অধিকাংশ আলেমের মতে অযু ব্যতীত মুসহাফ/ কুরআনুল কারিম
স্পর্শ করা বৈধ নয়। ইমাম আবু হানিফা[1],
মালিক[2],
শাফেয়ী[3],
আহমদ ইবনে হাম্বল[4] ও শায়খুল
ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ[5] প্রমুখগণ
এ মত পোষণ করেছেন। সাহাবিদের ফতোয়াও তাই ছিল। দলিল
হিসেবে তারা পেশ বলেন:
১. ইয়ামানের গভর্নর আমর ইবনে হাযম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম লিখে পাঠান:
«أَنْ لَا يَمَسَّ الْقُرْآنَ إِلَّا طَاهِرٌ».
“হাদিসটি মুত্তাসিল ও মুরসাল উভয়
সনদে বর্ণিত, ইমাম মালিক মুরসাল এবং ইমাম নাসায়ী ও ইবনে হিব্বান রহ. মুত্তাসিল বর্ণনা
করেছেন, প্রকৃতপক্ষে হাদিসটি মুরসাল, মুত্তাসিল নয়। ইমাম আহমদ রহ. বলেন: আশা করছি
হাদিসটি সহি। আসরাম বলেন: ইমাম আহমদ হাদিসটি দলিল হিসেবে পেশ করেছেন”।[7]
ইবনে হাজার রহ. ইবনে তাইমিয়ার কথা
সংক্ষেপ করে বলেন: এক দল ইমাম হাদিসটি সহি বলেছেন, সনদের বিবেচনায় নয়, প্রসিদ্ধির
বিবেচনায়”।[8]
তারা দ্বিতীয় দলিল হিসেব পেশ করেন কুরআনুল কারিমের নিম্নোক্ত আয়াত:
﴿ إِنَّهُۥ لَقُرۡءَانٞ كَرِيمٞ ٧٧ فِي كِتَٰبٖ مَّكۡنُونٖ ٧٨ لَّا يَمَسُّهُۥٓ
إِلَّا ٱلۡمُطَهَّرُونَ ٧٩ ﴾ [الواقعة: ٧٧، ٧٩]
“নিশ্চয় এটি মহিমান্বিত কুরআন, যা
সুরক্ষিত কিতাবে রয়েছে, কেউ তা স্পর্শ করবে না পবিত্রগণ ছাড়া”।[9]
দলিল হিসেবে এ আয়াত পেশ করা
দুরস্ত নয়, কারণ পূর্বাপর বিষয় থেকে স্পষ্ট যে, পবিত্রগণ ব্যতীত যে কিতাব কেউ
স্পর্শ করে না তা মাকনুন কিতাবে বিদ্যমান। মাকনুন কিতাব দ্বারা উদ্দেশ্য লাওহে মাহফুয”।[10] আর لَا يَمَسُّهُ এর সর্বনাম দ্বারা উদ্দেশ্য লাওহে মাহফুয, কারণ এটাই
তার নিকটতম বিশেষ্য। অর্থাৎ লাওহে মাহফুযে বিদ্যমান কুরআনুল কারিমকে পবিত্র
সত্ত্বা মালায়েকা বা ফেরেশতাদের ব্যতীত কেউ স্পর্শ করে না। অতএব দুনিয়ার জমিনে বিদ্যমান কুরআনুল
কারিম স্পর্শ করার জন্য অযু শর্ত এ আয়াত তার দলিল নয়।
ইবনুল কাইয়্যিম রহ. বলেন: “শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন: আসমানে বিদ্যমান সহিফাগুলো যখন পবিত্র সত্তা ব্যতীত কেউ স্পর্শ করে না, আমাদের হাতে বিদ্যমান সহিফাগুলো আমরা পবিত্র অবস্থা ব্যতীত স্পর্শ করব না, এটাই সতর্কতা, সাবধানতা ও মালায়েকাদের সাথে সামঞ্জস্যতা। বস্তুত এ আয়াত থেকে হাদিসটি নিঃসৃত হয়”।[11] অযু ব্যতীত কুরআনুল কারিম স্পর্শ করা যাবে না পক্ষে তারা তৃতীয় দলিল পেশ করেন সাহাবিদের আমল।
৩. ইসহাক ইবনে রাহওয়েহ বর্ণনা করেন, “নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবিগণ অযুসহ কুরআনুল কারিম স্পর্শ করতেন”।[12] শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন: সালমান ফারসি, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর ও অন্যান্য সাহাবি কুরআন স্পর্শ করার জন্য অযু শর্ত করতেন, কোনো সাহাবি তাদের বিরোধিতা করেননি”।[13]
কতক আলেম বলেন, কুরআনুল কারিম স্পর্শ করার জন্য অযু করা মোস্তাহাব, জরুরি নয়। এটা জাহেরিয়াদের মাযহাব, ইবনে হাযম রহ. এ মতকে শক্তিশালী করেছেন।[14] তাদের দলিল:
১. তিলাওয়াত করার জন্য মুসহাফ শরীফ স্পর্শ করা সাওয়াবের কাজ, দলিল ব্যতীত তাতে অযু শর্ত করা যাবে না, কারণ তখন যাদের অযু নেই তারা এ সাওয়াব থেকে মাহরূম হবে। আর প্রমাণিত যে, কুরআন ও সহি হাদিসে তার পক্ষে কোনো দলিল নেই, তাই কুরআন স্পর্শ করার জন্য অযু শর্ত করা যথাযথ নয়।[15]
২. আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বসরার প্রধান হিরাকলকে নিম্নোক্ত আয়াতসহ পত্র লিখেন:
﴿يَٰٓأَهۡلَ ٱلۡكِتَٰبِ تَعَالَوۡاْ إِلَىٰ كَلِمَةٖ سَوَآءِۢ بَيۡنَنَا وَبَيۡنَكُمۡ
أَلَّا نَعۡبُدَ إِلَّا ٱللَّهَ وَلَا نُشۡرِكَ بِهِۦ شَيۡٔٗا وَلَا يَتَّخِذَ بَعۡضُنَا
بَعۡضًا أَرۡبَابٗا مِّن دُونِ ٱللَّهِۚ فَإِن تَوَلَّوۡاْ فَقُولُواْ ٱشۡهَدُواْ بِأَنَّا
مُسۡلِمُونَ ٦٤ ﴾ [ال عمران: ٦٤]
‘হে কিতাবিগণ, তোমরা এমন কথার দিকে আস, যা আমাদের মধ্যে ও তোমাদের
মধ্যে সমান যে, আমরা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদত করব না। আর তার সাথে কোনো
কিছুকে শরীক করব না এবং আমাদের কেউ কাউকে আল্লাহ ছাড়া রব হিসাবে গ্রহণ করব না।
তারপর যদি তারা বিমুখ হয় তবে বল, ‘তোমরা সাক্ষী থাক যে, নিশ্চয় আমরা মুসলিম”।[16]
ইবনে হাযম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, খৃস্টানদের নিকট উক্ত আয়াতসহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পত্র প্রেরণ করা প্রমাণ করে অযু ও ইমান ব্যতীত কুরআনুল কারিম স্পর্শ করা বৈধ।[17]
উত্তর: এ হাদিস
সম্পর্কে জমহুর আলেমগণ বলেন, পত্রের আয়াত কুরআনুল কারিমের হুকুম রাখে না, তা নবী
সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বক্তব্যের অংশ, অথবা তাফসির গ্রন্থে বিদ্যমান
আয়াতের মত একটি আয়াত, যা অযু ব্যতীত স্পর্শ করা বৈধ।[18]
৩. মুসলিমরা তাদের বাচ্চাদের অযু ব্যতীত কুরআনুল কারিম স্পর্শ করার অনুমতি দিয়ে আসছেন, যদি অযু ব্যতীত কুরআনুল কারিম স্পর্শ করা হারাম হত তারা কখনো তার অনুমতি প্রদান করতেন না।
উত্তর: এ
যুক্তি সম্পর্কে জমহুর বলেন, প্রয়োজনের খাতিরে তারা অনুমতি প্রদান করেন, অযু
ব্যতীত বাচ্চাদের কুরআন পড়া নিষেধ করা হলে তারা কুরআন থেকে বিমুখ হবে, তাই
মুসলিমদের এ আমল দলিল হিসেবে পেশ করা যৌক্তিক নয়।
শায়খ উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহ প্রথম বলতেন অযু ব্যতীত কুরআন স্পর্শ করা বৈধ, পরবর্তীতে তিনি এ ফতোয়া থেকে প্রত্যাবর্তন করেন।
তার প্রথম বক্তব্য ছিল:
«أَنْ
لَا يَمَسَّ الْقُرْآنَ إِلَّا طَاهِرٌ».
“মুমিন ব্যক্তি ব্যতীত কেউ কুরআন
স্পর্শ করবে না”।[19]
তিনি ‘তাহির’ শব্দের অর্থ বলতেন মুমিন। পরবর্তীতে তিনি বলেন طاهرٌ শব্দের অর্থ মুমিন নয়, বরং পবিত্র ব্যক্তি, কারণ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো মুমিন ব্যক্তিকে ‘তাহির’ বলেননি। দ্বিতীয়ত অযুর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
তিনি ‘তাহির’ শব্দের অর্থ বলতেন মুমিন। পরবর্তীতে তিনি বলেন طاهرٌ শব্দের অর্থ মুমিন নয়, বরং পবিত্র ব্যক্তি, কারণ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো মুমিন ব্যক্তিকে ‘তাহির’ বলেননি। দ্বিতীয়ত অযুর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿مَا يُرِيدُ ٱللَّهُ لِيَجۡعَلَ عَلَيۡكُم مِّنۡ حَرَجٖ وَلَٰكِن يُرِيدُ لِيُطَهِّرَكُمۡ
٦﴾ [المائدة: ٦]
“আল্লাহ তোমাদের উপর কঠিন করতে
চান না, তবে তিনি তোমাদেরকে পবিত্র করতে চান”।[20]
অতএব ‘তাহির’ অর্থ পবিত্র, তাই কোনো ব্যক্তি পবিত্র অবস্থা ব্যতীত কুরআন স্পর্শ করবে না, তবে রোমাল, অথবা হাত মোজা অথবা মিসওয়াক দ্বারা কুরআনুল কারিমের পৃষ্ঠা উল্টানো বৈধ”। এটাই শায়খের সর্বশেষ ফতোয়া, তিনি বলেন:
অতএব ‘তাহির’ অর্থ পবিত্র, তাই কোনো ব্যক্তি পবিত্র অবস্থা ব্যতীত কুরআন স্পর্শ করবে না, তবে রোমাল, অথবা হাত মোজা অথবা মিসওয়াক দ্বারা কুরআনুল কারিমের পৃষ্ঠা উল্টানো বৈধ”। এটাই শায়খের সর্বশেষ ফতোয়া, তিনি বলেন:
«فالذي تَقَرَّرَ عندي أخيراً: أنَّه لا يجوز مَسُّ المصْحَفِ إلا
بِوُضُوء».
কুরআন স্পর্শ করার জন্য অযু শর্ত ফতোয়াই
সঠিক। বিশেষ করে পূর্বাপর সকল মনীষী তার উপর আমল করেছেন। ইবনে হাযম
রাহিমাহুল্লার দলিল খুব দুর্বল, তবে বাচ্চাদেরকে অযুর জন্য
বাধ্য করা, কিংবা অযু না থাকার অজুহাতে বড়দের কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত থেকে বিরত
খাতা বাঞ্ছনীয় নয়। কারণ, সবাই বলেছেন আড়াল দ্বারা মুসহাফ শরীফ স্পর্শ করা বৈধ। অতএব যত বেশী সম্ভব কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করুন, সর্বাবস্থায়
অযুর হালতে থাকার চেষ্টা করুন। যদি অযু না থাকে, কিংবা অযু করা সময় সাপেক্ষ বা
কষ্টকর হয়, তাহলে আড়ালসহ ধরে কুরআনুল কারিম তিলাওয়াত করুন। অসতর্কতা কিংবা বেখেয়ালে
কুরআনুল কারিমের সাথে শরীরের কোনো অংশের স্পর্শ হলে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চান, শরীরের
সাথে কুরআনুল কারিমের স্পর্শ হবে আশঙ্কায় তবুও দেখে তিলাওয়াত করা ছাড়বেন না। কারণ,
স্পর্শ হবে আশঙ্কায় তিলাওয়াত ত্যাগ করার তুলনায় তিলাওয়াতের সময় স্পর্শের পর তওবা
করা অনেক ভালো। বিশেষভাবে যেহেতু এতে
দ্বিমত রয়েছে, তাই সামান্য হলেও অযু করার বিষয়টি হালকা হয়।

[2] আশ-শারহুস সাগির:
(১/১৪৯), মাওয়াহিবুল জালিল ফি শারহি মুখতাসারিল খালিল: (১/৩০৩)
[3] মুগনিল মুহতাজ: (১/৩৬),
আল-মাজমু শারহুল মুহাজ্জাব: (২/৬৫)
[4] আল-ইনসাফ ফি মারিফাতির
রাজিহ মিনাল খিলাফ, লিল মুরদাওয়ি: (১/২২৩), শাহরু মুনতাহাল ইরাদাত: (১/৭৭)
[5] মাজমুউল ফতোয়া:
(২১/২৬৬)
[6] আল-মুয়াত্তা: (৫৩৪),
আবুদাউদ ফিল মারাসিল: (৯৩)
[7] আত-তিবইয়ান ফি আকসামিল
কুরআন: (পৃ.২২৯), আত-তালখিসুল হাবির: (৪/৫৮)
[8] আত-তালখিসুল হাবির:
(৪/৫৮)
[9] সূরা ওয়াকিয়াহ: (৭৭-৭৯)
[10] আত-তিবইয়ান ফি আকসামিল
কুরআন: (পৃ.২২৯)
[11] আত-তিবইয়ান ফি আকসামিল
কুরআন: (পৃ.২২৯)
[12] মাসায়েলুল ইমাম আহমদ ও
ইসহাক ইবনে রাহওয়েহ: (২/৩৪৫)
[13] মাজমুইল ফতোয়া:
(২১/২৬৬)
[14] আল-মুহাল্লাহ: (১/৯৫)
[15] আল-মুহাল্লা বিল আসার:
(১/৯৫)
[16] সূরা আলে-ইমরান: (৬৪)
[17] আল-মুহাল্লা বিল আসার:
(১/৯৮)
[18] আল-মুগনি লি ইবনে
কুদামাহ: (১/১০৯), নাইলুল আওতার: (১/২৬১)
[19] আল-মুয়াত্তা: (৫৩৪),
আবুদাউদ ফিল মারাসিল: (৯৩)
[20] সূরা মায়েদাহ: (৬)
____________________________________________________________________________________________________________
সূত্র: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব
No comments:
Post a Comment