==============================
নবুওতের যুগেই মুআবিয়ার উৎকর্ষতা প্রকাশ পায়; যদিও ইসলাম গ্রহণের দিক দিয়ে তিনি বহু মুহাজির ও আনসারের পিছনে ছিলেন। আল্লাহর রাসূল অহীর লেখক হিসাবে তার উপর আস্থা করেন। তাই তিনি আকাশ হতে অবতীর্ণ অহী লেখকের একজন। গর্বের জন্য এটাই যথেষ্ট।
মুআবিয়া রাসূল স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে হুনাইনের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। তিনি রাসূলুল্লাহ হতে একাধিক হাদীস বর্ণনা করেন যা স্বহীহাইন, সুনান সহ মাসানীদ গ্রন্থে বিদ্যমান এবং তার থেকে সাহাবা ও তাবেঈনদের একদল হাদীস বর্ণনা করেছেন। দুই হিদায়েতপ্রাপ্ত খলীফার যুগে তিনি আস্থা ও সম্মানের পাত্র ছিলেন এবং জিহাদ ও অন্য দায়িত্বভার প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আবু বাকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফতকালে –যদিও এই খেলাফতকাল সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ছিল- তিনি ইয়ামামার যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। ইবনু আসাকির বলেন: অনেকের ধারনা তিনিই মুসায়লামাকে হত্যা করেছিলেন। ইবনু কাসীর উক্ত ঘটনায় এই বলে টিপ্পনি করেছেন যে, হতেপারে তার হত্যায় তার সাথে অন্য কেউ শরীক ছিল। মুসায়লামাকে আঘাত করে একজন ওয়াহশী ব্যক্তি এবং তার মরদেহকে ঢেকে দেয় আবু দাজানা। [আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৮/১২৭]
ফারুক (রাযিয়াল্লাহু আনহুর) যুগে খলিফা তার মধ্যে নেতৃত্বের গুণ অনুভব করেন; যদিও তার বয়স কম ছিল। তিনি একটি এমন প্রদেশের নেতৃত্বের যোগ্য ছিলেন যেই প্রদেশটির বিশেষ গুরুত্ব ছিল। উমার (রাযি:) তাকে তার ভাই ইয়াযীদের মৃত্যুর পর সিরিয়ার গভর্নর নিযুক্ত করেন । আর মানুষেরা যখন এ সম্বন্ধে সমালোচনামূলক কথা-বার্তা বলেছিল, তখন উমার (রাযি:) বলেন: তার নেতৃত্বের ব্যাপারে আমাকে দোষারোপ করো না; কেন না আমি রাসূলুল্লাহর নিকট শুনেছি, তিনি বলেন: (হে আল্লাহ! তাকে সঠিক পথ প্রদর্শক ও হিদায়েতপ্রাপ্ত করো এবং তার দ্বারা অন্যকে হিদায়েত দাও)। [ইবনু কাসীর বলেন: এটি সূত্র বিচ্ছিন্ন বর্ণনা ইতিপূর্বের বর্ণনাটি এটিকে শক্তিশালী করে। আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৮/১৩২, কিন্তু হাদীসটি আহমাদ তাঁর মুসনাদে বর্ণনা করেছেন ৪/২১৬, তিরমিযী তাঁর সুনানে বর্ণনা করেছেন ৫/৬৭৮, ত্বাবারানী আল মুজাম আল আউসাতে বর্ণনা করেছেন ১/৩৮০, সহীহ হাদীস সিরিজে শাইখ আলবানী স্বহীহ বলেছেন ৪/৬১৫, দেখুন, ড. আব্দুল্লাহ আল খারআন কর্তৃক লিখিত আছারুল উলামা ফিল হায়াতিস সিয়াসিয়্যাহ ফিদ্ দাউলাহ আল্ উমাভিয়্যাহ, পৃ ৬২]
উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুর) যুগে রোম সম্রাজ্যকে ভীত ও শঙ্কিত করতে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে মুআবিয়ার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। ত্বাবারী ২৩ তম বছরের উল্লেখ্য ঘটনাবলীর আলোকে বর্ণনা করেছেন যে, মুআবিয়া সাইফার যুদ্ধ করেন এমনকি আমুরিয়া পর্যন্ত পৌছেঁ যান। সেই সময় তার সাথে ছিল সাহাবী উবাদাহ বিন সামিত, আবু আইয়্যুব আনসারী, আবু যার এবং শাদ্দাদ বিন আউস রাযিয়াল্লাহু আনহুম।
তার থেকে সম্মানিত ব্যক্তি কে হতে পারে, যাকে উমার (রাযি:) নেতৃত্ব দান করেন এবং যার নেতৃত্বে মর্যাদাবান সাহাবাদের এক দল উপস্থিত ছিলেন। বরং উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এই অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন যখন মুআবিয়া সিরিয়া প্রদেশের সীমান্তের গভর্নর হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। উমার (রাযি:) তাকে এতই ভালবাসতেন যে তিনি তাকে এই উপাধি দ্বারা সম্বোধন করতেন যে, এ হচ্ছে আরব সম্রাট। [আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৮/১৩৬]
আর যতদূর উসমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এর যুগের কথা তো সেই সময় তার মর্যাদা অন্যরকম ছিল। তিনি ইসলামী রাজত্বের সবচেয়ে বড় গভর্নর নিযুক্ত হোন। সেই সময় তার রাজত্বের সীমা বৃদ্ধি পায় এবং তার ক্ষমতাও উন্নিত হয়। ফলে সমগ্র সিরিয়ায় তার রাজত্ব কায়েম হয়। বরং খলীফা উসমান সিরিয়া প্রদেশের সাথে সাথে তাকে ফুরাত উপদ্বীপ এবং উভয় প্রদেশের সীমান্তেরও দায়িত্ব প্রদান করেন। [বেলাযুরী, ফতুহুল বুলদান: পৃ ১৮৭-১৮৮]
অত:পর উসমান (রাযি:) এর যুগে ২৮ তম হি: কিংবা তার পরে সাইপ্রাস দ্বীপ বিজয়ের কৃতিত্ব মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুরই রয়েছে। অনুরূপ ইসলামী নৌবাহিনী আবিষ্কারের কৃতিত্ব তারই রয়েছে, যার প্রস্তাব তিনি খলীফা উমারকে (রাযি:) দেন এবং এর জন্য তিনি পীড়াপীড়িও করেন। তিনি খলীফা উমারকে বলেন: “হিমস জনপদের একটি গ্রাম এমন আছে যে, যার বাসিন্দারা তাদের কুকুর ও মোরগরে আওয়াজ শুনতে পায়। (মুসলিম জনপদের অতি নিকটে অবস্থান করে কিন্তু মাঝে সমুদ্রপথ) কথাটি উমরের অন্তরে স্থান পায়। তাই খলীফা উমার আমর বিস আ’সকে পত্র লিখেন যেন সে সমুদ্র ও সমুদ্রে আরোহণকারীদের বর্ণনা দেয়। তারপর আমর উমারকে পত্র লিখে বলেন: আমি এক বিশাল সৃষ্টিকে দেখেছি তাতে ক্ষুদ্র সৃষ্টি আরোহণ করে। যদি তা ঝুকেঁ পড়ে তো অন্তর যেন ছিদ্র হয়ে যায় আর যদি চলতে লাগে তো বুদ্ধি দুড়ুম হয়ে যায়। তাতে বিশ্বাস হ্রাস পায় আর সন্দেহ বেশি হয়। তাতে তাদের অবস্থান কাঠের পোকার মত। হেলে পড়লে ডুবে যাবে আর পরিত্রান পেলে হাস্যজ্জ্বল হবে। উমার বিষয়টি অনুধাবন করেন এবং মুআবিয়াকে লিখেন.. আমি কি করে সেনাদলকে সেই পথে সফর করতে দেই। আল্লাহর কসম! রোম সম্রাজ্য যা কিছুর মালিক তার থেকে আমার নিকট একজন মুসলিমের মূল্য অনেক বেশী। তাই আমাকে এমন প্রস্তাব দেওয়া থেকে দূরে থাক। [তারিখ ত্বাবারী: ৪/২৫৮-২৫৯]
অত:পর মুআবিয়া (রাযি:) সামুদ্রিক অভিযানের চিন্তা-ভাবনা খলীফা উসমানের নিকট (রাযি:) পেশ করেন। এবং বরাবর এর তাগিদ দেন ফলে উসমান (রাযি:) তার শেষ সময়ে তা করার সংকল্প নেন। তিনি মুআবিয়াকে বলেন:লোকদের নির্বাচন করো না, তাদের মাঝে লটারি করো না বরং তাদের স্বাধীনতা দিবে। যে নিজ খুশিতে জিহাদ করতে চাইবে তাকে সাথে নিবে এবং তাকে সাহায্য করবে। অত:পর তিনি শাতিয়া ও সাইফার মাঝে পঞ্চাশটি সামুদ্রিক অভিযান চালান। তাদের কেউ ডুবে মারা যায়নি আর না কেউ দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়েছিল। [তারিখ ত্বাবারী: ৪/২৬০]
মুআবিয়া (রযি:) সামুদ্রিক অভিযানে অংশ নেন এবং এটা তার মর্যাদার মধ্যে গণ্য হয় যেমনটি স্বহীহ বুখারীতে এসেছে। [বুখারী নং ২৮৭৭] ইবনু হাজার হাদীসটির ব্যাখ্যায় বলেছেন: এবং মুআবিয়া প্রথম সেই ব্যক্তি যে সমুদ্রাভিযানে অংশ নেন আর তা ঘটে উসমানী খেলাফতের সময়কালে। [ফাতহুল বারী: ৬/৭৭]
ত্বাবারি মুআবিয়া (রাযি:) এর বিচক্ষণতা এবং মুসলিম প্রদেশের সংরক্ষণে তার আগ্রহের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন যে, তিনি সাইপ্রাসবাসীর সাথে সন্ধিকালে একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত সংযোগ করেন। তা ছিল, তাদের উপর জরুরি যে, তারা যেন মুসলিম শত্রু দমনে রোম থেকে তাদের দেশ পর্যন্ত যাত্রার অনুমতি দেয়। [তারিখ ত্বাবারী: ৪/২৬২]
খলীফা উসমানের যুগে মুআবিয়া (রাযি:) সম্মানিত ও জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব হিসাবে অবস্থান করেন। অত:পর মুসলিম বিরোধী ফেতনা তাদের খলীফাকে উদ্দেশ্য করে মাথাচাড়া দেয়। এই সময় মুআবিয়ার নিজস্ব অবস্থান প্রকাশ পায়। মনে হয় যেন তিনি কোনো বিপদের সংকেত অনুমান করতে পেরেছিলেন। তিনি উসমান (রাযি:) কে পরামর্শ দেন যে, তার উপর আক্রমণ হওয়ার পূর্বে তিনি যেন তার সাথে সিরিয়ায় গমন করেন। এ সময় উসমান (রাযি:) এই বলে ওজর পেশ করেন যে, তিনি রাসূল স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সান্নিধ্য ছাড়তে চান না; যদিও তার গর্দান কর্তন করা হয়। মুআবিয়া পরামর্শ দেন যে, সে সিরিয়া প্রদেশ হতে ফৌজ পাঠাতে চায়, যারা মদীনায় অবস্থান করবে এবং মদীনার উপর কোনো প্রকারের আক্রমন হলে তারা রুখে দাঁড়াবে। কিন্তু খলীফা উসমান তা নাকোচ করে দেন। সেই সময় মুআবিয়া বলেন: আল্লাহর কসম! হে আমীরুল মুমিনীন হয় আপনাকে চক্রান্ত করে গোপনে হত্যা করা হবে কিংবা আপনাকে অবশ্যই জিহাদ করতে হবে। খলীফা বলেন: আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট এবং তিনিই উত্তম প্রতিনিধি। [তারিখ ত্বাবারী:৪/৩৪৫]
মুআবিয়া (রাযি:) এর দূরদর্শিতা ঘটনাই প্রকাশ করে দিল এবং আল্লাহর ফয়সালা নির্ধারিত সময়ে সংঘটিত হল। খলীফা উসমান শহীদ হয়ে গেলেন। অত:পর আলী (রাযি:) খলীফা হলেন এবং সে সময় তিনিই খিলাফতের সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন এমনকি সাহাবাদের মধ্যে তিনিই সর্ব্বোত্তম ব্যক্তি ছিলেন। তারপর তিনি যখন খলীফা উসমান কর্তৃক নিয়োজিত গভর্নরদের বিচ্যুত করতে ইচ্ছা করলেন, যার মধ্যে মুআবিয়াও ছিল। তখন একদল সাহাবা যেমন মুগীরা বিন শুবা এবং আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস মুআবিয়াকে সিরিয়া প্রদেশে গভর্নর হিসাবে অব্যাহত রাখার পরামর্শ দেন। কারণ শামবাসীদের তিনি ব্যতীত অন্য কারো প্রতি সন্তুষ্ট হওয়া কষ্টকর ছিল।[তারিখ ত্বাবারী: ৪/৪৩৯] অন্যদিকে ইবনু উমার এবং ইবনু আব্বাস (রাযি:) আলী (রাযি:) এর পক্ষ হতে সিরিয়ার দায়িত্ব পালনে ওজর পেশ করেন। [তারিখ ত্বাবারী: ৪/৪৪০, সিয়ারু আলামিন নুবালা ২/২২৪]
এখান থেকে উম্মতের জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয় এবং আলী ও মুআবিয়ার মাঝে দ্বন্দ বাড়তে লাগে। এমনকি ৩৭ হিজরীতে সিফ্ফীনের যুদ্ধে দুই পক্ষের সেনাদল সম্মিলিত হয়। দীর্ঘ ঘটনা যা, বর্ণনা করার এটি স্থান নয়।
মতভেদ নির্ণয়, উত্তমকে প্রাধান্যদান, আলীকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান এবং মুআবিয়ার ক্ষেত্রে ওজর পেশ করত: সালাফদের কিছু সুন্দর মন্তব্য পেশ করার চেষ্টা করবো।
বায়হাক্বী ইমাম আহমদ রাহেমাহুল্লা হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন: খলীফাগণ হচ্ছেন: আবু বাকর, উমার, উসমান ও আলী। তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, আর মুআবিয়া? তিনি উত্তরে বলেন: আলীর যুগে আলী ছাড়া অন্য কেউ খেলাফতের অধিক যোগ্য ছিলেন না। আল্লাহ মুআবিয়ার প্রতি রহম করুক। [আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৮/১৪১]
উমার বিন আব্দুল আযীয হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি আল্লাহর রাসূলকে স্বপ্নে দেখেছি এমতাবস্থায় যে, তার নিকট আবু বাকর ও উমার বসে রয়েছেন। আমি তাকেঁ সালাম করলাম অত:পর বসে পড়লাম। আমি বসে ছিলাম ইতিমধ্যে আলী ও মুআবিয়াকে উপস্থিত করে উভয়কে একটি গৃহে প্রবেশ করানো হল এবং দরজা বন্ধ করে দেওয়া হল। আমি তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ আলী দ্রুত এ বলতে বলতে বেরিয়ে আসলনে যে, কা’বার রব্বের কসম! আমার বিচার করে দেওয়া হয়েছে। তারপর আবার হঠাৎ মুআবিয়া এ বলতে বলতে দ্রুত বেরিয়ে আসলনে যে, কা’বার রব্বের কসম! আমাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। [আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৮/১৪১]
আবু যুরআহ আর রাযী হতে বর্ণিত, তাকে এক ব্যক্তি বলল: আমি মুআবিয়াকে ঘৃণা করি। তিনি বললেন: কেন? সে বলল: কারণ সে আলীকে হত্যাকারী। তখন আবু যুরআহ তাকে বললেন: তোমার ধ্বংস হোক অবশ্যই মুআবিয়ার রব্ব দয়ালু এবং মুআবিয়ার প্রতিপক্ষ উদার। তাই উভয়ের মাঝে তোমার প্রবেশের কারণ কি? আল্লাহ উভয় হতে সন্তুষ্ট। [আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৮/১৪১]
সংক্ষিপ্তাকারে যেমনটি বহু সালাফ বলেছেন যখন তাদের আলী ও মুআবিয়ার মাঝে সংঘটিত বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হত, তখন তারা বলতেন: ( তাঁরা এক গোষ্ঠি ছিলেন যাঁরা পরলোক গমন করেছেন, তাদেঁর কৃতমর্ক সম্পর্কে তাঁরা জিজ্ঞাসিত হবেন এবং তোমরা তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে, তোমাদের তাদের কর্ম সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হবে না) [বাকারা/১৩৪]
অত:পর আল্লাহর দ্বিতীয় ফয়সালা উপস্থিত হল এবং আলী (রাযি:) কে খারেজীদের হাতে শহীদ করা হল। ইরাকবাসী আলী পুত্র হাসানের হস্তে তার পিতার খলীফা স্বরূপ বায়আত গ্রহণ করলেন। (তাকে নিজ শাসক হিসাবে গ্রহণ করে) কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে সে নিজ দায়িত্ব মুআবিয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিলেন। এমনটি করতে তাকে দুটি বিষয় অনুপ্রাণিত করেছিল:
এক: তার সম্পর্কে সেনাবাহিনীর মতভেদ করার আশঙ্কা যেমনটি তার পিতার ক্ষেত্রে করেছিল।
দুই: মুসলিমদের রক্তের হেফাযত, তাদের সংশোধন এবং মুসলিম ঐক্য অব্যাহত রাখার আগ্রহ। [দেখুন, ইবনুল আছীর, আল কামিল: ৩/২০৩-২০৪]
আর বিশেষ করে এই কারণেও যে তিনি তার নানা নবী স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে শুনেছিলেন, তিনি তার প্রসংশা করেন এবং বলেন: “আমার এই পুত্র অবশ্যই একজন সর্দার। আমার ধারণা এর মাধ্যমে আল্লাহ মুসলিমদের দুই বিশাল দলের মধ্যে আপোস করবেন”। [স্বহীহ বুখারী নং ২৭০৪]
হাসান চুপিচুপি আব্দুল্লাহ বিন জা’ফরের নিকট আপোসের আগ্রহ প্রকাশ করেন। [সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৩/২৬৫] মুআবিয়াও আপোসের চিন্তাধারা এবং মুলিমদের রক্তের হেফাযতের পদক্ষেপ থেকে দূরে ছিলেন না। স্বহীহ বুখারীতে এই মহৎ মীমাংসা, আলী পুত্র হাসানের শ্রেষ্ঠত্ব এবং মুআবিয়ার উৎকৃষ্টতার বর্ণনা রয়েছে। বুখারীর ভাষ্য নিম্নরূপ:
হাসান (বাসরী) (রাহে:) বর্ণনা করেছেন: আল্লাহর কসম! হাসান ইবনু আলী (রাযি:) পর্বত প্রমাণ সেনাদল নিয়ে মুআবিয়া (রা:) এর মুখোমুখী হলেন। আমর ইবনু আস (রা:) বললেন: আমি এমন সেনাদল দেখতে পাচ্ছি যারা প্রতিপক্ষকে হত্যা না করে ফিরে যাবে না। মুআবিয়া (রাযি:) তখন তাকে বললেন: (বর্ণনাকারী বলেন: আর মুআবিয়া ও আমর ইবনুল আস (রাযি:) উভয়ের মধ্যে মুআবিয়া (রাযি:) ছিলেন উত্তম ব্যক্তি- ‘হে আমর! এরা ওদের এবং ওরা এদের হত্যা করলে আমি কাকে দিয়ে লোকের সমস্যার সমাধান করব? তাদের নারীদের কে তত্ত্বাবধান করবে? তাদের দুর্বল ও শিশুদের কে রক্ষণাবেক্ষণ করবে? অত:পর তিনি কুরায়শের বানু আবদে শামস শাখার দুই ব্যক্তি ‘আব্দুর রহমান ইবনু সামুরাহ ও আব্দুল্লাহ বিন আমের বিন কুরাইয (রা:) কে হাসান (রাযি:) এর নিকট পাঠালেন। তিনি তাদের বললেন: তোমরা উভয়ে এক ব্যক্তির নিকট যাও এবং তার নিকট সন্ধির প্রস্তাব পেশ করো, তাঁর সঙ্গে আলোচনা কর। তাঁরা তাঁর নিকট গেলেন এবং তাঁর সঙ্গে কথা বললেন, আলাপ-আলোচনা করলেন। তখন হাসান ইবনু আলী (রা:)তাদের বললেন, আমরা আব্দুল মুত্তালিবের সন্তান, এই সম্পদ (বায়তুল মাল)আমরা পেয়েছি আর এরা রক্তপাতে লিপ্ত হয়েছে। তারা উভয়ে বললেন, [মুআবিয়া (রাযি:)]আপনার নিকট এরূপ বক্তব্য পেশ করেছেন। আর আপনার বক্তব্যও জানতে চেয়েছেন ও সন্ধি কামনা করেছেন। তিনি বললেন: এ দায়িত্ব কে নিবে? তারা তার জবাবে বললেন: আমরা এ দায়িত্ব নিচ্ছি। তাদের উভয়ের কাছে তিনি যাই তলব করলেন তারা প্রতিবারেই বললেন: এ দায়িত্ব আমরা নেব। অত:পর তিনি তার সঙ্গে সন্ধি করলেন। হাসান বাসরী (রহ:) বলেন: আমি আবু বাকরাহ (রা:) কে বলতে শুনেছি: রাসূলুল্লাহ স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আমি মিম্বরের উপর দেখেছি, হাসান বিন আলী (রাযি:) তাঁর পাশে ছিলেন। তিনি একবার লোকদের দিকে আরেকবার তার দিকে তাকাচ্ছিলেন আর বলছিলেন: আমার এ সন্তান একজন নেতা। সম্ভবত তার মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা মুসলমানদের দু’টি বড় দলের মধ্যে মীমাংসা করাবেন। [স্বহীহ বুখারী: সুলহ অধ্যায় নং (২৭০৪) ফিতান অধ্যায় নং (৭১০৯)]
হাদীসটি থেকে বুঝা যায় যে, মুআবিয়া তিনিই প্রথম মীমাংসার প্রস্তাব দেন, যেমনটি ইবনু হাজার বলেছেন। [আল ফাতহ:১৩/৬৩]
এই মহান আপোস ও এর অবস্থা এবং কেনই বা হাসান সন্ধি গ্রহণ করেছিলেন তা বিস্তারিত জানতে ত্বাবারী কর্তৃক স্বহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যেমনটি ইবনু হাজার বলেন। ইউনুস বিন ইয়াযীদ যুহরী হতে বর্ণনা করেছেন তিনি বলেন: আলী (রাযি:) ইরাকবাসীর নেতৃত্ব কায়স বিন সাআদ বিন উবাদাহকে দেন, তাদের সংখ্যা ছিল চল্লিশ হাজার, তারা সকলে মৃত্যু পর্যন্ত তার সাথে থাকার জন্য তার হাতে বায়আত করলেন। আলীকে হত্যা করা হলে তারা আলী পুত্র হাসানকে খলীফা মেনে তার নিকট অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন। তিনি যুদ্ধ পছন্দ করতেন না কিন্তু চাচ্ছিলেন যে, নিজের জন্য মুআবিয়াকে শর্ত দিবেন। তবে তিনি বুঝতে পারেন যে, কায়স বিন সাআদ আপোসের ব্যাপারে তার সমর্থন করবে না, তাই তিনি তাকে পদ থেকে অব্যাহতি দেন এবং আব্দুল্লাহ বিন আব্বাসকে গভর্নর নিযুক্ত করেন। সে নিজের জন্য শর্ত দেয় যেমন হাসান শর্ত দিয়েছিলেন। [আল ফাতহ: ১৩/৬৩]
ত্বাবারী যুহরী সূত্রে আপোসের ঘটনাকে বর্ণনা করেছেন, তাতে বর্ণিত হয়েছে, মুআবিয়া (রাযি:) লোকদের মাঝে খুতবা দিলেন। তারপর বললেন: হে হাসান! দাঁড়াও এবং জনগণের সাথে কথা বলো। তিনি সাক্ষী দিলেন তারপর বললেন: হে লোকেরা! আল্লাহ তা’আলা আমাদের পূর্বসুরীদের মাধ্যমে হিদায়েত দিয়েছেন এবং পরবর্তী লোকদের মাধ্যমে আমাদের রক্তপাত সংরক্ষণ করেছেন। অবশ্যই এ বিষয়ের একটি সময় রয়েছে আর পৃথিবী হচ্ছে পরিবর্তনশীল। [তারিখ ত্বাবারী: ৫/১৬৩, ফাতহ ১৩/৬৩]
যখন সন্ধি সম্পন্ন হয় এবং হাসান মুআবিয়ার নিকট বায়আত গ্রহণ করে, তখন মুআবিয়ার কাছে তারাও অঙ্গীকার নেয় যারা যুদ্ধ হতে দূরে ছিলে যেমন ইবনু উমার, সাআদ বিন আবী অক্কাস এবং মুহাম্মাদ বিন মুসলেমাহ..। [আল ফাতহ: ১৩/৬৩]
এভাবে সন্ধি স্থাপন হয়, মুসলিমদের রক্তপাত বন্ধ হয়, ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়, সমগ্র মুসলিমদের খলীফা হিসাবে মুআবিয়ার নিকট বায়আত করা হয়, (তাকেঁ খলীফা স্বীকার করা হয়) এবং এই বছরকে (৪০ হিজরী সন) ঐক্যের বছর নামকরণ করা হয়।
মুআবিয়া (রাযি:) এর মান-মর্যাদা, খেলাফতকালে তাঁর প্রচেষ্টা, ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা বিস্তৃতি, ইসলাম প্রচার প্রসারএবং ইসলাম শত্রুদের অন্তরে তাঁর ভয় হিসাবে যে সুখ্যাতি তাঁর রয়েছে, তাতে হাসান রাযিয়াল্লাহু আনহুরও অংশ রয়েছে। তিনি মুসলিম ঐক্য এবং ফেতনা দূরীকরণের কারণ ছিলেন। আল্লাহ তাদের উভয়ের প্রতি সন্তুষ্ট এবং রাসূল স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সকল সাথীদের প্রতি সন্তুষ্ট; যদিও তাদের অপছন্দ লাগে যাদের উদ্দেশ্য মন্দ; যদিও তাদের খারাপ লাগে যাদের অন্তর সঙ্কীর্ণ ও রোগাক্রান্ত তারা পূর্বাপর যেই হোক না কেন।
মুআবিয়া (রাযি:) ২০ বছর ধরে যেভাবে গভর্নরের দায়িত্বে সফলকাম হয়েছিলেন ঠিক সেভাবে খেলাফত কালেও সফলতা অর্জন করেছিলেন। অন্যায় ভাবে মুআবিয়াকে কিছু সম্প্রদায় যতই মন্দ বলুক না কেন। কিন্তু সাহাবাদের একদল যারা তাঁর সাথে জীবন যাপন করেছেন, তাঁর সিদ্ধান্ত, রাজনীতি এবং বুদ্ধিমত্ত্বাকে কাছে থেকে দেখেছেন তারা তাঁর প্রসংশা করেছেন। ন্যায়পরায়ণ ইতিহাসবিদগণ সেই সকল প্রশংসা নকল করেছেন এবং মুআবিয়াকে সেই স্থানে স্থান দিয়েছেন যার তিনি যোগ্য ছিলেন। তারা মুআবিয়া সম্পর্কে তাদের গ্রন্থসমূহে ভারসাম্যপূর্ণ সুষম প্রশংসা লিপিবদ্ধ করেছেন যেমন, ইবনু জারীর, ইবনুল আছীর, ইবনু কাসীর, যাহাবী এবং অন্যান্যরা। আল্লাহ তাদের সকলের উপর রহমত বর্ষন করুন।
মূল: ড সুলাইমান বিন হামাদ
হ্যাড অফ দ্যা ডিপার্টমেন্ট সিরাহ বিভাগ
অনুবাদ, আব্দুর রাকীব বুখারি মাদানী ।
No comments:
Post a Comment