”
মা আয়েশা রা. বলেন: তারপর থেকে আমি কখনও তাঁর ব্যাপারে খারাপ মন্তব্য করি নি।
আয়েশা রা. হতে ইমাম বুখারী ও মুসলিম আরও একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন:
আয়েশা রা. বলেন: “খাদীজার ব্যাপারে আমি যতটুকু ঈর্ষা করেছি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অন্য কোন স্ত্রীর সাথে ততটুকু ঈর্ষা করি নি। যদিও আমি তাঁকে কখনো দেখি নি। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেশি বেশি তার আলোচনা করতেন। কখনো কখনো ছাগল জবাই করলে খাদীজা রা. এর বান্ধবীদের নিকট গোশত পাঠিয়ে দিতেন।
কখনো আমি তাঁকে বলতাম, দুনিয়ায় মনে হয় খাদীজা ছাড়া কোন মহিলা নেই! তিনি বলতেন, “তিনি এই ছিলেন…ওই ছিলেন… তার মাধ্যমে আমার সন্তান হয়েছিল…।”
তিনি দীর্ঘ ২৫ বছর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে ঘর-সংসার করেছেন। ১৫ বছর নবুয়তের পূর্বে আর ১০ বছর নবুয়তের পরে। কিন্তু তিনি বেঁচে থাকা অবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্য কোন নারীকে বিবাহ করেন নি।
ইবরাহীম ছাড়া সকল সন্তানই তার থেকে পেয়েছেন। তিনি যখন মহাপ্রভুর ডাকে সাড়া দেন তখন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বয়স পঞ্চাশ। সে সময় তার আর কোন স্ত্রী ছিল না।
খাদীজা রা. এর তিরোধানের পরই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একাধিক বিবাহ করেন। যার পেছনে ছিল সে সকল কারণ ও তাৎপর্য যা ইতো:পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।

২- সাওদা বিনতে যামআ রা.
খাদীজা রা. এর তিরোধানের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাওদা রা. কে বিবাহ করেন। তার পূর্ব স্বামীর নাম সাকরান বিন আমর আল আনসারী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর চেয়ে বয়সে বড় হওয়া স্বত্বেও তিনি তাকে পছন্দ করেন।
এর তাৎপর্য হল, তিনি ছিলেন একজন হিজরকারীনী মুমিন নারী। তিনি হাবশা (ইথিওপিয়া)য় দ্বিতীয় বার হিজরত করেন। কিন্তু সেখান থেকে ফিরে আসার পর তার স্বামী ইন্তেকাল করলে তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। তাকে সাহায্য-সহযোগিতা করার মত কোন স্বজন ছিল না। স্বামী হারানোর পর নিজ পরিবারের নিকট ফিরে গেলে তারা তাকে শিরক করতে বাধ্য করত অন্যথায় ইসলাম ত্যাগ করার জন্য কঠিন শাস্তি দিত।
ফলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দায়িত্ব গ্রহণ করা পছন্দ করলেন এবং বিবাহ করলেন।
তার সত্যনিষ্ঠা বিশ্বাসের প্রতি এটি হল আল্লাহর রাসূলের চূড়ান্ত অনুগ্রহ।
কেবল মনোবাসনা চরিতার্থ করা যদি রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উদ্দেশ্য থাকত-যেমনটি পাশ্চাত্যের মিথ্যাবাদী ইসলাম বিদ্বেষীরা বলে থাকে-তাহলে তিনি ৫৫ বছর বয়স্ক এই বিধবা মহিলাকে বিবাহ না করে বিবাহ করতেন কম বয়সী সুন্দরী মেয়েদেরকে। কিন্তু তিনি তো উদারতা,সহমর্মিতা এবং মানবিকতার মূর্ত প্রতীক। তাই এই সম্ভ্রান্ত নারীকে নিজ তত্ববধানে দেখাশোনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করাই ছিল এই বিবাহের উদ্দেশ্য।

৩-আয়েশা বিনতে আবু বকর রা.
একমাত্র আয়েশা রা. কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুমারী অবস্থায় বিবাহ করেছিলেন। তার জীবন সাথীদের মধ্যে তিনি ছাড়া অন্য কেউ অবিবাহিত ছিলেন না।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সকল স্ত্রীর মাঝে তিনি ছিলেন সবচেয়ে বেশী মেধাবী ও স্মৃতি শক্তির অধিকারিণী। অধিকাংশ পুরুষদের মাঝেও তিনি ছিলেন বেশী জ্ঞানী। কারণ অনেক বড় বড় সাহাবীও সমস্যাপূর্ণ বিভিন্ন হুকুম-আহকাম তার নিকট সমাধান চাইতেন এবং তিনি তা সমাধান করে দিতেন।
প্রখ্যাত সাহাবী আবু মুসা আশাআরী রা. বর্ণনা করেন,“আমরা আল্লাহর রাসূলের সাহাবীগণ যে কোন সমস্যায় পড়লে তাঁর কাছে জিজ্ঞেস করলেই নির্দেশনা বা সমাধান পেতাম।”
আবু যোহা বর্ণনা করেন মাসরুক থেকে। তিনি বলেন: “অনেক বড় বড় সাহাবীকে আয়েশা রা. এর নিকট ফারায়েয বা উত্তরাধিকারীদের মাঝে সম্পদ বণ্টনের বিধিবিধান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে দেখছি।”
উরওয়া বিন যুবাইর বলেন: “চিকিৎসা, ফিকাহ এবং কবিতা বিষয়ে আয়েশা রা. থেকে অধিক কোন জ্ঞানী মহিলাকে দেখি নি।”
বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। হাদীসের গ্রন্থগুলো তার বিশাল জ্ঞান-বুদ্ধির সাক্ষ্য দেয়।
সহীহ বুখারীতে আবু হুরায়রা রা. এবং আবদুল্লাহ বিন উমর রা. ছাড়া আয়েশা রা. থেকে বেশী কোন পুরুষ বর্ণনাকারীর হাদীস বর্ণিত হয় নি।
অন্যান্য সকল সহধর্মিণীদের চেয়ে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আয়েশা রা. কে বেশী ভালবাসতেন কিন্তু দাম্পত্য জীবনে দিন বণ্টনের ক্ষেত্র সকলের মাঝে সমতা রক্ষা করতেন এবং বলতেন “হে আল্লাহ এ দিন বণ্টন আমার আওতাভুক্ত। সুতরাং যে বিষয়টি আমার আওতায় নেই (ভালবাসা ও মনের টান) সে বিষয়ে আপনি আমাকে ধরিয়েন না।”
যখন আয়াতে তাখয়ীর তথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর স্ত্রীগণ তার বিবাহ বন্ধনে থাকা না থাকার বিষয়ে কুরআনের আয়াত নাজিল হল তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বপ্রথম আয়েশা রা. কে দিয়ে শুরু করলেন।
বললেন: “তোমার নিকট আমি একটি বিষয় উল্লেখ করব সে বিষয়ে তুমি তোমার পিতা-মাতার সাথে পরামর্শ ছাড়া তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নিবে না।”
আয়েশা রা. বলেন: অথচ তিনি জানেন যে, আমার পিতা-মাতা আমাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বিচ্ছেদ হওয়ার নির্দেশ দিবেন না।
যাহোক আল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সামনে তেলাওয়াত করলেন,
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُل لِّأَزْوَاجِكَ إِن كُنتُنَّ تُرِدْنَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا فَتَعَالَيْنَ أُمَتِّعْكُنَّ وَأُسَرِّحْكُنَّ سَرَاحًا جَمِيلًا
“হে নবী, আপনার পত্নীগণকে বলুন, তোমরা যদি পার্থিব জীবন ও তার বিলাসিতা কামনা কর তবে আস, আমি তোমাদের ভোগের ব্যবস্থা করে দেই এবং উত্তম পন্থায় তোমাদের বিদায় নেই।” (সূরা আহযাব: ২৮)
তখন আয়েশা রা. বললেন: এ ব্যাপারেও কি পিতা-মাতার সাথে আমাকে পরামর্শ করতে হবে!! আমি নিশ্চয় আল্লাহ,রাসূল এবং পরকাল চাই।
আয়েশা রা. এর সম্মানিত পিতা আবু বকর সিদ্দীক রা. এর সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয়তা পার্থিব জীবনে আবু বকর রা. এর জন্য এক পরম প্রাপ্তি এবং প্রতিদান। অন্য দিকে এটি ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পবিত্র সুন্নাহ,বিবাহ ও দাম্পত্য সংক্রান্ত ফযিলত ও শরীয়তের বিধিবিধান বিশেষ করে নারী সম্পর্কীয় বিষাদীর প্রচার-প্রসারে উৎকৃষ্টতম মাধ্যম। বিষয়টি আমরা ইতোপূর্বে শিক্ষা মূলক তাৎপর্য বর্ণনা করতে গিয়ে আলোচনা করেছি।

৪-হাফসা বিনতে ওমর রা.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাফসা বিনতে ওমর রা. কে বিধবা অবস্থায় বিবাহ করেন। তার পূর্ব স্বামীর নাম ছিল খুনাইস বিন হুযাফাহ আল আনসারী রা.। তিনি বদর যুদ্ধে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করতে করতে শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন। তিনি ছিলেন সে সকল বীর যোদ্ধাদের একজন যারা জিহাদ, বীরত্ব ও সাহসিকতায় ইতিহাসের পাতায় চির স্মরণীয় হয়ে আছেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রাণ প্রিয় তনয়া রোকইয়া রা. এর মৃত্যুর পর উমর রা. তার মেয়ে হাফসা রা. কে বিবাহের জন্য উসমান রা. এর নিকট প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে হাফসা রা. কে বিয়ে করে তার পিতা ওমর রা. এর প্রতি অভূতপূর্ব দয়া এবং অনুগ্রহ প্রদর্শন করেন। এর মাধ্যমে তিনি উমর রা.কে অধিষ্ঠিত করেছেন মর্যাদা এবং সম্মানের সুউচ্চ আসনে।
ইমাম বুখারী রহ. প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন উমর রা. থেকে বর্ণনা করেন, উমর রা. এর কন্যা হাফসা রা. এর স্বামী খুনাইস বিন হুযাফা রা. কে হারিয়ে (তিনি বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন এবং মদীনায় মৃত্যু বরণ করেন) বিধবা হয়ে গেলে উমর রা. উসমান রা. এর সাথে সাক্ষাত করে বললেন: আপনি চাইলে হাফসাকে আপনার সাথে বিবাহ দিব।
উসমান রা. বললেন: এ বিষয়ে আমি চিন্তা-ভাবনা করে দেখব।
কয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ার পর উসমান রা. বললেন: আমার সিদ্ধান্ত হল, আমি হাফসা রা. কে বিয়ে করব না।
উমর রা. বলেন: এরপর আমি আবু বকর রা. এর নিকট গিয়ে বললাম: আপনি চাইলে হাফসাকে আপনার সাথে বিবাহ দিতে চাই। কিন্তু তিনি চুপ থাকলেন। এতে আমি উসমান রা. এর চেয়ে তার উপর বেশী মর্মাহত হলাম।
কয়েক দিন অতিবাহিত হওয়ার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিয়ের প্রস্তাব দিলে আমি তাঁর সাথে হাফসার বিয়ে দিলাম।
অত:পর আবু বকর রা. আমার সাথে সাক্ষাৎ করে বললেন: আপনি আমার নিকট হাফসার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন কিন্তু আমি কোন উত্তর না দেয়ায় মর্মাহত হয়েছেন তাই না?
বললাম: হ্যাঁ।
আবু বকর রা. বললেন: “আমি এ জন্যেই উত্তর দিতে পারি নি যে, আমি জানতে পেরেছিলাম যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাফসা রা. এর কথা স্মরণ করেছেন। কিন্তু তার গোপন কথা প্রকাশ করতে চাই নি। তিনি যদি বিয়ে না করতেন তবে আমি গ্রহণ করে নিতাম।” (সহীহ বুখারী)
এটিই হল প্রকৃত বিচক্ষণতা ও সত্যিকার বীরত্ব যা উমর ফারুক রা. এর কাজের মধ্যে ফুটে উঠেছে। তিনি তার আত্মমর্যাদাকে রক্ষা করতে চান। তাই উপযুক্ত পাত্রের নিকট নিজের কন্যার বিয়ের প্রস্তাব পেশ করতে তার মাঝে এতটুকুও সংকোচ দেখা যায় নি। কারণ মর্যাদাপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থার জন্য বিবাহই হল সর্বোত্তম মাধ্যম।
কিন্তু ইসলামের বিধিবিধান আর সৌন্দর্য সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে আমাদের সমাজ কোথায় অবস্থান করছে?! বর্তমানে মানুষ প্রচুর ধন-সম্পদের অধিকারী লোকদের পক্ষ থেকে প্রস্তাবের আশায় তাদের কন্যাদেরকে অবিবাহিত অবস্থায় রেখে দিচ্ছে!

৫-যয়নব বিনতে খুযাইমা রা.
হাফসা রা. এর পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যয়নব রা. কে বিয়ে করেন। তিনি সাহসী বীর শাহীদুল ইসলাম বা ইসলামের শহীদ প্রখ্যাত সাহাবী উবায়দা ইবনুল হারেস রা. এর পত্নী ছিলেন। এই মহান বীর বদরের প্রথম মল্লযুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। স্বামীর শাহাদাতের সময় যয়নব রা. আহতদের পরিচর্যা এবং ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ লাগানোর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু স্বামীর শাহাদাত বরণের সংবাদ তাকে তাঁর দায়িত্ব পালন হতে বিরত রাখে নি।
অবশেষে আল্লাহ তাআলা মুশরিকদের সাথে সংঘটিত ইসলামের এই প্রথম যুদ্ধে মুসলিমদেরকে বিজয় দান করেছিলেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তার অসীম ধৈর্য ও দৃঢ় জেহাদি মনোবলের কথা জানতে পারলেন তখন তিনি স্বয়ং তাকে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন এবং বিবাহ করে তার আশ্রয়ের ব্যবস্থা করলেন। এর মাধ্যমে তিনি স্বামী হারানোর শোকে বেদনাহত হৃদয়ের রক্তক্ষরণ বন্ধ করলেন।
শায়খ মুহাম্মদ মাহমুদ সাওয়াফ তার রচিত ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পবিত্র জীবন সঙ্গিনীগণ’ শীর্ষক এক মূল্যবান পুস্তিকায় যয়নব রা. এর স্বামীর শাহাদাতের ঘটনা এবং তাতে যে সব মূল্যাবান শিক্ষণীয় দিক রয়েছে সেগুলো উল্লেখ করার পর বলেছেন:
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন যয়নব রা. কে বিবাহ করেন তখন তার (যয়নব রা.) বয়স ছিল ৬০ বছর। বিবাহের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সাথে মাত্র দু বছর জীবন যাপন করেছেন। দু বছর পরই তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টি কুড়িয়ে এবং নিজেও আল্লাহর সন্তোষ ভাজন হয়ে পরাপারে পাড়ি জমান।”
সুতরাং এই পবিত্র বিবাহ এবং এর পেছনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুমহান উদ্দেশ্য সম্পর্কে ভণ্ড মিথ্যাবাদীদের বক্তব্য কী? এখানে অপবাদ আরোপ কারীরা তাদের মিথ্যা অভিযোগের কিছু খুঁজে পাবে কি? এখানে কি নারী লালসার কোন লক্ষণ আছে? এটি কি এটি দয়ার মূর্ত প্রতীক, মানবতা বোধের অগ্রদূত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মহৎ উদ্দেশ্য, পবিত্রতা, দয়া, সহানুভূতি ও সহমর্মিতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ নয়?
সুতরাং ধোঁকাবাজ ভণ্ড মিথ্যুকদের উচিৎ আল্লাহকে ভয় করা এবং জ্ঞানের আমানত রক্ষা করা। অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য জ্ঞানের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করা সমীচীন নয়। এরা মূলত: শ্রেষ্ঠতম মহামানব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতে এবং তার মান-সম্মানকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যেই ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা করেছে!!

৬-যয়নব বিনতে জাহাশ রা.
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যয়নব বিনতে জাহাশ রা. কে তালাক প্রাপ্তা অবস্থায় বিবাহ করেছেন। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ফুফাতো বোন। যায়েদ বিন হারেসা রা. তাকে বিয়ে করেছিলেন কিন্তু তিনি যয়নব রা.কে তালাক প্রদান করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে তাকে বিবাহ করেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে তার বিবাহের পেছনে এমন এক তাৎপর্য রয়েছে যা অন্যান্য বিবাহের চেয়ে ব্যতিক্রমী। তা হল পোষ্যপুত্র সংক্রান্ত জাহেলী ধ্যান-ধারণার মূলোৎপাটন করা-যেমনটি ইতোপূর্বে ‘শরঈ তাৎপর্য’ বিষয়ে আলোচিত হয়েছে।
যায়েদ রা. এর সাথে যয়নব র. এর বিবাহ বিচ্ছেদ প্রসঙ্গে একটি বানোয়াট হাদীস
কোন কোন তাফসীর গ্রন্থে কিছু ভিত্তিহীন বর্ণনায় যয়নব রা. এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিবাহ সংক্রান্ত এমন কিছু ঘটনার বিবরণ উল্লেখিত হয়েছে- যেগুলো প্রিয় নবীমুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্মল চরিত্রে কালিমা লেপন করে। আর সে সব উদ্ভট ঘটনাগুলোকে পুঁজি করে কতিপয় স্বার্থান্বেষী, হিংসুক, ভণ্ড, প্রতারক এবং তাদের পাপিষ্ঠ দোসররা তৃপ্তির সাথে সেগুলোকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে এবং নানা ধরণের মিথ্যাচার করে থাকে।!
তারা বলে (তাদের কথা কতই না নিকৃষ্ট!) যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার যয়নব রা. এর বাড়ির নিকট দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে দেখতে পেলেন। সে সময় যায়েদ বাড়িতে ছিলেন না। তাকে দেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মনে ধরে গেল এবং তাকে ভালবেসে ফেললেন। তিনি বলে উঠলেন:سُبْحَانَ مقلِّبَ الْقُلُوْبِ (পবিত্রতা ঘোষণা করছি সে মহান সত্তার যিনি মনের পরিবর্তনকারী)। এ কথা যয়নব রা. শুনতে পেলেন।
অতঃপর স্বামী বাড়িতে এলে তিনি তার নিকট বললেন: আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এই এই কথা শুনেছি। যায়েদ রা. ভাবলেন: যয়নব রা. তাহলে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মনে ধরেছে। এটা মনে করে, তিনি তালাক দেয়ার উদ্দেশ্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এসে বললেন: আপনার পরিবার (ফুফাতো বোন) কে আপনি গ্রহণ করুন। কিন্তু তার মনে ছিল ভিন্ন কথা।
যাহোক এভাবে যায়েদ রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিবাহের স্বার্থে যয়নব রা. কে তালাক দিয়ে দিলেন!
ইবনুল আরাবী রহ. তার ‘আহকামুল কুরআন’ শীর্ষক তাফসীর গ্রন্থে এই ভ্রান্ত দাবি এবং নিকৃষ্ট মিথ্যাচারের প্রতিবাদে বলেন: “ওরা বলে থাকে যে, যয়নব রা. কে দেখে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মনে ধরে গেল বা তার মনে দাগ কাটল” এটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত কথা। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর ফুফাতো বোন যয়নব রা. তো সব সময় একসাথে ছিলেন। কেননা তখনও হিজাব বা পর্দার বিধান আসে নি। তাহলে কিভাবে তার প্রতি কু প্রবৃত্তি জাগ্রত হতে পারে?! প্রতি মুহূর্তে যাকে দেখেছেন কিন্তু মনে বাজে চিন্তা স্থান পায় নি অথচ স্বামী থাকা অবস্থায় তার প্রতি আসক্ত হয়ে গেলেন! তাছাড়া যয়নব রা. ইতোপূর্বে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট নিজেকে সঁপে দিতে চেয়েছিলেন! যে আসক্তি পূর্বে ছিল না তা কী করে নতুনভাবে ফিরে আসে?!
এ সব অবৈধ সম্পর্ক থেকে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হৃদয় পবিত্র। আল্লাহ তাআলা বলেছেন:
لَا تَمُدَّنَّ عَيْنَيْكَ إِلَىٰ مَا مَتَّعْنَا بِهِ أَزْوَاجًا مِّنْهُمْ زَهْرَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا لِنَفْتِنَهُمْ فِيهِ
“আমি এদের বিভিন্ন প্রকার লোককে পরীক্ষা করার জন্যে পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য স্বরূপ ভোগ-বিলাসের যে উপকরণ দিয়েছি, আপনি সেই সব বস্তুর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করবেন না।” (সূরা ত্বাহা: ১৩১)
এরপর তিনি (ইবনুল আরাবী রহ.)এ সংক্রান্ত হদীসগুলো উল্লেখ করার পর বলেন: এ হাদীসগুলো সবগুলোই ভিত্তিহীন।
যায়েদ রা. এর সাথে যয়নব রা. এর বিবাহ বিচ্ছেদের প্রকৃত কারণ:
যায়েদ বিন হারেসা রা. এর সাথে যয়নব রা. এর বিবাহ কালীন পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং ইতিহাসের দিকে গভীর ভাবে দৃষ্টিপাত করলে আমরা অনুধাবন করতে পারি যে, যায়েদ রা. এবং যয়নব রা. এর মাঝে যে তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছিল তা হয়েছিল মূলত: সামাজিক অবস্থার ভিন্নতার দারুণ। কারণ যয়নব রা. ছিলেন সম্ভ্রান্ত বংশের পক্ষান্তরে যায়েদ রা. কদিন আগেও ছিলেন কৃতদাস।
আল্লাহর ইচ্ছা ছিল যায়েদ রা. এর সাথে বিবাহের মাধ্যমে যয়নব রা. কে পরীক্ষা করা যাতে বংশ আভিজাত্যের গোঁড়ামি এবং জাহেলী সম্ভ্রম-অহমিকার ভীত ধ্বংস হয়ে যায়। কারণ ইসলাম কেবল তাকওয়া (আল্লাহ ভীতি)কে মর্যাদার মানদণ্ড হিসেবে নির্ধারণ করেছে।
যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যয়নব রা. এর নিকট যায়েদ রা. এর বিবাহের প্রস্তাব পেশ করলেন তখন যয়নব রা. বংশগত আভিজাত্যের প্রশ্নে এ বিবাহে অস্বীকৃত জনালেন। তখন আল্লাহ তাআলা কুরআনের এ আয়াত নাজিল করলেন,
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّـهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَن يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ ۗ وَمَن يَعْصِ اللَّـهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُّبِينًا
“আল্লাহ এবং তার রাসূল কোন কাজের আদেশ করলে কোন ইমানদার পুরুষ ও ইমানদার নারীর সে বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশের অবকাশ নেই। যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ অমান্য করে সে স্পষ্ট ভ্রষ্টতায় পতিত হয়।” (আহযাব: ৩৬)
অতঃপর যয়নব রা. আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশে বাহ্যিক ভাবে যায়েদ রা. কে মেনে নিলেও মনঃকষ্ট ও সংকীর্ণতার দরুন মন থেকে তাকে গ্রহণ করতে পারেন নি।
নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যয়নব রা. কে বাল্যকাল থেকেই চিনেন। কারণ তিনি তার ফুফাতো বোন। তিনি তাকে বিয়ে করতে চাইলে কে নিষেধ করত?
তাহলে এটা কী করে সম্ভব যে, একজন মানুষ কোন কুমারী মেয়েকে অপর পুরুষের নিকট বিয়ে দেয়ার পর পুনরায় সেই বিবাহিত মহিলার প্রতি আকৃষ্ট হয়?!
সত্যি এ লোকগুলো বিবেকহীন। তারা ছুটছে অজ্ঞতার পেছনে।
তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিরুদ্ধে যত রটনা করছে সেগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা,ভিত্তিহীন এবং বিভ্রান্তি মূলক।
লক্ষ্য করুন,এরা কী বলছে? তারা বলছে, মুহাম্মদ যে বিষয়টি মনের গভীরে লুকিয়ে রেখেছিল তা হল যয়নব রা. এর প্রতি ভালবাসা। যার কারণে তিনি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিন্দিত ও তিরস্কৃত হয়েছে!
এটি কি বোধগম্য অপবাদ! কোন মানুষ কি এ কারণে তিরস্কৃত হয় যে, সে তার প্রতিবেশী নারীকে ভালবাসার কথা প্রকাশ করে নি?
سُبْحَانَكَ هَـٰذَا بُهْتَانٌ عَظِيمٌ
“হে আল্লাহ,তোমার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। এটা মস্ত বড় অপবাদ।” (সূরা নূর: ১৬)
এ সংক্রান্ত আয়াতটি অত্যন্ত দ্যার্থহীন ও সুস্পষ্ট। আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহর রাসূল যা গোপন রেখেছে তা আল্লাহ অবশ্যই প্রকাশ করে দিবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন: وَتُخْفِي فِي نَفْسِكَ مَا اللَّـهُ مُبْدِيهِ “তুমি তোমার মনে এমন বিষয় গোপন রাখছিলে যা আল্লাহ প্রকাশ করে দিবেন।” (সূরা আহযাব: ৩৭)
আল্লাহ কী প্রকাশ করেছেন? যয়নব রা. এর প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রেমাসক্তি? না, কখনই না। বরং পোষ্যপুত্র সংক্রান্ত ভ্রান্ত রেওয়াজ উৎখাতের উদ্দেশ্যে যয়নব রা.কে বিবাহের মাধ্যমে আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়নে তার আগ্রহ প্রকাশ করলে তিনি মুনাফিকদের সমালোচনার আশঙ্কা করতেন যে, তারা বলে বেড়াবে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার পুত্রবধূকে বিবাহ করেছে।
এ কারণে আল্লাহ তাআলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মনের মধ্যে লুকায়িত এ জিনিসটি (মুনাফিকদের সমালোচনার আশঙ্কা) প্রকাশ করে দিয়ে বলেন:
فَلَمَّا قَضَىٰ زَيْدٌ مِّنْهَا وَطَرًا زَوَّجْنَاكَهَا لِكَيْ لَا يَكُونَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ حَرَجٌ فِي أَزْوَاجِ أَدْعِيَائِهِمْ إِذَا قَضَوْا مِنْهُنَّ وَطَرًا
“অতঃপর যায়েদ যখন যয়নবের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করল, তখন আমি তাকে আপনার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করলাম যাতে মুমিনদের পোষ্যপুত্ররা তাদের স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলে সেসব স্ত্রীকে বিবাহ করার ব্যাপারে মুমিনদের কোন অসুবিধা না থাকে।” (সূরা আহযাব: ৩৭)
এভাবেই স্পষ্ট এবং অকাট্য প্রমাণাদি দ্বারা মিথ্যুকদের সকল ভ্রান্ত ধারণা তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যায় এবং সকল স্বার্থান্বেষী প্রতারকদের আরোপিত অপবাদকে ম্লান করে দিয়ে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর চারিত্রিক নির্মলতা ও পবিত্রতা প্রমাণিত হয়।

৭-উম্মে সালামা রা.
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মে সালামা (হিন্দ আল মাখযূমীয়াহ) কে বিধবা অবস্থায় বিয়ে করেন। তার পূর্ব স্বামীর নাম আব্দুল্লাহ বিন আব্দুস সামাদ রা.। তিনি প্রথম পর্যায়ের ইসলাম গ্রহণকারীদের একজন।
তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে দ্বীনের হেফাজতের স্বার্থে হাবশা (ইথিওপিয়া)য় হিজরত করেন। আর সেখানেই তাদের মেয়ে সালামা জন্ম গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তার স্বামী ওহুদ যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করলে তিনি চার এতিম শিশু নিয়ে অভিভাবক এবং সাহায্যকারী হীন অবস্থায় কালাতিপাত করতে থাকেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিয়ে করা ছাড়া তার নিজের এবং এতিম শিশুদের সান্ত্বনা দেয়ার কোন পথ দেখতে পেলেন না। ফলে তিনি যখন তাকে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন তখন তিনি অপারগতা প্রকাশ করলেন এই বলে যে, “আমি তো বয়স্ক মহিলা। আমার কয়েকজন এতিম সন্তান আছে। তাছাড়া আমি খুব ঈর্ষাকাতর।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি উত্তরে বললেন: “আমি এতিম শিশুদেরকে আমার দায়িত্বে নিয়ে নেব। আর আল্লাহর কাছে দোয়া করব, তিনি যেন তোমার অন্তর থেকে ঈর্ষা দূর করে দেন।”
তিনি বয়সকে কোন সমস্যা মনে না করে তার সম্মতিক্রমে বিয়ে করলেন এবং তার এতিম শিশুদের লালন-পালন করতে লাগলেন। হৃদয়কে তিনি এতটাই প্রশস্ত করলেন যে, শিশুরা পিতৃ বিয়োগের কোন কষ্ট উপলব্ধি করতে পারল না। কেননা তিনি তাদের নিজের পিতার চেয়েও বেশী মহানুভব হয়ে তাদের হারানো পিতৃত্বের স্থান দখল করে ছিলেন।
উম্মুল মুমেনীন উম্মে সালামা রা. এর মাঝে তিনটি জিনিস একত্রিত হয়েছিল। সেগুলো হল:
  • (১) উচ্চ বংশ
  • (২) মর্যাদাপূর্ণ ঘর।
  • (৩) প্রথম পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণ।
উপরন্তু তার আরও একটি মর্যাদার বিষয় ছিল। সেটি হল, সুচিন্তিত মত ও চমৎকার সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা।
‌এর প্রমাণ হিসেবে মুসলিমদের একটি সংকটময় মূহুর্তে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চিন্তিত অবস্থায় তার নিকট পরামর্শ চাইলে তিনি তাকে চমৎকার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এটি হুদাইবিয়ার সন্ধির ঘটনা।
ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ হল, মক্কার মুশরিকদের দেয়া কতিপয় শর্ত মোতাবেক ১০ বছর যুদ্ধ না করার চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ায় মুসলিমদের মাঝে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্ট হল। মুসলিমগণ মর্যাদার আসনে থাকার পরও এমন একটি অসম চুক্তি স্বাক্ষরকে তাদের অধিকার হরণ বলে মনে করল।
চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর সে বছর (উমরা আদায় না করেই) সেখানেই মাথা মুণ্ডন করে বা চুল খাটো করে মদীনা ফিরে যাওয়ার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীদের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তারা কেউ এ নির্দেশ পালন করলেন না। অবস্থা দৃষ্টে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মে সালামা রা. এর নিকট গিয়ে বললেন: মানুষের সর্বনাশ হয়ে গেল! আমি তাদেরকে নির্দেশ দিলাম কিন্তু তারা কেউই নির্দেশ পালন করল না!
উম্মে সালামা রা. সমস্যাটির সহজ সমাধান পেশ করলেন। তিনি বললেন: আপনি তাদের সামনে গিয়ে নিজের মাথা মুণ্ডন করে নিন। আর দৃঢ়ভাবে এও বললেন যে, তাহলে দেখবেন যে, আপনাকে অনুসরণ করতে কেউ দ্বিধা করবে না। কারণ তারা বুঝতে পারবে যে, এটাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। এখান থেকে ফিরে আসার কোন সুযোগ নেই।
বাস্তবে ঘটেছিলও তাই।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাইরে বের হয়ে মাথা মুণ্ডনের জন্য নাপিতকে নির্দেশ দেয়ার সাথে সাথেই মুসলিমগণও তার অনুসরণের জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করে দিলেন। তারপর সকলেই মাথা মুণ্ডন করে হালাল হয়ে গেলেন।
এ বিষয়টি উম্মুল মুমেনীন উম্মে সালামা রা. এর পরামর্শ ক্রমেই হয়েছিল।

৮-উম্মে হাবীবা রামলা বিনতে আবী সুফিয়ান রা.
হিজরতের ৭ম বছর রাসূলে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মে হাবীবা রা. কে বিবাহ করেন।
তার পূর্ব স্বামীর নাম উবায়দুল্লাহ বিন জাহাশ। তিনি হাবশায় (ইথিওপিয়া) মৃত্যু বরণ করলে উম্মে হাবীবা রা. কে বাদশা নাজাশি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে বিবাহ প্রদান করেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পক্ষ থেকে তাকে তিনি চার হাজার দিরহাম মোহর হিসেবে প্রদান করেন।
আর উম্মে হাবীবা রা. কে শুরাহবিল বিন হাসানা এর সাথে হাবশা থেকে মদীনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট প্রেরণ করেন।
ইতোপূর্বে এই বিবাহের তাৎপর্য সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
৯-জুওয়াইরিয়া বিনতে হারেস রা.
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বনী মুস্তালেক এর সরদার হারেস বিন যেরার এর কন্যা জুওয়াইরিয়া বিনতে হারেসকে বিধবা অবস্থায় বিয়ে করেন।
তার পূর্ব স্বামীর নাম মুসাফে ইবনে সাফওয়ান।
তিনি মুরাইসী যুদ্ধে মৃত্যু বরণ করলে তার স্ত্রী মুসলিমদের হাতে বন্দি হয়। তাঁর স্বামী ছিল মুসলিমদের ঘোর দুশমন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি চরম বিদ্বেষ পরায়ণ।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে বিয়ের করার পেছনে কী তাৎপর্য ছিল তা ইতোপূর্বে আলোচিত হয়েছে।
১০-সুফিয়া বিনতে হুয়াই বিন আখতাব রা.
সুফিয়া বিনতে হুয়াই বিন আখতাব রা. কে বিবাহের তাৎপর্য ইতোপূর্বে রাজনৈতিক তাৎপর্যে আলোচিত হয়েছে। তাই এখানে পুনরায় আলোচনা করা হল না।
১১- মাইমুনা বিনতে হারেস হেলালিয়া রা.
মাইমূনা বিনতে হারেস হেলালিয়া রা.। তার পূর্বনাম ‘বাররাহ’। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার নাম দিয়েছেন ‘মাইমূনা। তিনি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সর্বশেষ স্ত্রী।
আয়েশা রা. তার সম্পর্কে বলেন: “তিনি ছিলেন আমাদের মধ্যে সর্বাধিক আল্লাহ ভীরু এবং আত্মীয়তা সম্পর্ক স্থাপন কারিণী।”
তার পূর্ব স্বামীর নাম আবু রহম ইবনে আব্দুল উযযা।
বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর চাচা আব্বাস রা. মাইমূনা রা. কে বিবাহের ব্যাপারে তাকে উৎসাহিত করেছিলেন।
সুধী মণ্ডলী,এ হল উম্মাহাতুল মুমেনীন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবন সঙ্গিনীদের ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত যাদেরকে মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সান্নিধ্য দান করে সম্মানিত করেছেন,মুমিনের মা বানিয়েছেন আর আর যাদেরকে নিম্নোক্ত ভাষায় সম্বোধন করেছেন:
يَا نِسَاءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَأَحَدٍ مِّنَ النِّسَاءِ ۚ إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلًا مَّعْرُوفًا
“হে নবী পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও; যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে পরপুরুষের সাথে কোমল ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলো না ফলে সেই ব্যক্তি কুবাসনা করবে যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে। আর তোমরা সঙ্গত কথাবার্তা বলবে।”(সূরা আহযাব: ৩২)

মোটকথা:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ সকল সম্মানিত নারীদেরকে বিবাহ করেছেন বিভিন্ন কারণ ও প্রেক্ষাপটে। প্রত্যেকটি বিবাহের পেছনে অনেক তাৎপর্য নিহিত রয়েছে।
এ ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বীনের স্বার্থ ও কল্যাণের দিকটি লক্ষ্য রেখেছেন। বিবাহের মাধ্যমে ইসলামের দিকে মানুষের মন আকৃষ্ট করতে চেয়েছেন। ফলত: এর মাধ্যমে অনেক বড় বড় গোত্রকে তার প্রতি আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. ছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সকল স্ত্রী ছিলেন বিধবা। আর তিনি একাধিক বিবাহ করেছেন হিজরতের পরে-যে বছর মুশরিক এবং মুসলিমদের মাঝে ব্যাপকভাবে যুদ্ধ-বিগ্রহ ছড়িয়ে পড়েছিল। সেটা ছিল হিজরতের ২য় বছর। সে বছর (ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধে) মুসলিমগণ মুশরিকদের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করেছিলেন।
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতিটি বিয়েতে ঐ সকল মিথ্যুক প্রতারকদের অপবাদের বিপরীতে তার দয়া,মহানুভাবতা,মহৎ উদ্দেশ্য ইত্যাদি পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। যদি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অন্তরে কু প্রবৃত্তির স্থান থাকত তবে তিনি যৌবনকালে বিবাহ করতেন। বিবাহ করতেন কুমারী তরুণীদের।
কিন্তু পাশ্চাত্যের খৃষ্টান ধাপ্পাবাজদের অন্তরগুলো হিংসার ঘোর অমানিশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ায় সূর্যের দীপ্ত কিরণ দেখা হতে অন্ধ হয়ে গেছে। মহিমাময় আল্লাহ যথার্থই বলেছেন:
بَلْ نَقْذِفُ بِالْحَقِّ عَلَى الْبَاطِلِ فَيَدْمَغُهُ فَإِذَا هُوَ زَاهِقٌ ۚ وَلَكُمُ الْوَيْلُ مِمَّا تَصِفُونَ
“বরং আমি সত্যকে মিথ্যার উপর নিক্ষেপ করি অতঃপর সত্য মিথ্যার মস্তক চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়। অত:পর মিথ্যা তৎক্ষণাৎ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।” (সূরা আম্বিয়া: ১৮)
সমাপ্ত
মুক্কা মুকাররমা
শারিয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ কলেজ
شبهات و أباطيل حول تعدد زوجات الرسول صلى الله عليه وسلم
المؤلف:الشيخ محمد علي الصابوني
المترجم: عبد الله الهادي بن عبد الجليل

No comments:

Post a Comment

Download AsPDF

Print Friendly and PDFPrint Friendly and PDFPrint Friendly and PDF
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...