আমরা আজকে সুরেলা কণ্ঠের বক্তা মিজানুর রাহমান আল আযহারী (হাদাহুল্লাহ) নামক এক ব্যক্তির কয়েকটি বিভ্রান্তিকর বক্তব্যের পর্যালোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।
.
.
▶️ বক্তব্য - (এক)
"বিতির নামায তিনটি নিয়মে পড়া যায়। আমরা হানাফিরা যে পদ্ধতিতে বিতির নামায পড়ি তার আম দলিল রয়েছে। মৌলিক তিনটি পদ্ধতির যেকোনো একটি দিয়ে বিতির নামায পড়ুন, কিন্তু বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা যাবেনা। আমরা কেউ তাবলীগ জামাত করি, কেউ জামাআতে ইসলামী করি, কেউ চরমোনাই পীরের মুরিদ, কেউ হেফাজতে ইসলাম, কেউ কওমী, কেউবা আলিয়া। কিন্তু এই ভূখণ্ডে আমাদের দাড়িওয়ালা, টুপিওয়ালাদের মাঝে রয়েছে শতবছরের ঐক্য। এজন্যই দাওয়াতের নামে, সহিহ হাদিসের নামে, ইসলামের নামে এদেশের ঐক্য আপনারা নষ্ট করবেন না। এই ঐক্য নষ্ট করার কোনো অধিকার আপনাদের নাই। অতএব, এই ভূখণ্ডে কঠিন ইসলাম প্রচার করা আপনাদের দরকার নেই!
► লিংকঃ
https://www.youtube.com/watch?v=FMKgSZTO1p4&t=9s
► লিংকঃ
https://www.youtube.com/watch?v=FMKgSZTO1p4&t=9s
[মুলভাব সংক্ষেপিত]
.
.
এই বক্তব্যের পর্যালোচনাঃ
প্রথমত, বিতির নামায তিনটি নয়, দুইটি নিয়মে পড়ার বিশুদ্ধ বর্ণনা পাওয়া যায় হাদিসে। এদেশের হানাফিরা যে পদ্ধতিতে বিতির নামায আদায় করেন তার পক্ষে কোনো গ্রহনযোগ্য দলিল পাওয়া যায় না।
দ্বিতীয়ত, বক্তা অভিযোগ করেন, সহিহ হাদিসের নামে নাকি সমাজে বিভেদ তৈরি করা হচ্ছে, বিশুদ্ধ দ্বীনের দাওয়াতের কারণেই নাকি তাদের শতবছরের কথিত ঐক্য বিনষ্ট হচ্ছে!
আমি পাঠকদের কাছে জানতে চাই, কখন, কবে, কোথায় এদেশীয় বিভিন্ন ফিরকাবন্দী ওয়ালাদের ঐক্য ছিলো? দেওবন্দীদের একাংশের কাছে পীরপন্থীরা সবসময়ই ভ্রান্ত ছিলো। আবার মূলধারার দেওবন্দীদের কাছে জামাআতীরা পথভ্রষ্ট। এমনকি মওদুদী সাহেবকে রদ্দ করে তারা শত শত বই পর্যন্ত রচনা করেছেন। কওমীদের একাংশ ফুলতলীদের পিছনে নামাজ পড়ে না। আর জামাতীদের কাছে চরমোনাই হলো পথভ্রষ্ট। দেওয়ানবাগী সর্বমহলে গোমরাহ, কওমী আর আলিয়ার দ্বন্দ্ব বহু পুরনো। এইতো গতবছরই ব্রেরলভীদের সাথে দেওবন্দীদের খুনাখুনির ঘটনা ঘটে। কিছুদিন আগেও তাবলীগের দুই গ্রুপের খুনাখুনির ঘটনাগুলি জাতীয় পত্রিকার শিরোনাম হয়েছিল!
হ্যায়াতিদের কাছে মামাতিরা বিভ্রান্ত, আবার মামাতিদের কাছে হ্যায়াতি! এবার আপনিই বলুন, এ সমাজে ঐক্য কখন ছিল?
হ্যায়াতিদের কাছে মামাতিরা বিভ্রান্ত, আবার মামাতিদের কাছে হ্যায়াতি! এবার আপনিই বলুন, এ সমাজে ঐক্য কখন ছিল?
মোদ্দা কথা হলো, বক্তা সাহেবকে তার জাহালতের উপর ক্রন্দন করা উচিত এইজন্য যে, তিনি আজও ঐক্যের মানদণ্ড সম্পর্কেই ওয়াকিবহাল নন! কেনোনা ফিক্বহি মাসআলা মাসায়েল কখনো ঐক্যের ভিত্তি হতে পারেনা।
পাঠকদের জেনে রাখা জরুরী যে, এই বক্তা সাহেবগণ কিছু ভালো কথার আড়ালে বিভিন্ন মনভোলানো যুক্তি ও বচন দ্বারা আহলে সুন্নাহর বিরোধীতা। অতঃপর নিজ হস্তের কলম কিংবা মুখের বচন দ্বারা আহলে সুন্নাহর গর্দান উড়িয়ে দিয়ে বাতিলপন্থীদের রসদ জোগায়!
.
▶️ বক্তব্য - (দুই)
মুসা আলাইহিস সালাম যখন লোহিত সাগরে নিজ হাতের লাঠি দিয়ে আঘাত করলেন, তখন সেখানে একটি ব্রিজ তৈরি হয়েছিল।
এই বক্তব্যের পর্যালোচনাঃ
ইতিহাসবিদদের গ্রন্থ থেকে লোহিত সাগরে ব্রিজ তৈরি হওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং একটি রাস্তা তৈরি হয়েছিলো। কিন্তু সেটা ব্রিজ নয়, এমন বর্ণনা পাওয়া যায়। সুতরাং বক্তার উল্লিখিত দাবিটা মিথ্যা ও বানোয়াট!
.
.
▶️ বক্তব্য - (তিন)
নিম্নোক্ত ভিডিওতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দেহের গড়নের বর্ণনা দিতে গিয়ে বক্তা সাহেব বলেন, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বডি ছিলো সিক্স প্যাক। যুবক ভাইয়েরা, তোমরাও সবসময় এমনভাবে ফিট থাকবা!
এই বক্তব্যের পর্যালোচনাঃ
কুরআন হাদিস কিংবা সাহাবায়ে কেরামের কওল তো দূরের কথা, কোনো জাল হাদিস দ্বারাও এমন আজগুবী বর্ণনা ছাবিত হয়নি!
তাছাড়া যে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চুলায় কোনো কোনো সময় আগুন পর্যন্ত জ্বলতো না, উপোস করতে হয়েছে মাঝেমাঝে, সেই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কিনা সিক্স প্যাক বডি ছিলো!!!
আপনারা যারা gym করেন তারা নিশ্চয়ই জানেন সিক্স প্যাক বডি বানানো কতোটা কষ্টসাধ্য এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাছাড়া রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শরীরিক গড়ন সম্পর্কে মানুষকে এরকম বর্ণনা কোনো সাহাবী দেননি। অথচ উনারা যেনো তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সরাসরি দেখেছেন! অতএব, বক্তার উক্ত বক্তব্যটি বিভ্রান্তিকর, মনগড়া এবং বানোয়াট।
.
.
▶️ বক্তব্য - (চার)
দুটি প্রশ্নোত্তর রয়েছে নিম্নোক্ত ভিডিওতে।
১. কোনো ব্যক্তি মারা গেলে জিয়াফত, চল্লিশা খাওয়ানো কি জায়েজ?
২. মৃত ব্যক্তির পাশে বসে কোরআন মাজীদ পড়া ও খতম দেওয়া কি সাওয়াবের কাজ?
উত্তরে বক্তা মিজানুর রাহমান আল আযহার সাহেব বলেন,
১.আপনি [৪০ শা] খাওয়ান। খাওয়াতে দোষ নেই। মৃত ব্যক্তির রুহের মাগফিরাতের জন্য খাওয়ালে মাইয়াতের গুনাহ আল্লাহ মাফ করবেন। কিন্তু খাওয়াবেন মিস্কিনদেরকে, এয়াতিমদেরকে। কারণ, তারা বেশি হক্বদার। কিন্তু এখনকার চল্লিশাতে মিস্কিনদের জায়গা হয়না, বরং পয়সা ওয়ালারা এসে লাইনে বসে থাকে! অথচ, দরকার ছিলো আপনার আব্বা মারা গেছে তাই কোনো এতিমখানায় একটি গরু দান করে দেন, তারা খেয়ে দোয়া করবে।
২. কুরআন তেলাওয়াত করতে পারবেন। কারণ, হাদিসে এসেছে, মুমূর্ষু ব্যক্তির সামনে সুরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করলে তার মৃত্যু যন্ত্রণা হালকা হয়।
৩. অতিরিক্ত হিসেবে তিনি এখানে আম্নাজান খাদিজা রাদিআল্লাহু আনহা-র কবরে সাওয়াল জাওয়াব সংক্রান্ত একটি ঘটনা বর্ণনা করেন রেফারেন্সবিহীন।
তিনি বলেন, আম্মাজান খাদিজা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহা-র দাফন করার পর আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উনার কবরের পাশে দাড়িয়ে রইলেন কবরের তিনটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য। এমতাবস্থায় জিবরাইল আলাইহিসালাম এসে বললেন, খাদিজার জবাব স্বয়ং আল্লাহ দিবেন, আপনি চলে যান। অতঃপর তিনি বাড়ি ফিরে গেলেন।
এই বক্তব্যের পর্যালোচনাঃ
১. মৃত ব্যক্তির জন্য ভোজ, চারদিনা, চল্লিশা, জিয়াফত করা সুস্পষ্ট বিদাআত।
এটি আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহ দ্বারা সাবস্ত হয়নি। পরবর্তী লোকেরা এই রেওয়াজ চালু করেছে।
২. শ্রোতার প্রশ্ন ছিলো, মৃত ব্যক্তির পাশে বসে কোরআন তেলাওয়াত, খতম করা যাবে কিনা। অথচ বক্তা সাহেব মুমূর্ষু রোগীর পাশে বসে সুরা ইয়াসিন পড়ার দলীল দিয়ে সেটাকে জায়েজ বানিয়ে দিচ্ছেন! মুমূর্ষু রোগী আর মৃত ব্যক্তি কি এক হলো?
তারপরেও চলুন দেখি মুমূর্ষু রোগীর পাশে বসে সুরা ইয়াসিন পড়ার হাদিসটি বিশুদ্ধ কিনা!!!
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
(ب) عَنْ أُبَيَ بْنِ كَعْبٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ مَنْ قَرَأَ (يس) يُرِيْدُ بِهَا اللهَ غَفَرَ اللهُ لَهُ وَأَعْطَي مِنَ الْأَجْرِ كَأَنَّمَا قَرَأَ الْقُرْآنَ اثْنَتَىْ عَشَرَةَ مَرَّةً وَأَيُّمَا مَرِيْضٍ قُرِىءَ عِنْدَهُ سُوْرَةُ (يس) نَزَلَ عَلَيْهِ بِعَدَدِ كُلِّ حَرْفٍ عَشَرَةُ أَمْلاَكٍ يَقُوْمُوْنَ بَيْنَ يَدَيْهِ صُفُوْفاً فَيُصَلُّوْنَ وَيَسْتَغْفِرُوْنَ لَهُ وَيَشْهَدُوْنَ قَبْضَهُ وَغَسْلَهُ وَيَتَّبِعُوْنَ جَنَازَتَهُ وَيُصَلُّوْنَ عَلَيْهِ وَيَشْهَدُوْنَ دَفْنَهُ وَأَيُّمَا مَرِيْضٍ قَرَأَ سُوْرَةَ (يس) وَهُوَ فِىْ سَكْرَاتِ الْمَوْتِ لَمْ يَقْبِضْ مَلَكُ الْمَوْتِ رُوْحَهُ حَتىَّ يَجِيْئَهُ رِضْوَانُ خِازِنِ الْجَنَّةِ بِشُرْبَةٍ مِنَ الْجَنَّةِ فَيَشْرِبَهَا وَهُوَ عَلَى فِرَاشِهِ فَيَمُوْتُ وَهُوَ رَيَّانٌ وَلاَ يَحْتَاجُ إِلَى حَوْضٍ مِنْ حِيَاضِ الْأَنْبِيَاءِ حَتىَّ يَدْخُلَ الْجَنَّةَ وَهُوَ رَيَّانٌ .
উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য সূরা ইয়াসীন পাঠ করবে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন এবং তাকে প্রতিদান দান করবেন, যেনো সে দশবার কুরআন তেলাওয়াত করলো। কোনো অসুস্থ ব্যক্তির কাছে সূরা ইয়াসীন তেলাওয়াত করা হলে তার উপর প্রত্যেক অক্ষরের পরিবর্তে দশজন ফেরেশতা নাযিল হয়। তারা তার সামনে কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে তার জন্য দুআ করেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করেন। জান কবজ ও গোসল করার সময় উপস্থিত থাকেন, জানাযার সাথে গমন করেন। সালাত আদায় করেন এবং দাফন কার্যে উপস্থিত থাকেন। মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর এমন ব্যক্তির উপর যদি সূরা ইয়াসীন পাঠ করা হয়, তবে মালাকুল মাউত ততক্ষণ তার রূহ কবজ করবেন না, যতক্ষণ জান্নাতের তত্ত্বাবধায়ক জান্নাতের পানীয় না নিয়ে আসেন। অতঃপর বিছানায় থাকা অবস্থায় তাকে তা পান করাবেন। ঐ ব্যক্তি তখন পরিতৃপ্ত হবে। এমনকি নবীদের হাউযের পানিরও সে প্রয়োজন মনে করবে না। অবশেষে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তখনও সে পরিতৃপ্তই থাকবে।
(তাহক্বীক্ব : এটি ডাহা মিথ্যা বর্ণনা। এর সনদে উইসুফ ইবনু আতিইয়াহ নামে একজন মিথ্যুক রাবী আছে। এছাড়া সুওয়াইদ নামেও একজন দুর্বল রাবী আছে।
সোর্সঃ ছা‘লাবী ৩/১৬১ পৃঃ; সিলসিলা যঈফাহ হা/৪৬৩৬)
সোর্সঃ ছা‘লাবী ৩/১৬১ পৃঃ; সিলসিলা যঈফাহ হা/৪৬৩৬)
উল্লেখ্য যে, সূরা ইয়াসীন সম্পর্কে যতো ফজিলত বর্ণিত হয়েছে, সবই যঈফ কিংবা জাল। সহিহ কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না।
(সোর্সঃ সিলসিলাহ যঈফা ৬৬২৩-৬৬২৪)
(সোর্সঃ সিলসিলাহ যঈফা ৬৬২৩-৬৬২৪)
অতএব, মৃত ব্যক্তির পাশে সারিবদ্ধভাবে বসে কুরআন খতম করা নব আবিস্কৃত বিদাআত!
বক্তা এখানে হক (সত্য) কে পাশ কাটিয়ে বিদাআতের দিকে সুস্পষ্ট আহবানকারী বলেই প্রতীয়মান হয়েছে!
৩. স্বয়ং আল্লাহ তাআলা, আম্মাজান খাদিজা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহা-র কবরের (৩টি) প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। এটা ভিত্তিহীন এবং জাল কথা।
নোটঃ এরকম আরো ভুরি ভুরি বক্তব্য রয়েছে। যেখানে উক্ত বক্তা সাহেব জাল, জইফ হাদিস বর্ণনা, বিদাআতের দিকে আহবান করা, সুন্নাহপন্থীদের সাথে শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণ করা, কুতুব, বান্না, মওদূদী সাহেবের প্রশংসা সহ বেশকিছু আপত্তিজনক, মিথ্যা, মনগড়া বক্তব্য দিয়েছেন!
অবশেষে ইমাম মুহাম্মদ ইবনে সিরিন রাহিমাহুল্লাহ-র একটি সতর্কবাণী দিয়েই শেষ করছি।
তিনি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,
إنَّ هذا العلم دين ؛ فانظروا عمَّن تأخذون دينكم
إنَّ هذا العلم دين ؛ فانظروا عمَّن تأخذون دينكم
অর্থাৎ, নিশ্চয় এই ইলম দ্বীনের অন্তর্ভূক্ত। সুতরাং লক্ষ্য রেখো! কার নিকট থেকে তুমি তোমার দ্বীন গ্রহণ করছো।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা উক্ত বক্তার ফিতনা থেকে সকলকে হেফাজত করুক। আল্লাহুম্মা আমীন।
.
.
সংকলন:
আপনাদের শুভাকাঙ্ক্ষী,
আখতার বিন আমীর।
আপনাদের শুভাকাঙ্ক্ষী,
আখতার বিন আমীর।
No comments:
Post a Comment