Monday 20 October 2014

মাযার ও কবরের উদ্দেশ্যে কুরবানী, মান্নত ও হাদীয়া পেশ করা এবং এগুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শন



মাযার ও কবরের উদ্দেশ্যে কুরবানী, মান্নত ও হাদীয়া পেশ করা এবং এগুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শন
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিরকের দিকে নিয়ে যাওয়ার সকল পথ বন্ধ করে দিয়েছেন। আর এ সকল পথ হতে উম্মাতকে কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন। এসবের মধ্যে প্রথম হলো কবরের বিষয়টি। তাই তিনি কবর যিয়ারতের এমন নীতিমালা প্রণয়ন করেছেন, যাতে লোকজন কবরপূজা ও কবরবাসীদের ব্যাপারে যে কোন প্রকার বাড়াবাড়ি থেকে বেঁচে থাকতে পারে। তন্মধ্যে :

১. তিনি আওলীয়া ও পূন্যবান লোকদের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা থেকে নিষেধ করেছেন। কেননা এ ধরনের বাড়াবাড়ি করতে করতে মানুষ তাঁদের ইবাদাতে ও উপাসনায় লিপ্ত হয়। 
তিনি বলেন:
إيَّاكُمْ وَالْغُلُوفَإنَّماَ أهْلَكَ مَنْ قَبْلَكُمْ الْغُلُوُّ.
'বাড়াবাড়ি করা থেকে বিরত থাক। কেননা তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করার ফলে ধ্বংস ও বিনাশ হয়ে গিয়েছে'[১]
لَا تَطْرُوْنِيْ كَمَا أطْرَتِ النَّصَارَى ابنَ مَرْيَمَ إنَّمَا أنَا عَبْدٌ فَقُوْلُوا عَبْدُ الله وَرَسُولُه.
আমার ব্যাপারে তোমরা বাড়াবাড়ি করো না, যে ভাবে নাসারাগণ মরিয়ম পুত্র ঈসার ব্যাপারে করেছিলো। কেননা আমি শুধু একজন বান্দা। অতএব, আমাকে আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল হিসাবে অভিহিত করো। [২]

২. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরের উপর সৌধ স্থাপন করা থেকে নিষেধ করেছেন। 
যেমন: 
আবুল হাইয়াজ আল আসাদী থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন: আলী বিন আবু তালিব রাদি আল্লাহু আনহু আমাকে বলেন যে, আমি কি তোমাকে সেই দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করব না, যে দায়িত্ব দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে প্রেরণ করেছিলেন? তা হলো যেখানেই প্রতিমা ও ভাস্কার্য দেখবে ভেঙ্গে ফেলবে এবং যেখানেই সুউচ্চ কবর দেখবে সমান করে দেবে'[৩]

অনুরূপ ভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরে চুনকাম করা ও সৌধ তৈরী করা থেকে নিষেধ করেছেন। জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: 
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরের উপর বসা ও সৌধ তৈরী করা থেকে নিষেধ করেছেন। [৪]

৩. কবরের পাশে নামায পড়া থেকেও তিনি সতর্ক করেছেন। 
আয়েশা রাদি আল্লাহু আনহা বলেন: 
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মৃত্যু কালীন রোগ শয্যায় চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে নিতেন। যখন এতে কষ্ট লাগতো তখন মুখ থেকে চাদর সরিয়ে নিতেন। এমতাবস্থায় তিনি বলেছিলেন ''ইয়াহুদী ও নাসারাদের উপর আল্লাহর লা'নত বর্ষিত হোক। কারণ তারা তাদের নবীদের কবরগুলোকে মসজিদ তথা সিজদার স্থান বানিয়ে নিয়েছে।'' তাদের এসব কাজ- কর্ম থেকে তিনি স্বীয় উম্মাতকে সতর্ক করে দিয়েছেন। লোকেরা তাঁর কবরকে সিজদাগাহ বানাবে এ আশংকা যদি না থাকতো তাহলে তাঁর কবর উন্মুক্ত করে দেয়া হতো। [৫]
ألَا وَإنَّ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ كَانُوا يَتَّخِذُوْنَ قُبُوْرَ أنْبِيَائهِمْ مَسَاجِدَ ألَا فَلَا تتخِذُوا الْقُبُوْرَ مَسَاجِدَ- فَإنِّيْ أنْهَاكُمْ عَنْ ذَلِكَ.
জেনে রাখ, তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির লোকেরা নিজেদের নবীদের কবরসমূহকে মাসজিদ বানিয়ে নিত। সাবধান, তোমরা কবরসমূহকে মাসজিদ তথা সিজদার স্থান বানাবে না। আমি তোমাদেরকে তা থেকে নিষেধ করছি। [৬]

কবরকে মাসজিদ বানানোর অর্থ হলো কবরের পাশে নামায পড়া, যদিও কবরের উপর কোন মসজিদ তৈরী না করা হয়। সুতরাং যে কোন স্থানকেই নামাযের জন্য নির্দিষ্ট করা হবে তাই মাসজিদ বলে গণ্য হবে। 
যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
جُعِلَتْ لِيَ الأرْضُ مَسْجِداً وَطُهُوْراً.
সকল যমীনকে আমার জন্য সিজদার স্থান ও পবিত্র বানিয়ে দেয়া হয়েছে। [৭]

আর যদি কবরের উপর মাসজিদ বানানো হয় সেটা আরো ভয়াবহ ব্যাপার।

অধিকাংশ লোকই এসব ব্যাপারে শরীয়তের খেলাফ করেছে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সব বিষয় থেকে নিষেধ করেছেন তাতে লিপ্ত হয়েছে। ফলে তারা শিরকে আকবার তথা বড় শিরকী কাজে ব্যাপৃত হয়ে গেছে। আর কবরের উপরে মাসজিদ, মাযার ও মাকাম বানিয়ে নিয়েছে, যাতে শিরকে আকবারের সকল প্রকার কাজ-কর্মের চর্চা করা হচ্ছে। যেমন কবরের উদ্দেশ্যে যবেহ করা হচ্ছে, কবরবাসীদের কাছে দোয়া চাওয়া হচ্ছে ও তাদের সাহায্য ও মদদ প্রার্থনা করা হচ্ছে এবং তাদের উদ্দেশ্যে মান্নত প্রভৃতি করা হচ্ছে।

আল্লামা ইবনুল কাইয়েম রা. বলেন: যে ব্যক্তি কবরসমূহের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাত, তাঁর আদেশ- নিষেধ ও তাঁর সাহাবাদের আদর্শ এবং আজকাল মানুষ যেসব কাজ করে থাকে এতদুভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করতে চায়, সে মূলত: এর একটিকে অন্যটির বিপরীত ও প্রতিকূল দেখতে পাবে এমনভাবে যে, এদু'টি বিষয়ে কখনো সামঞ্জস্য বিধান করা যেতে পারেনা।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরে নামায পড়া থেকে নিষেধ করেছেন। অথচ এরা কবরের পাশে নামায পড়ে। তিনি কবরকে মাসজিদ বানাতে নিষেধ করেছেন। অথচ এরা কররের উপর মাসজিদ বানাচ্ছে এবং আল্লাহর ঘরের অনুকরণে তার নাম দিচ্ছে দরগাহ। তিনি কবরে প্রদীপ জ্বালাতে নিষেধ করেছেন। অথচ এরা কবরে প্রদীপ জ্বালানোর উদ্দেশ্যে জায়গা পর্যন্ত ওয়াকফ করে থাকে। তিনি কবরকে ঈদ উৎসবের স্থান বানাতে নিষেধ করেছেন। অথচ এসব লোক কবরস্থানকে ঈদ উৎসব ও কুরবানীর স্থানে পরিণত করেছে এবং ঈদে যেমন তারা একত্রিত হয় তেমন, বরং তার চেয়েও বেশী তারা কবরের উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়।

তিনি কবরসমূহকে সমান করে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন: 
ইমাম মুসলিম তাঁর সহীহ গ্রন্থে আবুল গ্রন্থে আবুল হাইয়াজ আল আসাদী থেকে বর্ণনা করেন যে, আলী বিন আবু তালেব রাদি আল্লাহু আনহু তাকে বলেন- আমি কি তোমাকে সেই দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করব না, যে দায়িত্ব দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে প্রেরণ করেছিলেন? তা হলো যেখানেই প্রতিমা ও ভাস্কর্য দেখবে ভেঙ্গে ফেলবে এবং যেখানেই সুউচ্চ কবর দেখবে সমান করে দেবে।

সহীহ মুসলিমের আরেকটি বর্ণনায় সুমামাহ বিন শুফাই বলেন: 
আমরা রোম দেশের বুরুদেস নামক স্থানে ফাদালাহ বিন উবায়েদ এর সাথে ছিলাম। সেখানে আমাদের এক সাথী মারা গেলেন। তার দাফন কার্যের সময় ফাদালাহ তার কবর সমান করে দেবার হুকুম দিলেন। অতঃপর বললেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে শুনেছি যে, তিনি কবরকে সমান করে দেবার হুকুম দিয়েছেন।

কবরের ভক্ত এসব লোকেরা প্রচন্ডভাবে এ দু'টো হাদীসের বিরোধিতা করছে। এবং বসতগৃহের মতই কবরকে উঁচু করছে ও এর উপর গম্বুজ তৈরী করছে। ইবনুল কাইয়েম আরো বলেন: দেখুন, কবরের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা কিছু অনুমোদন করেছেন ও ইতিপূর্বে উল্লেখিত যে সব কিছু থেকে নিষেধ করেছেন এবং এসব লোকেরা যা কিছু আইনসিদ্ধ করছে- এতদুভয়ের মধ্যে কী বিরাট পার্থক্য। নিঃসন্দেহে এতে অনেক বিপর্যয় রয়েছে যা গুণে শেষ করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার।

এরপর তিনি এসব বিপর্যয়ের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে পরিশেষে বলেন: রাসূূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবর যিয়ারতের অনুমতি দিয়ে এ ব্যাপারে যে নিয়ম নীতি প্রণয়ন করেছেন, তা শুধু আখিরাতকে স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং কবরবাসীর জন্য দোয়া, রহমত কামনা, ইস্তেগফার ও তার মুক্তির জন্য প্রার্থনার মাধ্যমে তার উপকার করার উদ্দেশ্যেই করেছেন। এর ফলে যিয়ারতকারী নিজের ও মৃতের উভয়েরই কল্যাণ সাধন করছে। পক্ষান্তরে কবরপন্থী এই মুশরিকগণ পুরো ব্যাপারটাকেই পাল্টে দিয়েছে এবং দ্বীনকে বদলে দিয়েছে। মৃতের সাথে আল্লাহর শরীক করা, মৃতের কাছে ও মৃতের অসীলায় দোয়া করা, তার কাছে স্বীয় হাজাত পূরণের প্রার্থনা করা, তার কাছে বরকত চাওয়া, ও শত্রুর বিরুদ্ধে তার কাছে সাহায্যের আবেদন ইত্যাদি বিষয়গুলোকে তারা যিয়ারতের উদ্দেশ্যে বানিয়ে নিয়েছে। এসবের মধ্যে যদি কোন ক্ষতি নেই বলে ধরে নেয়াও হয়, তা সত্বেও শরীয়ত প্রণীত দোয়া রহমত কামনা, ও ইস্তেগফার ইত্যাদি কাজের বরকত থেকে তো তারা বঞ্চিত হয়।[৮]

এদ্বারা এটাই প্রতিভাত হয় যে,মাযারের উদ্দেশ্যে মান্নত ও কুরবানী করা বড় শিরক। কবরের উপর কোন ইমারত তৈরী না করা ও মাসজিদ না বানানোর যে আদর্শ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছিল তার পরিপন্থী আমল করাই হলো এর মূল কারণ। কেননা যখনই কবরের উপর গম্বুজ নির্মাণ করা হয় এবং পাশে মাসজিদ ও মাযার তৈরী করা হয় তখনই জাহেল ও অজ্ঞ লোকেরা ভাবতে শুরু করে যে, কবরবাসীগণ উপকার ও ক্ষতি দুই-ই করতে পারেন। আর যে তাদের কাছে সাহায্য চায় তারা তাকে সাহায্য করেত পারেন এবং তাদের কাছে গেলে তারা হাজাত ও প্রয়োজন পুরা করেন। এজন্যই তারা কবরবাসীদের উদ্দেশ্যে মান্নত ও কুরবানী পেশ করে। যার ফলশ্রুতিতে আল্লাহর পরিবর্তে প্রতিমারূপে এই সব কবরের আজ উপাসনা করা হচ্ছে। অথচ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রার্থনা করেছিলেন:
اللهُمَّ لَا تَجْعَلْ قَبْرِيْ وَثَناً.
'হে আল্লাহ! আমার কবরকে এমন প্রতিমায় পরিণত করো না যার উপাসনা করা হয়।[৯]

আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এজন্যেই এই দোয়া করেছিলেন যে তাঁর কবর ছাড়া অনেক কবরেই এ ধরনের অবস্থা দেখা দিতে পারে। প্রকৃত পক্ষে মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশেই এ ব্যাপারটি ঘটেছে। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে দোয়া করেছিলেন সে দোয়ার বরকতেই আল্লাহ তাঁর কবরকে শিরকের পংকিলতা থেকে রক্ষা করেছেন। যদিও কিছু সংখ্যক জাহেল ও কুসংস্কারচ্ছন্ন লোক তাঁর মাসজিদে কখনো কখনো তার হেদায়াতের খেলাপ কাজ করে ফেলে। কিন্তু তারা তার কবর পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না কেননা তাঁর কবর তাঁর ঘরের অভ্যন্তরে, মাসজিদের অন্তর্গত নয় এবং সেটি চারদিকে দেয়াল দিয়ে ঘেরা। যেমন আল্লামাহ ইবনুল কাইয়্যেম তার 'নুনিয়া' কাব্যগ্রন্থে বলেন:

''তাঁর দোয়া রাব্বুল আলামীন করেছেন কবুল
তিনটি প্রাচীর দিয়ে ঘিরেছেন নির্ভুল''
সমাপ্ত
--------------------------------------------------------------------------------
[১] আহমাদ, রিতমিযী, ইবনে মাজাহ।
[২] বুখারী।
[৩] মুসলিম।
[৪] মুসলিম।
[৫] বুখারী, মুসলিম।
[৬] মুসলিম।
[৭] বুখারী।
[৮] ইগাসাত্থল লাহফান, ১ম খন্ড২১৪-২১৫-২১৭।
[৯] মুয়াত্তা মালেক ও মুসনাদে আহমেদ।
_________________________________________________________________________________

লেখক : সালেহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান
تأليف: صالح بن فوزان الفوزان
অনুবাদ : মুহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
مراجعة : محمد منظور إلهي
সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব

No comments:

Post a Comment

Download AsPDF

Print Friendly and PDFPrint Friendly and PDFPrint Friendly and PDF
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...