Sunday 7 June 2015

সুস্বাগত মাহে রমযান

 



সুস্বাগত মাহে রমযান 

বাড়িতে বিশেষ কোনো বিশেষ মেহমান আসার তারিখ থাকলে আমরা পূর্ব থেকেই নানা প্রস্তুতি নেই। ঘরদোর পরিষ্কার করি। বিছানাপত্র সাফ-সুতরো করি। পরিপাটি করি বাড়ির পরিবেশ। নিশ্চিত করি মেহমানের যথাযথ সম্মান ও সন্তুষ্টি রক্ষার সার্বিক ব্যবস্থা। তারপর অপেক্ষা করতে থাকি মেহমানকে সসম্মানে বরণ করে নেবার জন্য। আমাদের দুয়ারেও আজ কড়া নাড়ছে এক বিশেষ অতিথি। এমন অতিথি যার আগমনে সাড়া পড়ে যায় যমীনে ও আসমানে! আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায় সমগ্র সৃষ্টি জগতে! আল্লাহর হাবীবের মুখেই শুনুন সে কথা-
« إذا كَانَ أَوَّلُ ليْلَةٍ من شَهرِ رَمَضَانَ صُفِّدَتِ الشَّياطِينُ ومَرَدَةُ الجِنِّ، وغُلِّقَتْ أبوَابُ النَّارِ فَلَمْ يُفْتَحْ منْهَا بَابٌ، وفُتِحَتْ أَبوَابُ الجَنَّةِ فلمْ يُغْلَقْ منْها بَابٌ، ويُنَادِي مُنَادٍ: يا بَاغِيَ الخَيرِ: أَقْبِلْ، ويا بَاغِيَ الشَّر: أَقْصِرْ، ولله عُتَقَاءُ مِنَ النَّار وذَلكَ كُلَّ لَيْلَةٍ » .
যখন রমযানের প্রথম রাত্রি আগমন করে শয়তান এবং অবাধ্য জিনদের শৃঙ্খলিত করা হয়জাহান্নামের সকল দরোজা বন্ধ করে দেয়া হয়খোলা রাখা হয় না কোন দ্বারজান্নাতের দুয়ারগুলো অর্গলমুক্ত করে দেয়া হয়বদ্ধ রাখা হয় না কোন তোরণ। এদিকে একজন ঘোষক ঘোষণা করেন, হে পুণ্যের অনুগামীঅগ্রসর হও। হে মন্দ-পথযাত্রী থেমে যাও আবার অনেক ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। আর এমনটি করা হয় রমযানের প্রতি রাতেই’[1]
   
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাই রমযান আসার পূর্ব থেকেই রমযানের জন্য প্রস্তুতি নিতেন। শাবান মাসে অধিকহারে নফল রোযা পালনের মাধ্যমে তিনি রমযানে সিয়াম সাধনার আগাম প্রস্তুতি নিতেন  পূর্বানুশীলন করতেন। তদুপরি তিনি সাহাবীদেরকে রমযানের শুভাগমনের সুসংবাদ দিতেন। তাঁদেরকে শোনাতেন রমযানের ফযীলতের কথা। তাঁরা যেন রমযানে ইবাদত-বন্দেগীতে বেশি করে আত্মনিয়োগ করতে পারেন। নেকী অর্জনে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে প্রত্যয়ী হন। আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিততিনি বলেন,  
أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لِأَصْحَابِهِ يُبَشِّرُهُمْ : « قَدْ جَاءَكُمْ رَمَضَانُ شَهْرٌ مُبَارَكٌ افْتَرَضَ اللهُ عَلَيْكُمْ صِيَامَهُ، يُفْتَحُ فِيهِ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ، وَيُغْلَقُ فِيهِ أَبْوَابُ الْجَحِيمِ، وَيُغَلُّ فِيهِ الشَّيَاطِينُ، فِيهِ لَيْلَةٌ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ مِنْ حُرِمَ خَيْرَهَا فَقَدْ حُرِمَ» .
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সঙ্গী-সাথীদের এ মর্মে সুসংবাদ শোনাতেনতোমাদের সমীপে রমযান মাস এসেছে। এটি এক মোবারক মাস। আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের ওপর এ মাসের রোযা ফরজ করেছেন। এতে জান্নাতের দ্বার খোলা হয়। বন্ধ রাখা হয় জাহান্নামের দরোজা। শয়তানকে বাঁধা হয় শেকলে। এ মাসে একটি রজনী রয়েছে যা সহস্র মাস হতে উত্তম। যে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হল সে যেন যাবতীয় কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হল’[2]
সুতরাং আমাদের কর্তব্য হলএ মাস আসার আগেই এর যথার্থ মূল্যায়নের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। নরবে এসে নরবে চলে যাওয়ার আগেই এ মহান অতিথির যথাযথ সমাদর করা। এ মাস যেন আমাদের বিপক্ষে দলীল না হয়ে দাঁড়ায় সে জন্য প্রস্তুতি সম্মন্ন করা। কারণ মাসটি পেয়েও যে এর উপযুক্ত মূল্য দিল নাবেশি বেশি পুণ্য আহরণ করতে পারল না এবং জান্নাত লাভ ও জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণের পরোয়ানা পেল নাসে বড় হতভাগ্য। সবচে’ ভয়ংকর ব্যাপার হলো এমন ব্যক্তি আল্লাহর ফেরেশতা ও খোদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বদ দুর অধিকারী। কারণ এমন ব্যক্তির ওপর জিবরীল আলাইহিস সালাম লানত করেছেন আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সঙ্গে আমীন’ বলেছেন! কেননা হাদীসে এসেছেআবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিততিনি বলেন,
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ - صلى الله عليه وسلم - ارْتَقَى الْمِنْبَرَ فَقَالَ :« آمِينَ آمِينَ آمِينَ ». فَقِيلَ لَهُ : يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا كُنْتَ تَصْنَعُ هَذَا؟ فَقَالَ :« قَالَ لِى جَبْرَئِيلُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ : رَغِمَ أَنْفُ عَبْدٍ دَخَلَ عَلَيْهِ رَمَضَانُ فَلَمْ يُغْفَرْ لَهُ فَقُلْتُ آمِينَ ، ثُمَّ قَالَ : رَغِمَ أَنْفُ عَبْدٍ ذُكِرْتَ عِنْدَهُ فَلَمْ يُصَلِّ عَلَيْكَ فَقُلْتُ آمِينَ ، ثُمَّ قَالَ : رَغِمَ أَنْفُ عَبْدٍ أَدْرَكَ وَالِدَيْهِ أَوْ أَحَدَهُمَا فَلَمْ يَدْخُلِ الْجَنَّةَ فَقُلْتُ آمِينَ ».
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা মিম্বরে আরোহণ করলেন অতপর বললেনআমীনআমীন আমীন জিজ্ঞেস করা হলোহে আল্লাহর রাসূলএটা আপনি কী করলেনতিনি বললেনজিবরীল আমাকে বললেনওই ব্যক্তির নাক ধূলিধুসরিত হোক যার সামনে রমযান প্রবেশ করলো অথচ তাকে ক্ষমা করা হলো না আমি শুনে বললামআমীন (আল্লাহ কবূল করুন) এরপর তিনি বললেনওই ব্যক্তির নাক ধূলিধুসরিত হোক যার সামনে আপনার কথা আলোচিত হয় তথাপি সে আপনার ওপর দরূদ পড়ে না তখন আমি বললামআমীন (আল্লাহ কবূল করুন) অতপর তিনি বললেনওই ব্যক্তির নাক ধূলিধুসরিত হোক যে তার পিতামাতা বা তাঁদের একজনকে পেল অথচ সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারলো না তখন আমি বললামআমীন (আল্লাহ কবূল করুন)[3]
রমযানকে স্বাগত জানানোর ক্ষেত্রে সুন্নত হলরমযানের চাঁদ দেখে নিম্নের দু‘আটি পাঠ করা আবদুল্লাহ ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিততিনি বলেনরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন চাঁদ দেখতেনতখন তিনি বলতেন,   
اللَّهُمَّ أَهِلَّهُ عَلَيْنَا بِالْيُمْنِ وَالإِِيمَانِ ، وَالسَّلامَةِ وَالإِِسْلامِ ، رَبِّي وَرَبُّكَ اللَّهُ.
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিন ইউমনি ওয়াল-ঈমান ওয়াস-সালামাতি ওয়াল-ইসলামরাব্বী ওয়া রব্বুকাল্লাহ
অর্থ : হে আল্লাহ আপনি একে আমাদের ওপর বরকত ও ঈমানের সঙ্গে এবং সুস্থতা ও ইসলামের সঙ্গে উদিত করুনতোমার এবং আমার রব হলেন আল্লাহ[4]
অতপর একে স্বাগত জানানোর সর্বোত্তম উপায়রমযানকে সকল গুনাহ থেকে বিশেষ তাওবার সঙ্গে গ্রহণ করা। কারণ এটাতো তাওবারই মৌসুম। এ মাসে তাওবা না করলে তাওবা করবে কবেঅনুরূপভাবে রমযানকে স্বাগত জানানো ইবাদাতে দ্বিগুণ চেষ্টাদান-সাদাকাকুরআন তিলাওয়াতজিকির-ইস্তেগফার এবং অন্যান্য নেক আমল অধিক পরিমাণে করার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে। এবং এ দুআর মাধ্যমে- হে আল্লাহআমাদেরকে তোমার সন্তুষ্টি মত রোযা রাখার এবং তারাবীহ আদায় করার তাওফীক দাও।
তাই আসুন আমরা এ মহান অতিথিকে বরণ করে নিয়ে এ মাসের দিন-রাত্রিগুলো এমন আমালের মধ্য দিয়ে কাটানোর প্রস্তুতি নেই যা আমাদেরকে আল্লাহ তাআলার প্রিয় করে তুলবে।  আমরা যেন সেসব লোকের দলে অন্তর্ভুক্ত না হই যারা রসনা তৃপ্তির রকমারি আয়োজন ও সালাত বরবাদ করার মাধ্যমে রমযানকে স্বাগত জানায়। আমরা যেন সেই লোকদের অন্তর্ভুক্ত না হই যারা রমযান পাওয়ার পরও আল্লাহর কাছে মাগফিরাত না পেয়ে নিজেকে আল্লাহর ফেরশতা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বদ দুআর যোগ্য বানায় আল্লাহ তাআলা আমাদের কবুল করুন। আমীন





[1]তিরমীযী : ৬৮২; ইবন মাজা : ১৬৪২ইবন হিব্বান : ৩৪৩৫ সহীহুত-তিরমিযীতে শায়খ আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
[2]নাসায়ী : ২৪২৭; মুসনাদ আহমাদ : ৮৯৭৯; শুআবুল ঈমান : ৩৩২৪ শায়খ আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।   
[3]বুখারী, আল-আদাবুল মুফরাদ : ৬৪৬; শায়খ আলবানী হাদীসটিকে হাসান সহীহ বলেছেন। সহীহ ইবন খুযাইমাহ : ১৮৮৮; বাইহাকী : ৮২৮৭।  
[4]তিরমিযী : ৩৪৫১শায়খ আলবানী সহীহ বলেছেন। মুসনাদ আহমদ : ১৩৯৭। সহীহ ইবন হিব্বান : ৮৮৮।     
____________________________________________________________________________________________________________

লেখক : আলী হাসান তৈয়ব
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব

No comments:

Post a Comment

Download AsPDF

Print Friendly and PDFPrint Friendly and PDFPrint Friendly and PDF
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...