Tuesday 9 October 2018

স্বালাতে মুবাশ্‌শির

স্বালাতে মুবাশ্‌শির (১ম পর্ব) 




শুরুর কথা 

শুরুর কথা সমূহ
মহান আল্লাহর অনুগ্রহে ‘স্বালাতে মুবাশ্‌শির’-এর দ্বিতীয় খন্ড পাঠকের হাতে উপস্থিত হল। তার জন্য তাঁর দরবারে লাখো শুকরিয়া জ্ঞাপন করি। দ্বীনের অন্যতম খুঁ টির একটি কাঠামো পেশ করতে পেরে আমি নিজেকে যেমন ধন্য মনে করছি, তেমনি আশা করছি দুআ ও সওয়াব লাভের।

কেবল সহীহ হাদীসকে ভিত্তি করেই, অধিক ক্ষেত্রে কে কি বলেছেন তা উল্লেখ না করেই কেবল সহীহ দিকটা তুলে ধরেছি আমার এই পুস্তিকায়। মানুষের মনে সহীহ শিক্ষার চেতনা ও বাসনার কথা খেয়াল রেখেই আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। আল্লাহ যেন তা কবুল করেন, তাই আমার কামনা।

বিভিন্ন বিতর্কিত মাসায়েলে আমি বর্তমান বিশ্বের প্রধান ৩টি রত্ন; বর্তমান বিশ্বের অদ্বিতীয় মুহাদ্দিস আল্লামা শায়খ মুহাম্মাদ নাসেরুদ্দ্বীন আলবানী, আল্লামা শায়খ ইবনে বায এবং আল্লামা ও ফকীহ্‌ শায়খ ইবনে উষাইমীন (রাহিমাহুমুল্লাহু জামীআন)গণের হাদীস লব্ধ ও সহীহ দলীল ভিত্তিক মতকে প্রাধান্য দিয়েছি। আর এ কথা অবশ্যই প্রমাণ করে যে, আমি তাঁদের প্রত্যেকের; বরং প্রত্যেক হ্‌ক-সন্ধানী রব্বানী আলেমের ভক্ত ও অনুরক্ত। তা বলে কারো অন্ধভক্ত নই। পক্ষান্তরে প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য অধিকারীর অধিকার সঠিকরুপে আদায় করা। উলামার যথার্থ কদর করা। প্রত্যেক হ্‌ক-সন্ধানীর অনুরক্ত হওয়া; যদিও বা তাঁদের কোন কোন অভিমত আমার-আপনার বুঝের অনুকূল নয়। বলা বাহুল্য, খাঁটি সোনা স্বর্ণকারই চিনতে পারে; স্বর্ণ-ব্যবসায়ী নয়।

‘নামায’ ইসলামের প্রধান ইবাদত। ‘নামায’ শব্দটি ফারসী, উর্দু , হিন্দী ও আমাদের বাংলা ভাষায় আরবী ‘সালাত’ অর্থেই পরিপূ র্ণ রুপে ব্যবহৃত বলেই আমি ‘সালাত’-এর স্থানে ‘নামায’ই ব্যবহার করেছি। তাছাড়া বাংলাভাষীর অধিকাংশ মানুষ ‘সালাত’ শব্দটির সাথে পরিচিত নয়। তাই পরিচিত ও প্রসিদ্ধ শব্দই ব্যবহার করতে আমি প্রয়াস পেয়েছি। আর এতে শরয়ী কোন বাধাও নেই। সুতরাং এ বিষয়ে সুহৃদ পাঠকের কাছে আমার ইজতিহাদী  কৈফিয়ত পেশ করে সুদৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

বিনীত
আব্দুল হামীদ আল-মাদানী
আল-মাজমাআহ সঊদীআরব

প্রয়োজনের তাকীদে যা কিছু লিখি, সবই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায়। আল্লাহ যেন তা আমাকে দান করেন এবং কাল কিয়ামতে এরই অসীলায় আমাকে, আমার শ্রদ্ধেয় পিতা-মাতা ও ওস্তাযগণকে, আর এ বই-এর উদ্যোক্তা, প্রকাশক ও সকল আমলকারী পাঠককে তাঁর মেহ্‌মান-খানা বেহেশ্তে স্থান দেন। আমীন।


নিয়ত

নিয়ত সম্পর্কে বিস্তারিত

আমল ও ইবাদত শুদ্ধ-অশুদ্ধ এবং তাতে সওয়াব পাওয়া-না পাওয়ার কথা নিয়তের উপর নির্ভরশীল। নিয়ত শুদ্ধ হলে আমল শুদ্ধ; নচেৎ না। প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “যাবতীয় আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং প্রত্যেক ব্যক্তির তা-ই প্রাপ্য হয়, যার সে নিয়ত করে থাকে। যে ব্যক্তির হিজরত পার্থিব কোন বিষয় লাভের উদ্দেশ্যে হয়, সে ব্যক্তির তা-ই প্রাপ্য হয়। যার হিজরত কোন মহিলাকে বিবাহ্‌ করার উদ্দেশ্যে হয়, তার প্রাপ্যও তাই। যে যে নিয়তে হিজরত করবে সে তাই পেয়ে থাকবে।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ১নং)

নাম নেওয়া লোক দেখানো, কোন পার্থিব স্বার্থলাভ ইত্যাদির উদ্দেশ্যে কোন আমল করা এক ফিতনা; যা কানা দাজ্জালের ফিতনা অপেক্ষা বড় ও অধিকতর ভয়ঙ্কর । একদা সাহাবীগণ কানা দাজ্জালের কথা আলোচনা করছিলেন। ইত্যবসরে আল্লাহর রসূল (সাঃ) বের হয়ে তাঁদের উদ্দেশ্যে বললেন, “ আমি কি তোমাদেরকে এমন (ফিতনার) কথা বলে দেব না, যা আমার নিকট কানা দাজ্জালের ফিতনার চেয়ে অধিকতর ভয়ানক?” সকলে বললেন, ‘অবশ্যই হে আল্লাহর রসূল!’ তিনি বললেন, “ তা হল গুপ্ত শির্ক; লোকে নামায পড়তে দাঁড়ালে তার প্রতি অন্য লোকের দৃষ্টি খেয়াল করে তার নামাযকে আরো সুন্দর বা বেশী করে পড়তে শুরু করে।” (ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, বায়হাকী, সহিহ তারগিব ২৭নং)

বলাবাহুল্য, আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভ ছাড়া অন্য কোন স্বার্থলাভের উদ্দেশ্যে কোনও আমল করলে গুপ্ত শির্ক করা হয়।

আল্লাহ তাআলা বলেন, “সুতরাং দুর্ভোগ সেই সকল নামাযীদের, যারা তাদের নামায সম্বন্ধে উদাসীন। যারা লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে নামায পড়ে এবং গৃহ্‌স্থালির প্রয়োজনীয় ছোটখাটো সাহায্য দানে বিরত থাকে।” (কুরআন মাজীদ ১০৭/৪-৭)

জ্ঞাতব্য যে, প্রত্যেক ইবাদাত কবুল হওয়ার মূল বুনিয়াদ হল তাওহীদ।

অতএব মুশরিকের কোন ইবাদাত গ্রহণযোগ্য নয়। যেমন প্রত্যেক ইবাদত মঞ্জুর হওয়ার জন্য মৌলিক শর্ত হল দু’টি; নিয়তের ইখলাস বা বিশুদ্ধচিত্ততা এবং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর তরীকা, যা সহীহ হাদীসে বর্ণিত।

নামাযের নিয়ত

যে কোনও আমলের জন্য নিয়ত জরুরী। নিয়ত ছাড়া কোন ইবাদত বা আমল শুদ্ধ হয় না। মহানবী (সাঃ) বলেন, “আমলসমূহ তো নিয়তের উপরেই নির্ভরশীল।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ১নং)

ইমাম নওবী (রহঃ) বলেন, নিয়ত বলে মনের সংকল্পকে। (যার স্থল হল হৃদয় ও মস্তিষ্ক।) সুতরাং নামাযী নির্দিষ্ট নামাযকে তার মন-মস্তিষ্কে উপস্থিত করবে। যেমন যোহ্‌র, ফরয ইত্যাদি নামাযের প্রকার ও গুণ মনে মনে স্থির করবে। অতঃপর প্রথম তকবীরের সাথে সাথে (মন-মস্তিষ্কে উপস্থিতকৃত কর্ম করার) সংকল্প করবে। (রওযাতুত ত্বালেবীন ১/২২৪, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ৮৫পৃ:)

এই সংকল্প করার জন্য নির্দিষ্ট কোন শব্দ শরীয়তে বর্ণিত হয় নি। আরবীতে বাঁধা মনগড়া নিয়ত বা নিজ ভাষায় কোন নির্দিষ্ট শব্দাবলী দ্বারা রচিত নিয়ত মুখে উচ্চারণ করা বা আওড়ানো বিদআত। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩১৪, ৩১৫) সুতরাং নিয়ত করা জরুরী, কিন্তু পড়া বিদআত।

ইবনুল কাইয়েম (রহঃ) বলেন, নবী (সাঃ) যখন নামাযে দাঁড়াতেন তখন ‘আল্লাহু আকবার’ বলতেন। এর পূর্বে তিনি কিছু বলতেন না এবং মোটেই নিয়ত মুখে উচ্চারণ করতেন না। তিনি এ কথাও বলতেন না যে, (নাওয়াইতু আন) ‘উসাল্লী লিল্লাহি সালাতান---, আল্লাহর উদ্দেশ্যে অমুক নামায, কেবলাহ্‌ মুখে, চার রাকআত, ইমাম বা মুক্তাদী হয়ে পড়ছি।’ আর না তিনি আদায়, কাযা বা বর্তমান ফরযের কথা উল্লেখ করতেন। উক্ত ১০ প্রকার বিদআতগুলির কোন একটি শব্দও তাঁর নিকট হতে কেউই বর্ণনা করেন নি; না সহীহ সনদ দ্বারা, না যয়ীফ দ্বারা, না মুসনাদ রুপে, আর না-ই মুরসাল রুপে। বরং তাঁর কোন সাহাবী হতেও ঐ নিয়তের কথা বর্ণিত হয়নি। কোন তাবেয়ীও তা বলা উত্তম মনে করেন নি, আর না-ই চার ইমামের কেউ---। (যাদুল মাআদ ১/২০১)

তিনি অন্যত্র বলেন, নিয়ত কোন বিষয়ের উপর মনের ইচ্ছা ও সংকল্পকে বলে; যার স্থান হল অন্তর। মুখের সাথে এর আদৌ কোন সম্পর্ক নেই। এ জন্যই নবী (সাঃ) হতে, আর না তাঁর কোন সাহাবী হতে কোন প্রকার (নিয়তের) একটিও শব্দ বর্ণিত হয়নি এবং আমরা তাঁদের নিকট হতে এর কোন উল্লেখও শুনিনি। পরন্তু ঐ সমস্ত শব্দাবলী যা পবিত্রতা (ওযু-গোসল) ও নামায শুরু করার সময় (নিয়ত করার জন্য) রচনা করা হয়েছে, তা শয়তান খুঁতে লোকদের জন্য প্রতিযোগিতার ময়দানরুপে সৃষ্টি করেছে। যেখানে সে তাদেরকে আবদ্ধ করে রাখে, তাতে তাদেরকে কষ্টও দিয়ে থাকে এবং তা সহীহ-করণের পশ্চাতে তাদেরকে আপতিত করে রাখে। আপনি তাদের কাউকে দেখবেন, সে ঐ নিয়তকে মুখে বারবার আওড়াচ্ছে এবং তা উচ্চারণ করার জন্য নিজে কত কষ্ট স্বীকার করছে, অথচ তা নামাযের কোন কিছুই নয়। পক্ষান্তরে নিয়ত হল কোন কাজ করার জন্য সংকল্প করার নাম মাত্র---। (ইগাসাতুল লাহ্‌ফান ১/১৫৮)

আবার বাস্তব এই যে, নিয়তের এত এত শব্দ-সম্ভার দেখে অনেকে নামায শিখতেও ভয় পায়। মুখস্থ করলেও অনেকের ঐ অনর্থক বিষয়ে সময় ব্যয় করা হয় মাত্র। পক্ষান্তরে সূরা মুখস্থ করে ৩টি কি ৪টি! তাছাড়া বহু সাধারণ মানুষের নিকটেই নিয়তের শব্দাবলীতে তালগোল খেয়ে যায়। অনেকে তার অর্থই বোঝে না। অথচ অর্থ না বুঝলে নিয়ত অর্থহীন। সুতরাং যা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ নয় তার পিছনে আমরা খামাখা ছুটব কেন?

নিয়তে পরিবর্তন

নামায পড়তে পড়তে যদি নিয়ত পরিবর্তনের দরকার হয়, তাহলে সীমাবদ্ধ কয়েকটি নামাযে তা করা যাবে। যেমন;

ফরয পড়তে পড়তে কারো প্রয়োজন হল তা নফল গণ্য করবে। এরুপ বড়র নিয়ত করে ছোটতে পরিবর্তন করতে পারে। তবে এর জন্য শর্ত এই যে, পরে যেন ঐ ফরয পড়ার মত সময় অবশিষ্ট থাকে।

অনুরুপ নির্দিষ্ট সুন্নত (মুআক্কাদাহ) পড়তে পড়তে যদি কেউ তা সাধারণ নফল গণ্য করতে চায় তাও শুদ্ধ হবে।

পক্ষান্তরে এক ফরয পড়তে পড়তে অন্য ফরযের নিয়ত করা (যেমন, আসর পড়তে পড়তে মনে পড়ল যোহ্‌র কাযা আছে, সুতরাং তখনই যোহরের নিয়ত করে ঐ নামাযটাকে যোহরের ধরে নেওয়া) শুদ্ধ হবে না। উভয় নামাযই বাতিল গণ্য হবে।

তদনুরুপ সাধারণ নফল পড়তে পড়তে কোন নির্দিষ্ট সুন্নত বা নফল গণ্য করাও শুদ্ধ হবে না। যেমন কোন নির্দিষ্ট সুন্নত পড়তে পড়তে অন্য কোন নির্দিষ্ট সুন্নতের (যেমন এশার সুন্নত পড়তে পড়তে বিতরের) নিয়ত করা শুদ্ধ নয়। কারণ, শুরু থেকে নির্দিষ্ট নামাযের নিয়ত না হলে পূর্ণ নামায শুদ্ধ হয় না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ২/২৯৫-২৯৮, ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৪১৬)

তদ্রুপ ২ রাকআত সুন্নত পড়তে পড়তে ৪  বা ৪ রাকআত পড়তে পড়তে ২ রাকআত সুন্নতের নিয়ত শুদ্ধ নয়।

বলা বাহুল্য, তারাবীহ্‌র নামাযে ভুলে তৃতীয় রাকআতে উঠে গেলে মনে পড়ার সাথে সাথে বসে গিয়ে নামায পূর্ণ করে সহু সিজদাহ করতে হবে। নচেৎ ৪ রাকআতের নিয়ত করে নামায পড়লে তা বাতিল গণ্য হবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/১০৯-১১০)

নামাযের শর্তাবলী ও আরকানসমূহ

নামাযের শর্তাবলী

১। নামাযীকে প্রকৃত মুসলিম হতে হবে
২। জ্ঞানসম্পন্ন হতে হবে। (পাগল বা জ্ঞানশূন্য হবে না)
৩। বিবেকসম্পন্ন হতে হবে। (সাত বছরের নিম্ন বয়সী শিশু হবে না)
৪। (ওযু-গোসল করে) পবিত্র হতে হবে
৫। নামাযের সঠিক সময় হতে হবে
৬। শরীরের লজ্জাস্থান আবৃত হতে হবে
৭। শরীর, পোশাক ও নামাযের স্থান থেকে নাপাকী দূর করতে হবে
৮। কিবলার দিকে মুখ করতে হবে
৯। মনে  মনে নিয়ত করতে হবে


নামাযের আরকানসমূহ

১। (ফরয নামাযে) সামথ্য হলে কিয়াম (দাঁড়ানোর সময় দাঁড়িয়ে নামায পড়া)
২। তাকবীরে তাহ্‌রীমা
৩। (প্রত্যেক রাকআতে) সূরা ফাতিহা
৪। রুকু
৫। রুকু থেকে উঠে খাড়া হওয়া
৬। (সাষ্টাঙ্গে) সিজদাহ
৭। সিজদাহ থেকে উঠে বসা
৮। দুই সিজদার মাঝে বৈঠক
৯। শেষ তাশাহহুদ
১০। তাশাহহুদের শেষ বৈঠক
১১। উক্ত তাশাহ্‌হুদে নবী (সাঃ) এর উপর দরুদ পাঠ
১২। দুই সালাম
১৩। সমস্ত রুকনে ধীরতা ও স্থিরতা
১৪। আরকানের মাঝে তরতীব ও পর্যায়ক্রম।

নামাযের ওয়াজেবসমূহ

১। তাকবীরে তাহ্‌রীমা ছাড়া সমস্ত তাকবীর
২। রুকুর তাসবীহ্‌
৩। (ইমাম ও একাকী নামাযীর জন্য) ‘সামিআল্লাহু লিমানহামিদাহ্‌’ বলা
৪। (সকলের জন্য) ‘রাব্বানা অলাকালহাম্‌দ’ বলা
৫। সিজদার তাসবীহ্‌
৬। দুই সিজদার মাঝে দুআ
৭। প্রথম তাশাহহুদ
৮। তাশাহহুদের প্রথম বৈঠক।

নামায কখন ফরয হয়?

হিজরতের পূর্বে নবুওয়াতের ১২ অথবা ১৩তম বছরে শবে-মি’রাজে সপ্ত আসমানের উপরে সরাসরি আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রসূলের সাক্ষাতে (বিনা মাধ্যমে) নামায ফরয হয়। প্রত্যহ্‌ ৫০ ওয়াক্তের নামায ফরয হলে হযরত মূসা (আঃ) ও হযরত জিবরীল (আঃ) এর পরামর্শমতে মহানবী (সাঃ) আল্লাহ তাআলার নিকট কয়েকবার যাতায়াত করে নামায হাল্কা করার দরখাস্ত পেশ করলে ৫০ থেকে ৫ অক্তে কমিয়ে আনা হয়। কিন্তু আল্লাহর কথা অনড় বলেই ঐ ৫ ওয়াক্তের বিনিময়ে ৫০ ওয়াক্তেরই সওয়াব নামাযীরা লাভ করে থাকেন। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৫৮৬৪নং)

নামায ফরয হওয়ার গোড়াতে (৪ রাকআতবিশিষ্ট নামাযগুলো) দু’ দু’ রাকআত করেই ফরয ছিল। পরে যখন নবী (সাঃ) মদ্বীনায় হিজরত করলেন, তখন (যোহ্‌র, আসর ও এশার নামাযে) ২ রাকআত করে বেড়ে ৪ রাকআত হল। আর সফরের নামায হল ঐ প্রথম ফরমানের মুতাবেক। (বুখারী, মুসলিম,  আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ১৩৪৮ নং)

নামাযের মাহাত্ম

মহান আল্লাহ বলেন,
اُتْلُ مَا أُوْحِيَ إِلَيْكَ مِنَ الْكِتَابِ وَأَقِمِ الصَّلاَةَ، إِنَّ الصَّلاَةَ تَنْهى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ، وَلَذِكْرُ اللهِ أَكْبَر
অর্থাৎ, তুমি তোমার প্রতি প্রত্যাদিষ্ট গ্রন্থ  পাঠ কর এবং যথাযথভাবে নামায পড়। নিশ্চয় নামায অশ্লীল ও মন্দ কাজ হতে বিরত রাখে। আর অবশ্যই আল্লাহর যিক্‌র (স্মরণই) সর্বশ্রেষ্ঠ। (কুরআন মাজীদ ২৯/৪৫)

নামায মুমিনের চক্ষুকে শীতল করে, তার যাবতীয় ছোট ছোট গুনাহ বা লঘু ও উপপাপকে মোচন করে দেয়। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, আমি আল্লাহর রসূল (সাঃ) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, “কি অভিমত তোমাদের, যদি তোমাদের কারো দরজার সামনেই একটি নদী থাকে এবং সেই নদীতে সে প্রত্যহ্‌ পাঁচবার গোসল করে, তার শরীরে কোন ময়লা অবশিষ্ট থাকবে কি? সকলে বলল, ‘না, তার শরীরে কোন ময়লা অবশিষ্ট থাকবে না।’ তিনি বললেন, “অনুরুপই পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের উপমা। ঐ নামাযসমূহের ফলেই (নামাযীর) সমস্ত গুনাহকে আল্লাহ মোচন করে দেন।” (বুখারী ৫২৮নং, মুসলিম ৬৬৭নং, তিরমিযী, নাসাঈ)

 আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “কাবীরাহ্‌ গুনাহ না করলে পাঁচ ওয়াক্ত নামায, এক জুমুআহ থেকে অপর জুমুআহ -এর মধ্যবর্তীকালে সংঘটিত পাপসমূহের কাফফারা (প্রায়শ্চিত্ত)।”  (মুসলিম ২৩৩নং, তিরমিযী, প্রমুখ)

 হযরত আবু উসমান (রাঃ)  বলেন, একদা একটি গাছের নিচে আমি সালমান (রাঃ) এর সাথে (বসে) ছিলাম। তিনি গাছের একটি শুষ্ক ডাল ধরে হিলিয়ে দিলেন। এতে ডালের সমস্ত পাতাগুলি ঝড়ে গেল। অত:পর তিনি বললেন, ‘হে আবু উসমান! তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করবে না কি যে, কেন আমি এরুপ করলাম?’ আমি বললাম, ‘কেন করলেন?’ তিনি বললেন, ‘ একদা আমিও আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর সাথে গাছের নিচে ছিলাম। তিনি আমার সামনে অনুরুপ করলেন; গাছের একটি শুষ্ক ডাল ধরে হিলিয়ে  দিলেন। এতে তার সমস্ত পাতা খসে পড়ল। অতঃপর বললেন, “হে সালমান! তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করবে না কি যে, কেন আমি এরুপ করলাম?” আমি বললাম, কেন করলেন? তিনি উত্তরে বললেন, “মুসলিম যখন সুন্দরভাবে ওযু করে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে তখন তার পাপরাশি ঠিক ঐভাবেই ঝরে যায় যেভাবে এই পাতাগুলো ঝরে গেল। আর তিনি এই আয়াত পাঠ করলেন,
وَأَقِمِ الصَّلاَةَ طَرَفَىِ النَّهَارِ وَزُلَفاً مِّنَ اللَّيْلِ، إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّآتِ، ذلِكَ ذِكْرى لِلذَّاكِرِيْنَ
অর্থাৎ, আর তুমি দিনের দু’ প্রান্তভাগে ও রাতের প্রথাগোশতে নামায কায়েম কর। পুণ্যরাশি অবশ্যই পাপরাশিকে দূরীভূত করে দেয়। (আল্লাহর) স্মরণকারীদের জন্য এ হল এক স্মরণ। (সূরা হূদ ১১৪ আয়াত) (আহ্‌মদ,  নাসাঈ, ত্বাবারানী, সহীহ তারগীব ৩৫৬নং)

মহানবী (সাঃ) বলেন, “বান্দা যখন নামাযে দাঁড়ায়, তখন তার সে তার সমস্ত গুনাহকে নিয়ে তার মাথায় ও দুই কাঁধে রাখা হয়। অতঃপর সে যখনই রুকূ ও সিজদা করে, তখনই একটি একটি করে সমস্ত গুনাহগুলি ঝরে পড়ে যায়।” (বাইহাকী, সহীহ জামে ১৬৭১নং)

নামাযের গুরুত্ব

নামায ও তার গুরুত্বের কথা কুরআন মাজীদের বহু জায়গাতেই আলোচিত হয়েছে। কোথাও নামায কায়েম করার আদেশ দিয়ে, কোথাও নামাযীর প্রশংসা ও প্রতিদান এবং বেনামাযীর নিন্দা ও শাস্তি বর্ণনা করে, আল্লাহ তাআলা নামাযের প্রতি বড় গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এক স্থানে তিনি বলেন,
فإنْ تَابُوْا وَأَقَامُوا الصَّلاَةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّيْنِ
অর্থাৎ, তারপর তারা যদি তওবা করে নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয় তবে তারা তোমাদের দ্বীনী ভাই। (নচেৎ নয়।) (কুরআন মাজীদ ৯/১১)

অন্যত্র বলেন,
 مُنِيْبِيْنَ إِلَيْهِ وَاتَّقُوْهُ وَأَقِيْمُوا الصَّلاَةَ وَلاَ تَكُوْنُوْا مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ
অর্থাৎ, বিশুদ্ধচিত্তে তাঁর অভিমুখী হও; তাঁকে ভয় কর, যথাযথভাবে নামায পড়, আর মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হ্‌য়ো না। (কুরআন মাজীদ ৩০/৩১)

কুরআন মাজীদে নামাযকে মহান আল্লাহ ‘ঈমান’ বলে আখ্যায়ন করেছেন, তিনি বলেন,
وَمَا كَانَ اللّهُ لِيُضِيعَ إِيمَانَكُمْ: (১৪৩) سورة البقرة
অর্থাৎ, আল্লাহ তোমাদের (কা’বার দিক ছাড়া বায়তুল মাকদেসের দিকে মুখ করে আদায়কৃত পূর্বের) ঈমান (নামায)কে বরবাদ করবেন না। (কুরআন মাজীদ ২/১৪৩)

নামায মু’মিনের ঈমান ও মুসলিমের ইসলামের নিদর্শন। মহানবী (সাঃ) বলেন, “ইসলাম ও শির্ক এবং কুফরের মাঝে পার্থক্য নির্বাচনকারী হল এই নামায।” (মুসলিম, সহীহ ৮২নং, মিশকাত ৫৬৯নং)

কোন আমল ত্যাগ করার ফলে কেউকাফে র হয়ে যায় না। কিন্তু সাহাবাগণ নামায ত্যাগ করাকে কুফরী মনে করতেন। (তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ৫৭৯নং)

হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি নামায ত্যাগ করে তার দ্বীনই নেই।” (ইবনে আবী শাইবাই, ত্বাবারানীর কাবীর, সহীহ তারগীব ৫৭১নং)

হযরত আবূ দারদা (রাঃ) বলেন, “যার নামায নেই তার ঈমানই নেই।” (ইবনে আব্দুল বার, প্রমুখ, সহীহ তারগীব ৫৭২নং)

প্রিয় নবী (সাঃ) আরো বলেন, “আমাদের ও ওদের (কাফেরদের) মাঝে চুক্তিই হল নামায। সুতরাং যে ব্যক্তি তা ত্যাগ করবে, সে কাফের হয়ে যাবে (বা কুফরী করবে।) (তিরমিযী, সুনান ২৬২১, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ১০৭৯ নং)

তিনি আরো বলেন, “পাঁচ ওয়াক্ত নামায আল্লাহ বান্দাগণের উপর ফরয করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি তা যথার্থরুপে আদায় করবে এবং তাতে গুরুত্ব দিয়ে তার কিছুও বিনষ্ট করবে না, সেই ব্যক্তির জন্য আল্লাহর এই প্রতিশ্রুতি আছে যে, তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আর যে ব্যক্তি তা আদায় করবে না, সে ব্যক্তির জন্য আল্লাহর কোন প্রতিশ্রুতি নেই। তিনি ইচ্ছা করলে তাকে শাস্তি দেবেন, নচেৎ ইচ্ছা হলে জান্নাতেও দিতে পারেন।” (মালেক, মুঅত্তা, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ, সহিহ তারগিব ৩৬৩ নং)

পূর্বোক্ত আয়াত ওহাদীসের ভিত্তিতে বড় বড় বহু উলামাগণ বলেছেন যে, বেনামাযী কাফের। কোন মুসলিম (নামাযী) নারীর সাথে তার বিবাহ্‌ হতে পারে না, তার যবাইকৃত পশুর গোশতহালাল হয় না, সে মারা গেলে তার জানাযা পড়া হবে না, মুসলিম (নামাযী) ছেলেরা তার ওয়ারিস হবে না বা সেও নামাযী বাপের ওয়ারিস হবে না এবং তাকে মুসলিমদের কবরস্থানে দাফন করা হবে না --- ইত্যাদি।

অবশ্য শেষোক্তহাদীস এবং অনুরুপ অন্যান্যহাদীসের ভিত্তিতে অন্যান্য আলেমগণ বলেন যে, ‘বেনামাযী কাফের নয়, তবে নামায ত্যাগ করা কাফেরের কাজ বটে।’ (ইবনে বায, ইবনে উসাইমীন ও আলবানীর ফতোয়া দ্রষ্টব্য)

যাইবা হোক উক্ত আয়াত ওহাদীসসমূহে নামাযের বিরাট গুরুত্ব স্পষ্ট। নামায হল দ্বীনের খুঁটি। (তিরমিযী, সুনান ২১১০, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ৩৯৭৩ নং) দ্বীনের পাঁচটি বুনিয়াদের মধ্যে এটাই হল দ্বিতীয় বুনিয়াদ। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৪নং) তাই তো প্রিয় নবী (সাঃ) জীবনের শেষ মুহূর্তে মরণ-শয্যায় শায়িত অবস্থাতেও নামাযের জন্য ব্যতিব্যস্ত ছিলেন। ইন্তেকালের পূর্বে শেষ উপদেশে তিনি নামাযের গুরুত্ব সম্বন্ধে উম্মতকে সচেতন করে গেলেন। বললেন, “নামায! নামায! আর ক্রীতদাস-দাসী (এর ব্যাপারে তোমরা সতর্ক থেকো।) (জামে ৩৮৭৩ নং)

সাবালক হলেই মুসলিমের উপর নামায ফরয হয়। তবুও অভ্যস্ত করার উদ্দে শ্যে ই আল্লাহর নবী (সাঃ) বলেন, “তোমরা তোমাদের ছেলে-মেয়েদেরকে তাদের বয়স ৭ বছর হলেই নামাযের আদেশ দাও। ১০ বছর বয়সে নামাযে অ ভ্যা সী না হলে তাদেরকে প্রহার কর। আর তাদের প্রত্যেকের বিছানা পৃথক করে দাও।” (আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ৫৭২নং)

সব ওয়াক্তের নামায নয়, কেবলমাত্র এক ওয়াক্তের আসরের নামায ছুটে গেলে বা না পড়া হলে তার ক্ষতির পরিমাণ বুঝাতে প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি আসরের নামায ত্যাগ করে, সে ব্যক্তির আমল পন্ড হয়ে যায়।” (বুখারী ৫৫৩, নাসাঈ)

তিনি আরো বলেন, “যে ব্যক্তির আসরের নামায ছুটে গেল, তার যেন পরিবার ও ধন-মাল লুণ্ঠন হয়ে গেল।” (মালেক, বুখারী ৫৫২, মুসলিম ৬২৬ নং প্রমুখ)

মহান আল্লাহ বলেন,
فخلفَ مِنْ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ أَضَاعُوا الصَّلاَةَ وَاتَّبَعُوا الشَّهَوَاتِ فَسَوْفَ يَلْقَوْنَ غَيًّا
অর্থাৎ, ওদের পর এল এমন (অপদার্থ) পরবর্তীদল; যারা নামায নষ্ট করল ও কুপ্রবৃত্তি-পরবশ হল। সুতরাং ওরা অচিরেই কঠিন শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে। (কুরআন মাজীদ ১৯/৫৯)

আল্লাহ তাআলা বলেন,
(فَوَيْلٌ لِّلْمُصَلِّيْنَ، الَّذِيْنَ هُمْ عَنْ صَلاَتِهِمْ سَاهُوْنَ، الَّذِيْنَ هُمْ يُرَاؤُوْنَ)
অর্থাৎ, সুতরাং দুর্ভোগ সেই সকল নামাযীদের, যারা তাদের নামায সম্বন্ধে উদাসীন। যারা লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে নামায পড়ে। (কুরআন মাজীদ ১০৭/৪-৬) বলা বাহুল্য, নামাযী হয়েও নামাযে গাফলতি করার কারণে যদি দোযখের দুর্ভোগ ভোগ করতে হয়, তাহলে বেনামাযী হয়ে কত বড় দুর্ভোগ ভোগ করতে হবে তা অনুমেয়।

মরণের পরপারে মধ্যজগতে নামাযে উদাসীন ও শৈথিল্যকারী ব্যক্তির মাথায় কিয়ামত অবধি পাথর ঠুকে ঠুকে মারা হবে। (বুখারী ১১৪৩নং)

নামায আল্লাহ ও বান্দার মাঝে সম্পর্কের এক সেতুবন্ধ। “কিয়ামতের দিন বান্দার নিকট থেকে সর্বাগ্রে যে আমলের হিসাব নেওয়া হবে তা হল নামায। সুতরাং তা সঠিক হয়ে থাকলে তার অন্যান্য আমলও সঠিক বলে বিবেচিত হবে। নচেৎ অন্যান্য সকল আমল নিষ্ফল ও ব্যর্থ হবে।” (ত্বাবারানী, মু’জাম, সহিহ তারগিব ৩৬৯নং)

নামায এত গুরুত্বপূর্ণ যে, তার শর্তাবলী বর্তমান থাকা কালে তা (নাবালক শিশু, পাগল ও ঋতুমতী মহিলা ছাড়া) কারো জন্য কোন অবস্থাতেই মাফ নয়। এমন কি যুদ্ধের ময়দানে প্রাণহ্‌ন্তা রক্ত-পিপাসু শত্রুদলের সামনেও নয়! (কুরআন মাজীদ ৪/১০২)  অসুস্থ অবস্থায় খাড়া হয়ে না পারলে বসে, বসে না পারলে কাৎ হয়ে শুয়েও নামায পড়তেই হবে। (বুখারী, মিশকাত ১২৪৮ নং) ইশারা-ইঙ্গিতে রুকু-সিজদা না করতে পারলে মনে মনে নিয়তেও নামায পড়তে হবে। চেষ্টা সত্ত্বেও পবিত্র থাকতে অক্ষম হলেও ঐ অবস্থাতেই নামায ফরয। (ইবনে উসাইমীন, কাইফা য়্যাতাত্বাহ্‌হারুল মারীযু অয়্যুসাল্লী দ্রষ্টব্য)
পবিত্রতা

পবিত্রতা অর্জন
নামায কবুল হওয়ার জন্য যেরুপ বিশুদ্ধ ঈমান এবং হৃদয়কে সিক্ত ও কুফরী ধারণা ও বিশ্বাস থেকে পবিত্র রাখা জরুরী শর্ত, তদ্রুপ নামাযীর বাহ্যিক দেহ্‌ ও পোশাক-আশাককে পবিত্র রাখাও এক জরুরী শর্ত। যেহেতু “নামাযের চাবিকাঠিই হল পবিত্র তা ।” (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, দারেমী, সুনান, মিশকাত ৩১২ নং) তাছাড়া এই পবিত্রতা হল অর্ধেক ঈমান। (মুসলিম,  মিশকাত ২৮১নং)

(বিশেষ করে পানি দ্বারা অর্জিত) পবিত্রতায় বৃদ্ধি হয় মনোযোগ, দূর হয় আলস্য, তন্দ্রা ও নিদ্রা, স্ফূর্তির সাথে ইবাদতে মন বসে অধিক।

মযী বা মলমূত্র থেকে পবিত্রতা অর্জনের জন্য পানি বা (যথেষ্ট পানি না পাওয়া গেলে) মাটির ঢেলা ব্যবহার করে তা দূর করা এবং ওযু করাই যথেষ্ট। অবশ্য কোন প্রকারের মৈথুন দ্বারা বা স্বপ্নে অথবা যৌনচিন্তায় উত্তেজনা ও তৃপ্তির সাথে বীর্যপাত করলে বা হলে গোসল ফরয। যেমন সঙ্গমে যোনীপথে লিঙ্গাগ্র প্রবেশ করিয়ে বীর্যপাত না করলেও গোসল ফরয। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৪৩০নং) অনুরুপ মহিলাদের মাসিক ও নেফাস থেকে পবিত্র হওয়ার জন্যও গোসল ফরয।

ওযু ও গোসলের জন্য ব্যবহার্য পানিও পবিত্র তথা পবিত্রকারী হওয়া জরুরী। সাধারণত: পুকুর, নদী, নালা, সমুদ্র, প্রভৃতির পানি পবিত্র ও পবিত্রকারী। যে পানিতে পবিত্র কোন জিনিস -যেমন আটা, সাবান, জাফরান ইত্যাদি মিশ্রিত হয়, সে পানির রং, গন্ধ বা স্বাদ পরিবর্তন না হলে তাতে ওযু-গোসল চলবে।

পানিতে কোন অপবিত্র জিনিস পড়ে যাওয়ার ফলে অথবা অন্য কোন কারণে যদি তার রং, স্বাদ বা গন্ধ পরিবর্তন হয়ে যায়, তাহলে তা নাপাক গণ্য হবে। পরিবর্তন না হলেও যদি পানি ২ কুল্লাহ্‌ (প্রায় ২৭০ লিটার, মতান্তরে ১৯১ থেকে ২০০ কেজি) এর চেয়ে কম হয়, তাহলেও তা নাপাক। এর বেশী হলে সে পানি পাক। তাতে ওযু-গোসল চলবে। (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, দারেমী, সুনান, মিশকাত ৪৭৭নং)

যে পানি একবার ওযু-গোসলে ব্যবহার হয়েছে, সে পানি পাক। কিন্তু তাতে আর ওযু-গোসল হবে না।

মানুষ, গাধা, খচ্চর, পাখী,হালাল পশু, বিড়াল প্রভৃতির এঁটো পানি পাক; তাতে ওযু-গোসল চলবে। অবশ্য শূকর ও কুকুরের এঁটো পানি নাপাক। (বিস্তারিত দ্রষ্টব্য ফিকহুস সুন্নাহ্‌ উর্দু ৩৩-৩৭পৃ:)

গোসল করার নিয়ম

নাপাকীর গোসল করতে হলে গোসলের নিয়ত করে মুসলিম প্রথমে ৩ বার দুইহাত কব্জি পর্যন্ত ধুবে। অতঃপর বাম হাতের উপর পানি ঢেলে দেহের নাপাকী ধুয়ে ফেলবে। তারপর বাম হাতকে মাটি অথবা সাবান দ্বারা ধুয়ে নামাযের জন্য ওযু করার মত পূর্ণ ওযু করবে। অবশ্য গোসলের জায়গা পরিষ্কার না হলে পা দুটি গোসল শেষে ধুয়ে নেবে। ওযুর পর ৩ বার মাথায় পানি ঢেলে ভাল করে চুলগুলো ধোবে, যাতে সমস্ত চুলের গোড়ায় গোড়ায় পানি পৌঁছে যায়। তারপর সারা দেহে ৩ বার পানি ঢেলে ভালরুপে ধুয়ে নেবে। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৪৩৫-৪৩৬ নং)

মহিলাদের গোসলও পুরুষদের অনুরুপ। অবশ্য মহিলার মাথার চুলে বেণী  বাঁধা (চুটি গাঁথা) থাকলে তা খোলা জরুরী নয়। তবে ৩ বার পানি নিয়ে চুলের গোড়া অবশ্যই ধুয়ে নিতে হবে। (বুখারী, মিশকাত ৪৩৮নং) নখে নখপালিশ বা কোন প্রকার পুরু পেন্ট্‌ থাকলে তা তুলে না ফেলা পর্যন্ত গোসল হবে না। পক্ষান্তরে মেহেদী বা আলতা লেগে থাকা অবস্থায় গোসল হয়ে যাবে। কপালে টিপ (?) থাকলে ছাড়িয়ে ফেলে (কপাল) ধুতে হবে। নচেৎ গোসল হবে না।

বীর্যপাত বা সঙ্গম-জনিত নাপাকী ও মাসিকের গোসল, অথবা মাসিক ও ঈদ, অথবা বীর্যপাত বা সঙ্গম-জনিত নাপাকী ও জুমআ বা ঈদের গোসল নিয়ত হলে একবারই যথেষ্ট। পৃথক পৃথক গোসলের দরকার নেই। (ফিকহুস সুন্নাহ্‌ উর্দু ৬০পৃ: দ্র:)

গোসলের পর নামাযের জন্য আর পৃথক ওযুর প্রয়োজন নেই। গোসলের পর ওযু ভাঙ্গার কোন কাজ না করলে গোসলের ওযুতেই নামায হয়ে যাবে। (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, মিশকাত ৪৪৫নং)

রোগ-জনিত কারণে যদি কারো লাগাতার বীর্য, মযী, স্রাব বা ইস্তিহাযার খুন ঝরে তবে তার জন্য গোসল ফরয নয়; প্রত্যেক নামাযের জন্য ওযুই যথেষ্ট। এই সকল অবস্থায় নামায মাফ নয়। (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ৫৬০-৫৬১ নং)

প্রকাশ যে, গোসল, ওযু বা অন্যান্য কর্মের সময় নিয়ত আরবীতে বা নিজ ভাষায় মুখে উচ্চারণ করা বিদআত।

সতর্কতার বিষয় যে, নাপাকী দূর করার জন্য কেবল গা-ধোয়া বা গা ডুবিয়ে নেওয়া যথেষ্ট নয়। পূর্বে ওযু করে যথানিয়মে গোসল করলে তবেই পূর্ণ গোসল হয়। নচেৎ অনেকের মতে কুল্লি না করলে এবং নাকে পানি না নিলে গোসলই শুদ্ধ হবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ১/৩০৪)

ওযু ও তার গুরুত্ব
মহান আল্লাহ বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلاَةِ فَاغْسِلُوْا وُجُوْهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى الْمَرَافِقِ وَامْسَحُوْا بِرُؤُوْسِكُمْ وَأَرْجُلَكُمْ إِلَى الْكَعْبَيْنِ
অর্থাৎ, হে ঈমানদারগণ! যখন তোমরা নামাযের জন্য প্রস্তুত হবে তখন তোমরা তোমাদের মুখমন্ডল ও হাত কনুই পর্যন্ত ধৌত করবে এবং তোমাদের মাথা মাসাহ্‌ করবে। আর পা দু’টিকে গাঁট পর্যন্ত ধৌত করবে। (কুরআন মাজীদ ৫/৬)

সুতরাং বড় নাপাকী না থাকার ফলে গোসলের দরকার না হলেও নামাযের জন্য ছোট নাপাকী থেকে পবিত্রতা অর্জনের উদ্দেশ্যে ওযু ফরয। এ ব্যাপারে মহানবী (সাঃ) ও বলেন, “ওযু নষ্ট হয়ে গেলে পুনরায় ওযু না করা পর্যন্ত আল্লাহ কারো নামায কবুল করেন না।” (বুখারী, মুসলিম, সহীহ মিশকাত ৩০০নং)

ওযুর মাহাত্ম ও ফযীলত প্রসঙ্গে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এক হাদীসে তিনি বলেন, “কিয়ামতের দিন আমার উম্মতকে আহ্বান করা হবে; আর সেই সময় ওযুর ফলে তাদের মুখমন্ডল ও হাত-পা দীপ্তিময় থাকবে।” (বুখারী ১৩৬, মুসলিম, সহীহ ২৪৬নং)

অন্য এক হাদীসে তিনি বলেন, “ওযুর পানি যদ্দূর পৌঁছবে তদ্দূর মু’মিনের অঙ্গে অলঙ্কার (জ্যোতি) শোভমান হবে।” (মুসলিম, সহীহ ২৫০নং)

তিনি আরো বলেন, “মুসলিম বা মুমিন বান্দা যখন ওযুর উদ্দেশ্যে তার মুখমন্ডল ধৌত করে  তখন ওযুর পানির সাথে অথবা পানির শেষ বিন্দুর সাথে প্রত্যেক সেই গুনাহ বের হয়ে যায় যা সে দুই চক্ষুর দৃষ্টির মাধ্যমে করে ফেলেছিল। অতঃপর যখন সে তারহাত দুটিকে ধৌত করে তখন পানির সাথে অথবা পানির শেষ বিন্দুর সাথে প্রত্যেক সেই গুনাহ বের হয়ে যায় যা সে উভয় হাতে ধারণ করার মাধ্যমে করে ফেলেছিল। অতঃপর যখন সে তার পা দুটিকে ধৌত করে তখন পানির সাথে অথবা পানির শেষ বিন্দুর সাথে প্রত্যেক সেই গুনাহ বের হয়ে  যায় যা সে তার দুপায়ে চলার মাধ্যমে করে ফেলেছিল। শেষ অবধি সমস্ত গুনাহ থেকে সে পবিত্র হয়ে বের হয়ে আসে।” (মালেক, মুসলিম ২৪৪নং, তিরমিযী)

ওযু করার নিয়ম

১- নামাযী প্রথমে মনে মনে ওযুর নিয়ত করবে। কারণ নিয়ত ছাড়া কোন কর্মই শুদ্ধ হয় না। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ১নং)

২- ‘বিসমিল্লাহ্‌’ বলে ওযু শুরু করবে। কারণ শুরুতে তা না বললে ওযু হয় না। (আবূদাঊদ, সুনান ৯২নং)

৩- তিনবার দুইহাত কব্জি পর্যন্ত ধুয়ে নেবে।হাতে ঘড়ি, চুড়ি, আংটি প্রভৃতি থাকলে তা হিলিয়ে তার তলে পানি পৌঁছাবে। আঙ্গুল দিয়ে আঙ্গুলের ফাঁকগুলো খেলাল করবে। (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, মিশকাত ৪০৭নং) এরপর পানির পাত্রে হাত ডুবিয়ে পানি নিতে পারে। (বুখারী, মুসলিম, সহীহ ৩৯৪নং) প্রকাশ যে, নখে নখ পালিশ বা কোন প্রকার পুরু পেন্ট থাকলে তা তুলে না ফেলা পর্যন্ত ওযু হবে না। পক্ষান্তরে মেহেদী বা আলতা লেগে থাকা অবস্থায় ওযু-গোসল হয়ে যাবে।

৪- তারপর ডানহাতে পানি নিয়ে ৩ বার কুল্লি করবে।

৫-অতঃপর পানি নিয়ে নাকের গোড়ায় লাগিয়ে টেনে নিয়ে বামহাত দ্বারা নাক ঝাড়বে। এরুপ ৩ বার করবে। তবে রোযা অবস্থায় থাকলে সাবধানে নাকে পানি টানবে, যাতে গলার নিচে পানি না চলে যায়। (তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান ৮৯, মিশকাত ৪০৫, ৪১০নং)

অবশ্য এক লোট পানিতেই একই সাথে অর্ধেক দিয়ে কুল্লি করে বাকি অর্ধেক দিয়ে নাক ঝাড়লেও চলে। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৩৯৪নং)

৬- অতঃপর মুখমন্ডল (এক কান থেকে অপর কানের মধ্যবর্তী এবং কপালের চুলের গোড়া থেকে দাড়ির নিচের অংশ পর্যন্ত অঙ্গ) ৩ বার পানি লাগিয়ে দুইহাত দ্বারা ধৌত করবে। (বুখারী ১৪০নং) এক লোট পানি দাড়ির মাঝে দিয়ে দাড়ির ফাঁকে ফাঁকে আঙ্গুল চালিয়ে তা খেলাল করবে। (আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ৪০৮নং) মহিলাদের কপালে টিপ (?) থাকলে ছাড়িয়ে ফেলে (কপাল) ধুতে হবে। নচেৎ ওযু হবে না।

৭- অতঃপর প্রথমে ডানহাত আঙ্গুলের ডগা থেকে কনুই পর্যন্ত এবং তদনুরুপ বামহাত ৩ বার (প্রত্যেক বারে পুরোহাতে পানি ফিরিয়ে রগড়ে) ধৌত করবে।

৮- অতঃপর একবার মাথা মাসাহ্‌ করবে; নতুন পানি দ্বারা দুই হাতকে ভিজিয়ে আঙ্গুল গুলিকে মুখোমুখি করে মাথার সামনের দিক (যেখান থেকে চুল গজানো শুরু হয়েছে সেখান) থেকে পিছন দিক (গর্দানের যেখানে চুল শেষ হয়েছে সেখান) পর্যন্ত স্পর্শ করে পুনরায় সামনের দিকে নিয়ে এসে শুরুর জায়গা পর্যন্ত পূর্ণ মাথা মাসাহ্‌ করবে। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৩৯৪নং) মাথায় পাগড়ি থাকলে তার উপরেও মাসাহ্‌ করবে। (মুসলিম,  মিশকাত ৩৯৯নং)

৯- অতঃপর আর নতুন পানি না নিয়ে ঐ হাতেই দুই কান মাসাহ্‌ করবে; শাহাদতের (তর্জনী) দুই আঙ্গুল দ্বারা দুই কানের ভিতর দিক এবং দুই বুড়ো আঙ্গুল দ্বারা দুই কানের পিঠ ও বাহির দিক মাসাহ্‌ করবে। (আবূদাঊদ, সুনান ৯৯, ১২৫নং)

প্রকাশ যে, গর্দান মাসাহ্‌ করা বিধেয় নয়। বরং এটা বিদআত।

১০- অতঃপর প্রথমে ডান পা ও পরে বাম পা গাঁট পর্যন্ত ৩ বার করে রগড়ে ধোবে। কড়ে আঙ্গুল দ্বারা পায়ের আঙ্গুলের ফাঁকগুলো খেলাল করে রগড়ে ধৌত করবে। (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, মিশকাত ৪০৭নং)

প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “পূর্ণাঙ্গরুপে ওযু কর, আঙ্গুলের ফাঁকগুলো খেলাল কর আর রোযা না থাকলে নাকে খুব ভালরুপে পানি চড়াও। (তারপর তা ঝেড়ে ফেলে উত্তমরুপে নাক সাফ কর।) (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, দারেমী, সুনান, মিশকাত ৪০৫-৪০৬ নং)

১১- এরপর হাতে পানি নিয়ে কাপড়ের উপর থেকে শরমগাহে ছিটিয়ে দেবে। বিশেষ করে পেশাব করার পর ওযু করলে এই আমল অধিকরুপে ব্যবহার্য। যেহেতু পেশাব করে তাহারতের পর দু-এক কাতরা পেশাব বের হওয়ার অসঅসা থাকে। সুতরাং পানি ছিটিয়ে দিলে ঐ অসঅসা দূর হয়ে যায়। (আবূদাঊদ, সুনান ১৫২-১৫৪, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ৩৭৪-৩৭৬নং) এই আমল খোদ জিবরাঈল (আঃ) মহানবী (সাঃ) কে শিক্ষা দিয়েছেন। (ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, দারেমী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, বায়হাকী, আহমাদ, মুসনাদ, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৮৪১নং)

ওযুর শেষে দুআ

প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে যে কেউই পরিপূর্ণরুপে ওযু করার পর (নিম্নের যিক্‌র) পড়ে তার জন্যই জান্নাতের আটটি দ্বার উন্মুক্ত করা হয়; যে দ্বার দিয়ে ইচ্ছা  সে প্রবেশ করতে পারে।

أَشْهَدُ أَنْ لاَّ إِلهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ।

“আশহাদু আল লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু অহ্‌দাহু লা শারীকা লাহু অ আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আব্দুহু অরাসূলুহ্‌।”

অর্থাৎ, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই। তিনি একক তাঁর কোন অংশী নেই। আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর বান্দা ও রসূল। (মুসলিম ২৩৪নং, আবু দাঊদ, ইবনে মাজাহ্‌)

তিরমিযীর বর্ণনায় এই দুআর শেষে নিম্নের অংশটিও যুক্ত আছে:-

اَللّهُمَّ اجْعَلْنِيْ مِنَ التَّوَّابِيْنَ، وَاجْعَلْنِيْ مِنَ الْمُتَطَهِّرِيْنَ।

উচ্চারণ:- আল্লাহুম্মাজ আলনী মিনাত তাওয়াবীনা, অজ্‌আলনী মিনাল মুতাত্বাহ্‌হিরীন।

অর্থ:- হে আল্লাহ! আমাকে তওবাকারী ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের দলভুক্ত কর। (মিশকাত ২৮৯নং)

ওযুর শেষে নিম্নের দুআ পাঠ করলে তা শুভ্র নিবন্ধে লিখে সীল করা হয় এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা নষ্ট করা হয় না।

سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ، أَشْهَدُ أَنْ لاَّ إِلهَ إِلاَّ أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوْبُ إِلَيْكَ।

 “সুবহানাকাল্লা-হুম্মা অবিহামদিকা, আশহাদু আল লা ইলা-হা ইল্লা আন্ত , আস্তাগফিরুকা অ আতূবু ইলাইক।”

অর্থাৎ, তোমার সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা করছি হে আল্লাহ! আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে তুমিই একমাত্র সত্য উপাস্য। আমি তোমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি ও তোমার দিকে প্রত্যাবর্তন (তওবা) করছি। (ত্বাহাবী, সহিহ তারগিব ২১৮নং, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ১/১৩৫, ৩/৯৪)

এ ছাড়া প্রত্যেক অঙ্গ ধোয়ার সময় নির্দিষ্ট দুআ অথবা শেষে ‘ইন্না আনযালনা’ পাঠ বিদআত।

ওযুর আনুষঙ্গিক মাসায়েল

ওযুর অঙ্গগুলোকে কমপক্ষে ১ বার করে ধোয়া জরুরী। ২ বার করে ধুলেও চলে। তবে ৩ বার করে ধোয়াই উত্তম। এরই উপরে আল্লাহর রসূল (সাঃ) তথা সাহাবায়ে কেরামের আমল বেশী। কিন্তু তিনবারের অধিক ধোয়া অতিরঞ্জন, বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘন করা। (আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, মিশকাত ৪১৭-৪১৮ নং)

ওযুর কোন অঙ্গ ২ বার এবং কোন অঙ্গ ৩ বার ধোয়া দূষণীয় নয়। (সহীহ, আবূদাঊদ, সুনান ১০৯, সহীহ, তিরমিযী, সুনান ৪৩নং)

জোড়া অঙ্গগুলির ডান অঙ্গকে আগে ধোয়া রসূল (সাঃ) এর নির্দেশ। (আহমাদ, মুসনাদ, আবূ দাঊদ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, মিশকাত ৪০১নং) তিনি ওযু, গোসল, মাথা আঁচড়ানো, জুতো পরা প্রভৃতি সকল কাজের সময় ডান থেকে শুরু করা পছন্দ করতেন। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৪০০নং)

ওযুর অঙ্গগুলো -বিশেষ করে হাত ও পা- রগড়ে ধোয়া উত্তম। রসূল (সাঃ) এর এরুপই আমল ছিল। (নাসাঈ, সুনান ৭২, মিশকাত ৪০৭নং)

অঙ্গসমূহ এমনভাবে ধুতে হবে যাতে কোন সামান্য জায়গাও শুকনো থেকে না যায়। ওযুর অঙ্গে কোন প্রকার পানিরোধক বস্তু (যেমন পেন্ট, চুন, কুমকুম, অলঙ্কার, ঘড়ি, টিপ ইত্যাদি) থাকলে তা অবশ্যই দূর করে নিতে হবে। যেহেতু আল্লাহর নবী (সাঃ) একদা কতক লোকের শুষ্ক গোড়ালি দেখে বলেছিলেন, “গোড়ালিগুলোর জন্য দোযখে ধ্বংস ও সর্বনাশ রয়েছে! তোমরা ভালরুপে (সকল অঙ্গকে সম্পূর্ণরুপে) ধুয়ে ওযু কর।” (মুসলিম,  মিশকাত ৩৯৮নং)

এক ব্যক্তি ওযু করার পর মহানবী (সাঃ) এর নিকট উপস্থিত হলে দেখলেন, তার দুই পায়ে নখ পরিমাণ জায়গা শুষ্ক রয়েছে। তিনি তাকে বললেন, “তুমি ফিরে গিয়ে ভালরুপে ওযু করে এস।” (আবূদাঊদ, সুনান ১৫৮নং)

এক ব্যক্তিকে তিনি দেখলেন নামায পড়ছে, আর তার এক পায়ের পিঠে এক দিরহাম বরাবর স্থান শুষ্ক রয়েছে, যাতে সে পানিই পৌঁছায়নি। তিনি তাকে পুনরায় ওযু করে নতুনভাবে নামায পড়তে আদেশ দিলেন। (আবূদাঊদ, সুনান ১৬১ নং)

ওযু করার সময় নিরবচ্ছিন্নভাবে একটানা অঙ্গগুলোকে পর্যায়ক্রমে একের পর এক ধুতে হবে। মাঝে বিরতি দেওয়া বৈধ নয়। সুতরাং কেউ মাথা বা কান মাসাহ্‌ না করে ভুলে পা ধুয়ে ফেললে এবং সত্বর মনে পড়লে, সে মাসাহ্‌ করে পুনরায় পা ধোবে। বহু পরে মনে পড়লে পুনরায় নতুন করে ওযু করবে।

কেউ যদি ওযু শুরু করার পর কাপড়ে নাপাকী দেখে এবং তা সাফ করতে করতে পূর্বেকার ধৌত অঙ্গ শুকিয়ে যায়, তাহলে তাকে পুনঃ ওযু করতে হবে। পক্ষান্তরে যদি ওযু সম্পর্কিত কোন বিষয়ে ব্যস্ত হয়ে নিরবচ্ছিন্নতা কেটে যায়, তবে তাতে কোন ক্ষতি হয় না। যেমন ওযু করতে করতে হাতে বা ওযুর কোন অঙ্গে পেন্ট বা নখণ্ডপালিশ বা চুন ছাড়াতে অথবা পানি শেষ হয়ে গেলে পুনরায় কুঁয়ো বা কল থেকে পানি তুলতে কিংবা ট্যাঙ্কের পাইপ খুলতে প্রভৃতি কারণে ওযুতে সামান্য বিরতি এসে পূর্বেকার ধোয়া অঙ্গ শুকিয়ে যায়, তাহলে পুনরায় নতুনভাবে শুরু করে ওযু করতে হবে না। যে অঙ্গ ধোয়া হয়েছিল তার পর থেকেই বাকী অঙ্গসমূহ ধুয়ে ওযু শেষ করা যাবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ১/১৫৭)

ওযু করার সময় বাঁধানো দাঁত খোলা বা খেলাল করে দাঁতের ফাঁক থেকে লেগে থাকা খাদ্যাংশ বের করা জরুরী নয়। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/২৮৩, ফম: ১/২১০)

একই পাত্র হতে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে এক সাথে অথবা স্ত্রী আগে ও স্বামী পরে অথবা তার বিপরীতভাবে ওযু-গোসল করায় কোন ক্ষতি বা বাধা নেই। আল্লাহর রসূল (সাঃ) তথা সাহাবাগণ এরুপ আমল করেছেন। (বুখারী, ফতহুল বারী ১/৩৫৭-৩৫৮, মুসলিম,  মিশকাত ৪৪০নং)

ঠান্ডার কারণে গরম পানিতে ওযু-গোসল করায় কোন বাধা নেই। হযরত উমার (রাঃ) এরুপ করতেন। (বুখারী, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ১/৩৫৭-৩৫৮)

ওযু-গোসলের জন্য পরিমিত পানি ব্যবহার করা কর্তব্য। অধিক পানি খরচ করা অতিরঞ্জনের পর্যায়ভুক্ত; আর তা বৈধ নয়। (আহমাদ, মুসনাদ আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, মিশকাত ৪১৮নং) মহানবী (সাঃ) ১ মুদ্দ্ (কম-বেশী ৬২৫ গ্রাম) পানিতে ওযু এবং ১ সা’ থেকে ৫ মুদ্দ্ (কম-বেশী ২৫০০ থেকে ৩১২৫ গ্রাম) পানিতে গোসল করতেন। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৪৩৯নং) সুতরাং যাঁরা ট্যাঙ্কের পানিতে ওযু-গোসল করেন, তাঁদেরকে সতর্ক হওয়া উচিৎ।

ওযুর ফরয অঙ্গ সম্পূর্ণ কাটা থাকলে তার বাকী অঙ্গ ধুতে বা মাসাহ্‌ করতে হয় না। যেমন একটি হাত গোটা বা কনুই পর্যন্ত অথবা একটি পা গোটা বা গাঁট পর্যন্ত কাটা থাকলে বাকী একটি হাত বা পা-ই ওযুর জন্য ধুতে হবে। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩৯০)

ওযুর শেষে পাত্রের অবশিষ্ট পানি থেকে এক আঁজলা দাঁড়িয়ে পান করার কথা হাদীসে রয়েছে। (বুখারী ৫৬১৬, তিরমিযী, সুনান ৪৪-৪৫, নাসাঈ, সুনান ৯৩নং)

ওযুর শেষে ওযুর পানি অঙ্গ থেকে কাপড় দিয়ে মুছে ফেলা দূষণীয় নয়। মহানবী (সাঃ) ওযুর পর নিজের জুব্বায় নিজের চেহারা মুছেছেন। (ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ৩৭৯নং) ওযূর পর পানি মুছার জন্য তাঁর একটি বস্ত্র খন্ড ছিল। (তিরমিযী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, জামে ৪৮৩০নং)

ওযুর পর দুই রাকআত নামাযের বড় ফযীলত রয়েছে। আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “যে কোন ব্যক্তি যখনই সুন্দরভাবে ওযু করে সবিনয়ে একাগ্রতার সাথে (কায়মনোবাক্যে) দুই রাকআত নামায পড়ে তক্ষণই তার জন্য জান্নাত অবধার্য হয়ে যায়।” (মুসলিম ২৩৪নং, আবু দাঊদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ্‌)

তিনি আরো বলেন, “যে ব্যক্তি সুন্দরভাবে ওযু করে, কোন ভুল না করে ( একাগ্রচিত্তে) দুই রাকআত নামায পড়ে সেই ব্যক্তির পূর্বেকার সমূদয় গুনাহ মাফ হয়ে যায়।” (আবু দাঊদ, সহীহ তারগীব ২২১নং)

ওযুর পরে নামায পড়ার ফলেই নবী (সাঃ) বেহেশ্তে তাঁর আগে আগে হযরত বিলালের জুতোর শব্দ শুনেছিলেন। (বুখারী, মুসলিম,  সহিহ তারগিব ২১৯নং)

প্রিয় নবী (সাঃ) প্রত্যেক নামাযের জন্য ওযু করতেন। তবে সাহাবাগণ না ভাঙ্গা পর্যন্ত একই ওযুতে কয়েক ওয়াক্তের নামায পড়তেন। (আহমাদ, মুসনাদ, বুখারী ২১৪ নং, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, দারেমী, সুনান, মিশকাত ৪২৫নং)

অবশ্য মক্কা বিজয়ের দিন নবী (সাঃ) এক ওযুতেই পাঁচ ওয়াক্তের নামায পড়েছিলেন। (মুসলিম, সহীহ ২৭৭, আবূদাঊদ, সুনান ১৭২, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ৫১০নং)

সর্বদা ওযু অবস্থায় থাকা এবং ওযু ভাঙ্গলে সাথে সাথে ওযু করে নেওয়ার ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমরা (প্রত্যেক বিষয়ে) কর্তব্যনিষ্ঠ রহ্‌; আর তাতে কখনই  সক্ষম হবে না। জেনে রেখো, তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ আমল নামায। আর মুমিন ব্যতীত কেউই ওযুর হিফাযত করবে না।” (ইবনে মাজাহ্‌,হাকেম, সহীহ তারগীব ১৯০নং)

হযরত আব্দুল্লাহ বিন বুরাইদাহ্‌  তাঁর পিতার নিকট হতে বর্ণনা করে বলেন, একদা প্রভাতকালে আল্লাহর রসূল (সাঃ) হযরত বিলালকে ডেকে বললেন, “হে বিলাল! কি এমন কাজ করে তুমি জান্নাতে আমার আগে চলে গেলে? আমি গত রাত্রে (স্বপ্নে) জান্নাতে প্রবেশ করলে তোমার (জুতার) শব্দ আমার সামনে থেকে শুনতে পেলাম!” বিলাল বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমি যখনই আযান দিয়েছি তখনই দুই রাকআত নামায পড়েছি। আর যখনই আমি অপবিত্র হয়েছি তখনই আমি সাথে সাথে ওযু করে নিয়েছি।’ এ শুনে আল্লাহর রসূল (সাঃ) বললেন, “এই কাজের জন্যই। (জান্নাতে আমার আগে আগে তোমার শব্দ শুনলাম।)” (ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ তারগীব ১৯৪নং)

রোগীর পবিত্রতা ও ওযু-গোসল

রোগী হলেও গোসল ওয়াজেব হলে গোসল এবং ওযুর দরকার হলে ওযু করা জরুরী।

ঠান্ডা পানি ব্যবহার করায় ক্ষতির আশঙ্কা হলে রোগী গরম পানি ব্যবহার করবে। পানি ব্যবহারে একেবারেই অসমর্থ হলে বা রোগ-বৃদ্ধি অথবা আরোগ্য লাভে বিলম্বের আশঙ্কা হলে তায়াম্মুম করবে।

রোগী নিজে ওযু বা তায়াম্মুম করতে না পারলে অন্য কেউ করিয়ে দেবে।

ওযুর কোন অঙ্গে ক্ষত থাকলেও তা ধুতে হবে। অবশ্য পানি লাগলে ঘা বেড়ে যাবে এমন আশঙ্কা থাকলে হাত ভিজিয়ে তার উপর বুলিয়ে মাসাহ্‌ করবে। মাসাহ্‌ করাও ক্ষতিকারক হলে ঐ অঙ্গের পরিবর্তে তায়াম্মুম করে নেবে।

ক্ষতস্থানে পটি বাঁধা বা প্লাস্টার করা থাকলে অন্যান্য অঙ্গ ধুয়ে পটির উপর মাসাহ্‌ করবে। মাসাহ্‌ করলে আর তায়াম্মুমের প্রয়োজন নেই।

রোগীর জন্যও দেহ্‌, লেবাস ও নামায পড়ার স্থানের সর্বপ্রকার পবিত্রতা জরুরী। কিন্তু অপবিত্রতা দূর করতে না পারলে যে অবস্থায় থাকবে সে অবস্থাতেই তার নামায শুদ্ধ হয়ে যাবে।

কোন নামাযকে তার যথা সময় থেকে পিছিয়ে দেওয়া (যেমন ফজরকে যোহরের সময় পর্যন্ত বিলম্ব করা) রোগীর জন্যও বৈধ নয়। যথা সম্ভব পবিত্রতা অর্জন করে অথবা (অক্ষম হলে) না করেই নামাযের যথা সময় অতিবাহিত হওয়ার পূর্বেই নামায অবশ্যই পড়ে নেবে। নচেৎ গুনাহগার হবে। (রাসাইল ফিত্ তাহারাতি অস্ সালাত, ইবনে উসাইমীন ৩৯-৪১পৃ:)

কেবলমাত্র মাথা ধুলে অসুখ হওয়ার বা বাড়ার ভয় হলে বাকী দেহ্‌ ধুয়ে মাথায় মাসাহ্‌ করবে। অবশ্য এর সাথে তায়াম্মুমও করতে হবে। (ইবনে বায, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২১৪)

সর্বদা প্রস্রাব ঝরলে অথবা বাতকর্ম হলে অথবা মহিলাদের সাদা স্রাব ঝরলে প্রত্যেক নামাযের জন্য ওযু জরুরী। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/২৮৭-২৯১ দ্র:)

নামাযের সময় হলে যদি কাপড়ে নাপাকী লেগে থাকে, তবে নামাযী তা বদলে লজ্জাস্থান ধুয়ে ওযু করবে। নামাযের সময় যাতে নাপাকী অন্যান্য অঙ্গে বা কাপড়ে ছড়িয়ে না পড়ে তার জন্য শরমগাহে বিশেষ কাপড়, ল্যাঙ্গট বা পটি ব্যবহার করবে।

গোসল করলে রোগ-বৃদ্ধি হবে এবং ওযু করলে ক্ষতি হবে না বুঝলে তায়াম্মুম করে ওযু করবে।

ওযু নষ্ট হওয়ার কারণসমূহ

১। পেশাব ও পায়খানা দ্বার হতে কিছু (পেশাব, পায়খানা, বীর্য, মযী, হাওয়া, রক্ত, কৃমি, পাথর প্রভৃতি) বের হলে ওযু ভেঙ্গে যায়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ১/২২০)

তদনুরুপ দেহের অন্যান্য অঙ্গ থেকে (যেমন অপারেশন করে পেট থেকে পাইপের মাধ্যমে) অপবিত্র (বিশেষ করে পেশাব-পায়খানা) বের হলেও ওযু নষ্ট হয়ে যাবে। (ঐ১/২২১)

২। যাতে গোসল ওয়াজেব হয়, তাতে ওযুও নষ্ট হয়।

৩। কোন প্রকারে বেহুশ বা জ্ঞানশূন্য হলে ওযু নষ্ট হয়।

৪। গাঢ়ভাবে ঘুমিয়ে পড়লে ওযু ভাঙ্গে। আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “ চোখ হল মলদ্বারের বাঁধন। সুতরাং যে ঘুমিয়ে যায়, সে যেন ওযু করে।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, মিশকাত ৩১৬, জামে ৪১৪৯নং)

অবশ্য হাল্কা ঘুম বা ঢুল (তন্দ্রা) এলে ওযু ভাঙ্গে না। সাহাবায়ে কেরাম নবী (সাঃ) এর যুগে এশার নামাযের জন্য তাঁর অপেক্ষা করতে করতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে ঢুলতেন। অতঃপর তিনি এলে তাঁরা নামায পড়তেন, কিন্তু নতুন করে আর ওযু করতেন না। (মুসলিম, সহীহ ৩৭৬নং, আবূদাঊদ, সুনান ১৯৯-২০১নং)

৫। পেশাব অথবা পায়খানা-দ্বার সরাসরি স্পর্শ করলে ওযু নষ্ট হয়। (কাপড়ের উপর থেকে হাত দিলে নষ্ট হয় না।) (জামে ৬৫৫৪, ৬৫৫৫নং) মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি বিনা পর্দায় ও অন্তরালে নিজের শরমগাহ্‌ স্পর্শ করে, তার উপর ওযু ওয়াজেব হয়ে যায়।” (জামে ৩৬২, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১২৩৫ নং)

হাতের কব্জির উপরের অংশ দ্বারা স্পর্শ হলে ওযু ভাঙ্গবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ১/২২৯)

৬। উটের গোশত (কলিজা, ভূঁড়ি) খেলে ওযু ভেঙ্গে যায়। এক ব্যক্তি মহানবী (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করল, ‘উটের গোশত খেলে ওযু করব কি?’ তিনি বললেন, “হ্যাঁ, উটের গোশত খেলে ওযু করো।” (মুসলিম, সহীহ ৩৬০নং)

তিনি বলেন, “উটের গোশত  খেলে তোমরা ওযু করো।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, জামে ৩০০৬ নং)

যাতে ওযু নষ্ট হয় না

১। নারীদেহ্‌ স্পর্শ করলে ওযু ভাঙ্গে না। কারণ, মহানবী (সাঃ) রাত্রে নামায পড়তেন, আর মা আয়েশা (রাঃ) তাঁর সম্মুখে পা মেলে শুয়ে থাকতেন। যখন তিনি সিজদায় যেতেন, তখন তাঁর পায়ে স্পর্শ করে পা সরিয়ে নিতে বলতেন। এতে তিনি নিজের পা দু’টিকে গুটিয়ে নিতেন। (বুখারী ৫১৩, মুসলিম, সহীহ ৫১২নং)

তিনি হযরত আয়েশা (রাঃ)কে চুম্বন দিতেন। তারপর ওযু না করে নামায পড়তে বেরিয়ে যেতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ১৭৮-১৭৯ নং, আহমাদ, মুসনাদ ৬/২১০, দি: ৮৬, নাসাঈ, সুনান ১৭০, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ৫০২নং, দারাক্বুত্বনী, সুনান ১/১৩৮, বায়হাকী ১/১২৫)

অবশ্য স্পর্শ বা চুম্বনে মযী বের হলে তা ধুয়ে ওযু জরুরী। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন১/২৮৫-২৮৬)

২। হো-হো করে হাসলে; এ প্রসঙ্গের হাদীসটি দলীলের যোগ্য নয়। তাই হাসলে ওযু ভাঙ্গে না। (ফিকহুস সুন্নাহ্‌ উর্দু ১/৫০-৫১, বুখারী, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ১/৩৩৬)

৩। বমি করলে; একদা নবী (সাঃ) বমি করলে রোযা ভেঙ্গে ফেললেন। তারপর তিনি ওযু করলেন। (আহমাদ, মুসনাদ ৬/৪৪৯, তিরমিযী, সুনান) এই হাদীসে তাঁর কর্মের পরস্পর অবস্থা বর্ণিত হয়েছে।  বমি করলেন বলে ওযু ভেঙ্গে গিয়েছিল, তাই তিনি ওযু করেছিলেন -তা প্রমাণ হয় না। (ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ১/১৪৮, আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ১/২২৪-২২৫)

৪। গাঁটের নিচে কাপড় ঝুলালে; গাঁটের নিচে কাপড় ঝুলানো কাবীরা গুনাহ। কিয়ামতে আল্লাহ সেই ব্যক্তির দিকে তাকিয়েও দেখবেন না, যে ব্যক্তি তার পরনের কাপড় পায়ের গাঁটের নিচে পর্যন্ত ঝুলিয়ে পরে। (বুখারী ৫৭৮৪, মুসলিম, সহীহ ২০৮৫নং) কিন্তু এর ফলে ওযু ভাঙ্গে না। এক ব্যক্তি ঐরুপ কাপড় ঝুলিয়ে নামায পড়লে মহানবী (সাঃ) তাকে পুনরায় ওযু করে নামায পড়তে হুকুম দিয়েছিলেন বলে যে হাদীস আবূ দাঊদে বর্ণিত হয়েছে, তা যয়ীফ এবং দলীলের যোগ্য নয়। (যয়ীফ আবূদাঊদ, সুনান ১২৪, ৮৮৪নং)

৫। নাক থেকে রক্ত পড়লে; এতে ওযু নষ্ট হয় বলে হাদীস ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে, তা যয়ীফ। (যয়ীফ ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ২৫২, যয়ীফ জামে ৫৪২৬নং)

৬। দেহের কোন অঙ্গ কেটে রক্ত পড়লে, দাঁত থেকে রক্ত ঝরলে, তীরবিদ্ধ হয়ে রক্ত পড়লে; যা-তুর রিকা’ যুদ্ধে নবী (সাঃ) উপস্থিত ছিলেন। সেখানে এক ব্যক্তি তীরবিদ্ধ হয়ে রক্তাক্ত হলেও সে রুকু সিজদা করে নামায সম্পন্ন করেছিল। হাসান বাসরী (রহঃ) বলেন, মুসলিমরা এ যাবৎ তাদের রক্তাক্ত ক্ষত নিয়েই নামায পড়ে আসছে। হযরত ইবনে উমার (রাঃ) একটি ফুসকুরি গেলে দিলে তা থেকে রক্ত বের হল। কিন্তু তিনি ওযু করলেন না। ইবনে আবী আওফা রক্তমাখা থুথু ফেললেন। অতঃপর তিনি তাঁর নামায সম্পন্ন করলেন। ইবনে উমার ওহাসান বলেন, কেউ শৃঙ্গ লাগিয়ে বদ-রক্ত বের করলে কেবল ঐ জায়গাটা ধুয়ে নেবে। এ ছাড়া ওযু-গোসল নেই। (বুখারী ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ১/৩৩৬)

পূর্বোক্ত তীরবিদ্ধ লোকটি ছিল একজন আনসারী। তার সঙ্গী এক মুহাজেরী তার রক্তাক্ত অবস্থা দেখে বলল, ‘সুবহানাল্লাহ্‌! (তিন তিনটে তীর মেরেছে?!) প্রথম তীর মারলে তুমি আমাকে জাগিয়ে দাওনি কেন?’ আনসারী বলল, ‘আমি এমন একটি সূরা পাঠ করছিলাম, যা সম্পূর্ণ না করে ছেড়ে দিতে পছন্দ করিনি!’ (আবূদাঊদ, সুনান ১৯৮নং)

৭। মুর্দা গোসল দিলে; মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি মুর্দা কে গোসল দেবে, সে যেন নিজে গোসল করে নেয়। আর যে ব্যক্তি জানাযা বহন করবে, সে যেন ওযু করে নেয়।” (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ ২/২৮০ প্রভৃতি) কিন্তু এই নির্দেশটি মুস্তাহাব। অর্থাৎ না করলেও চলে। তবে করা উত্তম। কারণ, গোসলদাতার দেহে নাপাকী লেগে যাওয়ার সন্দেহ্‌ থাকে তাই। তাই তো অন্য এক বর্ণনায় আছে; তিনি বলেন, “মুর্দাকে গোসল দিলে তোমাদের জন্য গোসল করা জরুরী নয়। কারণ তোমাদের মুর্দা তো আর নাপাক নয়। অতএব তোমাদের হাত ধুয়ে নেওয়াই যথেষ্ট।” (হাকেম, মুস্তাদরাক ১/৩৮৬, বায়হাকী ৩/৩৯৮)

হযরত উমার (রাঃ) বলেন, ‘আমরা মাইয়্যেতকে গোসল দিতাম। তাতে আমাদের মধ্যে কেউ কেউ গোসল করে নিত। আবার অনেকে করত না।’ (দারাক্বুত্বনী, সুনান ১৯১নং)

অবশ্য মাইয়্যেতকে গোসল দেওয়ার সময় তার শরমগাহে হাত লেগে থাকলে ওযু অবশ্যই নষ্ট হবে। আর জানাযা বহন করাতে ওযু নষ্ট হয় না। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ২৬/৯৬)

৮। মৃতদেহের পোষ্টমর্টেম করাতেও ওযু ভাঙ্গে না। (ঐ ২৭/৪০)

৯। ওযু করে মায়েরা যদি তাদের শিশুর পেশাব বা পায়খানা সাফ করে, তবে তা হাতে লাগলেও ওযু ভাঙ্গে না। অবশ্য পায়খানাদ্বার বা পেশাবদ্বার ধোয়ার সময় কোন দ্বারে হাত লাগলে ওযু নষ্ট হয়ে যায়। (ঐ ২২/৬২)

১০। কোনও নাপাক বস্তু (মানুষ বা পশুর পেশাব, পায়খানা, রক্ত প্রভৃতি)তে হাত বা পা দিলে ওযু ভাঙ্গে না। (ঐ ৩৫/৯৬)

১১। ওযু করার পর ধূমপান করলে ওযু নষ্ট হয় না। তবে ধূমপান করা অবশ্যই হারাম। (ঐ ১৮/৯২-৯৩)

১২। কোলন, কোহল বা স্পিরিট-মিশ্রিত আতর বা সেন্টব্যবহার করলে ওযুর কোন ক্ষতি হয় না। তবে তা ব্যবহার বৈধ নয়। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২০৩)

১৩। চুল, নখ ইত্যাদি সাফ করলে ওযু ভাঙ্গে না। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/২৯২, বুখারী ১/৩৩৬) তদনুরুপ অশ্লীল কথা বললে, হাঁটুর উপর কাপড় উঠে এলে, মহিলার মাথা খোলা গেলে, কাউকে বা নিজেকে উলঙ্গ দেখলে ওযু নষ্ট হয় না।

দুধ পান করলে নামাযের পূর্বে কুল্লি করা মুস্তাহাব। (বুখারী ২১১, মুসলিম, সহীহ ৩৫৮নং)

যে যে কাজের জন্য ওযু জরুরী বা মুস্তাহাব
নামায পড়ার জন্য, কুরআন মাজীদ (মুসহাফ) স্পর্শ করা বা হাতে নেওয়ার জন্য এবং কা’বা শরীফের তওয়াফ করার জন্য ওযু করা জরুরী।

এ ছাড়া কুরআন তেলাওয়াত, আল্লাহর যিক্‌র, তেলাওয়াত ও শুক্‌রের সিজদা, আযান, সাফা-মারওয়ার সাঈ, বিভিন্ন খোতবা পাঠ ইত্যাদির সময় ওযু করা মুস্তাহাব।

মোজার উপর মাসাহ্‌

চামড়া বা কাপড়ের (সুতি বা নাইলনের) মোজার উপর মাসাহ্‌ বহু সংখ্যক হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। সাহাবী জারীর (রাঃ) (যিনি ওযুর আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর ইসলাম গ্রহণ করেন তিনি) বলেন, ‘আমি দেখেছি, আল্লাহর রসূল (সাঃ) পেশাব করার পর ওযু করলেন এবং নিজের (চামড়ার) মোজার উপর মাসাহ্‌ করলেন।’ (মুসলিম, সহীহ ২৭২নং)

মুগীরাহ্‌ বিন শো’বাহ্‌ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাঃ) ওযুর পর (সুতির) মোজা ও জুতোর উপর মাসাহ্‌ করেছেন। (আবূদাঊদ, সুনান ১৫৯, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, তিরমিযী, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ৫২৩নং)

এই মাসাহ্‌র শর্তাবলী

এই মাসাহ্‌র জন্য ৪টি শর্ত রয়েছে;

১- পা ধুয়ে পূর্ণরুপে ওযু করার পর মোজা পরতে হবে। পূর্বে ওযু না করে মোজা পরে, তারপর তার উপর মাসাহ্‌ চলবে না।

সাহাবী মুগীরাহ্‌ (রাঃ) বলেন, আমি নবী (সাঃ) এর সঙ্গে এক সফরে ছিলাম। তিনি ওযু করছিলেন। আমি তাঁর মোজা দু’টি খুলে নিতে ঝুঁকলাম। তিনি বললেন, “ছাড়ো, আমি ও দু’টিকে ওযু অবস্থায় পরেছি।” (বুখারী ২০৬, মুসলিম, সহীহ ২৭৪নং)

২- মোজা দু’টি যেন পবিত্র হয়। অর্থাৎ, তাতে যেন কোন প্রকারের নাপাকী লেগে না থাকে।

৩- এই মাসাহ্‌ যেন সেই পবিত্রতা অর্জনের সময় হয়, যার জন্য কেবল ওযু জরুরী হয়। কারণ, যার জন্য গোসল জরুরী হয়, সেই পবিত্রতা অর্জনের সময় মোজা খুলে দিয়ে পা ধোওয়া জরুরী। (তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, মিশকাত ৫২০নং)

৪- মাসাহ্‌ যেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে হয়। (ফাতাওয়া ফিল মাসহি আলাল খুফফাইন, ইবনে উসাইমীন ৩নং)

মাসাহ্‌র সময়কাল

হযরত আলী (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাঃ) মুসাফিরের জন্য ৩ দিন এবং গৃহ্‌বাসীর জন্য ১ দিন মোজার উপর মাসাহ্‌র সময়-সীমা নির্ধারিত করেছেন। (মুসলিম, সহীহ ২৭৬)

এই নির্দিষ্ট সময় শুরু হবে, ওযু করে মোজা পরে ঐ ওযু ভাঙ্গলে তার পরের ওযু করার সময় তার উপর মাসাহ্‌ করার পর থেকে। অতএব প্রথম মাসাহ্‌ থেকে ২৪ ঘন্টা গৃহ্‌বাসীর জন্য এবং ৭২ ঘন্টা মুসাফিরের জন্য মাসাহ্‌ করা বৈধ হবে। সুতরাং যদি কেউ মঙ্গলবারের ফজরের নামাযের জন্য ওযু করার সময় মোজা পরে, তারপর ঐ ওযুতে চার ওয়াক্ত নামায পড়ে যদি তার ওযু এশার পর ভাঙ্গে এবং বুধবার ফজরের পূর্বে ওযু করার সময় মাসাহ্‌ করে, তাহলে সে গৃহ্‌বাসী হলে পর দিন বৃহ্‌স্পতিবারের ফজর পর্যন্ত ওযু করার সময় মোজার উপর মাসাহ্‌ করতে পারে। অনুরুপ মুসাফির হলে শনিবার ফজর পর্যন্ত মাসাহ্‌ করতে পারবে। (ফাতাওয়া ফিল মাসহি আলাল খুফফাইন, ইবনে উসাইমীন, ইবনে উসাইমীন ৮-৯পৃ:, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১/২৩৬)

এই মাসাহ্‌র নিয়ম

দু’টি হাতকে ভিজিয়ে ডানহাতের আঙ্গুলগুলিকে ডান পায়ের আঙ্গুলের উপর থেকে শুরু করে পায়ের পাতার উপর দিকে বুলিয়ে নিয়ে গিয়ে পায়ের রলার শুরু পর্যন্ত মাসাহ্‌ করতে হবে। আর ঐ একই সাথে একই নিয়মে বামহাতের আঙ্গুল দিয়ে বাম পায়ের পাতার উপর মাসাহ্‌ করবে। উভয় কানের মাসাহ্‌ যেমন একই সঙ্গে হয়, ঠিক তেমনিই উভয় পায়ের মাসাহ্‌ একই সঙ্গে হবে। দুই হাত জুড়ে প্রথমে ডান পা, তারপর বাম পা পৃথক করে মাসাহ্‌ করা ঠিক নয়। (ফাতাওয়া ফিল মাসহি আলাল খুফফাইন, ইবনে উসাইমীন ১৩নং)

পায়ের তেলোতে ধুলো-বালি থাকলেও তার নিচে মাসাহ্‌ করা বিধেয় নয়। হযরত আলী (রাঃ) বলেন, ‘দ্বীনে যদি রায় ও বিবেকের স্থান থাকত, তাহলে মোজার উপরের অংশ অপেক্ষা নিচের অংশই অধিক মাসাহ্‌যোগ্য হত। কিন্তু আমি আল্লাহর রসূল (সাঃ) কে তাঁর মোজার উপরের অংশে মাসাহ্‌ করতে দেখেছি।’ (আবূদাঊদ, সুনান, দারেমী, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ৫২৫নং)

মাসাহ্‌ নষ্ট হয় কিসে?

১- মাসাহ্‌র নির্দিষ্ট সময়-সীমা অতিবাহিত হয়ে গেলে।

২- গোসল ফরয হলে।

৩- (মাসাহ্‌ করার পর) মোজা খুলে ফেললে।

এই মাসাহ্‌র আনুষঙ্গিক মাসায়েল
শীত-গ্রীষ্ম যে কোন সময়ে মোজা পরে থাকলে তার উপর মাসাহ্‌ বৈধ। মোজা পরা শীতের জন্যই হতে হবে, এমন কোন শর্ত নেই। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৩৫)

একেবারে পাতলা (যাতে পা দেখা যায় এমন) মোজা হলে তাতে মাসাহ্‌ চলবে না। (ঐ ১/২৩৪)

উত্তম ও সতর্কতামূলক আমল এই যে, উভয় পা ধোয়া শেষ হলে তবেই মোজা পরা হবে। নচেৎ ডান পা ধুয়ে মোজা পরে নিয়ে তারপর বাম পা ধোয়া ও মোজা পরা উত্তম নয়। (ঐ ১/২৩৩-২৩৪)

মোজা পরার সময় ‘এর উপর মাসাহ্‌ করব’ বা ‘এতদিন মাসাহ্‌ করব’ এমন কোন নিয়ত শর্ত বা জরুরী নয়। (ফাতাওয়া ফিল মাসহি আলাল খুফফাইন, ইবনে উসাইমীন ৬নং)

ওযু করার পরই মোজা পরলে তার উপর মাসাহ্‌ করা যায়। তায়াম্মুম করার পর মোজা পরলে (পুনরায় পানি পেলে ও ওযু করলে সেই সময়) মাসাহ্‌ করা যায় না। পক্ষান্তরে পানি না পেলে এবং ওযু না করলে যতদিন তায়াম্মুম করবে ততদিন পায়ে মোজা থাকবে। এ সময় মোজার উপর মাসাহ্‌ করা বা মোজা খুলে ফেলা জরুরী নয়। যেহেতু তায়াম্মুমের সাথে পায়ের কোন সম্পর্ক নেই। (ফাতাওয়া ফিল মাসহি আলাল খুফফাইন, ইবনে উসাইমীন ৫নং)

যে সফরে নামাযের কসর বৈধ, সেই সফরে ৩ দিন ৩ রাত মাসাহ্‌ বৈধ। (ঐ ৭নং)  ঘরে থেকে মাসাহ্‌ শুরু করার পর সফর করলে মুসাফিরের মত ৭২ ঘন্টাই মাসাহ্‌ করতে পারা যাবে। অনুরুপ সফরে মাসাহ্‌ শুরু করে ঘরে ফিরে এলে গৃহ্‌বাসীর মত কেবল ২৪ ঘন্টাই মাসাহ্‌ করা যাবে। (ঐ ৮নং)

মাসাহ্‌র নির্ধারিত সময়কাল শেষ হয়ে যাওয়ার পর মাসাহ্‌ করে নামায পড়লে নামায হয় না। (ঐ ১০নং)

ওযু করার পর মোজা পরে ওযু না ভাঙ্গার পূর্বেই যদি খুলে পুনরায় পরে নেওয়া হয়, তাহলে তাতেও মাসাহ্‌ করা চলবে। কিন্তু একবার মাসাহ্‌ করার পর মোজা খুলে ফেললে তারপর পুনরায় (ওযু থাকলেও) পরার পর আর মাসাহ্‌ চলবে না। কারণ, যে ওযুতে পা ধোওয়া হয় কেবল সেই ওযুর পরই মোজা পরলে তার উপর মাসাহ্‌ করা যাবে। (ঐ ১১নং)

মোজার উপর মাসাহ্‌ করার পর জুতো পরলে বা ডবল মোজা পরলে অথবা ডবল মোজা বা জুতোর উপর মাসাহ্‌ করার পর একটি মোজা বা জুতো খুলে ফেললে উভয় অবস্থাতেই মাসাহ্‌ বৈধ। তবে মাসাহ্‌র সময়কাল ধরতে হবে প্রথম অবস্থা থেকে। (ঐ ১২নং)

মহিলারাও পুরুষদের মতই মাসাহ্‌ করবে। (ঐ ১৬নং)

মোজা নামিয়ে পা চুলকালে বা পাথর আদি বের করলে যদি অধিকাংশ পা বের হয়ে যায়, তাহলে তার উপর আর মাসাহ্‌ বৈধ হবে না। মোজার তলায় হাত ভরলে বা সামান্য পা বের হয়ে গেলে মাসাহতে কোন প্রভাব পড়বে না। (ঐ ১৭নং)

মোজার উপর মাসাহ্‌ করার পর মোজা খুলে ফেললে ঐ ওযু নষ্ট হয়ে যায় না। তবে পুনরায় (পা না ধুয়ে ওযু করে) মোজা পরলে তার উপর মাসাহ্‌ চলে না। (ঐ ১৯নং)

ওযুর মধ্যে যতটা পা ধোয়া ফরয মোজাতে ততটা পা-ই ঢাকতে হবে; নচেৎ মাসাহ্‌ হবে না -এ কথার কোন দলীল নেই। অতএব ফাটা, কাটা ও ছেঁড়া মোজার উপরেও মাসাহ্‌ চলবে। (ঐ ৪নং) তবে যদি অধিকাংশ পা বেরিয়ে থাকে, তাহলে সে কথা ভিন্ন।

ওযু না করে মোজা পরে তাতে মাসাহ্‌ করে ওযু করলে নামায হয় না। যেমন ক্ষতস্থানে মাসাহ্‌ ভুলে গিয়ে ওযু করে নামায পড়লেও নামায হয় না। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৩২, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ৫/২৯৮)

তায়াম্মুম

তায়াম্মুমের নির্দেশ খোদ আল্লাহ তাআলা দিয়েছেন। তিনি বলেন,

وَإِنْ كُنْتُمْ مَّرْضَى أَوْ عَلى سَفَرٍ أَوْ جَاءَ أَحَدٌ مِّنْكُمْ مِّنَ الْغَائِطِ أَوْ لاَمَسْتُمُ النِّسَاءَ فَلَمْ تَجِدُوْا مَاءً فَتَيَمَّمُوْا صَعِيْداً طَيِّباً فَامْسَحُوْا بِوُجُوْهِكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ مِّنْهُ

অর্থাৎ, যদি তোমরা অসুস্থ হও অথবা সফরে থাক, কিংবা তোমাদের মধ্যে কেউপায়খানা করে আসে অথবা তোমরা স্ত্রী-সঙ্গম কর, অতঃপর পানি না পাও, তাহলে পাক মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করে নাও; তোমাদের মুখমন্ডল ও হাতকে মাটি দ্বারা মাসাহ্‌ কর---। (কুরআন মাজীদ ৫/৬)

সরল ও সহ্‌জ দ্বীনের নবী (সাঃ) বলেন, “সকল মানুষ (উম্মতের) উপর আমাদেরকে ৩টি বিষয়ের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে; আমাদের কাতারকে করা হয়েছে ফিরিশ্‌তাবর্গের কাতারের মত, সারা পৃথিবীকে আমাদের জন্য মসজিদ করে দেওয়া হয়েছে এবং পানি না পাওয়া গেলে মাটিকে আমাদের জন্য পবিত্রতা অর্জনের উপকরণ করা হয়েছে। (মুসলিম,  মিশকাত ৫২৬নং)

কোন্‌ কোন্‌ অবস্থায় তায়াম্মুম বৈধ?

১। একেবারেই পানি না পাওয়া গেলে অথবা পান করার মত থাকলে এবং ওযু-গোসলের জন্য যথেষ্ট পানি না পাওয়া গেলে।

হযরত ইমরান বিন হুসাইন (রাঃ) বলেন, আমরা নবী (সাঃ) এর সঙ্গে এক সফরে ছিলাম। এক সময় তিনি লোকেদের নিয়ে নামায পড়লেন। যখন তিনি নামায শেষ করলেন, তখন দেখলেন একটি লোক একটু সরে পৃথক দাঁড়িয়ে আছে। সে জামাআতে নামাযও পড়েনি। তিনি তাকে বললেন, “কি কারণে তুমি জামাআতে নামায পড়লে না?” লোকটি বলল,  ‘আমি নাপাকে আছি, আর পানিও নেই।’ তিনি বললেন, “পাক মাটি ব্যবহার কর। তোমার জন্য তাই যথেষ্ট।” (বুখারী, মুসলিম, সহীহ মিশকাত ৫২৭নং)

তিনি আরো বলেন, “দশ বছর যাবৎ পানি না পাওয়া গেলে মুসলিমের ওযুর উপকরণ হল পাক মাটি। পানি পাওয়া গেলে গোসল করে নেওয়া উচিৎ। আর এটা অবশ্যই উত্তম।” (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ৫৩০নং)

অবশ্য আশে-পাশে বা সঙ্গীদের কারো নিকট পানি আছে কি না, তা অবশ্যই দেখে নিতে হবে। যখন একান্ত পানি পাওয়ার কোন আশাই থাকবে না, তখন তায়া ম্মু ম করে নামায পড়তে হবে।

২। অসুস্থ থাকলে অথবা দেহে কোন প্রকার ক্ষত বা ঘা থাকলে এবং পানি ব্যবহারে তা বেড়ে যাওয়া বা সুস্থ হতে বিলম্ব হওয়ার আশঙ্কা হলে।

হযরত জাবের (রাঃ) বলেন, একদা আমরা কোন সফরে বের হ্‌লাম। আমাদের মধ্যে এক ব্যক্তির মাথায় পাথরের আঘাত লেগে ক্ষত হয়েছিল। এরপর তার স্বপ্ন দোষও হল। সে সঙ্গীদেরকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমার জন্য কি তায়াম্মুম বৈধ মনে কর?’ সকলে বলল, ‘তুমি পানি ব্যবহার করতে অক্ষম নও। অতএব তোমার জন্য আমরা তায়াম্মুম বৈধ মনে করি না।’ তা শুনে লোকটি গোসল করল এবং এর প্রতি ক্রি য়ায় সে মারা গেল। অতঃপর আমরা যখন নবী (সাঃ)-এর নিকট ফিরে এলাম তখন তাঁকে সেই লোকটার ঘটনা খুলে বললাম। তা শুনে তিনি বললেন, “ওরা ওকে মেরে ফেলল, আল্লাহ ওদেরকে ধ্বংস করুক! যদি ওরা জানত না, তবে জেনে কেন নেয়নি? অজ্ঞতার ওষুধ তো প্রশ্নই।” (সহীহ আবূদাঊদ, সুনান ৩২৫, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, দারাক্বুত্বনী, সুনান, মিশকাত ৫৩১নং)

৩। পানি অতিরিক্ত ঠান্ডা হলে এবং তাতে ওযু-গোসল করাতে অসুখ হবে বলে দৃঢ় আশঙ্কা হলে, পরন্তু পানি গরম করার সুযোগ বা ব্যবস্থা না থাকলে তায়াম্মুম বৈধ।

হযরত আম্‌র বিন আস (রাঃ) বলেন, যাতুস সালাসিল যুদ্ধ-সফরে এক শীতের রাতে আমার স্বপ্ন দোষ হল। আমার ভয় হল যে, যদি গোসল করি তাহলে আমি ধ্বংস হয়ে যাব। তাই আমি তায়াম্মুম করে সঙ্গীদেরকে নিয়ে (ইমাম হয়ে) ফজরের নামায পড়লাম। আমার সঙ্গীরা একথা নবী (সাঃ)-এর নিকটে উল্লেখ করলে তিনি বললেন, “হে আম্‌র! তুমি নাপাক অবস্থায় তোমার সঙ্গীদের ইমামতি করেছ?” আমি গোসল না করার কারণ তাঁকে বললাম। আরো বললাম যে, আল্লাহ তাআলার এ বাণীও আমি শুনেছি, তিনি বলেন, “তোমরা আত্মহ্‌ত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি বড় দয়াশীল।” (কুরআন মাজীদ ৪/২৯)

একথা শুনে তিনি হাসলেন এবং আর কিছুই বললেন না। (বুখারী, সহীহ আবূদাঊদ, সুনান ৩২৩নং, আহমাদ, মুসনাদ,হাকেম, মুস্তাদরাক, দারাক্বুত্বনী, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ)

৪। পানি ব্যবহারে ক্ষতি না হলে এবং পানি নিকটবর্তী কোন জায়গায় থাকলেও তা আনতে জান, মাল বা ইজ্জতহানির আশঙ্কা হলে, পানি ব্যবহার করতে গিয়ে সফরের সঙ্গীদের সঙ্গ-ছাড়া হওয়ার ভয় হলে, বন্দী অবস্থায় থাকলে অথবা ( কুঁয়ো ইত্যাদি থেকে) পানি তোলার কোন ব্যবস্থা না থাকলে তায়াম্মুম করা বৈধ। কারণ উক্ত অবস্থাগুলো পানি না পাওয়ার মতই অবস্থা।

৫। পানি কাছে থাকলেও তা ওযুর জন্য ব্যবহার করলে পান করা, রান্না করা ইত্যাদি হবে না আশঙ্কা হলেও তায়াম্মুম বৈধ। (মুগনী, ফিকহুস সুন্নাহ্‌ উর্দু ১/৬১-৬২)

কিসে তায়াম্মুম হবে?

পবিত্র মাটি এবং তার শ্রেণীভুক্ত সকল বস্তু (যেমন, পাথর, বালি, কাঁকর, সিমেন্ট প্রভৃতি) দ্বারা তায়াম্মুম শুদ্ধ। ধুলাযুক্ত মাটি না পাওয়া গেলে ধুলাহীন পাথর বা বালিতে তায়াম্মুম বৈধ হবে। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২১৮)

তায়াম্মুম করার পদ্ধতি

শুদ্ধতম হাদীস অনুসারে তায়াম্মুম করার পদ্ধতি নিম্নরুপ:

(নিয়ত করার পর ‘বিসমিল্লাহ্‌’ বলে) দুই হাতের চেটো মাটির উপর মারতে হবে। তারপর তুলে নিয়ে তার উপর ফুঁক দিয়ে অতিরিক্ত ধুলোবালি উড়িয়ে দিয়ে উভয় হাত দ্বারা মুখমন্ডল মাসাহ্‌ করতে হবে। এরপর বামহাত দ্বারা ডানহাত কব্জি পর্যন্ত এবং শেষে ডানহাত দ্বারা বাম হাত কব্জি পর্যন্ত মাসাহ্‌ করতে হবে। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৫২৮নং)

তায়াম্মুম কিসে নষ্ট হয়?

যে যে কারণে ওযু নষ্ট হয়, ঠিক সেই সেই কারণে তায়াম্মুমও নষ্ট হয়ে যায়। কারণ তায়াম্মুম হল ওযুর বিকল্প। এ ছাড়া যে অসুবিধার কারণে তায়াম্মুম করা হয়েছিল, সেই অসুবিধা দূর হয়ে গেলেই তায়াম্মুম নষ্ট হয়ে যায়। যেমন পানি না পাওয়ার কারণে তায়াম্মুম করলে পানি পাওয়ার সাথে সাথে তায়াম্মুম শেষ হয়ে যায়। অসুখের কারণে করলে, অসুখ দূর হয়ে যাওয়ার পর পরই আর তায়াম্মুম থাকে না। (ফিকহুস সুন্নাহ্‌ উর্দু ১/৬৩)

তায়াম্মুমের আনুষঙ্গিক মাসায়েল

খোঁজার পর পানি না পাওয়া গেলে আওয়াল অক্তেই তায়াম্মুম করে নামায পড়া উচিৎ। শেষ ওয়াক্ত পর্যন্ত পানির অপেক্ষা করা বা পানি খোঁজা জরুরী নয়। আওয়াল অক্তে নামায পড়ে শেষ অক্তে পানি পাওয়া গেলেও নামায পুনরায় পড়তে হবে না। (সি: সহীহ ৬/২৬৫-২৬৮)

পানি খোঁজাখুঁজি না করেই তায়াম্মুম করে নামায পড়লে এবং পানি তার আশে-পাশে মজুদ থাকলে নামায বাতিল গণ্য হবে। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২২০)

হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, দুই ব্যক্তি সফরে বের হল। নামাযের সময় হলে তাদের নিকট পানি না থাকার কারণে তায়াম্মুম করে উভয়েই নামায পড়ে নিল। অতঃপর ওয়াক্ত শেষ হওয়ার পূর্বেই তারা পানি পেয়ে গেল। ওদের মধ্যে একজন পানি দ্বারা ওযু করে পুনরায় ঐ নামায ফিরিয়ে পড়ল। কিন্তু অপর জন পড়ল না। তারপর তারা আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর নিকট এলে ঘটনা খুলে বলল। তিনি যে নামায ফিরিয়ে পড়েনি তার উদ্দেশ্যে বললেন, “তোমার আমল সুন্নাহর অনুসারী হয়েছে এবং তোমার নামাযও যথেষ্ট (শুদ্ধ) হয়ে গেছে।” আর যে ওযু করে নামায ফিরিয়ে পড়েছিল, তার উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, “তোমার জন্য ডবল সওয়াব।” (আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, দারেমী, সুনান, মিশকাত ৫৩৩নং)

প্রকাশ যে, সুন্নাহ্‌ জানার পর ডবল করে নামায  বৈধ নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ১/৩৪৪)

পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি নামায পড়া অবস্থায় পানি পেয়ে যায়, তাকে নামায ছেড়ে দিয়ে ওযু করে পুনরায় নামায পড়তে হবে। (ফিকহুস সুন্নাহ্‌ উর্দু ১/৬৩, আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ১/৩৪৩)

ওযু ও গোসলের পর যে কাজ করা বৈধ, তায়াম্মুমের পরও সেই কাজ করা বৈধ হয়। যেহেতু তায়াম্মুম ওযু-গোসলের পরিবর্ত। (ঐ)

পানি বা মাটি কিছু না পাওয়া গেলে বিনা ওযু ও তায়াম্মুমেই নামায পড়তে হবে। (বুখারী ৩৩৬নং)

ঘরে থাকলেও খোঁজাখুঁজির পর পানি না পাওয়া গেলে এবং নামাযের সময় অতিবাহিত হওয়ার আশঙ্কা হলে তায়াম্মুম করে নামায পড়তে হবে। (বুখারী, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ১/৫২৫-৫২৬)

পক্ষান্তরে পানি মজুদ থাকলে নামাযের ওয়াক্ত চলে যাওয়ার আশঙ্কা হলেও ওযু-গোসল করে নামায পড়তে হবে। ঐ সময় তায়াম্মুম করে নামায হবে না। (ঐ ১/২১২)

একই তায়াম্মুমে কয়েক ওয়াক্তের নামায পড়া সিদ্ধ। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ১/৩৪০) সিদ্ধ না হওয়ার ব্যাপারে আসার গুলো শুদ্ধ নয়।

মিসওয়াক (দাঁতন) করার গুরুত্ব

প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “আমি উম্মতের জন্য কষ্টকর না জানলে এশার নামাযকে দেরী করে পড়তে এবং প্রত্যেক নামাযের সময় দাঁতন করতে আদেশ দিতাম।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৩৭৬নং)

তিনি আরো বলেন, “আমি আমার উম্মতের পক্ষে কষ্টকর না জানলে (প্রত্যেক) ওযুর সাথে দাঁতন করা ফরয করতাম এবং এশার নামায অর্ধেক রাত পর্যন্ত দেরী করে পড়তাম।” (হাকেম, মুস্তাদরাক, বায়হাকী, সহীহ জামে ৫৩১৯ নং)

তাই সাহাবী যায়েদ বিন খালেদ জুহানী (রাঃ) মসজিদে নামায পড়তেহাজির হতেন, আর তাঁর দাঁতনকে কলমের মত তাঁর কানে গুঁজে রাখতেন। নামাযে দাঁড়াবার সময় তিনি দাঁতন করে পুনরায় কানে গুঁজে নিতেন। (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ৩৯০ নং)

মুসলিমের প্রকৃতিগত কর্মসমূহের একটি হল, মিসওয়াক করে মুখ সাফ করা। (মুসলিম,  মিশকাত ৩৭৯নং)

বিশেষ করে জুমআর দিন গোসল ও দাঁতন করা এবং আতর ব্যবহার করা কর্তব্য। (আহমাদ, মুসনাদ, বুখারী, মুসলিম,  আবূদাঊদ, সুনান, সহীহ জামে ৪১৭৮ নং)

মহানবী (সাঃ) বলেন, “জিবরীল (আহমাদ, মুসনাদ) আমাকে (এত বেশী) দাঁতন করতে আদেশ করেছেন, যাতে আমি আমার দাঁত ঝরে যাওয়ার আশঙ্কা করছি।” (সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১৫৫৬ নং) অন্য এক বর্ণনায় তিনি বলেন, “---এতে আমার ভয় হয় যে, দাঁতন করা আমার উপর ফরয করে দেওয়া হবে।” (সহীহ জামে ১৩৭৬ নং)

বাড়িতে প্রবেশ করা মাত্র তিনি প্রথম যে কাজ করতেন, তা হল দাঁতন। (মুসলিম,  মিশকাত ৩৭৭নং) তাহাজ্জুদ পড়তে উঠলেই তিনি দাঁতন করে দাঁত মাজতেন। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৩৭৮নং) আবার রাত্রের অন্যান্য সময়েও যখন জেগে উঠতেন, তখন মিসওয়াক করতেন। (সহীহ জামে ৪৮৫৩ নং) আর এই জন্যই রাত্রে শোবার সময় শিথানে দাঁতন রেখে নিতেন। (ঐ ৪৮৭২ নং)

তিনি বলেন, “দাঁতন করায় রয়েছে মুখের পবিত্রতা এবং প্রতিপালক আল্লাহর সন্তুষ্টি। (আহমাদ, মুসনাদ, দারেমী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ, বুখারী (বিনা সনদে), মিশকাত ৩৮১নং)

একদা হযরত আলী (রাঃ) দাঁতন আনতে আদেশ করে বললেন, আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেছেন, “বান্দা যখন নামায পড়তে দন্ডায়মান হয় তখন ফিরিশ্‌তা তার পিছনে দন্ডায়মান হয়ে তার ক্বিরাআত শুনতে থাকেন। ফিরিশ্‌তা তার নিকটবর্তী হন; (অথবা বর্ণনাকারী অনুরুপ কিছু বললেন।) পরিশেষে তিনি নিজ মুখ তার (বান্দার) মুখে মিলিয়ে দেন! ফলে তার মুখ হতে কুরআনের যেটুকুই অংশ বের হয় সেটুকু অংশই ফিরিশ্‌তার পেটে প্রবেশ করে যায়। সুতরাং কুরআনের জন্য তোমরা তোমাদের মুখকে পবিত্র কর।” (বাযযার, সহিহ তারগিব২১০নং)

তিনি বলেন, “মিসওয়াক করে তোমরা তোমাদের মুখকে পবিত্র কর। কারণ, মুখ হল কুরআনের পথ।” (বাযয়ীফ, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১২১৩ নং)

হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘নবী (সাঃ) মিসওয়াক করে আমাকে তা ধুতে দিতেন। কিন্তু ধোয়ার আগে আমি মিসওয়াক করে নিতাম। তারপর তা ধুয়ে তাঁকে দিতাম।’ (আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ৩৮৪নং)

তাঁর নিকট মিসওয়াকের এত গুরুত্ব ছিল যে, তিরোধানের পূর্ব মুহূর্তেও তিনি হযরত আয়েশার দাঁতে চিবিয়ে নরম করে নিজে দাঁতন করেছেন। (বুখারী, মিশকাত ৫৯৫৯ নং)

তিনি আরাক (পিল্লু) গাছের (ডাল বা শিকড়ের) দাঁতন করতেন। (আহমাদ, মুসনাদ, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ১/১০৪)

আঙ্গুল দ্বারা দাঁত মাজা যায়। তবে এটা সুন্নত কি না বা এতেও ঐ সওয়াব অর্জন হবে কি না, সে ব্যাপারে কোন সহীহ হাদীস মিলে না। হাফেয ইবনে হাজার (রহঃ) তালখীসে (১/৭০) এ সম্পর্কে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করার পর বলেন, ‘এগুলির চেয়ে মুসনাদে আহ্‌মাদে আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসটি অধিকতর সহীহ।’ কিন্তু সে হাদীসটিরও সনদ যয়ীফ। (মুসনাদে আহমাদ, তাহক্বীক্ব আহমাদ শাকের ১৩৫৫ নং)

লেবাস / পোশাক

নামাযীর লেবাস
আল্লাহ তাআলা বলেন,

“হে মানব জাতি! তোমাদের লজ্জাস্থান ঢাকার ও বেশভূষার জন্য আমি তোমাদেরকে লেবাস দিয়েছি। পরন্তু ‘তাকওয়া’র লেবাসই সর্বোৎকৃষ্ট  (কুরআন মাজীদ ৭/২৬)

“হে আদম সন্তানগণ! প্রত্যেক নামাযের সময় তোমরা সুন্দর পরিচ্ছদ পরিধান কর। পানাহার কর, কিন্তু অপচয় করো না। তিনি অপব্যয়ীদের পছন্দ করেন না।” (কুরআন মাজীদ ৭/৩১)

শরীয়তের সভ্য-দৃষ্টিতে সাধারণভাবে লেবাসের কতকগুলি শর্ত ও আদব রয়েছে; যা পালন করতে মুসলিম বাধ্য।

মহিলাদের লেবাসের শর্তাবলী নিম্নরুপ:-

১। লেবাস যেন দেহের সর্বাঙ্গকে ঢেকে রাখে। দেহের কোন অঙ্গ বা সৌন্দর্য যেন কোন বেগানা (যার সাথে কোনও সময়ে বিবাহ্‌ বৈধ এমন) পুরুষের সামনে প্রকাশ না পায়। কেন না মহানবী (সাঃ) বলেন, “মেয়ে মানুষের সবটাই লজ্জাস্থান (গোপনীয়)। আর সে যখন বের হয়, তখন শয়তান তাকে পুরুষের দৃষ্টিতে পরিশোভিতা করে তোলে।” (তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ৩১০৯ নং)

মহান আল্লাহ বলেন, “হে নবী! তুমি তোমার পত্নীগণকে, কন্যাগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলে দাও, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের (চেহারার) উপর টেনে নেয়---।” (কুরআন মাজীদ ৩৩/৫৯)

হযরত উম্মে সালামাহ্‌ (রাঃ) বলেন, ‘উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হলে (মদ্বীনার) আনসারদের মহিলারা যখন বের হল, তখন তাদের মাথায় (কালো) চাদর (বা মোটা উড়না) দেখে মনে হচ্ছিল যেন ওদের মাথায় কালো কাকের ঝাঁক বসে আছে!’ (আবূদাঊদ, সুনান ৪১০১ নং)

আল্লাহ তাআলার আদেশ, মুমিন মেয়েরা যেন তাদের ঘাড় ও বুককে মাথার কাপড় দ্বারা ঢেকে নেয়---। (কুরআন মাজীদ ২৪/৩১)

হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘পূর্বের মুহাজির মহিলাদের প্রতি আল্লাহ রহ্‌ম করেন। উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হলে তারা তাদের পরিধেয় কাপড়সমূহের মধ্যে সবচেয়ে মোটা কাপড়টিকে ফেড়ে মাথার উড়না বানিয়ে মাথা (ঘাড়-গলা-বুক) ঢেকেছিল।’ (আবূদাঊদ, সুনান ৪১০২)

সাহাবাদের মহিলাগণ যখন পথে চলতেন, তখন তাঁদের নিম্নাঙ্গের কাপড়ের শেষ প্রান্ত মাটির উপর ছেঁচড়ে যেত। নাপাক জায়গাতে চলার সময়েও তাদের কেউই পায়ের পাতা বের করতেন না। (মিশকাত ৫০৪, ৫১২, ৪৩৩৫ নং)

সুতরাং মাথা ও পায়ের মধ্যবর্তী কোন অঙ্গ যে প্রকাশ করাই যাবে না, তা অনুমেয়।

২। যে লেবাস মহিলা পরিধান করবে সেটাই যেন (বেগানা পুরুষের সামনে) সৌন্দর্যময় ও দৃষ্টি-আকর্ষী না হয়। যেহেতু মহান আল্লাহ বলেন, “সাধারণত: যা প্রকাশ হয়ে থাকে তা ছাড়া তারা যেন তাদের অন্যান্য সৌন্দর্য প্রকাশ না করে।” (কুরআন মাজীদ ২৪/৩১)

৩। লেবাস যেন এমন পাতলা না হয়, যাতে কাপড়ের উপর থেকেও ভিতরের চামড়া নজরে আসে। নচেৎ ঢাকা থাকলেও খোলার পর্যায়ভুক্ত। এ ব্যাপারে এক হাদীসে আল্লাহর রসূল (সাঃ) হযরত আসমা (রাঃ) কে সতর্ক করেছিলেন। (আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ৪৩৭২ নং)

একদা হাফসা বিন্তে আব্দুর রহ্‌মান পাতলা ওড়না পরে হযরত আয়েশা (রাঃ) এর নিকট গেলে তিনি তার উড়নাকে ছিঁড়ে ফেলে দিলেন এবং তাকে একটি মোটা ওড়না পরতে দিলেন। (মালেক, মুঅত্তা, মিশকাত ৪৩৭৫ নং)

মহানবী (সাঃ) বলেন, “দুই শ্রেণীর মানুষ দোযখবাসী; যাদেরকে আমি (এখনো) দেখিনি। ---(এদের মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ সেই) মহিলাদল, যারা কাপড় পরেও উলঙ্গ থাকবে, অপর পুরুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করবে এবং নিজেও তার দিকে আকৃষ্ট হবে, যাদের মাথা (চুলের খোঁপা) হিলে থাকা উটের কুঁজের মত হবে। তারা বেহেশ্তে প্রবেশ করবে না। আর তার সুগন্ধও পাবে না; অথচ তার সুগন্ধ এত এত দূরবর্তী স্থান থেকেও পাওয়া যাবে।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম,  সহীহ জামে ৩৭৯৯ নং)

৪। পোশাক যেন এমন আঁট- সাঁ ট (টাইট ফিট) না হয়, যাতে দেহের উঁচু-নিচু ব্যক্ত হয়। কারণ এমন ঢাকাও খোলার পর্যায়ভুক্ত এবং দৃষ্টি-আকর্ষী ।

৫। যেন সুগন্ধিত না হয়। মহানবী (সাঃ) বলেন, “সেন্ট বিলাবার উদ্দেশ্যে কোন মহিলা যদি তা ব্যবহার করে পুরুষদের সামনে যায়, তবে সে বেশ্যা মেয়ে।” (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ১০৬৫ নং)

সেন্ট ব্যবহার করে মহিলা মসজিদেও যেতে পারে না। একদা চাশতের সময় আবূ হুরাইরা (রাঃ) মসজিদ থেকে বের হলেন। দেখলেন, একটি মহিলা মসজিদ প্রবেশে উদ্যত। তার দেহ্‌ বা লেবাস থেকে উৎকৃষ্ট  সুগন্ধির সুবাস ছড়াচ্ছিল। আবূ হুরাইরা মহিলাটির উদ্দেশে বললেন, ‘আলাইকিস সালাম।’ মহিলাটি সালামের উত্তর দিল। তিনি তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘কোথায় যাবে তুমি?’ সে বলল, ‘মসজিদে।’ বললেন, ‘কি জন্য এমন সুন্দর সুগন্ধি মেখেছ তুমি?’ বলল, ‘মসজিদের জন্য।’ বললেন, ‘আল্লাহর কসম?’ বলল, ‘আল্লাহর কসম।’ পুনরায় বললেন, ‘আল্লাহর কসম?’ বলল, ‘আল্লাহর কসম।’ তখন তিনি বললেন, ‘তবে শোন, আমাকে আমার প্রিয়তম আবুল কাসেম (সাঃ) বলেছেন যে, “সেই মহিলার কোন নামায কবুল হয় না,  যে তার স্বামী ছাড়া অন্য কারোর জন্য সুগন্ধি ব্যবহার করে; যতক্ষণ না সে নাপাকীর গোসল করার মত গোসল করে নেয়।” অতএব তুমি ফিরে যাও, গোসল করে সুগন্ধি ধুয়ে ফেল। তারপর ফিরে এসে নামায পড়ো।’ (আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, বায়হাকী, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১০৩১ নং)

৬। লেবাস যেন কোন কাফের মহিলার অনুকৃত না হয়। প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি যে জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন (লেবাসে- পোশাকে, চাল-চলনে অনুকরণ) করবে সে তাদেরই দলভুক্ত।” (আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ৪৩৪৭ নং)

৭। তা যেন পুরুষদের লেবাসের অনুরুপ না হয়। মহানবী (সাঃ) সেই নারীদেরকে অভিশাপ দিয়েছেন, যারা পুরুষদের বেশ ধারণ করে এবং সেই পুরুষদেরকেও অভিশাপ দিয়েছেন, যারা নারীদের বেশ ধারণ করে।” (আবূদাঊদ, সুনান ৪০৯৭, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ১৯০৪ নং)

তিনি সেই পুরুষকে অভিশাপ দিয়েছেন, যে মহিলার মত লেবাস পরে এবং সেই মহিলাকেও অভিশাপ দিয়েছেন, যে পুরুষের মত লেবাস পরে। (আবূদাঊদ, সুনান ৪০৯৮, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ১৯০৩ নং)

৮। লেবাস যেন জাঁকজমকপূর্ণ প্রসিদ্ধিজনক না হয়। কারণ, বিরল ধরনের লেবাস পরলে সাধারণত: পরিধানকারীর মনে গর্ব সৃষ্টি হয় এবং দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাই মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি দুনিয়াতে প্রসিদ্ধিজনক লেবাস পরবে, আল্লাহ তাকে কিয়ামতে লাঞ্ছনার লেবাস পরাবেন।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, মিশকাত ৪৩৪৬ নং)

“যে ব্যক্তি জাঁকজমকপূর্ণ লেবাস পরবে, আল্লাহ তাকে কিয়ামতে অনুরুপ লেবাস পরিয়ে তা অগ্নিদগ্ধ করবেন।” (আবূদাঊদ, সুনান, বায়হাকী, সহীহ জামে ৬৫২৬ নং)

আর পুরুষদের লেবাসের শর্তাবলী নিম্নরুপ:-

১। লেবাস যেন নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত অংশ অবশ্যই আবৃত রাখে। যেহেতু ঐটুকু অঙ্গ পুরুষের লজ্জাস্থান। (সহীহ জামে ৫৫৮৩ নং)

২। এমন পাতলা না হয়, যাতে ভিতরের চামড়া নজরে আসে।

৩। এমন আঁট-সাট না হয়, যাতে দেহের উঁচু-নিচু ব্যক্ত হয়।

৪। কাফেরদের লেবাসের অনুকৃত না হয়।

৫। মহিলাদের লেবাসের অনুরুপ না হয়।

৬। জাঁকজমকপূর্ণ প্রসিদ্ধিজনক না হয়।

৭। গাঢ় হ্‌লুদ বা জাফরানী রঙের যেন না হয়। আম্‌র বিন আস (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রসূল (সাঃ) একদা আমার গায়ে দু’টি জাফরানী রঙের কাপড় দেখে বললেন, “এগুলো কাফেরদের কাপড়। সুতরাং তুমি তা পরো না।” (মুসলিম,  মিশকাত ৪৩২৭ নং)

৮। লেবাস যেন রেশমী কাপড়ের না হয়। মহানবী (সাঃ) বলেন, “সোনা ও রেশম আমার উম্মতের মহিলাদের জন্য হালাল এবং পুরুষদের জন্য হারাম করা হয়েছে।” (তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ৪৩৪১ নং) “দুনিয়ায় রেশম-বস্তু তারাই পরবে, যাদের পরকালে কোন অংশ নেই।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৪৩২০ নং)

হযরত উমার (রাঃ) বলেন, রসূল (সাঃ) রেশমের কাপড় পরতে নিষেধ করেছেন। তবে দুই, তিন অথবা চার আঙ্গুল পরিমাণ (অন্য কাপড়ের সঙ্গে জুড়ে) ব্যবহার করতে অনুমতি দিয়েছেন। (মুসলিম,  মিশকাত ৪৩২৪ নং) তদনুরুপ কোন চর্মরোগ প্রভৃতিতে উপকারী হলে তা ব্যবহারে অনুমতি আছে। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৪৩২৬ নং)

৯। পরিহিত লেবাস (পায়জামা, প্যান্ট, লুঙ্গি, কামীস প্রভৃতি) যেন পায়ের গাঁটের নিচে না যায়। মহানবী (সাঃ) বলেন, “গাঁটের নিচের অংশ লুঙ্গি জাহান্নামে।” (বুখারী, মিশকাত ৪৩১৪ নং) “মু’মিনের লুঙ্গি পায়ের অর্ধেক রলা পর্যন্ত। এই (অর্ধেক রলা) থেকে গাঁট পর্যন্ত অংশের যে কোনও জায়গায় হলে ক্ষতি নেই। কিন্তু এর নিচের অংশ দোযখে যাবে।” এরুপ ৩ বার বলে তিনি পুনরায় বললেন, “আর কিয়ামতের দিন আল্লাহ সেই ব্যক্তির প্রতি তাকিয়েও দেখবেন না, যে অহংকারের সাথে নিজের লুঙ্গি (গাঁটের নিচে) ছেঁচড়ে নিয়ে বেড়ায়।”(আবূদাঊদ, সুনান,ইবনে মাজাহ্‌, সুনান,মিশকাত ৪৩৩১)

আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর সবচেয়ে বেশী পছন্দনীয় লেবাস ছিল কামীস (ফুল-হাতা প্রায় গাঁটের উপর পর্যন্ত লম্বা জামা বিশেষ)। (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ৪৩২৮ নং)  যেমন তিনি চেক-কাটা চাদর পরতে ভালোবাসতেন। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৪৩০৪ নং)

তিনি মাথায় ব্যবহার করতেন পাগড়ী। (তিরমিযী, সুনান, সহীহ জামে ৪৬৭৬ নং) তিনি কালো রঙের পাগড়ীও বাঁধতেন। (আবূদাঊদ, সুনান, ৪০৭৭, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ৩৫৮৪ নং)

আল্লাহর রসূল (সাঃ) ও সাহাবা তথা সলফদের যুগে টুপীও প্রচলিত ছিল। (বুখারী, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ১/৫৮৭, ৩/৮৬, মুসলিম, সহীহ ৯২৫, আবূদাঊদ, সুনান ৬৯১ নং)

যেমন সে যুগে শেলোয়ার বা পায়জামাও পরিচিত ছিল। মহানবী (সাঃ) ও পায়জামা খরিদ করেছিলেন। (ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ২২২০, ২২২১ নং) তিনি ইহ্‌রাম বাঁধা অবস্থায় হাজীদেরকে পায়জামা পরতে নিষেধ করেছেন। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ২৬৭৮ নং) অবশ্য লুঙ্গি না পাওয়া গেলে পায়জামা পরতে অনুমতি দিয়েছেন। (ঐ ২৬৭৯ নং)

ইবনে আব্বাস (রাঃ) যখন লুঙ্গি পরতেন, তখন লুঙ্গির সামনের দিকের নিচের অংশ পায়ের পাতার উপর ঝুলিয়ে দিতেন এবং পেছন দিকটা (গাঁটের) উপরে তুলে নিতেন। এরুপ পরার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, ‘আমি আল্লাহর রসূল (সাঃ) কে এরুপ পরতে দেখেছি।’ (আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ৪৩৭০ নং)

তাঁর নিকট পোশাকের সবচেয়ে পছন্দনীয় রঙ ছিল সাদা। তিনি বলেন, “তোমরা সাদা কাপড় পরিধান কর। কারণ সাদা রঙের কাপড় বেশী পবিত্র থাকে। আর ঐ রঙের কাপড়েই তোমাদের মাইয়্যেতকে কাফনাও।” (আহমাদ, মুসনাদ, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, মিশকাত ৪৩৩৭ নং)

এ ছাড়া সবুজ রঙের কাপড়ও তিনি ব্যবহার করতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৪০৬৫ নং) এবং লাল রঙেরও লেবাস পরিধান করতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৪০৭২, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ৩৫৯৯, ৩৬০০ নং)

মুহাদ্দেস আলবানী হাফেযাহুল্লাহ্‌ বলেন, ‘লাল রঙের কাপড় ব্যবহার নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে কোন হাদীস সহীহ নয়।’ (মিশকাতের টীকা ২/১২৪৭)

লেবাসে-পোশাকে সাদা-সিধে থাকা ঈমানের পরিচায়ক। (আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ৪৩৪৫ নং) মহানবী (সাঃ) বলেন, “সামথ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি বিনয় সহকারে সৌন্দর্যময় কাপড় পরা ত্যাগ করবে, আল্লাহ তাআলা তাকে কিয়ামতে সৃষ্টির সামনে ডেকে এখতিয়ার দেবেন; ঈমানের লেবাসের মধ্যে তার যেটা ইচ্ছা সেটাই পরতে পারবে। (তিরমিযী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, সহীহ জামে ৬১৪৫ নং)

তবে সুন্দর লেবাস পরা যে নিষিদ্ধ তা নয়। কারণ, “আল্লাহ সুন্দর। তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন। বান্দাকে তিনি যে নেয়ামত দান করেছেন তার চিহ্ন (তার দেহে) দেখতে পছন্দ করেন। আর তিনি দারিদ্র ও (লোকচক্ষে) দরিদ্র সাজাকে ঘৃণা করেন।” (বায়হাকী, সহীহ জামে ১৭৪২ নং)

প্রিয় রসূল (সাঃ) বলেন, “যার অন্তরে অণূ পরিমাণও অহংকার থাকবে, সে জান্নাত প্রবেশ করবে না।” বলা হল, ‘লোকে তো চায় যে, তার পোশাকটা সুন্দর হোক, তার জুতোটা সুন্দর হোক। (তাহলে সেটাও কি ঐ পর্যায়ে পড়বে?)’ তিনি বললেন, “আল্লাহ সুন্দর। তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন। অহংকার তো ‘হ্‌ক’ (ন্যায় ও সত্য) প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে ঘৃণা করার নাম।” (মুসলিম,  সহীহ জামে ৭৬৭৪ নং)

তিনি আরো বলেন, “উত্তম আদর্শ, উত্তম বেশভূষা এবং মিতাচারিতা নবুওতের ২৫ অংশের অন্যতম অংশ।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, সহীহ জামে ১৯৯৩ নং)

আল্লাহর রসূল (সাঃ) এক ব্যক্তির মাথায় আলুথালু চুল দেখে বললেন, “এর কি এমন কিছুও নেই, যার দ্বারা মাথার এলোমেলো চুলগুলোকে সোজা করে (আঁচড়ে) নেয়?!” আর এক ব্যক্তির পরনে ময়লা কাপড় দেখে বললেন, “এর কি এমন কিছুও নেই, যার দ্বারা ময়লা কাপড়কে পরিষ্কার করে নেয়?!” (আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ৪৩৫১ নং)

আবুল আহওয়াস বলেন, একদা আমি আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর নিকট এলাম। আমার পরনে ছিল নেহাতই নিম্নমানের কাপড়। তিনি তা দেখে আমাকে বললেন, “তোমার কি মাল-ধন আছে?” আমি বললাম, ‘জী হ্যাঁ।’ বললেন, “কোন্‌ শ্রেণীর মাল আছে?” আমি বললাম, ‘সকল শ্রেণীরই মাল আমার নিকট মজুদ। আল্লাহ আমাকে উট, গরু, ছাগল, ভেঁড়া, ঘোড়া ও ক্রীতদাস দান করেছেন।’ তিনি বললেন, “আল্লাহ যখন তোমাকে এত মাল দান করেছেন, তখন আল্লাহর দেওয়া নেয়ামত ও অনুগ্রহ তোমার বেশ-ভূষায় প্রকাশ পাওয়া উচিৎ।” (আহমাদ, মুসনাদ, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ৪৩৫২ নং)

মহানবী (সাঃ) বলেছেন, “তোমরা খাও, পান কর, দান কর, পরিধান কর, তবে তাতে যেন অপচয় ও অহংকার না থাকে।” (বুখারী, আহমাদ ৬৬৯৫, নাসাঈ ২৫৫৯নং)

ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, “যা ইচ্ছা তাই খাও এবং যেমন ইচ্ছা তেমনিই পর, তবে তাতে যেন দু’টি জিনিস না থাকে; অপচয় ও অহংকার।” (বুখারী, মিশকাত ৪৩৮০নং)

নামাযের ভিতরে বিশেষ লেবাস

একটাই কাপড়ে পুরুষের নামায শুদ্ধ, তবে তাতে কাঁধ ঢাকতে হবে। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৭৫৪-৭৫৬ নং) আর খেয়াল রাখতে হবে, যেন শরমগাহ্‌ প্রকাশ না পেয়ে যায়। (ঐ মিশকাত ৪৩১৫ নং) তওয়াফে কুদূম (হজ্জ ও উমরায় সর্বপ্রথম তওয়াফ) ছাড়া অন্য সময় ইহ্‌রাম অবস্থায় ডান কাঁধ বের করে রাখা বিধেয় নয়। বলা বাহুল্য নামাযের সময় উভয় কাঁধ ঢাকা জরুরী।

এক ব্যক্তি হযরত উমার (রাঃ) কে এক কাপড়ে নামায পড়ার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, ‘আল্লাহ আধিক্য দান করলে তোমরাও অধিক ব্যবহার কর।’ অর্থাৎ বেশী কাপড় থাকলে বেশী ব্যবহার করাই উত্তম। (বুখারী ৩৬৫ নং)

দরবার আল্লাহর। তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন। তাই নামাযীর উচিৎ, যথাসাধ্য সৌন্দর্য অবলম্বন করে তাঁর দরবারে হাজির হওয়া। মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের কেউ যখন নামায পড়ে, তখন তাকে দু’টি কাপড় পরা উচিৎ। কারণ, আল্লাহ অধিকতম হ্‌কদার যে, তাঁর জন্য সাজসজ্জা গ্রহণ করা হবে।” (সহীহ জামে ৬৫২ নং)

পক্ষান্তরে নামাযের জন্য এমন নকশাদার কাপড় হওয়া উচিৎ নয়, যাতে নামাযীর মন বা একাগ্রতা চুরি করে নেয়। একদা মহানবী (সাঃ) নকশাদার কোন কাপড়ে নামায পড়ার পর বললেন, “এটি ফেরৎ দিয়ে ‘আম্বাজানী’ (নকশাবিহীন) কাপড় নিয়ে এস। কারণ, এটি আমাকে আমার নামায থেকে উদাস করে ফেলেছিল।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৭৫৭ নং)

নামাযীর নামাযের এমন লেবাস হওয়া উচিৎ নয়, যাতে কোন (বিচরণশীল) প্রাণীর ছবি থাকে। কারণ, এতেও নামাযীর মনোযোগ ছিনিয়ে নেয়। হযরত আয়েশা (রাঃ) এর কক্ষের এক প্রান্তে একটি ছবিযুক্ত রঙিন পর্দা টাঙ্গানো ছিল। একদা মহানবী (সাঃ) বললেন, “তোমার এই পর্দা আমাদের নিকট থেকে সরিয়ে নাও। কারণ, ওর ছবিগুলো আমার নামাযে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে।” (বুখারী ৩৭৪ নং)

তিনি বলেন, “যে ঘরে কুকুর অথবা ছবি (বা মূর্তি) থাকে, সে ঘরে ফিরিশ্‌তা প্রবেশ করেন না।” (ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ, তিরমিযী, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ, সহীহ জামে ১৯৬১, ১৯৬৩ নং)

অতএব নামাযের বাইরেও এ ধরনের ছবিযুক্ত লেবাস মুসলিমের জন্য বৈধ নয়। কারণ, ইসলাম ছবি ও মূর্তির ঘোর বিরোধী।

যে কাপড়ে অমুসলিমদের কোন ধর্মীয় প্রতীক (যেমন ক্রুশ, শঙ্খ প্রভৃতি) থাকে, সে কাপড় (ও অলঙ্কার) ব্যবহার বৈধ নয়। মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘নবী (সাঃ) বাড়িতে কোন জিনিসে ক্রুশ দেখলেই তা কেটে ফেলতেন।’ (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ৪১৫১ নং)

জুতো পবিত্র হলে, তা পায়ে রেখেই নামায পড়া বৈধ। মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমরা ইয়াহুদীদের বিপরীত কর। (এবং জুতো ও মোজা পায়ে নামায পড়।) কারণ, ওরা ওদের জুতো ও মোজা পায়ে রেখে নামায পড়ে না।” (আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ৭৬৫নং)

আল্লাহর রসূল (সাঃ) নিষেধ করেছেন, যেন কেউ বাম হাতে না খায়, কেউ যেন এক পায়ে জুতো রেখে না চলে, কেউ যেন এমনভাবে একটি মাত্র কাপড় দ্বারা নিজেকে জড়িয়ে না নেয়, যাতে তার হাত বের করার পথ থাকে না এবং কেউ যেন একটাই কাপড় পরে, পাছার উপর ভর করে, পায়ের রলা ও হাঁটু দু’টিকে খাড়া করে পেটে লাগিয়ে, হাত দু’টিকে পায়ে জড়িয়ে, লজ্জাস্থান খুলে না বসে। (মুসলিম,  মিশকাত ৪৩১৫ নং)

লুঙ্গির ভিতরে কিছু না পরে থাকলে এবং অনুরুপ বসলেও লজ্জাস্থান প্রকাশ পাওয়ার ভয় থাকে। যেমন মহিলাদের শাড়ি-সায়াতেও ঐ একই অবস্থা হতে পারে। অতএব ঐ সব কাপড়ে ঐরুপ বসা বৈধ নয়।

মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি নামাযে তার লুঙ্গিকে অহংকারের সাথে গাঁটের নিচে ঝুলিয়ে রাখে, তার এ কাজ হালাল নয় এবং আল্লাহর নিকট তার কোন সম্মান নেই।” (আবূদাঊদ, সুনান, সহীহ জামে ৬০১২ নং)

প্রকাশ যে, গাঁটের নিচে কাপড় ঝুলিয়ে নামায পড়লে নামায কবুল হয় না -এ ব্যাপারে বর্ণিত হাদীসটি সহীহ নয়। (যয়ীফ আবূদাঊদ, সুনান ১২৪, ৮৮৪ নং)

নাপাকীর সন্দেহ্‌ না থাকলে প্রয়োজনে মহিলাদের শাল, চাদর, বা শাড়ি গায়ে দিয়ে পুরুষরা নামায পড়তে পারে।

প্রয়োজনে একই কাপড়ের অর্ধেকটা (ঋতুমতী হলেও) স্ত্রীর গায়ে এবং পুরুষ তার অর্ধেকটা গায়ে দিয়ে নামায পড়তে পারে। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাঃ) রাত্রে নামায পড়তেন। আমি মাসিক অবস্থায় তাঁর পাশে থাকতাম। আর আমার একটি কাপড় আমার গায়ে এবং কিছু তাঁর গায়ে থাকত।’ (আবূদাঊদ, সুনান ৩৭০ নং)

যে কাপড় পরে থাকা অবস্থায় মেয়েদের মাসিক হয়, সেই কাপড়ে মাসিক লেগে থাকার সন্দেহ্‌ না থাকলে পবিত্রতার গোসলের পর না ধুয়েও ঐ কাপড়েই তাদের নামায পড়া বৈধ। মাসিক লাগলেও যে স্থানে লেগেছে কেবল সেই স্থান ধুয়ে খুনের দাগ না গেলেও তাতেই নামায পড়া বৈধ ও শুদ্ধ হবে। (আবূদাঊদ, সুনান ৩৬৫নং)

কেবল দুধ পান করে এমন শিশুপুত্র যদি কাপড়ে পেশাব করে দেয়, তাহলে তার উপর পানির ছিটা মেরে এবং না ধুয়ে তাতেই নামায হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে যদি শিশুকন্যার পেশাব হয় অথবা দুধ ছাড়া অন্য খাবারও খায় এমন শিশু হয়, তাহলে তার পেশাব কাপড় থেকে ধুয়ে ফেলতে হবে। নচেৎ নামায হবে না। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৪৯৭, ৫০২, আবূদাঊদ, সুনান ৩৭৭-৩৭৯ নং)

কাপড়ের পেশাব রোদে শুকিয়ে গেলেও তাতে নামায হয় না। কাপড় থেকে পেশাব পানি দিয়ে ধোয়া জরুরী। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/১৯৮)

যে কাপড় পরে স্বামী-স্ত্রীর মিলন হয় সেই কাপড়েও নামায শুদ্ধ। অবশ্য নাপাকী লাগলে বা লাগার সন্দেহ্‌ হলে নয়। (আবূদাঊদ, সুনান ৩৬৬নং)

টাইট-ফিট প্যান্ট ও শার্ট এবং চুস্ত পায়জামা ও খাটো পাঞ্জাবী পরে নামায মাকরুহ। টাইট হওয়ার কারণে নামাযে একাগ্রতা ভঙ্গ হয়। তাছাড়া কাপড়ের উপর থেকে (বিশেষ করে পিছন থেকে) শরমগাহের উঁচু-নীচু অংশ ও আকার বোঝা যায়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৫/৭৫)

মহিলাদের লেবাসে চুল, পেট, পিঠ,হাতের কব্জির উপরি ভাগের অঙ্গ (কনুই, বাহু প্রভৃতি) বের হয়ে থাকলে নামায হয় না। কেবল চেহারা ও কব্জি পর্যন্তহাত বের হয়ে থাকবে। পায়ের পাতাও ঢেকে নেওয়া কর্তব্য। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৬/১৩৮, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৮৮, কিদারেমী, সুনান ৯৪পৃ:)  অবশ্য সামনে কোন বেগানা পুরুষ থাকলে চেহারাও ঢেকে নিতে হবে।

ঘর অন্ধকার হলেও বা একা থাকলেও নামায পড়তে পড়তে ঢাকা ফরয এমন কোন অঙ্গ প্রকাশ পেয়ে গেলে নামায বাতিল হয়ে যাবে। সেই নামায পুনরায় ফিরিয়ে পড়তে হবে। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৮৫)

প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “কোন সাবালিকা মেয়ের মাথায় চাদর ছাড়া তার নামায কবুল হয় না।” (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ৭৬২নং)

পুরুষের দেহের ঊর্ধ্বাংশের কাপড় (চাদর বা গামছা) সংকীর্ণ হলে মাথা ঢাকতে গিয়ে যেন পেট-পিঠ বাহির না হয়ে যায়। প্রকাশ যে, নামাযে পুরুষের জন্য মাথা ঢাকা জরুরী নয়। সৌন্দর্যের জন্য টুপী, পাগড়ী বা মাথার রুমাল মাথায় ব্যবহার করা উত্তম। আর এ কথা বিদিত যে, আল্লাহর নবী (সাঃ) ও তাঁর সাহাবাগণ কখনো কখনো এক কাপড়েও নামায পড়েছেন। তাছাড়া কতক সলফ সুতরার জন্য কিছু না পেলে মাথার টুপী খুলে সামনে রেখে সুতরা বানাতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৯১নং)

প্রকাশ যে, পরিশ্রম ও মেহনতের কাজের ঘর্ম সিক্ত, কাদা বা ধুলোমাখা দুর্গন্ধময় লেবাসে মহান বাদশা আল্লাহর দরবার মসজিদে আসা উচিৎ নয়। কারণ, তাতে আল্লাহর উপস্থিত ফিরিশ্‌তা তথা মুসল্লীগণ কষ্ট পাবেন। আর এই জন্যই তো কাঁচা পিঁয়াজ-রসুন খেয়ে মসজিদে আসতে নিষেধ করা হয়েছে।

নামাযের ওয়াক্ত

নামাযের ওয়াক্তসমূহ

ফরয নামায শুদ্ধ হওয়ার জন্য এক শর্ত হল, তা যথা সময়ে আদায় করা। নির্দিষ্ট সময় ছাড়া ভিন্ন সময়ে নামায হয় না। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,

إنَّ الصَّلاَةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِيْنَ كِتَاباً مَّوْقُوْتاً

অর্থাৎ, নির্ধারিত সময়ে যথাযথভাবে নামায পড়া মু’মিনদের কর্তব্য। (কুরআন মাজীদ ৪/১০৩)

কুরআন মাজীদে কতিপয় আয়াতে নামাযের ৫টি ওয়াক্তের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে; যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, “আর নামায কায়েম কর দিনের দু’ প্রান্তভাগে (অর্থাৎ ফজর ও মাগরেবের সময়) ও রাতের প্রথমাংশে (অর্থাৎ এশার সময়)। (কুরআন মাজীদ ১১/১১৪)

“সূর্য ঢলে যাওয়ার পর হতে রাতের ঘন অন্ধকার পর্যন্ত (অর্থাৎ যোহ্‌র, আসর, মাগরেব ও এশার) নামায কায়েম কর, আর কায়েম কর ফজরের নামায।” (কুরআন মাজীদ ১৭/৭৮)

“আর সূর্যোদয়ের পূর্বে (ফজরে) ও সূর্যাস্তের পূর্বে (আসরে) তোমার প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর এবং পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর রাত্রির কিছু সময়ে (এশায়) এবং দিনের প্রান্তভাগগুলিতে (ফজর, যোহ্‌র ও মাগরেবে), যাতে তুমি সন্তুষ্ট হতে পার।” (কুরআন মাজীদ ২০/১৩০)

পাঁচ ওয়াক্তকে নির্দিষ্ট করতে আল্লাহর তরফ হতে স্বয়ং জিবরীল (আহমাদ, মুসনাদ) এসে ইমাম হয়ে রসূল (সাঃ)কে সঙ্গে নিয়ে নামায পড়েন। নবী (সাঃ) বলেন, “কা’বাগৃহের নিকট জিবরীল (আহমাদ, মুসনাদ) আমার দু’বার ইমামতি করেন; প্রথমবারে তিনি আমাকে নিয়ে যোহরের নামায তখন পড়লেন, যখন সূর্যঢলে গিয়ে তার ছায়া জুতোর ফিতের মত (সামান্য) হয়েছিল। অতঃপর তিনি আমাকে নিয়ে আসরের নামায পড়লেন যখন প্রত্যেক বস্তুর ছায়া তার সমপরিমাণ হয়েছিল। অতঃপর আমাকে নিয়ে মাগরেবের নামায পড়লেন তখন, যখন রোযাদার ইফতার করে ফেলেছিল। (অর্থাৎ সূর্যাস্তের সাথে সাথে।) অতঃপর এশার নামায তখন পড়লেন, যখন (সূর্যাস্তের পর পশ্চিম আকাশের অস্তরাগ) লাল আভা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। আর আমাকে নিয়ে ফজরের নামায তখন পড়লেন, যখন রোযাদারের জন্য পানাহার হারাম হয়ে গিয়েছিল।

দ্বিতীয় দিনে তিনি আমাকে নিয়ে যোহরের নামায তখন পড়লেন যখন প্রত্যেক বস্তুর ছায়া তার সমপরিমাণ হয়েছিল। আসরের নামাযে আমার ইমামতি তখন করলেন, যখন প্রত্যেক বস্তুর ছায়া তার দ্বিগুণ হয়েছিল। অতঃপর আমাকে নিয়ে মাগরেবের নামায তখন পড়লেন, যখন রোযাদার ইফতার করে ফেলেছিল। অতঃপর রাতের এক তৃতীয়াংশ গত হলে তিনি এশার নামায পড়লেন। আর আমাকে নিয়ে ফজরের নামায তখন পড়লেন, যখন (ভোর) ফর্সা হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর তিনি আমার প্রতি লক্ষ্য করে বললেন, ‘হে মুহাম্মাদ! এ হল আপনার পূর্বে সকল নবীগণের ওয়াক্ত। আর এই দুই ওয়াক্তের মধ্যবর্তী ওয়াক্তই হল নামাযের ওয়াক্ত।’ (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ৫৮৩নং)

শেষ অক্তে নামায যদিও শুদ্ধ, তবুও প্রথম (আওয়াল) অক্তে নামায পড়া হল শ্রেষ্ঠ আমল। আল্লাহর রসূল (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করা হল,  ‘কোন আমল সর্বশ্রেষ্ঠ?’ উত্তরে তিনি বললেন, “আওয়াল অক্তে নামায পড়া।” (সহীহ আবূদাঊদ, সুনান ৪৫২, সহীহ তিরমিযী, সুনান ১৪৪, মিশকাত ৬০৭নং)

হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাঃ) শেষ জীবন পর্যন্ত দ্বিতীয় বার কখনো শেষ অক্তে নামায পড়েন নি।’ (সহীহ তিরমিযী, সুনান ১৪৬, মিশকাত ৬০৮নং)


ফজরের সময়



সুবহে সাদেক উদিত হলে ফজরের নামাযের সময় শুরু হয় এবং রোযাদারের জন্য পানাহার হারাম হয়ে যায়। (সুবহে সাদেক বলা হয় সেই সময়কে, যে সময়ে ভোরের আভা পূর্ব আকাশে উত্তর-দক্ষিণে বিস্থির্ণ অবস্থায় দেখা যায়।) আর এর শেষ সময় হল সূর্যোদয়ের পূর্ব পর্যন্ত।



তবে এই নামায প্রথম অক্তে ‘গালাসে’ (একটু অন্ধকারে কাক ভোরে) পড়া উত্তম।



মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাঃ) ফজরের নামায পড়তেন। অতঃপর মহিলারা তাদের চাদর জড়িয়েই নিজ নিজ বাসায় ফিরে যেত। কিন্তু অন্ধকারের জন্য তাদেরকে চেনা যেত না।’ (বুখারী,  মুসলিম,  মিশকাত ৫৯৮নং)



আবূ মূসা (রাঃ) বলেন, ‘একদা আল্লাহর রসূল (সাঃ) তখন ফজরের নামায পড়লেন, যখন কেউ তার পাশ্ববর্তী সঙ্গীর চেহারা চিনতে পারত না অথবা তার পাশে কে রয়েছে তা জানতে পারত না।’ (আবূদাঊদ, সুনান ৩৯৫, ৩৯৮নং)



আবূ মাসঊদ আনসারী (রাঃ) বলেন, তিনি [নবী (সাঃ)] একবার ফজরের নামায অন্ধকারে (খুব ভোরে) পড়লেন। অতঃপর দ্বিতীয় বার ফর্সা করে পড়লেন। এরপর তাঁর ফজরের নামায অন্ধকারেই হত। আর ইন্তেকাল অবধি কোন দিন পুনর্বার (ফজরের নামায) ফর্সা করে পড়েন নি।’ (আবূদাঊদ, সুনান ৩৯৪নং)



আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “তোমরা ফজরের নামায ফর্সা করে পড়। কারণ, তাতে সওয়াব অধিক।” (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ৬১৪নং)



এই হাদীসের ব্যাখ্যা এই যে, ‘ফজর স্পষ্টরুপে প্রকাশ হতে দাও, নিশ্চিতরুপে ফজর উদিত হওয়ার কথা না জেনে নামাযের জন্য তাড়াহুড়া করো না।’ অথবা ‘তোমরা ফজরের নামায লম্বা ক্বিরাআত ধরে ফর্সা করে পড়। এতে অধিক সওয়াব লাভ হবে।’ আর এ কথা বিদিত যে, মহানবী (সাঃ) নিজে এই নামাযে (কখনো কখনো) ৬০ থেকে ১০০ আয়াত পর্যন্ত পাঠ করতেন এবং যখন নামায শেষ করতেন, তখন প্রত্যেকে তার পাশের সাথীকে চিনতে পারত। (বুখারী ৫৯৯নং)



অথবা ‘ চাঁদনী রাতে একটু ফর্সা হতে দাও। যাতে ফজর হওয়া স্পষ্ট ও নিশ্চিতরুপে বুঝা যায়।’ (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ২/১১৪-১১৫)



যেহেতু তাঁর আমল মৃত্যু পর্যন্ত ফজরের নামায ফর্সা করে ছিল না, বরং এ নামায একটু অন্ধকার থাকতেই শুরু করতেন, সেহেতু উক্ত হাদীসের এই সব ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই যুক্তিযুক্ত।



যোহরের সময়

সূর্য পশ্চি  আকাশের দিকে ঢলে গেলেই যোহরের আওয়াল ওয়াক্ত শুরু হয়। আর প্রত্যেক বস্তুর ছায়া তার সমপরিমাণ হলে তার সময় শেষ হয়ে যায়।

সূর্য মধ্য রেখায় থাকলে কোন খোলা জায়গায় একটি সরল কাঠি বা শলাকা সোজাভাবে গাড়লে যখন তার ছায়া তার দেহে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পর পূর্ব দিকে পড়ে লম্বা হতে লাগবে, তখনই হবে যোহরের সময়। এইভাবে তার ছায়া তার সমপরিমাণ হলে যোহরের সময় শেষ হয়ে যাবে।

অন্যথা সূর্য মধ্যরেখায় না থাকলে, কোন গোলার্ধে থাকার ফলে যে অতিরিক্ত ছায়া পড়ে, তা বাদ দিয়ে মাপতে হবে। কাঠির ছায়া কমতে কমতে ঠিক মধ্যাহ্নকালে আবার বাড়তে শুরু হবে। ঐ বাড়া অংশটি মাপলে যোহ্‌র-আসরের সময় নির্ণয় করা যাবে।

প্রত্যেক নামায তার প্রথম অক্তে পড়াই হল উত্তম। কিন্তু গ্রীষ্মকালে কঠিন গরমের দিনে যোহরের নামায একটু ঠান্ডা বা দেরী করে পড়া আফযল।

আবূ যার (রাঃ) বলেন, একদা আমরা নবী (সাঃ) এর সাথে এক সফরে ছিলাম। যোহরের সময় হলে মুআযযিন আযান দিতে চাইল। নবী (সাঃ) বললেন, “ঠান্ডা কর।” এইরুপ তিনি দুই অথবা তিন বার বললেন। তখন আমরা দেখলাম যে, ছোট ছোট পাহাড়গুলোর ছায়া নেমে এসেছে। পুনরায় নবী (সাঃ) বললেন, “গ্রীষ্মের এই প্রখর উত্তাপ দোযখের অংশ। অতএব গরম কঠিন হলে নামায ঠান্ডা (দেরী) করে পড়।” (বুখারী ৫৩৯নং, মুসলিম,  আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান) গ্রীষ্মকালে নিজের ছায়া ৩ থেকে ৫ কদম হলে এবং শীতকালে ৫ থেকে ৭ কদম হলে যোহরের সময় নির্ণয় করা যায়। (আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ৫৮৬নং) অবশ্য সকল দেশেই এ মাপ সঠিক হবে না।

আসরের সময়

যখন প্রত্যেক বস্তুর ছায়া তার সমপরিমাণ হয়ে যায়, তখন আসরের সময় শুরু হয়। (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ৫৮৩নং)  শেষ হয় ঠিক সূর্যাস্তের পূর্বমুহূর্তে।

মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি সূর্য ডোবার পূর্বে আসরের এক রাকআত পেয়ে নেয়, সে আসর পেয়ে নেয়।” (বুখারী, মুসলিম, সহীহ)

আসরের আওয়াল অক্তেই নামায পড়া মহানবী (সাঃ) এর আমল ছিল। আনাস (রাঃ) বলেন, ‘সূর্য যখন আকাশের উচ্চতায় প্রদীপ্ত থাকত, তখন আল্লাহর রসূল (সাঃ) আসরের নামায পড়তেন। তাঁর সাথে নামায পড়ে অনেকে মদ্বীনার পার্শ্ববর্তী বস্তীতে (কোন কাজে বা নিজের বাড়ি ফিরে) যেত, আর যখন সেখানে পৌঁছত তখনও সূর্য (অপেক্ষাকৃত) উচ্চতায় থাকত। পরন্তু কোন কোন ব স্তী মদ্বীনা থেকে প্রায় ৪ মীল (১৬ হাজার হাত, প্রায় ৭ কিমি) দূরে অবস্থিত ছিল।’ (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৫৯২নং)

রাফে’ বিন খাদীজ (রাঃ) বলেন, ‘আমরা আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর সাথে আসরের নামায পড়তাম। অতঃপর উট নহ্‌র (যবেহ্‌) করা হত, তারপর তার গোশত দশ ভাগ করা হত। সেই গোশত সূর্য ডোবার পূর্বেই রান্না করে খেতে পেতাম।’ (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৬১৫নং)

বিনা ওজরে আসরের নামায শেষ সময়ে দেরী করে পড়া মাকরুহ। মহানবী (সাঃ) বলেন, “এটা তো মুনাফিকের নামায; যে সূর্যের অপেক্ষা করে যখন তা হলদে হয়ে শয়তানের দুই শিঙের মাঝে আসে, তখন সে উঠে (কাকের বা মুরগীর দানা খাওয়ার মত) চার রাকআত ঠকাঠক পড়ে নেয়। যাতে সে আল্লাহর যিক্‌র কমই করে থাকে।” (মুসলিম,  আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ৫৯৩নং)

আল্লাহর রসূল (সাঃ) আরো বলেন, “যে ব্যক্তি আসরের নামায ত্যাগ করে  সে ব্যক্তির আমল পন্ড হয়ে যায়।” (বুখারী ৫৫৩, নাসাঈ)

অন্য এক বর্ণনায় তিনি বলেন, “যে ব্যক্তির আসরের নামায ছুটে গেল, তার যেন পরিবার ও ধন-মাল লুণ্ঠন হয়ে গেল।” (মালেক, বুখারী ৫৫২, মুসলিম ৬২৬ নং প্রমুখ)

মাগরেবের সময়

সূর্য অস্ত গেলেই মাগরেবের সময় হয় এবং পশ্চিমাকাশে লাল আভা (অস্তরাগ) কেটে গেলেই এর সময় শেষ হয়ে যায়। (মুসলিম, সহীহ)

মাগরেবের নামাযও আওয়াল অক্তে পড়া আফযল এবং বিনা ওজরে দেরী করে পড়া মাকরুহ। কেননা, জিবরীল (আহমাদ, মুসনাদ) মহানবী (সাঃ) এর ইমামতি কালে ২ দিনই একই সময়ে আওয়াল অক্তে নামায পড়িয়েছিলেন- যেমন পূর্বেকার হাদীস হতে আমরা জানতে পেরেছি। তাছাড়া রাফে’ বিন খাদীজ (রাঃ) বলেন, ‘আমরা নবী (সাঃ) এর সাথে মাগরেবের নামায পড়তাম। অতঃপর নামায সেরে যদি আমাদের কেউ তীর মারত, তাহলে সে তার তীর পড়ার স্থানটি দেখতে পেত।’ (অর্থাৎ, বেশী অন্ধকার হত না।)  (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৫৯৬নং)

মহানবী (সাঃ) বলেন, “আমার উম্মতের লোকেরা ততক্ষণ পর্যন্ত ইসলামী ফিতরাত (প্রকৃতির) উপর থাকবে, যতক্ষণ তারা তারকারাজি (আকাশে) প্রকাশ হওয়ার পূর্বেই মাগরেবের নামায পড়ে নেবে।” (আহমাদ, মুসনাদ, ত্বাবারানী, মু’জাম, আবূদাঊদ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, মিশকাত ৬০৯নং)

এশার সময়

সূর্যাস্তের পর পশ্চিম আকাশ হতে লাল আভা কেটে গেলে এশার সময় উপস্থিত হয়। নু’মান বিন বাশীর (রাঃ) এর বর্ণনা অনুযায়ী (চাঁদের মাসের) তৃতীয় রাতে চাঁদ ডুবে গেলে এশার সময় হয়। (আবূদাঊদ, সুনান, দারেমী, সুনান, মিশকাত ৬১৩নং) সূর্য ডোবার পর থেকে ঘড়ি ধরে দেড় ঘন্টা অতিবাহিত হলে এই ওয়াক্ত আসে।

আর এর শেষ সময় অর্ধেক রাত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকে। অবশ্য কোন ওযর ও বাধার ফলে ফজরের আগে পর্যন্ত এশার নামায পড়ে নিলে আদায় হয়ে যায়। যেহেতু মহানবী (সাঃ) বলেন, “কেউ ঘুমিয়ে যাওয়ার ফলে নামায না পড়লে তা শৈথিল্য বলে গণ্য হবে না। অবশ্য জাগ্রতাবস্থায় যদি কেউ নামায না পড়ে এবং অন্য নামাযের সময় উপস্থিত হয়ে যায়, তবে তার শৈথিল্যই ধর্তব্য।” (মুসলিম, সহীহ ৬৮১নং)

উক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আগামী নামাযের সময় এসে উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান নামাযের সময় অবশিষ্ট থাকে। অবশ্য ফজরের নামাযের সময় শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত। সূর্য উদয়ের সাথে সাথেই তা শেষ হয়ে যায়। যোহ্‌র পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকে না। (ফিকহুস সুন্নাহ্‌ উর্দু৭৫পৃ:)

আওয়াল অক্তে নামায আফযল হলেও এক তৃতীয়াংশ বা মধ্যরাতে (শেষ অক্তে) এশার নামায পড়া আফযল। মহানবী (সাঃ) বলেন, “আমার উম্মতের জন্য কষ্টসাধ্য না জানলে আমি এশার নামাযকে এক তৃতীয়াংশ অথবা অর্ধরাত পর্যন্ত দেরী করে পড়তে তাদেরকে আদেশ দিতাম।” (আহমাদ, মুসনাদ, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, মিশকাত ৬১১নং)

প্রিয় রসূল (সাঃ) এশার নামাযকে এক তৃতীয়াংশ রাত্রি পর্যন্ত দেরী করে পড়তে পছন্দ করতেন এবং এশার পূর্বে ঘুমানো ও পরে কথাবার্তা বলাকে অপছন্দ করতেন। (বুখারী ৫৯৯, মুসলিম,  প্রমুখ) যাতে এশা, তাহাজ্জুদ, বিতর ও ফজরের নামায যথা সময়ে পড়া সহজ হয়।

তবে দ্বীন অথবা জরুরী বিষয়ে কথাবার্তা বলা ও ইলম চর্চা করা দূষনীয় নয়। যেমন আল্লাহর রসূল (সাঃ) আবূ বকর ও উমারের সাথে এশার পর জনসাধারণের ভালো-মন্দ নিয়ে কথাবার্তা বলতেন। (আহমাদ, মুসনাদ, তিরমিযী, সুনান ১৬৯নং)

নামাযের সময় নির্দিষ্টী করণের পশ্চাতে হিকমত

মহান আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে এমন প্রকৃতি ও প্রবৃত্তি দান করেছেন, যাতে রুযী অনুসন্ধানের মাধ্যমে তাকে জীবনধারণ করতে হবে। আর তার জন্য প্রয়োজন পরিশ্রমের। পরিশ্রম দেহ্‌-মনে ক্লান্তি, ব্যস্ততা ও শৈথিল্য আনে। ফলে পরিশ্রমে ছিন্ন হয় আল্লাহ ও বান্দার মাঝে বিশেষ যোগসূত্র। তাই তো যথাসময়ে সেই যোগসূত্র -একটানা নয় বরং মাঝে মাঝে কায়েম করে বান্দাকে আল্লাহ-মুখো করে রাখার উদ্দেশ্যে নামাযের ওয়াক্তের এই বিশেষ সময়াবলী নির্দিষ্ট করা হয়েছে।

পক্ষান্তরে পরিশ্রম ও উপার্জনের জন্যও উদ্যম জরুরী। বিশেষ করে ফজরের সময়ে এমন কিছু অনুশীলনের দরকার, যার মাঝে নিদ্রার জড়তা ও আলস্য কেটে গিয়ে মনে স্ফূর্তি ফিরে আসে এবং যার ফলে এই বর্কতের সময়ে মানুষ নিজ নিজ কাজে মনোযোগী হতে পারে। তাই তো ফজরের নামাযের মাধ্যমে বান্দা তার নিদ্রা অবস্থায় নিরাপত্তা লাভের উপর আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করে এবং আল্লাহর নিকট তওফীক ও সাহায্য কামনার মধ্য দিয়ে শুরু করে তার প্রাত্যহিক কর্মজীবন।

পরিশ্রম ও ব্যস্ততার মাঝে ঠিক দিন দুপুরে মানুষ পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ে একটু বিরতির সাথে বিশ্রাম নিয়ে থাকে। এই বিশ্রামের সময় সে তার নিজ কর্মের উপর তওফীক লাভের শুকরিয়া জ্ঞাপন করে আল্লাহর নিকট। অতঃপর আসরের সময় উপস্থিত হলে পুনরায় বান্দা তার বাকী দিনের কর্ম সম্পন্ন করার মানসে আল্লাহর সাহায্য কামনা করে। মাগরেবের সময় হলে বান্দা নিজ গৃহে ফিরে কর্ম সম্পাদন করার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনপূর্বক মাগরেবের নামায পড়ে। অতঃপর সময় আসে বিশ্রাম ও আরামের। এই সময় বান্দা প্রাত্যহিক কর্ম সেরে সারা দিনে আল্লাহর তরফ থেকে অবতীর্ণ অনুগ্রহের  উপর শুক্‌র জানিয়ে এশার নামায পড়ে। আর এইভাবে সে প্রত্যহ্‌ কর্ম ও ইবাদতের মধ্য দিয়ে নিজের কাল যাপন করে থাকে। কোন সময় আত্মবি স্মৃ ত হয়ে পাপের প্রতিঢলে পড়লে নামায তাকে বাধা দেয়। আল্লাহর আযাব ভীষণ কঠিন এবং তাঁর অনুগ্রহ অনন্ত-অসীম -এ কথা প্রত্যহ্‌ পাঁপ-পাঁচ বার বান্দাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। (মাজমূউস স্বালাওয়াতি ফিল-ইসলাম, ড: শওকত উলাইয়ান ৯১-৯২পৃ:)

যে যে সময়ে নামায নিষিদ্ধ

দিবারাত্রে পাঁচটি সময়ে নামায পড়া নিষিদ্ধ; মহানবী (সাঃ) বলেন,
(১) “আসরের নামাযের পর সূর্য না ডোবা পর্যন্ত আর কোন নামায নেই এবং
(২) ফজরের নামাযের পর সূর্য না ওঠা পর্যন্ত আর কোন নামায নেই।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ১০৪১ নং)

উক্ববা বিন আমের (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রসূল (সাঃ) আমাদেরকে তিন সময়ে নামায পড়তে এবং মুর্দা দাফন করতে নিষেধ করতেন;

(৩) ঠিক সূর্য উদয় হওয়ার পর থেকে একটু উঁচু না হওয়া পর্যন্ত,
(৪) সূর্য ঠিক মাথার উপর আসার পর থেকে একটু ঢলে না যাওয়া পর্যন্ত এবং
(৫) সূর্য ডোবার কাছাকাছি হওয়া থেকে ডুবে না যাওয়া পর্যন্ত। (মুসলিম,  আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, মিশকাত ১০৪০ নং) যেহেতু এই সময়গুলিতে সাধারণত: কাফেররা সূর্যের পূজা করে থাকে তাই। (মুসলিম,  মিশকাত ১০৪২ নং)

নামায নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে এটি হল সাধারণ নির্দেশ। কিন্তু অন্যান্য হাদীস দ্বারা কিছু সময়ে কিছু নামাযকে ব্যতিক্রম করা হয়েছে। যেমন:-

১। ফরয নামায বাকী থাকলে তা আদায় করার সুযোগ হওয়া মাত্র যে কোন সময়ে সত্বর পড়ে নেওয়া জরুরী। মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি সূর্য ডোবার পূর্বে আসরের এবং সূর্য ওঠার পূর্বে ফজরের এক রাকআত নামায পেয়ে যায়, সে (যথাসময়ে) নামায পেয়ে যায়।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৬০১নং)

তিনি আরো বলেন, “যে ব্যক্তি সূর্য ডোবার পূর্বে আসরের এক রাকআত নামায পায়, সে যেন (সূর্য ডুবে গেলেও) তার বাকী রাকআত নামায সম্পন্ন করে নেয়। আর যে ব্যক্তি সূর্য ওঠার পূর্বে ফজরের এক রাকআত নামায পায়, সে যেন (সূর্য উঠে গেলেও) তার বাকী রাকআত নামায সম্পন্ন করে নেয়।” (বুখারী, মিশকাত ৬০২নং)

২। অনুরুপ কোন ফরয নামায পড়তে ভুলে গিয়ে থাকলে তা স্মরণ হওয়া মাত্র সত্বর যে কোন সময়ে অথবা ঘুমিয়ে গিয়ে থাকলে জাগার পর উঠে সত্বর যে কোন সময়ে আদায় করা জরুরী। মহানবী (সাঃ) বলেন, “কেউ ঘুমিয়ে গেলে তা তার শৈথিল্য নয়। শৈথিল্য তো জাগ্রত অবস্থাতেই হয়ে থাকে। সুতরাং যখন কেউকোন নামায পড়তে ভুলে যাবে অথবা ঘুমিয়ে যাবে, তখন তার উচিৎ, তা স্মরণ (বা জাগ্রত) হওয়া মাত্র পড়ে নেওয়া। কারণ, আল্লাহ তাআলা বলেন, “আমাকে স্মরণ করার উদ্দেশ্যে তুমি নামায কায়েম কর।” (মুসলিম,  মিশকাত  ৬০৪নং, কুরআন মাজীদ ২০/১৪)

৩। দিন-দুপুরে মসজিদে জুমুআহ পড়তে এসে ইচ্ছামত নফল নামায পড়া বিধেয়। এ নামাযও নিষেধের আওতাভুক্ত নয়। (মিশকাত ১০৪৬নং)

৪। ফজরের ফরয নামাযের পূর্বে দু’ রাকআত সুন্নত পড়তে সময় না পেলে ফরযের পর তা পড়া যায়। আল্লাহর রসূল (সাঃ) একদা এক ব্যক্তিকে দেখলেন ফজরের ফরয নামাযের পর দু’ রাক্‌আত নামায পড়ল। তিনি তাকে বললেন, “ফজরের নামায তো দু’ রাকআত মাত্র!” লোকটি বলল, ‘আমি ফরযের পূর্বে দু’ রাকআত পড়তে পাই নি, এখন সেটা পড়ে নিলাম।’ এ কথা শুনে তিনি নীরব থাকলেন। (অর্থাৎ,  মৌনসম্মতি জানালেন।) (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ১০৪৪)

৫। কারণ-সাপেক্ষ যাবতীয় নামায যথার্থ কারণ উপস্থিত হওয়া মাত্র যে কোন সময়েই পড়া যায়। যেমন :-

ক- কা’বা শরীফের তওয়াফের পর দু’ রাকআত নামায। তওয়াফ শেষ হওয়ার পরেই যে কোন সময়ে ঐ নামায পড়া যায়। মহানবী (সাঃ) বলেন, “হে আব্দে মানাফের বংশধর! দিবারাত্রের যে কোন সময়ে কেউএ গৃহের তওয়াফ করে নামায পড়লে তাকে তোমরা বাধা দিও না।” (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ১০৪৫ নং)

খণ্ড তাহিয়্যাতুল মাসজিদ (মসজিদ-সেলামী) দু’ রাকআত নামায। যে কোনও সময়ে মসজিদ প্রবেশ করে বসার ইচ্ছা করলে বসার পূর্বে এই নামায পড়তে হয়। মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের কেউমসজিদ প্রবেশ করলে সে যেন দু’ রাকআত নামায পড়ার পূর্বে না বসে।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৭০৪নং)

গ- সূর্য বা চন্দ্র গ্রহণের নামায। মহানবী (সাঃ) বলেন, “সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্যতম। কারো জন্ম বা মৃত্যুর কারণে তাতে গ্রহণ লাগে না। সুতরাং গ্রহণ লাগা দেখলে তোমরা আল্লাহর নিকট দুআ কর, তকবীর পড়, নামায পড় এবং সদকাহ্‌ কর।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ১৪৮৩ নং)

ঘ- জানাযার নামায। আসর ও ফজর নামাযের পরও জানাযার নামায পড়া যাবে। অবশ্য শেষোক্ত তিন সময়ে এই নামায বৈধ নয়। যেমন পূর্বোক্ত হাদীসে এ কথা বর্ণিত হয়েছে। (আজামে ১৩০-১৩১পৃ:)

সুতরাং সাধারণ নফল নামায উক্ত সময়গুলিতে নিষিদ্ধ। তবে আসরের পর সূর্য হ্‌লুদবর্ণ না হওয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ নয়। (সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৫৪৯ নং)

ওয়াক্ত-বিষয়ক আরো কিছু মাসায়েল

১। যে ব্যক্তি ওয়াক্ত শেষ হওয়ার পূর্বে এক রাকআত নামায পেয়ে নেবে সে ওয়াক্ত পেয়ে যাবে। অর্থাৎ, তার নামায যথা সময়ে আদায় হয়েছে এবং কাযা হয়নি বলে গণ্য হবে। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৬০১নং) বিধায় যে ব্যক্তি এক রাকআতের চেয়ে কম নামায পাবে, সে সময় পাবে না; অর্থাৎ তার নামায যথাসময়ে আদায় হবে না এবং তা কাযা বলে গণ্য হবে। তবে ইচ্ছাকৃতভাবে বিনা ওজরে শেষ সময়ে নামায পড়া বৈধ নয়।

তদনুরুপ যদি কোন ব্যক্তি এক রাকআত নামায পড়ার মত সময়ের পূর্বেই মুসলমান হয় অথবা কোন মহিলা অনুরুপ সময়ে মাসিক থেকে পবিত্রা হয় তবে ঐ ওয়াক্তের নামায তাদের জন্য কাযা করা ওয়াজেব।

যেমন কোন ব্যক্তি যদি সূর্য ওঠার পূর্বে এমন সময়ে ইসলাম গ্রহণ করে, যে সময়ের মধ্যে মাত্র এক রাকআত ফজরের নামায পড়লেই সূর্য উঠে যাবে, তাহলে ঐ ব্যক্তির জন্য ফজরের ঐ নামায ফরয এবং তাকে কাযা পড়তে হয়। অনুরুপ যদি কোন পাগল জ্ঞান ফিরে পায় অথবা কোন মহিলার মাসিক বন্ধ হয়, তাহলে তাদের জন্যও ঐ ফজরের নামায ফরয।

ঠিক তদ্রুপই যদি কোন মহিলা মাগরেবের নামায না পড়ে থাকে এবং এতটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর তার মাসিক শুরু হয়ে যায়, যার মধ্যে এক রাকআত নামায পড়া যেত, তাহলে ঐ মহিলার জন্য ঐ মাগরেবের নামায ফরয। মাসিক থেকে পাক হওয়ার পরে তাকে ঐ নামায কাযা পড়তে হবে। (রাসাইল ফিকহিয়্যাহ্‌, ইবনে উসাইমীন ২৩-২৪পৃ:)

২। এশার নামায অর্ধরাত্রি পর্যন্ত দেরী করে পড়া আফযল হলেও আওয়াল অক্তে জামাআত হলে জামাআতের সাথে আওয়াল অক্তেই পড়া আফযল। কারণ, জামাআতে নামায পড়া ওয়াজেব।

৩। ফজরের আযান হলে ২ রাকআত সুন্নাতে রাতেবাহ্‌ ছাড়া ফরয পর্যন্ত আর অন্য কোন নামায নেই। মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে উপস্থিত ব্যক্তি অনুপস্থিত ব্যক্তিকে যেন পৌঁছে দেয় যে, ফজরের (আযানের) পর দু’ রাকআত (সুন্নত) ছাড়া আর কোন (নফল) নামায পড়ো না।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ১২৭৮ নং)

৪। জামাআত খাড়া হলে ফরয নামায ছাড়া কোন প্রকারের নফল ও সুন্নত (অনুরুপ পৃথক ফরয) নামায পড়া বৈধ নয়। (মুসলিম, সহীহ প্রমুখ, মিশকাত ১০৫৮ নং)

৫। পৃথিবীর যে স্থানে দিন বা রাত্রি অস্বাভাবিক লম্বা (যেমন ৬ মাস রাত, ৬ মাস দিন) হয়, সে স্থানে ২৪ ঘন্টা হিসাব করে রাত-দিন ধরে হিসাব মত পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়তে হবে। যে স্থানে দিন বা রাত অস্বাভাবিক ছোট সেখানেও আন্দাজ করে সকল নামায আদায় করা জরুরী। যেমন দাজ্জাল এলে দিন ১ বছর, ১ মাস ও ১ সপ্তাহ্‌ পরিমাণ লম্বা হলে, স্বাভাবিক দিন অনুমান ও হিসাব করে নামায পড়তে বলা হয়েছে। (মুসলিম, সহীহ ২১৩৭ নং)

আযান ও ইক্বামত

আযান ও তার মাহাত্ম

আযান ফরয এবং তা দেওয়া হল ফ র্যে কিফায়াহ্‌। আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “নামাযের সময় উপস্থিত হলে তোমাদের একজন আযান দেবে এবং তোমাদের মধ্যে যে বড় সে ইমামতি করবে।” (বুখারী ৬২৮নং, মুসলিম,  নাসাঈ, সুনান, দারেমী, সুনান)

আযান ইসলামের অন্যতম নিদর্শন ও প্রতীক। কোন গ্রাম বা শহরবাসী তা ত্যাগ করলে ইমাম (রাষ্ট্রপ্রধান) তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবেন। যেমন মহানবী (সাঃ) অভিযানে গেলে কোন জনপদ থেকে আযানের ধ্বনি শুনলে তাদের উপর আক্রমণ করতেন না। (বুখারী ৬১০ নং, মুসলিম, সহীহ)

সফরে একা থাকলে অথবা মসজিদ খুবই দূর হলে এবং আযান শুনতে না পাওয়া গেলে একাই আযান ও ইকামত দিয়ে নামায পড়া সুন্নত। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৫৫)

আযান দেওয়ায় (মুআযযেনের জন্য) রয়েছে বড় সওয়াব ও ফযীলত। মহান আল্লাহ বলেন, “সে ব্যক্তি অপেক্ষা আর কার কথা উৎকৃষ্ট, যে ব্যক্তি আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান করে, সৎকাজ করে এবং বলে আমি একজন ‘মুসলিম’ (আত্মসমর্পণকারী)?” (কুরআন মাজীদ ৪১/৩৩)

প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “লোকে যদি আযান ও প্রথম কাতারের মাহাত্ম জানত, অতঃপর তা লাভের জন্য লটারি করা ছাড়া আর অন্য কোন উপায় না পেত, তাহলে তারা লটারিই করত।” (বুখারী ৬১৫, মুসলিম, সহীহ ৪৩৭নং)

“আল্লাহ প্রথম কাতারের উপর রহ্‌মত বর্ষণ করেন এবং ফিরিশ্‌তাগণ তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকেন। মুআযযিনকে তার আযানের আওয়াযের উচ্চতা অনুযায়ী ক্ষমা করা হয়। তার আযান শ্রবণকারী প্রত্যেক সরস বা নীরস বস্তু তার কথার সত্যায়ন করে থাকে। তার সাথে যারা নামায পড়ে তাদের সকলের নেকীর সমপরিমাণ তার নেকী লাভ হয়।” (আহ্‌মদ, নাসাঈ, সহীহ তারগীব ২২৮নং)

“কিয়ামতের দিন মুআযযিনগণের গর্দান অন্যান্য লোকেদের চেয়ে লম্বা হবে।” (মুসলিম, সহীহ৩৮৭নং)

 “যে ব্যক্তি বারো বৎসর আযান দেবে তার জন্য জান্নাত ওয়াজেব হয়ে যাবে। আর প্রত্যেক দিন আযানের দরুন তার আমল নামায় ষাটটি নেকী লিপিবদ্ধ করা হবে এবং তার ইকামতের দরুন লিপিবদ্ধ হবে ত্রিশটি নেকী।” (ইবনে মাজাহ্‌, দারাকুত্বনী,হাকেম, সহীহ তারগীব ২৪০নং)

“যে কোন মানুষ, জ্বিন বা অন্য কিছু মুআযযিনের  আযানের শব্দ শুনতে পাবে, সেই মুআযযিনের জন্য কিয়ামতের দিন সাক্ষ্য প্রদান করবে।” (বুখারী ৬০৯ নং)


আযানের প্রারম্ভিক ইতিহাস



মক্কায় অবস্থানকালে মহানবী (সাঃ) তথা মুসলিমগণ বিনা আযানে নামায পড়েছেন। অতঃপর মদ্বীনায় হিজরত করলে হিজরী ১ম (মতান্তরে ২য়) সনে আযান ফরয হয়। (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/৭৮)



সকল মুসলমানকে একত্রে সমবেত করে জামাআতবদ্ধভাবে নামায পড়ার জন্য এমন এক জিনিসের প্রয়োজন ছিল, যা শুনে বা দেখে তাঁরা জমা হতে পারতেন। এ জন্যে তাঁরা পূর্ব থেকেই মসজিদে উপস্থিত হয়ে নামাযের অপেক্ষা করতেন। এ মর্মে তাঁরা একদিন পরামর্শ করলেন; কেউ বললেন, ‘নাসারাদের ঘন্টার মত আমরাও ঘন্টা ব্যবহার করব।’ কেউ কেউ বললেন, ‘বরং ইয়াহুদীদের শৃঙ্গের মত শৃঙ্গ ব্যবহার করব।’ হযরত উমার (রাঃ) বললেন, ‘বরং নামাযের প্রতি আহ্বান করার জন্য একটি লোককে (গলি-গলি) পাঠিয়ে দিলে কেমন হয়?’ কিন্তু মহানবী (সাঃ) বললেন, “হে বিলাল! ওঠ, নামাযের জন্য আহ্বান কর।”(বুখারী ৬০৪ , মুসলিম, সহীহ)



কেউ বললেন, ‘নামাযের সময় মসজিদে একটি পতাকা উত্তোলন করা হোক। লোকেরা তা দেখে একে অপরকে নামাযের সময় জানিয়ে দেবে।’ কিন্তু মহানবী (সাঃ) এ সব পছন্দ করলেন না। (আবূদাঊদ, সুনান ৪৯৮নং) পরিশেষে তিনি একটি ঘন্টা নির্মাণের আদেশ দিলেন। এই অবসরে আব্দুল্লাহ বিন যায়দ (রাঃ) স্বপ্নে দেখলেন, এক ব্যক্তি ঘন্টা হাতে যাচ্ছে। আব্দুল্লাহ বলেন, আমি তাকে বললাম, ‘হে আল্লাহর বান্দা! ঘন্টাটি বিক্রয় করবে?’ লোকটি বলল, ‘এটা নিয়ে কি করবে?’ আমি বললাম, ‘ওটা দিয়ে লোকেদেরকে নামাযের জন্য আহ্বান করব।’ লোকটি বলল, ‘আমি তোমাকে এর চাইতে উত্তম জিনিসের কথা বলে দেব না কি?’ আমি বললাম, ‘অবশ্যই।’



তখন ঐ ব্যক্তি আব্দুল্লাহকে আযান ও ইকামত শিখিয়ে দিল। অতঃপর সকাল হলে তিনি রসূল (সাঃ) এর নিকট উপস্থিত হয়ে স্বপ্নের কথা খুলে বললেন। সব কিছু শুনে মহানবী (সাঃ) বললেন, “ইনশাআল্লাহ! এটি সত্য স্বপ্ন। অতএব তুমি বিলালের সাথে দাঁড়াও এবং স্বপ্নে যেমন (আযান) শুনেছ ঠিক তেমনি বিলালকে শুনাও; সে ঐ সব বলে আযান দিক। কারণ, বিলালের আওয়াজ তোমার চেয়ে উচ্চ।”



অতঃপর আব্দুল্লাহ (রাঃ) স্বপ্নে প্রাপ্ত আযানের ঐ শব্দগুলো বিলাল (রাঃ) কে শুনাতে লাগলেন এবং বিলাল (রাঃ) উচ্চস্বরে আযান দিতে শুরু করলেন। উমার (রাঃ) নিজ ঘর হতেই আযানের শব্দ শুনতে পেয়ে চাদর ছেঁচড়ে (তাড়াতাড়ি) বের হয়ে মহানবী (সাঃ) এর নিকট উপস্থিত হলেন; বললেন, ‘সেই সত্তার কসম, হে আল্লাহর রসূল! আমিও (২০ দিন পূর্বে) স্বপ্নে ঐরুপ দেখেছি।’ আল্লাহর রসূল (সাঃ) তাঁকে বললেন, “অতএব যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহরই।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ৪৯৮-৪৯৯, তিরমিযী, সুনান ১৮৯, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ৭০৬নং)



আযানের শব্দাবলী

মহানবী (সাঃ) এর মুআযযিন ছিল মোট ৪ জন। মদ্বীনায় ২ জন; বিলাল বিন রাবাহ্‌ ও আম্‌র বিন উম্মে মাকতূম কুরাশী। আম্‌র ছিলেন অন্ধ।আর কুবায় ছিলেন সা’দ আল-কুর্য। মক্কায় আবূ মাহ্‌যূরাহ্‌ আওস বিন মুগীরাহ্‌ জুমাহী। (যাদুল মাআদ, ইবনুল কাইয়েম ১/১২৪)

আব্দুল্লাহ বিন যায়দ (রাঃ) এর বর্ণিত বিলাল (রাঃ) এর আযান ছিল নিম্নরুপ:-

اَللهُ أَكْبَر  (আল্লা-হু আকবার) ৪ বার।

أَشْهَدُ أَنْ لاَّ إِلهَ إِلاَّ الله (আশহাদু আল লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ্‌) ২ বার।

أَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّداً رَّسُوْلُ الله (আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লা-হ্‌) ২ বার।

حَيَّ عَلَى الصَّلاَة(হাইয়্যা আলাস স্বলা-হ্‌) ২ বার।

حَيَّ عَلَى الْفَلاَح(হাইয়্যা আলাল ফালা-হ্‌) ২ বার।

اَللهُ أَكْبَر  (আল্লা-হু আকবার) ২ বার।

 لا إِلهَ إِلاَّ الله(লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ্‌) ১ বার। (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ৪৯৯নং)

আবূ মাহ্‌যূরাহ্‌ (রাঃ) কে আল্লাহর রসূল (সাঃ) নিম্নরুপ আযান শিখিয়েছিলেন:-

اَللهُ أَكْبَر  (আল্লাহ সবার চেয়ে মহান) ৪ বার।

أَشْهَدُ أَنْ لاَّ إِلهَ إِلاَّ الله (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ভিন্ন কোন সত্য উপাস্য নেই।) ২বার চুপে চুপে।

أَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّداً رَّسُوْلُ الله (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহর রসূল।) ২ বার চুপে চুপে।

পুনরায়  أشْهَدُ أَنْ لاَّ إِلهَ إِلاَّ الله ২বার উচ্চস্বরে।

أَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّداً رَّسُوْلُ الله ২বার উচ্চস্বরে।

حَيَّ عَلَى الصَّلاَة  (এস নামাযের জন্য) ২ বার।

حَيَّ عَلَى الْفَلاَح(এস মুক্তির জন্য) ২ বার।

اَللهُ أَكْبَر  (আল্লাহ সবার চেয়ে মহান) ২ বার।

 لاَ إِلهَ إِلاَّ الله(আল্লাহ ভিন্ন কোন সত্য মা’বূদ নেই।) ১ বার।

আর এই আযানকে ‘তারজী’ আযান’ বলা হয়। (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ৫০০নং, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান)

ফজরের আযান হলে  حيَّ عَلَى الْفَلاَح এর পরে ২বার বলতে হয়,

اَلصَّلاَةُ خَيْرٌ مِّنَ النَّوْم (আসস্বলা-তু খাইরুম মিনান্‌ নাওম। অর্থাৎ, নিদ্রা অপেক্ষা নামায উত্তম। (ঐ)

আযানের বিশেষ নিয়মাবলী

১। আযান যেন তার শব্দবিন্যাসের বিপরীত না হয়। যার পর যে বাক্য পরস্পর সজ্জিত আছে ঠিক সেই পর্যায়ক্রমে তাই বলা জরুরী। সুতরাং -উদাহ্‌রণস্বরুপ- যদি কেউحيَّ عَلَى الصَّلاَة  বলার আগে حيَّ عَلَى الْفَلاَح বলে ফেলে, তাহলে পুনরায় حيَّ عَلَى الصَّلاَة বলে যথা অনুক্রমে আযান শেষ করবে। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৩৪৮)

২। একটা বাক্য বলার পর অন্য বাক্য বলতে যেন বেশী দেরী না হয়। মাইক ইত্যাদি ঠিক করতে গিয়ে বা অন্য কোন কারণে বিরতি অধিক হলে পুনরায় শুরু থেকে আযান দিতে হবে।

৩। আযান যেন নামাযের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার পূর্বে না হয়। যেহেতু ওয়াক্তের পূর্বে আযান যথেষ্ট নয়। (মুগনী ১/৪৪৫) পূর্বে দিয়ে ফেললে ওয়াক্ত হলে পুনরায় আযান দেওয়া জরুরী। (আউনুল মা’বূদ ২/১৬৬) একদা হযরত বিলাল (সাঃ) (ফজরের) আযান ফজর উদয় হওয়ার আগেই দিয়ে ফেলেছিলেন। মহানবী (সাঃ) তাঁকে আদেশ করলেন যে, তিনি যেন ফিরে গিয়ে বলেন, ‘শোনো! বান্দা ঘুমিয়েছিল। শোনো! বান্দা ঘুমিয়েছিল।’ (অর্থাৎ ঘুমের ঘোরে সময় বুঝতে পারিনি।) (আবূদাঊদ, সুনান ৫৩২নং)

৪। আযানের শব্দাবলী আরবী। ভিন্ন ভাষায় (অনুবাদ করে) আযান তো শুদ্ধ নয়ই; পরন্তু ঐ আরবী শব্দগুলোর উচ্চারণে ভুল করাও বৈধ নয়। সুতরাং যদি আযানের এমন উচ্চারণ করা হয়, যাতে তার অর্থ বদলে যায়, তাহলে আযান শুদ্ধ নয়। যেমন,  آللهُ أَكْبَر ‘আ-ল্লা-হু আকবার’ (প্রথমকার আলিফে টান দিয়ে) বলা। এর অর্থ হবে, ‘আল্লাহ কি সবার চেয়ে মহান?’ আল্লাহর মহানতায় সন্দেহ্‌ পোষণ করে এ ধরনের প্রশ্ন বোধক বাক্য বললে মানুষ কাফের হয়ে যায়। না জেনে বললে কাফের না হলেও আযান শুদ্ধ নয়।

তদনুরুপ الله أكبار ‘আল্লাহু আকবা-র’ (আকবারের শেষে টান দিয়ে) বললে এর অর্থ দাঁড়াবে, ‘আল্লাহ একমুখো তবলা!’ অথবা ‘আল্লাহ আকবা-র (এক শয়তানের নাম)! নাঊযু বিল্লাহি মিন যালিক।

অনুরুপ যেখানে টান আছে সেখানে না টানা এবং যেখানে টান নেই সেখানে টান দেওয়া, ع  (আইন) কে ا  (আলিফ) এর মত অথবা তার বিপরীত, ح  (বড় হে বাহা) কে هـ  (ছোট হে বাহা)এর মত অথবা তার বিপরীত উচ্চারণ, ‘ফালাহ্‌’ ও ‘স্বালাহ্‌’ বলার সময় ‘হ্‌’এর উচ্চারণ বাদ দিয়ে ‘ফালা’ ও ‘সালা’ বলা, যের-যবর প্রভৃতি উল্টাপাল্টা করা ইত্যাদি আযানের অর্থ বদলে দেয়। এতে আযান শুদ্ধ হয় না।

৫। আযানের সমস্ত শব্দাবলী গোনা- গাঁথা। এর উপর কিছু অতিরিক্ত করা বিদআত। মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি আমাদের এ (দ্বীনের) ব্যাপারে কোন নতুন কিছু উদ্ভাবন করবে, যা তার অন্তর্ভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত।” (বুখারী, মুসলিম, সহীহ)

তাই ‘হাইয়্যা আলা খাইরিল আমাল,’ ‘আশহাদু আন্না সাইয়্যিদানা---’ প্রভৃতি বাড়তি শব্দ ও বাক্য বিদআত। (ফাতাওয়া মুহিম্মাহ্‌ তাতাআল্লাকু বিসসলাহ্‌, ইবনে বায ৩৪পৃ:)

তদনুরুপ ফজর ছাড়া অন্য ওয়াক্তের আযানে ‘আসস্বলাতু খাইরুম--’ বলা বৈধ নয়। ইবনে উমার (রাঃ) এটিকে বিদআত বলেছেন এবং তা শুনে সে আযানের মসজিদ ত্যাগ করেছেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৫৩৮নং)

অনুরুপ আযানের পর আযানের মত চিল্লিয়ে ‘নামায পড়’ ইত্যাদি বলাও বিদআত। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৫২)

প্রকাশ যে, ফজরের আযানে ‘আসস্বলাতু খাইরুম--’ বলতে ভুলে গেলে আযানের কোন ক্ষতি হয় না। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৩৪৯)

আযান দিতে দিতে অতি প্রয়োজনে কথা বলায় দোষ নেই। (বুখারী, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/১১৬)

কোন কারণে আযান দিতে দিতে মুআযযিন তা শেষ করতে না পারলে অন্য ব্যক্তি নতুন করে শুরু থেকে আযান দেবে।

টেপ-রেকর্ডারের মাধমে আযান শুদ্ধ নয়। কারণ, আযান এক ইবাদত। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ২/৬১-৬২)

মুআযযিনের কি হওয়া ও কি করা উচিত

১। মুআযযিন যেন ‘মুসলিম’ ও জ্ঞানসম্পন্ন (সাবালক বা নাবালক) পুরুষ হয়। কোন মহিলার জন্য (পুরুষ-মহলে) আযান দেওয়া বৈধ নয়; দিলে সে আযান শুদ্ধ নয়। (মুগনী ১/৪৫৯)

২। মুআযযিন হবে সুন্দর চরিত্রের অধিকারী। যাতে তার আযান শুনে কারো মনে (আযানের প্রতি) বিতৃষ্ণা ও ঘৃণার উদ্রেক না হয়। (কাবীরা গুনাহ করে এমন) ফাসেকের আযান যদিও শুদ্ধ, তবুও কোন ফাসেককে মসজিদের মুআযযিন নিয়োগ করা ঠিক নয়। (মুগনী ১/৪৪৯)

৩। সেই ব্যক্তিই হবে যোগ্য মুআযযিন, যে আযানের শব্দাবলীর যথার্থ উচ্চারণ করতে সক্ষম।

৪। উপযুক্ত মুআযযিন সেই, যে আযান দেওয়ার উপর কোন পারিশ্রমিক নেয় না। একদা উসমান আবিল আস (রাঃ) আল্লাহর রসূল (সাঃ) কে বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমাকে আমার কওমের ইমাম বানিয়ে দিন।’ তিনি বললেন, “তুমি ওদের ইমাম। (তবে) ওদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তির কথা খেয়াল করে ইমামতি (ও নামাযহাল্কা) করো। আর এমন মুআযযিন রেখো, যে আযান দেওয়ার বিনিময়ে কোন বেতন নেবে না।” (মুসলিম,  আবূদাঊদ, সুনান ৫৩১, তিরমিযী, সুনান ২০৯, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ৯৮৭নং,হাকেম, মুস্তাদরাক ৫/৩)

অবশ্য তার কিছু নেওয়ার উদ্দেশ্য না থাকার পরেও যদি তাকে কিছু পারিশ্রমিক দেওয়া হয়, তাহলে তা গ্রহণ করায় দোষ নেই। কিন্তু উদ্দেশ্য যদি বেতন পাওয়াই হয় অথবা নাম নেওয়া বা লোক-প্রদর্শন হয়, তবে তার ঐ আমল ছোট শির্কে পরিগণিত হবে। (রিসালাতুন ইলা মুআযযিন ৪২-৪৫ দ্র:)

৫। আযান দেওয়ার জন্য ওযু জরুরী নয়। কারণ, এ ব্যাপারে সহীহ হাদীস নেই। (ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ১/২৪০, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/১৩৫)

৬। আযান দিতে হবে উঁচু স্থানে; যাতে তার শব্দ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ইবনে উমার (রাঃ) উটের উপর চড়ে আযান দিতেন। (বায়হাকী, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ২২৬নং) বিলাল (রাঃ) আযান দিতেন নাজ্জার গোত্রের এক মহিলার ঘরের ছাদে উঠে। কারণ, মসজিদের আশেপাশে সমস্ত ঘরের চেয়ে তার ঘরটাই ছিল বেশী উঁচু। আর আব্দুল্লাহ বিন শাকীক বলেন, ‘সুন্নাহ্‌ (মহানবী (সাঃ) এর তরীকা) হল মিনারে আযান দেওয়া এবং মসজিদের ভিতর ইকামত দেওয়া।’ (ইআশা: ২৩৩১ নং)

অবশ্য এ প্রয়োজন মাইকে মিটিয়ে দেয়। কিন্তু মাইক-ঘর মিনারের উপরে করলে সুন্নত পালনে ত্রুটি হয় না এবং আযান চলা অবস্থায় মাইক বন্ধ হলেও আযান পুরা করা যায়।

৭। দাঁড়িয়ে আযান দেওয়াই সুন্নত। ইবনুল মুনযির বলেন, ‘যাঁদের নিকট হতে ইলম সংরক্ষণ করা হয় তাঁরা এ বিষয়ে একমত যে, মুআযযিনের দাঁড়িয়ে আযান দেওয়াই সুন্নত।’ (ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ১/২৪১)

অবশ্য কোন অসুবিধার ক্ষেত্রে বসে আযান দেওয়াও দোষাবহ্‌ নয়। যেমন সাহাবী আবূ যায়দ (রাঃ) কোন জিহাদে গিয়ে তাঁর পা ক্ষত হলে বসে আযান দিতেন। (আষরাম, বায়হাকী ১/৩৯২, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ২২৫নং)

৮। আযানের সময় কেবলামুখ হওয়া মুস্তাহাব। পূর্বে উল্লেখিত আব্দুল্লাহ বিন যায়দের হাদীসের এক বর্ণনায় আছে যে, এক ফিরিশ্‌তা আসমান থেকে অবতীর্ণ হয়ে এক পোড়ো বাড়ির দেওয়ালের উপর কেবলামুখে খাড়া হলেন---। (মুসনাদ ইসহাক বিন রাহওয়াইহ্‌, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ১/২৫০)

আযানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ্‌’ বলতে হবে এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। বলা উত্তম হলে নিশ্চয় এর কোন নির্দেশ থাকত। (রিসালাতুন ইলা মুআযযিন ৫১পৃ:)

৯। শব্দ জোর করার উদ্দেশ্যে দুই কানে আঙ্গুল রেখে নেওয়া সুন্নত। বিলাল (রাঃ) আযান দেওয়ার সময় কানে আঙ্গুল রাখতেন। (আহমাদ, মুসনাদ, তিরমিযী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ২৩০নং) অবশ্য আঙ্গুল দেওয়াটা জরুরী নয়। যেমন ইবনে উমার (রাঃ) আযান দেওয়ার সময় কানে আঙ্গুল রাখতেন না। (বুখারী, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/১৩৫)

ইবনে হাজার (রহঃ) বলেন, ‘নির্দিষ্ট করে কোন্‌ আঙ্গুলকে কানে রাখতে হবে সে বিষয়ে কোন নির্দেশ আসে নি।’ (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/১৩৭)

১০। উপযুক্ত মুআযযিন সেই ব্যক্তি, যার গলার আওয়াজে জোর বেশী। যেহেতু উদ্দেশ্য হল বেশী বেশী লোককে নামাযের সময় জানিয়ে মসজিদের দিকে আহ্বান করা। তাই তো সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন যায়দ (রাঃ) এর মাধ্যমে আযানের সূচনা হলেও মুআযযিন হলেন বিলাল (রাঃ)। আর তার জন্যই মহানবী (সাঃ) আব্দুল্লাহ (রাঃ) কে বললেন, “তুমি আযানের শব্দ গুলো বিলালকে শিখিয়ে দাও। কারণ, তোমার চেয়ে ওর গলার জোর বেশী।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ৪৯৯নং প্রমুখ)

অনেকে বলেছেন, এই সাথে কণ্ঠ স্বর মিষ্টি হওয়াও মুস্তাহাব। কারণ, তাহলে আযান শুনে মানুষের হৃদয় নরম হবে এবং কারো মনে আযানের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মাবেনা। (মুগনী ১/৪২৮)

কোন নির্জন প্রান্তরে একা হলেও নামাযের সময় জোরদার শব্দে আযান দেওয়া উত্তম। মহানবী (সাঃ) আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহ্‌মান (রাঃ) কে বলেছিলেন, “আমি দেখছি, তুমি ছাগল-ভেঁড়া ও মরু-ময়দান পছন্দ কর। সুতরাং তুমি যখন তোমার ছাগল-ভেঁড়ার সাথে মরু-ময়দানে থাকবে এবং নামাযের (সময় হলে) আযান দেবে, তখন যেন উচ্চস্বরে আযান দিও। কারণ, মানুষ, জিন অথবা যে কেউই মুআযযিনের সামান্য শব্দও শুনতে পাবে, সে তার জন্য কিয়ামতে সাক্ষ্য দেবে।” (মালেক, মুঅত্তা, বুখারী, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, মিশকাত ৬৫৬নং)

উচ্চস্বর বাঞ্জিত বলেই আযানে মাইক্রোফোন ব্যবহার (বিদআত) দূষনীয় নয়। বরং এ জন্য মাইক মুসলিমদের পক্ষে আল্লাহর এক বিশেষ নেয়ামত। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ২/৪৬)

১১। আযান ও ইকামতে তকবীরের শব্দ একটা একটা করে পৃথক পৃথক না বলা; বরং জোড়া জোড়া এক সাথে বলা বিধেয়। যেহেতু মহানবী (সাঃ) বলেন, “মুআযযিন যখন বলে, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার’ এবং তোমাদের কেউ তার জওয়াবে বলে, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার’---।” (মুসলিম,  আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, সহিহ তারগিব ২৪৪নং)

১২। আযান টেনে টেনে হলেও গানের মত সুললিত কণ্ঠে লম্বা টান টানা মাকরুহ। সলফদের এক জামাআত এরুপ টানাকে অপছন্দ করেছেন। মালেক বিন আনাস প্রমুখ উলামাগণের নিকট তা মাকরুহ বলে বর্ণিত আছে। (তালবীসু ইবলীস, ইবনুল জাওযী ১৬৮পৃ:) উমার বিন আব্দুল আযীযের যুগে একজন মুআযযিন আযানে গানের মত টান দিলে তিনি তাকে বললেন, ‘সাধারণ (সাদা-সিধা) ভাবে আযান দাও। নচেৎ আমাদের নিকট থেকে দূর হয়ে যাও!’ (ইআশা:, বুখারী, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/১০৫)

১৩। ‘হাইয়্যা আলাস সলা-হ্‌’ ও ‘---ফালা-হ্‌’ বলার সময় ডানে-বামে মুখ ফিরানো সুন্নত। আবূ জুহাইফাহ্‌ বলেন, আমি বিলালকে আযান দিতে দেখেছি। তিনি ‘হাইয়্যা আলাস সলা-হ্‌,হাইয়্যা আলাল ফালা-হ্‌’ বলার সময় তাঁর মুখকে এদিক ওদিক ডানে-বামে ফিরাতেন। (বুখারী ৬৩৪নং, মুসলিম,  আবূদাঊদ, সুনান ৫২০নং, নাসাঈ, সুনান)

২ বার ‘হাইয়্যা আলাস স্বলাহ্‌’ বলার সময় ডান দিকে এবং ‘---ফালা-হ্‌’ বলার সময় বাম দিকে মুখ ফিরানো যায়। এরুপ আমলই উক্ত হাদীসের অর্থের কাছাকাছি। পক্ষান্তরে প্রথমবার ‘হাইয়্য আলাস সলা-হ্‌’ বলার সময় ডান দিকে, তারপর দ্বিতীয়বার বলার সময় বাম দিকে, অনুরুপ ‘---ফালা-হ্‌’ বলার সময় ডান দিকে এবং দ্বিতীয়বার বলার সময় বাম দিকে মুখ ফিরালেও চলে। এতে উভয় দিকেই উভয় বাক্যই বলা হয়। (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/১৩৬) উক্ত উভয় প্রকার আমলের মধ্যে কোন একটিকে নির্দিষ্ট করার ব্যাপারে কোন সহীহ হাদীস নেই।

আযান মাইক্রো ফোনে ঘরের ভিতরে হলেও উক্ত সুন্নাত ত্যাগ করা উচিৎ নয়। (রিসালাতুন ইলা মুআযযিন ৩০পৃ:)

১৪। মুআযযিনের কর্তব্য যথা সময়ে আযান দেওয়া। কারণ, তার আযানের উপর লোকেদের নামায-রোযা শুদ্ধ-অশুদ্ধ হওয়া নির্ভর করে। অসময়ে আযান দিলে নামায ও রোযা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সুতরাং সময় জেনে আযান দেওয়া জরুরী। আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “মুআযযিনগণ লোকেদের নামায ও সেহ্‌রীর জিম্মেদার।” (বায়হাকী ১/৪২৬, ইর: ১/২৩৯)

তিনি আরো বলেন, “ইমাম (লোকেদের) যামিন, আর মুআযযিন হল তাদের (নামায-রোযার) জিম্মেদার। হে আল্লাহ! তুমি ইমামগণকে পথপ্রদর্শন কর এবং মুআযযিনগণকে ক্ষমা করে দাও।” এক ব্যক্তি বলল, ‘এ কথা শুনিয়ে আপনি তো আমাদেরকে আযানে প্রতিযোগিতা করতে লাগিয়ে দিলেন।’ তিনি বললেন, “তোমাদের পরে এমন যুগ আসবে, যে যুগের নিকৃষ্ট শ্রেণীর মানুষরাই হবে মুআযযিন।” (আহমাদ, মুসনাদ, তাব:, বায়হাকী, ইবনে আসাকের প্রমুখ, ইর: ২১৭নং)

আযানের জওয়াব

আযান শুরু হলে চুপ থেকে শুনে তার জওয়াব দেওয়া বিধেয় (সুন্নত)। মুআযযিন ‘আল্লাহু আকবার’ বললে, শ্রোতাও তার জবাবে ‘আল্লাহু আকবার’ বলবে। মুআযযিন ‘আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্‌, আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ্‌’ বললে শ্রোতা বলবে, ‘অআনা, অআনা।’ অর্থাৎ আমিও সাক্ষি দিচ্ছি, আমিও। (আবূদাঊদ, সুনান ৫২৬নং)

এই সময় নিম্নের দুআও বলতে হয়:-

وَ أَنَا أَشْهَدُ أَنْ لاَّ إِلهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ وَ (أَشْهَدُ) أَنَّ مُحَمَّداً عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ، رَضِيْتُ بِاللهِ رَباًّ وَبِمُحَمَّدٍ (সাঃ) رَسُوْلاً وَّ بِالإِسْلاَمِ دِيْناً।

উচ্চারণ:- অআনা আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু অহ্‌দাহু লা শারীকা লাহ্‌, অ (আশহাদু) আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু অরাসূলুহ্‌। রাযীতু বিল্লাহি রা ব্বাঁ উঅবিমুহাম্মাদিন (সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামা) রাসূলাঁউঅবিল ইসলামি দ্বীনা।

অর্থাৎ, আমিও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কেউ সত্য উপাস্য নেই, তিনি একক, তাঁর কোন অংশী নেই এবং মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর বান্দা ও রসূল। আল্লাহ আমার প্রতিপালক হওয়ার ব্যাপারে, মুহাম্মাদ (সাঃ) রসূল হওয়ার ব্যাপারে এবং ইসলাম আমার দ্বীন হওয়ার ব্যাপারে আমি সন্তুষ্ট।

এই দুআ পড়লে গুনাহসমূহ মাফ হয়ে যায়। (মুসলিম, সহীহ ৩৮৬, আবূদাঊদ, সুনান ৫২৫নং, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান)

আযানে মহানবী (সাঃ) এর নাম শুনে চোখে আঙ্গুল বুলানো বিদআত। এ ব্যাপারে বর্ণিত হাদীসটি জাল। (তাযকিরাহ্‌, ইবনে তাহের, রিসালাতুন ইলা মুআযযিন ৫৬পৃ:) অনুরুপ সেই সময় আঙ্গুলে চুমু খাওয়াও বিদআত।

মুআযযিন ‘হাইয়্যা আলাস স্বালাহ্‌’ ও ‘---ফালাহ্‌’ বললে জওয়াবে শ্রোতা বলবে,

لاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِالله
উচ্চারণ:- লাহাউলা অলা ক্বু ওঅতা ইল্লা বিল্লাহ্‌।

অর্থাৎ, আল্লাহর তওফীক ছাড়া পাপকর্ম ত্যাগ করা এবং সৎকর্ম করার সাধ্য কারো নেই। (মুসলিম,  আবূদাঊদ, সুনান ৫২৭নং)

মুআযযিন ‘আসস্বলাতু খাইরুম মিনান নাউম’ বললে অনুরুপ বলে জওয়াব দিতে হবে। এর জওয়াবে অন্য কোন দুআ (যেমন ‘স্বাদাকতা অবারিরতা বা বারারতা--’ বলার হাদীস নেই। (সুবুলুস সালাম ৮৭পৃ:, তুহ্‌ফাতুল আহওয়াযী ১/৫২৫)

আযান শেষ হলে মহানবী (সাঃ) এর উপর দরুদ পাঠ করে নিম্নের দুআ পড়লে কিয়ামতে তাঁর সুপারিশ নসীব হবে;

اَللّهُمَّ رَبَّ هذِهِ الدَّعْوَةِ التَّامَّةِ، وَالصَّلاَةِ الْقَائِمَةِ، آتِ مُحَمَّداً الْوَسِيْلَةَ وَالْفَضِيْلَةَ وَابْعَثْهُ مَقَاماً مَّحْمُوْداً الَّذِيْ وَعَدْتَّهُ।

 “আল্লাহুম্মা রাব্বাহা-যিহিদ দা’ওয়াতিত তা-ম্মাতি অসসালা-তিল ক্বা-ইমাহ্‌, আ-তি মুহাম্মাদানিল অসীলাতা অলফাযীলাহ্‌, অবআসহু মাক্বা-মাম মাহ্‌মূদানিল্লাযী অআত্তাহ্‌।”

অর্থাৎ, হে আল্লাহ! হে এই পরিপূর্ণ আহবান ও প্রতিষ্ঠালাভকারী নামাযের প্রভু! তুমি মুহাম্মাদ (সাঃ) কে অসীলাহ্‌ (জান্নাতের সুউচ্চ স্থান) এবং মর্যাদা দান কর। আর তাঁকে সেই মাক্বামে মাহ্‌মূদ (প্রশংসিত স্থানে) প্রেরণ করো যার প্রতিশ্রুতি তুমি তাঁকে দান করেছ। (বুখারী ৬১৪নং, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান)

প্রকাশ যে, উক্ত দুআর মাঝে ইবনে সুন্নীর বর্ণনায় ‘অদ্দারাজাতার রাফীআহ্‌’, (তদনুরুপ লোকেদের বর্ণনায় ‘সাইয়্যিদানা মুহাম্মাদান’, অরযুক্বনা শাফাআতাহু’) এবং শেষে বাইহাকীর বর্ণনায় অতিরিক্ত ‘ইন্নাকা লা তুখলিফুল মীআদ’ প্রভৃতি শুদ্ধ নয়। (ইর: ১/২৬১)

আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “মুআযযিনকে আযান দিতে শুনলে তোমরাও ওর মতই বল। অতঃপর আমার উপর দরুদ পাঠ কর; কেননা, যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরুদ পাঠ করে, আল্লাহ এর বিনিময়ে তার উপর দশবার রহ্‌মত বর্ষণ করেন। অতঃপর তোমরা আমার জন্য আল্লাহর নিকট অসীলা প্রার্থনা কর; কারণ, অসীলা হল জান্নাতের এমন এক সুউচ্চ স্থান, যা আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে একটি বান্দার জন্য উপযুক্ত। আর আমি আশা রাখি যে, সেই বান্দা আমিই। সুতরাং যে ব্যক্তি আমার জন্য ঐ অসীলা প্রার্থনা করবে, তার জন্য আমার শাফাআত (সুপারিশ) অবধার্য হয়ে যাবে।” (মুসলিম, সহীহ প্রমুখ, মিশকাত ৬৫৭নং)

আযানের পূর্বে শুরুতে (উচ্চস্বরে বা মাইক্রোফোনে) দরুদ বা তাসবীহ পাঠ এবং অনুরুপ শেষেও দরুদ বা উক্ত দুআ (জোরে-শোরে) পাঠ বিদআত। শিখাবার উদ্দেশ্যেও আল্লাহর নবী (সাঃ) বা সলফদের কেউই এরুপ করে যান নি। (ইবনে বায, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/৯২, টীকা) যেমন আযান  ও ইকামতের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ্‌’ পড়া বিদআত। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ১/১৩২) তদ্রুপ উপরোক্ত ঐ দুআ  পড়ার সময় হাত তোলাও বিধেয় নয়। বিধেয় নয় আযান শুরু হলে মহিলাদের মাথায় কাপড় নেওয়া।

জ্ঞাতব্য যে, আযানের জওয়াব দেবে প্রত্যেক সেই ব্যক্তি যার জন্য আল্লাহর যিক্‌র করা বৈধ। অতএব পবিত্র অবস্থায়, অপবিত্র বা মাসিক অবস্থায় নারী-পুরুষ সকলের জন্যই আযানের জওয়াব দেওয়া মুস্তাহাব। অবশ্য নামায পড়া অবস্থায়, প্রস্রাব-পায়খানা করা অথবা বাথরুমে থাকা অবস্থায় এবং স্ত্রী-মিলন রত অবস্থায় আযানের উত্তর দেওয়া বৈধ নয়। এসব কাজ থেকে ফারেগ হওয়ার পর বাকী আযানের উত্তর দেওয়া বিধেয়।

যে ব্যক্তি কুরআন তেলাওয়াত বা যিক্‌র করে অথবা দারস দেয় সে ব্যক্তি তা বন্ধ রেখে আযানের জওয়াব দিয়ে পুনরায় তা ছেড়ে রাখা জায়গা থেকে শুরু করবে। (ফিকহুস সুন্নাহ্‌ ১/৮৭)

খাওয়ার সময় আযান হলে খেতে খেতেও আযানের জওয়াব দিতে এবং তারপর দুআ পড়তে কোন বাধা নেই। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৫৩২)

আযানের সময় দুআ কবুল হয়ে থাকে। (আবূদাঊদ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, জামে ৩০৭৯ নং)

মসজিদ ছাড়া অন্য স্থানে আযান

ভয়, শত্রুতা প্রভৃতির কারণে মসজিদে যেতে বাধা থাকলে, মসজিদ বহু দূরে হলে (এবং আযান শুনতে না পেলে), সফরে কোন নির্জন প্রান্তরে থাকলে, যে জায়গায় থাকবে সেই জায়গাতেই নামাযের সময় হলে আযান-ইকামত দিয়ে নামায আদায় করতে হবে। একা হলে আযান ওয়াজেব না হলেও সুন্নত অবশ্যই বটে।

মহানবী (সাঃ) বলেন, “যখন সফরে থাকবে, তখন তোমরা আযান দিও এবং ইকামত দিও। আর তোমাদের মধ্যে যে বড় সে ইমামতি করো।” (বুখারী, মিশকাত ৬৮২নং)

তাছাড়া আল্লাহর নবী (সাঃ) এবং সাহাবাগণ সফরে থাকলে ফাঁকা মাঠে আযান দিয়ে নামায পড়েছেন। (মুসলিম, সহীহ ৬৮১নং, প্রমুখ)

মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমার প্রতিপালক বিস্মিত হন পর্বত চূড়ায় সেই ছাগলের রাখালকে দেখে যে নামাযের জন্য আযান দিয়ে (সেখানেই) নামায আদায় করে; আল্লাহ  আযযা অজাল্ল্‌ বলেন, “তোমরা আমার এই বান্দাকে লক্ষ্য কর, (এমন জায়গাতেও) আযান দিয়ে নামায কায়েম করছে! সে আমাকে ভয় করে। আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম এবং জান্নাতে প্রবেশ করালাম।” (আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, সহিহ তারগিব ২৩৯ নং)

তিনি বলেন, “কোন ব্যক্তি যখন কোন বৃক্ষ-পানিহীন প্রান্তরে থাকে, অতঃপর সেখানে নামাযের সময় উপস্থিত হয়, তখন সে যেন ওযু করে। পানি না পেলে যেন তায়াম্মুম করে। অতঃপর সে যদি শুধু ইকামত দিয়ে নামায পড়ে, তাহলে তার সাথে তার সঙ্গী দুই ফিরিশ্‌তা নামায পড়েন। কিন্তু সে যদি আযান দিয়ে ও ইকামত দিয়ে নামায পড়ে, তাহলে তার পশ্চাতে আল্লাহর এত ফিরিশ্‌তা নামায পড়েন, যাদের দুই প্রান্ত নজরে আসে না!” (আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ, সহিহ তারগিব ২৪১নং)

আর একদা তিনি আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহ্‌মানকে মরুভূমিতে ছাগপালে থাকাকালে নামাযের জন্য উচ্চশব্দে আযান দিতে আদেশ করেছিলেন। (বুখারী প্রমুখ, মিশকাত ৬৫৬নং)

কাযা নামাযের জন্য আযান

মসজিদে কেউ আযান না দিলে এবং শহরে বা গ্রামে থাকতে সকলের নামায কাযা হলে অথবা সফরে পুরো জামাআতের বা একাকীর নামায কাযা হলে অসময়েও আযান-ইকামত দিয়ে নামায পড়া কর্তব্য।

একদা মহানবী (সাঃ) সাহাবাসহ্‌ সফরে থাকাকালীন তাঁদের ফজরের নামায কাযা হয়ে যায়। সূর্য ওঠার পর তেজ হয়ে এলে ঐ স্থান ত্যাগ করে অন্য স্থানে গিয়ে বিলাল (রাঃ) আযান দেন। অতঃপর যথা নিয়মে ফজরের নামায আদায় করেন। (মুসলিম, সহীহ ৬৮১নং, প্রমুখ)

যেমন খন্দকের যুদ্ধের সময় একদা সকলের চার ওয়াক্তের নামায ক্বাযা হলে, এশার পর আযান দিয়ে যোহ্‌র, আসর, মাগরিব ও এশার নামায আদায় করেছিলেন। (আহমাদ, মুসনাদ প্রমুখ, ইর: ১/২৫৭)

সময় পার হলে আযান

নামাযের সময় বাকী থাকলে এবং আযানের যথা সময় পার হয়ে গেলে খুব দেরীতে হলেও আযান দিয়েই নামায পড়তে হবে। অবশ্য গ্রামে বা শহরে অন্যান্য মসজিদে আযান হয়ে থাকলে যে মসজিদে আযান দিতে খুব দেরী হয়ে গেছে সে মসজিদে আযান না দিলেও চলবে। তবে দেরী সামান্য হলে আযান দেওয়াই উত্তম। কিন্তু গ্রামে এ ছাড়া অন্য মসজিদ না থাকলে খুব দেরী হয়ে গেলেও আযান দেওয়া জরুরী। (ফ: ইবনে বায, রিসালাতুন ইলা মুআযযিন ৬৭পৃ:, তুহ্‌ফাতুল ইখওয়ান, ইবনে বায ৭৭পৃ:)

খাস মহিলা মহলে মহিলাদের আযান ও ইকামত

হযরত আয়েশা (রাঃ) এর আযান ও ইকামত দেওয়ার ব্যাপারে বর্ণিত হাদীস সহীহ নয়। অবশ্য বাইহাকীতে আছে, আম্‌র বিন আবী সালামাহ্‌ বলেন, আমি সওবানকে জিজ্ঞাসা করলাম যে, ‘মেয়েরা কি ইকামত দিতে পারে?’ উত্তরে তিনি তাঁর পিতা হতে বর্ণনার কথা উল্লেখ করে বললেন, ‘মকহুল বলেছেন, যদি মহিলারা আযান-ইকামত দেয় তবে তা আফযল। আর যদি শুধু ইকামত দেয়, তবে তাও যথেষ্ট।’ সওবান বলেন, যুহ্‌রী উরওয়া হতে এবং তিনি হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি (আয়েশা) বলেছেন, ‘আমরা বিনা ইকামতেই নামায পড়তাম।’ (এর সনদটি হাসান।)

ইমাম বাইহাকী বলেন, ‘প্রথমোক্ত আসারের সাথে -যদি এই আসার সহীহ হয় তাহলে উভয়ের মধ্যে- পরস্পর বিরোধিতা নেই। কারণ, হতে পারে যে, জায়েয বর্ণনার উদ্দেশ্যে তিনি উভয় প্রকারের আমল (কখনো এরুপ, কখনো ঐরুপ) করেছেন। আর আল্লাহই অধিক জানেন।’

আল্লামা আলবানী বলেন, এ ব্যাপারে সঠিক অভিমত হল নবাব সিদ্দীক হাসান খানের; তিনি বলেছেন, ‘---আর প্রকাশ যে, মহিলারা আমলে পুরুষদের মতই। কারণ, মহিলারা পুরুষদের সহোদরা। পুরুষদেরকে যা করতে আদেশ হয়, সে আদেশ মহিলাদের উপরেও বর্তায়। পক্ষান্তরে তাদের পক্ষে আযান-ইকামত ওয়াজেব না হওয়ার ব্যাপারে কোন গ্রহণযোগ্য দলীল নেই। আযান না থাকার ব্যাপারে বর্ণিত হাদীসের সনদের কিছু বর্ণনাকারী পরিত্যক্ত; যাদের হাদীস দলীলযোগ্য নয়। সুতরাং মহিলাদেরকে সাধারণ এ নির্দেশ থেকে খারিজ করার মত কোন নির্ভরযোগ্য দলীল থাকলে উত্তম; নচেৎ ওরাও পুরুষদের মতই।’ (আর-রওযাতুন নাদিয়্যাহ্‌ ১/৭৯, সিলসিলাহ যায়ীফাহ, আলবানী ২/২৭১)

ঝড়-বৃষ্টির সময় আযানের বিশেষ শব্দ

ঝড়-বৃষ্টি বা অতিরিক্ত ঠান্ডার সময় মসজিদ আসতে কষ্ট হলে মুআযযিন আযানে নিম্নলিখিত শব্দ অতিরিক্ত বলব

‘হাইয়্যা আলাস স্বলাহ্‌’ ও ‘---ফালাহ্‌’র পরিবর্তে:-

صَلُّوْا فِيْ بُيُوْتِكُمْ  (স্বল্লূ ফী বুয়ূতিকুম)। (বুখারী ৯০১, মুসলিম, সহীহ ৬৯৯নং)

অথবাالصَّلاَةُ فِي الرِّحَال(আসস্বলা-তু ফির্রিহাল)। (বুখারী ৬১৬নং)

অথবা যথানিয়মে আযান দেওয়ার শেষে:-

أَلاَ صَلُّوْا فِي الرِّحَال(আলা স্বল্লূ ফির্রিহাল)। (বুখারী ৬৩২, মুসলিম, সহীহ ৬৯৭নং)

অথবা أَلاَ صَلُّوْا فِيْ رِحَالِكُم(আলা স্বল্লূ ফী রিহা-লিকুম)। (বুখারী ৬৩২, মুসলিম, সহীহ ৬৯৭নং)

অথবা  ومَنْ قَعَدَ فَلاَ حَرَج  (অমান ক্বাআদা ফালাহারাজ)। (ইআশা:, বায়হাকী ১/৩৯৮, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৬০৫নং)

এগুলোর অর্থ হল, ‘শোনো! তোমরা নিজ নিজ বাসায় নামায পড়ে নাও। জামাআতে হাজির না হলে কোন দোষ নেই।

তাহাজ্জুদ ও সেহ্‌রী বা সাহারীর আযান

মহানবী (সাঃ) বলেন, বিলাল রাতে (ফজরের পূর্বে) আযান দেয়। সুতরাং ইবনে উম্মে মাকতূম (ফজরের) আযান না দেওয়া পর্যন্ত তোমরা খাও ও পান কর।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৬৮০নং)

উক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ফজরের পূর্বে তাহাজ্জুদ ও সেহ্‌রীর আযান মহানবী (সাঃ) এর যুগে প্রচলিত ছিল এবং আজও পর্যন্ত সে সুন্নত মক্কা-মদ্বীনা সহ্‌ সঊদী আরবের প্রায় সকল স্থানে সেহ্‌রীর ঐ আযান (বিশেষ করে রমযানে) শুনতে পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে আমাদের দেশে প্রায় সকল স্থানে ঐ সময়ে আযানের পরিবর্তে শোনা যায় কুরআন ও গজল পাঠ! সুতরাং এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, সুন্নতের জায়গা দখল করেছে মনগড়া বিদআত।

অনেকে বলে থাকেন, উভয় সময়ে আযান হলে লোকেরা গোলমালে পড়বে; সেটা সেহ্‌রীর না ফজরের আযান -এ নিয়ে সন্দেহে পড়বে। কিন্তু পৃথক পৃথক উভয় সময়ের জন্য নির্দিষ্ট দু’জন  মুআযযিন  আযান  দিলে  গোলমালের  ভয়  থাকে  না।  তা  ছাড়া  সেহ্‌রীর  আযানে

 الصَّلاَةُ خَيْرٌ مِّنَ النَّوْم শব্দ থাকবে না। অতএব সকল প্রকার ওজর-আপত্তি ত্যাগ করে বিদআত বর্জন করতে এবং সুন্নাহর উপর আমল করতে আল্লাহ আমাদের তওফীক দিন। আমীন।

সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে আযান

আবূ রাফে’ (রাঃ) বলেন, আমি আল্লাহর রসূল (সাঃ) কে দেখেছি, ফাতেমা (রাঃ) হাসান বিন আলীকে প্রসব করলে তিনি তাঁর (হাসানের) কানে নামাযের আযান দিলেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৫১০৫, তিরমিযী, সুনান ১৫৬৬, মিশকাত ৪১৫৭ নং)

সুতরাং ছেলে-মেয়ে সকলের কানে ঐ সময় নামাযের জন্য আযান দেওয়ার মতই আযান দেওয়া সুন্নত। (মতান্তরে হাদীসটি যয়ীফ, অতএব  এ সময় আযান সুন্নত নয়।) পক্ষান্তরে ডান কানে আযান এবং বাম কানে ইকামত দিলে ‘উম্মুস সিবয়্যান’ (ভূত, পেত(?) বা এক প্রকার রোগ) কোন ক্ষতি করতে না পারারহাদীসটি জাল। (সিলসিলাহ যায়ীফাহ, আলবানী ৩২১নং, জামে ৫৮৮১, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ১১৭৪নং)

জিন-ভূতের ভয়ে আযান

শয়তান জিন মানুষকে ভয় দেখায়। ভয় পেয়ে আযান দিলে জিন বা শয়তান বা ভূত সব পালিয়ে যায়।

সুহাইল বলেন, একদা আমার আব্বা আমাকে বনী হারেসায় পাঠান। আমার সঙ্গে ছিল এক সঙ্গী। এক বাগান হতে কে যেন নাম ধরে আমার সঙ্গীকে ডাক দিল। আমার সঙ্গী বাগানে খুঁজে দেখল; কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। ফিরে এলে আব্বার নিকট সে কথা উল্লেখ করলাম। আব্বা বললেন, যদি জানতাম যে, তুমি এই দেখতে পাবে, তাহলে তোমাকে পাঠাতাম না। তবে শোন! যখন (এই ধরনের) কোন শব্দ শুনবে, তখন নামাযের মত আযান দিও। কারণ, আমি আবূ হুরাইরা (রাঃ) কে আল্লাহর রসূল (সাঃ) হতে হাদীস বর্ণনা করতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, “নামাযের আযান দেওয়া হলে শয়তান পাদতে পাদতে পালিয়ে যায়!” (মুসলিম, সহীহ ৩৮৯নং)

আযানের পর মসজিদ থেকে বের হওয়া

আযান হয়ে গেলে বিনা ওজরে নামায না পড়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে যাওয়া বৈধ নয়।

মহানবী (সাঃ) বলেন, “মসজিদে অবস্থানকালে আযান হলেই তোমাদের কেউ যেন নামায না পড়া পর্যন্ত মসজিদ থেকে বের না হয়।” (আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ১০৭৪ নং)

এক ব্যক্তি আযানের পর মসজিদ হতে বের হয়ে গেলে আবূ হুরাইরা তার প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন, ‘এ লোকটা তো আবুল কাসেম (সাঃ) এর নাফরমানী করল।’ (মুসলিম,  আবূদাঊদ, সুনান ৫৩৬ নং, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, দারেমী, সুনান, বায়হাকী)

আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তির মসজিদে থাকা অবস্থায় আযান হয়, অতঃপর বিনা কোন প্রয়োজনে বের হয়ে যায় এবং ফিরে আসার ইচ্ছা না রাখে সে ব্যক্তি মুনাফিক।” (ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, সহিহ তারগিব ১৫৭নং)

আযান ও ইকামতের মাঝে ব্যবধান

আযান ও ইকামতের মাঝে কতটা বিরতি থাকবে সে ব্যাপারে হাদীস শরীফে কোন স্পষ্ট ইঙ্গিত ও উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে আযান হয় জামাআত ডাকার জন্য। আর এটাই স্বাভাবিক যে, আযানের পর অনেকে ওযু করবে। সুতরাং ওযু করার মত সময় দিতে হবে। তাছাড়া ফরয নামাযের পূর্বে যে সুন্নাতে রাতেবাহ্‌ বা মুআক্কাদাহ আছে তাও পড়ার জন্য সময় দিতে হবে। মহানবী (সাঃ) বলেন, “প্রত্যেক আযান ও ইকামতের মাঝে নামায আছে।” এইরুপ তিনবার বলার পর শেষে বললেন, “যে চাইবে তার জন্য।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৬৬২নং)

মাগরেবের আযানের পরেও সত্বর জামাআত শুরু করা উচিৎ নয়। যদিও সময় সংকীর্ণ তবুও জামাআত হওয়ার পূর্বে নামায আছে। সুতরাং যার সেই নামায পড়ার ইচ্ছা তাকে সেই নামায পড়তে সময় দেওয়া উচিৎ।

আনাস (রাঃ) বলেন, আমরা মদ্বীনায় ছিলাম। মুআযযিন যখন মাগরেবের আযান দিত, তখন লোকেরা প্রতিযোগিতার সাথে মসজিদের খাম্বাগুলোর পশ্চাতে ২ রাকআত নামায পড়তে লেগে যেত। এমনকি যদি কোন অজানা লোক এসে মসজিদে প্রবেশ করত, তাহলে এত লোকের নামায পড়া দেখে সে মনে করত, হয়তো মাগরেবের জামাআত হয়ে গেছে। (এবং ওরা পরের সুন্নত পড়ছে।) (মুসলিম,  মিশকাত ১১৮০ নং)

আযান ও ইকামতের মাঝে দুআ

আযান হওয়ার পর এবং ইকামত হওয়ার পূর্বের সময়ে দুআ কবুল হয়ে থাকে। তাই এই সময় দুনিয়া ও আখেরাতের মঙ্গল আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা উচিৎ। মহানবী (সাঃ)  বলেন, “আযান ও ইকামতের মাঝে দুআ রদ্দ্‌ করা হয় না।” (অর্থাৎ মঞ্জুর করা হয়।) (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ৫২১নং, তিরমিযী, সুনান)

এক বর্ণনায় আছে, “সুতরাং তোমরা এ সময়ে দুআ কর।” (জামে ৩৪০৫ নং)

তিনি আরো বলেন, “দু’টি সময়ে দুআ (প্রার্থনা)কারীর দুআ রদ্দ্‌ হয় না; যখন নামাযের ইকামত হয় এবং জিহাদের কাতারে।” (হাকেম, মুস্তাদরাক, মালেক, মুঅত্তা, সহিহ তারগিব ২৬০ নং)

ইকামত

যেমন দুই মুআযযিনের আযান দুই রকম ছিল, তেমনি উভয়ের ইকামতও ছিল দুই রকম; জোড় এবং বিজোড়। বিলাল (রাঃ) কে আযান ডবল ডবল শব্দে এবং ইকামত ‘ক্বাদ ক্বা-মাতিস সলা-হ্‌’ ছাড়া (অন্যান্য) বাক্যাবলীকে একক একক শব্দে বলতে আদেশ করা হয়েছিল। (বুখারী, মুসলিম, সহীহ প্রমুখ, মিশকাত ৬৪১ নং)

সুতরাং বিলালের উক্ত হাদীসের ভিত্তিতে ইকামত হবে ৯টি বাক্যে; ‘ক্বাদ ক্বামাতিস সালাহ্‌ ২বার এবং বাকী হবে ১ বার করে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ২/৫৯)

কিন্তু আব্দুল্লাহ বিন যায়দকে স্বপ্নে শিখানো হয়েছিল নিম্নরুপ ইকামত, আর এটাই প্রসিদ্ধ:-

اَللهُ أَكْبَر اَللهُ أَكْبَر، أَشْهَدُ أَنْ لاَّ إِلهَ إِلاَّ الله، أَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّداً رَّسُوْلُ الله، حَيَّ عَلَى الصَّلاَة،

حَيَّ عَلَى الْفَلاَح، قَدْ قَامَتِ الصَّلاَة، قَدْ قَامَتِ الصَّلاَة، اَللهُ أَكْبَر اَللهُ أَكْبَر، لاَ إِلهَ إِلاَّ الله،

আল্লাহু আকবার ২ বার। আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্‌ ১ বার। আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ্‌ ১ বার। হাইয়্যা আলাস স্বলাহ্‌ ১ বার। হাইয়্যা আলাল ফালাহ্‌ ১ বার। ক্বাদ ক্বামাতিস স্বলাহ্‌ (অর্থাৎ নামায প্রতিষ্ঠা বা শুরু হল) ২ বার। আল্লাহু আকবার ২বার এবং লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্‌ ১ বার। (আবূদাঊদ, সুনান ৪৯৯, দারেমী, সুনান ১১৭১, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ ৩৭০, ইবনে হিব্বান, সহীহ ১৬৭১নং, বায়হাকী ১/৩৯১)

উল্লেখ্য যে, যারা মুআযযিন আবূ মাহ্‌যূরার মত তারজী’ আযান দেয়, তাদের উচিৎ তাঁর মতই ইকামত দেওয়া। তিনি বলেন, ‘মহানবী (সাঃ) তাঁকে আযানের ১৯টি এবং ইকামতের ১৭টি বাক্য শিখিয়েছেন।’ (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, দারেমী, সুনান, মিশকাত ৬৪৪নং)

সুতরাং তাঁর ইকামত ছিল বিলাল (রাঃ) এর আযানের মতই। তবে তাতে ‘হাইয়্যা আলাল ফালাহ্‌’ এর পর অতিরিক্ত ছিল ‘ক্বাদ ক্বামাতিস স্বলাহ্‌’ ২ বার। (আবূদাঊদ, সুনান ৫০২নং)

ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ্‌ (রহঃ) বলেন, আহলে হাদীস ও তাঁদের সমর্থকদের নিকট সঠিক সিদ্ধান্ত এই যে, মহানবী (সাঃ) হতে যা কিছু শুদ্ধভাবে প্রমাণিত আছে তার প্রত্যেকটার উপর আমল করতে হবে। আর তাঁরা ঐ আমলের কোনটিকেও অপছন্দ করেন না। কেননা, আযান ও ইকামতের পদ্ধতি একাধিক হওয়ার ব্যাপারটা ক্বিরাআত, তাশাহহুদ প্রভৃতির পদ্ধতি একাধিক হওয়ার মতই।’ (মাজমূউ ফাতাওয়া ২২/৩৩৫, ২২/৬৬) সুতরাং উভয় প্রকারই আযান ও ইকামত আমলযোগ্য। আর বৈধ নয় এ নিয়ে কাদা ছুঁড়াছুঁড়ি।

প্রকাশ থাকে যে, ভুলে ইকামত না দিয়ে (একাকী অথবা জামাআতী) নামায পড়ে ফেললে নামাযের কোন ক্ষতি হয় না। ইকামত নামায হতে পৃথক জিনিস। অতএব ঐ ভুলের জন্য সহু সিজদা বিধেয় নয়। (তুহ্‌ফাতুল ইখওয়ান, ইবনে বায ৭৮পৃ:)

ইকামতের জওয়াব

ইকামতকে দ্বিতীয় আযান বলা হয়, তাই ইকামতও এক প্রকার আযান। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৪৯) সুতরাং এর জওয়াবও আযানের মতই। অবশ্য ‘হাইয়্যা আলাস সলা-হ্‌’ ও ‘--ফালাহ্‌’ এর জওয়াবে ‘লাহাউলা অলা ক্বুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ্‌’ এবং শেষে (সময় পেলে) দরুদ ও অসীলার দুআ পাঠ করা বিধেয়। যেহেতু হাদীস শরীফে মুআযযিনের জওয়াব (তার মতই) বলতে এবং তার শেষে দরুদ ও অসীলার দুআ পড়তে আমাদেরকে আদেশ করা হয়েছে। (মুসলিম,  মিশকাত ৬৫৭নং)

উক্ত হাদীসের ভিত্তিতেই ‘ক্বাদ ক্বামাতিস স্বলাহ্‌’ এর জওয়াবে ‘ক্বাদ ক্বামাতিস স্বলাহ্‌’ই বলতে হবে। নচেৎ এর জওয়াবে ‘আক্বামাহুল্লাহু অআদামাহা’ বলার হাদীস শুদ্ধ নয়। আর যয়ীফ হাদীসকে ভিত্তি করে শরীয়তের কোন আমল ও ইবাদত বৈধ নয়। (দেখুন, মিশকাত, আলবানীর টীকা ১/১২১) (মতান্তরে যেহেতু ইকামতের জবাবে কোন স্পষ্ট সহীহ হাদীস নেই, তাই ইকামতের জবাব দেওয়া সুন্নত নয়। অল্লাহু আ’লাম।)

ইকামত কে দেবে?

ইমাম ও মুক্তাদীগণের মধ্যে যে কেউ ইকামত দিতে পারে। যে আযান দিয়েছে তারই ইকামত দেওয়া জরুরী নয়। আর এ ব্যাপারে যে হাদীস এসেছে তা শুদ্ধ নয়। (সিলসিলাহ যায়ীফাহ, আলবানী ৩৫নং)

যয়ীফ হাদীসকে ভিত্তি করেই বহু স্থানে মুআযযিন ছাড়া অন্য কেউ ইকামত দিলে তার প্রতি চোখ তোলা হয়! আবার এর চেয়ে আরো বিস্ময়ের কথা এই যে, খালি মাথায় ইকামত দিলে অনেক জায়গায় ইকামত পুনরায় ফিরিয়ে বলা হয়! কারণ, তাদের নিকট আযান, ইকামত, নামায, যবাই প্রভৃতির সময় টুপী না হলেও তালপাতা বা প্লাস্টিকের ডালি, নচেৎ গা-মোছা গামছা, নতুবা নাক-মোছা রুমাল অথবা অন্য কিছু দিয়ে মাথা ঢাকা জরুরী!!

প্রকাশ যে, ইমামকে উপস্থিত না দেখা পর্যন্ত ইকামত দেওয়া বিধেয় নয়। (মুসলিম,  আবূদাঊদ, সুনান ৫৩৭নং)

ইকামত ও নামায শুরু করার মাঝে ব্যবধান

আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “নামাযের ইকামত হয়ে গেলে তোমরা আমাকে না দেখা পর্যন্ত (নামাযের জন্য) দাঁড়াও না।” (বুখারী ৬৩৭নং)

যেমন ইকামত হয়ে গেলে তাড়াহুড়ো করে দাঁড়ানোও উচিৎ নয়। কারণ উক্তহাদীসের এক বর্ণনায় তিনি বলেন, “তোমাদের মাঝে যেন ধীরতা ও শান্তভাব থাকে।” (ঐ ৬৩৮নং) যেহেতু রাজাধিরাজের দরবারে কোন প্রকারের হৈ-হুল্লোড় ও তাড়াহুড়ো চলে না। বলা বাহুল্য এই দরবারে থাকবে শত আদব, শত বিনয়, ধীরতা ও স্থিরতা।

হুমাইদ বলেন, আমি সাবেত আল-বুনানীকে ইকামতের পর কথাবার্তা বলার বৈধতার ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি আনাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীস শুনালেন; ‘একদা নামাযের ইকামত হয়ে গেলে এক ব্যক্তি নবী (সাঃ) কে নামাযে প্রবেশ করতে আটকে রেখেছিল।’ (বুখারী ৬৪৩নং) ‘মসজিদের এক প্রান্তে গোপনে কথা বলতে লাগলে উপস্থিত মুসল্লীগণ ঘুমে ঢলে পড়েছিল।’ (ঐ ৬৪২নং)

একদা নামাযের ইকামত হয়ে গেলে মুসল্লীগণ কাতার সোজা করে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আল্লাহর রসূল (সাঃ) হুজরা হতে বের হয়ে যখন ইমামতির জায়গায় এলেন, তখন তাঁর মনে পড়ল যে, তিনি নাপাকীর গোসল করেননি। তিনি সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, “তোমরা স্বস্থানে দন্ডায়মান থাক।” অতঃপর তিনি হুজরায় ফিরে গিয়ে গোসল করলেন। তিনি যখন বের হয়ে এলেন, তখন তাঁর মাথা হতে পানি টপকাচ্ছিল। এরপর তিনি ইমামতি করে নামায পড়লেন। (ঐ ৬৪০নং)

উক্ত হাদীস থেকে এ কথা বুঝা যায় যে, প্রয়োজনে ইকামত ও নামাযের মাঝে বেশ কিছু সময় বিরতি হলে কোন ক্ষতি হয় না। পরন্তু ইকামত ফিরিয়ে বলতে হয় না।

ইকামত হওয়ার পর কোন জরুরী কথা, নামায ও কাতার বিষয়ক কথা বলা বৈধ। তবে নামাযের প্রস্তুতি নেওয়ার পর কোন পার্থিব কথা বলা উচিৎ নয়। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৫১)

ইকামত শুরু হলে এবং ইমাম উপস্থিত থাকলে প্রত্যেকে নিজের সুবিধামত উঠে নামাযের জন্য দন্ডায়মান হবে। ইকামতের শুরুতে, মাঝে বা শেষে, যে কোন সময়ে দাঁড়ালেই চলবে। তবে এ কথার খেয়াল অবশ্যই রাখা উচিৎ, যাতে ইমামের সাথে তকবীরে তাহ্‌রীমা ছুটে না যায়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/১০)

মসজিদ ও নামায পড়ার জায়গা

মসজিদ ও নামায পড়ার জায়গা সম্পর্কিত

মহানবী (সাঃ) বলেন, “---আর সারা পৃথিবীকে আমার জন্য মসজিদ (নামাযের জায়গা) এবং পবিত্রতার উপকরণ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং আমার উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তির নিকট যে কোন স্থানে নামাযের সময় এসে উপস্থিত হবে , সে যেন সেখানেই নামায পড়ে নেয়।” (বুখারী ৪৩৮নং, মুসলিম প্রমুখ)

কবরস্থান ও গোসলখানা ছাড়া সারা পৃথিবীর (সমস্ত জায়গাই) মসজিদ (নামায ও সিজদার স্থান)। (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, দারেমী, সুনান, মিশকাত ৭৩৭নং)

একদা আবূ যার (রাঃ) মহানবী (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলেন, পৃথিবীতে সর্বপ্রথম কোন্‌ মসজিদ স্থাপিত হয়? উত্তরে তিনি বললেন, “হারাম (কা’বার) মসজিদ।” আবূ যার বললেন, তারপর কোন্‌টি? তিনি বললেন, “তারপর মসজিদুল আকসা।” আবূ যার বললেন, দুই মসজিদ স্থাপনের মাঝে ব্যবধান কত ছিল? তিনি বললেন, “চল্লিশ বছর। আর শোন, সারা পৃথিবী তোমার জন্য মসজিদ। সুতরাং যেখানেই নামাযের সময় এসে উপস্থিত হবে, সেখানেই নামায পড়ে নেবে।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৭৫৩নং)

নির্মিত গৃহ্‌ মসজিদ ছাড়া অন্য স্থানেও নামায পড়ার বৈধতা উম্মতে মুহাম্মাদিয়ার জন্য এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য।

মসজিদের মাহাত্ম

মহান আল্লাহ বলেন, وأَنَّ الْمَسَاجِدَ لِلّه অর্থাৎ, আর মসজিদসমূহ আল্লাহর।(কুরআন মাজীদ ৭২/১৮)

মহানবী (সাঃ) বলেন, “আল্লাহর নিকট পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠতম স্থান হল মসজিদ এবং সবচেয়ে নিকৃষ্টতম স্থান হল বাজার।” (মুসলিম,  মিশকাত ৬৯৬নং)

মাহাত্মপূর্ণ চারটি মসজিদ

মহানবী (সাঃ) বলেন, “তিনটি মসজিদ ছাড়া আর কোন স্থান যিয়ারতের জন্য সফর করা যাবে না; মসজিদুল হারাম, মসজিদুল আকসা ও আমার এই মসজিদ (নববী)।” (বুখারী,মুসলিম, সহীহ মিশকাত ৬৯৩)

তিনি বলেন, “মসজিদুল হারাম ছাড়া অন্যান্য মসজিদের তুলনায় আমার এই মসজিদে (নববীতে) একটি নামায হাজার নামায অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৬৯২নং)

“আর অন্যান্য মসজিদের তুলনায় মসজিদুল হারামের একটি নামায এক লক্ষ নামায অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।” (আহমাদ, মুসনাদ, বায়হাকী, জামে ৩৮৩৮, ৩৮৪১ নং)

প্রকাশ যে, এই ফযীলত মহিলাদের জন্য নয়। কারণ, তাদের জন্য স্বগৃহে নামায পড়াই উত্তম। যেমন নফল বা সুন্নত নামাযেও উক্ত সওয়াব নেই, কেননা, সুন্নত বা নফল নামায ঘরে পড়াই আফযল। অথবা মক্কা ও মদ্বীনার মহিলাদের জন্য তাদের স্বগৃহে এবং ঐ স্থানদ্বয়ে সুন্নত ও নফল নামায ঘরে পড়ার ফযীলত আরো অধিক। অল্লাহু আ’লাম।

মসজিদে নববীর একটি বিশেষ জায়গার কথা উল্লেখ করে মহানবী বলেন, “আমার গৃহ্‌ ও (আমার মসজিদের) মিম্বরের মাঝে বেহেশ্তের এক বাগান রয়েছে। আর আমার মিম্বর রয়েছে আমার হওযের উপর।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৬৯৪নং)

কুবার মসজিদ সম্বন্ধে মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি স্বগৃহে ওযু বানিয়ে কুবার মসজিদে এসে কোন নামায পড়ে, তার একটি উমরাহ্‌ করার সমান সওয়াব লাভ হয়।” (আহমাদ, মুসনাদ, নাসাঈ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, বায়হাকী, জামে ৬১৫৪ নং)

প্রথম কিবলা মসজিদুল আকসায় নামায পড়লে ৫০০ বা ১০০০ নামাযের সওয়াবের কথা কোন সহীহ হাদীসে আসে নি। (তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ২৯৩-২৯৪পৃ:) অবশ্য এক বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, হযরত সুলাইমান (আঃ) যখন ঐ মসজিদ নির্মাণ শেষ করেছিলেন, তখন আল্লাহর নিকট দুআ করেছিলেন যে, যে ব্যক্তি কেবলমাত্র নামাযের উদ্দেশ্যেই ঐ মসজিদে উপস্থিত হবে, সে ব্যক্তি যেন ঐ দিনকার মত নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসে, যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল। (নাসাঈ, সুনান ৬৬৯, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ১৪০৮ নং)

আর এক বর্ণনা মতে তাতে ২৫০ নামাযের সওয়াব আছে। মহানবী (সাঃ) বলেন, “বায়তুল মাকদিস অপেক্ষা আমার এই মসজিদে নামায চারগুণ উত্তম। আর তা হল শ্রেষ্ঠ নামাযের স্থান।” (হাকেম, মুস্তাদরাক ৪/৫০৯, বায়হাকী শুআবুল ঈমান, ত্বা, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৬/২/৯৫৪)

মসজিদ নির্মাণের ফযীলত

আল্লাহর নবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর (সন্তুষ্টি লাভের) উদ্দেশ্যে একটি মসজিদ নির্মাণ করে দেয়, আল্লাহ তার জন্য বেহেশ্তে একটি ঘর বানিয়ে দেন।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৬৯৭নং)

“যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় পাখির বাসার মত অথবা তার চেয়েও ছোট আকারের একটি মসজিদ বানিয়ে দেয়, আল্লাহ তার জন্য বেহেশ্তে একটি গৃহ্‌ নির্মাণ করে দেন।” (ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, জামে ৬১২৮ নং)

“যে ব্যক্তি তিতির পাখীর (পোকামাকড় খোঁজার উদ্দেশ্যে) আঁচড়ানো স্থান পরিমাণ আয়তনের অথবা তদপেক্ষা ছোট আকারের মসজিদ নির্মাণ করবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে একটি গৃহ্‌ নির্মাণ করবেন।” (ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, সহিহ তারগিব ২৬৫নং)

আর মহান আল্লাহ বলেন,

في بُيُوْتٍ أَذِنَ اللهُ أَنْ تُرْفَعَ وَيُذْكَرَ فِيْهَا اسْمُهُ يُسَبِّحُ لَهُ فِيْهَا بِالْغُدُوِّ وَالآصَال رِجَالٌ لاَّ تُلْهِيْهُمْ تِجَارَةً وَّلاَ بَيْعٌ عَنْ ذِكْرِ اللهِ وَإِقَامِ الصَّلاَةِ وَإِيْتَاءِ الزَّكَاةِ يَخَافُوْنَ يَوْماً تَتَقَلَّبُ فِيْهِ الْقُلُوْبُ وَالأَبْصَار

অর্থাৎ, আল্লাহ যে সব গৃহ্‌কে (মর্যাদায়) উন্নীত করার এবং সেগুলোতে তাঁর নাম স্মরণ করার আদেশ দিয়েছেন, সেখানে সকাল-সন্ধায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এমন লোকেরা; যাদেরকে ব্যবসা-বানিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ, নামায কায়েম এবং যাকাত প্রদান করা হতে বিরত রাখে না। তারা ভয় করে সেই দিনকে, যেদিন অন্তর ও দৃষ্টিসমূহ ভীতি-বিহ্বল হয়ে পড়বে। (কুরআন মাজীদ ২৪/৩৬-৩৭)

মসজিদে যাওয়ার মাহাত্ম

প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি সকাল অথবা সন্ধ্যায় মসজিদে যায়, তার জন্য আল্লাহ মেহ্‌মানীর উপকরণ প্রস্তুত করেন। যখনই সে সেখানে যায়, তখনই তার জন্য ঐ মেহ্‌মানীর উপকরণ প্রস্তুত করা হয়।” (বুখারী ৬৬২, মুসলিম, সহীহ ৬৬৯নং)

আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “পুরুষের স্বগৃহে বা তার ব্যবসাক্ষেত্রে নামায পড়ার চেয়ে (মসজিদে) জামাআতে শামিল হয়ে  নামায পড়ার সওয়াব পঁচিশ গুণ বেশি। কেননা, সে যখন সুন্দরভাবে ওযু করে কেবল মাত্র নামায পড়ার উদ্দেশ্যেই মসজিদের পথে বের হয় তখন চলামাত্র প্রত্যেক পদক্ষেপের বিনিময়ে তাকে এক-একটি মর্যাদায় উন্নীত করা হয় এবং তার এক-একটি গুনাহ মোচন করা হয়। অতঃপর নামায আদায় সম্পন্ন করে যতক্ষণ সে নামাযের স্থানে বসে থাকে ততক্ষণ ফিরিশতাবর্গ তার জন্য দুআ করতে থাকে; ‘হে আল্লাহ  ওর প্রতি করুণা বর্ষণ কর। হে আল্লাহ! ওকে ক্ষমা কর। আর সে ব্যক্তি যতক্ষণ নামাযের অপেক্ষা করে ততক্ষণ যেন নামাযের অবস্থাতেই থাকে।” (বুখারী ৬৪৭নং, মুসলিম, সহীহ ৬৪৯নং, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান)

তিনি বলেন, “অন্ধকারে অধিকাধিক মসজিদের পথে যাতায়াতকারীদেরকে কিয়ামত দিবসের পরিপূর্ণ জ্যোতির সুসংবাদ দাও।” (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, সহিহ তারগিব ৩১০নং)

তিনি আরো বলেন “যে ব্যক্তি কোন ফরয নামায আদায়ের উদ্দেশ্যে স্বগৃহে থেকে ওযু করে (মসজিদের দিকে) বের হয় সেই ব্যক্তির সওয়াব হয় ইহ্‌রাম বাঁধাহাজীর ন্যায়। আর যে ব্যক্তি কেবলমা­ত্র চাশতের নামায পড়ার উদ্দেশ্যেই বের হয়, তার সওয়াব হয় উমরাকারীর সমান। এক নামাযের পর অপর নামায; যে দুয়ের মাঝে কোন অসার (পার্থিব) ক্রিয়াকলাপ না থাকে তা এমন আমল যা  ইল্লিয়্যীনে (সৎলোকের সৎকর্মাদি লিপিবদ্ধ করার নিবন্ধ গ্রন্থে) লিপিবদ্ধ করা হয়।” (আবূদাঊদ, সুনান, সহিহ তারগিব ৩১৫নং)

“তিন ব্যক্তি আল্লাহর যামানতে; এদের মধ্যে একজন হল সেই ব্যক্তি যে মসজিদে যায়। মরণ পর্যন্ত সে আল্লাহর যামানতে থাকে। অতঃপর তিনি তাকে বেহেশ্তে প্রবেশ করান। অথবা তাকে তার প্রাপ্ত সওয়াব ও নেকীর সাথে (তার বাড়ি) ফিরিয়ে দেন।” (আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ৭২৭নং)

“নামাযে সওয়াবের দিক থেকে সবচেয়ে বড় সেই ব্যক্তি, যার (বাড়ি থেকে মসজিদের দিকে) চলার পথ সবচেয়ে দূরের।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৬৯৯নং)

মসজিদে নববীর আশেপাশে কিছু জায়গা খালি পড়েছিল। বনী সালেমাহ্‌ মসজিদের পাশে (ঐ খালি জায়গায়) ঘর বানাবার ইচ্ছা করল। এ খবর আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর নিকট পৌঁছলে তিনি তাদেরকে বললেন, “আমি শুনলাম যে, তোমরা তোমাদের পূর্বের ঘর-বাড়ি ছেড়ে মসজিদের পাশে এসে বসবাস করতে চাচ্ছ।” তারা বলল, ‘হ্যাঁ, হে আল্লাহর রসূল! এ রকমই ইচ্ছা আমরা করেছি।’ তিনি বললেন, “হে বনী সালেমাহ্‌! তোমরা তোমাদের ঐ বাড়িতেই থাক। (দূর হলেও, মসজিদ আসার ফলে) তোমাদের পায়ের চিহ্ন (তোমাদের নেকীর খাতায়) লিপিবদ্ধ করা হবে।” এরুপ তিনি দু’বার বললেন। (মুসলিম,  মিশকাত ৭০০নং)

মসজিদের প্রতি আসক্তি ও তথায় অবস্থানের ফযীলত

মহান আল্লাহ বলেন,

إِنّمَا يَعْمُرُ مَسَاجِدَ اللهِ مَنْ آمَنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَأَقَامَ الصَّلاَةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَلَمْ يَخْشَ إِلاَّ اللهَ، فَعَسَى أُولئِكَ أَنْ يَّكُوْنُوْا مِنَ الْمُهْتَدِيْنَ
অর্থাৎ, নি:সন্দেহে তারাই আল্লাহর মসজিদ আবাদ করবে, যারা আল্লাহতে ও পরকালে ঈমান রাখে, নামায কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে, আর আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করে না। আশা করা যায়, তারা সৎপথপ্রাপ্তদের দলভুক্ত হবে। (কুরআন মাজীদ ৯/১৮)

আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “আল্লাহ তাআলা সাত ব্যক্তিকে সেই দিনে তাঁর (আরশের) ছায়া দান করবেন যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত আর  কোন ছায়া থাকবে না; (তারা হল,)
১। ন্যায় পরায়ণ বাদশাহ্‌ (রাষ্ট্রনেতা),
২। সেই যুবক যার যৌবন আল্লাহ আযযা অজাল্লার ইবাদতে অতিবাহিত হয়, সেই  ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদ  সমূহের সাথে লটকে থাকে (মসজিদের প্রতি তার মন সদা আকৃষ্ট থাকে।)
৩। সেই দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা স্থাপন করে; যারা এই ভালোবাসার উপর মিলিত হয় এবং এই ভালোবাসার উপরেই চিরবিচ্ছিন্ন (তাদের মৃত্যু) হয়।
৪। সেই ব্যক্তি যাকে কোন কুলকামিনী সুন্দরী (অবৈধ যৌন-মিলনের উদ্দেশ্যে) আহ্বান করে কিন্তু সে বলে, ‘আমি আল্লাহকে ভয় করি।
৫। সেই ব্যক্তি যে দান করে গোপন করে; এমনকি তার ডানহাত যা প্রদান করে তা তার বাম হাত পর্যন্তুও জানতে পারে না। আর সেই ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে; ফলে তার উভয় চোখে পানি বয়ে যায়।” (বুখারী ৬৬০নং, মুসলিম, সহীহ ১০৩১নং)

“কোন ব্যক্তি যখন যিক্‌র ও নামাযের জন্য মসজিদে অবস্থান করা শুরু করে তখনই আল্লাহ তাআলা তাকে নিয়ে সেইরুপ খুশী হন যেরুপ প্রবাসী ব্যক্তি ফিরে এলে তাকে নিয়ে তার বাড়ির লোক খুশী হয়।” (ইআশা:, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, সহিহ তারগিব ৩২২নং)

 “মসজিদ প্রত্যেক পরহেযগার (ধর্মভীরু) ব্যক্তির ঘর। আর যে ব্যক্তির ঘর মসজিদ সেই ব্যক্তির জন্য আল্লাহ আরাম, করুণা এবং তার সন্তুষ্টি ও জান্নাতের প্রতি পুলসিরাত অতিক্রম করে যাওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন।” (ত্বাবারানী, মু’জাম কাবীর ও আওসাত্ব, বাযযার, সহিহ তারগিব ৩২৫ নং)

“যখন তোমাদের মধ্যে কেউ নিজ ঘরে ওযু করে মসজিদে আসে, তখন ঘরে না ফিরা পর্যন্ত সে নামাযেই থাকে। সুতরাং সে যেন হাতের আঙ্গুলগুলোর মাঝে খাঁজাখাঁজি না করে।” (হাকেম, মুস্তাদরাক, মিশকাত ৯৯৪, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১২৯৪নং)

“যে ব্যক্তি ওযু করে মসজিদে আসে, সে ব্যক্তি আল্লাহর মেহ্‌মান। আর মেজবানের দায়িত্ব হল, মেহ্‌মানের খাতির করা।” (সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১১৬৯ নং)

খেয়াল রাখার কথা যে, ই’তিকাফে বসা ছাড়া অন্যান্য দিনে মসজিদের মধ্যে নামাযের জন্য কোন এক কোণ বা স্থানকে নির্দিষ্ট করা বৈধ নয়। কারণ, মহানবী (সাঃ) নিষেধ করেছেন কাকের দানা খাওয়ার  মত (ঠকঠক করে) নামায পড়তে, নামাযে হিংস্র জন্তুদের মত হাত বিছিয়ে বসতে এবং উট যেমন একই স্থানকে নিজের জায়গা বানিয়ে নেয়, তেমনি মসজিদে নির্দিষ্ট জায়গা বানাতে। (আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, দারেমী, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, আহমাদ, মুসনাদ, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১১৬৮নং)

মসজিদ যাওয়ার আদব

পূর্বে উল্লেখিত একহাদীসে এসেছে যে, ওযু করে মসজিদ যাওয়ার সময়ও আঙ্গুলসমূহের মাঝে খাঁজাখাঁজি করা নিষিদ্ধ। অনুরুপ এই সময় পথে ইকামত শুনলেও তাড়াহুড়ো করে বা ছুটাছুটি করে দৌড়ে যাওয়া বৈধ নয়। যেহেতু মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমরা ধীর ও শান্তভাবে (মসজিদে বা জামাআতে) যাও। ইমামের সঙ্গে নামাযের যতটুকু অংশ পাও ততটুকু পড়ে নাও এবং যেটুকু অংশ ছুটে যায় তা একাকী পূর্ণ করে নাও।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৬৮৬ নং)

মসজিদ যাওয়ার সময় পথে নিম্নের দুআ পড়তে হয়:-

اَللّهُمَّ اجْعَلْ فِيْ قَلْبِيْ نُوْراً وَّ فِيْ لِسَانِيْ نُوْراً وَّ اجْعَلْ فِيْ سَمْعِيْ نُوْراً وَّ اجْعَلْ فِيْ بَصَرِيْ نُوْراً وَّاجْعَلْ مِنْ خَلْفِيْ نُوْراً ، وَّ مِنْ أَمَامِيْ نُوْراً، وَّاجْعَلْ مِنْ فَوْقِيْ نُوْراً وَ مِنْ تَحْتِيْ نُوْراً،

 اَللّهُمَّ أَعْطِنِيْ نُوْراً।

উচ্চারণ- আল্লাহুম্মাজ্‌আল ফী ক্বালবী নূরা, অফী লিসানী নূরা, অজ্‌আল ফী সাময়ী নূরা,অজ্‌আল ফী বাস্বারী নূরা, অজ্‌আল মিন খালফী নূরা, অমিন আমা-মী নূরা, অজ্‌আল মিন ফাউক্বী নূরা, অমিন তাহ্‌তী নূরা, আল্লাহুম্মা আ’তিনী নূরা।

অর্থ- হে আল্লাহ! আমার হৃদয়, রসনা, কর্ণ, চক্ষু, পশ্চাত, সম্মুখ, ঊর্ধ্ব ও নিম্নে জ্যোতি প্রদান কর। হে আল্লাহ! আমাকে নূর (জ্যোতি) দান কর। (বুখারী ৬৩১৬, মুসলিম, সহীহ ৭৬৩ নং)

মসজিদে প্রবেশ ও বাহির হওয়ার সময় দুআ

মহানবী (সাঃ) যখন মসজিদ প্রবেশ করতেন, তখন ‘বিসমিল্লাহ্‌’ বলতেন এবং নিজের উপর দরুদ ও সালাম পড়তেন। অনুরুপ বের হওয়ার সময়ও পড়তেন। (ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ৭৭১নং)

তিনি এই সময় নিম্নের দুআও পড়তেন,

أَعُوْذُ بِاللهِ الْعَظِيْمِ، وَبِوَجْهِهِ الْكَرِيْمِ، وَسُلْطَانِهِ الْقَدِيْمِ، مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ।

উচ্চারণ:- আঊযু বিল্লা-হিল আযীম, অবিঅজ্‌হিহিল কারীম, অ সুলত্বা-নিহিল ক্বাদীম, মিনাশ শায়ত্বা-নির রাজীম।

অর্থ- আমি মহিমময় আল্লাহর নিকট এবং তার সম্মানিত চেহারা ও তাঁর প্রাচীন পরাক্রমের অসীলায় বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

এই দুআ পড়ে মসজিদ প্রবেশ করলে শয়তান বলে, ‘সারা দিন ও আমার অনিষ্ট থেকে নিরাপত্তা লাভ করল।’ (আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ৭৪৯ নং)

(بِسْمِ الله)، وَالصَّلاَةُ وَالسَّلاَمُ عَلى رَسُوْلِ الله، اَللّهُمَّ افْتَحْ لِيْ أَبْوَابَ رَحْمَتِك।

উচ্চারণ- বিসমিল্লা-হ্‌, অসসালা-তু অসসালা-মু আলা রাসূলিল্লা-হ্‌, আল্লা-হুম্মাফ্‌ তাহ্‌লী আবওয়া-বা রাহ্‌মাতিক।

অর্থ- আল্লাহর নাম নিয়ে শুরু করছি, সালাম ও দরুদ বর্ষিত হোক আল্লাহর রসূলের উপর। হে আল্লাহ! আমার জন্য তুমি তোমার করুণার দুয়ার খুলে দাও।(জামে১/৫২৮,মুসলিম, সহীহ১/৪৯৪,ইবনুস সুন্নী ৮৮)

বের হওয়ার সময় বলতেন,

(بِسْمِ الله)، وَالصَّلاَةُ وَالسَّلاَمُ عَلى رَسُوْلِ الله، اللّهُمَّ إِنِّيْ أَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ।

‘বিসমিল্লাহ্‌’ ও দরুদের পর এ দুআও পড়া যায়,

اَللّهُمَّ اعْصِمْنِيْ مِنَ الشَّيْطَان।

উচ্চারণ:- আল্লাহুম্মা’সিমনী মিনাশ শাইত্বান।

অর্থ:- হে আল্লাহ! আমাকে শয়তান থেকে রক্ষা কর। (নাসাঈ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, বায়হাকী, ইবনে হিব্বান, সহীহ, জামে ৫১৪নং)

আনাস (রাঃ) বলেন, ‘এক সুন্নাহ্‌ (নবী (সাঃ) এর তরীকা) এই যে, যখন তুমি মসজিদ প্রবেশ করবে, তখন ডান পা আগে বাড়াবে এবং যখন মসজিদ থেকে বের হবে, তখন বাম পা আগে বাড়াবে।’ (হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২১৮)

তাহিয়্যাতুল মাসজিদ নামায

তাহিয়্যাতুল মাসজিদ বা মসজিদ সেলামীর নামায (২ রাক্‌আত) মসজিদ প্রবেশ করার পর বসার পূর্বেই পড়তে হয়। এর জন্য কোন সময়-অসময় নেই। প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে যে কেউ যখন মসজিদে প্রবেশ করবে, তখন সে যেন বসার পূর্বে ২ রাক্‌আত নামায পড়ে নেয়।” অন্য এক বর্ণনায় আছে, “সে যেন ২ রাক্‌আত নামায পড়ার পূর্বে না বসে।” (বুখারী, মুসলিম, সহীহ প্রমুখ ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৪৬৭নং)

এই দুই রাকআত নামায বড় গুরুত্বপূর্ণ। তাই তো জুমআর দিনে খুতবা চলাকালীন সময়েও মসজিদে এলে হাল্কা করে তা পড়ে নিতে হয়। (মুসলিম,  মিশকাত ১৪১১নং)

আযান চলাকালে মসজিদ প্রবেশ করলে না বসে আযানের জওয়াব দিয়ে শেষ করে তারপর ‘তাহিয়্যাতুল মাসজিদ’ পড়তে হবে। তবে জুমআর দিন খুতবার আযান হলে জওয়াব না দিয়ে ঐ ২ রাকআত নামায আযান চলা অবস্থায় পড়ে নিতে হবে। যেহেতু খুতবা শোনা আরো জরুরী। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩৩৫)

মসজিদে প্রবেশ করে সুন্নাতে মুআক্কাদাহ পড়তে হলে ঐ নামায আর পড়তে হয় না। কারণ, তখন এই সুন্নতই ওর স্থলাভিষিক্ত ও যথেষ্ট হয়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৫/৬৭, লিকাউবাবিল মাফতূহ্‌, ইবনে উসাইমীন ৫৩/৬৯)

যেমন হারামের মসজিদে প্রবেশ করে (বিশেষ করে মুহ্‌রিমের জন্য) ‘তাহিয়্যাতুল মাসজিদ’ হল তওয়াফ; ২ রাকআত সুন্নত নয়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ৬/২৬৪-২৬৫)

মসজিদ হবে পবিত্র ও সুগন্ধময়

মসজিদ আল্লাহর ঘর। ইবাদতের জায়গা। তা হবে পবিত্র ও সুগন্ধময়। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাঃ) মহ্‌ল্লায় মসজিদ বানাতে এবং তা পরিষ্কার ও সুগন্ধময় করে রাখতে আদেশ করেছেন।’ (আবূদাঊদ, সুনান ৪৫৫ নং,  তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ আহমাদ, মুসনাদ)

সামুরাহ্‌ (রাঃ) নিজের ছেলেকে পত্রে লিখেছিলেন, ‘অতঃপর বলি যে, আল্লাহর রসূল (সাঃ) আমাদেরকে আমাদের মহ্‌ল্লায় মসজিদ বানাতে, তার তরমীম করতে এবং তা পবিত্র রাখতে আদেশ করতেন।’ (আবূদাঊদ, সুনান  ৪৫৬নং)

মহানবী (সাঃ) বলেন, “নিশ্চয়ই এই মসজিদসমূহে কোন প্রকার নোংরা, পেশাব-পায়খানা (ইত্যাদি ময়লা দ্বারা অপবিত্র করা) সঙ্গত নয়। মসজিদ তো কুরআন পাঠ, আল্লাহর যিক্‌র এবং নামাযের জন্য (বানানো হয়)। (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম,  জামে ২২৬৮নং) তিনি মসজিদের দরজায় পেশাব করতে নিষেধ করেছেন। (জামে ৬৮১৩ নং)

মসজিদে থুথু বা কফ্‌ ফেলা গুনাহর কাজ। থুথু ইত্যাদি নোংরা বস্তু মসজিদ থেকে পরিষ্কার করা সওয়াবের কাজ। (আহমাদ, মুসনাদ, ত্বাবারানী, মু’জাম, জামে ২৮৮৫ নং) যেমন ঋতুমতী মহিলা প্রভৃতি অপবিত্রের জন্য মসজিদে অবস্থান করা বৈধ নয়। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ১৪৩১নং)

মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি (কাঁচা) পিঁয়াজ, রসুন বা কুর্রাস খাবে, সে যেন আমাদের মসজিদে আমাদের নিকটবর্তী না হয়। কেননা, যে বস্তু দ্বারা মানুষ কষ্ট পায়, সেই বস্তুতে ফিরিশ্‌তারাও কষ্ট পেয়ে থাকেন।” (মুসলিম,  তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, জামে ৬০৮৯ নং)

বলাই বাহুল্য যে, কাঁচা পিঁয়াজ-রসুন অপেক্ষা বিড়ি-সিগারেট, গুল-জর্দা, গালি-তামাক প্রভৃতি মাদকদ্রব্যের দুর্গন্ধ আরো বেশী। সুতরাং তা খেয়েও মসজিদে এসে মুসল্লী তথা আল্লাহর ফিরিশ্‌তাদেরকে কষ্ট দেওয়া বৈধ নয়। বরং এসব বস্তু খাওয়াইহারাম এবং তা বর্জন করা ওয়াজেব। (আদর্শ পরিবার ও পরিবেশ দ্র:)

মসজিদে যা অবৈধ

১। হারানো জিনিস খোঁজা; মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি কাউকে মসজিদে তার হারানো বস্তু খোঁজ করতে দেখবে, সে ব্যক্তি যেন তাকে বলে, ‘আল্লাহ তোমার জিনিস ফিরিয়ে না দিক।’ কারণ, মসজিদসমূহ এ উদ্দেশ্যে বানানো হয়নি।” (মুসলিম, সহীহ ৫৬৮নং)

২। বেচা-কেনা; মহানবী (সাঃ) বলেন, “যখন তোমরা দেখবে যে, মসজিদে কেউ কিছু বেচা-কেনা করছে, তখন তাকে বলবে যে, ‘আল্লাহ তোমার বেচা-কেনায় লাভ না দিক।” (তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, দারেমী, সুনান, মিশকাত ৭৩৩নং)

৩। অসার, বাজে ও অশ্লীল কবিতা, গজল বা ছড়া পাঠ। আম্‌র বিন শুআইবের পিতামহ্‌ বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাঃ) মসজিদে আপোসে কবিতা আবৃতি ও বেচা-কেনা করতে, জুমআর দিন (জুমআর) নামাযের পূর্বে গোল হয়ে বসতে নিষেধ করেছেন। (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ৭৩২নং)

অবশ্য বৈধ শ্রেণীর ইসলামী গজল পাঠ নিষিদ্ধ নয়। একদা হাসসান (রাঃ) মসজিদে কবিতা পাঠ করছিলেন। হযরত উমার (রাঃ) প্রতিবাদের দৃষ্টিতে তাঁর প্রতি তাকালে তিনি বললেন, ‘আমি কবিতা পাঠ করতাম, আর তখন মসজিদে আপনার থেকে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি [নবী (সাঃ)] উপস্থিত থাকতেন।’ অতঃপর তিনি আবূ হুরাইরার দিকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘আল্লাহর ওয়াস্তে বলুন, আপনি কি আল্লাহর রসূল (সাঃ) কে বলতে শুনেছেন, “(হে হাসসান! মুশরিকদেরকে) আমার তরফ থেকে (ওদের কবিতার) জবাব দাও। হে আল্লাহ! জিবরীল দ্বারা ওকে সাহায্য কর?” আবূ হুরাইরা বললেন, ‘জী হ্যাঁ, (আমি এ কথা শুনেছি)। (বুখারী ৪৫৩, মুসলিম, সহীহ ২৪৮৫ নং)

৪। হৈ-হাল্লা করা ও উচ্চস্বরে কথা বলা। (বুখারী, মিশকাত ৭৪৪নং) এমন কি কেউ নামায বা কুরআন পড়লে সেখানে সশব্দে কুরআন পাঠও করা যাবে না। একদা মহানবী (সাঃ) দেখলেন, লোকেরা নামাযে জোরে-শোরে কুরআন পাঠ করছে। তিনি বললেন, “মুসল্লী (নামাযী) তো আল্লাহর সাথে চুপিসারে কথা বলে। সুতরাং কি নিয়ে তাঁর সাথে কথা বলছে তা লক্ষ্য করা দরকার। আর তোমরা এমন উচ্চস্বরে কুরআন পড়ো না, যাতে অপরের নামাযে ব্যাঘাত ঘটে।” (আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ৮৫৬নং)

বলাই বাহুল্য যে, মসজিদের যে প্রতিবেশী অথবা অন্য লোক যে (মাইক, টেপ, রেডিও প্রভৃতির) শব্দ বা গান-বাজনা দ্বারা অথবা কোন রঙ-তামাশা দ্বারা মসজিদের পবিত্রতা-হানি করে এবং মসজিদে অবস্থিত নামাযীদের নামাযে, তেলাঅতে ও আল্লাহর যিক্‌রে ব্যাঘাত ও বাধা সৃষ্টি করে তার ভয় হওয়া উচিৎ। কারণ, মহান আল্লাহর সাধারণ উক্তি এই যে,

ومَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ مَنَعَ مَسَاجِدَ اللهِ أَنْ يُّذْكَرَ فِيْهَا اسْمُهُ وَسَعى فِيْ خَرَابِهَا أُولئِكَ مَا كَانَ لَهُمْ أَنْ يَّدْخُلُوْهَا إِلاَّ خَائِفِيْنَ، لَهُمْ فِي الدُّنْيَا خِزْيٌ وَّلَهُمْ فِي الآخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيْمٌ

অর্থাৎ, যে ব্যক্তি আল্লাহর মসজিদে তাঁর নাম স্মরণ (যিক্‌র) করতে বাধা দেয় ও তার ধ্বংস-সাধনে প্রয়াসী হয়, তার চেয়ে বড় যালেম আর কে হতে পারে?” (কুরআন মাজীদ ২/১১৪)

৫। হদ্দ্ (ইসলামী দন্ডবিধি; যেমন মদখোরকে চাবুক মারা, চোরের হাত কাটা, ব্যভিচারীকে কোড়া মারা প্রভৃতি) কায়েম করা। মহানবী (সাঃ) মসজিদে হদ্দ্ কায়েম করতে নিষেধ করেছেন। (হাকেম, মুস্তাদরাক ৪/৩৬৯, আহমাদ, মুসনাদ ৩/৪৩৪, আবূদাঊদ, সুনান ৪৪৯০, মিশকাত ৭৩৪ নং)

উল্লেখ্য যে, আধুনিক যুগের মোবাইল টেলিফোন বা ব্লিফার সঙ্গে নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করার পূর্বে তা বন্ধ করে দেওয়া জরুরী। কারণ, এ সবে যে রিং বা মিউজিকের শব্দ আছে তাতে মসজিদবাসীর ডিষ্টার্ব হয়ে থাকে।

মসজিদে যা করা বৈধ

এমন কতক কাজ আছে, যে সম্বন্ধে ধারণা হওয়া স্বাভাবিক যে, তা মসজিদে করা হয়তো বৈধ নয়। অথচ শরীয়তের দৃষ্টিতে তা বৈধ। যেমন;

১। দ্বীনী কথাবার্তা, বৈধ আলোচনা, প্রয়োজনীয় সাংসারিক কথা। জাবের বিন সামুরাহ্‌ (রাঃ) বলেন, ‘নবী (সাঃ) ফজরের নামায পড়ে সূর্য না ওঠা পর্যন্ত মুসাল্লা থেকে উঠতেন না। সূর্য উঠে গেলে তিনি উঠে যেতেন। ঐ অবসরে লোকেরা আপোসে কথা বলত। বলতে বলতে তারা ইসলাম-পূর্ব জাহেলিয়াতের কথা শুরু করে দিত। এতে তারা হাসত এবং তিনিও মুচকি হাসতেন।’ (মুসলিম, সহীহ ৬৭০নং)

অবশ্য নিছক দুনিয়াদারীর কথা বলা বৈধ নয়। মহানবী (সাঃ) বলেন, “আখেরী যামানায় এমন এক শ্রেণীর লোক হবে, যারা মসজিদে গোল-বৈঠক করে পার্থিব ও সাংসারিক গল্প-গুজব করবে। সুতরাং তোমরা তাদের সাথে বসো না। কারণ, এমন লোকেদের নিয়ে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।” (ত্বাব, বায়হাকী, মিশকাত ৭৪৩, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১১৬৩ নং)

২। খাওয়া-পান করা। আব্দুল্লাহ বিন হারেস (রাঃ) বলেন, ‘আমরা রসূল (সাঃ) এর আমলে মসজিদের ভিতর রুটী ও গোশত খেতাম।’ (ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ৩৩০০ নং)

যে জিনিস খাওয়া হারাম, তা মসজিদে খাওয়া তথা সকল স্থানেই খাওয়া হারাম। মসজিদের সম্মান রক্ষার্থে সে সব হারাম জিনিস সঙ্গে নিয়ে বা পকেটে রেখে মসজিদে যাওয়া বা নামায পড়াও বৈধ নয়। যেমন গুল, জর্দা, বিড়ি, সিগারেট, তামাক প্রভৃতি খাওয়া বৈধ নয়, বিধায় তা মসজিদে খাওয়া বা নিয়ে যাওয়া অবৈধ। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৭/৫৮)

৩। শয়ন করা। একদা আব্বাদ বিন তামীমের চাচা (রাঃ) দেখলেন, আল্লাহর রসূল (সাঃ) মসজিদে এক পা অপর পায়ের উপর রেখে চিৎ হয়ে শয়ন করে আছেন। সাঈদ বিন মুসাইয়িব বলেন, ‘উমার এবং উসমান (রাঃ)ও এরুপ করতেন।’ (বুখারী ৪৭৫ নং, মুসলিম, সহীহ)

আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, ‘আমরা আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর যুগে মসজিদে ঘুমাতাম। আর আমরা তখন ছিলাম অবিবাহিত যুবক।’ (বুখারী ৪৪০, তিরমিযী, সুনান ৩২১, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ৭৫১নং, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ)

তবে ঘরে জায়গা থাকতে মসজিদকে অভ্যাসগতভাবে শয়নাগার ও বিশ্রামাগার বানানো উচিৎ নয়। কারণ, ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘কেউ যেন মসজিদকে শয়নাগার ও বিশ্রামাগার বানিয়ে না নেয়।’ (তিরমিযী, সুনান ১/১০৩)

মসজিদ নির্মাণ বিষয়ক কিছু ফতোয়া

মুসলিম থাকতে কোন কাফের মিস্ত্রী-শ্রমিক দ্বারা মসজিদ নির্মাণ বৈধ নয়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ২১/২০-৩৮)

মুসলিমদের (সামাজিক, রাজনৈতিক) কোন ক্ষতির আশঙ্কা না হলে মসজিদ ও মাদ্রাসার জন্য অমুসলিমদের নিকট থেকে -তারা খুশী হয়ে হালাল অর্থ সাহায্য দিতে চাইলে- গ্রহণ করা বৈধ। (ইবনে বায প্রমুখ, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ৩২/৯০)

মসজিদ নির্মাণ হবে মুসলিমদের নিজস্ব পবিত্র মাল দ্বারা। এতে যাকাত ব্যবহার বৈধ নয়। কারণ, যাকাত হল গরীব-মিসকীন প্রভৃতি ৮ প্রকার খাতে ব্যয়িতব্য অর্থ। আর মসজিদ এ সব পর্যায়ে পড়ে না। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ৮/১৫২)

ওয়াকফের যে কোনও বস্তু বিক্রয় করা যায় না, হেবা (দান) করা যায় না এবং কেউ তার ওয়ারিস হতেও পারে না। (বুখারী ২৭৩৭ নং, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান)

অবশ্য যদি কোন ওয়াক্‌ফের জিনিস এমন অবস্থায় পৌঁছে যায়, যাতে কোন প্রকার উপকারই অবশিষ্ট না থাকে এবং তার তরমীম ও সংস্কার সম্ভব না হয়, অনুরুপ কোন মসজিদ সংকীর্ণ হলে এবং প্রশস্ত করার জায়গা না থাকলে সেই ওয়াক্‌ফ বা মসজিদের জায়গা বিক্রয় করে সেই অর্থে অন্য কোন উপযুক্ত স্থানে মসজিদ নির্মাণ করা বৈধ। কারণ, কোনও মসজিদ বা স্থান খামাখা ফেলে রাখা নিষ্ফল।

ইবনে রজব বলেন, ইমাম আহমাদ (রহঃ) প্রমুখ যে কথা স্পষ্টাকারে বর্ণিত হয়েছে তা এই যে, পোড়ো মসজিদ বিক্রয় করে তার মূল্য দ্বারা অন্য মসজিদ নির্মাণ করতে হবে। ঐ গ্রাম বা শহরে প্রয়োজন না থাকলে অন্য গ্রাম বা শহরে মসজিদ নির্মাণের খাতে ঐ অর্থ ব্যয় করতে হবে।

মসজিদ স্থানান্তরিত করা সাহাবা কর্তৃকও প্রমাণিত। (এ ব্যাপারে ইসলাহুল মাসাজিদ, উর্দু ৩১৫-৩১৭পৃ:, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১০/৬৩, ২৩/৯৯, ২৪/৬০, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ২/৯ দ্রষ্টব্য)

পক্ষান্তরে মসজিদ পোড়ো না হলে, নামায পড়া হলে বা চূড়ান্ত পর্যায়ের প্রয়োজন না পড়লে মসজিদ ভেঙ্গে অন্য কিছু (মাদ্রাসা, মুসাফিরখানা ইত্যাদি) করা বৈধ নয়, এমনকি ইমাম রাখার জন্য বাসাও নয়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১০/৮১, ২৩/১০৩)

এক মসজিদের আসবাব-পত্র অন্য মসজিদে লাগানো বৈধ। মসজিদের প্রয়োজন না থাকলে অথবা মসজিদের সম্পদ উদ্বৃত্ত  হলে তা হতে সাধারণ কল্যাণ-খাতে; যেমন ঈদগাহ্‌ বা দ্বীনী মাদ্রাসা নির্মাণ, কবরস্থান ঘেরা, এতীম-মিসকীনদের দেখাশুনা প্রভৃতি কাজে দান করা যায়। (ইসলাহুল মাসাজিদ, উর্দু ৩১৬পৃ:, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ৩/৩৬১, কিতাবুদ্দা’ওয়াহ্‌, ইবনে বায ২০৩পৃ:)

মসজিদের বর্ধিত স্থান মসজিদের অন্তর্ভুক্ত। উভয়ের মান সমান। তাই তো মহানবী (সাঃ) এর নির্মিত মসজিদে নামায পড়ে যে সওয়াব লাভ হয়, বর্তমানে ঐ মসজিদের বর্ধিত স্থানসমূহে নামায পড়লেও ঐ একই পরিমাণ সওয়াব লাভ হবে। অবশ্য প্রথম কাতারসমূহের ফযীলত তো পৃথক আছেই। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৫/৭২, ১৭/৬৯)

ইসলামের স্বর্ণযুগে যদিও মসজিদে নারী-পুরুষের মুসাল্লা পৃথক ছিল না তবুও বর্তমানে ফিতনা ও ফাসাদ থেকে বাঁচার জন্য মহিলাদের মুসাল্লা পৃথক করে মাঝে পর্দা দেওয়া দূষণীয় নয়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৯/১৪৭) অবশ্য এই উদ্দেশ্যে মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট ও পৃথক দরজা হওয়া বাঞ্ছনীয়। (আবূদাঊদ, সুনান ৪৬২ নং)

মসজিদের নির্মাণ কাজ শেষ হলে সমবেত হয়ে অনুষ্ঠান করে ফিতে কেটে বা অন্য কিছু করে উদ্বোধন করা বিদআত। এ ধরনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সাহায্য ও যোগদান করাও বৈধ নয়। যেমন বিশেষভাবে কোন নূতন (বা পুরাতন) মসজিদে নামায পড়ার জন্য দূর থেকে সফর করাও বৈধ নয়। যেহেতু কা’বার মসজিদ, মসজিদে নববী ও মসজিদুল আকসা (অনুরুপ কুবার মসজিদ) ছাড়া অন্য মসজিদের জন্য সফর বৈধ নয়। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৬৯৩, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/১৮-১৯)

উপরতলায় মসজিদ ও নিচের তলায় বসত-বাড়ি অথবা নিচের তলায় মসজিদ ও উপর তলায় বসত-বাড়ি হলে কোন দোষের কিছু নয়। (ইসলাহুল মাসাজিদ, উর্দু, ৩১৩পৃ:)

তদনুরুপ উপর তলায় মসজিদ এবং নিচের তলায় দোকান ইত্যাদি করে তা ভাড়া দেওয়া এবং সেই অর্থ মসজিদের খাতে ব্যয় করা বৈধ। (ঐ ৩১৭পৃ:) অবশ্য ঐ সমস্ত দোকানে যেন হারাম ও অবৈধ কোন কিছু ক্রয়-বিক্রয় না হয়। নচেৎ হারাম ব্যবসায় দোকান ভাড়া দিয়ে নেওয়া অর্থ হারাম তথা মসজিদে তা লাগানো অবৈধ হবে। বলাই বাহুল্য যে, সূদী বাংক, মাদকদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয়, দাড়ি চাঁছার সেলুন,  বাদ্যযন্ত্র বিক্রয়, কোন অশ্লীল কর্ম প্রভৃতি করার জন্য দোকান বা বাড়ি ভাড়া দেওয়া হারাম। (আসইলাতুম মুহিম্মাহ্‌, ইবনে উসাইমীন ১৪পৃ:)

মসজিদ দ্বিতল বা প্রয়োজনে আরো অধিকতল করা দূষণীয় নয়। তবে কাতার শুরু হবে ইমামের নিকট থেকে। যে তলায় ইমাম থাকবেন, সে তলা পূর্ণ হলে তবেই তার পরের তলায় দাঁড়ানো চলবে। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ৬/২৬০)

মসজিদ হবে সাদা-সিধে প্রকৃতির। এতে অধিক নক্সা ও চাকচিক্য পছন্দনীয় নয়। অধিক কারুকার্য-খচিত ও রঙচঙে করা বিধেয় নয়।

আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “আমি মসজিদসমূহকে রঙচঙে করতে আদিষ্ট হ্‌ইনি।” ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘অবশ্যই তোমরা মসজিদসমূহকে সৌন্দর্য-খচিত করবে, যেমন ইয়াহুদ ও খ্রিষ্টানরা (তাদের গির্জাগুলোকে) করেছে।’ (আবূদাঊদ, সুনান ৪৪৮ নং)  অথচ তাদের অনুকরণ অবৈধ।

আনাস (রাঃ) বলেন, ‘(কিছু মুসলমান হবে) তারা মসজিদের সৌন্দর্য নিয়ে গর্ব করবে। কিন্তু তা আবাদ করবে (নামায পড়বে) খুব কমই।’ (ইআশা: ৩১৪৭ নং)

উমার (রাঃ) বলেন, ‘খবরদার! মসজিদকে লাল বা হ্‌লুদ রঙের বানিয়ে লোকদেরকে (নামাযের সময়) ফিতনায় (ঔদাস্যে) ফেলো না।’ (বুখারী, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ১/৬৪২)

মহানবী (সাঃ) বলেন, “যখন তোমরা তোমাদের মসজিদসমূহকে সৌন্দর্য-খচিত করবে এবং কুরআন শরীফকে অলঙ্কৃত করবে, তখন তোমাদের উপর ধ্বংস নেমে আসবে।” (ইআশা: ৩১৪৮ নং)

তিনি আরো বলেন, “মসজিদ (তার নির্মাণ-সৌন্দর্য) নিয়ে গর্ব না করা পর্যন্ত কিয়ামত কায়েম হবে না।” (আবূদাঊদ, সুনান ৪৪৯ নং) অর্থাৎ এ কাজ হল কিয়ামতের একটি পূর্ব লক্ষণ।

অবশ্য তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান (রাঃ) মসজিদে নববীর দেওয়াল নক্সা-খচিত পাথর ও চুনসুরকি দ্বারা নির্মাণ করেন। থামগুলোকেও নক্সাদার পাথর দিয়ে তৈরী করেন। আর ছাত করেন সেগুন কাঠের। (বুখারী ৪৪৬, আবূদাঊদ, সুনান ৪৫১নং)

ইবনে বাত্ত্বাল প্রমুখ বলেন, মসজিদ নির্মাণে সুন্নত হল মধ্যবর্তী পন্থা অবলম্বন করা এবং তার সৌন্দর্যে অতিরঞ্জিত না করা। হযরত উমার (রাঃ) নিজের আমলে বহু বিজয় ও ধন লাভ সত্ত্বেও তিনি মসজিদে নববীতে কিছু অতিরিক্ত বা বর্ধিত করেননি। খেজুর ডালের ছাত নষ্ট হয়ে গেলে তিনি তা নতুন করে তৈরী করেছিলেন মাত্র। অতঃপর হযরত উসমান (রাঃ) তাঁর নিজের আমলে অর্থ-সম্পদের প্রাচুর্য দেখা দিলে তিনি মসজিদের কিছু সৌন্দর্য বর্ধিত করেছিলেন। কিন্তু তাকে চাকচিক্য বা রঙচঙে বলা চলে না। এতদসত্ত্বে ও অন্যান্য সাহাবীগণ তাঁর এ কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।

ইসলামে প্রথম মসজিদসমূহকে অধিক সৌন্দর্য-খচিত ও নক্সাদার করেন বাদশা অলীদ বিন আব্দুল মালেক। এ সময়টি ছিল সাহাবাদের যুগের শেষ সন্ধিক্ষণ। তখন ফিতনার ভয়ে বহু উলামা বাদশার কোন প্রতিবাদ না করতে পেরে চুপ থেকেছেন।

পক্ষান্তরে ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ) প্রমুখ আহলে ইলমদের নিকটে মসজিদের তা’যীম প্রদর্শনার্থে চাকচিক্য করণে অনুমতি রয়েছে। (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ১/৬৪৪)

মসজিদে শির্ক ও বিদআত

মহান আল্লাহ বলেন,

وأَنَّ الْمَسَاجِدَ للهِ فَلاَ تَدْعُوْا مَعَ اللهِ أَحَداً

অর্থাৎ, আর অবশ্যই মসজিদসমূহ আল্লাহর। সুতরাং আল্লাহর সঙ্গে আর কাউকে আহবান করো না। (কুরআন মাজীদ ৭২/১৮)

তিনি আরো বলেন, “নিজেদের উপর কুফরের সাক্ষ্য দিয়ে মুশরিকদের জন্য আল্লাহর মসজিদ আবাদ করা শুদ্ধ ও শোভনীয় নয়। ওরা তো এমন, যাদের সকল আমল ব্যর্থ এবং ওরা দোযখে স্থায়ীভাবে অবস্থান করবে।” (কুরআন মাজীদ ৯/১৭)

মসজিদে কবর থাকা শির্কের এক অসীলা। তাই তো মসজিদে কোন মাইয়্যেত দাফন করা বৈধ নয়। বৈধ নয় কবর-ওয়ালা মসজিদে নামায পড়া। এ জন্য মসজিদে কবর থাকলে তা তুলে কবরস্থানে পুনর্দাফন করা ওয়াজেব। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১০/৭৭)

কা’বার মসজিদে বিবি হা-জার (হাজেরা) বা অন্য কারো কবর নেই। এ ব্যাপারে কোন কোন ঐতিহাসিকদের কথা মান্য নয়। কারণ, তাঁদের নিকট কোন দলীল ও প্রমাণ নেই। অনুরুপ মহানবী (সাঃ) এর কবর হযরত আয়েশার হুজরায় হয়েছে, মসজিদে নয়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১০/৮০, ২৬/৮৬)

মৃত্যু-শয্যায় শায়িত থেকে মহানবী (সাঃ) উম্মতকে অসিয়ত করে বলেছেন, “আল্লাহ ইয়াহুদ ও খ্রীষ্টানদেরকে অভিশাপ করুন; তারা তাদের আম্বিয়ার কবরসমূহকে মসজিদ বানিয়ে নিয়েছে।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৭১২নং)

তিনি আরো বলেছেন, “সাবধান! তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা তাদের আম্বিয়া ও নেক লোকেদের কবরকে মসজিদ বানিয়ে নিত। শোন! তোমরা যেন কবরসমূহকে মসজিদ বানিয়ে নিও না। আমি তোমাদেরকে এ ব্যাপারে নিষেধ করছি।” (মুসলিম,  মিশকাত ৭১৩ নং)

তিনি বলেন, “তোমাদের নিজ নিজ ঘরে কিছু (নফল বা সুন্নত) নামায পড়; আর তা (ঘর) কে কবর করে নিওনা।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৭১৪নং) অর্থাৎ কবরস্থানে যেমন নামায পড়া হয় না, ঠিক তেমনি নামায না পড়ে ঘরকে কবরের মত করে রেখো না।

তিনি আরো বলেন, “তোমরা কবরের উপর বসো না এবং কবরের দিকে মুখ করে নামায পড়ো না।” (মুসলিম, সহীহ ৯২৭ নং, প্রমুখ)

ঈদগাহ্‌ বা মসজিদের সীমানার বাইরে কবর হলে এবং মাঝে দেওয়াল বা প্রাচীর থাকলে ঐ ঈদগাহ্‌ বা মসজিদে নামায দূষণীয় নয়। তবে যদি ঐ কবরবাসীর তা’যীমের উদ্দেশ্যে তার পাশে মসজিদ বানানো হয়ে থাকে, তাহলে তাতে নামায বৈধ নয়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৫/৭৮-৭৯)

রমযান, ঈদ, শবে কদর, শবেবরাত(?) প্রভৃতির দিবারাত্রে মসজিদকে ফুল বা অতিরিক্ত আলোকমালা দিয়ে সুসজ্বিত করা বিদআত। পরন্তু এমন কাজ কাফেরদের অনুরুপ। আর কাফেরদের অনুকরণ মুসলিমদের জন্য বৈধ নয়। (ঐ ২৫/৬৮-৬৯)

কোন মসজিদে বিদআত কর্ম হতে থাকলে তা দূর করার চেষ্টা করতে হবে। সম্ভব না হলে সে মসজিদ ত্যাগ করে বিদআতশূন্য মসজিদে নামায পড়া কর্তব্য। (ঐ ১৮/৮৯) মুজাহিদ (রহঃ) বলেন, একদা আমি ইবনে উমার (রাঃ) এর সঙ্গে ছিলাম। নামায পড়ার জন্য তিনি এক মসজিদে প্রবেশ করলেন। সেখানকার মুআযযিন যোহ্‌র বা আসরের আযানের পর পুনরায় নামাযের জন্য ডাক-হাঁক শুরু করলে তিনি বললেন, ‘এখান হতে বের হয়ে চল। কারণ এখানে বিদআত রয়েছে।’ অন্য এক বর্ণনায় তিনি বললেন, ‘(এই মসজিদ থেকে) বিদআতে আমাকে বের করে দিল।’ (আবূদাঊদ, সুনান ৫৩৮, বায়হাকী ১/৪২৪, ত্বাব)

বিদআতের বিরুদ্ধে লড়ে সফল না হয়ে বিদআতশূন্য সালাফী জামাআত পৃথক মসজিদ করলে, সে মসজিদকে ‘মাসজিদে যিরার’ বলা যাবে না। বরং বিদআত কর্মে সহমত প্রকাশ না করে ফিতনা দূর করার মানসে পৃথক মসজিদ করাই যুক্তিযুক্ত। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ৩৫/৮২)  যে মসজিদ সৎপথের পথিক হকপন্থী মুসলিমদের কোন ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে, জামাআতের প্রতি বিদ্রোহ করে, মুসলিমদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির ইচ্ছায় এবং আল্লাহ ও তদীয় রসূলের বিরুদ্ধে যারা সংগ্রাম করে তাদের গোপন ঘাঁটি স্বরুপ নির্মাণ করা হয়, তাই হল কুরআন মাজীদে উল্লেখিত ‘মাসজিদে যিরার।’ (কুরআন মাজীদ ৯/১০৭ দ্র:)

মসজিদ বিষয়ক আরো কিছু মাসায়েল

কোন প্রকার জুলুম ও অন্যায়ভাবে দখলকৃত জায়গার উপর মসজিদ নির্মাণ এবং জেনে-শুনে তাতে নামায পড়া বৈধ নয়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৭/৫৩)

মসজিদের কোন সম্পত্তি বা অন্য কোন জিনিস ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার কারো জন্য বৈধ নয়। (ইসলাহুল মাসাজিদ, উর্দু৩১১পৃ:)

কোনও বিষয় নিয়ে কারো সাথে বিরোধ ঘটলে তাকে মসজিদে আসতে বাধা দেওয়া উচিৎ নয়। কারণ, মহান আল্লাহ বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর মসজিদে তাঁর নাম স্মরণ (যিক্‌র) করতে বাধা দেয় ও তার ধ্বংস-সাধনে প্রয়াসী হয়, তার চেয়ে বড় জালেম আর কে হতে পারে?” (কুরআন মাজীদ ২/১১৪)

কোন অমুসলিম যদি বাহ্যিক পবিত্র অবস্থায় আদবের সাথে মসজিদ প্রবেশ করতে চায়, তবে তাতে কোন ক্ষতি হয় না। অবশ্য মক্কা (ও মদ্বীনার) হারাম ও মসজিদে তারা প্রবেশ করতে পারে না। (কুরআন মাজীদ ৯/২৮, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ২১/২০, ৩২/৯৪, ১০৫)

মসজিদের উপর দিয়ে রাস্তা করায় মসজিদের সম্মানহানি হয়। মহানবী (সাঃ) বলেন, “যিক্‌র ও নামায ছাড়া অন্য কিছুর জন্য মসজিদসমূহকে রাস্তা করে নিও না।” (ত্বাবারানী, মু’জাম, জামে ৭২১৫ নং) মসজিদকে রাস্তায় পরিণত করে তার সম্মান নষ্ট করা কিয়ামতের অন্যতম পূর্বলক্ষণ। (ত্বাবারানী, মু’জাম আউসাত্ব, জামে ৫৮৯৯ নং)

প্রকাশ যে, মসজিদের প্রতি তা’যীম প্রদর্শনের অর্থ এই নয় যে, মসজিদকে সালাম (প্রণাম) করতে হবে বা তার ধুলো খেতে হবে অথবা তার মেঝে ধুয়ে পানি খেতে হবে। কারণ এসব কাজ শির্কের পর্যায়ভুক্ত।

মসজিদে কোন প্রকার খেলাও বৈধ নয়। অবশ্য যে খেলা জিহাদ বিষয়ক অথবা জিহাদের সহায়ক (অস্ত্রচালনার খেলা) তা বৈধ। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘একদা হাবশী দল মসজিদে তাদের যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে খেলা করছিল। আর আমি আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর পশ্চাতে আড়ালে হুজরার দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে তাদের খেলা দেখছিলাম।’ (বুখারী ৪৫৪, ৪৫৫নং, প্রমুখ)

প্রয়োজনে কোন রোগীর জন্য মসজিদে তাঁবু লাগিয়ে বা অন্য স্থানে স্থান দেওয়া দূষণীয় নয়। এতে রক্ত পড়লেও ক্ষতি নেই, যা পরে ধুয়ে পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। খন্দকের যুদ্ধে হযরত সা’দ (রাঃ) আহত হলে তাঁকে মসজিদে নববীতে রাখা হয়েছিল এবং সেখানেই তাঁর ইন্তেকাল হয়েছিল। (বুখারী ৪৬৩নং, প্রমুখ)

যে পত্র-পত্রিকায় মানুষ বা পশু-পক্ষীর ছবি থাকে, তা মসজিদে পড়া বা রাখা বৈধ নয়। প্রয়োজনে কালি দ্বারা প্রাণীর মাথা নষ্ট করে রাখা যায়। অশ্লীল ছবি ও পত্রিকা তো কোন স্থানেই দেখা ও পড়া বৈধ নয়। মসজিদে আরো বেশী নয়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ২২/১০১)

বাড়ির কোন একটা কামরা বা নির্দিষ্ট জায়গাকে মসজিদ বানানো চলে। যাতে নফল নামায এবং মসজিদে যেতে না পারলে ফরয নামাযও পড়া যাবে। ইতবান বিন মালেক (রাঃ) এই রকমই একটি আবেদন আল্লাহর রসূল (সাঃ)কে জানালেন। তিনি তাঁর আবেদন মঞ্জুর করে তাঁর ঘরে গিয়ে তাঁর পছন্দমত এক স্থানে ২ রাকআত নামায পড়লেন। অনুরুপ বারা’ বিন আযেব (রাঃ) নিজ বাড়িতে (বাড়ির লোকদের নিয়ে) জামাআত করে নামায পড়তেন। (বুখারী ৪২৫নং)

নূতন মসজিদ অপেক্ষা পুরাতন মসজিদের অধিক কোন ফযীলত ও বৈশিষ্ট্য বা অধিক সওয়াব আছে -এর কোন দলীল নেই। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/২১৬, ফাতাওয়া নাযীরিয়্যাহ্‌ ১/৩৫৯) তবে অপ্রয়োজনে যেহেতু একই মহ্‌ল্লায় একাধিক মসজিদ বিদআত, সেহেতু এর ফলে যেখানে ‘যিরার’ হওয়ার আশঙ্কা থাকে সেখানে নূতন ছেড়ে পুরাতন মসজিদে নামায পড়া উত্তম। কিছু সাহাবা ও সলফ এই আশঙ্কাতেই কোন কোন স্থানে পুরাতন মসজিদে নামায পড়েছেন। অবশ্য সেই মসজিদে নামায পড়া উত্তম, যে মসজিদ বিদআতশূন্য, যার জামাআত সংখ্যা অধিক (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/২১৩) এবং যার ইমাম ফাসেক বা বিদআতী বলে আশঙ্কা নেই।

আল্লাহর রসূল (সাঃ) ও তাঁর সাহাবাবর্গের যুগে কোন মসজিদকে তালাবদ্ধ করা হ্‌তো না। তবে সে যুগে মসজিদের ভিতর এমন কোন মূল্যবান আসবাব-পত্র থাকত না, যা চুরি বা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করা যেত। পরন্তু সে যুগের লোকেরাও এমন হৃদয়বিশিষ্ট ছিলেন যে, তাঁদের দ্বারা মসজিদের কোন প্রকার ক্ষতি হবে, সে আশঙ্কাই ছিল না। কিন্তু বর্তমান যুগের অবস্থা তার বিপরীত। সুতরাং আসবাব-পত্র ও সম্মান রক্ষার্থে মসজিদকে তালাবদ্ধ করা দূষণীয় নয়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৩/৭৯, ১৭/৭০)

যে সব স্থানে নামায পড়া মাকরুহ ও অবৈধ

১। গোরস্থানে নামায পড়া বৈধ নয়। মহানবী (সাঃ) বলেন, “সাবধান! তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা তাদের আম্বিয়া ও আউলিয়াদের কবরসমূহকে মসজিদ বানিয়ে নিত। শোন! তোমরা যেন কবরসমূহকে মসজিদ (নামাযের স্থান) বানিয়ে নিও না। আমি তোমাদের উপর এ বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারী করে যাচ্ছি।” (মুসলিম,  মিশকাত ৭১৩নং)

তিনি বলেন, “তোমাদের নিজ নিজ ঘরে কিছু (নফল বা সুন্নত) নামায পড়; আর তা (ঘর)কে কবর করে নিওনা।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৭১৪নং) কারণ, কবরস্থানে নামায পড়া হয় না।

“তোমরা কবরের উপর বসো না এবং কবরের দিকে মুখ করে নামায পড়ো না।” (মুসলিম, সহীহ ৯৭২ নং, প্রমুখ)

২। উট বাঁ ধার জায়গায় নামায নিষিদ্ধ। মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমরা ছাগল-ভেঁড়া বাঁধার জায়গায় নামায পড়, আর উট বাঁধার জায়গায় নামায পড়ো না।” (মুসলিম,  তিরমিযী, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ প্রমুখ, মিশকাত ৭৩৯নং)

৩। গোসলখানায় নামায মাকরুহ। যেহেতু এ স্থান সাধারণত: নাপাকী ধোওয়ার জন্য ব্যবহৃত। মহানবী (সাঃ) বলেন, “কবরস্থান ও গোসলখানা ছাড়া সারা পৃথিবীর সকল জায়গা মসজিদ (নামায পড়ার জায়গা)।” (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, দারেমী, সুনান, মিশকাত ৭৩৭নং)

৪। কসাইখানা পবিত্র হলে তাতে নামায শুদ্ধ।

৫। রাস্তার মাঝে গাড়ি বা লোকজনের আসা-যাওয়া না থাকলে নামায নিষিদ্ধ নয়। অনুরুপ মসজিদ ভরে গেলে লাগালাগি রাস্তাতেও নামায শুদ্ধ। তবে কেউ যেন ইমামের সামনের দিকে রাস্তায় না দাঁড়ায়। কারণ, ইমামের সামনে দাঁড়ালে নামায শুদ্ধ হয় না। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৫/৬৪)

৬। ময়লা ফেলার জায়গাতে যেহেতু নাপাকীই থাকার কথা, তাই সেখানে নামায শুদ্ধ নয়।

৭। কা’বা শরীফের ভিতরে এবং হাতীম বা হিজরে ইসমাঈল (কা’বা শরীফের পার্শ্বে যে জায়গাটা গোলাকার ঘেরা আছে সেই জায়গা) এর সীমার ভিতরেও নামায শুদ্ধ। আল্লাহর রসূল (সাঃ) একদা কা’বা-ঘরের ভিতরে ২ রাকআত নামায পড়েছেন। (বুখারী, মুসলিম,  আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ৬৯১ নং)

প্রকাশ যে, সাত জায়গায় নামায পড়া নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে যে হাদীস উল্লেখ করা হয়, তা খুবই দুর্বল। (মিশকাত ৭৩৭ নং হাদীসের টীকা, আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ২/২৫২ দ্র:)

৮। অমুসলিমদের উপাসনালয়ে কোন মূর্তি বা ছবি না থাকলে তাতে নামায পড়া বৈধ। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) মূর্তি না থাকলে গির্জায় নামায পড়েছেন। (বুখারী বিনা সনদে, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ১/৬৩২)

হযরত আবূ মূসা আশআরী, উমার বিন আব্দুল আযীয কর্তৃকও গির্জায় নামায পড়ার ব্যাপারে বর্ণনা এসেছে। (ইআশা: ১/৪২৩, নাইলুল আউতার, শাওকানী, ফিকহুস সুন্নাহ্‌ উর্দু১৩৫ পৃ:)

প্রকাশ যে, নিরুপায় অবস্থা বা দাওয়াতী উদ্দেশ্য ছাড়া অমুসলিমদের কোন ভজনালয়ে যাওয়া বৈধ নয়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ৩২/১০৪)

অমুসলিমদের সমাজে এবং তাদের মালিকানাভুক্ত জায়গা-জমিতেও নামায শুদ্ধ। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৫/৬৮) বরং তাদের বাড়ির ভিতরেও (মূর্তি না থাকলে) নামায শুদ্ধ হয়ে যাবে। (ঐ ৩২/১০৪) তবে পবিত্রতা ইত্যাদি অন্যান্য শর্তাবলী সর্বক্ষেত্রে অবশ্য পালনীয়।

৯। নক্সাদার মুসাল্লায় নামায শুদ্ধ হলেও তাতে নামায পড়া মাকরুহ (অপছন্দনীয়)। যেহেতু এতে নামাযীর মনে কেড়ে নিয়ে উদাসীন করে ফেলে। এই জন্যই বিশ্বনবী (সাঃ) নক্সাদার কাপড়ে নামায পড়াকে অপছন্দ করেছেন। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৭৫৭ নং দ্র:)

একদা হযরত আয়েশা (রাঃ) এর হুজরার দেওয়ালে ছবিযুক্ত পর্দা টাঙ্গা থাকতে দেখলে তিনি তাঁকে বললেন, “তোমার এই পর্দা আমাদের নিকট থেকে সরিয়ে নাও। কারণ, ওর ছবিগুলো আমার নামাযে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে।” (বুখারী ৩৭৪ নং, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ৫/২৯৩, ১৫/৭৪, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৭৮)

তদনুরুপ সামনে ছবিযুক্ত ক্যালেন্ডার ইত্যাদি রেখে নামায পড়া মাকরুহ। (ইআশা: ১/৩৯৯ দ্র:)

বলা বাহুল্য, এ জন্যই মসজিদের সামনের দেওয়ালে কোন প্রকার দৃষ্টি-আকর্ষক নক্সা, বস্তু বা বিজ্ঞপ্তি, সময়সূচী ইত্যাদি রাখাও মাকরুহ।

১০। বিছানা পবিত্র হলে তাতে নামায পড়া দূষণীয় নয়। হযরত আনাস (রাঃ) নিজ বিছানায় নামায পড়েছেন। (ইআশা: ২৮১০ নং, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ১/৫৮৬)

১১। পেশাব-পায়খানা ঘরের ছাদে বা পিছনে (পেশাব-পায়খানা ঘরকে সামনে করে নামায শুদ্ধ। ছাত বা সামনের দেওয়াল পবিত্র হলে নামায মাকরুহ নয়। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৭০, দারেমী, সুনান ৯৫পৃ:) আড়াল থাকলে প্রস্রাব-পায়খানার নালা বা পাইপ সামনে করে, অথবা তার উপর ব্রিজে, অথবা মলমূত্রের পাইপের নিচে নামায শুদ্ধ। (বুখারী ৮২পৃ দ্র:)

১২। যে রুমে মাদকদ্রব্য থাকে সে রুমে নামায পড়তে হলে নামায শুদ্ধ হয়ে যাবে। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৪২৬)

১৩। ভাড়া দেওয়া বাড়ির মালিক ভাড়া গ্রহণকারীকে ঐ ঘরে থাকতে না দিতে চাইলে এবং সে সেখান হতে বের হতে না চাইলে তথা জোরপূর্বক বাস করলেও সে ঘরে নামায শুদ্ধ হয়ে যাবে। তবে এ কাজে সে নিরুপায় না হলে গুনাহগার হতে পারে। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৯/১৫৫)

সুতরাহ্‌

নামাযীর সামনে বেয়ে কেউ পার হবে না এমন ধারণা থাকলেও সামনে সুতরাহ্‌ রেখে নামায পড়া ওয়াজেব। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ৮২পৃ:) যেমন সফরে, বাড়িতে, মসজিদে,হারামের মসজিদদ্বয়ে সর্বস্থানে একাকী ও ইমামের জন্য সুতরাহ্‌ ব্যবহার করা জরুরী।

মহানবী (সাঃ) বলেন, “সুতরাহ্‌ ছাড়া নামায পড়ো না।” (ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ ৮০০ নং)

“যে ব্যক্তি সক্ষম হয় যে, তার ও তার কিবলার মাঝে কেউ যেন না আসে, তাহলে সে যেন তা করে।” (আহমাদ, মুসনাদ, দারাক্বুত্বনী, সুনান, ত্বাবারানী, মু’জাম)

“যখন তোমাদের কেউ নামায পড়বে, তখন সে যেন সামনে সুতরাহ্‌ রেখে নামায পড়ে।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, জামে ৬৫০, ৬৫১ নং)

পক্ষান্তরে আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর বিনা সুতরায় নামায পড়ার হাদীস যয়ীফ।।

সুতরাহ্‌ বলে কোন কিছুর আড়ালকে। নামাযী যখন নামায পড়ে তখন তার হৃদয় জোড়া থাকে সৃষ্টিকর্তা মা’বূদ আল্লাহর সাথে। বিচ্ছিন্ন থাকে পার্থিব সকল প্রকার কর্ম ও চিন্তা থেকে। ইবাদত করা অবস্থায় সে যেন মা’বূদ আল্লাহকে দেখতে পায়। কিন্তু তার সম্মুখে যখন এমন কোন ব্যক্তি বা পশু এসে উপস্থিত হয়, যে তার একাগ্রতা ও ধ্যান ভঙ্গ করে দেয়, মনোযোগ কেড়ে নেয়, দৃষ্টি চুরি করে ফেলে এবং কোন ভয় বা কামনা তার মনে জায়গা নিয়ে তাকে আল্লাহর দরবার হতে সরিয়ে পার্থিব জগতে ফিরিয়ে দেয়, তখন তার জন্য জরুরী এমন এক আড়াল ও অন্তরালের, যার ফলে সে নিজের দৃষ্টি ও মনকে তার ভিতরে সীমাবদ্ধ রাখতে পারে। আর তার পশ্চাতে কোন কিছু অতিক্রম করলেও সে তা ভ্রুক্ষেপ না করতে পারে।

সুতরাং সুতরাহ্‌ রেখে নামায না পড়া গুনাহর কাজ। পরন্তু ঐ অবস্থায় নামাযীর সম্মুখ বেয়ে কেউ পার হয়ে গেলে তার নামাযের সওয়াব কম হয়ে যায়। (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ১/৫৮৪)

সুতরাহ্‌ কিসের হবে?

আল্লাহর রসূল (সাঃ) কর্তৃক বিভিন্ন প্রকার সুতরাহ্‌ প্রমাণিত। যেমন, কখনো তিনি মসজিদের থামকে সামনে করে নামায পড়তেন। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ৮২পৃ:) ফাঁকা ময়দানে নামায পড়লে এবং আড়াল করার জন্য কিছু না পেলে সামনে বর্শা গেড়ে নিতেন। আর লোকেরা তাঁর পিছনে বিনা সুতরায় নামায পড়ত। (বুখারী ৪৯৪, ৪৯৮নং, মুসলিম,  ইবনে মাজাহ্‌, সুনান) কখনো বা নিজের সওয়ারী উটকে আড়াআড়ি দাঁড় করিয়ে তাকে সুতরাহ্‌ বানিয়ে নামায পড়তেন। (বুখারী ৫০৭ নং, আহমাদ, মুসনাদ) কখনো জিনপোশ (উটের পিঠে বসবার আসন) কে সামনে রেখে তার কাষ্ঠাংশের সোজাসুজি নামায পড়তেন। (বুখারী ৫০৭নং, মুসলিম,  ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, আহমাদ, মুসনাদ) তিনি বলতেন, “তোমাদের কেউ যখন তার সামনে জিনপোশের শেষে সংযুক্ত কাষ্ঠখন্ডের মত কিছু রেখে নেয়, তখন তার উচিৎ, (তার পশ্চাতে) নামায পড়া এবং এরপর তার সম্মুখ বেয়ে কেউ পার হয়ে গেলে কোন পরোয়া না করা।” (মুসলিম, সহীহ ৪৯৯ নং, আবূদাঊদ, সুনান) একদা তিনি একটি গাছকে সুতরাহ্‌ বানিয়ে নামায পড়েছেন। (নাসাঈ, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ) কখনো তিনি আয়েশা (রাঃ) এর খাটকে সামনে করে নামায পড়েছেন। আর ঐ সময় আয়েশা (রাঃ) তার উপর চাদর ঢাকা দিয়ে শুয়ে থাকতেন। (বুখারী ৫১১ নং, মুসলিম, সহীহ)

সুফয়্যান বিন উয়াইনাহ্‌ বলেন, তিনি শারীককে কোন ফরয নামায পড়ার সময় তাঁর টুপীকে সামনে রেখে সুতরাহ্‌ বানাতে দেখেছেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৯১নং)

প্রকাশ যে, কিছু না পেলে দাগ টেনে নেওয়ার হাদীস সহীহ নয়। (যইফ আবূদাঊদ, সুনান ১৩৪, যইফ ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ১৯৬, ৯৪৩, যইফ জামে ৫৬৯নং)

সুতরাহ্‌ হবে উটের পিঠে স্থাপিত জিনপোশের পেছনে সংযুক্ত কাষ্ঠখন্ডের মত (কম-বেশী একহাত, আধ মিটার বা ৪৭ সেমি. উঁচু) কোন বস্তু । কোন দাগ সুতরাহ্‌ বলে গণ্য হবে না। তবে যে বস্তু মাটি বা মুসাল্লা থেকে একটুও উঁচু হয়ে থাকে তাকেই সুতরাহ্‌ বলে ধরে নেওয়া যাবে। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৮৪)

প্রকাশ যে, মুসাল্লা, চাটাই বা কার্পেটের শেষ প্রান্তকে সুতরাহ্‌ বলে গণ্য করা যাবে না। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/৩১৭)

সুতরাহ্‌ কতদূরে রাখতে হবে?

মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ যখন নামায পড়বে, তখন সে যেন সামনে সুতরাহ্‌ রেখে নামায পড়ে এবং তার নিকটবর্তী হয়। যাতে শয়তান যেন তার নামাযকে নষ্ট করে না দিতে পারে।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, জামে ৬৫০নং)

একদা তিনি কা’বা শরীফের ভিতরে নামায পড়লে তাঁর ও দেওয়ালের মাঝে ৩ হাত ব্যবধান ছিল। (বুখারী ৫০৬, আহমাদ, মুসনাদ, নাসাঈ, সুনান) তাঁর মুসাল্লা (সিজদার জায়গা) ও দেওয়ালের মাঝে একটি ছাগল (অথবা ভেঁড়া) পার হয়ে যাওয়ার মত (প্রায় আধহাত) ফাঁক বা দূরত্ব থাকত। (বুখারী ৪৯৬নং, মুসলিম, সহীহ)

প্রকাশ থাকে যে, সুতরার একেবারে সোজাসুজি না দাঁড়িয়ে তার একটু ডানে বা বামে সরে দাঁড়ানোর হাদীস শুদ্ধ নয়। (যইফ আবূদাঊদ, সুনান ১৩৬নং)

ইমামের সুতরাই মুক্তাদীদের সুতরাহ্‌

ইমামের সামনে সুতরাহ্‌ থাকলে মুক্তাদীদের জন্য পৃথক সুতরার দরকার হয় না। মহানবী (সাঃ) ঈদের দিন নামায পড়তে বের হলে তাঁর সামনে বর্শা গাড়া হত। তিনি তা সুতরাহ্‌ বানিয়ে নামায পড়তেন এবং লোকেরা তাঁর পশ্চাতে (বিনা সুতরায়) নামায পড়ত। (বুখারী ৪৯৪, মুসলিম, সহীহ ৫০১নং)

একদা তিনি বাত্বহায় নামায পড়লেন। তাঁর সামনে (সুতরাহ্‌) ছিল ছোট একটি বর্শা। আর তাঁর সম্মুখ বেয়ে মহিলা ও গাধা পার হয়ে যাচ্ছিল। (বুখারী ৪৯৫নং, মুসলিম, সহীহ ২৫২নং)

বিদায়ী হ্‌জ্জের সময় মহানবী (সাঃ) মিনায় নামায পড়ছিলেন। ইবনে আব্বাস (রাঃ) একটি গাধীর পিঠে চড়ে কিছু কাতারের সামনে বেয়ে পার হয়ে এসে নামলেন। অতঃপর গাধীটিকে চরতে ছেড়ে দিয়ে কাতারে শামিল হলেন। তা দেখে কেউ তাঁর প্রতিবাদ করল না। (বুখারী ৪৯৩, মুসলিম,  মিশকাত ৭৮০নং)

নামাযীর সামনে বেয়ে পার হওয়া হারাম

মহানবী (সাঃ) বলেন, “যে নামাযীর সামনে বেয়ে পার হয়, সে যদি জানত যে, এতে তার কত পাপ হবে, তাহলে সে ৪০ (বছর বা মাস বা দিন নামাযীর সালাম ফিরার) অপেক্ষা করাকে ভাল মনে করত, তবুও নামাযীর সামনে বেয়ে অতিক্রম করত না।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৭৭৬ নং)

অবশ্য নামাযীর সামনে সুতরা থাকলে পার হওয়া হারাম বা গুনাহর কাজ নয়। অনুরুপ সুতরাহ্‌ না থাকলেও যদি নামাযীর সামনে প্রায় ৩ হাত দূর থেকে পার হয়, তাহলেও গুনাহ হবে না। (মাজমূ’ ফাতাওয়া, ইবনে বায ২/২৬৭)

কেউ সামনে বেয়ে পার হলে নামাযীর কর্তব্য

মহানবী (সাঃ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ সামনে সুতরাহ্‌ রেখে নামায পড়লে এবং কেউ তার ঐ সুতরার ভিতর দিয়ে পার হতে চাইলে সে যেন তার বুকে ঠেলে পার হতে বাধা দেয় ও যথাসম্ভব রুখতে চেষ্টা করে।” এক বর্ণনায় আছে, “তাকে যেন দু’ দু’ বার বাধা দেয়। এর পরেও যদি সে মানতে না চায় (এবং ঐ দিকেই পার হতেই চায়) তাহলে সে যেন তার সাথে লড়াই করে। কারণ, (বাধাদান সত্ত্বেও যে বাধা মানে না) সে তো শয়তান।” (বুখারী, মুসলিম,ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, মিশকাত ৭৭৭নং)

তিনি বলেন, “সুতরাহ্‌ ছাড়া নামায পড়ো না। কাউকে তোমার সামনে বেয়ে পার হতেও দিও না। (সুতরার ভিতর বেয়ে যেতে) সে যদি মানা না মানে, তবে তার সাথে লড়। কারণ, তার সাথে শয়তান আছে।” (ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ ৮০০নং)

আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) জুমআর দিন একটি থামকে সুতরাহ্‌ করে নামায পড়ছিলেন। ইত্যবসরে বানী উমাইয়ার এক ব্যক্তি তাঁর ও থামের মাঝ বেয়ে পার হতে গেলে তিনি তাকে বাধা দিলেন। কিন্তু লোকটি পুনরায় পার হওয়ার চে ষ্টা করল। তিনি তার বুকে এক থাপ্পড় দিলেন। লোকটি মদ্বীনার গভর্নর মারওয়ানের নিকট তাঁর বিরুদ্ধে নালিশ জানাল। মারওয়ান আবূ সাঈদ (রাঃ) কে বললেন, ‘আপনি আপনার ভাইপোকে মেরেছেন কি কারণে?’ আবূ সাঈদ (রাঃ) বললেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ যখন কিছুকে সুতরাহ্‌ বানিয়ে নামায পড়ে, অতঃপর কেউ তার ঐ সুতরার ভিতর দিয়ে পার হতে চায়, তবে সে যেন তাকে বাধা দেয়। এতেও যদি সে না মানে, তাহলে সে যেন তার সাথে লড়াই করে। কারণ, সে তো শয়তান।” সুতরাং আমি শয়তানকেই তো মেরেছি!’ (ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ ৮১৭নং)

শুধু মানুষই নয়, কোন পশুও সামনে বেয়ে পার হতে চাইলে তাকেও বাধা দেওয়া উচিৎ। ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘একদা নবী (সাঃ) নামায পড়ছিলেন। এমন সময় একটি ছাগল (বা ভেঁড়া) তাঁর সামনে দিয়ে ছুটে পার হতে চাইল। কিন্তু তিনি তার আগেই তাকে ধরে ফেললেন। এমনকি তার পেটকে দেওয়ালের সাথে লাগিয়ে দিলেন। অতঃপর ছাগল (বা ভেঁড়া)টি তাঁর পিছন দিক হতে পার হয়ে গেল।’ (আবূদাঊদ, সুনান ৭০৮-৭০৯, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ ৮২৭নং, ত্বাবা,হাকেম, মুস্তাদরাক)

সুতরাং বাধা দেওয়া ওয়াজেব এবং তাতে একটু নড়া-সরা দূষণীয় নয়।

বিনা সুতরায় নামায বাতিল কখন?

সুতরা রেখে নামায পড়লে এবং তার পশ্চাৎ বেয়ে কেউপার হয়ে গেলে নামাযীর নামাযে কোন ক্ষতি হয় না। (বুখারী ৪৯৯, মুসলিম, সহীহ ২৫২নং)

সুতরার ভিতর দিয়েও কোন পুরুষ, শিশু বা পশু পার হয়ে গেলে নামাযীর মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে ঠিকই, তবে নামায একেবারে নষ্ট হয়ে যায় না। পরন্তু বিনা সুতরায় নামায পড়লে এবং সামনে দিয়ে সাবালিকা মেয়ে, গাধা বা মিশমিশে কালো কুকুর পার হয়ে গেলে নামায বাতিল হয়ে যায়।

মহানবী (সাঃ) বলেন, “(সুতরাহ্‌ না হলে) সাবালিকা মেয়ে, গাধা ও কালো কুকুর নামায নষ্ট করে ফেলে।” আবূ যার বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! হ্‌লুদ ও লাল না হয়ে কালো কুকুরেই নামায নষ্ট করে তার কারণ কি?’ বললেন, “কারণ, কালো কুকুর শয়তান।” (মুসলিম, সহীহ ৫১০,আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ)

নাবালিকা মেয়ে অতিক্রম করলে নামায নষ্ট হয় না। একদা বানী আব্দুল মুত্তালিবের দু’টি ছোট মেয়ে মারামারি করতে করতে তাঁর সামনে এসে তাঁর হাঁটু ধরে ফেলল। তিনি উভয়কে দু’দিকে সরিয়ে দিলেন। আর এতে তিনি নামায ভাঙ্গলেন না। (আবূদাঊদ, সুনান ৭১৬, ৭১৭, নাসাঈ, সুনান ৭২৭নং)

যেমন নিজের স্ত্রী বা কোন মহিলা নামাযীর সামনে ঢাকা নিয়ে অন্ধকারে ঘুমিয়ে থাকলে নামাযের কোন ক্ষতি হয় না। আল্লাহর রসূল (সাঃ) রাত্রে তাহাজ্জুদ পড়তেন, আর আয়েশা (রাঃ) তাঁর সামনে জানাযার লাশের মত শুয়ে ঘুমাতেন। (বুখারী ৫০৮, মুসলিম, সহীহ ৫১২, মিশকাত ৭৭৯নং) যেমন তিনি কখনো কখনো চাদরের ভিতর থেকে পায়ের দিকে চুপে চুপে নিজের প্রয়োজনে বের হয়ে যেতেন। এতেও তাঁর নামাযের কোন ক্ষতি হ্‌তো না। (ঐ) এক বর্ণনায় আছে, ‘তখন ঘরে বাতি ছিল না।’ (বুখারী ৫১৩, মুসলিম, সহীহ ৫১২নং)

প্রকাশ যে, কোন মহিলা-নামাযীর সামনে বেয়ে (বিনা সুতরায়) কোন (সাবালিকা) মেয়ে পার হলেও নামায নষ্ট হয় না। (আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ ২৩৫৬ নং, মুহাল্লা ৪/১২, ২০)

ক্বিবলাহ্‌

ক্বিবলার বিধান

সমগ্র মুসলিম-জাতির জন্য রয়েছে একই ক্বিবলার বিধান। মহান আল্লাহ বলেন,

ومِنْ حَيْثُ خَرَجْتَ فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ، وَحَيْثُ مَا كُنْتُمْ فَوَلُّوْا وَجُوْهَكُمْ شَطْرَه।

অর্থাৎ, আর তুমি যেখান হতেই বের হও না কেন, মসজিদুল হারাম (কা’বা শরীফের) দিকে মুখ ফিরাও এবং তোমরা যেখানেই থাক না কেন, ঐ (কা’বার) দিকেই মুখ ফিরাবে। (কুরআন মাজীদ ২/১৫০)

আল্লাহর নবী (সাঃ) যখন নামাযে দাঁড়াতেন, তখন (ফরয-নফল সকল নামাযেই) কা’বা শরীফের দিকে মুখ ফিরাতেন। (ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ২৮৯নং) তিনি এক নামায ভুলকারীর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “যখন নামাযে দাঁড়াবার ইচ্ছা করবে তখন পরিপূর্ণরুপে ওযু কর। অতঃপর ক্বিবলার দিকে মুখ করে তকবীর বল---।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৭৯০নং)


নামায শুদ্ধ হওয়ার জন্য ক্বিবলাহ্‌-মুখ করা হল অন্যতম শর্ত। নামাযের সময় বান্দার থাকে দু’টি অভিমুখ; একটি হল হৃদয়ের এবং অপরটি হল দেহের। তার হৃদয়ের অভিমুখ থাকে আল্লাহর প্রতি। আর দেহ্‌ ও চেহারার অভিমুখ হয় আল্লাহরই এক বিশেষ নিদর্শন কা’বাগৃহের প্রতি। যে গৃহের তা’যীম করতে এবং যার প্রতি অভিমুখ করতে বান্দা আদিষ্ট হয়েছে। সারা বিশ্বের মুসলমানদের হৃদয় যেমন আল্লাহর অভিমুখী, তেমনিই নামাযে তাদের সকলের দেহ্‌-মুখও একই গৃহের প্রতি অভিমুখী হয়। এতে রয়েছে সারা মুসলিম জাতির ঐক্য ও সংহ্‌তির বহিঃপ্রকাশ এবং তাদের সকল বিষয়ে একাত্মতা অবলম্বন করার প্রতি ইঙ্গিত।

ক্বিবলার অভিমুখ

যারা কা’বার আশেপাশে নামায পড়ে এবং কা’বা তাদের দৃষ্টির সামনে থাকে, তাদের জন্য হুবহু কা’বার প্রতি মুখ ফেরানো জরুরী। পক্ষান্তরে যারা কা’বা দেখতে পায় না তাদের জন্য হুবহু কা’বার প্রতি মুখ ফেরানো জরুরী নয়। যেহেতু মহানবী (সাঃ) বলেন, “পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝামাঝি হল ক্বিবলার দিক।” (তিরমিযী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, মিশকাত ৭১৫নং)

তিনি বলেন, “প্রস্রাব-পায়খানা করার সময় তোমরা ক্বিবলাহ্‌কে সামনে বা পিছন করে বসো না; বরং পূর্ব অথবা পশ্চিম দিককে সামনে বা পিছন করে বস।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৩৩৪নং)

উক্ত হাদীস দু’টি হতে এ কথা বুঝা যায় যে, মদ্বীনাবাসীদের জন্য ক্বিবলাহ্‌ হল পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝে (দক্ষিণ) দিকে। যেহেতু মদ্বীনা শরীফ থেকে কা’বার অবস্থান হল দক্ষিণে। সুতরাং যদি মদ্বীনায় কেউ দক্ষিণ মুখে নামায পড়ে তবে তার ক্বিবলাহ্‌-মুখে নামায পড়া হবে। যদিও হুবহু কা’বা থেকে তার অভিমুখ একটু ডানে-বামে সরেও হয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ২/২৬৭)


অতএব পৃথিবীর মানচিত্রে যারা কা’বার যে দিকে অবস্থান করে তার ঠিক বিপরীত দিকে হবে তাদের ক্বিবলাহ্‌। ভারত-বাংলাদেশ পড়ছে কা’বার পূর্বে, তাই এ দেশের লোকেদেরকে পশ্চিম দিকে মুখ করে নামায পড়তে হয়। বলা বাহুল্য, মাহাত্ম হল ক্বিবলার; পশ্চিম দিকের কোন মাহাত্ম নয়।

ক্বিবলাহ জানতে না পারলে

কোন অচেনা-অজানা স্থানে অন্ধকার বা মেঘের কারণে চাঁদ, সূর্য, তারা দেখতে না পাওয়ার ফলে ক্বিবলার দিক কোন্‌টা নির্ণয় করতে না পারলে এবং জানার মত সে রকম কোন যন্ত্র বা উপায় না থাকলে, মনে মনে সঠিক ধারণার উপর ভিত্তি করেই নামায পড়তে হবে। অবশ্য নামাযের পর ক্বিবলার সঠিক দিক অন্য বুঝতে পারলেও নামায শুদ্ধ হয়ে যাবে। পুনরায় ঐ নামায সঠিক ক্বিবলাহ্‌-মুখে আর পড়তে হবে না।

হযরত জাবের (রাঃ) বলেন, আমরা আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর সঙ্গে কোন এক সফর বা অভিযানে ছিলাম। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে (নামাযের সময়) আমরা ক্বিবলার দিক নির্ণয়ে মতভেদ করলাম। এতে প্রত্যেকে নিজ নিজ মতে পৃথক পৃথক নামায পড়ে নিল। (তখন নবী (সাঃ) সেখানে ছিলেন না।) সঠিক ক্বিবলার দিকে নামায হয়েছে কি না তা পরীক্ষা করার জন্য প্রত্যেকে নিজের নিজের সামনে দাগ দিয়ে রাখল। সকাল হলে সে দাগগুলো আমরা দেখলাম; দেখলাম, আমরা ক্বিবলার ভিন্ন দিকে মুখ করে নামায পড়ে ফেলেছি। অতঃপর ব্যাপারটি নবী (সাঃ) এর নিকট উল্লেখ করলে তিনি আমাদেরকে ঐ নামায পুনরায় পড়তে আদেশ করলেন না। বরং তিনি বললেন, “তোমাদের নামায শুদ্ধ হয়ে গেছে।” (দারাক্বুত্বনী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, বায়হাকী, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ২৯৬নং)

নামায পড়া অবস্থায় যদি কারো বা কিছুর মাধ্যমে ক্বিবলার সঠিক দিক জানা যায়, তাহলে সাথে সাথে সেদিকে ফিরে যাওয়া জরুরী। মহানবী (সাঃ) শুরুতে বাইতুল মাক্বদেসের দিকে মুখ করে নামায পড়তেন।  তিনি মনে মনে চাইতেন যে, কা’বাই তাঁর ক্বিবলাহ্‌ হোক। সে সময় এই আয়াত অবতীর্ণ হল,

قَدْ نَرَىٰ تَقَلُّبَ وَجْهِكَ فِي السَّمَاءِ ۖ فَلَنُوَلِّيَنَّكَ قِبْلَةً تَرْضَاهَا ۚ فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ ۚ وَحَيْثُ مَا كُنْتُمْ فَوَلُّوا وُجُوهَكُمْ شَطْرَهُ ۗ وَإِنَّ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ لَيَعْلَمُونَ أَنَّهُ الْحَقُّ مِنْ رَبِّهِمْ ۗ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا يَعْمَلُونَ

অর্থাৎ, আকাশের দিকে তোমার বারবার তাকানোকে আমি প্রায় লক্ষ্য করি। সুতরাং আমি তোমাকে এমন ক্বিবলার দিকে ফিরিয়ে দেব, যা তুমি পছন্দ কর। অতএব তুমি (এখন) মাসজিদুলহারামের দিকে মুখ ফেরাও। (কুরআন মাজীদ ২/১৪৪) এরপর থেকে তিনি কা’বার দিকে মুখ ফিরিয়ে নামায পড়তে লাগলেন। কুবার মসজিদে লোকেরা ফজরের নামায পড়ছিল। ইত্যবসরে এক আগন্তুক তাদেরকে এসে বলল, ‘আজ রাত্রে আল্লাহর রসূলের উপর কিছু আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে, যাতে তাঁকে কা’বার দিকে মুখ করে নামায পড়তে আদেশ করা হয়েছে। সুতরাং শোন! তোমরা কা’বার দিকে মুখ ফেরাও।’ তখন তাদের মুখ ছিল শাম (বর্তমানে প্যালেস্টাইন) এর দিকে। সংবাদ শোনামাত্র তারা কা’বার দিকে ঘুরে গেল। (বুখারী, মুসলিম,  আহমাদ, মুসনাদ, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ২৯০নং)

কোন্‌ কোন্‌ অবস্থায় ক্বিবলাহ্‌-মুখ না হলেও নামায শুদ্ধ

১। অসুস্থ ও অক্ষম ব্যক্তি ক্বিবলার দিকে মুখ না করতে পারলে এবং তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার মত কেউনা থাকলে, সে যে মুখে নামায পড়বে সেই মুখেই নামায শুদ্ধ হয়ে যাবে। যেহেতু “আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের অতীত বোঝা বহ্‌নের ভার দেন না।” (কুরআন মাজীদ ২/২৮৬)

২। যুদ্ধ চলাকালীন হানাহানির সময় নামাযে ক্বিবলাহ্‌-মুখ হওয়া জরুরী নয়। শত্রুর গতিবিধি লক্ষ্য রেখে তাদের দিকে মুখ করেই নামায পড়তে হবে। (বুখারী, মুসলিম,  ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৫৮৮নং)

মহান আল্লাহ বলেন, “যদি তোমরা (শত্রুর) ভয় কর, তাহলে পথচারী অথবা আরোহী অবস্থায় (নামায পড়ে নাও)।” (কুরআন মাজীদ ২/২৩৯)

ইবনে উমার (রাঃ) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘ভয় খুব বেশী হলে তোমরা দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় অথবা সওয়ার হওয়া অবস্থায় ক্বিবলার দিকে মুখ করে অথবা না করেই নামায পড়ে নাও।’ (বুখারী ৪৫৩৫ নং)  আর মহানবী (সাঃ) বলেন, “শত্রুর সাথে যুদ্ধরত হলে (নামাযে) তকবীর ও মাথার ইশারাই যথেষ্ট।” (বায়হাকী ৩/২৫৫)

৩। সফরে উট, ঘোড়া বা গাড়ির উপর নফল বা সুন্নত নামায পড়ার সময়ও ক্বিবলাহ্‌-মুখ হওয়া জরুরী নয়। যেহেতু নবী (সাঃ) সফরে নিজের সওয়ারীর উপর যে মুখে উট চলত, সেই মুখেই নফল ও বিত্‌র নামায পড়তেন। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ১৩৪০ নং)

এ ব্যাপারে কুরআন মাজীদের এই আয়াত অবতীর্ণ হয়, “পূর্ব ও পশ্চিম সব দিকই আল্লাহর। সুতরাং তুমি যে দিকেই মুখ ফেরাও, সে দিকই আল্লাহর।” (কুরআন মাজীদ ২/১১৫)

আর কখনো কখনো তিনি উটনীর উপর নফল পড়ার ইচ্ছা করলে উটনী সহ্‌ ক্বিবলাহ্‌-মুখ হয়ে তকবীর দিতেন। তারপর বাকী নামায নিজের সওয়ারীর পথ অভিমুখেই সম্পন্ন করতেন। (আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ, প্রমুখ সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ৭৫পৃ:)  অবশ্য ফরয নামাযের সময় সওয়ারী থেকে নেমে ক্বিবলাহ্‌-মুখ হয়ে নামায পড়তেন। (বুখারী, আহমাদ, মুসনাদ, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ৭৫পৃ:)

কিয়াম

কিয়ামের বিবরন



আল্লাহর রসূল ফরয ও সুন্নত নামায দাঁড়িয়েই পড়তেন। মহান আল্লাহ বলেন,

 حَافِظُوْا عَلَى الصَّلَوَاتِ وَالصَّلاَةِ الْوُسْطى وَقُوْمُوْا للهِ قَانِتِيْنَ

অর্থাৎ, তোমরা নামাযসমূহের প্রতি এবং বিশেষ করে মধ্যবর্তী (আসরের) নামাযের প্রতি যত্নবান হও। আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে বিনীতভাবে দন্ডায়মান হও। (কুরআন মাজীদ ২/২৩৮)

অবশ্য অসুস্থ বা অক্ষম হলে বসে এবং মুসাফির হলে সওয়ারীর উপর বসে নামায পড়েছেন।

ইমরান বিন হুসাইন (রাঃ) বলেন, আমার অর্শ রোগ ছিল। আমি (কিভাবে নামায পড়ব তা) আল্লাহর রসূল (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, “তুমি দাঁড়িয়ে নামায পড়। না পারলে বসে পড়। তাও না পারলে পার্শ্বদেশে শুয়ে পড়।” (বুখারী, আবূদাঊদ, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ১২৪৮ নং)


সুতরাং সক্ষম হলে ফরয নামাযে কিয়াম (দাঁড়িয়ে পড়া) ফরয। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৪/১১২)

নামাযের নিয়মাবলি

তাকবীরে তাহ্‌রীমা

নামাযে দাঁড়িয়ে নবী মুবাশ্‌শির (সাঃ) ‘আল্লা-হু আকবার’ বলে নামায শুরু করতেন। (এর পূর্বে ‘বিসমিল্লাহ্‌’ বা অন্য কিছু বলতেন না।) নামায ভুলকারী সাহাবীকেও এই তকবীর পড়তে আদেশ দিয়েছেন। আর তাকে বলেছেন, “ততক্ষণ পর্যন্ত কোন মানুষেরই নামায পূর্ণ হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে ঠিক যথার্থরুপে ওযু করেছে। অতঃপর ‘আল্লাহু আকবার’ বলেছে।” (ত্বাবারানী, মু’জাম, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ৮৬পৃ:)


তিনি আরো বলেছেন, “নামাযের চাবিকাঠি হল পবিত্রতা (গোসল-ওযু), (নামাযে প্রবেশ করে পার্থিব কর্ম ও কথাবার্তা ইত্যাদি)হারাম করার শব্দ হল তকবীর। আর (নামায শেষ করে সে সব)হালাল করার শব্দ হল সালাম।” (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩০১নং)

এই তকবীরও নামাযে ফরয। ‘আল্লাহু আকবার’ ছাড়া অন্য শব্দে (যেমন আল্লাহ আজাল্ল্‌, আল্লাহু আ’যাম প্রভৃতি সমার্থবোধক) তকবীর বৈধ ও যথেষ্ট নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/২৬)

ইবনুল কাইয়েম (রহঃ) বলেন, ‘তাহ্‌রীমার সময় তাঁর অভ্যাস ছিল, ‘আল্লাহু আকবার’ শব্দ বলা। অন্য কোন শব্দ নয়। আর তাঁর নিকট হতে কেউই এই শব্দ ছাড়া অন্য শব্দে তকবীর বর্ণনা করেন নি।’ (যাদুল মাআদ ১/২০১-২০২)

তাকবীরে তাহ্‌রীমা বলার সময় (একটু আগে, সাথে সাথে বা একটু পরে) মহানবী (সাঃ) তাঁর নিজহাত দু’টিকে কাঁধ বরাবর তুলতেন। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৭৯৩নং) আর কখনো কখনো কানের ঊর্ধ্বাংশ বরাবরও ‘রফ্‌য়ে ইয়াদাইন’ করতেন। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৭৯৫নং) হাত তোলার সময় তাঁর হাতের আঙ্গুলগুলো লম্বা (সোজা) হয়ে থাকত। (জড়সড় হয়ে থাকত না)। আর আঙ্গুলগুলোর মাঝে (খুব বেশী) ফাঁক করতেন না, আবার এক অপরের সাথে মিলিয়েও রাখতেন না। (আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ ৪৫৯নং,হাকেম, মুস্তাদরাক)

প্রকাশ থাকে যে, ‘রফ্‌য়ে ইয়াদাইন’ করার সময় কানের লতি স্পর্শ করা বিধেয় নয়। যেমন এই সময় মাথা তুলে উপর দিকে তাকানোও অবিধেয়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ২৩/৯৫) তদনুরুপহাত তোলার পর নিচে ঝুলিয়ে দিয়ে তারপর হাত বাঁধাও ভিত্তিহীন। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৪৩) যেমন তকবীরের পূর্বে নামায শুরু করার সময় ‘বিসমিল্লাহ্‌’ বলা বিদআত। (ঐ ১/১৩৩)

হ্‌স্ত-বন্ধন (হাত বাধা)

এরপর নবী মুবাশ্‌শির (সাঃ) তাঁর ডানহাতকে বামহাতের উপর রাখতেন। (মুসলিম,  আবূদাঊদ, সুনান ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩৫২নং) আর তিনি বলতেন, “আমরা আম্বিয়ার দল শীঘ্র ইফতারী করতে, দেরী করে সেহ্‌রী খেতে এবং নামাযে ডানহাতকে বামহাতের উপর রাখতে আদিষ্ট হয়েছি।” (ত্বাবারানী, মু’জাম, মাজমাউয যাওয়াইদ,হাইষামী ২/১০৫)

একদা তিনি নামাযে রত এক ব্যক্তির পাশ দিয়ে পার হতে গিয়ে দেখলেন, সে তার বাম হাতকে ডান হাতের উপর রেখেছে। তিনি তার হাত ছাড়িয়ে ডান হাতকে বাম হাতের উপর চাপিয়ে দিলেন। (আহমাদ, মুসনাদ ৩/৩৮১, আবূদাঊদ, সুনান ৭৫৫নং)

সাহল বিন সা’দ (রাঃ) বলেন, লোকেরা আদিষ্ট হত, তারা যেন নামাযে তাদের ডানহাতকে বাম প্রকোষ্ঠ (হাতের রলার) উপর রাখে। (বুখারী ৭৪০নং)

ওয়াইল বিন হুজর (রাঃ) বলেন, তিনি ডান হাতকে বাম হাতের চেটোর পিঠ, কব্জি ও প্রকোষ্ঠের উপর রাখতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৭২৭ নং, নাসাঈ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ)

কখনো বা ডান হাত দ্বারা বাম হাতকে ধারণ করতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৭২৬নং, নাসাঈ, সুনান, তিরমিযী, সুনান ২৫২, দারাক্বুত্বনী, সুনান)

আল্লামা আলবানী বলেন, উক্ত হাদীস এই কথার দলীল যে, সুন্নত হল ডান হাত দিয়ে বাম হাতকে ধারণ করা। আর পূর্বের হাদীস প্রমাণ করে যে, ডান হাত বাম হাতের উপর (ধারণ না করে) রাখা সুন্নত। সুতরাং উভয় প্রকার আমলই সুন্নত। পক্ষান্তরে একই সঙ্গে প্রকোষ্ঠের উপর রাখা এবং ধারণ করা -যা কিছু পরবর্তী হানাফী উলামাগণ উত্তম মনে করেছেন তা বিদআত। তাদের উল্লেখ মতে তার পদ্ধতি হল এই যে, ডান হাতকে বাম হাতের উপর রাখবে, কড়ে ও বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে বাম হাতের প্রকোষ্ঠ (রলা) কে ধারণ করবে। আর বাকী তিনটি আঙ্গুল তার উপর বিছিয়ে দেবে। (হাশিয়া ইবনে আবেদ্বীন ১/৪৫৪) সুতরাং উক্ত পরবর্তীগণের কথায় আপনি ধোকা খাবেন না। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ৮৮পৃ:, ৩নং টীকা)

পক্ষান্তরে উভয় হাদীসের উপর আমল করতে হলে কখনো না ধরে রাখতে হবে এবং কখনো ধারণ করতে হবে। যেহেতু একই সঙ্গে ঐ পদ্ধতি হাদীসে বর্ণিত হয় নি।

প্রকাশ থাকে যে, ডান হাত দ্বারা বাম হাতের বাজু ধরারও কোন ভিত্তি নেই। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৪৫)

হাত রাখার জায়গা

এরপর মহানবী (সাঃ) উভয় হাতকে বুকের উপর রাখতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৭৫৯ নং, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ ৪৭৯ নং, আহমাদ, মুসনাদ, আবুশ শায়খ প্রমুখ)

প্রকোষ্ঠের উপর প্রকোষ্ঠ রাখার আদেশ একথাও প্রমাণ করে যে, হাত বুকের উপরেই বাঁধা হবে। নচেৎ তার নিচে ঐভাবে রাখা সম্ভব নয়। মুহাদ্দিস আলবানী (রহঃ) বলেন, বুকের উপরেই হাত বাঁধা সুন্নাহতে প্রমাণিত। আর এর অন্যথা হয় যয়ীফ, না হয় ভিত্তিহীন। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ৮৮পৃ:)

বুকে রয়েছে হৃদয়। যার উপর হাত রাখলে অনন্ত প্রশান্তি, একান্ত বিনয় ও নিতান্ত আদব অভিব্যক্ত হয়।

ইস্তিফতাহ্‌র দুআ

নবী মুবাশ্‌শির (সাঃ) নামাযে তাঁর দৃষ্টি অবনত করে সিজদার স্থানে নিবদ্ধ রাখতেন। (বায়হাকী,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩৫৪ নং) নামাযের প্রারম্ভে তিনি বিভিন্ন রুপে আল্লাহর প্রশংসা ও স্তুতি বর্ণনা করতেন এবং প্রার্থনা করতেন। পরন্তু নামায ভুলকারী সাহাবীকেও তিনি বলেছিলেন, “কোন ব্যক্তিরই নামায ততক্ষণ পর্যন্ত সম্পূর্ণ হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তকবীর দিয়েছে, আল্লাহ আয্‌যা অজাল্লার প্রশংসা ও স্তুতি বর্ণনা করেছে এবং যথাসম্ভব কুরআন পাঠ করেছে।” (আবূদাঊদ, সুনান ৮৫৭ নং,হাকেম, মুস্তাদরাক)

এই অবস্থায় তিনি বিভিন্ন সময় ও নামাযে বিভিন্ন দুআ পড়েছেন। যার কিছু নিম্নরুপ:-

হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রসূল (সাঃ) যখন নামাযে (তাহ্‌রীমার) তকবীর দিতেন, তখন ক্বিরাআত শুরু করার পূর্বে কিছুক্ষণ চুপ থাকতেন। আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোক। আপনি তকবীর ও ক্বিরাআতের মাঝে চুপ থেকে কি পড়েন আমাকে বলে দিন।’ তিনি বললেন, “আমি বলি,
اَللّــهُمَّ بَاعِدْ بَيْنِيْ وَبَيْنَ خَطَايَاىَ كَـمَا بَاعَــدْتَّ بَيْنَ الْمَشــْرِقِ وَالْمَغْرِبِ، اَللّهُمَّ نَقِّنِيْ مِنَ الْخَطَايَا كَمَا يُنَقَّى الثَّوْبُ الأَبْيَضُ مِنَ الدَّنَسِ، اَللّهُمَّ اغْسِلْ خَطَايَاىَ بِالْمَاءِ وَالثَّلْجِ وَالْبَرَدِ।

 উচ্চারণ:- আল্লা-হুম্মা বা-ইদ বাইনী অ বাইনা খাত্বা-য়্যা-য়্যা কামা বা-আত্তা বাইনাল মাশরিক্বি অল মাগরিব, আল্লা-হুম্মা নাক্বিনী মিনাল খাত্বা-য়্যা, কামা য়্যুনাক্বাষ ষাওবুল আবয়্যাযুমিনাদ দানাস, আল্লাহু-ম্মাগসিল খাত্বা-য়্যা-য়্যা বিল মা-য়ি অষষালজি অলবারাদ।

অর্থ- হে আল্লাহ! তুমি আমার মাঝে ও আমার গুনাহসমূহের মাঝে এতটা ব্যবধান রাখ যেমন তুমি পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝে ব্যবধান রেখেছ। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে গুনাহসমূহ থেকে পরিষ্কার করে দাও যেমন সাদা কাপড় ময়লা থেকে পরিষ্কার করা হয়। হে আল্লাহ! তুমি আমার গুনাহসমূহকে পানি, বরফ ও করকি দ্বারা ধৌত করে দাও।” (বুখারী ৭৪৪, মুসলিম, সহীহ ৫৯৮, আবূদাঊদ, সুনান ৭৮১, নাসাঈ, সুনান, দারেমী, সুনান, আআহমাদ, মুসনাদ ২/৯৮, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ৮০৫, আহমাদ, মুসনাদ ২/২৩১, ৪৯৪, ইআশা: ২৯১৯৯ নং)

লক্ষ্যণীয় যে, উক্ত দুআটি তিনি ফরয নামাযে বলতেন। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ৯১পৃ:)

২। আবূ সাঈদ ও আয়েশা (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রসূল (সাঃ) নামাযের শুরুতে এই দুআ পাঠ করতেন,

سُبْحَانَكَ اللّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ وَ تَبَارَكَ اسْمُكَ وَتَعَالى جَدُّكَ وَلاَ إِلهَ غَيْرُكَ।

উচ্চারণ:- সুবহা-নাকাল্লা-হুম্মা অবিহামদিকা অতাবা-রাকাসমুকা অতাআ’-লা জাদ্দুকা অ লা ইলা-হা গায়রুক।

অর্থ:- তোমার প্রশংসার সাথে তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করি হে আল্লাহ! তোমার নাম অতি বর্কতময়, তোমার মাহাত্ম অতি উচ্চ এবং তুমি ছাড়া কোন সত্য উপাস্য নেই। (আবূদাঊদ, সুনান ৭৭৬, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ৮০৬, ত্বাহাবী ১/১১৭, দারাক্বুত্বনী, সুনান ১১৩, বায়হাকী ২/৩৪,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২৩৫, নাসাঈ, সুনান, দারেমী, সুনান, ইআশা:)

মহানবী (সাঃ) বলেন, “নি:সন্দেহে আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় কথা হল বান্দার ‘সুবহানাকাল্লাহুম্মা---’ বলা।” (তাওহীদ, ইবনে মাজাহ্‌, নাসাঈ, সুনান, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৯৩৯ নং)

৩। মহানবী ফরযে ও নফলে তাকবীরে তাহ্‌রীমার পর বলতেন,

وَجَّهْتُ وَجْهِىَ لِلَّذِيْ فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ حَنِيْفاً وَّمَا أَناَ مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ، إِنَّ صَلاَتِيْ وَنُسُكِيْ وَ مَحْيَاىَ وَمَمَاتِيْ للهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ، لاَ شَرِيْكَ لَهُ وَبِذلِكَ أُمِرْتُ وَ أَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِيْنَ اَللّهُمَّ أَنْتَ الْمَلِكُ لاَ إِلهَ إَلاَّ أَنْتَ سُبْحَانَكَ وَبِحَمْدِكَ أَنْتَ رَبِّيْ وَ أَنَا عَبْدُكَ ، ظَلَمْتُ نَفْسِيْ وَاعْتَرَفْتُ بِذَنْبِيْ، فَاغْفِرْ لِيْ ذَنْبِيْ جَمِيْعاً إِنَّهُ لاَ يَغْفِرُ الذُّنُوْبَ إِلاَّ أَنْتَ وَاهْدِنِيْ لأَحْسَنِ الأَخْلاَقِ لاَ يَهْدِيْ لأَحْسَنِهَا  إِلاَّ أَنْتَ، وَاصْرِفْ عَنِّيْ سَيِّئَهَا لاَ يَصْرِفُ عَنِّيْ سَيِّئَهَا إِلاَّ أَنْتَ، لَبَّيْكَ وَسَعْدَيْكَ وَالْخَيْرُ كُلُّهُ فِيْ يَدَيْكَ وَالشَّرُّ لَيْسَ إِلَيْكَ وَالْمَهْدِيْ  مَنْ هَدَيْتَ، أَنَا بِكَ وَإِلَيْكَ، لاَ مَنْجَا وَلاَ مَلْجَأَ مِنْكَ إِلاَّ إِلَيْكَ، تَبَارَكْتَ وَتَعَالَيْتَ، أَسْتَغْفِرُكَ وَ أَتُوْبُ إِلَيْكَ।

 উচ্চারণ:- অজজাহ্‌তু অজহিয়া লিল্লাযী ফাত্বারাস সামা-ওয়া-তি অলআরযা হানীফাঁউ অমা আনা মিনাল মুশরিকীন। ইন্না সালা-তী অনুসুকী অমাহ্‌য়্যা-য়্যা অমামা-তী লিল্লা-হি রাব্বিল আ’-লামীন। লা শারীকা লাহু অবিযা-লিকা উমিরতু অআনা আওয়ালুল মুসলিমীন। আল্লা-হুম্মা আন্তাল মালিকু লা ইলা-হা ইল্লা আন্ত। সুবহা-নাকা অবিহামদিকা আন্তা রাব্বী অ আনা আব্দুক। যালামতু নাফসী অ’তারাফতু বিযামবী, ফাগফিরলী যামবী জামীআন ইন্নাহু লা য়্যাগফিরুয যুনূবা ইল্লা আন্ত। অহ্‌দিনী লিআহ্‌সানিল আখলা-ক্বি লা য়্যাহ্‌দী লিআহ্‌সিনহা ইল্লা আন্ত। অস্বরিফ আন্নী সাইয়্যিআহা লা য়্যাস্বরিফু আন্নী সাইয়্যিআহা ইল্লা আন্ত। লাব্বাইকা অ সা’দাইক, অলখায়রু কুল্লুহু ফী য়্যাদাইক। অশশার্রু লাইসা ইলাইক, অল-মাহ্‌দীয়্যু মানহাদাইত, আনা বিকা অ ইলাইক। লা মানজা অলা মালজাআ মিনকা ইল্লা ইলাইক, তাবা-রাকতা অতাআ’-লাইত, আস্তাগফিরুকা অ আতূবু ইলাইক।

অর্থ:- আমি একনিষ্ঠ হয়ে তাঁর প্রতি মুখ ফিরিয়েছি যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। নিশ্চয় আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ বিশ্ব -জাহানের প্রতিপালক আল্লাহরই জন্যই। তাঁর কোন অংশী নেই। আমি এ সম্বন্ধেই আদিষ্ট হয়েছি এবং আমি আত্মসমর্পণকারীদের প্রথম। হে আল্লাহ! তুমিই বাদশাহ্‌ তুমি ছাড়া কেউ সত্য উপাস্য নেই। আমি তোমার সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা করি। তুমি আমার প্রভু ও আমি তোমার দাস। আমি নিজের উপর অত্যাচার করেছি এবং আমি আমার অপরাধ স্বীকার করেছি। সুতরাং তুমি আমার সমস্ত অপরাধ মার্জনা করে দাও, যেহেতু তুমি ছাড়া অন্য কেউঅপরাধ ক্ষমা করতে পারে না। সুন্দরতম চরিত্রের প্রতি আমাকে পথ দেখাও, যেহেতু তুমি ছাড়া অন্য কেউ সুন্দরতম চরিত্রের প্রতি পথ দেখাতে পারে না। মন্দ চরিত্রকে আমার নিকট হতে দূরে রাখ, যেহেতু তুমি ছাড়া অন্য কেউমন্দ চরিত্রকে আমার নিকট থেকে দূর করতে পারে না। আমি তোমার আনুগত্যে হাজির এবং তোমার আজ্ঞা মানতে প্রস্তুত। যাবতীয় কল্যাণ তোমার হাতে এবং মন্দের সম্পর্ক তোমার প্রতি নয়। আমি তোমার অনুগ্রহে আছি এবং তোমারই প্রতি আমার প্রত্যাবর্তন। তুমি বরকতময় ও মহিমময়, তোমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং তোমার দিকেই প্রত্যাবর্তন করি। (মুসলিম, সহীহ ৭৭১, আআহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ আহমাদ, মুসনাদ, শাফেয়ী, ত্বাবারানী, মু’জাম)

৪- اَللهُ أَكْبَرُ كَبِيْراً، اَلْحَمْدُ للهِ كَثِيْراً، وَسُبْحَانَ اللهِ بُكْرَةً وَّأَصِيْلاً।

উচ্চারণ:- আল্লা-হু আকবারু কাবীরা, অলহামদু লিল্লা-হি কাসীরা, অ সুবহা-নাল্লা-হি বুকরাতাঁউঅ আস্বীলা।

অর্থ:- আল্লাহ অতি মহান, আল্লাহর অনেক অনেক প্রশংসা, আমি সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করি।

এই দুআটি দিয়ে নফল নামায শুরু করতে হয়। জনৈক সাহাবী এই দুআ দিয়ে নামায শুরু করলে মহানবী (সাঃ) বললেন, “এই দুআর জন্য আমি বিস্মিত হয়েছি। কারণ ওর জন্য আসমানের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করা হল।”

ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর নিকট ঐ কথা শোনার পর থেকে আমি কোন দিন ঐ দুআ পড়তে ছাড়ি নি। (মুসলিম, সহীহ ৬০১, আহমাদ, মুসনাদ, তিরমিযী, সুনান)

আবূ নুআইম ‘আখবারু আসবাহান’ গ্রন্থে (১/২১০) জুবাইর বিন মুত্বইম হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি নবী (সাঃ) কে উক্ত দুআ নফল নামাযে পড়তে শুনেছেন।

৫। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, ‘এক ব্যক্তি হাঁপাতে হাঁপাতে কাতারে শামিল হয়ে বলল,

اَلْحَمْدُ للهِ حَمْداً كَثِيْراً طَيِّباً مُّبَارَكاً فِيْهِ।

উচ্চারণ:- আলহামদু লিল্লা-হিহামদান কাসীরান ত্বাইয়িবাম মুবা-রাকান ফীহ্‌।

অর্থ:- আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা; যে প্রশংসা অজস্র, পবিত্র ও প্রাচুর্যময়।

আল্লাহর রসূল (সাঃ) নামায শেষ করার পর বললেন, “তোমাদের মধ্যে কে ঐ দুআ পাঠ করেছে?” লোকেরা সকলে চুপ থাকল। পুনরায় তিনি বললেন, “কে বলেছে ঐ দুআ? যে বলেছে, সে মন্দ বলে নি।” উক্ত ব্যক্তি বলল, ‘আমিই হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলে ফেলেছি।’ তিনি বললেন, “আমি ১২ জন ফিরিশ্‌তাকে দেখলাম, তাঁরা ঐ দুআ (আল্লাহর দরবারে) উপস্থিত করার জন্য প্রতিযোগিতা করছে!” (মুসলিম, সহীহ ৬০০, আহমাদ, মুসনাদ)

৬। তিনি তাহাজ্জুদের নামাযের শুরুতে পড়তেন,

  اَللّهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ نُوْرُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَ مَنْ فِيْهِنَّ، وَلَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ قَيِّمُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ  وَمَنْ فِيْهِنَّ، وَلَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ مَلِكُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَمَنْ فِيْهِنَّ، وَلَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ الْحَقُّ وَوَعْدُكَ الْحَقُّ وَ قَوْلُكَ الْحَقُّ وَلِقَاؤُكَ حَقٌّ وَالْجَنَّةُ حَقٌ وَالنَّارُ حَقٌّ وَالسَّاعَةُ حَقٌّ وَالنَّبِيُّوْنَ حَقٌّ وَمُحَمَّدٌ حَقٌّ، اَللّهُمَّ لَكَ أَسْلَمْتُ وَعَلَيْكَ تَوَكَّلْتُ وَبِكَ آمَنْتُ وَإِلَيْكَ أَنَبْتُ وَبِكَ خَاصَمْتُ وَإِلَيْكَ حَاكَمْتُ، أَنْتَ رَبُّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيْرُ، فَاغْفِرْ لِيْ مَا قَدَّمْتُ وَمَا أَخَّرْتُ وَمَا أَسْرَرْتُ وَمَا أَعْلَنْتُ وَمَا أَنْتَ أَعْلَمُ بِهِ مِنِّيْ، أَنْتَ الْمُقَدِّمُ  وَأَنْتَ  الْمُؤَخِّرُ أَنْتَ إِلهِيْ، لاَ إِلهَ إِلاَّ أَنْتَ، وَلاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِكَ।

উচ্চারণ- আল্লা-হুম্মা লাকালহামদু আন্তা নূরুস সামা-ওয়া-তি অলআরযি অমান ফীহিন্ন। অলাকালহামদু আন্তা কাইয়্যিমুস সামা-ওয়া-তি অলআরযি অমান ফীহিন্ন। অলাকালহামদু আন্তা মালিকুস সামা-ওয়া-তি অলআরযি অমান ফীহিন্ন। অলাকালহামদু আন্তালহাক্ব, অওয়া’দুকালহাক্ব, অক্বাওলুকালহাক্ব, অলিক্বা-উকা হাক্ব, অলজান্নাতুহাক্ব, অন্না-রুহাক্ব, অসসা-আতুহাক্ব, অন্নাবিয়্যুনাহাক্ব, অমুহাম্মাদুনহাক্ব। আল্লা-হুম্মা লাকা আসলামতু অআলাইকা তাওয়াক্কালতু অবিকা আ-মানতু অইলাইকা আনাবতু, অবিকা খা-সামতু অইলাইকাহা-কামতু আন্তা রাব্বুনা অইলাইকাল মাসীর। ফাগ্‌ফিরলী মা ক্বাদ্দামতু অমা আখখারতু অমা আসরারতু অমা আ’লানতু অমা আন্তা আ’লামু বিহী মিন্নী। আন্তাল মুক্বাদ্দিমু অআন্তাল মুআখখিরু আন্তা ইলা-হী, লা ইলা-হা ইল্লা আন্তা অলাহাওলা অলা ক্বুউওয়াতা ইল্লা বিক।

অর্থ- হে আল্লাহ! তোমারই যাবতীয় প্রশংসা। তুমি আকাশমন্ডলী, পৃথিবী এবং উভয়ের মধ্যে অবস্থিত সকল কিছুর জ্যোতি। তোমারই সমস্ত প্রশংসা, তুমি আকাশমন্ডলী, পৃথিবী ও উভয়ের মধ্যে অবস্থিত সকল কিছুর নিয়ন্তা, তোমারই সমস্ত প্রশংসা। তুমি আকাশম ন্ড লী, পৃথিবী ও উভয়ের মধ্যে অবস্থিত সকল কিছুর অধিপতি। তোমারই সমস্ত প্রশংসা, তুমিই সত্য, তোমার প্রতিশ্রুতিই সত্য, তোমার কথাই সত্য, তোমার সাক্ষাৎ সত্য, জান্নাত সত্য, জাহান্নাম সত্য, কিয়ামত সত্য, নবীগণ সত্য, মুহাম্মদ (সাঃ) সত্য। হে আল্লাহ! আমি তোমারই নিকট আত্মসমর্পণ করেছি, তোমার উপরেই ভরসা করেছি, তোমার উপরেই ঈমান (বিশ্বাস) রেখেছি, তোমার দিকে অভিমুখী হয়েছি, তোমারই সাহায্যে বিতর্ক করেছি, তোমারই নিকট বিচার নিয়ে গেছি। তুমি আমাদের প্রতিপালক, তোমারই দিকে প্রত্যাবর্তনস্থল। অতএব তুমি আমার পূর্বের, পরের, গুপ্ত, প্রকাশ্য এবং যা তুমি অধিক জান সে সব পাপকে মাফ করে দাও। তুমিই প্রথম, তুমিই শেষ। তুমি আমার উপাস্য, তুমি ছাড়া কোন সত্য উপাস্য নেই এবং তোমার তওফীক ছাড়া পাপ থেকে ফিরার ও সৎকাজ (নড়া-সরা) করার সাধ্য নেই। (বুখারী, মুসলিম,  আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, দারেমী, সুনান, মিশকাত ১২১১ নং)

নিম্নোক্ত দুআগুলিও তিনি তাহাজ্জুদের নামাযের শুরুতে পাঠ করতেন:-

৭। ‘সুবহানাকাল্লাহুম্মা---’ (২নং দুআ) পড়ে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্‌’ ৩ বার, এবং ‘আল্লাহু আকবারু কাবীরা’ ৩ বার। (আবূদাঊদ, সুনান, ৭৭৫ নং, ত্বাহাকেম, মুস্তাদরাক, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ৯৪পৃ:)

اَللّهُمَّ رَبَّ جِبْرَآئِيْلَ وَ مِيْكَائِيْلَ وَإِسْرَآفِيْلَ، فَاطِرَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ، عَالِمَ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ أَنْتَ تَحْكُمُ بَيْنَ عِبَادِكَ فِيْمَا كَانُوْا فِيْهِ يَخْتَلِفُوْنَ، اِهْدِنِيْ لِمَا اخْتُلِفَ
فِيْهِ مِنَ الْحَقِّ بِإِذْنِكَ إِنَّكَ تَهْدِيْ مَنْ تَشَاءُ إِلى صِرَاطٍ مُّسْتَقِيْمٍ।

 উচ্চারণ- আল্লা-হুম্মা রাব্বা জিবরা-ঈলা অমীকা-ঈলা অ ইসরা-ফীল। ফা-তিরাস সামা-ওয়া-তি অলআরয্ব, আ-লিমাল গায়বি অশশাহা-দাহ্‌। আন্তা তাহ্‌কুমু বাইনা ইবাদিকা ফীমা কা-নূ ফীহি য়্যাখতালিফূন। ইহ্‌দিনী লিমাখতুলিফা ফীহি মিনালহাক্বি বিইযনিক, ইন্নাকা তাহ্‌দী মান তাশা-উইলা স্বিরাতীম-মুস্তাক্বীম।

অর্থ- হে আল্লাহ! হে জিবরাঈল, মীকাঈল ও ইসরাফীলের প্রভু! হে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃজনকর্তা! হে দৃশ্য ও অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা! তুমি তোমার বান্দাদের মাঝে মীমাংসা কর যে বিষয়ে ওরা মতভেদ করে। যে বিষয়ে মতভেদ করা হয়েছে সে বিষয়ে তুমি আমাকে তোমার অনুগ্রহে সত্যের পথ দেখাও। নিশ্চয় তুমি যাকে ইচ্ছা সরল পথ দেখিয়ে থাক। (মুসলিম,  আআহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ৭৬৭, মিশকাত ১২১২ নং)

৯। ‘আল্লাহু আকবার’ ১০বার, ‘আলহামদু লিল্লা-হ্‌’ ১০বার, ‘সুবহা-নাল্লাহ্‌’ ১০বার, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্‌’১০বার, ‘আস্তাগফিরুল্লাহ্‌’ ১০বার, ‘আল্লা-হুম্মাগফির লী অহ্‌দিনী অরযুক্বনী অআ-ফিনী’ (অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা কর, হেদায়াত কর, রুজি ও নিরাপত্তা দাও) ১০ বার, এবং ‘আল্লা-হুম্মা ইন্নী আঊযু বিকা মিনায্বযাইক্বি ইয়াউমাল হিসাব’ (অর্থাৎ হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি হিসাবের দিনে সংকীর্ণতা থেকে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি) ১০ বার। (আহমাদ, মুসনাদ, ইআশা:, আবূদাঊদ, সুনান ৭৬৬ নং, ত্বাবারানী, মু’জাম আউসাত্ব ২/৬২)

১০।  ‘আল্লাহু আকবার’ ৩ বার। অতঃপর,

ذُو الْمَلَكُوْتِ وَالْجَبَرُوْتِ وَالْكِبْرِيَاءِ وَالْعَظَمَةِ।

 উচ্চারণ- যুল মালাকূতি অলজাবারুতি অলকিবরিয়া-য়ি, অলআযামাহ্‌।

 অর্থ- (আল্লাহ) সার্বভৌমত্ব, প্রবলতা, গর্ব ও মাহাত্মের অধিকারী। (আবূদাঊদ, সুনান ৮৭৪ নং)

ক্বিরাআত শুরু করার পূর্বে ইস্তিআযাহ্‌

উপরোক্ত একটি দুআ পড়ার পর নবী মুবাশ্‌শির (সাঃ) ক্বিরাআত শুরু করার জন্য শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন, বলতেন,

أَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ، مِنْ هَمْزِهِ وَنَفْخِهِ وَنَفْثِهِ।

উচ্চারণ:- আঊযু বিল্লা-হি মিনাশ শাইত্বা-নির রাজীম, মিনহামযিহী অনাফখিহী অনাফষিহ্‌।

আবার কখনো বলতেন,

أَعُوْذُ بِاللهِ السَّمِيْعِ الْعَلِيْمِ، مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ، مِنْ هَمْزِهِ وَنَفْخِهِ وَنَفْثِهِ।

উচ্চারণ- আঊযু বিল্লা-হিস সামীইল আলীম, মিনাশ শাইত্বা-নির রাজীম, মিনহামযিহী অনাফখিহী অনাফষিহ্‌।

অর্থ- আমি সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞাতা আল্লাহর নিকট বিতাড়িত শয়তান থেকে তার প্ররোচনা ও ফুৎকার হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। (আবূদাঊদ, সুনান ৭৭৫, দারাক্বুত্বনী, সুনান, তিরমিযী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইআশা:, ইবনে হিব্বান, সহীহ, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩৪২নং)

‘বিসমিল্লাহ্‌’ পাঠ

এরপর নবী মুবাশ্‌শির (সাঃ) بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْم‘ বিসমিল্লা-হির রাহ্‌মা-নির রাহীম’ (অনন্ত করুণাময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি।) পাঠ করতেন। এটিকে তিনি নি:শব্দেই পড়তেন। এ ছাড়া সশব্দে ‘বিসমিল্লাহ্‌’ পড়ার ব্যাপারে কোন স্পষ্ট ও সহীহ হাদীস নেই। (তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ১৯৬পৃ:)

আনাস (রাঃ) বলেন, আমি নবী (সাঃ), আবূ বকর ও উমার (রাঃ) এর সাথে নামায পড়েছি। তাঁরা সকলেই ‘আলহামদু লিল্লা-হি রাব্বিল আ-লামীন’ বলে ক্বিরাআত শুরু করতেন। (বুখারী ৭৪৩, আবূদাঊদ, সুনান ৭৮২, তিরমিযী, সুনান ২৪৬, নাসাঈ, সুনান ৮৬৭ নং প্রমুখ) অন্য এক বর্ণনায় তিনি বলেন, তাঁরা ক্বিরাআতের শুরুতে বা শেষেও ‘বিসমিল্লাহির রাহ্‌মানির রাহীম’ উল্লেখ করতেন না। আর এক বর্ণনায় তিনি বলেন, তাঁদের কাউকেই ‘বিসমিল্লাহির রাহ্‌মানির রাহীম’ বলতে শুনি নি। (মুসলিম, সহীহ ৩৯৯, সহিহ,নাসাঈ, সুনান ৮৭০, ৮৭১নং, ইবনে হিব্বান, সহীহ)

সূরা ফাতিহা পাঠ

অতঃপর মহানবী (সাঃ) জেহরী (মাগরিব, এশা, ফজর, জুমুআহ, তারাবীহ্‌, ঈদ প্রভৃতি) নামাযে সশব্দে ও সির্রী (যোহ্‌র, আসর, সুন্নত প্রভৃতি) নামাযে নি:শব্দে সূরা ফাতিহা পাঠ করতেন, 

الْحَمْدُ للهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ، اَلرَّحْمنِ الرَّحِيْم، مَالِكِ يَوْمِ الدِّيْن، إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِيْن، اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيْم، صِرَاطَ الَّذِيْنَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَيْهِمْ وَلاَ الضَّالِّيْن।

উচ্চারণ:- আলহামদু লিল্লা-হি রাব্বিল আ’-লামীন। আররাহ্‌মা-নির রাহীম। মা-লিকি য়্যাউমিদ্দ্বীন। ইয়্যা-কা না’বুদু অইয়্যা-কা নাস্তাঈন। ইহ্‌দিনাস স্বিরা-ত্বাল মুস্তাক্বীম।  স্বিরা-ত্বাল্লাযীনা আন্‌আ’মতা আলাইহিম। গাইরিল মাগযুবি আলাইহিম অলায্ব যা-ল্লীন।

অর্থ:- সমস্ত প্রশংসা সারা জাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। যিনি অনন্ত করুণাময়, পরম দয়ালু। যিনি বিচার দিনের মালিক। আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য চাই। আমাদেরকে সরল পথ দেখাও; তাদের পথ -যাদেরকে তুমি পুরস্কার দান করেছ। তাদের পথ নয় -যারা ক্রোধভাজন (ইয়াহুদী) এবং যারা পথভ্রষ্ট ( খ্রিষ্টান)।

এই সূরা তিনি থেমে থেমে পড়তেন; ‘বিসমিল্লাহির রাহ্‌মানির রাহীম’ পড়ে থামতেন। অতঃপর ‘আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’-লামীন’ বলে থামতেন। আর অনুরুপ প্রত্যেক আয়াত শেষে থেমে থেমে পড়তেন। (আবূদাঊদ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩৪৩নং)

সুতরাং একই সাথে কয়েকটি আয়াতকে জড়িয়ে পড়া সুন্নতের পরিপন্থী আমল। পরস্পর কয়েকটি আয়াত অর্থে সম্পৃক্ত হলেও প্রত্যেক আয়াতের শেষে থেমে পড়াই মুস্তাহাব। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ৯৬পৃ:)

নামাযে সূরা ফাতিহার গুরুত্ব

মহানবী (সাঃ) বলতেন, “সেই ব্যক্তির নামায হয় না, যে ব্যক্তি তাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করে না।” (বুখারী, মুসলিম,  আআহমাদ, মুসনাদ, বায়হাকী, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩০২নং)

“সেই ব্যক্তির নামায যথেষ্ট নয়, যে তাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করে না।” (দারাক্বুত্বনী, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩০২নং)

“যে ব্যক্তি এমন কোনও নামায পড়ে, যাতে সে সূরা ফাতিহা পাঠ করে না, তার ঐ নামায (গর্ভচ্যুত ভ্রুণের ন্যায়) অসম্পূর্ণ, অসম্পূর্ণ।” (মুসলিম,  আআহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ৮২৩নং)

“আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি নামায (সূরা ফাতিহা) কে আমার ও আমার বান্দার মাঝে আধাআধি ভাগ করে নিয়েছি; অর্ধেক আমার জন্য এবং অর্ধেক আমার বান্দার জন্য। আর আমার বান্দা তাই পায়, যা সে প্রার্থনা করে।’ সুতরাং বান্দা যখন বলে, ‘আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ-লামীন।’ তখন আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমার বান্দা আমার প্রশংসা করল।’ অতঃপর বান্দা যখন বলে, ‘আররাহ্‌মা-নির রাহীম।’ তখন আল্লাহ বলেন, ‘বান্দা আমার স্তুতি বর্ণনা করল।’ আবার বান্দা যখন বলে, ‘মা-লিকি য়্যাউমিদ্দ্বীন।’ তখন আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘বান্দা আমার গৌরব বর্ণনা করল।’ বান্দা যখন বলে, ‘ইয়্যা-কা না’বুদু অইয়্যা-কা নাস্তাঈন।’ তখন আল্লাহ বলেন, ‘এটা আমার ও আমার বান্দার মাঝে। আর আমার বান্দা তাই পায়, যা সে প্রার্থনা করে।’ অতঃপর বান্দা যখন বলে, ‘ইহ্‌দিনাস স্বিরা-ত্বাল মুস্তাকীম। স্বিরা-ত্বাল্লাযীনা আনআমতা আলাইহিম, গাইরিল মাগযূবি আলাইহিম অলায্ব যা-ল্লীন।’ তখন আল্লাহ বলেন, ‘এ সব কিছু আমার বান্দার জন্য। আর আমার বান্দা যা চায়, তাই পাবে।” (মুসলিম, সহীহ ৩৯৫, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, আআহমাদ, মুসনাদ, প্রমুখ, মিশকাত ৮২৩নং)

“উম্মুল কুরআন (কুরআনের জননী সূরা ফাতিহা) এর মত আল্লাহ আয্‌যা অজাল্ল্‌ তাওরাতে এবং ইঞ্জিলে কোন কিছুই অবতীর্ণ করেন নি। এই (সূরাই) হল (নামাযে প্রত্যেক রাকআতে) পঠিত ৭টি আয়াত এবং মহা কুরআন, যা আমাকে দান করা হয়েছে।” (নাসাঈ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ২১৪২ নং)

নামায ভুলকারী সাহাবীকে মহানবী (সাঃ) এই সূরা তার নামাযে পাঠ করতে আদেশ দিয়েছিলেন। (বুখারী জুযউল ক্বিরাআহ্‌, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ৯৮পৃ:) অতএব নামাযে এ সূরা পাঠ করা ফরয এবং তা নামাযের একটি রুক্‌ন।

‘দ্বা-ল্লীন’ না ‘যা-ল্লীন’

সূরা ফাতিহা পাঠের সময় যদি কেউতার একটি হ্‌রফের উচ্চারণ অন্য হ্‌রফের মত করে পড়ে, তাহলে এই মহা রুক্‌ন আদায় সহীহ হবে না। ঐ হ্‌রফ (আয়াত)কে পুন: শুদ্ধ করে পড়া জরুরী। যেমন যদি কেউع কে أ ,ح কে هـ , ط কে ت পড়ে তাহলে তার ফাতিহা শুদ্ধ হবে না। (অনুরুপ যে কোন সূরাই।)

আরবী বর্ণমালার সবচেয়ে কঠিনতম উচ্চারিতব্য অক্ষর হল ض । এরও বাংলায় কোন সম-উচ্চারণবোধক অক্ষর নেই। যার জন্য এক শ্রেণীর লেখক এর উচ্চারণ করতে ‘য’ লিখেন এবং অন্য শ্রেণীর লেখক লিখে থাকেন ‘দ’ বা ‘দ্ব’। অথচ উভয় উচ্চারণই ভুল। পক্ষান্তরে যাঁরা ‘জ’-এর উচ্চারণ করেন, তাঁরাও ভুল করেন। অবশ্য স্পষ্ট ‘দ’-এর উচ্চারণ আরো মারাত্মক ভুল।

আসলে ض এর উচ্চারণ হয় জিভের কিনারা (ডগা নয়) এবং উপরের মাড়ির (পেষক) দাঁতের স্পর্শে। যা ‘য’ ও ‘দ’-এর মধ্যবর্তী উচ্চারণ। অবশ্য ‘য’ বা ظ এর মত উচ্চারণ সঠিকতার অনেক কাছাকাছি। পক্ষান্তরে ‘দ’-এর উচ্চারণ জিভের উপরি অংশ ও সামনের দাঁতের মাড়ির গোড়ার স্পর্শে হয়ে থাকে। সুতরাং ض এর উক্ত উচ্চারণ করা নেহাতই ভুল। (দেখুন আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৯১-৯৪)

ض এর উচ্চারণ ظ বা ‘য’-এর কাছাকাছি হওয়ার আরো একটি দলীল এই যে, আরবের লোক শ্রুতিলিখনের সময় শব্দের ض  অক্ষরকে ظ লিখে এবং কখনো বা ظ  অক্ষরের ক্ষেত্রে  ض লিখে ভুল করে থাকেন। আর এ কথা পত্র-পত্রিকা এবং বহু বই-পুস্তকেও আরবী পাঠকের নজরে পড়ে।

সুতরাং আমি মনে করি যে, ض  যখন ظ এর জাত ভাই এবং د  এর জাত ভাই নয়, তখন তার উচ্চারণ লিখতে ‘য’ অক্ষর লিখাই যুক্তিযুক্ত। অবশ্য তার নিচে ছোট ‘ব’ লাগিয়ে ‘য্ব’ লিখলে ظ  থেকে পার্থক্য নির্বাচন করা সহ্‌জ হয়।

‘আ-মীন’ বলা

সূরা ফাতিহা শেষ করে নবী মুবাশ্‌শির (সাঃ) (জেহরী নামাযে) সশব্দে টেনে ‘আ-মীন’ বলতেন। (বুখারী জুযউল ক্বিরাআহ্‌, আবূদাঊদ, সুনান ৯৩২, ৯৩৩নং)

পরন্তু তিনি মুক্তাদীদেরকে ইমামের ‘আমীন’ বলা শুরু করার পর ‘আমীন’ বলতে আদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, “ইমাম যখন ‘গাইরিল মাগযূবি আলাইহিম অলায যা-ল্লীন’ বলবে, তখন তোমরা ‘আমীন’ বল। কারণ, ফিরিশ্‌তাবর্গ ‘আমীন’ বলে থাকেন। আর ইমামও ‘আমীন’ বলে। (অন্য এক বর্ণনা মতে) ইমাম যখন ‘আমীন’ বলবে, তখন তোমরাও ‘আমীন’ বল। কারণ, যার ‘আমীন’ বলা ফিরিশ্‌তাবর্গের ‘আমীন’ বলার সাথে সাথে হয়- (অন্য এক বর্ণনায়) তোমাদের কেউ যখন নামাযে ‘আমীন’ বলে এবং ফিরিশ্‌তাবর্গ আকাশে ‘আমীন’ বলেন, আর পরস্পরের ‘আমীন’ বলা একই সাথে হয় -তখন তার পূর্বেকার পাপরাশি মাফ করে দেওয়া হয়।” (দেখুন, বুখারী ৭৮০-৭৮২, ৪৪৭৫, ৬৪০২, মুসলিম,  আবূদাঊদ, সুনান ৯৩২-৯৩৩, ৯৩৫-৯৩৬, নাসাঈ, সুনান, দারেমী, সুনান)

মহানবী (সাঃ) আরো বলেন, “ইমাম ‘গাইরিল মাগযূবি আলাইহিম অলায যা-ল্লীন’ বললে তোমরা ‘আমীন’ বল। তাহলে (সূরা ফাতিহায় উল্লেখিত দুআ) আল্লাহ তোমাদের জন্য মঞ্জুর করে নেবেন।” (ত্বাবারানী, মু’জাম, সহিহ তারগিব ৫১৩নং) বলাই বাহুল্য যে, ‘আমীন’ এর অর্থ ‘কবুল বা মঞ্জুর কর।’

ইবনে জুরাইজ বলেন, আমি আত্বা-কে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সূরা ফাতিহা পাঠের পর ইবনে যুবাইর ‘আমীন’ বলতেন কি?’ উত্তরে আত্বা বললেন, ‘হ্যাঁ, আর তাঁর পশ্চাতে মুক্তাদীরাও ‘আমীন’ বলত। এমনকি (‘আমীন’-এর গুঞ্জরণে) মসজিদ মুখরিত হয়ে উঠত।’ অতঃপর তিনি বললেন, ‘আমীন’ তো এক প্রকার দুআ। (আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ ২৬৪০ নং, মুহাল্লা ৩/৩৬৪, বুখারী তা’লীক, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/৩০৬)

আবূ হুরাইরা (রাঃ) মারওয়ান বিনহাকামের মুআযযিন ছিলেন। তিনি শর্ত লাগালেন যে, ‘আমি কাতারে শামিল হয়ে গেছি এ কথা না জানার পূর্বে (ইমাম মারওয়ান) যেন ‘অলায যা-ল্লীন’ না বলেন।’ সুতরাং মারওয়ান ‘অলায যা-ল্লীন’ বললে আবূ হুরাইরা টেনে ‘আমীন’ বলতেন। (বায়হাকী ২/৫৯, বুখারী তা’লীক, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/৩০৬)

নাফে’ বলেন, ইবনে উমার ‘আমীন’ বলা ত্যাগ করতেন না। তিনি তাঁর মুক্তাদীগণকেও ‘আমীন’ বলতে উদ্বুদ্ধ করতেন। (বুখারী তা’লীক, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/৩০৬-৩০৭)

পরের ঐশ্বর্য, উন্নতি বা মঙ্গল দেখে কাতর বা ঈর্ষান্বিত হয়ে সে সবের ধ্বংস কামনার নামই পরশ্রীকাতরতা বা হিংসা। ইয়াহুদ এমন এক জাতি, যে সর্বদা মুসলিমদের মন্দ কামনা করে এবং তাদের প্রত্যেক মঙ্গল ও উন্নতির উপর ধ্বংস-কামনা ও হিংসা করে। কোন উন্নতি ও মঙ্গলের উপর তাদের বড় হিংসা হয়। আবার কোনর উপর ছোট হিংসা। কিন্তু মুসলিমদের সমূহ মঙ্গলের মধ্যে জুমুআহ, কিবলাহ্‌, সালাম ও ইমামের পিছনে ‘আমীন’ বলার উপর ওদের হিংসা সবচেয়ে বড় হিংসা।

মহানবী (সাঃ) বলেন, “ইয়াহুদ কোন কিছুর উপর তোমাদের অতটা হিংসা করে না, যতটা সালাম ও ‘আমীন’ বলার উপর করে।” (ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, সহিহ তারগিব ৫১২নং)

তিনি আরো বলেন, “ওরা জুমুআহ -যা আমরা সঠিকরুপে পেয়েছি, আর ওরা পায় নি, কিবলাহ্‌ -যা আল্লাহ আমাদেরকে সঠিকরুপে দান করেছেন, কিন্তু ওরা এ ব্যাপারেও ভ্রষ্ট ছিল, আর ইমামের পশ্চাতে আমাদের ‘আমীন’ বলার উপরে যতটা হিংসা করে, ততটা হিংসা আমাদের অন্যান্য বিষয়ের উপর করে না।” (আহমাদ, মুসনাদ, সহিহ তারগিব ৫১২নং)

প্রকাশ যে, ‘আমীন’ ও ‘আ-মীন’ উভয় বলাই শুদ্ধ। (সহিহ তারগিব ২৭৮পৃ:)  ইমামের ‘আমীন’ বলতে ‘আ-’ শুরু করার পর ইমামের সাথেই মুক্তাদীর ‘আমীন’ বলা উচিৎ। ইমামের বলার পূর্বে বা পরে বলা ইমামের এক প্রকার বিরুদ্ধাচরণ, যা নিষিদ্ধ। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৯৭, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৬/৮১)

জোরে ‘আমীন’ না বলার একটি খোঁড়া যুক্তি

ইমামের পশ্চাতে নিঃশব্দে ‘আমীন’ বলার সমর্থকরা সশব্দে ‘আমীন’ বলার পিছনে ঝাল ধরানো যুক্তি পেশ করে থাকেন যে, ‘সাহাবারা নবীর পিছুতে নামায পড়তে পড়তে পালিয়ে যেতেন! তাই তিনি সকলকে জোরে ‘আমীন’ বলতে আদেশ করেছিলেন, যাতে তিনি বুঝতে পারেন, তাঁরা পিছুতে মজুদ আছেন!!’

আলগা জিভের এই খোঁড়া যুক্তিতে রয়েছে দুটি অপবাদ; প্রথমত: সাহাবাগণের নামাযের প্রতি অনীহা প্রকাশ তথা নামায ও রসূল (সাঃ) কে ত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ার অপবাদ!

দ্বিতীয়ত: মহানবী (সাঃ) এর তরবিয়তে ত্রুটি থাকার অপবাদ! অথচ তাঁর তরবিয়ত এমন ছিল যে, সাহাবাগণ তীরবিদ্ধ অবস্থাতেও নামায পড়ে গেছেন। কাতর হয়ে নামায ছেড়ে দেন নি। তাছাড়া আল্লাহর রসূল (সাঃ) নামাযের মধ্যে নবুওয়াতের মোহ্‌র দ্বারা নিজের পিছনে সাহাবাদের রুকু-সিজদা দেখতে পেতেন। (বুখারী, মুসলিম, সহীহ মিশকাত ৮৬৮ নং) অতএব তাঁরা নামাযে আছেন, না পালিয়ে যাচ্ছেন তা জানার জন্য জোরে ‘আমীন’ বলাকে ব্যবহার তাঁর কি প্রয়োজন ছিল? আর যদি তাই হয়, তাহলে মাগরেব ও এশার শেষ তৃতীয় ও চতুর্থ রাকআতে এবং যোহ্‌র-আসরে কি ব্যবহার করতেন? পরন্তু তিনি স্বয়ং কেন জোরে ‘আমীন’ বলতেন?

বলাই বাহুল্য যে, এটা হল বক্তার সহীহ সুন্নাহর প্রতি অবজ্ঞা ও অনীহার বহিঃপ্রকাশ। আর এর ফল অবশ্যই ভালো নয়।

‘সাক্‌তাহ’ বা ক্ষণকাল নীরবতা


সূরা ফাতিহা পাঠের পর একটু সাকতাহ্‌ করা বা কিছু না পড়ে বিরতি নেওয়া সম্পর্কে বর্ণিত হাদীস সহীহ নয়। (ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৫০৫, যইফ ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ৮৪৪, ৮৪৫, যইফ আবূদাঊদ, সুনান ১৬৩/৭৭৭, যইফ তিরমিযী, সুনান ৪২, সিলসিলাহ যায়ীফাহ, আলবানী ৫৪৭নং) সুতরাং অনুরুপ বিরতি এবং বিশেষ করে মুক্তাদীগণকে সূরা ফাতিহা পাঠের সুযোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে ইমামের বিরতি অবিধেয় তথা বিদআত। (মিশকাত ১/২৯৫, ৪নং টীকা, সিলসিলাহ যায়ীফাহ, আলবানী ২/২৬, আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/১০২)

ফাতিহার পর অন্য সূরা পাঠ

‘আমীন’ বলার পর নবী মুবাশ্‌শির (সাঃ) অন্য একটি সূরা পাঠ করতেন। আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, ‘আমাদেরকে আদেশ করা হয়েছে যে, আমরা যেন সূরা ফাতিহা এবং সাধ্যমত অন্য সূরা পাঠ করি।’ (আবূদাঊদ, সুনান ৮১৮নং)

আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাঃ) আমাকে এই ঘোষণা করতে আদেশ করলেন যে, “সূরা ফাতিহা এবং অতিরিক্ত অন্য সূরা পাঠ ছাড়া নামায হবে না।” (ঐ ৮২০নং)

প্রত্যেক সূরা পাঠ করার পূর্বে ‘বিসমিল্লা-হির রাহ্‌মা-নির রাহীম’ বলা সুন্নত। (আবূদাঊদ, সুনান ৭৮৪, ৭৮৮নং) অবশ্য সূরার শুরু অংশ থেকে না পড়লে, অর্থাৎ সূরার মধ্য বা শেষাংশ হতে পাঠ করলে ‘বিসমিল্লাহির---’ বলা বিধেয় নয়। কারণ, সূরার মাঝে তা নেই। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/১০৫) সূরা নামলের মাঝে ‘বিসমিল্লাহ্‌’র কথা স্বতন্ত্র।

এই সূরা নবী (সাঃ) কখনো কখনো লম্বা পড়তেন। তিনি বলতেন, “যে নামাযের কিয়াম লম্বা, সে নামাযই শ্রেষ্ঠতম নামায।” (মুসলিম,  হাকেম, মুস্তাদরাক, মিশকাত ৮০০নং)

কখনো বা সফর, কাশি, অসুস্থতা অথবা কোন শিশুর কান্না শোনার কারণে সংক্ষিপ্ত ও ছোট সূরাও পড়তেন। যেমন আনাস (রাঃ) বলেন, একদা নবী (সাঃ) ফজরের নামাযে কুরআন মাজীদের সবচেয়ে ছোট সূরা দু’টি পাঠ করলেন। লোকেরা জিজ্ঞাসা করল, ‘এত সংক্ষেপ করলেন কেন?’ তিনি বললেন, “এক শিশুর কান্না শুনলাম। ভাবলাম, ওর মা আমাদের সাথে নামায পড়ছে। তাই ওর মা-কে ওর জন্য (তাড়াতাড়ি) ফুরসত দেওয়ার ইচ্ছা করলাম।” (আহমাদ, মুসনাদ, ইবনে আবী দাঊদ, মাসাহিফ, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১০২-১০৩পৃ:)

তিনি আরো বলতেন যে, “আমি নামাযে মনোনিবেশ করে ইচ্ছা করি যে, নামায লম্বা করব। কিন্তু শিশুর কান্না শুনে নামায সংক্ষেপ করে নিই। কারণ, জানি যে, শিশু কাঁদলে (নামাযে মশগুল) তার মায়ের মন কঠিনভাবে ব্যথিত হবে।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ১১৩০ নং)

অধিকাংশ নামাযে তিনি সূরার প্রথম থেকে শুরু করে শেষ অবধি পাঠ করতেন। তিনি বলতেন, “প্রত্যেক সূরাকে তার রুকু ও সিজদার অংশ প্রদান কর।” (ইবনে আবী শাইবা ৩৭১১ নং, আহমাদ, মুসনাদ, মাকদেসী) “এক-একটি সূরার জন্য এক-একটি রাকআত।” (ইবনে নাসর, হাকেম, মুস্তাদরাক) অর্থাৎ, এক রাকআতে একটি পূর্ণ সূরা পড়া উত্তম। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১০৩পৃ:)

আবার কখনো তিনি একটি সূরাকে দুই রাকআতে (আধাআধি ভাগ করে) পাঠ করতেন। কখনো বা একটি সূরাকেই উভয় রাকআতেই (পূর্ণরুপে) পড়তেন। (ফজরের নামাযে ক্বিরাআত দ্র:) আবার কোন কোন নামাযে এক রাকআতেই দুই বা ততোধিক সূরা একত্রে পড়তেন।

মহানবী (সাঃ) এক ব্যক্তিকে এক জিহাদের সেনাপতি রুপে প্রেরণ করলেন। সে তাদের নামাযে ইমামতি কালে প্রত্যেক সূরার শেষে ‘ক্বুল হুঅল্লাহু আহাদ’ যোগ করে ক্বিরাআত শেষ করত। যখন তারা ফিরে এল তখন সে কথা আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর নিকট উল্লেখ করল। তিনি বললেন, “তোমরা ওকে জিজ্ঞাসা কর, কেন এমনটি করে?” সুতরাং তারা ওকে জিজ্ঞাসা করলে লোকটি বলল, ‘কারণ, সূরাটিতে পরম দয়ালু (আল্লাহর) গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে। তাই আমি ওটাকে (বারবার) পড়তে ভালোবাসি।’ একথা শুনে তিনি বললেন, “ওকে সংবাদ দাও যে, আল্লাহ আয্‌যা অজাল্লাও ওকে ভালো বাসেন।” (বুখারী ৭৩৭৫ নং, মুসলিম, সহীহ ৮১৩ নং)

কুবার মসজিদে এক ব্যক্তি আনসারদের ইমামতি করত। (সূরা ফাতিহার পর) অন্য সূরা যা পড়ত, তা তো পড়তই। কিন্তু তার পূর্বে সূরা ইখলাসও প্রত্যেক রাকআতেই পাঠ করত। তার মুক্তাদীরা তাকে বলল, ‘আপনি এই সূরা প্রথমে পাঠ করছেন। অতঃপর তা যথেষ্ট মনে না করে আবার অন্য একটি সূরা পাঠ করছেন! হয় আপনি ওটাই পড়ুন, নচেৎ ওটা ছেড়ে অন্য সূরা পড়ুন।’ ইমাম বলল, আমি ওটা পড়তে ছাড়ব না। তোমরা চাইলে আমি তোমাদের নামাযে এইভাবেই ইমামতি করব, নচেৎ তোমাদের অপছন্দ হলে ইমামতিই ত্যাগ করব। লোকটি যেহেতু তাদের চেয়ে ভাল ও যোগ্য ছিল, তাই তারা ঐ ইমামকে ত্যাগ করতে অপছন্দ করল। কিন্তু মহানবী (সাঃ) তাদের নিকট উপস্থিত হলে তারা ঐ ব্যাপার খুলে বলল। নবী (সাঃ) তাকে বললেন, “হে অমুক! তোমার মুক্তাদীরা যা করতে বলছে, তা কর না কেন? আর কেনই বা ঐ সূরাটিকে নিয়মিত প্রত্যেক রাকআতে পাঠ করে থাক?” লোকটি বলল, ‘আমি সূরাটিকে ভালোবাসি।’ মহানবী (সাঃ) বললেন, “ঐ সূরাটির প্রতি ভালোবাসা তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে।” (বুখারী বিচ্ছিন্ন সনদে ৭৭৪ নং, সহিহ, তিরমিযী, সুনান ২৩২৩ নং)

সূরার মাঝখান থেকেও কতক আয়াত পাঠ করা যায়। যেহেতু আল্লাহ তাআলা বলেন,

فاقرَؤُوْا مَا تَيَسَّرَ مِنَ الْقُرْآن

অর্থাৎ, ---কাজেই কুরআনের যতটুকু অংশ পাঠ করা তোমাদের জন্য সহ্‌জ, ততটুকু তোমরা পাঠ কর। (কুরআন মাজীদ ৭৩/২০)

নামায ভুলকারী সাহাবীকেও রসূল (সাঃ) বলেছিলেন, “অতঃপর কুরআন থেকে যতটুকু তোমার জন্য সহ্‌জ হয় ততটুকু পাঠ কর।” (বুখারী, মুসলিম,  প্রমুখ, মিশকাত ৭৯০ নং) তাছাড়া তিনি ফজরের সুন্নতে প্রথম রাকআতে সূরা বাক্বারার ১৩৬ নং আয়াত এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা আ-লে ইমরানের ৬৪ নং আয়াত পাঠ করেছিলেন। (মুসলিম,  মিশকাত ৮৪৩ নং) আর এ কথা বিদিত যে, যা নফল নামাযে পড়া যায়, তা ফরয নামাযেও (কোন আপত্তির দলীল না থাকলে) পড়া যাবে। আর পড়া আপত্তিকর হলে নিশ্চয় তার বর্ণনা থাকত। যেমন সাহাবাগণ যখন মহানবী (সাঃ) এর উট ও সওয়ারীর উপর নফল এবং বিত্‌র নামায পড়ার কথা বর্ণনা করেন, তখনই তার সাথে এ কথাও বর্ণনা করেন যে, ‘অবশ্য তিনি সওয়ারীর উপর ফরয নামায পড়তেন না।’ (বুখারী ১০৯৮, মুসলিম, সহীহ ৭০০নং)

তবে এক রাকআতে পূর্ণ একটি সূরা এবং সূরার শুরু অংশ থেকে পাঠ করাই আফযল। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/১০৩-১০৪, ৩৩৪, ৩৬০)

ক্বিরাআতে যা মুস্তাহাব

আল্লাহর রসূল (সাঃ) (তাহাজ্জুদের) নামাযে যখন কুরআন পড়তেন, তখন ধীরে ধীরে পড়তেন। কোন তাসবীহর আয়াত পাঠ করলে তাসবীহ পড়তেন, কোন প্রার্থনার আয়াত পাঠ করলে প্রার্থনা করতেন এবং কোন আশ্রয় প্রার্থনার আয়াত পাঠ করলে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। (মুসলিম, সহীহ ৭৭২ নং)

ব্যাপারটি নফল নামাযের হলেও ফরয নামাযেও আমল করা বৈধ। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৯৬)

তিনি সূরা কিয়ামাহ্‌ এর শেষ আয়াত, أَلَيْسَ ذلِكَ بِقَادِرٍ عَلى أَنْ يُحْيِىَ الْمَوْتى (অর্থাৎ যিনি এত কিছু করেন তিনি কি মৃতকে পুনঃজীবিত করতে সক্ষম নন?) পড়লে জওয়াবে বলতেন,  سُبْحَانَكَ فَبَلى  (সুবহা-নাকা ফাবালা), অর্থাৎ তুমি পবিত্র, অবশ্যই (তুমি সক্ষম)।

সূরা আ’লার প্রথম আয়াত, سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الأَعْلىঅর্থাৎ তোমার প্রতিপালকের নামের পবিত্রতা ঘোষণা কর) পাঠ করলে জওয়াবে বলতেন,سُبْحَانَ رَبِّىَ الأَعْلى  (সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা। অর্থাৎ আমি আমার মহান প্রতিপালকের পবিত্রতা ঘোষণা করছি)। (আবূদাঊদ, সুনান ৮৮৩, ৮৮৪নং, বায়হাকী)

আল্লামা আলবানী বলেন, উক্ত আয়াতদ্বয়ের জওয়াবে উক্ত দুআ বলার ব্যাপারটা সাধারণ; অর্থাৎ, ক্বিরাআত নামাযে হোক বা তার বাইরে, ফরযে হোক বা নফলে সর্বক্ষেত্রে উক্ত জওয়াব দেওয়া যাবে। আবূ মূসা আশআরী এবং উরওয়াহ্‌ বিন মুগীরাহ্‌ ফরয নামাযে উক্ত দুআ বলতেন। (ইবনে আবী শাইবা ৮৬৩৯, ৮৬৪০, ৮৬৪৫ নং)

একদা মহানবী (সাঃ) সাহাবীদের নিকট সূরা রহ্‌মান শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করলেন। সাহাবীগণ নীরব বসে তেলাওয়াত শুনছিলেন। তিনি বললেন, “যে রাত্রে আমার নিকট জিনের দল আসে, সে রাত্রে আমি উক্ত সূরা ওদের নিকট পাঠ করলে ওরা সুন্দর জওয়াব দিচ্ছিল। যখনই আমি পাঠ করছিলাম,

فَبِأَيِّ آلاَءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبانِ

(অর্থাৎ, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কোন্‌ নিয়ামতকে অস্বীকার কর?) তখনই তারাও এর জওয়াবে বলছিল,

لاَ بِشَيْءٍ مِّنْ نِّعَمِكَ رَبَّنَا نُكَذِّبُ، فَلَكَ الْحَمْدُ।

উচ্চারণ:- লা বিশাইইম মিন নিআ’মিকা রাব্বানা নুকাযযিবু, ফালাকালহাম্‌দ।

অর্থ:-  তোমার নেয়ামতসমূহের কোন কিছুকেই আমরা অস্বীকার করি না হে আমাদের প্রতিপালক! (তিরমিযী, সুনান, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২১৫০নং)

এ তো গেল ইমাম বা একাকী নামাযীর কথা। কিন্তু মুক্তাদী হলে ইমাম চুপ থেকে ঐ সমস্ত দুআ পাঠ করলে সেও পড়তে পারে। নচেৎ ইমাম চুপ না হলে ইমামের ক্বিরাআত চলাকালে ঐ সমস্ত জওয়াব পড়া বৈধ নয়। কারণ, ক্বিরাআতের সময় ইমামের পশ্চাতে সূরা ফাতিহা ছাড়া অন্য কিছু পড়ার অনুমতি নেই। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৯৪)

ক্বিরাআতে মুসহাফের তরতীব (অনুক্রম) বজায় রেখে পাঠ করা মুস্তাহাব। অর্থাৎ, দ্বিতীয় সূরা বা দ্বিতীয় রাকআতে যে সূরা পাঠ করবে, তা যেন মুসহাফে প্রথমে পঠিত সূরার পরে হয়। অবশ্য এর বিপরীত করা দোষাবহ্‌ নয়; বরং বৈধ। যেমন মহানবী (সাঃ) এর তাহাজ্জুদের ক্বিরাআতে আমরা জানতে পারব। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৯/১৪৮, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১০৪পৃ:, ৪নং টীকা)

মহানবী (সাঃ) আল্লাহর আদেশ অনুসারে ধীরে ধীরে স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে কুরআন পাঠ করতেন; তাড়াহুড়ো করে শীঘ্রতার সাথে নয়। বরং এক একটা হ্‌রফ স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করে পাঠ করতেন। (ইবনুল মুবারক, যুহ্‌দ, আবূদাঊদ, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১২৪পৃ:)

তিনি বলতেন, “কুরআন তেলাওয়াতকারীকে পরকালে বলা হবে, ‘পড়তে থাক এবং মর্যাদায় উন্নীত হতে থাক। আর (ধীরে ধীরে, শুদ্ধভাবে কুরআন) আবৃত্তি কর, যেমন দুনিয়ায় অবস্থানকালে আবৃত্তি করতে। যেহেতু যা তুমি পাঠ করতে তার সর্বশেষ আয়াতের নিকট তোমার স্থান হবে।” (আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, জামে ৮১২২ নং)

তিনি ‘হ্‌রফে-মাদ্দ্‌ ‘ (আলিফ, ওয়াউও ইয়া) কে টেনে পড়তেন। (বুখারী ৫০৪৫, আবূদাঊদ, সুনান ১৪৬৫ নং) কখনো কখনো বিনম্র সুরে ‘আ-আ-আ’ শব্দে অনুরণিত কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। (বুখারী ৭৫৪০, মুসলিম, সহীহ)

তিনি কুরআন মধুর সুরে পাঠ করতে আদেশ করতেন; বলতেন :-

“তোমাদের (সুমিষ্ট) শব্দ দ্বারা কুরআনকে সৌন্দর্যমন্ডিত কর। কারণ, মধুর শব্দ কুরআনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।” (বুখারী তা’লীক, আবূদাঊদ, সুনান ১৪৬৮, দারেমী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক)

“কুরআন পাঠে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আওয়াজ তার, যার কুরআন পাঠ করা শুনে মনে হয়, সে আল্লাহর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত।” (যুহ্‌দ, ইবনুল মুবারক, দারেমী, সুনান, ত্বাবারানী, মু’জাম, প্রমুখ, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১২৫ পৃ:)

“তোমরা আল্লাহর কিতাব শিক্ষা কর, (পাঠ করার মাধ্যমে) তার যত্ন কর, তা ঘরে রাখ এবং সুরেলা কণ্ঠে তা তেলাওয়াত কর। কারণ, উট যেমন রশির  বন্ধন থেকে অতর্কিতে বের হয়ে যায়, তার চেয়ে অধিক অতর্কিতে কুরআন (স্মৃতি থেকে) বের হয়ে (বিস্মৃত হয়ে) যায়।” (দারেমী, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ ৪/১৪৬, ১৫০, ১৫৩, ৩৯৭)

তিনি আরো বলেন, “সে ব্যক্তি আমার দলভুক্ত নয়, যে সুরেলা কণ্ঠে কুরআন পড়ে না।” (আবূদাঊদ, সুনান ১৪৭১, ১৪৭৯,হাকেম, মুস্তাদরাক)

কুরআন পাঠকালে তিনি প্রত্যেক আয়াত শেষে থামতেন। (আবূদাঊদ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩৪৩ নং)

মহানবী (সাঃ) একই বা কাছাকাছি অর্থবোধক দুই সূরাকে কখনো কখনো একই রাকআতে পাঠ করতেন। (বুখারী ৭৭৫, মুসলিম, সহীহ ৭২২ নং)  সূরা রহ্‌মান (৫৫নং সূরা / ৭৮ আয়াত বিশিষ্ট) ও নাজম (৫৩/৬২) এক রাকআতে, সূরা ইক্বতারাবাত (৫৪/৫৫) ওহা-ক্বাহ্‌ (৬৯/৫২) এক রাকআতে, সূরা তূর (৫২/৪৯) ও যারিয়াত (৫১/৬০) এক রাকআতে, সূরা ওয়া-ক্বিআহ্‌ (৫৬/৯৬) ও নূন (৬৮/৫২) এক রাকআতে, সূরা মাআ-রিজ (৭০/৪৪) ও না-যিআত (৭৯/৪৬) এক রাকআতে, সূরা মুত্বাফফিফীন (৮৩/৩৬) ও আবাসা (৮০/৪২) এক রাকআতে, সূরা মুদ্দাষষির (৭৪/৫৬) ও মুযযাম্মিল (৭৩/২০) এক রাকআতে, সূরা দাহ্‌র (৭৬/৩১) ও ক্বিয়ামাহ্‌ (৭৫/৪০) এক রাকআতে, সূরা নাবা (৭৮/৪০) ও মুরসালাত (৭৭/৫০) এক রাকআতে এবং সূরা দুখান (৪৪/৫৯) ও তাকবীর (তাকভীর) (৮১/২৯) এক রাকআতে পাঠ করতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ১৩৯৬ নং)

আবার কখনো কখনো সূরা বাক্বারাহ্‌, আ-লে ইমরান ও নিসার মত বড় বড় সূরাকেও একই রাকআতে পাঠ করতেন। (মুসলিম, সহীহ ৭৭২ নং)

জেহরী ও সির্রী নামায

যে নামাযে ক্বিরাআত সশব্দে ও জোরে হয় তাকে জেহরী এবং যাতে নিঃশব্দে ও চুপেচুপে হয় তাকে সির্রী নামায বলা হয়।

ফজর ও জুমআর উভয় রাকআতে এবং মাগরিব ও এশার প্রথম দু’ রাকআতে জেহরী, আর যোহ্‌র ও আসরের সকল রাকআতে এবং মাগরেবের শেষ এক ও এশার শেষ দুই রাকআতে সির্রী ক্বিরাআত বিধেয়।

সাধারণ সুন্নত ও নফল নামাযের ক্বিরাআত সির্রী। বাকী নামাযের ক্বিরাআত বিষয়ক মসলা যথাস্থানে আলোচিত হবে ইন শা আল্লাহ।

নামাযী একাকী হলেও জেহরী নামাযে জেহরী ক্বিরাআত তার জন্য সুন্নত। অবশ্য সে এমন জোরে ক্বিরাআত করতে পারে না, যাতে অপর নামাযী, যিক্‌রকারী বা নিদ্রিত ব্যক্তির ডিষ্টার্ব হয়। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৬৯)

মহিলার ক্বিরাআতের শব্দ তার কোন বেগানা পুরুষ শুনতে পাবে -এই আশঙ্কা থাকলে সে জেহরী ক্বিরাআত করতে পারে না। এমন আশঙ্কা না থাকলে তার জন্যও জেহরী নামাযে জেহরী ক্বিরাআত সুন্নত। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৩৫৩)

সির্রী নামাযে যদি কেউ জেহরী ক্বিরাআত ভুল করে করেই ফেলে, তাহলে তার জন্য শেষে আর সহু সিজদার প্রয়োজন নেই। যেহেতু কোন সুন্নত ত্যাগ বা মাকরুহ আমল করে ফেললে সহু সিজদার দরকার হয় না। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ১৬/১৩৭)

জেহরী নামাযের ক্বিরাআত জোরে, সির্রী নামাযের ক্বিরাআত চুপেচুপে এবং কতক জেহরী নামাযের কয়েক রাকআতে সির্রী ক্বিরাআত কেন হল তার হিকমত ও যুক্তি স্পষ্ট নয়। যেমন যোহ্‌র, আসর ও এশার নামায চার রাকআত, মাগরেবের তিন রাকআত এবং ফজরের দুই রাকআত কেন হল তারও কোন সঠিক জওয়াব নেই। সুতরাং এ সবের হিকমত আল্লাহই জানেন।

পাঁচ-ওয়াক্ত নামাযে সুন্নতী ক্বিরাআত

সূরা ফাতিহার পর নামাযী তার নিজের মুখস্থ ও সহ্‌জ মত অন্য যে কোন একটি সূরা পাঠ করতে পারে। অবশ্য কতকগুলি বিশিষ্ট সূরা মহানবী (সাঃ) বিশেষ নামাযে পাঠ করতেন বলে অনুরুপ পাঠ করাকে সুন্নতী ক্বিরাআত বলে। এ সকল নামায ও সূরার বিস্তারিত বিবরণ জানার পূর্বে কুরআন মাজীদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত কয়েকটি পরিভাষা জেনে নেওয়া প্রয়োজন।

কুরআন মাজীদকে ৭ ভাগে বিভক্ত করলে শেষ ভাগে যে সব সূরা পড়ে তার সমষ্টিকে ‘মুফাস্‌স্বাল’ বলা হয়। ‘ফাস্ৱল’ মানে পরিচ্ছেদ। এই অংশে সূরা ও পরিচ্ছেদের সংখ্যা অধিক বলে একে ‘মুফাস্‌স্বাল’ বা পরিচ্ছেদ-বহুল অংশ বলা হয়ে থাকে। সঠিক অভিমত অনুসারে এই অংশের প্রথম সূরা হল সূরা ক্বাফ।

এই মুফাস্‌স্বাল আবার ৩ ভাগে বিভক্ত; সূরা ক্বাফ থেকে সূরা মুরসালাত পর্যন্ত অংশকে ‘ত্বিওয়ালে মুফাস্‌স্বাল’ (দীর্ঘ পরিচ্ছেদ-বহুল অংশ), সূরা নাবা থেকে সূরা লাইল পর্যন্ত অংশকে ‘আউসাত্বে মুফাস্‌স্বাল’ (মাঝারি পরিচ্ছেদ-বহুল অংশ), আর সূরা য্বুহা থেকে শেষ সূরা (নাস) পর্যন্ত অংশকে ‘ক্বিসারে মুফাস্‌স্বাল’ (ছোট পরিচ্ছেদ-বহুল অংশ) বলা হয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/১০৫)

ফজরের নামাযে সুন্নতী ক্বিরাআত

নবী মুবাশ্‌শির (সাঃ) ফজরের নামাযে ‘ত্বিওয়ালে মুফাস্‌স্বাল’ পাঠ করতেন। যেহেতু এই সময়টি হল পরিবেশ শান্ত এবং ঘুম পূর্ণ করার পর মনে স্ফূর্তি থাকার ফলে মনোযোগ সহকারে কুরআন তিলাওয়াতের সময়। তাছাড়া মহান আল্লাহ বলেন,

أقِمِ الصَّلاَةَ لِدُلُوْكِ الشَّمْسِ إِلىَ غَسَقِ اللَّيْلِ وَقُرْآنِ الْفَجْرِ إِنَّ قُرْآنَ الْفَجْرِ كَانَ مَشْهُوْداً

অর্থাৎ, সূর্য ঢলে যাওয়ার পর হতে রাতের ঘন অন্ধকার পর্যন্ত তুমি নামায কায়েম কর; আর বিশেষ করে ফজরের কুরআন (নামায কায়েম কর)। কারণ, ফজরের কুরআন (নামাযে ফিরিশ্‌তা) উপস্থিত হয়ে থাকে। (কুরআন মাজীদ ১৭/৭৮)

এখানে ফজরের কুরআন বলে ফজরের নামাযকে বুঝিয়ে এই কথার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, উক্ত নামাযে কুরআন অধিক সময় ধরে পড়া হবে। আর তার গুরুত্ব এত বেশী যে, তাতে ফিরিশ্‌তা উপস্থিত হয়ে থাকেন।

তিনি উক্ত নামাযে কখনো কখনো সূরা ওয়া-ক্বিআহ বা অনুরুপ সূরা পাঠ করতেন। (আহমাদ, মুসনাদ, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১০৯পৃ:)

বিদায়ী হজ্জের এক ফজরের নামাযে তিনি সূরা তূর পাঠ করেছেন। (বুখারী ১৬১৯ নং)

কখনো বা তিনি সূরা ক্বাফ বা অনুরুপ সূরা প্রথম রাকআতে পাঠ করতেন। (মুসলিম,  তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ৮৩৫ নং)

কখনো কখনো সূরা তাকবীর (ইযাশ্‌ শামসু কুউবিরাত) পাঠ করতেন। (মুসলিম,  আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ৮৩৬ নং)

একদা ফজরে তিনি সূরা যিলযালকে উভয় রাকআতেই পাঠ করেন। বর্ণনাকারী সাহাবী বলেন, ‘কিন্তু জানি না যে, তিনি তা ভুলে পড়ে ফেলেছেন, নাকি ইচ্ছা করেই পড়েছেন।’ (আবূদাঊদ, সুনান, বায়হাকী, মিশকাত ৮৬২ নং) সাধারণত: যা বুঝা যায় তা এই যে, মহানবী (সাঃ) ঐরুপ বৈধতা বর্ণনার উদ্দেশ্যেই ইচ্ছা করেই (একই সূরা উভয় রাকআতে পাঠ) করেছেন। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১১০পৃ:)

একদা এক সফরে তিনি ফজরের প্রথম রাকআতে সূরা ফালাক্ব ও দ্বিতীয় রাকআতে সূরা নাস পাঠ করেছেন। (আবূদাঊদ, সুনান ১৪৬২, নাসাঈ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, ইবনে আবী শাইবা,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/৫৬৭, আহমাদ, মুসনাদ ৪/১৪৯, ১৫০, ১৫৩, মিশকাত ৮৪৮ নং)

উক্ববাহ্‌ বিন আমের (রাঃ) কে তিনি বলেছেন, “তোমার নামাযে সূরা ফালাক্ব ও নাস পাঠ কর। (উভয় সূরায় রয়েছে বিভিন্ন অনিষ্টকর বিষয় থেকে আশ্রয় প্রার্থনা।) কারণ এই দুই (প্রার্থনার) মত কোন প্রার্থনা দ্বারা কোন প্রার্থনাকারী আশ্রয় প্রার্থনা করে নি।” (আবূদাঊদ, সুনান, ১৪৬৩, আহমাদ, মুসনাদ, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১১০পৃ:)

আবার কখনো কখনো এ সবের চেয়ে লম্বা সূরাও পাঠ করতেন। এই নামাযে তিনি এক রাকআতে অথবা উভয় রাকআতে ৬০ থেকে ১০০ আয়াত মত পাঠ করতেন। (বুখারী ৭৭১ নং, মুসলিম, সহীহ)

কখনো তিনি সূরা রুম পাঠ করতেন। (আহমাদ, মুসনাদ, নাসাঈ, সুনান, বাযযার) কখনো পাঠ করতেন সূরা ইয়াসীন। (আহমাদ, মুসনাদ, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১১০পৃ:)

একদা মক্কায় ফজরের নামাযে তিনি সূরা মু’মিনূন শুরু করলেন, অতঃপর মূসা ওহারুন অথবা ঈসা (আঃ) এর বর্ণনা এলে (অর্থাৎ উক্ত সূরার ৪৫ অথবা ৫০ আয়াত পাঠের পর) তাঁকে কাশিতে ধরলে তিনি রুকূতে চলে যান। (বুখারী, বিনা সনদে, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/২৯৮, মুসলিম,  মিশকাত ৮৩৭নং)

আবার কখনো কখনো তিনি সূরা স্বা-ফফাত পাঠ করে ইমামতি করতেন। (আহমাদ, মুসনাদ, আবূ য়্যা’লা, মাক্বদেসী, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১১১পৃ:)

জুমআর দিন ফজরে তিনি প্রথম রাকআতে সূরা সাজদাহ এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা দাহ্‌র পাঠ করতেন। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৮৩৮ নং)

হযরত উসমান (রাঃ) ফজরের নামাযে অধিকাংশ সময়ে সূরা ইউসুফ ও সূরা হজ্জ ধীরে ধীরে পাঠ করতেন। অবশ্য তিনি ফজর উদয় হওয়ার সাথে সাথেই নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন। (মালেক, মুঅত্তা ৩৫, মিশকাত ৮৬৪ নং)

যোহরের নামাযে সুন্নতী ক্বিরাআত

যোহরের (প্রথমকার) উভয় রাকআতে ৩০ আয়াত মত অথবা সূরা সাজদাহ পাঠ করার মত সময় কুরআন পাঠ করতেন। (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম,  মিশকাত ৮২৯ নং)

কখনো তিনি সূরা ত্বা-রিক্ব, বুরুজ, লাইল বা অনুরুপ কোন সূরা পাঠ করতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৮০৫, ৮০৬, তিরমিযী, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ)  আবার কখনো কখনো পড়তেন সূরা ‘ইযাস সামা-উন শা ক্বা ত’ বা অনুরুপ কোন সূরা। (ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ ৫১১নং)

সাহাবাগণ (রাঃ) আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর দাড়ি হিলা দেখে তাঁর ক্বিরাআত পড়া বুঝতে পারতেন। (বুখারী ৭৬০, আবূদাঊদ, সুনান ৮০১ নং)

কখনো কখনো তিনি মুক্তাদীগণকে আয়াত (একটু শব্দ করে পড়ে) শুনিয়ে দিতেন। (বুখারী,মুসলিম, সহীহ ৮২৮)

কখনো কখনো সাহাবাগণ (রাঃ) তাঁর নিকট হতে যোহরের নামাযে সূরা আ’লা ও গাশিয়াহ্‌র সুর শুনতে পেতেন। (ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ ৫১২নং)

কখনো কখনো তিনি যোহরের ক্বিরাআত এত লম্বা করতেন যে, নামায শুরু হওয়ার পর কেউ কেউ বাকী’ [মহানবী (সাঃ) এর আমলে মদ্বীনার পূর্বে এবং বর্তমানে মসজিদে নববীর পূর্ব দিকে অনতি দূরে অবস্থিত খালি জায়গা। বর্তমানে কবরস্থান] গিয়ে পায়খানা ফিরে এসে নিজের বাড়িতে ওযু করে যখন মসজিদে আসত, তখনও দেখত মহানবী (সাঃ) প্রথম রাকআতেই আছেন। (মুসলিম, সহীহ ৪৫৪ নং, বুখারী জুযউল ক্বিরাআহ্‌)

এ ব্যাপারে সাহাবাগণের ধারণা এই ছিল যে, তিনি সকলকে প্রথম রাকআত পাইয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এত লম্বা ক্বিরাআত পড়তেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৮০০ নং, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ)

আসরের নামাযে সুন্নতী ক্বিরাআত

আসরের নামাযে নবী মুবাশ্‌শির (সাঃ) প্রায় ১৫ আয়াত পাঠ করার মত ক্বিরাআত করতেন। যোহরের প্রথম দু’ রাকআতে যতটা পড়তেন তার অর্ধেক পড়তেন আসরের প্রথম দু’ রাকআতে।

তিনি এ নামাযেও পড়তেন, সূরা আ’লা ও সূরা লাইল। (মুসলিম,  মিশকাত ৮৩০ নং) সূরা ত্বারিক্ব ও বুরুজ। (আবূদাঊদ, সুনান ৮০৫ নং)  এতেও তিনি কখনো কখনো মুক্তাদীদেরকে আয়াত শুনিয়ে দিতেন।

মাগরেবের নামাযে সুন্নতী ক্বিরাআত

মাগরেবের নামাযে কখনো কখনো তিনি ‘ক্বিসারি মুফাস্‌স্বাল’ থেকে পাঠ করতেন। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৮৫৩ নং) এই সংক্ষেপের ফলেই সাহাবাগণ যখন নামায পড়ে ফিরতেন তখন কেউ তীর ছুঁড়লে তাঁর তীর পড়ার স্থানটিকে দেখেতে পেতেন। কারণ, তখনও বেশ উজ্জ্বল থাকত। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৫৯৬ নং)

কখনো সফরে তিনি এর দ্বিতীয় রাকআতে সূরা তীন পাঠ করেছেন। (ত্বায়ালেসী, আহমাদ, মুসনাদ, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১১৫ পৃ:)

কখনো বা তিনি ‘ত্বিওয়ালে মুফাস্‌স্বাল’ ও আওসাত্বে মুফাস্‌স্বাল’-এর সূরাও পাঠ করতেন। কখনো পড়তেন সূরা মুহাম্মাদ। (ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, ত্বাবারানী, মু’জাম, মাক্বদেসী, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১১৬ পৃ:) কখনো পাঠ করতেন সূরা তূর। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৮৩১ নং)

তিনি তাঁর জীবনের শেষ মাগরেবের নামাযে পাঠ করেছেন সূরা মুরসালাত। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৮৩২ নং)

কখনো উভয় রাকআতেই পড়েছেন সূরা আ’রাফ। (বুখারী, আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ৮৪৭ নং) কখনো বা সূরা আনফাল। (ত্বাবারানী, মু’জাম, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১১৬ পৃ:)

এশার নামাযে সুন্নতী ক্বিরাআত

এশার নামাযে তিনি ‘আওসাত্বে মুফাস্‌স্বাল’-এর সূরা পাঠ করতেন। (নাসাঈ, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ৮৫৩ নং) কখনো পড়তেন, সূরা শামস বা অনুরুপ অন্য কোন সূরা। (আহমাদ, মুসনাদ, তিরমিযী, সুনান ৩০৯ নং) কখনো সূরা ইনশিক্বাক্ব পড়তেন এবং এর সিজদার আয়াতে তিনি তিলাওয়াতের সিজদা করতেন। (বুখারী ৭৬৬, মুসলিম,  নাসাঈ, সুনান)

কখনো পাঠ করতেন সূরা তীন। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৮৩৪ নং)

তিনি মুআয (রাঃ) কে এশার ইমামতিতে লম্বা ক্বিরাআত পড়তে নিষেধ করে বলেছিলেন, “তুমি কি লোকদেরকে ফিতনায় ফেলতে চাও হে মুআয? তুমি যখন ইমামতি করবে তখন ‘অশ্‌শামসি অযযুহা-হা, সাব্বিহিসমা রাব্বিকাল আ’লা, ইক্বরা বিসমি রাব্বিকা, অল্লাইলি ইযা য়্যাগশা’ পাঠ কর। কারণ তোমার পশ্চাতে বৃদ্ধ, দুর্বল ও প্রয়োজনে উদগ্রীব মানুষ নামায পড়ে থাকে। (বুখারী, মুসলিম,  না, মিশকাত ৮৩৩ নং)

কেবল ফাতিহা পড়লেও চলে

১,২,৩ বা ৪ রাকআত বিশিষ্ট যে কোনও নামাযের প্রত্যেক রাকআতে সূরা ফাতিহার পর অন্য একটি সূরা মিলানো চলে, প্রথম দু’ রাকআতে ১টি মিলিয়ে শেষ দু’ রাকআতে না মিলালেও চলে। আবার কোন রাকআতেই সূরা ফাতিহার পর অন্য কোন সূরা পাঠ না করলেও যথেষ্ট হয়। পূর্বোক্ত মুআয (রাঃ) এর ব্যাপারে অভিযোগকারী যুবককে আল্লাহর রসূল (সাঃ) জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি যখন নামায পড় তখন কিরুপ কর, হে ভাইপো?” বলল, ‘আমি সূরা ফাতিহা পড়ি এবং (তাশাহহুদের পর) আল্লাহর নিকট বেহেশ্‌ত চাই ও দোযখ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি। আর আমি আপনার ও মুআযের গুঞ্জন বুঝি না। নবী (সাঃ) বললেন, “আমি ও মুআয এরই ধারে-পাশে গুন্‌গুন্‌ করি।” (আবূদাঊদ, সুনান ৭৯৩ নং)

পূর্বে উল্লেখিত এক হাদীসে উল্লেখ হয়েছে যে, সূরা ফাতিহা-বিহীন নামায অপরিণত ও অসম্পূর্ণ। (মুসলিম,  আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ৮২৩ নং) সুতরাং এ থেকে বুঝা যায় যে, সূরা ফাতিহাবিশিষ্ট নামায পরিণত ও সম্পূর্ণ। আর অন্য সূরা পাঠ জরুরী নয়। (ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ ১/২৫৮)

হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, ‘প্রত্যেক নামাযেই ক্বিরাআত আছে। সুতরাং আল্লাহর রসূল (সাঃ) যা আমাদেরকে শুনিয়েছেন, তা আমি তোমাদেরকে শুনালাম এবং যা চুপেচুপে পড়েছেন, তা চুপেচুপে পড়লাম।’ এক ব্যক্তি বলল, ‘যদি আমি সূরা ফাতিহার পর অন্য কিছু না পড়ি?’ তিনি বললেন, ‘যদি অন্য কিছু পড় তাহলে উত্তম। না পড়লে সূরা ফাতিহাই যথেষ্ট।” (বুখারী ৭৭২, মুসলিম, সহীহ ৩৯৬ নং)

রফউল য়্যাদাইন

সূরা পাঠ শেষ হলে দম নেওয়ার জন্য নবী মুবাশ্‌শির (সাঃ) একটু চুপ থাকতেন বা থামতেন। (আবূদাঊদ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২১৫) অতঃপর তিনি নিজের উভয়হাত দুটিকে পূর্বের ন্যায় কানের উপরি ভাগ বা কাঁধ পর্যন্ত তুলতেন। এ ব্যাপারে এত হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, তা ‘মুতাওয়াতির’-এর দর্জায় পৌঁছে।

ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাঃ) যখন নামায শুরু করতেন, যখন রুকূ করার জন্য তকবীর দিতেন এবং রুকূ থেকে যখন মাথা তুলতেন তখন তাঁর উভয়হাতকে কাঁধ বরাবর তুলতেন। আর (রুকূ থেকে মাথা তোলার সময়) বলতেন, “সামিআ’ল্লা-হু লিমানহামিদাহ্‌।” তবে সিজদার সময় এরুপ (রফয়ে য়্যাদাইন) করতেন না।’ (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৭৯৩নং)

মহানবী (সাঃ) এর দেহে চাদর জড়ানো থাকলেও হাত দুটিকে চাদর থেকে বের করে ‘রফয়ে য়্যাদাইন’ করেছেন। সাহাবী ওয়াইল বিন হুজর (রাঃ) বলেন, তিনি দেখেছেন যে, নবী (সাঃ) যখন নামাযে প্রবেশ করলেন, তখন দুই হাত তুলে তকবীর বলেহাত দুটিকে কাপড়ে ভরে নিলেন। অতঃপর ডান হাতকে বামহাতের উপর রাখলেন। তারপর যখন রুকূ করার ইচ্ছা করলেন, তখন কাপড় থেকে হাত দু’টিকে বের করে পুনরায় তুলে তকবীর দিয়ে রুকূতে গেলেন। অতঃপর যখন (রুকূ থেকে উঠে) তিনি ‘সামিআল্লাহু লিমানহামিদাহ্‌’ বললেন, তখনও হাত তুললেন। আর যখন সিজদা করলেন, তখন দুই হাতের চেটোর মধ্যবর্তী জায়গায় সিজদা করলেন। (মুসলিম,  মিশকাত ৭৯৭ নং)

এই সকল ও আরো অন্যান্য হাদীসকে ভিত্তি করেই তিন ইমাম এবং অধিকাংশ মুহাদ্দিস ও ফকীহ্‌গণের আমল ছিল এই সুন্নাহর উপর। কিছু হানাফী ফকীহও এই অনস্বীকার্য সুন্নাহর উপর আমল করে গেছেন। যেমন ইমাম আবূ ইউসুফের ছাত্র ইসাম বিন ইউসুফ, আবূ ইসমাহ্‌ বালখী রুকূ যাওয়া ও রুকূ থেকে ওঠার সময় ‘রফয়ে য়্যাদাইন’ করতেন। (আল-ফাওয়াইদ ১১৬পৃ:) বলাই বাহুল্য যে, তিনি দলীলের ভিত্তিতেই ইমাম আবূহানীফা (রহঃ) এর বিপরীতও ফতোয়া দিতেন। (আল-বাহ্‌রুর রাইক্ব ৬/৯৩, রসমুল মুফতী ১/২৮) বলতে গেলে তিনিই ছিলেন প্রকৃত ইমাম আবূহানীফার ভক্ত ও অনুসারী। কারণ, তিনি যে বলে গেছেন, ‘হাদীস সহীহ হলেই সেটাই আমার মযহাব।’

আব্দুল্লাহ্‌ বিন আহমাদ তাঁর পিতা ইমাম আহমাদ (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, উক্ববাহ্‌ বিন আমের হতে বর্ণনা করা হয়, তিনি নামাযে ‘রফয়ে য়্যাদাইন’ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘নামাযীর জন্য প্রত্যেক ইশারা (হাত তোলার) বিনিময়ে রয়েছে ১০টি করে নেকী।’ (মাসাইল ৬০পৃ:)

আল্লামা আলবানী বলেন, হাদীসে ক্বুদসীতে উক্ত কথার সমর্থন ও সাক্ষ্য মিলে; “যে ব্যক্তি একটি নেকী করার ইচ্ছা করার পর তা আমলে পরিণত করে, তার জন্য ১০ থেকে ৭০০ নেকী লিপিবদ্ধ করা হয়---।” (বুখারী, মুসলিম,  সহিহ তারগিব ১৬ নং, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ৫৬ ও ১২৮-১২৯পৃ:) যেহেতু ‘রফয়ে য়্যাদাইন’ হল সুন্নাহ্‌। আর সুন্নাহর উপর আমল নেকীর কাজ বৈকি?

দেহে শাল জড়ানো থাকলে শালের ভিতরেও কাঁধ বরাবর হাত তোলা সুন্নত।

ওয়াইল বিন হুজর (রাঃ) বলেন, ‘আমি শীতকালে নবী (সাঃ) এর নিকট এলাম। দেখলাম, তাঁর সাহাবীগণ নামাযে তাঁদের কাপড়ের ভিতরেই ‘রফয়ে য়্যাদাইন’ করছেন।’ (আবূদাঊদ, সুনান ৭২৯ নং)

‘রফ্‌য়ে ইয়াদাইন’ হল মহানবী (সাঃ) এর সুন্নাহ্‌ ও তরীকা। তার পশ্চাতে হিকমত বা যুক্তি না জানা গেলেও তা সুন্নাহ্‌ ও পালনীয়। তবুও এর পশ্চাতে যুক্তি দর্শিয়ে অনেকে বলেছেন, হাত তোলায় রয়েছে আল্লাহর প্রতি যথার্থ তা’যীম; বান্দা কথায় যেমন ‘আল্লাহ সবার চেয়ে বড়’ বলে, তেমনি তার ইশারাতেও তা প্রকাশ পায়। উক্ত সময়ে এই অর্থ মনে আনলে বান্দার নিকট থেকে দুনিয়া অদৃশ্য হয়ে যায়। নেমে আসে সে রাজাধিরাজ বিশ্বাধিপতির ভীতি ও তা’যীম।

কেউ বলেন, হাত তোলা হল বান্দা ও আল্লাহর মাঝে পর্দা তোলার প্রতি ইঙ্গিত। যেহেতু এটাই হল বিশেষ মুনাজাতের সময়। একান্ত গোপনে বান্দা আল্লাহর সাথে কথা বলে থাকে।

কেউ বলেন, এটা নামাযের এক সৌন্দর্য ও প্রতীক। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৩৪)

কেউ বলেন, ‘রফয়ে য়্যাদাইন’ হল আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করার প্রতি ইঙ্গিত। অপরাধী যখন পুলিশের রিভলভারের সামনে হাতে-নাতে ধরা পড়ে, তখন সে আত্মসমর্পণ করে হাত দু’টিকে উপর দিকে তুলে অনায়াসে নিজেকে সঁপে দেয় পুলিশের হাতে। অনুরুপ বান্দাও আল্লাহর নিকট অপরাধী। তাই বারবার হাত তুলে তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ করা হয়। (কাইফা তাখশাঈনা ফিস স্বালাহ্‌ ৩১পৃ: দ্র:)

পক্ষান্তরে আর এক শ্রেণীর বিকৃত-প্রকৃতির চিন্তাবিদ রয়েছেন, যাঁরা এর যুক্তি দেখাতে গিয়ে বলেন, ‘সাহাবীরা বগলে মূর্তি (বা মদের বোতল) ভরে রেখে নামায পড়তেন! কারণ ইসলামের শুরুতে তখনো তাঁদের মন থেকে মূর্তির (বা মদের বোতলের) মহব্বত যায়নি। তাই নবী করীম (সাঃ) তাঁদেরকে বারবার হাত তুলতে আদেশ করেছিলেন। যাতে কেউ আর বগলে মূর্তি (বা মদের বোতল) দাবিয়ে রাখতে না পারে।’ (নাঊযু বিল্লাহি মিন যালিক।) বক্তার উদ্দেশ্য হল, ‘রফয়ে য়্যাদাইন’-এর প্রয়োজন তখনই ছিল। পরবর্তীকালে সাহাবীদের মন থেকে মূর্তি (বা মদের বোতলে)র মায়া চলে গেলে তা মনসূখ করা হয়!!

এই শ্রেণীর যুক্তিবাদীরা আরো বলে থাকেন, ‘সে যুগে ক্ষুর-ব্লেড ছিল না বলেই দাড়ি রাখত! সে যুগের লোকেরা খেতে পেত না বলেই রোযা রাখত---!!’ অর্থাৎ বর্তমানে সে অভাব নেই। অতএব দাড়ি ও রোযা রাখারও কোন প্রয়োজনীয়তা ও যৌক্তিকতা নেই। এমন বিদ্রুপকারী যুক্তিবাদীদেরকে মহান আল্লাহর দু’টি আয়াত স্মরণ করিয়ে দিই, তিনি বলেন, “আর যারা মু’মিন নারী-পুরুষদেরকে বিনা অপরাধে কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও স্পষ্ট গুনাহর ভার নিজেদের মাথায় চাপিয়ে নেয়।” (কুরআন মাজীদ ৩৩/৫৮) “অতঃপর ওরা যদি তোমার (নবীর) আহ্‌বানে সাড়া না দেয়, তাহলে জানবে ওরা তো কেবল নিজেদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে। আল্লাহর পথনির্দেশ অমান্য করে যে ব্যক্তি নিজ খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে তার অপেক্ষা অধিক বিভ্রান্ত আর কে? নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়কে পথনির্দেশ করেন না।” (কুরআন মাজীদ ২৮/৫০)

পরন্তু ‘রফ্‌য়ে ইয়াদাইন’ করতে সাহাবাগণ আদিষ্ট ছিলেন না। বরং হযরত রসূলে কারীম (সাঃ) খোদ এ আমল করতেন। সাহাবাগণ তা দেখে সে কথার বর্ণনা দিয়েছেন এবং আমল করেছেন। তাহলে বক্তা কি বলতে চান যে, ‘তিনিও প্রথম প্রথম বগলে মূর্তি দেবে রেখে নামায পড়তেন এবং তাই হাত ঝাড়তেন?! (নাঊযু বিল্লাহি মিন যালিক।)

পক্ষান্তরে ঐ শ্রেণীর নামাযী বক্তারাও তাকবীরে তাহ্‌রীমার সময় ‘রফ্‌য়ে ইয়াদাইন’ করে থাকেন। তাহলে তা কেন করেন? এখনো কি তাঁদের বগলে মূর্তিই থেকে গেছে? সুতরাং যুক্তি যে খোঁড়া তা বলাই বাহুল্য।

প্রকাশ থাকে যে, ‘রফয়ে য়্যাদাইন’ না করার হাদীস সহীহ হলেও তা নেতিবাচক এবং এর বিপরীতে একাধিক হাদীস হল ইতিবাচক। আর ওসূলের কায়দায় ইতিবাচক নেতিবাচকের উপর প্রাধান্য পায়। তাছাড়া কোন যয়ীফ হাদীস এক বা ততোধিক সহীহ হাদীসকে মনসূখ করতে পারে না। অতএব মনসূখের দাবী যথার্থ নয় এবং এ সুন্নাহ্‌ বর্জনও উচিৎ নয়।

রুকূ ও তার পদ্ধতি

‘রফয়ে য়্যাদাইন’ করে নবী মুবাশ্‌শির (সাঃ) তকবীর বলে রুকূতে যেতেন। রুকূ করা ফরয। মহান আল্লাহ বলেন,

يا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا ارْكَعُوْا وَاسْجُدُوْا
অর্থাৎ, হে ঈমানদাগণ! তোমরা রুকূ ও সিজদা কর---। (কুরআন মাজীদ ২২/৭৭)

মহানবী (সাঃ) ও নামায ভুলকারী সাহাবীকে তকবীর দিয়ে রুকূ করতে আদেশ করে বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে কারো নামায ততক্ষণ পর্যন্ত সম্পূর্ণ হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে উত্তমরুপে ওযু করে---- অতঃপর তকবীর দিয়ে রুকূ করে এবং উভয় হাঁটুর উপর হাত রেখে তার হাড়ের জোড়গুলো স্থির ও শ্রান্ত হয়ে যায়।” (আবূদাঊদ, সুনান ৮৫৭, নাসাঈ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক)

রুকূতে ঝুঁকে তিনি হাতের চেটো দু’টোকে দুই হাঁটুর উপর রাখতেন। (বুখারী, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ৮০১ নং) আর এইভাবে রাখতে আদেশও দিতেন। হাত দ্বারা হাঁটুকে শক্ত করে ধরতেন। (বুখারী, আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ৭৯২ নং) হাতের আঙ্গুলগুলোকে খুলে (ফাঁক ফাঁক করে) রাখতেন। (হাকেম, মুস্তাদরাক, সআবূদাঊদ, সুনান ৮০৯ নং) আর এইরুপ করতে তিনি নামায ভুলকারী সাহাবীকে আদেশ করেছেন। তিনি বলেছেন, “যখন রুকূ করবে তখন তুমি তোমারহাতের চেটো দু’টোকে তোমার দুই হাঁটুর উপর রাখবে। অতঃপর আঙ্গুলগুলোর মাঝে ফাঁক রাখবে। অতঃপর স্থির থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত প্রত্যেক অঙ্গ স্ব-স্ব স্থানে বসে না যায়।” (ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ ৫৯৭ নং, ইবনে হিব্বান, সহীহ)

এই রুকূর সময় তিনি তাঁর হাতের দুই কনুইকে পাঁজর থেকে দূরে রাখতেন। (তিরমিযী, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, মিশকাত ৮০১নং) এই সময় তিনি তাঁর পিঠকে বিছিয়ে লম্বা ও সোজা রাখতেন। কোমর থেকে পিঠকে মচকে যাওয়া ডালের মত ঝুঁকিয়ে দিতেন। (বুখারী ৮২৮, বায়হাকী, মিশকাত ৭৯২নং) তাঁর পিঠ এমন সোজা ও সমতল থাকত যে, যদি তার উপর পানি ঢালা হত তাহলে তা কোন দিকে গড়িয়ে পড়ে যেত না। (ত্বাবা,কাবীরসাগীর,আহমাদ, মুসনাদ১/১২৪,ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ৮৭২)

তিনি নামায ভুলকারী সাহাবীকে আদেশ করে বলেছিলেন, “যখন তুমি রুকূ করবে, তখন তোমার দুইহাতের চেটোকে দুই হাঁটুর উপর রাখবে, তোমার পিঠকে সটান বিছিয়ে দেবে এবং দৃঢ়ভাবে রুকূ করবে।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান)

রুকূতে তিনি তাঁর মাথাকেও সোজা রাখতেন। পিঠ থেকে মাথা না নিচু হত, না উঁচু। (আবূদাঊদ, সুনান, বুখারী জুযউল ক্বিরাআহ্‌, মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ৮০১ নং)  আর নামাযে তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ হত সিজদার স্থানে। (বায়হাকী,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩৫৪নং)

রুকূতে স্থিরতার গুরুত্ব

নবী মুবাশ্‌শির (সাঃ) রুকূতে স্থিরতা অবলম্বন করতেন। এ ব্যাপারে তিনি নামায ভুলকারী সাহাবীকে আদেশও করেছেন। আর তিনি বলতেন, “তোমরা তোমাদের রুকূ ও সিজদাকে পরিপূর্ণরুপে আদায় কর। সেই সত্তার শপথ! যাঁর হাতে আমার প্রাণ আছে, আমি আমার পিঠের পিছন থেকে তোমাদের রুকূ ও সিজদাহ করা দেখতে পাই। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৮৬৮নং)

তিনি এক নামাযীকে দেখলেন, সে পূর্ণরুপে রুকূ করে না, আর সিজদাহ করে ঠকঠক করে। বললেন, “যদি এই ব্যক্তি এই অবস্থায় মারা যায়, তাহলে সে মুহাম্মাদের মিল্লাত ছাড়া অন্য মিল্লাতে থাকা অবস্থায় মারা যাবে। ঠকঠক করে নামায পড়ছে; যেমন কাক ঠকঠক করে রক্ত ঠুকরে খায়! যে ব্যক্তি পূর্ণরুপে রুকূ করে না এবং ঠকঠক করে সিজদাহ করে, সে তো সেই ক্ষুধার্ত মানুষের মত, যে একটি অথবা দু’টি খেজুর খায়, যাতে তার ক্ষুধা মিটে না।” (আবু য়্যা’লা, আজুরী, বায়হাকী, ত্বাবারানী, মু’জাম, যিয়া, ইবনে আসাকির, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৩১পৃ:)

আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, ‘আমার বন্ধু আমাকে নিষেধ করেছেন যে, আমি যেন মোরগের দানা খাওয়ার মত ঠকঠক করে নামায না পড়ি, শিয়ালের মত (নামাযে) চোরা দৃষ্টিতে (এদিক-ওদিক) না তাকাই, আর বানরের বসার মত (পায়ের রলা খাড়া করে) না বসি।’ (ত্বায়ালিসী, আহমাদ, মুসনাদ ২/২৬৫, ইবনে আবী শাইবা)

 তিনি বলতেন, “সবচেয়ে নিকৃষ্ট চোর হল সেই ব্যক্তি, যে তার নামায চুরি করে।” লোকেরা বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! নামায কিভাবে চুরি করবে?’ বললেন, “পূর্ণরুপে রুকূ ও সিজদাহ না করে।” (ইবনে আবী শাইবা ২৯৬০ নং, ত্বাবা,হাকেম, মুস্তাদরাক)

একদা তিনি নামায পড়তে পড়তে দৃষ্টির কোণে দেখলেন যে, এক ব্যক্তি তার রুকূ ও সিজদায় মেরুদন্ড সোজা করে না। নামায শেষ করে তিনি বললেন, “হে মুসলিম দল! সেই নামাযীর নামায হয় না, যে রুকূ ও সিজদায় তার মেরুদন্ড সোজা করে না।” (ইবনে আবী শাইবা ২৯৫৭, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৫৩৬ নং)

তিনি আরো বলেন, “সে নামাযীর নামায যথেষ্ট নয়, যে রুকূ ও সিজদায় তার পিঠ সোজা করে না।” (আবূদাঊদ, সুনান ৮৫৫নং, আহমাদ, মুসনাদ)

রুকূর গুরুত্ব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি একটি রুকূ অথবা সিজদাহ করে, সে ব্যক্তির তার বিনিময়ে একটি মর্যাদা উন্নত হয় এবং একটি পাপ মোচন হয়ে যায়।” (আহমাদ, মুসনাদ,বাযযার,দারেমী, সুনান,সহিহ তারগিব ৩৮৫নং)

রুকূর যিক্‌র

মহানবী (সাঃ) রুকূতে গিয়ে কয়েক প্রকার দুআ ও যিক্‌র পড়তেন। কখনো এটা কখনো ওটা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম দুআ পাঠ করতেন। যেমন:-

১।   ُ  سُبْحَانَ رَبِّيَ الْعَظِيْم
উচ্চারণ:- সুবহা-না রাব্বিয়াল আযীম।

অর্থ:- আমি আমার মহান প্রতিপালকের পবিত্রতা ঘোষণা করছি।

এটি তিনি ৩ বার পাঠ করতেন। (আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, দারাক্বুত্বনী, সুনান, ত্বাহা, বাযযার, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ ৬০৪নং, ত্বাবারানী, মু’জাম)

অবশ্য কোন কোন সময়ে তিনের অধিকবারও পাঠ করতেন। কারণ, কখনো কখনো তাঁর রুকূ ও সিজদাহ কিয়ামের মত দীর্ঘ হত। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৩২পৃ:)

২।سُبْحَانَ رَبِّىَ الْعَظِيْمِ وَبِحَمْدِهِ।
 উচ্চারণ- সুবহা-না রাব্বিয়াল আযীম অবিহামদিহ্‌।

  অর্থ-  আমি আমার মহান প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা করছি। ৩ বার। (আবূদাঊদ, সুনান ৮৮৫নং, দারাক্বুত্বনী, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ, ত্বাবারানী, মু’জাম, বায়হাকী)

৩। سُبُّوْحٌ قُدُّوْسٌ رَبُّ الْمَلاَئِكَةِ وَالرُّوْحِ।
 উচ্চারণ:- সু ব্বূহুন ক্বুদ্দূসুন রাব্বুল মালা-ইকাতি অররুহ্‌।

অর্থ- অতি নিরঞ্জন, অসীম পবিত্র ফিরিশ্‌তামন্ডলী ও জিবরীল (আহমাদ, মুসনাদ) এর প্রভু (আল্লাহ)। (মুসলিম,  আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ৮৭২ নং)

৪।  سُبْحَانَكَ اللّهُمَّ رَبَّنَا وَ بِحَمْدِكَ اللّهُمَّ اغْفِرْلِيْ।
উচ্চারণ:- সুবহা-নাকাল্লা-হুম্মা রব্বানা অবিহামদিকা,আল্লা-হুম্মাগ ফিরলী।

অর্থ- হে আল্লাহ! আমি তোমার সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা করি, হে আমাদের প্রভু! তুমি আমাকে মাফ কর।

উক্ত দুআ তিনি অধিকাংশ পাঠ করতেন। এ ব্যাপারে তিনি কুরআনের নির্দেশ পালন করতেন। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৮৭১নং) যেহেতু কুরআনে আল্লাহ তাঁকে আদেশ করেছেন,

 فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَاسْتَغْفِرْهُ إِنَّهُ كَانَ تَوَّاباً
অর্থাৎ, সুতরাং তুমি তোমার প্রভুর সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা কর এবং তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয় তিনি তওবা গ্রহণকারী। (কুরআন মাজীদ ১১০/৩)

৫। اَللّهُمَّ لَكَ رَكَعْتُ وَ بِكَ آمَنْتُ وَلَكَ أَسْلَمْتُ وَعَلَيْكَ تَوَكَّلْتُ، أَنْتَ  رَبِّيْ خَشَعَ سَمْعِيْ
وَبَصَرِيْ وَدَمِيْ وَلَحْمِيْ وَعَظْمِيْ وَ عَصَبِيْ للهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ।
উচ্চারণ:- আল্লা-হুম্মা লাকা রাকা’তু অবিকা আ-মানতু অলাকা আসলামতু অ আলাইকা তাওয়াক্কালতু আন্তা রাব্বী , খাশাআ সাময়ী, অ বাস্বারী অ দামী অ লাহ্‌মী অ আযমী অ আস্বাবী লিল্লা-হি রাব্বিল আলামীন।

অর্থ:- হে আল্লাহ! আমি তোমারই জন্য রুকু করলাম, তোমারই প্রতি বিশ্বাস রেখেছি, তোমারই নিকট আত্মসমর্পণ করেছি, তোমারই উপর ভরসা করেছি, তুমি আমার প্রভু। আমার কর্ণ, চক্ষু, রক্ত, গোশত, অস্থি ও ধমনী বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য বিনয়াবনত হল। (মুসলিম,  সহিহ,নাসাঈ, সুনান ১০০৬ নং)

৬। سُبْحَانَ ذِي الْجَبَرُوْتِ وَالْمَلَكُوْتِ وَالْكِبْرِيَاءِ وَالْعَظَمَةِ।
উচ্চারণ:- সুবহা-না যিল জাবারুতি অল মালাকূতি অল কিবরিয়া-ই অল আযামাহ্‌।

 অর্থ- আমি প্রবলতা, সার্বভৌমত্ব, গর্ব ও মাহাত্মের অধিকারী (আল্লাহর) পবিত্রতা ঘোষণা করি।

এই দুআ'টি তিনি তাহাজ্জুদের নামাযের রুকূতে পাঠ করতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৮৭৩, সহিহ,নাসাঈ, সুনান ১০০৪ নং)

রুকূর আনুষঙ্গিক মাসায়েল

নবী মুবাশ্‌শির (সাঃ) এর রুকূ, রুকূর পর কওমাহ্‌, সিজদাহ এবং দুই সিজদার মাঝের বৈঠক প্রায় সমপরিমাণ দীর্ঘ হত। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৮৬৯ নং)

রুকূ ও সিজদাতে তিনি কুরআন পাঠ করতে নিষেধ করতেন। তিনি বলতেন, “শোন! আমাকে নিষেধ করা হয়েছে যে, আমি যেন রুকূ বা সিজদাহ অবস্থায় কুরআন না পড়ি। সুতরাং রুকূতে তোমার প্রতিপালকের তা’যীম বর্ণনা কর। আর সিজদায় অধিকাধিক দুআ করার চেষ্টা কর। কারণ তা (আল্লাহর নিকট) গ্রহণ-যোগ্য।” (মুসলিম,  মিশকাত ৮৭৩নং)

যেহেতু আল্লাহর কালাম (বাণী)। সবচেয়ে সম্মানিত বাণী। আর রুকূ ও সিজদার অবস্থা হল বান্দার পক্ষে হীনতা ও বিনয়ের অবস্থা। তাই আল্লাহর বাণীর প্রতি আদব রক্ষার্থে উক্ত উভয় অবস্থাতেই কুরআন পাঠ সঙ্গত নয়। বরং এর জন্য উপযুক্ত অবস্থা হল কিয়ামের অবস্থা। (মাদারিজুস সা-লিকীন ২/৩৮৫)

উল্লেখ্য যে, দীর্ঘ নামাযের একই রুকূতে কয়েক প্রকার যিক্‌র এক সঙ্গে পাঠ দূষণীয় নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/১৩৩, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৩৪পৃ:)

কওমাহ্‌

অতঃপর আল্লাহর রসূল (সাঃ) রুকূ থেকে মাথা ও পিঠ তুলে সোজা খাড়া হতেন। এই সময় তিনি বলতেন,

 سَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدَه।
“সামিআল্লাহু লিমানহামিদাহ্‌।” (অর্থাৎ, আল্লাহর যে প্রশংসা করে তিনি তা শ্রবণ করেন। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৭৯৯ নং)

নামায ভুলকারী সাহাবীকে তিনি এ কথা বলতে আদেশ করে বলেছিলেন, “কোন লোকেরই নামায ততক্ষণ পর্যন্ত সম্পূর্ণ হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তকবীর দিয়েছে ---- অতঃপর রুকূ করেছে --- অতঃপর ‘সামিআল্লাহু লিমানহামিদাহ্‌’ বলে সোজা খাড়া হয়েছে।” (আবূদাঊদ, সুনান ৮৫৭ নং, হাকেম, মুস্তাদরাক)

এই সময়েও তিনি উভয়হাতকে কাঁধ অথবা কানের উপরিভাগ পর্যন্ত তুলতেন; যেমন এ কথা পূর্বে আলোচিত হয়েছে।

মালেক বিন হুয়াইরিস (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাঃ) তাকবীরে তাহরীমার সময় কান বরাবর উভয় হাত তুলতেন। আর যখন তিনি রুকূ থেকে মাথা তুলতেন ও ‘সামিআল্লাহু লিমানহামিদাহ্‌’ বলতেন তখনও অনুরুপহাত তুলতেন।’ (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৭৯৫নং)

উক্ত কওমায় তিনি এরুপ খাড়া হতেন যে, মেরুদন্ডের প্রত্যেক (৩৩ খানা)হাড় নিজ নিজ জায়গায় ফিরে যেত। (বুখারী ৮২৮, আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ৭৯২নং)

তিনি বলতেন, “ইমাম বানানো হয় তার অনুসরণ করার উদ্দেশ্যে। সুতরাং ---সে যখন ‘সামিআল্লাহু ---’ বলবে তখন তোমরা ‘রাব্বানা অলাকালহাম্‌দ’ বল। আল্লাহ তোমাদের প্রশংসা শ্রবণ করবেন। কারণ, আল্লাহ তাবারাকা অতাআলা তাঁর নবী (সাঃ) এর মুখে বলেছেন, ‘সামিআল্লাহু লিমানহামিদাহ্‌’ (অর্থাৎ, আল্লাহর যে প্রশংসা করে তিনি তা শ্রবণ করেন)। (মুসলিম, সহীহ ৪০৪, আহমাদ, মুসনাদ, আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ৯৭২নং)

অন্য এক হাদীসে তিনি উক্ত কথা বলার ফযীলত প্রসঙ্গে বলেন, “---যার ঐ কথা ফিরিশ্‌তাবর্গের কথার সমভাব হবে, তার পূর্বেকার পাপসমূহ মাফ হয়ে যাবে।” (বুখারী, মুসলিম,  তিরমিযী, সুনান, আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ৮৭৪নং)

পূর্বের বর্ণনা থেকে এ কথা বুঝা যায় যে, ইমাম ‘সামিআল্লাহু ---’ বললে মুক্তাদী ‘রাব্বানা অলাকালহাম্‌দ’ বলবে। তবে এখানে এ কথা নিশ্চিত নয় যে, মুক্তাদী ‘সামিআল্লাহু ---’ বলবে না। বরং মুক্তাদীও উভয় বাক্যই বলতে পারে। যেহেতু আল্লাহর নবী (সাঃ) উভয়ই বলেছেন। (দেখুন, মুসলিম,  আবূদাঊদ, সুনান, প্রভৃতি, মিশকাত ৭৯৩নং, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৩৫-১৩৬পৃ:)

কওমার দুআ

১।  ربَّنَا لَكَ الْحَمْد (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৭৯৩, ৭৯৯নং)

২।ربنا وَلَكَ الْحَمْد  (বুখারী ৮০৩ নং, প্রমুখ)

৩।اَللّهُمَّ رَبَّنَا لَكَ الْحَمْد  (বুখারী ৭৯৬, মুসলিম,  প্রভৃতি, মিশকাত ৮৭৪নং)

৪।  اَللّهُمَّ رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْد (বুখারী ৭৯৫নং, মুসলিম,  প্রমুখ)

উচ্চারণ:- রাব্বানা লাকাল হাম্‌দ, অথবা  রাব্বানা অলাকালহাম্‌দ, অথবা আল্লাহুম্মা  রাব্বানা লাকাল হাম্‌দ, অথবা আল্লাহুম্মা  রাব্বানা অলাকালহাম্‌দ।

অর্থ:- হে আমাদের প্রভু! তোমারই নিমিত্তে যাবতীয় প্রশংসা।

ربَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ حَمْدًا كَثِيْراً طَيِّباً مُّبَارَكاً فِيْه
উচ্চারণ:- রাব্বানা অলাকালহামদুহামদান কাসীরান ত্বাইয়িবাম মুবা-রাকান ফীহ্‌। (বুখারী ৭৯৮, মালেক, মুঅত্তা ৪৯৪, আবূদাঊদ, সুনান ৭৭০নং)

অন্য এক বর্ণনায় নিম্নের শব্দগুলো বাড়তি আছে,

উمُبَارَكاً عَلَيْهِ كَمَا يُحِبُّ رَبُّنَا وَيَرْضَى।

‘---মুবারাকান আলাইহি কামা য়্যুহিব্বু রাব্বুনা অয়্যারযা। (আবূদাঊদ, সুনান ৭৭৩, তিরমিযী, সুনান ৪০৫, সহিহ,নাসাঈ, সুনান ৮৯২-৮৯৩নং) অবশ্য উক্ত বর্ণনায় হাঁচির কথাও উল্লেখ আছে। যাতে মনে হয় যে, বর্ণনাকারী রিফাআহ্‌ বিন রাফে’ (রাঃ) এর হাঁচিও ঐ সময়েই এসেছিল। (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/৩৩৪)  নামায শেষে নবী (সাঃ) বললেন, “নামাযে কে কথা বলল?” রিফাআহ্‌ বললেন, ‘আমি।’ বললেন, “আমি ত্রিশাধিক ফিরিশ্‌তাকে দেখলাম, তাঁরা দুআটিকে (আমলনামায়) প্রথমে লিখার জন্য আপোসে প্রতিযোগিতা করছে!”

পূর্ণ দুআটির অর্থ:- হে আমাদের প্রভু! তোমারই যাবতীয় প্রশংসা, অগণিত পবিত্রতা ও বর্কতময় প্রশংসা (যেমন আমাদের প্রতিপালক ভালোবাসেন ও সন্তুষ্ট হন।)

উক্তহাদীসকে ভিত্তি করে অনেকে মনে করেন যে, কওমার দুআ সশব্দে পড়া চলবে। কিন্তু ব্যাপারটা ছিল আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত। তাইতো রিফাআহ্‌ ছাড়া আর কেউউক্ত দুআ সশব্দে বলেছেন বা ঐ দিন ছাড়া অন্য দিনও কেউবলেছেন কি না তার কোন প্রমাণ নেই। সুতরাং কওমার দুআ সশব্দে পড়া বিধেয় নয়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্‌ ২৬/৯৮)  বড়জোর এ কথা বলা যায় যে, কেউকেউকোন কোন সময় সশব্দে পড়তে পারে। কিন্তু শর্ত হ্‌লো, যেন অপর নামাযীর ডিস্টার্ব না হয়। (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/৩৩৫) কারণ, পরস্পর ডিস্টার্ব করে কুরআন পাঠও নিষেধ। (মালেক, মুঅত্তা, আহমাদ, মুসনাদ ২/৩৬, ৪/৩৪৪) সুতরাং উত্তম হ্‌লো নিঃশব্দে পড়াই।

৬।رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ مِلْءَ السَّماوَاتِ وَ مِلْءَ الأَرْضِ وَمِلْءَ مَا شِئْتَ مِنْ شَىْءٍ بَعْدُ

  উচ্চারণ:- রাব্বানা অলাকালহামদু মিলআস সামা-ওয়া-তি অমিলআল আর যি অ মিলআ মা শি’তা মিন শাইয়িন বা’দ।

  অর্থ- হে আমাদের প্রভু! তোমারই নিমিত্তে যাবতীয় প্রশংসা আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী ভরে এবং এর পরেও তুমি যা চাও সেই বস্তু ভরে।

এক বর্ণনায় এই দুআও বাড়তি আছে,

اَللَّهُمَّ طَهِّرْنِيْ بِالثَّلْجِ وَالْبَرَدِ وَالْمَاءِ الْبَارِدِ، اَللَّهُمَّ طَهِّرْنِيْ مِنَ الذُّنُوْبِ وَالْخَطَايَا

كَمَا يُنَقَّي الثَّوْبُ الأَبْيَضُ مِنَ الدَّنَس।

উচ্চারণ:- আল্লা-হুম্মা ত্বাহ্‌হিরনী বিষষালজি অলবারাদি অলমা-ইল বা-রিদ। আল্লাহুম্মা ত্বাহ্‌হিরনী মিনায যুনূবি অলখাত্বায়্যা কামা য়্যুনাক্বাষ ষাওবুল আবয়্যায্বু মিনাদ্‌ দানাস।

অর্থ:- হে আল্লাহ! তুমি আমাকে বরফ, শিলাবৃষ্টি ও ঠান্ডা পানি দ্বারা পবিত্র করে দাও। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে গুনাহ ও ত্রুটিসমূহ থেকে সেইরুপ পবিত্র কর, যেরুপ সাদা কাপড়কে ময়লা থেকে পবিত্র করা হয়। (মুসলিম, সহীহ ৪৭৬নং, প্রমুখ)

৭।رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ مِلْءَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَ مِلْءَ مَا شِئْتَ مِنْ شَىْءٍ بَعْدُ، أَهْلَ الثَّنَاءِ وَالْمَجْدِ أَحَقُّ  مَا قَالَ الْعَبْدُ وَكُلُّنَا لَكَ عَبْدٌ: اَللّهُمَّ لاَ مَانِعَ لِمَا أَعْطَيْتَ وَلاَ مُعْطِىَ لِمَا مَنَعْتَ وَلاَ يَنْفَعُ ذَا الْجَدِّ مِنْكَ الْجَدِّ।

উচ্চারণ:- রাব্বানা লাকালহামদু মিলআস সামা-ওয়া-তি অল আরযি অমিলআ মা শি’তা মিন শাইয়িন বা’দ, আহ্‌লাস সানা-য়ি অলমাজদ। আহা ক্কু মা ক্বা-লাল আব্দ, অকু ল্লু না লাকা আব্দ, আল্লা-হুম্মা লা মা-নিআ লিমা আ’ত্বাইতা অলা মু’ত্বিআ লিমা মানা’তা অলা য়্যানফাউযাল জাদ্দি মিনকাল জাদ্দ্‌।

অর্থ- হে  আমাদের প্রভু! তোমারই নিমিত্তে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী পূর্ণ এবং এর পরেও যা চাও তা পূর্ণ যাবতীয়  প্রশংসা। হে প্রশংসা ও গৌ রবের অধিকারী! বান্দার সব চেয়ে সত্যকথা -এবং আমরা প্রত্যেকেই তোমার বান্দা, ‘হে আল্লাহ! তুমি যা প্রদান কর তা রোধ করার এবং যা রোধ কর তা প্রদান করার সাধ্য কারো নেই। আর ধনবানের ধন তোমার আযাব থেকে মুক্তি পেতে কোন উপকারে আসবে না।’ (মুসলিম, সহীহ ৪৭৭)

উক্ত দুই প্রকার দুআর শুরুতে ‘আল্লাহুম্মা---’ শব্দও কিছু বর্ণনায় বাড়তি আছে। (আবূদাঊদ, সুনান ৮৪৬, ৮৪৭নং)

৮।لِرَبِّىَ  الْحَمْدُ لِرَبِّىَ الْحَمْدُ।

উচ্চারণ- লিরাব্বিয়ালহামদ, লিরাব্বিয়ালহামদ।

অর্থ- আমার প্রভুর জন্যই যাবতীয় প্রশংসা, আমার প্রভুর জন্যই যাবতীয় প্রশংসা।

তাহাজ্জুদের নামাযে তিনি বারবার এটি পাঠ করতেন। যার ফলে এই কওমাহ্‌ তাঁর কিয়ামের সমান লম্বা হয়ে যেত; যে কিয়ামে তিনি সূরা বাক্বারাহ্‌ পাঠ করতেন! (আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩৩৫নং)

কওমায় স্থিরতার গুরুত্ব

আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর এই কওমাহ্‌ প্রায় তাঁর রুকূর সমান হত। বরং তিনি কখনো কখনো এত লম্বা দাঁড়াতেন যে, অনেকে মনে করত, তিনি হয়তো বা সিজদায় যেতে ভুলে গেছেন। (বুখারী, মুসলিম,  আহমাদ, মুসনাদ, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩০৭নং)

নামায ভুলকারী সাহাবীকে তিনি এই কওমায় স্থিরতা অবলম্বন করতে আদেশ করে বলেছেন, “---অতঃপর মাথা তুলে সোজা খাড়া হবে; যাতে প্রত্যেক হাড় তার নিজের জায়গায় ফিরে যায়।”

অন্য এক বর্ণনায় আছে, “যখন (রুকূ থেকে পিঠ) উঠাবে তখন পিঠ (মেরুদন্ড) কে সোজা কর। মাথাকে এমন সোজা করে তোল, যাতে সমস্ত হাড় নিজ নিজ জোড়ে ফিরে যায়।” (বুখারী, মুসলিম,  দারেমী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, আহমাদ, মুসনাদ, শাফেয়ী)

তিনি আরো বলেনে, “আল্লাহ তাআলা সেই বান্দার নামাযের প্রতি তাকিয়েও দেখেন না, যে তার মেরুদন্ড (পিঠ)কে রুকূ ও সিজদার মাঝে সোজা করে না।” (আহমাদ, মুসনাদ ২/৫২৫, ত্বাবা কাবীর)

সুতরাং যাঁরা রুকূ থেকে সম্পূর্ণ খাড়া না হয়ে বা আধা খাড়া হয়ে হাঁটু ভেঙ্গে চটপট সিজদায় চলে যান তাঁদের নামায কেমন হবে তা সহজে অনুমেয়।

কওমায় হাত কোথায় থাকবে?

সুন্নাহতে এ কথা স্পষ্ট যে, নামাযীর উভয় হাত নামাযে কিয়াম অবস্থায় বক্ষস্থলে থাকবে। কিন্তু ‘নামায’ ও ‘কিয়াম’ নির্দিষ্ট করে কোন্‌ অবস্থাকে বুঝানো হয়েছে তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে।

কিয়ামে হাত বাঁধা বলতেও কি (রুকূর আগের ও পরের) উভয় কিয়ামকেই বুঝায়?

প্রত্যেক হাড় তার স্বস্থানে বা নিজ জোড়ে ফিরে যায় বলতে কি হাতও নিজের জায়গায় ফিরে যায়? নাকি এখানে শুধু মেরুদন্ডের হাড়ের কথাই বুঝানো হয়েছে? হাড়গুলোর নিজের জায়গায় বা জোড়ে ফিরে যাওয়ার অর্থে পুন:হাত বাঁধাও কি শামিল? নাকি উদ্দেশ্য হল উক্ত অবস্থায় পিঠ সোজা করে স্থির হওয়া (ইত্বমিনান)? হাত নিজের জায়গায় ফিরে গেলে, তার নিজের জায়গা বুকে থাকা অবস্থাটা, নাকি স্বাভাবিকভাবে ঝুলে থাকা অবস্থাটা?

বাস্তবপক্ষে ‘নামায’ ও ‘কিয়াম’ বলতে যদি রুকূর আগের কিয়াম (লম্বা দাঁড়ানো) ও রুকূর পরের কওমাহ্‌ (একটু দাঁড়ানো) উভয়কে এবং হাড় বলতে যদি হাতকেও তথা তার নিজ জায়গা বলতে বুকের উপরকে বুঝা হয়, তাহলে কওমাতেও বুকে হাত বাঁধা সুন্নত।

তাছাড়া (রুকূর আগের) কিয়ামে হাত বুকের উপর, রুকূ অবস্থায় হাঁটুর উপর, সিজদাহ অবস্থায় চেহারার দুই পাশে মুসাল্লায়, বসা অবস্থায় হাঁটু বা রানের উপর রাখার ব্যাপারে দলীল স্পষ্ট। কি­ন্তু রুকূর পর কওমার অবস্থায় হাত কোথায় থাকবে সে ব্যাপারে কোন প্রত্যক্ষ ও স্পষ্ট দলীল সুন্নাহতে নেই। অতএব অস্পষ্ট দলীলকে ভিত্তি করে বলা যায়, এই কিয়াম (কওমাহ্‌) ও ঐ কিয়ামেরই মত। তাই উভয় অবস্থায় বুকে হাত বাঁধা সুন্নত। (ইবনে বায, মাজমূআতু রাসাইল ফিস স্বালাহ্‌, ১৩৪পৃ:, ইবনে উসাইমীন, মুম ৩/১৪৬)

পক্ষান্তরে সাহাবাগণের এত এত হাদীসে রসূল (সাঃ) এর নামায-পদ্ধতির সূক্ষ্ণ বর্ণনা ও প্রত্যেক স্থানে হাত রাখার কথা উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ হাদীস বা বর্ণনা না থাকার ফলে তা বিদআতও হতে পারে। (আলবানী, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৩৯পৃ:)

সুতরাং বিষয়টি যে বিতর্কিত তা বলাই বাহুল্য। ফায়সালা ইজতিহাদের উপর। আর “মুজতাহিদ (আলেম) যখন ইজতিহাদ করে (কোন বিষয়ে সঠিক সি দ্ধান্তে পৌঁছনোর চেষ্টা করে) এবং সে সঠিকতায় পৌঁছে যায়, তখন তার ডবল সওয়াব লাভ হয়। কিন্তু ইজতিহাদ করে ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছলেও তার (গুনাহ হয় না, বরং) একটি সওয়াব লাভ হয়।” (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৩৭৩২ নং) এ ব্যাপারে কেউই অপরাধী নয়।

ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, খন্দকের যুদ্ধ শেষে যখন নবী (সাঃ) ফিরে এলেন, তখন তিনি আমাদেরকে বললেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ যেন বনী কুরাইযাহ্‌ ছাড়া অন্য স্থানে (আসরের) নামায না পড়ে।” পথে চলতে চলতে আসরের সময় উপস্থিত হল। একদল বলল, সেখানে না পৌঁছে আমরা নামায পড়ব না। (কারণ, তিনি সেখান ছাড়া অন্য স্থানে নামায পড়তে নিষেধ করেছেন।) অপর দল বলল, বরং আমরা পথেই নামায পড়ে নেব। (কারণ, নামাযের সময় এসে উপস্থিত হয়েছে। তাছাড়া) তাঁর উদ্দেশ্য এই ছিল না যে, আসরের সময় হলেও আমরা নামায পড়ব না। (বরং তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, আমরা যেন তাড়াতাড়ি বনী কুরাইযায় পৌঁছে যাই, যাতে সেখানে গিয়ে আসরের সময় হয়। ফলে প্রথম দল পথিমধ্যে নামায পড়ল না। আর দ্বিতীয় দল পড়ে নিল।) অতঃপর নবী (সাঃ) এর নিকট ঘটনাটি খুলে বলা হলে তিনি কোন দলকেই  ভর্ত্সনা করলেন না। (বুখারী ৯৪৬ নং, মুসলিম, সহীহ)

যেহেতু তাঁদের দলীল ছিল দ্ব্যর্থ বোধক। তাই প্রত্যেকের ধারণা এবং সিদ্ধান্তও ছিল সঠিক। আর তার জন্যই নিন্দার্হও হলেন না কেউ।

কওমায় হাত বাঁধার ব্যাপারটিও অনুরুপ ইজতিহাদী পর্যায়ের। দ্ব্যর্থবোধক বা অস্পষ্ট দলীল নিয়ে একে অন্যের নিন্দা করা অবশ্যই উচিৎ নয়।

ব্যাপারটি স্পষ্ট দলীল-ভিত্তিক  নয় বলেই ইমাম আহমাদ বিনহাম্বল (রহঃ) বলেছেন, ‘নামাযীর ইচ্ছা হলে রুকূর পর উঠে নিজেরহাত দু’টিকে ছেড়ে রাখবে, নচেৎ চাইলে বুকের উপর রাখবে।’ (মাসাইলু আহমাদ, সালেহ্‌ বিন ইমাম আহমাদ ২/২০৫, ফুরু’ ১/৪৩৩, মুবদি’ ১/৪৫১, ইনসাফ ২/৬৩, শারহু মুন্তাহাল ইরাদাত ১/১৮৫, আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/১৪৬) আর তাঁর নিকট কিয়াম ও কওমাহ্‌ এক নয় বলেই কওমায় এই এখতিয়ার।

সুতরাং আপনার জন্যও এখতিয়ার রয়েছে কওমায়হাত বাঁধা বা না বাঁধার। তবে মনে রাখবেন যে, এটি একটি সন্দিগ্ধ সুন্নত। সুন্নত হলে এবং তা পালন করলে আপনি তার সওয়াবের অধিকারী হবেন। না মানলে অপরাধী বা গুনাহগার হবেন না। পক্ষান্তরে বিদআত হলে তা আপত্তি কর। পরন্তু সেটাও সন্দিগ্ধ। অতএব এ নিয়ে বাড়াবাড়ি এবং আপোসে মনোমালিন্য তথা বিচ্ছিন্নতা ও অনৈক্য আনা আদৌ সমীচীন নয়।

সিজদাহ ও তার পদ্ধতি

কওমার পর নবী মুবাশ্‌শির (সাঃ) তকবীর বলে সিজদায় যেতেন। নামায ভুলকারী সাহাবীকে সিজদাহ করতে আদেশ দিয়ে বলেছিলেন, “স্থিরতার সাথে সিজদাহ বিনা নামায সম্পূর্ণ হবে না।” (আবূদাঊদ, সুনান ৮৫৭ নং,হাকেম, মুস্তাদরাক)

সিজদায় যাওয়ার পূর্বে ‘রফ্‌য়ে ইয়াদাইন’ করার বর্ণনাও সহীহ হাদীসে পাওয়া যায়। (সহিহ,নাসাঈ, সুনান ১০৪০ নং, দারাক্বুত্বনী, সুনান) সুতরাং কখনো কখনো তা করলে কোন দোষ হবে না।

সিজদায় যাওয়ার সময় আল্লাহর নবী (সাঃ) তাঁরহাত দু’টিকে নিজ পাঁজর থেকে দূরে রাখতেন। (আবূ য়্যা’লা, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ ৬২৫ নং)

এ সময় সর্বপ্রথম তিনি তাঁর হাত দু’টিকে মুসাল্লায় রাখতেন। তারপর রাখতেন হাঁটু। এ ব্যাপারে বর্ণিত হাদীসগুলি অধিকতর সহীহ। (আবূদাঊদ, সুনান ৭৪৬, সহিহ,নাসাঈ, সুনান ১০৪৪, মিশকাত ৮৯৯, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩৫৭, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৪০পৃ:, উদ্দাহ্‌ ৯৬পৃ:)

প্রথমে হাঁটু রাখার হাদীসও বহু উলামার নিকট শুদ্ধ। তাই তাঁদের নিকট উভয় আমলই বৈধ। সুবিধামত হাত অথবা হাঁটু আগে রাখতে পারে নামাযী। (ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ্‌ ২২/৪৪৯, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/২৯১,  উদ্দাহ্‌ ৯৬পৃ:, ইবনে বায; কাইফিয়্যাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), মারাসা ১২৭পৃ:, ইবনে উসাইমীন; রিসালাতুন ফী সিফাতি স্বালাতিন নাবী (সাঃ) ৯পৃ:, আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/১৬৫-১৫৭, ফাতহুল মা’বূদ বিসিহ্‌হাতি তাক্বদীমির রুকবাতাইনি ক্বাবলাল য়্যাদাইনি ফিস সুজুদ)

তিনি বলতেন, “হাত দু’টিও সিজদাহ করে, যেমন চেহারা করে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে কেউ যখন (সিজদার জন্য) নিজের চেহারা (মুসাল্লায়) রাখবে, তখন যেন সে তার হাত দু’টিকেও রাখে এবং যখন চেহারা তুলবে, তখন যেন হাত দু’টিকেও তোলে।” (ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, আহমাদ, মুসনাদ, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩১৩ নং)

সিজদাহ করার সময় তিনি উভয় হাতের চেটোর উপর ভর দিতেন এবং চোটো দু’টিকে বিছিয়ে রাখতেন। (আবূদাঊদ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৪১পৃ:) হাতের আঙ্গুলগুলোকে মিলিয়ে রাখতেন। (ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, বায়হাকী,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২২৭) এবং কেবলামুখে সোজা করে রাখতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৭৩২ নং, বায়হাকী, ইবনে আবী শাইবা)

হাতের চেটো দু’টিকে কাঁধের সোজাসুজি দুই পাশে রাখতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৭৩৪, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ৮০১নং) কখনো বা রাখতেন দুই কানের সোজাসুজি। (আবূদাঊদ, সুনান ৭২৩, ৭২৬, সহিহ,নাসাঈ, সুনান ৮৫৬নং)

কপালের সাথে নাকটিকেও মাটি বা মুসাল্লার সঙ্গে লাগিয়ে দিতেন। (আবূদাঊদ, সুনান, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩০৯ নং)

তিনি বলতেন, “সে ব্যক্তির নামাযই হয় না, যে তার কপালের মত নাককেও মাটিতে ঠেকায় না।” (দারাক্বুত্বনী, সুনান ১৩০৪ নং, ত্বাবারানী)

নামায ভুলকারী সাহাবীকে তিনি বলেছিলেন, “তুমি যখন সিজদাহ করবে, তখন তোমার মুখমন্ডল ও উভয়হাত (চেটো) কে মাটির উপর রেখো। পরিশেষে যেন তোমার প্রত্যেকটা হাড় স্বস্থানে স্থির হয়ে যায়।” (ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ ৬৩৮ নং)

এই সময় তাঁর উভয় হাঁটু এবং উভয় পায়ের পাতার শেষ প্রান্তও সিজদারত হত। পায়ের পাতা দু’টিকে তিনি (মাটির উপড়) খাড়া করে রাখতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৮৭৯, সহিহ,নাসাঈ, সুনান ১০৫৩, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ৩৮৪১নং, বায়হাকী) এবং খাড়া রাখতে আদেশও করেছেন। (তিরমিযী, সুনান ২২৮নং, হাকেম, মুস্তাদরাক) পায়ের আঙ্গুলগুলোকে কেবলার দিকে মুখ করে রাখতেন। (বুখারী ৮২৮নং, আবূদাঊদ, সুনান) গোড়ালি দু’টিকে একত্রে মিলিয়ে রাখতেন। ( ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ ৬৫৪ নং,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২২৮)

সুতরাং উক্ত ৭ অঙ্গ দ্বারা তিনি সিজদারত হতেন; মুখমন্ডল (নাক সহ্‌ কপাল) দুইহাতের চেটো, দুই হাঁটু এবং দুই পায়ের পাতা।

তিনি বলেন, “আমি সাত অঙ্গ দ্বারা সিজদাহ করতে আদিষ্ট হয়েছি; কপাল, -আর কপাল বলে তিনি নাকেওহাত ফিরান- দুই হাত (চেটো), দুই হাঁটু এবং দুই পায়ের প্রান্তভাগ।” (বুখারী, মুসলিম,  জামে ১৩৬৯ নং)

তিনি আরো বলেন, বান্দা যখন সিজদাহ করে, তখন তার সঙ্গে তার ৭ অঙ্গ সিজদাহ করে; তার চেহারা, দুইহাতের চেটো, দুই হাঁটু ও দুই পায়ের পাতা।” (মুসলিম,  আহমাদ, মুসনাদ, ইবনে হিব্বান, সহীহ, সহিহ,নাসাঈ, সুনান ১০৪৭, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ৮৮৫ নং)

তিনি বলেন, আমি (আমরা) আদিষ্ট হয়েছি যে, (রুকূ ও সিজদার সময়) যেন পরিহিত কাপড় ও চুল না গুটাই।” (বুখারী, মুসলিম,  জামে ১৩৬৯ নং)

এক ব্যক্তি তার মাথার লম্বা চুল পিছন দিকে বেঁধে রাখা অবস্থায় নামায পড়লে তিনি বলেন, “এ তো সেই ব্যক্তির মত, যে তার উভয়হাত বাঁধা অবস্থায় নামায পড়ে।” (মুসলিম, সহীহ ৪৯২, আআহমাদ, মুসনাদ, ইবনে হিব্বান, সহীহ, আবূদাঊদ, সুনান, ৬৪৭ নং, নাসাঈ, সুনান, দারেমী, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ ১/৩০৪) তিনি চুলের ঐ বাঁধনকে শয়তান বসার জায়গা বলে মন্তব্য করেছেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৬৪৬ নং, তিরমিযী, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ) এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা আসছে ‘নামাযে নিষিদ্ধ বা মাকরুহ কর্মাবলী’র অধ্যায়ে।

আল্লাহর নবী (সাঃ) সিজদায় নিজেরহাতের প্রকোষ্ঠ বা রলা দু’টিকে মাটিতে বিছিয়ে রাখতেন না। (বুখারী ৮২৮ নং, আবূদাঊদ, সুনান) বরং তা মাটি বা মুসাল্লা থেকে উঠিয়ে রাখতেন। অনুরুপ পাঁজর থেকেও দূরে রাখতেন। এতে পিছন থেকে তাঁর বগলের সাদা অংশ দেখা যেত। (বুখারী ৩৯০, মুসলিম,  ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩৫৯নং) তাঁর হাত ও পাঁজরের মাঝে এত ফাঁক হত যে, কোন ছাগলছানা সেই ফাঁকে পার হতে চাইলে পার হতে পারত। (মুসলিম,  আআহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ৮৯৮ নং,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২২৮, ইবনে হিব্বান, সহীহ)

সিজদার সময় তিনি কখনো কখনো হাত দুটিকে পাঁজর থেকে এত দূরে রাখতেন যে, তা দেখে কতক সাহাবী বলেন, ‘আমাদের মনে (তাঁর কষ্ট হ্‌চ্ছে এই ধারণা করে) ব্যথা অনুভব হত।’ (আবূদাঊদ, সুনান ৯০০নং, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান)

এ ব্যাপারে তিনি আদেশ করে বলতেন, “যখন তুমি সিজদাহ কর, তখন তোমার হাতের দুই চেটোকে (মাটির উপর) রাখ এবং দুই কনুইকে উপর দিকে তুলে রাখ।” (মুসলিম, সহীহ ৪৯৪নং, আআহমাদ, মুসনাদ) “তোমরা সোজা ভাবে সিজদাহ কর। তোমাদের মধ্যে কেউ যেন কুকুরের মত দুই প্রকোষ্ঠকে বিছিয়ে না দেয়।” (বুখারী ৮২২, মুসলিম,  আবূদাঊদ, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ) “তোমার দুই হাতের প্রকোষ্ঠকে হিংস্র জন্তুদের মত বিছিয়ে দিও না। দুই চেটোর উপর ভর কর ও পাঁজর থেকে (কনুই দু’টিকে) দূরে রাখ। এরুপ করলে তোমার সঙ্গে তোমার প্রত্যেক অঙ্গ সিজদাহ করবে।” (ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২২৭)

সিজদায় ধীরতার গুরুত্ব

ধীর-স্থিরভাবে সিজদাহ করা ওয়াজেব। তাড়াহুড়ো করে নামায শুদ্ধ হয় না। সিজদায় গিয়ে ধীরতা ও স্থিরতা অবলম্বন করে পিঠ সোজা না করলে এবং প্রত্যেক হাড় তার নিজের জোড়ে স্থিরভাবে বসে না গেলে মুরগীর দানা খাওয়ার মত নামায পড়া হয় ও নামায চুরি করা হয়। আর সিজদায় পিঠ সোজা না করলে নামাযও বাতিল পরিগণিত হয় -যেমন এসব কথা রুকূর বর্ণনায় আলোচিত হয়েছে।

সিজদার যিক্‌র ও দুআ

সিজদায় গিয়ে মহানবী (সাঃ) এক এক সময়ে এক এক রকম দুআ পাঠ করতেন। তাঁর বিভিন্ন দুআ নিম্নরুপ:-
(১)
سُبْحَانَ رَبِّىَ الأَعْلى। 
উচ্চারণ:- সুবহা-না রাব্বিয়্যাল আ’লা
অর্থ- আমি আমার মহান প্রভুর সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা করি। ৩ বার বা ততোধিক বার। (আবূদাঊদ, সুনান ৮৮৫নং, দারাক্বুত্বনী, সুনান, ত্বাহা, বাযযার, ত্বাবারানী)
(২)
 سُبْحَانَ رَبِّىَ الأَعْلى وَ بِحَمْدِهِ।
উচ্চারণ:-  সুবহা-না রাব্বিয়্যাল আ’লা অবিহামদিহ্‌।
অর্থ- আমি আমার সুমহান প্রভুর সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা করি। ৩ বার। (আবূদাঊদ, সুনান , আহমাদ, মুসনাদ, দারাক্বুত্বনী, সুনান, বায়হাকী ২/৮৬, ত্বাবারানী, মু’জাম)
(৩)
سُبُّوْحٌ قُدُّوْسٌ رَبُّ الْمَلاَئِكَةِ وَالرُّوْحِ।
উচ্চারণ:- সুব্বূহুন ক্বুদ্দূসুন রাব্বুল মালা-ইকাতি অররুহ।
অর্থ- অতি নিরঞ্জন, অসীম পবিত্র ফিরিশ্‌তামন্ডলী ও জিবরীল (আহমাদ, মুসনাদ) এর প্রভু (আল্লাহ)। (মুসলিম)
(৪)
سُبْحَانَكَ اللّهُمَّ رَبَّنَا وَ بِحَمْدِكَ اللّهُمَّ اغْفِرْلِيْ।
উচ্চারণ:- সুবহা-নাকাল্লা-হুম্মা রব্বানা অবিহামদিকা,আল্লা-হুম্মাগ ফিরলী।
অর্থ- হে আল্লাহ! আমি তোমার সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা করি, হে আমাদের প্রভু! তুমি আমাকে মাফ কর। (বুখারী, মুসলিম)
(৫)
اَللّهُمَّ لَكَ سَجَدْتُّ وَبِكَ آمَنْتُ وَ لَكَ أَسْلَمْتُ وَ أَنْتَ رَبِّىَ سَجَدَ وَجْهِىَ لِلَّذِيْ خَلَقَهُ وَ صوَّرَهُ فَأَحْسَنَ صُوَرَهُ وَ شَقَّ سَمْعَهُ وَبَصَرَهُ، فَتَبَارَكَ اللهُ أَحْسَنُ الْخَالِقِيْنَ।
উচ্চারণ:- আল্লা-হুম্মা লাকা সাজাত্তু অ বিকা আ-মানতু অ লাকা আসলামতু অ আন্তা রাব্বী, সাজাদা অজহিয়া লিল্লাযী খালাক্বাহু অ স্বাউওয়ারাহু ফাআহ্‌সানা স্বুয়ারাহু অ শাক্বা সামআহু অ বাস্বারাহু ফাতাবা রাকাল্লা-হু আহ্‌সানুল খা-লিক্বীন।
অর্থ- হে আল্লাহ! আমি তোমারই জন্য সিজদাবনত, তোমাতেই বিশ্বাসী, তোমার নিকটেই আত্মসমর্পণকারী, তুমি আমার প্রভু। আমার মুখমন্ডল তাঁর উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হল, যিনি তা সৃষ্টি করেছেন, ওর আকৃতি দান করেছেন এবং আকৃতি সুন্দর করেছেন। ওর চক্ষু ও কর্ণকে উদগত করেছেন। সুতরাং সুনিপুণ স্রষ্টা আল্লাহ কত মহান! (মুসলিম, সহীহ ৭৭১, আবূদাঊদ, সুনান ৭৬০ নং, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, নাসাঈ, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ)
(৬)
اَللّهُمَّ اغْفِرْ  لِيْ ذَنْبِيْ كُلَّهُ وَ دِقَّهُ وَجِلَّهُ وَ أَوَّلَهُ وَآخِرَهُ وَعَلاَنِيَّتَهُ وَسِرَّهُ।
উচ্চারণ- আল্লা-হুম্মাগফিরলী যামবী কুল্লাহ্‌, অদিক্বাহু অজিল্লাহ্‌, অআউওয়ালাহু অ আ-খিরাহ্‌, অ আলা-নিয়্যাতাহু অসির্রাহ্‌।
অর্থ- হে আল্লাহ! তুমি আমার কম ও বেশী, পূর্বের ও পরের, প্রকাশিত ও গুপ্ত সকল প্রকার গুনাহকে মাফ করে দাও। (মুসলিম, সহীহ ৪৮৩নং, আআহমাদ, মুসনাদ)
(৭)
سَجَدَ لَكَ سَوَادِيْ وَخِيَالِيْ، وَآمَنَ بِكَ فُؤَادِيْ، أَبُوْءُ بِنِعْمَتِكَ عَلَىَّ، هذِيْ يَدِيْ  وَمَا

جَنَيْتُ  عَلى نَفْسِيْ।
উচ্চারণ:- সাজাদা লাকা সাওয়া-দী অ খিয়ালী অ আ-মানা বিকা ফুআদী, আবূউবিনি’মাতিকা আলাইয়্যা।হা-যী য়্যাদী অমা জানাইতু আলা নাফসী।
অর্থ- আমার দেহ্‌ ও মন তোমার উদ্দেশ্যে সিজদাবনত, আমার হৃদয় তোমার উপর বিশ্বাসী। আমি আমার উপর তোমার অনুগ্রহ স্বীকার করছি। এটা আমার নিজের উপর অত্যাচারের সাথে (তোমার জন্য) আমার আনুগত্য। (হাকেম, বাযযার, মাজমাউয যাওয়ায়েদ ২/১২৮)

তাহাজ্জুদের  নামাযের সিজদায় নিম্নের দুআগুলি পাঠ করা উত্তম।
(৮)
سُبْحَانَكَ اللّهُمَّ وَ بِحَمْدِكَ، لاَ إِلهَ إِلاَّ أَنْتَ،
উচ্চারণ- সুবহা-কাল্লা-হুম্মা অ বিহামদিকা লা ইলা-হা ইল্লা আন্ত।
অর্থ- হে আল্লাহ! আমি তোমার সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা করি, তুমি ছাড়া অন্য কোন সত্য মাবুদ নেই। (মুসলিম, সহীহ ৪৮৫নং, নাসাঈ, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ)
(৯)
 سُبْحَانَ ذِي الْجَبَرُوْتِ وَالْمَلَكُوْتِ وَالْكِبْرِيَاءِ وَالْعَظَمَةِ।
উচ্চারণ:- সুবহা-না যিল জাবারুতি অল মালাকূতি অল কিবরিয়া-ই অল আযামাহ্‌।
অর্থ- আমি প্রবলতা, সার্বভৌমত্ব, গর্ব ও মাহাত্মের অধিকারী (আল্লাহর) পবিত্রতা ঘোষণা করি। (আবু দাউদ, নাসাঈ)
(১০)
  اَللّهُمَّ اغْفِرْ لِيْ  مَا أَسْرَرْتُ وَمَا أَعْلَنْتُ।
উচ্চারণ- আল্লা-হুম্মাগফিরলী মা আসরারতু অমা আ’লানতু।
অর্থ- হে আল্লাহ! আমার অপ্রকাশ্য  ও প্রকাশ্য পাপসমূহ ক্ষমা করে দাও। (নাসাঈ, সুনান ১০৭৬ নং,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইবনে আবী শাইবা)
(১১)
اَللّهُمَّ اجْعَلْ فِيْ قَلْبِيْ نُوْراً وَّ فِيْ لِسَانِيْ نُوْراً وَّفِيْ سَمْعِيْ نُوْراً وَّفِيْ بَصَرِيْ نُوْراً وَّ مِنْ فَوْقِيْ نُوْراً وَّمِنْ تَحْتِيْ نُوْراً وَّعَنْ يَّمِيْنِيْ نُوْراً وَّعَنْ شِمَالِيْ نُوْراً  وَّمِنْ بَيْنِ يَدَىَّ

نُوْراً وَّمِنْ خَلْفِيْ نُوْراً وَّاجْعَلْ فِيْ نَفْسِيْ نُوْراً وَّأَعْظِمْ لِيْ نُوْراً।
উচ্চারণ:- আল্লা-হুম্মাজ্‌আল ফী ক্বালবী নূরাঁউঅফী লিসা-নী নূরাঁউঅফী সাময়ী নূরাঁউঁ অফী বাস্বারী নূরাঁউঅমিন ফাউক্বী নূরাঁউঅমিন তাহ্‌তী নূরাঁউঅ আঁই য়্যামীনী নূরাঁউঅ আন শিমা-লী নূরাঁউঅমিন বাইনি য়্যাদাইয়্যা নূরাঁউঅমিন খালফী নূরাঁউঅজ্‌আল ফী নাফসী নূরাঁউঅ আ’যিম লী নূরা।
অর্থ- হে আল্লাহ! আমার হৃদয় ও রসনায় কর্ণ ও চক্ষুতে, ঊর্ধ্বে ও নিম্নে, ডাইনে ও বামে, সম্মুখে ও পশ্চাতে  জ্যোতি প্রদান কর। আমার আত্মায় জ্যোতি দাও এবং  আমাকে অধিক অধিক নূর দান কর। (মুসলিম, সহীহ ৭৬৩, সহিহ,নাসাঈ, সুনান ১০৭৩ নং, আআহমাদ, মুসনাদ, ইবনে আবী শাইবা)
(১২)
اَللّهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِرِضَاكَ مِنْ سَخَطِكَ وَبِمُعَافَاتِكَ مِنْ عُقُوْبَتِكَ وَ أَعُوْذُ بِكَ مِنْكَ لاَ أُحْصِيْ ثَنَاءً عَلَيْكَ أَنْتَ كَمَا أَثْنَيْتَ عَلى نَفْسِكَ।
উচ্চারণ- আল্লা-হুম্মা ইন্নী আঊযু বিরিযা-কা মিন সাখাত্বিক, অবিমুআফা-তিকা মিন উক্বূবাতিক, অ আঊযু বিকা মিন্‌কা লা উহস্বী ষানা-আন আলাইকা আন্তা কামা আষনাইতা আলা নাফসিক।
অর্থ- হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি তোমার সন্তুষ্টির অসীলায় তোমার ক্রোধ থেকে, তোমার ক্ষমাশীলতার অসীলায় তোমার শাস্তি থেকে এবং তোমার সত্তার অসীলায় তোমার আযাব থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমি তোমার উপর তোমার প্রশংসা গুনে শেষ করতে পারি না, যেমন তুমি নিজের প্রশংসা নিজে করেছ। (মুসলিম,  ইবনে আবী শাইবা, সহিহ,নাসাঈ, সুনান ১০৫৩, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ৩৮৪১ নং)

রুকূ ও সিজদাতে কুরআন পাঠ করতে মহানবী (সাঃ) নিষেধ করতেন এবং সিজদাতে অধিকাধিক দুআ করতে আদেশ করতেন। আর এ কথা রুকূর বর্ণনায় আলোচিত হয়েছে। তিনি আরো বলতেন, “সিজদাহ অবস্থায় বান্দা আপন প্রভুর সবচেয়ে অধিক নিকটতম হয়ে থাকে। সুতরাং ঐ অবস্থায় তোমরা বেশী-বেশী করে দুআ কর।” (মুসলিম, সহীহ ৪৮২, আআহমাদ, মুসনাদ, বায়হাকী, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৪৫৬নং)

উল্লেখ্য যে, সিজদায় প্রার্থনামূলক দুআ করার জন্য ৪, ৬, ১০, ১১ ও ১২নং যিক্‌র পঠনীয়। এ ছাড়া কুরআনী দুআ বা অন্য কোন সহীহ হাদীসের দুআ পাঠ করা দূষণীয় নয়। যেমন সিজদায় কুরআন পাঠ নিষিদ্ধ হলেও দুআ হিসাবে কোন কুরআনী আয়াত দ্বারা প্রার্থনা করা নিষেধের আওতাভুক্ত নয়।(আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/১৮৪-১৮৫)

দীর্ঘ সিজদাহ

মহানবী (সাঃ) এর সিজদা প্রায় রুকূর সমান লম্বা হত। অবশ্য কখনো কখনো কোন কারণে তাঁর সিজদাহ সাময়িক দীর্ঘও হত। শাদ্দাদ (রাঃ) বলেন, একদা যোহ্‌র অথবা আসরের নামায পড়ার উদ্দেশ্যে তিনি আমাদের মাঝে বের হলেন। তাঁর কোলে ছিল হাসান অথবা হুসাইন। তিনি সামনে গিয়ে তাকে নিজের ডান পায়ের কাছে রাখলেন। অতঃপর তিনি তকবীর দিয়ে নামায শুরু করলেন। নামায পড়তে পড়তে তিনি একটি সিজদাহ (অস্বাভাবিক) লম্বা করলেন। (ব্যাপার না বুঝে) আমি লোকের মাঝে মাথা তুলে ফেললাম। দেখলাম, তিনি সিজদাহ অবস্থায় আছেন, আর তাঁর পিঠে শিশুটি চড়ে বসে আছে! অতঃপর পুনরায় আমি সিজদায় ফিরে গেলাম। আল্লাহর রসূল (সাঃ) নামায শেষ করলে লোকেরা তাঁকে বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! আপনি নামায পড়তে পড়তে একটি সিজদাহ (অধিক) লম্বা করলেন। এর ফলে আমরা ধারণা করলাম যে, কিছু হয়তো ঘটল অথবা আপনার উপর ওহী অবতীর্ণ হ্‌চ্ছে।’

তিনি বললেন, “এ সবের কোনটাই নয়। আসলে (ব্যাপার হল), আমার বেটা (নাতি) আমাকে সওয়ারী বানিয়ে নিয়েছিল। তাই তার মন ভরে না দেওয়া পর্যন্ত (উঠার জন্য) তাড়াতাড়ি করাটাকে আমি অপছন্দ করলাম।” (সহিহ,নাসাঈ, সুনান ১০৯৩ নং, ইবনে আসাকির, হাকেম, মুস্তাদরাক)

ইবনে মসঊদ (রাঃ) বলেন, তিনি নামায পড়তেন, আর সিজদাহ অবস্থায় হাসান ও হুসাইন তাঁর পিঠে চড়ে বসত। লোকেরা তাদেরকে এমন করতে মানা করলে তিনি ইশারায় বলতেন, “ওদেরকে (নিজের অবস্থায়) ছেড়ে দাও।” অতঃপর নামায শেষ করলে তাদের উভয়কে কোলে বসিয়ে বলতেন, “যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসে, সে যেন এদেরকে ভালোবাসে।” (ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ ৮৮৭নং, বায়হাকী ২/২৬৩)

প্রকাশ থাকে যে, অকারণে একটি ছেড়ে অন্য সিজদাহটিকে লম্বা করা বিধেয় নয়। তাই শেষ সিজদাহকে লম্বা করা বিদআত। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্‌, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৮৫)

সিজদার মাহাত্ম

মা’দান বিন আবী তালহা হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আল্লাহর  রসূলের স্বা ধী নকৃত (মুক্ত) দাস সওবান (রাঃ) এর সাথে সাক্ষাৎ করে বললাম,  আমাকে এমন একটি আমলের কথা বলে দিন যা করলে আমি জান্নাত প্রবেশ করতে পারব, (অথবা বললেন, আমি বললাম, আল্লাহর নিকট সর্বাপেক্ষা প্রিয় আমলের কথা বলে দিন।) কিন্তু উত্তর না দিয়ে তিনি চুপ থাকলেন। পুনরায় আমি একই আবেদন রাখলাম। তবুও তিনি নীরব থাকলেন। আমি তৃতীয়বার আবেদন পুনরাবৃত্তি করলাম। এবারে তিনি বললেন, এ ব্যাপারে আমি আল্লাহর রসূল (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করেছি। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “তুমি আল্লাহর জন্য অধিকাধিক সিজদা করাকে অভ্যাস বানিয়ে নাও; কারণ যখনই তুমি আল্লাহর জন্য একটি  সিজদা করবে তখনই আল্লাহ তার বিনিময়ে তোমাকে এক মর্যাদায় উন্নীত করবেন এবং  তার দরুন একটি গুনাহ মোচন করবেন।” (মুসলিম ৪৮৮নং তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ্‌)

 আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, “প্রত্যেক বান্দাই, যখন সে আল্লাহর জন্য একটি সিজদা করে তখনই তার বিনিময়ে আল্লাহ তার জন্য একটি সওয়াব লিপিবদ্ধ করেন, তার একটি গুনাহ ক্ষালন করে দেন এবং তাকে একটি মর্যাদায় উন্নীত করেন। অতএব তোমরা বেশী বেশী করে সিজদা কর।” (ইবনে মাজাহ্‌, সহীহ তারগীব ৩৭৯নং)

রবীআহ্‌ বিন কা’ব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর সাথে রাত্রিবাস করতাম এবং তাঁর ওযুর পানি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসহাজির করে দিতাম। একদা তিনি আমাকে বললেন, “তুমি আমার নিকট কিছু চাও।” আমি বললাম, ‘আমি জান্নাতে আপনার সংসর্গ চাই।’ তিনি বললেন, “এছাড়া আর কিছু?” আমি বললাম, ‘ওটাই (আমার বাসনা)।’ তিনি বললেন, “তাহলে অধিক অধিক সিজদা করে (নফল নামায পড়ে) এ ব্যাপারে আমার সহায়তা কর।” (মুসলিম ৪৮৯ নং, আবু দাঊদ, প্রমুখ)

উম্মতে মুহাম্মাদীর মুখমন্ডল সিজদাহ ও ওযুর ফলে কিয়ামতের দিন জ্যোতির্ময় ও উজ্জ্বল হবে। (আহমাদ, মুসনাদ ৪/১৮৯, তিরমিযী, সুনান)

“আল্লাহ তাআলা যখন জাহান্নামবাসীদের মধ্য হতে যাকে ইচ্ছা দয়া প্রদর্শনের ইচ্ছা করবেন, তখন ফিরিশ্‌তাদেরকে আদেশ করবেন যে, ‘যারা একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করত তাদেরকে দোযখ থেকে বের কর।’ ফিরিশ্‌তাবর্গ সেই ইবাদতকারী ব্যক্তিবর্গকে বের করবেন। তাঁরা তাদের (কপালে) সিজদার চিহ্ন দেখে চিনতে পারবেন। কারণ, আল্লাহ দোযখের জন্য সিজদার চিহ্ন খাওয়াকে (জ্বালানোকে) হারাম করে দিয়েছেন। ফলে ঐ সকল লোককে দোযখ থেকে বের করা (ও নিষ্কৃতি দেওয়া) হবে। সুতরাং আদম-সন্তানের প্রত্যেক অঙ্গ দোযখ খেয়ে (জ্বালিয়ে) ফেলবে, কিন্তু সিজদার চিহ্নিত অঙ্গ খাবে না।” (বুখারী ৮০৬, মুসলিম, সহীহ ১৮২নং)

মাটি, কাপড় ও চাটাই-এর উপর সিজদাহ

নবী মুবাশ্‌শির (সাঃ) অধিকাংশ মাটির উপরই সিজদাহ করতেন। কারণ, তাঁর মসজিদের মেঝেই ছিল মাটির। না ছিল তা পলস্তরা করা। আর না ছিল চাটাই, চট বা গালিচা বিছানো। ঐ মসজিদের ছাদও ছিল খেজুর ডালের। বৃষ্টির সময় কখনো কখনো ছাদ বেয়ে মসজিদের ভিতরে পানি পড়ত। এক রমযানের ২১ তারীখের রাতে তিনি পানি ও কাদাতেই সিজদাহ করেছিলেন। আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর কপাল ও নাকে পানি ও কাদার চিহ্ন আমার উভয় চক্ষু প্রত্যক্ষ করেছে।’ (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ২০৮৬ নং)

পক্ষান্তরে তিনি কখনো কখনো চাটাই-এর উপরেও নামায পড়েছেন, কখনো সিজদাহ করেছেন (সিজদার জন্য চেহারা রাখার মত) ছোট চাটাই-এর উপর। (বুখারী ৩৮০, ৩৮১নং, মুসলিম, সহীহ)

সাহাবাগণ রসূল (সাঃ) এর সাথে প্রচন্ড গরমে নামায পড়েছেন। সিজদার স্থান গরম থাকায় কপাল-নাক রাখতে না পারলে তাঁরা নিজের কাপড় সিজদার জায়গায় বিছিয়ে নিয়ে তার উপর সিজদাহ করতেন। (বুখারী ৩৮৫নং, মুসলিম, সহীহ)

হাসান বাসরী (রহঃ) বলেন, সাহাবাগণ পাগড়ী ও টুপীর উপর (কপালে রেখে) এবং হাত দু’টিকে আস্তিনের ভিতরে রেখে সিজদাহ করতেন। (বুখারী, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ১/৫৮৭)

বলাই বাহুল্য যে, কতক ‘দরবেশ-পন্থী’দের উক্তি ‘শয়তানের সিজদার জায়গায় সিজদাহ করতে নেই। সে আসমানে-জমীনে সিজদাহ করে তিল বরাবরও স্থান বাকী রাখেনি। অতএব মাটিতে সিজদাহ বৈধ নয়---’ ভিত্তিহীন এবং নামাযের প্রতি বিতৃষ্ণা ও অনীহার বড় দলীল। মুসলিম এমন কথায় ধোকা খায় না।

সিজদাহ থেকে মাথা তোলা

অতঃপর (সিজদার পর) নবী মুবাশ্‌শির (সাঃ) ‘আল্লাহু আকবার’ বলে তকবীর দিয়ে সিজদাহ থেকে মাথা তুলতেন। এ ব্যাপারে তিনি নামায ভুলকারী সাহাবীকে আদেশ করে বলেছেন, “কোন ব্যক্তির নামায ততক্ষণ পর্যন্ত সম্পূর্ণ হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না --- সিজদাহ করেছে ও তাতে তার সমস্তহাড়ের জোড় স্থির হয়েছে। অতঃপর ‘আল্লাহু আকবার’ বলে মাথা তুলে সোজা বসে গেছে।” (আবূদাঊদ, সুনান ৮৫৭ নং,হাকেম, মুস্তাদরাক)

এই তকবীরের সাথেও তিনি কখনো কখনো ‘রফ্‌য়ে ইয়াদাইন’ করতেন। (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ৭৪০নং, সহিহ,নাসাঈ, সুনান ১০৪১, ১০৯৫ নং) অর্থাৎ তিনি প্রত্যেক নামাযে বা সর্বদা এই সময়ে বা বসা অবস্থায় হাত তুলতেন না। কারণ, আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ) বলেন, ‘নবী (সাঃ) সিজদার সময় বা বসা অবস্থায় হাত তুলতেন না।’ (বুখারী, মুসলিম,  প্রমুখ, মিশকাত ৭৯৩নং) অনুরুপ বলেন হযরত আলী (রাঃ) ও। (আবূদাঊদ, সুনান ৭৬১নং)

মাথা তোলার পর তিনি তাঁর বাম পা-কে বিছিয়ে দিতেন ও তার উপর স্থির হয়ে বসে যেতেন। (বুখারী, মুসলিম, সহীহ ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩১৬নং) পরন্তু তিনি নামায ভুলকারী সাহাবীকেও উক্ত আমল করার আদেশ দিয়ে বলেছিলেন, “যখন তুমি সিজদাহ থেকে মাথা তুলবে, তখন তোমার বাম ঊরুর উপর বসবে।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ৮৫৯ নং)

এরপর ডান পায়ের পাতাকে তিনি খাড়া রাখতেন। (বুখারী, বায়হাকী, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৫১পৃ:) আর এই পায়ের আঙ্গুল গুলোকে কেবলামুখী করে রাখতেন। (সহিহ,নাসাঈ, সুনান ১১০৯ নং)

কখনো কখনো তিনি এই বৈঠকে দুই পায়ের পাতাকে খাড়া রেখে পায়ের দুই গোড়ালির উপর বসতেন। এই প্রকার বৈঠক প্রসঙ্গে ইবনে আব্বাস (রাঃ) কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, ‘এরুপ বসা সুন্নত।’ ত্বাঊস বলেন, আমরা তাঁকে বললাম, ‘আমরা তো এটা নামাযীর জন্য কষ্টকর মনে করি।’ কিন্তু তিনি উত্তর দিলেন, ‘পরন্তু এটা তোমার নবী (সাঃ) এর সুন্নত (তরীকা)।’ (মুসলিম, সহীহ ৫৩৬নং, আআহমাদ, মুসনাদ, আবুশ শায়খ, আবূদাঊদ, সুনান ৮৪৫ নং, তিরমিযী, সুনান, বায়হাকী)

দুই সিজদার মাঝের বৈঠকে স্থিরতার গুরুত্ব

দুই সিজদার মাঝে এই বৈঠকে আল্লাহর নবী (সাঃ) স্থির হয়ে বসে যেতেন এবং এতে তাঁর প্রত্যেক হাড় নিজের জায়গায় ফিরে যেত। (আবূদাঊদ, সুনান ৭৩৪ নং, বায়হাকী) তিনি নামায ভুলকারী সাহাবীকেও উক্তরুপে বসার আদেশ দিয়ে বলেছিলেন, “এভাবে সোজা ও স্থির হয়ে না বসলে কারো নামায সম্পূর্ণ হবে না।” (আবূদাঊদ, সুনান ৮৫৭,হাকেম, মুস্তাদরাক)

এই বৈঠকে তিনি প্রায় ততটা সময় বসতেন, যতটা সময় ধরে তিনি সিজদাহ করতেন। (বুখারী ৭৯২, মুসলিম, সহীহ) কখনো কখনো এত লম্বা বসতেন যে, সাহাবীগণ মনে করতেন, হয়তো তিনি (দ্বিতীয় সিজদাহ করতে) ভুলেই গেছেন। (বুখারী ৮২১ নং, মুসলিম, সহীহ)

দুই সিজদার মাঝে বৈঠকের দুআ

اَللّهُمَّ اغْفِرْلِيْ وَارْحَمْنِيْ (وَاجْبُرْنِيْ وَارْفَعْنِيْ) وَاهْدِنِيْ وَعَافِنِيْ وَارْزُقْنِيْ।
 উচ্চারণ:- আল্লা-হুম্মাগফিরলী অরহামনী (অজবুরনী অরফা’নী) অহ্‌দিনী অ আ-ফিনী অরযুক্বনী।

 অর্থ- হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা কর, দয়া কর, (আমার প্রয়োজন মিটাও, আমাকে উঁচু কর), পথ দেখাও, নিরাপত্তা দাও এবং জীবিকা দান কর। (আবূদাঊদ, সুনান ৮৫০, তিরমিযী, সুনান ২৮৪, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ৮৯৮নং,হাকেম, মুস্তাদরাক)

কোন কোন বর্ণনায় উক্ত দুআর শুরুতে ‘আল্লাহুম্মা’র পরিবর্তে ‘রাব্বি ‘ ব্যবহার হয়েছে। (ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ৮৯৮ নং)

رَبِّ اغْفِرْ  لِيْ، رَبِّ اغْفِرْ لِيْ  (রাব্বিগফিরলী, রাব্বিগফিরলী)
অর্থ- হে আমার প্রভু! আমাকে ক্ষমা কর, হে আমার প্রভু! আমাকে ক্ষমা কর। (আবূদাঊদ, সুনান ৮৭৪, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ৮৯৭নং)

উক্ত দুআ তিনি তাহাজ্জুদের নামাযে পড়তেন। অবশ্য ফরয নামাযেও পড়া চলে। কারণ, পার্থক্যের কোন দলীল নেই। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৫৩পৃ:)

প্রকাশ থাকে যে, এই বৈঠকে আঙ্গুল ইশারা করার হাদীস সহীহ নয়। (মুখালাফাত ফিত্বাহারাতি অসস্বালাহ্‌ ৮২পৃ:)

দ্বিতীয় সিজদাহ

অতঃপর ‘আল্লাহু আকবার’ বলে তকবীর দিয়ে তিনি দ্বিতীয় সিজদাহ করতেন। এ বিষয়ে তিনি নামায ভুলকারী সাহাবীকে আদেশ দিয়েও বলেছিলেন, “--- অতঃপর তুমি ‘আল্লাহু আকবার’ বলবে। অতঃপর এমন সিজদাহ করবে, যাতে তোমার সমস্ত হাড়ের জোড়গুলো (নিজের জায়গায়) স্থির হয়ে যায়।” (আবূদাঊদ, সুনান ৮৫৭ নং,হাকেম, মুস্তাদরাক)

এই তকবীরের সাথেও তিনি কখনো কখনোহাত তুলতেন। (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ৭৩৯নং)

এই সিজদায় তিনি তাই করতেন, যা প্রথম সিজদায় করতেন। অতঃপর তিনি তকবীর দিয়ে সিজদাহ থেকে মাথা তুলতেন। এ ব্যাপারে তিনি নামায ভুলকারী সাহাবীকে আদেশ দিয়েও বলেছিলেন, “--- অতঃপর তুমি এইরুপ প্রত্যেক রুকূ ও সিজদায় করবে। এইরুপ করলেই তোমার নামায সম্পূর্ণ হবে। অন্যথা যদি এ সবের কিছু তুমি কম কর, তাহলে সেই পরিমাণে তোমার নামাযও অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।” (আহমাদ, মুসনাদ, তিরমিযী, সুনান ৩০২, আবূদাঊদ, সুনান ৮৫৬নং)

এই তকবীরের সাথেও তিনি কখনো কখনো ‘রফ্‌য়ে ইয়াদাইন’ করতেন। (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ৭৩৯নং)

জালসা-এ ইস্তিরাহাহ্‌

দ্বিতীয় সিজদাহ্‌ থেকে মাথা তুলে নবী মুবাশ্‌শির (সাঃ) পুনরায় বাম পায়ের উপর সোজা হয়ে বসে যেতেন। এতে তাঁর প্রত্যেক হাড় নিজ নিজ জায়গায় ফিরে যেত। (বুখারী ৬৭৭, ৮২৩, আবূদাঊদ, সুনান ৭৩০, ৮৪২-৮৪৪, আহমাদ, মুসনাদ, তিরমিযী, সুনান নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ৭৯৬ নং)

এই বৈঠককে ‘জালসা-এ ইস্তিরাহাহ্‌’ আরামের বৈঠক বলা হয়। কারণ, এতে প্রথম ও তৃতীয় রাক্‌আত শেষ করে দ্বিতীয় ও চতুর্থ রাক্‌আত শুরু করার পূর্বে একটু আরাম নেওয়া হয় তাই।

মালেক বিন হুয়াইরিস (রাঃ) মহানবী (সাঃ) কে দেখেছেন, তিনি যখন তাঁর নামাযের বিজোড় রাকআতে থাকতেন, তখন সোজা বসে না যাওয়া পর্যন্ত (পরের রাকআতের জন্য) উঠে দাঁড়াতেন না। (ঐ) অনুরুপ দেখেছেন আবূ হুমাইদ ও আরো ১০ জন সাহাবা। (ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩০৫নং, তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ২১১-২১২পৃ:)

অবশ্য সুন্নতের এই বৈঠকটি দুই সিজদার মাঝের বৈঠকের মত লম্বা হবে না। কেবল সোজা হওয়ার মত হাল্কা একটু বসতে হবে। তবে এতে পঠনীয় কোন যিক্‌র বা দুআ নেই।

দ্বিতীয় রাকআত

অতঃপর নবী মুবাশ্‌শির (সাঃ) মাটির উপর (দুই হাতের চেটোতে) ভর করে দ্বিতীয় রাকআতের জন্য উঠে খাড়া হতেন। (শাফেয়ী, বুখারী ৮২৪নং) এক্ষণে তিনি হাত দু’টিকে খমীর সানার মত মাটিতে রাখতেন। (আবূ ইসহাক হারবী, বায়হাকী, তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ১৯৬পৃ:) আরযাক বিন কইস বলেন, আমি দেখেছি, ইবনে উমার নামাযে যখন (পরবর্তী রাকআতের) জন্য উঠতেন, তখন মাটির উপর (হাতের) ভর দিয়ে উঠতেন। (ত্বাবারানী, মু’জাম আউসাত্ব, তামামুল মিন্নাহ্‌, আলবানী ২০১পৃ:)

ইমাম ইসহাক বিন রাহুয়াইহ্‌ বলেন, ‘নবী (সাঃ) হতে এই সুন্নাহ্‌ প্রচলিত হয়ে আসছে যে, বৃদ্ধ, যুবক প্রত্যেকেই নামাযের মধ্যে ওঠার সময় দুইহাতের উপর ভর করে উঠবে। (ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ২/৮২-৮৩, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৫৫পৃ:)

পক্ষান্তরে যাঁরা ওয়াইল বিন হুজরের হাতের পূর্বে হাঁটু রাখার হাদীসকেও হাসান মনে করেন তাঁরা বলেন, নামাযীর জন্য আসান হলে ঊরুর উপর হাত রেখে উঠে দাঁড়াবে। নচেৎ কষ্ট হলে মাটির উপর হাত রেখে উঠবে। (উদ্দাহ্‌ ৯৬পৃ:, ইবনে বায, মাজমূআতু রাসাইল ফিস স্বালাহ্‌ ১২৭পৃ:, ইবনে উসাইমীন, রিসালাতুন ফী সিফাতি স্বালাতিন্নাবী (সাঃ) ১১পৃ:, আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/১৯০-১৯১)

দ্বিতীয় রাকআতের জন্য উঠে মহানবী (সাঃ) চুপ না থেকে (বিসমিল্লাহির রাহ্‌মানির রাহীম বলে) সূরা ফাতিহা পাঠ করতেন। (মুসলিম, সহীহ ৫৯৯ নং, আহমাদ, মুসনাদ) শুরুতে ‘আঊযু বিল্লাহ্‌---’ও পড়া যায়। না পড়লেও ধর্তব্য নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/১৯৬)

সূরা ফাতিহা প্রত্যেক রাকআতে পাঠ করা ওয়াজেব। কারণ, তিনি নামায ভুলকারী সাহাবীকে প্রথম রাকআতে সূরা ফাতিহা পড়তে আদেশ করার পর বলেছিলেন, “--- অতঃপর এইরুপ তুমি প্রত্যেক রাকআতে বা তোমার পূর্ণ নামাযে কর।” (বুখারী, মুসলিম,  আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান)

তাঁর অন্যান্য কর্মও প্রথম রাকআতের অনুরুপ হত। তবে প্রথম রাকআতের তুলনায় দ্বিতীয় রাকআতটি সংক্ষেপ ও ছোট হত। (বুখারী, মুসলিম,  মিশকাত ৮২৮নং)

তাশাহহুদের বৈঠক

দ্বিতীয় রাকআতের সকল কর্ম (শেষ সিজদাহ) শেষ করে মহানবী (সাঃ) দুই সিজদার মাঝের বৈঠকের মত বাম পা বিছিয়ে তার উপর বসে যেতেন এবং ডান পায়ের পাতাকে খাড়া করে রাখতেন। (বুখারী, আবূদাঊদ, সুনান ৭৩১নং)

তাশাহহুদের জন্য বসতে আদেশ দিয়ে নামায ভুলকারী সাহাবীকে তিনি বলেছেন, “--- অতঃপর তুমি যখন নামাযের মাঝে বসবে, তখন স্থির হবে এবং বাম ঊরুকে বিছিয়ে দিয়ে তাশাহহুদ পড়বে।” (আবূদাঊদ, সুনান ৮৬০ নং, বায়হাকী)

আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, আমার দোস্ত (সাঃ) আমাকে কুকুরের মত (দুই পায়ের রলাকে খাড়া রেখে, দুই পাছার উপর ভর করে ওহাত দু’টিকে মাটিতে রেখে) বসতে নিষেধ করেছেন। (আহমাদ, মুসনাদ ২/২৬৫, ত্বায়ালিসী, ইবনে আবী শাইবা) উক্ত প্রকার বসাকে তিনি শয়তানের বৈঠক বলে অভিহিত করেছেন। (মুসলিম, সহীহ ৪৯৮নং, আহমাদ, মুসনাদ)

তাশাহ্‌হুদে বসে তিনি ডানহাতের চেটোকে ডান ঊরু (জাং) বা হাঁটুর উপর রাখতেন, আর বামহাতের চেটোকে রাখতেন বাম জাং বা হাঁটুর উপর বিছিয়ে। (মুসলিম, সহীহ ৫৮০নং, আহমাদ, মুসনাদ) ডানহাতের কনুই-এর শেষ প্রান্ত ডান জাং-এর উপর রাখতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৯৫৭নং, নাসাঈ, সুনান) অর্থাৎ কনুইকে পায়ের রলার উপর না রেখে ঊরুর উপর পাঁজরে লাগিয়ে রাখতেন।

এক ব্যক্তি নামাযে বাম হাতের উপর মাটিতে ঠেস দিয়ে বসলে তিনি তাঁকে বারণ করে বলেছিলেন, “এরুপ হল ইয়াহুদীদের নামায।” (বায়হাকী,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩৮০নং) “এরুপ বসো না। কারণ, এটা তো তাদের বৈঠক, যাদেরকে আযাব দেওয়া হবে।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩৮০নং) “এটা হল তাদের বৈঠক, যাদের প্রতি আল্লাহ ক্রোধান্বিত।” (আবূদাঊদ, সুনান ৯৯৩ নং, আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ)

তাশাহহুদের বৈঠকে তর্জনীর ইশারা

তিনি বাম হাতের চেটোকে বাম হাঁটুর উপর বিছিয়ে দিতেন। কখনো বাম হাঁটুকে বামহাতের লোকমা বা গ্রাস বানাতেন। ডান হাতের (তর্জনী ছাড়া) সমস্ত আঙ্গুলগুলোকে বন্ধ করে নিতেন। আর তর্জনী (শাহাদতের) আঙ্গুল দ্বারা কেবলার দিকে ইশারা করতেন এবং তার উপরেই নিজ দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতেন। (মুসলিম, সহীহ ৫৭৯, ৫৮০নং, আহমাদ, মুসনাদ, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ) কখনো বা ইশারার সময় তিনি তাঁর বুড়ো আঙ্গুলকে মাঝের আঙ্গুলের উপর রাখতেন। (মুসলিম, সহীহ ৫৭৯নং, আহমাদ, মুসনাদ) আর উক্ত উভয় আঙ্গুলকে মিলিয়ে গোল বালার মত গোলাকার করে রাখতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৯৫৭নং, নাসাঈ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্‌, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ প্রভৃতি)

কখনো বা (আরবীয়) আঙ্গুল গণনার হিসাবের ৫৩ গোনার মত করে রাখতেন। অর্থাৎ, কনিষ্ঠা, অনামিকা ও মধ্যমাকে চেটোর সাথে লাগিয়ে তর্জনীকে লম্বা ছেড়ে এবং বৃদ্ধার মাথাকে তর্জনীর গোড়াতে লাগিয়ে রাখতেন। (মুসলিম, সহীহ ৫৮০, মিশকাত ৯০৬নং)

তিনি তর্জনীকে তুলে হিলিয়ে হিলিয়ে এর মাধ্যমে দুআ করতেন। (সহিহ,নাসাঈ, সুনান ৮৫৬, ১২০৩ নং, দারেমী, সুনান, আহমাদ, মুসনাদ ৪/৩১৮, ৫/৭২) সুতরাং দুআ শেষ না করা (সালাম ফিরার পূর্ব) পর্যন্ত তর্জনী হিলানো সুন্নত। যেহেতু দুআ সালাম ফিরার পূর্বেই শেষ হয়ে থাকে। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৫৮-১৫৯ পৃ:)

তিনি বলতেন, “অবশ্যই ঐ তর্জনী শয়তানের পক্ষে লোহা অপেক্ষা অধিক কষ্টদায়ক (খোঁচার দন্ড)। (আহমাদ, মুসনাদ ২/১১৯, বাযযার, মাক্বদিসী, বায়হাকী, প্রমুখ)

ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, ‘ঐ আঙ্গুলটি শয়তানের জন্য আঘাত-দন্ড। যে এইভাবে ইশারা করে, সে (নামাযে) উদাসীন হয় না।’

হুমাইদী বলেন, মুসলিম বিন আবী মারয়্যামের নিকট এক ব্যক্তি বর্ণনা করেছে যে, সে শামের এক গির্জায় নামাযরত অবস্থায় কিছু নবীর ছবি দেখেছে; তাঁদের তর্জনী আঙ্গুলটি ঐরুপ ইশারা করা অবস্থায় ছিল। (মুসনাদে হুমাইদী, আবূ য়্যা’লা, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৫৮পৃ:)

 তিনি তর্জনী দ্বারা এই ইশারা ও হ্‌রকত প্রত্যেক তাশাহ্‌হুদে করতেন। তবে ঠিক কোন্‌ সময়ে হ্‌রকত করতেন বা হিলাতেন, সে বিষয়ে কোন বর্ণনা নেই। সুতরাং যেখানেই দুআ (প্রার্থনার) অর্থ পাওয়া যাবে সেখানেই তর্জনী হিলানো সুন্নত। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন ৩/২০২)  আর দুআর অর্থ না থাকলেও একটানা ক্রমাগত হিলিয়ে যাওয়া বিধেয় নয়।

তর্জনীর একটি মাত্র আঙ্গুল হিলিয়েই দুআ করা বিধেয়। মহানবী (সাঃ) এক ব্যক্তিকে দেখলেন, সে দুই আঙ্গুল হিলিয়ে দুআ করছে। তিনি তাকে বললেন, “একটি আঙ্গুল হিলাও, একটি আঙ্গুল হিলাও।” আর এই সঙ্গে তিনি তর্জনীর প্রতি ইঙ্গিত করলেন। (ইবনে আবী শাইবা, নাসাঈ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, বায়হাকী,হাকেম, মুস্তাদরাক, মিশকাত ৯১৩নং)

তাশাহহুদের গুরুত্ব

নবী মুবাশ্‌শির (সাঃ) প্রত্যেক দুই রাকআতে ‘তাহিয়্যাহ্‌’ (তাশাহহুদ) পাঠ করতেন। (মুসলিম, সহীহ ৪৯৮, আহমাদ, মুসনাদ) বৈঠকের শুরুতেই তিনি বলতেন, “আত্‌ তাহিয়্যা-তু লিল্লা-হি---।” (বায়হাকী, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (সাঃ), আলবানী ১৬০পৃ:) দুই রাকআত পড়ে ‘তাশাহহুদ’ পাঠ করতে ভুলে গেলে তিনি তার জন্য ভুলের সিজদাহ করতেন। (বুখারী, মুসলিম,  ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩৩৮ নং)

তিনি তাশাহহুদ পড়তে আদেশও করতেন। বলতেন, “যখন তোমরা প্রত্যেক দুই রাকআতে বসবে তখন ‘আত্‌তাহিয়্যাতু---’ বল। অতঃপর তোমাদের প্রত্যেকের পছন্দমত দুআ বেছে নিয়ে আল্লাহ আযযা অজাল্লার নিকট প্রার্থনা করা উচিৎ।” (সহিহ,নাসাঈ, সুনান ১১১৪ নং, আহমাদ, মুসনাদ, ত্বাবারানীরানী, মু’জাম কাবীর) এই তাশাহহুদ পড়তে তিনি নামায ভুলকারী সাহাবীকেও আদেশ করেছিলেন।

তাছাড়া তিনি সাহাবাগণকে ‘তাশাহহুদ’ শিখাতেন, যেমন কুরআনের সূরা শিক্ষা দিতেন। (বুখারী, মুসলিম, সহীহ ৪০৩নং) তাশাহহুদ নিঃশব্দে পড়া সুন্নত। (আবূদাঊদ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, মিশকাত ৯১৮নং)

তাশাহহুদের দুআ

১। তিনি সাহাবাগণকে যে তাশাহহুদ শিখিয়েছিলেন তা কয়েক প্রকারের। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশী প্রসিদ্ধ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) ও ইবনে ইমার (রাঃ) এর তাশাহহুদ:-

اَلتَّحِيَّاتُ للهِ وَالصَّلَوَاتُ وَالطَّيِّبَاتُ، اَلسَّلاَمُ عَلَيْكَ أَيُّهَا النَّبِيُّ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُهُ، اَلسَّلاَمُ عَلَيْنَا وَعَلى عِبَادِ اللهِ الصَّالِحِيْنَ، أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّداً عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ।
 উচ্চারণ:- আত-তাহিয়্যা-তু লিল্লা-হি অস্বস্বালা-ওয়া-তু অত্বত্বাইয়্যিবা-তু, আসসালা-মু আলাইকা আইয়্যুহান নাবিয়্যু অরাহ্‌মাতুল্লা-হি অবারাকা-তুহ্‌, আসসালা-মু আলাইনা অ আলা ইবা-দিল্লা-হিস্ব স্বা-লিহীন, আশহাদু আল লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু অ আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু অরাসূলুহ্‌।

অর্থ- মৌখিক, শারীরিক ও আর্থিক যাবতীয় ইবাদত আল্লাহর নিমিত্তে। হে নবী! আপনার উপর সালাম, আল্লাহর রহ্‌মত ও তাঁর বর্কত বর্ষণ হোক। আমাদের উপর এবং আল্লাহর নেক বান্দাগণের উপর সালাম বর্ষণ হোক। আমি সাক্ষি দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই এবং আরো সাক্ষি দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর দাস ও প্রেরিত রসূল।

নামাযী যখন ‘আস্‌সালা-মু আলাইনা অআলা ইবা-দিল্লা-হিস স্বা-লিহীন’ বলে, তখন আকাশ ও পৃথিবীর সকল নেক বান্দার নিকট ঐ সালাম পৌঁছে থাকে। ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, নবী (সাঃ) এর জীবদ্দশায় আমরা এরুপ বলতাম। অতঃপর তাঁর ইন্তেকাল হলে আমরা বলতে লাগলাম, ‘আসসালা-মু আলান নাবিয়্যি---।’ (বুখারী, মুসলিম,  ইবনে আবী শাইবা, আবূ য়্যা’লা, সিরাজ, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩২১, মিশকাত ৯০৯নং)

২। ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর তাশাহহুদ:-

اَلتَّحِيَّاتُ الْمُبَارَكَاتُ الصَّلَوَاتُ الطَّيِّبَاتُ لله।।।।
আত্‌ তাহিয়্যা-তুল মুবা-রাকা-তুস স্বালাওয়া-তুত ত্বাইয়িবা-তু লিল্লা-হি---। (বাকী প্রথমোক্ত তাশাহহুদের অনুরুপ।) (মুসলিম, সহীহ ৪০৩, আহমাদ, মুসনাদ, শাফেয়ী, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ৯১০ নং) অবশ্য কোন কোন বর্ণনায় দ্বিতীয় শাহাদতে কেবল ‘অআশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্‌’ উল্লেখিত হয়েছে। (মিশকাত ৯১০নং)

৩। আবূ মূসা আশআরী (রাঃ) এর তাশাহহুদ:-

اَلتَّحِيَّاتُ الطَّيِّبَاتُ الصَّلَوَاتُ لله।।।।।
‘আত্‌ তাহিয়্যা-তুত ত্বাইয়িবা-তুস স্বালাওয়া-তু লিল্লা-হি--।’

বাকী প্রথমোক্ত তাশাহহুদের মতই। অবশ্য কোন কোন বর্ণনায় ‘আশহাদু আল লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু’র পর ‘অহ্‌দাহু লা শারীকা লাহু’ বাক্য বাড়তি আছে। (মুসলিম, সহীহ ৪০৪নং, আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান)

৪। উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) এর তাশাহহুদ। তিনি মিম্বরের উপর লোকদেরকে এই তাশাহহুদ শিক্ষা দিতেন:-

اَلتَّحِيَّاتُ للهِ الزَّاكِيَاتُ للهِ الطَّيِّبَاتُ للهِ، اَلسَّلاَمُ عَلَيْكَ।।।।
আত্‌ তাহিয়্যাতু লিল্লা-হিয যা-কিয়া-তু লিল্লা-হিত ত্বাইয়িবা-তু লিল্লা-হ্‌, আস্‌সালা-মু আলাইকা---।

বাকী প্রথমোক্ত তাশাহহুদের মত। (মালেক, মুঅত্তা ৩০০নং, বায়হাকী ২/১৪২)

৫। আয়েশা رضي الله عنها এর তাশাহহুদ:-

اَلتَّحِيَّاتُ الطَّيِّبَاتُ الصَّلَوَاتُ الزَّاكِيَاتُ للهِ، اَلسَّلاَمُ عَلَى النَّبِيِّ।।।।।
  ‘আত্‌ তাহিয়্যা-তুত ত্বাইয়িবা-তুস স্বালাওয়া-তুয যা-কিয়া-তু লিল্লা-হ্‌, আস্‌সালা-মু আলান্নাবিয়্যি---।’

বাকী প্রথমোক্ত তাশাহহুদের মত। (ইবনে আবী শাইবা, সিরাজ, বায়হাকী ২/১৪৪)

লেখক: শায়খ আব্দুল হামীদ আল ফাইযী আল-মাদানী
লিসান্স: মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদিআরব
(সৌদী আরবের আল-মাজমাআ অঞ্চলের দাওয়াত সেন্টারে কর্মরত দাওয়াত-কর্মী এবং বাংলা ভাষার প্রসিদ্ধ লেখক ও অনুবাদক।)
কৃতজ্ঞতায়ঃ https://preachingauthenticislaminbangla.blogspot.com

No comments:

Post a Comment

Download AsPDF

Print Friendly and PDFPrint Friendly and PDFPrint Friendly and PDF
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...