Thursday 30 June 2016

রমযান মাসের ৩০ আসর (২য় পর্ব)

১ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন 
শায়খ মুহাম্মদ ইবন সালেহ ইবন উসাইমীন রহ.
অনুবাদ: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া ও আলী হাসান তৈয়ব

সপ্তদশ আসরঃযারা যাকাতের হকদার
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি নিচু করলে উপরে তোলার কেউ নেই, আর তিনি উপরে উঠালে নিচু করার কেউ নেই। তিনি দান করলে বাধা দেওয়ার কেউ নেই, তিনি নিষেধ করলে দেওয়ার কেউ নেই। তিনি যে সম্পর্ক ঠিক রেখেছেন তা কাটার কারও ক্ষমতা নেই, তিনি যে সম্পর্ক কর্তন করেছেন তা জোড়া দেওয়ার কেউ নেই। সুতরাং কতই না পবিত্র তিনি! তিনি মহা পরিচালক, প্রাজ্ঞ ও দয়ালু ইলাহ, তাঁর প্রাজ্ঞতার কারণেই ক্ষতি অনুষ্ঠিত হয় আর তার রহমতেই উপকার সাধিত হয়। আমি তাঁর সকল কর্মকাণ্ডের উপর তাঁর প্রশংসা করি, তার প্রশস্ত ব্যাপক দানের কারণে তার শুকরিয়া আদায় করি।
আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই, যা শরীয়ত হিসেবে দিয়েছেন তা দক্ষতার সাথে দিয়েছেন, যা তৈরী করেছেন সম্পূর্ণ নতুনভাবে তা করেছেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল, যাকে তিনি এমন সময় পাঠিয়েছেন যখন কুফরি উপরে উঠেছিল এবং উঁচু হয়ে গিয়েছিল, আক্রমণ করেছিল, জমায়েত হয়েছিল, কিন্তু তিনি সে ঊঁচু অবস্থান থেকে সেটাকে নীচে নামিয়ে রেখেছিলেন এবং দমন করেছিলেন, আর যারা ক্ষতি করার জন্য একত্রিত হয়েছিল তিনি তাদেরকে শতধা বিভক্ত করে দিয়েছেন।
আল্লাহ তাঁর উপর সালাত পেশ করুন, অনুরূপ তাঁর সাথী আবু বকরের উপর, যার বীরত্বের তারকা মুরতাদদের সাথে যুদ্ধে দেখা দিয়েছিল এবং উদিত হয়েছিল। আর ‘উমারের উপর, যার দ্বারা আল্লাহ ইসলামকে করেছেন সম্মানিত ও অপ্রতিরোধ্য। তদ্রূপ ‘উসমানের উপর, যিনি মাযলুমভাবে নিহত হয়েছিলেন। অনুরূপ আলীর উপর, যিনি তাঁর জিহাদ দ্বারা কুফরিকে করেছেন বিনষ্ট ও দমন। তাছাড়া রাসূলের সকল পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীর উপর, যতদিন সালাত আদায়কারীরা সিজদা ও রুকু করবে। আর আল্লাহ তাঁদের উপর যথাযথ সালামও পেশ করুন।
প্রিয় ভাইয়েরা!
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿إِنَّمَا ٱلصَّدَقَٰتُ لِلۡفُقَرَآءِ وَٱلۡمَسَٰكِينِ وَٱلۡعَٰمِلِينَ عَلَيۡهَا وَٱلۡمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمۡ وَفِي ٱلرِّقَابِ وَٱلۡغَٰرِمِينَ وَفِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱبۡنِ ٱلسَّبِيلِۖ فَرِيضَةٗ مِّنَ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٞ ٦٠ ﴾ [التوبة: ٦٠]
‘নিশ্চয়ই ফকীর, মিসকীন, যাকাত আদায়ে নিযুক্ত কর্মচারী, (ইসলামের প্রতি অমুসলিমদের) হৃদয় আকৃষ্ট করার জন্য, দাস মুক্তি, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, আল্লাহর পথে জিহাদে রত এবং মুসাফিরগণ যাকাতের হকদার, এ বিধান আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, আল্লাহ জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময়।’ {সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ২০}
এ মহতী আয়াতে: আল্লাহ তা‘আলা যাকাত ব্যয়ের খাত ও তার হকদারদের বিষয়টি তাঁর জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ইনসাফ ও দয়া অনুসারে ওই আট প্রকারে সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন।
তিনি আরও বর্ণনা করেছেন যে, এদের মাঝেই যাকাত বণ্টন করা আবশ্যকীয় ফরয। আর এ বণ্টন আল্লাহর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা থেকে উত্থিত। সুতরাং এর ব্যতিক্রম করা ও যাকাতকে অন্য খাতে ব্যবহার করা জায়েয নেই। কারণ, আল্লাহ তা‘আলাই তাঁর সৃষ্টির কল্যাণ সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো জানেন এবং প্রত্যেক বিষয়কে তার যথাস্থানে রাখতে তিনিই শ্রেষ্ঠ প্রজ্ঞার অধিকারী।

﴿ وَمَنۡ أَحۡسَنُ مِنَ ٱللَّهِ حُكۡمٗا لِّقَوۡمٖ يُوقِنُونَ ٥٠ ﴾ [المائ‍دة: ٥٠]
“আর নিশ্চিত বিশ্বাসী কওমের জন্য বিধান প্রদানে আল্লাহর চেয়ে কে অধিক উত্তম? {সূরা আল-মায়িদাহ্‌, আয়াত: ৫০}
প্রথম ও দ্বিতীয় প্রকার হকদার: ফকীর ও মিসকীন
এরা হলো ওই সকল লোক, যাদের পরিবারের ভরণ-পোষণ ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটানোর জন্য তাদের নগদ অর্থ, বেতন ভাতা, প্রতিষ্ঠিত শিল্প ও আয় রোজগার যথেষ্ট নয়। অন্যের সাহায্য সহায়তার প্রয়োজন হয়।
* উলামায়ে কেরামের মতে, এদেরকে এ পরিমাণ যাকাতের অংশ দেয়া উচিত, যাতে সামনের বছর যাকাতের সময় আসা পর্যন্ত আর অর্থের প্রয়োজন না হয়।
– গরীবদের বিবাহ সম্পাদনে বিয়ের প্রয়োজন পূরণে যাকাত দেওয়া যাবে।
– গরীব দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের কিতাব ক্রয়েও দেওয়া যাবে।
– গরীব চাকরীজীবি, যাদের বেতন ভাতা নিজের ও পরিবারের জন্য যথেষ্ট নয়, এদেরকে প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট পরিমাণ যাকাত দেয়া উচিত।
পক্ষান্তরে যার আয়-রোজগার নিজের ও পরিবারের জন্য যথেষ্ট, তাকে যাকাত দেয়া যাবে না। তাকে বরং এ অবৈধ যাচনা থেকে বিরত থাকার উপদেশ প্রদান করাই কর্তব্য।
এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যেমন,
* আবদুল্লাহ ইবন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
্র্রلَا تَزَالُ الْمَسْأَلَةُ بِأَحَدِكُمْ حَتَّى يَلْقَى اللهَ، وَلَيْسَ فِي وَجْهِهِ مُزْعَةُ لَحْمٍ
‘মানুষের কাছে ব্যক্তি চাইতে থাকে, এমনকি কিয়ামতের দিন তাকে এমন অবস্থায় উঠানো হবে যে তার চেহারায় কোনো গোশত অবশিষ্ট থাকবে না।’
* অনুরূপ আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
مَنْ سَأَلَ النَّاسَ أَمْوَالَهُمْ تَكَثُّرًا، فَإِنَّمَا يَسْأَلُ جَمْرًا فَلْيَسْتَقِلَّ أَوْ لِيَسْتَكْثِرْ
‘যে ব্যক্তি নিজের সম্পদ বৃদ্ধির জন্য অন্যের কাছে ভিক্ষা চায়, সে মূলত আগুনের টুকরাই চায়, এখন সে ভিক্ষা চাওয়া বাড়াতেও পারে বা কমাতেও পারে।’
* হাকীম ইবন হিযাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إِنَّ هَذَا المَالَ خَضِرَةٌ حُلْوَةٌ، فَمَنْ أَخَذَهُ بِسَخَاوَةِ نَفْسٍ بُورِكَ لَهُ فِيهِ، وَمَنْ أَخَذَهُ بِإِشْرَافِ نَفْسٍ لَمْ يُبَارَكْ لَهُ فِيهِ، كَالَّذِي يَأْكُلُ وَلاَ يَشْبَعُ، اليَدُ العُلْيَا خَيْرٌ مِنَ اليَدِ السُّفْلَى
‘এই সম্পদ হলো আকর্ষণীয় মিষ্ট ভোগ উপকরণ। সুতরাং যে একে গ্রহণ করে অন্তরের বদান্যতার সঙ্গে তার জন্য তাতে বরকত দেয়া হয়। আর যে একে গ্রহণ করে আগ্রহ আতিশয্যের সঙ্গে তার জন্য তাতে বরকত দেয়া হয় না। যেমন ওই ব্যক্তি যে খায় কিন্তু তৃপ্ত হয় না। উচু হাত নিচু হাতের চেয়ে শ্রেয়।’
* আবদুর রহমান ইবন ‘আউফ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
وَلا يَفْتَحُ عَبْدٌ بَابَ مَسْأَلَةٍ إِلا فَتَحَ اللَّهُ عَلَيْهِ بَابَ فَقْرٍ
‘যে ব্যক্তি ভিক্ষার পথ অবলম্বন করে, আল্লাহ তার জন্য অভাবের দরজা খুলে দেন।’
যদি অপরিচিত লোক যাকাত প্রার্থনা করে যার মধ্যে ধনাঢ্যতার ছাপ স্পষ্ট, তাকে দান করা যাবে। তবে তাকে এ কথা জানিয়ে দিতে হবে যে ধনী এবং কামাই করতে সক্ষমদের জন্য যাকাতে কোনো অংশ নাই। কেননা,
* হাদীসে আছে, একবার দু’জন লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে যাকাতের অর্থ থেকে কিছু চাইলো। তিনি তাদের দেখে বুঝতে পারলেন তারা সামর্থ্যবান। তাদের তিনি বললেন,
إِنَّ شِئْتُمَا أَعْطَيْتُكُمَا، وَلَا حَظَّ فِيهَا لِغَنِيٍّ، وَلَا لِقَوِيٍّ مُكْتَسِبٍ
‘তোমরা চাইলে তোমাদের দেব; তবে জেনে রেখো, ধনী ও সামর্থ্যবানদের জন্য যাকাতে কোনো অংশ নেই।’
তৃতীয় প্রকার: যাকাত আদায়ের কাজে নিয়োজিত কর্মচারী
এরা হলেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে যাকাত আদায়, সংরক্ষণ ও যথাস্থানে ব্যয় করার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ। তাদের নিজ নিজ কর্ম ও শ্রম অনুপাতে যাকাতের অর্থ প্রদান করা হবে, যদিও তারা ধনী হয়। তবে ব্যক্তিগতভাবে যদি কেউ কোনো লোককে তার যাকাত বণ্টনের কাজে ওকিল বা প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ করে, তাহলে সে যাকাতের কর্মচারী বলে বিবেচিত হবে না। সুতরাং তাকে ওকালতির কাজে যাকাতের কোনো অংশ দেওয়া যাবে না।
এ ওকিল বা প্রতিনিধিগণ যদি বিশ্বস্ততা ও শ্রম ব্যয় করে হকদারদের মধ্যে এ কাজ বিনা পারিশ্রমিকে সওয়াবের আশায় করে তবে অবশ্যই তারা যাকাতদাতার সওয়াবে শরীক হবেন। কারণ;
* বুখারীতে এসেছে, আবূ মুসা আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
إِنَّ الْخَازِنَ الْمُسْلِمَ الْأَمِينَ الَّذِي يُنْفِذُ – وَرُبَّمَا قَالَ يُعْطِي – مَا أُمِرَ بِهِ، فَيُعْطِيهِ كَامِلًا مُوَفَّرًا، طَيِّبَةً بِهِ نَفْسُهُ، فَيَدْفَعُهُ إِلَى الَّذِي أُمِرَ لَهُ بِهِ – أَحَدُ الْمُتَصَدِّقَيْنِ
‘বিশ্বস্ত মুসলিম কোষাধ্যক্ষ, যিনি তাকে যা নির্দেশ করা হয় তা সুন্দর ও পরিপূর্ণভাবে যথাযথ ও সন্তুষ্টচিত্তে; যাকে দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তার জন্য তা বাস্তবায়ণ করেন -অথবা বলেছেন: প্রদান করেন, সেও দুই সদকাকারীর একজন।’
আর যদি এ ওকিল বা প্রতিনিধিগণ বিনা পারিশ্রমিকে এ বণ্টনের দায়িত্ব গ্রহণ করতে না চায়, তবে সম্পদের মালিক তাকে নিজ সম্পদ থেকে পারিশ্রমিক প্রদান করবেন, যাকাত থেকে নয়।
চতুর্থ প্রকার: যাদের হৃদয় আকর্ষণ করা প্রয়োজন
তারা হচ্ছে এমন নতুন মুসলিম যাদের অন্তর এখনো দোদুল্যমান অথবা এমন লোক যাদের ক্ষতির আশংকা করা হয়; তাই তাদের ঈমানকে মজবুত করার জন্য অথবা তাদের ক্ষতি প্রতিহত করার জন্য তাদেরকে যাকাত থেকে প্রদান করা যাবে; যদি তাদের ক্ষতি প্রতিহত করার অন্য উপায় না থাকে।
পঞ্চম প্রকার: দাস মুক্তির জন্য
যে সকল দাস-দাসী আপন মুনিবের সঙ্গে অর্থের বিনিময়ে নিজেদের মুক্তির ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে, তাদের যাকাত থেকে এ পরিমাণ অর্থ দেয়া যাবে, যাতে তারা এর মাধ্যমে মুক্তিলাভ করতে পারে।
অনুরূপভাবে যাকাতের অর্থ দিয়ে সাধারণ দাস-দাসী ক্রয় করেও মুক্ত করা যাবে।
তাছাড়া মুসলিম কয়েদিদেরকেও মুক্ত করা যাবে। কারণ এটাও দাসমুক্তির ব্যাপক নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত।
ষষ্ঠ প্রকার: যারা ঋণের বোঝা বহন করছে
যারা ঋণের বোঝা বহন করে তারা দু’প্রকার:
১) যে ব্যক্তি সমাজে পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ়করণ এবং সমাজ থেকে বিশৃঙ্খলার আগুন নেভাতে গিয়ে ঋণের শিকার হয়েছে, যাকাতের অর্থ থেকে তাকে ঋণ পরিমাণ অর্থ প্রদান করা যাবে। যেন সে এমন মহতী কাজে আরও উৎসাহিত হয়, যাতে সমাজে বিশৃঙ্খলা ও হিংসা-বিবাদ দূর হয়ে মুসলিমদের মধ্যে পরস্পর সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়।
* কাবীসা ইবন মুখারিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
تَحَمَّلْتُ حَمَالَةً فَأَتَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَسْأَلُهُ فِيهَا فَقَالَ: أَقِمْ يَا قَبِيصَةُ حَتَّى تَأْتِيَنَا الصَّدَقَةُ، فَنَأْمُرَ لَكَقَالَ: ثُمَّ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَا قَبِيصَةُ إِنَّ الصَّدَقَةَ لَا تَحِلُّ إِلَّا لِأَحَدِ ثَلَاثَةٍ: رَجُلٍ تَحَمَّلَ حَمَالَةً، فَحَلَّتْ لَهُ الْمَسْأَلَةُ حَتَّى حَتَّى يُصِيبَهَا ثُمَّ يُمْسِكَ…
‘একবার আমি অপরের ভার (ঋণ বা সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব) নিজের উপর নিয়ে নিলাম। অতঃপর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বিষয়টি জানিয়ে এ বিষয়ে সহযোগিতা চাইলাম। তখন তিনি বললেন, ‘হে কাবীসা! তুমি আমার নিকট অবস্থান কর; যাতে আমার কাছে যাকাতের মাল আসে। যখন সেটা আসবে তখন আমি তোমাকে তা প্রদান করার নির্দেশ দেব। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে কাবীসা! সাদাকা কেবল তিন ব্যক্তির জন্য হালাল: (তাদের মধ্যে একজন) ওই ব্যক্তি যে পরোপকার করতে গিয়ে ঋণী হয়েছে ফলে তার জন্য চাওয়া বৈধ; যাতে তা পরিশোধ করতে পারে। অতঃপর যাচ্ঞা থেকে বিরত থাকে।…’
২) যে ব্যক্তি নিজের বা পরিবারের প্রয়োজন পূরণে ঋণগ্রস্ত হয়েছে, কিন্তু তার ঋণ পরিশোধ করার কোনো ব্যবস্থা নেই, তাকে ঋণ শোধ পরিমাণ অর্থ যাকাত থেকে প্রদান করা যাবে; যদিও তার পরিমাণ বেশি হয়। অথবা তলবকৃত ব্যক্তি (ঋণী)র কাছে না দিয়ে সরাসরি তলবকারীকে অর্থ দিয়ে দেয়া যাবে। কারণ তলবকারীর কাছে অর্থ হস্তান্তরের মাধ্যমেই তলবকৃত ব্যক্তি দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভ করবে।
সপ্তম প্রকার: আল্লাহর রাস্তায়
‘আল্লাহর রাস্তায়’ বলতে ‘জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ’ বুঝায়; যে জিহাদের একমাত্র উদ্দেশ্য আল্লাহর বাণীকে সমুন্নত করা। নিজের বীরত্ব বা শ্রেষ্ঠত্ব অথবা দলীয় কিংবা গোত্রীয় গোড়ামী প্রদর্শনের জন্য নয়। সুতরাং এ নিয়্যতে যে জিহাদ করবে সে মুজাহিদকে যাকাত থেকে এমন অর্থ প্রদান করা যাবে যা জিহাদের পথে তার প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট হবে। অথবা ইসলামের সাহায্য ও তার শত্রুদের বিতাড়ন এবং আল্লাহর বাণীকে বিজয়ী করার জন্য আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী মুজাহিদদের জন্য যাকাতের অর্থ থেকে যুদ্ধাস্ত্র ও যুদ্ধ সামগ্রী কেনা যাবে।
অষ্টম প্রকার: মুসাফির
যে মুসাফিরের আসবাবপত্র শেষ হয়ে গেছে, যাকাত থেকে তাকে এ পরিমাণ অর্থ দেওয়া যাবে যাতে সে সফর পূর্ণ করে নিজ আবাসে পৌঁছুতে পারে।
এ জাতীয় মুসাফির যদি তার নিজ দেশে ধনী লোকও হয় এবং এমন কাউকে পাওয়া যায় যে তাকে ঋণও প্রদান করবে, তারপরও তাকে যাকাত থেকে প্রদান করা যাবে।
তবে এভাবে যাকাতের টাকা নেওয়ার মানসিকতা নিয়ে অল্প-পরিমাণ টাকা-পয়সা নিয়ে সফরে বের হওয়া মুসাফিরের জন্য উচিত নয়।
আর কোনো ক্রমেই যাকাতের সম্পদ কাফিরদেরকে দেয়া যাবে না। তবে যদি তাদের মন আকৃষ্ট করার জন্য হয় তাহলে তা ভিন্ন কথা। অনুরূপভাবে কোনো ধনী লোক, যার কাছে তার প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা রয়েছে, যেমন ব্যবসায়ী, কারিগর, শিল্পী এবং নিয়মিত বেতনভোগী, প্রচুর ফসলের মালিক অথবা অত্যাবশ্যক খরচ মেটানোর ব্যবস্থা রয়েছে এমন ব্যক্তি, তাদের কাউকেই যাকাতের সম্পদ থেকে দেয়া বৈধ হবে না। তবে তারা যদি যাকাত সংগ্রহের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক নিযুক্ত কর্মচারী হয় অথবা যদি তারা আল্লাহর পথে জিহাদকারী হয় অথবা কোনো ধনী ব্যক্তি যদি সামাজিক সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে যায়, তবে ধনী হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে যাকাতের সম্পদ থেকে দেয়া যাবে।
উপরে বর্ণিত কাজগুলো ব্যতীত অন্য কোনো ওয়াজিব কাজ সম্পাদনের জন্য যাকাত থেকে ব্যয় করা যাবে না। সুতরাং কোনো মেহমানকে মেহমানদারীর জন্য যাকাত থেকে দেওয়া যাবে না। অনুরূপভাবে যাদের খোর-পোষ তার উপর ওয়াজিব, যেমন স্ত্রী বা নিকটাত্মীয়, তাদেরকে তাদের জন্য খরচের পরিবর্তে যাকাত থেকে দেওয়া যাবে না। তবে স্ত্রী ও নিকটাত্মীয়ের ওয়াজিব খরচ বাদে অন্য কাজে তাদের প্রয়োজনে যাকাত থেকে দেওয়া যাবে। সুতরাং স্বামী যাকাত থেকে তার স্ত্রীর একান্ত ঋণ, যা সে পরিশোধ করতে অক্ষম, তা পরিশোধ করতে পারবে। অনুরূপভাবে কেউ তার পিতা-মাতা বা নিকটাত্মীয়ের ঋণ যা তারা পরিশোধ করতে পারছে না সেটাও যাকাত থেকে পরিশোধ করতে পারবে।
অনুরূপভাবে নিকটাত্মীয়দের সম্পদ যদি তাদের খরচ মেটাতে অপ্রতুল হয়, তবে তাদের খরচ মেটানোর জন্য তাদেরকে যাকাত থেকে দেওয়া যাবে; যদি তাদের খরচ মেটানোর দায়িত্ব যাকাতদাতার উপর ওয়াজিব না হয়।
তদ্রূপ কোনো স্ত্রী তার স্বামীকে ঋণ পরিশোধ বা এ জাতীয় কাজের জন্য যাকাতের সম্পদ থেকে দিতে পারবে। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা যাকাতের হকদার করার বিষয়টি এমন সাধারণ গুণাগুণের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন যা তাদেরকে ও অন্যান্যদেরকে সমভাবে সম্পৃক্ত করে। সুতরাং নস তথা কুরআন ও সুন্নাহর ভাষ্য অথব ইজমা ব্যতীত তাদেরকে হকদারের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যাবে না। তাছাড়া এর সপক্ষে হাদীসও রয়েছে। যেমন,
* বুখারী ও মুসলিমে ইবন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর পতœী যায়নাব সাকাফিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলাদের সাদাকাহ দেয়ার নির্দেশ দিলেন। তখন যায়নাব রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন,
يَا نَبِيَّ اللَّهِ، إِنَّكَ أَمَرْتَ اليَوْمَ بِالصَّدَقَةِ، وَكَانَ عِنْدِي حُلِيٌّ لِي، فَأَرَدْتُ أَنْ أَتَصَدَّقَ بِهِ، فَزَعَمَ ابْنُ مَسْعُودٍ: أَنَّهُ وَوَلَدَهُ أَحَقُّ مَنْ تَصَدَّقْتُ بِهِ عَلَيْهِمْ، فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: صَدَقَ ابْنُ مَسْعُودٍ، زَوْجُكِ وَوَلَدُكِ أَحَقُّ مَنْ تَصَدَّقْتِ بِهِ عَلَيْهِمْ
“হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কিছু গহনা আছে, আমি এটা দ্বারা সাদাকা করতে চাই। এদিকে ইবন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু মনে করলেন তিনিই সাদাকার যোগ্য হকদার। বিষয়টি জেনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ইবন মাসঊদ ঠিকই বলেছেন; তুমি যাদের কাছে তা সাদাকা করবে তাদের মধ্যে তোমার স্বামী ও সন্তানরাই এর অধিক হকদার।’
* সালমান ইবন আমের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
الصَّدَقَةُ عَلَى الْمِسْكِينِ صَدَقَةٌ وَهِى عَلَى ذِى الرَّحِمِ ثْنَتَانِ صَدَقَةٌ وَصِلَةٌ .
‘ফকীর-মিসকীনকে সাদাকাহ দিলে শুধু সাদাকাই করা হয় আর আত্মীয়দের সাদাকাহ দিলে দুটি কাজ হয়: সাদাকাহও দেওয়া হয় আবার আত্মীয়তার সম্পর্কও রক্ষা করা হয়।’
কোনো দরিদ্র লোকের কাছে প্রাপ্য ঋণ মাফ করে দিয়ে যাকাতের নিয়ত করলে যাকাত আদায় হবে না। কারণ,
– যাকাত হলো গ্রহণ ও প্রদানের সমষ্টি।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿خُذۡ مِنۡ أَمۡوَٰلِهِمۡ صَدَقَةٗ تُطَهِّرُهُمۡ وَتُزَكِّيهِم بِهَا وَصَلِّ عَلَيۡهِمۡۖ إِنَّ صَلَوٰتَكَ سَكَنٞ لَّهُمۡۗ وَٱللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ١٠٣ ﴾ [التوبة: ١٠٣]
‘আপনি তাদের সম্পদ থেকে সদাকা নিন, এর মাধ্যমে তাদেরকে আপনি পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবেন। আর তাদের জন্য দো‘আ করুন, নিশ্চয় আপনার দো‘আ তাদের জন্য প্রশান্তিকর। আর আল্লাহ্ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ {সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ১০৩}
* আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
أَنَّ اللَّهَ قَدْ فَرَضَ عَلَيْهِمْ زَكَاةً تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَائِهِمْ فَتُرَدُّ عَلَى فُقَرَائِهِمْ .
‘আল্লাহ তাদের সম্পদে যাকাত ফরয করেছেন, ধনীদের থেকে তা নেয়া হবে আর দরিদ্রদের দেয়া হবে।’
আর ঋণ মাফ করার মধ্যে যেহেতু এ আদান-প্রদান নেই, সেহেতু তা দিয়ে যাকাত আদায় হবে না।
– তাছাড়া ফকীরের যিম্মায় যে ঋণ রয়েছে তা অনুপস্থিত ঋণ, যাতে কোনো কিছু করার নেই, তাই সেটা উপস্থিত সম্পদ যাতে কিছু করার আছে সেটার জন্য তা যথেষ্ট হবে না।
– অনুরূপভাবে ঋণের ব্যাপারটি উপস্থিত সম্পদের চেয়ে অন্তরে কমই প্রভাব ফেলে, তাই সেটা দিয়ে ঋণ দেওয়া যেন ভালোর বদলে মন্দ প্রদান করা।
আর যদি যাকাতদাতা তার প্রচেষ্টা চালানোর পর যাকাতের হকদার মনে করে কাউকে যাকাত দেয়, তারপর জানতে পারে যে সে যাকাতের হকদার নয়, এমতাবস্থায় যাকাতদাতার যাকাত আদায় হয়ে যাবে। কারণ সে তার সাধ্যানুসারে চেষ্টা করেছে ও আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করেছে। আর আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের বাইরে কষ্ট দেন না।
* আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত লম্বা হাদীসের অংশবিশেষ হলো:
قَالَ رَجُلٌ لأَتَصَدَّقَنَّ اللَّيْلَةَ بِصَدَقَةٍ فَخَرَجَ بِصَدَقَتِهِ فَوَضَعَهَا فِى يَدِ غَنِىٍّ فَأَصْبَحُوا يَتَحَدَّثُونَ تُصُدِّقَ عَلَى غَنِىٍّ. قَالَ اللَّهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ عَلَى غَنِىٍّ لأَتَصَدَّقَنَّ بِصَدَقَةٍ. فَأُتِىَ فَقِيلَ لَهُ أَمَّا صَدَقَتُكَ فَقَدْ قُبِلَتْ وَلَعَلَّ الْغَنِىَّ يَعْتَبِرُ فَيُنْفِقُ مِمَّا أَعْطَاهُ اللَّهُ .
‘(পূর্ববর্তী উম্মতদের মধ্য হতে) এক ব্যক্তি শপথ করে বলল, আজ রাতে আমি সাদাকাহ্‌ করব… তাতে এসেছে, “পরে সে এক ধনী লোককে (না জেনে) সাদাকাহ্‌ দিয়ে বসল। এতে লোকেরা তার সমালোচনা করে বলতে লাগলো যে ধনীকে সাদাকাহ দেওয়া হয়েছে। লোকটি বলল, হে আল্লাহ আপনার প্রশংসা, যদিও আমি ধনীকে দিয়েছি।… অতঃপর লোকটিকে স্বপ্নে এসে জানানো হলো যে, ওই ধনী লোক সম্ভবত এ থেকে শিক্ষা নেবে এবং তাকে আল্লাহ যে সম্পদ দান করেছেন তা থেকে সে দান করবে।’ সহীহ মুসলিমের অপর বর্ণনায় স্পষ্ট এসেছে যে, তাকে স্বপ্নে এসে বলা হলো যে, তোমার সাদাকাহ্‌ গৃহীহ হয়েছে। … আর ওই ধনী লোক…।
* মা‘আন ইবন ইয়াযীদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
كَانَ أَبِى يَزِيدُ أَخْرَجَ دَنَانِيرَ يَتَصَدَّقُ بِهَا فَوَضَعَهَا عِنْدَ رَجُلٍ فِى الْمَسْجِدِ ، فَجِئْتُ فَأَخَذْتُهَا فَأَتَيْتُهُ بِهَا فَقَالَ وَاللَّهِ مَا إِيَّاكَ أَرَدْتُ . فَخَاصَمْتُهُ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ – صلى الله عليه وسلم – فَقَالَ لَكَ مَا نَوَيْتَ يَا يَزِيدُ ، وَلَكَ مَا أَخَذْتَ يَا مَعْنُ .
‘আমার বাবা ইয়াযীদ দান করার উদ্দেশে স্বর্ণমুদ্রা মসজিদে এক ব্যক্তির কাছে রাখলেন। অতঃপর আমি সেখানে গিয়ে তা গ্রহণ করলাম, তারপর সেটা নিয়ে তার কাছে এলাম। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম, আমি তো তোমাকে দেব এমন নিয়ত করিনি। তখন আমি এর সমাধানের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলাম। তিনি বললেন, ‘হে ইয়াযীদ তুমি যা নিয়ত করেছ তাই পাবে আর হে মা‘আন তুমি যা গ্রহণ করেছে তাই তোমার’।’
ভাই সকল! যাকাত ততক্ষণ আদায় হবে না যতক্ষণ না তা তার সঠিক ও উপযুক্ত স্থান যেখানে আল্লাহ দিতে বলেছেন সেখানে দেওয়া হবে।
সুতরাং, আল্লাহ তোমাদেরকে রহমত করুন, তোমরা সকলে যাকাতকে তার সঠিক ও যথাযথ স্থানে দেওয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালাও ও যতœবান হও; যাতে তোমরা দায়িত্বমুক্ত হও, তোমাদের সম্পদ পবিত্র হয়, তোমাদের রবের নির্দেশ বাস্তবায়িত হয় এবং তোমাদের সাদাকাসমূহ কবুল হয়। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন।
আর সকল প্রশংসা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর জন্য, আল্লাহ সালাত ও সালাম পেশ করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তার পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীর উপর।
অষ্টাদশ আসরঃবদর যুদ্ধ
সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি শক্তিশালী সুদৃঢ়, পদানতকারী বিজয়ী কর্তৃত্বশীল, প্রকাশ্য সত্য, মৃদু কান্নার শব্দও যার শ্রবণ থেকে গোপন থাকে না, যার মহত্বের কাছে ক্ষমতাধর নরপতিরা হীন হয়ে গেছে। তিনি তাঁর প্রজ্ঞা অনুযায়ী ফয়সালা করেন, আর তিনি মহাবিচারক।
আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই, তিনি পূর্বের ও পরের সবার ইলাহ। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল, যাঁকে তিনি সকল সৃষ্টিকুল থেকে বেঁছে নিয়েছেন, বদর প্রান্তরে ফেরেশতা দিয়ে সাহায্য করেছেন।
আল্লাহ তাঁর উপর সালাত পেশ করুন, অনুরূপ তার পরিবার-পরিজন, সকল সাহাবী এবং কিয়ামত পর্যন্ত সুন্দরভাবে তাদের অনুসারীদের সবার উপর। আর তিনি তাদের উপর যথাযথ সালামও প্রদান করুন।
সম্মানিত ভাইয়েরা! এ পবিত্র মাসেই আল্লাহ তা‘আলা মহান বদর যুদ্ধে মুসলিমদেরকে তাদের শত্রু মুশরিকদের বিরুদ্ধে বিজয় দান করেছেন। এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা এ দিবসকে ‘ইয়াওমুল ফুরকান’ তথা সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নিরূপণের দিন বলে নাম রেখেছেন; কেননা আল্লাহ তা‘আলা সেদিন তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুমিনদের বিজয়ী এবং কাফির ও মুশরিকদের পরাজিত করার মাধ্যমে হক্ব ও বাতিলের পার্থক্য সূচিত করেছেন।
এ মহা বিজয়ের ঘটনাটি ঘটেছিল দ্বিতীয় হিজরীর রমযান মাসে।
এ যুদ্ধের কারণ ছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মর্মে সংবাদ পেলেন যে, আবূ সুফিয়ান কুরাইশ কাফিরদের একটি বানিজ্য দল নিয়ে সিরিয়া থেকে মক্কা ফিরছে। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে কুরাইশদের বানিজ্য কাফেলার গতিরোধের জন্য বের হওয়ার আহ্বান জানালেন। কেননা কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তাদের মাঝে কোনো প্রকার চুক্তি ছিল না। আর কাফির কুরাইশরা মুসলিমদেরকে তাদের ঘর-বাড়ি ও ধন-সম্পদ হতে বের করে দিয়েছিল এবং ইসলামের সত্যবাণীর দাওয়াতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ বানিজ্য কাফেলার সাথে যা করার ইচ্ছা করেছিলেন তা ছিল যথার্থ।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৩১০ এর বেশি কিছু সাহাবীকে নিয়ে বদর অভিমুখে রওয়ানা হন। তাদের ছিল কেবলমাত্র দুটি ঘোড়া ও সত্তরটি উট; যাতে তারা পালাক্রমে চড়ছিলেন। এ যুদ্ধে ৭০ জন মুহাজির এবং অন্যরা আনসার মুজাহিদ ছিলেন। তারা বানিজ্য কাফেলা ধরতে চেয়েছিলেন, যুদ্ধ করতে চান নি। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা অনির্ধারিত সময়ে তাঁর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য মুসলিম ও শত্রুদের মাঝে মুখোমুখি দাঁড় করালেন।
আবূ সুফিয়ান মুসলিমদের অবস্থা জানতে পেরে কুরাইশদের কাছে এ মর্মে একজন চিৎকারকারী সংবাদবাহক পাঠায় যেন কুরাইশরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে তার সাহায্যে এগিয়ে আসে। তাই আবূ সুফিয়ান রাস্তা পরিবর্তন করে সমুদ্র উপকূল ধরে রওয়ানা দিল এবং নিরাপদে পৌঁছে গেল।
কিন্তু কুরাইশ সম্প্রদায়; তাদের কাছে চিৎকারকারীর মাধ্যমে সংবাদ পৌঁছা মাত্রই তাদের নেতৃস্থানীয় একহাজার লোক সদলবলে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। তাদের ছিল ১০০টি অশ্ব ও ৭০০ উষ্ট্র। তারা বের হয়েছিল
﴿بَطَرٗا وَرِئَآءَ ٱلنَّاسِ وَيَصُدُّونَ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِۚ وَٱللَّهُ بِمَا يَعۡمَلُونَ مُحِيطٞ ٤٧ ﴾ [الانفال: ٤٧]
‘অহঙ্কার ও লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে এবং আল্লাহর রাস্তা থেকে বাধা প্রদান করতে, আর তারা যা করছিল, আল্লাহ তা পরিবেষ্টনকারী।’ {সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৪৭}
তাদের সঙ্গে ছিলো নর্তকী দল, যারা মুসলিমদের বদনামি ও বিদ্রূপ করে গান গাইছিলো। আবূ সুফিয়ান যখন কুরাইশদের যাত্রার কথা জানতে পারল, তখন সে নিজের নিরাপদে ফিরে আসার সংবাদ জানিয়ে কুরাইশদের যুদ্ধ ছাড়াই ফিরে যেতে অনুরোধ করল। কিন্তু কুরাইশ বাহিনী যুদ্ধ ছাড়া পিছু ফিরে যেতে অস্বীকার করল।
আবূ জেহেল বলল, “আল্লাহর শপথ, আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত বদর প্রান্তরে না পৌঁছব ততক্ষণ ফিরে যাব না। আমরা বদর প্রান্তরে তিনদিন অবস্থান করব। তথায় উট জবাই করব, খাদ্য খাব, মদ পান করব আর তাতে আরব জাতি আমাদের গৌবরগাথা শুনে সর্বদা ভয় পাবে”।
অন্যদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কুরাইশদের বের হবার খবর জানতে পারলেন, সাহাবীদের একত্র করে পরামর্শে বসলেন। তাদের উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা আমার সঙ্গে ওয়াদা করেছেন দু’টি দলের একটি (মুসলিমদের মাধ্যমে পদানত হবে) হয়তো ব্যবসায়ী কাফেলা অথবা অন্যটি সৈন্যবাহিনী।’
* অতঃপর মুহাজির সাহাবী মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ আপনাকে যে ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন তা বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত হোন। আল্লাহর শপথ! আমরা আপনাকে এমন কথা বলব না, যেমন মুসা (‘আলাইহিস সালাম) কে তাঁর জাতি বনী ইসরাইল বলেছিল:
﴿ٱذۡهَبۡ أَنتَ وَرَبُّكَ فَقَٰتِلَآ إِنَّا هَٰهُنَا قَٰعِدُونَ ٢٤ ﴾ [المائ‍دة: ٢٤]
‘হে মুসা! তুমি ও তোমার রব যাও এবং যুদ্ধে অবতীর্ণ হও। আমরা এখানে বসে থাকলাম।’ {সূরা আল-মায়িদাহ্‌, আয়াত: ২৪} বরং আমরা আপনার ডানে, বামে, সামনে এবং পিছনে যুদ্ধ করব।
* এ কথা শুনে আউস গোত্রের নেতা সা‘দ ইবন মু‘আয আল-আনসারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! সম্ভবত আপনি আনসারদের ব্যাপারে এ আশংকা করছেন যে, তাদের অধিকার আছে তাদের বাড়ী-ঘর থেকে দূরে আপনাকে সাহায্য না করার। তাই আমি আনসারদের পক্ষ থেকে বলছি এবং তাদের পক্ষ থেকে জবাব দিচ্ছি, যে দিকে আপনি চলুন, যার সঙ্গে ইচ্ছা আপনি সম্পর্ক গড়ে তুলুন, যার থেকে ইচ্ছা সম্পর্ক কর্তন করুন, আমাদের সম্পদ হতে যা ইচ্ছা গ্রহণ করুন, তন্মধ্য হতে যা ইচ্ছা আমাদের দান করুন, আপনি যা আমাদের জন্য ছেড়ে যাবেন তার চেয়ে যা আমাদের থেকে গ্রহণ করবেন তা-ই আমাদের নিকট অধিক প্রিয়। আপনি আমাদের যা নির্দেশ দেবেন আমাদের নির্দেশ সেখানে আপনার নির্দেশের অনুগামী হবে। আল্লাহর শপথ! আপনি যদি আমাদের নিয়ে গামদান হতে বুরাক পর্যন্ত চলেন, তাহলে অবশ্যই আমরা আপনার সঙ্গে চলব। আর যদি আপনি আমাদের এ সাগরে ঝাঁপ দিতে বলেন, আমরা তাই করব। আমরা এটা পছন্দ করি না যে, আপনি আগামী দিন আমাদের নিয়ে শত্রুদের মোকাবিলা করবেন। নিশ্চয় আমরা যুদ্ধে অত্যন্ত ধৈর্যশীল, শত্রুদের মোকাবিলায় সত্যের পক্ষে দৃঢ় অবস্থানকারী। আমরা আশা রাখি আল্লাহ আপনাকে আমাদের পক্ষ থেকে এমন কিছু দেখাবেন যদ্বারা আপনার চক্ষু শীতল হবে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুহাজির ও আনসার সাহাবীদের কথা শুনে খুশি হয়ে সুসংবাদ দিয়ে বললেন:
سَيْرُوا وأبْشِرُوا فَوالله لَكَأنِّي أنْظُرَ إلى مَصارِعِ القومِ
‘তোমরা চলতে থাক আর সুসংবাদ গ্রহণ করো। আল্লাহর শপথ, আমি যেন (মুশরিক) গোষ্ঠীর মৃত দেহ পড়ে থাকার জায়গাগুলো দেখতে পাচ্ছি।’
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর সৈন্যদল সাহাবীদের সঙ্গে নিয়ে চললেন এবং বদর কূপসমূহের কাছের পানির কূপের সম্মুখে যাত্রাবিরতি দিলেন। হুবাব ইবনুল মুনযির ইবন ‘আমর ইবনুল জুমুহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এটা কি এমন স্থান যেখানে অবস্থানের জন্য আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, যা থেকে আমাদের এদিক-সেদিক যাওয়ার সুযোগ নেই; নাকি এটা যুদ্ধ সংক্রান্ত কর্মকৌশল ও অভিমত?
উত্তরে তিনি বললেন, বরং এটা যুদ্ধ সংক্রান্ত কৌশল ও সিদ্ধান্ত। হুবাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু পুনরায় বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এটা তো ভালো স্থান নয়, তাই আমাদেরকে কুরায়েশের নিকটবর্তী কূপের নিকট নিয়ে চলুন। সেখানে আমরা অবস্থান করব এবং এর পিছনের কূপগুলো নষ্ট করব। অতঃপর সে কূপের কাছে হাওজ বানিয়ে তা পানি দিয়ে পূর্ণ করে রাখব, ফলে আমরা পানি পান করব অথচ তারা পানি পান করতে পারবে না।
এ মতটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পছন্দ করলেন। এরপর তারা সেখান থেকে রওয়ানা হয়ে মদীনার দিক থেকে নিকটবর্তী ‘উদওয়াতুদ দুনিয়া’তে (উপত্যকার নিকটবর্তী অংশে) অবতরণ করলেন, অন্য দিকে কুরাইশরা মক্কার দিক থেকে ‘উদওয়াতুল কুসওয়া’তে (উপত্যকা থেকে দূরের অংশে) অবস্থান করল। ওই রাতেই আল্লাহ তা‘আলা এমন মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করলেন যা কাফিরদের জন্য বিরাট বিপদ ও দুর্দশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তাদের মাটি কাদা ও পিচ্ছিল হয়ে পড়ে। ফলে তারা সম্মুখে অগ্রসর হতে পারেনি। অপরদিকে বৃষ্টি মুসলিমদের জন্য খুব হাল্কা ছিল ফলে তা তাদেরকে পবিত্র করল এবং তাদের যমীনকে চলাচল উপযোগী করে দিল, বালুকে শক্ত করল, অবস্থানকে অনুকুল করল এবং পদসমূহে স্থিরতা প্রদান করল।
আর মুসলিমরা যুদ্ধের মাঠে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য উঁচু স্থানে একটি তাঁবু বানালেন, যেখান থেকে যুদ্ধের ময়দান দেখা যায়, তিনি সেখানে অবস্থান করেছিলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখান থেকে নামলেন, সাহাবীগণের কাতার সুন্দর করে সাজালেন, যুদ্ধের ময়দানে চলতে থাকলেন এবং মুশরিকদের পতনের স্থল ও হত্যার স্থানসমূহের দিকে ইঙ্গিত করতে থাকলেন, আর তিনি বলছিলেন, “আল্লাহ চাহেত এটা অমুকের পতিত হওয়ার জায়গা, এটা অমুকের মৃত্যুস্থান।” পরবর্তীতে দেখা গেল যে, রাসূলের ইঙ্গিতের জায়গা থেকে ঐ লোকদের মৃত্যু সামান্যও হেরফের হয়নি। ।
এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবী মুসলিম মুজাহিদ এবং কাফির কুরাইশদের দিকে তাকালেন। আল্লাহর কাছে দু’হাত তুলে দো‘আ করে বললেন, “হে আল্লাহ! এ কাফির কুরাইশ দল অহংকার ও গর্বোদ্ধত হয়ে এখানে এসেছে তাদের যাবতীয় সৈন্য-সামন্ত নিয়ে, আপনার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করছে এবং আপনার রাসূলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করছে। হে আল্লাহ! এ কঠিন মুহূর্তে আপনি আমাকে সাহায্য করুন, যার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি আপনি আমাকে দিয়েছেন। হে আল্লাহ! আপনি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা বাস্তাবায়ন করুন। হে আল্লাহ আমি আপনার প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গিকারের বাস্তবায়ণ চাই। হে আল্লাহ, আপনি যদি চান তো আপনার ইবাদত করা হবে না। হে আল্লাহ! যদি এ মুসলিম দলকে আপনি ধ্বংস করে দেন, তাহলে আজ থেকে আপনার ইবাদত করার মত কেউ থাকবে না।”
মুসলিমগণ স্বীয় রবের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলেন এবং তাঁর কাছে উদ্ধার কামনা করলেন। তখন আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদের ডাকে সাড়া দিলেন।
﴿إِذۡ يُوحِي رَبُّكَ إِلَى ٱلۡمَلَٰٓئِكَةِ أَنِّي مَعَكُمۡ فَثَبِّتُواْ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْۚ سَأُلۡقِي فِي قُلُوبِ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ ٱلرُّعۡبَ فَٱضۡرِبُواْ فَوۡقَ ٱلۡأَعۡنَاقِ وَٱضۡرِبُواْ مِنۡهُمۡ كُلَّ بَنَانٖ ١٢ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمۡ شَآقُّواْ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥۚ وَمَن يُشَاقِقِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ فَإِنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ ٱلۡعِقَابِ ١٣ ذَٰلِكُمۡ فَذُوقُوهُ وَأَنَّ لِلۡكَٰفِرِينَ عَذَابَ ٱلنَّارِ ١٤﴾ [الانفال: ١٢، ١٤]
‘স্মরণ কর, যখন আপনার রব ফেরেশতাদের প্রতি ওহী প্রেরণ করেন যে, ‘নিশ্চয় আমি তোমাদের সাথে আছি। সুতরাং যারা ঈমান এনেছে তোমরা তাদেরকে অনড় রাখ। অচিরেই আমি ভীতি ঢেলে দেব তাদের হৃদয়ে যারা কুফরী করেছে। অতএব তোমরা আঘাত কর ঘাড়ের উপরে এবং আঘাত কর তাদের প্রত্যেক আঙুলের অগ্রভাগে। এটি এ কারণে যে, তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করেছে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করবে, তবে নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি দানে কঠোর। এটি আযাব, সুতরাং তোমরা তা আস্বাদন কর। আর নিশ্চয় কাফিরদের জন্য রয়েছে আগুনের আযাব।’ {সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ১২-১৪}
অতঃপর দু’টি দল (মুসলিম ও মুশরিক) পরস্পর মুখোমুখি হল এবং যুদ্ধ চলতে থাকল এবং প্রচণ্ড রূপ লাভ করল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁবুতে অবস্থান করলেন। তার সঙ্গে ছিলেন আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ও সা‘দ ইবন মু‘আয রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু। তারা দু’জনই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পাহারা দিচ্ছিলেন। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় রবের নিকট দীর্ঘ সময় পর্যন্ত কাতর প্রার্থনা জানালেন, সাহায্য ও বিজয়ের প্রার্থনা করলেন, উদ্ধার চাইলেন। তারপর রাসূল সামান্যতম সময়ের জন্য তন্দ্রাচ্ছন্ন হলেন, তারপর এ অবস্থা থেকে বের হয়ে বললেন, “অবশ্যই কাফিররা পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠদেশ দেখিয়ে পলায়ন করবে।” [সূরা আল-কামার: ৪৫]
আর তিনি মুসলিম যোদ্ধাদের যুদ্ধের প্রতি উৎসাহ দিয়ে বললেন, “ওই সত্তার শপথ! যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, আজ যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, ধৈর্যধারণ করে সওয়াবের আশায় সামনে অগ্রসর হয়ে পৃষ্ঠদেশ প্রদর্শন না করে যুদ্ধ করে মারা যাবে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।” এ কথা শুনে ‘উমাইর ইবনুল হুমাম আল আনসারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু দাঁড়ালেন, আর তার হাতে ছিল কিছু খেজুর; যা তিনি খাচ্ছিলেন; তিনি বলতে লাগলেন: হে আল্লাহর রাসূল! জান্নাত কি আকাশ ও জমিন পরিমাণ প্রশস্ত? উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ। তখন ‘উমাইর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, বিরাট ব্যাপার, বিরাট ব্যাপার, হে আল্লাহর রাসূল! আমার মাঝে আর জান্নাতে প্রবেশের মাঝে পার্থক্য এতটুকুই যে, ওই কাফিররা আমাকে হত্যা করবে। আমি যদি এ খেজুরগুলো খাওয়া শেষ করা পরিমান সময় জীবিত থাকি তাহলে তো অনেক লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হবে, এ কথা বলেই তিনি খেজুরগুলো নিক্ষেপ করে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন এবং নিহত হলেন, আল্লাহ তাঁর উপর সন্তুষ্ট হোন।
আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক মুষ্টি মাটি বা পাথর নিয়ে কাফির দলের প্রতি ছুঁড়ে মারলেন, রাসূলের নিক্ষিপ্ত পাথর তাদের সকলের চোখে বিদ্ধ হল। তাদের সকলের চোখেই সেটা পূর্ণ করে দিল, তারা তাদের চোখের মাটি ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল; যা ছিল আল্লাহর নিদর্শনসমূহের একটি নিদর্শন। ফলে মুশরিক সৈন্যদের পরাজয় হল এবং তারা যুদ্ধের মাঠ ছেড়ে পৃষ্ঠদেশ প্রদর্শন করে পলায়ন করল। আর মুসলিমগণ তাদের পিছু নিয়ে তাদের হত্যা ও বন্দি করা অব্যাহত রাখল। এভাবে তাদের ৭০ জন কাফির নিহত ও ৭০ জন বন্দি হল। নিহতের মধ্যকার ২৪ জন কাফির কুরাইশ নেতৃবৃন্দকে বদরের একটি নর্দমাক্ত কূপে নিক্ষেপ করা হলো। এদের মধ্যে ছিল আবূ জাহল, শায়বা ইবন রবী‘আ ও তার ভাই ‘উতবা এবং তার ছেলে অলীদ ইবন ‘উতবা।
* সহীহ বুখারীতে ‘আবদুল্লাহ ইবন মাস‘ঊদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেবলামুখী হয়ে কাফির কুরাইশদের এ চারজনের বিরুদ্ধে বদ দো‘আ করেছিলেন”। ইবন মাস‘উদ বলেন, আমি আল্লাহর সাক্ষ্য দিয়ে বলছি, নিশ্চয়ই আমি এ কাফির কুরাইশ নেতৃবৃন্দকে মৃত দেখতে পেয়েছি; সূর্য তাদের চেহারাগুলোকে পরিবর্তন করে দিয়েছিল। আর সেদিন খুব গরম ছিল।”
* অনুরূপভাবে বুখারীতে আবূ তালহা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদর যুদ্ধের দিন ২৪ জন কুরাইশ নেতৃবৃন্দকে বদরের নিকৃষ্ট কূপের মধ্যে ফেলতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিয়ম ছিল যে, তিনি কারও উপর বিজয়ী হলে সেখানে তিন দিন অবস্থান করতেন। সে অনুসারে বদরের তৃতীয় দিনে তিনি তাঁর বাহন প্রস্তুতের নির্দেশ দিলেন, তা বাঁধা হলে তিনি চলতে লাগলেন সাহাবীগণ তাঁর পিছু নিলেন। অবশেষে তিনি কূপের পার্শ্বদেশে দাঁড়ালেন এবং প্রত্যেকের নাম ও পিতার নাম ধরে ডাকলেন এবং বলতে লাগলেন, হে অমুকের পুত্র অমুক, হে অমুকের পুত্র অমুক, আজ তোমাদের জন্য কি এটা আন্দদায়ক হত না, যদি তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করতে? আমাদের রব আমাদের বিজয় দান করার ব্যাপারে যে ওয়াদা করেছিলেন, তা আমরা যথার্থ পেয়েছি। তোমরা কি তোমাদের রবের ওয়াদা পেয়েছ? ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এমন লোকদের সঙ্গে কি কথা বলছেন যাদের দেহ আছে কিন্তু আত্মা নেই? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ مَا أَنْتُمْ بِأَسْمَعَ لِمَا أَقُولُ مِنْهُمْ
ওই সত্তার শপথ! যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, আমি তাদের সঙ্গে যা বলছি, তোমরা তা তাদের চেয়ে বেশি শুনতে পাচ্ছ না।”
আর বন্দীদের ব্যাপার: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের ব্যাপারে সাহাবীদের পরামর্শ চাইলেন। সা‘দ ইবন মু‘আয রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর কাছে তাদের বিষয়টি খুবই মারাত্মক ও খারাপ মনে হয়েছে, তাই তিনি বললেন, এটাই সর্বপ্রথম ঘটনা যা আল্লাহ মুশরিকদের উপর ঘটিয়েছেন। আর যুদ্ধে রক্ত প্রবাহিত করে দেওয়া আমার কাছে তাদেরকে জীবিত রাখার চেয়েও বেশি প্রিয়।
* ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, আমি মনে করি, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার অনুমতি থাকলে আমরা কাফিরদের ঘাড়ে আঘাত করে হত্যা করব। অতএব আলীকে (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) আকীলের ব্যাপারে নির্দেশ দিন, তিনি যেন তাকে হত্যা করেন। আর আমাকে অমুকের (যিনি তার আত্মীয় ছিলেন তার) ব্যাপারে অনুমতি দিন তার ঘাড়ে আমি এখনিই আঘাত হানব। কেননা এরা সকলেই কাফির নেতৃবৃন্দ ও প্রধান ব্যক্তিবর্গ।”
* আর আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, “এরা তো আমাদেরই চাচাতো ভাই, আমাদেরই গোষ্ঠীর লোক। তাই আমি মনে করি, তাদের কাছ থেকে বিনিময় গ্রহণ করা হোক। এতে করে কাফিরদের উপর আমাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, তাছাড়া হতে পারে তাদেরকে আল্লাহ ইসলামের প্রতি হেদায়াত করবেন।”
অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিনিময় (মুক্তিপণ) গ্রহণ করলেন। তাদের সর্বোচ্চ বিনিময়ের পরিমাণ ছিল ৪০০০ দিরহাম থেকে শুরু করে ১০০০ দিরহাম পর্যন্ত।
– আর তাদের কেউ কেউ মদীনায় ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের পড়া-লেখা করানোর মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় করল।
– কেউ মুক্তি পেল কুরাইশের কাছে বন্দি মুসলিমের মুক্তির বিনিময়ে।
– আবার কাউকে মুসলিমদের প্রতি কঠিন কষ্টদায়ক আচরনের কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হত্যা করলেন।
– আবার কাউকে তিনি বিশেষ স্বার্থের কারণে দয়া করে বিনা বিনিময়েই মুক্ত করে দিলেন।
এ হচ্ছে বদর যুদ্ধ। যে যুদ্ধে অল্প সংখ্যক সৈন্যবাহিনী বেশি সংখ্যক সৈন্যবাহিনীর ওপর বিজয় অর্জন করেছিল।
﴿ فِئَةٞ تُقَٰتِلُ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَأُخۡرَىٰ كَافِرَةٞ ﴾ [ال عمران: ١٣]
‘একটি দল লড়াই করছিল আল্লাহর পথে এবং অপর দলটি কাফির। {সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩}
অল্প সংখ্যক লোকের দলটি বিজয় অর্জন করেছিল। কেননা তারা আল্লাহর দ্বীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। তারা আল্লাহর দ্বীনের কালেমা বুলন্দ করার জন্য ও আল্লাহর দ্বীনের পক্ষে প্রতিরোধ করার জন্য যুদ্ধ করেছিল। ফলে মহান আল্লাহ তাদের বিজয় দান করেছিলেন। অতএব হে মুসলিম ভাইসব! আপনারা দ্বীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকুন; যাতে আপনাদের শত্রুদের ওপর বিজয়ী হতে পারেন এবং ধৈর্য ধারণ করুন, অপরকে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দিন, স্থির থাকুন এবং আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করুন। আশা করা যায় আপনারা সফল হবেন।
হে আল্লাহ! আমাদের ইসলাম দিয়ে আমাদেরকে বিজয় দান করুন, আমাদেরকে আপনার দ্বীনের সাহায্যকারী এবং আপনার দ্বীনের দা‘ঈ হিসেবে কবুল করুন আর আপনার সাক্ষাতের সময় পর্যন্ত আপনি আমাদেরকে এ দ্বীনের ওপর অটল রাখুন।
আর আল্লাহ সালাত ও সালাম পেশ করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদ ও তার পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীর উপর।
ঊনবিংশ আসরঃমক্কা বিজয়
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন অতঃপর তা পরিমিত করেছেন। প্রতিটি সৃষ্টির অবতরণস্থল ও বের হওয়ার স্থান জেনেছেন, তিনি যা চেয়েছেন তা লাওহে মাহফুজে সন্নিবেশিত করেছেন এবং লিখে রেখেছেন। সুতরাং তিনি যা সামনে নিতে চাইবেন তা কেউ পেছাতে সক্ষম হবে না, আর তিনি যা পিছনে ফেলবেন তা কেউ এগিয়ে দিতে পারবে না। তিনি যাকে অপমান করবেন তার কোনো সাহায্যকারী নেই, আর তিনি যার সাহায্য করবেন তার কোনো অপমানকারী নেই। রাজত্ব, স্থায়ী অস্তিত্ব, সম্মান ও প্রতিপত্তিতে তিনি একক, সুতরাং যে কেউ এগুলোতে তার সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হবে তাকে তিনি তুচ্ছ বানিয়ে ছাড়বেন। সর্বজ্ঞ, সবিশেষ অবহিত সুতরাং তাঁর কাছে বান্দা যা গোপন বা লুকিয়ে রাখবে তা কোনোভাবেই গোপন থাকবে না। আমি তাঁর প্রশংসা করছি তাঁর সকল নেয়ামতের উপর যা তিনি আমাকে প্রাধান্য দিয়ে প্রদান করেছেন এবং সহজলভ্য করে দিয়েছেন।
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত কোনো হক ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই, অপরাধীর তাওবা কবুল করেছেন, তাকে তার গুনাহ থেকে মুক্ত করেছেন এবং তাকে ক্ষমা করেছেন। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল; যার মাধ্যমে তিনি হেদায়াতের পথ স্পষ্ট করে দিয়েছেন এবং আলোকিত করেছেন। আর তার মাধ্যমে শির্কের অন্ধকার ও তমাসা দূর করেছেন। আর তিনি তাঁর হাতে মক্কা বিজয়ের গৌরব তুলে দিয়েছেন, ফলে আল্লাহর ঘর থেকে মূর্তি দূর করেছেন এবং ঘরকে পবিত্র করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা তার উপর সালাত পেশ করুন, তাঁর পরিবার-পরিজনের উপর, অনুরূপ তাঁর সৎকর্মশীল সম্মানিত সাহাবীগণের উপর, আর তাঁদের সুন্দর অনুসারীর উপর, যতদিন চাঁদের পূর্ণতা ও সূক্ষ্মতা চলবে ততদিন পর্যন্ত। আর আল্লাহ তাদের উপর যথাযথ সালামও প্রদান করুন।
প্রিয় ভাইয়েরা! যেমনিভাবে এ রমযান মাসে বদর প্রান্তে যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছে; যাতে ইসলামকে বিজয়ী করা হয়েছে এবং তার মিনার বুলন্দ হয়েছে, তেমনিভাবে অষ্টম হিজরীর এ মাসে নিরাপদ নগরী মক্কা বিজয়ের যুদ্ধও অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ বিজয়ের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা মক্কা নগরীকে শির্কমুক্ত ইসলামী শহরে পরিণত করেন। যেখানে শির্কের পরিবর্তে একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কুফরীর পরিবর্তে ঈমান, অহংকারের পরিবর্তে ইসলাম তথা আত্মসমর্পন প্রতিষ্ঠিত হয়। এক মহাপ্রতাপশীল আল্লাহর ইবাদত ঘোষিত হলো, শির্কী মুর্তিগুলো এমনভাবে ভেঙে ফেলা হলো যে সেগুলো আর কোনোদিন জোড়া লাগেনি।
এ মহান বিজয়ের কারণ সম্পর্কে বলা হয়, যখন ৬ষ্ঠ হিজরীতে হুদায়বিয়া প্রান্তরে কুরাইশ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাঝে সন্ধি হয়, তখন কেউ স্বেচ্ছায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের দলভুক্ত হল আবর কেউ কুরাইশের দলভুক্ত। খুযা‘আ গোত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের দলে যোগ দিল এবং বনু বকর কুরাইশের দলে যোগ দিল।
এ গোত্রদ্বয়ের মাঝে জাহেলিয়্যাতের যুগে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ছিল। বনূ বকর এ সন্ধির সুযোগকে কাজে লাগাল এবং খুযা‘আর ওপর নিরাপদ অবস্থায় হামলা করে বসল। কুরাইশরা গোপনে তাদের দলভুক্ত বনূ বকরকে জনশক্তি ও অস্ত্র দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের দলভুক্ত খুযা‘আকে আক্রমণে সাহায্য করল। অতঃপর খুযা‘আ গোত্রের একটি প্রতিনিধি দল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বনূ বকরের কার্যক্রম ও কুরাইশের সাহায্য সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমি অবশ্যই তোমাদের পক্ষ হয়ে তোমাদের থেকে প্রতিরোধ করব যেভাবে আমি নিজের ব্যাপারে প্রতিরোধ করে থাকি।”
কিন্তু কুরাইশ; তারা বিপদ আঁচ করতে পারল ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলো, তারা বুঝতে পারল যে, তারা তাদের এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে হুদায়বিয়ার সন্ধি ভঙ্গ করে ফেলেছে। তাই তারা তাদের আবূ সুফিয়ানকে সন্ধি পুনর্বহাল ও মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পাঠালো। আবু সুফিয়ান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলল। কিন্তু রাসূল তার কথার কোনো উত্তর দিলেন না। এরপর সে আবূ বকর ও উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার সাথে কথা বলল; যাতে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সুপারিশ করে কিন্তু তাতেও সে সফল হতে পারলো না, তারপর সে আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর সুপারিশ চেয়েও কাজ হল না। তখন আবূ সুফিয়ান আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বলল, হে হাসানের পিতা! তোমার কী অভিমত? তখন তিনি বললেন, আমি এমন কিছু দেখি না যা তোমার কাজে আসবে। কিন্তু তুমি বনী কেনানার সর্দার। তুমি যাও আর লোকদেরকে নিরাপত্তা ও আশ্রয় দাও। আবূ সুফিয়ান বলল, আপনি কি মনে করেন এটা আমার কোনো কাজে আসবে? উত্তরে আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন: না, আল্লাহর শপথ! কিন্তু এ-ছাড়া অন্য কিছু তোমার জন্য আমি পাচ্ছি না। অতঃপর আবূ সুফিয়ান তা-ই করল এবং কুরাইশদের কাছে ফিরে গেল। তখন কুরাইশের লোকেরা বলল, তোমার অভিযানের সংবাদ কী? আবূ সুফিয়ান বলল, আমি মুহাম্মাদের কাছে গিয়েছি এবং কথাবার্তা বলেছি। আল্লাহর কসম তিনি কোনো উত্তর দেন নি। অতঃপর আমি ইবন আবি কুহাফা (আবু বকর) ও ইবনুল খাত্তাবের কাছে গিয়েছি, তার থেকেও কোনো ভালো কিছু পাইনি। অতঃপর আমি আলীর কাছে গিয়েছি, তিনি আমাকে একটি বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন; যা আমি করেছি। আমি মানুষদেরকে পরস্পরের থেকে নিরাপত্তা ও আশ্রয় দিয়েছি। তখন তারা বলল, মুহাম্মদ কী এ ব্যাপারে অনুমতি দিয়েছেন? সে বলল, না। তখন তারা বলল, তুমি ধ্বংস হও, তুমি কোনো কাজ করতে পারো নি। বরং সে (আলী) তোমার সঙ্গে তামাশা করেছে।
এদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীগণকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার হুকুম দিলেন। তাদেরকে তাঁর ইচ্ছা সম্পর্কে অবহিত করলেন। আর তিনি তাঁর চারপাশের গোত্রসমূহকেও যুদ্ধের জন্য বের হওয়ার আহ্বান জানালেন। এরপর এ বলে দো‘আ করলেন, “হে আল্লাহ! কুরাইশ গুপ্তচরদের কাছে আমাদের এ সংবাদ পৌঁছা বন্ধ কর, যাতে আমরা হঠাৎ করে তাদের দেশে পৌঁছুতে পারি।”
তারপর তিনি মদীনা থেকে প্রায় দশ হাজার যোদ্ধা সাহাবী নিয়ে বের হলেন। আর আব্দুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতূমকে মদীনার দায়িত্ব প্রদান করেন।
পথিমধ্যে তিনি যখন ‘জুহফা’য় ছিলেন, তখন তাঁর চাচা আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল, তিনি সপরিবারে ইসলাম গ্রহণ করে হিজরত করে মদীনা আসছিলেন। অতঃপর যখন তিনি আবওয়া নামক স্থানে পৌঁছলেন তখন রাসূলের চাচা আবু সুফিয়ান ইবনুল হারেস ইবনে আবদিল মুত্তালিব ও তাঁর ফুফাতো ভাই আবদুল্লাহ ইবন আবি উমাইয়্যা তার সাথে সাক্ষাৎ করলেন। তারা উভয়েই ছিল তাঁর ঘোর শত্রু; কিন্তু তারা উভয়ে ইসলাম গ্রহণ করল। রাসূল তাদের ইসলাম গ্রহণ মেনে নিলেন। তিনি আবু সুফিয়ান ইবনুল হারেস সম্পর্কে বললেন, “আমি আশা করি তিনি হামযার স্থলাভিষিক্ত হবেন”।
তারপর যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার নিকটবর্তী “মাররুয যাহরান” নামক স্থানে পৌঁছলেন, তখন তিনি সৈন্য বাহিনীকে আগুন জ্বালাতে নির্দেশ দিলেন, তারা ১০,০০০ আগুনের চুলা জ্বালালেন। আর মুসলিম সেনাবাহিনীর প্রহরায় উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে নিযুক্ত করলেন। আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের খচ্চরে আরোহণ করে এমন এক ব্যক্তিকে তালাশ করতে লাগলেন যে কুরাইশদের কাছে এ সংবাদ নিয়ে যাবে যে, তারা যেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মুখে এসে যুদ্ধ পরিহার করে নিরাপত্তা চায়। যাতে মক্কায় যুদ্ধ-বিগ্রহ ও রক্তপাত না ঘটে। আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু চলতে চলতে হঠাৎ আবূ সুফিয়ান (ইবনে হারব) এর কথার আওয়াজ শুনলেন, সে বুদাইল ইবন ওয়ারাকাকে বলছে, “গত রাতের মতো এত আগুন প্রজ্জ্বলিত হতে আমি আর কখনো দেখিনি। তখন বুদাইল বলল, এ তো খোযা‘আ গোত্র। আবূ সুফিয়ান বলল, খোযা‘আরা তো এরচেয়ে অনেক কম ও হীন লোক। আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আবূ সুফিয়ানদের আওয়াজ বুঝতে পেরে ডাকলেন, আবূ সুফিয়ান বলল, হে আবূল ফযল! তোমার কী হয়েছে? আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, এই তো আল্লাহর রাসূল সকলের মাঝে উপস্থিত। আবূ সুফিয়ান বলল, এখন আমি কী করব? আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, আমার সঙ্গে চল, আমি তোমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে যাব এবং তোমার জন্য নিরাপত্তা চাইব। এরপর আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে এলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে আবূ সুফিয়ান তোমার জন্য ধ্বংস, এখনো কি তোমার বুঝে আসেনি যে, আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া সত্যিকারের কোনো মা‘বুদ নেই? উত্তরে আবূ সুফিয়ান বলল, আপনার প্রতি আমার পিতামাতা উৎসর্গ হোক! আপনি কতই না সহিষ্ণু, সম্মানিত ও আত্মীয়পরায়ণ। আমি ভালোভাবে জানি যে, যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ থাকত, তাহলে এখন সে আমার কাজে লাগত।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি কি এখনো বুঝতে পারোনি যে আমি আল্লাহর রাসূল? এ কথা শুনে আবূ সুফিয়ান ইতস্তত করতে লাগলেন। তাকে উদ্দেশ করে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, তোমার জন্য ধ্বংস; ইসলাম গ্রহণ কর। এরপর আবূ সুফিয়ান কালেমায়ে শাহাদাৎ পাঠ করে ইসলাম গ্রহণ করলেন।’
পরক্ষণেই রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে নির্দেশ দিলেন, তিনি যেন আবূ সুফিয়ানকে নিয়ে পাহাড়ের সংকীর্ণ উপত্যকায় অবস্থান করেন এবং মানুষ যেন তার পাশ দিয়ে যাতায়াত করে। এরপর তার পাশ দিয়ে বিভিন্ন গোত্রের লোকজন তাদের ঝান্ডাসহ অতিক্রম করতে লাগল। যে গোত্রই অতিক্রম করত আবূ সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে গোত্রের পরিচিতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন, তখন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু উভয়ের মাঝে পরিচয় করিয়ে দিতেন। আর আবু সুফিয়ান বলতেন, ‘আমাদের মাঝে ও তাদের কী হলো’? ইতোমধ্যে একটি কাফেলা তার মুখোমুখি হলে আবু সুফিয়ান জিজ্ঞাসা করলেন এরা কারা?
আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, এরা হলো মদীনার আনসার, তাদের নেতা হলেন সা‘দ ইবন উবাদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তার সঙ্গেই ঝান্ডা ছিল, যখন সা‘দ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তার পাশাপাশি আসলেন, তখন তিনি বললেন, হে আবূ সুফিয়ান! আজকের দিন ধ্বংসযজ্ঞের দিন, আজ কা‘বায় রক্তপাত হালাল করা হয়েছে।
অতঃপর ছোট অথচ সম্মানিত একটি কাফেলা এলো যাদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবায়ে কিরামও ছিলেন। তাদের ঝান্ডা ছিল যুবায়ের ইবন ‘আওয়াম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর হাতে। যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবূ সুফিয়ানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, আবু সুফিয়ান তখন তাকে সা‘দ ইবন ‘উবাদা রাদিয়াল্লাহু যা বলেছিলেন সে সম্পর্কে রাসূলকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন:
كَذَبَ سَعْدٌ، وَلَكِنْ هَذَا يَوْمٌ يُعَظِّمُ اللَّهُ فِيهِ الكَعْبَةَ، وَيَوْمٌ تُكْسَى فِيهِ الكَعْبَةُ
‘সা‘দ ভুল বলেছে, বরং আজ এমন এক দিন যাতে আল্লাহ তা‘আলা কা‘বাকে সম্মানিত করেছেন। আজ কা‘বাকে গিলাফাচ্ছাদিত করা হবে।’
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সা‘দ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর হাত থেকে ঝান্ডা নিয়ে তার ছেলে কায়েসের হাতে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। তিনি লক্ষ্য রাখছিলেন যে যখন ঝান্ডাটা তার ছেলের হাতে দেয়া হচ্ছিল তখন তা সম্পূর্ণরূপে সা‘দ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর হস্তচ্যুত হয় নি।
তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সামনে অগ্রসর হলেন, তিনি তাঁর ঝাণ্ডাটি ‘হাজুন’ নামক স্থানে স্থাপন করতে বললেন। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দৃঢ়পদে বিজয়ী বেশে মক্কায় প্রবেশ করছিলেন। তিনি সেখানে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি বিনীত হয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে প্রবেশ করছিলেন। এমনকি তাঁর মাথা বাহনের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল এবং তিনি উঁচু আওয়াজে বার বার পড়ছিলেন:
﴿ إِنَّا فَتَحۡنَا لَكَ فَتۡحٗا مُّبِينٗا ١ ﴾ [الفتح: ١]
‘নিশ্চয় আমি তোমাকে সুস্পষ্ট বিজয় দিয়েছি।’ {সূরা আল-ফাতহ, আয়াত: ১}
তিনি মক্কা নগরীর এক প্রান্তে খালিদ ইবন ওয়ালিদ রা. এবং অন্য প্রান্তে যোবায়ের ইবন ‘আওয়াম রা. কে প্রেরণ করে এ ঘোষণা দিতে বললেন, “যে ব্যক্তি মাসজিদে হারাম তথা বায়তুল্লাহতে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ। যে আবূ সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ। আর যে ব্যক্তি নিজের ঘরে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করবে সেও নিরাপদ।”
এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সামনে অগ্রসর হয়ে মসজিদে হারামে প্রবেশ করে তিনি তার বাহনের উপর থেকেই তাওয়াফ করলেন। তখন বাইতুল্লাহর পাশে ৩৬০টি মূর্তি ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সঙ্গে থাকা ধনুকের অগ্রভাগ দিয়ে মূর্তিগুলোর গায়ে আঘাত করে তিরস্কার করে বলছিলেন:
﴿جَآءَ ٱلۡحَقُّ وَزَهَقَ ٱلۡبَٰطِلُۚ إِنَّ ٱلۡبَٰطِلَ كَانَ زَهُوقٗا ٨١ ﴾ [الاسراء: ٨١]
‘হক এসেছে এবং বাতিল বিলুপ্ত হয়েছে। নিশ্চয় বাতিল বিলুপ্ত হওয়ারই ছিল’। {সূরা বানী ইসরাঈল, আয়াত: ৮১} আরও পড়লেন,
﴿جَآءَ ٱلۡحَقُّ وَمَا يُبۡدِئُ ٱلۡبَٰطِلُ وَمَا يُعِيدُ ٤٩ ﴾ [سبا: ٤٩]
‘সত্য এসেছে এবং বাতিল কিছু সৃষ্টি করতে পারে না, আর কিছু পুনরাবৃত্তিও করতে পারে না’।’ {সূরা সাবা’, আয়াত: ৪৯} আর তখন মূর্তিগুলো আপনা আপনি মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছিল।
এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কা‘বার ভিতরে প্রবেশ করলেন। তিনি সেখানে কিছু ছবি দেখতে পেলেন। তিনি সেগুলোকে মিটিয়ে দেবার নির্দেশ দিলে তা নিশ্চিহ্ন করা হলো। তারপর তিনি সেখানে সালাত আদায় করলেন; সালাত শেষ করার পর তিনি কা‘বার বিভিন্ন দিকে ঘুরে ফিরে দেখলেন এবং সবদিকে তাওহিদের বাণী উচ্চারণ করলেন। তারপর তিনি বায়তুল্লাহর দরজার উপর আসলেন, আর কুরাইশরা ছিল তাঁর নীচে; তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি করেন তা প্রত্যক্ষ করার অপেক্ষায় ছিল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কা‘বার দরজার দুপাল্লা ধরে বললেন: একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্যিকারের মা‘বুদ নেই। তাঁর কোনো শরীক নেই। সকল রাজত্ব তাঁরই, তাঁর জন্যই সকল প্রশংসা, তিনি সকল বিষয়ে ক্ষমতাবান। তিনি স্বীয় ওয়াদা সত্য করে দেখিয়েছেন। স্বীয় বান্দার সাহায্য করেছেন। একাকী সমস্ত শত্রু বাহিনীকে পরাজিত করেছেন। হে কুরাইশ সম্প্রদায়! আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের থেকে জাহিলিয়্যাতের অহমিকা ও পূর্বপুরুষদের নিয়ে অহংকার দূর করে দিয়েছেন। সকল মানুষ আদম ‘আলাইহিস সালাম থেকে জন্ম নিয়েছে। আর আদম ‘আলাইহিস সালাম মাটির তৈরি।
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنَّا خَلَقۡنَٰكُم مِّن ذَكَرٖ وَأُنثَىٰ وَجَعَلۡنَٰكُمۡ شُعُوبٗا وَقَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوٓاْۚ إِنَّ أَكۡرَمَكُمۡ عِندَ ٱللَّهِ أَتۡقَىٰكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٞ ١٣﴾ [الحجرات: ١٣]
‘হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে এক নারী ও এক পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি; যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়াসম্পন্ন। নিশ্চয় আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত।’ [সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত ১৩]
তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে কুরাইশ সম্প্রদায়! আমার সম্পর্কে তোমাদের কী ধারণা? আমি তোমাদের সঙ্গে কেমন আচরণ করব? তারা বলল, আমরা শুধু উত্তমই আশা করি, সম্মানিত ভাই এবং সম্মানিত ভাতুষ্পুত্র। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি তোমাদের তেমনি বলব যেমন ইউসূফ ‘আলাইহিস সালাম তাঁর ভাইদের উদ্দেশে বলেছিলেন:
﴿لَا تَثۡرِيبَ عَلَيۡكُمُ ٱلۡيَوۡمَۖ يَغۡفِرُ ٱللَّهُ لَكُمۡ﴾ [يوسف: ٩٢]
‘আজ তোমাদের প্রতি কোনো ভর্ৎসনা নেই, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। {সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৯২} তোমরা যাও, তোমরা মুক্ত। তোমাদের থেকে কোনো প্রতিশোধ নেওয়া হবে না।’
মক্কা বিজয়ের দ্বিতীয় দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভাষণ দেওয়ার জন্য দাঁড়ালেন। প্রথমে আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা ও স্তুতি পেশ করলেন এরপর বললেন, “নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা মক্কা নগরীকে সম্মানিত করেছেন। কোনো মানুষ তা সম্মানিত ঘোষণা করে নি। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের উপর ঈমান রাখে, তার জন্য এখানে রক্তপাত এবং গাছ কর্তন করা বৈধ নয়। সুতরাং তোমাদের কেউ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুদ্ধের কারণে এখানে যুদ্ধের অবকাশ চাইলে তাকে বলবে, আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় রাসূলকে অনুমতি দিয়েছিলেন, তোমাদের অনুমতি দেন নি। তিনি বললেন, আমাকে দিনের কিছু অংশ অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। আজ মক্কার হুরমত ও সম্মান পুনরায় বহাল হলো, যেমনটি গতকাল ছিল। তোমাদের উপস্থিতরা যেন আমার বাণী অনুপস্থিতদের কাছে পৌঁছে দেয়।”
আর যে সময়টুকু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য মক্কায় যুদ্ধ হালাল করা হয়েছিল, তা হলো বিজয়ের দিন সূর্যোদয় থেকে নিয়ে ওই দিন আসর পর্যন্ত। এরপর তিনি মক্কায় ১৯ দিন অবস্থান করেছিলেন এবং তখন সালাত কসর করেছিলেন।” আর মাসের অবশিষ্ট দিনগুলোতে তিনি সিয়ামও পালন করেন নি।” কেননা তখনও তিনি সফর শেষ করার নিয়ত করেন নি। তিনি সেখানে অবস্থান করেছিলেন তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদের শিক্ষাকে সুদৃঢ় করা, ইসলামের ভিত্তি অন্তরে বদ্ধমূল করে দেয়া, ঈমান দৃঢ় করা এবং মানুষের কাছ থেকে বাই‘আত গ্রহণ করার জন্য।
* সহীহ বুখারীতে মুজাশে‘ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর বর্ণনায় উল্লেখিত হয়েছে, তিনি বলেন, “আমি আমার ভাইকে নিয়ে মক্কা বিজয়ের পর হিজরতের জন্য বাই‘আত গ্রহণের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এলে তিনি বললেন, “হিজরতকারীরা হিজরতের সকল কল্যাণ নিয়ে অগ্রগামী হয়ে গেছে। তাই এখন আমি তাকে ইসলাম, ঈমান ও জিহাদের ওপর বাইয়াত গ্রহণ করছি।”
আর এ প্রকাশ্য বিজয়ের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য পূর্ণাঙ্গ রূপ ফেলো, লোকেরা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করতে লাগল। আর আল্লাহর নগরী মক্কা পুনরায় ইসলামী রুপান্তরিত হলো; যেখানে আল্লাহ তা‘আলার একত্ববাদ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্যতা এবং আল্লাহর কিতাবের দৃঢ়তার ঘোষণা প্রদত্ত হলো। আর এর ক্ষমতা মুসলিমদের হাতে চলে এলো। শির্ক দূরীভূত হলো এবং তার আঁধার বিলুপ্ত হলো। আল্লাহই সবচে বড়, আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা; আর এটি কিয়ামতাবধি তাঁর বান্দাদের ওপর তাঁর রহমতের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
হে আল্লাহ! আমাদের এ মহান নিয়ামতের শুকরিয়া আদায়ের তাওফীক দিন। সব জায়গায় সব সময় মুসলিম উম্মাহর বিজয় নিশ্চিত করুন। আমাদের ও আমাদের পিতামাতা এবং সকল মুসলিমকে আপনার দয়ায় ক্ষমা করুন, হে পরম করুণাময়।
আর আল্লাহ সালাত ও সালাম বর্ষণ করুন আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবীগণের ওপর।
বিংশ আসরঃআল্লাহর সাহায্য প্রাপ্তির প্রকৃত কারণসমূহ
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি তাঁর মর্যাদায় মহান, তাঁর দমনে প্রবল পরাক্রমশালী, বান্দার গোপন ও প্রকাশ্য সকল অবস্থা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানী, জিহাদকারীর উপর বিজয় প্রদানের মাধ্যমে বদান্যতা প্রদর্শনকারী, তাঁর জন্য বিনয় অবলম্বনকারীকে উঁচু মর্যাদায় আসীনকারী, তিনি ছত্র লেখার সময় কলমের খচখচ শব্দ শুনতে পান, জনমানবহীন মরুপ্রান্তরে পিপড়ার চলার গতি দেখতে পান। আমি তার প্রশংসা করছি তাকদীরের ফয়সালা, তা মিষ্ট হোক কিংবা তিক্ত।
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত কোনো হক ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই, এ সাক্ষ্য তার স্মরণকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল, যাকে তিনি জলে-স্থলে সর্বস্থানের সৃষ্টিকুলের প্রতি রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছেন।
আল্লাহ তাঁর উপর সালাত পেশ করুন আর তাঁর সাথী আবু বকরের উপর, যিনি তাঁর অন্তরে আছড়ে পড়া ঈমান নিয়ে সর্বপ্রথম সাড়া দিয়েছিলেন, অনুরূপ ‘উমারের উপর, যিনি তাঁর সাবধানতা ও নিয়ন্ত্রণক্ষমতা দ্বারা ইসলামকে সম্মানিত করেছেন, আর উসমানের উপর, যিনি ছিলেন দুই নূরের মালিক, কঠিন বিপদের মধ্যে নিজের বিষয়ে পূর্ণ ধৈর্যশীল। তদ্রূপ আলীর উপর, যিনি ছিলেন তাঁর চাচাতো ভাই ও জামাতা। আর তাঁর সকল পরিবার-পরিজনের উপর, সকল সাহাবীর উপর এবং তাদের সকল সুন্দর অনুসারীর উপর যতদিন মেঘ তার বৃষ্টি নিয়ে বদান্যতা দেখাবে। আর আল্লাহ তাদের সবার উপর যথাযথ সালামও প্রদান করুন।
প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা! আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের বহু স্থানে সাহায্য করেছেন। যেমন, বদর, আহযাব, মক্কা বিজয় ও হুনাইনের যুদ্ধসহ অন্যান্য স্থানে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদেরকে তার কৃত অঙ্গীকার পূরণার্থে,
* তিনি বলেছেন:
﴿ وَكَانَ حَقًّا عَلَيۡنَا نَصۡرُ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ ٤٧ ﴾ [الروم: ٤٧]
‘আর মুমিনদের সাহায্য করা আমার কর্তব্য।’ {সূরা আর-রূম, আয়াত: ৪৭}
* আরও বলেন,
﴿إِنَّا لَنَنصُرُ رُسُلَنَا وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا وَيَوۡمَ يَقُومُ ٱلۡأَشۡهَٰدُ ٥١ يَوۡمَ لَا يَنفَعُ ٱلظَّٰلِمِينَ مَعۡذِرَتُهُمۡۖ وَلَهُمُ ٱللَّعۡنَةُ وَلَهُمۡ سُوٓءُ ٱلدَّارِ ٥٢﴾ [غافر: ٥١، ٥٢]
“নিশ্চয় আমরা আমাদের রাসূলদেরকে এবং যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে সাহায্য করব দুনিয়ার জীবনে, আর যেদিন সাক্ষীগণ দাঁড়াবে। যেদিন যালিমদের ‘ওজর-আপত্তি তাদের কোন কাজে আসবে না। আর তাদের জন্য রয়েছে লা‘নত এবং তাদের জন্য রয়েছে নিকৃষ্ট আবাস।”। {সূরা গাফের:৫১-৫২}
আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে এ কারণে সাহায্য করেছেন যে, মুমিনরা তাদের দ্বীন ইসলামের উপর অটল থেকেছে। আর ইসলাম এমন একটি দ্বীন যাহা অন্যসব দ্বীনের উপর বিজয়ী। অতঃপর যে ব্যক্তি এ মহান দ্বীনকে আকড়ে ধরেছে সে অবশ্যই অন্যান্য জাতির উপর বিজয়ী হবে।
﴿ هُوَ ٱلَّذِيٓ أَرۡسَلَ رَسُولَهُۥ بِٱلۡهُدَىٰ وَدِينِ ٱلۡحَقِّ لِيُظۡهِرَهُۥ عَلَى ٱلدِّينِ كُلِّهِۦ وَلَوۡ كَرِهَ ٱلۡمُشۡرِكُونَ ٣٣ ﴾ [التوبة: ٣٣]
“তিনিই সে মহান সত্তা যিনি তার রাসূলকে প্রেরণ করেছেন হেদায়াত ও সত্যদ্বীনসহ যেন তিনি অন্যসব দ্বীনের উপর দ্বীন ইসলামকে বিজয়ী করতে পারেন। যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে থাকে।”
মহান আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করেন; কেননা তারা বস্তুগত ও মানসিক উভয় প্রকার সাহায্য ও বিজয় লাভের উপকরণ নিয়ে আল্লাহর জন্য দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁদের কাছে ছিল এমন দৃঢ়তা যা তাদেরকে শত্রুদের বিরুদ্ধে জয়ী করেছিল। তারা গ্রহণ করেছিল আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে তাদের জন্য প্রদত্ত দিক-নির্দেশনা, তারা তাঁর দেওয়া হেদায়াত অনুসারে চলেছিল আর তিনি তাদেরকে সৃদৃঢ় করেছিলেন।
﴿ وَلَا تَهِنُواْ وَلَا تَحۡزَنُواْ وَأَنتُمُ ٱلۡأَعۡلَوۡنَ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِينَ ١٣٩ إِن يَمۡسَسۡكُمۡ قَرۡحٞ فَقَدۡ مَسَّ ٱلۡقَوۡمَ قَرۡحٞ مِّثۡلُهُۥۚ وَتِلۡكَ ٱلۡأَيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيۡنَ ٱلنَّاسِ﴾ [ال عمران: ١٣٩، ١٤٠]
“আর তোমরা নিষ্ঠুর হয়ো না, হতাশ হয়ো না। আর তোমরাই বিজয়ী হবে; যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক। যদি তোমাদেরকে আঘাত স্পর্শ করে থাকে তবে তোমাদের মতই তাদের উপরও ইতিপূর্বে আঘাত এসেছিল। আর এভাবেই আমরা দিনগুলো মানুষের মাঝে চক্রাকারে ঘুরিয়ে থাকি।” {সূরা আলে-ইমরান: ১৩৯-১৪০}
﴿ وَلَا تَهِنُواْ فِي ٱبۡتِغَآءِ ٱلۡقَوۡمِۖ إِن تَكُونُواْ تَأۡلَمُونَ فَإِنَّهُمۡ يَأۡلَمُونَ كَمَا تَأۡلَمُونَۖ وَتَرۡجُونَ مِنَ ٱللَّهِ مَا لَا يَرۡجُونَۗ وَكَانَ ٱللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا ١٠٤ ﴾ [النساء: ١٠٤]
“আর আর শত্রু সম্প্রদায়ের সন্ধানে তোমরা হতোদ্যম হয়ো না। যদি তোমরা যন্ত্রণা পাও তবে তারাও তো তোমাদের মতই যন্ত্রণা পায় এবং আল্লাহ্‌র কাছে তোমরা যা আশা কর ওরা তা আশা করে না। আর আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।” {সূরা আন-নিসা: ১০৪}
﴿ فَلَا تَهِنُواْ وَتَدۡعُوٓاْ إِلَى ٱلسَّلۡمِ وَأَنتُمُ ٱلۡأَعۡلَوۡنَ وَٱللَّهُ مَعَكُمۡ وَلَن يَتِرَكُمۡ أَعۡمَٰلَكُمۡ ٣٥ إِنَّمَا ٱلۡحَيَوٰةُ ٱلدُّنۡيَا لَعِبٞ وَلَهۡوٞۚ﴾ [محمد: ٣٥، ٣٦]
“কাজেই তোমরা হীনবল হয়ো না এবং সন্ধির প্রস্তাব করো না, যখন তোমরা প্রবল; আর আল্লাহ্ তোমাদের সঙ্গে আছেন এবং তিনি তোমাদের কর্মফল কখনো ক্ষুণ্ণ করবেন না। দুনিয়ার জীবন তো শুধু খেল-তামাশা।” {সূরা মুহাম্মাদ: ৩৫-৩৬}
সুতরাং তারা এ শক্তি ও সৃদৃঢ়করণ দ্বারা শক্তি, দৃঢ়তা ও পূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে পথ চলেছিল এবং সব ধরণের শক্তি থেকে কিছু অংশ নিতে সক্ষম হয়েছিল।
* এ ব্যাপারে তারা আল্লাহর নির্দেশের আনুগত্য করেছেন। তিনি বলেন,
﴿ وَأَعِدُّواْ لَهُم مَّا ٱسۡتَطَعۡتُم مِّن قُوَّةٖ﴾ [الانفال: ٦٠]
“আর তোমরা তোমাদের সাধ্যানুযায়ী শক্তি সামর্থ্য নিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ কর।” {সূরা আল-আনফাল: ৬০।}
আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে অপ্রকাশ্য আত্মশক্তি এবং প্রকাশ্য সৈন্যশক্তি দিয়ে যুদ্ধে সাহায্য করেছিলেন; কারণ তারা তার দ্বীনকে সাহায্য-সহযোগিতায় নিজেদের নিয়োজিত করেছিল।
* আল্লাহ বলেন,
﴿وَلَيَنصُرَنَّ ٱللَّهُ مَن يَنصُرُهُۥٓۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ ٤٠ ٱلَّذِينَ إِن مَّكَّنَّٰهُمۡ فِي ٱلۡأَرۡضِ أَقَامُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتَوُاْ ٱلزَّكَوٰةَ وَأَمَرُواْ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَنَهَوۡاْ عَنِ ٱلۡمُنكَرِۗ وَلِلَّهِ عَٰقِبَةُ ٱلۡأُمُورِ ٤١ ﴾ [الحج: ٤٠، ٤١]
“আর অবশ্যই আল্লাহ তাদের সাহায্য করবেন যারা আল্লাহকে সাহায্য করবে, নিশ্চয় আল্লাহ শক্তিশালী ও প্রবল পরাক্রমশালী। যাদেরকে আমরা যমীনের বুকে প্রতিষ্ঠিত করলে তারা সালাত প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত প্রদান করে, সৎ কাজের আদেশ দেয় ও অসৎ কাজের নিষেধ করে। আর আল্লাহর জন্যই সকল কাজের পরিণাম ফল নির্ধারিত হয়ে আছে।” {সূরা আল-হজ: ৪০-৪১}
উল্লেখিত আয়াত দু’টিতে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে বিজয় ও সাহায্য করার ওয়াদা দিচ্ছেন যারা তার দ্বীনকে সাহায্য করবে। আর এ ওয়াদা শব্দগত ও অর্থগত সবধরণের তাগিদের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে।
তন্মধ্যে শব্দগত তাগিদ হচ্ছে: গোপন শপথ, কারণ, এখানে অর্থ হচ্ছে, “আল্লাহর শপথ অবশ্যই অবশ্যই আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করবেন যারা আল্লাহকে সাহায্য করে।” অনুরূপভাবে ‘লাইয়ানসুরান্না’ শব্দের মধ্যে ‘লাম’ এবং ‘নূন’ নিয়ে আসা হয়েছে, যা তাগিদের জন্য ব্যবহৃত হয়।
আর অর্থগত তাকিদ হচ্ছে: মহান আল্লাহর বাণী, إِنَّ ٱللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ “নিশ্চয় আল্লাহ শক্তিশালী ও প্রবল পরাক্রমশালী” এ কথার মধ্যে। এর দ্বারা বোঝা গেল যে, মহান আল্লাহ শক্তিমান তাকে কেউ দুর্বল করতে পারে না, তিনি প্রবল প্রতাপশালী তাকে কেউ হীন করার ক্ষমতা রাখে না। সুতরাং যে কোনো শক্তি ও প্রতাপ তাঁর বিপরীতে দাঁড়াতে চাইবে সে অবশ্যই অপমানিত ও দুর্বল হতে বাধ্য।
* অনুরূপভাবে আল্লাহর বাণী, وَلِلَّهِ عَٰقِبَةُ ٱلۡأُمُورِ “আর আল্লাহর জন্যই সকল কাজের পরিণাম ফল নির্ধারিত হয়ে আছে”। এর মাধ্যমে মুমিনদের অন্তরকে সুদৃঢ় করা হয়েছে, যখন মুমিনের দৃষ্টিতে সাহায্য আসা সুদূর পরাহত মনে হবে, কারণ তার সাহায্য আসার মত উপায়-উপকরণ অবলম্বন করতে পারে নি। তাই আল্লাহ তা‘আলা মুমিনকে সান্ত্বনা ও তার অন্তরকে দৃঢ়তা প্রদান করার জন্যই বলেছেন, সবকিছুর শেষ পরিণাম তো আল্লাহর হাতেই, সুতরাং তিনি তাঁর প্রজ্ঞা অনুসারে যখন ইচ্ছা অবস্থা পরিবর্তন করে দিতে সক্ষম।
আর এ আয়াত দুটিতে: যে সব গুণাবলী থাকলে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়ার অধিকারী হয় তার বর্ণনা রয়েছে। মুমিন এগুণগুলো যমীনের বুকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অর্জন করবে, সুতরাং যমীনের বুকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে সে যেন গর্ব, অহংকার, অহমিকা, সীমালঙ্গন ও ফেতনা-ফাসাদে জড়িত না হয়, বরং এ প্রতিষ্ঠিত হওয়া যেন আল্লাহর দ্বীনের জন্য শক্তিবর্ধক হিসেবে কাজ করে এবং দ্বীনকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে, এটাই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।
আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার জন্য অপরিহার্য গুণাবলি:
প্রথম গুণ: “যাদেরকে আমরা যমীনের বুকে প্রতিষ্ঠিত করলে তারা সালাত প্রতিষ্ঠা করে।”
তবে যমীনে প্রতিষ্ঠা লাভের পূর্বশর্ত হচ্ছে, একমাত্র আল্লাহর ইবাদত বাস্তবায়ণ করা। ইবাদত শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট না করা (অর্থাৎ শির্ক বন্ধ না করা) পর্যন্ত যমীনের বুকে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারবে না। যেমন,
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَعَدَ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مِنكُمۡ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ لَيَسۡتَخۡلِفَنَّهُمۡ فِي ٱلۡأَرۡضِ كَمَا ٱسۡتَخۡلَفَ ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِهِمۡ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمۡ دِينَهُمُ ٱلَّذِي ٱرۡتَضَىٰ لَهُمۡ وَلَيُبَدِّلَنَّهُم مِّنۢ بَعۡدِ خَوۡفِهِمۡ أَمۡنٗاۚ يَعۡبُدُونَنِي لَا يُشۡرِكُونَ بِي شَيۡ‍ٔٗاۚ﴾ [النور: ٥٥]
‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনবে এবং সৎকাজ করবে, তাদের সঙ্গে আল্লাহর ওয়াদা হলো, আল্লাহ অবশ্যই পৃথিবীতে তাদেরকে প্রতিনিধি বানাবেন, যেমন পূর্ববর্তীদের বানিয়েছিলেন। আর তাদের জন্য মনোনীত দ্বীন (ইসলাম) কে তিনি তাদের জন্য প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন, তাদের ভয়-ভীতির পরিবর্তে নিরাপত্তা দান করবেন, যারা শুধুমাত্র আমার ইবাদত করবে, আমার সঙ্গে কাউকে শরীক করবে না।’ {সূরা আন-নূর, আয়াত: ৫৫}
সুতরাং বান্দা যখন তার কথা, কাজ ও ইচ্ছায় একান্তভাবে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে, শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখেরাতের সফলতাই তার লক্ষ্য থাকবে, কোনো মান-মর্যাদা, সম্পদ, মানুষের প্রশংসা বা জাগতিক অন্য কিছু তার কাম্য হবে না, সুখে দুঃখে বিপদাপদে সর্বাবস্থায় অবিচলভাবে একমাত্র আল্লাহর ইবাদতে অটল থাকবে তখন আল্লাহ তাদেরকে পৃথিবীর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করবেন।
তাহলে বুঝা গেল যে, যমীনের বুকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে হলে এর আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ অর্জন করতে হবে, আর সেটি হচ্ছে: একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা, যার কোনো শরীক নেই।
আর যমীনের বুকে প্রতিষ্ঠিত ও ইখলাসের পর আসবে দ্বিতীয় গুণটি।
দ্বিতীয় গুণ: সালাত প্রতিষ্ঠা করা:
আর সালাত প্রতিষ্ঠা করার অর্থ হচ্ছে, বান্দার কাছ থেকে যেভাবে সালাত আদায় চাওয়া হয়েছে সেভাবে সেটা সংঘটিত হওয়া, তার সকল শর্ত, রুকন ও ওয়াজিবসমূহ যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা করা।
আর এর পূর্ণরূপ হচ্ছে, সালাতের যাবতীয় মুস্তাহাব পালন করা, সুতরাং সুন্দরভাবে অযু করবে, রূকু, সিজদা, কিয়াম ও বসা সুন্দরভাবে সম্পন্ন করবে, সময়ের প্রতি যথাযথ যতœবান হবে, জুম‘আ ও জামাআতের প্রতি গুরুত্ব দিবে, সালাতে খুশু‘ তথা বিনয়াবনত হবে, আর তা হচ্ছে, সালাতে মন উপস্থিত রাখা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সুস্থির রাখা। কেননা সালাতের মূল ও প্রাণই হচ্ছে বিনয়াবনত থাকা। বিনয়াবনত ব্যতীত সালাত আদায় যেন আত্মা ব্যতীত শরীর।
* আম্মার ইবন ইয়াসের রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, “নিশ্চয় কোনো লোক সালাত থেকে ফিরে এমতাবস্থায় যে তার সালাতের এক দশমাংশ লিখা হয়েছে, এক নবমাংশ, এক অষ্টমাংশ, এক সপ্তমাংশ, এক ষষ্ঠাংশ, এক পঞ্চমাংশ, এক চতুর্থাংশ, এক তৃতীয়াংশ, অর্ধেক লেখা হয়েছে।”
তৃতীয় গুণ: যাকাত প্রদান
﴿وَءَاتَوُاْ ٱلزَّكَوٰةَ﴾ যাকাতের বিধান অনুসারে তার সঠিক প্রাপককে কোনো প্রকার ত্রুটি ছাড়া খুশি মনে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় যাকাত দেওয়া। এর মাধ্যমে নিজের আত্মার পরিশুদ্ধি, সম্পদের পবিত্রতা এবং গরীব দুঃখী ইত্যাদি অভাবী ভাইদের উপকার হয়। যাকাতের হকদার কারা এ বিষয়টি সপ্তদশ আসরে বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে।
চতুর্থ গুণ: সৎকাজে আদেশ করা
﴿وَأَمَرُواْ بِٱلۡمَعۡرُوفِ﴾ মা‘রূফ হচ্ছে, আল্লাহ তাঁর রাসূল কর্তৃক নির্দেশিত সকল ওয়াজিব ও মুস্তাহাব কাজ। সুতরাং যারা আল্লাহর সাহায্য পেতে চায় তারা শরীয়তের পূনর্জীবন দান করা, বান্দাদের সংস্কার এবং আল্লাহর রহমত ও সন্তুষ্টি কামনায় এ কাজগুলো করে থাকে।
বস্তুত মুমিন হচ্ছে দেয়ালের মত। যার একটি ইট অপরটিকে মজবুত করে। সুতরাং একজন মুমিন যেভাবে নিজের জন্য পছন্দ করে যে সে তার রবের আনুগত্যে সদা তৎপর থাকবে, সেভাবে সে নিজের মত করে তার অন্যান্য ভাইদের জন্যও আল্লাহর আনুগত্যে অটল থাকা পছন্দ করা ওয়াজিব।
সৎকাজের নির্দেশ যদি সত্যিকারের ঈমান ও সততার মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয় সেটা আবশ্যক করে যে নির্দেশদাতা নিজেও সেটা যথাযথভাবে পালন করবে; কেননা সে সৎকাজের আদেশের উপকারিতা ও ইহ ও পারলৌকিক ফলাফল সম্পর্কে ঈমান ও পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের কারণেই সে সেটার নির্দেশ প্রদান করে থাকে।
পঞ্চম গুণ: মন্দের প্রতিকার
﴿وَنَهَوۡاْ عَنِ ٱلۡمُنكَرِۗ﴾মুনকার বলতে বুঝায়: এমন প্রত্যেক বিষয় যা থেকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল নিষেধ করেছেন। ইবাদতের সাথে সংশ্লিষ্ট কিংবা চরিত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট অথবা লেন-দেনের সাথে সম্পৃক্ত সকল কবীরা গুনাহ, সগীরা গুনাহ এর অন্তর্ভ্ক্তু। সুতরাং যারা আল্লাহর সাহায্য পেতে চায় তারা আল্লাহর দ্বীনকে হেফাযত করার জন্য, আল্লাহর বান্দাদের রক্ষা করার জন্য এবং ফেতনা-ফাসাদ ও শাস্তির কারণসমূহ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য এসকল কাজ থেকে নিষেধ করে থাকেন।
বস্তুত উম্মতের স্থায়িত্ব, সম্মান ও একতা বজায় রাখার জন্য সৎ কাজের আদেশ প্রদান এবং মন্দের প্রতিবিধান দু’টি শক্তিশালী স্তম্ভবিশেষ। যাতে করে উম্মতকে প্রবৃত্তির তাড়না বিচ্ছিন্ন করতে এবং বিভিন্ন মত ও পথ তাদেরকে ছিন্ন-ভিন্ন করতে সক্ষম না হয়। আর এজন্যই সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়; যা সকল মুসলিম নারী-পুরুষের ওপর সাধ্যানুযায়ী ফরয।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَلۡتَكُن مِّنكُمۡ أُمَّةٞ يَدۡعُونَ إِلَى ٱلۡخَيۡرِ وَيَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِۚ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ ١٠٤ وَلَا تَكُونُواْ كَٱلَّذِينَ تَفَرَّقُواْ وَٱخۡتَلَفُواْ مِنۢ بَعۡدِ مَا جَآءَهُمُ ٱلۡبَيِّنَٰتُۚ وَأُوْلَٰٓئِكَ لَهُمۡ عَذَابٌ عَظِيمٞ ١٠٥ ﴾ [ال عمران: ١٠٤، ١٠٥]
“আর যেন তোমাদের মধ্য থেকে এমন একটি দল হয়, যারা কল্যাণের প্রতি আহ্বান করবে, ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর তারাই সফলকাম। আর তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা বিভক্ত হয়েছে এবং মতবিরোধ করেছে তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ আসার পর। আর তাদের জন্যই রয়েছে কঠোর আযাব।’ {সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০৪-১০৫}
যদি ভালো কাজের আদেশ প্রদান আর মন্দের প্রতিবিধান না থাকতো তবে মুসলিম সমাজ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। এমন হতো যে, প্রত্যেক দলই তার কাছে যা আছে তা নিয়ে খুশী হয়ে যেতো। (অথচ সত্য কখনো মানুষের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে না।)
এ আহ্বান থাকার ফলেই এ উম্মত অন্যদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতে পেরেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ كُنتُمۡ خَيۡرَ أُمَّةٍ أُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ تَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَتَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَتُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِۗ﴾ [ال عمران: ١١٠]
“তোমরা হলে সর্বোত্তম উম্মত, যাদেরকে মানুষের জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে, আর আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।’ {সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১১০}
যারা সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করে না তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ لُعِنَ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ مِنۢ بَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ عَلَىٰ لِسَانِ دَاوُۥدَ وَعِيسَى ٱبۡنِ مَرۡيَمَۚ ذَٰلِكَ بِمَا عَصَواْ وَّكَانُواْ يَعۡتَدُونَ ٧٨ كَانُواْ لَا يَتَنَاهَوۡنَ عَن مُّنكَرٖ فَعَلُوهُۚ لَبِئۡسَ مَا كَانُواْ يَفۡعَلُونَ ٧٩ ﴾ [المائ‍دة: ٧٨، ٧٩]
“বনী ইসরাঈলের মধ্যে যারা কুফরী করেছে তাদেরকে দাঊদ ও মারইয়াম পুত্র ঈসার মুখে লা‘নত করা হয়েছে। তা এ কারণে যে, তারা অবাধ্য হয়েছে এবং তারা সীমালঙ্ঘন করত। তারা পরস্পরকে মন্দ থেকে নিষেধ করত না, যা তারা করত। তারা যা করত, তা কতইনা মন্দ! {সূরা আল-মায়িদাহ্‌, আয়াত: ৭৮-৭৯}
উল্লেখিত পাঁচটি গুণসহ আল্লাহর নির্দেশিত সতর্কতা, দৃঢ়তা ও বাহ্যিক বস্তুগত শক্তি যখন লাভ করবে, তখন আল্লাহর সাহায্য অবশ্যই আসবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَعۡدَ ٱللَّهِۖ لَا يُخۡلِفُ ٱللَّهُ وَعۡدَهُۥ وَلَٰكِنَّ أَكۡثَرَ ٱلنَّاسِ لَا يَعۡلَمُونَ ٦ يَعۡلَمُونَ ظَٰهِرٗا مِّنَ ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا وَهُمۡ عَنِ ٱلۡأٓخِرَةِ هُمۡ غَٰفِلُونَ ٧﴾ [الروم: ٦، ٧]
‘আল্লাহর ওয়াদা। আল্লাহ তাঁর ওয়াদা খেলাফ করেন না। কিন্তু অধিকাংশ লোক জানে না। তারা দুনিয়ার জীবনের বাহ্যিক দিক সম্পর্কে জানে, আর আখিরাত সম্পর্কে তারা গাফিল।’ {সূরা আর-রূম, আয়াত: ৬-৭}
সুতরাং এ গুণগুলো অর্জিত হলে উম্মত অকল্পনীয় আসমানী সাহায্য দ্বারা ধন্য হবে। আর আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল ব্যক্তি নিশ্চিতরূপে জানে যে বাহ্যিক উপকরণ যতই শক্তিশালী হোক তা এগুলোর স্রষ্টা ও অস্তিত্বদানকারী আল্লাহর শক্তির সামনে অতি নগণ্য।
* আদ সম্প্রদায় নিজেদের শক্তিমত্তায় অন্ধ হয়ে ঘোষণা করেছিল:
﴿مَنۡ أَشَدُّ مِنَّا قُوَّةًۖ﴾
“অর্থাৎ কে আমাদের চেয়ে বেশি শক্তিমান?!!”
আল্লাহ তা‘আলা তার উত্তরে বলেন,
﴿أَوَ لَمۡ يَرَوۡاْ أَنَّ ٱللَّهَ ٱلَّذِي خَلَقَهُمۡ هُوَ أَشَدُّ مِنۡهُمۡ قُوَّةٗۖ وَكَانُواْ بَِٔاۡيَٰتِنَا يَجۡحَدُونَ ١٥ فَأَرۡسَلۡنَا عَلَيۡهِمۡ رِيحٗا صَرۡصَرٗا فِيٓ أَيَّامٖ نَّحِسَاتٖ لِّنُذِيقَهُمۡ عَذَابَ ٱلۡخِزۡيِ فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَاۖ وَلَعَذَابُ ٱلۡأٓخِرَةِ أَخۡزَىٰۖ وَهُمۡ لَا يُنصَرُونَ ١٦ ﴾ [فصلت: ١٥، ١٦]
“তবে কি তারা লক্ষ্য করেনি যে, নিশ্চয় আল্লাহ যিনি তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী? আর তারা আমার আয়াতগুলোকে অস্বীকার করত। তারপর আমি তাদের উপর অশুভ দিনগুলোতে ঝঞ্ঝাবায়ু পাঠালাম যাতে তাদেরকে দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনাদায়ক আযাব আস্বাদন করাতে পারি। আর আখিরাতের আযাব তো অধিকতর লাঞ্ছনাদায়ক এবং তাদেরকে সাহায্য করা হবে না।’ {সূরা ফুসসিলাত, আয়াত: ১৫-১৬}
* ফির‘আউন কতই না দম্ভ করেছিল তার মিসরের রাজত্ব নিয়ে এবং যে সকল নদী-নালা তার নিম্নভাগে প্রবাহিত আছে তা নিয়ে!!
অতঃপর আল্লাহ তাকে সে পানিতেই ডুবে মেরেছিলেন যা নিয়ে সে অহংকারে ফেটে পড়েছিল। আর তার রাজত্বের ওয়ারিস বানিয়েছেন মূসা ও তার জাতিকে; যারা ছিল ফের‘আউনের দৃষ্টিতে হীন ও কথা বলতে অক্ষম।
* আর এই যে কুরাইশ, তারা তাদের মর্যাদা আর শ্রেষ্ঠত্বের অহংকারে অন্ধ হয়ে সর্বশক্তি নিয়ে তাদের নেতা ও কর্তা ব্যক্তিরা গর্ব ও লোকদেখানোর জন্য বেরিয়ে পড়েছিল। তারা ঘোষণা দিয়েছিল, আমরা ততক্ষণ কখনো ফিরবো না যতক্ষণ না বদরে পৌঁছব, সেখানে উট যবেহ করব, মদ পান করব, আমাদের উপর গায়ক-গায়িকা, নর্তকীরা গান গাইবে এবং আমরা সেটা উপভোগ করব, আর আরবরা সেটা শুনবে এবং সব সময়ের জন্য আমাদেরকে ভয় পেতে থাকবে!!
কিন্তু তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবীদের হাতে সবচেয়ে নিকৃষ্টতম ও শোচনীয় পরাজয় বরণ করেছিল। আর তাদের লাসগুলো বদরের দুর্গন্ধময় কূপে টেনে-হেঁচড়ে ফেলা হয়েছিল। এভাবে তারা অপমান-অপদস্থের জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে মানুষের মুখে কিয়ামত পর্যন্ত আলোচিত হবে।
আমরা মুসলিমরা যদি এ যুগেও আল্লাহর সাহায্যের জন্য অপরিহার্য গুণাবলি অর্জন করতে পারি, যদি দীনের প্রতিটি নির্দেশ মান্য করে চলতে পারি, যদি আমরা অন্যদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হতে পারি, অন্যদের অনুসারী না হয়ে পথপ্রদর্শক হতে পারি, অনুসরণকারী না হয়ে অনুসরণীয় হতে পারি, ন্যায়-নিষ্ঠা আর পরিশুদ্ধ মানসিকতা নিয়ে যুদ্ধের যাবতীয় আধুনিক সামগ্রী অবলম্বন করতে পারি, তাহলে অবশ্যই আল্লাহ আমাদেরকে শত্রুর ওপর বিজয়ী করবেন; যেমন অতীতে আমাদের পূর্বসূরীদের সাহায্য করেছিলেন, আল্লাহ তাঁর ওয়াদা সত্য করেছিলেন, তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছিলেন এবং যাবতীয় বিরোধী শক্তিকে একাই পরাস্ত করেছিলেন।
﴿ سُنَّةَ ٱللَّهِ فِي ٱلَّذِينَ خَلَوۡاْ مِن قَبۡلُۖ وَلَن تَجِدَ لِسُنَّةِ ٱللَّهِ تَبۡدِيلٗا ٦٢ ﴾ [الاحزاب: ٦٢]
‘তোমাদের পূর্বে যারা গত হয়েছে তাদের ব্যাপারে এটি আল্লাহর নিয়ম; আর আপনি আল্লাহর নিয়মে কোনো পরিবর্তন পাবে না।’ {সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৬২}
হে আল্লাহ! আপনি আমাদের জন্য আপনার এমন সাহায্যের উপায়-উপকরণগুলোর ব্যবস্থা করে দিন, যাতে রয়েছে আমাদের বিজয়, ইয্‌যত, সম্মান আর ইসলামের জন্য উঁচু মর্যাদা ও কুফরি ও অবাধ্যতার জন্য অপমান ও হীনতা। নিশ্চয় আপনি দানশীল ও দাতা।
আর আল্লাহ সালাত ও সালাম পেশ করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তার পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীর উপর।
একবিংশ আসরঃরমযানের শেষ দশ দিনের ফযিলত
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি মাহাত্ম্য, চিরস্থায়িত্ব, মহত্ব ও গর্বে একক, এমন সম্মানের অধিকারী যার ইচ্ছা কেউ করতে পারে না, এক ও একক, অনন্য ও অমুখাপেক্ষী, এমন বাদশাহ যিনি কারও প্রয়োজন বোধ করেন না, চিন্তায় যে সব নিকৃষ্টতা আসে তা থেকে তিনি বহু উর্ধ্বে, তিনি এমন মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী যে কোনো বিবেক ও বুঝ তাকে আয়ত্ব করতে পারে না, তাঁর সকল সৃষ্টি থেকে তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ; কারণ যমীনের বুকে যা-ই রয়েছে সবাই তার প্রতি স্থায়ীভাবে মুখাপেক্ষী, তিনি যাকে ইচ্ছা তাওফীক দিয়েছেন ফলে সে তাঁর উপর ঈমান এনেছে এবং তাতে সুদৃঢ় রয়েছে; তারপর তাকে তার প্রভুর সাথে গোপনে আলাপ করার স্বাদ দিয়েছে ফলে সে আরামের ঘুম ত্যাগ করেছে এবং এমন বন্ধুদের সাথী হয়েছে যাদের পার্শ্বদেশ বিছানা থেকে দূরে থাকে, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে মহান প্রভুর সামনে দাঁড়ানো। আপনি যদি তাদের দেখতেন যখন তাদের কাফেলা নিশ্চিদ্র অন্ধকারে চলতে শুরু করেছে, তাদের কেউ তার পদস্খলন থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করছে, অপর কেউ বেদনার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে, আবার কেউ তার যিকিরে ব্যস্ত থাকার কারণে কিছু চাওয়া থেকে বিরত থাকছে, সুতরাং ঐ সত্ত্বা কতই পবিত্র! যিনি এদের জাগিয়ে দিয়েছেন অথচ অন্য মানুষরা সবাই ঘুমে বিভোর, আর ঐ সত্ত্বা কতই বরকতময়! যিনি ক্ষমা করেন ও অপরাধ মিটিয়ে দেন, দোষ-ত্রুটি গোপন করেন ও যথেষ্ট করেন, সবার উপর সব রকমের নেয়ামত ঢেলে দিয়েছেন। আমি তার প্রশংসা করি তার বড় বড় নেয়ামতসমূহের উপর আর তার শুকরিয়া জ্ঞাপন করি এবং তাঁর কাছে ইসলাম নামক নেয়ামতটি হেফাযত করার বিনীত প্রার্থনা করি।
আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত কোনো হক ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই, যে তাঁর দ্বারা প্রতিপত্তি অর্জন করতে চায় সে হয় সম্মানিত ফলে তার উপর কেউ যুলুম করতে পারে না। যে তাঁর আনুগত্য করতে অহঙ্কার করে ও গুনাহে লিপ্ত থাকে সে হয় অপমানিত। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল, যিনি হালাল ও হারাম বর্ণনা করেছেন।
আর আল্লাহ সালাত পেশ করুন তাঁর উপর, অনুরূপ তাঁর সাথী আবু বকর আস-সিদ্দীক তথা মহাসত্যবাদীর উপর, যিনি সাওর গিরি গুহায় তাঁর উত্তম সহচর হিসেবে ছিলেন, আর ‘উমার ইবনুল খাত্তাবের উপর, যিনি সঠিক কথা কাজের ছিলেন তাওফীকপ্রাপ্ত, আর ‘উসমানের উপর, যিনি বিপদে ধৈয্যধারণ করেছিলেন এবং শত্রুদের হাতে মহান শাহাদাতের মর্যাদা অর্জন করতে পেরেছিলেন, আর তাঁর চাচাতো ভাই আলী ইবন আবী তালেবের উপর, অনুরূপ সকল সাহাবী ও তাঁদের সুন্দর অনুসারীদের উপর, যতদিন আকাশের দিগন্তে নক্ষত্র লুকাতে থাকবে। আর আল্লাহ তাঁদের উপর যথাযথ সালামও পেশ করুন।
প্রিয় ভাইসকল! আল্লাহ আপনাদের রমযানের শেষ দশ দিনে পৌছিয়েছেন। এ দশ দিনের রয়েছে অনেক কল্যাণ ও অধিক সওয়াব; অনেক ফযীলত ও তাৎপর্য। তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যান্য সময়ের চেয়ে এতে বেশি আমল করতেন।
* সহীহ মুসলিমে ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন:
كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَجْتَهِدُ فِي الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ، مَا لَا يَجْتَهِدُ فِي غَيْرِهِ
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ দশকে যে পরিমাণ আমল করতেন অন্য কোনো সময় এত বেশি আমল করতেন না।’
* বুখারী ও মুসলিমে উম্মুল মুমিনীন ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে আরও বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন:
كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا دَخَلَ العَشْرُ شَدَّ مِئْزَرَهُ، وَأَحْيَا لَيْلَهُ، وَأَيْقَظَ أَهْلَهُ
‘যখন রমযানের শেষ দশদিন আসত, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিধেয় বস্ত্রকে শক্ত করে বাঁধতেন, রাত জেগে ইবাদত করতেন এবং পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন।’
* মুসনাদে ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে আরও বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন:
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَخْلِطُ الْعِشْرِينَ بِصَلَاةٍ وَنَوْمٍ، فَإِذَا كَانَ الْعَشْرُ شَمَّرَ وَشَدَّ الْمِئْزَرَ
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম বিশ দিন সালাত আদায় করতেন ও ঘুমাতেন। কিন্তু শেষ দশ দিন ঘুমাতেন না, বরং পরিধেয় বস্ত্রকে মজবুত করে বেঁধে সালাতে মনোনিবেশ করতেন।’
এ সকল হাদীস এ কথার প্রমাণ বহন করে যে, রমযানের শেষ দশদিনের গুরুত্ব অনেক বেশি। কেননা,
* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য সময়ের চেয়ে এ দশদিন অধিক আমল করতেন। এ দশদিনে সকল প্রকার ইবাদত তথা সালাত, কুরআন তিলাওয়াত, যিকির ও সদাকাহ ইত্যাদি বেশি করতেন।
* অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘পরিধেয় বস্ত্র খুব মজবুত করে বাঁধতেন।’ এর অর্থ হলো, তিনি স্ত্রীদের থেকে দূরে অবস্থান করতেন, যেন সালাত ও যিকিরে অধিক মগ্ন হতে পারেন।
* তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ রাতগুলোতে সারা রাত জাগ্রত থেকে মন, জিহ্বা ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের দ্বারা যিকির, কুরআন তিলাওয়াত ও সালাতে অতিবাহিত করতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটা করতেন রাতগুলোর সম্মানার্থে এবং লাইলাতুল কদরের খোঁজে, কারণ, লাইলাতুল কদর এমন এক রাত, যে রাতে ঈমান ও সাওয়াবের আশায় কেউ সালাত আদায় করলে, আল্লাহ তার পূর্ববর্তী গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন।
এ হাদীসের স্পষ্ট ভাষ্য থেকে বুঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারা রাত তাঁর রবের ইবাদত তথা সালাত, কুরআন তিলাওয়াত, যিকির ও শেষ রাতে সাহরী খাওয়ার মধ্য দিয়ে সমাপ্ত করতেন।
* এ বক্তব্যের মাধ্যমে উপরোক্ত হাদীস ও সহীহ মুসলিমে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে যা বর্ণিত হয়েছে যে তিনি বলেছেন,
ما أعلمه صلى الله عليه وسلم قام ليلةً حتى الصباح
“আমি জানি না রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো রাত সকাল পর্যন্ত দাঁড়িয়েছেন।” এ দুয়ের মধ্যে সামঞ্জস্যবিধান হয়েছে। কারণ; রমযানের শেষ দশ দিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিয়াম তথা সালাতের জন্য দাঁড়ানোর সাথে সাথে অন্যান্য ইবাদতও করতেন, পক্ষান্তরে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা যা নিষেধ করেছেন তা হচ্ছে শুধু কিয়াম তথা সালাতে দণ্ডায়মান হয়ে সারা রাত নিঃশেষ করা। ‘আল্লাহই সবচেয়ে বেশি জানেন’।
এ হাদীস থেকে শেষ দশকের আরও যে ফযীলত জানা যাচ্ছে তা হলো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত ও যিকিরের জন্য নিজ পরিবারবর্গকেও জাগ্রত রাখতেন এ আশায় যেন তারা শেষ ১০ রাতের উপযোগী ইবাদতের মাধ্যমে বরকত লাভ করতে পারেন।
নিঃসন্দেহে প্রতিটি মানুষের জীবনে এটা একটি সুবর্ণ সুযোগ। যাকে আল্লাহ তাওফীক দান করেন সে-ই এ অমূল্য নেয়ামত লাভ করতে পারে। সুতরাং বুদ্ধিমান মু’মিন ও তার পরিবার-পরিজনের জন্য এ মূল্যবান সময় অবহেলায় কাটানো উচিৎ হবে না। বস্তুত এ মূল্যবান সময় খুব হাতেগোনা নির্দিষ্ট কয়েকটি রাত; হতে পারে কোনো লোক এ মূল্যবান রাতে আল্লাহর রহমতের একটু পরশ পাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করবে। ফলে সেটা তার জন্য দুনিয়া ও আখেরাতের সৌভাগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে যাবে।
তবে কেউ কেউ এ মহান রাত অবহেলায় কাটিয়ে দুনিয়া ও আখিরাতের প্রভুত কল্যাণ থেকে মাহরূম ও বঞ্চিত হয়। কোনো কোনো মুসলিমকে দেখা যায়, তারা এ মূল্যবান সময় অবহেলায় কাটায়। রাতের বেশির ভাগ সময় হাসি-ঠাট্টা ও অনর্থক খেলাধুলায় কাটিয়ে দেয়। অতঃপর সালাতের সময় ঘুমিয়ে থাকে। এভাবে ইবাদতবিহীন রাত কাটিয়ে নিজেরা অনেক কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়। তারা এ মূল্যবান রাত আর নাও পেতে পারে।
আর এসব হচ্ছে শয়তানের কর্মকাণ্ড ও প্রতারণা, যা আল্লাহর রাস্তা হতে ফিরিয়ে রাখার ও পথভ্রষ্ট করার এক অশুভ পরিকল্পনা।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿إِنَّ عِبَادِي لَيۡسَ لَكَ عَلَيۡهِمۡ سُلۡطَٰنٌ إِلَّا مَنِ ٱتَّبَعَكَ مِنَ ٱلۡغَاوِينَ٤٢﴾ [الحجر: ٤٢]
‘নিশ্চয় আমার বান্দাদের ওপর তোমার সামান্যতম আধিপত্য নেই; তবে বিপথগামীদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করে চলে, তারা ছাড়া।’ {সূরা আল-হিজর, আয়াত: ৪২}
বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া শয়তানকে কখনোই বন্ধুরূপে গ্রহণ করতে পারে না। কেননা এটা জ্ঞান ও ঈমানের বিপরীত কাজ।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿أَفَتَتَّخِذُونَهُۥ وَذُرِّيَّتَهُۥٓ أَوۡلِيَآءَ مِن دُونِي وَهُمۡ لَكُمۡ عَدُوُّۢ ۚ بِئۡسَ لِلظَّٰلِمِينَ بَدَلٗا﴾ [الكهف: ٥٠]
‘তবে কি তোমরা আমার পরিবর্তে তাকে (শয়তানকে) ও তার বংশধরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করছ? তারা তো তোমাদের শত্রু, এটা কতই না নিকৃষ্ট বিকল্প।’ {সূরা আল-কাহফ, আয়াত: ৫০}
* আরেক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ إِنَّ ٱلشَّيۡطَٰنَ لَكُمۡ عَدُوّٞ فَٱتَّخِذُوهُ عَدُوًّاۚ إِنَّمَا يَدۡعُواْ حِزۡبَهُۥ لِيَكُونُواْ مِنۡ أَصۡحَٰبِ ٱلسَّعِيرِ ٦ ﴾ [فاطر: ٦]
‘নিশ্চই শয়তান তোমাদের শত্রু। সুতরাং তাকে শত্রু হিসেবেই গণ্য কর, সে তো তার দলবলকে জাহান্নামী হওয়ার জন্যই আহ্বান করে।’ {সূরা ফাতির, আয়াত: ৬}
ই‘তিকাফ রমযানের শেষ ১০ দিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ১০ দিনে মসজিদে ই‘তিকাফ করতেন।
আর ই‘তিকাফ হলো, আল্লাহর আনুগত্য করার জন্য পার্থিব কাজ থেকে অবসর হয়ে মসজিদে অবস্থান করা। ই‘তিকাফ করা সুন্নাত, যা কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَلَا تُبَٰشِرُوهُنَّ وَأَنتُمۡ عَٰكِفُونَ فِي ٱلۡمَسَٰجِدِۗ ﴾ [البقرة: ١٨٧]
‘তোমরা মসজিদে ই‘তিকাফ অবস্থায় তোমাদের স্ত্রীদের সাথে মেলা-মেশা করো না।’ {সূরা আল-বাকারাহ্‌, আয়াত: ১৮৭}
তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ই‘তিকাফ করতেন সাহাবাগণও ই‘তিকাফ করতেন।
* আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের প্রথম ১০ দিন ই‘তিকাফ করলেন, এরপর দ্বিতীয় ১০ দিন ই‘তিকাফ করলেন, এরপর বললেন,
إِنِّى اعْتَكَفْتُ الْعَشْرَ الأَوَّلَ أَلْتَمِسُ هَذِهِ اللَّيْلَةَ ثُمَّ اعْتَكَفْتُ الْعَشْرَ الأَوْسَطَ ثُمَّ أُتِيتُ فَقِيلَ لِى إِنَّهَا فِى الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ فَمَنْ أَحَبَّ مِنْكُمْ أَنْ يَعْتَكِفَ فَلْيَعْتَكِفْ .
‘আমি প্রথম ১০ দিন ই‘তিকাফ করে এ মহান রাতটি খুঁজলাম, এরপর দ্বিতীয় ১০ দিন ই‘তিকাফ করলাম, কিন্তু তাতে কদর নামক রাতটি পেলাম না। এরপর আমাকে বলা হলো, এ রাতটি শেষ ১০ দিনের মাঝে নিহেত রয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই ই‘তিকাফ করতে চায়, সে যেন শেষ দশকে ই‘তিকাফ করে।’
* সহীহ বুখারী ও মুসলিমে ‘আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত,
كَانَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللَّهُ ثُمَّ اعْتَكَفَ أَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِه.
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত রমযানের শেষ ১০ দিনে ই‘তিকাফ করেছেন। তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর স্ত্রীগণও ই‘তিকাফ করতেন।’
* সহীহ বুখারীতে ‘আয়েশা ছিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে আরও বর্ণিত,
كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَعْتَكِفُ فِي كُلِّ رَمَضَانَ عَشْرَةَ أَيَّامٍ فَلَمَّا كَانَ الْعَامُ الَّذِي قُبِضَ فِيهِ اعْتَكَفَ عِشْرِينَ يَوْمًا.
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক রমযানে ১০ দিন ই‘তিকাফ করতেন। আর তিনি যে বছর মারা যান, সে বছর ২০ দিন ই‘তিকাফ করেছেন।’
* আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত,
كَانَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ فَلَمْ يَعْتَكِفْ عَامًا فَلَمَّا كَانَ الْعَامُ الْمُقْبِلُ اعْتَكَفَ عِشْرِينَ لَيْلَةً.
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ ১০ দিন ই‘তিকাফ করতেন, পুরো বছর আর কোনো ই‘তিকাফ করতেন না। পরবর্তী বছর রমযানে ২০ দিন ই‘তিকাফ করেছেন।’
* ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ই‘তিকাফ করতেন, ফজরের সালাত আদায় করতেন তারপর ই‘তিকাফের জন্য নির্ধারিত স্থানে প্রবেশ করতেন। একবার আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তার কাছে অনুমতি চাইলেন, তিনি তাকে অনুমতি দিলেন, অতঃপর তার জন্যও তাঁবু টাঙ্গানো হলো। এরপর হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহা আয়েশার কাছে তার জন্য রাসূলের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার অনুরোধ জানালেন, তিনি তাই করলেন, ফলে তার জন্যও তাঁবু টাঙ্গানো হলো, অতঃপর যখন যায়নার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা সেটা দেখলেন, তিনি তার জন্য তাঁবু টাঙ্গানোর নির্দেশ দিলেন, ফলে তাই করা হলো। অতঃপর যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেকগুলো তাঁবু দেখলেন তখন বললেন, এটা কি? তারা বলল, এ হচ্ছে আয়েশা, হাফসা ও যাইনাবের তাঁবু। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তারা কী এর মাধ্যমে সাওয়াব পাওয়ার ইচ্ছা করছে? তোমরা এগুলোকে খুলে ফেল, আমি এগুলোকে দেখতে চাই না। ফলে এগুলো খুলে ফেলা হলো, আর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের ই‘তিকাফ পরিত্যাগ করলেন; শেষপর্যন্ত রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাওয়ালে প্রথম দশক ই‘তিকাফ করলেন।” (বুখারী ও মুসলিমের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে সংগৃহীত।
* ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল রহ. বলেন, “আমি জানি না কোনো আলেম দ্বিমত করেছেন কি না যে: ই‘তিকাফ সুন্নাত।”
ই’তিকাফের উদ্দেশ্য
“কোনো মানুষ সাধারণ মানুষদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লাহর ঘর মসজিদসমূহের কোনো মসজিদে বসে তাঁর অনুগ্রহ, সাওয়াব এবং লাইলাতুল কদর লাভের আশায় একান্তভাবে আল্লাহর আনুগত্যে ব্যয় করা। এ জন্য প্রত্যেক ই‘তিকাফকারীর উচিৎ আল্লাহর যিকির, কুরআন তিলাওয়াত, সালাত ও অন্যান্য ইবাদতে ব্যস্ত থাকা এবং দুনিয়াবী অনর্থক কথা-বার্তা থেকে বেঁচে থাকা।
তবে পরিবার বা অন্য কারও সাথে কোনো বৈধ বিষয়ে অল্প কথা-বার্তায় কোনো দোষ নেই। কারণ,
* উম্মুল মুমিনীন সাফিয়্যাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كَانَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مُعْتَكِفًا فَأَتَيْتُهُ أَزُورُهُ لَيْلاً فَحَدَّثْتُهُ ثُمَّ قُمْتُ لأنْقَلِبَ، أي: لأنصرف إلى بيتي، فَقَامَ النبي صلى الله عليه وسلم مَعِي… الحديث. متفق عليه.
আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ই‘তিকাফ অবস্থায় রাতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলাম এবং কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললাম, আলোচনা শেষে যখন বাড়িতে ফিরে আসতে চাইলাম, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বিদায় দেয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন।’
ই‘তিকাফকারীর জন্য স্ত্রী সহবাস ও তার পূর্বক্রিয়া যেমন- চুম্বন করা, পূর্ণ উত্তেজনার সঙ্গে স্পর্শ করা নিষেধ। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَلَا تُبَٰشِرُوهُنَّ وَأَنتُمۡ عَٰكِفُونَ فِي ٱلۡمَسَٰجِدِۗ ﴾ [البقرة: ١٨٧]
‘তোমরা মসজিদে ই‘তিকাফ অবস্থায় সহবাস ও তাদের সঙ্গে অন্যান্য যৌনকর্ম করবে না।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৭}
আর ই‘তিকাফকারীর মসজিদ হতে বের হওয়ার ব্যপারে বিধান হলো, যদি শরীরের কিছু অংশ বাইরে বের করে তবে কোনো দোষ নেই। কারণ,
* ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كَانَ النبي صلى الله عليه وسلم يُخْرِجُ رَأْسَهُ مِنَ الْمَسْجِدِ وَهْوَ مُعْتَكِفٌ فَأَغْسِلُهُ وَأَنَا حَائِضٌ.
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ই‘তিকাফ অবস্থায় মসজিদ হতে মাথা বের করতেন আর আমি ঋতু অবস্থায় তাঁর মাথা ধৌত করতাম।’
* অন্য বর্ণনায় এসে,
كَانَتْ تُرَجِّلُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم وَهِيَ حَائِضٌ وَهْوَ مُعْتَكِفٌ فِي الْمَسْجِدِ وَهْيَ فِي حُجْرَتِهَا يُنَاوِلُهَا رَأْسَهُ
‘‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা ঋতু অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চুল আঁচড়ে দিতেন। তখন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা তার কক্ষেই থাকতেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মাথা বের করে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার দিকে দিতেন।’
ই‘তিকাফকারী মসজিদ থেকে সারা শরীর নিয়ে বের হওয়ার তিন অবস্থা:
প্রথম: কোনো প্রয়োজনে মসজিদের বাইরে যাওয়া। তা স্বভাবগত হোক বা শরীয়তসম্মত হোক। যেমন পেশাব-পায়খানা, উযু, ফরয গোসল, ইত্যাদি ও পানাহার হয়, আর ওই কর্মকাণ্ডের ব্যবস্থা মসজিদে না থাকে বা সমজিদে সম্ভব না হয়, তা হলে ই‘তিকাফকারীর জন্য বাইরে যাওয়া জায়েয হবে। আর যদি ওই কাজগুলো মসজিদে করা সম্ভব হয় বা তার ব্যবস্থা থাকে, তাহলে ই‘তিকাফকারীর মসজিদের বাইরে যাওয়া জায়েয হবে না। গেলে ই‘তিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে।
দ্বিতীয়: কোনো ইবাদত জাতীয় কাজের জন্য বের হওয়া, যা তার ওপর ওয়াজিব নয়। যেমন- অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখার জন্য যাওয়া ও জানাযায় উপস্থিত হওয়া ইত্যাদি। এসব অবস্থায় বের হওয়া জায়েয নেই; তবে যদি ই‘তিকাফের প্রথমেই শর্ত করে নেয় যে, তবে বের হওয়াতে ক্ষতি নেই। যেমন, ই‘তিকাফকারীর কোনো রোগী থাকে; যাকে সে দেখা-শোনা করতে চায়, অথবা যদি তাঁর মৃত্যুর আশংকা থাকে আর ই‘তিকাফ শুরুর পূর্বেই তাকে দেখতে যাওয়ার শর্ত করে থাকে তবে সমস্যা নেই।
তৃতীয়: ই‘তিকাফকারী এমন কোনো কাজের জন্য বের হওয়া যা ই‘তিকাফের উদ্দেশ্য বিরোধী। যেমন, যেমন ক্রয়-বিক্রয়, স্ত্রী সহবাস অথবা তাদের সাথে মেলা-মেশা ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়া। ই‘তিকাফকারী এগুলো করতে পারে না। এর জন্য শর্ত করলেও কোনো লাভ নেই। শর্ত করা না করা সমান। কারণ, এগুলো ই‘তিকাফ নষ্ট করে দেয় এবং তার মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থি।
রমযানের এই শেষ দশ দিনের আরও অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এ ১০ দিনের মধ্যে রয়েছে লাইলাতুল কদর, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। সুতরাং আল্লাহ তোমাদেরকে রহমত করুন, তোমরা এ ১০ দিনের ফযীলত সম্পর্কে জান, সাবধান! এ মূল্যবান সময়গুলো নষ্ট করবে না; কেননা এ সময়গুলো অতীব মূল্যবান, এর কল্যাণ স্পষ্ট ও প্রকাশ্য।
হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে এমন কর্মের তৌফিক দিন যাতে আমাদের দ্বীন ও দুনিয়ার মঙ্গল নিহিত রয়েছে। আর আমাদের শেষ পরিণাম সুন্দর করুন এবং সম্মান জনক ঠিকানা দান করুন। আর আমাদেরকে এবং আমাদের পিতা-মাতা ও সকল মুসলিমদেরকে আপনার কৃপায় ক্ষমা করে দিন।
আর আল্লাহ সালাত ও সালাম পেশ করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তার পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীর উপর।
দ্বাবিংশ আসরঃরমযানের শেষ দশকের ইবাদত ও লাইলাতুল ক্বদর
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি গোপন ও প্রকাশ্য সম্পর্কে সর্বজ্ঞ, নিজ প্রতাপ ও প্রতিপত্তির মাধ্যমে নিপীড়কদের দমনকারী, নদীতে প্রবাহমাণ পানির ফোটার সংখ্যা গণনাকারী, রাতের অন্ধকার সৃষ্টিকারী যাকে ভোরের আলো মিটিয়ে দূরিভূত করে দেয়। ইবাদতকারীদের জন্য সাওয়াবে পরিপূর্ণতা প্রদানকারী এবং তাদের প্রতিদানে উৎকর্ষতা প্রদানকারী, চোখের খেয়ানত ও অন্তরের গোপন ইচ্ছা সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞানী, তাঁর রিযিক সকল সৃষ্টিকুলকে অন্তর্ভুক্ত করেছে, ফলে বালুতে অবস্থানরত কোনো পিপড়া কিংবা নীড়ে অবস্থানরত পাখীর বাচ্ছাও বাদ যায় নি। ধনী করেন, দরিদ্র করেন আর তাঁরই প্রজ্ঞায় অনুষ্ঠিত হয় ধনাঢ্যতা কিংবা দারিদ্র্যতা। কোনো কোনো সৃষ্টিজীবকে অপর সৃষ্টিজীবের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন এমনকি সময়ের ক্ষেত্রেও, লাইলাতুল কদর, সম্মানিত রাত্রি, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। আমি তার এমন প্রশংসা করছি যা কোনো সংখ্যায় শেষ হবার নয়, আর এমন শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি যা তার আরও সাহায্যকে টেনে আনে।
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত কোনো হক্ব ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই, একজন ঐকান্তিক বিশ্বাসীর সাক্ষ্য, আর আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল যাঁর আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছিল। আল্লাহ তাঁর উপর সালাত প্রেরণ করুন, অনুরূপ আবু বকরের ওপর, যিনি সুখে কিংবা দুঃখে তাঁর সাথী ছিলেন, অনুরূপ উমরের ওপর, যিনি ছিলেন ইসলামের কাঁধ ও বাজু, আর উসমানের উপর, যিনি ছিলেন কুরআনের বিন্যাস ও একত্রকারী। আর আলীর উপর যিনি একাই যুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শনে যথেষ্ট নৈপূণ্যতা প্রদর্শনকারী, অনুরূপ রাসূলের সকল পরিবার-পরিজন ও সাহাবীগণের ওপর, যাঁদের প্রত্যেকেই তাদের আমল ও উদ্দেশ্যে ছিলেন সৎ ও কল্যাণকামী। আর আল্লাহ তাদের উপর যথাযথ সালামও প্রেরণ করুন।
প্রিয় ভাইয়েরা! রমযানের শেষ দশদিনে রয়েছে বরকতময় ক্বদরের রাত। এ মাসকে আল্লাহ তা‘আলা অন্যান্য মাসের তুলনায় অধিক মর্যাদা দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা উম্মতকে এ রাতে অফুরন্ত সাওয়াব ও কল্যাণ দান করে অনুগ্রহ করেছেন।
* আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সুস্পষ্ট কিতাব আল-কুরআনে এ রাতের মর্যাদা বিশেষভাবে উল্লেখ করে বলেছেন:
﴿ إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ فِي لَيۡلَةٖ مُّبَٰرَكَةٍۚ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ ٣ فِيهَا يُفۡرَقُ كُلُّ أَمۡرٍ حَكِيمٍ ٤ أَمۡرٗا مِّنۡ عِندِنَآۚ إِنَّا كُنَّا مُرۡسِلِينَ ٥ رَحۡمَةٗ مِّن رَّبِّكَۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡعَلِيمُ ٦ رَبِّ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَمَا بَيۡنَهُمَآۖ إِن كُنتُم مُّوقِنِينَ ٧ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ يُحۡيِۦ وَيُمِيتُۖ رَبُّكُمۡ وَرَبُّ ءَابَآئِكُمُ ٱلۡأَوَّلِينَ ٨ ﴾ [الدخان: ٣، ٨]
“নিশ্চয় আমরা এটা নাযিল করেছি এক মুবারক রাতে; নিশ্চয় আমরা সতর্ককারী। সে রাতে প্রত্যেক চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত স্থিরকৃত হয়, আমাদের পক্ষ থেকে আদেশক্রমে, নিশ্চয় আমরা রাসূল প্রেরণকারী। আপনার রবের রহমতস্বরূপ; নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ– আসমানসমূহ, যমীন ও এ দু’য়ের মধ্যবর্তী সমস্ত কিছুর রব, যদি তোমরা নিশ্চিত বিশ্বাসী হও। তিনি ছাড়া কোন সত্য ইলাহ্ নেই, তিনি জীবন দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু ঘটান; তিনি তোমাদের রব এবং তোমাদের পিতৃপুরুষদেরও রব।” {সূরা আদ-দুখান, আয়াত: ৩-৮}
মহান আল্লাহ এ রাতকে মুবারক বলে গুণান্বিত করেছেন; কারণ এতে রয়েছে অত্যাধিক কল্যাণ, বরকত ও মর্যাদা।
এ রাতের বরকতের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, এ বরকতময় কুরআন ওই রাতেই নাযিল হয়েছে। এর গুণ বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেছেন যে, এ রাতে প্রত্যেক চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত স্থিরকৃত হয়, অর্থাৎ লাওহে মাহফূয থেকে লেখক ফেরেশতাদের কাছে স্থিরিকৃত হয়, এ বছর আল্লাহর নির্দেশে রিযিক, বয়স সীমা, ভাল ও মন্দ ইত্যাদি যত প্রজ্ঞাপূর্ণ কাজ রয়েছে সবই। এ সবই আল্লাহর প্রজ্ঞাপূর্ণ ও হিকমতপূর্ণ নির্দেশ যাতে নেই কোনো দোষ, কমতি, অবিবেচনাপ্রসূত কিংবা বাতিল কিছু; সর্বজ্ঞ, মহাসম্মানিতের কাছ থেকে সুনির্ধারিতরূপে।
* মহান আল্লাহ বলেন,
﴿إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ فِي لَيۡلَةِ ٱلۡقَدۡرِ ١ وَمَآ أَدۡرَىٰكَ مَا لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ ٢ لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ خَيۡرٞ مِّنۡ أَلۡفِ شَهۡرٖ ٣ تَنَزَّلُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَٱلرُّوحُ فِيهَا بِإِذۡنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمۡرٖ ٤ سَلَٰمٌ هِيَ حَتَّىٰ مَطۡلَعِ ٱلۡفَجۡرِ ٥ ﴾ [القدر: ١، ٥]
“নিশ্চয় আমরা কুরআন নাযিল করেছি ‘লাইলাতুল কদরে’; আর আপনাকে কিসে জানাবে ‘লাইলাতুল কদর’ কী? ‘লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। সে রাতে ফিরিশ্তাগণ ও রূহ্ নাযিল হয় তাদের রবের অনুমতিক্রমে সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে। শান্তিময় সে রাত, ফজরের আবির্ভাব পর্যন্ত।’ {সূরা আল-ক্বদর, আয়াত: ১-৫}
ক্বদর শব্দটি সম্মান ও মর্যাদা অর্থে ব্যবহৃত হয়। আবার এর অপর অর্থ হচ্ছে, তাকদীর ও ফয়সালা করা; কেননা ক্বদরের রাত অত্যাধিক সম্মানিত ও মহত্বপূর্ণ রাত, এ রাতে আল্লাহ তা‘আলা এ বছর যা কিছু হবে তা নির্ধারণ করেন এবং প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন।
আর “কদরের রাত্রি হাজার মাসের চেয়ে উত্তম” কথাটির অর্থ হলো: ফযিলত, সম্মান, অত্যাধিক সাওয়াব ও পুরস্কারের দিক থেকে তা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। তাই যে ব্যক্তি পূর্ণ ঈমান ও সাওয়াবের আশা নিয়ে এ রাতের সালাত (কিয়ামুল-লাইল) আদায় করবে, তার পূর্বের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।
আর “ফেরেশতা নাযিল হওয়া” এর অর্থ হলো: ফেরেশতাগণের অবতরণ; তারা আল্লাহর এক প্রকার বান্দা; যারা দিন-রাত আল্লাহর ইবাদতে রত থাকে। “তারা অহংকার-বশে তাঁর ‘ইবাদাত করা হতে বিমুখ হয় না এবং বিরক্তি বোধ করে না। তারা দিন-রাত তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে, তারা ক্লান্তও হয় না।” {সূরা আল-আম্বিয়া: ১৯-২০} তারা লাইলাতুল ক্বদরের কল্যাণ, বরকত ও রহমত নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন।
আর “রূহ” বলতে জিব্রাঈল ‘আলাইহিস সালামকে বুঝানো হয়েছে। মর্যাদা ও সম্মানের কারণে তাঁকে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
আর “শান্তি বর্ষণ” করার অর্থ হলো: লাইলাতুল ক্বদর মুমিনদের জন্য যাবতীয় ভীতিপ্রদ বস্তু হতে শান্তির রাত; কারণ আল্লাহ তা‘আলা বহু লোককে এ রাত্রিতে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন, এর মাধ্যমে অনেকেই তাঁর আযাব থেকে মুক্তি নিরাপত্তা পায়।
আর “ফজর উদয় পর্যন্ত” এর অর্থ হলো: ক্বদরের রাতের পরিসমাপ্তি ঘটে ফজর উদয়ের মাধ্যমে; কারণ এর মাধ্যমে রাতের যাবতীয় কাজ শেষ হয়ে যায়।
এ সূরায় ক্বদরের রাতের বিবিধ মর্যাদার কথা বর্ণিত হয়েছে, যেমন:
প্রথম ফযীলত: আল্লাহ তা‘আলা এ রাতে কুরআন নাযিল করেছেন; যা মানুষের জন্য সঠিক পথ নির্দেশিকা এবং দুনিয়া ও আখিরাতের সৌভাগ্য।
দ্বিতীয় ফযীলত: “আপনাকে কিসে জানাবে ‘লাইলাতুল কদর’ কী?” এ প্রশ্নবোধক আয়াত এ রাতের বড় গুরুত্ব ও মহত্বের উপর প্রমাণবহ।
তৃতীয় ফযীলত: এটা এমন এক রাত, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।
চতুর্থ ফযীলত: এ রাতে ফেরেশতারা দুনিয়ার বুকে অবতরণ করে থাকেন; যারা কেবল কল্যাণ, বরকত ও রহমত বর্ষণ করতেই অবতরণ করে থাকেন।
পঞ্চম ফযীলত: এটা শান্তি ও নিরাপত্তাময়; কারণ বান্দা এ রাত আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতে কাটিয়ে দেয় ফলে আল্লাহ শাস্তি ও আযাব থেকে অধিক পরিমানে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রদান করেন।
ষষ্ঠ ফযীলত: আল্লাহ তা‘আলা এ রাতের সম্মানে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা অবতীর্ণ করেছেন, যা কিয়ামত পর্যন্ত তিলাওয়াত করা হবে।
এ রাতের ফযীলতের মধ্যে আরও রয়েছে:
* বুখারী ও মুসলিমে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
مَنْ قَامَ لَيْلَةَ القَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
‘যে ব্যক্তি ঈমান ও সাওয়াবের আশায় ক্বদরের রাতে দণ্ডায়মান থাকবে (ইবাদত করবে), তার পূর্বের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।’
রাসূলের বাণী: “ঈমান ও সাওয়াবের আশায়” এর অর্থ হলো: আল্লাহর উপর এবং যারা এ রাত্রিতে কিয়াম করবে (সালাত আদায় করবে) তাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলা যে প্রতিদান তৈরী করে রেখেছেন সেটার উপর তার পূর্ণ ঈমান রয়েছে। আর সওয়াব ও প্রতিদানের আশাও তার থাকতে হবে।
এ ধরনের সাওয়াব প্রাপ্তির যারা জানে ও যারা জানে না সবার জন্যই সাব্যস্ত হবে। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সওয়াব প্রাপ্তির জন্য জানা থাকা শর্ত করেন নি।
আর লাইলাতুল কদর অবশ্যই রমযান মাসে; কারণ, আল্লাহ তা‘আলা এ রাতেই কুরআন অবতীর্ণ করেছেন; আর তিনি নিজেই জানিয়েছেন যে তিনি কুরআনকে রমযান মাসে নাযিল করেছেন।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ فِي لَيۡلَةِ ٱلۡقَدۡرِ ١ ﴾ [القدر: ١]
“আর অবশ্যই আমরা এ কুরআনকে লাইলাতুল কদরে নাযিল করেছি”। {সূরা আল-কাদর: ১}
* আরও বলেন,
﴿ شَهۡرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِيٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلۡقُرۡءَانُ ﴾ [البقرة: ١٨٥]
‘রমযান এমন একটি মাস, যাতে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৫}
এর দ্বারা নির্ধারিত হয়ে গেল যে, পবিত্র ক্বদরের রাত রমযানের মধ্যেই রয়েছে। এটি সকল উম্মতের মধ্যে ছিল আর এ উম্মতের জন্য কিয়ামত পর্যন্ত বহাল থাকবে। কারণ,
* এ ব্যাপারে ইমাম আহমাদ ও নাসাঈ রহ. আবূ যর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে ক্বদরের রত সম্পর্কে সংবাদ দিন তা কি রমযানে না অন্য কোনো মাসে? উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তা রমযানেই রয়েছে। এরপর আবূ যর আবার প্রশ্ন করলেন, তা কি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যত দিন জীবিত ততদিন অবশিষ্ট থাকবে, নাকি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পর কিয়ামত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে? উত্তরে তিনি বললেন, কিয়ামত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে।” … আল-হাদীস।
কিন্তু এ রাতের এ মহান মর্যাদা ও বৃহৎ পুরস্কার এ উম্মতের জন্যই নির্দিষ্ট। যেমন এ উম্মতকে জুম‘আর ফযীলত ও এ জাতীয় অন্যান্য ফযীলত দ্বারা বিশেষিত করা হয়েছে। সুতরাং আল্লাহর জন্যই যাবতীয় প্রশংসা।
আর ক্বদরের রাত অবশ্যই রমযানের শেষ দশ রাতে রয়েছে। কারণ,
* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
تَحَرَّوْا لَيْلَةَ القَدْرِ فِي العَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ
‘তোমরা রমযানের শেষ দশকে লাইলাতুল ক্বদর অন্বেষণ করো।’
আর তা জোড় রাত্রিগুলোর চেয়ে বেজোড় রাত্রিগুলোর মধ্যে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
* কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
تَحَرَّوْا لَيْلَةَ القَدْرِ فِي الوِتْرِ، مِنَ العَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ
‘তোমরা রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে লইলাতুল ক্বদর অম্বেষণ করো।’
আর লাইলাতুল ক্বদর রমযানের শেষ সাত দিনের মধ্য হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কেননা,
* ইবন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমার হাদীসে এসেছে,
أَنَّ رِجَالًا مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، أُرُوا لَيْلَةَ القَدْرِ فِي المَنَامِ فِي السَّبْعِ الأَوَاخِرِ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَرَى رُؤْيَاكُمْ قَدْ تَوَاطَأَتْ فِي السَّبْعِ الأَوَاخِرِ، فَمَنْ كَانَ مُتَحَرِّيهَا فَلْيَتَحَرَّهَا فِي السَّبْعِ الأَوَاخِرِ
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে কতিপয় সাহাবী রমযানের শেষ সাত দিনে লাইলাতুল ক্বদর স্বপ্নে দেখেছিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি দেখতে পাচ্ছি যে তোমাদের সবার স্বপ্ন শেষ সাত দিনের ব্যাপারে এসে একাত্মতা ঘোষণা করছে। অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি ক্বদরের রাতকে নির্দিষ্ট করতে চায়, সে যেন শেষ সাত দিনের মধ্যে তা নির্ধারণ করে।’
* অনুরূপভাবে সহীহ মুসলিমে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
الْتَمِسُوهَا فِي الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ – يَعْنِي لَيْلَةَ الْقَدْرِ – فَإِنْ ضَعُفَ أَحَدُكُمْ أَوْ عَجَزَ، فَلَا يُغْلَبَنَّ عَلَى السَّبْعِ الْبَوَاقِي
‘তোমরা রমযানের শেষ দশ রাতে লাইলাতুল ক্বদর অন্বেষণ কর। যদি তোমাদের কেউ দুর্বল থাকে অথবা অক্ষম হয়, তাহলে সে যেন শেষ সাত রাতে সেটা খোঁজতে অপারগ না হয়।’
আর শেষ সাতদিনের বেজোড় রাতগুলোর মধ্যে ২৭ তম রাত্রিটিই লাইলাতুল ক্বদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ,
* উবাই ইবন কা‘আব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
وَاللهِ، إِنِّي لَأَعْلَمُهَا اللَّيْلَةُ الَّتِي أَمَرَنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِقِيَامِهَا، هِيَ لَيْلَةُ سَبْعٍ وَعِشْرِينَ
আল্লাহর শপথ! আমি অবশ্যই সে রাতটিকে জানি যে রাতটিতে কিয়াম করার (সালাত নিয়ে দাঁড়ানোর) কথা আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা হলো, রমযানের ২৭ তম রাত।’
তবে প্রতি বছরেই ক্বদরের রাত ২৭ তারিখে হবে তা নির্ধারিত নয়; বরং সেটি স্থানচ্যুত হয়; কোনো বছর ২৭, আবার কোনো বছরে ২৫ হয়ে থাকে। এতে একমাত্র আল্লাহর হিকমত ও ইচ্ছা নিহিত।
এর প্রমাণ হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা। তিনি বলেছেন,
التَمِسُوهَا فِي العَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ لَيْلَةَ القَدْرِ، فِي تَاسِعَةٍ تَبْقَى، فِي سَابِعَةٍ تَبْقَى، فِي خَامِسَةٍ تَبْقَى
“তোমরা এ রাতটিকে রমযানের শেষ দশকে তালাশ কর; নয় রাত বাকী থাকতে তালাশ করো, সাত রাত বাকী থাকতে তালাশ করো, পাঁচ রাত বাকী থাকতে তালাশ করো”।
ইমাম ইবন হাজার রহ. তার ফাতহুল বারীতে বলেন, “আমি প্রাধান্য দিচ্ছি যে, এটি রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রিগুলোতে রয়েছে এবং এটি স্থানান্তর হয়ে থাকে।”
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের ওপর অনুগ্রহস্বরূপ এ রাতকে গোপন রেখেছেন। যাতে প্রতেক বান্দা এ রাত অম্বেষণে বেশি করে আমল করতে পারে। এ মহিমাম্বিত রাতে সালাত, যিকির ও দু’আ করে আল্লাহর নৈকট্য ও অধিক সাওয়াব অর্জন করতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা এ রাত গোপন রেখেছেন বান্দাকে পরীক্ষা করার জন্য যে, কে এ রাত অম্বেষণে অধিক সচেষ্ট হয়, আর কে অলস ঘুমায়। কেননা যে ব্যক্তি কোনো বস্তুর আকাঙ্খী হয় সে তা অর্জনে অধিক চেষ্টা-সাধনা চালায় এবং তা অর্জন করার জন্য সর্বশক্তি ব্যয় করে থাকে। এ পথে তা লাভ করতে ও সঠিক মঞ্জিলে মাকসূদে পৌঁছুতে যত কষ্টই হোক না কেন সেটা তার কাছে গৌণ হিসেবে পরিগণিত হয়। তবে কখনো কখনো আল্লাহ তা‘আলা কিছু কিছু বান্দার জন্য কিছু আলামত ও চিহ্ন দিয়ে এ রাতের জ্ঞানকে প্রকাশ করে থাকেন।
* সে কারণেই একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে রাতের আলামত হিসেবে দেখেছিলেন যে সে রাত্রির সকাল বেলা পানি ও মাটির মধ্যে ফজরের সালাত আদায় করছেন। অতঃপর সে রাত্রিতে বৃষ্টি বর্ষিত হলে সেদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের সালাত বৃষ্টি ও মাটির মাঝে আদায় করেন।
সম্মানিত ভাই সকল! ক্বদরের রাতে আল্লাহর রহমতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। প্রিয় বান্দাদের আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভের সুযোগ করে দেয়া হয়। আর বান্দা যা কিছু আল্লাহর কাছে চায় আল্লাহ তা শ্রবণ করেন, বান্দার চাহিদা ও প্রার্থনার উত্তর দেন ও সৎ কর্মশীলদের জন্য মহা পুরস্কার নির্ধারণ করেন। কেননা ক্বদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।
তাই আপনারা ক্বদরের রাতের মর্যাদা লাভের অন্বেষণে যথাসাধ্য চেষ্টা করুন। আর গাফিলতি ও অলসতা থেকে সাবধান হোন, কারণ এ ধরনের গাফিলতিতে ধ্বংস অনিবার্য।
গত হয়ে গেছে পুরো জীবন ভুলে ও খেলা এবং ক্ষতিগ্রস্ততায়
আমার জীবনের যে সময়টুকু নষ্ট করেছি তার জন্য আফসোস
জীবনের যে সময়টুকু আমি নষ্ট করেছি তাতে আমার কোনো ওযর নেই
আমি প্রশংসা ও শুকরিয়ার কর্তব্য থেকে কত গাফেল হলাম!!
যেহেতু আল্লাহ আমাদেরকে একটি মাস দিয়েছেন, তা আবার এমন মাস
যে মাসে দয়াময় সবচেয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ যিকির নাযিল করেছেন।
এ মাসের সাথে কী আর কোনো মাসের তুলনা চলে যেখানে আছে লাইলাতুল কদর?
কারণ, এ রাত্রির সংবাদ দিয়ে বহু সহীহ হাদীস রয়েছে।
গ্রহণযোগ্য বর্ণনাকারীদের থেকে আমাদের কাছে বর্ণিত হয়েছে যে তা খোঁজা হবে বেজোড় রাত্রিতে
সুতরাং সে ব্যক্তির জন্য সুসংবাদ যে এটাকে এর শেষ দশকে তালাশ করে
এতে নাযিল হয় ফেরেশতারা যাবতীয় নূর ও সৎকাম নিয়ে
আর এজন্যই বলা হয়েছে, শান্তি আর শান্তি যতক্ষণ না উদিত হবে ফজর।
সাবধান! এটাকে গোপন মূলধন হিসেবে জমা করে রাখ, এটা তো সর্বোত্তম মূলধন।
কারণ, এতে রয়েছে বহু মানুষ যারা জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে অথচ সে জানে না।
হে আল্লাহ! আমাদেরকে তাদের মধ্যে গণ্য করুন যারা এ মাসের সত্যিকারের সিয়াম পালন করেছে, লাইলাতুল ক্বদর লাভ করেছে, এবং এর মাধ্যমে ব্যাপক সাওয়াব ও প্রতিদান প্রাপ্ত হয়েছে।
হে আল্লাহ! আমাদের অন্তর্ভুক্ত করুন তাদের মধ্যে, যারা ভালো কাজে প্রতিযোগিতা করে, সকল অন্যায় ও গর্হিত কাজ থেকে পলায়নকারী, জান্নাতের সুউচ্চ প্রসাদসমূহে নিরাপদ অবস্থানকারী, তাদের সাথে যাদের ওপর আপনি অনুগ্রহ করেছেন ও গুনাহের কাজ থেকে হেফাযত করেছেন।
হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে আশ্রয় দিন পথভ্রষ্টকারী ফিতনা থেকে, বাঁচিয়ে রাখুন অশ্লীলতা থেকে যা প্রকাশ পেয়েছে এবং যা গোপন রয়েছে।
হে আল্লাহ! আপনার নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার এবং উত্তম ইবাদত করার তাওফীক দিন। আর আমাদেরকে আপনার আনুগত্যশীল ও ওলীদের কাতারে শামিল করুন। আর দুনিয়া ও আখিরাতে আমাদের কল্যাণ দান করুন ও জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। আমাদেরকে, আমাদের পিতা-মাতাদেরকে এবং সকল মুসলিমকে আপনার দয়ায় ক্ষমা করুন। হে দয়াময়।
আর আল্লাহ সালাত ও সালাম পেশ করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীর উপর।
ত্রয়োবিংশ আসরঃজান্নাতের বর্ণনা
সকল প্রশংসা ওই আল্লাহর জন্য, যিনি প্রত্যাশাকারীকে প্রত্যাশার ওপরে পৌঁছান এবং প্রার্থনাকারীকে প্রার্থনার বেশি দেন। তাওবাকারীর ওপর ক্ষমা ও গ্রহণের দ্বারা অনুগ্রহকারী, সৃষ্টি করেছেন মানুষ এবং তৈরী করেছেন একটি ঘর সেখানে অবতরণের জন্য, আর দুনিয়াকে করেছেন সেখানে নাযিল হওয়ার একটি পর্যায়রূপে। যারা প্রকৃত ঘরের মর্যাদা সম্পর্কে অজ্ঞ তারা তাদের বোকামীরি কারণে এ দুনিয়াকেই তাদের মূল আবাস বানিয়ে নিয়েছে, অতঃপর তাদেরকে সেখান থেকে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হওয়ার পূর্বেই তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তারা যে সকল সম্পদ কিংবা সন্তান-সন্তুতি অর্জন করেছিল তা তাদের কোনো কাজে আসে নি, তাদের সবাইকেই এতে পরাজিত হতে হয়েছে; তুমি কি কাকদেরকে তাদের ভগ্নাংশের উপর কাঁদতে দেখনি? কিন্তু যাকে আল্লাহ তাওফীক দিয়েছেন সে দুনিয়াকে সঠিকভাবে চিনতে পেরেছে, ফলে তার সামনে আজ্ঞাবহ হয়ে পড়ে থাকলেও সে দুনিয়া দ্বারা প্রতারিত হয় নি, সে আল্লাহর ক্ষমা ও এমন জান্নাত লাভের জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে যার প্রশস্ততা আসমান ও যমীনব্যাপী। যা শুধু তাদের জন্য তৈরী করা হয়েছে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান এনেছে।
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই, এমন সাক্ষ্য যে সাক্ষীদাতা সে সাক্ষ্যের দলীল-প্রমাণাদি ও মূলনীতি সম্পর্কে সম্যক অবগত। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল। আল্লাহ তাঁর উপর সালাত পেশ করুন, যতদিন মৃদু বাতাস তার উত্তর, দক্ষিন থেকে প্রবাহিত হবে এবং সেটা সামনে ও পিছনে বয়ে যেতে থাকবে। আরও পেশ করুন আবু বকরের উপর যিনি সফর ও অবস্থান সর্বাবস্থায় তাঁর সাথী ছিলেন, অনুরূপ ‘উমারের ওপর, যিনি ইসলামকে এমন তলোয়ার দিয়ে হেফাযত করেছিলেন যার মধ্যে কোনো প্রকার খাঁজ পড়ার ভয় ছিল না, অনুরূপভাবে ‘উসমানের উপর, যিনি তার উপর আপতিত বিপদে ধৈর্যধারণকারী ছিলেন, আর আলীর উপর, যিনি তাঁর উপর কারও হামলা হওয়ার আগেই নিজের বীরত্বে ছিলেন সম্মুখগামী। অনুরূপভাবে রাসূলের সকল পরিবার-পরিজন, সাহাবীগণ এবং যুগ যুগ ধরে তাদের সুন্দর অনুসারীদের উপর। আর আল্লাহ তাদের উপর যথাযথ সালামও প্রেরণ করুন।
প্রিয় ভাইয়েরা! আপনার রবের ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে অগ্রসর হোন, যার প্রশস্ততা আসমান এবং জমিনের সমান; যাতে এমন নিয়ামত রয়েছে, যা কোনো চক্ষু কোনো দিন দেখে নি, কোনো কান শুনে নি এবং কোনো অন্তর কল্পনাও করে নি, এমন জান্নাতের প্রতি দ্রুত এগিয়ে চলুন।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ ۞مَّثَلُ ٱلۡجَنَّةِ ٱلَّتِي وُعِدَ ٱلۡمُتَّقُونَۖ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُۖ أُكُلُهَا دَآئِمٞ وَظِلُّهَاۚ﴾ [الرعد: ٣٥]
‘মুত্তাকীদের যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, সেটির দৃষ্টান্ত এরূপ, তার তলদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। তার খাদ্যসামগ্রী ও তার ছায়া সার্বক্ষণিক।’ {সূরা আর-রা‘দ, আয়াত: ৩৫}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ مَّثَلُ ٱلۡجَنَّةِ ٱلَّتِي وُعِدَ ٱلۡمُتَّقُونَۖ فِيهَآ أَنۡهَٰرٞ مِّن مَّآءٍ غَيۡرِ ءَاسِنٖ وَأَنۡهَٰرٞ مِّن لَّبَنٖ لَّمۡ يَتَغَيَّرۡ طَعۡمُهُۥ وَأَنۡهَٰرٞ مِّنۡ خَمۡرٖ لَّذَّةٖ لِّلشَّٰرِبِينَ وَأَنۡهَٰرٞ مِّنۡ عَسَلٖ مُّصَفّٗىۖ وَلَهُمۡ فِيهَا مِن كُلِّ ٱلثَّمَرَٰتِ وَمَغۡفِرَةٞ مِّن رَّبِّهِمۡۖ﴾ [محمد: ١٥]
‘মুত্তাকীদেরকে যে জান্নাতের ওয়াদা দেয়া হয়েছে তার দৃষ্টান্ত হল, তাতে রয়েছে নির্মল পানির নহরসমূহ, দুধের ঝর্নাধারা, যার স্বাদ পরিবর্তিত হয়নি, পানকারীদের জন্য সুস্বাদু সুরার নহরসমূহ এবং আছে পরিশোধিত মধুর ঝর্ণাধারা। তথায় তাদের জন্য থাকবে সব ধরনের ফলমূল আর তাদের রবের পক্ষ থেকে ক্ষমা।” {সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ১৫}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿وَبَشِّرِ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ أَنَّ لَهُمۡ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُۖ كُلَّمَا رُزِقُواْ مِنۡهَا مِن ثَمَرَةٖ رِّزۡقٗا قَالُواْ هَٰذَا ٱلَّذِي رُزِقۡنَا مِن قَبۡلُۖ وَأُتُواْ بِهِۦ مُتَشَٰبِهٗاۖ وَلَهُمۡ فِيهَآ أَزۡوَٰجٞ مُّطَهَّرَةٞۖ وَهُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٢٥ ﴾ [البقرة: ٢٥]
‘(হে রাসূল!) আপনি তাদের সুসংবাদ দিন, যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে। নিশ্চয়ই তাদের জন্য রয়েছে এমন জান্নাত, যা তলদেশ দিয়ে নহরসমূহ প্রবাহিত। যখন জান্নাতবাসীদের কোনো ফল-ফলাদি প্রদান করা হবে, কখন তারা বলবে, এ তো ওই রিযিক যা আমাদেরকে ইতোপূর্বে দেয়া হয়েছিল এবং অনুরুপ ফলও প্রদান কর হয়েছিল। আর তথায় তাদের জন্য রয়েছে পবিত্রতমা স্ত্রীগণ। আর তারা সেখানে স্থায়ী হবে।’ {সূরা আল-বাকারাহ্‌, আয়াত: ২৫}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ وَدَانِيَةً عَلَيۡهِمۡ ظِلَٰلُهَا وَذُلِّلَتۡ قُطُوفُهَا تَذۡلِيلٗا ١٤ وَيُطَافُ عَلَيۡهِم بَِٔالنِيَةٖ مِّن فِضَّةٖ وَأَكۡوَابٖ كَانَتۡ قَوَارِيرَا۠ ١٥ قَوَارِيرَاْ مِن فِضَّةٖ قَدَّرُوهَا تَقۡدِيرٗا ١٦ وَيُسۡقَوۡنَ فِيهَا كَأۡسٗا كَانَ مِزَاجُهَا زَنجَبِيلًا ١٧ عَيۡنٗا فِيهَا تُسَمَّىٰ سَلۡسَبِيلٗا ١٨ ۞وَيَطُوفُ عَلَيۡهِمۡ وِلۡدَٰنٞ مُّخَلَّدُونَ إِذَا رَأَيۡتَهُمۡ حَسِبۡتَهُمۡ لُؤۡلُؤٗا مَّنثُورٗا ١٩ وَإِذَا رَأَيۡتَ ثَمَّ رَأَيۡتَ نَعِيمٗا وَمُلۡكٗا كَبِيرًا ٢٠ ﴾ [الانسان: ١٤، ٢٠]
‘তাদের উপর সন্নিহিত থাকবে উদ্যানের ছায়া এবং তার ফলমূলের থোকাসমূহ তাদের সম্পূর্ণ আয়ত্তাধীন করা হবে। তাদের চারপাশে আবর্তিত হবে রৌপ্যপাত্র ও স্ফটিক স্বচ্ছ পানপাত্র- রূপার ন্যায় শুভ্র স্ফটিক পাত্র; যার পরিমাপ তারা নির্ধারণ করবে। সেখানে তাদেরকে পান করানো হবে পাত্রভরা আদা-মিশ্রিত সুরা, সেখানকার এক ঝর্ণা যার নাম হবে সালসাবীল। আর তাদের চারপাশে প্রদক্ষিণ করবে চিরকিশোরেরা; তুমি তাদেরকে দেখলে বিক্ষিপ্ত মুক্তা মনে করবে। আর তুমি যখন দেখবে তুমি সেখানে দেখতে পাবে স্বাচ্ছন্দ্য ও বিরাট সাম্রাজ্য।’ {সূরা আন-ইনসান, আয়াত: ১৪-২০}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ فِي جَنَّةٍ عَالِيَةٖ ١٠ لَّا تَسۡمَعُ فِيهَا لَٰغِيَةٗ ١١ فِيهَا عَيۡنٞ جَارِيَةٞ ١٢ فِيهَا سُرُرٞ مَّرۡفُوعَةٞ ١٣ وَأَكۡوَابٞ مَّوۡضُوعَةٞ ١٤ وَنَمَارِقُ مَصۡفُوفَةٞ ١٥ وَزَرَابِيُّ مَبۡثُوثَةٌ ١٦ ﴾ [الغاشية: ١٠، ١٦]
‘তারা সুউচ্চ জান্নাতে অবস্থান কবে, আর তারা সেখানে কোনো অনর্থক কথা-বার্তা শুনতে পাবে না এবং তথায় তাদের জন্য থাকবে প্রবাহমান ঝর্ণাধারা। তথায় রয়েছে সুউচ্চ পালংক, সদা প্রস্তুত পান-পাত্র, সারিবদ্ধ বালিশ ও উন্নত মানসম্পন্ন বিছানাসমূহ।’ {সূরা আল-গাশিয়া, আয়াত: ১০-১৬}
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿يُحَلَّوۡنَ فِيهَا مِنۡ أَسَاوِرَ مِن ذَهَبٖ وَلُؤۡلُؤٗاۖ وَلِبَاسُهُمۡ فِيهَا حَرِيرٞ ٢٣ ﴾ [الحج: ٢٣]
‘জান্নাতীদের স্বর্ণের ও মনিমুক্তার অলঙ্কার পরিধান করানো হবে এবং রেশমী কাপড়ের পোশাক পরিধান করানো হবে। {সূরা আল-হজ, আয়াত: ২৩}
* আল্লাহ আরো বলেন:
﴿عَٰلِيَهُمۡ ثِيَابُ سُندُسٍ خُضۡرٞ وَإِسۡتَبۡرَقٞۖ وَحُلُّوٓاْ أَسَاوِرَ مِن فِضَّةٖ وَسَقَىٰهُمۡ رَبُّهُمۡ شَرَابٗا طَهُورًا ٢١ ﴾ [الانسان: ٢١]
‘তাদের উপর থাকবে সবুজ ও মিহি রেশমের পোশাক এবং মোটা রেশমের পোশাক, আর তাদেরকে পরিধান করানো হবে রূপার চুড়ি এবং তাদের রব তাদেরকে পান করাবেন পবিত্র পানীয়।’ {সূরা আল-ইনসান/আদ-দাহর, আয়াত: ২১}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿مُتَّكِ‍ِٔينَ عَلَىٰ رَفۡرَفٍ خُضۡرٖ وَعَبۡقَرِيٍّ حِسَانٖ ٧٦ ﴾ [الرحمن: ٧٦]
‘তারা সবুজ বালিশে ও সুন্দর কারুকার্য খচিত গালিচার উপর হেলান দেয়া অবস্থায় থাকবে।’ {সূরা আর-রহমান, আয়াত: ৬৭}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿مُّتَّكِ‍ِٔينَ فِيهَا عَلَى ٱلۡأَرَآئِكِۖ لَا يَرَوۡنَ فِيهَا شَمۡسٗا وَلَا زَمۡهَرِيرٗا١٣﴾ [الانسان: ١٣]
‘তারা সেখানে সুউচ্চ আসনে হেলান দিয়ে আসীন থাকবে। তারা সেখানে না দেখবে অতিশয় গরম, আর না অত্যধিক শীত।’ {সূরা আল-ইনসান/আদ-দাহর, আয়াত: ১৩}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿إِنَّ ٱلۡمُتَّقِينَ فِي مَقَامٍ أَمِينٖ ٥١ فِي جَنَّٰتٖ وَعُيُونٖ ٥٢ يَلۡبَسُونَ مِن سُندُسٖ وَإِسۡتَبۡرَقٖ مُّتَقَٰبِلِينَ ٥٣ كَذَٰلِكَ وَزَوَّجۡنَٰهُم بِحُورٍ عِينٖ ٥٤ يَدۡعُونَ فِيهَا بِكُلِّ فَٰكِهَةٍ ءَامِنِينَ ٥٥ ﴾ [الدخان: ٥١، ٥٥]
‘নিশ্চয় মুত্তাকীরা থাকবে নিরাপদ স্থানে, বাগ-বাগিচা ও ঝর্ণাধারার মধ্যে, তারা পরিধান করবে পাতলা ও পুরু রেশমী বস্ত্র এবং বসবে মুখোমুখী হয়ে। এরূপই ঘটবে, আর আমি তাদেরকে বিয়ে দেব ডাগর নয়না হূরদের সাথে। সেখানে তারা প্রশান্তচিত্তে সকল প্রকারের ফলমূল আনতে বলবে।’ {সূরা আদ-দুখান, আয়াত: ৫১-৫৫}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ٱدۡخُلُواْ ٱلۡجَنَّةَ أَنتُمۡ وَأَزۡوَٰجُكُمۡ تُحۡبَرُونَ ٧٠ يُطَافُ عَلَيۡهِم بِصِحَافٖ مِّن ذَهَبٖ وَأَكۡوَابٖۖ وَفِيهَا مَا تَشۡتَهِيهِ ٱلۡأَنفُسُ وَتَلَذُّ ٱلۡأَعۡيُنُۖ وَأَنتُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٧١﴾ [الزخرف: ٧٠، ٧٤]
‘তোমরা সস্ত্রীক সানন্দে জান্নাতে প্রবেশ কর। স্বর্ণখচিত থালা ও পানপাত্র নিয়ে তাদেরকে প্রদক্ষিণ করা হবে, সেখানে মন যা চায় আর যাতে চোখ তৃপ্ত হয় তা-ই থাকবে এবং সেখানে তোমরা হবে স্থায়ী।’ {সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ৭০-৭১}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ فِيهِنَّ قَٰصِرَٰتُ ٱلطَّرۡفِ لَمۡ يَطۡمِثۡهُنَّ إِنسٞ قَبۡلَهُمۡ وَلَا جَآنّٞ ٥٦ فَبِأَيِّ ءَالَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ ٥٧ كَأَنَّهُنَّ ٱلۡيَاقُوتُ وَٱلۡمَرۡجَانُ ٥٨ ﴾ [الرحمن: ٥٦، ٥٨]
‘সেখানে থাকবে স্বামীর প্রতি দৃষ্টি সীমিতকারী মহিলাগণ, যাদেরকে ইতঃপূর্বে স্পর্শ করেনি কোন মানুষ আর না কোন জিন। সুতরাং তোমাদের রবের কোন্ নি‘আমতকে তোমরা উভয়ে অস্বীকার করবে? তারা যেন পদ্মরাগ ও প্রবাল। {সূরা আর-রহমান, আয়াত: ৫৬-৫৭}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ فِيهِنَّ خَيۡرَٰتٌ حِسَانٞ ٧٠ فَبِأَيِّ ءَالَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ ٧١ حُورٞ مَّقۡصُورَٰتٞ فِي ٱلۡخِيَامِ ٧٢ ﴾ [الرحمن: ٧٠، ٧٢]
‘সেই জান্নাতসমূহে থাকবে উত্তম চরিত্রবতী অনিন্দ্য সুন্দরীগণ। সুতরাং তোমাদের রবের কোন্ নিআমতকে তোমরা উভয়ে অস্বীকার করবে? তারা হূর, তাঁবুতে থাকবে সুরক্ষিতা।’ {সূরা আর-রহমান, আয়াত: ৭০-৭২}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ فَلَا تَعۡلَمُ نَفۡسٞ مَّآ أُخۡفِيَ لَهُم مِّن قُرَّةِ أَعۡيُنٖ جَزَآءَۢ بِمَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٧ ﴾ [السجدة: ١٧]
‘কেউ জানে না তাদের জন্য নয়ন প্রীতিকর কী নিয়ামত লুকিয়ে রাখা হয়েছে, তাদের কৃতকর্মের পুরস্কারস্বরূপ।’ {সূরা আস-সিজদা, আয়াত: ১৭}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ ۞لِّلَّذِينَ أَحۡسَنُواْ ٱلۡحُسۡنَىٰ وَزِيَادَةٞۖ وَلَا يَرۡهَقُ وُجُوهَهُمۡ قَتَرٞوَلَا ذِلَّةٌۚ أُوْلَٰٓئِكَ أَصۡحَٰبُ ٱلۡجَنَّةِۖ هُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٢٦ ﴾ [يونس: ٢٦]
‘যারা সৎকর্ম করেছে, তাদের জন্য রয়েছে হুসনা তথা সুন্দর প্রতিদান এবং তা আরো বাড়তি কিছু। আর তাদের মুখমণ্ডলকে আবৃত করবে না মলিনতা কিংবা অপমান। তারাই জান্নাতের অধিকারী, সেখায় অনন্তকাল বসবাস করতে থাকবে।’ {সূরা ইউনুস, আয়াত: ২৬}
এ আয়াতে বর্ণিত ‘হুসনা’ বা সুন্দর হলো জান্নাত; কেননা জান্নাতের চেয়ে সুন্দর আর কোনো আবাস নেই। আর আয়াতে বর্ণিত আরো বাড়তি কিছু হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার দর্শন। আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় করুণা ও দয়ায় আমাদের তা দান করুন।
তাছাড়া জান্নাতের গুণাগুণ, নিয়ামতরাজি, সন্তুষ্টি ও আনন্দদায়ক বিষয়ের বর্ণনায় কুরআনুল কারীমের বহু আয়াত রয়েছে।
হাদীসে জান্নাতের বিবরণ:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম জান্নাত সম্পর্কে যেসব বিবরণ দিয়েছেন, নমুনা স্বরূপ তার কিছু নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
* আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
قُلْنَا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، حَدِّثْنَا عَنِ الْجَنَّةِ، مَا بِنَاؤُهَا؟ قَالَ: لَبِنَةُ ذَهَبٍ وَلَبِنَةُ فِضَّةٍ، وَمِلَاطُهَا الْمِسْكُ الْأَذْفَرُ، وَحَصْبَاؤُهَا اللُّؤْلُؤُ وَالْيَاقُوتُ، وَتُرَابُهَا الزَّعْفَرَانُ، مَنْ يَدْخُلُهَا يَنْعَمُ وَلَا يَبْأَسُ، وَيَخْلُدُ وَلَا يَمُوتُ، لَا تَبْلَى ثِيَابُهُ وَلَا يَفْنَى شَبَابُهُ
‘আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের জান্নাত সম্পর্কে বর্ণনা করুন, তা কিসের তৈরি? উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, স্বর্ণ ও রৌপ্যের ইটের তৈরি, তার গাঁথুনী হবে মিশক আম্বরের। তার নুড়ি বা কংকর হবে মনিমুক্তা ও ইয়াকুত পাথরের। আর তার মাটি যা‘ফরানের। যে তাতে প্রবেশ করবে সে (অশেষ) নিয়ামতপ্রাপ্ত হবে। নিরাশ হবে না, বা অভাব বোধ করবে না, সে তথায় চিরস্থায়ী হবে; মৃত্যুবরণ করবে না। তার পোশাক (কখনও) পুরাতন হবে না। তার যৌবন শেষ হবে না।’
* সহীহ মুসলিমে এসেছে, সাহাবী উৎবাহ ইবন গাযওয়ান একদিন ভাষণ দিতে গিয়ে আল্লাহর প্রশংসা ও তার স্তুতি প্রকাশ করে বললেন,
أَمَّا بَعْدُ، فَإِنَّ الدُّنْيَا قَدْ آذَنَتْ بِصَرْمٍ وَوَلَّتْ حَذَّاءَ، وَلَمْ يَبْقَ مِنْهَا إِلَّا صُبَابَةٌ كَصُبَابَةِ الْإِنَاءِ، يَتَصَابُّهَا صَاحِبُهَا، وَإِنَّكُمْ مُنْتَقِلُونَ مِنْهَا إِلَى دَارٍ لَا زَوَالَ لَهَا، فَانْتَقِلُوا بِخَيْرِ مَا بِحَضْرَتِكُمْ، فَإِنَّهُ قَدْ ذُكِرَ لَنَا أَنَّ الْحَجَرَ يُلْقَى مِنْ شَفَةِ جَهَنَّمَ، فَيَهْوِي فِيهَا سَبْعِينَ عَامًا، لَا يُدْرِكُ لَهَا قَعْرًا، وَوَاللهِ لَتُمْلَأَنَّ، أَفَعَجِبْتُمْ؟ وَلَقَدْ ذُكِرَ لَنَا أَنَّ مَا بَيْنَ مِصْرَاعَيْنِ مِنْ مَصَارِيعِ الْجَنَّةِ مَسِيرَةُ أَرْبَعِينَ سَنَةً، وَلَيَأْتِيَنَّ عَلَيْهَا يَوْمٌ وَهُوَ كَظِيظٌ مِنَ الزِّحَامِ
‘অতঃপর, দুনিয়া তার সমাপ্তির এবং পশ্চাদাপসারণের ঘোষণা দিচ্ছে। দুনিয়ার কিছুই বাকী থাকবে না, একমাত্র ততটুকু যা পাত্রের নিচে অবশিষ্ট থাকে; যা পাত্রের মালিক গ্রহণ করে থাকে। নিশ্চয়ই তোমরা এমন এক বাড়ীর দিকে অগ্রসর হচ্ছো যা শেষ হওয়ার নয়। অতএব তোমরা উত্তম আমলসহ সেদিকে স্থানান্তরিত হও। আর আমাদের কাছে বর্ণনা করা হয়েছে যে, জান্নাতের দরজার দুই কপাটের মধ্যকার ব্যবধান চল্লিশ বছরের রাস্তার সমপরিমাণ। অথচ এমন একদিন আসবে যেদিন সেখানেও প্রচণ্ড ভীড় থাকবে।’
* অন্য হাদীসে রয়েছে, সাহল ইবন সা‘দ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
فِي الجَنَّةِ ثَمَانِيَةُ أَبْوَابٍ، فِيهَا بَابٌ يُسَمَّى الرَّيَّانَ، لاَ يَدْخُلُهُ إِلَّا الصَّائِمُونَ
‘জান্নাতের আটটি দরজা আছে, তন্মধ্যে একটি দরজার নাম রাইয়্যান। এ দরজা দিয়ে সিয়াম পালনকারী ছাড়া অন্য কেউ প্রবেশ করবে না।’
* হাদীসে আরও রয়েছে:
عَنْ أُسَامَةَ بْنِ زَيْدٍ، قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَاتَ يَوْمٍ لِأَصْحَابِهِ: أَلَا هَلْ مُشَمِّرٍ لِلْجَنَّةِ، فَإِنَّ الْجَنَّةَ لَا خَطَرَ لَهَا هِيَ، وَرَبِّ الْكَعْبَةِ نُورٌ يَتَلَأْلَأُ، وَرَيْحَانَةٌ تَهْتَزُّ، وَقَصْرٌ مُشَيَّدٌ، وَنَهْرٌ مُطَّرِدٌ، وَفَاكِهَةٌ كَثِيرَةٌ نَضِيجَةٌ، وَزَوْجَةٌ حَسْنَاءُ جَمِيلَةٌ، وَحُلَلٌ كَثِيرَةٌ فِي مَقَامٍ أَبَدًا فِي حَبْرَةٍ وَنَضْرَةٍ فِي دَارٍ عَالِيَةٍ سَلِيمَةٍ بَهِيَّةٍ، قَالُوا: نَحْنُ الْمُشَمِّرُونَ لَهَا يَا رَسُولَ اللَّهِ، قَالَ: قُولُوا: إِنْ شَاءَ اللَّهُ
‘উসামা ইবন যায়েদ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সাবধান! জান্নাতে যাওয়ার ঐকান্তিক আগ্রহ ও প্রচেষ্টাকারী কেউ আছে কী? কেননা জান্নাত এমন এক বস্তু যার অবস্থা সম্পর্কে কল্পনাও উদিত হয় না। কা‘বার রবের কসম! তা হচ্ছে, উজ্জ্বল আলোকে উদ্ভাসিত, চকচককারী, সুগন্ধি সুবাতাস, সুরম্য অট্রালিকা, প্রবাহমান নদী, পাকা বা সুস্বাদু ফল, অনিন্দ্য সুন্দরী স্ত্রী এবং বাহারী পোশাক, তা হবে শান্তির চিরস্থায়ী নীড়। নিরাপদ বাসস্থান, ফল-মূল, চিরসবুজ, নেয়ামতপূর্ণ ও সুউচ্চ সুদৃশ্য মহল্লা। সাহাবাগণ আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা তো ওই জান্নাতের প্রতি প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষী ও এর জন্য প্রচেষ্টাকারী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি সাল্লাম বললেন, তোমরা বল ইন-শাআল্লাহ। অতঃপর উপস্থিত লোকেরা বললেন, ইন-শাআল্লাহ।’
* অনুরূপভাবে আবু সা‘ঈদ আল-খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إِنَّ فِى الْجَنَّةِ مِائَةَ دَرَجَةٍ لَوْ أَنَّ الْعَالَمِينَ اجْتَمَعُوا فِى إِحْدَاهُنَّ لَوَسِعَتْهُمْ.
‘নিশ্চয় জান্নাতের একশ স্তর রয়েছে, যদি পৃথিবীর সকল অধিবাসী তার একটি স্তরে একত্রিত হয়, তবুও তার বিস্তৃতি অক্ষ্ণ্নু থাকবে।’
অন্য এক হাদীসে ‘আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إِنَّ فِي الجَنَّةِ مِائَةَ دَرَجَةٍ، أَعَدَّهَا اللَّهُ لِلْمُجَاهِدِينَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، مَا بَيْنَ الدَّرَجَتَيْنِ كَمَا بَيْنَ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ، فَإِذَا سَأَلْتُمُ اللَّهَ، فَاسْأَلُوهُ الفِرْدَوْسَ، فَإِنَّهُ أَوْسَطُ الجَنَّةِ وَأَعْلَى الجَنَّةِ – أُرَاهُ – فَوْقَهُ عَرْشُ الرَّحْمَنِ، وَمِنْهُ تَفَجَّرُ أَنْهَارُ الجَنَّةِ
‘নিশ্চয়ই জান্নাতের একশতটি স্তর রয়েছে। আল্লাহ তার রাস্তায় জিহাদকারীদের জন্য তা তৈরি করেছেন। প্রতি দু’ স্তরের মধ্যে আসমান ও জমিনের ব্যবধান রয়েছে। সুতরাং তোমরা যখন আল্লাহর কাছে জান্নাত প্রার্থনা করবে, তখন জান্নাতুল ফিরদাউস প্রার্থনা করবে। কারণ তা জান্নাতের মাঝখানে অবস্থিত এবং সর্বোচ্চ জান্নাত, সেখান থেকেই জান্নাতের নদীসমূহ প্রবহিত হয়, এর ওপরই আল্লাহর আরশ অবস্থিত।’
* অন্য হাদীসে আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إِنَّ أَهْلَ الجَنَّةِ يَتَرَاءَوْنَ أَهْلَ الغُرَفِ مِنْ فَوْقِهِمْ، كَمَا يَتَرَاءَوْنَ الكَوْكَبَ الدُّرِّيَّ الغَابِرَ فِي الأُفُقِ، مِنَ المَشْرِقِ أَوِ المَغْرِبِ، لِتَفَاضُلِ مَا بَيْنَهُمْقَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ تِلْكَ مَنَازِلُ الأَنْبِيَاءِ لاَ يَبْلُغُهَا غَيْرُهُمْ، قَالَ: بَلَى وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، رِجَالٌ آمَنُوا بِاللَّهِ وَصَدَّقُوا المُرْسَلِينَ
‘জান্নাতবাসীরা পরস্পর পরস্পরকে কক্ষে অবস্থানরত উপরের দিকে দেখতে পাবে, যেমন- তোমরা দূর আকাশের প্রান্তদেশে পূর্ব বা পশ্চিমে মোতির ন্যায় উজ্জ্বল তারকারাজী দেখে থাকো। আর এটা হবে তাদের পরস্পরের মর্যাদার ভিত্তিতে। সাহাবীগণ বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ওই স্থান কি নবীদের? তথায় তাঁরা ছাড়া আর কেউ কি পৌঁছতে পারবে না? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, হ্যাঁ, ওই সত্তার কসম যার হাতে আমার জীবন! তারা হচ্ছে এমন লোক যারা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে এবং রাসূলদের যথাযথ সত্য বলে বিশ্বাস করেছে।’
* অনুরূপভাবে আবূ মালেক আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
إِنَّ فِي الْجَنَّةِ غُرَفًا يُرَى ظَاهِرُهَا مِنْ بَاطِنِهَا، وَبَاطِنُهَا مِنْ ظَاهِرُهَا، فَقَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُولَ اللَّهِ تِلْكَ مَنَازِلُ الْأَنْبِيَاءِ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَعَدَّهَا اللَّهُ لِمَنْ أَطْعَمَ الطَّعَامَ، وَأَفْشَى السَّلَامَ، وَأَدَامَ الصِّيَامَ، وَصَلَّى بِاللَّيْلِ، وَالنَّاسُ نِيَامٌ.
‘নিশ্চয়ই জান্নাতের মাঝে অনেকগুলো কামরা থাকবে। যার ভেতর থেকে বাইরে এবং বাইরে থেকে ভেতরে দেখা যাবে। আল্লাহ তা তৈরি করেছেন ওই সকল ব্যক্তির জন্য, যারা মানুষকে খাদ্য দেয়, সিয়াম পালন করে এবং মানুষ যখন ঘুমায়, তখন তারা সালাতে মগ্ন থাকে।’
* অন্য হাদীসে আবূ মুসা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
إِنَّ لِلْمُؤْمِنِ فِي الْجَنَّةِ لَخَيْمَةً مِنْ لُؤْلُؤَةٍ وَاحِدَةٍ مُجَوَّفَةٍ، طُولُهَا سِتُّونَ مِيلًا، لِلْمُؤْمِنِ فِيهَا أَهْلُونَ، يَطُوفُ عَلَيْهِمِ الْمُؤْمِنُ فَلَا يَرَى بَعْضُهُمْ بَعْضًا
‘নিশ্চয়ই মুমিনদের জন্য জান্নাতে একটি সুরক্ষিত মোতির তাবু থাকবে। আসমানের দিকে তার দৈর্ঘ্য হবে ষাট মঞ্জিল। আর মুমিনদের জন্য সেখানে এমন পরিবারসমূহ থাকবে, মুমিন সে তাঁবুগুলোর চারপাশে ঘোরাফেরা করবে অথচ তাদের কেউ কাউকে দেখতে পাবে না।’
* অনুরূপভাবে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে রয়েছে, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إِنَّ أَوَّلَ زُمْرَةٍ يَدْخُلُونَ الجَنَّةَ عَلَى صُورَةِ القَمَرِ لَيْلَةَ البَدْرِ، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ عَلَى أَشَدِّ كَوْكَبٍ دُرِّيٍّ فِي السَّمَاءِ إِضَاءَةً، لاَ يَبُولُونَ وَلاَ يَتَغَوَّطُونَ، وَلاَ يَتْفِلُونَ وَلاَ يَمْتَخِطُونَ، أَمْشَاطُهُمُ الذَّهَبُ، وَرَشْحُهُمُ المِسْكُ، وَمَجَامِرُهُمْ الأَلُوَّةُ الأَنْجُوجُ، عُودُ الطِّيبِ وَأَزْوَاجُهُمُ الحُورُ العِينُ، عَلَى خَلْقِ رَجُلٍ وَاحِدٍ، عَلَى صُورَةِ أَبِيهِمْ آدَمَ، سِتُّونَ ذِرَاعًا فِي السَّمَاءِ
‘সর্বপ্রথম যে দল জান্নাতে প্রবেশ করবে, তাদের চেহারা হবে পুর্ণিমার চাঁদের ন্যায়। তারপর যে দলটি প্রবেশ করবে তারা হবে আকাশের সবচেয়ে আলোকিত তারকার চেয়ে উজ্জ্বল। যারা জান্নাতে যাবে তারা পেশাব করবে না, পায়খানা করবে না, থুতু আসবে না, কফ-শ্লেষাও আসবে না। তাদের চিরুনী হবে স্বর্ণের, ঘাম হবে মেশকের ন্যায় সুগন্ধিযুক্ত। তাদের সুগন্ধি কাঠ হবে মুল্যবান আলাঞ্জুজ (সুগন্ধিযুক্ত কাঠ) সকলের গঠন হবে আদি পিতা আদম ‘আলাইহিস সালামের ন্যায় লম্বায় ঘাট হাত লম্বা।’
অন্য বর্ণনায় আছে,
لاَ اخْتِلاَفَ بَيْنَهُمْ وَلاَ تَبَاغُضَ، قُلُوبُهُمْ قَلْبٌ وَاحِدٌ، يُسَبِّحُونَ اللَّهَ بُكْرَةً وَعَشِيًّا
‘তাদের মধ্যে কোনো মতনৈক্য থাকবে না। তারা পরস্পর হিংসা করবে না, তারা সকলে এক আত্মা সদৃশ হবে এবং সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর প্রশংসা করবে।’
অন্য বর্ণনায় এসেছে,
وَأَزْوَاجُهُمُ الحُورُ العِينُ
“আর তাদের স্ত্রীগণ হবেন ডাগর নয়না হূরীগণ” ।
* অন্য হাদীসে রয়েছে, জাবের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إِنَّ أَهْلَ الْجَنَّةِ يَأْكُلُونَ فِيهَا وَيَشْرَبُونَ، وَلَا يَتْفُلُونَ وَلَا يَبُولُونَ وَلَا يَتَغَوَّطُونَ وَلَا يَمْتَخِطُونَقَالُوا: فَمَا بَالُ الطَّعَامِ؟ قَالَ: جُشَاءٌ وَرَشْحٌ كَرَشْحِ الْمِسْكِ، يُلْهَمُونَ التَّسْبِيحَ وَالتَّحْمِيدَ، كَمَا تُلْهَمُونَ النَّفَسَ
‘নিশ্চয় জান্নাতীগণ পানাহার করবে অথচ থুতু ফেলবে না, পেশাব-পায়খানাও করবে না, নাকও ঝাড়বে না। সাহাবীগণ বললেন, তাহলে খাদ্যের কি হবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তারা ঢেকুর দেবে এবং মিশকের ন্যায় ঘাম বের হবে। তাদের তাসবীহ ও তাহমীদ শিখিয়ে দেয়া হবে যেমনি তাদেরকে শ্বাস-প্রশ্বাসের ইলহাম হবে।’
* অন্য হাদীসে রয়েছে, যায়েদ ইবন আরকাম থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ ، إِنَّ أَحَدَهُمْ لَيُعْطَى قُوَّةَ مِئَةِ رَجُلٍ فِي الْمَطْعَمِ وَالْمَشْرَبِ وَالشَّهْوَةِ وَالْجِمَاعِ . حَاجَةُ أَحَدِهِمْ عَرَقٌ يَفِيضُ مِنْ جُلُودِهِمْ مِثْلُ رِيحِ الْمِسْكِ، فَإِذَا الْبَطْنُ قَدْ ضَمُرَ.
‘শপথ ওই সত্তার! যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন, নিশ্চয়ই তাদের মধ্য হতে অর্থাৎ জান্নাতবাসীদের মধ্য হতে প্রত্যেককে একশত ব্যক্তির ন্যায় পানাহার, সহবাস শক্তি ও চাহিদা প্রদান করা হবে। তাদের শরীরের প্রয়োজন (পয়ঃনিস্কাষণের ব্যবস্থা) হবে শরীরের চামড়ার উপর থেকে বের হওয়া ঘাম, যা মিশকের ন্যায় সুগন্ধিযুক্ত হবে। অতঃপর তাদের পেট আবার খালি হয়ে যাবে।’
* অন্য হাদীসে রয়েছে, আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
وَلَقَابُ قَوْسِ أَحَدِكُمْ، أَوْ مَوْضِعُ قَدَمٍ مِنَ الجَنَّةِ، خَيْرٌ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيهَا، وَلَوْ أَنَّ امْرَأَةً مِنْ نِسَاءِ أَهْلِ الجَنَّةِ اطَّلَعَتْ إِلَى الأَرْضِ لَأَضَاءَتْ مَا بَيْنَهُمَا، وَلَمَلَأَتْ مَا بَيْنَهُمَا رِيحًا، وَلَنَصِيفُهَا – يَعْنِي الخِمَارَ – خَيْرٌ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيهَا
“জান্নাতে তোমাদের কারও ধনুক অথবা কারও পা রাখার স্থান দুনিয়া ও তাতে যা আছে তা থেকেও উত্তম। যদি কোনো জান্নাতি মহিলা যমীনের দিকে তাকাতো তবে যমীন পর্যন্ত সকল স্থান আলোকিত হয়ে যেতো, আর তার সুগন্ধে এ সকল স্থান পূর্ণ হয়ে যেতো। জান্নাতি মহিলার একটি উড়না দুনিয়া ও তার মধ্যে যা আছে তা থেকে উত্তম।’
* অন্য হাদীসে রয়েছে, আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إِنَّ فِى الْجَنَّةِ لَسُوقًا يَأْتُونَهَا كُلَّ جُمُعَةٍ فَتَهُبُّ رِيحُ الشَّمَالِ فَتَحْثُو فِى وُجُوهِهِمْ وَثِيَابِهِمْ فَيَزْدَادُونَ حُسْنًا وَجَمَالاً فَيَرْجِعُونَ إِلَى أَهْلِيهِمْ وَقَدِ ازْدَادُوا حُسْنًا وَجَمَالاً فَيَقُولُ لَهُمْ أَهْلُوهُمْ وَاللَّهِ لَقَدِ ازْدَدْتُمْ بَعْدَنَا حُسْنًا وَجَمَالاً. فَيَقُولُونَ وَأَنْتُمْ وَاللَّهِ لَقَدِ ازْدَدْتُمْ بَعْدَنَا حُسْنًا وَجَمَالاً.
‘নিশ্চয় জান্নাতে একটি বাজার রয়েছে। জান্নাতীগণ প্রতি শুক্রবার সে বাজারে আসবেন। অতঃপর উত্তরের বাতাস তাদের মুখমণ্ডল ও কাপড়ের উপর প্রবাহিত হবে। এতে তাদের সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি পাবে। অতঃপর তারা যখন নিজ পরিবারের কাছে প্রত্যাবর্তন করবে, তখন তাদের স্ত্রীরা বলবে, আল্লাহর শপথ! আমাদের কাছ থেকে যাওয়ার পর তোমাদের সৌন্দর্য ও চিত্তাকর্ষকতা আরো বেড়ে গেছে।’
* তাছাড়া অন্য হাদীসে রয়েছে, ‘আবূ সাঈদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
يُنَادِي مُنَادٍ: إِنَّ لَكُمْ أَنْ تَصِحُّوا فَلَا تَسْقَمُوا أَبَدًا، وَإِنَّ لَكُمْ أَنْ تَحْيَوْا فَلَا تَمُوتُوا أَبَدًا، وَإِنَّ لَكُمْ أَنْ تَشِبُّوا فَلَا تَهْرَمُوا أَبَدًا، وَإِنَّ لَكُمْ أَنْ تَنْعَمُوا فَلَا تَبْأَسُوا أَبَدًافَذَلِكَ قَوْلُهُ عَزَّ وَجَلَّ: {وَنُودُوا أَنْ تِلْكُمُ الْجَنَّةُ أُورِثْتُمُوهَا بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ} [الأعراف: ৪৩]
জান্নাতীগণ যখন জান্নাতে প্রবেশ করবে, তখন একজন আহ্বানকারী ঘোষণা করবেন: জেনে রাখ! তোমরা সর্বদা সুস্থ্য থাকবে; অসুস্থ হবে না। জীবিত থাকবে; কখনও মরবে না; সর্বদা যুবক থাকবে; কখনও বৃদ্ধ হবে না। নিয়ামত প্রাপ্ত হবে; কখনও বঞ্চিত হবে না। এটাই হচ্ছে মহান আল্লাহর বাণী: “তোমরা যে (ভালো) আমল করতে, তারই জন্য তোমাদেরকে এই জান্নাতের উত্তরাধিকারী করা হয়েছে।’ {সূরা আল-‘আরাফ, আয়াত: ৪৩}’
* অন্য হাদীসে রয়েছে, আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
قَالَ اللَّهُ أَعْدَدْتُ لِعِبَادِي الصَّالِحِينَ مَا لاَ عَيْنٌ رَأَتْ، وَلاَ أُذُنٌ سَمِعَتْ، وَلاَ خَطَرَ عَلَى قَلْبِ بَشَرٍ، فَاقْرَءُوا إِنْ شِئْتُمْ فَلاَ تَعْلَمُ نَفْسٌ مَا أُخْفِيَ لَهُمْ مِنْ قُرَّةِ أَعْيُنٍقَالَ أَبُو هُرَيْرَةَ: اقْرَءُوا إِنْ شِئْتُمْ: {فَلاَ تَعْلَمُ نَفْسٌ مَا أُخْفِيَ لَهُمْ مِنْ قُرَّةِ أَعْيُنٍ} [السجدة: ১৭]
‘আল্লাহ তা‘আলা বলছেন: আমি আমার পুণ্যবান বান্দাদের জন্য এমন সব নিয়ামত প্রস্তুত করে রেখেছি, যা কখনও কোনো চক্ষু দেখে নি, কোনো কান শুনে নি এবং কোনো অন্তকরণ কল্পনাও করে নি। (তিনি বলেন) এর সত্যতা প্রমাণে তোমরা ইচ্ছা করলে এই আয়াতটি পাঠ করতে পার। “কোনো প্রাণী জানে না, কৃতকর্মের প্রতিদানস্বরূপ চক্ষু শীতলকারী আনন্দদায়ক কী ধরনের নিয়ামত তাদের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে।” {সূরা আস-সাজদাহ, আয়াত: ১৭}’
* অন্য হাদীসে রয়েছে, সুহাইব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إِذَا دَخَلَ أَهْلُ الْجَنَّةِ الْجَنَّةَ، وَأَهْلُ النَّارِ النَّارَ، نَادَى مُنَادٍ: يَا أَهْلَ الْجَنَّةِ، إِنَّ لَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ مَوْعِدًا يُرِيدُ أَنْ يُنْجِزَكُمُوهُ، فَيَقُولُونَ: وَمَا هُوَ؟ أَلَمْ يُثَقِّلْ مَوَازِينَنَا، وَيُبَيِّضْ وُجُوهَنَا، وَيُدْخِلْنَا الْجَنَّةَ، وَيُجِرْنَا مِنَ النَّارِ ” قَالَ: فَيُكْشَفُ لَهُمُ الْحِجَابُ فَيَنْظُرُونَ إِلَيْهِقَالَ: فَوَاللَّهِ مَا أَعْطَاهُمْ شَيْئًا أَحَبَّ إِلَيْهِمْ مِنَ النَّظَرِ إِلَيْهِ، وَلَا أَقَرَّ لِأَعْيُنِهِمْ
‘যখন জান্নাতবাসী জান্নাতে প্রবেশ করবে, তখন এক ঘোষক ঘোষণা করে বলবে, হে জান্নাতীগণ! আল্লাহ তোমাদের জন্য যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা তিনি পূর্ণ করতে চাও। তারা উত্তরে বলবে সেটা আবার কী? তিনি কি আমাদের আমলের পাল্লাকে ভারী করে দেন নি? আমাদের চেহারা উজ্জ্বল করে দেন নি? আমাদেকে জান্নাতে প্রবেশ করান ন? জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন নি? তিনি বলেন, তখন তাদের জন্য পর্দা উম্মোচন করা হবে। তখন তারা তাঁর (আল্লাহর) দিকে তাকাবেন। আল্লাহর কসম! তাঁর দর্শনের চেয়ে অধিক প্রিয় এবং চক্ষু শীতলকারী কোনো প্রিয় বস্তুই তিনি মানুষকে দান করেন নি।’
* অন্য হাদীসে রয়েছে, আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إِنَّ اللَّهَ تَبَارَكَ وَتَعَالَى يَقُولُ لِأَهْلِ الجَنَّةِ: أُحِلُّ عَلَيْكُمْ رِضْوَانِي، فَلاَ أَسْخَطُ عَلَيْكُمْ بَعْدَهُ أَبَدًا
‘আল্লাহ রাব্বুল আলামীন জান্নাতীদের বলবেন, আমি তোমাদের ওপর চির দিনের জন্য সন্তুষ্ট হয়ে গেলাম। আর কখনও অসন্তুষ্ট হব না।’
হে আল্লাহ! আমাদের জান্নাতের স্থায়ী বাসিন্দা করে দিন এবং আমাদের ওপর সন্তুষ্টির অবারিত ঝর্ণাধারা বর্ষণ করুন। আর আপনার দর্শন ও সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হবার তাওফীক দান করুন; যে দর্শনে থাকবে না কোনো ধরণের ক্ষতি ও ক্ষতিকারী এবং ভ্রষ্টকারী ফিতনা।
হে আল্লাহ! সালাত ও সালাম বর্ষণ করুন আপনার বান্দা ও নবী মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাহবীর ওপর।
চতুর্বিংশ আসরঃজান্নাতীদের বৈশিষ্ট্যাবলি
আল্লাহ তাঁর বিশেষ দয়া ও অনুগ্রহে আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি সকল প্রাণবানকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার গঠন সুনিপুণ বানিয়েছেন। আসমানসমূহ ও যমীনকে পৃথক করে দিয়েছেন ইতোপূর্বে উভয়ে ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিল। আপন প্রজ্ঞানুযায়ী বান্দাদের ভাগ্যবান ও হতভাগার শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। ভাগ্যবানদের কিছু কারণ নির্ধারণ করেছেন যা মুত্তাকী অবলম্বন করে। তারা অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে পরিণামের প্রতি লক্ষ্য করে যা অনন্তকালের তাই পছন্দ করে। আমি প্রশংসা করি তাঁর, আর এ স্বীকৃতি প্রদান করছি যে আমি তার প্রশংসার হক আদায় করতে সমর্থ নই। আমি তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি আর তিনি অনন্ত কৃতজ্ঞতা পাবার যোগ্য।
আমি সাক্ষ্য দেই যে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই; তাঁর কোনো শরীক নেই। তিনি সকল সৃষ্টিকুলের সত্যিকারের মালিক; তারা সবাই তার দাস। আমি আরও সাক্ষ্য দেই যে মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসূল। যিনি সুরত ও সীরাতে তথা চেহারা ও চরিত্রে পূর্ণতর ও সুন্দরতম ব্যক্তি।
আল্লাহ সালাত ও সালাম বর্ষিত করুন তাঁর ওপর, তাঁর সাহাবী আবূ বকরের ওপর যিনি অনুসারীদের মধ্যে মর্যাদায় ছিনিয়ে নেয়ায় বিজয়ী প্রতিযোগী, উমরের ওপর যিনি ছিলেন ন্যায়বিচারক যার তুলনা নয় কোনো মানুষ, উসমানের ওপর যিনি প্রত্যশা মাফিক শাহাদাতের জন্য নিজেকে সমর্পণ করেছেন, আলীর ওপর যিনি ক্ষণিকের বিষয়াবলি বিকিয়েছেন এবং অনন্তের বিষয়াদি খরিদ করেছেন এবং তাঁর পরিবার-পরিজন আর আল্লাহর দীনের যথার্থ সাহায্যকারী তাঁর সাহাবীগণের ওপর।
মুসলিম ভাইয়েরা! আপনারা জান্নাতের নিয়ামতসমূহ ও তাতে বিভিন্ন প্রকারের খুশি ও আনন্দের বস্তু সম্পর্কে শুনেছেন। আল্লাহর শপথ, জান্নাত এতই উপযুক্ত যে এর জন্য প্রত্যেক আমলকারী আমল করবে এবং প্রতিযোগীরা এতে প্রতিযযোগিতা করবে। আর মানুষ এর অন্বেষণে জীবন বিসর্জন করবে; এর চেয়ে নিম্নমানের বস্তু থেকে বিমুখ হবে।
যদি তোমরা আমাকে জিজ্ঞেস কর যে, এর জন্য কী আমল করতে হবে এবং তা লাভের পথ কী?
তাহলে বলব যে, এর উত্তর আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় কালামে ওহীর মাধ্যমে সর্বোত্তম সৃষ্টি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যবানীতে বর্ণনা করেছেন।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ ۞وَسَارِعُوٓاْ إِلَىٰ مَغۡفِرَةٖ مِّن رَّبِّكُمۡ وَجَنَّةٍ عَرۡضُهَا ٱلسَّمَٰوَٰتُ وَٱلۡأَرۡضُ أُعِدَّتۡ لِلۡمُتَّقِينَ ١٣٣ ٱلَّذِينَ يُنفِقُونَ فِي ٱلسَّرَّآءِ وَٱلضَّرَّآءِ وَٱلۡكَٰظِمِينَ ٱلۡغَيۡظَ وَٱلۡعَافِينَ عَنِ ٱلنَّاسِۗ وَٱللَّهُ يُحِبُّ ٱلۡمُحۡسِنِينَ ١٣٤ وَٱلَّذِينَ إِذَا فَعَلُواْ فَٰحِشَةً أَوۡ ظَلَمُوٓاْ أَنفُسَهُمۡ ذَكَرُواْ ٱللَّهَ فَٱسۡتَغۡفَرُواْ لِذُنُوبِهِمۡ وَمَن يَغۡفِرُ ٱلذُّنُوبَ إِلَّا ٱللَّهُ وَلَمۡ يُصِرُّواْ عَلَىٰ مَا فَعَلُواْ وَهُمۡ يَعۡلَمُونَ ١٣٥ ﴾ [ال عمران: ١٣٣، ١٣٥]
‘আর তোমরা নিজ রবের ক্ষমা এবং জান্নাতের দিকে দ্রুত অগ্রসর হও, যার প্রশস্ততা আসমান ও যমীন সমপরিমাণ, যা মুত্তাকীদের জন্য তৈরি করা হয়েছে। যারা স্বচ্ছলতায় ও অভাবের সময় (আল্লাহর পথে) ব্যয় করে, নিজেদের গোস্বা সংবরণ করে এবং মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রর্দশন করে আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন। তারা কখনও কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে কিংবা কোনো মন্দ কাজে জড়িত হয়ে) নিজের ওপর জুলুম করে ফেললে, আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া আর কে পাপ ক্ষমা করতে পারে? তারা নিজের কৃতকর্মের জন্য হঠকারিতা প্রদর্শন করে না এবং জেনে শুনে (ওই পাপ) একধিকবার করে না।’ {সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩৩-১৩৫}
উল্লিখিত আয়াতসমূহে জান্নাতীদের গুণাবলি বর্ণনা করা হয়েছে:
১ম গুণ: তারা মুত্তাকী
তারা হচ্ছে ঐসব ব্যক্তিবর্গ, যারা তাদের রবের শাস্তি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে তাঁর আনুগত্য ও সওয়াবের আশায় যাবতীয় নির্দেশের বাস্তবায়ন করেছে এবং তার আনুগত্য ও শাস্তির ভয়ে যাবতীয় নিষিদ্ধ বস্তু পরিত্যাগ করেছে।
২য় গুণ: তারা স্বচ্ছলতা ও অভাবের সময় ব্যয় করে
তারা আল্লাহর আদিষ্ট স্থানে ব্যয় করে যেমন-যাকাত, সাদকা, প্রত্যেক পূণ্যের স্থান ও আল্লাহর পথে তথা-জিহাদ ও অন্যান্য ভালো কাজে প্রকাশ্যে ও গোপনে ব্যয় করে।
স্বচ্ছলতার কারণে অর্থের প্রতি তাদের মহব্বত বৃদ্ধি পায় না আর অর্থের লোভে কৃপণতা তাদেরকে স্পর্শ করে না। অনুরূপভাবে অভাব-অনটন বা দারিদ্র্য তাদেরকে প্রয়োজন পড়তে পারে এ আশংকায় সম্পদ ব্যয় করা থেকে বিরত রাখে না।
৩য় গুণ: তারা গোস্বা সংবরণ করে
তারা যখন ক্রোধান্বিত হয় তখন নিজেদের ক্রোধ হজম করে, ফলে তারা সীমালঙ্ঘন করে না এবং এর কারণে অন্যের ওপর হিংসা-দ্বেষে জড়িত হয়ে পড়ে না।
৪র্থ গুণ: তারা মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে
অর্থাৎ যারা তাদের ওপর জুলুম করে ও সীমালঙ্ঘন করে, তাদের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও নিজেদের জন্য প্রতিশোধ নেয় না।
* এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَٱللَّهُ يُحِبُّ ٱلۡمُحۡسِنِينَ ١٣٤ ﴾ [ال عمران: ٣٤]
‘আল্লাহ সৎ কর্মশীলদের ভালোবাসেন।’ {সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩৪} এর মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, ক্ষমা করা সেখানেই প্রশংসনীয়, যেখানে সেটা ইহসান তথা অনুগ্রহের মধ্যে পড়বে, যখন সেটা ক্ষমার স্থানে হয়, অর্থাৎ এর মাধ্যমে অপরাধীর সংশোধনের আশা করা যায়। কিন্তু যদি ক্ষমার কারণে সে ব্যক্তির অপরাধ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে তবে সেখানে তাকে ক্ষমা করা যেমন প্রশংসনীয় কাজ নয় তেমনি তার দ্বারা সাওয়াবেরও আশা করা যায় না।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ فَمَنۡ عَفَا وَأَصۡلَحَ فَأَجۡرُهُۥ عَلَى ٱللَّهِۚ﴾ [الشورى: ٤٠]
‘যে ক্ষমা করে ও সংশোধন করে, তার প্রতিদান তো রয়েছে আল্লাহর কাছে।’ {সূরা আশ-শুরা, আয়াত: ৪০}
৫ম গুণ: তারা অশ্লীল কাজ হয় গেলে কিংবা নিজেদের উপর যুলুম করলে নিজেদের অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে
‘ফাহেশা’ বা অশ্লীলতা ওই জাতীয় পাপকে বলে: যে পাপ মানুষ ঘৃণ্য ও নিকৃষ্ট মনে করে। আর তা হচ্ছে কবীরা গুনাহ। যেমন, ১. মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা, ২. পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, ৩. সুদ খাওয়া, ৪. ইয়াতীমের মাল ভক্ষণ করা, ৫. যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করা, ৬. যিনা করা, ৭. চুরি করা ইত্যাদি।
আর মন্দ কাজে জড়িত হয়ে নিজের ওপর জুলুম করা: এটা ব্যাপক বিষয়, যা সগীরা ও কবীরা উভয় গুনাহকে অন্তর্ভুক্ত করে।
সুতরাং যখন তারা কোনো দোষ বা গুনাহ করে বসে তখনই সে বিরাট সত্ত্বার কথা স্মরণ করে যার অবাধ্যতা তারা করছে; ফলে তারা তাঁকে ভয় পায়; কিন্তু সাথে সাথে তারা ক্ষমা ও দয়াকেও স্মরণ করে এবং সে ক্ষমা পাওয়ার উপায়সমূহ অবলম্বনে সচেষ্ট হয় আর তাঁর কাছে তাদের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে; আর তাঁর কাছে চায় তিনি যেন এ গুনাহগুলোকে তাঁর ক্ষমা দিয়ে ঢেকে দেন, সেগুলোর উপর শাস্তি দেওয়া থেকে বিরত থাকেন।
আর আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “আল্লাহ ছাড়া আর পাপ মার্জনাকারী কী কেউ আছে?” এর দ্বারা ইঙ্গিত রয়েছে যে, তারা আল্লাহ ছাড়া আর কারও কাছে ক্ষমা চায় না; কারণ, তিনি ব্যতীত কেউই ক্ষমা করতে পারে না।
৬ষ্ঠ গুণ: তারা জ্ঞাতসারে পাপ কাজ বারবার করে না:
অর্থাৎ তারা যে কাজটি করেছে সেটাকে পাপ জেনে, যাঁর অবাধ্য হয়েছে সে বিরাট সত্ত্বার কথা জেনে, তাঁর ক্ষমার বিষয়টি নিকটে মনে করে বারবার সে পাপটি করে না; বরং তারা সে পাপ দ্রুত বর্জন করে ও তাওবা করে; কারণ জেনে-বুঝে ছোট গুনাহ বারবার করার ফলে তা কবীরা গুনাহে রুপান্তরিত হয়ে যায়। আর তা ধীরে ধীরে গুনাহগারকে কঠিন পরিণতির দিকে ধাবিত করবে।
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ قَدۡ أَفۡلَحَ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ ١ ٱلَّذِينَ هُمۡ فِي صَلَاتِهِمۡ خَٰشِعُونَ ٢ وَٱلَّذِينَ هُمۡ عَنِ ٱللَّغۡوِ مُعۡرِضُونَ ٣ وَٱلَّذِينَ هُمۡ لِلزَّكَوٰةِ فَٰعِلُونَ ٤ وَٱلَّذِينَ هُمۡ لِفُرُوجِهِمۡ حَٰفِظُونَ ٥ إِلَّا عَلَىٰٓ أَزۡوَٰجِهِمۡ أَوۡ مَا مَلَكَتۡ أَيۡمَٰنُهُمۡ فَإِنَّهُمۡ غَيۡرُ مَلُومِينَ ٦ فَمَنِ ٱبۡتَغَىٰ وَرَآءَ ذَٰلِكَ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡعَادُونَ ٧ وَٱلَّذِينَ هُمۡ لِأَمَٰنَٰتِهِمۡ وَعَهۡدِهِمۡ رَٰعُونَ ٨ وَٱلَّذِينَ هُمۡ عَلَىٰ صَلَوَٰتِهِمۡ يُحَافِظُونَ ٩ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡوَٰرِثُونَ ١٠ ٱلَّذِينَ يَرِثُونَ ٱلۡفِرۡدَوۡسَ هُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ١١ ﴾ [المؤمنون: ١، ١١]
‘১. মুমিনগণ সফলকাম হয়েছে। ২. যারা নিজের সালাত বিনয় ও নম্রতার সঙ্গে আদায় করে। ৩. যারা অনর্থক কথাবার্তায় লিপ্ত হয় না। ৪. যারা যাকাত প্রদান করে। ৫. যারা নিজ যৌনাঙ্গ সংযত রাখে। ৬. তবে তাদের স্ত্রী ও মালিকানাভুক্ত দাসীদের ক্ষেত্রে সংযত না রাখলে তিরস্কৃত হবে না। ৭. অতঃপর কেউ এদের ছাড়া অন্যকে কামনা করলে তারা সীমালঙ্ঘনকারী হবে। ৮. এবং যারা আমানত ও অঙ্গীকার সম্পর্কে হুশিয়ার থাকে। ৯. এবং যারা তাদের সালাতসমূহের হিফাযত করে। ১০. তারাই উত্তরাধিকারী। ১১. যারা জান্নাতুল ফিরদাউসের উত্তরাধিকার লাভ করবে, তারা তাতে চিরকাল থাকবে।’ {সূরা আল-মুমিনূন, আয়াত : ১-১১}
উল্লিখিত আয়াতসমূহে জান্নাতীদের আরো কিছু গুণাবলি বর্ণনা করা হয়েছে:
১ম গুণ: যারা ঈমান এনেছে
যারা আল্লাহর ওপর ঈমান রাখে এবং প্রত্যেক ওই সকল বস্তুর ওপর ঈমান আনে, যার প্রতি ঈমান আনা আবশ্যক। যেমন-ফেরেশতাগণ, কিতাবসমূহ, রাসূলগণ ও আখেরাতের ওপর। তেমনি তাকদীরের ভালো-মন্দের উপর বিশ্বাস রাখে। তারা সেই বিশ্বাস এমন দৃঢ়তার সঙ্গে রাখে যে, তা তাদেরকে সেগুলো সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করে নিতে, স্বীকৃতি দিতে, কথা ও কাজে পরিণত করতে বাধ্য করে।
২য় গুণ : যারা বিনয়াবনত হয়ে সালাত আদায় করে
সালাতে তারা তাদের অন্তরকে হাযির রাখে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহকে স্থির রাখে, এটা মনের মধ্যে আনয়ন করে যে, তারা তাদের সালাতে মহান আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান। আল্লাহর সঙ্গে তাঁর কথা দিয়ে কথপোকথন করছে, আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করছে তাঁর জিকিরের মাধ্যমে, আল্লাহর কাছে আশ্রয় নিচ্ছে তার দু‘আর মাধ্যমে। সুতরাং তারা বাহ্যিক ও আন্তরিক সার্বিকভাবে প্রকৃত বিনয়াবনত।
৩য় গুণ: যারা অনর্থক কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকে
আয়াতে বর্ণিত ‘লাগও’ বা অযথা বলতে এমন কথা ও কাজকে বুঝায় যাতে কোনো ফায়দা নেই, নেই কোনো কল্যাণ। সুতরাং তারা এসব বেহুদা কথা ও কাজ থেকে বিমুখ থাকে তাদের দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি, কঠিন হুশিয়ারী কারণে। তারা তাদের মূল্যবান সময়কে উপকারহীন কাজে নষ্ট করে না। সুতরাং যেরূপে তারা নিজ সালাতকে খুশু‘ বা বিনয়াবনত হওয়ার মাধ্যমে সংরক্ষণ করে, তেমনি তারা তাদের মূল্যবান সময়কে নষ্ট না করার মাধ্যমে হেফাযত করে। আর যখন তাদের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে যে, তারা অযথা ও উপকারহীন কাজে তাদের সময়কে নষ্ট করে না, তখন যে সকল কাজ তাদের জন্য ক্ষতির কারণ হবে তারা তা থেকে দূরে থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
৪র্থ গুণ: যারা তাদের যাকাতকে পালন করে থাকে
এখান যাকাত শব্দ দ্বারা সে সম্পদ উদ্দেশ্য হতে পারে যা ফরয হিসেবে প্রদান করতে হয়। আবার হতে পারে তা দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে এমন সকল কথা ও কাজ যা দ্বারা অন্তর পবিত্র ও স্বচ্ছ হয়।
৫ম গুণ: যারা তাদের লজ্জাস্থান হেফাজত করে
তারা নিজেদের লজ্জাস্থান যিনা-ব্যভিচার ও সমকামিতা তথা যৌনাঙ্গ দ্বারা যত প্রকার চারিত্রিক অঘটন হওয়া সম্ভব তা তেকে মুক্ত রাখে; কারণ এতে রয়েছে আল্লাহর অবাধ্যতা, সামাজিক ও চারিত্রিক অধঃপতন। এখানে লজ্জাস্থানের হিফাযত দ্বারা ব্যাপকভাবে এসব ছাড়াও অন্যান্য কিছুও অন্তর্ভুক্ত হবে। যেমন- পর নারীর প্রতি কৃদৃষ্টি দেয়া বা কাউকে অবৈধভাবে স্পর্শ করা।
* আল্লাহর বাণী “তারা তিরস্কৃত হবে না” এর দ্বারা ইঙ্গিত রয়েছে যে, মূল হচ্ছে একজন মানুষ এসব কাজ দ্বারা তিরস্কৃত হবে; কেবলমাত্র স্ত্রী ও নিজের কৃতদাসী এর ব্যতিক্রম। কারণ মানুষের এর প্রয়োজন রয়েছে; এর মাধ্যমে সে প্রাকৃতিক চাহিদা মেটাতে পারে এবং সন্তান-সন্ততি লাভ করতে পারে।
* আর আল্লাহর বাণী “অতঃপর কেউ এদের ছাড়া অন্যকে কামনা করলে তারা সীমালঙ্ঘনকারী হবে” এর ব্যাপকতা প্রমাণ করে যে, অন্য যে কোনো পন্থায় যৌনক্ষুধা মিটালে সে তিরস্কৃত হবে; সুতরাং হস্ত মৈথুন (যাকে খারাপ অভ্যাসও বলা হয়) তা হারাম হবে। যেহেতু এর দ্বারা স্ত্রী ও কৃতদাসী ছাড়া অপাত্রে বীর্যপাত করা হয়।
৬ষ্ঠ গুণ: যারা আমানত ও অঙ্গীকার রক্ষা করে
আমানত অর্থ অন্যের কাছে কোনো কথা, কাজ ও সম্পদকে নিঃশঙ্কচিত্তে গচ্ছিত রাখা। সুতরাং কেউ যদি তোমার কাছে গোপন কথা বলে, তাহলে সে তাকে কথাটি তোমার কাছে আমানত হিসেবে রেখেছে। অনুরূপভাবে যদি কোনো ব্যক্তি তোমার নিকট এমন কাজ করে যা সে অন্যের কাছে প্রকাশ করা অপছন্দ করে, তাহলে সে ওই কাজটি তোমার কাছে আমানত হিসেবে রেখেছে। তদ্রূপ যদি কেউ কোনো সম্পদ তোমার কাছে সংরক্ষনের জন্য সোপর্দ করে তাহলে ওই সম্পদ সে তোমার কাছে আমানত রেখেছে।
আর অঙ্গীকার হচ্ছে: মানুষ নিজের উপর অন্যের জন্য যা বাধ্য করে নেয়। যেমন আল্লাহর জন্য কোনো কিছু মানত করা এবং মানুষের মধ্যে প্রচলিত ওয়াদা-অঙ্গীকার বা চুক্তি।
সুতরাং জান্নাতিরা তাদের মধ্যকার আমানত এবং তাদের মধ্যকার পরস্পর কৃত অঙ্গীকার ও আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূরণের উপর সদা প্রতিষ্ঠিত থাকে।
তাছাড়া ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে অথবা কোনো বৈধ শর্ত পূরণের বিষয়টিও এর অন্তর্ভুক্ত হবে।
৭ম গুণ: যারা সালাত আদায়ের প্রতি যতœবান থাকে
তারা সালাতকে নষ্ট করা থেকে হেফাযত করার ব্যাপারে সর্বদা সচেষ্ট থাকে। তাই তারা সেটার সময়ের প্রতি লক্ষ্য শর্ত, রুকন ও ওয়াজিবসমূহ যথাযথভাবে আদায় করে থাকে।
উপরে বর্ণিত জান্নাতিদের গুণাবলী ছাড়াও কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতিদের আরও বহু গুণ বর্ণনা করেছেন; যাতে করে যারা জান্নাতে যেতে চায় তারা এসব গুণে গুণান্বিত হতে পারে।
এ ছাড়াও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসংখ্য হাদীসে জান্নাতী হওয়ার পদ্ধতি বলা হয়েছে: যেমন,
* আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
َمَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا، سَهَّلَ اللهُ لَهُ بِهِ طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّةِ
‘আর যে ব্যক্তি ইলমে দ্বীন অর্জনের জন্য কোনো পথ অবলম্বন করে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতের একটি রাস্তা সহজ করে দেন।’
* আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরও বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
أَلَا أَدُلُّكُمْ عَلَى مَا يُكَفِّرُ اللَّهُ بِهِ الْخَطَايَا وَيَرْفَعُ بِهِ الدَّرَجَاتِ؟ الْخُطَى إِلَى الْمَسَاجِدِ، وَإِسْبَاغُ الْوُضُوءِ عِنْدَ الْمَكَارِهِ، وَانْتِظَارُ الصَّلَاةِ بَعْدَ الصَّلَاةِ، فَذَلِكَ الرِّبَاطُ
‘আমি কি তোমাদের বলব না কোন জিনিস গুনাহকে বিলুপ্ত করে ও মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধি করে? সাহাবীগণ বললেন, বলুন হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, শীতকালে ঠান্ডার মধ্যে উত্তমরূপে ওযু করা, বেশি বেশি মসজিদের দিকে পদক্ষেপ এবং এক সালাতের পর অন্য সালাতের অপেক্ষা করা।’
* সহীহ মুসলিমে ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
مَا مِنْكُمْ مِنْ أَحَدٍ يَتَوَضَّأُ فَيُسْبِغُ الْوُضُوءَ ثُمَّ يَقُولُ أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ إِلاَّ فُتِحَتْ لَهُ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ الثَّمَانِيَةُ يَدْخُلُ مِنْ أَيِّهَا شَاءَ .
‘তোমাদের মধ্যকার যে কেউ উত্তমরূপে সব স্থানে পানি পৌঁছিয়ে ওযু করে, অতঃপর কালেমা শাহাদাত তথা ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ব্যতীত কোনো হক ইলাহ নেই, আর মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও রাসূল’ এটা পাঠ করে, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতের ৮টি দরজা খুলে দেন। সে যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা জান্নাতে প্রবেশ করবে।’
* অনুরূপভাবে ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে আরও বর্ণিত আছে, দীর্ঘ হাদীসে তিনি বলেন, যে ব্যক্তি অন্তর দিয়ে মুয়াজ্জিনের আহ্বানে আন্তরিকভাবে সাড়া দেয় তথা প্রতিটি বাক্যের উত্তর দেয় এবং সালাতে শরীক হয়, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (হাদীসের সারাংশ)
* উসমান ইবন আফ্‌ফান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে আরও বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
مَنْ بَنَى مَسْجِدًا يَبْتَغِي بِهِ وَجْهَ اللهِ بَنَى اللهُ لَهُ بَيْتًا فِي الْجَنَّةِ
‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার সন্তষ্টির জন্য মসজিদ বানায়, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতে ঘর নির্মাণ করেন।’
* উবাদা ইবন সামিত রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
خَمْسُ صَلَوَاتٍ كَتَبَهُنَّ اللَّهُ عَلَى الْعِبَادِ فَمَنْ جَاءَ بِهِنَّ لَمْ يُضَيِّعْ مِنْهُنَّ شَيْئًا اسْتِخْفَافًا بِحَقِّهِنَّ كَانَ لَهُ عِنْدَ اللَّهِ عَهْدٌ أَنْ يُدْخِلَهُ الْجَنَّةَ.
‘আল্লাহ তা‘আলা বান্দার ওপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। যে ব্যক্তি ওই সালাতসমূহ উত্তমরূপে আদায় করে এবং তা আদায়ের ব্যাপারে কোনো প্রকার শৈথিল্য প্রদর্শন না করে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।’
* সাওবান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো, কোন আমল দ্বারা জান্নাতী হওয়া যায়? উত্তরে তিনি বললেন,
عَلَيْكَ بِكَثْرَةِ السُّجُودِ لِلَّهِ فَإِنَّكَ لاَ تَسْجُدُ لِلَّهِ سَجْدَةً إِلاَّ رَفَعَكَ اللَّهُ بِهَا دَرَجَةً وَحَطَّ عَنْكَ بِهَا خَطِيئَةً .
‘তুমি অধিক পরিমাণে সিজদা কর। যত বেশি সিজদা করবে আল্লাহ তোমার মর্যাদা ততখানি বৃদ্ধি করে দেবেন এবং গুনাহ মাফ করে দেবেন।’
* উম্মে হাবীবা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
مَا مِنْ عَبْدٍ مُسْلِمٍ يُصَلِّى لِلَّهِ كُلَّ يَوْمٍ ثِنْتَىْ عَشْرَةَ رَكْعَةً تَطَوُّعًا غَيْرَ فَرِيضَةٍ إِلاَّ بَنَى اللَّهُ لَهُ بَيْتًا فِى الْجَنَّةِ أَوْ إِلاَّ بُنِىَ لَهُ بَيْتٌ فِى الْجَنَّةِ .
‘যদি কোনো মুসলিম আল্লাহ তা‘আলার সন্তষ্টির জন্য ফরয ছাড়াও দিবারাতে বারো রাকাত সুন্নত সালাত আদায় করে, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করেন।
আর সেগুলো হচ্ছে: চার রাকাআত জোহরের পূর্বে, দু রাকাআত জোহরের পর, দু রাকাআত মাগরিবের পর, দু রাকাআত ইশার পর ও দু রাকাআত ফজরের ফরযের পূর্বে।
* মু‘আয ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন:
قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَخْبِرْنِى بِعَمَلٍ يُدْخِلُنِى الْجَنَّةَ وَيُبَاعِدُنِى مِنَ النَّارِ. قَالَ لَقَدْ سَأَلْتَنِى عَنْ عَظِيمٍ وَإِنَّهُ لَيَسِيرٌ عَلَى مَنْ يَسَّرَهُ اللَّهُ عَلَيْهِ تَعْبُدُ اللَّهَ وَلاَ تُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا وَتُقِيمُ الصَّلاَةَ وَتُؤْتِى الزَّكَاةَ وَتَصُومُ رَمَضَانَ وَتَحُجُّ الْبَيْتَ .
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি আমাকে এমন আমলের কথা বলে দিন, যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে। উত্তরে তিনি বললেন, তুমি বড় এক বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছ। তবে তা ওই ব্যক্তির জন্য সহজ, যার জন্য আল্লাহ সহজ করে দিয়েছেন। তা হলো: ১। তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক করবে না, ২. সালাত কায়েম করবে, ৩. যাকাত প্রদান করবে, ৪. রমযান মাসে সিয়াম পালন করবে এবং ৫. বাইতুল্লাহর হজ পালন করবে।’
* সাহাল ইবন সা‘দ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إِنَّ فِى الْجَنَّةِ بَابًا يُقَالُ لَهُ الرَّيَّانُ يَدْخُلُ مِنْهُ الصَّائِمُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لاَ يَدْخُلُ مَعَهُمْ أَحَدٌ .
‘নিশ্চয়ই জান্নাতে একটি দরজা আছে যার নাম রাইয়্যান। ওই দরজা দিয়ে শুধুমাত্র সিয়াম পালনকারীগণ প্রবেশ করবেন। তাদের সঙ্গে অন্য কেউ প্রবেশ করবে না।’
* আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
الْعُمْرَةُ إِلَى الْعُمْرَةِ كَفَّارَةٌ لِمَا بَيْنَهُمَا وَالْحَجُّ الْمَبْرُورُ لَيْسَ لَهُ جَزَاءٌ إِلاَّ الْجَنَّةُ .
‘এক উমরা হতে দ্বিতীয় উমরা উভয়ের মধ্যবর্তী সময়ের জন্য কাফফারাস্বরূপ। আর হজ্জে মাবরুর বা কবূল হজ্জের সাওয়াব জান্নাত ছাড়া অন্য কিছু নয়।’ অর্থাৎ যে বক্তি কবূল হজ করল, সে জান্নাতী।’
* জাবের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
مَنْ كُنَّ لَهُ ثَلاَثُ بَنَاتٍ يُؤْوِيهِنَّ ، وَيَرْحَمُهُنَّ ، وَيَكْفُلُهُنَّ ، وَجَبَتْ لَهُ الْجَنَّةُ الْبَتَّةَ ، قَالَ: قِيلَ: يَا رَسُولَ اللهِ: فَإِنْ كَانَتْ اثْنَتَيْنِ ؟ قَالَ: وَإِنْ كَانَتْ اثْنَتَيْنِ ، قَالَ: فَرَأَى بَعْضُ الْقَوْمِ ، أَنْ لَوْ قَالُوا لَهُ وَاحِدَةً ، لَقَالَ: وَاحِدَةً.
‘যে ব্যক্তি নিজ ৩টি কন্যা সন্তানকে লালন-পালন করে এবং তাদের আদর যতœ করে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলা হলো, যদি দু’টি কন্যা সন্তান হয়? তিনি উত্তর দিলেন, তবুও ওয়াজিব। সাহাবীগণ কেউ কেউ বলেন, যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ১টি কন্যা সন্তান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হত, তাহলে তিনি অবশ্যই একই উত্তর দিতেন।’
* আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত,
سُئِلَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- عَنْ أَكْثَرِ مَا يُدْخِلُ النَّاسَ الْجَنَّةَ فَقَالَ تَقْوَى اللَّهِ وَحُسْنُ الْخُلُقِ .
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো, কোন জিনিস মানুষকে বেশি জান্নাতে প্রবেশ করায়? তিনি উত্তর দিলেন, আল্লাহর ভয় ও উত্তম চরিত্র।’
* ‘ইয়াদ ইবন হিমার আল-মুজাশে‘য়ী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
أَهْلُ الْجَنَّةِ ثَلَاثَةٌ ذُو سُلْطَانٍ مُقْسِطٌ مُتَصَدِّقٌ مُوَفَّقٌ وَرَجُلٌ رَحِيمٌ رَقِيقُ الْقَلْبِ لِكُلِّ ذِي قُرْبَى وَمُسْلِمٍ وَعَفِيفٌ مُتَعَفِّفٌ ذُو عِيَالٍ …
“জান্নাতী তিন প্রকার: ১. ন্যায়-বিচারক, সদকাদানকারী, তৌফিকপ্রাপ্ত বাদশাহ, ২. দয়াবান, কোমল হৃদয়ের অধিকারী, আত্মীয়-স্বজন ও প্রত্যেক মুসলিমের সঙ্গে নম্র ব্যবহারকারী ও ৩. সচ্চরিত্র ও যাচ্ঞা করা থেকে পবিত্র ব্যক্তি অথচ সে বড় পরিবারের অধিকারী অভাবী।’
হে ভ্রাতাগণ! এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এমন কিছু হাদীস বর্ণনা করা হলো, যাতে জান্নাতী ব্যক্তিগণের গুণাবলি উল্লেখ করা হয়েছে। যে ব্যক্তি জান্নাতে যাওয়ার ইচ্ছা করে এটা শুধু তার জন্য।
আল্লাহর কাছে তাওফীক চাই যেন তিনি আমাদের ও আপনাদের সে পথের অনুসারী করেন এবং আমাদের জান্নাতের পথে অটল রাখেন। নিশ্চয় তিনি দাতা ও দয়ালু।
আর আল্লাহ সালাত পেশ করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীর উপর।
পঞ্চবিংশ আসরঃজাহান্নামের বর্ণনা
আল্লাহ আমাদেরকে তা থেকে আশ্রয় দিন
সকল প্রশংসা চিরঞ্জীব সর্বসত্ত্বার ধারক আল্লাহর জন্য, তিনি শ্বাশত আর কেউ নয়। তিনি আসমান উপরে স্থাপন করেছেন এবং তারকারাজি দিয়ে সুসজ্জিত করেছেন। পাহাড়রাজি দিয়ে ভূপৃষ্ঠকে মহাশূন্যে স্থির করেছেন। আপন কুদরতে এসব দেহধারীকে সৃষ্টি করেছেন অতঃপর তাকে মৃত্যু দিয়েছেন এবং চিহ্নটুকুও মিটিয়ে দিয়েছেন। আবার তিনি ছবিগুলোয় প্রাণ ফুঁকিয়ে দেবেন আর সহসা মৃতরা দাঁড়িয়ে যাবে। তাদের একদল নেয়ামতস্থান তথা জান্নাতে যাবে। আরেকদল শাস্তিস্থান তথা জাহান্নামে যাবে, তাদের সামনে এর দরজা উন্মুক্ত করা হবে, প্রতিটি দরজার জন্য রয়েছে তাদের মধ্য থেকে নির্দিষ্ট একটি শ্রেণী। তাদেরকে প্রলম্বিত স্তম্ভসমূহে আবদ্ধ করে রাখা হবে চিন্তা ও কষ্টের মধ্যে। সেদিন তাদেরকে তাদের ওপর ও নিচ থেকে শাস্তি গ্রাস করবে, তাদের কেউ করুণাপ্রাপ্ত হবে না।
আমি সাক্ষ্য দেই যে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই; তাঁর কোনো শরীক নেই। এমন ব্যক্তির সাক্ষ্য যে মুক্তির প্রত্যাশা করে। আমি আরও সাক্ষ্য দেই যে মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসূল। যার আনীত দীনকে আল্লাহ পারস্য ও রোম সাম্রাজ্যের ওপর বিজয় দান করেছেন।
আল্লাহ সালাত ও সালাম বর্ষিত করুন তাঁর ওপর, তাঁর পরিবার, সাহাবী এবং যতদিন মেঘমালা মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করে ততদিন পর্যন্ত আগত তাঁর সকল অনিন্দ্য অনুসারীর ওপর।
হে মুসলিম ভাইগণ! আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে জাহান্নামের আগুন সম্পর্কে ভয় দেখিয়েছেন এবং আমাদের বিভিন্ন প্রকার আযাবের খবর দিয়েছেন। যা শুনলে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। জান ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়। তিনি আমাদের ওপর করুণাময় বলেই আমাদের বিভিন্ন ধরণের ভয় দেখিয়ে সতর্ক করেছেন; যাতে আমরা ভালোভাবে সাবধান ও ভীত হতে পারি।
সুতরাং আল্লাহর কিতাব কুরআনে মাজীদে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাতে জাহান্নামের আযাব সম্পর্কে যা এসেছে তা শুনুন; যাতে আপনারা উপদেশ গ্রহণ করতে পারেন।
﴿وَأَنِيبُوٓاْ إِلَىٰ رَبِّكُمۡ وَأَسۡلِمُواْ لَهُۥ مِن قَبۡلِ أَن يَأۡتِيَكُمُ ٱلۡعَذَابُ ثُمَّ لَا تُنصَرُونَ ٥٤ ﴾ [الزمر: ٥٤]
‘তোমরা স্বীয় রবের অভিমুখী হও এবং তার আজ্ঞাবহ ও অনুগত হও তোমাদের কাছে আযাব আসার পূর্বে। এরপর তোমাদের সাহায্য করা হবে না।’ {সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৫৪}
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَٱتَّقُواْ ٱلنَّارَ ٱلَّتِيٓ أُعِدَّتۡ لِلۡكَٰفِرِينَ ١٣١ ﴾ [ال عمران: ١٣١]
‘তোমরা ওই আগুনকে ভয় কর, যা কাফেরদের জন্য তৈরি করা হয়েছে।’ {সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩১}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ إِنَّآ أَعۡتَدۡنَا لِلۡكَٰفِرِينَ سَلَٰسِلَاْ وَأَغۡلَٰلٗا وَسَعِيرًا ٤ ﴾ [الانسان: ٤]
‘নিশ্চয় আমরা কাফেরদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছি শিকল, বেড়ি ও প্রজ্জ্বলিত অগ্নি।’ {সূরা আল-ইনসান, আয়াত: ৪}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ إِنَّآ أَعۡتَدۡنَا لِلظَّٰلِمِينَ نَارًا أَحَاطَ بِهِمۡ سُرَادِقُهَاۚ﴾ [الكهف: ٢٩]
‘নিশ্চয় আমরা যালিমদের জন্য আগুন প্রস্তুত করেছি, যার প্রাচীরগুলো তাদেরকে বেষ্টন করে রেখেছে। {সূরা আল-কাহফ, আয়াত: ২৯}
* আল্লাহ তা‘আলা শয়তানকে লক্ষ্য করে বলছেন:
﴿إِنَّ عِبَادِي لَيۡسَ لَكَ عَلَيۡهِمۡ سُلۡطَٰنٌ إِلَّا مَنِ ٱتَّبَعَكَ مِنَ ٱلۡغَاوِينَ ٤٢ وَإِنَّ جَهَنَّمَ لَمَوۡعِدُهُمۡ أَجۡمَعِينَ ٤٣ لَهَا سَبۡعَةُ أَبۡوَٰبٖ لِّكُلِّ بَابٖ مِّنۡهُمۡ جُزۡءٞ مَّقۡسُومٌ ٤٤﴾ [الحجر: ٤٢، ٤٤]
‘নিশ্চয় আমার বান্দাদের উপর তোমার কোনো ক্ষমতা নেই, তবে পথভ্রষ্টরা ছাড়া যারা তোমাকে অনুসরণ করেছে। আর নিশ্চয় জাহান্নাম তাদের সকলের প্রতিশ্রুত স্থান। তার সাতটি দরজা রয়েছে। প্রতিটি দরজার জন্য রয়েছে তাদের মধ্য থেকে নির্দিষ্ট একটি শ্রেণী।’ {সূরা আল-হিজর, আয়াত: ৪২-৪৪}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ وَسِيقَ ٱلَّذِينَ كَفَرُوٓاْ إِلَىٰ جَهَنَّمَ زُمَرًاۖ حَتَّىٰٓ إِذَا جَآءُوهَا فُتِحَتۡ أَبۡوَٰبُهَا﴾ [الزمر: ٧١]
‘আর কাফিরদেরকে দলে দলে জাহান্নামের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। অবশেষে তারা যখন জাহান্নামের কাছে এসে পৌঁছবে তখন তার দরজাগুলো খুলে দেয়া হবে।’ {সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৭১}
* আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
﴿ وَلِلَّذِينَ كَفَرُواْ بِرَبِّهِمۡ عَذَابُ جَهَنَّمَۖ وَبِئۡسَ ٱلۡمَصِيرُ ٦ إِذَآ أُلۡقُواْ فِيهَا سَمِعُواْ لَهَا شَهِيقٗا وَهِيَ تَفُورُ ٧ تَكَادُ تَمَيَّزُ مِنَ ٱلۡغَيۡظِۖ﴾ [الملك: ٦، ٨]
‘আর যারা তাদের রবকে অস্বীকার করে, তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আযাব। আর কতইনা নিকৃষ্ট সেই প্রত্যাবর্তনস্থল! যখন তাদেরকে তাতে নিক্ষেপ করা হবে, তখন তারা তার বিকট শব্দ শুনতে পাবে। আর তা উথলিয়ে উঠবে। ক্রোধে তা ছিন্নভিন্ন হবার উপক্রম হবে।’ {সূরা আল-মুলক, আয়াত: ৬-৮}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ يَوۡمَ يَغۡشَىٰهُمُ ٱلۡعَذَابُ مِن فَوۡقِهِمۡ وَمِن تَحۡتِ أَرۡجُلِهِمۡ﴾ [العنكبوت: ٥٥]
‘যেদিন আযাব তাদেরকে তাদের উপর থেকে ও তাদের পায়ের নীচে থেকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে’ {সূরা আল-‘আনকাবূত, আয়াত: ৫৫}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ لَهُم مِّن فَوۡقِهِمۡ ظُلَلٞ مِّنَ ٱلنَّارِ وَمِن تَحۡتِهِمۡ ظُلَلٞۚ ذَٰلِكَ يُخَوِّفُ ٱللَّهُ بِهِۦ عِبَادَهُۥۚ يَٰعِبَادِ فَٱتَّقُونِ ١٦ ﴾ [الزمر: ١٦]
‘তাদের জন্য তাদের উপরের দিকে থাকবে আগুনের আচ্ছাদন আর তাদের নিচের দিকেও থাকবে (আগুনের) আচ্ছাদন; এদ্বারা আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে ভয় দেখান। ‘হে আমার বান্দারা, তোমরা আমার তাকওয়া অবলম্বন কর’।’ {সূরা আয-যুমার, আয়াত: ১৬}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ وَأَصۡحَٰبُ ٱلشِّمَالِ مَآ أَصۡحَٰبُ ٱلشِّمَالِ ٤١ فِي سَمُومٖ وَحَمِيمٖ ٤٢ وَظِلّٖ مِّن يَحۡمُومٖ ٤٣ لَّا بَارِدٖ وَلَا كَرِيمٍ ٤٤ ﴾ [الواقعة: ٤١، ٤٤]
‘আর বাম দিকের দল, কত হতভাগ্য বাম দিকের দল! তারা থাকবে তীব্র গরম হাওয়া এবং প্রচণ্ড উত্তপ্ত পানিতে, আর প্রচণ্ড কালো ধোঁয়ার ছায়ায়, যা শীতলও নয়, সুখকরও নয়।’ {সূরা আল-ওয়াকিয়া, আয়াত: ৪১-৪৪}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿وَقَالُواْ لَا تَنفِرُواْ فِي ٱلۡحَرِّۗ قُلۡ نَارُ جَهَنَّمَ أَشَدُّ حَرّٗاۚ ﴾ [التوبة: ٨١]
‘তারা (মুনাফিকরা) বলে, এ গরমে অভিযানে বের হয়ো না। বলে দাও, জাহান্নামের আগুন এর চেয়েও প্রচণ্ড উত্তপ্ত।’ {সূরা আত-তওবা, আয়াত: ৮১}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ وَمَآ أَدۡرَىٰكَ مَا هِيَهۡ ١٠ نَارٌ حَامِيَةُۢ ١١ ﴾ [القارعة: ١٠، ١١]
‘আপনি কি জানেন তা কী? তা হলো: প্রজ্জ্বলিত অগ্নি।’ {সূরা আল-কারি‘আহ, আয়াত: ১০-১১}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ إِنَّ ٱلۡمُجۡرِمِينَ فِي ضَلَٰلٖ وَسُعُرٖ ٤٧ يَوۡمَ يُسۡحَبُونَ فِي ٱلنَّارِ عَلَىٰ وُجُوهِهِمۡ ذُوقُواْ مَسَّ سَقَرَ ٤٨ ﴾ [القمر: ٤٧، ٤٨]
‘নিশ্চয় অপরাধীরা রয়েছে পথভ্রষ্টতা ও (পরকালে) প্রজ্জ্বলিত আগুনে। সেদিন তাদেরকে উপুড় করে টেনে হিঁচড়ে জাহান্নামে নেয়া হবে। (বলা হবে) জাহান্নামের ছোঁয়া আস্বাদন কর।’ {সূরা আল-কামার, আয়াত: ৪৭-৪৮}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ وَمَآ أَدۡرَىٰكَ مَا سَقَرُ ٢٧ لَا تُبۡقِي وَلَا تَذَرُ ٢٨ لَوَّاحَةٞ لِّلۡبَشَرِ ٢٩ ﴾ [المدثر: ٢٧، ٢٩]
‘কিসে আপনাকে জানাবে জাহান্নামের আগুন কী? এটা অবশিষ্টও রাখবে না এবং ছেড়েও দেবে না। চামড়াকে দকরে কালো করে দেবে।’ {সূরা আল-মুদ্দাসসির, আয়াত: ২৭-২৯}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ قُوٓاْ أَنفُسَكُمۡ وَأَهۡلِيكُمۡ نَارٗا وَقُودُهَا ٱلنَّاسُ وَٱلۡحِجَارَةُ عَلَيۡهَا مَلَٰٓئِكَةٌ غِلَاظٞ شِدَادٞ لَّا يَعۡصُونَ ٱللَّهَ مَآ أَمَرَهُمۡ وَيَفۡعَلُونَ مَا يُؤۡمَرُونَ ٦ ﴾ [التحريم: ٦]
‘হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের এবং পরিবার-পরিজনদের সে অগ্নি থেকে রক্ষা কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও প্রস্তর। যাতে নিয়োজিত আছে পাষাণ হৃদয় ও কঠিন স্বভাবের ফেরেশতাগণ। তারা আল্লাহ তা‘আলা যা আদেশ করেন তা অমান্য করে না এবং যা করতে আদেশ করা হয় তাই করে।’ {সূরা আত-তাহরীম, আয়াত: ৬}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ إِنَّهَا تَرۡمِي بِشَرَرٖ كَٱلۡقَصۡرِ ٣٢ كَأَنَّهُۥ جِمَٰلَتٞ صُفۡرٞ ٣٣ ﴾ [المرسلات: ٣٢، ٣٣]
‘নিশ্চয় তা (জাহান্নাম) ছড়াবে প্রাসাদসম স্ফুলিঙ্গ। তা যেন হলুদ উষ্ট্রী।’ {সূরা আল-মুরসালাত, আয়াত: ৩২-৩৩}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ وَتَرَى ٱلۡمُجۡرِمِينَ يَوۡمَئِذٖ مُّقَرَّنِينَ فِي ٱلۡأَصۡفَادِ ٤٩ سَرَابِيلُهُم مِّن قَطِرَانٖ وَتَغۡشَىٰ وُجُوهَهُمُ ٱلنَّارُ ٥٠ ﴾ [ابراهيم: ٤٩، ٥٠]
‘আর সে দিন তুমি অপরাধীদের দেখবে তারা শিকলে বাঁধা। তাদের পোশাক হবে আলকাতরার এবং আগুন তাদের চেহারাসমূহকে ঢেকে ফেলবে।’ {সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ৪৯-৫০}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ إِذِ ٱلۡأَغۡلَٰلُ فِيٓ أَعۡنَٰقِهِمۡ وَٱلسَّلَٰسِلُ يُسۡحَبُونَ ٧١ ﴾ [غافر: ٧١، ٧٢]
‘যখন তাদের গলদেশে বেড়ী ও শিকল থাকবে, তাদেরকে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে- ফুটন্ত পানিতে, অতঃপর তাদেরকে আগুনে পোড়ানো হবে।’ {সূরা গাফির/আল-মুমিন, আয়াত: ৭১-৭২}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ فَٱلَّذِينَ كَفَرُواْ قُطِّعَتۡ لَهُمۡ ثِيَابٞ مِّن نَّارٖ يُصَبُّ مِن فَوۡقِ رُءُوسِهِمُ ٱلۡحَمِيمُ ١٩ يُصۡهَرُ بِهِۦ مَا فِي بُطُونِهِمۡ وَٱلۡجُلُودُ ٢٠ وَلَهُم مَّقَٰمِعُ مِنۡ حَدِيدٖ ٢١ كُلَّمَآ أَرَادُوٓاْ أَن يَخۡرُجُواْ مِنۡهَا مِنۡ غَمٍّ أُعِيدُواْ فِيهَا وَذُوقُواْ عَذَابَ ٱلۡحَرِيقِ ٢٢ ﴾ [الحج: ١٩، ٢٢]
‘তবে যারা কুফরী করে তাদের জন্য আগুনের পোশাক প্রস্তুত করা হয়েছে। তাদের মাথার উপর থেকে ঢেলে দেয়া হবে ফুটন্ত পানি। যার দ্বারা তাদের পেটের অভ্যন্তরে যা কিছু রয়েছে তা ও তাদের চামড়াসমূহ বিগলিত করা হবে। আর তাদের জন্য থাকবে লোহার হাতুড়ি। যখনই তারা যন্ত্রণাকাতর হয়ে তা থেকে বের হয়ে আসতে চাইবে, তখনই তাদেরকে তাতে ফিরিয়ে দেয়া হবে এবং বলা হবে, দহন-যন্ত্রণা আস্বাদন কর।’ {সূরা আল-হজ, আয়াত: ১৯-২২}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ بَِٔاিيَٰتِنَا سَوۡفَ نُصۡلِيهِمۡ نَارٗا كُلَّمَا نَضِجَتۡ جُلُودُهُم بَدَّلۡنَٰهُمۡ جُلُودًا غَيۡرَهَا لِيَذُوقُواْ ٱلۡعَذَابَۗ﴾ [النساء: ٥٦]
‘নিশ্চয় যারা আমার নিদর্শনসমূহ অস্বীকার করবে, আমি তাদের আগুনে নিক্ষেপ করব। তাদের চামড়াগুলো যখন জ্বলে পুড়ে যাবে তখন আবার আমি অন্য চামড়া দিয়ে তা পাল্টে দেব। যাতে তারা আযাব ভোগ করবে পারে।’ {সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৫৬}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ إِنَّ شَجَرَتَ ٱلزَّقُّومِ ٤٣ طَعَامُ ٱلۡأَثِيمِ ٤٤ كَٱلۡمُهۡلِ يَغۡلِي فِي ٱلۡبُطُونِ ٤٥ كَغَلۡيِ ٱلۡحَمِيمِ ٤٦ ﴾ [الدخان: ٤٣، ٤٦]
‘নিশ্চয় যাক্কূম বৃক্ষ। পাপীর খাদ্য; গলিত তামার মত, উদরসমূহে ফুটতে থাকবে। ফুটন্ত পানির মত।’ {সূরা আদ-দুখান, আয়াত: ৪৩-৪৬}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿إِنَّهَا شَجَرَةٞ تَخۡرُجُ فِيٓ أَصۡلِ ٱلۡجَحِيمِ ٦٤ طَلۡعُهَا كَأَنَّهُۥ رُءُوسُ ٱلشَّيَٰطِينِ ٦٥﴾ [الصافات: ٦٤، ٦٥]
‘এটি একটি বৃক্ষ যা উদগত হয় জাহান্নামের মূল থেকে। এর গুচ্ছ শয়তানের মস্তকের ন্যায়।’ {সূরা আস-সাফফাত: ৬৪-৬৫}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ ثُمَّ إِنَّكُمۡ أَيُّهَا ٱلضَّآلُّونَ ٱلۡمُكَذِّبُونَ ٥١ لَأٓكِلُونَ مِن شَجَرٖ مِّن زَقُّومٖ ٥٢ فَمَالِ‍ُٔونَ مِنۡهَا ٱلۡبُطُونَ ٥٣ فَشَٰرِبُونَ عَلَيۡهِ مِنَ ٱلۡحَمِيمِ ٥٤ فَشَٰرِبُونَ شُرۡبَ ٱلۡهِيمِ ٥٥ ﴾ [الواقعة: ٥١، ٥٥]
‘অতঃপর হে পথভ্রষ্ট মিথ্যারোপকারীরা! তোমরা অবশ্যই ভক্ষণ করবে যাক্কুম বৃক্ষের ফল, তা দ্বারা উদর পূর্ণ করবে। অতঃপর পান করাবে উত্তপ্ত পানি, পান করবে পিপাসিত উটের ন্যায়।’ {সূরা আল-ওয়াকি‘আ, আয়াত: ৫১-৫৫}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿وَإِن يَسۡتَغِيثُواْ يُغَاثُواْ بِمَآءٖ كَٱلۡمُهۡلِ يَشۡوِي ٱلۡوُجُوهَۚ بِئۡسَ ٱلشَّرَابُ وَسَآءَتۡ مُرۡتَفَقًا ٢٩ ﴾ [الكهف: ٢٩]
‘যদি তারা পান করার জন্য প্রার্থনা করে তখন তাদের পুঁজের ন্যায় পানীয় দ্রব্য দেয়া হবে। যা তাদের মুখমণ্ডল দকরবে। তা কতই না নিকৃষ্ট পানি এবং খুবই মন্দ আশ্রয়স্থল।’ {সূরা আল-কাহফ, আয়াত: ২৯}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ وَسُقُواْ مَآءً حَمِيمٗا فَقَطَّعَ أَمۡعَآءَهُمۡ ١٥ ﴾ [محمد: ١٥]
‘এবং তাদের ফুটন্ত পানি পান করানো হবে। যা তাদের নাড়ী-ভুড়ি ছিন্ন-ভিন্ন করে ফেলবে।’ {সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ১৫}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ وَيُسۡقَىٰ مِن مَّآءٖ صَدِيدٖ ١٦ يَتَجَرَّعُهُۥ وَلَا يَكَادُ يُسِيغُهُۥ وَيَأۡتِيهِ ٱلۡمَوۡتُ مِن كُلِّ مَكَانٖ وَمَا هُوَ بِمَيِّتٖۖ وَمِن وَرَآئِهِۦ عَذَابٌ غَلِيظٞ ١٧ ﴾ [ابراهيم: ١٦، ١٧]
‘তাদের পুঁজ মেশানো পানি পান করানো হবে। ঢোক গিলে তা পান করবে। তা গলার ভেতর প্রবেশ করলে মনে হবে চতুর্দিক থেকে তার কাছে মৃত্যু আগমন করছে। এরপরও সে মরবে না। তার পিছনে অপেক্ষা করছে কঠোর আযাব।’ {সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ১৬-১৭}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ إِنَّ ٱلۡمُجۡرِمِينَ فِي عَذَابِ جَهَنَّمَ خَٰلِدُونَ ٧٤ لَا يُفَتَّرُ عَنۡهُمۡ وَهُمۡ فِيهِ مُبۡلِسُونَ ٧٥ وَمَا ظَلَمۡنَٰهُمۡ وَلَٰكِن كَانُواْ هُمُ ٱلظَّٰلِمِينَ ٧٦ وَنَادَوۡاْ يَٰمَٰلِكُ لِيَقۡضِ عَلَيۡنَا رَبُّكَۖ قَالَ إِنَّكُم مَّٰكِثُونَ ٧٧ ﴾ [الزخرف: ٧٤، ٧٧]
‘নিশ্চয়ই অপরাধীরা জাহান্নামে চিরকাল থাকবে। তাদের আজাব লাঘব করা হবে না। তারা তথায় হতাশ হয়ে থাকবে। আমরা তাদের প্রতি জুলুম করিনি বরং তারাই ছিল জালেম। তারা ডেকে বলবে হে মালিক! (ফেরেশতার নাম) তোমার রবকে বল, যেন আমাদের ব্যাপারে ফয়সালা করে দেন (আমাদের মৃত্যু দেন)। সে বলবে নিশ্চয়ই তোমরা চিরকাল জাহান্নামে থাকবে।’ {সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ৭৪-৭৭}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ مَّأۡوَىٰهُمۡ جَهَنَّمُۖ كُلَّمَا خَبَتۡ زِدۡنَٰهُمۡ سَعِيرٗا ٩٧ ﴾ [الاسراء: ٩٧]
‘তাদের ঠিকানা হলো জাহান্নাম। যখনই নির্বাপিত হওয়ার উপক্রম হবে আমি তখন অগ্নি আরও বৃদ্ধি করে দেব।’ {সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত: ৯৭}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ وَظَلَمُواْ لَمۡ يَكُنِ ٱللَّهُ لِيَغۡفِرَ لَهُمۡ وَلَا لِيَهۡدِيَهُمۡ طَرِيقًا ١٦٨ إِلَّا طَرِيقَ جَهَنَّمَ خَٰلِدِينَ فِيهَآ أَبَدٗاۚ وَكَانَ ذَٰلِكَ عَلَى ٱللَّهِ يَسِيرٗا ١٦٩ ﴾ [النساء: ١٦٨، ١٦٩]
‘নিশ্চয়ই যারা কুফুরী করে এবং যুলম করে, আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন না। তিনি তাদের জাহান্নামের পথ ছাড়া অন্য কোনো পথ দেখাবেন না। তারা সেখানে চিরকাল থাকবে। আর এটা আল্লাহর জন্য সহজ।’ {সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৬৮-১৬৯}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ إِنَّ ٱللَّهَ لَعَنَ ٱلۡكَٰفِرِينَ وَأَعَدَّ لَهُمۡ سَعِيرًا ٦٤ ﴾ [الاحزاب: ٦٤]
‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা কাফেরদের লা‘নত করেছেন। তাদের জন্য অগ্নি প্রস্তত করে রেখেছেন।’ {সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৬৪}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ وَمَن يَعۡصِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ فَإِنَّ لَهُۥ نَارَ جَهَنَّمَ خَٰلِدِينَ فِيهَآ أَبَدًا ٢٣ ﴾ [الجن: ٢٣]
‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ অমান্য করে তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন তারা তথায় চিরকাল থাকবে।’ {সূরা আল-জিন, আয়াত: ২৩}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ وَمَآ أَدۡرَىٰكَ مَا ٱلۡحُطَمَةُ ٥ نَارُ ٱللَّهِ ٱلۡمُوقَدَةُ ٦ ٱلَّتِي تَطَّلِعُ عَلَى ٱلۡأَفۡ‍ِٔدَةِ ٧ إِنَّهَا عَلَيۡهِم مُّؤۡصَدَةٞ ٨ فِي عَمَدٖ مُّمَدَّدَةِۢ ٩ ﴾ [الهمزة: ٥، ٩]
‘আর কিসে আপনাকে জানাবে হুতামা কী? আল্লাহর প্রজ্জ্বলিত আগুন। যা হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। নিশ্চয় তা তাদেরকে আবদ্ধ করে রাখবে প্রলম্বিত স্তম্ভসমূহে।’ {সূরা আল-হুমাযা, আয়াত: ৫-৯}
এছাড়াও জাহান্নামের আগুনের বর্ণনা ও বিভিন্ন প্রকারের যন্ত্রণাদায়ক স্থায়ী শাস্তি সম্পর্কে বহু আয়াত রয়েছে।
অনুরূপভাবে হাদীসেও জাহান্নামের বর্ণনা রয়েছে: যেমন,
* হাদীসে রয়েছে, আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
يُؤْتَى بِجَهَنَّمَ يَوْمَئِذٍ لَهَا سَبْعُونَ أَلْفَ زِمَامٍ مَعَ كُلِّ زِمَامٍ سَبْعُونَ أَلْفَ مَلَكٍ يَجُرُّونَهَا .
‘জাহান্নামকে কিয়ামতের ময়দানে আনা হবে। যা ৭০ হাজার ফেরেশতা ৭০ হাজার শিকল দ্বারা (বেঁধে) টেনে উঠাবে।’
* হাদীসে আরো রয়েছে, আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
نَارُكُمْ جُزْءٌ مِنْ سَبْعِينَ جُزْءًا مِنْ نَارِ جَهَنَّمَ قِيلَ يَا رَسُولَ اللهِ إِنْ كَانَتْ لَكَافِيَةً قَالَ فُضِّلَتْ عَلَيْهِنَّ بِتِسْعَةٍ وَسِتِّينَ جُزْءًا كُلُّهُنَّ مِثْلُ حَرِّهَا.
‘দুনিয়ার আগুন থেকে জাহান্নামের আগুনের তাপ সত্তর গুণ বেশি। তখন সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এ দুনিয়ার আগুনই তো শাস্তি দেয়ার জন্য যথেষ্ট। তিনি উত্তর দিলেন, এর তাপ দুনিয়ার আগুনের ওপর ৬৯ গুণ বৃদ্ধি করে দেয়া হবে। প্রত্যেকটিই এর মত গরম।’
* হাদীসে আরো আছে, আবূ হুরায়রা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كُنَّا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- إِذْ سَمِعَ وَجْبَةً فَقَالَ النَّبِىُّ -صلى الله عليه وسلم- تَدْرُونَ مَا هَذَا . قَالَ قُلْنَا اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ. قَالَ هَذَا حَجَرٌ أرسله الله في جهنم مُنْذُ سَبْعِينَ خَرِيفًا فَالآنَ حين انْتَهَى إِلَى قَعْرِهَا .
‘আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মুখে হাজির ছিলাম হঠাৎ আমরা একটা শব্দ শুনতে পেলাম। তিনি বলেন, তোমরা কি জান এটা কিসের শব্দ? আমরা বললাম আল্লাহ ও তাঁর রাসূলুল্লাহ এ ব্যাপারে বেশি জানেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটা জাহান্নামের একটি পাথরের শব্দ। যা আল্লাহ ৭০ বছর পূর্বে জাহান্নামে নিক্ষেপ করেছিলেন, আজ তা জাহান্নামের শেষ প্রান্তে পৌঁছল।’
* উৎবাহ ইবন গাযওয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু তার খুৎবার মধ্যে জাহান্নামের ব্যাপারে আলোচনা করছিলেন, তিনি বলেন,
قَدْ ذُكِرَ لَنَا أَنَّ الْحَجَرَ يُلْقَى مِنْ شَفَةِ جَهَنَّمَ فَيَهْوِى فِيهَا سَبْعِينَ عَامًا لاَ يُدْرِكُ لَهَا قَعْرًا وَوَاللَّهِ لَتُمْلأَنَّ أَفَعَجِبْتُمْ
‘জাহান্নামের একটি পাথর জাহান্নামের কিনারা থেকে নিক্ষেপ করা হবে তা নিচ পর্যন্ত পৌঁছতে ৭০ বছর লাগবে। এতদসত্ত্বেও জাহান্নাম পাপীদের দ্বারা ভর্তি হয়ে যাবে। তোমরা কি আশ্চর্যাম্বিত হয়েছ?’
* ‘ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে হাদীসে আরও রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
لَوْ أَنَّ قَطْرَةً مِنَ الزَّقُّومِ قُطِرَتْ فِى دَارِ الدُّنْيَا لأَفْسَدَتْ عَلَى أَهْلِ الدُّنْيَا مَعَايِشَهُمْ.
‘যদি জাহান্নামের যাক্কুম ফল দুনিয়াতে নিক্ষেপ করা হয়, তাহলে তার দুর্গন্ধে দুনিয়াবাসীর জীবন-যাপন অসম্ভব হয়ে যাবে।’ আবু ঈসা তিরমিযী হাদীসটিকে ‘হাসান সহীহ’ বলেছেন।
* অন্য হাদীসে নু‘মান ইবন বশীর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إِنَّ أَهْوَنَ أَهْلِ النَّارِ عَذَابًا مَنْ لَهُ نَعْلاَنِ وَشِرَاكَانِ مِنْ نَارٍ يَغْلِى مِنْهُمَا دِمَاغُهُ كَمَا يَغْلِى الْمِرْجَلُ مَا يَرَى أَنَّ أَحَدًا أَشَدُّ مِنْهُ عَذَابًا وَإِنَّهُ لأَهْوَنُهُمْ عَذَابًا .
‘জাহান্নামে যাকে সব চেয়ে কম শাস্তি দেয়া হবে, তাকে জাহান্নামের দু’টি স্যান্ডেল পরিধান করানো হবে যার ফিতাদ্বয় হবে আগুনের। তার উত্তাপে মাথার মগজ টগবগ করতে থাকবে ডেগের ফুটন্ত পানির ন্যায়। সে মনে করবে তাকে সবচেয়ে বেশি শাস্তি দেয়া হচ্ছে। মূলত তাকে সবচেয়ে কম শাস্তি দেয়া হচ্ছে।’
* আরও হাদীসে রয়েছে, আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
يُؤْتَى بِأَنْعَمِ أَهْلِ الدُّنْيَا مِنْ أَهْلِ النَّارِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَيُصْبَغُ فِى النَّارِ صَبْغَةً ثُمَّ يُقَالُ يَا ابْنَ آدَمَ هَلْ رَأَيْتَ خَيْرًا قَطُّ هَلْ مَرَّ بِكَ نَعِيمٌ قَطُّ فَيَقُولُ لاَ وَاللَّهِ يَا رَبِّ. وَيُؤْتَى بِأَشَدِّ النَّاسِ بُؤْسًا فِى الدُّنْيَا مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ فَيُصْبَغُ صَبْغَةً فِى الْجَنَّةِ فَيُقَالُ لَهُ يَا ابْنَ آدَمَ هَلْ رَأَيْتَ بُؤْسًا قَطُّ هَلْ مَرَّ بِكَ شِدَّةٌ قَطُّ فَيَقُولُ لاَ وَاللَّهِ يَا رَبِّ مَا مَرَّ بِى بُؤُسٌ قَطُّ وَلاَ رَأَيْتُ شِدَّةً قَطُّ .
‘কিয়ামতের ময়দানে দুনিয়ার মধ্যে সব যেয়ে ধনাঢ্য ও সুখী ব্যক্তিকে আনা হবে, অতঃপর তাকে জাহান্নাম থেকে অল্প সময় ঢুকিয়ে এনে জিজ্ঞাসা করা হবে, হে আদম সন্তান! তুমি কি কখনও দুনিয়াতে সুখ-শান্তিতে ছিলে? তুমি কি কখনও দুনিয়ার নিয়ামত পেয়েছিলে? সে বলবে, না-আল্লাহর কসম! হে আমার রব! আমি কখনও দুনিয়তে শান্তি পাই নি। ঠিক তদ্রুপ দুনিয়ায় যে ব্যক্তি সর্বাধিক কষ্টকর ও অশান্তিতে ছিলে, তাকে অল্প সময়ের জন্য জান্নাতে ঢুকিয়ে নিয়ে আসা হবে, অতঃপর তাকে বলা হবে, হে আদম সন্তান! তুমি কি কখনও অভাব অনটনে ছিলে? সে আল্লাহর কসম করে বলবে, না, আমি কখনও কোনো অভাব-অনটনে বা কষ্টে ছিলাম না।’
অর্থাৎ জাহান্নামী ব্যক্তি দুনিয়ার সকল শান্তি ও নেয়ামতের কথা ভুলে যাবে। আর জান্নাতী ব্যক্তি দুনিয়ার সকল কষ্ট-ক্লেশের কথা ভুলে যাবে।
* অপর হাদীসে রয়েছে, আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
يُقَالُ لِلرَّجُلِ مِنْ أَهْلِ النَّارِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ: أَرَأَيْتَ لَوْ كَانَ لَكَ مَا عَلَى الأَرْضِ مِنْ شَيْءٍ أَكُنْتَ مُفْتَدِيًا بِهِ ؟ قَالَ: فَيَقُولُ: نَعَمْ ، قَالَ: فَيَقُولُ: قَدْ أَرَدْتُ مِنْكَ أَهْوَنَ مِنْ ذَلِكَ ، قَدْ أَخَذْتُ عَلَيْكَ فِي ظَهْرِ آدَمَ أَنْ لاَ تُشْرِكَ بِي شَيْئًا ، فَأَبَيْتَ إِلاَّ أَنْ تُشْرِكَ.
‘কিয়ামতের ময়দানে এক জাহান্নামী ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করা হবে, তুমি দুনিয়ার সমস্ত সম্পদের মালিক হলে কি তা প্রাণের ফিদয়াস্বরূপ খরচ করতে? সে বলবে হে আমার রব! আমি তা করতাম। তখন আল্লাহ বলবেন, হে আমার বান্দা! আমি তোমাকে তার চেয়েও সহজ হুকুম দিয়েছিলাম, যখন আমি তোমাকে আদম (‘আলাইহিস সালাম) এ পিঠ থেকে বের করেছিলাম। তখন বলেছিলাম তুমি আমার সঙ্গে কাউকে শরীক করবে না। কিন্তু তুমি আমার কথা অমান্য করে আমার সঙ্গে অন্যকে শরীক করেছিলে।’
* অন্য হাদীসে,
عَنْ يَعْلَى بْنِ مُنْيَةَ ، وهو ابن أمية، ومنيه أمه ـ : يُنْشِئُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ لأَهْلِ النَّارِ سَحَابَةً سَوْدَاءَ مُظْلِمَةً مُدْلَهِمَّةً ، فَإِذَا أَشْرَفَتْ عَلَيْهِمْ نَادَاهُمْ: يَا أَهْلَ النَّارِ، أَيَّ شَيْءٍ تَطْلُبُونَ ؟ وَمَا الَّذِي تُسْأَلُونَ ، فَيَذْكُرُونَ بِهَا سَحَابَ الدُّنْيَا ، وَالْمَاءَ الَّذِي كَانَ يَنْزِلُ عَلَيْهِمْ ، فَيَقُولُونَ: نَسْأَلُ بَارِدَ الشَّرَابِ ، فَيُمْطِرُ عَلَيْهِمْ أَغْلالا تُزَادُ فِي أَغْلالِهِمْ ، وَسَلاسِلَ تُزَادُ فِي سَلاسِلِهِمْ ، وَجَمْرًا تُلْهِبُ النَّارَ عَلَيْهِمْ
‘ইয়া‘লা ইবন মুনইয়াহ – তাঁর পিতার নাম উমাইয়া আর মুনইয়াহ তার মায়ের নাম- বর্ণনা করেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন জাহান্নামীদের জন্য ঘন কালো মেঘ সৃষ্টি করবেন। যখন মেঘ তাদের সামনে দেখা যাবে তখন মেঘ তাদের ডেকে বলবে, হে জাহান্নামীরা! তোমরা মেঘ থেকে কি কিছু চাও, তখন তারা দুনিয়ার মেঘের কথা চিন্তা করবে এবং দুনিয়ার পানির কথা ভাববে, তাই তারা বলবে, আমরা পিপাসিত, আমরা মেঘ থেকে বৃষ্টি চাই, পানি চাই। অতঃপর মেঘ তাদের জন্য আগুনের বেড়ী, শিকল ও আগুনের কয়লা অধিক পরিমাণে বর্ষণ হতে থাকবে। আর আগুনের কয়লা আগুনের দাহ্য আরও শক্তি বাড়িয়ে দেবে।’
* অন্য হাদীসে রয়েছে, আবূ মূসা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
ثَلاَثَةٌ لاَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ: مُدْمِنُ خَمْرٍ ، وَقَاطِعُ رَحِمٍ ، وَمُصَدِّقٌ بِالسِّحْرِ . وَمَنْ مَاتَ مُدْمِنًا لِلْخَمْرِ سَقَاهُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ مِنْ نَهْرِ الْغُوطَةِ . قِيلَ: وَمَا نَهْرُ الْغُوطَةِ ؟ قَالَ: نَهْرٌ يَجْرِي مِنْ فُرُوجِ الْمُومِسَاتِ يُؤْذِي أَهْلَ النَّارِ رِيحُ فُرُوجِهِمْ.
‘তিন ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না ১. মদ্যপায়ী, ২. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী ও ৩. জাদুতে বিশ্বাসী। যে ব্যক্তি মদ পান করে মারা যাবে, আল্লাহ তাকে গুওত্বাহ নদীর রক্ত পান করাবেন। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, নহরে গুওত্বাহ কী? তিনি উত্তরে বললেন, যে নদী দিয়ে জাহান্নামী মহিলাদের লজ্জাস্থানের দুর্গন্ধযুক্ত রক্ত বইতে থাকবে, তার দুর্গন্ধ প্রত্যেক জাহান্নামীর কষ্ট বৃদ্ধি করবে।’
* অন্য হাদীসে জাবের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إِنَّ عَلَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ عَهْدًا لِمَنْ يَشْرَبُ الْمُسْكِرَ أَنْ يَسْقِيَهُ مِنْ طِينَةِ الْخَبَالِقَالُوا: يَا رَسُولَ اللهِ، وَمَا طِينَةُ الْخَبَالِ؟ قَالَ: عَرَقُ أَهْلِ النَّارِأَوْ عُصَارَةُ أَهْلِ النَّارِ
‘আল্লাহ তা‘আলার ওয়াদা; যে ব্যক্তি নেশা করবে আল্লাহ অবশ্যই তাকে ‘তীনাতুল খাবাল’ থেকে পান করাবেন। সাহাবাগণ জিজ্ঞাসা করলে, হে আল্লাহর রাসূল! তীনাতুল খাবাল কি? তিনি বললেন, জাহান্নামীদের পুঁজ বা দুর্গন্ধযুক্ত ঘাম।’
* বুখারী ও মুসলিমের হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ইয়াহূদী ও নাসারাদের বলা হবে,
مَاذَا تَبْغُونَ؟ قَالُوا عَطِشْنَا يَا رَبَّنَا فَاسْقِنَا. فَيُشَارُ إِلَيْهِمْ أَلاَ تَرِدُونَ؟ فَيُحْشَرُونَ إِلَى النَّارِ كَأَنَّهَا سَرَابٌ يَحْطِمُ بَعْضُهَا بَعْضًا فَيَتَسَاقَطُونَ فِى النَّارِ.
‘তোমরা কী চাও? তারা বলবে হে রব! আমরা পিপাসিত। আপনি আমাদেরকে পানি পান করতে দিন। তখন তাদেরকে ইঙ্গিত করে বলা হবে যে তোমরা কি হাওযে নামবে না? এরপর তাদেরকে জাহান্নামে একত্রিত করা হবে; তারা দেখতে পাবে জাহান্নামকে মরীচিকার মত; যার একাংশ আরেক অংশকে বিধ্বংস করছে; তারপর তারা জাহান্নামে পতিত হবে।’
হাসান বছরী রহ. বলেন, ‘তোমাদের ওই জাহান্নামীদের সম্পর্কে কী ধারণা, যারা ৫০ হাজার বছর পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে, যেখানে তারা কোনো খাবারের স্বাদ গ্রহণ করতে পারবে না এবং এক ফোঁটা পানিও পান করতে পারবে না। পানির পিপাসায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার উপক্রম হবে। তাদের পেট ক্ষুধায় আগুনের মত জ্বলতে থাকবে। অতঃপর তাদের জাহান্নামের আগুনের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে, আর সেখানে তাদেরকে ফুটন্ত গরম পানি পান করনো হবে। যার উত্তপ্ততার কোনো তুলনা নেই, যে উষ্ণতা ও উত্তপ্ততা পরিপক্কতা পেয়েছে।’
ইবনুল জাওযী রহ. জাহান্নামের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, জাহান্নাম এমন ঘর যার অধিবাসীদের শান্তি থেকে দূরে রাখা হয়েছে। সকল প্রকারের আনন্দ ও শান্তি তেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। তাদের সাদা চামড়া কাল রঙে পরিবর্তন করে দেয়া হয়েছে। তাদের পাহাড়ের চেয়ে শক্ত হাতুড়ি দ্বারা পিটানো হচ্ছে। সেখানে শাস্তি দেওয়ার জন্য কঠোর হৃদয়ের ও কঠিন শাস্তিদাতা ফেরেশতা রয়েছে। হায়! যদি তুমি তাদেরকে দেখতে সেই ফুটন্ত পানিতে সাঁতার কাটতে। কঠিন ঠাণ্ডাতে নিক্ষিপ্ত হতে। চিন্তা ও কষ্ট সর্বক্ষণ তাদের সাথী থাকবে, ফরে তারা কখনও খুশী হতে পারবে না। তাদের অবস্থান সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, তাই তারা সে স্থান ত্যাগ করতে পারবে না। স্থায়ীভাবে, চিরকাল সেখানে তারা থাকবে, তারা তা থেকে মুক্তি পাবে না। তাদের শাস্তি দেয়ার জন্য ফেরেশতা নিযুক্ত করা হবে, যারা কঠোর হৃদয়ের হবে। যাদের ধমক আযাব থেকে বড় কষ্টদায়ক হবে। যাদের অনুশোচনা তাদের বিপদের চেয়েও অধিক শক্তিশালী। তাদের যৌবনকালকে পাপ দ্বারা ধ্বংস করার কারণে তার কাঁদতে থাকবে। তারা যত কাঁদবে কঠোর হৃদয় কঠিন ফেরেশতাগণ তাদেরকে তত বেশি কষ্ট দিতে থাকবে। হায় আফসোস তাদের জন্য যে তারা তাদের রবের রোষানলে পড়েছে! হায় আফসোস তাদের বড় বিপদের জন্য! আহা তাদের কত অপমান যে সকল মানুষের সামনে অপমানিত হচ্ছে। হে সৃষ্টির ঘৃণিত ব্যক্তিরা! এখন তোমাদের দুনিয়ার হারাম উপার্জন কোথায় গেল? আজ তোমাদের পাপ করার আগ্রহ কোথায় গেল? মনে হবে যেন তা ছিল তাদের আকাশ কুসুম কল্পনা। তারপর তাদের এ শরীরকে জাহান্নামে পোড়ানো হবে, যখনই তাদের শরীর পুড়ে যাবে, আল্লাহ নতুন দেহ পরিবর্তন করে দেবেন। যখন শরীরের চামড়া পুড়ে যাবে, নতুন চামড়া দ্বারা পরিবর্তন দেবেন। সেখানে তাদের শাস্তি বাড়ানোর জন্য কঠিন হৃদয়ের ফেরেশতা সর্বক্ষণ নিযুক্ত থাকবে।’
হে আল্লাহ! আপনি আমাদের জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচান। আমাদের চিরস্থায়ী আপমান ও ধ্বংস হতে বাঁচান। হে আল্লাহ আপনি আপনার রহমতে আমাদেরকে মুত্তাকীদের ঘরের বাসিন্দা করুন করুন। আর আমাদের ও আমাদের পিতা-মাতাসহ মুসলিমদের ক্ষমা করে দিন। হে করুণাময় রব!
আর আল্লাহ আমাদের নবী মুহাম্মদ ও তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবীগণের ওপর সালাত পেশ করুন।
ষষ্ঠবিংশ আসরঃজাহান্নামে প্রবেশের কারণ
সকল প্রশংসা শক্তিমান, সুদৃঢ়, বিজয়ী, শক্তিশালী, সুউচ্চ আল্লাহর জন্য, ক্ষীণতর স্বরও যার শ্রবণের বাইরে নয়; গর্ভস্থ শিশুর নড়াচড়াও যার দৃষ্টিতে গোপন নয়। তাঁর বড়ত্বের সামনে প্রতাপশালী বাদশাও বিনীত হয়। তাঁর ক্ষমতার সম্মুখে চক্রান্তকারীর চক্রান্ত বিফল হয়। ভুলকারীর ওপর তিনি যেমন চান তাঁর ফয়সালা বাস্তবায়ন করেন। তিনি যাকে চান সৃষ্টিকূলের মধ্য থেকে তাকে নির্বাচিত করেন। আর এরাই বামপন্থী দল আর ওরাই ডানপন্থী। কর্মসম্পাদনকারীদের কর্মসম্পাদনের আগেই এ সম্পর্কে ভাগ্যলিপি চূড়ান্ত হয়েছে। যদি এ শ্রেণীকরণ না হত তবে মুজাহিদদের জিহাদ বিফলে যেত এবং কাফেরদের মধ্য থেকে ঈমানদারদের কিংবা বিশ্বাসীদের মধ্য থেকে সন্দেহবাদীদের চেনা যেত না। এ বিন্যাসকরণ না হলে অপরাধীতে জাহান্নাম পূর্ণ হত না। {আর যদি আমি ইচ্ছা করতাম, তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার হিদায়াত দান করতাম। কিন্তু আমার কথাই সত্যে পরিণত হবে যে, ‘নিশ্চয় আমি জিন ও মানুষ উভয় দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করব’।} ওই হলো আল্লাহর হিকমত হে আমার ভাই আর তিনি সকল প্রজ্ঞাবানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রজ্ঞাবান। আমি পবিত্র সে সত্তার প্রশংসা করি শোকরগুযারদের অনুরূপ প্রশংসা। তাঁর কাছে প্রার্থনা করি ধৈর্যশীলদের অনুরূপ সাহায্য। আমি তাঁর কাছে অপমানজনক শাস্তি থেকে পরিত্রাণ চাই।
আমি সাক্ষ্য দেই যে আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই; তিনিই সত্য ও প্রকাশ্য মালিক। আমি আরও সাক্ষ্য দেই যে মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও সুনির্বাচিত বিশ্বস্ত রাসূল।
আল্লাহ সালাত ও সালাম বর্ষিত করুন তাঁর ওপর, তাঁর সাহাবী আবূ বকরের ওপর যিনি দীনের ক্ষেত্রে পুরুষদের মধ্যে তাঁর প্রথম অনুসারী, উমরের ওপর যিনি আল্লাহর নির্দেশের ক্ষেত্রে দৃঢ় ও অনড়, উসমানের ওপর যিনি রাসূলের দুই কন্যার স্বামী ও উত্তম জোড়ার অধিকারী, আলীর ওপর যিনি বিদ্যার সাগর ও মুক্ত বক্ষের অধিকারী এবং জাহান্নামের অগ্নির কারণসমূহ থেকে পবিত্র। আর রাসূলের সব পরিবার-পরিজন, পুণ্যাত্মা সব সাহাবী ও কিয়ামত পর্যন্ত আগত তাঁর দীনের সকল অনুসারীর ওপর।
মুসলিম ভাইগণ! জেনে নিন যে, জাহান্নামে প্রবেশের কিছু কারণ রয়েছে, যা আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মজীদে ও তাঁর রাসূলের সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের যবানীতে বর্ণনা করেছেন, যাতে করে মানুষ তা থেকে সাবধান হয় ও তা থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখে।
এ কারণসমূহ দু’ভাগে বিভক্ত:
প্রথম: এমন কারণ যা মানুষকে কাফির বানায়। এ রকম কাজে লিপ্ত ব্যক্তি ঈমান থেকে বের হয়ে কাফির হয়ে যায় এবং তা তার জন্য চিরস্থায়ী জাহান্নাম অবধারিত করে।
দ্বিতীয়: এমন কারণ যদ্বারা মানুষ ফাসিক হয়। এরকম অপরাধে লিপ্ত ব্যক্তি ন্যায়-পরায়ণতা থেকে পাপাচারী হয়ে পড়ে; এবং তা তাকে জাহান্নামে শাস্তি ভোগ করার উপযোগী বানিয়ে দেয়; যদিও তাকে সেখানে চিরস্থায়ী করে না।
প্রথম শ্রেণীর লোকদের প্রকারভেদ:
১ম প্রকার: আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা
যা সংঘটিত হয় আল্লাহর রুবূবিয়্যাত, উলূহিয়্যাত এবং আসমা ওয়াস-সিফাতের মধ্যে শির্ক করার মাধ্যমে। যেমন- এ বিশ্বাস করা যে, আল্লাহর সঙ্গে দ্বিতীয় কোনো স্রষ্টা আছে, সৃষ্টির ব্যাপারে তার সংশ্লিষ্টতা আছে অথবা সে এককভাবে কিছু সৃষ্টি করতে পারে। তেমনি এ ধারণা পোষণ করা যে, আল্লাহর সাথে কোনো ইলাহ রয়েছে যে ইবাদত পাওয়ার উপযোগী অথবা আল্লাহর সাথে অন্য কারও ইবাদত করা, ফলে তার জন্য কিছু ইবাদত নিবেদিত করা অথবা এ বিশ্বাস করা যে, আল্লাহর মত অন্য কারও সে রকম জ্ঞান, ক্ষমতা কিংবা সম্মান রয়েছে; এ জাতীয় যে কোনো বিশ্বাসই শিরকে আকবার বড় শির্ক; যা ঐ ধরণের বিশ্বাসীকে চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামের অধিবাসী বানাবে।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ إِنَّهُۥ مَن يُشۡرِكۡ بِٱللَّهِ فَقَدۡ حَرَّمَ ٱللَّهُ عَلَيۡهِ ٱلۡجَنَّةَ وَمَأۡوَىٰهُ ٱلنَّارُۖ وَمَا لِلظَّٰلِمِينَ مِنۡ أَنصَارٖ ٧٢ ﴾ [المائ‍دة: ٧٢]
‘নিশ্চয় যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে শির্ক করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন। তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম। আর জালিমদের কোনো সাহায্যকারী নেই।’ {সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ৭২}
২য় প্রকার: আল্লাহর সঙ্গে কুফুরী করা অথবা তাঁর ফেরেশতাগণ অথবা রাসূলগণ অথবা কিয়ামত দিবস অথবা তাকদিরের ভালো-মন্দকে অস্বীকার করা।
সুতরাং যারাই উপর্যুক্ত বিষয়সমূহের কোনো কিছু মিথ্যা মনে করবে কিংবা অস্বীকার করবে অথবা সন্দেহ পোষণ করবে সে অবশ্যই কাফের হয়ে যাবে এবং চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামে অবস্থান করবে।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ يَكۡفُرُونَ بِٱللَّهِ وَرُسُلِهِۦ وَيُرِيدُونَ أَن يُفَرِّقُواْ بَيۡنَ ٱللَّهِ وَرُسُلِهِۦ وَيَقُولُونَ نُؤۡمِنُ بِبَعۡضٖ وَنَكۡفُرُ بِبَعۡضٖ وَيُرِيدُونَ أَن يَتَّخِذُواْ بَيۡنَ ذَٰلِكَ سَبِيلًا ١٥٠ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡكَٰفِرُونَ حَقّٗاۚ وَأَعۡتَدۡنَا لِلۡكَٰفِرِينَ عَذَابٗا مُّهِينٗا ١٥١ ﴾ [النساء: ١٥٠، ١٥١]
‘নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে কুফরী করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলদের মধ্যে ঈমানের ব্যাপারে পার্থক্য করতে চায়, আর আমরা কতিপয় রাসূলে ঈমান রাখি ও কতিপয় রাসূলকে অস্বীকার করি; বস্তুত এরা মধ্যবর্তী কোনো পথ অবলম্বন করতে চায়, প্রকৃতপক্ষে এরাই নিরেট কাফের। আর আমরা কাফেরদের জন্য তৈরি করে রেখেছি অপমানজনক আযাব।’ {সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৫০-১৫১}
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ إِنَّ ٱللَّهَ لَعَنَ ٱلۡكَٰفِرِينَ وَأَعَدَّ لَهُمۡ سَعِيرًا ٦٤ خَٰلِدِينَ فِيهَآ أَبَدٗاۖ لَّا يَجِدُونَ وَلِيّٗا وَلَا نَصِيرٗا ٦٥ يَوۡمَ تُقَلَّبُ وُجُوهُهُمۡ فِي ٱلنَّارِ يَقُولُونَ يَٰلَيۡتَنَآ أَطَعۡنَا ٱللَّهَ وَأَطَعۡنَا ٱلرَّسُولَا۠ ٦٦ وَقَالُواْ رَبَّنَآ إِنَّآ أَطَعۡنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَآءَنَا فَأَضَلُّونَا ٱلسَّبِيلَا۠ ٦٧ رَبَّنَآ ءَاتِهِمۡ ضِعۡفَيۡنِ مِنَ ٱلۡعَذَابِ وَٱلۡعَنۡهُمۡ لَعۡنٗا كَبِيرٗا ٦٨ ﴾ [الاحزاب: ٦٤، ٦٨]
‘নিশ্চয় আল্লাহ কাফিরদের ওপর লা‘নত করেছেন ও তাদের জন্য জাহান্নামের আগুন প্রস্তুত করে রেখেছেন। তারা তথায় চিরকাল থাকবে। সেখানে কোনো বন্ধু বা কোনো সাহায্যকারী পাবে না। যেদিন তাদের চেহারা আগুনে উলট পালট করা হবে সেদিন তারা বলবে, হায় আফসোস! যদি আমরা আল্লাহ ও রাসূলের অনুসরণ করতাম! আমরা তো আমাদের নেতাদের ও বড়দের অনুসারী ছিলাম। তারা আমাদের পথভ্রষ্ট করেছে। হে আমাদের রব! আপনি তাদের দ্বিগুণ শাস্তি প্রদান করুন এবং তাদের প্রতি মহা অভিসম্পাত করুন।’ {সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৬৪-৬৮}
৩য় প্রকার: ইসলামের পঞ্চ ভিত্তির কোনো একটি ফরযকে অস্বীকার করা।
– সুতরাং যে কেউ আল্লাহর একত্ববাদ ফরয হওয়া অস্বীকার করে অথবা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য রিসালাতের সাক্ষ্য প্রদান অস্বীকার করে অথবা তাঁর রিসালত সকল মানুষের জন্য হওয়াকে অস্বীকার করে অথবা পাঁচ সালাতের ফরয, অথবা যাকাত অথবা রমযানের সিয়াম অথবা হজ অস্বীকার করে, সে কাফির ব্যক্তি হবে। কারণ; সে আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুসলিমদের ঐকমত্য তথা ইজমাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছে।
– ঠিক তদ্রুপ কেউ যদি আল্লাহর সঙ্গে শির্ক হারাম হওয়াকে অস্বীকার করে অথবা যাদের হত্যা করা আল্লাহ হারাম ঘোষণা করেছেন তাদের হত্যা করা হারাম মনে করতে অস্বীকার করল অথবা যিনা-ব্যভিচার অথবা পুং মৈথুন অথবা মদ পান ইত্যাদি যেগুলো হারাম হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহর কুরআন ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নায় প্রকাশ্য ভাষ্য রয়েছে সেগুলোকে হারাম মানতে অস্বীকার করল সেও কাফের হয়ে যাবে; কারণ সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর মিথ্যারোপকারী। কিন্তু যদি সে নও মুসলিম হয়, আর এ গুলোর কোনো কিছুকে অজ্ঞতার কারণে অস্বীকার করে বসে, তবে যতক্ষণ না সেটা জানবে ততক্ষণ কাফের হবে না। তবে যদি জানার পর অস্বীকার করে তবে সেও কাফের হয়ে যাবে।
৪র্থ প্রকার: আল্লাহ তা‘আলা অথবা তাঁর দ্বীন অথবা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَلَئِن سَأَلۡتَهُمۡ لَيَقُولُنَّ إِنَّمَا كُنَّا نَخُوضُ وَنَلۡعَبُۚ قُلۡ أَبِٱللَّهِ وَءَايَٰتِهِۦ وَرَسُولِهِۦ كُنتُمۡ تَسۡتَهۡزِءُونَ ٦٥ لَا تَعۡتَذِرُواْ قَدۡ كَفَرۡتُم بَعۡدَ إِيمَٰنِكُمۡۚ﴾ [التوبة: ٦٥، ٦٦]
‘আর যদি আপনি তাদেরকে প্রশ্ন করেন, অবশ্যই তারা বলবে, ‘আমরা আলাপচারিতা ও খেল-তামাশা করছিলাম। বলুন, ‘আল্লাহ, তাঁর আয়াতসমূহ ও তাঁর রাসূলের সাথে তোমরা বিদ্রূপ করছিলে’? তোমরা ওযর পেশ করো না। তোমরা তোমাদের ঈমানের পর অবশ্যই কাফের হয়ে গেছ।’ {সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ৬৫-৬৬}
আর আয়াতে বর্ণিত ‘ইস্তেহযা’ বা বিদ্রূপ করার অর্থ হচ্ছে, ঠাট্টা করা, ব্যঙ্গ করা। এটা আল্লাহ, তাঁর দ্বীন ও রাসূলের সাথে বড় ধরণের অপমানজনক কাজ ও বড় ধরণের অপদস্থ ও অসম্মান প্রকাশ। মহান আল্লাহ তা থেকে বহু উর্ধ্বে।
৫ম প্রকার : আল্লাহ তা‘আলা, তাঁর দ্বীন ও তাঁর রাসূলকে গালি দেয়া
গালি দ্বারা উদ্দেশ্য, দোষ-ত্রুটি তালাশ করা, ভুল বের করে বেড়ানো এবং এমনভাবে উল্লেখ করা যা দ্বারা তাদের অপমান, খাটো করা অথবা সম্মানহানি ইত্যাদি বুঝায়; যথা- লা‘নত দেওয়া কিংবা তাদের খারাপ ভাষায় কথা বলা ও খারাপ গুণে গুণান্বিত করা ইত্যাদি।
শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ অথবা তাঁর রাসূলকে গালি দেবে করে সে কাফির বলে বিবেচিত হবে; প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সার্বিকভাবে সে কাফের। চাই সে গালি দেয়াকে হালাল মনে করুক বা হারাম মনে করুক অথবা বিশ্বাসের কথাটি ভুলে শৈথিল্য প্রদর্শন করেই বলুক।… আর আমাদের আলেমগণ আরও বলেন, যদি ওই কথা কেউ ঠাট্টা করে অথবা ঐকান্তিকভাবে বলে, সর্বাবস্থায় সে কাফির হয়ে যাবে। আর এটাই হচ্ছে সঠিক ও অকাট্য কথা।
ইমাম ইসহাক ইবন রাহওয়াই থেকে বর্ণনা করা হয়েছে যে, তিনি বলেছেন: ‘সকল মুসলিমের এ বিষয়ে ইজমা‘ তথা ঐকমত্য যে, যে কেউ আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলকে গালি দেবে অথবা আল্লাহ তা‘আলা যা নাযিল করেছেন তার সামান্যতম অংশকেও প্রতিহত করতে চাইবে সে কাফির বলে বিবেচিত হবে। যদিও সে আল্লাহ যা নাযিল করেছে তা স্বীকারকারী বলে মুখে দাবি করে থাকুক।’
শাইখুল ইসলাম আরও বলেন, ‘অন্যান্য নবীকে গালি দেওয়ার বিধান আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালি দেওয়ার বিধানের মতই। তাই যদি কেউ কুরআনে যাদেরকে নবী হিসেবে নাম নিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে তাদেরকে গালি দেয়, অথবা যাদের নবুওয়তের বিষয়টি প্রসিদ্ধ হয় যেমন রাসূলের হাদীসে তাদের উল্লেখ এসেছে যে একজন নবী এমন করেছেন অথবা এমন বলেছেন এটা শুনে কেউ যদি তাঁকে নবী জানার পরও গালি দেয় তবে সেও ওই হুকুমের অন্তর্গত। অর্থাৎ কাফের হয়ে যাবে।
তবে নবীগণ ব্যতীত অন্যদের গালি দেওয়া: যদি এ গালি দ্বারা রাসূলকেই গালি দেওয়া উদ্দেশ্য হয়, যেমন কেউ রাসূলের সাহাবীগণকে গালি দিল, যার দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে খাটো করা উদ্দেশ্য হয়, তাহলে সেও কাফির হিসেবে ধর্তব্য হবে। কারণ রাসূলের সাথে থাকার কারণেই তাদেরকে গালি দেওয়া হচ্ছে।
এর উদাহরণ হচ্ছে, যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো স্ত্রীর প্রতি ব্যভিচার ইত্যাদির অপবাদ দেওয়া (নাউযু বিল্লাহ)। এর মাধ্যমে এ ব্যক্তি কাফের হয়ে যাবে; কারণ এর দ্বারা খোদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অপমান ও তাকে গালি দেওয়া হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ ٱلۡخَبِيثَٰتُ لِلۡخَبِيثِينَ﴾ [النور: ٢٦]
‘দুশ্চরিত্রা নারীরা দুশ্চরিত্র পুরুষদের জন্য।’ {সূরা আন-নূর, আয়াত: ২৬}
৬ষ্ঠ প্রকার: আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা ব্যতীত বিচার-ফয়সালা করা; এ বিশ্বাসে যে, এটি বেশি বাস্তব এবং মানুষের জন্য আল্লাহর আইন থেকে অধিক কল্যাণকর
* সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা ব্যতীত অন্য কিছু দিয়ে সেটাকে বেশি বাস্তব এবং মানুষের জন্য আল্লাহর আইন থেকে অধিক কল্যাণকর বিশ্বাস পোষণ করে বিচার ফয়সালা করবে সে কাফের হয়ে যাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَمَن لَّمۡ يَحۡكُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡكَٰفِرُونَ ﴾ [المائ‍دة: ٤٤]
‘যারা আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ বিধান অনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করে না তারাই কাফির।’ {সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ৪৪}
* তদ্রুপ কেউ যদি মনে করে গায়রুল্লাহর (মানুষের) ফয়সালা আল্লাহর ফায়সালা থেকে শ্রেষ্ঠ অথবা মনে করে যে, মানুষের ফয়সালা আল্লাহর ফয়সালার সমান অথবা সে মনে করল যে আল্লাহর বিধান ছাড়া অন্য কিছু দ্বারা বিচার-ফয়সালা দেওয়া জায়েয; এসব অবস্থায়ও সে কাফির হবে; যদিও সে ঐ বিচার না করে। কারণ, এর মাধ্যমে সে আল্লাহর বাণীতে মিথ্যারোপ করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :
﴿وَمَنۡ أَحۡسَنُ مِنَ ٱللَّهِ حُكۡمٗا لِّقَوۡمٖ يُوقِنُونَ ﴾ [المائ‍دة: ٥٠]
‘আর নিশ্চিত বিশ্বাসী কওমের জন্য বিধান প্রদানে আল্লাহর চেয়ে কে অধিক উত্তম?’ {সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ৫০}
৭ম প্রকার: মুনাফিকী
অর্থাৎ অন্তরে কুফরী গোপন রেখে মানুষের সম্মুখে কথা ও কাজে নিজেকে মুসলিম হিসেবে প্রকাশ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ إِنَّ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ فِي ٱلدَّرۡكِ ٱلۡأَسۡفَلِ مِنَ ٱلنَّارِ وَلَن تَجِدَ لَهُمۡ نَصِيرًا ١٤٥ ﴾ [النساء: ١٤٥]
‘নিশ্চয়ই মুনাফিকরা জাহান্নামের তলদেশে থাকবে। আপনি তাদের কোনো সাহায্যকারী পাবেন না।’ {সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৪৫}
এই দল (মুনাফিকরা) পূর্বের দল হতে নিকৃষ্টতম। সুতরাং এদের শাস্তি কাফিরদের থেকেও বেশি হবে। তারা জাহান্নামের নিম্নতম স্থানে অবস্থান করবে। কেননা এরা কুফরী, ধোঁকাবাজী এবং আল্লাহ, তাঁর আয়াত ও তাঁর রাসূলের সঙ্গে ঠাট্টা করাসহ বিবিধ পাপে জড়িত।
* আল্লাহ তা‘আলা এদের প্রসঙ্গে বলেছেন :
﴿وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَقُولُ ءَامَنَّا بِٱللَّهِ وَبِٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَمَا هُم بِمُؤۡمِنِينَ ٨ يُخَٰدِعُونَ ٱللَّهَ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَمَا يَخۡدَعُونَ إِلَّآ أَنفُسَهُمۡ وَمَا يَشۡعُرُونَ ٩ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٞ فَزَادَهُمُ ٱللَّهُ مَرَضٗاۖ وَلَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمُۢ بِمَا كَانُواْ يَكۡذِبُونَ ١٠ وَإِذَا قِيلَ لَهُمۡ لَا تُفۡسِدُواْ فِي ٱلۡأَرۡضِ قَالُوٓاْ إِنَّمَا نَحۡنُ مُصۡلِحُونَ ١١ أَلَآ إِنَّهُمۡ هُمُ ٱلۡمُفۡسِدُونَ وَلَٰكِن لَّا يَشۡعُرُونَ ١٢ وَإِذَا قِيلَ لَهُمۡ ءَامِنُواْ كَمَآ ءَامَنَ ٱلنَّاسُ قَالُوٓاْ أَنُؤۡمِنُ كَمَآ ءَامَنَ ٱلسُّفَهَآءُۗ أَلَآ إِنَّهُمۡ هُمُ ٱلسُّفَهَآءُ وَلَٰكِن لَّا يَعۡلَمُونَ ١٣ وَإِذَا لَقُواْ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ قَالُوٓاْ ءَامَنَّا وَإِذَا خَلَوۡاْ إِلَىٰ شَيَٰطِينِهِمۡ قَالُوٓاْ إِنَّا مَعَكُمۡ إِنَّمَا نَحۡنُ مُسۡتَهۡزِءُونَ ١٤ ٱللَّهُ يَسۡتَهۡزِئُ بِهِمۡ وَيَمُدُّهُمۡ فِي طُغۡيَٰنِهِمۡ يَعۡمَهُونَ ١٥﴾ [البقرة: ٨، ١٥]
‘মানুষের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে যারা বলে, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর ওপর শেষ দিবসের ওপর, বাস্তবে তারা মুমিন নয়। তারা আল্লাহকে ও মুমিনগণকে ধোঁকা দেয়। বস্তুত তারা নিজেদের ধোঁকা দেয় কিন্তু তারা তা বুঝে না। তাদের অন্তরে রোগ রয়েছে। আর আল্লাহ তাদের রোগ বৃদ্ধি করে দেন। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি তাদের মিথ্যা বলার কারণে। আর যখন তাদেরকে বলা হয়, তোমরা জমিনে ফেৎনা সৃষ্টি করো না, তখন তারা বলে আমরা মীমাংসাকারী। জেনে রাখ! তারাই প্রকৃত ফেৎনা সৃষ্টিকারী কিন্তু তারা বুঝে না। আর যখন তাদের বলা হয়, তোমরা সে রকম ঈমান আন, যেভাবে অন্য লোকজন ঈমান এনেছে। তখন তারা বলে, আমরা কি ঈমান আনব বোকাদের মত? মনে রেখ, প্রকৃতপক্ষে তারাই বোকা কিন্তু তারা তা বোঝে না। আর তারা যখন ঈমানদারদের সঙ্গে সাক্ষাত করে তখন বলে, আমরা ঈমান এনেছি। আবার যখন তাদের শয়তানদের সঙ্গে একান্তে সাক্ষাৎ করে, তখন বলে আমরা তোমাদের সঙ্গেই রয়েছি। আমরা তো মুসলিমদের সঙ্গে শুধু উপহাস করছি। বরং আল্লাহই তাদের সঙ্গে উপহাস করেন আর তাদের অবকাশ দেন যেন তারা নিজেদের অহংকার ও কুমতলবে হয়রান পেরেশান থাকে।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৮-১৫}
মুনাফিকদের অনেকগুলি আলামত বা নিদর্শন আছে:
আল্লাহর যা নাযিল করেছেন তাতে সন্দেহ করা, যদিও সে নিজেকে ঈমানদার বলে প্রকাশ করে। যেমন,
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ إِنَّمَا يَسۡتَ‍ٔۡذِنُكَ ٱلَّذِينَ لَا يُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَٱرۡتَابَتۡ قُلُوبُهُمۡ فَهُمۡ فِي رَيۡبِهِمۡ يَتَرَدَّدُونَ ٤٥ ﴾ [التوبة: ٤٥]
‘নিঃসন্দেহে তারাই আপনার কাছে অব্যাহতি চায় যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসে ঈমান রাখে না এবং তাদের অন্তর সন্দেহ বাতিক হয়ে পড়েছে। সুতরাং সন্দেহের অবর্তে তারা ঘুরপাক খাচ্ছে।’ {সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ৪৫}
আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেওয়া হুকুম-আহকাম ও বিধি-বিধান অপছন্দ করা। যেমন,
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ أَلَمۡ تَرَ إِلَى ٱلَّذِينَ يَزۡعُمُونَ أَنَّهُمۡ ءَامَنُواْ بِمَآ أُنزِلَ إِلَيۡكَ وَمَآ أُنزِلَ مِن قَبۡلِكَ يُرِيدُونَ أَن يَتَحَاكَمُوٓاْ إِلَى ٱلطَّٰغُوتِ وَقَدۡ أُمِرُوٓاْ أَن يَكۡفُرُواْ بِهِۦۖ وَيُرِيدُ ٱلشَّيۡطَٰنُ أَن يُضِلَّهُمۡ ضَلَٰلَۢا بَعِيدٗا ٦٠ وَإِذَا قِيلَ لَهُمۡ تَعَالَوۡاْ إِلَىٰ مَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ وَإِلَى ٱلرَّسُولِ رَأَيۡتَ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ يَصُدُّونَ عَنكَ صُدُودٗا ٦١ ﴾ [النساء: ٦٠، ٦١]
‘আপনি কি তাদের দেখেন নি যারা দাবি করে যে, তারা আপনার এবং আপনার পূর্ববর্তীদের ওপর অবতীর্ণ বিষয়ে ঈমান এনেছে, তারা বিরোধপূর্ণ বিষয়ে ত্বাগুতের কাছে নিয়ে যেতে চায় (মীমাংসার জন্য)। অথচ তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যাতে তারা যেন ত্বাগুতকে অমান্য করে। আর শয়তান তাদেরকে পথভ্রষ্টতায় বহু দূর নিয়ে যেতে চায়। আর যখন আপনি তাদের বলেন, যা আল্লাহ নাযিল করেছে এবং তিনি যা রাসূলের প্রতি নাযিল করেছেন সে দিকে আস, তখন আপনি মুনাফিকদের দেখবেন, ওরা আপনার কাছ থেকে সম্পূর্ণরূপে সরে যাচ্ছে।’ {সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৬০-৬১}
ইসলামের বিজয় এবং মুসলিমদের সাহায্য করাকে অপছন্দ করা এবং মুসলিমদের অপমান-লাঞ্ছনায় খুশি হওয়া। যেমন,
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ إِن تُصِبۡكَ حَسَنَةٞ تَسُؤۡهُمۡۖ وَإِن تُصِبۡكَ مُصِيبَةٞ يَقُولُواْ قَدۡ أَخَذۡنَآ أَمۡرَنَا مِن قَبۡلُ وَيَتَوَلَّواْ وَّهُمۡ فَرِحُونَ ٥٠ ﴾ [التوبة: ٥٠]
‘আপনাকে কোনো কল্যাণ স্পর্শ করলে তাদের তা মন্দ লাগে, পক্ষান্তরে আপনার কোনো বিপদ এলে তারা বলে, আমরা পূর্ব থেকেই নিজেদের কাজ সামলে নিয়েছি এবং তারা উল্লাসিত মনে ফিরে যায়।’ {সূরা আত-তওবা, আয়াত: ৫০}
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَإِذَا لَقُوكُمۡ قَالُوٓاْ ءَامَنَّا وَإِذَا خَلَوۡاْ عَضُّواْ عَلَيۡكُمُ ٱلۡأَنَامِلَ مِنَ ٱلۡغَيۡظِۚ قُلۡ مُوتُواْ بِغَيۡظِكُمۡۗ إِنَّ ٱللَّهَ عَلِيمُۢ بِذَاتِ ٱلصُّدُورِ ١١٩ إِن تَمۡسَسۡكُمۡ حَسَنَةٞ تَسُؤۡهُمۡ وَإِن تُصِبۡكُمۡ سَيِّئَةٞ يَفۡرَحُواْ بِهَاۖ وَإِن تَصۡبِرُواْ وَتَتَّقُواْ لَا يَضُرُّكُمۡ كَيۡدُهُمۡ شَيۡ‍ًٔاۗ إِنَّ ٱللَّهَ بِمَا يَعۡمَلُونَ مُحِيطٞ ١٢٠ ﴾ [ال عمران: ١١٩، ١٢٠]
‘যখন তারা তোমাদের সঙ্গে মিশে তখন বলে, আমরা ঈমান এনেছি। পক্ষান্তরে তারা যখন পৃথক হয় তখন তোমাদের ওপর আক্রোশবশত আঙ্গুল কামড়াতে থাকে। বলুন, তোমরা নিজ আক্রোশেই মরতে থাক। নিশ্চয় আল্লাহ অন্তরের কথা সম্পর্কে সবিশেষ অবগত। তোমাদের যদি কোনো ক্যল্যাণ হয়, তাহলে তাদের মন্দ লাগে আর তোমাদের যদি কোনো অকল্যাণ হয়, তাহলে তারা আনন্দিত হয়। আর যদি তোমরা ধৈর্য্য ধর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, তাহলে তাদের প্রতারণায় তোমাদের কোনোই ক্ষতি হবে না। নিশ্চয়ই তারা যা কিছু করে সে সবই আল্লাহর আয়ত্বে রয়েছে।’ {সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১১৯-১২০}
মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ ও ফেৎনা-ফাসাদ সৃষ্টি করা এবং মুসলিমদের মধ্যে অনৈক্য তৈরী করা এবং এটা করতে পছন্দ করা। যেমন,
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿لَوۡ خَرَجُواْ فِيكُم مَّا زَادُوكُمۡ إِلَّا خَبَالٗا وَلَأَوۡضَعُواْ خِلَٰلَكُمۡ يَبۡغُونَكُمُ ٱلۡفِتۡنَةَ وَفِيكُمۡ سَمَّٰعُونَ لَهُمۡ﴾ [التوبة: ٤٧]
‘যদি তারা তোমাদের সাথে বের হত, তবে তোমাদের মধ্যে ফাসাদই বৃদ্ধি করত এবং তোমাদের মাঝে ছুটোছুটি করত, তোমাদের মধ্যে ফিতনা সৃষ্টির অনুসন্ধানে। আর তোমাদের মধ্যে রয়েছে তাদের কথা অধিক শ্রবণকারী।’ {সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ৪৭}
ইসলামের দুশমন ও কাফের নেতৃবৃন্দকে ভালোবাসা, তাদের প্রশংসা করা এবং তাদের ইসলাম বিরোধী মতাদর্শ প্রচার-প্রসার করা। যেমন,
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ ۞أَلَمۡ تَرَ إِلَى ٱلَّذِينَ تَوَلَّوۡاْ قَوۡمًا غَضِبَ ٱللَّهُ عَلَيۡهِم مَّا هُم مِّنكُمۡ وَلَا مِنۡهُمۡ وَيَحۡلِفُونَ عَلَى ٱلۡكَذِبِ وَهُمۡ يَعۡلَمُونَ ١٤ ﴾ [المجادلة: ١٤]
‘আপনি কি তাদের প্রতি লক্ষ্য করেন নি যারা আল্লাহর গজবে নিপতিত সম্প্রদায়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। তারা মুসলিমদের দলভুক্ত নয় অনুরূপভাবে তারা তাদেরও দলভুক্ত নয়; আর তারা জেনে শুনে মিথ্যা শপথ করে।’ {সূরা আল-মুজাদালাহ্‌, আয়াত: ১৪}
মুমিনদের নিয়ে টিপ্পনী কাটা, তাদের ইবাদতের ক্ষেত্রে দোষ খুঁজে বেড়ানো। যেমন,
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ ٱلَّذِينَ يَلۡمِزُونَ ٱلۡمُطَّوِّعِينَ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ فِي ٱلصَّدَقَٰتِ وَٱلَّذِينَ لَا يَجِدُونَ إِلَّا جُهۡدَهُمۡ فَيَسۡخَرُونَ مِنۡهُمۡ سَخِرَ ٱللَّهُ مِنۡهُمۡ وَلَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمٌ ٧٩ ﴾ [التوبة: ٧٩]
‘মুমিনদের মধ্যে যারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সদকা দেয় এবং যারা নিজ শ্রম ছাড়া কিছুই পায় না, তাদেরকে যারা দোষারোপ করে। অতঃপর তারা তাদের নিয়ে উপহাস করে, আল্লাহ্ তাদেরকে নিয়ে উপহাস করেন; আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ {সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ৭৯}
অর্থাৎ যারা অধিক ইবাদত করতে তাদেরকে মুনাফিকরা রিয়াকারী বা প্রদর্শনকারী বলত। আর যারা অক্ষম ছিল তাদেরকে শৈথিল্যকারী বলে দোষ দিত।
ঘৃণা ও তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে মুমিনদের ডাকে সাড়া দেওয়া থেকে বিরত থাকা। যেমন,
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَإِذَا قِيلَ لَهُمۡ تَعَالَوۡاْ يَسۡتَغۡفِرۡ لَكُمۡ رَسُولُ ٱللَّهِ لَوَّوۡاْ رُءُوسَهُمۡ وَرَأَيۡتَهُمۡ يَصُدُّونَ وَهُم مُّسۡتَكۡبِرُونَ ٥ ﴾ [المنافقون: ٥]
‘যখন তাদের বলা হয় তোমরা এসো! আল্লাহর রাসূল তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন, তখন তারা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আর আপনি তাদের দেখবেন তারা দম্ভভরে ফিরে যায়।’ {সূরা আল-মুনাফিকূন, আয়াত: ৫}
সালাতকে ভারী মনে করা ও তা থেকে অলসতা। যেমন,
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ إِنَّ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ يُخَٰدِعُونَ ٱللَّهَ وَهُوَ خَٰدِعُهُمۡ وَإِذَا قَامُوٓاْ إِلَى ٱلصَّلَوٰةِ قَامُواْ كُسَالَىٰ يُرَآءُونَ ٱلنَّاسَ وَلَا يَذۡكُرُونَ ٱللَّهَ إِلَّا قَلِيلٗا ١٤٢ ﴾ [النساء: ١٤٢]
‘অবশ্যই মুনাফিকরা প্রতারণা করছে আল্লাহর সঙ্গে। বস্তুত তারা নিজেরা নিজেদের প্রতারিত করে। তারা যখন সালাতে দাঁড়ায় তখন অলসভাবে লোক দেখানোর জন্য দাঁড়ায়; আর তারা আল্লাহকে খুব অল্পই স্মরণ করে।’ {সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৪২}
* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
إِنَّ أَثْقَلَ صَلَاةٍ عَلَى الْمُنَافِقِينَ صَلَاةُ الْعِشَاءِ، وَصَلَاةُ الْفَجْرِ
‘মুনাফিকদের পক্ষে ইশা ও ফজরের সালাত আদায় করা বড় কঠিন।’
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেওয়া এবং যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান এনেছে এমন মুমিনদের কষ্ট দেওয়া।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَمِنۡهُمُ ٱلَّذِينَ يُؤۡذُونَ ٱلنَّبِيَّ﴾ [التوبة: ٦١]
‘আর তাদের মধ্যে এমন লোক আছে, যারা নবীকে কষ্ট দেয়।’ {সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ৬১}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ يُؤۡذُونَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ لَعَنَهُمُ ٱللَّهُ فِي ٱلدُّنۡيَا وَٱلۡأٓخِرَةِ وَأَعَدَّ لَهُمۡ عَذَابٗا مُّهِينٗا ٥٧ وَٱلَّذِينَ يُؤۡذُونَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتِ بِغَيۡرِ مَا ٱكۡتَسَبُواْ فَقَدِ ٱحۡتَمَلُواْ بُهۡتَٰنٗا وَإِثۡمٗا مُّبِينٗا ٥٨ ﴾ [الاحزاب: ٥٧، ٥٨]
‘নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদেরকে ইহকাল ও পরকালে অভিশপ্ত করেন আর তাদের জন্য রেখেছেন অবমাননাকর শাস্তি। আর যারা বিনা অপরাধে মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহণ করে।’ {সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৫৭-৫৮}
এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মুনাফিকের নিদর্শনাবলী আলোচিত হলো, আমরা এগুলো উল্লেখ করেছি; যাতে এগুলো থেকে সাবধান করা যায় এবং এ পথের পথিক হওয়া থেকে নিজের অন্তরকে পবিত্র রাখা যায়।
হে আল্লাহ! আমাদেরকে নিফাক থেকে আপনার কাছে আশ্রয় দিন। আমাদেরকে যেরূপ ঈমান থাকলে আপনি সন্তুষ্ট হোন সেরূপ ঈমান নসীব করুন।
হে সৃষ্টিকুলের রব! আপনি আমাদের, আমাদের পিতা-মাতা এবং সকল মুসলিমকে ক্ষমা করে দিন।
আর আল্লাহ সালাত ও সালাম পেশ করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবার-পরিজন এবং সাহাবীগণের ওপর।
সপ্তবিংশ আসরঃজাহান্নামে প্রবেশের আরো কিছু কারণ
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি আপন ক্ষমতায় সকল সৃষ্টকে সৃষ্টি করেছেন। তাদের মধ্যে নিজ বিস্ময়কর প্রজ্ঞার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তাঁর নিদর্শনাবলি দ্বারা নিজ এককত্বের সপ্রমাণতা তুলে ধরেছেন। অপরাধীর জন্য তাঁর বিরুদ্ধাচারণের শাস্তির ফয়সালা করেছেন। অতঃপর তাওবার আহ্বান জানিয়েছেন এবং তার তাওবা কবুলের মাধ্যমে তার প্রতি বদান্যতা দেখিয়েছেন। অতএব আল্লাহর আহ্বায়কের ডাকে সাড়া দাও এবং তাঁর জান্নাতের প্রতি প্রতিযোগী হও। তিনি তোমাদের পাপসমূহ মার্জনা করবেন এবং তোমাদেরকে নিজ দয়া থেকে দ্বিগুণ অংশ দেবেন।
আমি তাঁর প্রশংসা করি তাঁর মহান গুণাবলির এবং পূর্ণতর বিশেষণসমূহের। আমি তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি তাঁর তাওফীক দান এবং তাঁর পর্যাপ্ত নেয়ামতরাজির জন্য।
আর আমি সাক্ষ্য দেই যে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই; তাঁর ইবাদত কিংবা প্রতিপালনে কোনো শরীক নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দেই যে মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা এবং রাসূল। যিনি নিখিল সৃষ্টির প্রতি প্রেরিত হয়েছেন; মুমিনদের জান্নাতের সুসংবাদদাতা হিসেবে এবং কাফেরদের তাঁর জাহান্নাম ও শাস্তি থেকে সতর্ককারী হিসেবে। আল্লাহ সালাত ও সালাম বর্ষণ করুন তাঁর ওপর, তাঁর উম্মতের মধ্যে তাঁর খলীফা আবূ বকরের ওপর, কাফেরদের প্রতি দৃঢ়তা ও শক্তিমত্ততায় বিখ্যাত উমরের ওপর, নিজ দায়িত্ব পালনে মৃত্যুকে আলিঙ্গনকারী উসমানের ওপর, তাঁর চাচাতো ভাই ও জামাতা আলীর ওপর এবং রাসূলের সকল পরিবার-পরিজন, সাহাবী ও আদর্শের অনুসারীর ওপর।
মুসলিম ভাইগণ! পূর্ব আসরে প্রথম প্রকার জাহান্নামী যারা স্থায়ীভাবে জাহান্নামে প্রবেশ করবে, তাদের কারণসমূহ নিয়ে আলোচনা করেছি।
এ আসরে আল্লাহর তাওফীকে আমরা দ্বিতীয় প্রকার জাহান্নামীদের কয়েকটি কারণ আলোচনা করব।
দ্বিতীয় প্রকার হচ্ছে ঐ সব কারণ, কেউ সেগুলো করলে সাময়িকভাবে জাহান্নামী হয়ে থাকে। তন্মধ্যে:
১ম কারণ: মাতা-পিতার অবাধ্য হওয়া।
অবাধ্য হওয়া অর্থ, তাদের সঙ্গে অপরিহার্য সদ্ব্যবহার ও সুসম্পর্ক বজায় রাখার নির্দেষ লঙ্ঘন করা বা কথা ও কাজের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা। যেমন,
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعۡبُدُوٓاْ إِلَّآ إِيَّاهُ وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ إِحۡسَٰنًاۚ إِمَّا يَبۡلُغَنَّ عِندَكَ ٱلۡكِبَرَ أَحَدُهُمَآ أَوۡ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُل لَّهُمَآ أُفّٖ وَلَا تَنۡهَرۡهُمَا وَقُل لَّهُمَا قَوۡلٗا كَرِيمٗا ٢٣ وَٱخۡفِضۡ لَهُمَا جَنَاحَ ٱلذُّلِّ مِنَ ٱلرَّحۡمَةِ وَقُل رَّبِّ ٱرۡحَمۡهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرٗا ٢٤﴾ [الاسراء: ٢٣، ٢٤]
‘আর আপনার রব আদেশ দিয়েছেন তিনি ছাড়া অন্য কারো ‘ইবাদাত না করতে ও পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তারা একজন বা উভয়ই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকে ‘উফ্’ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না; তাদের সাথে সম্মানসূচক কথা বল। আর মমতাবশে তাদের প্রতি নম্রতার পক্ষপুট অবনমিত কর এবং বল, ‘হে আমার রব! তাঁদের প্রতি দয়া করুন যেভাবে শৈশবে তাঁরা আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন।’ {সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত: ২৩-২৪}
* অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ أَنِ ٱشۡكُرۡ لِي وَلِوَٰلِدَيۡكَ إِلَيَّ ٱلۡمَصِيرُ﴾ [لقمان: ١٤]
‘আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই কাছে ফিরে আসতে হবে।’ {লুকমান: ১৪}
* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
ثَلاَثَةٌ قَدْ حَرَّمَ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى عَلَيْهِمُ الْجَنَّةَ: مُدْمِنُ الْخَمْرِ ، وَالْعَاقُّ لوالديه وَالدَّيُّوثُ الَّذِي يُقِرُّ فِي أَهْلِهِ الْخُبْثَ.
‘তিন ব্যক্তির ওপর আল্লাহ জান্নাত হারাম করেছেন। ১ম: মদ পানে আসক্ত ২য়: পিতা-মাতার নাফরমান সন্তান ও ৩য়: দায়্যুস যে, নিজ পরিবারের অশ্লীলতা সমর্থন করে।’
২য় কারণ: আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা।
এর দ্বারা উদ্দেশ্য, কোনো লোক কর্তৃক তার আত্মীয়দের সাথে সম্পর্কচ্যুতি ঘটানো; ফলে সে তাদেরকে তাদের প্রাপ্য শারিরীক ও আর্থিক অধিকার প্রদান করা থেকে বিরত থাকে।
* সহীহ বুখারী ও মুসলিমে জুবাইর ইবন মুত‘ইম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَاطِعٌ .
(আত্মীয়তার সম্পর্ক) ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ সুফিয়ান রাহেমাহুল্লহ বলেন: ছিন্নকারী অর্থাৎ আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী।
* অনুরূপভাবে বুখারী ও মুসলিমে আরও এসেছে, আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “যখন আল্লাহ তা‘আলা সকল সৃষ্টিকুলকে অস্তিত্বে আনলেন, তখন ‘রাহেম’ তথা আত্মীয়তার সম্পর্ক দাঁড়িয়ে আল্লাহকে বলল,
هَذَا مَقَامُ الْعَائِذِ بِكَ مِنَ الْقَطِيعَةِ قَالَ نَعَمْ أَمَا تَرْضَيْنَ أَنْ أَصِلَ مَنْ وَصَلَكِ وَأَقْطَعَ مَنْ قَطَعَكِ قَالَتْ بَلَى يَا رَبِّ قَالَ فَهْوَ لَكِ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم: فَاقْرَؤُوا إِنْ شِئْتُمْ {فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ}
‘আমাকে বিচ্ছিন্ন করা থেকে আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনার স্থান (সময়) এটা। আল্লাহ বলেন, হ্যাঁ, তবে তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, যে তোমার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখবে আমি তার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখব এবং তোমাকে যে ছিন্ন করবে আমি তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করব? শুনে আত্মীয় বলল, অবশ্যই। তখন আল্লাহ বললেন, তোমার জন্য এরূপই করা হবে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ইচ্ছা করলে তোমরা এ আয়াতটি পড়তে পারো:
﴿ فَهَلۡ عَسَيۡتُمۡ إِن تَوَلَّيۡتُمۡ أَن تُفۡسِدُواْ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَتُقَطِّعُوٓاْ أَرۡحَامَكُمۡ ٢٢ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ لَعَنَهُمُ ٱللَّهُ فَأَصَمَّهُمۡ وَأَعۡمَىٰٓ أَبۡصَٰرَهُمۡ ٢٣ ﴾ [محمد: ٢٢، ٢٣]
‘ক্ষমতা লাভ করলে সম্ভবত তোমরা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। এদের প্রতিই আল্লাহ অভিসম্পাত করেন, অতঃপর তাদের বধির ও দৃষ্টি শক্তিহীন করেন।’ {সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ২২-২৩}
আফসোসের বিষয়, কোনো কোনো মুসলিম আজ পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের অধিকার সম্পর্কে একেবারেই গাফেল। তারা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে মিলনের সেতুবন্ধনকে ছিন্ন করে চলছে।
তাদের কারও কারও বক্তব্য হচ্ছে, আত্মীয়রাই সম্পর্ক বজায় রাখছেন না। কিন্তু এ বক্তব্য তাদের কোনো উপকারে আসবে না। কারণ, যে সম্পর্ক ঠিক রাখবে, শুধু তার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে-এ যদি নীতি হয়, তাহলে তা আল্লাহর জন্য হলো না; বরং বদলা স্বরূপ। যেমন,
* ‘আব্দুল্লাহ ইবন ‘আমর ইবন ‘আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
لَيْسَ الْوَاصِلُ بِالْمُكَافِئِ وَلَكِنِ الْوَاصِلُ الَّذِي إِذَا قَطَعَتْ رَحِمُهُ وَصَلَهَا.
‘সে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপনকারী বলে গণ্য হবে না যে শুধু বদলাস্বরূপ সম্পর্ক বজায় রাখে; বরং সেই সম্পর্ক স্থাপনকারী যে তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলেও জুড়ে দেয়।’
* অনুরূপভাবে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল:
يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ لِى قَرَابَةً أَصِلُهُمْ وَيَقْطَعُونِى وَأُحْسِنُ إِلَيْهِمْ وَيُسِيئُونَ إِلَىَّ وَأَحْلُمُ عَنْهُمْ وَيَجْهَلُونَ عَلَىَّ. فَقَالَ لَئِنْ كُنْتَ كَمَا قُلْتَ فَكَأَنَّمَا تُسِفُّهُمُ الْمَلَّ وَلاَ يَزَالُ مَعَكَ مِنَ اللَّهِ ظَهِيرٌ عَلَيْهِمْ مَا دُمْتَ عَلَى ذَلِكَ .
‘আমার কিছু আত্মীয় এমন তাদের সঙ্গে সম্পর্ক যতই জুড়ি, ততই তারা ছিন্ন করে, যতই সৎ ব্যবহার করি, তারা দুর্ব্যবহার করে, সহনশীলতা অবলম্বন করলেও তারা বুঝতে চায় না; তারা আমার সাথে মূর্খের আচরণ করে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যদি ব্যাপার এমনই হয়, যেমন তুমি বললে, তাহলে তুমি যেন তাদের প্রতি গরম বালু নিক্ষেপ করলে, (যেন তুমি তাদেরকে তা-ই খাইয়েছ) আর তুমি যেভাবে তাদের সঙ্গে ব্যবহার করে চলছ, তা যদি অব্যাহত রাখতে পার, তাহলে আল্লাহ সর্বদা তোমার সাহায্যকারী থাকবেন।’
বান্দা যখন সম্পর্ক ছিন্ন করা সত্ত্বেও তার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করবে, তখন তার পরিণাম প্রশংসনীয় হবে এবং শীঘ্রই এমন ফল হবে যে, তারা নিজেরাই এসে সম্পর্ক স্থাপন করবে; যেমনটি সে সম্পর্ক তৈরী করেছে; যদি আল্লাহ তাদের কল্যাণ চান।
৩য় কারণ: সুদ খাওয়া।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَأۡكُلُواْ ٱلرِّبَوٰٓاْ أَضۡعَٰفٗا مُّضَٰعَفَةٗۖ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ ١٣٠ وَٱتَّقُواْ ٱلنَّارَ ٱلَّتِيٓ أُعِدَّتۡ لِلۡكَٰفِرِينَ ١٣١ وَأَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَٱلرَّسُولَ لَعَلَّكُمۡ تُرۡحَمُونَ ١٣٢ ﴾ [ال عمران: ١٣٠، ١٣٢]
‘হে মুমিনগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেও না আর আল্লাহকে ভয় করতে থাক, যাতে তোমরা কল্যাণ অর্জন করতে পার। তোমরা সে আগুনকে ভয় কর, যা কাফেরদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহ ও রাসূলের, যাতে তোমাদের ওপর রহম করা হয়।’ {সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩০-১৩২}
আল্লাহর পক্ষ হতে উপদেশ ও সতর্কপাণী পৌঁছার পরও যে সুদে লিপ্ত, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য স্থায়ী জাহান্নামের ধমক দিচ্ছেন।
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ ٱلَّذِينَ يَأۡكُلُونَ ٱلرِّبَوٰاْ لَا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ ٱلَّذِي يَتَخَبَّطُهُ ٱلشَّيۡطَٰنُ مِنَ ٱلۡمَسِّۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمۡ قَالُوٓاْ إِنَّمَا ٱلۡبَيۡعُ مِثۡلُ ٱلرِّبَوٰاْۗ وَأَحَلَّ ٱللَّهُ ٱلۡبَيۡعَ وَحَرَّمَ ٱلرِّبَوٰاْۚ فَمَن جَآءَهُۥ مَوۡعِظَةٞ مِّن رَّبِّهِۦ فَٱنتَهَىٰ فَلَهُۥ مَا سَلَفَ وَأَمۡرُهُۥٓ إِلَى ٱللَّهِۖ وَمَنۡ عَادَ فَأُوْلَٰٓئِكَ أَصۡحَٰبُ ٱلنَّارِۖ هُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٢٧٥ ﴾ [البقرة: ٢٧٥]
‘যারা সুদ খায় তারা কিয়ামতের দিন দণ্ডায়মান হবে ওই ব্যক্তির ন্যায় যাকে শয়তান আছর করে মোহাবিষ্ট করেছে। তাদের এ অবস্থার কারণ হলো: তারা বলেছে, ক্রয়-বিক্রয় তো সুদের মতই। অথচ আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয় বৈধ করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতঃপর যার কাছে তার রবের পক্ষ থেকে উপদেশ এসেছে এবং সে বিরত রয়েছে, তাহলে পূর্বে যা হয়ে গেছে, তা (মূলধন) তারই থাকবে, আর তার ব্যাপারটি আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল। আর যারা পুনরায় সুদ গ্রহণ করে, তারাই জাহান্নামে যাবে। তারা সেখানে স্থায়ী হবে।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৭৫}
৪র্থ কারণ: ইয়াতীমের সম্পদ ভক্ষণ করা।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ يَأۡكُلُونَ أَمۡوَٰلَ ٱلۡيَتَٰمَىٰ ظُلۡمًا إِنَّمَا يَأۡكُلُونَ فِي بُطُونِهِمۡ نَارٗاۖ وَسَيَصۡلَوۡنَ سَعِيرٗا ١٠ ﴾ [النساء: ١٠]
‘নিশ্চয় যারা ইয়াতীমের মাল অন্যায়ভাবে ভক্ষণ (গ্রাস) করে তারা নিজেদের পেট আগুন দিয়ে ভর্তি করে, অচিরেই তারা প্রজ্জলিত আগুনে প্রবেশ করবে।’ {সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১০}
ইয়াতীম: প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পূর্বে যার পিতা মৃত্যুবরণ করেছে তাকে শরীয়তের পরিভাষায় ইয়াতীম বলা হয়।
৫ম কারণ: মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করা।
* আব্দুল্লাহ ইবন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
لَنْ تَزُولَ قَدَمُ شَاهِدِ الزُّورِ حَتَّى يُوجِبَ اللَّهُ لَهُ النَّارَ.
‘মিথ্যা সাক্ষ্যদাতার পা স্বস্থান হতে ততক্ষণ পর্যন্ত নড়বে না যতক্ষণ না আল্লাহ তার জন্য জাহান্নামের আগুন অবধারিত করবেন।’
মিথ্যা সাক্ষ্য বলা হয়, অজানা বা বাস্তবের বিপরীত সাক্ষ্য প্রদান করাকে। কারণ সাক্ষ্যদাতার জন্য জানা বিষয় ছাড়া অন্য কিছুর সাক্ষ্য প্রদান বৈধ নয়।
* হাদীসে রয়েছে:
‘জনৈক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করা হলো, তুমি কি সূর্য দেখেছ? সে বলল হ্যাঁ, তখন তিনি তাকে বললেন, এ ধরনের বিষয়ে সাক্ষ্য দেবে; নতুবা বিরত থাকবে।’
৬ষ্ঠ কারণ: বিচার-ফয়সালায় ঘুষ।
* ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘আমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
الرَّاشِي وَالْمُرْتَشِي فِي النَّارِ.
‘ঘুষদাতা ও ঘুষগ্রহীতা উভয়ে জাহান্নামে যাবে।’
হাদীসটি তাবারানী বর্ণনা করছেন। তার বর্ণনাকারীরা সবাই গ্রহণযোগ্য ও প্রসিদ্ধ। যেমটি তারগীব ওয়াত তারহীবে এসেছে।
নিহায়া গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘হাদীসে বর্ণিত ‘রা-শী’ অর্থ ঘুষদাতা আর ‘মুরতাশী’ অর্থ ঘুষগ্রহীতা।
তবে ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তি বা জুলুম থেকে রক্ষার জন্য বাধ্য হয়ে কিছু প্রদান করতে হলে, তা এর অন্তর্ভুক্ত হবে না।’
৭ম কারণ: মিথ্যা শপথ করা।
* হারেস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হজে (মিনার পাথর মারার স্থান) দু’জামরার মধ্যবর্তী স্থানে বলতে শুনেছি,
مَنِ اقْتَطَعَ مَالَ أَخِيهِ الْمُسْلِمِ بِيَمِينٍ فَاجِرَةٍ فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ ، لِيُبَلِّغْ شَاهِدُكُمْ غَائِبَكُمْ مَرَّتَيْنِ أَوْ ثَلاَثًا.
‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের সম্পদ মিথ্যা শপথের দ্বারা ছিনিয়ে নেয়, সে যেন জাহান্নামে তার স্থান করে নেয়। কথাটি উপস্থিত সকলেই তোমাদের অনুপস্থিতদের বলে দেবে। এভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওই বাণীটি দু’বার অথবা তিনবার বলেছেন।’
আর শপথকে ‘গামূস’ বলার কারণ হচ্ছে, যে ব্যক্তি এ ধরনের শপথ করবে তাকে তা গুনাহে ডুবিয়ে দেয়, তারপর তাকে জাহান্নামে ডুবায়।
মিথ্যা শপথ করে কোনো দাবীকৃত বস্তুর ফয়সালা নিজের পক্ষে নিয়ে আসা, অথবা মিথ্যা শপথ করে অস্বীকারকৃত বস্তু থেকে তার দায়মুক্তির ঘোষণা আদায় করা উভয়টিই গুনাহের দিক থেকে কোনো পার্থক্য নেই।
৮ম কারণ: মানুষের মধ্যে না জেনে বিচার করা অথবা যুলুম ও পক্ষপাতিত্ব করে বিচার করা।
* বুরাইদা ইবনুল হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
الْقُضَاةُ ثَلاَثَةٌ وَاحِدٌ فِى الْجَنَّةِ وَاثْنَانِ فِى النَّارِ فَأَمَّا الَّذِى فِى الْجَنَّةِ فَرَجُلٌ عَرَفَ الْحَقَّ فَقَضَى بِهِ وَرَجُلٌ عَرَفَ الْحَقَّ فَجَارَ فِى الْحُكْمِ فَهُوَ فِى النَّارِ وَرَجُلٌ قَضَى لِلنَّاسِ عَلَى جَهْلٍ فَهُوَ فِى النَّارِ .
‘বিচারক তিন প্রকার। এক প্রকার জান্নাতে যাবে এবং দুই প্রকার যাবে জাহান্নামে। যে জান্নাতে যাবে সে হলো, যে বিচারক সত্য উদ্ঘাটন করে এবং তদনুযায়ী ন্যায়বিচার করে। আর যে ব্যক্তি সত্য জেনেও অন্যায় বিচার করে সে জাহান্নামী। আরেকজন মানুষের বিচার করে না জেনেই, সেও আগুনে যাবে।’
৯ম কারণ: প্রজাদের ধোঁকা দেয়া এবং তাদের কল্যাণ কামনা না করা।
অর্থাৎ এমনভাবে রাষ্ট্র বা বিচারকার্য পরিচালনা করা, যাতে জনসাধারণের কল্যাণের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয় না এবং কাজটিও অনুপকারী হয়। কারণ,
* মা‘কাল ইবন ইয়াসার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:
مَا مِنْ عَبْدٍ يَسْتَرْعِيهِ اللَّهُ رَعِيَّةً يَمُوتُ يَوْمَ يَمُوتُ وَهُوَ غَاشٌّ لِرَعِيَّتِهِ إِلاَّ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ .
‘যাকে আল্লাহ জনগণের শাসক হিসেবে নিযুক্ত করেছেন, যদি প্রজাদের ধোঁকা দেয়া অবস্থায় তার মৃত্যু হয়, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন।’
এ হাদীসটি ব্যাপক অর্থবোধক। এটা গৃহকর্তা কর্তৃক তার পরিবার পরিচালনা এবং শাসক কর্তৃক তার রাষ্ট্র পরিচালনাকেও অন্তর্ভুক্ত করে। কারণ,
* ইবন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি,
أَلاَ كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، فَالإِمَامُ الَّذِي عَلَى النَّاسِ رَاعٍ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالرَّجُلُ رَاعٍ عَلَى أَهْلِ بَيْتِهِ، وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلَى أَهْلِ بَيْتِ زَوْجِهَا، وَوَلَدِهِ وَهِيَ مَسْئُولَةٌ عَنْهُمْ، وَعَبْدُ الرَّجُلِ رَاعٍ عَلَى مَالِ سَيِّدِهِ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْهُ، أَلاَ فَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ
‘মনে রেখো তোমরা প্রত্যেকেই অভিভাবক, তোমাদের প্রত্যেককে আপন আপন দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হতে হবে, শাসক রক্ষক, অতএব তাকে তার প্রজা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে, গৃহকর্তা তার পরিবারের অভিভাবক, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে, স্ত্রী তার স্বামীর সংসারের দায়িত্বশীল, অতএব তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে যথাযথ হিসাব দিতে হবে, খাদেম তার মনিবের সম্পদের হিফাযতকারী, কাজেই সেও তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে, অতএব তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, সকলকে নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হতে হবে।’
১০ম কারণ: প্রাণীর মূর্তি তৈরি করা।
অর্থাৎ যে সকল সৃষ্টির প্রাণ তথা রূহ আছে, যেমন-মানুষ, জীব-জন্তু উত্যাদি। এ সকল প্রাণীর মূর্তি তৈরি বা চিত্রাঙ্কন করা। কারণ,
* ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:
كُلُّ مُصَوِّرٍ فِي النَّارِ، يَجْعَلُ لَهُ، بِكُلِّ صُورَةٍ صَوَّرَهَا، نَفْسًا فَتُعَذِّبُهُ فِي جَهَنَّمَ
‘প্রত্যেক অঙ্কনকারী জাহান্নামী, তার তৈরিকৃত বা অঙ্কিত প্রত্যেকটির আত্মা তার দেহে প্রবিষ্ট করে তাকে জাহান্নামে শাস্তি দেয়া হবে।’
* বুখারীর অন্য বর্ণনায় এসেছে:
مَنْ صَوَّرَ صُورَةً، فَإِنَّ اللَّهَ مُعَذِّبُهُ حَتَّى يَنْفُخَ فِيهَا الرُّوحَ، وَلَيْسَ بِنَافِخٍ فِيهَا أَبَدًا
‘যে ব্যক্তি কোনো চিত্রাঙ্কন বা মূর্তি তৈরি করবে, অবশ্যই আল্লাহ তাকে ততক্ষণ শাস্তি প্রদান করতে থাকবেন, যতক্ষণ সে মুর্তি বা চিত্রে আত্মা সঞ্চার না করবে। অথচ সে কখনও তাতে আত্মা সঞ্চারে সক্ষম হবে না।’
তবে ফল, বৃক্ষ, লতা-পাতা উদ্ভিদ ইত্যাদি যার বাড়ন্ত শরীর আছে কিন্তু প্রাণ নেই, এ ধরনের সৃষ্টির চিত্র আঁকতে কোনো অসুবিধা নেই। অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম এ মত পোষণ করেন।
* অবশ্য কিছু সংখ্যক আলেম সহীহ বুখারীর হাদীসের ব্যাপকতার কারণে তাও নিষেধ করেছেন। হাদীসটি আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ ذَهَبَ يَخْلُقُ كَخَلْقِي، فَلْيَخْلُقُوا ذَرَّةً أَوْ لِيَخْلُقُوا حَبَّةً أَوْ شَعِيرَةً
‘তার চেয়ে বড় জালেম আর কে হতে পারে যে আমার সৃষ্টির অনুরূপ কিছু সৃষ্টি করতে চায়। সে একটি যব বা শষ্যদানা বা বিন্দু পরিমাণ একটা কিছু সৃষ্টি করে দেখায় না কেন?’
১১তম কারণ: কঠোরত, কৃপণতা ও অহঙ্কার।
* হারেস ইবন ওয়াহাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ النَّارِ؟ كُلُّ عُتُلٍّ جَوَّاظٍ مُسْتَكْبِرٍ
‘আমি কি তোমাদের জাহান্নামীদের সম্পর্কে সংবাদ দেব না? তারা হচ্ছে প্রত্যেক কঠোরতাকারী, সম্পদ সঞ্চয়কারী কৃপণ ও অহংকারী।’
(উতুল্ল) বলা হয় অত্যধিক কঠিন ব্যক্তি, যার হৃদয় সত্য গ্রহণ বা মানুষের জন্য বিগলিত হয় না।
(জাওয়ায) বলা, হয়, লোভী ও কৃপণকে। অর্থাৎ সে সম্পদ গচ্ছিত ও সঞ্চয়কারী এবং সম্পদ বিতরণে বাধা প্রদানকারী।
(মুস্তাকবির) যে অহঙ্কারবশত সত্যকে উপেক্ষা করে এবং মানুষের জন্য বিনম্র হয় না, যে নিজেকে মানুষ থেকে উঁচু ও বড় মনে করে এবং তার মতকে বাস্তবের বিপরীত হলেও সঠিক মনে করে।
১২ তম কারণ: পানাহারের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে স্বর্ণ-রৌপ্যে পাত্র ব্যবহার করা।
* বুখারী ও মুসলিমে উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা সূত্রে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
الَّذِي يَشْرَبُ فِي إِنَاءِ الفِضَّةِ إِنَّمَا يُجَرْجِرُ فِي بَطْنِهِ نَارَ جَهَنَّمَ
‘যে ব্যক্তি রূপার পাত্রে পান করে, মূলত সে নিজ পেটে আগুন ভর্তি করে।’
মুসলিমের অপর বর্ণনায় এসেছে:
إِنَّ الَّذِي يَأْكُلُ أَوْ يَشْرَبُ فِي آنِيَةِ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ، فَإِنَّمَا يُجَرْجِرُ فِي بَطْنِهِ نَارَ جَهَنَّمَ.
‘যে স্বর্ণ-রূপার পাত্রে খায় বা পান করে, সে মূলত স্বীয় পেটে জাহান্নামের আগুনই ভরে।’
* ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনৈক ব্যক্তির হাতে স্বর্ণের আংটি দেখে তা খুলে নিক্ষেপ করে বললেন:
يَعْمِدُ أَحَدُكُمْ إِلَى جَمْرَةٍ مِنْ نَارٍ فَيَجْعَلُهَا فِي يَدِهِ
‘তোমাদের কেউ কি করে আগুনের অঙ্গারের ইচ্ছা করে সেটাকে হাতে রেখে দেয়? রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম চলে গেলে তাকে বলা হলো, তোমার আংটিটি গ্রহণ কর এবং এর দ্বারা উপকৃত হও। তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ! কখনো নয়, আমি সেটা নেবো না, কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা ফেলে দিয়েছেন।’
সুতরাং ভাইয়েরা আমার! আপনারা জাহান্নামে প্রবেশের কারণসমূহ থেকে সাবধান হোন এবং এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করুন যা আপনাদেরকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে। এর ফলে স্থায়ী জান্নাত পেয়ে ধন্য হবেন। আর জেনে রাখুন! দুনিয়া তুচ্ছ বস্তু মাত্র, যা দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত।
কাজেই স্বীয় রবের দরবারে আজীবন সত্যের ওপর অটল থাকার প্রার্থনা করুন। আরও প্রার্থনা করুন তিনি যেন আপনাদেরকে এমন মুমিন পুরুষ ও নারীদের সাথে হাশর করান যাদের উপর আল্লাহ তার নেয়ামত প্রদান করেছেন।
হে আল্লাহ! নিজ দয়ায় আমাদেরকে হকের ওপর অটল রাখুন এবং তার ওপর মৃত্যু দান করুন। আর আমাদেরকে, আমাদের পিতা-মাতা ও সকল মুসলিমকে ক্ষমা করুন। হে শ্রেষ্ঠ দয়ালু!
আর আল্লাহ আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবার-পরিজন এবং তাঁর সকল সাহাবীর প্রতি সালাত পেশ করুন।
অষ্টাবিংশ আসরঃ যাকাতুল ফিতর
সকল প্রশংসা মহাজ্ঞানী, মহাপ্রজ্ঞাবান, সর্বোচ্চ, মহান আল্লাহর জন্য। তিনি তিনি সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তা নিপুণভাবে নিরূপণ করেছেন। তিনি তাঁর শরীয়তের বিধানাবলিকে আপন প্রজ্ঞানুযায়ী সুদৃঢ় করেছেন সৃষ্টির জন্য সুস্পষ্ট ও শিক্ষা হিসেবে। আমি তাঁর প্রশংসা করি তাঁর পূর্ণাঙ্গ গুণাবলির উপর। আমি তাঁর শুকরিয়া আদায় করি তাঁর পরিপূর্ণ নেয়ামতসমূহের উপর।
আর আমি সাক্ষ্য দেই যে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই; তাঁর কোনো শরীক নেই। রাজত্ব তাঁর এবং প্রশংসাও তাঁর। তিনি সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান। আমি আরও সাক্ষ্য দেই যে মুহাম্মদ তাঁর বান্দা এবং সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রাসূল। আল্লাহ সালাত ও সালাম বর্ষণ করুন তাঁর ওপর, তাঁর পরিবার-পরিজন, সাহাবীবৃন্দ এবং সবার প্রত্যাবর্তন ও ফিরে যাওয়ার দিন পর্যন্ত সুন্দরভাবে তাঁদের আদর্শের সকল অনুসারীর ওপর।
ভাইয়েরা আমার! সম্মানিত মাস রমযান গত হতে চলেছে, তার সামান্য অংশই বাকী আছে; সুতরাং যে ব্যক্তি এটা যথাযথ মূল্যায়নের সাথে অতিবাহিত করেছে সে যেন আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করে অতঃপর এটা কবুল হওয়ার জন্য আল্লাহ তা‘আলার নিকট প্রার্থনা করে। আর যে এটা অলসতায় অতিবাহিত করেছে, সে যেন আল্লাহর নিকট তওবা করে এবং নিজ ত্রুটি বিচ্যুতির জন্য আল্লাহর তাআলার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে, কারণ মৃত্যুর পূর্বে ওযর পেশ করা গ্রহণযোগ্য হবে।
ভাইয়েরা আমার! নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা এই মাসের শেষে আপনাদের উপর যাকাতুল ফিতর ফরয করেছেন; আর এটা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন ঈদের নামাযের পূর্বেই।
আজকের মজলিসে এ যাকাতুল ফিতর বিষয়ে কথা বলব। এর বিধান, হেকমত, শ্রেণী, পরিমাণ, ওয়াজিব হওয়ার সময়, প্রদানের সময় ও স্থান সম্পর্কে আলোচনা করব।
যাকাতুল ফিতরের বিধান বা হুকুম:
যাকাতুল ফিতর প্রদান করা ফরয। এটাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল মুসলিমের উপর অপরিহার্য বলে ঘোষণা করেছেন। আল্লাহর রাসূল যা ফরয করেছেন অথবা করতে নির্দেশ প্রদান করেছেন সেগুলোও যা আল্লাহ ফরয করেছেন ও নির্দেশ দিয়েছেন তার হুকুম রাখে। অর্থাৎ তা মানাও অবশ্যম্ভাবী।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ مَّن يُطِعِ ٱلرَّسُولَ فَقَدۡ أَطَاعَ ٱللَّهَۖ وَمَن تَوَلَّىٰ فَمَآ أَرۡسَلۡنَٰكَ عَلَيۡهِمۡ حَفِيظٗا ٨٠ ﴾ [النساء: ٨٠]
‘যে রাসূলের হুকুম মান্য করল, সে আল্লাহর হুকুমই মান্য করল। আর যে তা থেকে বিমুখতা অবলম্বন করল, আমি আপনাকে তাদের জন্য পর্যবেক্ষণকারী নিযুক্ত করে পাঠাই নি।’ {সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৮০}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ وَمَن يُشَاقِقِ ٱلرَّسُولَ مِنۢ بَعۡدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ ٱلۡهُدَىٰ وَيَتَّبِعۡ غَيۡرَ سَبِيلِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ نُوَلِّهِۦ مَا تَوَلَّىٰ وَنُصۡلِهِۦ جَهَنَّمَۖ وَسَآءَتۡ مَصِيرًا ١١٥ ﴾ [النساء: ١١٥]
‘যে কেউ রাসূলের বিরুদ্ধাচারণ করে, তার কাছে সরল পথ প্রকাশিত হওয়ার পর এবং মুমিনদের অনুসৃত পথের বিরুদ্ধে চলে, আমি তাকে ওই দিকে ফিরাবো যে সে ফিরতে চায় এবং আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। তা নিকৃষ্টতম গন্তব্যস্থল।’ {সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১১৫}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَىٰكُمۡ عَنۡهُ فَٱنتَهُواْۚ﴾ [الحشر: ٧]
‘আর রাসূল তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক।’ {সূরা আল-হাশর, আয়াত: ৭}
আর যাকাতুল ফিতর মুসলিম নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, স্বাধীন-কৃতদাস সকলের ওপর ফরয।
* আব্দুল্লাহ ইবন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
فَرَضَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ زَكَاةَ الفِطْرِ صَاعًا مِنْ تَمْرٍ، أَوْ صَاعًا مِنْ شَعِيرٍ عَلَى العَبْدِ وَالحُرِّ، وَالذَّكَرِ وَالأُنْثَى، وَالصَّغِيرِ وَالكَبِيرِ مِنَ المُسْلِمِينَ
‘রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান মাসে স্বাধীন, গোলাম, নারী, পুরুষ, ছোট-বড় সকল মুসলিমের ওপর এক সা‘ খেজুর, বা এক সা‘ যব যাকাতুল ফিতর ফরয করেছেন।’
* পেটের বাচ্চার পক্ষ থেকে যাকাতুল ফিতর দেয়া ওয়াজিব নয়, কিন্তু কেউ যদি আদায় করে, তাহলে কোনো সমস্যা নেই। কারণ,
* ‘উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু পেটের বাচ্চার পক্ষ হতে ফিতরা আদায় করতেন।
ফিতরা নিজের পক্ষ থেকে এবং যাদের ভরণ-পোষণ তার দায়িত্বে রয়েছে যেমন-স্ত্রী ও এমন নিকটাত্মীয় যাদের নিজেদের ফিতরা নিজেদের দেওয়ার সামর্থ নেই সন্তান তাদের পক্ষ থেকেও আদায় করা আবশ্যক। আর যদি তারা নিজেদের ফিতরা নিজেরা দেওয়ার সামর্থ রাখে তবে নিজেদের যাকাতুল ফিতর নিজেরাই আদায় করা উত্তম। কারণ ওয়াজিব হওয়ার সম্বোধন তাদেরকেই মৌলিকভাবে করা হয়েছে।
আর যাকাতুল ফিতর কেবল তাদের উপরই আবশ্যক যার ঈদের দিন ও রাত্রের খরচ সম্পাদনের পর অতিরিক্ত সম্পদ থাকবে। যদি এক সা‘ এর চেয়ে কম পরিমাণ সম্পদও কারও অতিরিক্ত থাকে তবে তাকে তা-ই যাকাতুল ফিতর হিসেবে প্রদান করতে হবে। কারণ,
* আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :
﴿ فَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ مَا ٱسۡتَطَعۡتُمۡ ﴾ [التغابن: ١٦]
‘তোমরা সাধ্য অনুপাতে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর।’ {সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত: ১৬}
* অনুরূপ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
َإِذَا أَمَرْتُكُمْ بِأَمْرٍ فَأْتُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ
‘আমি যখন তোমাদের কোনো বিষয়ে আদেশ করি, তোমরা তখন তা সাধ্যানুযায়ী পালন করো।’
যাকাতুল ফিতর প্রবর্তনের হিকমত বা রহস্য:
বস্তুত: যাকাতুল ফিতরের হিকমত অত্যন্ত স্পষ্ট। কারণ:
এর দ্বারা দরিদ্র ব্যক্তির প্রতি সদয় ব্যবহার করা হয়; যাতে তারা ঈদের দিনে ভিক্ষা করা থেকে বিরত থেকে ঈদের দিনগুলোতে ধনীদের সাথে ঈদের আনন্দে শরীক হতে পারে; ফলে ঈদ হবে সার্বজনীন। তাছাড়া এর মধ্যে বদান্যতা ও সহমর্মিতার মত মহৎ চরিত্র দ্বারা গুণান্বিত হওয়া যায়। চওয়ার প্রয়োজন না হয়
সিয়াম পালনকারীর সিয়ামে যে শৈথিল্য বা ত্রুটি-বিচ্যুতি ব গুনাহ হয়ে থাকে, এর মাধ্যমে সিয়াম পালনকারীকে তা থেকে পবিত্র করা যায়।
যাকাতুল ফিতর আদায়ের দ্বারা আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা হয়। তিনি নিজ দয়ায় বান্দাকে পূর্ণ একমাস সিয়াম পালনের তাওফীক দিয়েছেন, সঙ্গে সঙ্গে কিয়ামেরও সুযোগ দিয়েছেন এবং এর মধ্যে যতটুকু সম্ভব কিছু সৎ কাজেরও সুযোগ দিয়েছেন।
* আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন,
فَرَضَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ زَكَاةَ الْفِطْرِ طُهْرَةً لِلصَّائِمِ مِنَ اللَّغْوِ وَالرَّفَثِ، وَطُعْمَةً لِلْمَسَاكِينِ، مَنْ أَدَّاهَا قَبْلَ الصَّلَاةِ، فَهِيَ زَكَاةٌ مَقْبُولَةٌ، وَمَنْ أَدَّاهَا بَعْدَ الصَّلَاةِ، فَهِيَ صَدَقَةٌ مِنَ الصَّدَقَاتِ
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাকাতুল ফিতর ফরয করেছেন অনর্থক ও অশ্লীল কথা-বার্তা দ্বারা সিয়ামের যে ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছে তা থেকে পবিত্র করা এবং মিসকীনদের খাদ্য প্রদানের জন্য। ঈদের সালাতের পূর্বে আদায় করলে তা যাকাতুল ফিতর হিসাবে গণ্য হবে। আর ঈদের সালাতের পর আদায় করলে তা অন্যান্য সাধারণ দানের মত একটি দান হবে।’
যাকাতুল ফিতরের শ্রেণী বিভাগ:
মানুষের সাধারণ খাদ্য জাতীয় বস্তু; যেমন-খেজুর, আটা, চাল, কিসমিস, পনির ইত্যাদি। অথবা এর বাইরে সাধারণত যা মানুষের খাদ্য হিসেবে পরিগণিত তাও দেওয়া যাবে।
* বুখারী ও মুসলিমে ইবন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
فَرَضَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ زَكَاةَ الفِطْرِ صَاعًا مِنْ تَمْرٍ، أَوْ صَاعًا مِنْ شَعِيرٍ
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাকাতুল ফিতর ফরয করেছেন, খেজুর অথবা যব থেকে এক সা‘ পরিমাণ।’
আর ওই যুগে তাদের খাদ্য ছিলো যব।’ যেমন,
* আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كُنَّا نُخْرِجُ فِي عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ الفِطْرِ صَاعًا مِنْ طَعَامٍ، وَقَالَ أَبُو سَعِيدٍ: وَكَانَ طَعَامَنَا الشَّعِيرُ وَالزَّبِيبُ وَالأَقِطُ وَالتَّمْرُ
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জামানায় আমরা যাকাতুল ফিতর আদায় করতাম এক সা‘ খাদ্য দ্বারা। তখন আমাদের খাদ্য ছিল যব, কিসমিস, পনির এবং খেজুর।’
অতএব, পশুর খাদ্য দ্বারা যাকাতুল ফিতর আদায় করলে, আদায় হবে না। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিসকীনদের খাদ্যদ্রব্য হিসেবে যাকাতুল ফিতর ফরয করেছেন জীব-জন্তুর খাদ্য হিসেবে নয়।
তাছাড়া কাপড়, বিছানা-কার্পেট, পানপাত্র, খাদ্য-রসদ ইত্যাদি যা মানুষের খাদ্য বলে বিবেচিত নয় তা দ্বারা দিলে তাও গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাদ্য দ্বারা দেওয়া ফরয করেছেন সুতরাং রাসূল যেটা নির্ধারণ করেছেন সেটা অতিক্রম করা যাবে না।
অনুরূপ খাদ্যের মূল্য পরিশোধের মাধ্যমেও আদায় করা যাবে না। কারণ,
– তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ আদেশের বিপরীত। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সাব্যস্ত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন:
مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ
‘যে ব্যক্তি এমন কোনো আমল করল, যে ব্যাপারে আমাদের কোনো আদেশ নেই, তা অগ্রহণযোগ্য।’ অপর বর্ণনায় এসেছে:
مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيهِ، فَهُوَ رَدٌّ
‘যে আমাদের এ দ্বীনে এমন কিছু আবিষ্কার করবে, যা এর অন্তর্ভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত হবে।’ এটি ইমাম মুসলিম সংকলন করেছেন। তবে এর মূল কথা বুখারী-মুসলিম উভয়টিতেই রয়েছে।’
– তাছাড়া খাদ্যমূল্য প্রদান সাহাবীগণের আমলের পরিপন্থী। কারণ, তারা খাদ্যজাতীয় বস্তু দ্বারাই যাকাতুল ফিতর আদায় করতেন।
* আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
عَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ المَهْدِيِّينَ من بعدي
‘তোমরা অপরিহার্যভাবে আমার সুন্নাতকে আকড়ে ধরো এবং আমার পরবর্তীতে সঠিক পথে পরিচালিত ও হিদায়াতের ওপর প্রতিষ্ঠিত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত বা আদর্শ অনুসরণ করে চলো।’
– তাছাড়া যাকাতুল ফিতর সুনির্দিষ্ট প্রকার নির্ধারণ করে-দেওয়া ইবাদত। বিধায় তা সুনির্দিষ্ট বস্তুর বাইরে অন্য কিছু দ্বারা আদায় করলে গ্রহণযোগ্য হবে না। যেমনিভাবে সুনির্দিষ্ট সময়ের পরে বের করলে তা যথেষ্ট হয় না।
– তাছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাকাতুল ফিতর বিভিন্ন প্রকারের খাদ্যদ্রব্য দ্বারা নির্ধারণ করেছেন, আর সে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য সমান নয়। সুতরাং মূল্যই যদি ধর্তব্য হয়, তাহলে নির্দিষ্ট কোনো এক প্রকারের এক সা‘ পরিমাণ নির্ধারিত হতো এবং অন্যান্য প্রকার থেকে একই মূল্যের সমান নির্ধারিত হতো।
– আর মূল্য প্রদান করলে যাকাতুল ফিতর প্রকাশ্য ইবাদাত থেকে পরিণত হয় গোপন ইবাদতে। যেহেতু এক সা‘ খাদ্য প্রদান করলে তা মুসলিমদের মাঝে প্রকাশ্য হয়, ছোট-বড় সকলেই তা জানতে পারে, স্বচক্ষে তার পরিমাপ ও বণ্টন দেখে এবং তারা পরস্পর তা গ্রহণ করে। কিন্তু মূল্য হলে দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে তা গোপনে আদান-প্রদান হয়ে যায়।
যাকাতুল ফিতরের পরিমাণ:
যাকাতুল ফিতরের পরিমাণ হলো: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগের এক সা‘। যার ওজন: উন্নত মানের গমের চার শত আশি মিসকাল গম। আর গ্রামের ওজনে ‘দুই কেজি ৪০ গ্রাম’ গম। যেহেতু এক মিসকাল সমান সোয়া চার গ্রাম, তাই ৪৮০ মিসকাল সমান ২০৪০ গ্রাম।
অতএব রাসূলে যুগের সা‘ জানতে ইচ্ছা করলে, তাকে দুই কেজি চল্লিশ গ্রাম গম ওজন করে এমন পাত্রে রাখতে হবে, যা মুখ পর্যন্ত ভরে যাবে। অতঃপর তা দ্বারা পরিমাপ করতে হবে।
যাকাতুল ফিতর ওয়াজিব হওয়ার সময়:
ঈদের রাতে সূর্যাস্তের সময় জীবিত থাকলে তাদের ওপর যাকাতুল ফিতর আদায় করা আবশ্যক; নতুবা নয়।
সুতরাং কেউ সুর্যাস্তের এক মিনিট পূর্বে মারা গেলে তার ওপর ওয়াজিব হবে না।
আর এক মিনিট পরে মারা গেলে অবশ্যই তার পক্ষ থেকে আদায় করতে হবে।
যদি কোনো শিশু সূর্যাস্তের কয়েক মিনিট পর ভূমিষ্ট হয়, তার ওপরও আবশ্যক হবে না। তবে আদায় করা সুন্নাত হবে। যার আলোচনা পূর্বে অতিবাহিত হয়েছে।
আর সূর্যাস্তের কয়েক মিনিট পূর্বে ভূমিষ্ট হলে তার পক্ষ থেকে আদায় করতে হবে।
যাকাতুল ফিতর আবশ্যক হওয়ার সময় রামযানের শেষ দিনের সূর্যাস্তের পর এজন্য নির্ধারণ করা হয়েছে যে, তখন থেকে ফিতর তথা খাওয়ার মাধ্যমে রমযানের সিয়াম সমাপ্ত হয়। এ কারণেই একে রমযানের যাকাতুল ফিতর বা সিয়াম ভাঙ্গার যাকাত বলা হয়। এতে বুঝা গেল যে, ফিতর তথা সিয়াম শেষ হওয়ার সময়টাই যাকাতুল ফিতর ওয়াজিব হওয়ার সময়।
যাকাতুল ফিতর আদায়ের সময়:
যাকাতুল ফিতর আদায়ের দুটি সময় রয়েছে:
১. ফযীলতপূর্ণ সময় ও ২. জায়েয সময়।
ফযীলতপূর্ণ সময়: ঈদের দিন সকালে ঈদের সালাতের পূর্বে। কারণ;
* সহীহ বুখারীতে আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كُنَّا نُخْرِجُ فِي عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ الفِطْرِ صَاعًا مِنْ طَعَامٍ
‘আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যামানায় যাকাতুল ফিতর ঈদুল ফিতরের দিনে এক সা‘ পরিমাণ খাদ্য আদায় করতাম।’
অনুরূপভাবে বুখারীতে ইবন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন,
أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَمَرَ بِزَكَاةِ الْفِطْرِ، أَنْ تُؤَدَّى قَبْلَ خُرُوجِ النَّاسِ إِلَى الصَّلَاةِ
‘রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষকে ঈদের সালাত পড়তে যাওয়ার পূর্বে যাকাতুল ফিতর আদায় করার আদেশ নিয়েছেন।’ অনুরূপভাবে হাদিসটি ইমাম মুসলিম ও অন্যান্যরা বর্ণনা করেছেন।
ইবন ‘উয়াইনা স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে ‘আমর ইবন দীনারের সূত্রে ইকরিমা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, মানুষ ঈদের দিন যাকাতুল ফিতর ঈদের সালাতের পূর্বে আদায় করবে। কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ قَدۡ أَفۡلَحَ مَن تَزَكَّىٰ ١٤ وَذَكَرَ ٱسۡمَ رَبِّهِۦ فَصَلَّىٰ ١٥ ﴾ [الأعلى: ١٤، ١٥]
‘নিশ্চয়ই সাফল্য লাভ করবে সে, যে শুদ্ধ হয় এবং তার পালনকর্তার নাম স্মরণ করে, অতঃপর সালাম আদায় করে।’ {সূরা আ‘লা, আয়াত: ১৪-১৫}
সুতরাং ঈদুল ফিতরের সালাত একটু বিলম্ব করে পড়া উত্তম; যাতে মানুষ যাকাতুল ফিতর আদায় করতে পারে।
জায়েয সময়: ঈদের একদিন দু’দিন পূর্বে যাকাতুল ফিতর আদায় করা।
* সহীহ বুখারীতে নাফে‘ বর্ণনা করেন, ইবন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু নিজের এবং ছেট-বড় সন্তানদের পক্ষ হতেও যাকাতুল ফিতর প্রদান করতেন। এমনকি তিনি আমার সন্তানদের যাকাতুল ফিতরও প্রদান করতেন। তিনি যারা যাকাতুল ফিতর গ্রহণ করত তাদেরকেই প্রদান করতেন। আর তারা ঈদের একদিন বা দু’দিন পূর্বে যাকাতুল ফিতর দিতেন।
 ঈদের সালাতের পর আদায় করা জায়েয নেই। তাই বিনা কারণে সালাতের পর পর্যন্ত বিলম্ব করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না কারণ তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশের পরিপন্থী।
* পূর্বে ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
مَنْ أَدَّاهَا قَبْلَ الصَّلَاةِ، فَهِيَ زَكَاةٌ مَقْبُولَةٌ، وَمَنْ أَدَّاهَا بَعْدَ الصَّلَاةِ، فَهِيَ صَدَقَةٌ مِنَ الصَّدَقَاتِ
‘ঈদের সালাতের পূর্বে আদায় করলে তা যাকাতুল ফিতর হিসাবে গণ্য হবে। আর ঈদের সালাতের পর আদায় করলে তা অন্যান্য সাধারণ দানের মত একটি দান হবে।’
 আর যদি কোনো সঙ্গত কারণবশত বিলম্ব করে, তাহলে কোনো অসুবিধা নেই। যেমন সে এমন স্থানে আছে যে তার কাছে আদায় করার মত কোনো বস্তু নেই বা এমন কোনো ব্যক্তিও নেই, যে এর হকদার। অথবা হঠাৎ তার কাছে ঈদের সালাতের সংবাদ পৌঁছল যে কারণে সে সালাতের পূর্বে আদায় করার সুযোগ পেল না অথবা সে কোন ব্যক্তিকে দায়িত্ব দিয়েছিল, আর সে আদায় করতে ভুলে গেছে। এমতাবস্থায় সালাতের পর আদায় করলে কোনো অসুবিধা নেই। কারণ সে অপারগ।
ওয়াজিব হচ্ছে, যাকাতুল ফিতর তার প্রাপকের হাতে সরাসরি বা উকিলে মাধ্যমে যথাসময়ে সালাতের পূর্বে পৌঁছানো। যদি নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে প্রদানের নিয়ত করে, কিন্তু যাকাতুল ফিতর বের করার সময় তার সঙ্গে বা তার কোনো ওকিল বা প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎ না ঘটে তাহলে অন্য কোনো যাকাতুল ফিতরের উপযুক্ত ব্যক্তিকে প্রদান করবে। কোনো ক্রমেই নির্দিষ্ট সময় থেকে বিলম্ব করবে না।
যাকাতুল ফিতর প্রদানের স্থান:
যাকাতুল ফিতর প্রদানের সময় ফিতরা প্রদানকারী যে এলাকায় সে অবস্থান করছে সে এলাকার গরীবরাই এর হকদার; সে (ফিতরা প্রদানকারী) উক্ত এলাকার স্থায়ী অধিবাসী হোক বা অস্থায়ী হোক। বিশেষ করে যদি সম্মানিত স্থান হয় যেমন মক্কা বা মদীনা অথবা সেখানকার ফকীররা এর প্রতি বেশি মুখাপেক্ষী হয় তবে সেখানে বের করাই নির্দিষ্ট। কিন্তু যদি সে এমন এলাকায় থাকে যেখানে কোনো হকদার না থাকে বা হকদার চেনা অসম্ভব হয়, তাহলে তার পক্ষ থেকে একজন উকিল নিযুক্ত করবে যে উকিল উপযুক্ত ব্যক্তি খুঁজে তার যাকাতুল ফিতর আদায় করে দেবে।
যাকাতুল ফিতরের হকদার:
সদকাতু ফিতরের হকদার হচ্ছে (১) দরিদ্র, (২) ঋণগ্রস্ত, যারা তা আদায়ে অক্ষম। সুতরাং তাদেরকে প্রয়োজন পরিমাণ দেয়া যাবে।
একটি যাকাতুল ফিতর অনেক ফকীরকে দেওয়া জায়েয।
আবার অনেকগুলো যাকাতুল ফিতর এক মিসকীনকেও দেয়া যাবে। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাকাতুল ফিতরের পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন। কিন্তু তাদের কতটুকু দেওয়া হবে তা নির্ধারণ করেন নি।
এর উপর ভিত্তি করে বলা যায় যে, যদি একদল লোক তাদের যাকাতুল ফিতর ওজন করার পর একটি পাত্রে জমা করে, তারপর সেখান থেকে পুনরায় পরিমাপ ছাড়া বণ্টন করে তবে তা আদায় হয়ে যাবে।
কিন্তু ফকীরকে জানিয়ে দেয়া উচিৎ যে, তাকে তারা যা দিচ্ছে তার পরিমাণ তারা জানে না; যাতে করে (ফকীর) নিজে কাউকে দিতে গিয়ে তার পরিমাপ না জেনে ধোঁকায় না পড়ে।
আর ফকীরের জন্য বৈধ, কারো থেকে যাকাতুল ফিতর গ্রহণের পর নিজের পক্ষ থেকে বা পরিবারের অন্য সদস্যদের পক্ষ থেকে পরিমাপ করার পর যাকাতুল ফিতর প্রদান করা। অথবা তা পরিপূর্ণ আছে বলে দাতার কথায় বিশ্বাস করে পরিমাপ ছাড়াই প্রদান করা।
হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে আপনার সন্তুষ্টি অনুযায়ী আনুগত্য করার তাওফীক দিন। আমাদের আত্মা, কথা ও কাজ পরিশুদ্ধ করে দিন। আমাদেরকে খারাপ আকীদা-বিশ্বাস, খারাপ কথা ও খারাপ কাজ থেকে পবিত্র করুন। নিশ্চয় আপনি উত্তম দানশীল ও করুণাময়।
হে আল্লাহ! আপনি সালাত ও সালাম পেশ করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তাঁর সকল পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীর ওপর।
ঊনত্রিংশ আসরঃ তওবা সম্পর্কে
সকল প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য, যিনি প্রত্যেক সৃষ্টিতে আপন এককত্বের ওপর প্রমাণ স্থাপন করেছেন। আপন সৃষ্টিতে যেভাবে চান ইয্‌যত ও ক্ষমতার হস্তক্ষেপ করেন। মুত্তাকীদের নির্বাচিত করে তাদের ঈমান ও নিরাপত্তা দান করেন। অপরাধীদের আপন সংযম ও করুণায় ক্ষমা ও মার্জনা করেন। তাঁর অবাধ্যদের রিযিক বন্ধ করেন না দয়া ও করুণাবশত। নিষ্ঠাবান মুমিনদেরকে আপন নৈকট্যের মৃদু বায়ূ দ্বারা প্রশান্তি দান করেন এবং হিসাব দিবসে তার মহাবিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেন। তাঁর সন্তুষ্টির পথ অবলম্বনকারীকে তিনি নিজ আস্তানায় হেফাযত করেন। মুমিনকে তার অন্তরে ঈমান অঙ্কিত করে সম্মানিত করেন। নিজ সৃষ্টিতে তিনি বিধি-বিধান প্রবর্তন করেন, তাই তাদের জন্য জারী করেন আদেশ-নিষেধ। আপন সহযোগিতায় দাঁড় করান ফলে কেউ সে আদেশ পালন করতে সমর্থ হয় আবার কেউ তাতে অপারগ হয়। যে উদাসীন ও বিস্মৃতপ্রায় তাকে নিজ উপদেশবাণী দিয়ে জাগ্রত করেন। তিনি গুনাহগারকে তার গুনাহ মাফের জন্য তাওবার দিকে আহ্বান করেন। তিনি মহান রব; সৃষ্টিজগতে তাঁর কোনো তুলনা নেই। তিনি দয়ালু দাতা; যিনি পানাহারের মুখাপেক্ষী নন। সকল সৃষ্টি সর্বদা তাঁর মুখাপেক্ষী এবং দিবারাত্রি তাঁর করুণার ভিখারী। আমি তাঁর প্রশংসা করি এমন প্রশংসা যা কোনো রবের ইবাদতকারী করে থাকে এবং আর তাঁর কাছে ওযর পেশ করছি নিজ পাপ ও ত্রুটির জন্য।
আর আমি সাক্ষ্য দেই যে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই; তাঁর কোনো শরীক নেই, নিজ মন থেকে একনিষ্ঠ ব্যক্তির সাক্ষ্য। আমি আরও সাক্ষ্য দেই মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসূল, যাকে তাঁর দল থেকে বাছাই করা হয়েছে।
আল্লাহ সালাত ও সালাম বর্ষণ করুন তাঁর ওপর, তাঁর শ্রেষ্ঠতম সঙ্গী আবূ বকরের ওপর, উমরের ওপর যার চলার পথে শয়তান চলত না, উসমান শহীদের ওপর, যিনি যুদ্ধের কাতারে শহীদ হননি, আলীর ওপর যিনি তাঁর যুদ্ধের সাহায্যকারী এবং তাঁর পরিবার-পরিজন, সাহাবীবৃন্দ ও তাঁর আদর্শের অনুসারীদের ওপর।
ভাইয়েরা আমার! রমযান মাস শেষ করুন, আল্লাহর কাছে গুনাহ থেকে তাওবার মাধ্যমে, তাঁর সন্তুষ্টি অনুযায়ী কাজ করে তাঁর কাছে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে। কেননা, মানুষ গুনাহ ও ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত নয়। প্রত্যেক আদম সন্তান গুনাহ করে তবে সর্বোত্তম পাপী হলো, তাওবাকারী।
আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় কিতাবে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বাণীতে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ও তাঁর কাছে তাওবার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَأَنِ ٱسۡتَغۡفِرُواْ رَبَّكُمۡ ثُمَّ تُوبُوٓاْ إِلَيۡهِ يُمَتِّعۡكُم مَّتَٰعًا حَسَنًا إِلَىٰٓ أَجَلٖ مُّسَمّٗى وَيُؤۡتِ كُلَّ ذِي فَضۡلٖ فَضۡلَهُۥۖ وَإِن تَوَلَّوۡاْ فَإِنِّيٓ أَخَافُ عَلَيۡكُمۡ عَذَابَ يَوۡمٖ كَبِيرٍ ٣ ﴾ [هود: ٣]
‘আরো যে, তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর, তারপর তাঁর দিকে ফিরে আস, তিনি তোমাদেরকে এক নির্দিষ্ট কালের এক উত্তম জীবন উপভোগ করতে দেবেন এবং তিনি প্রত্যেক গুণীজনকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দান করবেন। আর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে নিশ্চয় আমি তোমাদের উপর মহাদিনের শাস্তির আশংকা করি।’ {সূরা হূদ, আয়াত: ৩}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ قُلۡ إِنَّمَآ أَنَا۠ بَشَرٞ مِّثۡلُكُمۡ يُوحَىٰٓ إِلَيَّ أَنَّمَآ إِلَٰهُكُمۡ إِلَٰهٞ وَٰحِدٞ فَٱسۡتَقِيمُوٓاْ إِلَيۡهِ وَٱسۡتَغۡفِرُوهُۗ﴾ [فصلت: ٦]
‘(হে মুহাম্মাদ) আপনি বলুন, আমিও তোমাদের মতই মানুষ, তবে আমার প্রতি ওহী আসে যে, তোমাদের মা‘বুদ একমাত্র মা‘বুদ। অতএব তাঁরই পথ দৃঢ়ভাবে অবলম্বন কর এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর।’ {সূরা হা-মীম-সিজদাহ, আয়াত: ৬}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
﴿ وَتُوبُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ ٣١ ﴾ [النور: ٣١]
‘হে মুমিনগণ, তোমরা সকলেই আল্লাহর নিকট তাওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।’ {সূরা আন-নূর, আয়াত: ৩১}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ تُوبُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِ تَوۡبَةٗ نَّصُوحًا عَسَىٰ رَبُّكُمۡ أَن يُكَفِّرَ عَنكُمۡ سَيِّ‍َٔاتِكُمۡ وَيُدۡخِلَكُمۡ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ﴾ [التحريم: ٨]
‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কর, খাঁটি তাওবা; আশা করা যায় তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত।’ {সূরা আত-তাহরীম, আয়াত: ৮}
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلتَّوَّٰبِينَ وَيُحِبُّ ٱلۡمُتَطَهِّرِينَ ٢٢٢ ﴾ [البقرة: ٢٢٢]
‘নিশ্চয় আল্লাহ তাওবাকারী এবং পবিত্রতা অর্জনকারীদের পছন্দ করেন।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২২২}
আর তাওবার বর্ণনায় বহু আয়াত রয়েছে।
হাদীসসমূহ:
* আগার্র ইবন ইয়াসার আল-মুযানী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
يَا أَيُّهَا النَّاسُ تُوبُوا إِلَى اللهِ، فَإِنِّي أَتُوبُ، فِي الْيَوْمِ إِلَيْهِ مِائَةَ، مَرَّةٍ
‘হে লোকসকল! তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কর ও ক্ষমা প্রার্থনা কর। কারণ, আমি প্রতিদিন একশত বার তাওবা করি।’
* আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি:
وَاللَّهِ إِنِّي لَأَسْتَغْفِرُ اللَّهَ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ فِي اليَوْمِ أَكْثَرَ مِنْ سَبْعِينَ مَرَّةً
‘আল্লাহর শপথ, অবশ্যই আমি প্রতিদিন আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি ও তাওবা করি ৭০ বারেরও অধিক।’
* আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
لَلَّهُ أَشَدُّ فَرَحًا بِتَوْبَةِ عَبْدِهِ حِينَ يَتُوبُ إِلَيْهِ، مِنْ أَحَدِكُمْ كَانَ عَلَى رَاحِلَتِهِ بِأَرْضِ فَلَاةٍ، فَانْفَلَتَتْ مِنْهُ وَعَلَيْهَا طَعَامُهُ وَشَرَابُهُ، فَأَيِسَ مِنْهَا، فَأَتَى شَجَرَةً، فَاضْطَجَعَ فِي ظِلِّهَا، قَدْ أَيِسَ مِنْ رَاحِلَتِهِ، فَبَيْنَا هُوَ كَذَلِكَ إِذَا هُوَ بِهَا، قَائِمَةً عِنْدَهُ، فَأَخَذَ بِخِطَامِهَا، ثُمَّ قَالَ مِنْ شِدَّةِ الْفَرَحِ: اللهُمَّ أَنْتَ عَبْدِي وَأَنَا رَبُّكَ، أَخْطَأَ مِنْ شِدَّةِ الْفَرَحِ
‘বান্দা যখন আল্লাহর কাছে তাওবা করে, তখন আল্লাহ ওই ব্যক্তির চেয়েও অধিক খুশি হন, যে বিশাল বিস্তৃত ভূমিতে সফর করছিল, হঠাৎ তার বাহন পালিয়ে গেল, যে বাহনে তার খাদ্য ও পানীয় ছিল। কোনো উপায় না দেখে সম্পূর্ণ নিরাশ হয়ে মৃত্যুর অপেক্ষায় একটি বৃক্ষের ছায়ায় শুয়ে পড়ল। এমতাবস্থায় হঠাৎ বাহনটি তার পাশেই উপস্থিত পেল। সে লাগাম হাতে নিয়ে আনন্দের অতিশয্যে বলে ফেললো, আল্লাহ! তুমি আমার বান্দা এবং আমি তোমার প্রভু। অতি আনন্দে ভুল বলে ফেলল।’
আল্লাহ সুবহানাহু বান্দার তাওবাতে খুশি হওয়ার কারণ হচ্ছে তিনি তাওবা ও ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। অনুরূপভাবে তিনি এটাও ভালোবাসেন যে বান্দা তার কাছ থেকে পলায়ন করার পর আবার তার কাছে ফিরে আসছে।
* আনাস এবং ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
لَوْ أَنَّ لِابْنِ آدَمَ وَادِيًا مِنْ ذَهَبٍ أَحَبَّ أَنْ يَكُونَ لَهُ وَادِيَانِ، وَلَنْ يَمْلَأَ فَاهُ إِلَّا التُّرَابُ، وَيَتُوبُ اللَّهُ عَلَى مَنْ تَابَ
‘বনী আদমের যদি স্বর্ণের একটি উপত্যকা থকে, তাহলে সে তখন দু’টি উপত্যকার কামনা করে। মাটিই একমাত্র তার মুখ ভরতে পারে। আর যে তাওবা করে, আল্লাহ তার তাওবা কবুল করেন।’
তাওবা: আল্লাহর নাফরমানী ছেড়ে, তার আনুগত্যে ফিরে আসাকে তাওবা বলে। কারণ, আল্লাহ তা‘আলাই সত্যিকারের মা‘বুদ। আর ইবাদতের তাৎপর্য হচ্ছে ভালোবাসা ও সম্মানার্থে মা‘বুদ সমীপে বিনয়ী ও অনুগত হওয়া। অতএব, যখনই বান্দার পক্ষ হতে প্রভুর অবাধ্যতা প্রকাশ পাবে, তখন সেটা থেকে তাওবা হচ্ছে, তার কাছে দীন, হীন, ভীত, সন্ত্রস্ত, লজ্জিত ও নত হয়ে তার দরবারে ফিরে আসা ও তার দরজায় দাড়ানো।
তাওবা করা ওয়াজিব; তাৎক্ষণিকভাবে। বিলম্ব করা বা গড়িমসি করা জায়েয নেই। কারণ;
– আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে আদেশ করেছেন। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশ তৎক্ষণাৎ পালনীয়। কারণ, বান্দার জানা নেই বিলম্বে কী পরিণতি হবে। হতে পারে হঠাৎ তার মৃত্যু এসে যাবে, আর তাওবার সুযোগ ঘটবে না।
– তাছাড়া বারবার গুনাহ করা অন্তরকে কঠিন করে দেয়, আল্লাহ হতে দুরে সরিয়ে দেয় ও ঈমানী শক্তি দুর্বল করে দেয়। পক্ষান্তরে আনুগত্য ঈমান বৃদ্ধি করে ও নাফরমানী কমিয়ে দেয়।
– বারংবার গুনাহে লিপ্ততা, ওই গুনাহের প্রতি মুহাব্বত ও দৃঢ়তা সৃষ্টি করে। কারণ, নফস কোনো বিষয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেলে তা বর্জন করা কঠিন হয়। এ কারণেই আল্লাহর নাফরমানী হতে মুক্ত হওয়া কষ্টকর। তখন শয়তান পূর্বের চেয়ে বড় গুনাহে জড়িয়ে দেয়।
* এজন্য আল্লাহ ওয়ালা আলেমগণ বলেন, ‘গুনাহ কুফরীর দূতস্বরূপ।’ ক্রমশ গুনাহে জড়িত হতে থাকে, পরিণামে দ্বীন থেকে সরে পড়ে। আল্লাহর কাছে এ থেকে নিরাপত্তা চাই।
আল্লাহ যে তাওবার আদেশ করেছেন, তা হলো খালেস তাওবা। খালেস তাওবার জন্য পাঁচটি শর্ত:
প্রথম শর্ত: তাওবা একান্তভাবে আল্লাহর জন্য হতে হবে
আল্লাহর ভালোবাসা, তাঁর প্রতি সম্মান, সাওয়াবের আশা, শাস্তি ভয় তাকে তাওবার প্রতি উদ্বুদ্ধ করবে। এ তাওবার মধ্যে মাখলুকের মহব্বত বা দুনিয়ার তুচ্ছ কোনো স্বার্থ থাকতে পারবে না। অন্যথায় তাওবা কবুল হবে না। কারণ, সে আল্লাহর কাছে তওবা করে নি; বরং ওই উদ্দেশ্যের কাছে সে তাওবা করেছে।
দ্বিতীয় শর্ত: কৃত অপরাধের জন্য লজ্জিত হতে হবে
সে তার অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হবে, এই গুনাহ যদি না হতো—এমন আশা করবে। ফলে এই লজ্জা ও পেরেশানীর কারণে সে আল্লাহর দিকে ফিরে যাবে, তাঁর সমীপে নত হবে এবং যে নফস তাকে অন্যায় করতে প্ররোচিত করেছিল তার প্রতি ঘৃণার উদ্রেক হবে; আর এভাবেই তার তাওবা হবে বিশ্বাস ও সঠিক অনুধাবন থেকে উদ্ভূত।
তৃতীয় শর্ত: তৎক্ষণাৎ সে গুনাহ বর্জন করা
তাই নাফরমানী যদি হারাম কাজ করার ফলে হয়, তাহলে তৎক্ষণাৎ তা পরিত্যাগ করবে।
আর যদি নাফরমানী ওয়াজিব বর্জন করার কারণে হয়, তবে তা তখনই করতে হবে, যদি তার কাযা সম্ভব হয়, যেমন, যাকাত, হজ।
গুনাহে লিপ্ত থাকা অবস্থায় তওবা কবুল হয় না। উদাহরণস্বরূপ:
– কেউ সুদী লেনদেনে লিপ্ত থেকে বললো, আমি সুদ থেকে তাওবা করছি। তাহলে তাওবা সহীহ হবে না; বরং এ হলো আল্লাহর সঙ্গে ঠাট্টার শামিল, যা বান্দাকে আল্লাহ থেকে আরো দূরে সরিয়ে দেয়।
– অনুরূপ জামাতের সঙ্গে সালাত আদায় না করার গুনাহ থেকে তাওবা করল অথচ এখনো জামাতে সালাত আদায় বর্জন করেই চলে তবে তার সে তাওবা বিশুদ্ধ হয়নি।
আর যদি গুনাহ মানুষের অধিকার সম্পর্কিত হয়, তাহলে তাদের থেকে নিষ্পত্তি না করা পর্যন্ত তাওবা সহীহ হবে না।
– সুতরাং যদি গুনাহটি হয় কারও সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়া অথবা সম্পদ অস্বীকার করা, তাহলে সেটার হকদারের কাছে তা পৌঁছাতে হবে, যদি সে জীবিত থাকে। আর যদি হকদার মারা গিয়ে থাকে তবে তা ওয়ারিসদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। আর যদি ওয়ারিসও না থাকে তাহলে বায়তুল মালে (রাষ্ট্রীয় কোষাগারে) জমা দিতে হবে। আর যদি প্রাপক জানা না থাকে, তার পক্ষ থেকে দান করে দেবে। আর এ সম্পর্কে আল্লাহই জানবেন।
– আর নাফরমানী যদি কোনো মুসলিমের গীবত তথা পরনিন্দা হয়, তবে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবে; যদি সে তার গীবত করা সম্পর্কে জানতে পারে অথবা যদি এ আশংকা থাকে যে লোকটি তার গীবত সম্পর্কে জেনে যাবে। আর যদি এরকম কিছু না হয় তবে সেই গীবতের মজলিসেই তার ভালো প্রশংসা করবে। কারণ, নেক কাজ গুনাহকে বিলুপ্ত করে দেয়।
নির্দিষ্ট গুনাহ থেকে তাওবা করা যাবে, যদিও অন্য গুনাহে লিপ্ত থাকে। কারণ ‘আমল যৌগিক বিষয়, আর ঈমান বাড়ে-কমে। তবে যতক্ষণ পর্যন্ত সব গুনাহ থেকে তাওবা না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাওবার গুণ তার জন্য সাব্যস্ত হবে না এবং তাওবাকারীদের উঁচু মর্যাদা ও প্রশংসার অধিকারীও সে হবে না।
চতুর্থ শর্ত: ভবিষ্যতে আর গুনাহ না করার দৃঢ় সংকল্প করতে হবে।
কারণ, তাওবার ফলাফল এটাই, যা তাওবাকারীর সত্যবাদিতার প্রমাণ।
যদি বলে যে ‘সে তাওবাকারী’ অথচ সে কোনো একদিন গুনাহ করার সংকল্পবদ্ধ বা দোদুল্যমান থাকে, তাহলে তার তাওবা বিশুদ্ধ হবে না। কারণ, এটা সাময়িক তাওবা, এ তাওবাকারী উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় আছে যখন সে আবার এ গুনাহটি করবে। এর মাধ্যমে লোকটিকে ঘৃণাবশত গুনাহ থেকে আল্লাহর আনুগত্যের দিকে প্রত্যাবর্তনকারী বুঝায় না।
পঞ্চম শর্ত: তাওবা কবুলের সময় অতিক্রান্ত না হওয়া
কেননা, সময় অতিক্রম করার পর তাওবা করলে, তা গৃহীত হবে না।
তাওবা কবুলের শেষ সময় দু’ প্রকার:
১. সকলের জন্য সমানভাবে ও ২. প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য বিশেষ।
 তন্মধ্যে সকলের জন্য সাধারণভাবে: সূর্য পশ্চিম দিকে উদিত হওয়া। তখন আর তাওবা কোনো উপকারে আসবে না।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ يَوۡمَ يَأۡتِي بَعۡضُ ءَايَٰتِ رَبِّكَ لَا يَنفَعُ نَفۡسًا إِيمَٰنُهَا لَمۡ تَكُنۡ ءَامَنَتۡ مِن قَبۡلُ أَوۡ كَسَبَتۡ فِيٓ إِيمَٰنِهَا خَيۡرٗاۗ﴾ [الانعام: ١٥٨]
‘যে দিন আপনার পালনকর্তার কোনো নিদর্শন আসবে, সে দিন এমন কোনো ব্যক্তির ঈমান আনয়ন তার জন্য ফলপ্রসু হবে না যে পূর্ব থেকে ঈমান আনয়ন করে নি কিংবা স্বীয় ঈমান অনুযায়ী কোনোরূপ সৎকর্ম করে নি।’ {সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১৮৫}
এখানে নিদর্শন দ্বারা পশ্চিম দিক হতে সূর্য উদয় হওয়া উদ্দেশ্য। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন।
* ‘আব্দুল্লাহ ইবন ‘আমর ইবন ‘আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
ولا تزال التوبة تقبل حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا، فَإِذَا طَلَعَتْ طُبِعَ عَلَى كُلِّ قَلْبٍ بِمَا فِيهِ وَكُفِيَ النَّاسُ الْعَمَلَ
‘তাওবা সর্বদা কবুল হতে থাকে সূর্য পশ্চিম আকাশ হতে উদিত হওয়া পর্যন্ত। উদয় হলে প্রত্যেকের অন্তরে মোহর মেরে দেয়া হয়। মানুষের জন্য তার আমল যথেষ্ট হয়ে যায়।’ ইবন কাসীর হাদীসের সূত্রকে ‘হাসান’ বলেছেন।
* আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
مَنْ تَابَ قَبْلَ أَنْ تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا، تَابَ اللهُ عَلَيْهِ
‘যে ব্যক্তি সূর্য পশ্চিম দিক হতে উদয়ের পূর্বে তাওবা করবে আল্লাহ তার তাওবা কবুল করবেন।’
 প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য বিশেষভাবে: মৃত্যুমুখে পতিত হওয়া।
যখন কারো মৃত্যু উপস্থিত হবে এবং মৃত্যু প্রত্যক্ষ করবে তখন তাওবা তার কোনো উপকারে আসবে না এবং গৃহীতও হবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَلَيۡسَتِ ٱلتَّوۡبَةُ لِلَّذِينَ يَعۡمَلُونَ ٱلسَّيِّ‍َٔاتِ حَتَّىٰٓ إِذَا حَضَرَ أَحَدَهُمُ ٱلۡمَوۡتُ قَالَ إِنِّي تُبۡتُ ٱلۡـَٰٔنَ﴾ [النساء: ١٨]
‘আর এমন লোকদের তাওবা কবুল হবে না যারা মন্দ কাজ করে। এমনকি যখন তাদের কারো কাছে মৃত্যু উপস্থিত হয় তখন বলতে থাকে আমি এখন তাওবা করছি।’ {সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ১৮}
‘আবদুল্লাহ ইবন ‘উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إِنَّ اللَّهَ يَقْبَلُ تَوْبَةَ العَبْدِ مَا لَمْ يُغَرْغِرْ
‘আল্লাহ বান্দার তাওবা গরগরার (রূহ ওষ্ঠাগত হবার) পূর্ব পর্যন্ত কবুল করেন।’
সকল শর্ত পূরণের মাধ্যমে তাওবা যখন সহীহ ও গৃহীত হবে তখন আল্লাহ তার কৃত পাপ যত বড়ই হোক তা মুছে দেবেন।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ قُلۡ يَٰعِبَادِيَ ٱلَّذِينَ أَسۡرَفُواْ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمۡ لَا تَقۡنَطُواْ مِن رَّحۡمَةِ ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ يَغۡفِرُ ٱلذُّنُوبَ جَمِيعًاۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلۡغَفُورُ ٱلرَّحِيمُ ٥٣ ﴾ [الزمر: ٥٣]
‘হে আমার বান্দারা যারা নিজেদের ওপর যুলম করেছো তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সকল গুনাহ মাফ করবেন। তিনি ক্ষমাশীল দয়ালু।’ {সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৫৩}
এ আয়াতটি মহান পালনকর্তার অনুগত ও আজ্ঞাবহ তাওবাকারীদের জন্য সুসংবাদস্বরূপ।
* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
﴿ وَمَن يَعۡمَلۡ سُوٓءًا أَوۡ يَظۡلِمۡ نَفۡسَهُۥ ثُمَّ يَسۡتَغۡفِرِ ٱللَّهَ يَجِدِ ٱللَّهَ غَفُورٗا رَّحِيمٗا ١١٠ ﴾ [النساء: ١١٠]
‘যে গুনাহ করে কিংবা নিজের ওপর যুলম করে অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে তখন সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল ও করুণাময় পাবে।’ {সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১১০}
অতএব আপনারা নিজের জীবনের সময় থাকতে হঠাৎ করে মৃত্যু আসার পূর্বেই দ্রুত স্বীয় রবের কাছে খালেস তাওবা করুন। কারণ তখন আর উদ্ধারের কোনো উপায় থাকবে না।
হে আল্লাহ! আমাদেরকে এমন আন্তরিকভাবে তাওবা করার তাওফীক দিন; যা আমাদের কৃত পাপসমূহ মিটিয়ে দেবে এবং আমাদেরকে সহজ পথ জান্নাতের রাস্তা সহজ করে দিন। কঠিন পথ জাহান্নামের রাস্তা থেকে দূরে রাখুন। আর আপনার স্বীয় করুনায় আমাদেরকে এবং আমাদের পিতামাতা ও সকল মুসলিমকে ক্ষমা করুন, হে সর্বশ্রেষ্ঠ দয়াময়।
আর আল্লাহ আমাদের নবী মুহাম্মদ, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবায়ে কিরামের ওপর সালাত পেশ করুন।
ত্রিংশ আসরঃ রমযান মাসের সমাপ্তি
সকল প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য, যিনি প্রশস্ত, মহান, বদান্য, দানশীল, দয়ালু। তিনি সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তা নিপুণভাবে নিরূপণ করেছেন। তিনি শরীয়ত নাযিল করেছেন আর তা সহজ করেছেন। তিনি মহাপ্রজ্ঞাবান ও সর্বজ্ঞাতা। তিনি সৃষ্টির সূচনা করেছেন অতঃপর তা সম্পন্ন করেছেন। [আর সূর্য ভ্রমণ করে তার নির্দিষ্ট পথে, এটা মহাপরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ (আল্লাহ)-র নির্ধারণ। আর চাঁদের জন্য আমি নির্ধারণ করেছি মানযিলসমূহ, অবশেষে সেটি খেজুরের শুষ্ক পুরাতন শাখার মত হয়ে যায়। সূর্যের জন্য সম্ভব নয় চাঁদের নাগাল পাওয়া, আর রাতের জন্য সম্ভব নয় দিনকে অতিক্রম করা, আর প্রত্যেকেই কক্ষ পথে ভেসে বেড়ায়।] {সূরা ইয়াছীন, আয়াত : ৩৮-৪০}
প্রশংসা করছি তিনি যা প্রদান করেছেন এবং হেদায়াত দিয়েছেন তার। কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি তাঁর অনুগ্রহ ও দানের। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে তিনি ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই। তিনিই মুনিব, উচ্চ ও সর্বোচ্চ। তিনি প্রথম তাঁর আগে কিছু নেই। তিনি শেষ তাঁর পরে কিছু নেই। তিনি বিজয়ী তাঁর ওপর কেউ নেই। তিনি নিকটে তাঁর চেয়ে কাছে কিছু নেই। তিনি সবকিছুই জানেন। আর সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসূল, যাকে তিনি সকল সৃষ্টিকুল থেকে নির্বাচিত করেছেন।
আল্লাহ সালাত ও সালাম বর্ষণ করুন তাঁর ওপর; তাঁর সাথী শ্রেষ্ঠতম সত্যবাদী আবূ বকরের ওপর; ধর্মকর্মে বীরত্বে খ্যাতিমান উমরের ওপর; দুষ্কৃতিকারীদের হাতে অন্যায়ভাবে নিহত উসমানের ওপর; সুনিশ্চিতভাবে সবচে নিকটাত্মীয় আলীর ওপর এবং তাঁর সকল পরিবার-পরিজন, সাহাবী ও কিয়ামত পর্যন্ত আগত সুচারুরূপে তাঁদের অনুসরণকারীদের ওপর।
ভ্রাতৃবৃন্দ! অতি শীঘ্রই রমযান মাস আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে এবং নতুন একটি মাস আগমন করছে। কিন্তু রমযান মাস আমাদের আমল অনুযায়ী আমাদের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে সাক্ষী হয়ে থাকবে। এ মাসে যে ব্যক্তি ভালো আমল করতে পেরেছে, সে যেন আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। ও শুভ পরিণামের অপেক্ষায় থাকে। নিশ্চয় আল্লাহ ভালো আমলকারীর আমল নষ্ট করেন না। আর যে ব্যক্তি এ মাসে অন্যায় কাজ করেছে, সে যেন তা প্রভুর কাছে খালেস তাওবা করে। যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা তাওবাকারীর তাওবা কবুল করেন।
আল্ল‘হ তা‘আলা আমাদের জন্য এ রমযানের শেষে কিছু ইবাদত নির্ধারণ করেছেন, যা আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্য বাড়িয়ে দিবে, ঈমানী শক্তি বৃদ্ধি পাবে এবং আমলনামায় অধিক সাওয়াব লেখা হবে।
আল্লাহ আমাদের জন্য প্রবর্তন করেছেন যাকাতুল ফিতর: যার বিস্তারিত আলোচনা পূর্বে করা হয়েছে।
তিনি আমাদের জন্য প্রবর্তন করেছিন ‘তাকবীর’: রমযানের সময় পূর্ণ হওয়ার পর সূর্য ডোবার পর ঈদের চাঁদ উঠা থেকে শুরু করে ঈদের সালাত আদায় পর্যন্ত তাকবীর পাঠ করা।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَلِتُكۡمِلُواْ ٱلۡعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُواْ ٱللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَىٰكُمۡ وَلَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُونَ ١٨٥ ﴾ [البقرة: ١٨٥]
‘যাতে তোমরা গণনা পূরণ করো এবং তোমাদের হেদায়াত দান করার দরুন আল্লাহ তা‘আলার মহত্ব বর্ণনা করো (তাকবীর বলো) আর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে পারো।’ {সূরা আল-বাকারাহ্‌, আয়াত: ১৮৫}
তাকবীরের পদ্ধতি হলো: অধিকহারে নিম্নের এ তাকবীর পড়া:
الله أكبر الله أكبر لا إِله إِلاَّ الله والله أكبر الله أكبر ولله الحمد
আর সুন্নাত হচ্ছে, পুরুষগণ মসজিদে, বাজারে এবং ঘরে সকল জায়গায় উচ্চস্বরে তাকবীর দিবে, আল্লাহর মহত্বের ঘোষণা দেওয়া, তাঁর ইবাদত ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য।
আর মহিলারা তাদের স্বর নিচু করে তাকবীর দিবে। যেহেতু তার নিজেদেরকে ও নিজেদের কণ্ঠস্বরকে গোপন করার জন্য আদিষ্ট হয়েছে।
কতইনা সুন্দর ঈদের দিনে মানুষের অবস্থা। তাদের সিয়াম সাধনার মাস শেষে তারা সর্বত্র তাকবীর ধ্বনী দ্বারা আল্লাহর বড়ত্ব ও মহত্ব প্রকাশ করে এবং তারা আল্লাহর তাকবীর, প্রশংসা ও একত্ববাদের ঘোষণা দিয়ে আকাশ-বাতাশ মুখরিত করে তোলে। তারা আল্লাহর রহমতের আশাবাদী এবং তাঁর আযাবের ভয়ে শংকিত !!
অনুরূপভাবে আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তা‘আলা ঈদের দিন তাঁর বান্দাদের জন্য ঈদের সালাত প্রবর্তন করেছেন; যা মহান আল্লাহর যিকির বা স্মরণকে পূর্ণতা প্রদান করে। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাঁর উম্মতের নারী-পুরুষ সবাইকে এ আদেশ দিয়েছেন। আর নির্দেশ শিরোধার্য। কারণ,
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَأَطِيعُواْ ٱلرَّسُولَ وَلَا تُبۡطِلُوٓاْ أَعۡمَٰلَكُمۡ ٣٣﴾ [محمد: ٣٣]
‘হে ঈমানদারগণ! তেমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। তোমাদের আমলসমূহকে নষ্ট করো না।’ {সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ৩৩}
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদের ঈদের সালাত আদায়ের জন্য ঈদগাহে যেতে বলেছেন। যদিও তাদের জন্য ঈদের সালাত ছাড়া অন্যান্য সালাত ঘরে পড়াই উত্তম। যা প্রমাণ করে যে ঈদগাহে নারীদের উপস্থিতি একান্তভাবে কাম্য।
* উম্মে আতিয়্যাহ্‌ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বর্ণনা করেন:
أَمَرَنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، أَنْ نُخْرِجَهُنَّ فِي الْفِطْرِ وَالْأَضْحَى، الْعَوَاتِقَ، وَالْحُيَّضَ، وَذَوَاتِ الْخُدُورِ، فَأَمَّا الْحُيَّضُ فَيَعْتَزِلْنَ الصَّلَاةَ، وَيَشْهَدْنَ الْخَيْرَ، وَدَعْوَةَ الْمُسْلِمِينَ، قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ إِحْدَانَا لَا يَكُونُ لَهَا جِلْبَابٌ، قَالَ: لِتُلْبِسْهَا أُخْتُهَا مِنْ جِلْبَابِهَا
‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যাতে আমরা যুবতী, ঋতুবর্তী এবং পর্দানশীনা নারীদেরকে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আদ্বহাতে সালাতের উদ্দেশ্যে বের করি। তবে ঋতুবতী নারীগণ সালাতে অংশ গ্রহণ করবে না। ঈদগাহে এক পাশে থাকবে, কল্যাণ প্রত্যক্ষ করবে এবং দো‘আয় শরীক হবে। তিনি বলেন, আমি আরজ করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের প্রত্যেকের জিলবাব বা বোরকা নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন, সে তার বোনের বোরকা নিয়ে হলেও ঈদের সালাতে শরীক হবে।’
সুন্নাত হচ্ছে, ঈদুল ফিতরের সালাতে যাওয়ার পূর্বে খেজুর খাওয়া। তিন, পাঁচ বা ততোধিক বেজোড় সংখ্যায়। কারণ,
* আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لاَ يَغْدُو يَوْمَ الفِطْرِ حَتَّى يَأْكُلَ تَمَرَاتٍ وَيَأْكُلُهُنَّ وِتْرًا
‘রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরের সালাতে খেজুর না খেয়ে বের হতেন না এবং তিনি বেজোড় সংখ্যায় হিসাব করে খেতেন।’
অনুরূপ আরও সুন্নাত হচ্ছে, ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া। কেননা,
* আলী ইবন আবী তালেব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন,
مِنَ السُّنَّةِ أَنْ تَخْرُجَ إِلَى العِيدِ مَاشِيًا
‘সুন্নাত হলো, ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া।’
আরও সুন্নাত হচ্ছে, পুরুষগণ সৌন্দর্য অবলম্বন করবেন এবং সবচেয়ে সুন্দর পোশাক পরে সজ্জিত হবে। যেমন,
* সহীহ বুখারীতে ‘আব্দুল্লাহ ইবন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,
أَخَذَ عُمَرُ جُبَّةً مِنْ إِسْتَبْرَقٍ تُبَاعُ فِي السُّوقِ، فَأَخَذَهَا، فَأَتَى بِهَا رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، ابْتَعْ هَذِهِ تَجَمَّلْ بِهَا لِلْعِيدِ وَالوُفُودِ، فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّمَا هَذِهِ لِبَاسُ مَنْ لاَ خَلاَقَ لَهُ
‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু একটি রেশমী পোশাক বাজার থেকে এনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এটা ক্রয় করে ঈদের দিন এবং মেহমানের উপস্থিতিতে ব্যবহার করুন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রেশমী কাপড়ের দরুণ অসন্তুষ্ট হলেন এবং বললেন: রেশমী পোশাক ওই সকল ব্যক্তিদের জন্য যারা আখেরাতের কিছুই পাবে না।’
পুরুষের জন্য রেশমী পোশাক বা স্বর্ণলঙ্কার ব্যবহার বৈধ নয় বিধায রাসূল এ কথা বলেছেন। এর থেকে বুঝা যায় যে, অন্য সুন্দর পোষাক পরা সুন্নাত।
পুরুষদের জন্য কোনো প্রকার রেশমী কাপড় এবং কোনো ধরনের স্বর্ণালঙ্কার পরিধান করা জায়েয নেই। কারণ এগুলো উম্মতে মুহাম্মাদীর পুরুষদের জন্য হারাম।
তবে নারীগণ, ঈদগাহে সাজ-সজ্জাহীন, আতর ব্যবহার ছাড়া, পূর্ণ পর্দাসহ যাবে। কারণ তাদেরকে বাইরে বের হওয়ার সময় উলঙ্গপনা, সৌন্দর্য প্রদর্শন এবং সুঘ্রাণ ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং গোপনীয়তা ও পর্দার আদেশ করা হয়েছে।
ঈদের সালাত বিনয়াবনত ও একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ভয়-ভীতি সহকারে আদায় করবে। বেশি বেশি করে আল্লাহর যিকর করবে এবং দো‘আ পড়বে। তাঁর রহমতের আশা ও আযাবের ভয় করবে। ঈদগাহে সবাই একত্রিত হওয়ার বিষয়টিকে কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহর সামনে হাশরের মাঠে মহা অবস্থানস্থলে একত্রিত হওয়ার সাথে তুলনা করে তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে। আর এ ঈদগাহ মাঠে মানুষের মধ্যকার মর্যাদার তারতম্যকে আখেরাতের সেদিন বড় ধরনের তারতম্য হবে সেটাও স্মরণ করবে।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ٱنظُرۡ كَيۡفَ فَضَّلۡنَا بَعۡضَهُمۡ عَلَىٰ بَعۡضٖۚ وَلَلۡأٓخِرَةُ أَكۡبَرُ دَرَجَٰتٖ وَأَكۡبَرُ تَفۡضِيلٗا ٢١ ﴾ [الاسراء: ٢١]
‘হে নবী! আপনি লক্ষ্য করুন, আমরা কিভাবে তাদের একদলকে অন্যের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি, আখিরাত তো অবশ্যই মর্যাদায় মহত্তর ও শ্রেষ্ঠত্বে বৃহত্তর।’ {সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ২১}
আর প্রত্যেকে যেন রমযানের মত আল্লাহর বড় নেয়ামত প্রাপ্তি এবং তিনি যে এতে বান্দাকে সালাত, সিয়াম, কুরআন তিলাওয়াত, সাদকা ইত্যাদি ইবাদত করা সহজ করে দিয়েছেন সে জন্য আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করে। কারণ তা দুনিয়া ও তার মধ্যে যা আছে তা থেকেও উত্তম।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ قُلۡ بِفَضۡلِ ٱللَّهِ وَبِرَحۡمَتِهِۦ فَبِذَٰلِكَ فَلۡيَفۡرَحُواْ هُوَ خَيۡرٞ مِّمَّا يَجۡمَعُونَ ٥٨ ﴾ [يونس: ٥٨]
‘বলুন, ‘এটা আল্লাহর অনুগ্রহে ও তাঁর দয়ায়; কাজেই এতে তারা যেন আনন্দিত হয়।’ তারা যা পুঞ্জীভূত করে তার চেয়ে এটা উত্তম।’ {সূরা ইউনুস, আয়াত: ৫৮}
কারণ, ঈমান ও সওয়াবের আশায় রমযানের সিয়াম ও কিয়াম গুনাহ মাফের ও পাপ থেকে মুক্তির অন্যতম উপায়। সুতরাং মুমিনগণ রমযান মাস পেলে খুশি হয়। আর দুর্বল ঈমানদার রমযান মাস পূর্ণ হলে খুশি হয়; কারণ সে সাওম থেকে মুক্তি পেয়েছে যা তার উপর ভারী ছিল এবং যা নিয়ে তার অন্তর সংকীর্ণ ছিল। আর এ দু’দলের মধ্যে পার্থক্য যে বিরাট তা স্পষ্ট।
হে আমার ভাই সকল! রমযান মাস শেষ হয়ে গেল। কিন্তু মুমিনের আমল তো মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শেষ হবে না।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَٱعۡبُدۡ رَبَّكَ حَتَّىٰ يَأۡتِيَكَ ٱلۡيَقِينُ ٩٩ ﴾ [الحجر: ٩٩]
‘আপনি আপনার প্রভুর ইবাদত করুন, আপনার মৃত্যু আসা পর্যন্ত।’ {সূরা হিজর, আয়াত: ৯৯}
* তিনি আরো বলেন:
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِۦ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنتُم مُّسۡلِمُونَ ١٠٢ ﴾ [ال عمران: ١٠٢]
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর যথাযথ তাকওয়া অবলম্বন কর। আর তোমরা মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।’ {সূরা আলে-ইমরান, আয়াত: ১০২}
* আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَمَلُهُ …
‘মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করে, তখন তার আমল বন্ধ হয়ে যায়।’
এখানে একমাত্র মৃত্যুকেই মানুষের আমলের পরিসমাপ্তি ধরা হয়েছে। সুতরাং রমযান মাসের সাওম শেষ হলেও ঈমানদারের আমল সিয়াম পালনের দ্বারাই বন্ধ হয়ে যাবে না; কারণ সিয়াম তো তারপরও প্রতি বছর থাকবে। আর আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা। যেমন,
* সহীহ মুসলিমে আবূ আইয়ূব আনসারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
مَنْ صَامَ رَمَضَانَ ثُمَّ أَتْبَعَهُ سِتًّا مِنْ شَوَّالٍ، كَانَ كَصِيَامِ الدَّهْرِ
‘যে ব্যক্তি রমযানে সিয়াম পালন করবে, অতঃপর শাওয়ালের আরো ছয়টি সিয়াম পালন করবে, সে সারা বছর সিয়াম রাখার সমতুল্য সাওয়াব প্রাপ্ত হবে।’
এ ছাড়া প্রতি মাসে তিনটি করে সিয়াম পালন করা: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সম্পর্কে বলেন,
ثَلَاثٌ مِنْ كُلِّ شَهْرٍ، وَرَمَضَانُ إِلَى رَمَضَانَ، فَهَذَا صِيَامُ الدَّهْرِ كُلِّهِ
‘প্রতি মাসে তিনটি এবং এক রমযানের পর অন্য রমযান সিয়াম পালন করা সারা বছর সিয়াম পালনের সমান।’
* অনুরূপ আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
أَوْصَانِي خَلِيلِي صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِثَلاَثٍ… صِيَامِ ثَلاَثَةِ أَيَّامٍ مِنْ كُلِّ شَهْرٍ
‘আমাকে আমার বন্ধু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনটি বিষয়ে অসিয়ত করেছেন।… এর মাঝে উল্লেখ করলেন: প্রতি মাসে তিন দিন সিয়াম পালন।
তবে উত্তম হচ্ছে, এ তিন দিনের সাওম أيام الْبِيض অর্থাৎ চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে হওয়া। কারণ,
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবূ যর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বললেন:
يَا أَبَا ذَرٍّ، إِذَا صُمْتَ مِنَ الشَّهْرِ ثَلَاثَةَ أَيَّامٍ فَصُمْ ثَلَاثَ عَشْرَةَ، وَأَرْبَعَ عَشْرَةَ، وَخَمْسَ عَشْرَةَ
‘হে আবূ যর! তুমি যখন প্রতি মাসে তিনদিন সিয়াম পালন করবে তখন তা ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে পালন করবে।’
* অনুরূপভাবে সহীহ মুসলিমে এসেছে, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আরাফার দিনের সিয়ামের ফযীলত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে, তিনি উত্তর দিলেন, ‘তা এক বছরের আগের গুনাহ ও এক বছরের পরের গুনাহের কাফ্ফারাস্বরূপ।’ আর তাঁকে আশুরার সিয়াম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, ‘তা পূর্বের এক বছরের গুনাহ মাফ করে।’ আর প্রতি সোমাবারের সিয়াম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি বললেন, ‘সোমবার আমি জন্মগ্রহণ করেছি ও সোমবার নবুওয়াত প্রাপ্ত হয়েছি এবং সোমবার আমার ওপর কুরআন নাযেল হয়েছে।’
* তাছাড়া সহীহ মুসলিমে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে জিজ্ঞেস করা হলো,
َأَيُّ الصِّيَامِ أَفْضَلُ بَعْدَ شَهْرِ رَمَضَانَ؟ فَقَالَ: صِيَامُ شَهْرِ اللهِ الْمُحَرَّمِ
‘রমযানের পরে কোন মাসে সিয়াম পালন উত্তম? তিনি উত্তর দিলেন, আল্লাহর মাস মুহাররমের সিয়াম।’
* বুখারী ও মুসলিমে ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
مَا رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اسْتَكْمَلَ صِيَامَ شَهْرٍ قَطُّ إِلَّا رَمَضَانَ، وَمَا رَأَيْتُهُ فِي شَهْرٍ أَكْثَرَ صِيَامًا مِنْهُ فِي شَعْبَانَ
‘আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রমযান ছাড়া অন্য কোনো সময় পূর্ণ এক মাস সিয়াম পালন করতে দেখি নি। তেমনি শাবান মাস ছাড়া অন্য মাসে অধিক নফল সিয়াম পালন করতে দেখে নি।’
* অন্য শব্দে এসেছে, ‘তিনি শা‘বানের অল্পকিছু ছাড়া পুরোটারই সাওম পালন করতেন।’
* ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে অপর বর্ণনায় আছে,
إنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَتَحَرَّى صِيَامَ الِاثْنَيْنِ وَالْخَمِيسِ
‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সপ্তাহে সোমবার ও বৃহস্পতিবার সিয়াম পালন করার ব্যাপারে যতœবান ছিলেন।’ এ হাদীসটি আবু দাউদ ব্যতীত ছয় গ্রন্থকারের বাকী সবাই সংকলন করেছেন। আবু দাউদে তা উসামা ইবন যায়েদ থেকে বর্ণিত।
* আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
تُعْرَضُ الأَعْمَالُ يَوْمَ الِاثْنَيْنِ وَالخَمِيسِ، فَأُحِبُّ أَنْ يُعْرَضَ عَمَلِي وَأَنَا صَائِمٌ
‘বনী আদমের আমল সপ্তাহে সোমবার ও বৃহস্পতিবার আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়। আমার আমল সিয়াম অবস্থায় পেশ হওয়া আমি পছন্দ করি।’
রমযান মাস শেষ হওয়ার দ্বারা রাত জাগরণ কিন্তু শেষ হয়ে যায় না; বরং বছরে প্রত্যেক রাতে নফল সালাত ও তাহাজ্জুদ পড়ার মাধ্যমে রাতের কিয়াম শরীয়তে অনুমোদিত। আর আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামে কথা ও কাজ দ্বারা সারা বছর তাহাজ্জুদ সালাত আদায়ের বিষয়টি প্রমাণিত।
* সহীহ বুখারীতে মুগীরাহ ইবন শু‘বা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيَقُومُ لِيُصَلِّيَ حَتَّى تَرِمَ قَدَمَاهُ، فَيُقَالُ لَهُ، فَيَقُولُ: أَفَلاَ أَكُونُ عَبْدًا شَكُورًا
‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে এত অধিক নফল সালাত আদায় করতেন যে, তাঁর পা মুবারক ফুলে যেত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, আমি কি শুকরগুজার বান্দা হব না?’
* অনুরূপ আব্দুল্লাহ ইবন সালাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
أَيُّهَا النَّاسُ، أَفْشُوا السَّلَامَ، وَأَطْعِمُوا الطَّعَامَ، وَصَلُّوا بِاللَّيْلِ وَالنَّاسُ نِيَامٌ تَدْخُلُونَ الجَنَّةَ بِسَلَامٍ
‘হে লোকসকল! তোমরা সালামের প্রসার কর, খাদ্য খাওয়াও, আর যখন মানুষ ঘুমে থাকে তখন রাতে নফল সালাত আদায় কর, তাহলে তোমরা শান্তির সাথে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।’
* অনুরূপ আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
َأَفْضَلُ الصَّلَاةِ، بَعْدَ الْفَرِيضَةِ، صَلَاةُ اللَّيْلِ
‘ফরয সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হলো রাতের (তাহাজ্জুদ) সালাত।’
আর রাতের সালাতে সব ধরনের নফল এবং বিতর অন্তর্ভুক্ত। রাতের সালাত দু’ দু’ রাকাত করে আদায় করতে থাকবে। সময় শেষ হওয়ার ভয় হলে এক রাকাত মিলিয়ে বিতর পড়ে নেবে। অথবা চতুর্থ আসরে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে সেভাবেও পড়া যেতে পারে।
* বুখারী ও মুসলিমে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا، حِينَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الآخِرُ فَيَقُولُ: مَنْ يَدْعُونِي فَأَسْتَجِيبَ لَهُ، مَنْ يَسْأَلُنِي فَأُعْطِيَهُ، مَنْ يَسْتَغْفِرُنِي فَأَغْفِرَ لَه
‘আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রতি রাতে এক তৃতীয়াংশ বাকী থাকতে (শেষ রাতে) প্রথম আসমানে অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন, আমাকে কে ডাকবে যে আমি তার ডাকে সাড়া দেব? আমার কাছে চাওয়ার মত কে আছে যে আমি তাকে দান করবো? কে আছে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে যে আমি তাকে ক্ষমা করে দেব।’
তাছাড়া রয়েছে, দৈনিক ১২ রাকাত সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। চার রাকাত জোহরের পূর্বে ও দু’রাকাত পরে। দু’রাকাত মাগরিবের পর। দু’রাকাত ইশার পর ও দু’রাকাত ফজরের সালাতের পূর্বে।
* উম্মে হাবীবা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে শুনেছি,
مَا مِنْ عَبْدٍ مُسْلِمٍ يُصَلِّي لِلَّهِ كُلَّ يَوْمٍ ثِنْتَيْ عَشْرَةَ رَكْعَةً تَطَوُّعًا، غَيْرَ الفَرِيضَةِ، إِلَّا بَنَى اللهُ لَهُ بَيْتًا فِي الْجَنَّةِ
‘যদি কোনো মুসলিম বান্দা ফরয ছাড়া বার রাকাত সুন্নাত সালাত প্রতিদিন আদায় করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করেন।’
আরও রয়েছে পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাত আদায়ের পর কিছু যিকর। এ যিকর করতে আল্লাহ তাঁর কিতাবে নির্দেশ দিয়েছেন, অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ فَإِذَا قَضَيۡتُمُ ٱلصَّلَوٰةَ فَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ قِيَٰمٗا وَقُعُودٗا وَعَلَىٰ جُنُوبِكُمۡۚ ﴾ [النساء: ١٠٣]
‘অতঃপর যখন তোমরা সালাত সম্পন্ন কর, তখন দণ্ডায়মান, উপবিষ্ট ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ কর।’ {সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১০৩}
* অনুরূপভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ফরয সালাত থেকে সালাম ফিরাতেন, তখন তিনবার ইস্তেগফার করতেন। অতঃপর এ দো‘আ পড়তেন:
اللهُمَّ أَنْتَ السَّلَامُ وَمِنْكَ السَّلَامُ، تَبَارَكْتَ ذَا الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ
‘হে আল্লাহ! আপনিই শান্তি আর আপনার কাছ থেকেই আসে শান্তি; আপনি বড়ই বরকতময় হে সম্মান ও প্রতিপত্তির অধিকারী’।
* রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন,
مَنْ سَبَّحَ اللهَ فِي دُبُرِ كُلِّ صَلَاةٍ ثَلَاثًا وَثَلَاثِينَ، وَحَمِدَ اللهَ ثَلَاثًا وَثَلَاثِينَ، وَكَبَّرَ اللهَ ثَلَاثًا وَثَلَاثِينَ، فَتْلِكَ تِسْعَةٌ وَتِسْعُونَ، وَقَالَ: تَمَامَ الْمِائَةِ: لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ غُفِرَتْ خَطَايَاهُ وَإِنْ كَانَتْ مِثْلَ زَبَدِ الْبَحْرِ
‘যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরয সালাতের পর ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ ও আল্লাহু আকবার ৩৩ বার মোট ৯৯ বার। সর্বশেষে ১০০ পূর্ণ করতে বলবে:
لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
তাহলে তার গুনাহ সমুদ্র ফেনা পরিমাণ হলেও আল্লাহ তা মাফ করে দেবেন।’
সুতরাং হে আমার ভাইগণ! আপনারা পূণ্যের কাজে বেশি করে আত্মনিয়োগ করুন। পাপ ও গুনাহ থেকে বেঁচে থাকুন। যাতে আপনাদের পার্থিব জীবন সুখময় হয় আর মৃত্যুর পর চিরস্থায়ী শান্তির অধিকারী হতে পারেন।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿مَنۡ عَمِلَ صَٰلِحٗا مِّن ذَكَرٍ أَوۡ أُنثَىٰ وَهُوَ مُؤۡمِنٞ فَلَنُحۡيِيَنَّهُۥ حَيَوٰةٗ طَيِّبَةٗۖ وَلَنَجۡزِيَنَّهُمۡ أَجۡرَهُم بِأَحۡسَنِ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ٩٧ ﴾ [النحل: ٩٧]
‘পুরুষ ও নারীদের মধ্য থেকে যে ঈমানসহ সৎকর্ম করে, আমরা তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং তাদেরকে তাদের কার্যের উত্তম পুরস্কার দেব।’ {সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৯৭}
হে আল্লাহ! আপনি আমাদের ঈমানের ওপর মজবুত রাখুন এবং আমলে সালেহ করার তাওফীক দিন। হায়াতে তায়্যিবাহ দান করুন। আমাদেরকে পুণ্যবান ব্যক্তিদের সঙ্গী বানান।
আর সকল প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য, যিনি সৃষ্টিকুলের রব। আল্লাহ সালাত ও সালাম পেশ করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবীগণের ওপর।
উৎসঃ quranalo.wordpress.com

No comments:

Post a Comment

Download AsPDF

Print Friendly and PDFPrint Friendly and PDFPrint Friendly and PDF
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...