Monday 18 July 2016

জিহাদ, কিতাল ও খিলাফাহ ( পর্ব – ৪)


শায়খ মুজাম্মেল হক্ক।


প্রথম পর্বের লিংক –এখানে ক্লিক করুন


দ্বিতীয় পর্বের লিংক –এখানে ক্লিক করুন

তৃতীয় পর্বের লিংক –এখানে ক্লিক করুন

৫ম পর্বের লিঙ্ক- এখানে ক্লিক করুন
ষষ্ঠ পর্বের লিংক - এখানে ক্লিক করুন
জিহাদ নামের ফেতনাহ সফল হতে দেখা যায়না। কারণ কি তা আল্লাহ ভালো জানেন। আমরা সীমিত জ্ঞানে কিছুটা হলেও বুঝতে পারি। তবে মুসলমানের কপাল খারাপ হলে আল্লাহ যেকোন ফেতনাকে আজাব হিসেবে সফলতা বা দীর্ঘস্থায়ীতা দান করতে পারেন, এমনটি মোটেও অযৌক্তিক নয়। তাতে শাস্তির ভয়ে মুসলমান ভাল হয়ে যাওয়ার প্রতি অগ্রসর হতে পারে।
لِيُذِيقَهُمْ بَعْضَ الَّذِي عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ- الروم/41
“আমি তাদেরকে কিছু শাস্তি প্রদান করি এই জন্যে যে, হয়ত তারা কৃত কর্মের ভুল শুধরে নিয়ে ভালোর দিকে অগ্রসর হতে পারে।”
সুরা রুমঃ ৪১।
আমাদের জ্ঞান বলে এই ফেতনার জিহাদ সফল না হওয়ার পিছনে কারণগুলির মধ্যে যা বিশেষ ভাবে স্মরণীয় তা হলঃ
১. জিহাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ সঠিক হয়না।
২. কারণ যথার্থ থাকেনা।
৩. যথেষ্ট শক্তির যোগান থাকেনা।
৪. উপযুক্ত প্রস্তুতি ও উপযোগী কৌশল অবলম্বন করা হয়না।
৫. বাস্তবতার নিরিখে বিচার না করে আবেগকেই মূল ভিত্তি ও চালিকা হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
৬. আল্লাহর দ্বীন বিজয়ী করা উদ্দেশ্য না হয়ে, দুনিয়ার স্বার্থকেই সামনে রাখা হয় ইত্যাদি।
প্রতিশোধ মূলক সম্মুখ যুদ্ধের যথার্থ কারণ ও প্রস্তুতি থাকলেও আল্লাহ পাক সহসা জিহাদে না জড়িয়ে সবর করাকেই উত্তম বলে ঘোষণা করেছেন তা আগেই উল্লেখিত হয়েছে।
وإن عاقبتم فعاقبوا بمثل ما عوقبتم به ولئن صبرتم لهو خير للصابرين- النحل/126
“যদি তোমরা প্রতিশোধ নাও, তাহলে ততটুকই নেবে যতটুকু তারা তোমাদের ক্ষতি করেছে। তবে তোমরা যদি ধৈর্য ধরো তাহলে তা হবে ধৈর্য ধারণকারীদের জন্যে উত্তম।”
সুরা নাহলঃ ১২৬।
কুরআন-সুন্নাহ থেকে যেসব আয়াত ও হাদিস দলীল হিসাবে তারা ব্যবহার করেন মূলত তা তাদের এহেন হীন কাজের পক্ষে দলীল নয়। তাদের দলীল গুলোর দুয়েকটি এখানে উল্লখ করছিঃ
إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَىٰ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُم بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ-التوبة/111
“আল্লাহ ক্রয় করে নিয়েছেন মুসলমানদের জান ও মাল, বিনিময়ে তাদেরকে জান্নাত দেবেন। তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর পথে। অতঃপর তারা মারে ও মৃত্যুবরণ করে।’’
সুরা তাওবাহঃ ১১১।
আয়াতটিতে আল্লাহপাক اشْتَرَىٰ বলে এক ধরনের কেনা বেচার কথা বলেছেন। আমরা সকলেই জানি কেনা বেচা সঠিক হতে হলে, আইনানুগ হতে হলে বেচা কেনার প্রধান শর্ত গুলো পাওয়া যেতে হবে। সেগুলির মধ্যে উল্লেখ্য যোগ্য হলঃ
ক. বিক্রেতা ও ক্রেতা মার্কেট জানতে হবে।,
খ. উভয়ের কেউ জাহেল ও বোকা হলে হবেনা,
গ. জ্ঞান সম্পন্ন হতে হবে এবং
ঘ. কোন পক্ষ কোন পক্ষের দ্বারা প্ররোচিত হবেনা ইত্যাদি।
এ শর্ত গুলোর কোন একটির অবর্তমানে ঐ কেনা বেচা বৈধ হবেনা। আইনের কাছে তা বাতিল বলে গণ্য হবে। যে ব্যাবসার কথা আয়াতে বলা হয়েছে সে ব্যাবসাও গ্রহণযোগ্য হবেনা যদি ক্রেতা ও বিক্রেতা কারো মধ্যে কোন উল্লেখ যোগ্য সমস্যা থাকে। আল্লাহর সঙ্গে কেনা বেচার জন্যে মানসিক, দার্শনিক, সামাজিক, শারিরীক ও জ্ঞানগত বিচক্ষণতা ইত্যাদির দিক থেকে অবশ্যই ফিট হতে হবে। আমরা জানি পাগলের উপর তিনি নামাজ ফরজ করেন না। রুগীর উপর রোজা আবশ্যকীয় করেন না। এমনি ভাবে জিহাদের মত এত বড় ব্যবসার জন্যে যেসব শর্ত রয়েছে তা অবশ্যই পাওয়া যেতে হবে।
قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ- الأنعام/162
“আপনি বলুন, আমার নামাজ, আমার এবাদাত, আমার মরণ, আমার জীবন সবই বিশ্ব প্রভু আল্লাহর উদ্দেশ্যে।”
সুরা আন’আমঃ ১৬২।
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় প্রায় সকল মুফাসসিরগণ ইখলাস ও একনিষ্ঠতার দিকে ইংগিত করেছেন। তাদের মতে এর অর্থ হবে এই যে, জান মালের খরচ ও ইবাদাত সবই হবে একমাত্র আল্লাহর খুশী অর্জনের লক্ষে। মুসলমান বেঁচে থাকে বাচার জন্যে নয়, সে বেঁচে থাকে যাতে আল্লাহকে খুশী করার নিমিত্তে বেশী বেশী অবদান রাখতে।
قُلْ إِنْ كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُمْ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّىٰ يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ- التوبة/24
“আপনি বলুন, যদি তোমাদের পিতা-মাতা, ছেলে-মেয়ে, ভাইয়েরা, স্ত্রীরা, পরিবারের সদস্যরা, সহায়-সম্পদ, ব্যবসা বাণিজ্য যা নিয়ে উৎকণ্ঠায় থাকো, বসতবাড়ি যা পছন্দ করো তোমাদের নিকট আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের চেয়ে প্রিয় মনে হয়, তাহলে অপেক্ষা করো আল্লাহর পাকড়াও আসা পর্যন্ত।”
সুরা তাওবাহঃ ২৪।
আয়াতটি সাবধান বাণী উচ্চারণ করে কিন্তু কেন? এই জন্যে যে, আল্লাহর রাসূল (সঃ) আল্লাহর নির্দেশে যে জিহাদ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেই জিহাদে ধনসম্পদের ও জীবনের মহব্বতে পিছুপা হওয়া কোন মুমিনের জন্যেই উচিৎ নয়। আমদেরকে বুঝতে হবে রাসূল (সঃ) এর সিদ্ধান্তে যুদ্ধ এই জিহাদি মুফতিদের সিদ্ধান্তে যুদ্ধ কি কখনো এক হতে পারে?
وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّىٰ لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ- الأنفال/39
“তোমরা কিতাল (অস্ত্রের যুদ্ধ) করো তাদের বিরুদ্ধে যতক্ষন না ফেতনাহ নিপাত হয়ে যায়, যতক্ষণ না দ্বীন পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
সুরা আনফালঃ ৩৯।
এখানে هُمْ শব্দটি দ্বারা তাদেরকে বুঝানো হয়েছে যারা ইসলামের কারণে, ইসলামকে রুখতে যুদ্ধ করে বা শুরু করেছে। শুধু কারণ পাওয়া গেলেই হবেনা, অন্যান্য শর্তগুলী যা রয়েছে তা অবশ্যই হিসাবে নিতে হবে। ইতিঃপূর্বে সে সবের কথা বলা হয়েছে তাই পুনরায় ব্যক্ত করছিনা।
তারা বলে, এই আয়াতের মরমার্থ বুঝতে হলে জিহাদের ময়দানে নামতে হবে। দরবারি (তাদের ভাষায়) আলেমরা এসব আয়াতের অর্থ বুঝতে পারবেনা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সাইয়েদ ‪#‎কুতুব‬ তার তাফসীরে এমন কথা বলে গেছেন। তবে যুদ্ধে না গিয়েও কিভাবে তিনি এসব আয়াতের অর্থ বুঝলন, এমন প্রশনের উত্তর তিনি দিয়ে যাননি। তবে তার ঐ কথা এক শ্রেণীর যুবকের মুখে মুখে উচ্চারিত হতে দেখা যায়।
আসলে কেতালের সকল আয়াতের মাথায় ক্যাপ লগিয়ে দিয়েছে সুরা বাকারায় উল্লেখিত ১ম কেতাল সম্পর্কিত আয়াত সে কথা তারা দিব্যি ভুলে যান। যেখানে আল্লাহ বলেছেনঃ
وَقَاتِلُواْ فِي سَبِيلِ اللّهِ الّذِينَ يُقَاتِلُونَكُمْ وَلاَ تَعْتَدُوَاْإِنّ اللّهَ لاَ يُحِبّ الْمُعْتَدِينَ- البقرة/178
“তোমরা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করো ( যে যুদ্ধে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হয়), তাদের সাথে যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ শুরু করেছে। আর এতে কখনো যেন সীমা অতিক্রম করোনা। কেননা আল্লাহ সীমা অতিক্রম কারীদেরকে ভালবাসেন না।”
তারা আরও ভুলে যান যে, একই মতবাদে বিশ্বাসী, একই দলের অনুসারী, একই ভাবে মগজ ধোলাই হওয়া এক দল আবেগ আপ্লুত মানুষ জিহাদের মত অতি স্পর্শকাতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া সঠিক কাজ নয়। হক-বাতিলকে নিজেদের দাঁড়িপাল্লায় ওজন করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়। যথেচ্ছা - কাফের- মুনাফেককে- ও মুসলমানকেও দ্বীনের দুশমন বলে হত্যা করা বৈধ নয়। আল্লাহর রাসুল (সঃ) মুনাফেকদের পরিচয় জেনেও তাদেরকে হত্যা করেননি (বিশেষ সময়ে বিশেষ ব্যক্তি ছাড়া)।
শান্তি প্রিয় কাফেরের বিন্দু পরিমাণ ক্ষতি করার অনুমতিও ইসলাম দেয়নি।
আবেগ আপ্লুত খামখেয়ালির নাম ইসলাম নয়। দলীয় মতবাদকেও ইসলাম বলেনা। ইসলাম এক শাস্বত সত্য ও আদর্শের নাম, একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান। সমগ্র দুনিয়ার শান্তির দূত। আখেরাতের কল্যাণকামী। উভয় জগতে শান্তি ও নিরাপত্তার জন্যে যা দরকার, তা সবই ইসলাম নিয়ে এসেছে। যোগ্য উলামাগন তা ব্যাখ্যা করে রেখেছেন। যাদের গভীর জ্ঞান নেই, যারা আবেগ তাড়িত, ভুল কাজে আত্মদান করে শাহাদাতের কামনা করে তাদের লাভ হবেনা। বরং সকল ক্ষতির দায়ভার বহন করতে হতে পারে বলে সন্দেহ করা যায়না।
জিহাদ বিষয়ে তাদের বুঝ যেন ঐ পিপীলিকার মত যে কলমের নিবের দিকে তাকিয়ে মনে করে আহ! নিবে কি সব সুন্দর আঁকাবাঁকা দাগ টানছে। অথচ এই নিবের গোঁড়ায় রয়েছে কলম, এর তিনটি প্রধান অংশ, ভিতরে কালী, এটাকে চালনা করছে একটি হাত। এ হাত একজন মানুষের, মানুষটি শিক্ষিত, তার জ্ঞান থেকে যা উদগিরীত হচ্ছে তাই সে এখানে লিপিবদ্ধ করছে। আর এই মানুষ সৃষ্টি করেছন আল্লাহ...ইত্যাদি সে কিছুই জানেনা। সে শুধু জানে নিবটি এই দাগ গুলো সৃষ্টি করছে। বাহ! কি চমৎকার জ্ঞান তাই নয় কি?
কুরআন যদি ময়দানে না নামলে বুঝে না আসে, তাহলে সাহাবাগনের সময় থেকে আজ পর্জন্ত যেসব মুফাসসিরগন কুরআনের ব্যাখ্যা করে গেছেন তারা কেউই বুঝেন নাই! আর যারা জিহাদ না করে মারা গেছেন ও যাবেন তাঁরা কেউ বেহেস্তে যেতে পারবেন না! এমন মনে করা কি গোমরাহি নয়? এমন যারা মনে করেন, তারা যে নিজেদের ভুল বুঝেননা তাকি আর বলার প্রয়োজন থাকে?

No comments:

Post a Comment

Download AsPDF

Print Friendly and PDFPrint Friendly and PDFPrint Friendly and PDF
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...