Tuesday 5 July 2016

মসজিদে হারামের জুমার খুতবা: আইএসের ভ্রান্তির চিত্র


77076

মসজিদে হারামের জুমার খুতবা
আইএসের ভ্রান্তির চিত্র
শায়খ ড. সালেহ বিন আবদুল্লাহ বিন হুমাইদ
কোনো ভূমিকা ও পূর্বকথা ছাড়াই সব মুসলিম বিশেষ করে যুবসমাজের জন্য আইএস নামক বিপথগামী গোষ্ঠী সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছি। আঞ্চিলক ও আন্তর্জাতিক মদদপুষ্ট রক্তপিপাসু দুর্বৃত্ত দলটি যে অন্যায় পথ ও ভুল পন্থা অবলম্ব্বন করছে তা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কোনো ব্যক্তির কাছে অস্পষ্ট নয়। আলেমসমাজ ও সাধারণ মুসলিম সমাজমাত্রই জানে, সীমা লঙ্ঘনকারী খারেজি সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান চরিত্র হলো তারা অন্যান্য সাধারণ মুসলামানকে কাফের আখ্যায়িত করে, এমনকি সাহাবায়ে কেরামকেও তারা কাফের বলে বেড়ায়। ইসলামপন্থীদের হত্যা করে। পৌত্তলিকদের নিমন্ত্রণ জানায়। পথভ্রষ্ট আইএস গোষ্ঠীও খারেজিদের পথ ও মত অবলম্ব্বন করেছে। মুসলিম দেশ ও তার মুসলিম অধিবাসীকে কাফের বলে ঘোষণা করেছে। তাদের বিরোধিতাকারী সবার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এমনকি গোলযোগপূর্ণ অঞ্চলের নিরাপত্তায় নিয়োজিত রক্ষীবাহিনীর সঙ্গেও তারা লড়াইয়ে জড়িয়েছে। কেউ তাদের বিরোধিতা করলেই তাদের ওপর মুরতাদ ও কাফের হওয়ার হুকুম আরোপ করছে।
মানুষ তাদের কাছে কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত- হয়তো নিরেট কাফের অথবা মুরতাদ অথবা মোনাফেক। আর তাদের সরকারি মুখপাত্রের ভাষ্য অনুযায়ী মুরতাদের মাথা তাদের কাছে হাজারটা কাফের শত্রুর চেয়েও অধিক প্রিয়। অথচ বিশিষ্ট হক্কানি আলেম কাজী আবুল ওয়ালিদ বলেন, একজন মুসলিমের রক্ত প্রবাহে ভুল করার চেয়ে হাজারটা কাফেরকে ছেড়ে দেয়ার ভুলের চেয়ে হালকা। এখন এই দুই শরিয়ত ও ফতোয়ার মাঝে তুলনা করে দেখুন কারা সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ ভ্রষ্ট দলের অনুসারীরা গর্ব করে বলে, তাদের পানীয় হলো রক্ত, তাদের সহচর হলো খ-িত মস্তক। আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে এদের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করুন।

মুসলিম দেশগুলো ও গোলযোগকবলিত অঞ্চলগুলোতে এদের প্রবাহিত অবৈধ রক্তনদীর ক্ষেত্রে কেউ চিন্তা করলে, ফতোয়া প্রদানে তাদের হঠকারিতা ও বিচ্যুতি নিয়ে ভেবে দেখলে প্রকৃত মুসলমানদের প্রতি তারা কী রকম হিংসা-বিদ্বেষ, ঘৃণা ও ক্রোধ পোষণ করে তা অনুধাবন করতে পারবে। তাদের বিশ্বাস হচ্ছে, যে ব্যক্তি তাদের বিরোধিতা করবে সে যেন ইসলাম থেকে বের হওয়ার মতো কোনো অপরাধ করল। তাদের আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের ভাষা হলো, ‘যারা আমাদের বিপক্ষে লড়বে তারাই কাফের।’ এ ধরনের বিশ্বাস পোষণ করে তারা মনে করছে তারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী শাসন করছে। ইসলাম থেকে বের হয়ে যাওয়ার কারণগুলো মুসলমানের কাছে সুবিদিত। এ বিষয়ে মুসলিম আলেমদের আলোচনা খুবই গভীর। কোনো মুসলিমই একথা বলেনি যে, শুধু বিরোধিতা করলেই কাফের হয়ে যায়, বরং এটি চূড়ান্ত ভ্রষ্টতা, অজ্ঞতা, সীমা লঙ্ঘন ও বিচ্ছিন্নতাবাদিতা। রক্তপাত, ইসলাম থেকে বের হয়ে যাওয়া ও আল্লাহর বিধানের নামে এ ধরনের মারাত্মক ভ্রষ্টনীতির ব্যাপারে নীরব থাকা মোটেই সমীচীন নয়। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেন, ‘যে ব্যক্তি সাম্প্রদায়িক যুদ্ধচেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে লড়াই করে, বিরুদ্ধাচরণ করে, তার লড়াই হলো শয়তানের পথে লড়াইয়ের নামান্তর।’
এমন দলের বিরোধিতাকারীকে যারা কাফের-মুরতাদ হুকুম আরোপ করে, তারা তাহলে কত ভ্রষ্ট হতে পারে? তাদের বিভ্রান্তিকর নীতির নমুনা হলো- ‘যুদ্ধে লিপ্ত নয় এমন ব্যক্তি মুজাহিদের জন্য ফতোয়া দিতে পারবে না।’ তাদের শব্দের ঝংকার ও আকর্ষণ তাদের মর্মের ভুল সম্ব্বন্ধে বিভ্রান্ত করে দিয়েছে। ইসলামের যুদ্ধনীতির গৌরবময় সুদীর্ঘ ইতিহাসে কেউ এ ব্যাপারে এরকম নির্দেশ জারি করেননি। মুসলিম আলেমদের সবাই কি যুদ্ধের সময় সীমান্তে, রণক্ষেত্রে ও লড়াইয়ের অঙ্গনে ছিলেন? তারা যে যুদ্ধ করছে তা কি আল্লাহর পথে যুদ্ধ? তাদের প্রত্যেক মুজাহিদই কি আলেম? যারা এ ধরনের দাবি করছে তাদের মধ্যে কি জেহাদবিষয়ক আলেম আছে? যারা যুদ্ধে লিপ্ত নয় তারা কি নিরুপায় নয়? আল্লাহ তায়ালা তো মুজাহিদ ও যুদ্ধ থেকে বিরতদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘তিনি প্রত্যেককেই উত্তম প্রতিদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।’ (সূরা নিসা : ৯৫)।
আর এটা যদি জেহাদই হয়ে থাকে তবে তা কি ফরজে আইন? তারা কি সূরা তওবায় বর্ণিত সেই আয়াতগুলো ভুলে গেছে, যেখানে একই সূরায় একই উপলক্ষে কঠিনতম পরিস্থিতিতে সবাইকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে একটি দলকে গভীর জ্ঞান অন্বেষণে মনোনিবেশ করার কথা বলা হয়েছে? আল্লাহ তায়ালা জেহাদ প্রসঙ্গে বলেন, ‘তোমরা বের হয়ে পড় স্বল্প বা প্রচুর সরঞ্জামের সঙ্গে এবং জেহাদ করো আল্লাহর পথে নিজেদের মাল ও জান দিয়ে।’ (সূরা তওবা : ৪১)। আর দ্বীনের গভীর জ্ঞান অর্জন করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আর সব মোমিনের অভিযানে বের হওয়া সঙ্গত নয়। তাই তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হলো না, যাতে দ্বীনের জ্ঞান লাভ করে এবং সংবাদ দান করে স্বজাতিকে, যখন তারা তাদের কাছে প্রত্যাবর্তন করবে, যেন তারা বাঁচতে পারে।’ (সূরা তওবা : ১২২)।
তারা মসজিদকে পর্যন্ত তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। মিথ্যা প্রচারণা ও ভিত্তিহীন অপপ্রচার চালিয়ে তারা মুসলিম যুবকদের তাদের ভ্রান্ত মতাদর্শে দীক্ষিত করে মুসলিম জাতির বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছে। অভিজ্ঞ ইসলামী চিন্তাবিদ ও আলেমরা লক্ষ করে দেখছেন যে, আইএস হলো শরিয়তের বিধান লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে, শরিয়তের বক্তব্য অমান্য করা, সচেতন বিশেষজ্ঞ ওলামাদের দ্বারস্থ না হওয়া ও শরিয়তের অমর্যাদা করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে। এ হলো তাদের ভ্রষ্টতার সামান্য নমুনা মাত্র। যার আড়ালে রয়েছে ভয়ঙ্কর বাস্তবতা।
তাই হে যৌবন-উদ্দীপ্ত যুবসমাজ! তোমরা যারা সত্য ও মুক্তি প্রত্যাশী, এই বিভ্রান্ত দলটির প্রকৃত পরিচয়, তাদের নীতি ও পথ সম্পর্কে সচেতন হও। তারা তোমাদের যৌবনের আবেগ, উম্মাহর ভালোবাসা ও গৌরববোধকে ভুল খাতে কাজে লাগাতে চায়। উম্মাহর রক্ত, উম্মাহকে কাফের বলা ও শরিয়ত লঙ্ঘনের ভয়াবহ এ চক্রান্তের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করো।
২৯ শাওয়াল ১৪৩৬ হি. মসজিদে হারাম (কা’বা শরীফ) এ প্রদত্ত জুমার খুতবাটি সংক্ষেপে অনুবাদ করেছেন মাহমুদুল হাসান জুনাইদ

No comments:

Post a Comment

Download AsPDF

Print Friendly and PDFPrint Friendly and PDFPrint Friendly and PDF
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...