অদৃশ্য জগতের কথা (পর্ব-১, ২)
(১) আল্লাহ তাআ’লা বলেন, “সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আসমান ও যমীনের স্রষ্টা এবং ফেরেশতাগণকে করেছেন বার্তা বাহক। তারা দুই দুই, তিন তিন ও চার চার ডানা বিশিষ্ট হয়ে থাকে। তিনি সৃষ্টির মধ্যে যা ইচ্ছা তা যোগ করেন। আর নিশ্চয় আল্লাহ সর্ববিষয়ে সক্ষম।”
আল্লাহ তাআ’লা তাঁর নিজের ও নবী-রসুলদের মাঝে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ফেরেশতাদেরকে বার্তাবাহক বা ‘দূত’ বানিয়েছেন। ফেরেশতাদের ডানা রয়েছে, যার সাহায্যে তাঁরা উড়তে পারেন, যাতে তাঁরা দ্রুত আল্লাহর বাণী নবী-রসুলদের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন। তাঁদের মাঝে কারো দুইটি ডানা রয়েছে, কারো তিন তিনটি, কারো চার চারটি করে ডানা রয়েছে। কারো কারো এর চাইতে বেশি ডানা রয়েছে। যেমন মেরাজের রাতে আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম জিব্রাঈল আ’লাইহিস সালামকে দেখেছিলেন, এ সময় তাঁর ছয়শত ডানা ছিলো। তাঁর ডানাগুলো এতো বড় ছিলো যে, দুইটি ডানার মাঝখানে পূর্ব দিক ও পশ্চিম দিকের সমান দূরত্ব ছিলো। সুরা ফাতির, আয়াত ১-এর তর্জমা ও তাফসীর।
(২) কোন ব্যক্তি ‘বিসমিল্লাহ’ বলে কাপড় খুললে শয়তান আর তার লজ্জাস্থানের মাঝে আল্লাহ তাআ’লা একটা পর্দা সৃষ্টি করে দেন, যে কারণে শয়তান তার লজ্জাস্থানের দিকে দৃষ্টিপাত করতে পারেনা। সুনানে তিরমিযীঃ ২/৫০৫, ইরওয়াউল গালীলঃ ৪৯, সহিহ আল-জামিঃ ৩/২০৩।
(৩) নারীদের সম্পূর্ণ শরীর হচ্ছে ‘আওড়াহ’। আওড়াহ অর্থ হচ্ছেঃ গোপনীয় জিনিস, যা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা ফরয। একারণে, নারীরা ঘর থেকে বের হলে শয়তান তাদের দিকে চোখ তুলে তাকায়। তিরমিযীঃ ১১৭৩, সহীহ, শায়খ আলবানী, সহীহ তিরমিযীঃ ৯৩৬।
(৪) প্রতিটা মানুষের সাথে আল্লাহ তাআ’লার পক্ষ থেকে একজন ‘হাফিজ’ (হিফাজতকারী ফেরেশতা) নিযুক্ত রয়েছেন। তিনি তাকে বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করে থাকেন, তবে আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তা ছাড়া। যেইভাবে দেহরক্ষীরা রাজা-বাদশাহদেরকে সর্বদা পাহারা দিয়ে রাখে, তারা ঠিক সেইভাবে আমাদেরকে হেফাজত করেন। আল্লাহ তাআ’লা বলেন, “তার সামনে ও পেছনে পালাক্রমে আগমনকারী ফেরেশতা নিযুক্ত রয়েছে, তারা আল্লাহর আদেশক্রমে তার হিফাজত করে থাকে।” সুরা রাদঃ ১১, সুরা আত-ত্বারিক্বঃ ৪।
(৫) ফেরেশতাদের মাঝে সবচাইতে সম্মানিত, আল্লাহর নৈকট্যশীল ও বিশ্বস্ত হচ্ছেন জিব্রাঈল আমিন, আ’লাইহিস সালাম। ইয়াহুদীরা আল্লাহর সম্মানিত দূত জিব্রাঈলের সাথে শত্রুতা পোষণ করে। কারণ একবার আল্লাহ তাআ’লা জিব্রাঈলকে দিয়ে ইহুদীদেরকে শাস্তি দিয়েছিলেন। সুরা তাকভীরঃ ২০-২১, সুরা নজমঃ ৫, সুরা বাক্বারাহঃ ৯৮।
(৬) আজরাঈল বলতে কোন ফেরেশতার নাম নেই। তাদের আসল নাম হচ্ছে ‘মালাকুল মাউত’ বা মৃত্যুর ফেরেশতারা। আর মৃত্যুর ফেরেশতা একজন না, অনেক ফেরেশতারা সম্মিলিতভাবে বান্দার জান কবজ করে থাকেন।
(৭) ‘কিরামান কাতিবিন’ অর্থ হচ্ছে সম্মানিত লেখকবৃন্দ। এটা কোন একজন ফেরেশতার নাম নয়, প্রতিটা বান্দার ডান দিকে ও বাম দিকে যেই ফেরেশতারা তার আমল লিপিবদ্ধ করেন, তাদের সাধারণ নাম হচ্ছে কিরামান কাতিবিন। সুরা ইনফিতারঃ ১১।
(৮) দুনিয়াবাসী মানুষের ইবাদতের জন্যে, নামাযের জন্য ও তাওয়াফ করার জন্যে যেমন মর্যাদাপূর্ণ ঘর ‘কাবা’ রয়েছে, ঠিক তেমনি আকাশবাসী ফেরেশতাদের জন্যে সমান মর্যাদাসম্পন্ন একটা মসজিদ রয়েছে, যাকে ‘বায়তুল মামুর’ বলা হয়। বায়তুল মামুরের অবস্থান হচ্ছে একেবারে আমাদের কাবা বরাবর সোজা সাত আসমানের উপরে। প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা এই বায়তুল মামুরে নামায পড়ার জন্যে প্রবেশ করেন। ফেরেশতাদের সংখ্যা এতো বেশি যে, একদিন যেই সত্তর হাজার ফেরেশতাদের বায়তুল মামুরে প্রবেশ করেন, কেয়ামত পর্যন্ত তাদের কারো সেখানে পুনরায় প্রবেশ করার সুযোগ হবেনা। আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম মেরাজের রাত্রিতে নিজ চোখে বায়তুল মামুর দেখেছিলেন। সুরা ত্বুরঃ আয়াত ৪-এর তাফসীর, ইবনে কাসীর।
(৯) নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ যখন কোন বান্দাকে ভালবাসেন, তখন তিনি জিব্রাঈলকে ডেকে বলেন, আমি (আল্লাহ) অমুক বান্দাকে ভালবাসি, সুতরাং তুমিও তাকে ভালবাসো। তখন জিব্রাঈল আ’লাইহিস সালাম তাকে ভালবাসেন। অতঃপর জিব্রাঈল আ’লাইহিস সালাম আসমানে এই ঘোষণা করে দেন যে, আল্লাহ অমুক বান্দাকে ভালবাসেন, সুতরাং (হে ফেরেশতাগণ!) তোমরাও তাকে ভালবাসো। তখন তাকে আসমানবাসীরা ভালবাসে এবং যমীনবাসীদের মাঝেও তাকে ‘মকবুল’ অর্থাৎ তাঁর প্রতি সকলের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি করে দেওয়া হয়।” সহীহ বুখারীঃ ৭৪৮৫।
(১০) মানুষের আত্মা যখন কবজ করার সময় হয়, তখন আল্লাহর নির্দেশে আকাশ থেকে মালাকুল মউত বা মৃত্যুর ফেরেশতারা সেই ব্যক্তির নিকটে আসে। নেককার লোকদের জন্যে রহমতের ফেরেশতা আসে, আর পাপাচারী ব্যক্তির জন্যে আজাবের ফেরেশতারা আসেন। আজাবের ফেরেশতাদের ভয়ংকর চেহারা ও রূপ দেখেই কাফের, মুশরেক ও পাপাচারী মুসলমানদের আত্মাটা ভয়ে শরীরের বিভিন্ন অংগ-প্রত্যংগে পালানোর চেষ্টা করে। এমনকি পাপাচারী ব্যক্তির আত্মাটা তার নখের নীচে, পশমের নিচে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করে। মালাকুল মউত পলায়নপর এই আত্মাকে পিটিয়ে পিটিয়ে টেনে বের করে আনার চেষ্টা করেন। বের করার সময় আত্মাটার এমন কষ্ট হয়, যেনো একটা চটের বস্তার মধ্যে দিয়ে একটা লোহার আংটা ঢুকিয়ে দিয়ে টেনে বের করার সময় যেভাবে ছিড়েফুড়ে বের হয়ে আসে, ঐ আত্মাটাও সেইভাবে ছিড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে বের হয়ে আসে। আর এইজন্যই ‘সাখারাতুল মউতের’ সময় পাপী লোকদের এতো কষ্ট হয়।
অপরদিকে নেককার বান্দাদের আত্মা মালাকুল মউতের আহবানে সাড়া দিয়ে এতো সহজে বের হয়ে আসে, যেইভাবে একটা পানির পাত্রকে কাত করলে একদম সহজেই পানি বের হয়ে আসে। আর শহীদদের মৃত্যু কষ্ট হয় সবচেয়ে কম। একটা পিপিলীকা কামড় দিলে যতটুকু কষ্ট হয়ে, ঠিক তেমনি কষ্ট হয় যখন একজন শহীদের শরীর থেকে তার আত্মাটা বের হয়ে যায় (সুনানে তিরমিযী)। মানুষের আত্মা কবজ করা শুরু হয় একেবারে তার পায়ের নখ থেকে। এইভাবে মৃত্যুর ফেরেশতারা আত্মাটাকে সমস্ত শরীর থেকে বের করে এনে গলার গরগরা পর্যন্ত নিয়ে আসেন। গলার গরগরা পর্যন্ত নিয়ে আসলে তখন ঐ ব্যক্তি একটা শব্দ করে বা কাপুনি দেয়, আর এরপরেই তার দুনিয়ার হায়াত শেষ হয়ে যায়। এরপরে তার বারযাখী বা পর্দার জীবন শুরু হয়।
সুবহানাল্লাহ ওয়াবিহা’মদিহী। ই’লম বা দ্বীনি জ্ঞান, আল্লাহর যিকির (আল্লাহকে স্বরণ করার) স্বাদ কত যে মিষ্টি! আপনি যত বেশি ইলমের সংস্পর্শে আসবেন, দেখবেন আপনি তত বেশি আল্লাহকে ভালোবেসে ফেলবেন। আশা করি আমার এই লেখা পড়ার দ্বারা আপনারা সকলেই এই কথাটা অনুভব করতে পেরেছেন। আমি কাবার প্রভু, মহান আরশের মালিকের কাছে এই দুয়া করছিঃ আয় আল্লাহ আপনি আমাদেরকে, আমাদের পরিবারের সকলকে আপনার প্রশস্ত রহমত ও খাস ভালোবাসা অর্জন করার তোওফিক দান করুন, আমিন।
____________________________________
অদৃশ্য জগতের কথা (পর্ব-৩)
(১) উপুর হয়ে বুকের বা পেটের উপরে শোয়া মাকরুহ, কারণ এইভাবে শোয়া আল্লাহ তাআ’লা অপছন্দ করেন। আবু দাউদঃ ৫০৪০, হাদীসটি সহীহ। অন্য হাদীসে আছে, এইভাবে জাহান্নামী লোকেরা শোয়। ইবনে মাজাহঃ ৩৭২৪।
(২) বাম হাতে খাবার বা পানি খাওয়া নিষিদ্ধ এবং অত্যন্ত ঘৃণিত একটা কাজ। কারণ, বাম হাত হচ্ছে ইস্তেঞ্জা, নাক পরিষ্কার করার মতো অপছন্দনী কাজের জন্যে। আর এমন অপছন্দনীয় কাজের জন্যে নির্ধারিত বাম দ্বারা হাত খাওয়া-দাওয়ার মতো উত্তম কাজেও বাম হাত ব্যবহার করা আল্লাহর অবাধ্য শয়তানের বদ স্বভাব। সহীহ মুসলিমঃ ৩৭৬৪। এমনকি খাবার সময়ও ডান হাতেই পানি খেতে হবে। অনেকে মনে করে, খাবার সময় ডান হাতে খেলে খাবার লেগে গ্লাস নোংরা হয়ে যাবে! জানিনা তাদের গ্লাসগুলো কি স্বর্ণ নাকি রূপা দিয়ে বানানো যে, একটু খাবার লাগলে ময়লা হয়ে যাবে? অথচ সুন্নাহ অনুসরণ করার ইচ্ছা থাকলে ডান হাতে খাবার সহ ধরলে একটু খাবার যদি লেগেই যায়, তাহলে খাওয়া শেষ করে গ্লাস ধুয়ে ফেললেই হয়। আর এমনটা করলে আশেপাশের লোকেরা কি মনে করবে? শরিয়ত সম্পর্কে অজ্ঞ, দুনিয়ামুখী লোকেরা আপনাকে খারাপ মনে করলো এটা ভালো, নাকি শয়তানের অনুসরণ করে বাম হাতে পানি খেয়ে আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করা ও নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আদেশের বিরোধীতা করা ভালো? উল্লেখ্য, খাবার সময় পানির গ্লাস বাম হাতে নিয়ে সামান্য একটু ডান হাতে দিয়ে স্পর্শ করলেও হবে না। বরং, ডান হাতেই ধরতে হবে, তবে ডান হাতের পাশাপাশি সুবিধার জন্যে একটু বাম হাত দ্বারা স্পর্শ করলে সমস্যা নেই।
(৩) পশুর হাড় ঢিলা-কুলুখ হিসেবে ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। কারণ আল্লাহর নাম নিয়ে জবাই করা হালাল প্রাণীর হাড় যেইগুলো মানুষেরা না খেয়ে ফেলে দেয়, সেইগুলো মুসলিম জিনদের খাবার। সহীহ বুখারীঃ ৩৫৭১। উল্লেখ্য, মুরগি বা গরুর হাড় খেতে আমাদের নিষেধ নাই, যার ইচ্ছা সে খাবে, যার রুচিতে হবেনা সে খাবেনা। যেইগুলো ফেলে দেওয়া হবে, সেইগুলো মুসলিম জিনেরা খাবে।
(৪) যখন সন্ধ্যাবেলা ঘনিয়ে আসে এবং রাত্রি ডানা মেলে পৃথিবীকে আচ্ছন্ন করা শুরু করে, তখন জিনেরা বের হয়। একারণে আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বাচ্চাদেরকে বাইরে বের হতে দিতে নিষেধ করেছেন। সন্ধ্যা শেষ হয়ে রাতের কিছুটা সময় পার হলে তখন বাচ্চাদেরকে বের হতে দিতে কোন সমস্যা নেই। সহীহ বুখারীঃ ৩২৮০।
(৫) রাতের বেলা ঘরের দরজা বন্ধ করার সময় বিসমিল্লাহ বলে বন্ধ করতে হবে, তাহলে জিনেরা সেই দরজা খুলতে পারবেনা। রাতের বেলা খাবার ও পানির পাত্রগুলোও বিসমিল্লাহ বলে ঢেকে রাখতে হবে এবং শোয়ার পূর্বে বাতি বা চুলার আগুন নিভিয়ে ফেলতে হবে। সহীহ মুসলিমঃ ২০১২।
(৫) আযান দিলে শয়তান বা কাফের জিনেরা বায়ু ছাড়তে ছাড়তে লোকালয় থেকে পলায়ন করে। আযান শেষ হলে তারা পুনরায় লোকালয়ে ফিরে এসে মানুষকে, বিশেষ করে যারা নামায পড়ে তাদেরকে কুমন্ত্রনা দিতে থাকে। সহীহ মুসলিমঃ ৭৫৩।
(৬) রাতের বেলা কুকুর ও গাধা শয়তান জিনদেরকে দেখতে পেলে চিৎকার-চেঁচামেচি করে। অনেক সময় ইশা বা ফযরের আযান দিলে কুকুরেরা চিৎকার শুরু করে। কারণ, তখন কুকুরেরা আযান শুনে পলায়নরত শয়তান জিনদের দেখতে পায়। যেহেতু রাতের বেলা কুকুর ও গাধা শয়তান দেখলে ডাকে, একারণে রাতের বেলা গাধা ও কুকুরের ডাক শুনলে “আ’উযু বিল্লাহিমিনাশ-শাইতানির রাযীম” এই দুয়া পড়ে শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতে হয়। সহীহ মুসলিমঃ ২৭৬৯।
(৬) মোরগ যখন আল্লাহর রহমতের ফেরেশতাদেরকে দেখে, তখন সে ডাকে। একারণে মোরগের ডাক শুনে “আল্লাহুম্মা ইন্নি আস-আলুকা মিং ফাযলিক” এই দুয়া পড়ে আল্লাহর অনুগ্রহ চাইতে হয়। দুয়াটির অর্থ হচ্ছেঃ হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে তোমার অনুগ্রহ প্রার্থনা করছি। সহীহ বুখারীঃ ৩৩০৩।
(৭) হাশরের দিন শেষ বিচারের পরে আল্লাহ তাআ’লা জান্নাতীদেরকে জান্নাতে দেবেন, আর জাহান্নামীদেরকে জাহান্নামে দেবেন। তখন একজন ঘোষণাকারী জান্নাতী ও জাহান্নামীদেরকে ডাক দিয়ে বলবেন, তোমরা এই দিকে দেখো। তখন জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝখানে একটা সাদা মেষ বা দুম্বাকে দেখিয়ে বলা হবে, তোমরা কি জানো এটা কি? সকলেই বলবে, হ্যা জানি, এটা হচ্ছে “মৃত্যু”। তখন সেই দুম্বাটিকে জবাই করে ফেলা হবে। এইভাবে দুম্বারূপী মরণকে জবাই করে আল্লাহ মৃত্যুকে চিরতরে হত্যা করে ফেলবেন। তখন বলা হবে, আজকের পর থেকে আর কোন মরণ থাকবেনা। সুতরাং যারা জান্নাতে যাবে, তারা চিরকাল জান্নাতে আনন্দ-উল্লাসের মাঝে থাকবে। আর যারা জাহান্নামে যাবে তারা আযাব-গজবে যতই কষ্ট পাক, কিন্তু কোনদিন একেবারে মরবে না। দুম্বারূপী মৃত্যুকে হত্যা করে ফেলার এই ঘোষণার কারণে জান্নাতীরা আরো বেশি আনন্দিত হবে, কারণ তাদের আনন্দের জীবন কখনো শেষ হবেনা। আর এই ঘোষণা জাহান্নামীদের জন্যে আরো বড় বিপদ ও দুঃখ নিয়ে আসবে। কারণ, জাহান্নামে যতই আগুনে পুড়ুক বা যতই যন্ত্রনাদায়ক শাস্তির ফলে যতই কষ্ট ভোগ করুক, তার ফলে তাদের মৃত্যু হবেনা। সহীহ বুখারীঃ ৪৪৫৩, সহীহ মুসলিমঃ ২৮৪৯।
আয় আল্লাহ! তুমি আমাদের জন্যে সেই কঠিন দিনকে সহজ করো। আয় আমাদের রব্ব! সেইদিন আপনি দয়া করে আমাদেরকে অনন্ত সুখের জীবন দান করুন এবং অনন্তকালের জাহান্নামের শাস্তি থেকে আপনি আমাদেরকে, আমাদের পরিবারে সকলকে, সমস্ত মুসলমান ভাই ও বোনদেরকে হেফাজত করুন। আমিন ইয়া রাব্বাল আ’লামীন।
____________________________________
অদৃশ্য জগতের কথা (পর্ব-৪)
(১) রুকু থেকে দাঁড়ানোর সময় “সামিআ’ল্লা-হুলিমান হা’মিদাহ” বলে দাঁড়াতে হয়। এরপর দাঁড়িয়ে বলতে হয় “রব্বানা ওয়া লাকাল হা’মদ”। এতটুকু বললেই ফরয আদায় হয়ে যাবে। তবে এই দুয়ার পরে ছোট্ট সুন্দর আরেকটা দুয়া আছে। সেই দুয়াটা আল্লাহ তাআ’লা এতো বেশি পছন্দ করেন যে, কোন ব্যক্তি যদি রুকু থেকে দাঁড়ানোর পরে সেই দুয়াটা পড়ে, তাহলে ত্রিশ (৩০) জনের বেশি ফেরেশতা সেই দুয়ার সাওয়াব কে আগে লিখবেন, এনিয়ে তারা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু করেন। সহীহ বুখারীঃ ৭৬৫। দুয়াটা হচ্ছে, “হা’মদান কাসীরান ত্বোয়ায়্যিবান মুবা-রাকান ফীহ”।
(২) আল্লাহ একেক জন ফেরেশতাকে একেকটা দায়িত্ব দিয়েছেন। তাঁদের মাঝে প্রধান একজন ফেরেশতা হচ্ছেন ইসরাফিল আ’লাইহিস সালাম। তিনি হচ্ছেন শিংগাওয়ালা ফেরেশতা, অর্থাৎ তিনি ফুঁ দেওয়ার জন্য মুখে শিংগা ধরে সর্বদা প্রস্তুত আছেন। তিনি কান লাগিয়ে আছেন, আল্লাহ কখন তাঁকে আদেশ দেবেন আর তিনি শিংগাতে ফুঁ দেবেন। ইসরাফিল আ’লাইহিস সালাম যখন প্রথমবার শিংগাতে ফুঁ দিবেন, তখন কিয়ামত সংগঠিত হবে। যার ফলে মানুষ, জিন, পশু-পাখি, সকলেই মৃত্যুবরণ করবে। এরপর আল্লাহ যখন তাঁকে পুনরায় আদেশ করবেন, তখন তিনি দ্বিতীয়বারের মতো শিংগাতে ফুঁ দিবেন, যার ফলে সমস্ত মানুষ জীবিত হয়ে উঠবে। আর একে ‘হাশর’ বা পুনরুত্থান বলা হয়।
(৩) কোন মহিলা যদি তার স্বামীকে কষ্ট দেয়, তাহলে সেই লোকের জান্নাতের হুর মহিলাটিকে অভিশাপ দিতে থাকে। নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যখনই কোনো মহিলা দুনিয়াতে তার স্বামীকে কষ্ট দেয়, তখনই তার সুনয়না হুর (জান্নাতী) স্ত্রী (অদৃশ্যভাবে) ঐ মহিলার উদ্দেশ্যে বলতে থাকে, আল্লাহ তোকে ধ্বংস করুন। ওকে কষ্ট দিস না। ও তো তোর নিকট সাময়িক মেহমান মাত্র। অচিরেই সে তোকে ছেড়ে আমাদের কাছে আসবে।” তিরমিযীঃ ১১৭৪, ইবনু মাজাহঃ ২০১৪, হাদিসটি হাসান, শায়খ আলবানী।
(৪) যখন আল্লাহর কোনো ঘরে (মসজিদে) লোকজন একত্রিত হয়ে কুরআন তিলাওয়াত করে এবং নিজেদের মাঝে তা অধ্যয়ন করে, তখন তাদের উপর প্রশান্তি অবতীর্ণ হয়, আল্লাহর রহমত তাদেরকে আবৃত করে রাখে, ফেরেশতাগণ তাদের বেষ্টন করে রাখেন এবং আল্লাহ তাঁর কাছে অবস্থিত ফেরেশতাদের কাছে তাদের আলোচনা করেন। সহীহ মুসলিমঃ ২৬৯৯, আবু দাউদঃ ১৪৫৫।
(৫) নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যদি তোমাদের কেউ নামাযে হাই তোলে, তাহলে সে যেন যথা সম্ভব তা চেপে রাখার চেষ্টা করে; কারণ (মুখ হা করে) হাই তুললে (তার মুখ দিয়ে) শয়তান প্রবেশ করে।” আহমাদ, মুসলিমঃ ২৯৯৫। হাই চেপে রাখার নিয়ম হবে, সে যেন তার হাত মুখে রাখে। নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেনঃ “যদি তোমাদের কেউ হাই তোলে, তাহলে সে যেন তার মুখে হাত দিয়ে ঢাকে।” সহীহ মুসলিমঃ ২৯৯৫।
____________________________________
অদৃশ্য জগতের কথা (পর্ব-৫) ::: সিদরাতুল মুনতাহা ও রফরফ
আরবী ‘সিদরাহ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে কুল বা বড়ই গাছ, আর ‘মুনতাহা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে শেষ সীমানা। সুতরাং, ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ অর্থ হচ্ছেঃ একেবারে শেষ সীমানায় অবস্থিত বড়ই গাছ। এই গাছটি সাত আসমানের উপরে, একেবারে শেষ সীমানায় অবস্থিত, যা অত্যন্ত সুন্দর ও সুসজ্জিত। এই গাছটিকে সিদরাতুল মুনতাহা বলা হয় কারণ এটা হচ্ছে আল্লাহ তাআ’লার আরশ ও তাঁর সমগ্র সৃষ্টির মাঝে একটা সীমানা বা বাউন্ডারী। সিদরাতুল মুনতাহার উর্ধ্বে কেউ যেতে পারেনা, এমনকি আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত কোন ফেরেশতাও না। সিদরাতুল মুনতাহার উর্ধ্বে আল্লাহর আরশে মুআ’ল্লাকা অবস্থিত।
মিরাজের রাত্রিতে নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামকে জিব্রাঈল আ’লাইহিস সালাম সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে একা রেখে চলে যান, কারণ সিদরাতুল মুনতাহার সীমানা অতিক্রম করে আরশের দিকে অগ্রসর হলে আল্লাহ তাআলা’র নূরে জিব্রাঈল আ’লাইহিস সালামের ডানাগুলো পুড়ে যেত। আর সেখানে তাঁর যাওয়ার অনুমতিও ছিলোনা।
আল্লাহ তাআ’লা যত ওয়াহী (আদেশ বা বিধানাবলী) নাযিল করেন, তা আরশ থেকে প্রথমে সিদরাতুল মুনতাহায় নাযিল করা হয়। অতঃপর, সেখান থেকে ওয়াহী বহনকারী সংশ্লিষ্ট ফেরেশতাদের মাধ্যমে তা দুনিয়াতে প্রেরিত হয়। অনুরূপভাবে, বান্দাদের আমলনামাসমূহ প্রথমে সিদরাতুল মুনতাহা নিয়ে আসা হয়। অতঃপর, এখান থেকে আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়। ফেরেশতা বা নবী-রাসুল কেউই সিদরাতুল মুনতাহার স্থান অতিক্রম করতে পারেননি, একমাত্র আমাদের নবী মুহা’ম্মাদ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ছাড়া।
মিরাজের রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ফিরে এসে সিদরাতুল মুনতাহা সম্পর্কে বলেছিলেন, “আমি সিদরাতুল মুনতাহা দেখলাম। এর ফল (বড়ই) যেন ‘হাজার’ নামক স্থানের (বড়) মটকার ন্যায়। আর তার পাতা যেন হাতীর কানের মতো বড়। সিদরাতুল মুনতাহার মূল থেকে চারটি ঝরনা প্রবাহিত হয়েছে। দুইটি ঝরণা ভেতরে, আর দুইটি ঝরণা বাইরে। এই (চারটি ঝরণা) সম্পর্কে আমি জিবরাঈলকে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, ভেতরের দুইটি ঝরণা জান্নাতে অবস্থিত। আর বাইরের ঝরণা দুইটির একটি হল (ইরাকের) ফুরাত, আর অপরটি হল (মিশরের) নীল নদ।
সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করার পর নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামকে ‘রফরফ’ নামক একটি বাহন আরশে মুআ’ল্লাকা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। রফরফ আরবী শব্দ, যার অর্থ হচ্ছেঃ রেশমী কাপড়, বালিশ, চাদর, মাদুর ইত্যাদি। রফরফ হল সবুজ রংয়ের গদি বিশিষ্ট একটা পালকী বিশেষ, এক প্রকার বাহন, যার মাধ্যমে নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম সিদরাতুল মুনতাহা থেকে আরশে মুআ’ল্লাকা গিয়েছিলেন।
আল্লাহ তাআ’লা কুরআনুল কারীমে উল্লেখ করেছেন, “অতঃপর তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম, জিব্রাঈল আ’লাইহিস সালাম-এর) নিকটবর্তী হলেন এবং ঝুলে গেল। তখন (তাঁদের মাঝে ব্যবধান ছিলো) দুই ধনুকের ব্যবধান বা তার চাইতেও কম (খুবই নিকটে)। অতঃপর আল্লাহ স্বীয় বান্দার প্রতি যা ওয়াহী (প্রত্যাদেশ) করার তা করলেন।” সুরা আন-নাজমঃ ৮-১০।
উল্লেখ্য, সুরা নজমের এই আয়াত “তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকটবর্তী হলেন এবং ঝুলে গেল”, এর দ্বারা সিদরাতুল মুনতাহার নিকটে নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জিব্রাঈল আ’লাইহিস সালাম-এর সাথে সাক্ষাত লাভকে বুঝানো হয়েছে, আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখা নয়। কারণ, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামআ’তের নিকট অধিকতর গ্রহণযোগ্য মত হচ্ছে, মিরাজের রাত্রিতে নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তাআ’লার সাথে সরাসরি কথা বলেছেন, কিন্তু স্বচক্ষে দেখতে পারেন নি। কারণ, দুনিয়ার কোন চোখ দ্বারা আল্লাহকে দেখা সম্ভব নয়। তবে আল্লাহর ইচ্ছায় মুমিনরা জান্নাতে আল্লাহকে দেখতে পারবে, সেটা ভিন্ন কথা। এনিয়ে মা আয়িশাহ রাদিয়াল্লাহু আ’নহার সহীহ হাদীস ও ব্যখ্যা রয়েছে, যেই ব্যপারে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউ’দ রাদিয়াল্লাহু আ’নহু একমত পোষণ করেছেন।
মিরাজের রাতে আল্লাহ তাআ’লা নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামকে যেই ওয়াহী করেছিলেন, তার মাঝে অন্যতম ছিলোঃ দিনে-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত বা নামায ফরয করার বিষয়টি। প্রথমে আল্লাহ তাআ’লা আমাদের উপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছিলেন। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম যখন এই আদেশ নিয়ে ফিরে আসছিলেন, তখন সাইয়্যিদিনা মুসা আ’লাইহিস সালাম তাঁকে বলেন, হে মুহাম্মাদ! আপনার উম্মতের লোকদের জন্যে দিনে-রাতে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায আদায় করার বোঝা ভারী হয়ে যাবে, যার কারণে তারা তা আদায় করবেনা। সুতরাং, আপনি আল্লাহর কাছে আবার যান এবং নামায কমিয়ে নিন। এভাবে আল্লাহর বার বার যাওয়া-আসার মাধ্যমে কমাতে কমাতে শেষ পর্যন্ত আল্লাহ নামাযকে কমিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত করে দেন। এরপরে আরো কমানোর জন্যে আল্লাহর কাছে যেতে নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম সংকোচ বোধ করলেন। কিন্তু আল্লাহ তাআ’লা তাঁর দয়াবশত আমাদের জন্যে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করলে তার জন্য প্রথমে নির্ধারিত পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাযের সওয়াব দান করবেন বলে ঘোষণা করলেন। সুবহা’নাল্লাহি ওয়া বিহা’মদিহী, সুবহা’নাল্লাহিল আ’যীম। বুখারীঃ ৩৪২, মুসলিমঃ ১৬৩।
____________________________________
অদৃশ্য জগতের কথা (পর্ব-৬)
(১) নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “(মৃত্যুর ফেরেশতারা) যখন কোন ব্যক্তির আত্মা কবজ করে নিয়ে যায়, তখন চক্ষু তার অনুসরণ করে।” আহকামুল জানায়িজ, শায়খ আলবানী রাহিমাহুল্লাহ। একারণে মৃত্যুর পরে মানুষের চোখ দুটি খোলা থাকে, কারণ তার চোখ মৃত্যুর ফেরেশতারা আত্মা নিয়ে যাচ্ছে, সর্বশেষ এই দৃশ্য দেখতে দেখতে দৃষ্টিহীন হয়ে পড়ে। মৃত্যুর পরে আত্মীয় স্বজনের জন্য করণীয় হচ্ছেঃ
(ক) হাত দিয়ে চোখ দুটি বন্ধ করে দেওয়া,
(খ) চাদর দিয়ে মৃত ব্যক্তির সম্পূর্ণ শরীর ঢেকে দেওয়া,
(গ) দ্রুত গোসল, জানাজা ও কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
(২) আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউ’দ রাদিয়াল্লাহু আ’নহু বলেছেন, “(স্বামী ও স্ত্রীর মাঝে) বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর ঘৃণা ও রাগ শয়তানের পক্ষ থেকে হয়ে থাকে।” মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বাহ, মুসান্নাফ ইবনে আব্দুর রাযযাক্ব, সহীহ, শায়খ আলবানী আদাবুল যিফাফ। শয়তানের বড় একটা লক্ষ্য হচ্ছে, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে রাগ ও ঘৃণা সৃষ্টি করা, যাতে করে তারা ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয়। এভাবে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে দুজনেই পেরেশানিতে ভুগবে, আল্লাহর ইবাদত থেকে, যিকর থেকে দূরে থাকবে, আস্তে আস্তে তালাক বা বিচ্ছেদের দিকে যাবে। পরকীয়া, অবৈধ সম্পর্ক ও নাজায়েজ কাজের রাস্তা উন্মুক্ত হবে। সুতরাং, দাম্পত্য জীবনে স্বামী ও স্ত্রীকে শয়তানের ষড়যন্ত্রের ব্যপারে সাবধান থাকতে হবে, একজন আরেকজনের প্রতি সর্বদা, আন্তরিক, কল্যাণকামী, উত্তম চরিত্রের ও মিষ্টভাষী হতে হবে। রাগ, জিদ, অহংকার, মন্দ ও কটু ভাষা, কঠোরতা বর্জন করতে হবে। আশা করা যায় এভাবে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে আল্লাহর যেই রহমত, তা বজায় থাকবে।
(৩) কুরআনের তাফসীরবিদগণ বলেছেন, “জিনদের মাঝে যারা অবাধ্য, বেহায়া, মাস্তান, দুষ্ট প্রকৃতির ও শক্তিশালী হয়ে থাকে, তাদেরকে ইফরীত বলা হয়।” আল-মুফরাদাত ফী গারিবিল কুরআন। ইফরীত শব্দের বাংলা অর্থ হচ্ছেঃ ভূত।
(৪) ইমাম ইবনে কুদামাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, “যাদুর প্রভাবে মানুষ দৈহিক ও মানসিকভাবে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে, মৃত্যুবরণ করে এবং স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছিন্নতা ঘটে।” ফাতহুল মাজীদঃ ৩১৪।
(৫) নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “চোখের নজর সত্য, তা মানুষকে উপর থেকে নীচে ফেলে দেয়।” মুসনাদে আহমাদ, তাবারানী, শায়খ আলবানী (রহঃ)।
নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন, “চোখের নজর মানুষকে কবর পর্যন্ত পৌঁছে দেয় আর উটকে পাতিলে।” সহীহ আল-জামিঃ ১২৪৯। পাতিলে পৌঁছে দেয় কথাটির অর্থ হচ্ছে, উত্তম উট যার দ্বারা মালিকের অনেক উপকার হয়, তার এমন ক্ষতি বা রোগ হবে যে, মৃত্যুর আশংকার কারণে দ্রুত জবাই করে রান্না করে খেতে হবে।
চোখ লাগা বা বদ নজর বলতে কি বুঝায়?
ইমাম ইবনে আসীর রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, “অমুকের চোখ লেগেছে এটা তখন বলা হয় যখন কারো প্রতি কোন শত্রু অথবা হিংসুক দৃষ্টিপাত করে, আর এর ফলে সে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে।” আল-বিদায়া ওয়া আন-নিয়াহাঃ ৩/৩২।
____________________________________
অদৃশ্য জগতের কথা (পর্ব-৭)
(১) মৃত্যুর ফেরেশতারা যখন কোন মানুষের আত্মা কবজ করেন, তখন ফেরেশতাদের চেহারা, কথা ও আচরণ দ্বারাই একজন মানুষ বুঝতে পারে, দুনিয়াতে সে যেই আমল করেছে, কবরে তার জন্যে কি প্রতিদান অপেক্ষা করছে। আল্লাহর প্রতি সঠিক ঈমান এনে, আল্লাহকে ভয় করে ও ভালোবেসে তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে যে ব্যক্তি দুনিয়াতে নেক জীবন অতিবাহিত করে, মৃত্যুর সময়ই ফেরেশতারা কবরে ও আখেরাতের জীবনে তার জন্যে আল্লাহ যে সুখের জীবন প্রস্তুত করে রেখেছেন, সেই সুসংবাদ শোনাতে থাকে। যেকারণে কোন নেককার ব্যক্তির জানাযা শেষে যখন তার লাশ কাঁধে বহন করে কবরের দিকে নেওয়া হয়, সেই মৃত নেককার ব্যক্তিটি তখন বলতে থাকে, “তোমরা আমাকে দ্রুত (কবরের দিকে) নিয়ে চলো, আমাকে তোমরা দ্রুত নিয়ে চলো।” পক্ষান্তরে, কোন পাপী ব্যক্তির মৃত্যুর সময়ই দুনিয়াতে তার কৃত খারাপ কাজের শাস্তি শুরু হয়ে যায়। আর ফেরেশতারা কবরে ও আখেরাতের জীবনে তার জন্যে আল্লাহ যে কঠিন শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন, সেই দুঃসংবাদ শোনাতে থাকে। যেকারণে কোন পাপী ব্যক্তির জানাযা শেষে যখন তার লাশ কাঁধে বহন করে কবরের দিকে নেওয়া হয়, সেই মৃত পাপী ব্যক্তিটি আফসোস করে বলতে থাকে, “হায়! তোমরা আমকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ। হায়! তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ।” তার এই চিৎকার মানুষ ব্যতীত সমস্ত প্রাণী শুনতে পায়। মানুষ যদি পাপী ব্যক্তিদের এই ভয়ংকর চিৎকার শুনতে পেতো, তাহলে বেহুঁশ হয়ে যেত। সহীহ বুখারীঃ ১৩১৪, নাসায়ীঃ ১৯০৯। একারণে নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমরা জানাযার (লাশ) নিয়ে যেতে তাড়াতাড়ি কর। কেননা, সে যদি পুণ্যবান হয়, তাহলে ভালো; ভালো (গন্তব্যের) দিকেই তোমরা তাকে পেশ করবে। আর যদি তা এর উল্টো হয়, তাহলে তা মন্দ; যা তোমরা তোমাদের ঘাড় থেকে নামিয়ে দেবে।” সহীহ বুখারীঃ ১৩১৫, সহীহ মুসলিম ৯৪৪।
(২) শয়তান দুই প্রকার, জিন শয়তান ও মানুষ শয়তান। মানুষের মাঝে যারা শয়তানের বন্ধু, শয়তান তাদের কাছে ওয়াহী (প্রত্যাদেশ) পাঠায়। আল্লাহ তাআ’লা বলেন, “নিশ্চয়ই শয়তান তার আওলিয়া (বন্ধুদের) কাছে ওয়াহী প্রেরণ করে, যাতে তারা যেন তোমাদের সাথে তর্ক করে। সুতরাং (হে মুসলমানেরা সাবধান!) তোমরা যদি শয়তানের বন্ধুদের আনুগত্য করো, তাহলে তোমরা মুশরেক হয়ে যাবে।” সুরা আন’আম আয়াতঃ ১২১। গণক বা জ্যোতিষীরা শয়তানের দোসর, যাদের উপর শয়তান নাযিল হয় এবং তারা শয়তানের নাযিল করা ভবিষ্যতবাণীর কথাগুলোর সাথে আরো ৯৯-টা মিথ্যা যুক্ত করে মানুষকে বলে। আল্লাহ তাআ’লা শয়তানের বন্ধু, তাগুত এই জ্যোতিষীদের ব্যপারে বলেছেন, “(হে নবী!) আমি কি আপনাকে বলে দেব, শয়তানেরা কার উপর অবতরণ করে? শয়তানরা অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক মিথ্যাবাদী, গোনাহগারের উপরে। তারা শোনা কথা এনে দেয় এবং তাদের অধিকাংশই মিথ্যাবাদী।” সুরা শুআ’রাঃ ২২১-২২৩।
(৩) আল্লাহ তাআ’লা নক্ষত্র বা আকাশের তারাগুলোকে সৃষ্টি করেছেন তিনটি উদ্দেশ্যে। প্রথমতঃ প্রদীপের মতো মিষ্টি ও নরম আলো দিয়ে আসমানের সৌন্দর্য বর্ধন করার জন্যে। দ্বিতীয়তঃ শয়তানেরা যখন ফেরেশতাদের কথা শোনার জন্যে আসমানের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে, তখন এগুলোকে উল্কারূপে তাদের উপর নিক্ষেপ করা হয়। তৃতীয়তঃ মানুষ যেনো এই নক্ষত্রগুলো দেখে জাহাজে করে সমুদ্রে ও স্থলে পথ ও দিক নির্ণয় করতে পারে। সুরা মুলকঃ ৫, সুরা আনআ’মঃ ৯৭।
(৪) হাজার অর্থ পাথর, আর আসওয়াদ অর্থ কালো। সুতরাং, হাজরে আসওয়াদ অর্থঃ কালো পাথর। এই পাথরটি আল্লাহ তাআ’লা জান্নাত থেকে ফেরেশতাদেরকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছিলেন, যা ইব্রাহীম ও ইসমাঈল আ’লাইহিস সালাম কাবাঘর নির্মানের সময় কাবার দক্ষিণ-পূর্ব দেয়ালে স্থাপন করেছিলেন। প্রথম যখন পাথরটি আনা হয়েছিলো তখন তার রঙ ছিলো দুধের চাইতে সাদা। কিন্তু পাপী মানুষের স্পর্শের কারণে আস্তে আস্তে এটা কালো বর্ণ ধারণ করে। কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআ’লা এই হাজরে আসওয়াদকে এমনভাবে উত্থিত করবেন যে, তার দুটি চোখ থাকবে যার দ্বারা সে দেখতে পারবে, তার একটা জিহবা থাকবে যার দ্বারা সে কথা বলবে। যে ব্যক্তি দুনিয়াতে ঈমানের সহিত এই পাথরটিকে চুম্বন করবে, কেয়ামতের দিন হাজরে আসওয়াদ তাকে চিনতে পারবে এবং তার ঈমানের পক্ষে সাক্ষ্য দেবে। উল্লেখ্য, এই পাথরের নিজের ক্ষমতা নেই যে, সে মানুষের কোন ভালো বা মন্দ করবে। যেহেতু আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম জান্নাতের এই পাথরটিকে ভালোবেসে চুমু খেয়েছিলেন, সেজন্যে আমাদের জন্যেও তাঁর অনুসরণে সুন্নত হচ্ছে পাথরটিকে চুমু দেওয়া। তিরমিযীঃ ৯৬১, তিরমিযীঃ ৭৮৮, সনদ সহীহ।
(৫) নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যখন তোমাদের কেউ ঘুমাতে যায়, শয়তান তখন তার মাথায় তিনটা গিঁট লাগিয়ে দেয়। প্রত্যেক গিঁট লাগানোর সময় সে বলে, “এখনো অনেক রাত্র বাকী আছে” অথাৎ তুমি শুয়ে থাক। যখন সে জেগে উঠে, সে যদি আল্লাহর যিকর করে (অর্থাৎ আল্লাহকে স্মরণ করে), তাহলে একটি গিঁট খুলে যায়। অতঃপর সে যদি ওযু করে, তাহলে আরো একটি গিঁট খুলে যায়। আর সে যদি সালাত আদায় করে, তাহলে সবগুলো গিঁট খুলে যায় এবং তার সকালটা হয় আনন্দ ও উদ্দীপনার সহিত। আর সে যদি (ঘুম থেকে না উঠে, আল্লাহকে স্মরণ না করে, ওযু না করে এবং ফযরের নামায না পড়ে), তাহলে তার সকালটা হয় ক্লান্ত ও বিষাদময়।” সহীহ বুখারীঃ ১১৪২, সহীহ মুসলিমঃ ৭৭৬, নাসায়ীঃ ১৬১০।
(৬) নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যখন তোমাদের কেউ ঘুম থেকে উঠবে, সে যেন নাকে পানি দিয়ে তিনবার নাক ঝেড়ে নেয়। কেননা, শয়তান তার নাকের ভেতর রাত্রি যাপন করে।” সহীহ বুখারী ৩২৯৫, সহীহ মুসলিম।
(৭) কোন ব্যক্তি সূর্য উদয় হওয়া পর্যন্ত ঘুমিয়ে ফযরের নামায কাযা করে ফেললে শয়তান তার কানে পেশাব করে দেয়। সহীহ বুখারীঃ ৫৪/৪৯২।
(৮) নামাযরত কোন ব্যক্তি ও তার সুতরার জায়গার মধ্য দিয়ে কালো কোন কুকুর হেঁটে গেলে তার নামায ভেংগে যাবে। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “কালো কুকুর হচ্ছে শয়তান।” সহীহ মুসলিমঃ ১০৩২, তিরমিযীঃ ৩৩৮। একারণে নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কালো কুকুর এবং কুকুরদের মাঝে যেইগুলো হিংস্র, সেগুলোকে হত্যা করতে বলেছেন। সহীহ মুসলিমঃ ৩৮১৩, আবু দাউদঃ ২৮৩৯।
(৯) কল্যাণের দেশ শাম, হাশরের ময়দান শামঃ
আল্লাহ তাআ’লা বলেন, “আমি তাঁকে (ইব্রাহীম) ও লুতকে উদ্ধার করে সেই দেশে পৌঁছিয়ে দিলাম, যেখানে আমি বিশ্বের জন্যে কল্যাণ রেখেছি।” সুরা আল-আম্বিয়াঃ ৭১।
উল্লেখিত আয়াতে যেই স্থানের কথা বলা হয়েছে, সেটা হচ্ছে শাম, যেই এলাকা বর্তমানে বৃহত্তর সিরিয়া ও ফিলিস্থিন নামে পরিচিত। এই শামে অধিকাংশ নবী-রসুলদেরকে পাঠানো হয়েছিলো, এবং সেখান থেকেই তাঁদের উপর নাযিলকৃত শরিয়ত পৃথিবীর অন্যান্য দেশে প্রচারিত হয়েছিলো। এমনকি কিয়ামতের পর পুনরুত্থান ও হাশরও হবে এই শামে। আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আল-শাম হচ্ছে হাশরের ও পুনরুত্থানের ময়দান।” মুসনাদে আহমাদ, সনদ সহীহ।
অনেকে মনে করে, হাশরের ময়দান হবে আরাফাতে, এই ধারণা সঠিক নয়। আল্লাহর আদেশে ইসরাফীল আ’লাইহিস সালাম সিংগায় প্রথমবার ফুঁ দিলে কিয়ামত সংগঠিত হবে। এরপর দ্বিতীয়বার সিংগায় ফুঁ দেওয়া হবে, যার ফলে লোকেরা কবর থেকে উঠবে। বিচারের জন্যে তখন লোকদেরকে শামের দিকে তাড়িয়ে নেওয়া হবে। বিচারের জন্যে সবাইকে শামে বিশাল এক ময়দানে একত্রিত করাকে ‘হাশর’ বা মহা-সমাবেশ বলা হয়। আল-মানাভী, ফাতহুল ক্বাদীরঃ ৪/১৭১।
সংগ্রহঃ তোমরা তোমাদের পালনকর্তার অভিমূখী হও এবং তাঁর আজ্ঞাবহ হও
No comments:
Post a Comment