Thursday 13 June 2019

যারা বোরকা-পরিহিতা মহিলাদের নানা উপমা দিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে হাতি, ভূত, জীবন্ত তাবু’ ইত্যাদি বলে থাকে, তাদের বিকৃত মস্তিষ্কপ্রসূত ইসলাম-বিরোধী কুরুচিকর উপমা উল্লেখ করে তারা নারীর সম্ভ্রম ও পর্দার প্রতি আঘাত হানতে চায়।

গৃহ, ঘরঃ

আরবরা স্ত্রীকে ‘ঘর’ বলে থাকে। যেহেতু সেই সাধারণতঃ ঘরে থাকে। আর পুরুষ রুযী-রুটির সন্ধানে অধিকাংশ সময় বাইরে অবস্থান করে। যদিও অধিকাংশ মহিলাদের ঘর নেই। সে থাকে মায়ের বাড়িতে, নচেৎ শ্বশুর বাড়িতে। স্বামীর ঘর তার নিজস্ব না হলেও মহান আল্লাহর নির্দেশ,
{أَسْكِنُوهُنَّ مِنْ حَيْثُ سَكَنتُم مِّن وُجْدِكُمْ} (6) سورة الطلاق
এই নির্দেশের ফলেই সে গৃহে থাকার অধিকার পায় এবং গৃহের গৃহিণী হয়ে যায়। আর স্বামীর ঘর তার নিজের ঘর হয়ে যায়।
মহান আল্লাহ তাঁর কিতাবের অনেক জায়গায় মহিলাদের ব্যাপারে কিছু বলার সময় ঘরের কথা এলে ঘরকে স্ত্রীর সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে স্বামীর ঘরকে তার ঘর বলা হয়েছে।
যেমন মহান আল্লাহ ইউসুফ-যুলাইখার কাহিনীর বর্ণনায় বলেছেন,
{وَرَاوَدَتْهُ الَّتِي هُوَ فِي بَيْتِهَا عَن نَّفْسِهِ} (23) سورة يوسف
“সে যে স্ত্রীলোকের গৃহে ছিল সে তার কাছে (উপাচিকা হয়ে) যৌন-মিলন কামনা করল।” (ইউসুফ ও ২৩)
ইউসুফ (আলাইহিস সালাম)- মিসরের বাদশা আযীযের গৃহে পালিত হচ্ছিলেন। কিন্তু মহান আল্লাহ আযীযের গৃহ না বলে (তার) স্ত্রীলোকের গৃহ বলেছেন।
তিনি মহানবী (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর স্ত্রীদেরকে সম্বোধন করে বলেছেন,
{وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى وَأَقِمْنَ الصَّلَاةَ وَآتِينَ الزَّكَاةَ وَأَطِعْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا} (33) سورة الأحزاب
“তোমরা তোমাদের গৃহে অবস্থান কর এবং (প্রাক-ইসলামী) জাহেলী যুগের মত নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়িয়ো না। তোমরা নামায প্রতিষ্ঠা কর ও যাকাত প্রদান কর এবং আল্লাহ ও তার রসূলের অনুগতা হও; হে নবী-পরিবার! আল্লাহ তো কেবল তোমাদের মধ্য থেকে অপবিত্রতা দুর করতে চান। এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে চান।” (আহযাব : ৩৩)
তিনি আরো বলেছেন,
{وَاذْكُرْنَ مَا يُتْلَى فِي بُيُوتِكُنَّ مِنْ آيَاتِ اللَّهِ وَالْحِكْمَةِ إِنَّ اللَّهَ كَانَ لَطِيفًا خَبِيرًا} (34) سورة الأحزاب
“আল্লাহর আয়াত ও জ্ঞানের কথা যা তোমাদের গৃহে পঠিত হয়, তা তোমরা স্মরণ রাখ। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সমস্ত গোপন রহস্য জানেন, খবর রাখেন সর্ববিষয়ের। (আহযাব : ৩৪)
তিনি বলেছেন, 'তোমাদের গৃহে' অথচ গৃহ ছিল তাদের স্বামী মহানবী (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মালিকানাভুক্ত। তবুও গৃহের সম্পর্ক তাদের সাথে জোড়া হল কেন? যেহেতু স্বামীর গৃহ স্ত্রীর গৃহ। এ যেন প্রত্যেক পুরুষের নিকট একটি বার্তা দেওয়া হয়েছে যে, পুরুষ যদিও কাগজপত্রে গৃহের মালিক, তবুও স্ত্রী হল তার আভ্যন্তরিক মালকিন। সেই তার মালিকাহ’ (রাণী) এবং তা হল তার মামলাকাহ’ (রাজত্ব)।
পুরুষ ঘরে-বাইরে অবস্থান করে, কিন্তু নারী অবস্থান করে কেবল ঘরে। ঘরই তার প্রধান ঠিকানা। সেই ঘরেই তার জীবন-সংসার। সেই ঘরের সেই হিফাযত করে। বাইরের কোন কাজে যুক্ত হলেও ঘর-সংসারই তার মৌলিক কাজ। সেখানেই সে নিরাপদ থাকে, সেখানেই সে শান্তি ও স্বস্তি লাভ করে। সেখানেই সে দৈহিক ও মানসিক নির্বিঘ্নতা অনুভব করে।
ঘর হল শান্তির স্থল। পুরুষের জন্য (দ্বীনদার) স্ত্রীও হল শান্তির আধার। মহান আল্লাহ বলেছেন,
{وَاللّهُ جَعَلَ لَكُم مِّن بُيُوتِكُمْ سَكَنًا} (80) سورة النحل
“আল্লাহ তোমাদের গৃহকে করেছেন তোমাদের আবাস স্থল (শান্তির জায়গা)।” (নাহলঃ ৮০)।
{هُوَ الَّذِي خَلَقَكُم مِّن نَّفْسٍ وَاحِدَةٍ وَجَعَلَ مِنْهَا زَوْجَهَا لِيَسْكُنَ إِلَيْهَا} (189) سورة الأعراف
“তিনিই তোমাদেরকে এক ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তা থেকে তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন, যাতে সে তার নিকট শান্তি পায়।” (আ'রাফঃ ১৮৯)
{وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُم مَّوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ} (21) سورة الروم
“আর তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে আর একটি নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতেই তোমাদের সঙ্গিনীদেরকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা ওদের নিকট শান্তি পাও এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও মায়া-মমতা সৃষ্টি করেছেন। চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।” (রূমঃ ২১)।
ঘর হল আবাস ও শান্তির স্থল। সে ঘর হল স্ত্রীর। মহান আল্লাহ নবী এ ও মু'মিনগণকে সম্বোধন করে বলেছেন,
{يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَاء فَطَلِّقُوهُنَّ لِعِدَّتِهِنَّ وَأَحْصُوا الْعِدَّةَ وَاتَّقُوا اللَّهَ رَبَّكُمْ لَا تُخْرِجُوهُنَّ مِن بُيُوتِهِنَّ وَلَا يَخْرُجْنَ إِلَّا أَن يَأْتِينَ بِفَاحِشَةٍ مُّبَيِّنَةٍ وَتِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ وَمَن يَتَعَدَّ حُدُودَ اللَّهِ فَقَدْ ظَلَمَ نَفْسَهُ لَا تَدْرِي لَعَلَّ اللَّهَ يُحْدِثُ بَعْدَ ذَلِكَ أَمْرًا} (1) سورة الطلاق
“হে নবী! (তোমার উম্মতকে বল,) তোমরা যখন তোমাদের স্ত্রীদেরকে তালাক দিতে ইচ্ছা কর, তখন তাদেরকে তালাক দিয়ো ইদ্দতের প্রতি লক্ষ্য রেখে, ইদ্দতের হিসাব রেখো এবং তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করো, তোমরা তাদেরকে তাদের গৃহ হতে বহিষ্কার করো না এবং তারা নিজেও যেন বের না হয়; যদি না তারা লিপ্ত হয় স্পষ্ট অশ্লীলতায়। এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা। আর যে আল্লাহর সীমা লংঘন করে, সে নিজের উপরই অত্যাচার করে। তুমি জান না, হয়তো আল্লাহ এর পর কোন উপায় করে দেবেন।” (ত্বালাক্বঃ ১)
হ্যা, কলহের সময়ও তারই গৃহ। স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্য যখন বিচ্ছেদের কাছাকাছি নিয়ে যায়, তখনও আল্লাহ বলেছেন, 'তোমরা তাদেরকে তাদের গৃহ হতে বহিষ্কার করো না!
সুতরাং পুরুষের অধিকার নেই যে, সে সেই চরম মুহূর্তেও স্ত্রীকে তার ঘর থেকে বের করে দেবে। উচিত নয় তাকে কথায় কথায় ঘর থেকে বেরিয়ে যা বলে অসম্মান করা। অথবা তার অধিকারভুক্ত ঘর নয় বলে তাকে সেই অনুভূতি দিয়ে ছোট করা। যেহেতু মহান প্রতিপালক তাকে আভ্যন্তরিকভাবে বৈবাহিকসূত্রে তাকে সেই ঘরের মালকিন বানিয়েছেন। সুতরাং যতক্ষণ না বন্ধন পুর্ণরূপে ছিন্ন হয়েছে, ততক্ষণ তাকে তার ঘরের অধিকার দিতে হবে। আর স্ত্রীরও উচিত নয়, কথায় কথায় ঘর থেকে চলে যাব, মায়ের ঘর চলে যাব’ ইত্যাদি বলে স্বামীকে হুমকি দেওয়া এবং নিজের ঘর ছেড়ে বাইরে কোথাও চলে যাওয়া। এমনকি এক বা দুই তালাক হয়ে গেলেও সামান বেঁধে ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়া তার জন্য উচিত নয়। ইসলাম নারীকে সম্মান দিয়েছে, নারীর উচিত নয়, তার নিজ গৃহ ছেড়ে নিজেকে তথা স্বামীকে অপমান করা।
অবশ্য একটি আয়াতে মহান আল্লাহ ঘরের কথা উল্লেখ করেছেন, কিন্তু তার সম্পর্ক স্ত্রীর সাথে যুক্ত করেননি। তিনি বলেছেন,
{وَاللاَّتِي يَأْتِينَ الْفَاحِشَةَ مِن نِّسَآئِكُمْ فَاسْتَشْهِدُواْ عَلَيْهِنَّ أَرْبَعةً مِّنكُمْ فَإِن شَهِدُواْ فَأَمْسِكُوهُنَّ فِي الْبُيُوتِ حَتَّىَ يَتَوَفَّاهُنَّ الْمَوْتُ أَوْ يَجْعَلَ اللّهُ لَهُنَّ سَبِيلاً } (15) سورة النساء
“তোমাদের নারীদের মধ্যে যারা ব্যভিচার করে, তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের মধ্য হতে চার জন সাক্ষী উপস্থিত কর। সুতরাং যদি তারা সাক্ষ্য দেয়, তাহলে তাদেরকে গৃহবন্দী করে রাখ, যে পর্যন্ত না তাদের মৃত্যু হয় অথবা আল্লাহ তাদের জন্য অন্য কোন ব্যবস্থা করেন।” (নিসা : ১৫)
হ্যা, যখন সে অশ্লীলতা ও ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, তখন তার অধিকার হারিয়ে যায়। তখন তার সেই আল্লাহর দেওয়া সম্মান প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। যার ফলে উক্ত আয়াতে 'তাদেরকে তাদের গৃহে বন্দী করে রাখ’ বলা হয়নি। কারণ সে নিজের অধিকার নিজের কর্মদোষে হারিয়ে ফেলে।
স্ত্রী তালাক হয়ে গেলে স্বামীর ঘর ভেঙ্গে যায়। বেদুঈনের তাবুর ঘরও ভেঙ্গে যায়। কিন্তু বোরকা-ওয়ালী মেয়েকে কি তাবু বলা যায়? জীবন্ত বা জ্যান্ত তাবু বলে উপহাস করা যায়?
যারা বোরকা-পরিহিতা মহিলাদের নানা উপমা দিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে হাতি, ভূত, জীবন্ত তাবু’ ইত্যাদি বলে থাকে, তাদের বিকৃত মস্তিষ্কপ্রসূত ইসলাম-বিরোধী কুরুচিকর উপমা উল্লেখ করে তারা নারীর সম্ভ্রম ও পর্দার প্রতি আঘাত হানতে চায়।
অবশ্য কেউ বলতে পারে, মুখঢাকা বোরকা হল তাবু, মুখখোলা নয়। কিন্তু মুখখোলা পর্দা অনেকের নিকট বৈধ হলেও, সঠিক মতে এবং বিশেষ করে ফিতনার আশস্কাস্থলে মুখঢাকা পর্দাই হল আসল ও পরিপূর্ণ পর্দা। আর তা নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা কোন মুসলিমের জন্য বৈধ নয়।

-Shaykh Abdul Hamid Al-Faizi Al-Madani Hafizahullah

No comments:

Post a Comment

Download AsPDF

Print Friendly and PDFPrint Friendly and PDFPrint Friendly and PDF
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...